বকুলবাগানের এই এলাকাটা বেশ ছিমছাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আশপাশের কয়েকটা বাড়ি একটু পুরোনো আমলের, কিন্তু বাড়ির মালিকরা কেউ দুঃস্থ নয়, দেয়ালের খসে পড়া পলেস্তারা মাঝে মাঝে সারানো হয়। কেউ কেউ বাইরের রঙও ফিরিয়েছে, সবুজ রঙ পড়েছে দরজা জানালায়।
এখানে অনেক সুবিধে। অফিস তেমন দূর নয়, একটুখানি হাঁটতে হয় ঠিকই, কিন্তু বাস-ট্রামের অভাব নেই। দোকানপাট, বাজার এমন কিছু দুরে নয়। এমন পাড়া ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু ঘরে যদি শান্তিই না থাকে, এ-সব সুখসুবিধে নিয়ে কি লাভ।
বঙ্কিমবাবু বাড়ি ছাড়ার নোটিশ পেয়ে প্রথমে বোধহয় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। উনি তো ভয় পাবেনই, ওঁর নামেই নোটিশ। তাঁর সঙ্গে ধ্রুবর কোনও সম্পর্ক নেই, তবু সেও ধাক্কা খেয়েছিল।
অমিতবাবু বলেছিলেন, আমার তো মনে হয় ওয়ান বাই ওয়ান সকলের নামেই আসবে। আমাদের এখন ইউনাইটেড থাকতে হবে ধ্রুববাবু। বঙ্কিমবাবুর মামলা এখন আমাদের সকলের মামলা, একজোট হয়ে লড়তে হবে।
—ঠিকই বলেছেন। ধ্রুব মন্তব্য করেছে, ব্যাটা একজনকে ওঠাতে পারলেই একে একে সকলকে ওঠাবে।
বঙ্কিমবাবু শুনে সাহস পেয়েছেন। সেটুকুই বা কম কি। বলেছেন, আমার এখন তো উপায় নেই, দেয়ালে পিঠ দিয়েও আত্মরক্ষা করতে হবে।
কিন্তু মুখে যাই বলুক, ধ্রুবর নিজেকে বড় বিভ্রান্ত লেগেছে। এসব মামলা মকদ্দমা নিয়ে জড়িয়ে পড়া ওর একেবারেই পছন্দ নয়। সে আরেক অশান্তি।
তাছাড়া একটা ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন ও অনেকদিন থেকে দেখছে। প্রীতিও মাঝে মাঝেই তাগাদা দেয়। সময় থাকতে থাকতে কিছু একটা করে ফেল। এই ভো অনুপমদা কেমন একটা চমক্কার ফ্ল্যাট কিনে ফেলল। তোমার চেষ্টা নেই।
শুনে এতদিন বড় অসহায় আর অক্ষম লাগত। এখন তো অফিস থেকে লোন পাওয়া যাবে। ব্যাঙ্কেও কিছু জমেছে। বাকিটা মাসে মাসে ভাড়ার মতো কিস্তিতে শোধ করে দিলেই চলবে।
ধ্রুব বঙ্কিমবাবুকে বললে, ভাবছি একটা ফ্ল্যাট কিনব, আপনিও একটু খোঁজখবর রাখুন।
শুনেই হাসলেন বঙ্কিমবাবু। —আপনার তো টাকা আছে, তাই ও লাইনে ভাবছেন। আমার নেই। কলকাতায় কজন ভাড়াটের মশাই টাকা আছে, যে জল বন্ধ করলেই ফ্ল্যাট কিনে চলে যাবে। এ যুগে বাঁচতে হলে বাড়িওয়ালা যদি ঘোটলোক হয় আপনাকেও হতে হবে। তা না হলে বাঁচতে পারবেন না।
বঙ্কিমবাবু বেঁচে থাকাকে সত্যি সত্যি জীবনযুদ্ধ মনে করেন। মানিয়ে চলা বা হটে যাওয়ার পক্ষপাতী নন। একসিশটেন্সের সঙ্গে যে স্ট্রাগল কথাটা জড়িয়ে আছে উনি তা বিশ্বাস করেন। সেজন্যেই বলেছিলেন, পঞ্চাশটা টাকা আপনি এক কথায় বাড়িয়ে দিলেন? কত বাড়াবেন? তরতর করে বাড়িভাড়া বাড়ছে, হাজার দুহাজার, পারবেন পাল্লা দিতে? ও তো জানে তুলে দিতে পারলেই হাজার কি দেড় হাজার পাবে, আপনার পঞ্চাশে কি হবে ওর!
ধ্রুব কোনও উত্তর দিতে পারেনি। ও ঝঞ্জাট এড়িয়ে চলতে চায়। তাছাড়া ও তো স্বপ্ন দেখছে, সুন্দর একটা ফ্ল্যাট কিনবে। নিজস্ব ফ্ল্যাট হবে। বাড়িওয়ালাকে ভাড়ার টাকা দেবার সময় যে হীনম্মন্যতায় ভোগে, তা আর ভুগতে হবে না।
কিন্তু কিন্তু করে বলেছে, লোভ হওয়া তো স্বাভাবিক, বঙ্কিমবাবু। পাশের ওই বাড়ির ফ্ল্যাট খালি হল, একেবারে হাজার পেয়ে গেল। শুনলে কোন বাড়িওয়ালার না লোভ হয়।
-পেলেই যদি নিতে হবে, তা হলে ব্ল্যাকমার্কেটিয়ারকে গালাগাল দেন কেন? ঘুষখোরকে গালাগাল দেন কেন? ওরাও তো পায় বলেই নেয়। সোজাসুজি না পেলে বাড়িওয়ালাদের মতোই প্যাঁচ কষে আদায় করে।
ধ্রুব আর কোনও কথা বলেনি, বরং রাখালবাবু সম্পর্কে দুটো কটুক্তি করেছে। পাছে ইউনিটি নষ্ট হয়ে যায়।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফ্ল্যাটের খোঁজ করেছে।
ওর মনের মধ্যে সব সময়েই একটা উদ্বেগ। ফ্ল্যাট কেনার আগেই না রাখালবাবু কিছু একটা করে বসেন। মামলাটামলা। কে তখন ছোটাছুটি করবে। অবশ্য বিশ্বস্ত ভাল উকিল ওর চেনা আছে। বাধ্য হলে তখন বঙ্কিমবাবুর মতোই লড়তে হবে। কিন্তু কে ওসব ঝুটঝামেলা চায়। তার ওপর ওই সদর দরজায় চাবি দেওয়া। একটা ড়ুপ্লিকেট চেয়েও পায়নি। আর গোঁপওয়ালা দারোয়ানটা দশটা বাজতে না বাজতেই চাবি দিয়ে এক-একদিন ছাদে চলে যায়। কেউ বেড়াতে এলে ধ্রুবকে ঘড়ির দিকে চোখ রাখতে হয়, নিজেকেই হাসতে হাসতে বলতে হয়, আসুন এবার। কারণ হাঁকাহাঁকি করে ও ব্যাটাকে ছাদ থেকে নীচে নামাতে আধ ঘণ্টা লেগে যাবে। বড় অপমান লাগে।
সব কারসাজি, সব কারসাজি।
আর এইসব ছোটখাটো ব্যাপারের জন্যে নিজেকে বড় নিরাশ্রয় লাগে।
ছোটমাসির দুভাবনা ও এখন বুঝতে পারছে।
এই সময়েই সেই দৃশ্যটা দেখল। দেখার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল।
হনহন করে হেঁটেই আসছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
এই গলিটা দিয়েই বাড়ি ফেরে ও। বকুলবাগানের দিকে যেতে হলে পথ সংক্ষেপ হয়।
দৃশ্যটা ওকে চুম্বকের মত টানল। দেখল রাস্তার অর্ধেক জুড়ে তূপীকৃত হয়ে পড়ে আছে একটি সংসারের যাবতীয় আসবাবপত্র। কেউ যেন ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যে ছুড়ে ছুড়ে বের করে দিয়েছে।
খাট, আলমারি, ড্রেসিংটেবল, বুককেস। ত্রিভঙ্গ হয়ে পড়ে আছে নারকেল ছোবড়ার পুরু গদি। তার চারপাশ ঘিরে বালতি, মদ, হাঁড়িকুড়ি, রাশি রাশি মশলাপাতির কৌটো। একটা পুরোেনো টিন টলে পড়েছে, তা থেকে গড়িয়ে পড়ছে সরষের তেল।
বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল। ধ্রুবর মুখ অজানা আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে।
অস্ফুটে বলে উঠল, ইস।
হঠাৎ নজরে পড়ল এক কোণে একটা তোলা উনোন, কেউ জ্বলন্ত উনোনে জল ঢেলে দিয়েছে। রান্নাও শেষ করতে দেয়নি, খাওয়ার কথাই ওঠে না। এক পাশে কড়াইয়ে আধরান্না কোনও একটা তরকারি, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িটা কাত হয়ে পড়ে আছে, তা থেকে ভাত গড়িয়ে পড়েছে ফুটপাথে।
প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকানো ছেলেটি বলে উঠল, শালা ছোটলোক, রান্না ভাতটুকুও খেতে দেয়নি।
ধ্রুবর চোখে পড়ল কিছুটা দূরে একজন ভদ্রমহিলা, সঙ্গে দুটি বাচ্চা ছেলে, একটি ফ্রক পরা মেয়ে। ভদ্রমহিলা মুখ নিচু করে আছেন। লজ্জায়, অপমানে।
ভদ্রলোক নেই। হয়তো তাড়াতাড়ি কোথাও কিছু একটা ব্যবস্থার খোঁজে বেরিয়ে গেছেন।
কে একজন বললে, ইজেক্টমেন্ট।
কথাটা শুনেই যেন শিউরে উঠল ধ্রুব।
মনে পড়ে গেল ছোটমাসির কথা।–তোর ছোটমেসো বলছে উকিল ড়ুবিয়েছে, উকিল বলছে তোর ছোটমসো ড়ুবিয়েছে। ছোটমাসির গলার স্বর কাঁদো কাঁদো। একটা ফ্ল্যাট কোথাও দেখে দে না।
ওই নিরাশ্রয় অচেনা লোকটার জন্যে বুকের ভিতরটা হা-হুতাশ করে উঠছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি নিজের জন্যে অজানা আতঙ্ক।
