০৫.
গেটের বাইরে মোতায়েন থাকা দুজন গার্ড এতটুকুও বিচলিত হল না। ওরা জানে, অথরাইজড স্মার্ট কার্ড ছাড়া মেন গেট খুলবে না।
জিশানরা বাইরে এসে দাঁড়ানোর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই একটা অদ্ভুত ধাঁচের গাড়ি ওদের কাছে এসে থামল। গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দটা মউমাছির গুঞ্জনের মতো শোনাল।
জিশান গাড়িটাকে ভালো করে দেখল। মেন গেটের জোরালো বাতির রোশনাই গাড়িটার স্টেইনলেস স্টিল বডিতে পড়ে ঠিকরে যাচ্ছে। গাড়ির বনেটের ওপরে গাঢ় নীল রঙে সিন্ডিকেটের লোগো আঁকা।
গাড়িটার আকৃতি অনেকটা কম্পিউটারের মাউসের মতো। তবে সামনের দিকটা ছুঁচলো। গতিবেগ বাড়ানোর জন্য আধুনিক এরোডায়ানামিক ডিজাইনের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। গাড়ির দুপাশে হাঙরের কানকোর মতো ভেন্টিলেটর। আর ছাদের দুপাশে দুটো খাটো অ্যানটেনা লাগানো।
হঠাৎই গাড়িটার চারটে দরজা পাখির ডানার মতো খুলে গেল—উঠে গেল ওপরের দিকে। একজন গার্ডের নির্দেশে ওরা বসে পড়ল গাড়িতে।
এরকম গাড়ি নিউ সিটির রাস্তায় আগেও দেখেছে জিশান। তবে কখনও তার দরজা খুলতে দেখেনি। এ-গাড়ির নাম কেন কিউ-মোবাইল সেটা ওর মাথায় ঢুকল না।
গাড়ির পাইলট কী একটা বোতাম টিপতেই চারটে দরজা নেমে এল। ‘ক্লিক’ শব্দ করে লক হয়ে গেল। এবং কিউ-মোবাইল চলতে শুরু করল।
জিশান আর ফকিরচাঁদ পিছনের সিটে বসেছিল। আর গার্ড দুজন বসেছিল পাইলটের পাশে। গাড়ি চলা শুরু করতেই একজন গার্ড পাইলটকে বলল, ‘আমরা নেকরোসিটি যাব…।’
‘ও. কে.।’ মাথা নেড়ে বলল পাইলট। একইসঙ্গে ড্যাশবোর্ডের টাচস্ক্রিনের কয়েকটা উজ্জ্বল আইকনে আঙুল ছোঁয়াল।
কিউ-মোবাইল যে সঙ্গে-সঙ্গে একটা বাঁক নিল সেটা বেশ টের পেল জিশান। ও গাড়ির জানলার কাচ ভেদ করে বাইরে তাকাল।
সুন্দর মসৃণ রাস্তা। কোথাও কোনও খানাখন্দ নেই। যেন একটা ইস্পাতের কালো ফিতে সামনে বিছানো রয়েছে।
ওল্ড সিটি ওরফে ডেড সিটির কথা মনে পড়ল জিশানের। সেখানকার সব পথঘাটই ভাঙাচোরা গর্তে ভরা। অথবা বলা যায় পুরোটাই খানাখন্দ—তার মধ্যে কোথাও-কোথাও রাস্তা। জিশান স্বপ্ন দ্যাখে সেই গুটিবসন্তে ভরা রাস্তা একদিন ঝকঝকে মোলায়েম হবে। তার ওপর দিয়ে এতটুকুও শব্দ না করে ছুটে যাবে শানুর ঝকঝকে গাড়ি।
বিষণ্ণ হাসল জিশান। স্বপ্ন দেখার অসুখ ওর এখনও গেল না! কিন্তু যাবেই বা কেন? দু:খ কষ্ট আছে বলে কি স্বপ্ন থাকবে না?
হঠাৎই ফকিরচাঁদ ওর হাত চেপে ধরাতে জিশানের চটকা ভাঙল।
‘নেকরোসিটিতে আমি যাব না, জিশানভাইয়া।’
মুখ ফেরাল জিশান। দেখল, ফকিরের চোখে জল।
‘কেন, যাবে না কেন?’
‘আমার ভাইয়ের ওই হেনস্থা সহ্য করা যায় না। ও:…।’
জিশান কিছু একটা জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সামনের সিট থেকে একজন গার্ড বলে উঠল, ‘আমরা নেকরোসিটিতে এসে গেছি—।’
প্রায় একইসঙ্গে কিউ-মোবাইল থেমে গেল। উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে সামনে তাকাল জিশান। এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে ওর চোখ আটকে গেল।
সামনেই গোটা পথ জুড়ে এক বিশাল তোরণ। তার চেহারা ওলটানো ‘W’ অক্ষরের মতো। তোরণের সর্বত্র নীল রঙের আলোকসজ্জা। আর মাথার ওপরে নীল রঙের নিওন সাইনে বড়-বড় করে লেখা ‘ওয়েলকাম টু নেকরোসিটি’। তার ঠিক নীচে ছোট হরফে লেখা আছে : ‘নো এন্ট্রি উইদাউট ভ্যালিড অথরাইজেশান।’
রাস্তাটা তোরণ পেরিয়ে সোজা চলে গেছে। তবে তোরণ পেরোনোমাত্রই রাস্তার দুপাশের আলোর রং সাদার বদলে নীল হয়ে গেছে। এবং সামনে যতদূর চোখ যায়, যতগুলো আলোর বিন্দু চোখে পড়ছে, সবগুলোর রংই নীল।
নীলনগরী। মনে-মনে ভাবল জিশান। মৃত্যুর প্রতীকী রং নীল—হয়তো সেইজন্যেই নেকরোসিটি নীল আলোয় সাজানো।
একজন গার্ডের নির্দেশে পাইলট কিউ-মোবাইলের দরজা খুলল। দরজা খুলতেই একজন গার্ড নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। জিশানদের লক্ষ করে বলল, ‘তোমরা গাড়িতেই বোসো। আমি সিকিওরিটি গার্ডদের সঙ্গে কথা বলে কার্ড টেনে আসছি—।’
জিশান দেখল, তোরণের একপাশে একটা ছোট মাপের ঘর—সিকিওরিটি চেকপোস্ট। গার্ড সেদিকেই এগিয়ে গেল।
একটু পরেই গার্ড ফিরে এল গাড়িতে। আবার চলতে শুরু করল কিউ-মোবাইল। এবং কয়েকমিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেল আসল জায়গায়।
কিউ-মোবাইলের দরজা খুলে গেল। গার্ডদের নির্দেশে জিশান আর ফকির নেমে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে নাম-না-জানা কোনও ফুলের এক মনোরম সুগন্ধ জিশানের মন-প্রাণ ভরিয়ে দিল। আর চোখের সামনে যে-দৃশ্য ও দেখল, সেটাও চোখ জুড়িয়ে দেওয়ার মতো।
ফকিরচাঁদ জিশানের বাহু আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। তবে অবাক চোখ মেলে দৃশ্যটা দেখতে লাগল। বোঝা গেল, এ-দৃশ্য আগে ও দেখেনি।
জিশানের সামনে এক অন্ধকার বিস্তীর্ণ প্রান্তর। সেই অন্ধকারে হাজার-হাজার মোমবাতি উজ্জ্বল নীল শিখায় জ্বলছে। মোমবাতির মায়াময় নীল আলো আর সুগন্ধী বাতাস জিশানকে মুগ্ধ করে দিল, স্তব্ধ করে দিল।
একজন প্রহরী জিশানের হাত ধরে টান মারল। বলল, ‘চলো, ভেতরে চলো—নেকরোসিটি দেখে তোমার দশহাজার টাকা উশুল করো…।’
ওরা চারজন আলোকমালার দিকে এগিয়ে চলল। জিশান তখনও বুঝতে পারছিল না ফকিরচাঁদ কেন অকারণে কাঁদছে।
বেঁটে গার্ডটি অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিল—বোধহয় কিছু বলতে চাইছিল। ও ওর সঙ্গীর সঙ্গে চাপা গলায় কিছু পরামর্শ করে তারপর হঠাৎই বলল, ‘এখানে চ্যালেঞ্জ গেম খেলতে এসে যে ক’জন পার্টিসিপ্যান্ট মারা গেছে তাদের মাথাপিছু একটা করে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে।’
জিশান একটা ধাক্কা খেল। এত মোমবাতি! এত পার্টিসিপ্যান্ট মারা গেছে এখানে! ভাবা যায় না।
চারপাশে দেখল গার্ডটি। তারপর পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল। চাপা হেসে বলল, ‘উফ, ”নো স্মোকিং” নিয়মের ঠেলায় দম আটকে মারা যাওয়ার জোগাড়। সিগারেট খাওয়া বারণ তো সিগারেট বিক্রি বন্ধ করে দে। তা না, ওদিক থেকেও ট্যাক্সের পয়সা লুটবে আর আমাদেরও নেশায় বাঁশ দেবে। ওই শ্রীধর পাট্টা—সালা শুয়োরের বাচ্চা—যত নষ্টের গোড়া…।’
জিশান তাজ্জব হয়ে গেল। এসব কী শুনছে ও! শ্রীধর পাট্টার নামে এই বেপরোয়া গালাগাল! নেশার ঘোরে আসল কথাগুলো কি বেরিয়ে আসছে?
গার্ডটির লম্বা সঙ্গী প্রায় ছুটে গিয়ে ওর মুখে হাত চাপা দিল: ‘এসব কী বলছিস তুই! চুপ—চুপ! কেউ শুনতে পেলেই কেলেঙ্কারি হবে। তুই—।’
এক ঝটকায় সঙ্গীর হাত সরিয়ে দিয়ে বেঁটে গার্ডটি বলল, ‘ছাড় তো! সালা কেলেঙ্কারির নিকুচি করেছে। এরা হাজার-হাজার লোককে কোতল করে মোমবাতি জ্বেলে দিল তাতে কিছু না—আর আমি দুটো সত্যি কথা বললেই দোষ!’
চৌকশ কেতায় প্যাকেটে সিগারেটটা কয়েকবার ঠুকে ঠোঁটে ঝোলাল গার্ড। ছোট্ট ইলেকট্রিক লাইটার বের করে সিগারেট ধরাল। তারপর প্যাকেটটা সামনে বাড়িয়ে জিগ্যেস করল, ‘আর কেউ ধরাবে?’
ফকিরচাঁদ মাথা নাড়ল : ‘না।’
দ্বিতীয় গার্ড কিছু বলল না।
জিশান বলল, ‘না। ধন্যবাদ। তবে…’ একটু ভেবে আরও যোগ করল: ‘এখানে… মানে, এই কবরস্থানে…সিগারেট খাওয়াটা ঠিক নয়…।’
এ-কথা শুনে প্রথম গার্ডের কী হাসি! হাসতে-হাসতে পেটে হাত চেপে ঝুঁকে পড়ল ও। হাসতেই লাগল।
সঙ্গীর এই পাগলামি দেখে দ্বিতীয় ভয়ে-ভয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। পিস ফোর্সের কেউ এসব কথা শুনছে না তো—এসব কাণ্ড দেখে ফেলছে না তো!
হাসির দমক থামিয়ে জ্বলন্ত সিগারেটে কষে টান দিল প্রথম। জিশানের গায়ে তাচ্ছিল্যের ঠেলা মেরে বলল, ‘কে বলেছে এটা কবরস্থান? কে বলেছে ওইসব মোমবাতির নীচে ডেডবডি আছে? সব ঢপের কেত্তন। ওগুলো সব ফলস। আসল ডেডবডি আছে এই নকল লোকদেখানো কবরস্থানের পেছনে। সেখানে একটা ডেডবডির ডোবা আছে। জল-টল কিছু নেই—শুধু পচা-গলা ডেডবডি। সেগুলো ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে হায়েনা, শেয়াল, নেকড়ে আর শকুন।’
ফকিরচাঁদ ডুকরে কেঁদে উঠল। জিশানের একটা হাত আঁকড়ে ধরল। ওর দেহটা ফুলে-ফুলে উঠতে লাগল।
প্রথম তখন সিগারেটে ঘন-ঘন টান দিচ্ছে। মাথা নাড়তে-নাড়তে ও বলল, ‘চাকরির সারাক্ষণই তো শ্রীধর পাট্টার ভয়ে চুপ করে থাকি। কত আর চুপ করে থাকব?’ জিশানের বুকে আঙুল ঠুকে বলল, ‘তোমার কাছ থেকে যখন ঘুষ কবুল করেছি তখন তার এক্সচেঞ্জে সার্ভিস দেব, নেকরোসিটির সব কেলো ফাঁস করব…।’
সারি-সারি মোমবাতির মাঝখান দিয়ে সরু হাঁটা পথ। জিশান আর ফকিরকে মাঝখানে রেখে নিয়ে গার্ড দুজন হেঁটে চলল। জিশান অবাক হয়ে মোমবাতির নীল শিখাগুলো দেখছিল। এই বিচিত্র মোমবাতি এরা পেল কোথায়? সে-কথাই ও জিগ্যেস করল প্রথমকে।
সিগারেটে জোরে টান দিয়ে প্রথম বলল, ‘কোথায় আর পাবে! হয় বিদেশ থেকে আনিয়েছে, নয়তো এই নিউ সিটিতেই তৈরি করেছে।’ সিগারেটটা ছোট হয়ে এসেছিল। সেটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে গার্ড বলল, ‘এই যে নাকে মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছ এটা মেশিনে তৈরি। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা স্প্রেয়ারের নল থেকে স্প্রে করা হচ্ছে। বাইরে থেকে যখন নামিদামি লোকজন নিউ সিটি ভিজিট করতে আসে তখন এইসব ব্যবস্থা দেখে ওদের মাথা ঘুরে যায়। ভাবে, মারা যাওয়া মানুষগুলোর জন্যে সরকারের কত না দরদ, কত না শ্রদ্ধা। হুঁ:! আসল কাণ্ড তো আছে পেছনদিকটায়। বাইরের কাউকে ওদিকটায় নিয়ে যাওয়া বারণ। তুমি টাকা দেবে বলেছ, তাই তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি…।’
কবরস্তানের নানান জায়গায় বড়-বড় গাছ লাগানো। আবছা আলোয় সেই অন্ধকার গাছগুলোকে অপার্থিব দানব মনে হচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে জোনাকির ঝাঁক দেখতে পেল জিশান। চলে বেড়ানো নীল আলোর ফুটকি।
ফকিরচাঁদ জিশানের পাশে-পাশে হাঁটছিল। ওর গা থেকে ঘামের গন্ধ পাচ্ছিল জিশান। সেইসঙ্গে শোকের গন্ধও।
প্রথমের কথার খেই ধরে দ্বিতীয় গার্ড জিশানকে বলল, ‘তোমার হয়তো মনে হচ্ছে…আমরা তোমার কাছ থেকে ঘুষ নিচ্ছি…আমরা দুজন ঘুষখোর। আসলে ব্যাপার কী জানো…’ অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল দ্বিতীয়: ‘এই নিউ সিটিতে ওপরমহলেই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি। ওই শ্রীধর পাট্টা…আমাদের মার্শাল…ওটাই সবচেয়ে বড় হারামজাদা। নেকরোসিটির আইডিয়াটা ওরই। রেগুলার এত লোক গেম সিটিতে এসে মারা যাচ্ছে…এত ডেডবডির গতি হবে কী করে! কে রোজ এত ডেডবডি কবর দেবে? কে-ই বা দাহ করবে? তার চেয়ে অনেক ভালো…।’
দ্বিতীয় গার্ডের কথা শেষ হল না—ওদের কানে এল হিংস্র গর্জন।
জিশানের খেয়াল ছিল না, কথায়-কথায় ওরা কখন যেন মোমবাতির মিছিল পেরিয়ে গেছে। এখন ওরা এসে পড়েছে এক গাঢ় অন্ধকার এলাকায়।
প্রথমজন একটা টর্চ বের করে আলো জ্বালল। সেই আলোয় পথ দেখে-দেখে ওরা এগোতে লাগল।
হঠাৎই অন্ধকার ফুঁড়ে দুজন গার্ড আচমকা ওদের সামনে হাজির হল। ওদের হাতে বাগিয়ে ধরা অদ্ভুত ধরনের খাটো পিস্তল। ওদের একজন কর্কশ গলায় জানতে চাইল, ‘এখানে এসেছ কেন বলো। অথরাইজেশান দেখানোর জন্যে সময় দিলাম দশসেকেন্ড…।’
জিশানদের সঙ্গী দ্বিতীয় গার্ড চটপট স্মার্ট কার্ড বের করে দেখাল। বলল, ‘স্পেশাল পারমিশান আছে…।’
দুটো পিস্তলই খাপে ঢুকে গেল। গার্ড দুজন জিশানদের সঙ্গে এগোল।
হিংস্র গর্জন আরও জোরালোভাবে শোনা যাচ্ছিল। সেইসঙ্গে একটা বিকট পচা গন্ধ এসে ওদের নাকে ঝাপটা মারল। ফকিরচাঁদ শিউরে উঠে ‘ওয়াক’ শব্দ তুলল। জিশান নাক টিপে দম বন্ধ করে গন্ধটা সামাল দিতে চাইল।
আর কয়েক পা এগোতেই ওরা দেখল সামনে একটা লোহার জালের বেড়া। বেড়ার মাঝে একটা ইস্পাতের দরজা।
জিশানদের পাহারাদার গার্ড দুজনের একজন একটা রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট বের করে বোতাম টিপল।
ইস্পাতের দরজায় দুটো সবুজ আলো জ্বলে উঠল এবং দরজা খুলে গেল।
রিমোট ইউনিটটা পকেটে রেখে গার্ড বলল, ‘ভেতরে ঢুকে পাঁচটা স্টেপের বেশি এগোবে না। তখনই আমরা আলো জ্বেলে দেব—।’
জিশানরা এগোল।
ফকিরচাঁদ ভাঙা গলায় জিশানকে বলল, ‘জিশানভাইয়া, এবার আমি চিনতে পেরেছি। আমাকে ওরা চোখ বেঁধে এখানেই নিয়ে এসেছিল। দুজন ডেডবডি হ্যান্ডলার আমিরচাঁদের বডিটা খুঁজে বের করে দিয়েছিল। সেটার যা অবস্থা দেখেছি…’ ফুঁপিয়ে উঠল ফকিরচাঁদ: ‘বাঁ-কানের একটা দুল দেখে ওকে চিনতে পেরেছিলাম। ওর নাক-চোখ কিছু ছিল না…সব খোবলানো। ফুলের তোড়াটা আমি ছুড়ে দিয়েছিলাম আমিরের দিকে…’ দু-হাতে চোখ মুছে ফকির বলল, ‘ও আটদিন আগে সাপের কামড়ে মারা গেছে। সে-দু:খ যা পেয়েছি, পেয়েছি। কিন্তু ওর ডেডবডিটার কথা মনে পড়লেই আমার সবসময় কান্না পায়, জিশানভাইয়া। নিজেকে আমি আর রুখতে পারি না।’
জিশানরা ইস্পাতের দরজা পেরোনোর সময় ফকিরচাঁদ দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘আমি এখানেই থাকব—ভেতরে আর যাব না।’
জিশান ওর করুণ মুখের দিকে একবার দেখল শুধু—কিছু বলল না। তারপর সামনে এগোল। কারণ, যতই বীভৎস দৃশ্য সামনে থাক জিশানকে দেখতেই হবে। যতই কটু দুর্গন্ধ ওর নাকে এসে ঝাপটা মারুক ওকে সেটা উপেক্ষা করতেই হবে। জিশান যদি স্নেক লেক, পিট ফাইট কিংবা কিল গেম-এ হেরে যায়, মারা যায়, তা হলে ওর যেখানে ঠাঁই হবে সেই জায়গাটা জিশান দেখতে চায়, অনুভব করতে চায়।
গেস্টহাউস থেকে আসা গার্ড দুজনও ইস্পাতের দরজা পেরিয়ে আর এগোল না। নাকে-মুখে হাত চাপা দিয়ে জিশানকে ইশারা করল এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
জিশান কাঁধ ঝাঁকিয়ে পা বাড়াল সামনে। চার পা এগিয়েই ও থমকে দাঁড়াল। আর ঠিক তখনই ওর সামনের জায়গাটা আলোর বন্যায় ভেসে গেল। উজ্জ্বল আলোয় জিশানের চোখ ধাঁধিয়ে গেল।
সামনে যে-দৃশ্য ও দেখল তাকে এককথায় মর্মান্তিক ছাড়া আর কী বলা যায় জিশান জানে না।
একটা বিশাল পুকুরের কিনারায় জিশান দাঁড়িয়ে রয়েছে। পুকুরটার পাড় কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো। পুকুরে জল নেই। শুধু নগ্ন মানুষের মৃতদেহে পুকুরের অর্ধেকটা ভরতি। সেইসব মৃতদেহের বেশিরভাগই পচা-গলা। টুকরো-টুকরো হাত-পা, কিংবা মাথা এখানে-সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে। তার ওপরে ঘুরে বেড়াচ্ছে নেকড়ে, হায়েনা, শেয়ালের দল। নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করছে। কখনও-কখনও হিংস্র গর্জন করে উঠছে। চোয়ালে চোয়াল ঠোকার ‘খটাস’ শব্দ হচ্ছে। এ ছাড়া শকুনের পাল জটলা করে আছে নানান জায়গায়।
ওরা সবাই মিলে নরমাংস নিয়ে মহোৎসবে মেতে আছে।
চড়া আলোয় ঝকঝকে নোংরা দৃশ্যটা জিশানকে কাঁপিয়ে দিল। ও দেখল, পুকুরের ওপাশটায় গভীর জঙ্গল শুরু হয়েছে। ক্ষুধার্ত বন্যপ্রাণীগুলো সেই জঙ্গল থেকে আসা-যাওয়া করছে। ওরা জানে, এই পুকুরে নিয়মিত মহাভোজের ব্যবস্থা রাখা আছে ওদের জন্য।
জিশান নাক-মুখ চেপে অনেকক্ষণ ধরে দৃশ্যটা সহ্য করছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত আর পারল না। সাদা ফুলের তোড়াটা ওর হাত থেকে খসে পড়ে গেল। কয়েকবার ‘ওয়াক’ তুলে ও হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল কংক্রিটের মেঝেতে। দু-হাতে ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ল। প্রবল হেঁচকি তুলে বিকট শব্দে বমি করতে শুরু করল। সেই শব্দগুলো জিশানের কানে জন্তুর ডাকের মতো শোনাল।
জিশানের মনে হল, এই জঘন্য ভয়ংকর জায়গায় কিছুতেই ও আসতে চায় না। মৃতদেহ হিসেবেও নয়।
সুতরাং এখানে না আসার জন্য ওকে দাঁত-নখ দিয়ে ভয়ংকর লড়াই করতে হবে।
বমির দমক শেষ হলে কয়েকবার থুতু ফেলল জিশান। মুখের ভেতরটা টক হয়ে গেছে। কিছুটা তেতোও। শ্রীধর পাট্টার কথা মনে পড়ল ওর। সুট-বুট পরা কেউটে সাপ। এখানে হাজির থাকলে নিশ্চয়ই ছড়া কেটে বলতেন, ‘এই যে বাবু জিশান। এই হল আমাদের শ্মশান।’
ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল জিশান। চারপাশের কটু গন্ধটা এতক্ষণে নাকে অনেকটা সয়ে এসেছে। যা দেখার ছিল তা দেখা হয়ে গেছে। এবার ফিরতে হবে। তারপর… ক’দিন পর…স্নেক লেক।
জিশানের ভেতরে হঠাৎই যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। এই গেমটায় ও কোয়ালিফাই করবেই। করতে ওকে হবেই।
ও টের পেল, স্নেক লেক গেমটার মোকাবিলার জন্য ও কোন ম্যাজিকে যেন চনমনে হয়ে উঠল।
•
নিয়মমাফিক পার্টিসিপ্যান্টদের স্নেক লেক গেম-এর কম্পিউটার সিমুলেশান দেখানো হল।
কমব্যাট পার্কের মতো এখানেও গেম সাইটের কাছাকাছি গেম কন্ট্রোল রুম বিল্ডিং। সেই বিল্ডিং-এর এয়ারকন্ডিশনড হলে বসে জিশানরা স্নেক লেক গেম-এর সিমুলেশান দেখল।
অগভীর জলের বিস্তীর্ণ আয়তাকার পুকুর। মাপ একশো মিটার বাই তিরিশ মিটার। সেই পুকুরে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে ছোট-বড় নানান বিষধর সাপ। সাপগুলো ঠিক কী-কী ধরনের সেগুলো ছবিসমেত বোঝানো হচ্ছিল। সাপগুলোর চলাফেরা, আচরণ, শিকার ধরা বিশদভাবে বোঝানো হচ্ছিল। তিনজন সাপবিশেষজ্ঞ পালা করে সবকিছু ব্যাখ্যা করছিলেন। সাপগুলোর বিষগ্রন্থি, তাদের বিষদাঁতের মাপ ও আকার, বিষের তেজ, ছোবল মারার বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি অত্যন্ত যত্ন আর নিষ্ঠা নিয়ে বোঝাচ্ছিলেন তাঁরা। এবং তারই মাঝে-মাঝে জাম্প কাট করে গেম-এর সিমুলেশানটা দেখানো হচ্ছিল।
জিশানের মনে হল, সাপ নিয়ে কোনও তথ্যচিত্র দেখেও বোধহয় ব্যাপারটা এত ভালো করে বোঝা যেত না।
বিষধর সাপের তালিকায় সাতরকমের সামুদ্রিক সাপের নাম ও ছবি দেখানো হল। সাঁতার কাটার সুবিধের জন্য প্রকৃতি ওদের লেজের দিকটা আচমকা চ্যাপটা করে দিয়েছে—অনেকটা মাছের লেজের মতো। একইসঙ্গে জিশানদের জানানো হল, প্রায় সব সামুদ্রিক সাপই মারাত্মকরকম বিষধর।
সিমুলেশান শেষ হওয়ার পর মিনিটপাঁচেক ধরে চলল প্রশ্নোত্তরের পালা। জানানো হল যে, এই গেম-এর সারভাইভাল ফ্যাক্টর 0.36।
সবশেষে গেম ইনস্ট্রাকটর ঘোষণা করলেন, এই খেলায় প্রাইজ মানি চল্লিশহাজার টাকা।
জিশান ভাবছিল, এরপর বোধহয় ওদের বিল্ডিং-এর বাইরে বেরোতে হবে। সার বেঁধে হাঁটা দিতে হবে স্নেক লেকের দিকে। কিন্তু অডিয়ো সিস্টেমে শোনা গেল একটি বিশেষ ঘোষণা ঃ ‘পার্টিসিপ্যান্টদের এবারে ”ভেনম হাউস” দেখানো হবে। যেহেতু আসল গেম-এর সময় সাপগুলো থাকবে ঘোলাজলের আড়ালে, সেহেতু পার্টিসিপ্যান্টরা সাপগুলোকে দেখতে পাবে না। তাই ”ভেনম হাউস”-এ সেই প্রজাতির সাপগুলো কাচের বাক্সে রাখা আছে—যাতে খেলায় নামার আগে তারা সাপগুলোকে ভালো করে দেখে নিতে পারে। ”ভেনম হাউস” রয়েছে এই বিল্ডিং-এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে…নর্থ-ইস্ট কর্নারে।
‘নাউ স্টার্ট। হলের দরজায় ”ভেনম হাউস”-এর গাইড আপনাদের জন্যে ওয়েট করছে। ”ভেনম হাউস” দেখার জন্যে আপনাদের সময় দেওয়া হল তিরিশমিনিট। তার মানে, কাঁটায়-কাঁটায় এগারোটায় আমরা এই গেম কন্ট্রোল বিল্ডিং-এর মেন গেটে জড়ো হব। তারপর স্টার্ট দেব স্নেক লেকের দিকে। ও. কে., প্রসিড গাইজ…।’
জিশানরা সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। হলের দরজার দিকে এগোল।
সেখানে একজন গাইড আর পিস ফোর্সের দুজন গার্ড ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। গাইডের গায়ে নীল রঙের স্লিভলেস জ্যাকেট। জ্যাকেটের বুকের দিকটায় প্যাঁচানো একটা সাপের ছবি—ফণা তুলে আছে। আর জ্যাকেটের পিঠের দিকে সাদা ইংরেজি হরফে লেখা ‘ভেনম হাউস’।
গাইডকে অনুসরণ করে জিশানরা সার বেঁধে এগোল। চোরা-দৃষ্টিতে সারির সামনে-পিছনে তাকিয়ে প্রতিযোগীর সংখ্যাটা গুনে নিল জিশান। মোট ষোলোজন। তার মধ্যে মনোহর সিং-ও আছে।
প্রায় পনেরো সেকেন্ড হেঁটে কয়েকটা করিডর বদল করে ওরা ‘ভেনম হাউস’-এ পৌঁছে গেল।
সহজ কথায় বলতে গেলে ব্যাপারটা সাপের চিড়িয়াখানা। আধুনিক ছাঁদে সাজানো বিশাল মাপের ঘর। ঘরের চারদেওয়ালে নানান মাপের কাচের বাক্স। নেমপ্লেট লাগানো সেইসব বাক্সে রাখা আছে জীবন্ত সাপ। যে-সাপগুলো একটু আগেই জিশানরা তথ্যচিত্রে দেখে এসেছে।
কী সাপ নেই এখানে! কেউটে, গোখরো, চন্দ্রবোড়া, শাখামুটি থেকে শুরু করে ব্ল্যাক মাম্বা, ঝুমঝুমি সাপ পর্যন্ত সবই হাজির।
এই সাপগুলোর পাশেই সার বেঁধে রাখা আছে অ্যাকোয়ারিয়াম। তার মধ্যে রয়েছে সমুদ্রের সাপ। একটা সাপের নাম পড়ল জিশান—অলিভ সি স্নেক। সেই নামের পাশে ব্র্যাকেটে লেখা Alpysurus laevis।
জিশানের গা-টা কেমন শিউরে উঠল। মনে হল, সাপগুলো ওর পোশাকের নীচে কিলবিল করছে।
গাইড তখন মেগাফোনে ভরাট গলায় বলছে, ‘…এই সাপগুলোই থাকবে ওই লেকের জলের ভেতরে। আপনারা ভালো করে দেখে নিন কী-কী ধরনের সাপের কামড় আপনাদের বাঁচিয়ে চলতে হবে। অবশ্য রেসের ফিনিশ লাইনের পর এক্সপার্ট মেডিক্যাল ইউনিট হাজির থাকবে। ওরা সাপের কামড় খাওয়া পার্টিসিপ্যান্টদের দেখভাল করবে।’
কাচের বাক্সের ভেতরে সাপগুলো অলসভাবে নড়াচড়া করছিল। আর কতকগুলো সাপ অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে সাঁতার কাটছিল। ওদের আকর্ষণীয় রং মুগ্ধ হয়ে দেখছিল জিশান। আর একইসঙ্গে ভাবছিল, ওই বিচিত্র রঙের আড়ালে রয়েছে মারাত্মক বিষ।
জিশান চোয়াল শক্ত করল। গত কয়েকদিন ধরে বালির ওপরে দৌড় আর জলের ওপরে দৌড় ও কম প্র্যাকটিস করেনি। আজ আসল পরীক্ষায় বোঝা যাবে ওর প্র্যাকটিস ঠিকমতো হয়েছে কি না।
‘ভেনম হাউস’ দেখা শেষ করে এগারোটার দু-মিনিট আগেই গেম কন্ট্রোল বিল্ডিং-এর মেন গেটে ওরা সবাই এসে জড়ো হল। তারপর ঠিক এগারোটা পাঁচে সার বেঁধে হাঁটা দিল স্নেক লেক-এর দিকে। ওদের ষোলোজনকে আগলে নিয়ে চলল চারজন গার্ড। তার মধ্যে সেই বেঁটেমতন গার্ডটাকে দেখতে পেল জিশান। ওর হাতেই ও ঘুষের দশহাজার টাকা তুলে দিয়েছিল।
গার্ডটার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ও ছোট্ট করে হাসল। তারপর চোখের ইশারায় বলতে চাইল যে, পরে জিশানের সঙ্গে ও কথা বলবে।
আজ সকালে সূর্য নিয়মমতোই উঠেছে। সোনা রোদে ভরিয়ে দিয়েছে চারিদিক। গাছপালায় সারারাত ঘুমিয়ে থাকা পাখিরা ভোর হতেই বেরিয়ে পড়েছে খাবারের খোঁজে। সকালে ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেইসব পাখিদের দেখছিল জিশান। দেখতে-দেখতে মনখারাপ হয়ে যাচ্ছিল। পাখিরা কত স্বাধীন! ওদের কাছে ওল্ড সিটি আর নিউ সিটির মাঝে কোনও বাধা নেই। পাখি হলে ও এখুনি উড়ে চলে যেত মিনি আর শানুর কাছে। কে জানে, আজ রাতে ও মিনির সঙ্গে কথা বলতে পারবে কি না! স্নেক লেক গেম-এর সাপের ছোবল বাঁচিয়ে ও কি আজ গেস্টহাউসে ফিরতে পারবে?
