বাঁড়ুজ্জেরা ক্ষুদ্র জমিদার; সাত আনায় শিবনাথের আয় হাজার চারেক টাকা। তবে পাকা বন্দোবস্ত অনেক আছে; পালকিবহনের বেহারা চাকরান জমি ভোগ করে, মহলে পাইকদের জমি দেওয়া আছে, সদরে কাজ করিবার জন্যও চার জন পাইকের কায়েমি বন্দোবস্ত, নাপিত, বৃত্তিভোগী পুরোহিত, দেবদত্তের পূজক, এমনকি গয়া শ্ৰীক্ষেত্ৰ কাশী প্রভৃতি তীৰ্থস্থলের পাণ্ডারা পর্যন্ত জমি ভোগ করেন। গৃহদেবতার ফুল যোগাইবার ভারও একজনকে দেওয়া আছে, চাকরানভোগী বাদ্যকরকে নিত্য সকাল-সন্ধ্যায় টেকরা বাজাইতে হয়, সেজন্য মালিককে চিন্তা করিবার প্রয়োজন নাই।
যাক, জমিদার ক্ষুদ্র হইলেও শিবনাথের বিবাহটা হইল বিপুল সমারোহে। শিবনাথের বাপের বিবাহের ফর্দ বাহির করিয়া পিসিমা ফর্দ করিতে বসিলেন।
নায়েব বলিয়াছিলেন, অভয় দেন তো একটি কথা বলি মা।
পিসিমা বলিলেন, খরচের কথা বলবেন আপনি?
হ্যাঁ মা, সে আমল আর এ আমল, তার ওপর এই বাজার, জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য, আদায়পত্রের এই অবস্থা, হয়ত ঋণ করতে–
নায়েব কোনো সায় না পাইয়া কথা অর্ধসমাপ্ত রাখিয়াই নীরব হইয়া গেলেন। শিবনাথের মাও পাশে বসিয়াছিলেন, তিনি বলিলেন, আপনি ঠিক কথা বলেছেন সিংমশায়, বারুদের কারখানা, কি খেমটা নাচ, এই রকম কতকগুলো খরচা, সে অপব্যয়।
স্থানীয় মহলের বহু পুরাতন গোমস্তা প্রতাপ মুখুজ্জে বসিয়া ছিলেন, তিনি বলিলেন, সে ঠিক বউমা, ওগুলো অপব্যয় বৈকি।
পিসিমা বলিলেন, মতির মা, আমার তেল-গামছা বের করতো, বেলা অনেক হয়ে গেল।
নায়েব বলিলেন, তা হলে ফর্দটর্দ কী রকম হবে?
পিসিমা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, তোমরা ঠিক কর সব। কই রে মতির মা, কোথায় গেলি? অ মতির মা! হারামজাদী গেল কোথায়? কে? কারা ওখানে দাঁড়িয়ে?
কেষ্ট সিং আসিয়া বলিল, আজ্ঞে ২১৯ নম্বরের মুচি আর বাগদী প্রজারা।
কী, বলে কী সব?
প্ৰাণকৃষ্ণ বায়েন ভূমিষ্ঠ প্ৰণাম করিয়া জোড়হাতে বলিল, আজ্ঞে মা, আমরা বাবুর বিয়ের বাজনার বায়না নিতে এসেছি। বাগদীরা এসেছে রায়বেশের জন্যে।
পিসিমা তাহাদের সঙ্গে কোনো কথা কহিলেন না, ডাকিলেন নিত্যকে, নিত্য, দেখ তো, মতির মা গেল কোথায়?
প্রাণকৃষ্ণ বলিল, আমাদের রোশনচৌকি আর ঢেলার বাজনা আর কেউ নেয় না, কিন্তু আমাদের বাবুর বিয়েতে আমরা যেন বাদ না পড়ি।
কৃষ্ণবৰ্ণ বিশালকায় প্রৌঢ় রামভল্লা, জোড়হাতে পাশে দাঁড়াইয়াছিল, সে শুধু বলিল, আমরাও মা, আমরা রায়র্বেশে।
মতির মা এতক্ষণে তেল-গামছা আনিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল।
পিসিমা বলিলেন, তোকে জবাব দিলাম আমি মতির মা। তোর কাজে বড় অবহেলা হয়েছে।
তাহার হত হইতে গামছাটা টানিয়া কাঁধে ফেলিয়া তিনি রুক্ষই স্নান করিতে চলিয়া গেলেন।
ইহার পর আর ফর্দ হওয়া সম্ভব নয়। নায়েব গোমস্তা উঠিয়া গেল, শিবনাথের মা শুধু একটু হাসিলেন। প্রজারা দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাদের তিনি বলিলেন, তোমাদের বায়না হবে বৈকি বাবা, তোমাদের বাবুর বিয়েতে কি তোমাদের বাদ দেওয়া যায়?
