অধ্যায় ৫ — ফ্যাসিবাদের পূর্বসূত্র
আমরা যখন আমাদের যুগের সঙ্গে (ধরুন) ১ম জর্জের যুগের তুলনা করি, আমরা লক্ষ্য করি বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার মেজাজে একটা গভীর পরিবর্তন ঘটেছে এবং এই পরিবর্তনের অনুসরণে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক সুরও বদলে গেছে। এক হিসেবে গত দুশো বছর আগের ধ্যান-ধারণাকে যুক্তিশীল বলা যেতে পারে এবং আমাদের যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্যকে বলা যেতে পারে যুক্তিবিরোধী। কিন্তু আমি এই শব্দগুলোকে ব্যবহার করছি কোনো একটি মেজাজ সম্পূর্ণ গ্রহণ কিংবা সম্পূর্ণ বর্জন অর্থে নয়। উপরন্তু এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, রাজনৈতিক ঘটনা বারে বারে নতুন রঙে রঞ্জিত হয় পূর্বতন কালের ভাবনা দ্বারা একটি তত্ত্ব ঘোষণা এবং তার ব্যবহারিক কার্যকারিতার ভেতর বিরাট বিরতি থাকে। ১৮৬০ সালে ইংরেজ জাতির রাজনীতি প্রভাবিত হয়েছিল ১৭৭৬ সালের অ্যাডাম স্মিথের ভাবনা-ধারণা দ্বারা। আজকের জার্মান রাজনীতিকে ১৮০৭ সালের ফিশতের তত্ত্বের বাস্তবায়ন গণ্য করা চলে। রুশ রাজনীতি ১৯১৭ সালের পর কম্যুনিস্ট ইশতেহারের মতবাদ বাস্তবায়িত করেছে, ঐ ইশতেহার প্রথম ঘোষিত হয় ১৮৪৮ সালে। সুতরাং বর্তমান যুগকে বুঝতে হলে অনেক আগের সময়ের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।
কোনো রাজনৈতিক মতবাদ ব্যাপক প্রচারণা পেলে ধরে নিতে হবে এর পেছনে দুটো কারণ ক্রিয়াশীল ছিল। একদিকে থাকে পূর্বতন কালের জ্ঞানচর্চা। অর্থাৎ থাকেন কিছু লোক যারা কিছু তত্ত্ব এগিয়ে নিয়ে যান, যে তত্ত্বগুলো গজিয়ে উঠেছে পূর্বতন তত্ত্বের বিকাশ কিংবা প্রতিক্রিয়া হিসেবে। অপরপক্ষে, কিছু-কিছু অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি জনগণকে এমন দৃষ্টিকোণ গ্রহণে আগেই অনুপ্রাণিত করে রাখে যা সুনির্দিষ্ট মেজাজ অবলম্বনে মন্ত্রণা যোগায়। তবু শুধু এগুলো থেকেই সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা মেলে না, যেহেতু প্রায়ই দেখা যায়, পূর্বতন জ্ঞানচর্চা অবজ্ঞা করা হয়। যে ব্যাপার নিয়ে আমরা এখানে ভাবতে বসেছি তাতে দেখা যায় যে, যুদ্ধোত্তর কালের দুনিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠীর অসন্তোষের সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল, ফলে তা আগের কালে উদ্ভাবিত নির্দিষ্ট একটি দর্শনের প্রতি তাদের সহানুভূতিশীল করেছে। এই দর্শন বিষয়ে প্রথমে কিছু কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করি। অতঃপর এই দর্শনের বর্তমান জনপ্রিয়তার বিষয়ে ভাবা যাবে।
যুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় যুক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে নিউটন যখন মানুষের মন শাসন করছিলেন, তখন একটা বিশ্বাস ব্যাপক প্রসার লাভ করে যে প্রাঞ্জল সাধারণ সূত্র আবিষ্কারের মধ্যেই জ্ঞানের পথ মেলে। এবং এই সাধারণ সূত্র থেকে অবরোহী যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব। অনেকেই ভুলে গেছিলেন যে নিউটনের মধ্যাকর্ষণ সূত্রের ভিত্তি এক শতাব্দীর সতর্ক পর্যবেক্ষণ, এবং তিনি কল্পনা করতেন যে সাধারণ সূত্র প্রকৃতির আলোকে আবিষ্কার সম্ভব। সে সময় ছিল প্রাকৃতিক ধর্ম, প্রাকৃতিক আইন, প্রাকৃতিক নৈতিকতা, এবং প্রাকৃতিক আরো অনেক কিছু। ধরা হতো এই বিষয়গুলো গঠিত স্বতঃপ্রমাণিত স্বতঃসিদ্ধান্ত থেকে গৃহীত প্রতিপাদক অনুমান, অনেকটা ইউক্লিডের নিয়মে। এই দৃষ্টিভঙ্গির রাজনৈতিক ফল ছিল মানুষের অধিকার, যা আমেরিকান এবং ফরাসি বিপ্লবের সময় প্রচার পায়।
কিন্তু যে মুহূর্তে যুক্তির মন্দির নির্মাণ প্রায় শেষ হবার পথে, সেই সময় একটা মাইন পোতা হয় এবং পরিশেষে গোটা অট্টালিকা বিস্ফোরিত হয়ে দূর আকাশে বেড়াতে থাকে। যে ব্যক্তি এই মাইন পুতেছিলেন তার নাম ডেভিড হিউম। তাঁর মানবের প্রকৃতি (Treatise of Human Nature) প্রকাশিত হয় ১৭৩৯ সালে, বইটির উপনাম ছিল নৈতিক বিষয়ে যুক্তির পরীক্ষামূলক পদ্ধতির সূচনার প্রচেষ্টা। বইটি তাঁর সমগ্র অভিপ্রায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে তা তাঁর কর্মতৎপরতার অর্ধেক মাত্র। তাঁর অভিপ্রায় ছিল পর্যবেক্ষণ ও আরোহী যুক্তি বিকল্প হিসেবে ব্যবহার, নামমাত্র স্বতঃপ্রমাণিত স্বতঃসিদ্ধান্তের পরিবর্তে। মেজাজের দিক থেকে তিনি ছিলেন পুরোপুরি বুদ্ধিবাদী, তবে তাঁর বুদ্ধিবাদের চরিত্র এরিস্টটলীয় নয়, বেকনপন্থী। কিন্তু তাঁর সূক্ষ্মদর্শিতার সঙ্গে বুদ্ধিগত সতোর প্রায় অভূতপূর্ব সম্মিলন তাঁকে কয়েকটি বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিচালিত করে; যে, আরোহী যুক্তির অভ্যাসের যৌক্তিক ন্যায্যতা নেই, এবং কারণবাদে বিশ্বাস কুসংস্কারে বিশ্বাস থেকে সামান্যই উন্নত। ফল দাঁড়াল ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে বিজ্ঞানও ভ্রমাত্মক প্রত্যাশা এবং যুক্তিহীন বিশ্বাসের অবাঞ্ছিত পর্যায়ে ঠেকল।