মন-প্রাণ দিয়ে রোদের তাপ নিচ্ছিল জিশান। কে জানে, কাল যদি আর সূর্যের সঙ্গে ওর দেখা না হয়। সেইজন্যই হয়তো চারপাশের দৃশ্যটাকে ও ব্লটিং পেপারের মতো হৃদয়ে শুষে নিতে চাইছিল।
ওদের চলার পথের পাশ দিয়ে চলে গেছে মসৃণ রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে মাঝে-মাঝে ছুটে যাচ্ছে কিউ-মোবাইল আর গেমস মোবাইল। রাস্তার দুপাশে ফুলের বাগান, লন। এ ছাড়া কোথাও-কোথাও আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘ গাছের সারি। তাদের ফাঁকে-ফাঁকে ছবির মতো আঁকা নীল আকাশের টুকরো। দেখে বোঝাই যায় না, এসবের আড়ালে চলেছে প্রাণ নিয়ে খেলা।
কখন যে বেঁটেমতন গার্ডটি জিশানের পাশাপাশি এসে পড়েছে জিশান খেয়ালই করেনি।
জিশানের পাশে হাঁটতে-হাঁটতে নিচু গলায় জিগ্যেস করল, ‘কেমন আছ?’
জিশান সামনের দিকে চোখ রেখে পথ চলতে-চলতে ছোট্ট করে বলল, ‘ভালো।’
‘আমি জানতাম আজ তোমার স্নেক লেক আছে। আমাদের কোনও গেম-এ ডিউটি দেওয়ার সময় পার্টিসিপ্যান্টদের আই-ডি নাম্বারের লিস্ট দিয়ে দেয়। কবরস্তানে তোমাদের নিয়ে যাওয়ার পারমিশান করানোর সময় তোমার আই-ডি নাম্বার নিয়েছিলাম মনে আছে?’
জিশান মাথা নাড়ল : ‘হ্যাঁ, মনে আছে—।’
‘তোমার নাম্বারটায় লাস্টে পরপর তিনটে ফোর ছিল। সেটা দেখেই আইডিয়া করলাম তোমার আজ স্নেক লেক আছে…।’
জিশান কোনও কথা বলল না। চুপচাপ হাঁটতে লাগল।
‘তুমি লোক খারাপ না। একটা সামান্য কাজের জন্যে এককথায় দশহাজার টাকা দিয়ে দিয়েছ। তাতে আমাদের দুজনের খুব হেলপ হয়েছে। তাই তোমাকে হেলপ করা উচিত…।’
জিশান চমকে গার্ডের দিকে তাকাল। হেলপ করার ছুতোয় আবার টাকা চাইবে না কি?
গার্ডটা জিশানের মনের কথা আঁচ করতে পেরে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না, কোনও টাকাপয়সার ব্যাপার না। এমনি তোমাকে একটা স্পেশাল খবর জানাতে চাই…।’
‘কী?’
জিশানের সামনের আর পিছনের প্রতিযোগীর দিকে তাকাল গার্ড। জিশানের কাছ থেকে ওদের দূরত্ব প্রায় তিনফুট। সেটা চোখের নজরে মেপে নিয়ে জিশানের আরও কাছ ঘেঁষে এল। চাপা গলায় বলল, ‘লেকের জলে যে-সাপগুলো ছাড়া আছে সেগুলো সাধারণ সাপ না…।’
‘তার মানে?’
‘জানো তো, সাপ কখনও তেড়ে এসে কামড়ায় না। কেউ গায়ে পা দিলে, বা হঠাৎ কাছাকাছি চলে গেলে, ছোবল মারে। লেকের সাপগুলো সেরকম না। ওদের বডিতে একটা স্পেশাল ড্রাগ ইনজেক্ট করা আছে। সেজন্যে ওরা কিছু দেখতে পেলেই তেড়ে গিয়ে কামড়াবে। ওই ড্রাগের জন্যে ওরা ভীষণ হিংস্র হয়ে যায়…।’
সাপের সঙ্গে ‘হিংস্র’ শব্দটা যে কখনও জোট বাঁধতে পারে এটা জিশান স্বপ্নেও ভাবেনি। তা হলে লেকে দৌড়নোর সময় বিষধর সাপের কামড় খাওয়াটাই স্নেক লেক কমপিটিশানের প্রতিযোগীদের ভবিতব্য! তা হলে সারভাইভাল ফ্যাক্টর যে 0.36 বলা হয়েছে সেটাও আগাপাশতলা মিথ্যে! এই লোডেড গেম-এর লাইভ টেলিকাস্ট দেখবে নিউ সিটির বাসিন্দারা! দেখবে আর আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়বে!
গেম কন্ট্রোল বিল্ডিং-এ সিমুলেশান ইত্যাদি দেখানোর সময় সাপগুলোকে যে ড্রাগ ইনজেক্ট করা থাকবে এ-তথ্য জানানো হয়নি। এটা শোনার পর জিশান এত দমে গেল যে, ও ধরেই নিল, আজ রাতে মিনির সঙ্গে ওর আর কথা বলা হবে না।
ওর মুখে যে একটা বিষাদের পরদা নেমে এসেছে সেটা বোধহয় গার্ডের নজরে পড়ল। ও নিচু গলায় বলল, ‘তোমাকে একটা পাউচ দিচ্ছি—এটা লুকিয়ে রেখে দাও। প্যান্টের কোমরে-টোমরে গুঁজে নাও।’
কথা বলতে-বলতে মুঠো করা একটা হাত জিশানের দিকে বাড়িয়ে দিল গার্ড।
জিশান ইতস্তত করছিল। সেটা লক্ষ করে গার্ড বলল, ‘নাও, নাও। বললাম তো—কোনও পয়সা লাগবে না…।’
জিশানের বাঁ-হাত গার্ডের ডানহাতের মুঠোর কাছে চলে গেল। সকলের চোখ এড়িয়ে একটা ছোট পলিথিন পাউচ জিশানের হাতে চলে এল।
জিশান চাপা গলায় জানতে চাইল, ‘কী আছে এতে?’
‘স্নেক রিপেলান্ট অয়েল,’ গার্ড বলল, ‘এটা গায়ে মেখে নিলে সাপ আর কাছে আসবে না। এই তেলটা এমন পিকিউলিয়ার যে, শুধু সাপ এর গন্ধ পায়—মানুষ পায় না। আমাদের ”ভেনম হাউস”-এর স্নেক হ্যান্ডলাররা এই তেলটা রেগুলার ইউজ করে। স্নেক লেক গেম-এর পার্টিসিপ্যান্টদের মধ্যে যারা ইন্টারেস্টেড তাদের আমরা এই পাউচ বিক্রি করি—অবশ্যই লুকিয়ে-চুরিয়ে। তবে তোমার কাছ থেকে টাকা নেব না…।’
‘থ্যাংকস—’ বলে ছোট্ট পাউচটা প্যান্টের কোমরে গুঁজে ফেলল জিশান।
গার্ড বলল, ‘লেকে নামার আগে পা চুলকানোর ভান করে ওই পাউচের তেলটা পায়ে মেখে নেবে…হাঁটু পর্যন্ত। কোনও সাপ যদি জল থেকে লাফিয়ে হাঁটুর ওপরে কামড়ায় তা হলে তোমার আর কিছু করার নেই…ভগবান যা করার করবে। যাকগে, জেতার চেষ্টা করো। তুমি জিতলে আমার খারাপ লাগবে না। ওই শ্রীধর পাট্টা আর তার চ্যালাচামুণ্ডাগুলোকে যদি টাইট দিতে পারতাম তা হলে আমার হাড়ে বাতাস লাগত। ওই শুয়োরের বাচ্চার দল ছাপোষা মানুষগুলোকে ধরে এনে ছারপোকার মতো টিপে-টিপে মারছে। কোনও প্রতিবাদ নেই, কোনও আন্দোলন নেই। বুঝলে, আমরা সব ভেড়া হয়ে গেছি। এই দু:খেই আমি মাল খাই, আর ঘুষ খাই। আমরা সব হেরে যাওয়া পাবলিক, জিশান। তোমার ব্যাপারে আমি খোঁজ নিয়েছি। তুমি হয়তো কিছু একটা করতে পারবে। তুমি জিতলে আমার মনে হবে আমিই জিতেছি।’ হঠাৎই সামনের দিকে তাকিয়ে গার্ড বলল, ‘আমরা এসে গেছি। ওই যে স্নেক লেক। বেস্ট অফ লাক, ভাই। মনে রেখো, আমাকে জেতানো চাই…।’
কথা বলতে-বলতে গার্ড চলে গেল।
কিন্তু জিশানের বুকের ভেতরে ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে গেল। যাওয়ার আগে জিশানকে কী বলে গেল ঘুষখোর লোকটা! ‘মনে রেখো, আমাকে জেতানো চাই।’
মিনি বারবার বলছে, ওকে জিততে হবে। এই অসভ্য মরণখেলার একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত করতে হবে।
মনোহর সিং চাইছে জিশান জিতুক।
ওকে ঘিরে এতরকম মানুষের এত আশা!
গার্ড বলে গেল, ‘…আমরা সব হেরে যাওয়া পাবলিক…।’ গার্ড চাইছে, এইসব হেরে যাওয়া পাবলিকদের হয়ে জিশান লড়বে—এবং জিতবে।
জিশান ঘাড় ঘুরিয়ে গার্ডকে খুঁজল। ও তখন প্রতিযোগীদের সারির একেবারে পিছনে গিয়ে পজিশন নিয়েছে। কয়েকসেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে রইল জিশান—যদি একটিবারের জন্য চোখাচোখি হয়।
চোখাচোখি হল। এবং হওয়ামাত্রই জিশান ঠোঁটের কোণে হাসল, আর বাঁ-হাতে ‘থামস আপ’ দেখাল। মনে-মনে বলল, ‘আমি তোমাকে জেতানোর জন্যে শেষ দম পর্যন্ত লড়ব।’
জিশানদের নিয়ে যাওয়া হল লেকের সামনে। ওদের সবার গায়ে কমপিটিশানের চেনা পোশাক : হলদে টি-শার্ট আর কালো বারমুডা। টি-শার্টের বুকে সুপারগেমস কর্পোরেশনের লোগো আর তার নীচে বার কোড।
য়ুনিফর্ম পরা চারজন ‘স্নেক হ্যান্ডলার’-কে দেখতে পেল জিশান। ওদের গায়ে কমলা রঙের জ্যাকেট। জ্যাকেটের পিঠের দিকে ইংরেজিতে লেখা : ‘স্নেক হ্যান্ডলার’। এ ছাড়া মেডিকেল ইউনিটের হুডখোলা সাদা গাড়িও চোখে পড়ল ওর। না, কোনও ব্যবস্থাতেই কোনও ফাঁক নেই।
খেলাটা লাইভ টেলিকাস্টের জন্য টিভি চ্যানেলের ত্রু লেকের চারকোণে আর মাঝামাঝি দুটো জায়গায় যন্ত্রপাতিসমেত পজিশন নিয়েছে। একটা উঁচু ফ্রেমে ক্যামেরা বসিয়ে লেকের টপভিউ নেওয়ার বন্দোবস্তও করা হয়েছে। সব আয়োজনই এমন নিখুঁত যাতে উত্তেজনা ও আনন্দের মাত্রা ঠিকঠাক রেখে খেলার প্রতিটি মুহূর্ত ‘জীবন্তভাবে’ পৌঁছে দেওয়া যায় টিভি দর্শকদের কাছে।
একজন ইনস্ট্রাকটরের নির্দেশে জিশানরা প্রত্যেকে জুতো খুলে ফেলল—যাতে জলের মধ্যে জোরে দৌড়তে সুবিধে হয়। তারপর সাঁতারের প্রতিযোগিতার মতো ওদের পরপর দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল।
ওদের সামনে একটা ধাতব পাঁচিল—তিনফুট মতো উঁচু। পাঁচিলটা ডিঙোলেই লেক। লেকের জলের রং সাদা, ঘোলাটে। জলে কি মিশিয়েছে কে জানে!
জিশানের ডানদিকে চারজন প্রতিযোগীর পর মনোহর সিং। ও মাঝে-মাঝে উঁকি মেরে জিশানের দিকে দেখছিল। ওর জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল জিশানের। ওর কাছে স্নেক রিপেলান্ট অয়েল রয়েছে—মনোহরের কাছে নেই। কিন্তু ওই তেলটা তো পায়ে মাখতে হবে!
হঠাৎই জিশান একজন গার্ডকে ডেকে বলল, ‘আমাকে টয়লেটে যেতে হবে। খুব জোর পেয়ে গেছে।’
গার্ডটার মুখে বিরক্তির ভাঁজ পড়ল। জিগ্যেস করল, ‘ছোট, না বড়?’
‘ছোট।’
‘বাঁচালে—।’ গার্ড ওর কাছে এগিয়ে এল। আঙুল তুলে দেখাল: ‘ওই যে—ওইদিকে।’
জিশান ইশারা লক্ষ করে তাকাল। পনেরো-কুড়ি মিটার দূরে অদ্ভুত ছাঁদের একটা একতলা ঘর।
ও তাড়াতাড়ি পা চালাল সেদিকে।
টয়লেটের দরজায় দুজন গার্ড। ওদের বলে ভেতরে ঢুকল জিশান। ঢুকেই বুঝল বাথরুমটা এয়ারকন্ডিশনড এবং আধুনিক ঢঙে সাজানো। আরামের ব্যবস্থার বহর দেখে ওর তেতো হাসি পেল। তবে আর সময় নষ্ট না করে কোমর থেকে অয়েল পাউচটা বের করে নিল। চটপট পাউচ ছিঁড়ে তেলটা বের করে দু-পায়ে ভালো করে মাখতে লাগল—গোড়ালির গাঁট থেকে হাঁটু পর্যন্ত।
তেল মাখা শেষ হলে ও ছেঁড়া পাউচটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিল। এটা এখানে পড়ে থাকা ঠিক নয়। গার্ডদের কারও নজরে পড়ে যেতে পারে।
ওটা লুকোনোর জায়গা খুঁজতে গিয়ে কাচের জানলায় লাগানো ভেনেশিয়ান ব্লাইন্ডের দিকে চোখ গেল জিশানের। তাড়াতাড়ি একটা জানলার কাছে গিয়ে ব্লাইন্ডের প্লাস্টিকের পাতের আড়ালে পাউচটা লুকিয়ে ফেলল।
তখনই ব্লাইন্ড টানার দড়ির দিকে নজর পড়ল ওর। কী ভেবে দুটো জানলা থেকে চটপট দুটো সিনথেটিক দড়ি খুলে নিল। দড়িদুটো দলা পাকিয়ে জাঙ্গিয়ার ভেতরে গুঁজে দিল। ভালো করে তাকিয়ে দেখল, পোশাকের ওপর থেকে দড়ির ব্যাপারটা মোটেই বোঝা যাচ্ছে না। তারপর টয়লেট থেকে বেরিয়েই লেকের দিকে ছুটতে শুরু করল।
সেখানে পৌঁছে দ্যাখে একজন ইনস্ট্রাকটর পোর্টেবল অডিয়ো সিস্টেমে পার্টিসিপ্যান্টদের আই-ডি নম্বর অ্যানাউন্স করে সেটা ল্যাপটপে চেক করে নিচ্ছেন।
জিশান পৌঁছনোর দু-মিনিটের মধ্যেই কমপিটিশান শুরু হয়ে গেল। ওদের সামনের ধাতব পাঁচিলটা নি:শব্দে ঢুকে গেল মেঝেতে। এবং ওরা স্টার্টারের বন্দুকের শব্দ শোনামাত্রই লেকে নেমে পড়ল। দুরন্ত গতিতে ছুটতে শুরু করল।
লেকের দুপাশে দর্শকের ভিড়। তারা এই অদ্ভুত রেস দেখছে আর উত্তেজনায় হইহই করছে। ওদের বেশিরভাগই পিস ফোর্সের গার্ড, সুপারগেমস কর্পোরেশনের স্টাফ, আর বিভিন্ন গেমে নাম দেওয়া সব পার্টিসিপ্যান্ট। নিউ সিটির বাসিন্দারা এখানে নেই। তারা ঘরের কিংবা অফিসের আরামে বসে এই মারাত্মক খেলার লাইভ টেলিকাস্ট দেখছে। যারা এখন দেখার সময় পাচ্ছে না তারা পরে সুবিধেমতো এর ভিডিয়ো রেকর্ডিং ডাউনলোড করে দেখে নেবে।
ওল্ড সিটিতেও এই গেমের লাইভ টেলিকাস্ট দেখছে বহু মানুষ। তাদের বেশিরভাগেরই চোখে বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু মিনি টিভির সামনে বসে আছে জিশানের জন্য। আর জিশানকেও জিততে হবে মিনির জন্য। ওই ভয়ংকর শ্মশানের ওই হতভাগ্য মরা মানুষগুলোর জন্য। এবং ওই গার্ডের জন্য।
স্নেক রিপেলান্ট অয়েলটা ঠিকঠাক কাজ করবে কি না এ নিয়ে জিশানের মনে এককণা হলেও সংশয় ছিল। তাই ও প্রাণপণে ছুটছিল। ও পা ফেলার সঙ্গে-সঙ্গে ছপছপ শব্দ হচ্ছিল, জল ছিটকে উঠছিল। ওর সামনে-পিছনে বাকি পনেরোজনও একইরকম শব্দ তুলছিল। ছিটকে ওঠা জলের পরদায় প্রতিযোগীদের চেহারা আড়াল হয়ে যাচ্ছিল।
তারই মধ্যে দুটো সাপকে শূন্যে ছিটকে উঠতে দেখল জিশান। হয়তো কোনও পার্টিসিপ্যান্টের পায়ের টানে ওপরদিকে ছিটকে গেছে।
ছুটতে-ছুটতে তিনবার পায়ের নীচে নরম শরীর টের পেল ও। সাপের গায়ে পা পড়েছে ভাবতেই ওর গা-টা শিরশির করে উঠল। কিন্তু সেসব নিয়ে বেশি ভাবার সময় নেই। ছুট—ছুট—ছুট।
জিশান দেখল, এর মধ্যেই ছ’জন লেকের মধ্যে লুটিয়ে পড়েছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ছিটকে ওঠা জলের ফোয়ারার জন্য মনোহরকে ও দেখতে পাচ্ছিল না। ও এখনও ছুটছে তো?
সামনেই লেকের পাড় দেখা যাচ্ছে—দৌড়ের ফিনিশ লাইন। জিশান পাগলের মতো ছুটতে লাগল। এবং কিনারার কাছাকাছি এসে সামনে প্রচণ্ড এক লাফ দিল।
লেকের ফিনিশ লাইনের পরই ঘাসে ঢাকা লন। ছুটন্ত প্রতিযোগীরা যখন রেস শেষ করছে তখন লাফিয়ে এসে পড়ছে এই লনে। জিশানের শরীরটা ঘাসের ওপর পড়ে দুবার ভল্ট খেয়ে গেল। তারপর একপাক গড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে রইল।
আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে রইল জিশান। ওর বুকটা হাপরের মতো ওঠা-নামা করছিল। দর্শকদের উল্লাসের চিৎকার কানে আসছিল। আকাশে তিনটে পাখি উড়ে যেতে দেখল ও। তখনই যেন ওর মনে পড়ল, ও বেঁচে আছে। স্নেক লেক রাউন্ডে ও কোয়ালিফাই করে ফেলেছে। আর একইসঙ্গে পিট ফাইটের মুখোমুখি চলে এসেছে।
হঠাৎই মনোহরের কথা খেয়াল হল ওর। ও চট করে উঠে বসল। চারপাশে তাকাতে লাগল। কোথায়? কোথায় মনোহর?
সব পার্টিসিপ্যান্টের পোশাক একইরকম হওয়ায় মনোহরকে খুঁজে নিতে জিশানের অসুবিধে হচ্ছিল। ও উঠে দাঁড়াল। বাজপাখির চোখে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল মনোহরকে।
হঠাৎই দেখতে পেল।
মনোহর সিং ঘাসের ওপরে শুয়ে ছটফট করছে। ওর কাছাকাছি কেউ নেই। ওর দিকে তেমন করে কারও নজর পড়েনি।
মনোহরের দিকে ছুটে গেল জিশান। ‘মনোহর—’ বলে চিৎকার করে উঠল।
ওর কাছে গিয়ে জিশান হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল।
‘মনোহর! মনোহর!’