মনে পড়ে গেল বঙ্কিমবাবুর নামে উচ্ছেদের নোটিশ এসেছে।
কে যেন বলেছিল, আইন-আদালত ওই খাতায়-কলমে।
নিরাশ্রয়, নিরাশ্রয়। এই শহরের বেশিরভাগ মানুষ নিতান্তই নিরাশ্রয়। একটা অজানা আতঙ্ক নিয়ে বাস করে। বাড়িওয়ালার মেজাজ-মর্জির ওপর নির্ভর করে।
আইন আছে। আইন তো অনেকরকমই আছে। আইনের বই দেখলে মনে হবে এ দেশের প্রতিটি মানুষ কত নিশ্চিন্ত, সুখী। কারও কিছু ভয় পাওয়ার নেই। শুধু অফিস কামাই করে উকিলের কাছে, কোর্টঘরে ছুটে বেড়াতে পারলেই হল। শুধু টাকার জোরে ভাল উকিল জোগাড় করো। তাতেও নিশ্চিন্ত হতে পারবে না।
ওই অচেনা অজানা লোকটা স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথায় যাবে ভেবে কোনও কুলকিনারা পেল না ধ্রুব। তার সঙ্গে ওই গোটা সংসারের আসবাবপত্র।
ধ্রুব একটা বাড়ি করার স্বপ্ন দেখছে বেশ কিছুদিন থেকে। অন্তত একটা ফ্ল্যাট। প্রচণ্ড ঘৃণার সঙ্গে ও মনে মনে উচ্চারণ করল, আমি আশ্রয় খুঁজব। শুধু নিজের জন্যে। হয়তো বাড়ির মালিক হব, কিন্তু বাড়িওয়ালা হব না। ভাড়াটের সুখ স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে শুধু কিছু টাকার লোভে নির্দয় বাড়িওয়ালা হবো না।
কিন্তু ওসব মহৎ সঙ্কল্প এখন থাক।
প্রীতি অনেককাল থেকে বলে আসছে, ও কান দেয়নি। কারণ কান দেবার মতো অবস্থা ওর ছিল না।
ছোটমাসি বলেছিল, তোর পিসিদের মতো তো টাকা নেই, মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, ফ্ল্যাট কিনব কোত্থেকে।
কজনেরই বা আছে। এখন চড়চড় করে যা ভাড়া বেড়ে গেছে। সেই ভাড়া দেবার মতো সঙ্গতিই বা কজনের।
সেসব চিন্তা করার কারও সময় নেই। পুরমন্ত্রী বলেছেন, জলের সাপ্লাই বাড়িয়ে দেব। সে জল কার ঘরে যাবে সে হিসেব রাখার কথা তাঁর নয়।
তাছাড়া রাস্তায় রাস্তায় ভারীরা তো খেয়ে পরে বাঁচছে। নতুন একটা প্রফেশন। আধুনিক কলকাতায় পুরনো একটা বৃত্তি। সেই সেকালের ভিস্তিওয়ালা এখন অন্য চেহারায়।
ল্যান্সডাউন রোডের চেহারাটা কি চমত্তার বদলে যাচ্ছে। দেখে গর্ব হয়। আমাদের কলকাতা। ঢাকুরিয়া ব্রিজের পাশে বিরাট সুপারমার্কেট হচ্ছে। দেখে তাক লেগে গেল ধ্রুবর। আঃ, কলকাতা বড় সুন্দর দেখতে হবে।
বাসের জানালা থেকে ঢাকুরিয়ার সুপারমার্কেট ঘেঁষে আকাশছোঁয়া বাড়িটা দেখতে দেখতে যোধপুর পার্কে পৌঁছে গেল।
ঠিকানাটা মনে নেই। কিন্তু পিসিমার গৃহপ্রবেশের দিন এসেছিল। অনেক লোেক, বহু আত্মীয়স্বজন। সবাই খুব প্রশংসা করছিল। দারুণ ফ্ল্যাট, দারুণ। পাশাপাশি দুখানা ফ্ল্যাট জুড়ে নিয়ে সে এক এলাহি কাণ্ড। কেটারার ডেকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা। খুব ভাল খাইয়েছিল পিসিমা। গোটা গোটা গলদা চিংড়ি আর মুর্গির ঠ্যাং।
পিসিমা বলেছিলেন, জমি বাড়ি কি ফ্ল্যাট যদি কিনতে চাস, তোর পিসেমশাইয়ের কাছে খবর পাবি। ও তো কম খোঁজেনি।
ধ্রুব সেজন্যেই চলে গেল একদিন। খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেল।
বিশাল ফ্ল্যাট, খুব সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলেছেন।
ও তো বিজ্ঞাপন দেখে দেখে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। কোথাও নাগালের বাইরে। বেশির ভাগই ফ্ল্যাটের সঙ্গে ঝামেলাও কিনতে হবে।
টাকাটাই মার যাবে কিনা স্থির নেই। কিংবা টাকা দিয়ে পাঁচ সাত বছর বসে থাকো।
পিসেমশাই সব শুনে বললেন, ফ্ল্যাটে সুখ নেই ধ্রুব, তার চেয়ে জমি কিনে বাড়ি করা ভাল। কিনবে জমি? আছে।
ধ্রুব বললে, সে তো অনেক টাকার ব্যাপার। আমি একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাট কিনব ভাবছি। শুধু মাথা গোঁজার আশ্রয়।
পিসেমশাই বললেন, আমি তো ফ্ল্যাট বিক্রি করে দেব ভাবছি।
একটু থেমে বললেন, একটা জমি আছে, পাঁচ কাঠা। বায়না করে রেখেছিলাম অনেক আগে। অ্যাদ্দিন ঝামেলা চলছিল। কিন্তু ফ্ল্যাট কিনে টাকা আটকে গেছে, দুকাঠা কেউ যদি নেয়…
দামটাম শুনল প্রীতি। দুদিন ধরে হিসেব কষা হল। ব্যাঙ্কে ইউনিটে কত আছে, অফিস থেকে কত লোন পাওয়া যাবে।
জায়গাটাও একদিন দেখে আসা হল। দিব্যি পছন্দ। একটু দূর, তা হোক।
একজন কারও ওপর নির্ভর করার মতো আনন্দ আর নেই। পিসেমশাই চৌকোশ লোক। ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
পিসেমশাই বললেন, ভালই হল, বাইরের কাউকে দিতে হল না। তুমি পাশে থাকবে সেও শান্তি।
বললেন, জমির জন্যে টাকা বায়না নিয়েই জমির মালিকটা মরে গেল, পাঁচজনের পরামর্শে বিধবা বৌটা আর বেচতেই চায় না। মামলা চলছিল, পাব কি পাব না ভেবে ফ্ল্যাট কিনে ফেললাম। এখন রায় বেরিয়েছে, এক মাসের মধ্যে পুরো টাকা দিয়ে কিনে ফেলতে হবে। তুমি ঠিক সময়েই এসে গেছ ধ্রুব।
কীভাবে এত টাকার ড্রাফট করাতে হয় ধ্রুব জানত না। ছোটাছুটি করে সমস্ত টাকা একটা অ্যাকাউন্টে এনে যেদিন ড্রাফট নিয়ে দিতে যাবে, বেশ ভয়-ভয় করছিল। একটাই ভরসা, পিসেমশাই সঙ্গে ছিলেন।
কেনা হয়ে গেল। অবশ্য ভাল দিকটাই পিসেমশাই তিন কাঠা নিয়ে নিলেন। তা হোক।
তখন রাতে ভাল ঘুম হত না ধ্রুবর। আনন্দে।
ওর স্বপ্ন সফল হতে চলেছে। একটা বাড়ি। ছোট ছোট দুখানা ঘর, ব্যস আর কিছু চাই না।
কিনবে বলে যখন প্রায় ঠিক করে ফেলেছে, অফিসে অবিনাশকে বলল। অবিনাশ খুব উৎসাহ দিল, যেন তার নিজেরই বাড়ি হচ্ছে, এমন খুশি দেখাল ওকে।
–করে ফেল ধ্রুব, করে ফেল। ও শুরু করলে কি করে যেন হয়ে যায়।
সেদিনই চলে গিয়েছিল হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে। ভিতরে ভিতরে এমন একটা আনন্দ হচ্ছিল চেপে রাখতে পারছিল না।
বাবা সব শুনে খুশি হলেন, তবু বললেন, দেখেশুনে কিনবি।
মা আরও খুশি। বড়বৌদি শুনে বললে, যাক্, তোমার হলেও সুখ। আমাদের তো আর হবে না, ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে, তাদের পড়ার খরচ…
মেজবৌদিও খুব খুশি।–ধ্রুবদা করে ফেল, তোমার দাদাদের দেখিয়ে দাও, ইচ্ছে থাকলে করা যায়।
এমন যে হবে ধ্রুব ভাবতেও পারেনি। সেজন্যেই মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় ঈশ্বর আছেন। অন্তত যাদের বাড়িঘর হয়, টাকাপয়সা হয়, নানাদিকে সাফল্য, তাদের নিশ্চয়ই ঈশ্বর আছেন। না, যাদের কিছুই নেই তাদেরও সেই ঈশ্বরই ভরসা।
খুব দৈবে বিশ্বাস করত না, কিন্তু ওরও মনে হল দৈব বলে কিছু থাকলেও থাকতে পারে। তা না হলে জগন্নাথবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়ে যাবে কেন। জগনাথবাবু এসেছিলেন পিসেমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে কি একটা কাজে। উনি বড় কন্ট্রাক্টর।
ধ্রুব নিজে দেখাশোনা করে বাড়ি করবে তা তো সম্ভব নয়। এসবের ও কিই বা বোঝে।
পিসেমশাই হাসতে হাসতে বললেন, কি ধ্রুব, এখনই বাড়ি শুরু করে দেবে নাকি?