হিউমের মধ্যে বুদ্ধিবাদ ও সংশয়বাদ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছে। তবে সংশয়বাদ চর্চার ক্ষেত্রেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকবে এবং নিত্যদিনের ব্যবহারিক জীবনে এটি ভুলে থাকতে হবে। উপরন্তু ব্যবহারিক জীবন শাসিত হবে, যতদূর সম্ভব, সেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দ্বারা, যে পদ্ধতি সম্পর্কে সংশয়বাদ প্রশ্ন তুলেছে। এ ধরনের আপস সম্ভবপর এমন একজন ব্যক্তির পক্ষেই, যিনি সমানভাবে দার্শনিক এবং ইহজাগতিক; অনুপ্রাণিত ব্যক্তির ভেতর এই দুয়ে অবিশ্বাস সংরক্ষণে আভিজাতিক রক্ষণশীলতার (Toryism) আস্বাদও এতে ছিল। বৃহত্তর জগৎ কিন্তু হিউমের মতবাদ সম্পূর্ণ গ্রহণে অস্বীকার করে। তাঁর অনুসারীগণ তাঁর সংশয়বাদ বাতিল করে দেন, পক্ষান্তরে তাঁর প্রতিপক্ষরা বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবাদী দৃষ্টিকোণের ফল হিসেবে এই তত্ত্বের উপর জোর দেন। হিউমের দর্শনের ফলে ব্রিটিশ দর্শন হয়ে পড়ে অগভীর, জার্মান দর্শন হয়ে পড়ে বুদ্ধিবাদবিরোধী এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অসহনীয় অজ্ঞেয়তাবাদের ভীতি কাজ করে। ইউরোপীয় চিন্তা তার অতীতের ঐকান্তিকতা আর পুনরুদ্ধার করতে পারে নি; হিউমের প্রতিটি অনুসারীর কাছে মানসিক ভারসাম্যের অর্থ দাঁড়ায় অগভীরতা, গভীরতার অর্থ দাঁড়ায় নির্দিষ্ট মাত্রার উন্মাদগ্রস্ততা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উপযোগী দর্শনের উপর অতি সাম্প্রতিককালীন আলোচনায় হিউম-উত্থাপিত পুরাতন বিতর্ক পুনরায় শুরু হয়েছে।
বিশেষভাবে জার্মান ছাপ-যুক্ত দর্শন সূচিত কান্টের সঙ্গে, এবং হিউমের দর্শনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে। কান্ট কারণবাদ, ঈশ্বর, নৈতিকতা, নৈতিক আইন এবং অনুরূপ আরো অন্যান্য ব্যাপারে বিশ্বাস করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু তিনি উপলব্ধি করলেন হিউমের দর্শন এসবে বিশ্বাস কঠিন করে তুলেছে। ফলে তিনি উদ্ভাবন করলেন বিশুদ্ধ যুক্তি এবং ব্যবহারিক যুক্তির মধ্যে পার্থক্য। বিশুদ্ধ যুক্তির কাজ হলো যা-কিছু প্রমাণ করা সম্ভব তাই নিয়ে, যা অধিক পরিমাণে ছিল না; ব্যবহারিক যুক্তি হলো পুণ্য অর্জনের জন্য যা-কিছু প্রয়োজন, এটা খুবই বেশি পরিমাণে ছিল। এটা সুস্পষ্ট যে বিশুদ্ধ যুক্তি যুক্তি মাত্র, পক্ষান্তরে ব্যবহারিক যুক্তি পক্ষপাতদোষদুষ্ট। অনুরূপভাবে দর্শনে এমন জিনিসের প্রতি আবেদন ফিরিয়ে আনলেন যা তাত্ত্বিক যুক্তিশীলতার বহির্ভূত ব্যাপার বলে স্বীকৃত, স্কলাসটিমিজমের অভ্যুদয়ের পর যা স্কুলগুলো থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল।
আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে কান্টের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলেন তাঁর অব্যবহিত উত্তরসূরি ফিশতে, যিনি দর্শন থেকে রাজনীতিতে এসে এমন আন্দোলনের উদ্বোধন করেন যা জাতীয় সমাজতন্ত্র নামে বিকাশ লাভ করেছে। তবে ফিশতে সম্পর্কে বলার আগে যুক্তির ধারণা সম্পর্কে আরো কিছু বলবার রয়েছে।
হিউমের মতবাদের উত্তর খুঁজে পাওয়ার ব্যর্থতা থেকে, যুক্তি-কে আর কিছুতেই পরম গণ্য করা চলে না। যে অবস্থা থেকে যে কোনো ধরনের প্রস্থান তাত্ত্বিক কারণে নিন্দিত হতে পারে। তথাপি একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য থেকে যায় এবং পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, দার্শনিক র্যাডিকেলদের মনের গঠন এবং প্রথম যুগের মুসলমান ধর্মোন্মত্তদের পার্থক্যের কথা এখানে বলা হচ্ছে। যদি আমরা প্রথম দলের সদস্যদের যুক্তিশীল এবং দ্বিতীয় দলভুক্তদের যুক্তিবিবর্জিত গণ্য করি, তাহলে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সাম্প্রতিককালে অ-যুক্তি গজিয়ে উঠেছে।
আমি মনে করি আমরা যাকে বাস্তবে যুক্তি মনে করি তা তিনটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। প্রথমত, এটা বলপ্রয়োগ নয়, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাজের পক্ষপাতী; দ্বিতীয়ত, এর কাজ হলো যুক্তিতর্ক দ্বারা বোঝানো, এবং যারা এ কাজটি করেন তারা তাদের যুক্তিকে সম্পূর্ণ বৈধ জ্ঞান করেন; তৃতীয়ত, মতামত গঠন করতে গিয়ে, যত বেশি সম্ভব পর্যবেক্ষণ এবং আরোহী পদ্ধতি ব্যবহার করেন, এবং সজ্ঞার উপর নির্ভর করে কম। প্রথম যুক্তিটি ইনকুইজিশন বাতিল করে দেয়; দ্বিতীয়টি বাতিল করে ব্রিটিশ যুদ্ধ-প্রচার পদ্ধতির মতো ঘটনা, যা হিটলার এই যুক্তিতে প্রশংসা করেন যে প্রচার অবশ্যই এর মানসিক উন্নতি ডুবিয়ে দেবে গভীরে কি সংখ্যক লোককে এর নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে তার সমানুপাতে। দ্বিতীয়টি এই ধরনের রাশভারি প্রস্তাব প্রয়োগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, যেমন মিসিসিপি সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন বলেছিলেন, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রভু চান যে এই বিরাট উপত্যকা একটি জাতির শরিক হবে, এটি তাঁর কাছে ছিল স্বতঃসিদ্ধ, তাঁর শ্রোতাদের কাছেও, কিন্তু যিনি এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন তার কাছে এটা সহজে প্রমাণ করা যায় নি।