চোখ মেলে জিশানকে দেখতে পেল। যন্ত্রণা মেশানো গলায় বলল, ‘জিশানভাইয়া…সালা হমে ডস দিয়া…।’
সাপে কেটেছে মনোহরকে।
ওকে পাশ ফেরাতেই জোড়া দাঁতের দাগ দেখতে পেল জিশান। বাঁ-পায়ের ডিমের ওপরে পাশাপাশি দুটো দাঁতের দাগ।
জিশান চিৎকার করে মেডিকেল ইউনিটের লোকজনকে ডাকতে লাগল। ওরা তখন সাপের কামড় খাওয়া অন্য প্রতিযোগীদের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত।
কাছাকাছি পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন গার্ডকে জিশান ডাক্তার ডাকার জন্য বারবার বলতে লাগল। একইসঙ্গে জাঙ্গিয়ার ভেতরে হাত ঢোকাল। ভেনেশিয়ান ব্লাইন্ডের দড়ি দুটো বের করে নিল। তারপর মনোহরকে চটপট ফাঁস বেঁধে দিল—একটা হাঁটুর নীচে, আর-একটা হাঁটুর ঠিক ওপরে।
মনোহর চিত হয়ে শুয়ে হাঁ করে মুখ দিয়ে ‘আ—আ:—’ শব্দ করতে লাগল।
এর মধ্যেই টিভি ক্যামেরা নিয়ে লোকজন চলে এসেছে মনোহরের কাছে। কী করে একটা মানুষ সাপের কামড়ে ধীরে-ধীরে মারা যাচ্ছে তারই ‘সিধা প্রসারণ’ নিউ সিটির বড়লোকদের দেখাতে লাগল। মিনিও নিশ্চয়ই এই লাইভ টেলিকাস্ট দেখছে।
জিশানের মাথার ভেতরে সুপারনোভা ঘটে গেল। ও ভুলে গেল শ্রীধর পাট্টার কথা, রোলারবলের শাস্তির কথা, ভুলে গেল মিনি আর শানুর কাছে ওকে ফিরতে হবে।
ও উঠে দাঁড়াল। তিন-চার পা ফেলেই পৌঁছে গেল টিভি ক্যামেরায় চোখ সেঁটে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার কাছে। ওর জামার কলার আর কোমরের বেল্ট দু-হাতে খামচে ধরে ওকে তুলে নিল শূন্যে। লোকটার শরীর জিশানের কাছে পালকের চেয়েও হালকা বলে মনে হচ্ছিল। ওর মনে পড়ে গেল ওল্ড সিটিতে কার্তিকের সঙ্গে লড়াইয়ের কথা।
চারপাশের লোকজনদের কেউ-কেউ এই কাণ্ড দেখে হইহই করে উঠল।
একজন গার্ড ছুটে এল জিশানের কাছে। শকার উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘ওকে নামাও! এক্ষুনি! নইলে…।’ শকারটা জিশানের নাকের ডগার কাছে এনে কয়েকবার নাড়াল।
জিশান মনে-মনে হিসেব কষল।
ক্যামেরাম্যান লোকটাকে ও অনায়াসে ছুড়ে দিতে পারে গার্ডের দিকে। তা হলে শকারের সাধ্য নেই জিশানকে ছোঁয়। একইসঙ্গে জিশান জিমের ‘লেগ পুশ’ ব্যায়ামের মতো গার্ডটাকে পা দিয়ে এক প্রবল ধাক্কা মারতে পারে। তাতে গার্ডটা নির্ঘাত ছিটকে গিয়ে পড়বে স্নেক লেক-এ। তারপর জহরিলা সাপ তার মহান দায়িত্ব পালন করবে।
জিশান জানে, এই কাজগুলো ও সহজেই করতে পারে। তেত্রিশদিন হল ও জিপিসি-তে এসেছে। এখানকার ব্যায়ামের রুটিন ওর শরীরটাকে এর মধ্যেই কাঁচা লোহা থেকে ইস্পাত বানিয়ে দিয়েছে। নিজের শরীরটার ওপরে ওর ভরসা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
কিন্তু মনোহরের কথা ভেবে কাজগুলো করল না জিশান। গার্ডের চোখে চোখ রেখে ক্যামেরাম্যানকে মাথার ওপর থেকে ধীরে-ধীরে নীচে নামিয়ে দিল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে ভয়-পাওয়া লোকটাকে বলল, ‘যদি নিজে ছবি না হতে চাও তা হলে আমার বন্ধুর ছবি তুলবে না। তুললে কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না…।’
লোকটার চোয়ালে আলতো করে দুবার চাপড় মারল জিশান: ‘যাও, অন্য লোকদের ছবি-টবি তোলো…।’
লোকটা দু-চোখে ভয় নিয়ে ছিটকে চলে গেল ওর সঙ্গীসাথীর কাছে। যাওয়ার সময় পিছন ফিরে বারবার দেখতে লাগল জিশানের দিকে।
এবার গার্ডের দিকে তাকাল জিশান। ওর চোখে চোখ রেখে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। তারপর ঘুরে হাঁটা দিল মনোহরের দিকে। মেডিকরা তখন মনোহর সিং-কে ঘিরে ভিড় জমিয়ে ফেলেছে—ওর শুশ্রূষা করছে।
জিশান মনে-মনে চাইল, মনোহর যেন ভালো হয়ে যায়। ওর মতো ভালোমানুষের ভালো হয়ে যাওয়া উচিত।
•
জিশান অ্যানালগ জিমে ব্যায়াম করছিল।
জিমের চারটে স্পেশাল কিউবিকলের নাম ‘সোলো জিম’। পিট ফাইটের যারা পার্টিসিপ্যান্ট তাদের এখন সোলো জিম-এ ওয়ার্কআউট করতে হয়। সকালে একঘণ্টা, বিকেলে একঘণ্টা। এটাই নির্দেশ।
সোলো জিম-এর মাপ বারো ফুট বাই বারো ফুট। এয়ার কন্ডিশানড। বডি টেম্পারেচারের সঙ্গে-সঙ্গে রুম টেম্পারেচার নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে নিজে থেকেই বদলায়। জিমের ভেতরের দেওয়ালগুলো সব আয়না। এমনকী সিলিং-ও।
একটা সোলো জিমে জিশান ‘ইউনিভার্সাল ক্রাঞ্চ’ মেশিন নিয়ে ব্যায়াম করছিল। শরীরের নানান অংশের মাসলকে হাইপার অ্যাক্টিভ করে তোলার জন্য এই মেশিনের জুড়ি নেই। তা ছাড়া জিশান বুঝতে পারছিল, পিট ফাইটের আগে পার্টিসিপ্যান্টদের ফিট করার জন্য মার্শাল শ্রীধর পাট্টার কেন এত মাথা ব্যথা। যাতে ওয়ান-টু-ওয়ান লড়াইগুলো জমে। রাফনেস আর টাফনেসের চূড়ান্ত স্কেলে পৌঁছে যায়। লড়াই দেখে যেন মনে না হয় দুটো মানুষ খালি হাতে লড়ছে। বরং যেন মনে হয়, দুটো নেকড়ে দাঁত-নখ দিয়ে মরণপণ লড়াই করছে, একটা আর-একটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খতম করতে চাইছে। তবেই না নিউ সিটির মানুষ লাইভ টেলিকাস্ট দেখে সত্যিকারের থ্রিল আর এক্সাইটমেন্ট এনজয় করবে! তবেই না মালটিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো কোটি-কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দেবে!
তাই প্রতিটি কণা মাসলের প্রতিটি কণা শক্তি এখন জিশানের দরকার। সেই সুপার লেভেল শক্তি নিয়ে পিট ফাইট। এবং সেটা ডিঙোতে পারলেই সুপার-ডুপার লেভেলের শক্তি চাই—সঙ্গে আর্মস—যার যেমন পছন্দ। তারপর কিল গেম। শেষ লড়াই। লড়াই শেষ। নাকি জীবনও?
জিশান ব্যায়াম করছিল, আর আয়নায় নিজেকে দেখছিল। ওর মধ্যে একটু জানোয়ার-জানোয়ার ভাব এসেছে না? বাইসেপ, ট্রাইসেপ, ল্যাট—সব মাসলগুলো কেমন যেন পাথরের মতো দেখাচ্ছে। দু-গাল বসে গিয়ে চোয়াড়ে লাগছে। উজ্জ্বল চোখ দুটোকে ধূর্ত আলোর বিন্দু মনে হচ্ছে।
এ কোন জিশান?
আয়নার জিশানকে চিনতে ওর কষ্ট হল। একইসঙ্গে কান্না পেল। এই চেহারায় কোন মুখে মিনির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে ও? অথচ এখানকার ভয়ংকর গেমগুলোতে জিততে হলে এই চেহারাটাই জরুরি।
সোলো জিমে একঘণ্টা ব্যায়াম করার পর দরজা খুলে বেরোল জিশান।
বাইরে একজন জিম বয় স্টপওয়াচ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ঘড়ি দেখে হিসেব কষল একঘণ্টা হয়েছে কি না। যদি পাঁচমিনিটের বেশি এদিক-ওদিক হয় তা হলে সে সঙ্গে-সঙ্গে অ্যানালগ জিমের চিফ ইনস্ট্রাকটরকে মোবাইলে ফোন করে জানাবে। তারপর ডিসিপ্লিন ভায়োলেট করার জন্য জিশানকে ‘শিক্ষা’ দেওয়া হবে। যেমন, ওকে মাঝরাতে ডেকে তুলে টানা তিনঘণ্টা ব্যায়াম করার হুকুম দেওয়া হতে পারে। অথবা অন্য কিছু।
জিশান শুনেছে, সুপারগেমস কর্পোরেশনে নতুন-নতুন শাস্তির টেকনিক আবিষ্কার করার জন্য নাকি চারজন এক্সিকিউটিভের একটা টিমকে প্রচুর মাইনে দিয়ে পোষা হয়।
অ্যানালগ জিমের দরজার দিকে হাঁটা দিল জিশান। একইসঙ্গে ও মনোহরের কথা ভাবছিল। তিনদিন হয়ে গেল, ও এখনও জিপিসি-র নার্সিংহোমে। অ্যান্টিভেনম দিয়ে ওর চিকিৎসা চলছে। তার সঙ্গে ফলমূল, হেলথ পাউডার আর হেলথ ড্রিংক। ডাক্তাররা বলছে চাঙ্গা হয়ে উঠতে মনোহরের এখনও চার-পাঁচদিন লেগে যাবে।
মনোহর সিং-এর কথা ভাবতে গিয়েই জিশান একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। তাই লোকটাকে ও খেয়াল করেনি। খেয়াল যখন করল তখন দেখল লোকটার গায়ে লাল ইউনিফর্ম। অর্থাৎ, অ্যানালগ জিমের একজন ইনস্ট্রাকটর।
জিশানের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সে মাটিতে ছিটকে পড়েছে।
জিশান ‘সরি’ বলে ঝুঁকে পড়ে তাকে তুলতে যাবে, হঠাৎই কে যেন পাশ থেকে ওর পাঁজরে সপাটে লাথি চালিয়ে দিল। একইসঙ্গে নোংরা ভাষায় খিস্তি করে উঠল।
লাথি চালানো পায়ে কালো চামড়ার জিম-বুট পরা ছিল। এবং বুটের তীক্ষ্ণ ডগাটা জিশানের পাঁজর যেন ফুটো করে দিল। একটা অসহ্য যন্ত্রণা ওর বুকের ভেতরে তৈরি হয়ে বেতার তরঙ্গের মতো শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরায় চিনচিন করে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
জিশানের হাত থেকে তোয়ালে ছিটকে পড়ল। ও পড়ে গেল জিমের প্যাড দেওয়া মেঝেতে। সেই অবস্থাতেই শরীরটা আধপাক ঘুরিয়ে চিত করে নিল। তারপর আক্রমণকারীকে দেখতে চেষ্টা করল।
জিমের সিলিং-এ শৌখিন সাদা আলো। তার ফ্রস্টেড কাচের ঢাকনায় অসংখ্য হিরের কুচি চিকচিক করছে। সেই আলোর ব্যাকগ্রাউন্ডে আক্রমণকারীর অন্ধকার মুখটা ঠাহর করতে চাইল ও।
লোকটার টাক মাথা চকচক করছিল।
‘কী রে শুয়োরের বাচ্চা! ট্রেনারের গায়ে হাত তুললি!’ কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে বুট পরা পায়ের সোল নেমে এল জিশানের মুখের ওপরে।
জিশান এক ঝটকায় মাথাটা ঘুরিয়ে নিতে চাইল। লাথিটা এসে লাগল ওর বাঁ-গাল আর কানের ওপরে। শরীরের বাঁ-দিকটা ব্যথায় ঝনঝন করে উঠল।
লোকটা এবার নিচু হল। জিশানের বাঁ-রগের ওপর পরপর দুটো মারাত্মক ঘুষি মারল।
জিশানের মাথার ভেতরে যেন বোমা ফাটল। ওর চোখের সামনে অ্যানালগ জিম ঝাপসা হয়ে গেল। সিলিং-এর ঠান্ডা সাদা আলো ঘোলাটে হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। পলকে একটা উজ্জ্বল আকাশ হয়ে গেল যেন।
তারপরই জিশানের আর কিছু মনে নেই। অজ্ঞান হয়ে গেল।
কিন্তু তার আগে ও আক্রমণকারীকে চিনতে পেরেছে। লোকটা যখন ঘুষি মারার জন্য ওর ওপরে ঝুঁকে পড়েছিল তখনই পাশ থেকে ছিটকে আসা আলোয় একঝলক দেখতে পেয়েছিল জিশান। ওর চেতনা ঝাপসা হয়ে গেলেও রণজিৎ পাত্রকে চিনতে ও ভুল করেনি।
রণজিৎ যে বদলা নেওয়ার সুযোগ খুঁজবে সে তো জানা কথা! কিন্তু যে-বুদ্ধিটা রণজিৎ ব্যবহার করেছে তার প্রশংসা করতে হয়। ও জিশানকে সবসময় চোখে-চোখে রাখছিল। এখন সামান্য সুযোগ পেতেই জিম ট্রেনারের পক্ষ নিয়ে জিশানের ওপরে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
ব্যাপারটা কেউই ঠিকমতো খেয়াল করেনি। তাই রণজিৎ পাত্র যখন চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে সবাইকে বলছিল জিশান কীরকম বদবুদ্ধি ধরে এবং জিম ইনস্ট্রাকটরকে হেনস্থা করার জন্য ও বহুদিন ধরেই সুযোগ খুঁজছিল, তখন সকলেই রণজিতের কথা বিশ্বাস করছিল।
‘…জানেন, ও আমাকে কতবার ওর প্ল্যানের কথা বলেছে? কিন্তু আমি রাজি হইনি। ওকে বুঝিয়েছি। বলেছি, ভাই, আমরা এখানে কম্পিটিশান লড়তে এসেছি—তার বাইরে আর কোনও লড়াই নেই। কিন্তু আমার কথা শুনলে তো! আপনারা তো নিজের চোখে…।’
রণজিৎকে ঘিরে চার-পাঁচজন জড়ো হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে পিস ফোর্সের দুজন গার্ডও ছিল। কোমরে শকার। তাদের একজন মোবাইল ফোন বের করে ব্যস্তভাবে কারও সঙ্গে কথা বলছিল। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, জিশানের বেয়াদপির ব্যাপারটা নিয়েই সে কোনও ওপরওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে।
ইনস্ট্রাকটরকে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে যে-দুজন তারা হাসান আর পাপুয়া। ওরা দুজন ইনস্ট্রাকটরের গা থেকে কাল্পনিক ধুলো ঝেড়ে দিচ্ছিল। এবং অভিনয়টাকে জোরদার করার জন্য জিশানের হয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইছিল।
জিশানের জ্ঞান ফিরে এসেছিল। বাঁ-দিকে রগের কাছের অসহ্য ব্যথা। অজান্তেই হাত চলে গেল সেখানে।
‘উ:!’
জায়গাটা চটচট করছে। হাত চোখের সামনে এনে ধরল।
রক্ত।
রাগে ফুঁসে উঠল জিশান। ওই তো রণজিৎ! ভিড় করে দাঁড়ানো লোকগুলোকে কাঁড়ি-কাঁড়ি মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে এখনও।
জিশান উঠে বসার চেষ্টা করল। ও এবার চেঁচিয়ে সত্যি কথাটা সবাইকে বলবে। ফাঁস করে দেবে রণজিতের নোংরা চালাকি। তারপর সুযোগ পেলে লাথি এবং ঘুষি কড়ায়-গণ্ডায় শোধ দেবে। পারলে তার চেয়েও কিছু বেশি।
কিন্তু পারল না। মাথাটা টলে গেল। শরীরটা বাঁকিয়ে মাথাটা শূন্যে ফুটখানেক তুলেছিল—সেখান থেকেই ওর মাথা খসে পড়ল। মেঝেতে প্যাডের লাইনিং থাকায় তেমন শব্দ হল না।
জিশান শূন্য চোখে রণজিতের দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি ঘটনাটা কেউ খেয়াল করেনি ভেবে ওর ভীষণ মনখারাপ লাগছিল।
একজন কিন্তু সত্যি ঘটনাটা খেয়াল করেছিল। তবে জিশান সেটা খেয়াল করেনি।
অ্যানালগ জিম মাপে বিশাল। জায়গাটা শুধু যে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো তা নয়। সাজানোর ঢংটাও রীতিমতো আধুনিক।
পুরো ঘরটায় চিলিং এসি। ঘরের বাতাসে রুম ফ্রেশনারের সুগন্ধ। দেওয়ালের বেশিরভাগটাই আয়নায় ঢাকা। সিলিং-এ মোলায়েম সাদা আলো। ব্যায়ামের ছন্দ ঠিকঠাক রাখার জন্য জিমের হল জুড়ে হালকা মিউজিক ভেসে বেড়াচ্ছে।
পার্টিসিপ্যান্টদের ড্রেস হলদে রঙের স্লিভলেস ভেস্ট আর কালো শর্টস। হাতে আঙুল কাটা কালো চামড়ার দস্তানা। প্রত্যেকের সঙ্গে রয়েছে একটা করে সাদা তোয়ালে। সবাই আপনমনে ব্যায়াম করছে. কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। যেটুকু কথাবার্তা বলার ইনস্ট্রাকটররা বলছে।
অ্যানালগ জিমে ঢোকার সময় প্রত্যেক প্রতিযোগীকে স্মার্ট কার্ড সোয়াইপ করতে হয়। আর ঢোকার পর একটা ফর্ম ফিল আপ করতে হয়। ফর্মটার নাম ডেইলি ওয়ার্কআউট অ্যাসেসমেন্ট ফর্ম। কী-কী ব্যায়াম করতে হবে, কতক্ষণ ধরে করতে হবে, ফর্মে তার খুঁটিনাটি হিসেব আর নির্দেশ দেওয়া আছে। ফর্ম ফিল আপের বেশিরভাগ কাজটাই অবশ্য বক্সে টিক মারা।
জিমের দরজার কাছাকাছি একটা বড় মাপের আধুনিক টেবিলে একটি ছিপছিপে মেয়ে বসে আছে। ওর সামনে রাখা একগোছা ফর্ম। তার পাশেই বসানো একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার। তার নীচের তাকে একটা লেসার প্রিন্টার।
মেয়েটির গায়ে হালকা নীল টপ। আর গাঢ় নীল স্কার্ট। বুকে কোড নম্বর লেখা একটা স্টিকার। গলায় একটা সরু নীল ফিতে বয় স্কাউটের ঢঙে বাঁধা। চুল বয়কাট। যদিও মুখটা ভীষণ মেয়েলি। এবং মিষ্টি।
ওর ফরসা মুখে দুটো টানা-টানা চোখ কী সুন্দর মানিয়ে গেছে! চোখের তারা দুটো যেমন উজ্জ্বল, তেমনই চঞ্চল। প্রতিদিন অ্যানালগ জিমে ঢুকে ফর্ম ফিল আপ করার সময় জিশানের মনে হয়, এত সুন্দর প্রাণচঞ্চল মেয়েটি এই নিষ্ঠুর দেশে কী করছে?
জিশান খেয়াল করেছে, ফর্ম ফিল আপ করার সময় মেয়েটি সবার সঙ্গেই গায়ে পড়ে টুকটাক কথা বলে। অন্তত বলার চেষ্টা করে। যারা নেহাতই খিটখিটে গম্ভীর তারা মেয়েটির কথা গ্রাহ্য করে না। ফর্মের রুটিন সেরে তারা জিমের যন্ত্রের কাছে এগিয়ে যায়। কিন্তু তাতে মেয়েটি মোটেই উৎসাহ হারায় না। পরের প্রতিযোগী ঢুকলেই নতুন উদ্যমে ওর কথা শুরু হয়ে যায় আবার।
‘আজ কেমন আছেন?’
‘ভালো—।’ ফর্মের নানান খোপে টিক মারতে-মারতে জিশান বলল।
‘এক্সারসাইজের মুড আছে তো?’
‘কেন থাকবে না?’
‘না, অনেক সময় দেখি সামনে কোনও টাফ কমপিটিশান থাকলে পার্টিসিপ্যান্টদের মুড অফ হয়ে যায়। মেঘ করলে আকাশের যা অবস্থা হয়…।’ কথা শেষ করে হাসল।
জিশান চমকে চোখ তুলে দেখল ওকে। মেয়েটা কবি-টবি নাকি?
ওল্ড সিটিতে কবিতা লেখা কবে উঠে গেছে। অন্তত পত্র-পত্রিকাগুলো উঠে গেছে। কিন্তু কিছু-কিছু মানুষ এখনও পথে-ঘাটে কবিতা আবৃত্তি করে বেড়ায়, গান গেয়ে বেড়ায়। সবাই তাদের পাগল বলে। কিন্তু জিশানের মনে হয় ওই পাগলগুলো মরা শহরটাকে বাঁচিয়ে তুলতে চাইছে, ফুল-পাখি ফিরিয়ে আনতে চাইছে, ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোকে জাগিয়ে তুলছে চাইছে।
চাইছে অনেকেই। জিশান আর মিনিও চাইছে। তাই ওরা কবিতা ভালোবাসে। ওরা চায় কোনও এক অলৌকিক ম্যাজিকে ওল্ড সিটিটা কবিতা হয়ে যাক। এই চাওয়ায় কোনও ভুল নেই। কিন্তু পাওয়া বোধহয় এখনও অনেক দূরে।
নিউ সিটিতে কবিতা নিশ্চয়ই নিষিদ্ধ নয়। তবে শ্রীধর পাট্টা আর তাঁর তৈরি ভয়ংকর সব নিয়মকানুন দেখলে মনে হয় কবিতা বোধহয় নিষিদ্ধর চেয়েও কিছু বেশি।
জিশান নিচু গলায় বলল, ‘মুড অফ হলে তো চলবে না। ট্রেনিং-এর নিয়মে নড়চড় হওয়ার জো নেই।’
‘সেটা ঠিক। তবে…’ মাথার চুলে হাত চালাল মেয়ে : ‘তবে আমরাও তো মানুষ…।’
‘দেখে তো মনে হয় না।’
‘তার মানে!’ রাগ ঢুকে পড়ল গলায় : ‘আমি কি জিমের ওইসব যন্ত্র নাকি?’
‘হতেই পারে—।’ ঠোঁট উলটে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল জিশান। তারপর একটু হেসে সরে এসেছিল টেবিলের কাছ থেকে।
দূর থেকে ও লক্ষ করেছিল মেয়েটি তখনও অখুশি চোখে জিশানের দিকে তাকিয়ে আছে।
দু-দিন আগে জিমে ঢোকার সময় মেয়েটি জিশানকে বলেছিল, ‘আপনার নাম তো জিশান…।’
‘হ্যাঁ—কেন?’
‘কনগ্র্যাচুলেশানস। আপনি কাল স্নেক লেক কমপিটিশানে জিতেছেন।’
জিতেছি এবং মৃত্যুর দিকে আরও এক পা এগিয়ে গেছি হয়তো। মনে-মনে ভাবল জিশান। কিন্তু মুখে বলল, ‘থ্যাংকস।’
জিশান ওর নাম জিগ্যেস করল না। শিবপদর কথা মনে পড়ে গেল। নাম জেনে কী লাভ! ঝামেলা বাড়বে।
‘অল দ্য বেস্ট উইশেস ফর ইয়োর নেক্সট গেম—।’
‘কেন? হঠাৎ আমাকে উইশ করছেন কেন?’ ভুরু কুঁচকে মেয়েটির দিকে তাকিয়েছিল জিশান।
চকচকে সাদা আলো ওর মিষ্টি মুখে একটা অদ্ভুত আভা তৈরি করেছে। মনে হচ্ছে, এই মুখটা যিনিই তৈরি করে থাকুন তিনি প্রচুর সময় এবং ভালোবাসা দিয়ে তৈরি করেছেন। এই শহরে এরকম প্রাকৃতিক অলীক সৌন্দর্য বেমানান। এখানকার যত সৌন্দর্য সব কৃত্রিম—মানুষের তৈরি। আর প্রতিটি সুন্দরের পিছনে বুদ্ধি, যুক্তি, পরিশ্রম, আর উদ্দেশ্য রয়েছে। যেমন, নেকরোসিটির নীল আলো জ্বলা মোমবাতির আড়ালে রয়েছে মানুষের মৃতদেহের ভাগাড়।
মেয়েটি হেসে বলল, ‘আমি সবাইকেই উইশ করি। আমি চাই সবার ভালো হোক। সবাই জিতুক—।’
জিশানের মধ্যে তর্ক করার সাধ জেগে উঠল। বহুদিন ও কারও সঙ্গে প্রাণ ভরে তর্ক করেনি। তাই ও ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘এই ইমপসিবল উইশের কোনও মানে নেই। একটা গেম-এ সবাই কখনও জিততে পারে?’
‘না, পারে না।’ মাথা ঝাঁকাল মেয়ে : ‘জানি—এটা অবাস্তব। কিন্তু তাই বলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না? যদি এমন হত, কমপিটিটাররা সবাই মিলে সুপারগেমস কর্পোরেশনের এগেইনস্টে রুখে দাঁড়াত, ওদের ডেডলি গেমগুলো চিরকালের জন্যে ধ্বংস করে দিত, তা হলে কী ফ্যানট্যাসটিক হত! তখন কি বলা যেত না যে, গেমটায় সবাই ফার্স্ট হয়েছে! বলুন?’
জিশান কোনও কথা বলতে পারল না। হাঁ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। এ কী রূপকথা শোনাচ্ছে সোনার মেয়েটা?
গার্ডের কথা মনে পড়ে গেল। স্নেক লেক কমপিটিশানের আগে যে ওকে স্নেক রিপেলান্ট অয়েলের একটা পাউচ দিয়েছিল। বলেছিল, ‘…আমরা সব ভেড়া হয়ে গেছি। আমরা সব হেরে যাওয়া পাবলিক, জিশান…। তুমি জিতলে আমার মনে হবে আমিই জিতেছি…। মনে রেখো, আমাকে জেতানো চাই…।’
জিশানকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা বলল, ‘আমি ভীষণ স্বপ্ন দেখি, জিশান। এখানকার কেউই—এমনকী নিউ সিটির মার্শালও আমার স্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে পারবে না। রিয়েল লাইফে যদি নাও পারি রূপকথায় অন্তত মানুষের মতো বাঁচব। তাই আমি সবাই জিতেছে এমন স্বপ্ন দেখি। আপনিও স্বপ্ন দেখুন, জিশান। স্বপ্ন দেখার অসুখটা খারাপ না। আমি বলছি, রূপকথার মধ্যেই মানুষের আসল জীবন লুকিয়ে আছে। আমরা দেখতে চাই না, তাই দেখতে পাই না…।’
সেদিন থেকে জিশান মনে-মনে ওর নাম দিয়েছিল রূপকথা। কসাইয়ের দেশে ও রূপকথা বিক্রি করতে চাইছে। ওর সাহস তো কম নয়!
জিশানের সঙ্গে ইনস্ট্রাকটরের সংঘর্ষের ঘটনাটা রূপকথা দেখতে পেয়েছিল।
কারণ, ওর হাতে তখন কোনও কাজ ছিল না। তাই টেবিলে বসে ও এমনিই জিমের পার্টিসিপ্যান্টদের দিকে তাকিয়েছিল। ও জানে, এরা ক্রমশ সংখ্যায় কমছে। আরও কমবে।
সোলো জিম থেকে জিশানকে ও বেরোতে দেখেছিল। সংঘর্ষটাও ভালো করে খেয়াল করেছিল। তাই জটলা এবং হইচই দেখে ও জিশানের কাছে ছুটে এল। ততক্ষণে চিফ ইনস্ট্রাকটরও সেখানে চলে এসেছে।
রূপকথা উত্তেজিতভাবে তাকে বলল, ‘স্যার, আমি সব দেখেছি। ব্যাপারটা পিয়োরলি অ্যাকসিডেন্ট। যেভাবে ওরা বলছে…’ রণজিৎ পাত্রের দিকে আঙুল দেখাল : ‘সেটা ঠিক নয়। আমি…।’
চিফ ইনস্ট্রাকটর হাতের ইশারায় রূপকথাকে চুপ করতে বলল। তারপর রণজিৎ ও তার দুই সঙ্গীকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনারা প্লিজ নিজেদের কাজে চলে যান। আমরা এখানে কোনওরকম হইহল্লা বা জটলা চাইছি না।’
জিপিসি-র ডিসিপ্লিন এমনই যে, অনুরোধ মানে আদেশের চেয়েও কিছু বেশি। রণজিৎ সেটা জানে। হাসান আর পাপুয়াও। তাই চোখের পলকে ওরা তিনজন সরে গেল। বাড়তি যে দু-তিনজন উৎসাহী পার্টিসিপ্যান্ট ছিল তারাও চিফ ইনস্ট্রাকটরের কথা শেষ হওয়ামাত্রই পা চালাল।
যার সঙ্গে জিশানের ধাক্কা লেগেছিল সেই ইনস্ট্রাকটর আর পিস ফোর্সের দুজন গার্ড অ্যাটেনশানের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। চিফ ইনস্ট্রাকটরের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
রূপকথা জিশানের তোয়ালেটা কুড়িয়ে নিল। তারপর ওর দিকে হাত বাড়াল। জিশান হাতটা ধরল। শরীরটা বাঁকিয়ে উঠে দাঁড়াল। বাঁ-হাতে কপালের পাশ থেকে রক্ত মুছে নিল।
রক্তে লাল হয়ে যাওয়া হাতের আঙুলগুলো দেখল জিশান। আজ থেকে দেড়-দু-মাস আগে এভাবে রক্ত দেখলে ওর মধ্যে যে-প্রতিক্রিয়া হত আজ তেমন হল না। জিশান একটু অবাক হলেও বুঝল, এটাই হওয়ার ছিল। জিপিসি-তে যারা গেম খেলতে আসে তাদের সবারই এরকম হয়। ধীরে-ধীরে রক্ত-টক্ত সব গা-সওয়া হয়ে যায়।
রূপকথা চিফ ইনস্ট্রাকটরকে আকুল গলায় বলল, ‘স্যার, হি ইজ ব্লিডিং। দ্যাট গডড্যামড গাই হিট হিম সো হার্ড…।’
চিফ ইনস্ট্রাকটর হাতের ইশারায় ওকে আশ্বস্ত করে জিশানের স্মার্ট কার্ড দেখতে চাইল। চার-পাঁচ-সেকেন্ড সেটায় চোখ বুলিয়ে কার্ডটা জিশানকে ফেরত দিল। জিমের চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে কোমর থেকে মোবাইল ফোন বের করে কাউকে ফোনে ধরতে চেষ্টা করল।
পরপর কয়েকবার চেষ্টা করে লাইন ‘বিজি’ পাওয়ায় বিরক্ত হল। তখন চিফ একজন গার্ডকে বলল, ‘একে মেডিক রুমে নিয়ে যাও। চিফ মেডিকের ফোন বিজি। যখনই ফোন করি ফোন বিজি। কার সঙ্গে এত বকবক করে কে জানে!’