কে জানে কেন, ধ্রুবকে ভাল লেগে গেল জগন্নাথবাবুর। বললেন, করতে হলে এখনই করে ফেলুন, এরপরে আর পারবেন না। হু হু করে দাম বাড়ছে জিনিসপত্রের।
ধ্রুব সঙ্কোচের সঙ্গে বলেছে, বাড়ি বলবেন না, পারলে শুধু দুখানা ঘর, মাথা গোঁজার মতো।
জগন্নাথবাবু বললেন, আমি একজন বিশ্বাসী লোক দিয়ে দেব, কম খরচে করিয়ে দেব।
হেসে বললেন, ভয় নেই, আমি মাঝে মাঝে দেখে আসব।
জগন্নাথবাবু রীতিমত বড় কন্ট্রাক্টর, বেশির ভাগই সরকারি কাজ। পাঁচ-সাতখানা। মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংও বানিয়েছেন।
ধ্রুব তাই ভয় পেয়ে বললে, না না, আমি একেবারে সাদাসিধে ছোট্ট একটা বাড়ি করব। অত টাকা কোথায়? ধারধোর করে…।
জগন্নাথবাবু একটা কার্ড বের করে দিলেন ধ্রুবকে। বললেন, কত টাকা জোগাড় করতে পারবেন হিসেব করে, একদিন চলে আসুন। বাকিটা আমার দায়িত্ব।
সত্যি সত্যি বাড়ি শুরু হয়ে গেল। শুধু জগন্নাথবাবুর পরামর্শে নানা জায়গায় একটু ছোটাছুটি করতে হল ধ্রুবকে। কিন্তু সেটুকু এখন আর বিরক্তিকর নয়। বাড়ি হবে, নিজের বাড়ি। এর চেয়ে আনন্দের ব্যাপার যেন আর কিছু নেই। ভিত পুজো হল, ভিত খোঁড়া হল, বাড়ি উঠতে শুরু করল।
ধ্রুব প্রায়ই যায়, দেখে আসে। ও একা গেলে প্রীতি অনুযোগ করে। প্রীতিকেও তাই প্রায়ই সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়।
এ যেন এক ধরনের নেশা। চোখের সামনে দেয়াল উঠছে, কংক্রিট ঢালাই হচ্ছে। বহুদিনের একটা স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।
যেদিন প্ল্যান স্যাংশন হয়ে এসেছিল, কাগজের ওপর আঁকা নকশাটায় চোখ রেখে ও কল্পনায় যেন বাড়িটা দেখতে পেয়েছিল। এখন সেটা আরো স্পষ্ট রূপ নিচ্ছে। ইটের ওপর ইট গাঁথা হচ্ছে, আর কি অধৈর্য লাগতো ধ্রুব আর প্রীতির। মনে হত যেন বড় বেশি সময় লাগছে। যেন রাতারাতি বাড়িটা তৈরি হয়ে যাবার কথা!
ধ্রুবর ইচ্ছে ছিল একতলায় দুখানা ঘর। আপাতত ওইটুকুই। প্রীতি অবশ্য রান্নাঘর সম্বন্ধে কি সব ফরমাশ করেছিল। কোথায় শেলফ হবে, কোথায় গ্যাস সিলিন্ডার থাকবে।
জগন্নাথবাবু হেসে ফেলে বলেছেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে।
দেখতে দেখতে ছাদ পর্যন্ত হয়ে গেল।
কিন্তু জগন্নাথবাবু থামতে চাইলেন না। বললেন, প্ল্যান তো তিনতলা অবধি স্যাংশন হয়ে আছে, এখন অন্তত দোতলা অবধি করে দিই।
ধ্রুব ভয় পেয়ে গেল। হতাশ গলায় বললে, যা কিছু ছিল, যেখানে যা লোন পাবার সবই তো পেয়ে গেছি। আর তো কোথাও কিছু পাব না জগন্নাথবাবু। আমার ওই একতলাই ভাল।
জগন্নাথবাবু বলে বসলেন, আপনাকে এখন টাকা দিতে হবে না। আপনি যখন যেমন পারবেন দিয়ে দেবেন। হাসলেন উনি।
পিসেমশাই একদিন বাড়িটা দেখতে গিয়েছিলেন। সব শুনে বললেন, তুমি তো ভাগ্যবান হে, নিজের টাকায় দোতলাটা করে দেবেন।
প্রীতি তো শুনে অবাক। ধ্রুবর মনে হল জগন্নাথবাবুর মতো মানুষ হয় না। প্রীতি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললে, ভগবান, ভগবান।
শুধু পিসিমা বললেন, আমাদের বাড়িটাও এই সময় করে নিলে হত। টাকাগুলো সব ফ্ল্যাট কিনে আটকে গেছে, তা না হলে…
তারপরই রহস্যটা ফাঁস করলেন। বললেন, এ রকম বাড়ি আরো দু-চারটে করে দিচ্ছেন উনি। দিব্যি সুযোগ ছিল।
ধ্রুব বুঝতে পারল না। ওর কাছে ব্যাপারটা সত্যি এক রহস্য। নিজের টাকায় দোতলা করে দিচ্ছেন। কেন কে জানে।
পিসিমা হেসে বললেন, বড় কন্ট্রাক্ট পেয়েছেন গভর্নমেন্টের। বুঝতে পারছিস না? সব সেখান থেকে এখানে পাচার করছেন। পকেটের টাকা তো নয়।
কথাটা শুনেই ধ্রুবর চোখে জগন্নাথবাবু ভগবানের আসন থেকে একেবারে নীচে পড়ে গেলেন। তা হোক। ওর দোতলা তো উঠছে।
এতকাল এ সব কাজ ও ঘৃণা করেছে। অন্যায় মনে হয়েছে।
একদিন বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে রাখালবাবু সম্পর্কে বলেছিল, কালো টাকায় তো মশাই বাড়ি বানিয়েছে, পাপের টাকায়, এখন বাড়িওয়ালা বনে গেছে।
এখন আর ধ্রুবর অন্যায় মনে হচ্ছে না। মনকে বোঝাল, আমি তো অন্যায় কবছি। জগন্নাথবাবু কোত্থেকে কী আনছেন আমার জানার কথা নয়। আমি টাকা দিয়েই খালাস।
দেখতে দেখতে দোতলা উঠে গেল। সামনে ছোট্ট এক টুকরো ব্যালকনি বের করে দিয়েছেন জগন্নাথবাবু।