যুক্তির উপর নির্ভরতা যেভাবে সংজ্ঞায়িত হলো, তা ব্যক্তি ও তার শ্ৰোতৃমণ্ডলীর মধ্যে স্বার্থ ও দৃষ্টিকোণের নির্দিষ্ট একতা বিরাজ করছে ধরে নেয়। সত্য যে, মিসেস বন্ড এই যুক্তি তাঁর পাঁতিহাসগুলোর উপর প্রয়োগ করেন, যখন তিনি চিৎকার করে বলেন, এসো এবং নিহত হও, কারণ তোমাকে দিয়ে আমার ক্রেতাদের উদর পূর্ণ করতে হবে। কিন্তু সাধারণভাবে তাদের কাছে যুক্তি খাটানো অকার্যকর ভাবা হয় যাদের আমরা প্রকৃতপক্ষে গ্রাস করতে ইচ্ছুক। যে ব্যক্তি মাংস ভক্ষণে বিশ্বাস করে সে এমন যুক্তিজাল বিস্তারের চেষ্টা করে না যা ভেড়ার জন্য বৈধ মনে হবে এবং নিৎশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেন না যাদের তিনি এই বলে গাল দেন যে এরা অপদার্থ এবং কদর্য। মার্কসও পুঁজিবাদীদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন না। এই উদাহরণগুলো থেকে আমরা দেখতে পাই, যুক্তির প্রতি আবেদন সহজতর হয় যখন ক্ষমতা প্রশ্নাতীতভাবে কতিপয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অষ্টাদশ শতকের বিলেতে কেবলমাত্র অভিজাত শ্রেণির লোক এবং তাদের বন্ধুদের মতামতের গুরুত্ব ছিল। এবং এই মতামত সব সময়ই অপরাপর অভিজাতদের কাছে যৌক্তিক আকারে উপস্থাপন করা যেত। রাজনৈতিক নির্বাচকমণ্ডলীর আকার বৃদ্ধি এবং মতামতের ভিন্নতা তীব্রতর হলে, যুক্তির প্রতি আবেদন কঠিনতর হয়ে পড়ে, কারণ সার্বজনীনভাবে স্বীকৃতি যাত্রাবিন্দুর সংখ্যা কমে যায়, যা থেকে সম্মতি সূচিত হতে পারে। যখন অনুরূপ যাত্রাবিন্দু খুঁজে পাওয়া যায় না, লোকেরা তখন স্ব-স্ব স্বজ্ঞার উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়; এবং যেহেতু বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বজ্ঞা বিভিন্ন, অতএব এগুলোর উপর নির্ভরতা পরিচালিত করে বিবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতিতে।
এদিক থেকে যুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ইতিহাসের পুনরাবর্তক ঘটনা। প্রথম যুগের বৌদ্ধধর্ম ছিল যুক্তিশীল; এর পরবর্তী আকৃতি, এবং ভারতে যে হিন্দুধর্ম এর স্থান দখল করে, উভয়ই ছিল যুক্তিবর্জিত। প্রাচীন গ্রিসে অর্ফিয়ুসপন্থীরা হোমারের যুক্তিশীলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সক্রেটিস থেকে মারকাস অরেলিয়াস পর্যন্ত প্রাচীন কালের সকল প্রসিদ্ধ ব্যক্তি প্রধানত যুক্তিশীল ছিলেন। মারকাস অরেলিয়াসের পর এমনকি রক্ষণশীল নব্য-প্লেটোবাদীরা কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়। ইসলামি জগৎ বাদ দিয়ে ধরলে যুক্তির দাবি একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শিকেয় তোলা থাকে। অতঃপর স্কলাস্টিসিজম, রেনেসাঁস এবং বিজ্ঞানের মাধ্যমে যুক্তি ক্রমান্বয়ে প্রবল হয়ে ওঠে। রুশো এবং ওয়েসলের জন্য একটা প্রতিক্রিয়া মাথাচাড়া দিয়েছিল, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও যন্ত্রাদির বিজয়ের দরুন বেশিদূর এগোতে পারেনি। ষাটের দশকে যুক্তিতে বিশ্বাস সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল; কিন্তু তারপর থেকে এর প্রাধান্য ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায় এবং এখনও হ্রাস পাচ্ছে। গ্রিক সভ্যতার সূচনা থেকে বুদ্ধিবাদ এবং বুদ্ধিবাদ বিরোধিতা পাশাপাশি বাস করেছে, এবং যখন মনে হয়েছে কোনো একটি সম্পূর্ণ প্রাধান্য লাভ করতে পারে, তখন প্রতিক্রিয়া দ্বারা, সর্বদাই বিরুদ্ধপক্ষ নতুনভাবে আসরে ফেটে পড়েছে।
যুক্তির বিরুদ্ধে আধুনিক বিদ্রোহ একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে পূর্বেকার বিদ্রোহসমূহ থেকে বিভিন্ন। অর্ফিয়ুসবাদ থেকে শুরু করে, অতীতে সাধারণ লক্ষ্য ছিল মুক্তি,-এই ধারণাটা জটিল, এতে মিশে রয়েছে কল্যাণচিন্তা ও সুখ, এবং নিয়মানুসারে এটা অর্জন করা হতো কঠিন আত্মত্যাগের মাধ্যমে। আমাদের সময়ের যুক্তিবিরোধীদের লক্ষ্য মুক্তি নয়, ক্ষমতা। এই লক্ষ্যে তারা এমন নৈতিক কর্তব্য দাঁড় করিয়েছে যা একই সঙ্গে খ্রিষ্টধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম বিরোধী। এবং আধিপত্য করার বাসনা থেকে প্রয়োজনে জড়িত হয়ে পড়েছে রাজনীতির সঙ্গে। এদের লেখক তালিকায় রয়েছেন; ফিশতে, কার্লাইল, ম্যাসিনি, নিৎশে-আর এদের সমর্থনদাতারা হলেন ট্রেইটশকে, রাডিয়ার্ড কিপলিং, হিউস্টন চেম্বারলেইন এবং বার্গসে। এই আন্দোলনের বিরোধীদের মধ্যে বেন্থামপন্থীদের এবং সমাজতন্ত্রীদের একই দলের দুই শাখা গণ্য করা চলে। উভয় শাখা বিশ্বজনীন, জাতীয় সংস্কারমুক্ত, উভয় দল গণতান্ত্রিক। উভয় দলের আবেদন অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতি। এদের মধ্যে তফাতটা উপায়ের ব্যাপারে, উপেয় নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। পক্ষান্তরে এই নতুন আন্দোলন, যার পরাকাষ্ঠা (এখন পর্যন্ত) ঘটেছে হিটলারে, উপেয় ব্যাপারেও ভিন্ন, গোটা খ্রিস্টীয় সভ্যতার ঐতিহ্য থেকেও পৃথক।