‘আমি সঙ্গে যাব, স্যার?’ রূপকথার চোখে অনুনয়। ও তখন জিশানের ডানহাতের ওপরদিকটা আঁকড়ে ধরে আছে। ওর বোধহয় মনে হয়েছে, জিশান হঠাৎ টলে পড়ে যেতে পারে।
চিফ ইনস্ট্রাকটর বেশ কয়েকসেকেন্ড মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হাতের ইশারায় দুজন গার্ডকে চলে যেতে বলল।
ওরা রোবটের মতো নির্দেশ পালন করল।
চিফ এবার জিশানের দিকে তাকাল। ওর নজর দেখে বোঝা যাচ্ছিল জিশানের শরীরের কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটা আঁচ করার চেষ্টা করছে।
জরিপের কাজ শেষ হতেই চিফের নজর গেল সামান্য দূরে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইনস্ট্রাকটরের দিকে।
লোকটা মাথা নিচু করল। যেন জিশানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাওয়াটা ওর পক্ষে মর্মান্তিক অপরাধ হয়ে গেছে।
‘এবার দয়া করে ডিউটিতে যাও—।’ ঠান্ডা গলায় চিফ বলল।
লোকটা খাঁচা থেকে ছাড়া পাওয়া ইঁদুরের মতো পালাল।
চিফ তাকাল রূপকথার দিকে। রূপকথা আবার বলল, ‘আমাকে এই পেশেন্টের সঙ্গে থাকার পারমিশান দিন, স্যার। প্লিজ…। আমার রিকোয়েস্টটা রাখুন। প্লিজ…।’
‘পেশেন্ট?’ ছোট্ট করে উচ্চারণ করল চিফ, ‘রিকোয়েস্ট? তোমার কত রিকোয়েস্ট রাখব বলো তো, রিমিয়া? তুমি আমার রিকোয়েস্ট রাখো?’
রূপকথা—রিমিয়া—চুপ করে রইল। চিফের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
জিশান চিফকে ভালো করে দেখছিল। এমনিতে লোকটার মুখে শয়তানির ছাপ নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হল ছাপ পড়েছে। হাসলও লোকটা। হাসিতে আশা-প্রত্যাশা।
রূপকথা ঠোঁট কামড়াল : ‘কী রিকোয়েস্ট, বলুন?’
চিফ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর জিশানকে দেখল। মুখে গম্ভীর ভাব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে বলল, ‘পেশেন্টকে নিয়ে এখন যাও—তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব…।’
রূপকথা আর দেরি করল না। জিশানের হাত থেকে গ্লাভস খুলে নিল। তারপর গ্লাভস আর তোয়ালেটা গারমেন্টস বিন-এ ফেলে দিয়ে জিশানকে নিয়ে রওনা হল।
চিফ ওদের চলে যাওয়া দেখছিল। দেখতে-দেখতে মোবাইল ফোন কানে দিল। কারও সঙ্গে কথা বলতে লাগল।
অ্যানালগ জিমের বাইরে এসে ডানদিকের করিডরে ঘুরল মেয়ে। সামনেই একটা ঘর। ঘরের দরজায় সুন্দর করে লেখা : PHYSICAL REDRESSAL। দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে একজন গার্ড। অল্পবয়েসি ছেলে। রোগা চেহারায় বেমানান মোটা গোঁফ। দুটো তরুণ চোখে চনমনে কৌতূহল।
রূপকথা জিশানকে নিয়ে গার্ডের কাছে গেল। আলতো গলায় বলল, ‘পেশেন্ট।’ একইসঙ্গে ইশারা করল জিশানের রক্তাক্ত বাঁ-গালের দিকে।
গার্ড পকেট থেকে একটা রিমোট বের করল। দরজার দিকে তাক করে রিমোটের বোতাম টিপতেই দরজা খুলে গেল। ওরা ভেতরে ঢুকে পড়ল।
রূপকথা জিশানকে জিগ্যেস করল, ‘কষ্ট হচ্ছে?’
জিশান হাসতে চেষ্টা করল : ‘ততটা নয়।’
একটু চুপ করে থেকে তারপর জিগ্যেস করল, ‘আপনার নাম রিমিয়া?’
ঘুরে তাকাল : ‘হ্যাঁ।’
‘অদ্ভুত নাম। অবশ্য আমি অন্য একটা নাম রেখেছি।’
‘কী নাম?’
ততক্ষণে দুজন মেডিক এবং দুজন নার্স ওদের কাছে চলে এসেছে। জিশানকে হাত ধরে নিয়ে গিয়ে একটা সুন্দর বিছানায় বসিয়ে দিয়েছে।
জিশান চারপাশটা জরিপ করে দেখছিল। জায়গাটা আসলে নার্সিংহোম হলেও দেখতে একেবারে আলট্রা-টিপটপ, অন্যরকম।
বিশাল মাপের চৌকোনা ঘর। দেওয়ালের রং হালকা নীল। বিছানাগুলো মেঝেতে লুডোর ছকের ঢঙে ছোট-ছোট বর্গাকারে সাজানো। চারটে বিছানা একটা বর্গক্ষেত্র তৈরি করেছে। এরকম পাশাপাশি দুটো বর্গক্ষেত্রের মাঝে গাঢ় নীল রঙের অ্যাক্রিলিকের পার্টিশান।
বিছানার চাদর কিংবা পিলো কভারের রং দেওয়ালের মতোই হালকা নীল। তবে বেডকভারগুলো সব গাঢ় নীল রঙের।
চার দেওয়ালে প্লেট টিভি আর পেইন্টিং সুন্দর করে সাজানো। একটা টিভি, তারপরই একটা পেইন্টিং—তারপর আবার টিভি। এইরকমভাবে সারিটা চলে গেছে এক দেওয়াল থেকে আর-এক দেওয়ালে।
জিশান লক্ষ করল, পেইন্টিংগুলোর একটাতেও প্রকৃতির ছবি নেই। সবই বিমূর্ত। ছন্নছাড়া রঙের খেলা।
বেশিক্ষণ সময় লাগল না। প্রাথমিক চিকিৎসার ঢঙে জিশানের যত্ন নিল মেডিকরা। ওকে বিছানায় বসিয়ে ওরা ঘিরে ধরেছিল। কাটা জায়গায় ওষুধপত্র লাগিয়ে দেওয়ার পর একজন নার্স একটা স্প্রে-গান তাক করল জিশানের দিকে। বোতাম টিপতেই সাদা ধোঁয়ার মতো স্প্রে ছিটকে বেরোল। বাঁ-রগের কাছে কাটা জায়গাটা পলকে একটা চকচকে সাদা পরদায় ঢেকে গেল।
নার্স মেয়েটি স্প্রে-গানের সুইচ অফ করে বলল, ‘ওয়াটার রেসিস্ট্যান্ট লেয়ার পেস্ট করে দিলাম। স্নান করার সময় জল-টল লাগলেও কোনও প্রবলেম নেই। পারফেক্টলি সেফ। ও.কে.?’
‘ও.কে.। থ্যাংকস।’ ঘাড় নাড়ল জিশান। ওর মনে হল, দপদপানি ব্যথাটা এখনই যেন অনেকটা কমে গেছে।
রূপকথা এতক্ষণ চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। নার্স আর মেডিকদের শরীরের ফাঁকফোকর দিয়ে জিশানকে দেখতে চেষ্টা করছিল।
জিশান বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। ডাক্তার-নার্সদের আর-একবার ধন্যবাদ জানিয়ে রূপকথার কাছে এগিয়ে এল।
এবার ওদের ফিজিক্যাল রিড্রেসাল রুম থেকে বেরিয়ে অ্যানালগ জিমে ঢুকতে হবে। আজকের মতো জিশান হয়তো ব্যায়াম থেকে ছুটি পাবে—তারপর কাল থেকে আবার একই রুটিন। টার্গেট : পিট ফাইট।
কিন্তু ওর রূপকথার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল।
রূপকথা ওর কাটা জায়গাটার দিকে তাকাল। এখন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। চকচকে সাদা প্লাস্টিকের মতন কিছু দিয়ে ঢাকা।
ও জিগ্যেস করল, ‘আর কষ্ট হচ্ছে না তো?’
‘না—।’ মাথা নাড়ল জিশান।
ওরা দরজার দিকে এগোল।
‘আমার কী নাম রেখেছেন বললেন না তো?’ রূপকথা জিগ্যেস করল।
এতক্ষণ ধরে জিশানের কথাটা ও মনে রেখেছে!
জিশান লজ্জা পেয়ে বলল, ‘না, থাক। শুনলে আপনার হাসি পাবে।’
‘হাসতে আমার ভালো লাগে—।’
জিশান চুপ করে রইল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল। রূপকথাকে একপলক দেখে নিয়ে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে বলল, ‘এখানে চাকরি করতে আপনার ভালো লাগে?’
রূপকথা ঘুরে তাকাল। বুঝল জিশান এখন নামটা বলতে চাইছে না। একটু চুপ করে থেকে ভাবল উত্তর দেবে কি দেবে না। তারপর বলল, ‘না—একেবারেই না।’
‘তা হলে করছেন কেন? টাকার জন্যে?’
হাসল রূপকথা : ‘হ্যাঁ—সবাইকে তাই বলি।’
‘আসল কারণটা তা হলে কী?’
আবার তাকাল জিশানের দিকে। চোখের ওপরে কুয়াশা নেমেছে মনে হল যেন। কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই কুয়াশা সরিয়ে রোদের ঝিলিক দেখাল মেয়ে। হাসল।
‘আসল কারণটা সিক্রেট।’
জিশান চুপ করে গেল।
ওরা দরজা খুলে বেরিয়ে এল। বাদামি গ্রানাইটের ওপরে পা ফেলে এগিয়ে চলল অ্যানালগ জিমের দরজার দিকে।
দরজার কাছাকাছি এসে জিশান বলল, ‘আমাকে নিশ্চয়ই এখন আর জিম করতে হবে না…।’
‘না। এখন রেস্ট। আপনার ডেইলি অ্যাসেসমেন্ট ফর্মটায় আমি নোট দিয়ে দিচ্ছি।’
তারপরই কি অ্যানালগ জিম থেকে বিদায়? জিপিসি-র গেস্টহাউসে চলে যেতে হবে? ভাবল জিশান। রূপকথার সিক্রেট কারণটা ওর জানতে ইচ্ছে করছিল। তার সঙ্গে ‘রূপকথা’ নামটাও বলতে ইচ্ছে করছিল।
অ্যানালগ জিমে ঢুকল ওরা। রূপকথা জিশানকে নিয়ে গেল ওর টেবিলের কাছে। বিমূর্ত জ্যামিতি দিয়ে তৈরি একটা সুন্দর চেয়ার দেখিয়ে বলল, ‘বসুন। ফর্মটায় নোট দিয়ে দিই…।’
জিশান চারপাশে তাকাল একবার। সবাই ব্যায়াম নিয়ে ব্যস্ত। ডিসিপ্লিন। এখানে ডিসিপ্লিনই প্রথম এবং শেষ কথা। ও চুপচাপ বসে রইল।
রূপকথা কাজ করছিল, জিশান ওকে মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগল। এই নিউ সিটিতেও স্বপ্ন নিয়ে বাঁচা যায়। শুধু স্বপ্নকে আঁকড়ে থাকার গোপন কৌশলটা জানতে হয়।
জিশান এক অদ্ভুত দোটানায় পড়ে গেল। একদিকে নিষ্ঠুর বাস্তব—হাই রিসক রিয়্যালিটি গেমস। আর-একদিকে স্বপ্ন আর প্রকৃতি। ওর মনে হল, আকাশের সুন্দর চাঁদ, তারা, সূর্য যেমন সত্যি, ওই লাল-নীল আলো ছড়ানো অশুভ ধূমকেতুগুলোও সত্যি।
এই জিপিসি-তে আসার পর থেকে জিশান রোজ বদলাচ্ছে। মানুষ থেকে গুটিগুটি করে হেঁটে চলেছে অমানুষের দিকে। এটা ওর পছন্দ নয়। কিন্তু যদি ও না বদলায় তা হলে কিল গেম জেতার জন্য তৈরি হবে কী করে? বাঁচবে কী করে? আগে তো ও বাঁচুক—তারপর বাঁচার মতো বাঁচতে চেষ্টা করবে।
মিনির কথা মনে পড়ল জিশানের। ওর মধ্যেও সেই একই টানাপোড়েন। যেরকম স্বামীকে ও চায় না, কখনও চায়নি, স্বামী যদি সেরকম না হয় তা হলে স্বামীকে ও আর কখনও ফেরত পাবে না। মানুষটাকে ফেরত পাওয়ার জন্যই মানুষটাকে অমানুষ হতে হবে।
‘কী ভাবছেন?’
জিশানকে আনমনা দেখে রূপকথা জিগ্যেস করল।
জিশান তাকাল ওর দিকে। ছোট্ট করে হেসে বলল, ‘সিক্রেট।’
‘প্রতিশোধ নিলেন?’
‘না—তা না। বলব—যদি আপনারটা বলেন।’
‘আর আপনার রাখা নামটা?’
‘সেটাও বলব।’
‘গিভ অ্যান্ড টেক?’
‘জানেন, রিমিয়া, আমাদের ওল্ড সিটিটা একসময়ে গিভ অ্যান্ড গিভ ছিল। ওখানকার সিনিয়ার সিটিজেনদের কাছে শুনেছি। এখন ব্যাপারটা ঘেঁটে গেছে। আর আপনাদের এই নিউ সিটি? মোস্টলি টেক অ্যান্ড টেক। গিভ বলতে এরা টাকা ছাড়া আর কিছু বোঝে না।’
‘কেন, আমার সিক্রেটটা বললে আপনি বুঝি আমাকে টাকা দেবেন?’
‘না, আপনার কথা বলছি না। আপনি আলাদা।’
জিশান রূপকথাকে দেখল। রূপকথাও তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
কয়েকসেকেন্ড পর হেসে ফেলল দুজনেই।
জিশান বলল, ‘আপনার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলে ভালো হত। এখানে কোথাও চা-কফি পাওয়া যায়? আপনাদের ক্যান্টিন নেই?’
‘আছে। ক্যান্টিন নয়—ফুড প্লাজা। এমপ্লয়িদের জন্যে। কোনও গেস্ট সঙ্গে থাকলে স্পেশাল পারমিশান করাতে হয়—সেকশনাল চিফের কাছ থেকে। চলুন, যাবেন?’ রূপকথার চোখে খুশি।
জিশানও চাইল, আজ কিছুটা সময় অন্তত অন্যরকমভাবে কাটুক।
রূপকথা টান-টান হয়ে দাঁড়াল। বোধহয় কোনও লড়াইয়ের জন্য মনে-মনে নিজেকে তৈরি করল। মোবাইল ফোন বের করে পটাপট বোতাম টিপল, ফোন কানে চেপে ধরল।
‘স্যার, রিমিয়া হিয়ার।’
… … …
‘আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। আপনি জিমের কোথায় আছেন?’
… … …
‘আমি এখুনি যাচ্ছি—।’
কানেকশান কেটে দিয়ে জিশানকে তাড়া দিল রিমিয়া : ‘শিগগির চলুন। চিফ ইনস্ট্রাকটর একেবারে লাস্টের সোলো জিমের কাছে আছে। আপনি সঙ্গে না গেলে হবে না। আপনার স্মার্ট কার্ডের নাম্বারটা চিফের লাগবে…।’
তাড়াতাড়ি পা ফেলে ওরা দুজন পৌঁছে গেল চিফের কাছে।
চিফ ইনস্ট্রাকটর একটা ছোট্ট কিউবিকল-এ বসেছিল। একটা হেক্সাগনাল শেপের ট্রান্সপ্যারেন্ট সিপিং ওয়াটার বটল থেকে সিপ করে জল খাচ্ছিল। রূপকথাকে দেখে বাঁকানো সিপারটা ঠোঁট থেকে সরিয়ে নিল। সিপিং ওয়াটার বটলটা সামনের টেবিলে রাখল। কপালে ভাঁজ ফেলে ভুরু কুঁচকে চোখের ইশারায় বলতে চাইল, ‘কী ব্যাপার?’
‘একটা রিকোয়েস্ট আছে।’
‘আবার রিকোয়েস্ট?’ ভুরু আরও কুঁচকে গেল।
‘হ্যাঁ—এই রিকোয়েস্টটা রাখুন। আমিও আপনার রিকোয়েস্টের ব্যাপারে সিরিয়াসলি ভাবব।’ রূপকথার কথাগুলো কেমন কাঠ-কাঠ শোনাল। কিন্তু ও ঠোঁটে হাসছিল।
এটাই তা হলে লড়াই? এর জন্যই ও একটু আগে মনে-মনে নিজেকে তৈরি করছিল! ভাবল জিশান।
চিফের ঠোঁটে হাসি তৈরি হল। গালের পেশি নড়াচড়া করল। জিশানের দিকে একবার দেখল। তারপর হঠাৎ হাত বাড়িয়ে রূপকথার গালে আঙুল ছোঁয়াল। আলতো করে বলল, ‘আই ফিল ফর য়ু, রিমিয়া। সেই ফিলিংটা তোমার কাছে এক্সপ্রেস করতে চাই। আই হোপ য়ু নো দ্যাট—ডোন্ট য়ু?’
রিমিয়া রোবটের মতো হাসল। ওর ঠোঁটের চামড়া যেন মোটা প্লাস্টিকের তৈরি। চোখের তারায় কোনও আলো নেই।
‘জানি, স্যার। আই ডু রেসপেক্ট ইয়োর ফিলিং…।’
‘থ্যাংকস।’ চিফ বড় করে হাসল : ‘এবার বলো, তোমার কী রিকোয়েস্ট আমি রাখতে পারি।’
রূপকথা তখন বলল যে, জিশানকে নিয়ে ও ফুড প্লাজায় বসে একটু কফি খেতে চায়। বড়জোর আধঘণ্টা। কারণ কথায়-কথায় ও জানতে পেরেছে যে, জিশান ওর হাজব্যান্ডের বন্ধু।
হাজব্যান্ড? জিশান অবাক হল। ওর হাজব্যান্ডের বন্ধু জিশান!
রূপকথা জিশানের দিকে একবারও তাকায়নি। ও তখন ওর রিকোয়েস্টের সঙ্গে মিষ্টি হাসি মাখিয়ে দিতে ব্যস্ত।
কাজ হল খুব তাড়াতাড়ি। চিফ জিশানের স্মার্ট কার্ডটা চেয়ে নিল। পার্টিসিপ্যান্ট আই-ডি নম্বরটার দিকে তাকিয়ে মনে-মনে ওটা বোধহয় কয়েকবার আওড়ে নিল। তারপর মোবাইলের বোতাম টিপে কাকে যেন ফোন করল। লাইন পেয়ে গেল কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই। কথা বলতে লাগল : ‘…হ্যাঁ, অ্যানালগ জিমের রিমিয়া। এমপ্লয়ি কোড সি-ওয়ান ওয়ান টু সেভেন ফাইভ। ও ফুড প্লাজায় যাচ্ছে। সঙ্গে একজন গেস্ট। পার্টিসিপ্যান্ট। আই-ডি নাম্বার পি-টু সেভেন ওয়ান থ্রি ফোর ফোর ফোর—হ্যাঁ, ট্রিপল ফোর। একটু আগে মেডিকেল ট্রিটমেন্টহয়েছে। ওরা ফুড প্লাজায় থাকবে আধঘণ্টা—একজ্যাক্টলি হাফ অ্যান আওয়ার—থারটি মিনিটস। নট মোর দ্যান দ্যাট। প্লিজ অ্যালাও। ও.কে.?’
ওপাশ থেকে কিছু একটা শুনল চিফ। তারপর ফোন কেটে দিয়ে রিমিয়ার চোখে তাকিয়ে চওড়া হাসল। রিমিয়ার গাল টিপে দিল ছোট্ট করে : ‘কী, স্যাটিসফায়েড?’
‘থ্যাংক য়ু, স্যার।’
‘ও.কে.। বাট রিমেমবার—থারটি মিনিটস। অলসো রিমেমবার মাই রিকোয়েস্ট।’
‘অফ কোর্স, স্যার।’ হাসল রিমিয়া। তারপর জিশানকে ডেকে নিয়ে রওনা হল।
রূপকথা খুব তাড়াতাড়ি পা ফেলে হাঁটছিল। জিশানও ওর পিছন-পিছন তাল মিলিয়ে হাঁটা দিল। ওর মাথার মধ্যে তখনও ‘হাজব্যান্ড’ শব্দটা ঘুরপাক খাচ্ছিল।
অ্যানালগ জিমের চেঞ্জ রুমে গিয়ে জিশান জিম ভেস্ট ছেড়ে একটা টি-শার্ট পরে নিল। বাইরে আসতেই বোঝা গেল সূর্য আকাশে ঠিকঠাক আলো দিচ্ছে। কারণ জিমের ভেতরে, এমনকী ফিজিক্যাল রিড্রেসাল ইউনিটেও, দিনের আলোর কোনও জায়গা নেই। তার বদলে হাইটেক ইলিউমিনেশান টেকনিক নকল আলোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রেখেছে।
গায়ে রোদ লাগতেই জিশানের ভালো লাগল। গরমে বিরক্ত হওয়ার কথা ও ভুলে গেল।
ওরা মসৃণ রাস্তা ধরে হাঁটছিল। এ-রাস্তা শুধু হাঁটার জন্য। কারণ, রাস্তার দুপাশে ইংরিজিতে লেখা সাইনবোর্ড : WALKERS ONLY। তার নীচে একটা গাড়ির ছবি। তার ওপরে লাল রঙের ‘X’ চিহ্ন আঁকা।
রাস্তার দুপাশে সবুজ লন। লনে মিহি পালকের মতো ঘাস। দেখে মনে হয় সবুজ ভেলভেট। বা অনেকগুলো বাচ্চা টিয়াপাখি চুপ করে শুয়ে আছে।
কিন্তু এর নীচেই হয়তো লুকোনো রয়েছে রুক্ষ পাথর। জিশান ভাবল। এখানে বাইরের চেহারার সঙ্গে ভেতরের চেহারার এত গরমিল!
জিশান রিমিয়ার পাশে-পাশে হাঁটছিল। চাপা গলায় বলল, ‘চিফ ইনস্ট্রাকটর লোকটা সুবিধের নয়।’
‘হুঁ।’ ছোট্ট করে জবাব দিল রূপকথা।
‘আপনি ম্যারেড?’ কৌতূহল চাপতে না পেরে জিগ্যেস করল।
‘হুঁ—।’
‘চিফ কীসব ফিলিং-টিলিং-এর কথা বলছিলেন…।’
রূপকথা ইশারায় জিশানকে চুপ করতে বলল। আঙুল তুলে দেখাল সামনেই ফুড প্লাজা। বিল্ডিং-এর গায়ে সিন্ডিকেটের লোগো। সুদৃশ্য গেটের সামনে পিস ফোর্সের দুজন গার্ড দাঁড়িয়ে।
রূপকথা এগিয়ে গিয়ে একজন গার্ডের সঙ্গে কথা বলল। তারপর জিশানকে ইশারায় কাছে ডেকে দরজার স্লটে নিজের স্মার্ট কার্ডটা সোয়াইপ করল।
ওরা ভেতরে ঢুকল।
ঢুকেই একটা ধাক্কা খেল জিশান। ভেতরের চেহারাটা যেমন বিচিত্র তেমনই সুন্দর। প্লাজার মেঝেটা ডানদিক থেকে সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ক্রমশ ওপরে উঠে গেছে।
জিশান গুনল। পাঁচটা পাক—পাঁচটা লেয়ার। লেয়ারের নতি কোণ এতই কম যে, সিঁড়ির ধাপের কোনও দরকার হয়নি।
প্লাজার দু-দিকের দেওয়াল স্বচ্ছ প্লাস্টিক কিংবা কাচ দিয়ে তৈরি। সেটার রং সামান্য নীল হওয়ায় রোদের তেজ কমানোর কাজ যেমন হয়েছে, তেমনই ভেতরে একটা নীল মায়া ছড়িয়ে দেওয়া গেছে। তার সঙ্গে রং মিলিয়ে ভেতরের অন্যান্য আলোও নীল।
প্লাজার মাপের তুলনায় লোকজন অনেক কম। তাদের কথাবার্তা এমনই নিচু গলায় চলছে যে, সবমিলিয়ে কোনও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে না। শুধু সাউন্ড সিস্টেমে চাপা মিউজিক বেজে চলেছে। চারদিকে একটা শান্ত আনন্দের ভাব।
রূপকথা জিশানের হাত ধরল। নিচু গলায় বলল, ‘এখানে নানান জায়গায় স্পাই-ক্যামেরা লাগানো আছে। তা ছাড়া প্লেইন ড্রেসে গার্ডরাও ঘোরাফেরা করে। নজর রাখে যে, সিন্ডিকেটের এগেইনস্টে কোনও ছক কষা হচ্ছে কি না। সো বি কেয়ারফুল। আসুন—।’
সেকেন্ড লেয়ারের একটা টেবিলে মুখোমুখি বসল ওরা। চিলিং এসিতে জিশানের একটু শীত-শীত করছিল।
জিশান অবাক হয়ে দেখল, ওদের টেবিলে একটা চৌকোনা অংশে স্নিগ্ধ আলো জ্বলছে। সেখানে অনেকগুলো ব্যাক লাইটেড ছোট-ছোট খোপ—সেই খোপে আই-ফোনের রঙিন আইকনের মতো এক-একটা খাবারের ছবি। ছবির নীচে খাবারের নাম লেখা।
ধোঁয়া ওঠা কফির কাপের ছবিতে আঙুল ছোঁয়াল রূপকথা—দুবার। বলল, ‘অবাক হবেন না। এটাই অর্ডার দেওয়ার সিস্টেম। হাইটেক সব ব্যাপার। এই প্লাজায় যখন যে-যে আইটেম অ্যাভেইলেবল তখন সেইসব খাবারের নাম আর ছবি এই টাচস্ক্রিন অ্যাকটিভেটেড আইকন মেট্রিক্স-এ ফুটে ওঠে। আইকনগুলো টাইম টু টাইম আপডেটেড হয়।’
‘এবার স্টার্ট করুন।’ বলল জিশান, ‘গিভ অ্যান্ড টেক।’
‘না, প্রথমে আপনি। বিকজ য়ু স্টার্টেড দ্য হোল গেম। বলুন, কী নাম রেখেছেন আমার—।’
দাঁত দিয়ে ঠোঁটের কোণ কামড়াল জিশান। একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘বলছি। তবে আগেই বলে রাখছি, ব্যাপারটা স্পোর্টিংলি নেবেন। ও.কে.?’
‘ও.কে.।’ হাসল।
‘নাম রেখেছি রূপকথা। নামটা খারাপ?’