শুধু রঙ করা বাকি। সে পরে করা যাবে। জগন্নাথবাবুই করে দেবেন বলেছেন। অথাৎ ওঁর সরকারি কন্ট্রাক্টের বাড়ি এখনও হয়তো শেষ হয়নি। শেষ হলে রঙ করার সময় রঙ করিয়ে দেবেন।
কথাটা কীভাবে যেন রাখালবাবুর কানে পৌঁছে গিয়েছিল। কীভাবে আর, কাজের লোকের মারফত।
ইদানীং তো ওর আর প্রীতির মধ্যে আর কোনও কথাই ছিল না। শুধু বাড়ি আর বাড়ি। আর কতদিন লাগবে। জানালার গ্রীল যেন সুন্দর হয়।
ঠিকে ঝি বাসন মাজতে মাজতে নিশ্চয় শুনেছে।
রাখালবাবুকে এড়িয়ে এড়িয়েই চলত ধ্রুব। কথা বলতেও ইচ্ছে করত না। লোকটা জল বন্ধ করে দিয়েছে, ভারীর কাছ থেকে জল নিতে হয়। এদিকে পাম্প দিব্যি চলছে দুবেলা, শুধু নিজেই নেন।
লোকটার চক্ষুলজ্জাও নেই। একবার বলতে গিয়েছিল, উত্তর এল, এত অসুবিধে যখন, ছেড়ে দিলেই তো পারো। জল নেই, জল নেই, কপোরেশন দিচ্ছে না তো আমি দেব কোত্থেকে।
সারা শরীর জ্বলে উঠেছিল ধ্রুবর।
এই লোকের সঙ্গে দেখা হলে দিব্যি হেসে হেসে কথা বলতে হবে। তার চেয়ে এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।
অবিনাশ অবশ্য বলেছিল, ও তোমার রাখালবাবুকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সব বাড়িওয়ালা একই ডিজাইনের ভাই, একই প্যাটার্ন। দু-চার জন শুধু আমাদের সুনন্দর মতো।
ভারীকে দিয়ে জল আনিয়ে জলের সমস্যা মেটানো যায়। একটু খরচ বাড়ে। ধ্রুব প্রীতিকে বুঝিয়েছিল, কত আর খরচ, একশো দেড়শো। দেড়শো টাকা বেশি দিলেও এ তল্লাটে কোথাও আর এরকম ফ্ল্যাট পাবে নাকি।
প্রীতিকে বোঝানো যায়, নিজেকে নয়।
এই ভারীকে দিয়ে জল আনানোয় বড় সম্মানে লাগে।
প্রথম প্রথম কি অস্বস্তি। সকালের দিকে বন্ধুবান্ধব কি আপিসের কেউ এসে পড়লে ভয়ে তটস্থ, যদি দেখে ফেলে।
উপেন থাকে চক্রবেড়িয়ায়। একদিন সকালে চলে এসেছিল কি একটা কাজে। ভারী তখন এক ভার জল নিয়ে গেছে, আবার আসবে। কাঁধে বাঁক লোকটাকে যদি দেখে ফেলে, কি আতঙ্ক। পর্দা টেনে যদি বা আড়াল করা যায়, দুদিকের কেরোসিন টিন থেকে জল উপছে পড়বে বারান্দায়। হয়তো কিছু জিগ্যেস করে বসবে উপেন। কি লজ্জা!
এখন পুরোনো হয়ে গেছে। ওসব লজ্জাটজ্জা নেই।
বাড়িওয়ালা উঠিয়ে দিতে চাইছে। সুতরাং উঠে যাওয়াটাই নাকি ভদ্রতা।
হয়তো বলে বসবে, এত অপমান সহ্য করে থাকেন কী করে?
রাখালবাবু হয়তো দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন। মর্নিং ওয়াক করে ফিরছেন। ঢিলেঢালা প্যান্টে যতটা সম্ভব স্মার্ট হয়ে হাঁটছিলেন।
দেখতে পেয়েই হয়তো ফুটপাথ বদলে নিলেন, ফলে একেবারে সামনাসামনি। সমস্ত মন বিস্বাদ হয়ে গেল ধ্রুবর।
রাখালবাবু একমুখ হেসে বললেন, সুখবরটা জানাওনি তো এতদিন? তোমাদের নাকি বাড়ি হয়ে গেছে?
ধ্রুবকে হাসতে হল। বললে, হয়ে গেছে বলবেন না, হয়ে আসছে।
—তা কবে নাগাদ উঠে যাবে ঠিক করেছ?
ধ্রুবর মন তেতো হয়ে গেল। সঠিক কোনও উত্তর দিল না। দেবেই বা কী করে। ও নিজেই তো জানে না। জলের পাইপ, বাথরুম, ইলেকট্রিক।
শুধু বললে, উঠে যেতে পারলে তো আমারও লাভ, মাসে মাসে ভাড়া গুনতে হবে না।
শুনে প্রীতি বললে, এবার বোধহয় জল দেবে। দেখছে, যখন উঠেই যাবে…
কিন্তু না। উপরন্তু মাঝেমাঝেই, সিঁড়িতে ওঠানামার সময়, ডেকে জিগ্যেস করেন।–কদ্দূর কি হল? দিন ঠিক করেছ কিছু?
সে আরেক যন্ত্রণা। দরজাটা একদিন শব্দ করে বন্ধ করে দিয়ে ধ্রুব রাগের গলায় বললে, শালা!
বাড়িটা তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
ধ্রুব প্রীতিকে বললে, দেখো, ছোটমাসি এলে যেন বলে বসোনা বাড়ি হয়ে এসেছে। শেষে যদি নীচের তলাটা ভাড়া চেয়ে বসে…
প্রীতি বললে, ছোটমাসিরা তো বাড়ি পেয়ে গেছে, অবশ্য অনেক দূরে, ছশো টাকা নাকি ভাড়া।
ধ্রুব বললে, তা হোক, তবু কি জানি, যদি বলে বসে। বরং সে কথা তুললে বলে দেবে ভাড়া হয়ে গেছে।
প্রীতি সায় দিল। —ঠিক বলেছ।
তারপর একটু থেমে বললে, নীচের তলাটা কিন্তু ভাড়া দিতে হবে। তা হলে তাড়াতাড়ি জগন্নাথবাবুর ধার শোধ হয়ে যাবে।
ধ্রুব বললে, তা বলে আজেবাজে কাউকে দেওয়া যাবে না। শুধু কোম্পানি লীজ। একজন বলছিল হাজার টাকা ভাড়া হবে।
প্রীতি বলে উঠল, বাঃ শুধু ভাড়া? অ্যাডভান্স নেবে না?
