বনু কুরাইজা হত্যাকাণ্ড—ঘটনার পেছনের ঘটনা
শাবিরকে আমি সবসময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কারণ, আমাকে দেখলেই সে মোল্লা বলে টিটকারি করে। আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করাটা তার কাছে আনন্দের ব্যাপার। তোর ধর্ম এমন-তেমন বলে বলে আমাকে সে উত্তেজিত করার চেষ্টা করে। আরে বাপু, দু-চার লাইন পড়ে পণ্ডিত হয়েছিস ভালো কথা, প্যান প্যান করে অন্যের মাথা খেতে হবে কেন শুনি?
ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে তার অসংখ্য অভিযোগ! এত অভিযোগ সম্ভবত মক্কার কুরাইশ নেতাদেরও ছিল না। সেদিন দোয়েল চত্বরে তার সাথে দেখা। দূর থেকে দেখেই আমি পাশ ফিরে গেলাম। বিরক্তিকর লোকগুলো সবসময়ই আমার আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। কী জ্বালা! শাবির ঠিক-ই আমাকে চিনে ফেলল। এসেই তার ফোকলা দাঁতগুলো বের করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস আরিফ?
ভালো।
আমার উচিত সে কেমন আছে জিজ্ঞেস করা; কিন্তু এই ক্যাটাগরির লোকগুলোর সাথে যত কম কথা বলা যাবে, ততই উত্তম। সে আবার জিজ্ঞেস করল, কারও জন্য অপেক্ষা করছিস?
না
চল চা খাই?
না! আমার তাড়া আছে।
রোবটের মতো উত্তর দিচ্ছিস কেন?
মন চাচ্ছে ওর সামনে থেকে দৌড়ে পালাতে। ওর প্রশ্নের এখনো যে আমি রোববাটিক গলায় উত্তর দিচ্ছি সেটিই তো ঢের আশ্চর্যের ব্যাপার! শাবির আমার হাত ধরে বলল, চল, চা খাব। কতদিন হয় তোর সাথে চা খাই না।
চোখেমুখে মহাবিরক্তি নিয়ে আমি তার পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করলাম। চেষ্টা করেও তার অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। শাবির বলল, তুই আমাকে খুব অপছন্দ করিস, তাই না?
এই মুহূর্তে যদি তার মুখের ওপরেই বলতে পারতাম আমি তোকে এক্কেবারে অপছন্দ করি। তুই আর কোনোদিন আমার সাথে কথা বলবি না, তাহলে বেশ হতো; কিন্তু পৃথিবীতে মন চাইলেই সবকিছু করা বা বলা যায় না। আমিও বলতে পারলাম না। কেবল তার প্রশ্নের প্রতিউত্তরে নকল একটি হাসি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম—আমি তাকে আসলে অপছন্দ করি না।
আলম ভাইয়ের টং দোকানে এসে সামনে পেতে রাখা বেঞ্চিতে সে বসল। আলম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ফোকলা দাঁতগুলো বের করে বলল, মামা, চা দাও দুই কাপ। আমারটায় চিনি কম দিবা, লিকার বেশি।
রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে বাদাম-বিক্রেতা, চা-বিক্রেতা সবাইকেই ঢাকা শহরের লোকজন মামা বলে ডাকে। কেবল আমিই একটু ভিন্ন। একটু কম বয়স হলে ভাইয়া ডাকি, একটু বেশি বয়স হলে আঙ্কেল। মামা ডাকি না কাউকেই। আলম ভাই আমাকে খুব ভালোভাবেই চেনেন। রোজ সকালে তার দোকান থেকেই চা খাই আমি আর সাজিদ। আলম ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটি হাসি দিলেন। শাবির ধমকের সুরে আমাকে বলল, আরে বস না ব্যাটা।
আমি বসলাম ওর পাশে। ইয়া লম্বা লম্বা চুল তার। হাতে ব্রেসলেট, গায়ের কয়েক জায়গায় ট্যাটু করা। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সে বলল, জানিস, আমার বাবার একটি ব্যাপার না আমার খুব্বি ভালো লাগে। বাপ আমার উঠতে-বসতে ইয়াহিয়া খান আর ভুট্টোকে গালি দেয়। শোবার আগে গালি দেয়, শোয়া থেকে উঠে গালি দেয়; অবস্থা দেখে মনে হয় এই দুই ইনসানকে গালি না দিলে আমার বাপের পেটের ভাত হজম-ই হয় না।
মনে মনে বললাম, তোর বাপের গল্প শুনতে চেয়েছে কে-রে, নালায়েক!
সে আবার বলল, কেন গালি দেয়, জানিস?
না।
কারণ, এই দুই লোক বাঙালিদের ওপরে ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালিয়েছিল। হত্যা করেছিল হাজার হাজার মানুষ। এই কারণে বাবা এদের দুজনকে একদমই দেখতে পারে না। বলতে পারিস দুজন-ই বাবার চোখের বিষ।
চুপ করে আছি আমি। সে অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে, কিন্তু আমার বাবা আবার খুবই ধার্মিক লোক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ-কালাম পড়ে। তার পিয়ারের পিয়ার নবীর জন্য তার যে কী দরদ! আহা!