রিমিয়া অদ্ভুত চোখে জিশানের দিকে তাকাল। একটু পরে বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘খুব ভালো নাম। আমি সেদিন আপনাকে বলেছিলাম, রূপকথার মধ্যেই মানুষের আসল জীবন লুকিয়ে আছে। আমরা দেখতে চাই না, তাই দেখতে পাই না।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : ‘সেইজন্যেই এই নাম দিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ।’
টিপটপ ড্রেস পরা একজন বেয়ারা কফি নিয়ে এল। ট্রে থেকে কফির কাপ নামিয়ে দিল টেবিলে।
ফ্রস্টেড ক্রিস্টালের তৈরি কাপ-প্লেট। তার মধ্যে নীল আর গোলাপি রঙের ছটা।
বেয়ারা চলে যেতেই রূপকথা বলল, ‘অর্কপ্রভও বলত, আমি খুব আজব পাবলিক। সবসময় গল্পের বইয়ের সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে রূপকথার দেশে বাস করি। কোনও বাস্তব বুদ্ধি নেই..। কিন্তু একইরকম দেশে অর্কপ্রভও বাস করত। আমাদের জুটিটা ভারি অদ্ভুত ছিল।
‘কে অর্কপ্রভ?’ কফিতে চুমুক দিয়ে জিশান জিগ্যেস করল। ওর অর্কনিশানের কথা মনে পড়ল—ছেলে শানুর কথা।
‘আমার হাজব্যান্ড—ডেড হাজব্যান্ড।’ মাথা নিচু করল রিমিয়া। ওর কফির কাপটাকে গভীর মনোযোগে পরীক্ষা করতে লাগল। জিশান ওর চোখ দেখতে পাচ্ছিল না।
হঠাৎই কফির কাপের ওপারে জলের ফোঁটা পড়ল।
‘সরি, রিমিয়া। আমি আপনাকে হার্ট করতে চাইনি। আই অ্যাম রিয়েলি সরি।’
মুখ তুলল। হাসছে। কিন্তু চোখের কোণে জলের কণা।
‘আপনার হাজব্যান্ড কবে মারা গেছেন?’
‘বেশিদিন নয়।’ রুমাল বের করে চোখের কোণে চেপে ধরল: ‘অ্যাবাউট ফোর মান্থস…।’ স্কার্টের পকেটে রুমাল রেখে দিল।
‘কী হয়েছিল?’
.
০৬.
জোর করে হাসল রূপকথা। মাথা ঝাঁকিয়ে কফির কাপে চুমুক দিল। জিশানের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ‘বললে আপনি বিশ্বাস করবেন না। ও এখানকার কমপিটিশানে নাম দিয়েছিল। হাংরি ডলফিন। গেমটার নাম শুনেছেন তো?’
জিশান মাথা নাড়ল : হ্যাঁ, শুনেছে। শুধু শুনেছে নয়, গেমটার ভিডিয়ো রেকর্ডিংও টিভিতে দেখেছে।
‘…তো সেই গেমটায় হাঙরের পেটে চলে গেল। হাঙরটাকে ডলফিন ভেবে ভুল করল। ব্যস, এন্ড অফ দ্য গেম…।’
কিছুক্ষণ ওরা দুজনেই চুপ করে রইল। শুধু কফির কাপে চুমুকের শব্দ শোনা যেতে লাগল। সাউন্ড সিস্টেমের মিউজিকটাকে দু:খের সুর বলে মনে হচ্ছিল।
ধীরে-ধীরে পুরো গল্পটা শুনল জিশান।
অর্কপ্রভ ওল্ড সিটি থেকে এসেছিল। রিমিয়া তখনও এই অ্যানালগ জিমেই চাকরি করত। সেখানেই অর্কর সঙ্গে আলাপ।
অর্ক পড়াশোনা জানা ব্রাইট ইয়াং ম্যান ছিল। অনেক বিষয়ে খোঁজখবর রাখত। ওল্ড সিটিতে সাঁতারে বহুবার ফার্স্ট হয়েছে। ওর ভেতরে একটা চ্যালেঞ্জার পারসোনালিটি ছিল। আর সবচেয়ে বড় কথা, ওরা ছিল ভীষণ গরিব। তাই হাংরি ডলফিন।
জিপিসি-তে অর্কপ্রভ ছিল একমাস মতন। তার মধ্যেই রিমিয়ার সঙ্গে পরিচয়, দুরন্ত আলাপ—এবং বিয়ে।
ওকে বিয়ে করতে চেয়ে শ্রীধর পাট্টার কাছে অ্যাপিল করেছিল রিমিয়া। সিন্ডিকেটের অনুমতি না পেলে কোনও এমপ্লয়ির সঙ্গে কোনও পার্টিসিপ্যান্টের বিয়ে মানে একটা ক্রাইম। সোজা কথায় পারমিশান ছাড়া এ ধরনের বিয়ে অসম্ভব।
শ্রীধর অনুমতি দিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে এও বলেছিলেন, অর্কপ্রভর নাম হাংরি ডলফিন গেম থেকে কিছুতেই উইথড্র করা যাবে না।
অর্কটা বোধহয় কিছুটা পাগল ছিল। কোনও নেগেটিভ ব্যাপারকে ও পাত্তা দিত না। সবসময় বলত, ‘রিমিয়া, আমি জিতব। জিতবই।’
প্রথম কয়েকটা ছোটখাটো গেম-এ জিতে প্রাইজ মানি পেয়েছিল অর্ক। সেইসব টাকা ও রিমিয়াকে দিয়েছিল। রিমিয়া আর ও মিলে রিমিয়ার কোয়ার্টার সাজাতে শুরু করেছিল সংসার পাতবে বলে।
অর্ক বলত, ‘হাংরি ডলফিন গেমটায় জিতলে বিশ লাখ টাকা! ভাবা যায়? বিশমিনিটে বিশলাখ। আর বিশমিনিটের আগে খাঁচা থেকে বেরিয়ে এলে একলাখ টাকা পার মিনিট। আমরা সত্যিকারের বড়লোক হয়ে যাব, রিমিয়া! ক্যান য়ু বিলিভ ইট?’
অর্ক খুব অপটিমিস্ট ছিল।
কিন্তু হাংরি ডলফিন গেম ওকে শেষ করে দিল। ডলফিনের ছদ্মবেশ নেওয়া টাইগার শার্কের ঝাঁক ওকে খতম করে দিল। একইসঙ্গে ওর স্বপ্নও খতম।
কথা বলতে-বলতে পকেট থেকে আবার রুমাল বের করল রিমিয়া। চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, ‘অর্ক চলে যাওয়ার পর থেকে আমি আরও বেশি করে স্বপ্ন দেখি। জোর করে স্বপ্ন দেখি। তাই ভালো না লাগলেও এই চাকরিটা আমি ছাড়িনি। সবসময় ভাবি, অর্ক আমাকে এই স্বপ্ন দেখার বিরাট দায়িত্বটা দিয়ে গেছে। আমাকে স্বপ্ন দেখতেই হবে। সব্বাইকে উইশ করতে হবে। সব্বাইকে জেতাতে হবে—শুধু ইচ্ছে দিয়ে জেতাতে হবে। আমি পারব না?’
শেষ প্রশ্নটা জিশানকে লক্ষ্য করে।
জিশানের খারাপ লাগছিল। অর্কপ্রভকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল ও। জিশান যেন পিট ফাইট-এ লড়ছে আর দর্শকের ভিড়ে দাঁড়িয়ে অর্ক আর রূপকথা ওকে পাগলের মতো চিয়ার করছে, চেঁচাচ্ছে তারস্বরে : ‘জি—শান! জি—শান!’
‘আমি পারব না, জিশান?’ রূপকথা আবার জিগ্যেস করল।
জিশান ঘাড় হেলাল। আলতো করে বলল, ‘পারবেন। আপনি পারবেন।’
নাক টানল রিমিয়া। ছোট্ট করে কেশে নিয়ে বলল, ‘এই চাকরির যে কী অসুবিধে তা তো আপনি খানিকটা দেখেছেন। চিফের ওই হতচ্ছাড়া রিকোয়েস্ট। আমার হাজব্যান্ডের মৃত্যুতে উনি নাকি সাংঘাতিক মুষড়ে পড়েছেন। তাই ওঁর ফিলিং এক্সপ্রেস করতে আমার কোয়ার্টারে আসতে চান। আপনি বলুন তো, জিশান, আমি সবসময় কী নিয়ে ভাবি, আর ওই লোকটা কী নিয়ে ভাবে! ও ভাবে আমি সবার গায়ে পড়া। পার্টিসিপ্যান্ট দেখলেই আমার চোখ দিয়ে লালা ঝরে। থু:।’ মাথা ঝাঁকাল রিমিয়া। একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আসলে সবাইকে আমি অর্কপ্রভ ভাবি। তাই সবাইকে আমি জেতাতে চাই। এটা কি চিফ কখনও বুঝতে পারবে? ওর চিন্তা এত নোংরা, এত ছোট…।’
জিশান নতুন চোখে রূপকথাকে দেখছিল। পিট ফাইটে জিততে হলে এইরকম একজন সাপোর্টার ভীষণ দরকার। জিশানের চোখে রূপকথার বাইরের সুন্দর আর ভেতরের সুন্দর একাকার হয়ে যাচ্ছিল।
ও এবার মিনির কথা বলল রিমিয়াকে। বলল ছোট্ট শানুর কথা।
রিমিয়া মন দিয়ে শুনল। বলল, ‘কাল আমাকে ওদের ফটো দেখাবেন?’
‘দেখাব।’ জিশান জানে মাইক্রোভিডিয়োফোন থেকে কীভাবে ছবি স্টোর করা যায়। তারপর ইউ. এস. বি. কেবল দিয়ে ওর ঘরে রাখা টার্মিনাল থেকে সহজেই তার প্রিন্ট বের করা যায়।
কথা বলার ফাঁকে-ফাঁকে হাতঘড়ির দিকে বারবার তাকাচ্ছিল রিমিয়া। হঠাৎই ও বলল, ‘আমাদের হাতে আর দেড়মিনিট আছে…।’ এবং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
ওরা স্পাইরাল বেয়ে নেমে এল। ক্যাশ কাউন্টারে এসে স্মার্ট কার্ড সোয়াইপ করে বিল মেটাল রিমিয়া।
ফুড প্লাজার দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় ও জিগ্যেস করল, ‘কবে আপনার পিট ফাইট?’
‘আর সাতদিন পর—এই রোববারের পরের রোববার।’
‘আমি ওটা দেখতে যাব। চিফ ইনস্ট্রাকটরকে বলে স্পেশাল লিভের ব্যবস্থা করব। চিফের রিকোয়েস্ট রাখব এই আশায় চিফ আমার অনেক রিকোয়েস্ট রাখে। বোধহয় ছুটি পেয়ে যাব।’
ওর দিকে তাকিয়ে হাসল জিশান। বলল, ‘আপনি দেখতে গেলে আমার খুব জিততে ইচ্ছে করবে।’
•
পিট ফাইটের গর্তটার কাছে পৌঁছে জিশান দৃশ্যটাকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করল।
এই সাতদিনে পিট ফাইট নিয়ে আরও অনেক কিছু জেনেছে ও। এখন সেই তথ্যগুলোর সঙ্গে বাস্তবটাকে মনে-মনে যোগ করছিল।
নানানজনের মুখে ও শুনেছিল পিট ফাইটের বাঁধাধরা কোনও সময় নেই—দিনের যে-কোনও সময় হতে পারে। কিন্তু এখন যখন ওর নিজের লড়াইয়ের পালা এসেছে তখন ও এই প্রথম জানল পিট ফাইট রাতেও হতে পারে। যেমন, ওর লড়াই শুরু হবে ঠিক রাত একটায়।
এই রাতটাকে জিশান অন্য চোখে দেখছিল।
পিস ফোর্সের গার্ডের দল রাত ঠিক বারোটায় ওকে গেস্টহাউস থেকে নিতে এল। গার্ডরা ওর ঘরের কম্পিউটার টার্মিনাল অ্যাক্টিভেট করে দিতেই শ্রীধর পাট্টার ছবি ফুটে উঠল। সেইসঙ্গে জিশানের প্রতি নির্দেশও শোনা গেল : ‘বাবু জিশান, কুইক। চটপট রেডি হয়ে নাও। কাম, কাম—ওয়েলকাম টু স্টেডিয়াম। পিট ফাইট। সি য়ু…।’
জিশানের ভেতরটা জ্বালা করে উঠল। কিন্তু ও ব্যস্তভাবে তৈরি হতে লাগল।
জিপিসি-র গেস্টহাউস থেকে কিউ-মোবাইলে রওনা হওয়ার সময় জিশান আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। সেই একই আকাশ। একই চাঁদ-তারা, ধূমকেতুর একই লাল-নীল রঙিন আলো। তবু আজকের রাতই ঠিক করে দেবে কাল সকালে সূর্য ওঠা জিশান দেখবে কি না।
পিট ফাইটের স্টেডিয়ামটা জিশানকে অবাক করল। ছোট মাপের আধুনিক স্টেডিয়াম। মেটাল-হ্যালোজেন ল্যাম্পের আলো রাতকে দিন করে দিয়েছে। স্টেডিয়ামের ঠিক মাঝখানে তিরিশ ফুট ব্যাসের একটা গর্ত। গর্তটা মোটেই আধুনিক নয়। গোল করে কবর খুঁড়লে যেরকম কাদা-মাটির জমি পাওয়া যায়, ব্যাপারটা ঠিক তাই।
স্টেডিয়ামে এখনও দর্শক ঢোকানো শুরু হয়নি। পিস ফোর্সের চারজন গার্ড ফাঁকা স্টেডিয়ামে জিশানকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে সবকিছু দেখাচ্ছিল। তার মধ্যে যে নেতা গোছের সে জিশানকে গাইডের ট্যুরের ধারাবিবরণী শোনাচ্ছিল।
গর্তটা প্রায় দশফুট গভীর। তার ভেতরে নামার কিংবা বেরিয়ে আসার কোনও ব্যবস্থা নেই। আর খালি হাতে গর্তের খাড়া দেওয়াল বেয়ে ওঠার চেষ্টা করাটা স্রেফ বোকামি। তা সত্বেও যদি কেউ ভাগ্যের জোরে গর্তের কিনারায় হাত ছোঁয়াতে পারে তা হলে তার কপালে জুটবে ইলেকট্রিক শক—একহাজার ভোল্টের। কারণ, একটা সরু তার গর্তের কিনারায় ছোট-ছোট পোর্সিলেন বুশিং-এর ওপরে বসানো রয়েছে। ঠিক যেন একটা তারের পাঁচিল।
জিশান কমেন্টেটর গার্ডকে জিগ্যেস করল, ‘কার সঙ্গে আমার লড়াই?’
গার্ড বলল, ‘জানি না। ওটা শেষ মুহূর্তে সিন্ডিকেটের মার্শাল ঠিক করবেন।’
শ্রীধর পাট্টা ঠিক করবেন জিশানের প্রতিদ্বন্দ্বী!
জিশান একটু অবাক হল। এই যে গার্ডরা ওকে স্টেডিয়াম এবং যুদ্ধের জায়গাটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাচ্ছে, সেরকম তো দেখানো উচিত ওর প্রতিদ্বন্দ্বীকেও! তা হলে তাকে কখন দেখানো হবে?
সে-কথাই ও গার্ডকে জিগ্যেস করল।
উত্তরে হাসল গার্ড : ‘তোমার মতো আরও দুজনকে এরকম ঘুরিয়ে দেখানো হবে। একজন-একজন করে। অনেক সময় কী হয়, পিট ফাইটে নামার ঠিক আগে অনেকে ভয় পেয়ে যায়। প্যান্টে হিসি করে ফ্যালে। একবার তো একজন ফাইটার গর্তে নামার আগে পটি করে ফেলেছিল—’ জোরে হেসে ফেলল গার্ড। ওর তিনজন সঙ্গীও ছোট করে হাসল।
গার্ড বলে চলল, ‘তোমার বেশ কয়েকটা সাইকোলজিক্যাল টেস্ট হয়েছে না?’
জিশান মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, হয়েছে। তবে টেস্টের কারণ জিশানকে বলা হয়নি।
‘সেই টেস্টগুলো থেকে বোঝা যায় কার নার্ভ কতটা স্ট্রং। তুমি ওইসব টেস্টে ঠিকঠাক পাশ করে গেছ। তোমাকে নিয়ে কোনও প্রবলেম নেই। যারা পাশ-ফেলের বর্ডারে থাকে তাদের নিয়েই যত প্রবলেম। তবে তাদের কেউ-কেউ টিকে যায়। পিট ফাইটে নামে। অনেক সময় লাকের জোরে জিতেও যায়। আবার কারও-কারও ব্রেকডাউন হয়ে যায়। কান্নাকাটি করে। প্যান্টে ওইসব করে ফ্যালে। সেইসব ক্যান্ডিডেটকে নামালে লড়াই জমে না। তখন…।’
তখন কী হবে জিশান জানে।
স্টেডিয়ামে দর্শক হবে না। টিকিট বিক্রি হবে না। লাইভ টেলিকাস্ট জমবে না। বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া রেভিনিউ অনেক কমে যাবে।
তা হলে কে-কে নামবে জিশানের এগেইনস্টে? সাইকোলজিক্যাল টেস্টগুলোয় আর কে ঠিকমতো পাশ-টাশ করেছে?
জিশান স্টেডিয়ামটা ভালো করে দেখছিল। বড়জোর দশহাজার দর্শকের জায়গা হতে পারে সেখানে। স্টেডিয়ামের চারদিকে একইরকম ডিজাইনের শৌখিন চেয়ার জ্যামিতিক ঢঙে সাজানো। তবে স্টেডিয়ামের এক-এক অংশে চেয়ারের রং এক-একরকম। সাদা, নীল, কমলা, সবুজ, আকাশি আর লাল।
এখন সব চেয়ার খালি। তবে একটু পরেই ভরতি হয়ে যাবে। পিট ফাইট স্বচক্ষে দেখার জন্য নিউ সিটির বাসিন্দাদের আগ্রহ কম নয়। কারণ, সুপার গেমস কর্পোরেশনের এই একটিমাত্র খেলাই গ্যালারিতে বসে দেখা যায়, ঠিকমতো এনজয় করা যায়। এই খেলাটা দেখার জন্য মানুষের আগ্রহ যে ফেটে পড়ে তার কারণ, সবাই জানে এর পরের ধাপই হল কিল গেম। যে-গেম-এর প্রাইজ মানি একশো কোটি টাকা। সেই গেম-এর খেলোয়াড়কে আগাম দেখা, এবং খালি হাতে লড়তে দেখা, কিছু কম উত্তেজনার ব্যাপার নয়।
পিট ফাইট যাতে দর্শকরা ভালোভাবে দেখতে পায় তার জন্য স্টেডিয়ামের দুপাশে গ্যালারির মাথায় দুটো জায়ান্ট টিভি স্ক্রিন। এ ছাড়া স্টেডিয়ামের বাইরে ভিড় করে থাকা দর্শকদের জন্য আরও দুটো জায়ান্ট স্ক্রিনের ব্যবস্থা করা আছে।
সবমিলিয়ে সবাইকে উত্তেজনার শরিক করে তোলার ব্যাপারে সিন্ডিকেটের বন্দোবস্তের কোনও ঘাটতি নেই।
আলো-ঝলমলে ফাঁকা স্টেডিয়ামটা জিশান ঘুরে-ঘুরে দেখছিল আর কল্পনায় উত্তেজিত দর্শকদের হিংস্র উল্লাসের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল। আধুনিক প্রযুক্তি আর আদিম প্রবৃত্তির কী অদ্ভুত মিলন! একটু পরেই ওই কাদা-মাটির গর্তের মধ্যে একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে জিশানকে মরণপণ লড়তে হবে—জানোয়ারের মতো। যেমন করে হোক বেঁচে থাকতে হবে। তা হলে পাওয়া যাবে প্রাইজ মানি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা, আর একশো কোটি টাকার গেম-এ ঢোকার ছাড়পত্র।
বাইরে থেকে জমায়েত দর্শকদের চিৎকার ভেসে আসছিল। স্টেডিয়ামের গেট এখনও খোলা হয়নি বলে ওরা অধৈর্য হয়ে পড়েছে।
জিশানের গাইডেড ট্যুর শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই গার্ডরা ওকে ফিরিয়ে নিয়ে চলল পিট ফাইট প্যাভিলিয়নে।
প্যাভিলিয়নে এক-একজন পার্টিসিপ্যান্টের এক-একটা আলাদা এয়ারকন্ডিশানড ঘর। ঘরগুলো পার্টিশান ওয়াল দিয়ে এমনভাবে আলাদা করা যে, একজন খেলোয়াড় আর-একজনকে মোটেই দেখতে পাবে না। তবে প্রতিটি ঘরের দরজা দিয়ে বেরোলেই লম্বা করিডর। সাদা গ্রানাইট বসানো সেই করিডর চলে গেছে সোজা স্টেডিয়ামের ভেতরে—গর্তের কাছে।
প্যাভিলিয়নের তিন নম্বর ঘর জিশানের। অন্যান্য ঘরে কারা আছে ও জানে না। ওর ঘরে ফার্নিচার বলতে একটা সোফা, একটা টেবিল, একটা চেয়ার, একটা আয়না, একটা প্লেট টিভি, আর একটা ফ্রিজ। এ ছাড়া ঘরের এককোণে আছে আয়না বসানো একটা মিনি জিম—অনেকটা সোলো জিমের মতো। সেখানে পরীক্ষার আগে শেষ মুহূর্তের পড়ার মতো লড়াইয়ের আগে শেষ মুহূর্তের ব্যায়ামের জন্য হালকা কয়েকটা যন্ত্রপাতি রয়েছে। জিশান পনেরোমিনিটের জন্য গায়ের জামাটা ছেড়ে চেইন-পুলি আর বাটারফ্লাই ক্রাঞ্চ করে নিল। তারপর তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছে চলে গেল উলটোদিকের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা ফ্রিজের কাছে।
ফ্রিজ খুলে দেখতে পেল দু-গ্লাস হেলথ ড্রিংক—ফাইবারের গ্লাসে রাখা। একটা গ্লাস নিয়ে খেয়ে নিল জিশান। ওর পিট ফাইট কোচ খেলার আগে এই ড্রিংক একগ্লাস খেতে বলেছে। এসি থাকায় এই ঘরের মধ্যে গরম কম। বাইরে ওই কাদা-মাটির গর্তের মধ্যে গরম নিশ্চয়ই অনেক বেশি।
খালি গ্লাসটা ফ্রিজের ভেতরে ফিরিয়ে দিল জিশান। ফ্রিজের পাশেই টেবিলে রাখা ছিল একটা গোলাপি রঙের সিপিং ওয়াটার বটল। সিপারে ঠোঁট লাগিয়ে জল খেল ও। তারপর দেওয়ালে টাঙানো পাঁচকোনা আয়নায় নিজেকে একবার দেখল। ওর মনে হল আয়নার ওই পেশিবহুল চেহারাটা যেন অন্য লোকের। আর সেই অচেনা মানুষটার কাঁধের ওপরে জিশানের চেনা মুন্ডুটা বসানো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় বসে পড়ল জিশান। একটু পরেই লড়াই শুরু হবে। বুকের ভেতরে একটা চাপ টের পেল। দম যেন আটকে যেতে চাইছে। এ খেলায় হারলে খেল খতম। আর জিতলেও তাই। মাঝে শুধু কিল গেম-এর ছলনার ব্যবধান।
হঠাৎই হইহই আওয়াজ শুনে চোখ তুলল। তাকাল উলটোদিকের দেওয়ালে টাঙানো প্লেট টিভির দিকে। হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে রিমোট তুলে নিল। ভলিয়ুমটা একটু বাড়িয়ে দিল।
স্টেডিয়ামে দর্শকরা ঢুকতে শুরু করেছে। লাউডস্পিকারে অদ্ভুত একটা মিউজিক বাজছে। একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা কমেন্টেটর তারই মধ্যে বকবক করে চলেছে।
‘…একদিকে রয়েছে জিশান পালচৌধুরী। হাই স্কোরিং ফাইটার। আগের সবক’টা গেম-এ জিশান যে শুধু কোয়ালিফাই করেছে তা নয়—দারুণ স্কোরও করেছে। স্পেশালিস্টদের ধারণা ওর মধ্যে ব্যাপক পোটেনশিয়াল রয়েছে। কিন্তু ওর সঙ্গে কে লড়বে? কে সেই সারপ্রাইজ ফাইটার?’
জিশানের মনে পড়ে গেল মালিকের কথা, ছুন্নার কথা, কার্তিকের কথা, খালধারের সেই অন্ধকার রাতের ফাইটের কথা। টিভির কমেন্টেটরদের কথাবার্তাগুলো যেন খালধারের সেই টিংটিঙে রেফারির সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল।
‘…আপনাদের একটা দারুণ খবর দিই। আজ স্টেডিয়ামে হাজির রয়েছেন আমাদের ক্রিমিনাল রিফর্ম ডিপার্টমেন্টের সম্মানিত মার্শাল শ্রীধর পাট্টা…।’
টিভি ক্যামেরা শ্রীধর পাট্টাকে দেখাল। জোরালো আলো পড়েছে ফরসা ছিপছিপে মানুষটার মুখে। ঠোঁট জোড়া এতই লাল যে, মনে হয় এইমাত্র পান অথবা রক্ত খেয়ে এসেছেন।
‘…সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজ!’ কমেন্টেটর উত্তেজিতভাবে বলল, ‘আমাদের মার্শালের অনারে আজ আসল ফাইটের আগে একটা সারপ্রাইজ ফাইট হবে। ডগ ফাইট।
‘এই ফাইটটার পরেই হবে পিট ফাইট। দুটো ফাইট দেখার পর আপনারা কমপেয়ার করতে পারবেন লড়াইয়ের ব্যাপারে মানুষ এবং কুকুরের মধ্যে কী-কী মিল, আর কী-কী তফাত। ব্যাপারটা কি দারুণ ইন্টারেস্টিং নয়?…তোমার কী মনে হয়, রাজশ্রী?’
মহিলা কমেন্টেটর—যার নাম রাজশ্রী—ধারাবিবরণীর খেই ধরে বলল, ‘ইট ইজ অ্যান একসিলেন্ট আইডিয়া, মণীশ। এরকম কমপ্যারিজন-এর স্কোপ আমরা আগে কখনও পাইনি, তাই না? সো লেট আস ওয়াচ, গাইজ…।’
ক্যামেরা গর্তটাকে বারবার দেখাচ্ছিল। দেখাচ্ছিল স্টেডিয়ামের দর্শকদেরও। এরপর মণীশ আর রাজশ্রী গর্তটার মেক্যানিক্যাল ডেটা টিভির দর্শকদের বলতে শুরু করল। তারই ফাঁকে-ফাঁকে পুরোনো পিট ফাইট-এর ভিডিয়ো ক্লিপিং দেখানো হতে লাগল। গত সাতদিন ট্রেনিং-এর সময় জিশানদের এইসব ফাইটের ভিডিয়ো দেখানো হয়েছে। পিট ফাইট কোচরা ফাইটার তৈরির কাজে সত্যিই আন্তরিক যত্ন নিয়েছেন।
বড় করে শ্বাস ফেলল জিশান। এখন যদি ডগ ফাইট হয় তা হলে বধ্যভূমিতে যেতে জিশানের এখনও কিছুটা দেরি আছে। একইসঙ্গে ওর মনে হল, ওল্ড সিটির জোড়াতালি দেওয়া ঘরে বসে মিনিও নিশ্চয়ই এই লাইভ টেলিকাস্ট দেখছে।
জিশানের হঠাৎ ইচ্ছে হল, এই ডগ ফাইটটা ও লাইভ টেলিকাস্ট-এ নয়—লাইভ দেখবে। কারণ, তার পরের ডিজিটাল লড়াইটার জন্য ওর মনটা আরও হিংস্র আরও নৃশংস হওয়া দরকার। নিজেকে তৈরি করার জন্য ডগ ফাইটের প্রতিটি মুহূর্ত প্রতিটি টুকরো ওকে ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিতে হবে। কিল গেম-এ মারা যাওয়াটা যদি ভবিতব্যও হয়, তা হলেও পিট ফাইটটা জিশান জিততে চায়। কারণ, এই লড়াইটা ও নিজের জন্য নয়—অনেকের জন্য লড়ছে, অনেকের হয়ে লড়ছে।
ডগ ফাইটটা স্বচক্ষে দেখার তেষ্টায় জিশানের বুক হঠাৎ শুকিয়ে গেল যেন। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ও। টেবিলে রাখা ওয়াটার বটল থেকে আবার অনেকটা জল খেল। তারপর দেওয়ালে গাঁথা কলিংবেলের পুশ বাটন-এ চাপ দিল।
কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই কোমরে শকার ঝোলানো একজন গার্ড ঘরে এসে ঢুকল। এই গার্ডকে জিশান আগে দেখেনি।
গার্ড বলল, ‘কী দরকার বলো?’