রাষ্ট্রনীতিজ্ঞদের যে লক্ষ্য অন্বেষণ করা উচিত, প্রায় সকল যুক্তিবিরোধী যেমন মনে করেন, যা থেকে জন্ম নিয়েছে ফ্যাসিবাদ, তা সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে বিবৃত করেছেন নিৎশে। সচেতনভাবে, খ্রিস্টধর্ম এবং উপযোগবাদ-এর বিরোধিতা করে তিনি বেন্থামের মতবাদ বাতিল করে দিয়েছেন। ঐ মতবাদের সুখ ও সর্ববৃহৎসংখ্যা কথা দুটির জন্য। মানবতা, তিনি বলেন, উপেয়-র চেয়ে অধিক উপায়-মানবতা কেবলমাত্র পরীক্ষামূলক বস্তু। তার প্রস্তাবে উপেয় হলো অসাধারণ ব্যক্তির মহত্ত্ব: লক্ষ্য হলো পর্যাপ্ত মহৎ শক্তি অর্জন যা মানুষের ভবিষ্যতের রূপ দেবে, শৃঙ্খলা আরোপ এবং কোটি কোটি আনাড়ি ও কদর্য লোক সম্পূর্ণ নির্মূল করার মাধ্যমে, তবু এই আনাড়ির উক্ত উপায়ে সৃষ্ট দুর্ভাগ্যের দৃশ্য দেখে ধ্বংসপ্রাপ্তি এড়াতে পারে, যে ধ্বংসযজ্ঞের তুলনা ইতঃপূর্বে ছিল না। উপেয় সম্পর্কিত এই ধারণা, লক্ষ্য করা উচিত, স্বতঃই যুক্তিবিরোধী নয়, কারণ উপেয়-র প্রশ্ন যুক্তি দ্বারা নির্ধারণ সম্ভব নয়। এটা আমরা অপছন্দ করতে পারি, আমি নিজে পছন্দ করি না-কিন্তু আমরা এটা ভ্রমাত্মক প্রমাণ করতে পারি না, নিৎশে যেমন নির্ভুল প্রমাণ করতে পারেন না। তথাচ এর সঙ্গে যুক্তিহীনতার স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে, যেহেতু যুক্তি দাবি করে পক্ষপাতহীনতা, পক্ষান্তরে মহৎ মানুষের তন্ত্র সবসময় প্রতিজ্ঞার উপর জোর দেয়; আমি মহৎ ব্যক্তি।
যে চিন্তাসংঘ থেকে ফ্যাসিবাদ জন্ম নিয়েছে তার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। তারা কল্যাণ অন্বেষণ করেছেন ইচ্ছার মধ্যে, অনুভূতি কিংবা প্রত্যক্ষ জ্ঞানে নয়, তারা সুখের চেয়ে ক্ষমতাকে বেশি মূল্যবান মনে করেন। তাদের পক্ষপাত বলপ্রয়োগের প্রতি, যুক্তিশীলতার প্রতি নয়। তাদের কাম্য শান্তি নয়, যুদ্ধ, গণতন্ত্র নয়, অভিজাততন্ত্র, বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতা নয়, অপপ্রচার। তারা প্রাচীনকালের স্পার্টায় প্রচলিত কৃচ্ছুতাসাধনকে অন্যের উপর প্রভুত্ব বিস্তারের উপায় মনে করেন, আত্ম-শৃঙ্খলার উপায় মনে করেন না, যা পুণ্য অর্জনের অনুকূল এবং কেবল অপর জগতে সুখ নিশ্চিত করে। এদের মধ্যে শেষোক্তরা জনপ্রিয় ডারুইনবাদে আপুত এবং অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামকে তারা উন্নততর প্রজাতির উৎস গণ্য করেন; তবে এই সংগ্রাম হবে বিভিন্ন জাতির মধ্যে, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নয়, মুক্ত প্রতিযোগিতার পক্ষপাতীরা যেমন এর পক্ষে ওকালতি করে থাকেন। সুখ ও জ্ঞানকে লক্ষ্য মনে করা তাদের কাছে নিষ্ক্রিয় ব্যাপার। তাদের কাছে সুখের বিকল্প হলো গৌরব, এবং জ্ঞানের বিকল্প হিসেবে ধরেন এই ব্যবহারিক দাবি যে তারা যা ইচ্ছে করেন তাই সত্য। ফিশতে, কার্লাইল এবং ম্যাসিনির কাছে এই মতবাদগুলো এখনও প্রথাগত নৈতিক ভাষার পোশাকে আবৃত; নিৎশের কাছে এগুলো প্রথমে নগ্ন ও নির্লজ্জভাবে এগিয়ে যায়।
এই বিরাট বিপ্লব উদ্বোধনের জন্য ফিশতের যতটুকু কৃতিত্ব পাওয়া উচিত ছিল তিনি তা পান নি। তিনি শুরু করেন বিমূর্ত পরাবিজ্ঞানী হিসেবে, তবু পরবর্তীকালে স্বেচ্ছাচারী এবং আত্মকেন্দ্রিক মেজাজের পরিচয় দেন। তাঁর গোটা দর্শন আমি আমিই, এই অবস্থা থেকে বিকশিত হয়েছে। এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য:
অহম (Ego) নিজেকে স্থাপন করে এবং এই স্থাপনের ফলেই সে অহম; এটা একই সঙ্গে প্রতিনিধি ও কাজের ফলাফল, এটি সক্রিয় এবং সক্রিয়তা দ্বারা সৃষ্ট; আমি আছি বলতে কর্ম বোঝায় (Thathandlung), অহম আছে, কারণ এটি নিজেকে স্থাপন করেছে।
এই তত্ত্বানুসারে অহম অস্তিত্বশীল, কারণ অহম অস্তিত্বশীল থাকতে চায়। উপস্থিত মনে হয় যে নন-ইগোও অস্তিত্বশীল, কারণ ইগো একে অস্তিত্বশীল দেখতে চায়। তবে এভাবে সৃষ্ট নন-ইগো কখনো ইগো বহির্ভূত কিছু হতে চায় না, কারণ ইগো একে স্থাপন করা সাব্যস্ত করেছে। চতুর্দশ লুই বলতেন, Letat cest moi,১২ ফিশতে বলতেন, আমি নিজেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। কান্ট এবং রোবেসপিয়য়ের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে হাইনে মন্তব্য করেছেন, আমরা জার্মানদের তুলনায় তোমরা ফরাসিরা নিস্তেজ ও নমনীয়।
এটা সত্য যে ফিশতে কিছু পরই ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে এই আমি বলতে তিনি ঈশ্বরকে বুঝিয়েছেন; কিন্তু পাঠক কী-করে এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত হতে পারেন।