খুব মাথা নাড়ল। দেখি।
পাওয়া যাবে না মানে? দাদা তো বলেছিল, মাড়োয়ারিকে দিলে তিরিশ চল্লিশ হাজারও পেয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়।
–সত্যি! খুব খুশি খুশি মুখে ধ্রুব বললে।
প্রীতি যেন একটা আশার কথা শোনাল। ঠিক বিশ্বাস হল না, তবু শুনতেও ভাল লাগল।
এখন তো ধ্রুব একদিক থেকে নিশ্চিন্ত। আর কয়েকটা মাস, তখন আর নিজেকে নিরাশ্রয় মনে হবে না। কিন্তু ঘাড়ের ওপর একরাশ দেনা। অবশ্য জগন্নাথবাবুর কাছে যা বাকি আছে সেটা নিয়েই চিন্তা। বাকি সবই তো মাইনে থেকে কেটে নেবে। কেটে নিচ্ছে। এরপর বাড়িভাড়াটাও দিতে হবে না। হয়তো দুএক বছর একটু কষ্টেসৃষ্টে চালাতে হবে।
একটা ইচ্ছে ছিল, বাড়ি করবে শুধু নিজে থাকার জন্যে। ভাড়া দেবে না। বাড়িওয়ালা হবে না। তাছাড়া ভাড়াটে নিয়ে তো ঢের অশান্তি। তবু পাকেচক্রে, টাকার টানাটানিতে, কিছুটা হয়তো লোভ, এখন ভাড়া দেওয়ার কথা ভাবতে হচ্ছে।
একটাই সান্ত্বনা, এখন আর নিজেকে নিরাশ্রয় মনে হয় না।
নিরাশ্রয়। কথাটা ভাবতে গিয়ে হাসি পেল। একটা বাড়িই কি মানুষের আশ্রয়? শুধু কখানা ঘর? হয়তো তাই। এই সমাজে, এই সমাজব্যবস্থায়। তা না হলে আজকের মানুষের সমস্ত জীবনটাই অতৃপ্ত, অসুখী কেন, শুধু একটা আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ ভাড়ার ফ্ল্যাট খুঁজছে, কেউ তা পেয়েও উদ্বেগ কিংবা অশান্তি নিয়ে টিকে আছে। একদিন ভারী জল দিতে না এলেই চক্ষুস্থির, হন্যে হয়ে তাদের খুঁজে বেড়াতে হয়। আর ধ্রুবর মতো যারা একটা কিছু করে ফেলেছে, তারাও তো ভাবছে সব কর্তব্য শেষ হয়ে গেল। যেন জীবনে একটা ফ্ল্যাট কিংবা বাড়ি করা ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। এই টাকায় গড়া সমাজ মানুষের জীবনের কাছ থেকে যেন আর কিছু চায় না। আর কোনও চাহিদা নেই। তোমার সমস্ত কিছু বিষয়বুদ্ধির কাছে বিকিয়ে দিয়ে যদি কিছু উদ্বৃত্ত থাকে, রুচি ও শিল্পবোধ, তা হলে একটা আর্ট ফিল্ম দেখে এসো, সম্ভব হলে গরিব কিংবা হরিজনদের সম্পর্কে। ছবিটা তোমার ভালই লাগবে, কারণ যারা তুলেছে, বিশ্বজোড়া নাম, তারাও ভাড়াটে। এতটুকু বিষয়বুদ্ধি নেই যে, সময় থাকতে একটা ফ্ল্যাট কিংবা বাড়ি করে ফেলবে।
ধ্রুব দৈবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। দৈব না থাকলে ওর পক্ষে এই বয়েসে কি একটা বাড়ি করে ফেলা সম্ভব হত। পিসেমশাই বেকায়দায় পড়ে হঠাৎ দুকাঠা জমি সেই বায়নার দরে দিতে চাইবেন কেন! তিন বছর আগেকার দাম। ভাবাই যায় না, ফ্ল্যাট কিনে ফেলে পাঁচ কাঠা জমি কেনার টাকাই ছিল না ওঁর হাতে।
তার ওপর এই জগন্নাথবাবু। দোতলাটা করে দিচ্ছি, আপনি সুবিধেমতো শোধ দেবেন।
কোত্থেকে কীভাবে যেন হয়ে গেল।
কিন্তু এখন আর দৈব মনে হচ্ছে না ধ্রুবর।
–কি ভাগ্য রে তোর, এই বয়েসে একটা বাড়ি করে ফেললি। তোর মেসো সারাজীবন চাকরি করে কিছুই করতে পারল না।
একটু থেমে বললে, আগে রিটায়ার করে লোকে বাড়ি করার কথা ভাবত। তাও পারত। তোরা আজকাল অনেক চালাকচতুর। কত কম বয়েসে সব করে ফেলছিস।
ছোটমাসি খবর পেয়েই একদিন চলে এসেছিল।
ধ্রুব হাসতে হাসতে বললে, দেনায় চুল পর্যন্ত ড়ুবে আছে, তোমরা শুধু ভাগ্যই দেখছ।
ছোটমাসি হাসল, বিশ্বাসই করল না।
তারপর বললে, নীচের তলাটা কি ভাড়া দিবি নাকি?
ধ্রুব চটপট বললে, ও তো ভাড়া হয়ে গেছে, অ্যাডভান্সের টাকা নিয়েই বাড়ি।
ছোটমাসি হতাশ গলায় বললে, অ্যাডভান্স না হয় আমরাই দিতাম, বললি না কেন?
ধ্রুব কোনও উত্তর দিল না। আত্মীয়কে কেউ বাড়ি ভাড়া দেয় নাকি। নিয়মিত ভাড়া দিলে তখন কিছু বলাও যাবে না। আত্মীয় তো দূরের কথা, বাঙালিকেই দেবে না। অবাঙালির মতো অত টাকা এরা দিতে পারবে নাকি।
প্রীতি অবশ্য একদিন বললে, বাঙালি ভাড়াটে হলেই কিন্তু ভাল হত। একটা কথা বলার লোক পেতাম।
ধ্রুব বললে, কথা বলার? না ঝগড়া করার? সম্ভব হলে ভাড়াই দিতাম না। ভাড়াটে নিয়ে বাস করা মানেই অশান্তি।
প্রীতি সশব্দে হেসে উঠল। —এই, তুমি বাড়িওয়ালা হয়ে গেছ এর মধ্যে। এখনো তো আমরা ও বাড়িতে উঠে যাইনি।
ধ্রুবও হেসে ফেলল।–হ্যাঁ, এখন তো আমরা বাড়িওয়ালাই।
একটু থেমে বললে, ভেবেচিন্তে করতে হবে সব। বাজারে এখন যেভাবে ভাড়া বাড়ছে, দিয়ে ফেললে তখন আর বাড়ানো যাবে না।
প্রীতি হাসতে হাসতে বললে, কেন? সে তো আমরা শিখে নিয়েছি, জল বন্ধ করে দিলেই হবে। উঠিয়ে দিয়ে আবার বেশি ভাড়ায়…
ধ্রুব বললে, জল বন্ধ করলে সবাই কি আর উঠে যায়? যার উপায় নেই সে কি করবে?
তারপর হেসে বললে, তা দেখা অবশ্য আমাদের কাজ নয়। গভর্নমেন্টই তাদের কথা ভাবে না, বাড়িওয়ালারা ভাববে কেন!
একটা কি যেন চিন্তা করল, তারপর বললে, ভাড়া যতই বাড়ুক, তাতেও লাভ হয় না।
আগে এ সব বুঝত না। এখন হিসেব কষে।
–ধরো ডিবেঞ্চারে টাকা রাখলে ফিফটিন পার্সেন্ট সুদ।
প্রীতি বললে, তুমি তো দোতলায় থাকবে বলে দোতলা করেছ, নীচের তলা তো করতেই হত। এখন সেটাকেও ইনভেস্টমেন্ট ভাবছ কেন?
ধ্রুব ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বললে, কারণ লোন শোধ করতে হবে। এর পর কপোরেশন ট্যাক্স আছে, এটা ওটা সারানো আছে।
একটাই সুবিধে, জলের পাম্প করতে হয়নি। রিসার্ভয়েরটা এতই কাছে, তার প্রেসাবেই দোতলায় জল উঠে যায়।
জগন্নাথবাবু বলেছিলেন, পাম্পের দরকার হবে না।
একদিন গিয়ে দেখল। সত্যি, ট্যাঙ্ক ভর্তি হয়ে উপছে পড়ছে।
জগন্নাথবাবুর ওভারসিয়ারকে বললে, ট্যাঙ্কে একটা কল লাগিয়ে দেবেন।
প্রীতি ছিল সঙ্গে। বলল, কেন?
-পরে বলব।
পরে আড়ালে হাসতে হাসতে বললে, একটা সুবিধে কি জানো? পাম্প নেই, কতক্ষণ চালাচ্ছ তা নিয়ে ভাড়াটে ঝগড়া করতে পারবে না। যখন দরকার হবে, ধরো ভাড়াটে যদি মাথা নিচু করে থাকে, সে অন্য কথা, তা না হলে জল উঠবে একদিকে, কল খুলে আরেকদিকে বের করে দাও। বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করলে বলা যাবে এসে দেখুন, জল ওঠেই না। সবাই তাই করে।
প্রীতি হাসল। বললে, আমার কিন্তু আর একদিনও ও বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না। চটপট সব করিয়ে নাও।
ধ্রুব নিজেও অধৈর্য হয়ে উঠছিল। শুধু সামনে এই স্বপ্নটা আছে বলেই ধৈর্য ধরেছে। একটা বাড়ি করতে যে এত সময় লাগে ও জানতই না। জগন্নাথবাবু তো প্রথমে অনেক কম সময় বলেছিলেন, কিন্তু পারলেন না।
হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে গেলে আজকাল প্রীতির খাতির যত্ন অনেক বেশি হয়। দূরে সরে আসার জন্যে ওরা কাছের মানুষ হয়ে গেছে বলে, নাকি বাড়ি করছে বলেই ওদের দাম বেড়ে গেছে।
বড়বৌদি বললে, একদিন চলো দেখিয়ে নিয়ে এসো। একজন অন্তত ভাড়াটে নাম ঘোচাল, দেখে আসব না?
