দুপুরের পর যে-কোনো সময় বজুলল করিম সাহেব আসবেন ঢাকার টিকিট নিতে। টিকিট আনতে এক্ষুণি না বেরুলে নয়। মিস্টার আলি আপিস ঘরে ফিরে এসে শূন্য দৃষ্টিতে করিম সাহেবের নাম লেখা চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এতক্ষণ নাহার আপিস ঘরেই বসেছিল। ঘর খালি রেখে যেতে পারে না। এখন স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে মুহূর্তে বুঝে নেয়, মাহজাবীনের কাছ থেকে কোনো কিছু জানা যায় নি।
দাঁড়িয়ে না থেকে বোসো। ভয়ে ভয়ে নাহার বলে।
চেয়ারে বসে আলি দুহাতে মাথার দুপাশ ধরে পাথরের মতো বসে থাকেন। কী করবেন, কোন পথে এগোবেন, কিছুই ভেবে পান না। তার স্ত্রীও চুপ করে বসে। তার এই চুপ করে থাকাটা আলিকে বরং ক্ষিপ্তই করে তোলে।
বসে আছ কী করতে? যাও সারা লন্ডনে বলে বেড়াও তোমার মেয়ের কীর্তি। তারা বাহবা দেবে।
নাহার কিছু বলে না।
বারবার বলেছি, দেশ থেকে বই আনিয়ে দিয়েছি, কতবার তোমাকে বলেছি, মেয়েদের নামাজ পড়া শেখাও, আদব কায়দা শেখাও। আরবি অক্ষর শেখাও, সপ্তাহে অন্তত একদিন বসে কোরান পড়ক। মেয়ে সেয়ানা হয়ে যায়, তোমার হুশ হয় না। ছিছিছি। লোকে কী বলবে?
নাহার মৃদুস্বরে বলে, কী জানি, বন্ধুর বাড়িতে রাত হয়ে গেছে বলে থেকে গেছে কিনা।
থেকে গেল বেলা দশটা পর্যন্ত? তার হুশ নেই, একটা ফোন করত না? আর ও রকম থাকবেই বা কেন?
মেয়ের বাইরে রাতবাস করবার কথা ভেবেও শিউরে উঠেন আলি।
এখন আবার আমার বিমান আপিসে যাওয়া দরকার।
নাহার উঠে দাঁড়ায়। বলে, মেয়ের দায়িত্ব আমার একার ছিল না।
তা কার ছিল? তোমার কাজটা কী শুনি মেয়ে লেহাজ-তমিজ মায়ের কাছ থেকে শিখবে। না কার কাছে শিখবে? ছেলে হলে আমাকে বলতে পারতে। মেয়ের দায়িত্ব মায়েদের। ছেলে তো জন্ম দিতে পার নি। তিনটে মেয়ে জন্ম দিয়ে আমাকে উদ্ধার করেছ।
নীরবে নাহার আপিস ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
শোন।
নাহার বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে।
আছ না গেছ?
শুনছি।
মেয়ের বন্ধু বান্ধব যারা আছে টেলিফোন কর। জিগ্যেস কর, কেউ জানে কিনা, কারো কাছে আছে কিনা। অন্তত এ কাজটা কর। যত দায়িত্ব আমার? মানসম্মান গেলে আমার যাবে, না, তোমারও যাবে?
মিস্টার আলি আপিসের দরোজা বন্ধ করে ক্লোজড লেখাটা সমুখে ঝুলিয়ে দেন। তারপর হঠৎ করে মনে পড়ে করিম সাহেব যদি আসেন?
দরোজা আবার খুলে ক্লোজড লেখা সরিয়ে আলি বলেন, আপিসে বোসো। ফোনটোন যা করতে হয় এখান থেকে কর। আমি ঘুরে আসি। এবার ব্যবসাটা লাটে উঠলেই মা-মেয়েতে শান্তি পাও।
হল থেকে কোট হাতে নিয়ে আলি দুমদাম করে বেরিয়ে যান।
নাহার নিচের তলা থেকেই ডাকে, বীনা।
মাম।
নিচে এসো!
মাহজাবীনের আগে নাসরিন নেমে আসে। আলির চেয়ারে নাহার এখন বসেছে। চেয়ারের হাতল ধরে নাসরিন বলে, মাম, বুবু কি চিরদিনের মতো চলিয়া গিয়াছে?
চুপ কর।
কেন চুপ করিব?
বড়দের সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করিতে শিখেছ?
কী বলিতেছ? বুঝি না।
বুঝবে কেন? ভেতো বাঙালির মেয়ে বাংলা বুঝবে কেন?
নাসরিন এ কথার একবর্ণ বোঝে না। তার মাথায় যে কথাটা ঘুরছে, পরিষ্কার বলে ফেলে। মাম, বুবুর ঘর আমাকে দিতে হইবে। বীনাবুবুকে আমি পছন্দ করি না। তাহার সহিত বাস করিব না।
ওপরে যাও, রিনা।
মায়ের গম্ভীর আদেশ শুনে একটু হকচকিয়ে যায় নাসরিন। তারপর সামলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, দায় পড়িয়াছে।
এখন ঠিক আলির মতো ভঙ্গিতে নাহার দুহাতে মাথা ধরে বসে থাকে। চোখ বুজে বাস্তবতার বোধ ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে অনেকক্ষণ ধরে। সফল হয় না। হাল ছেড়ে দেয়। হঠাৎ মনে পড়ে মাহজাবীন সাড়া দিয়ে এখনো আসে নি।
বীনা।
সে ডাক ওপর পর্যন্ত পৌঁছুলো কিনা, সন্দেহ হয়। উঠে দরোজা খুলে নাহার চিৎকার করে বলে, তুইও কি বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিস, হারামজাদি? তাই যা। ভালোমানুষ সেজে থাকিস, মনে করিস মা বোকা, মা কিছু বোঝে না? এইবার আমি হাড়ে হাড়ে বোঝাব। নেমে এসো নিচে।
ধীর পায়ে নেমে আসে মাহজাবীন।
প্যাড পরিবর্তন করিতে ছিলাম। ডাকিলেই কিছু সঙ্গে সঙ্গে আসা যায় না।
নির্লজ্জ। দুনিয়াকে জানান দিয়ে প্যাড বদলাও। মুখে আনতে শরম নাই। বেহায়া মেয়ে। মাহজাবীন বিস্মিত হয়।
ইহা জৈবিক ব্যাপার, ইহাতে লজ্জিত হইবার কী আছে? তুমি নারী নও? নারীত্বের কারণে তুমি লজ্জিত? কেন ডাকিতেছিলে?
রাগটা মনের ভেতরে পুষে রেখে দিতে হয়, একই সঙ্গে হতাশও বোধ করে নাহার। মেয়েদের মুখে হঠাৎ হঠাৎ এ সব কথা শুনে, একেক সময় তার মনে হয় না এরা তার পেটের মেয়ে।
নাহার বলে, মিনার বন্ধুদের ফোন নম্বরগুলো দে।
সে তাহার ঠিকানা-বহিতে আছে।
সে বই নিয়ে আয়।
সে উহা লইয়া গিয়াছে। উহা তাহার ঝুলিতে থাকে।
নাহার ভীষণভাবে পরাজিত বোধ করে।
মাম, তুমি কাঁদিতেছ?
টপটপ করে চোখের পানি পড়ে নাহারের। মোছার চেষ্টা পর্যন্ত সে করে না। যেন তার হাতও তার নিয়ন্ত্রণে নয়।
তুমি কাঁদিতেছ কেন?