আমি জানতাম শাবির ঘুরে-ফিরে এই টপিকেই চলে আসবে। খাঁজকাটা কুমিরের গল্পের মতো-ই সে সবখানে ধর্মকে টেনে আনে। মহাত্মা গান্ধীর ছাগল চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে দিলে তারমধ্যেও সে ধর্মকে টেনে এনে একহাত নেওয়ার চেষ্টা করবেই করবে।
এরই মধ্যে আমার মোবাইলে কয়েকবার রিং হয়ে গেল। সাজিদের ফোন। আমার মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় বুঝতে পারিনি। কল ব্যাক করতেই সাজিদ ওপ্রান্ত থেকে জানতে চাইল, কই আছিস?
আলম ভাইয়ের দোকানে। তোর ক্লাস কি শেষ?
হুম।
তাহলে চলে আয় এদিকে।
আচ্ছা বলে সাজিদ ফোনটি রাখল।
সাজিদ সম্ভবত কাছাকাছিই ছিল। আসতে বেশিক্ষণ লাগল না ওর। তাকে দেখে আলম ভাই আবারও মিষ্টি একটি হাসি দিলেন। এই লোকের হাসিটি খুবই চমৎকার। পাক্কা কোনো ফটোগ্রাফারের চোখে পড়লে ফ্রেমবন্দি হয়ে যাবে নিশ্চিত।
সাজিদের জন্যও এককাপ চা অর্ডার করা হলো। সে এসে আমার পাশে বসল। শাবিরকে সে আগে থেকেই চেনে। কবিতা আবৃত্তিশালায় একসাথে ওরা কবিতা আবৃত্তি শিখত। তা ছাড়া, আমি আর শাবির সেইম ডিপার্টমেন্টেই পড়ি। সেই সুবাদে শাবিরকে নিয়ে অনেক গল্প করা হয়ে গেছে সাজিদের সাথে।
পৃথিবীতে মানুষ মানুষের কাছে তার ভালোলাগার মানুষদের গল্প করে। আর আমি গল্প করি আমার অপছন্দের মানুষগুলো নিয়ে। আমার অপছন্দের তালিকায় বাংলাদেশের কয়েকজন সেলিব্রেটি আছেন। আছেন আমাদের ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক আজমত স্যার, বাকি বিল্লাহ স্যারসহ অনেকে। শাবির সেই তালিকার একেবারে প্রথম দিকের একজন।
আমি শাবিরের একটি কথা বুঝতে পারিনি। তার বাবা নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে ইয়াহিয়া ভুট্টোকে গালাগাল দেয় তা বুঝলাম; কিন্তু এর সাথে তার বাবার ধার্মিক, নবী-প্রেমিক হবার কী সম্পর্ক?
খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাবিরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর বাবা ১৯৭১ এর ঘটনার জন্য ইয়াহিয়া-ভুট্টোকে গালাগালি করে, বুঝলাম; কিন্তু এর সাথে তার ধার্মিক বা নবী-প্রেমিক হবার কী হেতু?
শাবির চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতে দিতে বলল, ইয়াহিয়া-ভুট্টো ঠিক যে-দোষে বাবার গালি খায়, ইসলামের নবীও ঠিক একই দোষে দোষী; কিন্তু বাবা ইয়াহিয়া ভুট্টোকে রোজ গালি দিলেও, ইসলামের নবীর জন্য তিনি একেবারে দিওয়ানা। আশেকে রাসূল। পিয়ারে রাসূল। একেই বলে অন্ধবিশ্বাস। ধর্মান্ধতা।
সাজিদ শাবিরের দিকে তাকাল। সে তাকানোয় একধরনের বিস্ময় আছে। কোনো ছেলে তার বাবাকে নিয়ে এভাবে মন্তব্য করতে পারে দেখে সাজিদ হয়তো অবাক-ই হয়েছে। সাজিদ বলল, আমি ঠিক বুঝলাম না। তুই কী বোঝাতে চাচ্ছিস? ইয়াহিয়া ভুট্টো-ইসলামের নবী… সব গুলিয়ে ফেলেছিস মনে হচ্ছে।
ব্যাপারটি স্পষ্ট করার জন্য নড়েচড়ে বসল শাবির। বলল, সাজিদ, তুই তো ১৯৭১ সালের ঘটনা জানিস, তাই না?
হুম।
ইয়াহিয়া-ভুট্টো বাঙালিদের ওপরে যে-পাশবিকতা চালিয়েছিল, সেটিও নিশ্চয় জানিস?
হুম।
বাঙালির কি কোনো অপরাধ ছিল এতে?
না।
ঠিক একইভাবে বনু কুরাইজার ওপরে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তোদের নবী। অথচ বনু কুরাইজা গোষ্ঠীর কোনো অপরাধ ছিল না। অপরাধ কী ছিল জানিস?
সাজিদ বলল, বল শুনি…।
বনু কুরাইজা গোষ্ঠীর অপরাধ ছিল মুহাম্মদকে যখন মক্কার কুরাইশরা স্বদেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, তখন মদীনার এই বনু কুরাইজাসহ অন্যান্য ইহুদী গোষ্ঠী মুহাম্মাদকে মদীনায় আশ্রয় দিয়েছিল।
এরপর?
বনু কুরাইজারা মুহাম্মদকে নেতা নির্ধারণ করেছিল।
তারপর?
