বঙ্গসাহিত্যে ইতিহাসের সাধনা
আমি যে এত বৎসর ধরে সাহিত্য-পরিষৎ পরিচালনা করেছি; কর্মীদের দৈনিক কাজে ও পরামর্শে অতি নিকটভাবে সঙ্গী হয়ে আমাদের চেষ্টাগুলি ফলপ্রদ করবার সাহায্য করেছি, এর মধ্যে আমার একটি লক্ষ্য লুকানো ছিল। সেটি আজ প্রকাশ করে বলব। আমরা জানি যে সভা-সমিতি সর্ব্বোচ্চ সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে না; কারণ প্রতিভার জন্ম শুধু ভগবানের দয়ার উপরই নির্ভর করে, মানুষের পরিকল্পনা বা আয়োজনে হয় না। তবে আমরা কি করতে পারি? আমরা পারি- যেখানে প্রতিভা আগে থেকে জন্মেছে তার বিকাশে সাহায্য করতে, তাকে অকালে শুকিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে, তাকে সমাজে পরিচিত, সমাদৃত করতে। এই হ’ল পরিষদের পক্ষে সম্ভব কাজ, এ কাজ আমাদের আগেও অনেক সভা-সমিতি এবং গুণগ্রাহী ধনী লোক করে এসেছেন।
কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল, বাঙ্গালী সাহিত্যকর্ম্মীদের চেষ্টা একটা বিশেষ দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া এবং সেই লক্ষ্যে দৃঢ় করে রাখা, যার ফলে বাঙ্গালী-চরিত্রের এক দিককার অভাব পূরণ হবে এবং আমাদের এক শ্রেণীর কাজ স্থায়ী হয়ে থাকবে। এই অভিপ্রায়টি এখন খুলে বলব।
যে-সব বিলাতী পণ্ডিত ভারতবর্ষে শিক্ষক হয়ে এসেছেন তাঁরা সহজেই ধরে ফেললেন যে, মোটের উপর ভারতীয় লোকদের প্রকৃতি ও মনোবৃত্তি দর্শনের দিকে ঝোঁকে, পদার্থ-বিজ্ঞানের দিকে বড় কম। আমরা কল্পনা ও ভাবে বিভোর হয়ে থাকতে ভালবাসি, বাস্তব জগতে কাজের লোক হয়ে এবং তার উপযুক্ত প্রণালীতে চিন্তা করতে আমরা স্বভাবতই চাই না, বা পারি না। এই কারণে আমাদের বিলাতী শিক্ষকেরা অনেকবার বলেছেন যে, অর্থাগম ও মানব-সুখ বাড়াবার জন্যে বিজ্ঞান-চর্চ্চা ত সব দেশেই আবশ্যক। কিন্তু ভারতবর্ষে তার উপর অন্য এক কারণে এটা আবশ্যক। সেই বিশেষ কারণটি হচ্ছে এই যে, বিজ্ঞান-শিক্ষার সংযম ও কঠোর ব্রহ্মচর্য্য ভিন্ন ভারতীয়দের মানসিক গঠন দৃঢ় ও বিচিত্র করা সম্ভব নহে।
আমাদের দেশে অতি প্রাচীন যুগে এক দল মনীষী যে বস্তুতান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক ছিলেন, একথা আমি অস্বীকার করি না। পাণিনির ব্যাকরণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, সূর্য্যসিদ্ধান্ত, চরকসংহিতা এবং মানসার বা স্থপতিশাস্ত্র যে জাতি রচনা করেছিল, তারা ভাব-প্রবণ কল্পনা-বিলাসী ছিল না। কিন্তু আজ আমাদের বংশধরদের কোথায় দেখতে পাই? শত সহস্র বৎসর ধরে আমাদের চিন্তা-নায়কেরা, আমাদের গ্রন্থকারগণ, প্রাচীন ভারতের এই লক্ষ্য ভুলে শুধু ভাব ও দর্শনের দিকেই ঝুঁকে পড়েছেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিধৰ্ম্মী রাজার অধীনতা অত্যাচার অবমাননা ও দারিদ্র্য সহ্য করে বাঙ্গালীর জর্জরিত প্রাণ বেদান্ত-চর্চায় ও ভক্তিসাধনায় আশ্রয় নিয়ে চিত্তের একমাত্র শান্তি ও সুখ পেয়েছে। এইজন্য আমাদের পূর্ব্ববর্ত্তী সাহিত্যরচয়িতাদের আমি দোষ দিই না, ভাব ও দর্শনের ক্ষেত্রে তাঁদের হাত থেকে বঙ্গসাহিত্য যে অনেক রত্ন পেয়েছে সেসম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ সচেতন।