দাদা বললে, সবই ভাল, বলছিস দুখানা ঘর এক এক তলায়, তিনখানা না হলে…
ধ্রুব বললে, প্ল্যানে আছে, ওটা পরে বাড়িয়ে নেব।
বড়বৌদি দাদাকে ধমক দিল।–তুমি থামো, দু’খানাও তত করেছে।
মেজবৌদি বললে, আমি বাবা রঙটঙ করার পর দেখতে যাব। রঙ না পড়লে বাড়ি ঠিক খোলতাই হয় না।
তারপর হাসতে হাসতে বললে, ধ্রুবদা, গৃহপ্রবেশে খুব খাওয়াতে হবে কিন্তু। তোমার পিসেমশাইদের মতোই, গোটা গোটা গলদা চিংড়ি আর মুর্গির ঠ্যাং।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
মেজদা বললে, হ্যাঁ, দেখিয়ে দিবি পিসেমশাইকে, আমরাও পারি। টাকা হয়েছে বলে ওঁর খুব গর্ব। কেমন বলছিলেন, পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট জুড়ে নিয়েছি। আসলে বোধহয় বলতে চাইছিলেন, তোরা তো একটাই কিনতে পারলি না।
মেজদার কথাটা ধ্রুবর প্রথমে ভাল লাগেনি। পিসেমশাই না থাকলে বাড়িটাই তো হত না। উনি তো ও দু কাঠা অন্য কাউকেও দিতে পারতেন। অবশ্য বাইরের লোককে বোধহয় দিতে চাননি। গায়ে গায়ে বাড়ি, আত্মীয় খুঁজেছিলেন। কিন্তু জগন্নাথবাবু? উনিও তো বিশ্বাস করেছেন পিসেমশাই মাঝখানে আছেন বলেই। একজন টাকাওয়ালা লোক, অনেকদিনের পরিচয়…
কিন্তু মেজদার কথাটা শোনার পর ধ্রুবর মনে হল, পিসেমশাই একটু টাকাও দেখাতে চেয়েছিলেন। তা না হলে ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশে অত এলাহি কাণ্ড করার কি দরকার ছিল। এত লোককে নেমন্তন্নই বা কেন!
বাবা আর মার দারুণ আনন্দ।–কবে যাচ্ছিস?
মা বললেন, বাবাকে বলিস পাঁজি দেখে দিন ঠিক করে দেবে।
হাসতে হাসতে প্রীতিকে বললেন, আমি কিন্তু সত্যিনারাণ দিয়ে আসব বৌমা।
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, হ্যাঁ, তোর মায়ের সত্যিনারাণের খুব পয়া আছে, বাড়ি হয়ে গেল।
মা বাধা দিয়ে বললেন, সে কথা বলো না, পয়া যদি কারো থাকে সে বৌমার।
প্রীতি খুব খুশি, কুলকুল করে হেসে উঠল। তোষামোদ করে বললেন, না, সে আপনাদের আশীর্বাদ।
এখন এ ধরনের কথা বলতে ওর অস্বস্তি নেই। আগে পারত না।
ধ্রুব চলে আসার আগে মা ওকে একটু আড়ালে নিয়ে গেলেন। চাপা গলায় জিগ্যেস করলেন, হ্যাঁ রে, শ্বশুরের কাছে কিছু নিসনি তো? বাড়ি করার জন্যে?
ধ্রুব চমকে উঠল। রেগে গেল।–কেন? তাঁর কাছে নিতে যাব কেন?
–না, সেকথাই জিগ্যেস করছি। তেমন হলে তোর বাবার শুনলে তো খারাপ লাগবে। বড় বৌমা বলছিল কিনা, অনেক টাকার ব্যাপার…
ধ্রুব রাগের গলায় বললে, ওদের বলে দিও, আমার একটা আত্মসম্মান বলে জিনিস আছে।
আবার কি একটা ঝামেলা হয় এই ভয়ে মা বললেন, না না, ওরা সেভাবে বলেনি, ধার নেয়ার কথা বলছিল…
ধ্রুব হেসে বললে, না, তাও নিইনি।
একটু থেমে বললে, ধার দেওয়ার মতো অবস্থাও তাঁর নয়।
ফেরার পথে প্রীতিকে কথাটা বলতে পারল না। চেপে গেল। শুনলে বড়বৌদি আর মেজবৌদির ওপর আবার রেগে যাবে। উল্টে হয়তো ভাববে, ধ্রুব যখন চতুর্দিকে লোনের চেষ্টা করছে, তখন হয়তো ভেবেছে, প্রীতি কেন তার বাবাকে বলছে না। একবার লোভ সত্যি হয়েছিল ধ্রুবর, কথাটা প্রীতিকে বলার। ভাগ্যিস বলেনি।
এখন জানে, উনি দিতে পারতেন না। উল্টে না দিতে পারার জন্যে লজ্জা পেতেন।
অথচ প্রীতি যদি শোনে ও মাকে বলেছে, ধার দেওয়ার মতো অবস্থাও তাঁর নেই, তা হলেও রেগে যাবে। শ্বশুরবাড়িতে বাবার দুরবস্থার কথা প্রকাশ করে দেওয়ার কি দরকার ছিল। শ্বশুরের কাছে ধার নিতে আমার আত্মসম্মানে বাধে, এটুকু বললেই তো পারতে।
হয়তো রেগে গিয়ে বলত, ওদের কাছে আমার বাপের বাড়িকে ছোট করে তোেমার কি লাভ হল!
বাড়ি ফিরেই মেজাজটা আরো বিগড়ে গেল।
ঢোকার আর বেরোনোর সময়টা বড় অস্বস্তিতে কাটে। গোঁপওয়ালা বিহারি দারোয়ানটা আজকাল এতটুকু সমীহ করে না। আগে করত। এমন ভাবভঙ্গি করে যেন ধ্রুব এই ফ্ল্যাটে থাকে না। ধ্রুব বেশ বুঝতে পারে এর পিছনে রাখালবাবুর উৎসাহ আছে। কিংবা কে জানে, ওঁদের কথাবার্তা শুনে লোকটা সব বুঝে নিয়েছে।
কিন্তু মেজাজ আরো বিগড়ে গেল হাতকাটা দালালটাকে দেখে।
ধ্রুবর জন্যেই অপেক্ষা করছিল।
কনুই থেকে ফুলহাতা শার্টের হাতাটা ঝুলছে, সেই হাতটাই নেড়ে বললে, এই ফ্ল্যাটটা আমিই আপনাকে দেখে দিয়েছিলাম।
ধ্রুব রেগে গিয়ে বললে, সে আর মনে নেই? এই রকম একটা বাড়িওয়ালার কাছে জেনেশুনে…
একমুখ হাসল লোকটা। বাড়িওয়ালা বাড়িওয়ালার মতোই তো হবে বাবু?
—তা তুমিও কি জানতে এসেছ কবে উঠে যাচ্ছি?
আবার হাসল।–হ্যাঁ, সেকথাই বলতে এলাম। আমাকে একটু আগে থেকে বলবেন, আবার অন্য কোনও দালাল না মেরে দেয়। আগে থেকে জানলে, আমার লোক নিয়ে আসব, কটা টাকা পেতাম, দেখছেন তো হাতটা কাটা। কিছুই করার নেই। দুটো পয়সা যদি পাই দালালি করে…
ধ্রুব বললে, ঠিক আছে, বলব।
লোকটা তবু দাঁড়িয়ে রইল। আরেকটা কথা বলছিলাম। আপনার তো বাড়ি হয়ে গেছে, নীচের তলাটা নাকি ভাড়া দেবেন…
–সে কথাও জেনে গেছ?
লোকটা হাসল। ঘাড় নেড়ে জানাল, হ্যাঁ।
লোকটাকে বলতে পারত, পরে বলব। কিংবা ভাড়া দেব না।
তবু একটু যাচিয়ে দেখতে ইচ্ছে হল।
জায়গাটার মোটামুটি একটু ধারণা দিল। বললে, দুখানা ঘর, ভিতর দিকে বারান্দা, সামনে ব্যালকনি…
–ব্যালকনি আছে? লোকটা খুব খুশি।
ধ্রুব বললে, সে তো দোতলায়।
-কিচেন খুব ছোট নয় তো?