বনু কুরাইজারা সংখ্যালঘু ছিল।
শাবির থামল। চায়ে ফু দিয়ে চুমুক দিল সাজিদ। এরপর বলল, আর কিছু?
এভাবে নিরপরাধ একটি জাতিকে উচ্ছেদ করা কোনো বিবেকবান লোক সহ্য করতে পারে?
সাজিদ বলল, একদমই না। এটি একেবারে মেনে নেওয়া যায় না।
হঠাৎ, পেছন থেকে এসে আমার কাঁধে হাত রাখল কেউ একজন। পাশ ঘুরতেই দেখলাম বিমল দা।
বিমল দা হচ্ছে আমাদের ডিবেট ক্লাবের সেক্রেটারি। তিনি খুবই ভালো মানুষ; কিন্তু একটাই দোষ। ধর্মবিরোধী। এজন্য বিমল দাকে আমি কিছুটা অপছন্দ করি। আমি কেন যেন ধর্মবিরোধী লোকগুলোকে একদম সহ্য করতে পারি না। এই যেমন শাবির, আমার ক্লাসমেট। অথচ ওর কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে পারলেই যেন বাঁচি; কিন্তু সাজিদের ওঠা-বসা, মেলামেশা সব এদের সাথেই। ওর কথা হচ্ছে, জগতের সবার মতামতকে শুনতে হয়, বুঝতে হয়। আমি বাপু এত মতামত শোনার পক্ষে না।
বিমল দা আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল
ইচ্ছে করে শালিক হতে নীল আকাশের কোলে
ইচ্ছে করে ধুলোয় লুটাই আমার মায়ের বোলে।
ইচ্ছে করে মেঘের দেশে বৃষ্টি হতে ফের–
যখন তখন হারিয়ে যাবার ইচ্ছে আমার ঢের!
এটি আমার লেখা কবিতার একটি অংশ। বিমল দার মুখে এটি প্রায়ই শুনি। বিপ্লব দা এবং বিমল দা আমার কবিতার একনিষ্ঠ ভক্ত। কবিতার এই লাইনগুলো আবৃত্তি করে বিমল দা বলল, কী ব্যাপার! কবিদের সভা হচ্ছে নাকি এখানে? আমাকে ছাড়া টিএসসিতে কোনো কবিতার আড্ডা হতে দেওয়া চলবে না। এ জন্য আজকে হরতাল!!!
তার কথা শুনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম। আমাদের সাথে সাথে আলম ভাইও হেসে ফেললেন। বিমল দা খুবই মজার লোক। মানুষকে হাসাতে পারার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে। শাবির বলল, না দাদা, এখানে কবিতার সভা হচ্ছে না, ধর্ম নিয়ে আলাপ হচ্ছে…।
বিমল দা বলে উঠল, ওম শান্তি ওম শান্তি!!
বিমল দা এটি টিটকারি করে বলল নাকি মজা করে বলল ঠিক বুঝলাম না। বিমল দা আবার বলল, তা ধর্মের কোন অংশটি নিয়ে আলাপ হচ্ছে? রামের লঙ্কা জয়, নাকি যিশু খ্রিষ্টের মরেও বেঁচে যাওয়া? অথবা, মুহাম্মাদের ধর্মযুদ্ধ? কোনটা?
আমি আর সাজিদ চুপ করে আছি। শাবির বলল, দাদা, ইসলামের নবী শান্তি প্রতিষ্ঠার নাম করে যে নিরপরাধ বনু কুরাইজা সম্প্রদায়কে হত্যা করেছিল, এটি নিয়েই বলছি…।
ও আচ্ছা। বনু কুরাইজা নিরপরাধ তো ছিলই, তাদের গোত্রের সকল পুরুষকেই হত্যা করেছিলেন দয়ার নবী। শুধু তা-ই না, বনু কুরাইজা সম্প্রদায়কে হত্যা করার আগে দয়ার নবীকে মদীনায় আশ্রয় দেওয়া আরও দুই ইহুদী সম্প্রদায় বনু কায়নুকা এবং বনু নাযীরকেও তিনি মদীনা থেকে বের করে দেন। অথচ, তিনি নাকি স্রষ্টার কাছ থেকে রহমতস্বরূপ এই ধরাধামে অবতরণ করেছেন। What an irony…!
না! আর চুপ করে থাকা যাচ্ছে না। দুজনের টিটকারি আর উপহাসে আমার গা ঘিনঘিন করছে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, সাজিদ আমাকে ইশারা করে চুপ করতে বলল। ইতোমধ্যেই বিমল দা তার হাতে থাকা চায়ের কাপে শেষ চুমুকটুকু দিয়ে সিগারেট ধরাল। সিগারেটের ধোঁয়া খোলা আকাশে ফু দিয়ে বিলীন করে দিতে দিতে বলল, কই, আলাপ কি থেমে গেল নাকি?
বিমল দার কথা শুনে শাবির সাজিদের দিকে ফিরে বলল, সাজিদ, তোর কী মনে হয়, এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ নয়?
অবশ্যই মানবতাবিরোধী অপরাধ, সাজিদের সরল স্বীকারোক্তি।
এরপরেও কি বলবি তোদের নবী ঠিক কাজ করেছে?