হঠাৎই হাসি পেয়ে গেল জিশানের। শকার ঝোলানো গার্ডটাকে কেমন জোকারের মতো লাগছে না? ইচ্ছে করলে জিশান লোকটাকে এখুনি স্রেফ একহাতে মেরে ফেলতে পারে। ওর হাত-পাগুলো পাটকাঠির মতো পটপট করে মটকে ভেঙে দেওয়াটাও তেমন কঠিন নয়—তবে তখন আর একহাতে হবে না, দু-হাত লাগবে। তারপর কোথায় শকার, আর কোথায় গার্ড! মেঝেতে সব টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে থাকবে। অথচ গার্ড বেচারা এসব বুঝতেও পারছে না। ভাবছে, শকার কোমরে ঝুলিয়ে ও কত শক্তিশালী!
ওর ভেতরে যে শক্তি টগবগ করে ফুটছে তার বুড়বুড়ির শব্দ পেল জিশান। শক্তিকণাগুলো পাগলের মতো মাথা খুঁড়ছে। বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নিজেদের ব্যবহার করতে চাইছে।
জিশানের পাগল-পাগল লাগছিল। ও গার্ডকে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি স্টেডিয়ামে বসে ডগ ফাইট দেখব—টিভিতে দেখব না।’
গার্ডটা জিশানের মুখের দিকে তাকিয়ে কী বুঝল কে জানে। ‘দেখছি কী করা যায়—’ বলে চট করে চলে গেল।
পাঁচ থেকে দশসেকেন্ডের মধ্যেই গার্ড ফিরে এল। সঙ্গে একটি লম্বা রোগামতন মেয়ে। গায়ে সিন্ডিকেটের ইউনিফর্ম। হাতে একটা মোবাইল। কারও সঙ্গে কথা বলছে।
‘…হ্যাঁ, স্যার। নিয়ে যাচ্ছি। স্পেশাল এনক্লেভে সিট আছে। সেখানেই বসাচ্ছি, স্যার। ও. কে., স্যার…।’
ফোন কেটে দিয়ে জিশানকে লক্ষ করে বলল, ‘চলুন। পারমিশান গ্রান্টেড। লেটস গো—।’
জিশান শার্টটা আবার গায়ে চড়িয়ে নিল। মেয়েটির সঙ্গে ঘরের দরজার দিকে পা বাড়াল।
টিভির পরদায় তখন রাজশ্রী বলছে, ‘শুরু হচ্ছে ডগ ফাইট। দুটো গ্রেট ডেন কুকুরকে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। সঙ্গে তাদের ট্রেনার অভিজিৎ আর কমলেশ্বর। গ্রেট ডেন আসলে ম্যাস্টিফ আর আইরিশ উলফহাউন্ডের ক্রস। এই দুটো ব্লাডলাইন মিশিয়ে ব্রিড করার জন্যে গ্রেট ডেনের সাইজও যেমন বড়, শক্তিও অসাধারণ। সো উই এক্সপেক্ট আ গ্রেট ফাইট। আ গ্রেট সাইট। হোয়াট ডু য়ু সে, মণীশ?’
মণীশ কী বলল সেটা জিশানের আর শোনা হল না। ও আর মেয়েটি তখন নির্জন করিডরে প্রতিধ্বনি তুলে হেঁটে চলেছে।
স্পেশাল এনক্লেভে আকাশি রঙের সিটে জিশানকে বসানো হল। চারপাশের দর্শকদের উত্তেজনার শোরগোলটা যেন মাইকে শোনা মউমাছির গুঞ্জন। একবার চোখ বুলিয়েই জিশান বুঝল দর্শকে স্টেডিয়াম টইটম্বুর। অসম্ভব জেনেও ওর চোখ রিমিয়াকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। চেনার সুবিধের জন্য ও রিমিয়াকে বলেছিল লাল ড্রেস পরে আসতে।
রিমিয়াকে খুঁজে পেল না জিশান। চোখ ফিরিয়ে গর্তের দিকে তাকাল। ওর সিট থেকে গর্তটা ভালোই দেখা যাচ্ছে। আর যেটুকু জ্যামিতির জন্য আড়াল হচ্ছে সেটুকু ষোলোআনার বেশি পুষিয়ে দিচ্ছে জায়ান্ট টিভি স্ক্রিন।
গর্তের কিনারায় দুই বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে অভিজিৎ আর কমলেশ্বর।
অভিজিতের গায়ে টকটকে লাল রঙের ফুলহাতা শার্ট, আর পায়ে কালো প্যান্ট। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে ওর গ্রেট ডেন। লম্বা-চওড়া কুকুর। হালকা বাদামি রং। কান দুটো ভাঁজ হয়ে ঝুলছে। মুখের ডগাটা কালচে। চোয়ালের নীচে চামড়া সামান্য ঝুলে আছে।
কুকুরটার পেটের কাছে দু-দিকেই লাল রঙের একটা করে গোল ছাপ। মাপে টেনিস বলের মতো।
গর্তের ওপারে, অভিজিতের ঠিক বিপরীতে, দাঁড়িয়ে আছে কমলেশ্বর। গায়ে ক্যাটক্যাটে হলদে রঙের শার্ট আর পায়ে কালো প্যান্ট। ওর পাশে দাঁড়ানো গ্রেট ডেনটার পেটে গোল হলদে ছাপ।
লাউডস্পিকারে মণীশ আর রাজশ্রীর ধারাবিবরণী চলছিল। ওরা বলছিল, দুটো কুকুর যেহেতু একইরকম দেখতে সেহেতু কোনটা অভিজিতের আর কোনটা কমলেশ্বরের কুকুর সেটা স্পষ্টভাবে বোঝার জন্যই ওই লাল আর হলদে ছাপ।
দুটো কুকুরের গলাতেই চামড়ার কলার, সঙ্গে স্টিলের চেইন। দুজন ট্রেনারই চেইনটা হাতে পাকিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে। কুকুর দুটো চেইন টেনে সামনে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করছিল। চাপা গর্জন করছিল।
মাইকে কুকুর দুটোর নাম-ধাম পেডিগ্রি শোনা যাচ্ছিল। হলদে ছাপওয়ালা কুকুরটার নাম ইয়েলো, আর অন্যটার নাম রেড। রং অনুযায়ী নাম, অথবা নাম অনুযায়ী রং। ওদের বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। যখনই নিউ সিটিতে কোনও ডগ ফাইটের ব্যবস্থা করা হয় তখন কুকুর আনা হয় বিদেশ থেকে। ফাইটের আগে এখানে ওদের অ্যাক্লাইমেটাইজ করা হয় এবং ট্রেনিং দেওয়া হয়। অভিজিৎ ও কমলেশ্বর খুবই নামি ট্রেনার। ওরা এ-বিষয়ে বিদেশ থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে।
ধারাবিবরণী চলছিল আর টিভি ক্যামেরা বারবার ট্রেনার দুজন এবং কুকুর দুটোর ক্লোজ আপ দেখাচ্ছিল।
হঠাৎই স্টেডিয়ামের দুপাশের একটা ফোকর দিয়ে দুটো ক্রেনের ধাতব বাহু ধীরে-ধীরে বেরিয়ে এল। এসে থামল অভিজিৎ আর কমলেশ্বরের কাছে।
ক্রেনের বাহুর প্রান্তে একটা ছোট কেবিন। দুজন করে গার্ড ছুটে চলে এল কেবিনের কাছে। ট্রেনারকে কুকুরসমেত কেবিনে উঠতে সাহায্য করল। তারপর ক্রেন নিখুঁতভাবে ট্রেনার ও কুকুরকে নামিয়ে দিল গর্তের ভেতরে।
মাইকে তখন রাজশ্রীর গলা : ‘…শুনলে আপনাদের ভালো লাগবে—লড়াইটা যাতে থ্রিলিং হয়, এনটারটেইনিং হয় সেজন্যে ইয়েলো আর রেডকে আজ সারাদিন খেতে দেওয়া হয়নি। সো উই এক্সপেক্ট আ ভেরি থ্রিলিং ফাইট, আ ভেরি এনটারটেইনিং ফাইট, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন…।’
ট্রেনার দুজন কুকুর নিয়ে একইসঙ্গে কেবিন থেকে নেমে গেল গর্তের মাটিতে। কুকুর দুটোকে গর্তের দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড় করাল। গলা থেকে কলার খুলে নিল। খালি হাতে কুকুরটার ঘাড় ধরে রইল। তারপর মাইকে যেই শোনা গেল ‘ওয়ান, টু, থ্রি—স্টার্ট।’ ওমনি কুকুরটার গালে একটা থাপ্পড় মেরে ট্রেনার তার মুখটা সামনে ঘুরিয়ে দিল।
ইয়েলো আর রেড এখন মুখোমুখি। পরমুহূর্তেই দুই ট্রেনার লাফিয়ে উঠে পড়ল যার-যার কেবিনে। এবং ক্রেন কেবিনটাকে টেনে তুলে নিল শূন্যে।
শুরু হয়ে গেল ডগ ফাইট।
দুটো ক্রেন তখন দুজন ট্রেনারকে নিয়ে আগের জায়গায় ফিরে চলেছে।
ইয়েলো আর রেড মুখোমুখি ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু ওদের ধারালো দাঁতের কামড়গুলো মাংস পেল না—পেল বাতাস। তাই চোয়ালের শব্দ হল।
জিশান অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ করল। কুকুর দুটো কোনও শব্দ করছে না। গরগর শব্দও নয়। নি:শব্দে লড়ছে। শব্দহীন যন্ত্রের মতো।
দ্বিতীয়বার যখন ইয়েলো আর রেড পরস্পরের দিকে ঝাঁপাল তখন ওদের মাথায়-মাথায় ঠোকাঠুকি লাগল। ইয়েলো চিত হয়ে ছিটকে পড়ল। রেড হাঁ করে ধেয়ে গেল। কামড় বসাতে চাইল ইয়েলোর গলায়। কিন্তু ইয়েলো ঝটিতি মাথা তুলে রেডের নাকে কামড় বসাল। এবারে মাংসে দাঁত বসেছে।
দর্শক হইহই করে উঠল। মণীশের ধারাবিবরণী থেকে জিশান বুঝল, রেড আর ইয়েলোর মধ্যে কে জিতবে তা নিয়ে দর্শকদের মধ্যে বাজি ধরা শুরু হয়ে গেছে। অন্ধকার খালপাড়ের সেই লড়াই।
রেড তখন ইয়েলোকে ছেঁচড়ে টেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে গর্তের মধ্যে। ওর নাক থেকে কামড় ছাড়াতে চেষ্টা করছে। বারেবারেই মাথা ঝাঁকুনি দিচ্ছে। টিভির ক্লোজ আপে দেখা যাচ্ছে রেডের রক্তাক্ত নাক।
শেষ পর্যন্ত মারাত্মক এক ঝটকায় মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের নাক ছাড়াতে পারল রেড। তবে নাকের খানিকটা অংশ ওকে খোয়াতে হল।
ইয়েলো সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই রেডের ওপরে ঝাঁপাল। ওর হাঁ করা চোয়ালের কাছ থেকে চকিতে মাথা সরিয়ে নিল রেড। ইয়েলোর দাঁতে-দাঁতে ঠোকাঠুকি হল। লালা ছিটকে বেরোল শূন্যে।
টিভি স্ক্রিনের দৌলতে লড়াইয়ের বীভৎস খুঁটিনাটিও নিখুঁতভাবে দেখা যাচ্ছিল। দর্শকরা উত্তেজনায় পাগলের মতো চিৎকার করছিল। অভিজিৎ আর কমলেশ্বর গর্তের কিনারায় ছোটাছুটি করে ঘুরপাক খেয়ে যার-যার কুকুরকে চেঁচিয়ে নানান ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছিল।
রেড ইয়েলোর ডান কানটা কামড়ে ধরল। কামড়ে যে যথেষ্ট জোর ছিল সেটা বোঝা গেল প্রবল ঝাঁকুনির বহর দেখে। চুলের ঝুঁটি ধরে ঝাঁকুনি দেওয়ার মতো রেড ইয়েলোকে যক্ষ্মা-ঝাঁকুনি দিয়ে চলল। ইয়েলোর অতবড় শরীরটা ক্রেনের হুকে ঝোলানো ভেজা তুলোর বস্তার মতো অসাড় হয়ে রইল, লাট খেতে লাগল।
কয়েকটা প্রবল ঝাঁকুনির পর ইয়েলোর কান চলে এল রেডের মুখে। সেখান থেকে টুকরোটা ছিটকে পড়ল ভেজা মাটিতে।
জিশানের গা গুলিয়ে উঠল। মনে হল, এই বুঝি বমি পাবে ওর। ও লড়াই থেকে চোখ সরিয়ে নিল। পরপর কয়েকটা ঢোক গিলে বমির দমকটা সামলে নিল।
টিভির পরদায় ইয়েলোর কানের টুকরোটার ক্লোজ আপ দেখাচ্ছিল। কমেন্টেটরের গলা তখন উত্তেজনায় উঁচু পরদায় পৌঁছে গেছে। মণীশ বলছে, ‘…ওই দেখুন, ইয়েলোর কান। রেড ওর প্রতিদ্বন্দ্বীর কান ছিঁড়ে নিয়েছে। তা হলে বুঝে দেখুন, রেডের দাঁত কত ধারালো, ওর চোয়াল কত শক্তিশালী! গ্রেট ডেন কুকুর বলে কথা! এদের মধ্যে আইরিশ উলফহাউন্ডের জিন রয়েছে….।’
জিশানের মনে হচ্ছিল, ও নিজের লড়াইয়ের ধারাবিবরণী শুনছে। গর্তের মধ্যে যে-জিশান লড়ছে সে অন্য জিশান।
পাবলিকের চিৎকারে জিশানের কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। কুকুর দুটোর রক্তারক্তি লড়াই দেখে তারা সব উত্তেজনার তুঙ্গে। কখনও ‘রেড! রেড!’ চিৎকার শোনা যাচ্ছে, কখনও বা ‘ইয়েলো! ইয়েলো!’
পুরো ব্যাপারটা জিশানকে পুরোনো আদিম ইতিহাসে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। যখন মানুষ আগুন জ্বালতে শেখেনি, চাকা আবিষ্কার করেনি। যখন মানুষ সোজা হয়ে ঠিকঠাক দাঁড়াতেও পারত না।
গর্তের মধ্যে কুকুর দুটো তুলকালাম লড়াই করছিল। এখন ওরা আর চুপচাপ নয়। ওদের গর্জন চিৎকার ইত্যাদি শোনা যাচ্ছে। ওরা শূন্যে লাফিয়ে উঠছে, গায়ে-গায়ে ঠোকাঠুকি খাচ্ছে, গর্তের দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে। ওদের শরীরের নানান জায়গায় কাদার ছোপ আর রক্তের দাগ।
অভিজিৎ আর কমলেশ্বর একনাগাড়ে উত্তেজিতভাবে ছোটাছুটি করছে। চিৎকার করে নিজের-নিজের কুকুরকে নির্দেশ দিচ্ছে। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ওরা গর্তের মধ্যে নেমে পড়বে।
হঠাৎই ইয়েলো প্রবল চিৎকার করে উঠল। জিশান চোখ ফেরাল গর্তের দিকে।
একমুহূর্তের সুযোগে রেড ইয়েলোকে চিত করে ফেলেছে। এবং অলৌকিক ক্ষিপ্রতায় ইয়েলোর পেটে এক ভয়ংকর কামড় বসিয়ে দিয়েছে।
ইয়েলো মাথা তুলে রেডের গলায় কামড় বসাতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু ওর চোয়ালে বোধহয় আর ততটা ক্ষমতা ছিল না। কামড়গুলো রেডের লোমের ওপরে পিছলে যাচ্ছিল।
ততক্ষণে রেড ওর কাজ সেরে ফেলেছে। ইয়েলোর পেটে আরও একটা গভীর কামড় বসিয়েছে এবং চোয়ালের এক হ্যাঁচকায় ইয়েলোর নাড়িভুঁড়ির অনেকটাই বাইরে বের করে ফেলতে পেরেছে।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। আর ইয়েলো যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল।
‘দে, দে—খতম করে দে!’ দর্শকের চিৎকার শোনা গেল।
‘আরে মাথামোটা, গলা কামড়ে ধর!’
‘শাবাশ, রেড! তুই কুত্তার বাচ্চা না—বাঘের বাচ্চা!’
এ ছাড়া সমবেত কণ্ঠে ‘রেড! রেড!’ বলে চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। গোটা স্টেডিয়াম যেন টগবগ করে ফুটছে।
জিশান দেখল, প্রতিটি দর্শক সামনে ঝুঁকে বসেছে। ওদের লালচে মুখে ঘামের বিন্দু। চোখ উত্তেজনায় যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। হিংস্র লালসা ছাপ ফেলেছে চোখে-মুখে। ওরা যেন কয়েকমুহূর্তের জন্য গর্তে নেমে পড়েছে। গ্রেট ডেন কুকুর হয়ে গেছে নিজেরাই। টান-টান উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ উপভোগ করছে—অথচ কোনও যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে না।
ইয়েলোর পাগুলো শূন্যে সাইকেল চালানোর চেষ্টা করছিল। ওর ছটফটানি নিভে আসছিল।
দর্শকদের সমবেত চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।
‘খতম কর! খতম কর! শেষ করে দে!’
‘কিল হিম! কিল হিম!’
ইয়েলোর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু রেড তখনও ওর ছেঁড়া পেটের ফাঁকে মুখ ঢুকিয়ে কী যেন খুঁজে চলেছে।
হঠাৎই তীব্র এক হুইসল শোনা গেল। রাতের বাতাস ছুরি দিয়ে চিরে দিল যেন কেউ। তারপরই মাইকে ঘোষণা শোনা গেল, লড়াই শেষ। রেড জিতেছে।
তখনই ক্রেনের বাহু দুটো স্টেডিয়ামের দু-দিকের সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে এল। দুটো কেবিনে উঠে পড়ল দুই ট্রেনার—কমলেশ্বর আর অভিজিৎ। কেবিন দুটো গর্তের ভেতরে নামতে শুরু করল।
ততক্ষণে টিভির পরদায় ডগ ফাইটের চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেছে। দুজন বিশেষজ্ঞ সুচিন্তিত মতামত দিচ্ছেন। একইসঙ্গে পরের লড়াইটা কার ফেবারে যেতে পারে তা নিয়েও আলোচনা করছেন।
দর্শকদের চিৎকার এখন কমে গেছে। তার বদলে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা আর গুঞ্জন। মাথার ওপরে খোলা আকাশ থাকলেও কেমন যেন একটা গুমোট ভাব জাঁকিয়ে বসেছে। কে জানে বৃষ্টি হবে কি না।
জিশান জায়ান্ট টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েছিল। না, কোনও ফাইটারের নাম ওঁরা বলছেন না। যা বলার জেনারেল টার্মস-এ বলছেন। যেমন, পিট ফাইট জেতার জন্য মেজর ফ্যাক্টরগুলো হল : বডি ওয়েট, স্পিড, হাইট, রিচ, স্কিল, মাসল পাওয়ার আর সাইকোলজিক্যাল স্টেবিলিটি। আর এগুলোর মধ্যে শেষেরটাই সবচেয়ে জরুরি।
টিভি ক্যামেরা এবার গর্তের ক্লোজ আপ দেখাল।
রেড এখনও ইয়েলোকে নিয়ে ব্যস্ত। অভিজিৎ ওর কাছে গিয়ে ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে একটু আদর করল। তারপর টেনে সরিয়ে নিয়ে এল। কমলেশ্বরকে বলল, ‘আপনার কুকুরটা এখনও বেঁচে আছে।’
কমলেশ্বর অভিজিতের কথার কোনও জবাব দিল না।
রেড অভিজিতের পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল। সারা গায়ে দাঁত-নখের চিহ্ন, রক্তের দাগ। ওর দিকে একবার তাকাল কমলেশ্বর। তারপর নিজের হেরে যাওয়া গ্রেট ডেনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে কার সঙ্গে যেন দশ-পনেরো সেকেন্ড কথা বলল।
কথা শেষ হতেই ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা রিভলভার বের করে নিল কমলেশ্বর। ডাবল অ্যাকশন 0.44 ম্যাগনাম। স্টেইনলেস স্টিলের লম্বা নল। স্যান্টোপ্রিন-ওয়ান-এর তৈরি কালো গ্রিপ।
ইয়েলোর মাথা তাক করে পরপর তিনবার গুলি করল। ইয়েলোর শূন্যে উঠে থাকা পাগুলো একটুও কাঁপল না—শুধু একপাশে কাত হয়ে গেল। আর একইসঙ্গে কুকুরটা পটি করে দিল।
রেড কী বুঝল কে জানে! চট করে চলে এল ইয়েলোর ডেডবডির কাছে। মাথার কাছে মুখ নিয়ে বারকয়েক কী শুঁকল। তারপর পিছনের এক পা তুলে ইয়েলোর মুখে পেচ্ছাপ করে দিল। পেচ্ছাপের রং টকটকে লাল।
অভিজিৎ ওর কুকুরকে ডেকে নিয়ে ক্রেনের কেবিনে ঢুকল। ক্রেন ওদের তুলে নিল গর্ত থেকে—নিরাপদ জায়গায় নামিয়ে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে কয়েকজন মেডিক রেডকে নিয়ে প্যাভিলিয়নের দিকে চলে গেল। চিকিৎসা করে ওরা রেডকে সুস্থ করে তুলবে। অভিজিৎও তাদের সঙ্গে হাঁটা দিল।
কমলেশ্বরও কেবিনে চড়ে ওপরে উঠে এসেছিল। ও মোবাইল ফোন বের করে কাকে যেন ফোন করল। কথা বলতে-বলতেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরল।
সঙ্গে-সঙ্গে সুইপারদের ইউনিট এসে হাজির হল। ওরা দরকারি যন্ত্রপাতি নিয়ে ক্রেনে চড়ে গর্তে নেমে গেল। পাঁচমিনিটের মধ্যেই জায়গাটা সাফ করে দিল। মরা কুকুর আর নোংরা হয়ে যাওয়া মাটির সিলড প্যাকেট নিয়ে ওরা ওপরে উঠে এল। পিট এখন আবার লড়াইয়ের জন্য তৈরি। এবার লড়বে মানুষ।
বাইরে শান্ত থাকার চেষ্টা করলেও ভেতরে-ভেতরে জিশান উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। টের পাচ্ছিল ও ঘামছে। টেনশানটা কমানোর জন্য ও দর্শকের ভিড়ে আবার রূপকথাকে খুঁজল। ও বলেছিল, লাল ড্রেস পরে আসবে। এ-কথা ভাবতেই ওর রেডের কথা মনে পড়ল। আর তখনই মাইকে ঘোষণা করা হল : ‘এইবার শুরু হবে আজকের পিট ফাইট। লড়বে এমন একজন ফাইটার যে এর আগে অনেকগুলো গেম জিতেছে। কিল গেম-এর একজন মেজর পার্টিসিপ্যান্ট। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, প্লিজ ওয়েলকাম আওয়ার ফেভারিট পার্টিসিপ্যান্ট জিশান পালচৌধুরী—।’
টিভি ক্যামেরা জিশানের মুখে জুম করল। জায়ান্ট স্ক্রিনের পরদা জুড়ে এখন জিশানের মুখ।
জিশানকে দেখেই দর্শকরা হইহই করে উঠল। কারণ, জিশান নিউ সিটির রিয়্যালিটি শো-র খুব চেনা মুখ। অনেকগুলো গেম-এ জিতেছে। কিল গেম-এ পার্টিসিপেট করার দৌড়ে রয়েছে।
দর্শক আবার পাগলের মতো চিৎকার শুরু করে দিয়েছিল। আওয়াজ উঠছিল : ‘জি—শান! জি—শান!’
প্রথম থেকেই জিশান খেয়াল করেছিল আশপাশের দর্শকদের অনেকেই কৌতূহলী চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছে। ওর দিকে গোপন ইশারা করে দেখাচ্ছে।
এতক্ষণ যেটা ছিল দর্শকদের দোলাচলে ঘেরা অনুমান, এখন সেটা সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে বদলে দিয়েছে জায়ান্ট টিভি স্ক্রিন।
জোরালো স্পট লাইট এসে পড়ল জিশানের ওপর।
নীল ইউনিফর্ম পরা একটি ভারি চেহারার মেয়ে কোথা থেকে যেন চলে এল জিশানের কাছে। বুকে কোড নম্বর লেখা স্টিকার।
মেয়েটি বলল, ‘জিশান, উড য়ু প্লিজ স্ট্যান্ড আপ ফর আ মিনিট?’
জিশান উঠে দাঁড়াল।
সঙ্গে-সঙ্গে দর্শকদের তুমুল চিৎকার কয়েক ধাপ বেড়ে গেল।
জায়ান্ট স্ক্রিন তখন জিশানের ছবির পাশে স্ক্রোল করে দেখিয়ে চলেছে জিশানের ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস : ওজন, উচ্চতা, বাহুর দৈর্ঘ্য, পায়ের দৈর্ঘ্য, বুকের মাপ, কোমরের মাপ ইত্যাদি। এবং তার সঙ্গে মণীশের ধারাবিবরণী।
তারপরই স্ক্রিনে দেখানো শুরু হল ওর নানান কমপিটিশানের ভিডিয়ো রেকর্ডিং-এর অংশ : শিবপদর সঙ্গে লড়াই, কোমোডোর সঙ্গে মোকাবিলা, স্নেক লেকের দৌড়। রেকর্ডিং-এর বিশেষ-বিশেষ অংশ আবার স্লো মোশানে দেখানো হচ্ছিল। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক্সপার্ট কমেন্টস।
জিশান অবাক হয়ে দেখছিল, টিভির ছবিগুলো ‘পশু’ জিশানকে কী নিখুঁতভাবেই না দর্শকদের সামনে পেশ করছিল।
জিশান বসে পড়ল।
তারপরই ওকে অবাক করে দিয়ে টিভিতে দেখানো হল ওর এলিভেটরের লড়াই—রণজিৎ পাত্রের সঙ্গে। এবং সেই ছবির পরই রোলারবল এপিসোড।
রোলারবল এপিসোড দেখানোর সময় রাজশ্রী বারবার জিশানের অলৌকিক সহ্যশক্তির প্রশংসা করছিল। বলছিল, বহুদিন পর নিউ সিটি এমন একজন পার্টিসিপ্যান্ট পেয়েছে যে শুধু মারতে জানে না, মার খেতেও জানে।
জিশানের অডিয়ো-ভিশুয়াল পরিচয়ের পালা আরও কিছুক্ষণ ধরে চলল। তারপর রাজশ্রী বলল, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, এইবার আপনাদের জানাব সেকেন্ড ফাইটারের নাম। এই নামটা এইমাত্র আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। নামটা সিলেক্ট করেছেন আমাদের ক্রিমিনাল রিফর্ম ডিপার্টমেন্টের মার্শাল মাননীয় শ্রীধর পাট্টা…।’
সঙ্গে-সঙ্গে টিভির পরদায় চলে এল শ্রীধর পাট্টার ছবি।
‘…জিশানের সঙ্গে আজ পিট ফাইট যে লড়বে সেও কম নয়। এর আগে অনেকগুলো কমপিটিশানে সে জিতেছে। নিজেকে বারবার প্রমাণ করেছে। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, লেট আস ওয়েলকাম দ্য গ্রেট ফাইটার মনোহর সিং…।’
জিশানের হাত থেকে একরাশ কাচের বাসন পড়ে গেল যেন। ওর সারা শরীর ঝনঝন করে কেঁপে উঠল। একটা কান্নার দমক উথলে উঠল বুকের ভেতরে।
ও: ভগবান!
শেষ পর্যন্ত মনোহর সিং!
চোখের পলকে জায়ান্ট স্ক্রিনে মনোহর সিং-এর ছবি ফুটে উঠল। ক্যামেরা ওর হাত-পা-কাঁধের পেশির ক্লোজ-আপ দেখাতে শুরু করল। তারপর পৌঁছে গেল ওর মুখে।
কিন্তু এ কোন মনোহর সিং!