ধ্রুব বললে, না।
লোকটা বললে, খুব ভাল পার্টি আছে, আজ রাত্রেই নিয়ে আসব স্যার। অ্যাডভান্স দেবে মোটা টাকা। কত চান বলুন…
লোকটা যেন ক্রমশই উত্তেজিত হয়ে উঠছিল।
ধ্রুব বললে, এখন নয়, এখন নয়।
কোনওরকমে তাকে বিদায় দিল।
তারপর নিজেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করল।
ভিতরের রঙ আগেই হয়ে গিয়েছিল, বাড়ির বাইরেটায় রঙ পড়তেই সমস্ত পাড়াটাই যেন ঝলমল করে উঠেছে। ধ্রুব যখনই বাড়ি ফেরে, অফিস থেকে, কিংবা বাজারের থলি হাতে নিয়ে, প্রাণভরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। দেখে আর গর্বে, পুলকে বুক ভরে ওঠে। মনে মনে বলে আমার বাড়ি, নিজস্ব বাড়ি।
এর প্রতিটি ইট যেন ধ্রুবর স্বপ্ন দিয়ে গাঁথা। কৃচ্ছসাধনই কি কম আছে এর পিছনে, কে তার খোঁজ রাখে। পরিশ্রম, উদ্বেগ, অর্থ, কি না দিয়েছে এই বাড়ির জন্যে।
আমার নিজের বাড়ি। বলতেও আনন্দ।
ধ্রুব, প্রীতি আর টিপু। দেখতে দেখতে টিপু কত বড় হয়ে গেছে। মাস দুই হল ওরা এই নতুন বাড়িতে উঠে এসেছে। ভাবছে, টিপুকে এবারই পাড়ার স্কুলে ভর্তি করে দেবে।
সেখানেই খবর নিতে গিয়েছিল। রিকশা করে ফিরছিল।
রিকশা থেকেই বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল ধ্রুব।
–যাই বলল, রঙটা কিন্তু চমৎকার ম্যাচ করে করেছে। জগন্নাথবাবু ভদ্রলোকের রুচি আছে।
প্রীতি বললে, তুমি তো প্রথমে আপত্তি করেছিলে, উনিই বললেন খুব ব্রাইট দেখাবে।
ধ্রুব বললে, তখন কি ছাই এ-সব বুঝতাম। এখন আমি নিজেই কন্ট্রাক্টর হয়ে যেতে পারি, সব জেনে গেছি।
প্রীতি হেসে ফেলল।–তা হলে সেই কাজই শুরু করে দাও।
তারপর বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললে, যাই বলো, আমাদের বাড়িটাই কেস্ট, এ পাড়ায়।
ধ্রুবরও সেরকমই মনে হচ্ছিল। আশেপাশে কয়েকটা বেশ বড়সড় বাড়িও আছে, কিন্তু সেগুলোকে এখন আর তেমন সুন্দর লাগছে না। হয়তো অনেককাল বাইরেটা রঙ করেনি বলে, রোদে-জলে কেমন মরামরা লাগে। দু-একটা বাড়ির রঙ নতুন, কিন্তু কোনও রুচি নেই। নীল কিংবা সবুজ ঢেলে দিয়েছে।
প্রীতি একটা বাড়ির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললে। হরিবল, এই রকম ব্লু কেউ দেয়!
ধ্রুব গম্ভীরভাবে বললে, ওটা সুধীনবাবুর বাড়ি, চমত্ত্বার লোক। এমন ভদ্র আর মিশুকে, কোনও গর্ব নেই…
প্রীতি আর কিছু বলল না।
এ পাড়ায় উঠে এসেই ধ্রুব অনেকের সঙ্গে আলাপ করে ফেলেছে। প্রীতির এখনও চেনাজানার গণ্ডি তেমন বাড়েনি। কে কেমন লোক ও কিছুই জানে না।
জানার দরকারও নেই। বাড়ির দোতলার ব্যালকনিতে বেতের চেয়ারে এলিয়ে বসে সিনেমার ম্যাগাজিনের পাতায় ড়ুব দিয়ে ওর অবসর কেটে যায়।
প্রীতির নিজেকে বেশ সুখী মনে হয়। ধ্রুবরও। যেন জীবনের কাছে সব চাওয়া ফুরিয়ে গেছে। এই বয়েসেই। এখন শুধু টিপুকে মানুষ করে তোলা। ও তো আপনা থেকেই হবে। শুধু একটা ভাল স্কুলে ভর্তি করে দিলেই হবে।
এর মধ্যে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে সেই হাত কাটা দালালটা একদিন এসে হাজির। কিছু ঠিক করলেন স্যার, ভাল পার্টি আছে, অবাঙালি চান অবাঙালি, বাঙালি চান বাঙালি…
ধ্রুব তাকে ফিরিয়ে দিল। এখন নয়, এখন নয়।
আরো দুচারজন এসেছে, আপনা থেকেই। বিব্রত, বিরক্তবোধ করেছে ধ্রুব। নীচের তলাটা খালি পড়ে থাকাও যেন এক অশান্তি।
–শালা ভাড়াটেদের জ্বালায় টেকা দায়।
একজনের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে ধ্রুব বললে।
প্রীতিও সমান বিরক্ত। বললে, সামনে লিখে দাও, ভাড়া দেওয়া হবে না।
ধ্রুব হাসল। তা হলে তো আরও বিরক্ত করবে। সবাই জেনে যাবে নীচের তলা খালি আছে।
আসলে ধ্রুব এখনও মনস্থির করতে পারছে না, ভাড়া দেবে কিনা। ভাড়া না দিয়ে যদি ধার দেনা শোধ হয়ে যায়! না, ওর কেবলই ভয়, হয়তো ঠকে যাবে। হয়তো আরো ভাড়া বাড়বে, তখন ভাড়াটে তুলতে পারবে না।
ভাড়াটেকে খোলা এ বাজারে যে কঠিন কাজ, ধ্রুব জানে। ওর মতো সকলেই তো আর বাড়ি করে উঠে আসতে পারে না। তাই সব অত্যাচার সয়েও দাঁত কামড়ে পড়ে থাকে। উঠে আসতে কি আর পারে না, চেষ্টাই করে না। ধ্রুবর তো এখন তাই মনে হয়। ও পারল কী করে।
অফিসে অবিনাশ তো ঠাট্টা করে ওকে মূখ বলল। ভাড়ার ফ্ল্যাট এমনি এমনি ছেড়ে দিয়েছে শুনে বলে উঠল, তুমি তো একটি মুখ হে। এমনি কখনো ছাড়ে? জানো, পঞ্চাশ হাজার দিলেও ভাড়াটে ওঠে না। আদায় করে নিতে হত।
ধ্রুব হেসেছিল ওর কথা শুনে।
অবিনাশ বলেছে, হাসির কী আছে? এটা তোমার রাইট। ও লোকটা আইনের জোরে বাড়িওয়ালা, তুমি আইনের জোরে ভাড়াটে। যখন ভাড়া দিয়েছিল তখন তো ও অনেক দেখেশুনে দিয়েছে। কার বেশি দরকার তা তো দেখেনি, যে ভাড়া বেশি দেবে, ভাড়া ঠিক ঠিক দিতে পারবে তাকেই দিয়েছে। সবাই তাই দেয়। স্বার্থ দেখে। তা হলে ভাড়াটেই বা স্বার্থ দেখবে না কেন?
শুনে সমস্ত মন তেতো হয়ে গিয়েছিল। অবিনাশের কাছে এই কথাগুলো শুনে খুব রীতিমত ভয় পেয়ে গেছে। ও যদি ভাড়া দেয়, ভাড়াটেকে তুলতে চাইলে সেও এরকম টাকা চেয়ে বসবে হয়তো। অথচ ভিতরে ভিতরে একটা লোভ। ভাড়া দিলে তাড়াতাড়ি ধারদেনা শোধ করে দেওয়া যাবে।
এখন ধ্রুবর কাছেও ভাড়াটেরা একটা আতঙ্ক।
আসা-যাওয়ার পথে পাড়ার সুখেনবাবুর সঙ্গে আলাপ। মাঝে মাঝেই দেখা হত, আর ভদ্রলোক টানাটানি করতেন, আসুন, চা খেয়ে যান। কিংবা স্ত্রীকে নিয়ে একদিন আসুন।
ভদ্রলোকের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে, হাঁটা-চলা দেখে ধারণা হয়েছিল উনিই বাড়িটার মালিক। তা নয়, ভাল চাকরি করেন। অনেক টাকা ভাড়া দিয়ে আছেন।
একদিন সপরিবারে এলেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী খুব জমিয়ে গল্প করতে পারেন। যতক্ষণ ছিলেন সময় যে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারেনি ওরা।
যাবার সময় বললেন, নিজে বাড়ি করেছেন, অনেক শান্তিতে আছেন। আমাদের যা বাড়িওয়ালা মশাই, ছবি টাঙাব বলে দেয়ালে একটা পেরেক ঠুকছি, গুণ্ডামতো ছেলেটা ছুটে এসে সে কি হম্বিতম্বি।
সুখেনবাবুর স্ত্রী বললেন, ছোটলোক, ছোটলোক।
চলে গেলেন ওঁরা, কিন্তু ধ্রুবর সমস্ত মন বিস্বাদ করে দিয়ে।
ধ্রুবর তো এই দুমাসের মধ্যেই বাড়িটার ওপর মায়া পড়ে গেছে। মনে হচ্ছে এর চেয়ে ভাল জায়গা ভাল বাড়ি যেন হতে পারত না।
দরজার ঝকঝকে নব দুবেলা ঘষেমেজে চকচকে করে রাখে প্রীতি।
বলছিল, জিনিস রাখার জন্যে রান্নাঘরে কয়েকটা কাঠের খোপ বানিয়ে নেবে।
—আর হ্যাঁ, বসার ঘরের জন্যে বেশ বড় একটা ছবি। কোনও মডার্ন আটিস্টের। প্রীতি বলেছিল, বসার ঘরে কোনও অরিজিনাল পেন্টিং না থাকলে ড্রয়িং রুম বলে মনেই হয় না।
ধ্রুবর মডার্ন আর্ট অত পছন্দ নয়। বলেছিল, যামিনী রায়।
প্রীতি উল্লসিত। –তা হলে তো কথাই নেই, কিন্তু অরিজিন্যাল!