এবার সাজিদ চুপ করে গেল। বিমল দা বলল, Hell be back with his witty logics now, Ha-ha-ha…
সাজিদ বিমল দার কথায় কর্ণপাত করল বলে মনে হলো না। সে শাবিরের দিকে তাকিয়ে বলল, শাবির, দেখা যাচ্ছে তুই আমার মতামত শুনতে বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছিস। যদি ধৈর্য ধরে শোনার মতো অবস্থায় থাকিস, তাহলে আমি আমার মতামত তুলে ধরতে পারি।
বিমল দা সিগারেটে শেষ-টান দিয়ে দূরে ছুড়ে মারল শেষ অংশটুকু। এরপর বিদ্রুপের সুরে বলল, শুধু শাবির কেন ব্রো? আমরাও তোমার বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় আছি।
শাবির বলল, অবশ্যই, আমরা শুনতে আগ্রহী।
দুজনের আগ্রহ দেখে সাজিদ বলতে আরম্ভ করল, আচ্ছা বিমল দা, খুব সংক্ষেপে কিছু কথা বলব। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।
বিমল দা বলল, হুম।
ধরো, তুমি, আমি, আরিফ আর শাবির, আমরা চারজন মিলে একটি রাষ্ট্র গঠন করলাম।
হুম।
আরও ধরো, আমরা এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিশেবে তোমাকে নির্বাচিত করলাম। ঠিক আছে?
বিমল দা মাথা নেড়ে বললেন, কিয়া বাত হ্যায়! আমি রাষ্ট্রপতিও হয়ে গেলাম? সে যা-ই হোক, ধরে নিলাম—আমি এখন রাষ্ট্রপতি। তারপর?
সাজিদ বলল, এখন তুমি যেহেতু আমাদের ভূখণ্ডের রাষ্ট্রনায়ক, তাহলে আমাদের করণীয় কী?
বিমল দার উত্তর, তোদের করণীয় হচ্ছে, তোরা যেহেতু আমাকে নেতা নির্বাচন করেছিস, সেহেতু আমার সিদ্ধান্ত মেনে চলা। আমার তৈরি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা করা এবং তা মেনে চলা।
তোমার তৈরি আইন মানে? সাজিদের প্রশ্ন।
আমার তৈরি আইন মানে হচ্ছে রাষ্ট্রের তৈরি আইন।
ও আচ্ছা, সে আইনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কোনো ধারা থাকবে? সাজিদের পাল্টা প্রশ্ন।
বিমল দার উত্তর, অবশ্যই থাকবে। থাকতে হবে।
কীরকম?
কেউ যখন যে-রাষ্ট্রে বাস করে সেই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের আইন ও সরকার ইত্যাদির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সেগুলো কেমন হতে পারে?
বিমল দা ভাবতে লাগল। সাজিদ আবারও বলল, বিমল দা, তুমি চাইলে বাংলাদেশ সংবিধানের সাহায্য নিতে পারো।
সাজিদের কথা শুনে হাসি দিল বিমল দা। ঝটপট সমাধান পেয়ে হয়তো-বা খুশি হয়েছে। সাথে সাথেই গুগল সার্চ করে বিমল দা বাংলাদেশ সংবিধানের দণ্ডবিধির ধারাগুলো পড়া শুরু করল। দুবার আগাগোড়া চোখ বুলিয়ে এবার রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিধান খুঁজে পেল। বিমল দা সরাসরি বাংলাদেশ সংবিধানের পেনাল কোড ১৮৬০ এর ১২১ ধারা থেকে পড়া শুরু করল : ১২১ ধারায় আছে, Whoever wages war against Bangladesh, or attempts to wage such war, or abets the waging of such war, shall be punished with death, or (imprisonment) for life, and shall also be liable to fine
অর্থাৎ বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ১২১ ধারায় বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কেউ যদি যুদ্ধ পরিচালনা করে অথবা যুদ্ধ পরিচালনার চেষ্টা করে, নতুবা এরকম যুদ্ধ পরিচালনায় যদি অন্যপক্ষকে সাহায্যও করে, তাহলে সে (বা তারা ) মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, সাথে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।
১২১ ধারার (ক) নম্বর ধারায় আছে, Whoever within or without Bangladesh conspires to commit any of the offences punishable by section 121, or to deprive Bangladesh of the sovereignty of her territories or of any part thereof, or conspires to overawe, by means of criminal force or the show of criminal force, the Government, shall be punished with imprisonment for life] or with imprisonment of either description which may extend to ten years, and shall also be liable to fine
অর্থাৎ কেউ বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে ১২১ ধারায় কোনো অপরাধের ষড়যন্ত্র করলে অথবা বাংলাদেশের বা বাংলাদেশের কোনো অংশের সার্বভৌমত্ব খর্ব করার ষড়যন্ত্র করলে অথবা অপরাধমূলক শক্তি প্রয়োগ বা প্রদর্শন করে বৈধ সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করলে তার শাস্তি হবে যাবজ্জীবন বা অনূর্ধ্ব ১০ বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডও।
১২২ নম্বর ধারায় আছে, Whoever collects men, arms or ammunition or otherwise prepares to wage war with the intention of either waging or being prepared to wage war against Bangladesh, shall be punished with (imprisonment] for life or imprisonment of either description for a term not exceeding ten years, and shall also be liable to fine.