তাহারা কৃতার্থ হইয়া প্ৰণাম করিল, অপ্রতিভের মত হাসিতে লাগিল।
মা বলিলেন, রতন, এদের সব জলখাবার দাও তো।
কেষ্ট সিং বলিল, আয় সব, উঠোনে সারি দিয়ে আঁচল পেতে দাঁড়া।
অবশেষে শৈলজা-ঠাকুরানীর ফর্দমতই আয়োজন, অনুষ্ঠান, সমারোহ করিয়াই বিবাহ হইল। রায়বেশে, ঢুলীর বাজনা, ব্যান্ড, ব্যাগপাইপ, নাচ, তরজা, আলো, চতুৰ্দোল, শোভাযাত্রা কিছুই বাদ পড়িল না। ব্রাহ্মণ শূদ্ৰ ইতর-জাতি সকলেরই নিমন্ত্রণ হইল। আয়োজন অনুষ্ঠানে কিছু ঋণ করা ভিন্ন উপায় ছিল না। সমস্ত এস্টেটের আয়ের অর্ধেক টাকাতেও এ কুলাইবার কথা নয়। কিন্তু কৌশলপরায়ণা এই জমিদারকন্যা এমন করিয়া ব্যবস্থা করিলেন যে, নায়েব গোমস্তা পর্যন্ত বিস্মিত না হইয়া পারিল না। উদ্যোগের প্রারম্ভেই এস্টেটের উকিলদিগকে লোক পাঠাইয়া আনিয়া যেসব মকদ্দমা চলিতেছিল, তাহারই অগ্রিম কিছু কিছু টাকা লইয়া বার শত টাকা সংস্থান করিলেন।
নায়েবকে বলিলেন, এ টাকার সঙ্গে আপনাদের সম্বন্ধ কী? এ তো বকেয়া পাওনা টাকা, এ হল এস্টেটের মজুত তহবিল, মামলা খরচের টাকা আমি নিলাম না, সে তো আপনার মজুতই রইল উকিলের কাছে।
হাজার টাকা ঋণ করিতে হইল।
পাকস্পর্শের দিন শিবনাথকে ও নববধূকে তিনি কাছারি-ঘরের বারান্দায় বসাইয়া দিয়া মহলের সমস্ত প্রজাকে বউ দেখাইলেন। পাশে নিজে দাঁড়াইয়া রহিলেন, ওপাশে নায়েব ও যাবতীয় গোমস্তা হাজির ছিল। বধূর পিছনে নিত্য-ঝি দাঁড়াইয়া ছিল। প্ৰকাণ্ড একখানা কাসার পরাত বর-বধূর পায়ের নিকট একটা পোয়ার উপর রক্ষিত ছিল, দেখিতে দেখিতে টাকায় সেটা ভরিয়া গেল। রাত্রি নয়টার সময় শেষ প্রজাটি চলিয়া গেল। তখন নয় বৎসরের নববধূটি চেয়ারের হাতলের উপর ঘুমাইয়া ঢলিয়া পড়িয়াছে।
পিসিমা বলিলেন, পরাত তোল কেষ্ট সিং।
বাড়ির মধ্যে শিবনাথের মা টাকা গনিয়া থাক থাক করিয়া সাজাইয়া তুলিলেন। গণনা করিয়া দেখা গেল, সাত শত উনপঞ্চাশ টাকা উঠিয়াছে।
আত্মীয়-কুটুম্বে কলরব করিতেছিল। একজন প্রৌঢ়া বলিলেন, ওগো পিসিমা, তোমরা এবার হিসেব নিকেশ শেষ কর বাপু। ফুলশয্যে আর কখন হবে? বউ তো তোমার ঘুমিয়ে কাদার মত পড়ে আছে।
পিসিমা বলিলেন, একটু দাঁড়াও না। সিংমশায়, আয়রন-চেস্ট খুলুন।
লক্ষ্মীর ঘরের মধ্যে সে-আমলের সিন্দুকের ধরনের ভারী আয়রন-চেস্ট, নায়েব ও অপর এক জন গোমস্তা দুই জনে মিলিয়া ডালাটা টানিয়া তুলিল। পিসিমা বলিলেন, এই সিন্দুক দাদা। আমার একা এক টানে টেনে তুলতেন।
সিন্দুকে তালা-চাবি বন্ধ করিয়া পিসিমা শোরগোল বাঁধাইয়া তুলিলেন, বাজনা বন্ধ কেন? কেষ্ট সিং রোশনচৌকি বাজাতে বল। কই গো, বউমারা সব কোথায় গেলে?