জেনার যুদ্ধের পর-পর ফিশতেকে যখন বার্লিন থেকে পালিয়ে যেতে হলো, ভাবলেন নিজেও নন-ইগোকে খুব বেশি জোর দিয়ে নেপোলিয়নের আকারে স্থাপন করছেন। ১৮০৭ সালে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বিখ্যাত জার্মান জাতির প্রতি বক্তৃতা প্রদান করেন। উক্ত বক্তৃতায় প্রথমবারের মতো তিনি জাতীয়তাবাদের সমগ্র নীতিমালা উপস্থাপন করেন। এই বক্তৃতাগুলো শুরু করা হয় এই ব্যাখ্যা দিয়ে যে জার্মানরা আধুনিক জাতিসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কারণ এই জাতির শুধু বিশুদ্ধ ভাষা রয়েছে। (রুশ, তুর্কী, চিনা, এস্কিমোদের এবং হটেনটটদের নাম না হয় নাই উল্লেখ করি, যদিও তাদের বিশুদ্ধ ভাষা রয়েছে)। ফিশতে কিন্তু তাঁর ইতিহাসের বইগুলোতে তা উল্লেখ করেন নি। জার্মান ভাষায় বিশুদ্ধতা কেবল জার্মানদেরই গভীরতার সমর্থতা দিয়েছে; তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, চরিত্র থাকা এবং জার্মান হওয়া নিঃসন্দেহে একই জিনিস বোঝায়। কিন্তু যদি জার্মান চরিত্রকে বৈদেশিক কলুষতার সংক্রামক প্রভাব থেকে রক্ষা করতে হয়, এবং জার্মান জাতিকে যদি এককভাবে কাজে সমর্থ হতে হয়, তাহলে অবশ্যই নতুন ধরনের শিক্ষার দরকার করবে, যে শিক্ষা জার্মান জাতিকে সম্মিলিত একদেহে রূপান্তরিত করবে। তিনি বলেন, নতুন শিক্ষা অবশ্যই এমন হবে যে তা ইচ্ছার স্বাতন্ত্র ধ্বংস করবে। তিনি আরো যোগ করেন, ইচ্ছা হলো মানুষের প্রকৃত ভিত্তি।
বহির্বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে, কিছুটা একেবারে অনিবার্য হড়ে পড়লে সেটুকু মেনে নিতে হয় তার অতিরিক্ত নয়। সামরিক বাহিনীতে চাকুরি সার্বজনীন করতে হবে। সবাইকে যুদ্ধে অশগ্রহণে বাধ্য করতে হবে, বাস্তব অবস্থার উন্নয়নের জন্য নয়, স্বাধীনতার জন্য নয়, শাসনতন্ত্র সংরক্ষণের জন্যও নয়, বরং এই তাড়নার অধীনে করতে হবে যে-উচ্চতর দেশপ্রেমের সর্বগ্রাসী শিখা। এই দেশপ্রেম জাতিকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে মহাকালের পোশাক হিসেবে, যার জন্য মহৎ লোকেরা আনন্দের সঙ্গে আত্মোৎসর্গ করে, এবং অবজ্ঞেয় লোকেরা, যারা কেবল অপরের জন্য বেঁচে আছে, তাদেরও অনুরূপভাবে আত্মোৎসর্গ করতে হবে।
মহৎ মানুষ মানবতার লক্ষ্য, এবং অবেজ্ঞয় মানুষের নিজেদের কোনো দাবি নেই, এই মতবাদ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আধুনিক আক্রমণের প্রধান দিক। খ্রিস্টধর্ম শেখায় প্রতিটি মানুষের মধ্যে অবিনশ্বর আত্মা রয়েছে এবং এই হিসেবে সকল মানুষই সমান। মানুষের অধিকার তত্ত্ব খ্রিস্টধর্মীয় মতবাদের বিকাশ মাত্র। উপযোগবাদ ব্যক্তির জন্য সর্বাত্মক অধিকার স্বীকার না করলেও, একজন মানুষের সুখের প্রতি যতটুকু গুরুত্ব দেয়, সকল মানুষের প্রতি ততটুকুই গুরুত্ব দিয়ে থাকে; ফলে এই মতবাদের পরিণতি গণতন্ত্র, প্রাকৃতিক অধিকার-এর মতবাদ যেমন। কিন্তু ফিশতে, এক ধরনের রাজনৈতিক ক্যালভিনদের মতো, নির্দিষ্ট কিছু লোককে বেছে নেন, অন্যদের বাতিল করে দেন অবান্তর গণ্য করে।
অবশ্য কঠিন কাজ হলো কারা পছন্দকৃত বা নির্বাচিত তা জানা। যে জগতে ফিশতের মতবাদ সার্বজনীনভাবে গ্রহণ করা হবে সেই জগতের প্রত্যেকেই মনে করবেন তিনি মহৎ ব্যক্তি, এবং তিনি এমন দলে যোগ দেবেন যে দলকে তার মতামতের যথেষ্ট অনুরূপ মনে হবে এবং আরো মনে হবে যে উক্ত দল তার মতোই মহৎ। উক্ত দলীয় লোকগুলো তার জাতি হতে পারে, ফিশতের বেলায় যেমন হয়েছিল, তার শ্রেণিভুক্তও হতে পারে, সর্বহারা ক্যুনিস্টদের বেলায় যেমন; কিংবা তার পরিবার, নেপোলিয়নের বেলায় যেমন। মহত্ত্বের কোনো বস্তুগত বৈশিষ্ট্য নেই, যুদ্ধে সফল হওয়া ছাড়া; সুতরাং এই নীতির অনিবার্য ফল হলো যুদ্ধ।
জীবন সম্পর্কে কার্লাইলের দৃষ্টিভঙ্গি প্রধানত ফিশতে থেকে গৃহীত। একমাত্র ফিশতেই তাঁর মতামতকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেন। কিন্তু কার্লাইল এর সঙ্গে আরো কিছু যোগ করেন যা তখন থেকে উক্ত গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে; এ যুক্ত হয় এক ধরনের সমাজতন্ত্র এবং সর্বহারাদের জন্য উল্কণ্ঠা, যা প্রকৃত শিল্পবাদ ও নব্য ধনীদের অপছন্দ করে। কার্লাইল এ কাজটি এত সুন্দরভাবে করেন যে এঙ্গেলসও এতে প্রতারিত হন। ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত ইংরেজ শ্রমজীবীদের উপর লিখিত পুস্তকে তিনি কালাইলের উচ্চ প্রশংসা করেন। সুতরাং আমরা অবাক হই না যে জনগণ জাতীয় সমাজতন্ত্রের মধ্যে সমাজতন্ত্রের বহিরাবরণ দেখে মুগ্ধ হন।
বস্তুত, কার্লাইলের এখনও প্রতারণা করার শক্তি আছে। তার বীর পূজা খুবই মর্যাদাকর শোনায়; তিনি বলেন, আমাদের নির্বাচিত সংসদের দরকারই নেই, বরং দরকার বীর-রাজা, এবং অ-বীরোচিত নয় এমন একটা জগৎ। এটা বোঝার জন্য তা কীভাবে বাস্তবে রূপান্তরিত হয় সেটা বিচার করে দেখতে হবে। কার্লাইল অতীত ও বর্তমান গ্রন্থে দ্বাদশ শতাব্দীর অ্যাবট স্যামসনকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেছেন। একজন যদি তাকে পাত্তা না দিয়ে বরং Chronicle of Jocelin of Brakelonde পড়েন তিনি দেখতে পাবেন যে উক্ত অ্যাবট ছিলেন বিবেকহীন দাঙ্গাবাজ, যার মধ্যে মিশেছিল অত্যাচারী ভূ-স্বামী এবং বটতলার উকিলের সকল দোষ। কার্লাইলের অপরাপর বীরগণও অন্তত সমান আপত্তিকর। ক্রোমওয়েল আয়ারল্যান্ডে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালানোর পর তিনি মন্তব্য করেন, আমি বলবো অলিভারের সময়েও ঈশ্বরের সুবিচারে বিশ্বাস করা হতো; কিন্তু অলিভারের সময়ে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের পক্ষে কথার উন্মত্ত ফুলঝুরি ছিল না, এই পাপপূর্ণ জগতে জাঁ-জ্যাক ফিলানথ্রপি এবং সর্বজনীন গোলাপজল নিয়ে বাড়তি কথা হতো না, কেবলমাত্র পরবর্তী অবক্ষয়ী প্রজন্মে-ভালো ও মন্দ এমন নির্বিচারে মিশে সার্বিক ঝোলা-গুড়ে পরিণত হয়-বাস্তবায়িত হয় এই জগতে। তার অপরাপর বীরদের অধিকাংশ সম্পর্কে, যেমন ফ্রেডারিক দ্য গ্রেট, ড. ফ্রানসিয়া, এবং গবর্নর আয়ার, একটি কথাই বলা প্রয়োজন যে, এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল একটিই, এবং তা হলো, রক্তের জন্য দুর্নিবার তৃষ্ণা।