অর্থাৎ কেউ যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে সৈন্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ করে, তাহলে সে (বা তারা) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
বিমল দার পড়া শেষ হলে সাজিদ বলল, তাহলে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য যে-শাস্তির কথা উল্লেখ আছে তা এরকম :
এক, কেউ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করলে বা করার চেষ্টা করলে বা (এরকম কাজে লিপ্ত বাইরের) কাউকে সাহায্যও করলে, তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন এবং অর্থদণ্ড।
দুই. বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং এর সরকারকে উচ্ছেদ কিংবা কোনো অংশের স্বাধীনতা খর্ব করার কোনো ষড়যন্ত্র কেউ করলে তার শাস্তি—যাবজ্জীবন বা অনূর্ধ্ব ১০ বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
তিন. কেউ যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে সৈন্য, অস্ত্র, গোলা-বারুদ সংগ্রহ করে, তাহলে সে (বা তারা) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
বিমল দা মাথা নাড়িয়ে বলল, হ্যাঁ। এরকমই তো লেখা।
এবার প্রশ্ন করল শাবির। সে বলল, কিন্তু সাজিদ, তুই হঠাৎ এরকম আইন-আদালত নিয়ে বসলি কেন এখানে?
আগে আমার কথা শেষ হোক বলে সাজিদ আবার বলতে আরম্ভ করল, আচ্ছা বিমল দা, তুমি এখন আমাদের রাষ্ট্রপতি, ঠিক আছে?
মাথা নাড়ল বিমল দা।
ধরো, যদি আমি এবং আরিফ তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্লট আঁকি? যদি আমরা তোমাকে মান্য করার, তোমার তৈরি সংবিধান মান্য করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েও তোমার বিরুদ্ধে, তোমার আইনের বিরুদ্ধে যাই? যদি তোমার শত্রুদের সাহায্য করি? অস্ত্র দিই? সৈন্য দিই? তাহলে তুমি তোমার সংবিধান-মতে আমাদের কী বিচার করবে?
বিমল দা কিছুক্ষণ ভাবল। এরপর বলল, হয়তো তোদের দুজনকে মৃত্যুদণ্ড দেবো, নয়তো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড…।
এক্সাক্টলি! তুমি ঠিক এটাই করবে এবং রাষ্ট্রনেতা হিশেবে, সংবিধান-মতে, তোমার ঠিক এটাই করা উচিত। সাজিদ বলল। সে আরও বলতে লাগল, এবার একই চিত্রপটে আরেকটি ঘটনায় আসো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হিজরত করে মদীনায় আসলেন, তখন মদীনায় ইহুদী সম্প্রদায় ছিল তিনটি। বনু নাযীর, বনু কায়নুকা এবং বনু কুরাইজা। মদীনায় এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার নেতা হলেন এবং মদীনার ইহুদী সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সম্প্রদায় নিয়ে তিনি একটি রাষ্ট্রীয় সংবিধান তৈরি করলেন। সেই সংবিধানের নাম : মদীনা সনদ। এটুকু তো সবাই জানি, তাই না?
হু, বিমল দার সম্মতি।
সেই মদীনা সনদের অনেকগুলো ধারা ছিল। ধারাগুলোতে বলা ছিল : মদীনায় মুসলিম, ইহুদী এবং অন্যান্যরা পরস্পর সহাবস্থান করবে এবং কেউ মদীনা আক্রমণ করলে সবাই একযোগে যুদ্ধ করবে। মদীনার কেউ কখনোই কুরাইশদের সাহায্য সহযোগিতা করবে না ইত্যাদি।
এখন, সীরাত থেকে আমরা জানতে পারি, মদীনায় ইহুদী গোষ্ঠী বনু নাযীর এবং বনু কায়নুকা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্লট আঁকে। তাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করে। কুরাইশদের সাথেও গোপনে যোগাযোগ রাখে, যা ছিল স্পষ্ট সনদবিরুদ্ধ। এমতাবস্থায়, এই দুই সম্প্রদায়কে মদীনা থেকে বহিষ্কার করলে কি তা সংবিধানবিরুদ্ধ হবে? আমাদের পেনাল কোড- ১৮৬০ অনুসারে এদের কী শাস্তি হওয়া উচিত?
বিমল দা চুপ করে আছে। সাজিদ কেন এত লম্বা গল্প ফাঁদল এতক্ষণে বুঝলাম। বিমল দা যে বলেছিল, দয়ার নবী কেবল বনু কুরাইজা নয়, বনু নাযীর আর বনু কায়নুকা গোত্রও স্বদেশ ছাড়া করেছিল, এর জবাব দেওয়ার জন্যই সে এতদূর কাহিনি সাজিয়েছে।
সাজিদ আবার বলতে লাগল, আমাদের পেনাল কোড অনুযায়ী-ই তো এটি স্বতঃসিদ্ধ। তাহলে একজন রাষ্ট্রনায়ক হয়ে, মদীনার সর্বোচ্চ নেতা হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি আইনের প্রয়োগ করে, তাতে কেন অসুবিধা হবে বিমল দা?
কারও মুখে কোনো কথা নেই। বিমল দা একদম চুপসে গেছে। আলম ভাই চায়ের কেতলি চুলোয় তুলে দিচ্ছেন আর মুচকি মুচকি হাসছেন।
একটু থেমে সাজিদ এবার শাবিরকে উদ্দেশ্য করে বলল, এবার তোর পয়েন্টে আসি, শাবির। তুই বলতে চাস যে, বনু কুরাইজা গোত্র নিরপরাধ ছিল, তাই তো?