দেখিতে দেখিতে রোশনচৌকির বাজনা বাজিয়া উঠিল।
পিসিমা বলিলেন, নায়েববাবু, সন্দেশের ঘরের ভাড়ারীকে বলুন, লুচি মিষ্টি ফুলশয্যের ঘরে। পাঠিয়ে দিক, মেয়েরা খাবে সব। পাঁচথুপীর বউমা, তোমার ওপর ভার রইল, যারা না খাবেন, তাদের ছাঁদা দিও তুমি।
বহির্দ্বারে মোটা ভারী গলার শব্দ হইল, তারা তারা, মা হামার আনন্দময়ী।
কে? রামজীদাদা?
হাঁ হামার দিদি। আনন্দময়ী আজ হামাকে আনন্দ দিলেন দিদি। হামার শিবু বাবা আজ গৃহী হইল রে। আমি যে মায়ীকে আশীর্বাদী মালা আনিয়েছি ভাই।
তিনি বস্ত্রাঞ্চল মুক্ত করিয়া বাহির করিলেন দুই গাছি সত্বরচিত বনমল্লিকার মালা। সমস্ত প্রাঙ্গণটা গন্ধে ভরিয়া গেল।
যাও দাদা, ওপরে যাও তুমি, আশীৰ্বাদ করে এস।
সন্ন্যাসী শুধু মালা দুই গাছিই দিলেন না, দুইটি টাকা বধূর হাতে দিয়া বলিলেন, ভাগ্যমানী লছমী হবেন হামার মায়ী।—বলিয়া টাকা দেওয়ার জন্য কেহ কোনো অভিযোগ করিবার পূর্বেই তিনি একটু দ্রুতই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। ফুলশয্যার উৎসব আরম্ভ হইল।
পাঁচথুপীর বউ পিসিমাকে ডাকিল, একবার তুমি এস পিসিমা, দেখে যাও। পিসিমা উত্তর দিলেন না, মুক্ত অঙ্গনে আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া তিনি দাঁড়াইয়া ছিলেন। রতন ভাসিয়া বলিল, একবার চলুন পিসিমা, মজা দেখবেন চলুন। বউ কিছুতেই উঠছিল না, শিবনাথ কষে কান মলে দিয়েছে।
সে হাসিয়া উৎসবক্লান্ত বাড়িখানাকে মুখরিত করিয়া তুলিল। পিসিমা বলিলেন, বউ কোথায়?
রতন বলিল, শুয়েছেন তিনি, কিছুতেই উঠলেন না। বোধহয়। সে চুপ করিয়া গেল।
পিসিমা বলিলেন, কাঁদছে? আরও কী বলিতে গিয়া তিনি বলিতে পারিলেন না, পরমুহুর্তেই দ্রুতপদে উপরে গিয়া শয়নঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন।
শিবনাথ তখন ঘরের মধ্যে ভ্রাতৃবধূদের অনুরোধমাত্রেই সোৎসাহে গান আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। আবার কিছুক্ষণ পরে পিসিআর দরজা খোলার শব্দ হইল। পিসিমা ক্লান্ত রুদ্ধস্বরে ডাকিলেন, কে আছ নিচে?
কে উত্তর দিল, আজ্ঞে, আমি মা—শ্ৰীপতি, বেলেড়া মৌজার গোমস্তা।
হুকুম হইল, কেষ্ট সিংকে বলে দাও ফুলশয্যার ঘরের দোরে পাহারা থাকতে।
মা উপহার দিয়াছেন—বধূকে একখানি রামায়ণ ও শিবুকে একটি রুপাবাঁধানো কলম।