কিন্তু আজ যে বিশ্বময় বিজ্ঞানের রাজত্ব! আজ যে সব দেশেই, মানব-জীবনের সব ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানের প্রণালী ও মন্ত্রতন্ত্র একাধিপত্য করছে! এ রাজত্ব শুধু রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসা ও যন্ত্রপাতির কারখানায় নয়; সাহিত্যের সব বিভাগেও প্রকাশ্যেই হোক বা তলে তলে হোক, বৈজ্ঞানিক প্রণালী অনুসৃত হয়েছে।
প্রথম থেকে আমার বিশেষ লক্ষ্য ছিল, কি ক’রে বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে এই বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি ও কর্মপ্রণালী আনা যায়? এই কাজের জন্য চাই, ন্যায়ের তর্কের জন্য আবশ্যক তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার মস্তিষ্ক নয়,- যা শুধু শুষ্ক খড় কাটতে পারে; ভাবে উন্মত্ত বা ভক্তিরসে অশ্রুসিক্ত শুষ্ক মস্তিষ্ক– যা মাটিতে গড়াগড়ি দেয়, তা নয়। এখন চাই-ধীর স্থির সংলগ্ন চিন্তাশক্তি; অসীম শ্রমশীলতা, পরীক্ষা না ক’রে কোন কথা গ্রহণ করব না–এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা; সমস্ত উপকরণ একত্র করে, সামঞ্জস্য করে তার ভিতর থেকে সত্যের খাঁটি নির্যাস বের করব, এই মন্ত্রে দীক্ষা। অর্থাৎ এক কথায়, যাকে বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি বলে। আমাদের সাহিত্য-পরিষৎ বর্ত্তমান যুগে এই কাজ আরম্ভ করেছে এবং তার এই প্রচেষ্টায় উপদেশ ও সাহায্য দিতে পেরে আমি চরিতার্থ হয়েছি।
দৃষ্টান্ত দিয়ে কথাটা বুঝিয়ে দিচ্ছি। অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র ভট্টাচাৰ্য ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিত, নৈয়ায়িকদের বংশধর, তাঁর কাজ যা পরিষৎ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এক দিকে রাখুন, আর প্রাচীনপন্থী নৈয়ায়িকদের রচনা অন্য দিকে রাখুন, এই দুইয়ের তুলনা করলেই পার্থক্য বুঝতে পারবেন। প্রাচীন আদর্শে
কি ফল পেয়েছি? কবির ভাষায় বলি-
“এক দিন নবদ্বীপে মহা তৰ্ক হৈল
তৈলধার পাত্র কিম্বা পাত্রাধার তৈল?
যাহাতে ফুরিয়ে গেল উনিশ পিপে নস্য।”
বাঙ্গালী মস্তিষ্কের তীক্ষ্ণতার ইহা ভিন্ন আর কোন ফলই রইল না। আর দেখুন, নবীন দীনেশচন্দ্রের সাধনার ফলে বঙ্গীয় ন্যায়-রচয়িতাদের পরম্পরা ও ভাববিস্তার এবং সেন-রাজাদের সময় থেকে মুসলমান সুলতানদের রাজসভা পৰ্য্যন্ত বাঙ্গালী হিন্দু বৈদ্যদের ইতিহাস অতি নিখুঁত ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উদ্ধার করা হয়েছে। আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির এবং বাঙ্গালী জাতির অতীত গতির একটি অন্ধকার কুঠুরী সম্পূর্ণ আলোকিত হয়েছে। ভারতের মানচিত্রে অঙ্গুলি দিয়ে দীনেশচন্দ্র দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, কোন্ কোন্ অঞ্চলে; কখন কখন কোন্ চিন্তা বা জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ল, গৌড়ীয় পণ্ডিত বাঙ্গলা থেকে কাশী, কাশী, থেকে বুন্দেলখণ্ডে গিয়ে গ্রন্থ রচনা করলেন, রাজসভায় জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলে দিলেন। আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এই গবেষণা অমূল্য উপাদান হয়ে থাকবে। বাঙ্গালী মস্তিষ্কের তীক্ষ্ণতার এটাও জাজ্বল্য প্রমাণ।