হ্যাঁ, শাবির বলল।
তোর দাবির পক্ষে প্রমাণ আছে?
শাবির বলল, সীরাতে ইবনে ইসহাক-এ বর্ণনা করা আছে, মুহাম্মদ যখন খন্দকের যুদ্ধের জন্য পরিখা খনন করে ঘরে এসে অস্ত্র ত্যাগ করে গোসলের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই জিবরাঈল এসে তাকে কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধে ফুসলিয়ে দেয়। ব্যস, মুহাম্মদ তার সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে তাদের হত্যা করে আসে। অথচ, বনু কুরাইজা ছিল নিরপরাধ। একটি নিরপরাধ গোত্রের সকলকে নির্বিচারে হত্যা করে ফেলা কি অমানবিক নয়?
সাজিদ একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, সীরাতে ইবনে ইসহাক-এর কত পৃষ্ঠায় এটি আছে?
৮২ পৃষ্ঠায়, শাবিরের উত্তর।
তার মানে, তুই সীরাতে ইবনে ইসহাক-এর বর্ণনা টেনে প্রমাণ করতে চাইছিস যে, বনু কুরাইজা কোনো অপরাধ করেনি।
হ্যাঁ। সীরাতে ইবনে ইসহাক-এর এই বর্ণনাতে তাদের অপরাধের কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। এটাই প্রমাণ করে বনু কুরাইজা গোষ্ঠী নিরপরাধ ছিল।
সাজিদ বলল, তুই সীরাতে ইবনে ইসহাক পুরোপুরি পড়েছিস কখনন? এই প্রশ্ন শুনে বিমল দা, শাবির এবং আমি সাজিদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম।
সাজিদ বলল, তুই সীরাতে ইবনে ইসহাক-এর ৮২ পৃষ্ঠার বর্ণনা টেনে প্রমাণ করতে চাইছিস যে, বনু কুরাইজা নিরপরাধ। অথচ সীরাতে ইবনে ইসহাক-এর ৮০ পৃষ্ঠাতেই আছে, And news came that the Jewish tribe of Banu Qurayza had broken their treaty with Muhammad
অর্থাৎ জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসে খবর দেওয়ার আগেই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে খবর চলে আসে যে, বনু কুরাইজা গোত্র চুক্তিভঙ্গ করেছে। সীরাতে ইবনে ইসহাক-এর এই লাইনগুলো মনে হয় তোর চোখ এড়িয়ে গেছে, তাই না?
সাজিদের কথা শুনে শাবির চুপ করে আছে। সাজিদ বলে যেতে লাগল, বনু কুরাইজা যে অপরাধী ছিল, তার অনেক ঐতিহাসিক প্রমাণ বিদ্যমান আছে। সহীহ বুখারী-তে ইবনু উমারের বরাতে বলা হয়েছে, Bani An-Nadir and Bani Quraiza fought (against the Prophet violating their peace treaty), so the Prophet exiled Bani An-Nadir and allowed Bani Quraiza to remain at their places (in Medina) taking nothing from them till THEY FOUGHT AGAINST THE PROPHET AGAIN.[১]
এখান থেকে স্পষ্ট যে, বনু কুরাইজা চুক্তি ভঙ্গ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। সুনানু আবি দাউদে ইবনু উমারের বরাতে বলা হচ্ছে, The Jews Al Nadir and Quraizah fought with the Apostle of Allah, so the Apostle of Allah expelled Banu Al Nadir and allowed the Quraizah to stay and favored them. The Quraizah thereafter fought (with the Prophet).[২]
এখান থেকেও স্পষ্ট যে, বনু কুরাইজা সম্প্রদায় নিরপরাধ ছিল না। তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছিল। তাহলে, তুই যে বলছিলি— নিরপরাধ বনু কুরাইজা-নিরপরাধ বনু কুরাইজা, এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। তারা নিরপরাধ ছিল না, অপরাধী ছিল। সংবিধান লঙ্ঘন করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো অপরাধ।
তাহলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রনেতার বিরুদ্ধে গিয়ে, তাকে উৎখাত করে নিজেদের স্বায়ত্তশাসন চালু করতে বা অন্য কোনো শত্রুপক্ষকে বিজয়ী করতে যখন কেউ রাষ্ট্রদ্রোহ করে, পেনাল কোড- ১৮৬০ অনুযায়ী তার কী শাস্তি হওয়া উচিত?
আমি বললাম, মৃত্যুদণ্ড…।
এক্সাক্টলি, সাজিদের জবাব।
এতক্ষণ পরে বিমল দা বলে উঠল, তা বুঝলাম; কিন্তু মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন দণ্ড দিলেও তো পারত, তাই না? সাজিদ হাসল। তারপরে বলল, মজার ব্যাপার হলো কী জানোনা, হত্যার এই নির্দেশ কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেননি।
অদ্ভুত কিছু শুনলে মানুষ যেরকম চমকে ওঠে, আমিও সেরকম চমকে উঠলাম অনেকটা। চোখ বড় বড় করে সাজিদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শাবির বলল, মানে কী? হত্যার নির্দেশ নবী মুহাম্মাদ না দিলে তাহলে দিল কে?