এখনও ওদের বাড়িটাকে ঘিরে নানা স্বপ্ন। যেমন টিপুকে ঘিরে। বাড়িটাও যেন আরেকজন টিপু। আসলে এও তো রক্তমাংস দিয়েই গড়া। শেষে কি একজন ভাড়াটে এসে দুম দুম করে এর দেয়াল খুঁড়তে আরম্ভ করবে নাকি। সে এক আতঙ্ক।
সুখেনবাবুর কথাটা মনে পড়ে গেল। বললে, ভাড়াটে, তার আবার ছবি টাঙানোর শখ।
ওর স্বগতোক্তি প্রীতির কানে গেল।–আগের ফ্ল্যাটে আমরাও তো টাঙিয়েছিলাম। তুমি না, কেমন যেন বদলে যাচ্ছ।
ধ্রুব বললে, বদলে যাচ্ছি না, বদলে গিয়েছি। এখন আমি সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তখন পেতাম না।
প্রীতি ভুরু কুঁচকে তাকাল ধ্রুবর চোখের দিকে।–তুমি কি যেন হয়ে যাচ্ছ।
ধ্রুব চুপ করে গেল। ও কি সত্যি সত্যি বদলে যাচ্ছে নাকি?
তা না হলে ও সুখেনবাবুকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলতে চাইল কেন? ওঁরা তা নিজে থেকেই একদিন আলাপ করতে এসেছিলেন। ধ্রুব কথা দিয়েছিল, ওরাও একদিন যাবে।
কিন্তু গেল না।
প্রীতি একদিন বলেছিল। ধ্রুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছে, না না, অত মেলামেশার কি দরকার।
একটু পরে বলেছে, জীবনবাবুকে চটিয়ে কি লাভ।
জীবনবাবু অথাৎ সুখেনবাবুর বাড়িওয়ালা। লোকটিকে ভালই লাগে ধ্রুবর। খুব খোলামেলা। কথাবার্তায় কোনও রাখাঢাকা নেই।
এখানে এসে ও ভেবেছিল সকলের খুব বন্ধু হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম বোধহয় চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু পারেনি। কেন, কে জানে।
ওর নিজেরই দোষ কিনা জানে না।
এখন প্রীতিও বলছে, তুমি না, কেমন যেন বদলে যাচ্ছ!
ধ্রুব মনে মনে বললে, বদলে যেতেই তো চাই। আমি তো বাড়ি বদল করেছি। বাড়ি বদল মানে তো শুধু একটা বাড়ি থেকে আরেকটা বাড়িতে যাওয়া নয়।
এসে একদিন প্রীতিকে বললে, চলো অরিন্দমবাবুদের বাড়ি যেতে হবে। উনি আজ আমাদের চায়ের নেমন্তন্ন করেছেন।
প্রীতি অবাক হয়ে বললে, অরিন্দমবাবু, সে আবার কে?
–বাঃ, তোমাকে তো কতদিন বলেছি, প্রায়ই দেখা হয়। নামগুলো তো মনে রাখবে।
তারপর ধীরে ধীরে বললে, ওই তিনতলা বড় বাড়ি, ওঁরই। বলেছেন, ওঁর কপোরেশনে চেনা আছে, বাড়ির ট্যাক্সটা যাতে কম হয় ব্যবস্থা করে দেবেন।
প্রীতি শুধু বললে, ও।
গেল। কিন্তু খুব মন খুলে আলাপ করল না। বোধহয় ভদ্রলোকের গিন্নিকে পছন্দ হয়নি। পছন্দ হবার কথাও নয়। বেশ বয়স্ক, জবুথবু। একটু প্রাচীনপন্থী।
অরিন্দমবাবুকেও ধ্রুবর খুব ভাল লাগেনি। কেবল ঘরের মোজেক দেখাচ্ছিলেন। কী রকম পালিশ দেখেছেন? ডিজাইনটা আর কোথাও দেখবেন না। বারান্দার গ্রীল দেখাচ্ছিলেন।
তবু বন্ধু মনে হল তাঁকে। অরিন্দমবাবু বললেন, ট্যাক্স নিয়ে আপনি ভাববেন না, আমার লোক আছে। এই গোটা বাড়ির কত ট্যাক্স করিয়েছি জানেন, মাত্র একশো কুড়ি।
বলে হো হো করে হাসলেন।
ফেরার সময় ধ্রুব বলেছিল, যাই বলল, ভদ্রলোক খুব পরোপকারী। যেচে কে এই উপকার করে আজকের বাজারে।
পরোপকারী কথাটা নিজের কানেই খট করে লাগল। পরের উপকার? কিন্তু অরিন্দমবাবু কি ধ্রুবকে পর ভাবছেন? নাকি ধ্রুবই ওঁকে পর ভাবছে। কেমন যেন আপন আপন মনে হচ্ছে। শুধু স্বার্থের জন্যে? না কি স্বার্থই ওদের এক করে দিয়েছে, আপন করে দিয়েছে।
হয়তো তাই।
সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি। রাস্তায় রাস্তায় জল জমে গেছে। অফিস থেকে বেরিয়ে ভেবেছিল ট্যাক্সি করেই বাড়ি ফিরবে। কিন্তু পকেটে টাকাও বেশি ছিল না। আজকাল খরচ কমানোর চেষ্টা করছে, সেজন্যেই পকেটে টাকাও বেশি রাখে না। থাকলেই খরচ হয়ে যায়। ভয় হল, জ্যামে আটকে গিয়ে মিটার কোথায় উঠবে কে জানে। শেষে বাড়ি পর্যন্ত যদি না আসে, মাঝপথে টাকা দিতে পারবে না।
দু দুবার বাস বদলাতে গিয়ে একেবারে কাকভেজা।
বাড়ি ফিরেই শুনতে পেল প্রচণ্ড উল্লাস। হাসিহল্লা।
বেল বাজানোর পর এসে দরজা খুলতেও দেরি করল প্রীতি। কিংবা একে ক্লান্ত তার ওপর ভিজে গেছে বলেই ধ্রুবর মনে হল দরজা খুলতে বড় বেশি দেরি করছে প্রীতি।
রাগ চেপে রাখার চেষ্টা করল।
কিন্তু ঢুকেই চক্ষুস্থির। জামাকাপড় বদলানোর জন্যে বসার ঘরে এসে অপেক্ষা করল। প্রীতি শুকনো জামাকাপড় এনে দিয়ে গেল।
এক ঝলক দেখেছে, তাতেই বিরক্তি। সুখেনবাবুর স্ত্রী।
ওঁরই সঙ্গে এত হাসিগল্প। এত হলা। দুড়মদাঁড়াম করে দেয়াল খুড়ছিল বলে জীবনবাবু একটু আপত্তি করেছেন, তাঁরই তো বাড়ি, মায়া হবে না। তার জন্যে বাড়ি বয়ে বলতে এসেছিলেন এই সুখেনবাবুরা।
উদ্দেশ্য তো একটাই। অরিন্দমবাবুর বিরুদ্ধে পাড়ায় প্রোপাগাণ্ডা করা।
অনেকক্ষণ ধরে বসার ঘরে বসে বসে রাগ চাপছিল খুব। ভদ্রমহিলার যাবার নাম নেই।
শেষে শুনতে পেল, ভদ্রমহিলা বলছেন, ছাতাই দাও ভাই, চলে যাই। কতক্ষণ আর উনি বসে থাকবেন।
একথাটা যেন আগে বলা যেত না।
উনি চলে যেতেই রাগে ফেটে পড়ল ধ্রুব।
–বার বার বলেছি, ওদের সঙ্গে মেলামেশা করো না, করো না।
প্রীতি অবাক হয়ে বলল, কেন, কি করল ওরা? বরং আমি একা একা থাকি, উনি এলেন বলে তো..
খুব গলার স্বর তুলল।–মেলামেশার আরো ভোলোক আছে। এখন তো খুব হাসাহাসি, নীচের তলায় যদি ভাড়াটে বসাই, তখন দেখবে তার সঙ্গে দল বাঁধছে। সব চেনা আছে আমার।
প্রীতি বিভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইল ধ্রুবর চোখের দিকে।
ধ্রুব তখনও ক্রমশ উত্তেজিত হচ্ছে।
বললে, ওরা তো শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখে। গল্প বলতে তো, বাড়িওয়ালা মাথার ওপর শিলনোড়ায় মশলা বাটে, বললেও শোনে না। কিংবা এই সেদিন এসেছি, এর মধ্যে ভাড়া বাড়াতে বলছে। আর নয়তো ওই এক কথা, জল দেয় না। ওরা একটা আলাদা ক্লাশ, বুঝলে!
প্রীতি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ধ্রুবর চোখের দিকে। তারপর কেমন একটা রহস্যের হাসি হাসল।
আর ধীরে ধীরে বললে, বাড়িটা সত্যি বদলে গেছে।
———–