তেমনি ভারতীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে আমার শিষ্য ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বহুবর্ষ ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম ক’রে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে ইংরাজ-শাসনে বঙ্গদেশে যে নবজাগরণ হয় তার ইতিহাসের সব উপকরণ সংগ্রহ ক’রে তা থেকে বাঙ্গালী সমাজ, বঙ্গভাষার সংবাদপত্র, বাঙ্গালীর নাট্যশালা এবং শিক্ষা ও সমাজ-সংস্কার বিস্তারের প্রামাণ্য ইতিহাস এবং সাহিত্য-সাধকদের জীবনীর খাঁটি সত্য বিবরণ প্রকাশ ক’রে বঙ্গ সাহিত্যের পাঠকদের এবং বঙ্গের ইতিহাসের ছাত্রদের চিরঋণী করে রেখেছে। যোগেশচন্দ্র বাগল প্রভৃতি নবীন কৰ্ম্মীগণ এই কাজে সহকারী হয়েছে। ব্রজেন্দ্রনাথের এই সব রচনার সঙ্গে আমাদের কবিদের জন্ম-শতবার্ষিকীতে যে সব প্রবন্ধ পড়া হয় তার তুলনা করলেই ইতিহাস ও জীবনীর ক্ষেত্রেও এই বৈজ্ঞানিক প্রণালীর মূল্য কত বেশী তা বুঝতে পারবেন। এরূপ একান্ত সত্যনিষ্ঠাকে “পাথুরে ইতিহাস” বলে উপহাস করার দিন চলে গেছে।
ব্রজেন্দ্রনাথ ও সজনীকান্ত দাস সেইমত বঙ্কিম প্রভৃতি সাহিত্যরথীদের গ্রন্থের নির্ভরযোগ্য শিক্ষাপ্রদ সংস্করণ প্রস্তুত ক’রে সমস্ত দেশের সম্মুখে এক মহৎ দৃষ্টান্ত রেখেছে। এই কাজটি বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ না করলে তার লজ্জা চিরস্থায়ী হ’ত। তেমনি আমার শিষ্য অধ্যাপক কালিকারঞ্জন কানুনগো ইতিহাস-গ্রন্থগুলির সঙ্গে রজনীকান্ত গুপ্তের লেখা ভারত-ইতিহাস তুলনা করলেই নবীন ও পুরাতন লেখকদের মধ্যে গবেষণার প্রণালী এবং ফল-প্রসূতিতাতে কত পার্থক্য তা স্পষ্ট হবে।
এই সব নবীন কর্মীর সত্যস্পৃহা এত বেশী যে, তাদের প্রকাশিত লেখায় কোন ভুল বা ত্রুটি দেখিয়ে দিলে, তারা তা বিচার করে তার সত্য অংশটুকু পরবর্ত্তী সংস্করণে যোগ ক’রে দেয়। এরূপ নিজ ভ্রম স্বীকার করাকে তারা অপমানের কারণ ব’লে মনে করে না। এই ক্রমোন্নতির জন্য আগ্রহ, এই মুক্ত হৃদয়ে সত্য বরণ করার স্পৃহাই প্রকৃত পণ্ডিতের চিহ্ন। আমার শিষ্যগণ তা ভোলে নি।
আমার ঐতিহাসিক শিষ্যগণ, এখানে এবং অন্যত্র, কখনও আর্থিক পুরস্কার খোঁজে নি, কাগজে প্রশংসা পাবার জন্যে ষড়যন্ত্র করে নি, যে দরবারে খোশামোদ করলে বেশ অর্থাগম হতে পারত, সেখানে তারা ধরণা দেয় নি। গবর্ণমেণ্ট অথবা কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান তাদের এক পয়সার সাহায্যও করে নাই। আমি এটাকেই আমার জীবনের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ গৌরব মনে করি। সংস্কৃতে আছে–
“সর্বত্র বিজয়ম্ ইচ্ছেৎ পুত্রাৎ ইচ্ছেৎ পরাজয়ম্”
অর্থাৎ আর সব লোককে হারাতে চেষ্টা কোরো, কিন্তু পুত্রের নিকট পরাস্ত হ’লে তা গৌরব বলে মনে কোরো।
এখানে পুত্র শব্দের অর্থ শিষ্য অর্থাৎ মানস-সন্তান ধরতে হবে। আমার শিষ্য-প্রশিষ্যদের ধারা পুরুষ পুরুষানুক্রমে চলতে থাকুক, বঙ্গদেশ ও বঙ্গসাহিত্যকে তারা স্থায়ী দানে সমৃদ্ধ করতে থাকুক, এই প্রার্থনা করেই আমি আমার সাহিত্যিক কর্মজীবনের দৃশ্যের উপর যবনিকা টেনে দিলাম 1
[প্রবাসী, ভাগ ৪৮, খণ্ড ২, সংখ্যা ৬, চৈত্র, ১৩৫৫।]
[সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা ১৩৫৫, ৩য়-৪র্থ সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত।]*
* ৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ কর্তৃক অনুষ্ঠিত সম্বৰ্দ্ধনা-সভায় আচার্য্যের ভাষণ।