সাজিদ বলল, বনু কুরাইজা সম্প্রদায়কে হত্যার নির্দেশ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেননি। দিয়েছিলেন সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু। বনু কুরাইজাদের সামনে অপশান রাখা হয়, তারা কি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রায় মানবে, নাকি তাদের পূর্বসূরি, যিনি একসময় ইহুদী ছিলেন, সেই সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর রায় মানবে। ইহুদীরা সম্মিলিতভাবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বাদ দিয়ে সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহুকে বাছাই করেছিল এবং সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর দেওয়া রায় অনুসারেই কিন্তু তাদের হত্যা করা হয়। তাদের হত্যার রায়টি আলটিমেটলি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে আসেনি।
শাবির কাচুমাচু করে বলল, তবুও, এটি একটি অমানবিক কাজ।
কোনটি অমানবিক? সাজিদের জিজ্ঞাসা।
এভাবে একসাথে এতগুলো ইহুদী-হত্যার নির্দেশ দেওয়াটা।
সাজিদ হেসে বলল, অমানবিক হবে কেন? এই আইন তো স্বয়ং ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থের-ই আইন। তাদের ধর্মগ্রন্থে সুস্পষ্টভাবে এই আইনের কথা উল্লেখ করা আছে।
সাজিদের এই কথা শুনে এবার অবাক হলো বিমল দা। বলল, বুঝতে পারলাম না ঠিক।
সাজিদ বলল, সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বনু কুরাইজাদের হত্যার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেটি মূলত ইহুদী ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি আইন। চুক্তিভঙ্গের অপরাধের জন্য এরকম আইনের শাস্তির কথা ওল্ড টেস্টামেন্টেই উল্লেখ করা আছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কীরকম?
সাজিদের প্রামাণ্য জবাব, ওল্ড টেস্টামেন্টের Deuteronomy অধ্যায়ে আছে : Thou shalt smite every male thereof with the edge of the sword : But the women, and the little ones, and the cattle, and all that is in the city, even all the spoil thereof, shalt thou take unto thyself; and thou shalt eat the spoil of thine enemies, which the LORD thy God hath given thee. [৩]
এখানে স্পষ্ট করেই বলা আছে, চুক্তিভঙ্গের জন্য প্রত্যেক পুরুষকে হত্যা করো….। সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সেদিন যেটি করেছিলেন, সেটি বাইবেলেরই আইন। তাহলে, ইহুদীদের আইন তো ইহুদীদের ওপরেই আরোপ করা হয়েছে। এতে তো কারও বিরোধ থাকার কথা না…।
সবাই চুপ করে আছে। একটু পরে বিমল দা বলল, কিন্তু, বনু কুরাইজার সকল পুরুষ হত্যা করা হলো, ব্যাপারটি কেমন না? একটি গোত্রের সকল পুরুষ তো আর অপরাধ করে না। এমন অনেক পুরুষ কি সেই গোত্রে ছিল না—যারা হয়তো যুদ্ধ করেনি বা যুদ্ধ করার মতো অবস্থায়ও ছিল না? তাহলে তাদেরও কেন হত্যা করা হলো?
সাজিদ একটু থামল। এরপর বলল, ওইদিন বনু কুরাইজার সকল পুরুষ হত্যা করা হয়নি; বরং সকল যোদ্ধা (যারা যুদ্ধ করতে সক্ষম) হত্যা করা হয়েছিল। সেদিনকার ঘটনার বর্ণনায় যে-সকল হাদীস পাওয়া যায়, সবগুলোতে রাজুল তথা পুরুষ শব্দের পরিবর্তে মোকাতেল তথা যোদ্ধ শব্দ ব্যবহার করা হয়।
সহীহ বুখারী-তে ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর বরাতে বলা হয়েছে, বনু কুরাইজার ঘটনার দিন তাদের কিছু লোক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করলে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ক্ষমা করে দেন। পরে তারা ইসলাম গ্রহণ করে। সুতরাং, সকল পুরুষ হত্যার যে মিথ্যা বর্ণনা আমরা শুনি, তা এই হাদীস দিয়ে বাতিল করে দেওয়া যায়। কারণ, সেদিন ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের মধ্যে অনেক নারী-পুরুষ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত।
সাজিদ থামল। আলম ভাই তার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলে সে ঢকঢক করে পানিটুকু গলাধঃকরণ করল। এরপর আবার বলতে শুরু করল, তাহলে, আমরা দেখলাম যে
(১) বনু নাযীর এবং কায়নুকা সম্প্রদায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী। তাই তাদের রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা বেআইনি ছিল না; বরং আইনসিদ্ধ ছিল।