চাপ-চাপ লোহা দিয়ে তৈরি ওর শরীরের পেশি। মাথায় কদমছাঁট চুল। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। জীবনে অনেক দু:খ-কষ্ট থাকলেও মনোহরের সরল মুখে সবসময় হাসির ছোঁওয়া। ও অনেক কিছু পারে। এত অভাবের মধ্যে থেকেও ও প্রাইজ মানির পঞ্চাশহাজার টাকা জিশানের ছেলেকে উপহার দিতে পারে। নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য কোমোডো ড্রাগনের শরীরে কামড় বসাতে পারে।
সেই হাসিখুশি উদার অশিক্ষিত মানুষটা এখন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে জল। চোয়াল শক্ত করে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ছে। বলছে ‘নহি! নহি!’ কিন্তু অডিয়ো সিস্টেম লাগানো নেই বলে শুধু ওর ঠোঁট নাড়াটা দেখা যাচ্ছে।
মনোহরের ছবির সঙ্গে মণীশ আর রাজশ্রীর ধারাভাষ্য চলছিল। গেম সিটিতে আসার পর থেকে মনোহর সিং লড়াইয়ে কী-কী ক্যারিশমা দেখিয়েছে, কোন-কোন কমপিটিশানে কীভাবে জিতেছে, সেসব কথা ওরা অনর্গল বলে চলেছে।
‘…মনোহর সিং কোমোডো ড্রাগনের কামড় খেয়েছে, বিষধর সাপের ছোবল খেয়েছে—কিন্তু তাও ও হারেনি। হি ইজ আ বর্ন উইনার। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, আপনারা…।’
জিশানের কানে টিভির ধারাবিবরণীর একটা শব্দও ঢুকছিল না। ও শুধু মনোহরের গাল বেয়ে নেমে আসা চিকচিকে জলের রেখা দেখছিল আর শ্রীধর পাট্টার সর্বনাশা বুদ্ধির শক্তি আঁচ করছিল। কিল গেম-এ যাওয়ার আগে শুধু গায়ের জোরের লড়াই নয়, মনের জোরের লড়াইও জিততে হয়!
জিশানের হাত-পাগুলো যেন রবারের হয়ে যাচ্ছিল। ও উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। ওর শরীরের শিরা-উপশিরায় তড়িৎপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। একটা চিনচিনে জ্বালা ছড়িয়ে যাচ্ছিল প্রতিটি স্নায়ুতে।
জিশানের ভয় হচ্ছিল, ওর রবার হয়ে যাওয়া শরীর না গলে যায়! গলে কনডেনসড মিল্কের মতো গড়িয়ে যায় স্টেডিয়ামের মেঝেতে!
জিশান চিৎকার করে বলতে চাইল, ‘মনোহরের সঙ্গে আমি লড়ব না—কিছুতেই না।’ কিন্তু ওর ঠোঁট থরথর করে কাঁপল শুধু—কোনও শব্দ বেরোল না।
কিন্তু মনোহর সিং প্রতিবাদে ফেটে পড়ল।
ওর কোনও কথা শোনা যাচ্ছিল না, কিন্তু মূকাভিনয়ের মতো ব্যাপারটা জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিল।
মনোহর পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছিল। টিভি ক্যামেরা খানিকটা পিছিয়ে যেতেই দেখা গেল চারজন গাঁট্টাগোট্টা সিকিওরিটি গার্ড মনোহরের দুটো হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মনোহর প্রবল শক্তিতে ট্যানাহ্যাঁচড়া করছে, ওদের বাঁধন ছাড়াতে চেষ্টা করছে। ওর গলার শিরা ফুলে উঠেছে।
স্টেডিয়ামের দর্শক মনোহরের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝতে পারছিল। ওরা হইহই চিৎকারে মনোহরকে ‘দুয়ো’ দিতে লাগল। দর্শকের ক্ষিপ্ত গর্জনে টিভির ধারাবিবরণী ডুবে গেল।
জিশানের মনখারাপ হয়ে যাচ্ছিল। একটা মানুষ জীবনের মূল্যবোধ বজায় রাখতে বলছে, ‘জিশানের সঙ্গে লড়ব না।’ আর সেই কারণে পাবলিক তাকে ‘দুয়ো’ দিচ্ছে!
নিউ সিটির মূল্যবোধের বিকৃত আকারটা জিশানকে আরও একবার ব্যথা দিল। মনোহরের করুণ অবস্থা দেখে ওর বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। ওর চোখ যে জলে ভরে উঠেছে সেটা জিশান টের পাচ্ছিল, কিন্তু চোখের জল ফেললে চলবে না। টিভি ক্যামেরার চোখ যে-কোনও মুহূর্তে ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তখন স্টেডিয়ামের দর্শকরা, নিউ সিটির আরামের ফ্ল্যাটে টিভির সামনে বসে থাকা দর্শকরা, দেখবে জিশান কাঁদছে—ফাইটার জিশান কাঁদছে।
জামার হাতা দিয়ে চোখের জল মুছে নিল। তারপর জোর করে রিমিয়ার কথা ভাবতে শুরু করল। কোথায় লাল ড্রেস পরা মেয়েটা? এই স্টেডিয়ামে ঠিক কোন জায়গাটায় বসে আছে ও? জিশানের দু:খ নিশ্চয়ই ওর চেয়ে বেশি নয়! স্টেডিয়ামের গিজগিজে দর্শকের ওপরে সন্ধানী চোখ বোলাতে লাগল। চোখজোড়া যে জ্বালা করছে সেটা ভুলতে চাইল।
হঠাৎই জায়ান্ট স্ক্রিনের দিকে চোখ গেল জিশানের। কারণ, এইমাত্র ও একটা অদ্ভুত অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতে পেয়েছে। মণীশ তখন বলছে, ‘সারপ্রাইজ, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, সারপ্রাইজ! এইমাত্র আমাদের কাছে একটা স্পেশাল ইনফরমেশান এসে পৌছেছে। মনোহর সিং পিট ফাইট থেকে ব্যাক আউট করেছে বলে আমাদের মাননীয় মার্শাল শ্রীধর পাট্টা এইমাত্র ওর শাস্তি ঘোষণা করেছেন—খুব সহজ শাস্তি—”হাউন্ড গেম”। নরম্যালি এই ধরনের ব্যাক আউটের কেসে সিন্ডিকেটের তরফ থেকে ”ডগ স্কোয়াড” শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু সেটাকে ইনজিনিয়াসলি মডিফাই করেছেন আমাদের মাননীয় মার্শাল। এবারে আপনারা তাঁর কথা শুনুন…।’
সঙ্গে-সঙ্গে জায়ান্ট টিভির পরদায় শ্রীধরকে দেখা গেল। তিনি চিবিয়ে-চিবিয়ে নিচু গলায় বলছেন, ‘ওকে শাস্তি দেব। আর-একটা খেলা খেলব। ও জিশানের সঙ্গে লড়বে না। তাই শেম, শেম। হাউন্ড গেম। ওই গর্তে নামবে ও একা। সেইসঙ্গে পাঁচটা হাউন্ড যাবে দেখা…।’
ছন্দবাণী শেষ করে অদ্ভুতভাবে হাসলেন শ্রীধর। ওঁর ঠোঁট সামান্য চওড়া হল, চোখের কোণে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। মুখের আর কোনও পেশি নড়ল না। মরা মানুষ হাসতে পারলে বোধহয় এইভাবেই হাসত।
কয়েকসেকেন্ড চুপ করে থেকে শ্রীধর ঠান্ডা গলায় আবার বললেন, ‘শেম, শেম! হাউন্ড গেম।’
সঙ্গে-সঙ্গে উত্তেজনার হিংস্র রসদ খোঁজা দর্শকের দল শ্রীধরের তালে তাল মিলিয়ে গর্জন করে উঠল, ‘শেম, শেম! হাউন্ড গেম।’
শ্রীধরের কথার মধ্যে পদ্যের লুকোনো ছন্দ জিশানের বুকে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু ও কেমন যেন শক পেয়ে স্থবির চোখে টিভির পরদার দিকে তাকিয়ে ছিল।
দর্শকদের উল্লাসের চিৎকার জিশানের ঘোর কাটিয়ে দিল। ও স্পষ্ট বুঝতে পারছিল হাউন্ড গেম-এ কী হতে চলেছে। আর ঠিক তখনই মণীশের উত্তেজিত কমেন্ট্রি শোনা গেল।
‘…একটা নতুন গেম। গর্তের ভেতরে পাঁচটা হাউন্ডের সঙ্গে লড়বে ফাইটার মনোহর সিং—ডাকাবুকো বর্ন ফাইটার মনোহর সিং…।’
লড়বে? নাকি মরবে? ভাবল জিশান।
ও দেখল, দুটো ক্রেন তাদের কাজ শুরু করেছে। কুচকুচে কালো রঙের পাঁচটা হিংস্র হাউন্ডকে একে-একে গর্তের ভেতরে নামিয়ে দিচ্ছে। ওদের সঙ্গে কোনও ট্রেনার নেই। একটা নিরস্ত্র মানুষকে ছিন্নভিন্ন করার জন্য কোনও ট্রেনারের দরকারও নেই।
ওরা গর্তের ভেতরে এলোমেলো ছুটোছুটি করতে লাগল।
শ্রীধর পাট্টার ছবি সরে গিয়ে জায়ান্ট স্ক্রিনে আবার ফিরে এসেছে মনোহর সিং-এর মুখ। এবার ওর অডিয়ো সিস্টেম কাজ করছে। শোনা যাচ্ছে ওর পাগলের মতো চিৎকার।
‘…জিশান ভাইয়াসে ম্যায় নহি লড়ুঙ্গা। তুম লোগ ইয়ে কাম মুঝসে নহি করা সকতে। নহি লড়ুঙ্গা ম্যায় মেরে জিগরি দোস্তসে। অওর কোই ভি ফাইটার হমে মনজুর হ্যায়, পর জিশানভাইয়া? কভি নহি…।’
জিশান অবাক হয়ে সহজ-সরল মানুষটাকে দেখছিল। লোকটা ওই গর্তের মধ্যে এক্ষুনি টুকরো-টুকরো হতে চলেছে, অথচ এখনও শুধু একটা কথাই বলে চলেছে : জিশানের সঙ্গে ও লড়বে না।
মনোহরকে এবার সরাসরি দেখা গেল। প্যাভিলিয়নের করিডর ধরে ও স্টেডিয়ামে চলে এসেছে। ওর গায়ে টকটকে লাল রঙের জিম ভেস্ট আর কালো রঙের বারমুডা। পায়ে সাদা-কালো-রুপোলি স্পোর্টস শু। আর কালো মোজা। মনোহরের দুপাশে দুজন সিকিওরিটি গার্ড।
একটা ক্রেনের কেবিন ওদের কাছে এসে থামল। গার্ড দুজন ওকে ঠেলে তুলে দিল কেবিনে। তারপর নিজেরা উঠে পড়ল। ক্রেনের লম্বা হাত কেবিনটাকে শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে গেল গর্তের ওপর। গর্তের ঠিক কেন্দ্রে মনোহরকে নামিয়ে দিয়ে ক্রেন আবার উঠে গেল শূন্যে।
মনোহর অসহায় চোখে কুকুরগুলোর দিকে একবার তাকাল। সঙ্গে-সঙ্গে পাঁচটা কালো বিদ্যুৎঝলক চাপা গর্জন করে মনোহরের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
মনোহর চিৎকার করতে লাগল।
শুরুর দিকে ও হাত-পা ছুড়ছিল, শ্রীধর পাট্টার নাম ধরে গালিগালাজ করছিল। কিন্তু সেটা মাত্র কয়েকসেন্ডের জন্য।
কারণ, তারপরই ও হিংস্র কুকুরগুলোর আক্রমণ ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কুকুরগুলো এতই ক্ষিপ্র যে, পাঁচটা কুকুরকে দশটা বলে মনে হতে লাগল।
মনোহরের চিৎকার জিশানের কানে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছিল। আর-একজন মালিক অথবা শিবপদকে ও দেখতে লাগল। মনোহরের কথা জায়ান্ট টিভির স্পিকারেও শোনা যাচ্ছিল। ও তখন জড়ানো গলায় কাটা-কাটাভাবে বলছে, ‘জিশান! জিশানভাইয়া! ইন হারামি লোগোঁকো ছোড়না নহি। ইনকো সবক জরুর সিখানা। ছোড়না নহি সালোকো…।’
চিৎকার করতে-করতে মনোহর পড়ে গেল। ওর চিৎকার থেমে গেল। কুকুরগুলোর শরীরে ওর শরীর ঢাকা পড়ে গেল। জন্তুগুলো মনোহরের ভেস্ট, প্যান্ট আর জুতো-মোজা নিয়ে ছেঁড়াছিঁড়ির হরির লুঠের খেলা খেলতে লাগল। তারপর শুরু হল ওর চামড়া আর মাংস নিয়ে খেলা।
জায়ান্ট স্ক্রিন মাঝে-মাঝেই জাম্প কাট করে শ্রীধর পাট্টার মুখ দেখাচ্ছিল। ভাবলেশহীন মুখ। চকচকে চোখ। সরু পাতলা লাল টুকটুকে ঠোঁট। দেখে মোটেই মনে হয় না, তিনি কারও নৃশংস মৃত্যু দেখছেন।
উত্তেজিত জনতা প্রবল চিৎকার করছিল। নানান মন্তব্য করছিল। কেউ-কেউ শূন্যে রঙিন বেলুন ওড়াচ্ছিল। আর কুকুরগুলোর আক্রমণের তালে-তালে জনতার চিৎকার সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ওঠা-নামা করছিল।
অসম লড়াইটা শেষ হতে কুড়ি সেকেন্ডের বেশি লাগল না।
কুকুরগুলো মনোহরকে ছেড়ে যখন সরে দাঁড়াল তখন মনোহরের শরীরের খুব একটা অবশিষ্ট নেই।
জায়ান্ট স্ক্রিনে সেই অবশেষের ক্লোজ-আপ দেখা গেল। অতিথি নেমন্তন্ন খেয়ে চলে গেলে পাতে এঁটোকাঁটা যেরকম পড়ে থাকে মনোহরের এঁটোকাঁটা ঠিক তেমনই গর্তের মাটির ওপরে পড়ে রয়েছে।
জিশানের চোখে জল এসে গেল আবার। গা গুলিয়ে উঠল। মনোহর আর নেই—এই সত্যিটা উপলব্ধি করার জন্য ও মাথার ওপরে কালো আকাশের দিকে তাকাল। ওপরওয়ালা এই মৃত্যুটা কি দেখতে পেয়েছেন? ওই অন্ধকার থেকে?
হা ঈশ্বর!
ওল্ড সিটিতে মালিক যখন ফাইটার কার্তিকের হাতে মারা যায় তখন ঘোলাটে চোখে জিশানের দিকে তাকিয়ে মালিক বিড়বিড় করে বলেছিল, ‘…তুই ওকে উড়িয়ে দে। ওই কার্তিক সালাকে না উড়িয়ে তুই জল খাবি না। গড প্রমিস।’
জিশান মনে-মনে শপথ নিয়েছিল। এবং কথা রেখেছিল।
এখনও তো এই একটু আগেই মনোহর বলল, ‘…জিশানভাইয়া! ইন হারামি লোগোঁকো ছোড়না নহি। ইনকো সবক জরুর সিখানা। ছোড়না নহি…।’
না, জিশান ছাড়বে না। এদের উচিত শিক্ষা অবশ্যই দেবে।
শরীরে যেন মন্ত্রশক্তি টের পেল ও। বিদ্যুতের হলকা ছুটে বেড়াতে লাগল ওর শরীরের শিরা-উপশিরায়। ও বিড়বিড় করে বলল, ‘মনোহর, সালোকো হম সবক জরুর সিখাউঙ্গা। তু আশমানসে দেখতে রহেনা।’
জিশান এবার উঠে দাঁড়াল। চোয়ালে চোয়াল চেপে নিজের মনেই বলল, ‘যদি এই পিট ফাইটে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে লড়তেই হয় তা হলে আমি এই গেমটার নাম দিলাম ”কিল গেম”—খতমের খেলা।’
টিভির বিশাল পরদায় শ্রীধর পাট্টাকে দেখা যাচ্ছিল। তিনি তখন সুপারগেমস কর্পোরেশনের কঠোর নিয়মকানুনের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত এবং জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখছিলেন। ওঁর কথা বলা শেষ হতেই আবার শুরু হয়ে গেল জিশানের কীর্তির পাঁচালি। তার সঙ্গে চলতে লাগল নানান গেমের মানানসই চলমান ছবি। অর্থাৎ, ব্যাপারস্যাপার একটু আগে দেখানো পিট ফাইটের প্রাোমোশনাল ট্রেলারের অ্যাকশান রিপ্লে বলে মনে হতে লাগল। সবমিলিয়ে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যেন মনোহর সিং-এর ঘটনাটা কখনও ঘটেনি। গর্তের মধ্যে মনোহর সিং নামে কেউ কখনও নামেনি, পাঁচটা কালো হাউন্ডও কেউ কখনও দ্যাখেনি।
জিশানের মাথার ভেতরে গরম তেল টগবগ করে ফুটতে লাগল।
মাইকে মণীশের কথা শোনা যাচ্ছিল। জিশানের ফাইটিং ক্যালিবার সবিস্তারে বুঝিয়ে বলার পর ও বলল, ‘…এখুনি আপনাদের সামনে আমরা নতুন একজন ফাইটারের নাম ঘোষণা করব। মাননীয় শ্রীধর পাট্টা নিজে সেই নাম আপনাদের জানাবেন। আর-একটু ধৈর্য ধরুন, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন…।’
গর্তের ভেতর থেকে পাঁচটা কুকুরকেই ক্রেন-কেবিনে তুলে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গর্তের মাটি সাফ করে আবার ঠিকঠাকভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন দাঁত-নখ লড়াইয়ের জন্য গর্ত আবার তৈরি।
জায়ান্ট স্ক্রিনে শ্রীধর পাট্টার মুখ ভেসে উঠল। ওঁর চোয়াল নড়ছে। কিছু একটা চিবোচ্ছেন যেন। চোখজোড়া তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল। মনে হয়, কোনও কিছুর প্রত্যাশায় একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।
শ্রীধর হঠাৎই চিৎকার করে বললেন, ‘জিশান! বাবু জিশান! কোথায় তুমি? আর য়ু রেডি?’
অন্য আর-একটা ক্যামেরা তাক করল জিশানের দিকে। জায়ান্ট স্ক্রিনে ইনসেটে দেখা গেল জিশানের মুখ।
ওর ঠোঁট কাঁপছে। কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। চোয়ালের হাড় শক্ত।
জিশানকে দেখানোমাত্রই জনতা তীব্র গর্জন করে উঠল।
শ্রীধর পাট্টা ঠোঁটে একচিলতে হাসি ফুটিয়ে তুললেন। তারপর চিবিয়ে-চিবিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্যে আমাদের প্রীতি উপহার/জাব্বার সঙ্গে তোমাকে মানাবে চমৎকার। হ্যাঁ, জিশান—এইবার দেখি কেমন করে ওড়াও তোমার নিশান। তোমার সঙ্গে পিট ফাইটে লড়বে জাব্বা, জাব্বা, জাব্বা। ওরে বাব্বা, বাব্বা, বাব্বা!’
শ্রীধরের ছড়া-কাটা ব্যঙ্গের খোঁচা শেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই জায়ান্ট স্ক্রিনে জাব্বার ক্লোজ-আপ ভেসে উঠল। জিশান তাকাল সেই ভয়ংকর মুখের দিকে। শতকরা দুশো ভাগ একটা পোড়খাওয়া খুনির মুখ।
জিশানের মনে পড়ল, পিট ফাইটে জাব্বার হাতে পুনিয়া মারা গেছে—খিদিরপুরের পুনিয়া সরকার। এ ছাড়াও আর-একজন ফাইটারকে জাব্বা খতম করেছে। তার নাম জিশান জানে না।
মোট দুজন জান দিয়েছে। আজ কি সংখ্যাটা দুই থেকে তিনে যাওয়ার পালা?
টিভির পরদায় জাব্বার গুণকীর্তন চলছিল। ওর ওজন, উচ্চতা, বাহুর দৈর্ঘ্য, পায়ের দৈর্ঘ্য, বুকের মাপ ইত্যাদি জানানো হচ্ছিল। আর মাঝে-মাঝেই দেখানো হচ্ছিল ওর ক্লোজ-আপ।
জিশান লোকটাকে দেখছিল। এখনই জাব্বাকে পিট ফাইট চ্যাম্পিয়ন বলা যেতে পারে। দুজন ফাইটার ওর হাতে মারা গেছে। এ ছাড়া আর ক’জন হেরেছে জিশান জানে না। পিট ফাইটের এতগুলো রাউন্ড জাব্বাকে দিয়ে কেন লড়ানো হচ্ছে তাও জিশানের জানা নেই। হয়তো বাড়তি রাউন্ডগুলো সারপ্রাইজ রাউন্ড—কিংবা নিউ সিটির বাসিন্দাদের বাড়তি আনন্দ আর উত্তেজনা জোগান দেওয়ার জন্য।
জাব্বার গায়ের রং বেশ কালো। তবে তা থেকে একটা চকচকে আভা বেরোচ্ছে। মাথাটা বড়—প্রায় ফুটবলের মতো। মাথায় মিলিটারিদের মতো কদমছাঁট চুল। মুখে এত ব্রণ যে, মনে হচ্ছে ব্যাঙের চামড়া গ্রাফটিং করে লাগানো হয়েছে। চোখ গর্তে ঢোকানো কিন্তু জ্বলজ্বল করছে। ভুরু চওড়ায় ছোট, লোমশ। দাড়ি-গোঁফ চেঁছেপুঁছে কামানো। ডানকানের ঠিক পাশ ঘেঁষে একটা বড় আঁচিল। আর বাঁ-চোয়ালের ওপরে ইঞ্চিতিনেক লম্বা একটা কাটা দাগ।
সবমিলিয়ে কাউকে খুন করার ব্যাপারে বেশ সম্ভাবনাময় মুখ।
নীল ইউনিফর্ম পরা ভারী চেহারার মেয়েটি বোধহয় কাছাকাছিই ছিল—হঠাৎ চলে এল জিশানের কাছে।
‘জিশান, এবার প্যাভিলিয়ানে চলুন। আপনাকে পিট ফাইট গেমটার জন্যে খুব কুইকলি রেডি হয়ে নিতে হবে। প্লিজ।’
জিশান মেয়েটার সঙ্গে হাঁটা দিল। আর মনে-মনে ভাবল, কী চমৎকার! পিট ফাইট গেম! হাউন্ড গেম! কিল গেম! এই নিউ সিটিতে মৃত্যুও একটা খেলা।
কোনও নিয়মকানুনের বালাই না মেনেই ঘেন্নায় পায়ের কাছে একদলা থুতু ফেলল জিশান। মেয়েটি সঙ্গে-সঙ্গে ভুরু কুঁচকে তাকাল জিশানের দিকে। বিরক্ত হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিশান বলে উঠল, ‘এটা থুতু ফেলার গেম, ম্যাডাম—।’
লাউডস্পিকারে তখন মিউজিক বাজানো শুরু হয়েছে। তার ঢং অনেকটা যুদ্ধের বাজনার মতো।
প্যাভিলিয়নে যাওয়ার টানেলে ঢোকার সময় স্টেডিয়ামের গ্যালারির দিকে তাকাল জিশান—রিমিয়ার লাল ড্রেসটা যদি ওর চোখে পড়ে। পড়ল না।
•
গর্তের ভেতরে মুখোমুখি দুজন।
একজন পুরুষ মাইকে নির্দেশ দিচ্ছিল। তার নির্দেশমতো জিশান আর জাব্বা গর্তের দুটো বিপরীত কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল।
জিশানের গায়ে কালো রঙের জিম ভেস্ট আর লাল বারমুডা। পায়ে স্পোর্টস শু আর কালো মোজা।
জাব্বার পোশাক ঠিক উলটো : লাল জিম ভেস্ট আর কালো বারমুডা—মনোহরের মতো।
জিশান বুঝল, লড়াইয়ের সময় প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঠিকমতো চেনার সুবিধের জন্যই দুজনের পোশাক দুরকম।
জাব্বার শরীরের দিকে তাকিয়ে ওর শক্তি আঁচ করতে চাইছিল জিশান। ওর কালো শরীরের সর্বত্র শক্তিশালী পেশি ঢেউ খেলছে। নি:শব্দ চিৎকারে জানান দিচ্ছে, আমরাই সেরা, আমরাই পিট ফাইটের চ্যাম্পিয়ন।
জাব্বাকে দেখে মনে হচ্ছিল ও মানুষ নয়—কালো পাথরে খোদাই করা মূর্তি। কয়েকমাস আগে ও রক্ত-মাংসের মানুষ ছিল। কিন্তু একটানা ভয়ংকর ট্রেনিং করার পর ও পাথর হয়ে গেছে।
নিজের শরীরেও পাথর টের পেল জিশান। পাথর, নাকি স্টেইনলেস স্টিল? মাসের-পর-মাস অ্যানালগ জিমের ব্যায়াম, বালির ওপরে দৌড় প্র্যাকটিস, জলের তলায় কতক্ষণ ডুব দিয়ে থাকা যায় তার অভ্যাস, তিরিশ কেজি বালির বস্তা কাঁধে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দৌড়নো, দড়ি বেয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠা-নামা করা, পায়ে ওজন বেঁধে দৌড়নো, লেকে ফ্রি স্টাইল সাঁতারে এককিলোমিটার পেরোনো—সেসব যাবে কোথায়?
তা হলে জিশান কি পারবে না তিরিশ ফুট দূরে দাঁড়ানো ওই লোকটার কালো ঘাড়টা মটকে দিতে? শানু, মিনি—ওদের সঙ্গে দেখা করার জন্য জিশানকে যে বেঁচে থাকতেই হবে!
ভগবান! ভগবান! তুমি মাথার ওপরে আছ তো?
মুখ তুলে ওপরদিকে তাকাল জিশান। চারপাশের উজ্জ্বল আলো ওর চোখ ধাঁধিয়ে দিল। তবু চোখে পড়ল উজ্জ্বল আলো দিয়ে ঘেরা একটা কালো গহ্বর। সেটাই আকাশ।
লাউডস্পিকারে হঠাৎই নতুন একটা গলা শোনা গেল। কোনও মেয়ের মিষ্টি গলা।
‘জিশান—জাব্বা—আমি এই গেমের রেফারি। নিয়মের কোনও ভুলচুক হলে আমি তোমাদের ইনস্ট্রাকশন দেব। তোমরা সেটা খেয়াল রাখবে…।’
জিশান জায়ান্ট স্ক্রিনের দিকে তাকাল। অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়েকে সেখানে দেখা যাচ্ছে। মিষ্টি গলায় সে-ই কথা বলছে।
‘জিশান—জাব্বা—তোমরা দুজনে ওপরদিকে হাত তুলে দেখাও যে, তোমাদের সঙ্গে কোনও লুকোনো অস্ত্র নেই…।’
জিশান আর জাব্বা রেফারির কথা শুনল। দু-হাত ওপরে তুলল। আঙুলগুলো তালপাতার শিষের মতো ছড়িয়ে দিল।
না, ওদের হাতে কোনও লুকোনো অস্ত্র নেই। তবে যে-অস্ত্র রয়েছে সেটা সরাসরি দেখা যাচ্ছে : ওদের শক্ত শক্তিশালী আঙুল—চামড়া আর মাংস দিয়ে আড়াল করা আঙুলের হাড়—লোহা দিয়ে তৈরি হাড়।
জাব্বা ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে লাফাতে লাগল, হাত-পা ঝাঁকাতে লাগল, আর মরা মানুষের চোখে জিশানকে দেখতে লাগল। হয়তো ভাবছিল, এই ছোকরাটাকে মটাস করে ঘাড় ভেঙে মারতে ও ঠিক কতটা সময় নেবে।
লাউডস্পিকারে রেফারির গলা শোনা গেল : ‘আর য়ু রেডি, জাব্বা?’
জাব্বা একটা হাত ওপরে তুলল। ওপর-নীচে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল যে, ও রেডি।
সঙ্গে-সঙ্গে দর্শকের দল পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল।
রেফারি এবার চেঁচিয়ে জিশানকে জিগ্যেস করল, ‘আর য়ু রেডি, জিশান?’