যারা এখনও মনে করেন যে কার্লাইল কম-বেশি উদারপন্থী ছিলেন তাদের অতীত ও বর্তমান-এ গণতন্ত্রের উপর লিখিত অধ্যায়টি পড়া উচিত। এই অধ্যায়ের প্রায় গোটা অংশে উইলিয়াম দ্য কনকারের প্রশংসা করা হয়েছে এবং তাঁর সময়ে ভূমিদাসরা কি সুখী জীবনযাপন করেছেন, দিয়েছেন তার বর্ণনা। অতঃপর দিয়েছেন স্বাধীনতার সংজ্ঞা, মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা, আপনি বলবেন, সঠিক পথ বেছে নেয়া কিংবা বেছে নিতে বাধ্য করা এবং উক্ত পথে হাঁটা (পৃ. ২৬৩)। এরপর তিনি বলেন, গণতন্ত্র হলো শাসিত হওয়ার জন্য বীর খুঁজে হতাশ হওয়া এবং বীরের অভাব মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা। অধ্যায়টি শেষ করা হয়েছে গয়গম্বরসুলভ গম্ভীর ভাষায় বিবৃতি দিয়ে: গণতন্ত্রের দৌড় পূর্ণ হবার পর যে সমস্যা থেকে যাবে তা হলো আপনার চেয়ে প্রকৃত শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি দ্বারা শাসিত সরকার অনুসন্ধান। এই কথাগুলোতে এমন একটি শব্দ কি রয়েছে। যা হিটলার সমর্থন করতেন না?
ম্যাৎসিনির মেজাজ কার্লাইলের চেয়ে নমনীয় ছিল, বীরতন্ত্র ব্যাপারে তিনি ভিন্নমত পোষণ করতেন। তাঁর আদরের ধন ছিল জাতি, মহান ব্যক্তি নয়। এবং যদিও তিনি ইতালিকে সর্বোচ্চ স্থান দিতেন, তবু আইরিশদের বাদ দিয়ে ইউরোপীয় সকল জাতির ভূমিকা স্বীকার করতেন। অবশ্য তিনি কার্লাইলের মতো কর্তব্যের স্থান সুখের উপর বলে বিশ্বাস করতেন। এমনকি এর স্থান সর্বজনীন সুখের উপর। তিনি ভাবতেন ঈশ্বর প্রত্যেক ব্যক্তিকে সঠিক বিবেক দিয়েছেন, সর্বোপরি দরকার হলো, সবাই তাঁর আন্তরিকভাবে অনুভূত নৈতিক বিধি মান্য করে চলবে। তিনি কখনো বুঝতে পারেননি যে বিভিন্ন ব্যক্তি আন্তরিকভাবেই নৈতিক বিধি সম্পর্কে বিভিন্ন মত পোষণ করতে পারেন, অথবা তিনি প্রকৃত প্রস্তাবে চাইতেন যে অন্যেরা তিনি যাকে উচিত কর্তব্য মনে করবেন তাই কবুল করবেন। তিনি নৈতিকতাকে গণতন্ত্রের উপর স্থান দিয়ে বলেছেন; সংখ্যাগুরুর সাধারণ ভোটে সার্বভৌমত্ব গঠিত হয় না, যদি তা সর্বোচ্চ নৈতিকতার সুস্পষ্টভাবে বিরোধিতা করে,….. জনগণের ইচ্ছা পবিত্র, যখন জনগণ নৈতিক বিধি ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করে; আইন থেকে বিচ্যুত হলে বাতিল ও অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং এতে খামখেয়ালী প্রকাশ পায়। মুসোলিনিরও একই অভিমত ছিল।
এই গোষ্ঠীর মতবাদে সেই সময়ের পর শুধুমাত্র একটা নতুন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যুক্ত হয়েছে, উপাদানটি হলো জাতি নামক ছদ্ম-ডারউইনবাদী বিশ্বাস। (ফিশতে জার্মান শ্রেষ্ঠতা বুঝতেন ভাষাগত দিক থেকে, জৈবিক উত্তরাধিকার নয়) নিৎশে, যিনি তাঁর অনুসারীদের মতো জাতীয়তাবাদী এবং সেমাইট বিরোধী ছিলেন না, তাঁর মতবাদ কেবলমাত্র বিভিন্ন ব্যক্তির ভেতর প্রয়োগ করেন; ইচ্ছে করেছেন অযোগ্যদের সন্তান প্রজননে বাধা দিতে হবে এবং আশা করেছেন, কুকুর বিশেষজ্ঞদের পদ্ধতিতে, শ্রেষ্ঠতর। জাতির উৎপাদন, যাদের ক্ষমতা থাকবে, এবং এদের হিতসাধনের জন্যই শুধু মানবতার বাকি অংশ বেঁচে থাকবে। তবে পরবর্তী সকল লেখকই অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে সর্বপ্রকার চমৎকারিত্ব তার জাতির মধ্যে মিশে আছে। আইরিশ লেখকরা হোমর যে আইরিশ ছিলেন তা প্রমাণ করার জন্য অনেক পুস্তক লিখেছেন; ফরাসি নৃতত্ত্ববিদগণ পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছেন কেল্ট নয়, টিউটনরাই উত্তর ইউরোপের সভ্যতার উৎস; হিউস্টন চেম্বারলেন বিস্তৃত যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যে দান্তে ছিলেন জার্মান এবং খ্রিস্ট ইহুদি ছিলেন না। ঈঙ্গ ভারতীয়দের মধ্যে জাতিতত্ত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ সর্বজনীন ব্যাপার। এদের কাছ থেকেই সাম্রাজ্যবাদী ইংল্যান্ড রাডিয়ার্ড কিপলিং-এর মাধ্যমে এই সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে ইংল্যান্ডে সেমেটিক বিরোধিতা কখনো শক্তিশালী ছিল না; যদিও একজন ইংরেজ, হিউস্টন চেম্বারলেন, জার্মানিতে সেমেটিক বিরোধিতার মিথ্যা ঐতিহাসিক ভিত্তি প্রদানে মূল ভূমিকা পালন করেন। তবে জার্মানিতে এটা দাপটের সঙ্গে মধ্যযুগ থেকে বজায় ছিল।
রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হলে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, জাতি সম্পর্কে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই জানা যায় না। এটা সম্ভব বলে ধরে নেয়া যায় যে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে জেনেটিক মানসিক ব্যবধান থাকতে পারে; তবে এটা সুনিশ্চিত যে ব্যবধানটা কী তা আমরা এখনও জানতে পারি নি। বয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে পরিবেশের প্রতিক্রিয়া বংশগতির ছাপ আড়াল করে। উপরন্তু বিভিন্ন ইউরোপীয়দের জাতিগত পার্থক্য, সাদা, হলুদ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে পার্থক্যের চেয়ে কম সুনির্দিষ্ট ইউরোপীয়দের মধ্যে এমন কোনো সুচিহ্নিত শারীরিক বৈশিষ্ট্য নেই যে যার সাহায্যে বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতিসমূহের সদস্যদের আলাদা করে চেনা যেতে পারে, কারণ বিভিন্ন উৎসের সংমিশ্রণের ফলাফল হলো ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। মানসিক শ্রেষ্ঠতার বেলায় প্রত্যেকটি সভ্য জাতি গ্রহণযোগ্য দাবি উত্থাপন করতে পারেন, এতে প্রমাণিত হয় যে সবার দাবি সমানভাবে অসিদ্ধ। এটা সম্ভব হতে পারে যে ইহুদিরা জার্মানদের চেয়ে হীন, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সম্ভব হতে পারে জার্মানরা ইহুদিদের চেয়ে হীন। এই প্রশ্নে ছদ্ম-ডারউইনবাদী অর্থহীন কথা সূচনা করার গোটা ব্যাপারটাই বিজ্ঞানবিরোধী। ভবিষ্যতে মানুষ যাই জানতে সমর্থ হোন না কেন, বর্তমানে আমাদের হাতে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে একটি জাতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে অপর একটি জাতিকে উৎসাহিত করার ইচ্ছে বোধ করতে পারি।
ফিশতে থেকে শুরু করে গোটা আন্দোলনের পদ্ধতিটাই হলো আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির প্রয়াস এবং ক্ষমতাভিলাষ। উপায় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে কতকগুলো বিশ্বাস। যে বিশ্বাসগুলোতে এমন কিছুই নেই তাদের পক্ষে যায়, কেবল বিশ্বাসগুলো একটু আত্মতৃপ্তিকর বটে। ফিশতের একটা মতবাদের দরকার ছিল যা তাকে নেপোলিয়নের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর অনুভব করতে সাহায্য করবে; কার্লাইল এবং নিৎশে কয়েকটি ক্ষেত্রে দুর্বল ছিলেন, ফলে উক্ত দুর্বলতাগুলোর ক্ষতিপূরণ খোঁজেন কল্পনার জগতে; রাডিয়ার্ড কিপলিং-এর যুগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদিতার কারণ শিল্পায়নে প্রাধান্য হারানোর লজ্জা এবং আমাদের কালের হিটলারীয় পাগলামী হলো মিথ্যার মুকুট, যার সাহায্যে জার্মান অহমকে ভার্সাইর ঠাণ্ডা ঝাঁপটার বিরুদ্ধে উষ্ণ রাখা হয়। মারাত্মক আঘাতে আত্ম মর্যাদা বিক্ষত হলে কোনো মানুষই সুস্থভাবে চিন্তা করতে পারেন না, এবং যারা ইচ্ছাকৃতভাবে একটি জাতিকে অপমানিত করে তারা শুধু নিজেদেরকেই ধন্যবাদ জানাতে পারেন যদি নিজেরা উন্মাদের জাতিতে পরিণত হন।
এখানেই আমি কারণগুলো খুঁজে পাই যা অযৌক্তিক এমনকি যুক্তিবিরোধী (আমাদের বিবেচ্য) মতবাদটি ব্যাপকভাবে গ্রহণ সম্ভব করে তুলেছে। প্রায় সব সময়ই সব ধরনের মতবাদ সব ধরনের প্রত্যাদিষ্ট ব্যক্তিগণ প্রচার করতেন, তবে যে মতবাদগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে তা অবশ্যই ঐ সময়ের পরিস্থিতির দ্বারা সৃষ্ট মেজাজের প্রতি বিশেষ আবেদন রাখে। আধুনিক যুক্তিবিযুক্তবাদীদের মতবাদগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, আমরা যেমন দেখেছি, চিন্তা ও অনুভূতি বাদ দিয়ে, ইচ্ছা-র উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ। ক্ষমতাকে গৌরবান্বিত করে তোলে। পর্যবেক্ষণমূলক এবং আরোহী পরীক্ষার পরিবর্তে পদান্বয়ী অব্যয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থাপনে বিশ্বাস। মনের এই অবস্থা, উড়োজাহাজের মতো যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ যাদের অভ্যাস এবং আরো, যারা বর্তমানে আগের চেয়ে কম ক্ষমতাবান এবং পূর্বেকার প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুক্তিশীল পথ খোঁজায় অসমর্থ, তাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। শিল্পায়ন ও যুদ্ধ, যান্ত্রিক ক্ষমতার অভ্যাস সূচিত করলেও, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অবস্থানের পরিবর্তন করেছে, ফলে বড় বড় গোষ্ঠীর মেজাজ হয়েছে বাস্তবিক আত্ম-জাহিরের। এবং এর পরিণামই হলো ফ্যাসিবাদ।
১৯২০ সালের জগতের সঙ্গে ১৮২০ সালের জগতের তুলনা করলে আমরা দেখতে পাই যে কয়েকটি গোষ্ঠীর ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে; বড়-বড় শিল্পপতি, শ্রমজীবী, নারী, ধর্মদ্বেষী এবং ইহুদিদের। (এখানে ধর্মদ্বেষী বলতে আমি তাদের বুঝিয়েছি যাদের ধর্ম তাদের দেশের সরকারি ধর্ম নয়) পারস্পরিকভাবে, এই শ্রেণিগুলো ক্ষমতা হারিয়েছেন: রাজা, অভিজাত ব্যক্তি, পাদরি, নিম্নমধ্যবিত্তশ্রেণি এবং নারীর তুলনায় পুরুষরা। বড়-বড় শিল্পপতিরা, যদিও আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অধিকতর শক্তিশালী, সমাজতন্ত্রের হুমকিতে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেছেন, বিশেষ করে এদের মধ্যে মস্কোর ভীতি কাজ করছে। যাদের স্বার্থ যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত, যেমন সমরনায়ক, নৌসেনাপতি, পাইলট, অস্ত্রনির্মাতা প্রতিষ্ঠান, তাদের অবস্থা এই রকম: বর্তমানে তারা খুব শক্তিশালী কিন্তু বলশেভিক এবং শান্তিবাদী