(২) বনু কুরাইজা সম্প্রদায় নিরপরাধ ছিল না। তারাও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অপরাধী ছিল। তাদের অপরাধ প্রথমবার ক্ষমা করা হয়। তথাপি তারা তাদের অপরাধ থেকে সরে না এসে বারবার মুসলিমদের বিরুদ্ধাচরণ করে। ফলে, তাদের রাষ্ট্রীয় আইনের আওতায় আনা যুক্তিযুক্ত।
(৩) বনু কুরাইজার সকল পুরুষ নয়; বরং সকল যোদ্ধ হত্যা করা হয়েছিল।
(৪) হত্যার রায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নন, দিয়েছিলেন ইহুদীদের একসময়কার সমগোত্রীয় নেতা সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু।
(৫) হত্যার রায় দেওয়া হয়েছিল ইহুদীদের ধর্মীয় বিধানমতেই। সুতরাং, এতে আপত্তি তোলার অবকাশ নেই।
(৬) কুরাইজা গোত্রের সকলকে হত্যা করা হয়নি। যারা ক্ষমা চেয়েছিল, তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল।
এই ঘটনাগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, একটি রাষ্ট্রীয় সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে বনু নাযীর, বনু কায়নুকা এবং বনু কুরাইজার সাথে হওয়া ঘটনাগুলো কোনোভাবেই অমানবিক নয়; বরং আইনসম্মত ছিল। এই আইন প্রয়োগ করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরং একজন ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব-ই পালন করেছিলেন।
সাজিদের কথা বলা শেষ হলে আমি শাবিরের মুখের দিকে তাকালাম। বললাম, ইশ! এতক্ষণ কী সুন্দর বাঙালি-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গুলিয়ে ফেলা গল্প শুনছিলাম। সাজিদ এসে সেগুলোকে ঠাকুরমার ঝুলি বানিয়ে দিল।
আমার কথা শুনে আলম ভাই হা-হা-হা করে হেসে উঠল। এই লোকের হাসিটি খুবই চমৎকার। বাঁধাই করে রাখার মতো।
———-
১ সহীহ
বুখারী, খণ্ড : ৫; হাদীস : ৩৬২
২ সুনানু আবি দাউদ, ২২৯৯
৩ Deuteronomy: 20-25
“গ্রন্থের নামঃ সহীহ মুসলিম (ইফাঃ)
হাদিস নম্বরঃ [4442] অধ্যায়ঃ ৩৩/ জিহাদ ও এর নীতিমালা
পাবলিশারঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন
পরিচ্ছদঃ ২১. ইয়াহুদী ও নাসারাদের আরব উপ-দ্বীপ থেকে বহিস্কার
৪৪৪২। যুহায়র ইবনু হারব ও মুহাম্মাদ ইবনু রাফি (রহঃ) … জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমার কাছে উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছেন যে, নিশ্চয়ই আমি ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায়কে আরব উপ-দ্বীপ থেকে বহিস্কার করবো। পরিশেষে মুসলমান ব্যতীত অন্য কাউকে এখানে থাকতে দেবো না।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)”
এটা কেমন কথা হলো???
এতোক্ষণ এক মহাগাঁজাখোরের গল্প শুনলাম। আমার কথা বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় সমস্ত বিহারি ও মুসলিমলীগের সমর্থক রা বাংলাদেশের স্বাধীনতার শুধু বিরোধিই ছিল না কট্টরপন্থি পাকিস্থানী ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে কাজ করত। এছাড়াও অনেক সাধারণ মানুষও পাকি পন্থি ছিল। আমার প্রশ্ন বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর কী সবাইকে হত্যা করা হইছিল? ধৌনের গোড়ায় বাল গজানো সবাইকে মেরে ফেলা হইছে? স্বাধীনতার অনেকদিন পরে মেইন মেইন নেতার ফাঁসি দেয়া, স্বাধীনতার পরে গুটিকয় বিহারিদের হত্যা তাও উত্তেজিত জনতার হাতে। পাকিদের ত্রিশ লাখ হত্যার বিনিময়ে এইটুকু কি বেশি ছিল?
আপনার বালের যুক্তিতে প্রমাণ হয় নবীর চেয়ে শেখ মুজিব মানবিক ছিল। নবীর পিছে না ঘুরে মুজিবের পিছনে ঘুর হালার ঘরে হালা।
৩০ লাখ সহিদ হয়েছে মানে যুদ্ধ করেছে এর থেকে আর অনেক বেশি। তারা সবাই তোআর ইন্ডিয়ার ছিলো না। অর্থাৎ বেসির ভাগ বঙালিই যুদ্ধ করেছে, বিরাট একটা অংশ ভারতে চলে যায়, বড অংশ ভয়ে ঘরে বসে থাকে জারা ঘরে বসে থাকে সবাই ত আর মুক্তিযুদ্ধে বিরধিতা করে নি।বিরধিতা করেছে সংখ্যা লঘু কয়েকজন। তাদের সবাই কে সনাক্ত করাও সুযোগ হয়নি। ধরুন কেউ কোন পাকিস্তানিকে ১গ্লাস পানি পান করালো তা আর বঙ্গবন্ধু জানে না। বঙ্গবন্ধু সুধু বড নেতাদেরই সনাক্ত করতে পেরেছে তাই তাদের শস্তি দিয়েছে। কাউকে ক্ষমা করেনি।কিন্তু রাসুল (সঃ) সকলকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন এবং শাস্তি দিয়েছেন আবার যারা ক্ষমা চেয়েছে তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। (ধন্যবাদ)
আল্লাহ মুসলমানদের জন্য যুদ্ধ ফরজ করেছেন। বুঝা গেল যুদ্ধের বিকল্প মানুষের নিকট যেমন নাই আল্লাহর নিকটও নাই।