জিশান ডানহাতটা তুলে ধরল শূন্যে। মাথা নেড়ে জানাল, ‘হ্যাঁ, রেডি—।’
সঙ্গে-সঙ্গে স্টেডিয়ামে আবার তুমুল চিৎকার।
রেফারি বলল, ‘ওয়ান…টু…থ্রি…স্টার্ট।’
লাউডস্পিকারে শোনা গেল কানফাটানো রক মিউজিকের ঝলক।
জিশান আর জাব্বার পিট ফাইট শুরু হল।
ওরা দুজন কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দুটো হাত সামনের দিকে খানিকটা বাড়িয়ে গোল হয়ে পাক খেতে লাগল।
জাব্বা অদ্ভুত এক প্রশান্ত চোখে জিশানকে দেখছিল, আর মাঝে-মাঝেই দু-হাতের তালু ঘষছিল। কী এক কৌশলে ও যেন ওর জ্বলজ্বলে চোখের বাতি নিভিয়ে দিয়েছে।
বৃত্তাকার পথে ওরা দুজন পাক খাচ্ছিল আর অদৃশ্য এক টানে ওদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব কমছিল।
পনেরোসেকেন্ডের মধ্যেই দূরত্বটা ছ’ফুটে এসে দাঁড়াল। তখনই জাব্বা হিংস্রভাবে চাপা গর্জন করে বলে উঠল, ‘খতম!’ এবং জিশানের দিকে থুতু ছেটাল।
জিশান কোনও পালটা জবাব দিল না। শরীরের প্রতিটি শক্তিকণা ও সঞ্চয় করে রাখতে চায় লড়াইয়ের জন্য। ও মনে-মনে মিনির কথা ভাবল। ভাবল শানুর কথা। যদি এই পিট ফাইটে জাব্বার হাতে ও শেষ হয়ে যায় তা হলে আর কোনওদিনও মিনি আর শানুর সঙ্গে ওর দেখা হবে না।
জিশানের হঠাৎ মনে হল, জাব্বার সঙ্গে ও নয়—মিনি আর শানু লড়ছে। আর ও বাইরে থেকে দেখছে। যদি ওরা জাব্বার হাতে খতম হয়ে যায় তা হলে জিশানের সঙ্গে ওদের আর কখনও দেখা হবে না।
দুটো ব্যাপার জিশানের কাছে একই বলে মনে হল। ওর মনে হল, মিনি আর শানুকে জাব্বার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই ওকে লড়তে হবে। প্রাণপণ লড়তে হবে।
জিশানের নাকে গন্ধ আসছিল। মাটির গন্ধ, কুকুরের গন্ধ, রক্তের আঁশটে গন্ধ। হয়তো ওর আর জাব্বার লড়াই শেষ হওয়ার পর এই গর্তে মানুষের গন্ধও পাওয়া যাবে।
দর্শকের দল খ্যাপা নেকড়ের মতো চিৎকার করছিল। শূন্যে হাত-পা ছুড়ছিল। ওরা রক্ত দেখতে চাইছিল। হাতাহাতি শুরু হওয়ার এক-একসেকেন্ড দেরি ওদের কাছে এক-একঘণ্টা বলে মনে হচ্ছিল। ওদের ধৈর্যের সুতো ছিঁড়ে গেছে অনেকক্ষণ।
নানান সুরে গালাগালের টুকরো ছিটকে আসছিল জিশানদের দিকে। সেইসঙ্গে মাইকের ধারাবিবরণী। হিংসার চাহিদা যে এত তীব্র হতে পারে সেটা জিশান আগে কখনও ভাবেনি। ওর কান ভোঁ-ভোঁ করছিল। মনে হচ্ছিল, শরীরের কাঠামোয় বসানো কতকগুলো জ্যান্ত খুলি রক্তের পিপাসায় পরিত্রাহি চিৎকার করছে।
জিশান আর জাব্বার বৃত্ত এখন অনেক ছোট হয়ে এসেছে। এত ছোট যে, ওরা হাত বাড়ালেই একে অপরকে ছুঁয়ে ফেলতে পারবে।
জাব্বা কথা বলছিল। প্রায় ফিসফিস করে বিড়বিড় করছিল। কথাগুলো শুনতে না পেলেও জিশান অনুমান করতে পারছিল। জাব্বা খিস্তির ফোয়ারা ছোটাচ্ছে।
হঠাৎই জাব্বা চোখের ইশারা করল। জিশানের বাঁ-পাশ দিয়ে যেন জিশানের পিছনে কারও দিকে তাকাল। বলল, ‘দ্যাখ, কে এসেছে—।’
জিশান বুঝতে পারছিল এটা বহু পুরোনো লোকঠকানো প্যাঁচ। কিন্তু সেই মুহূর্তে কী যে হল! ও মাত্র পাঁচ কি দশ ডিগ্রি মাথাটা ঘুরিয়ে ছিল। তাও এক লহমার জন্য। তাতেই গন্ডগোল হয়ে গেল। জাব্বা ওর নেমন্তন্নের চিঠি পেয়ে গেল।
জাব্বার লাথিটা সপাটে এসে পড়ল জিশানের বুকে—ডানদিকে। জিশান ছিটকে পড়ল মাটিতে। একটা পাক খেয়ে হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে শরীরটাকে তুলে ধরল। ততক্ষণে জাব্বা ওর আরও কাছে চলে এসেছে। ফুটবল খেলার ফ্রি কিক শট নেওয়ার মতো পরপর তিনটে লাথি কষাল জিশানের মাথায় আর পাঁজরে।
জিশানের মনে হল বুকের ভেতরে পাঁজরের হাড়-টার বা কিছু একটা বোধহয় ভেঙে গেল। ছুঁচ ফোটানো ব্যথা টের পেল ও। তবু কোনওরকমে মাটিতে ভর দিয়ে মাতালের মতো হাঁচরপাঁচর করে টলতে-টলতে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
এই ওর লড়াইয়ের নমুনা! বাঁচা-মরার লড়াই লড়তে গিয়ে বস্তাপচা প্যাঁচে মাত হয়ে যাচ্ছে!
‘শাবাশ, জাব্বা! শাবাশ!’ একজন হিংস্র দর্শকের উত্তেজিত চিৎকার শোনা গেল।
‘অ্যাই, জিশান! তোর জুতোর ফিতে খুলে গেছে. তাকা—পায়ের দিকে তাকা, সালা! মাথামোটা আলুরদম কোথাকার!’ আর-একজন দর্শক। বোকা-বোকা লড়াই লড়ার জন্য জিশানকে ব্যঙ্গ করছে।
জিশান আন্দাজ করল, ওর আর জাব্বার লড়াই নিয়ে দর্শকদের মধ্যে নিশ্চয়ই বাজি ধরাধরি চলছে। আর সুপারগেমস কর্পোরেশন নিশ্চয়ই এ থেকে ভালো পয়সা লুটছে। এক ঢিলে দু-পাখি—বিনোদন আর ফায়দা।
জাব্বা কুঁজো হয়ে দু-হাত দুপাশে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর মরা মাছের চোখ জিশানের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে-চিবিয়ে ও বলল, ‘বাঁচতে চাস তো এই গাড্ডা থেকে ফুটে যা। নইলে পাঁচমিনিটে তোকে টুটা-ফুটা সও টুকরা করে দেব। দাঁতগুলো গোটা-গোটা হাথে দিয়ে দেব। সালা…সুয়ার কা বাচ্চা!’
জিশানের মাথা ঘুরছিল। ও যেন জায়ান্টস হুইলে পাক খাচ্ছিল। কপালের পাশ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। নাক বেয়ে নেমে এসে ফোঁটা-ফোঁটা করে ঝরে পড়ছিল ঠোঁটের ওপর। ঝাপসা চোখে দেখছিল জাব্বা ওর কাছে এগিয়ে আসছে।
হাতের পিঠ দিয়ে রক্ত মুছে নিল। মনে-মনে ভাবল, এই গর্ত থেকে ওর বোধহয় আর বেরোনো হবে না। গর্ত নয়, আসলে একটা কবরের মধ্যে ও লড়াই করছে—জিশান পালচৌধুরীর কবর।
দলাপাকানো কাগজের বল ছিটকে আসছিল গর্তের ভেতরে। সেইসঙ্গে কিছু পেপার কাপ আর প্লাস্টিকের হালকা কৌটো। না, নিউ সিটির খেলায় এ ধরনের ‘মিসাইল’ ছোড়া বারণ নয়। কারণ, সুপারগেমস কর্পোরেশনের কর্তাদের মতে এগুলো উত্তেজনাময় খেলার একটা অঙ্গ। তাই অঙ্গহানি যাতে না হয় তার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে দর্শকরা।
হঠাৎই লম্বা মোটা দড়ির মতো কী যেন একটা উড়ে এসে পড়ল গর্তের ভেতরে। জিনিসটা এসে পড়েছে জিশান আর জাব্বার কাছ থেকে প্রায় দশ-বারো ফুট দূরে। কিন্তু মেটাল ল্যাম্পের চোখধাঁধানো সাদা ঝকঝকে আলোর কৃপায় বস্তুটাকে চিনে নিতে কোনও অসুবিধে হল না।
প্রায় সাতফুট লম্বা একটা কালচে রঙের সাপ। নরম মাটিতে ছিটকে এসে পড়ার পর স্থির হয়ে রয়েছে।
সাপটা বোধহয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নড়াচড়া বন্ধ রেখেছিল। জিশান আর জাব্বারও তখন একই অবস্থা। কিন্তু চার-পাঁচসেকেন্ড পরেই সাপটা নড়ে উঠল। কিলবিল করে চলতে শুরু করল। তখন জিশান দুরকম শত্রুর ওপরে সতর্ক চোখ রেখে পায়ে-পায়ে সরতে লাগল। লক্ষ করল, জাব্বার নজরও দুই শত্রুর দিকে।
সাপটা হঠাৎ কোথা থেকে এল? কেন এল? সাপটা কি বিষধর?
জিশানের এইসব প্রশ্নের উত্তর দিল মণীশের ধারাবিবরণী।
‘সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজ! এক্সাইটিং! এক্সাইটিং! এক্সাইটিং! পিটের মধ্যে উড়ে গিয়ে পড়েছে জ্যান্ত আফ্রিকান ব্ল্যাক মাম্বা। এবার দুই ফাইটারের সঙ্গে চলবে জ্যান্ত সাপের কিলবিল। তবে ভয়ের কিছু নেই। ব্ল্যাক মাম্বা সাংঘাতিক বিষধর সাপ হলেও এই সাপটার বিষ দুয়ে নেওয়া হয়েছে—কিন্তু ওর ধারালো বিষদাঁত জোড়া ইনট্যাক্ট রয়েছে। অ্যাজ আ রেজাল্ট, এই সাপটা যদি জিশান কিংবা জাব্বাকে কামড় বসায় তা হলে সেই বাইটটা পেইনফুল হবে, কিন্তু ডেডলি হবে না। জিশান আর জাব্বা—তোমাদের বলছি—এই সাপটার বিষ নেই বটে, কিন্তু তবু ওটা সাপ। সাপটা এখন তোমাদের লড়াইয়ের প্যাকেজে ঢুকে পড়েছে। সো, কাম অন ফোকস, লেটস নাউ ওয়াচ দিস সুপার এক্সাইটিং ভেনোমাস গেম। হো—য়া—!’
মণীশের উল্লাসের চিৎকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খ্যাপা দর্শকের দল ক্ষিপ্ত গর্জন করে উঠল।
কোনও গেমকেই সুপারগেমস কর্পোরেশন কখনও একঘেয়ে হতে দেয় না। তাই এইসব সারপ্রাইজ হচ্ছে ওদের আস্তিনের তাস। নতুন-নতুন ধরনের গেম আর নতুন-নতুন ধরনের সারপ্রাইজ ডিজাইন করার জন্য সুপারগেমস কর্পোরেশনের কোর ডিজাইনার গ্রুপ রয়েছে। সেই গ্রুপের হাই আই-কিউ এক্সিকিউটিভরাই হচ্ছে গেম ডিজাইনের থিংক ট্যাংক। এই খেলায় সারপ্রাইজ ফ্যাক্টর হিসেবে ওরা একটা নন-ভেনোমাস ব্ল্যাক মাম্বা অ্যাড করার কথা ভেবেছে।
ব্ল্যাক মাম্বাটা গর্তের কোণ ঘেঁষে সড়সড় করে চলে বেড়াচ্ছে। হয়তো জোরালো আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে বলে সরীসৃপটা অন্ধকার কোণ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
লাউডস্পিকারের এবার শোনা গেল রেফারির গলা : ‘জিশান! জাব্বা! ওই সাপটা তোমাদের। তোমরা ওটা নিয়ে যা খুশি করতে পারো। যেমন তোমরা তোমাদের রাইভালকে নিয়ে যা খুশি করতে পারো। পিট ফাইটে কোনও রুল নেই। ফ্রি ফর অল। স্কাই ইজ দ্য লিমিট। সো ক্যারি অন। আর তোমাদের তো আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, পিট ফাইটের রাউন্ড একটাই—এবং তার কোনও টাইম লিমিট নেই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অ্যাট আ স্ট্রেচ লড়াই—একটাই রাউন্ড…।’
গর্তের ঠিক মাঝখানে জিশান আর জাব্বার আবার সংঘর্ষ হল।
জাব্বার ঘুসি তো নয়, যেন দু-দুটো কালো লোহার বল বারবার আছড়ে পড়ল জিশানের মাথার দুপাশে। গর্তটা ঘূর্ণিপাকে ঘুরতে লাগল। গর্তের দেওয়াল যেন এখুনি ধসে পড়বে, জিশানকে কবর দিয়ে দেবে মাটির তলায়। ওকে একটানে শুষে নেবে অন্ধকার পাতালে।
জিশান হাঁটুগেড়ে বসে পড়েছিল। সেই অবস্থাতেই মাথা ঝাঁকাল এপাশ-ওপাশ।
সাপটা কোথায়? কোথায় গেল ব্ল্যাক মাম্বাটা? ওটা শানুকে ছোবল মারবে না তো? শানু কোথায়? ওকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কোথায় আমার ছোট্ট শানু? ওকে দেখার জন্যে আমাকে বাঁচতে হবে…।
সেই তীব্র ইচ্ছেটাই জিশানের ডানহাত মুঠো করে একটা লোহার ঘুসি তৈরি করে দিল। সেটা ও সজোরে চালাল ওপরদিকে। অনেকটা আন্দাজে ও ঘুসিটা চালালেও সেটা লাগল গিয়ে জাব্বার তলপেটে।
জাব্বার মুখ দিয়ে ‘ওঁক’ শব্দ বেরিয়ে এল। ও কুঁজো হয়ে গেল। এলোমেলো পা ফেলে খানিকটা পিছিয়ে গেল।
পাবলিক কানফাটানো গর্জন করে উঠল।
হঠাৎই জিশান দেখল, কালো সাপটা ওর কাছে এসে গেছে। ওটার গা চকচক করছে। যেন সারা গায়ে ভেসলিন মেখে এসেছে।
সাপটা ছোবল মারার আগেই জিশান ছোবল মারল। সাপটাকে এক ছোবলে মাটি থেকে তুলে নিয়ে ছুড়ে দিল জাব্বার দিকে। সাপটা ওর বুকের ওপর গিয়ে পড়ল। চাবুক মারার মতো শব্দ হল। জাব্বা খপ করে সাপটার হিলহিলে শরীর চেপে ধরল। সাপটা চকিতে ছোবল মারল জাব্বার কাঁধে।
পলকের জন্য চোখ কুঁচকে গেলেও জাব্বা সাপটার দিকে ফিরেও তাকাল না। রোবটের মতো যান্ত্রিকভাবে ওটাকে সজোরে ছুড়ে দিল গর্তের এবড়োখেবড়ো দেওয়ালে।
সাপটা জাব্বার কালো চামড়া ফুটো করে দিয়েছিল। ওর কাঁধ থেকে সরু রক্তের রেখা গড়িয়ে পড়ছিল।
জিশান বিদ্যুৎঝলকের মতো লাথি চালাল।
লাথিটা ও চালিয়েছিল জাব্বার দু-পায়ের জোড় লক্ষ্য করে। আঘাতটা এড়ানোর জন্য জাব্বা ওর কোমরটাকে একঝটকায় পিছিয়ে নিল। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে ওর মাথাটা ঝুঁকে পড়ল সামনে। ফলে লাথিটা যে-বৃত্তচাপ তৈরি করছিল সেটা থামল গিয়ে জাব্বার চোয়ালে।
জাব্বার শরীর হয়তো ইস্পাত দিয়ে তৈরি, কিন্তু জিশানের ইস্পাতও তো ফেলনা নয়! সুতরাং সংঘর্ষটা মেগাটন লেভেলের শোনাল। জাব্বার একটা দাঁত ছিটকে পড়ল মাটিতে। জাব্বা পিছনদিকে একটা ঝটকা খেয়েই সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
জিশান ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুর ওপরে। আঙুলে আঙুল জড়িয়ে দু-হাত মুঠো করে পাগলের মতো রদ্দা মেরে চলল জাব্বার কালো মোটা ঘাড়ে। যেভাবেই হোক, শত্রুকে ও মাটিতে পেড়ে ফেলতে চায়।
হয়তো সেই উদ্দেশ্যেই জিশান হঠাৎ একটু পিছিয়ে এল। একটা জোরালো লাথি কষানোর জন্য ডান পা-কে তৈরি করল। কিন্তু লাথিটা শুরু করার আগেই হাঁটুগেড়ে মাথা ঝুঁকিয়ে থাকা জাব্বা ডানহাতে ছোবল মারল জিশানের দু-পায়ের ফাঁকে। ওর সবচেয়ে দুর্বল প্রত্যঙ্গ আঁকড়ে ধরল। তারপর ইস্পাতের আঙুল দিয়ে পাথর গুঁড়ো করার শক্তিতে চাপ বাড়িয়ে চলল।
জাব্বার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল জয়ের গর্জন। আর জিশান যন্ত্রণায় এমন এক ভয়ংকর চিৎকার করে উঠল যে, সে-চিৎকার শুনে ও নিজেও ভয় পেয়ে গেল।
গ্যালারির দর্শক একসঙ্গে গর্জে উঠল। গ্যালারি থেকে পঞ্চাশ-ষাটটা রঙিন বেলুন উড়ে গেল আকাশে।
জিশান প্রাণ বাঁচাতে জাব্বার মাথায় প্রাণপণে ঘুসি-বৃষ্টি করতে লাগল। তারপর দু-হাতে ওর গলা টিপতে চাইল। কিন্তু ঘাড়ের দিক থেকে গলা টেপার চেষ্টা করায় ও তেমন জুতসই বাঁধন পাচ্ছিল না। এদিকে যন্ত্রণার তীব্র স্রোত দু-পায়ের ফাঁক থেকে শুরু হয়ে কোমর-বুক বেয়ে জিশানের মাথায় পৌঁছে যাচ্ছিল। সেখান থেকে ফেটে পড়ছিল যন্ত্রণার তীব্র চিৎকারে। সেই চিৎকার অ্যানটেনা থেকে বেরিয়ে আসা অদৃশ্য তরঙ্গের মতো আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। জিশানের মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ও অজ্ঞান হয়ে যাবে।
সেই অবস্থাতেই জিশান টের পেল জাব্বা ওর শর্টস খামচে ধরা মুঠোটাকে ধীরে-ধীরে কাছে টানছে—ওর মুখের কাছে। ও কি মুঠোর বদলে এবার ওখানে কামড় বসাবে নাকি? একটা ভয়ের স্রোত মিশে গেল যন্ত্রণার স্রোতের সঙ্গে। বাঁচার ইচ্ছেটা জিশানের ভেতরে প্রবল হয়ে উঠল। ওর মনে পড়ল মালিকের কথা, মনোহর সিং-এর কথা। তারপরে মনে হল, জাব্বা ওর দুর্বল প্রত্যঙ্গ নয়, শানুর কচি গলাটা বজ্রমুঠিতে আঁকড়ে ধরেছে। এখন সেই নরম গলায় হিংস্র কামড় বসাতে চাইছে।
শানু আর মিনির ছবি পালা করে ঝলকে যেতে লাগল ওর চোখের সামনে।
•
সেই রাতটার কথা জিশান কোনওদিনও ভুলবে না।
যেমন ঝড়, তেমন বৃষ্টি। ঘরের ভেতর থেকে ঝড়-বৃষ্টির দাপট শুনলে মনে হয় প্রকৃতির দাঙ্গা চলছে। ঝোড়ো বাতাস পাগলের মতো ছুটে চলেছে। এ-রাস্তা সে-রাস্তায়, এ-বাড়ি ও-বাড়ি, কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর মাঝে-মাঝেই বাজ পড়ছে।
সকাল থেকে শানুর জ্বর ছিল। তখন কতই-বা বয়েস বাচ্চাটার? বড়জোর মাসদেড়েক হবে। কিছুতেই খেতে চাইছে না। চোখ-মুখ লালচে। গাল দুটো ফোলা-ফোলা লাগছে। মিনি অস্থির হয়ে উঠেছে। কান্নাকাটি করছে।
ডাক্তারের বাড়ি দৌড়োদৌড়ি করে হোমিওপ্যাথি ওষুধ এনে দিয়েছিল জিশান। সেটা খেয়ে জ্বরটা একটু কমেছিল। কিন্তু বিকেলের পর আবার বাড়তে শুরু করল।
যখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হল তখন মিনি জিশানকে বারবার বলতে লাগল, ‘চলো, ওকে হসপিটালে নিয়ে চলো। এরপর আরও দেরি করলে আমার শানু আর বাঁচবে না…আর বাঁচবে না…।’ কথা বলতে-বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছে মিনি।
জিশান যে একটু কিন্তু-কিন্তু করছিল তার কারণ তখন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। তা ছাড়া সন্ধের পর মিনিকে নিয়ে রাস্তায় বেরোনোটা এ-শহরে মোটেই নিরাপদ নয়। তাই ও ভাবছিল যদি আজকের রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যায় তা হলে কাল সকালে…।
কিন্তু শানুর জ্বর ক্রমশ বাড়তেই লাগল। বাইরের পাগল করা ঝড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মিনিও পাগল হয়ে উঠল। আর জিশান দোটানায় পড়ে অস্থিরভাবে ছটফট করতে লাগল।
শেষ পর্যন্ত ওরা যখন রাস্তায় বেরোল তখন প্রায় সাতটা। দুটো ছাতা নিয়ে ঘুমন্ত শানুকে পলিথিনে জড়িয়ে মাথা হেঁট করে ওরা সামনে এগোচ্ছিল। আর ট্যাক্সির খোঁজে উদভ্রান্তের মতো এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছিল।
ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে অনেকটা পথ পেরিয়ে ওরা বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ভাঙাচোরা খানাখন্দে ভরা রাস্তার বেশিরভাগটাই পুকুরের চেহারা নিয়েছে। তারই মধ্যে দিয়ে কয়েকটা গাড়ি লাফাতে-লাফাতে ছুটে চলেছে। ওদের হেডলাইটের আলো সেই তালে-তালে ঝাঁকুনি খাচ্ছে।
না, একটাও খালি ট্যাক্সি চোখে পড়ল না।
তিনটে ছেলে কাকভেজা হয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। ওদের একজনের হাতে টর্চলাইট। জিশানদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওরা থমকে দাঁড়াল। টর্চের আলো ছুড়ে দিল মিনির মুখে। একজন বলে উঠল, ‘চলে এসো, মা-মণি। দুজনে মিলে একটু ঝড় তুলি—তারপর বৃষ্টি।’ বলেই খ্যা-খ্যা করে হেসে উঠল।
আর-একজন জড়ানো গলায় গান গেয়ে উঠল, ‘এই রাত তোমার আমার…।’
তৃতীয়জন চাপা গলায় দুই সঙ্গীকে ধমক দিল, ‘কী করছিস কী! দেখছিস না, কোলে একটা ছোট বাচ্চা রয়েছে! চল, চল—।’
সে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বাকি দুজনকে এগিয়ে নিয়ে চলল।
যেতে-যেতে একজন একটা হাত ওপরে তুলে মাতালের গলায় বলল, ‘সরি, হাজব্যান্ড। সরি…সরি…গুড বাই…।’
জিশান মিনিকে জড়িয়ে ধরে ছিল। সেইজন্যই টের পেল মিনি থরথর করে কাঁপছে। একইসঙ্গে ডুকরে কাঁদছে। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে ওর চাপা কান্না ভালো করে শোনা যাচ্ছিল না।
‘মিনি, মিনি—’ ওকে আশ্বাস দিতে গাঢ় গলায় ডাকল জিশান, ‘ভয় পেয়ো না। এখুনি একটা ট্যাক্সি পেয়ে যাব। জানোই তো, এ-শহরটা কেমন বাজে হয়ে গেছে। এটার দিকে আর কেউ তাকায় না। এটার কথা কেউ আর ভাবে না। সবাই জানে শহরটা একেবারে গোল্লায় গেছে।’
জিশান অস্থির হয়ে পড়ছিল। ছাতা মাথায় দিয়েও বৃষ্টির দাপট আটকানো যাচ্ছে না। শানুর হয়তো আরও ঠান্ডা লাগবে, জ্বর বাড়বে, এখুনি ও হয়তো জেগে উঠবে।
ওদের পাশ দিয়ে দুটো গাড়ি পরপর চলে গেল। জিশান রাইড পাওয়ার আশায় প্রবলভাবে হাত নেড়েছিল কিন্তু একটা গাড়িও দাঁড়াল না।
জিশান রাস্তা বরাবর নজর চালিয়ে দেখতে চেষ্টা করছিল আর কোনও গাড়ি আসছে কি না। কিন্তু বৃষ্টির চিক ভেদ করে বেশিদূর নজর গেল না। তবে হেডলাইট জ্বেলে কোনও গাড়ি যদি এগিয়ে আসত তা হলে তার হলদে আভা আর বৃষ্টির ফোঁটার ঝিকমিক নিশ্চয়ই জিশানের চোখে পড়ত।
ঝোড়ো হাওয়ার বেগ হঠাৎ বেড়ে গেল। কড়কড় করে দূরে কোথাও বাজ পড়ল। নীল আলোর ঝলকানি দেখা গেল। তার পরেই কানফাটানো শব্দ। জিশান উদভ্রান্তের মতো এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছিল। একটা ট্যাক্সি…ইস, একটা খালি ট্যাক্সি।
রাস্তার দুপাশের ফুটপাথ ঘেঁষে বেশ কয়েকটা ঝুপড়ি। ঝুপড়িগুলোর মাথায় পলিথিনের চাল—তার ওপরে ইটের টুকরো, কাঠের তক্তা আর বাঁশ চাপা দেওয়া। কয়েকটার পলিথিনের চালের কোনা হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে, অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে : ফটফট, ফটফট। রাস্তার ওপারে দাঁড়ানো দুটো বিশাল গাছ। গাছদুটো ঝোড়ো বাতাসে একটুও নড়ছে না। কারণ, গাছদুটোয় একটাও পাতা নেই। ধুলো-ময়লায় নোংরা এই শহরের বাতাস এতটাই নষ্ট প্রকৃতির যে, গাছের পাতা ক’দিন বাদেই ডাল থেকে খসে পড়ে।
আরও মিনিট-পনেরো-কুড়ি কেটে যাওয়ার পর মিনি কান্না-কান্না গলায় জিশানকে বলল, ‘চলো, বাড়ি ফিরে যাই। রাতটা কোনওরকমে কাটিয়ে দিই। তারপর কাল সকালে…।’
মিনির কথা শেষ হওয়ার আগেই হেডলাইট জ্বেলে ছুটে আসা একটা গাড়ি জিশানের নজরে পড়ল। গাড়িটা ট্যাক্সি কি না কে জানে! উত্তাল সাগরে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টার মতো জিশান একছুটে রাস্তার ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। পাগলের মতো ওর ছাতা আর হাত নাড়তে লাগল। ওর মনে হচ্ছিল, এ-গাড়িটা যদি না দাঁড়ায়, ওদের না সাহায্য করে, তা হলে শানুকে আর বাঁচানো যাবে না।
গাড়িটা জিশানের কাছে এসে দাঁড়াল। জলে ভেজা জিশান হেডলাইটের আলোয় মাখামাখি। ঠিকরে পড়া আলোয় ও বুঝতে পারল গাড়িটা ট্যাক্সি নয়—করসিকা-এইট—প্রাইভেট কার আর জিপের মাঝামাঝি একটা মডেল।
গাড়ির বনেট রং চটা, তোবড়ানো। বাকি চেহারাটাও তার সঙ্গে মানানসই। গাড়ির ভেতরে কতকগুলো ছায়া-ছায়া মানুষ। তাদেরই একজন নেমে পড়ল জল-কাদায় মাখামাখি রাস্তায়। হেডলাইটের আলোর পিছনে লোকটার অন্ধকার বিশাল চেহারা জিশানের চোখে পড়ল।