নামক বিনাশক দলের ভয়ে ভীত। এরা ইতোমধ্যেই রাজা, অভিজাত ব্যক্তি, ক্ষুদ্র দোকানদার, যারা মেজাজের কারণে ধর্মীয় সহিষ্ণুতাবিরোধী, যারা আক্ষেপ করেন নারীর উপর পুরুষের প্রাধান্যের দিনগুলোর জন্য, ইত্যাদি শ্রেণিকে পরাজিত করেছে; এরা সুনিশ্চিতভাবে জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়েছেন বলেই মনে হয়; অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ, ভাবা হয়, আধুনিক জগতে তাদের জন্য কোনো স্থান রাখেনি। স্বাভাবিকভাবেই তারা অসন্তুষ্ট হন, সামগ্রিকভাবে এদের সংখ্যাও অগণন। তাদের মানসিক প্রয়োজনের জন্য নিৎশের দর্শন মনস্তাত্ত্বিকভাবে উপযোগী করে তোলা হয়, এবং অত্যন্ত চতুরভাবে শিল্পপতি ও সমরবিদগণ এই অসন্তোষ কাজে লাগিয়ে পরাজিত গোষ্ঠীগুলোকে একটা দলে রূপান্তরিত করে, যারা শিল্প ও যুদ্ধ বাদে সবকিছুর প্রতি মধ্যযুগীয় প্রতিক্রিয়া সমর্থন করবে। শিল্প ও যুদ্ধের ক্ষেত্রে গোটা প্রযুক্তি হবে আধুনিক, ক্ষমতার অংশীদারিত্বের বেলায় নয়, এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা যাবে না, কারণ শান্তিই বর্তমান শিল্পপতিদের কাছে সমাজতন্ত্রীদের বিপজ্জনক করে তুলেছে।
কার্যত নাৎসি দর্শনে অযৌক্তিক উপাদানগুলো ঢুকেছে, রাজনৈতিকভাবে বলতে গেলে, সেই গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন আদায়ের প্রয়োজনে যাদের জন্য আর কোনো লক্ষ্য নেই, সুস্থ উপাদানগুলো স্থান পেয়েছে শিল্পপতি ও সমরবিদদের জন্য। পূর্বোক্ত উপাদান অযৌক্তিক, কারণ ক্ষুদ্র দোকানদারগণ প্রত্যাশা বাস্তবায়িত করতে পারবেন বলে মনে হয় না, এবং হতাশা থেকে আত্মরক্ষার জন্য তাদের আজগুবি বিশ্বাসে আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া গত্যন্তর নেই; অপরদিকে, ফ্যাসিবাদের সাহায্যে শিল্পপতি এবং সমরবিদগণ তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন, অন্য কোনো উপায়ে ইচ্ছাপূরণের সম্ভাবনা নেই বললে চলে। সভ্যতার ধ্বংসসাধন করেই কেবল তারা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন, এই ঘটনা থেকে তারা অযৌক্তিক হন না, খাড়া শয়তানে পরিণত হন। এরা আন্দোলনের শ্রেষ্ঠতম বুদ্ধিগত উপাদান; নৈতিক দিক দিয়ে হীনতম; বাকিরা গৌরব, বীরত্ব এবং আত্মত্যাগের স্বপ্নে চমকিত হয়ে তাদের গুরুতর স্বার্থের প্রতি হয়ে পড়েছে অন্ধ, এবং আবেগে প্রজ্জ্বলিত হয়ে নিজেদের এমন লক্ষ্য অর্জনে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছে যা তাদের লক্ষ্য হতে পারে না। এটাই হচ্ছে নাৎসিরাজ্যের মনস্তাত্ত্বিক রোগনিরূপণ বিজ্ঞান।
শিল্পপতি এবং সমরবিদ, যারা ফ্যাসিবাদের সমর্থক, তারা সুস্থ মনের অধিকারী বলেছি, কিন্তু তারা কেবলমাত্র তুলনামূলকভাবে সুস্থ। দাইজেন (Thyssen) বিশ্বাস করেন যে, তিনি একই সঙ্গে সমাজতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা এবং তার বাজার বিরাট আকারে সম্প্রসারিত করতে সক্ষম। ১৯১৪ সালের তাঁর পূর্বসূরিদের চেয়ে তিনি এ ব্যাপারে সঠিক মনে করার অধিক কোনো কারণ দেখি না। জার্মান আত্মবিশ্বাস এবং জাতীয়তাবাদী অনুভূতি বিপজ্জনক মাত্রায় উন্নীত করা তার জন্য খুবই দরকারি, এবং এর ফলাফল যে অসফল যুদ্ধ তা এক রকম অনিবার্য। এমনকি বড় ধরনের প্রাথমিক কিছু সাফল্যও চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারবে না; বিশ বছর আগের মতো, এখন জার্মান সরকার আবার আমেরিকাকে ভুলে গেছে।
একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা, সামগ্রিকভাবে নাৎসিবিরোধী, যদিও প্রতিক্রিয়াশীলতার সমর্থক হতে পারত-আমি সংঘবদ্ধ ধর্মের কথা বলছি। যে আন্দোলনের দর্শন নাৎসিবাদে পৌঁছেছে তা এক হিসেবে প্রটেস্টান্টবাদের যৌক্তিক বিকাশ। ফিশতে ও কার্লাইলের নৈতিকতা ক্যালভিনপন্থী, এবং ম্যাৎসনি, যিনি আজীবন রোমের বিরোধিতা করেছেন, লুথারপন্থীদের মতো ব্যক্তি-বিবেকে আগাগোড়া বিশ্বাসী ছিলেন। নিৎশের ব্যক্তির মূল্যের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল, এবং তাঁর বিবেচনায় বীর কর্তৃপক্ষের কাছে নতি স্বীকার করবেন, এটা অনুচিত। এক্ষেত্রে তিনি প্রাটেস্টান্টদের বিদ্রোহী শক্তিকে বিকশিত করেছিলেন। হয়তো প্রত্যাশা করা যেত যে প্রটেস্টান্ট গির্জাগুলো নাৎসি আন্দোলনকে অভিনন্দন জানাবে, একটা পর্যায় তারা তা করেছেও। কিন্তু যে সব ব্যাপারে প্রটেস্টান্টবাদ ক্যাথলিকবাদের শরিক ছিল, দেখতে পেল নতুন দর্শন তার বিরোধী। নিৎশে ছিলেন জোরালোভাবে খ্রিস্টান ধর্মবিরোধী, এবং হিউস্টন চেম্বারলেন বুঝিয়ে গেছেন যে খ্রিস্টধর্ম হলো নীচু শ্রেণির কুসংস্কার যা গড়ে উঠছে ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলীয় (Levant) সংকর জাতীয় বিশ্বনাগরিকদের মধ্যে। বিনয়-নম্রতা, প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা, বশংবদ ব্যক্তিদের অধিকার, এসব বাতিল করে দেয়া গসপেলের শিক্ষার বিরোধী; এবং এন্টিসেমিটিজম, যখন এটা একই সঙ্গে তাত্ত্বিক ও বাস্তবিক, ইহুদিদের ভেতর থেকে জন্ম নেয়া ধর্মের সঙ্গে সহজে আপোস করতে পারে না। এইসব কারণে নাৎসিরাজ্য এবং খ্রিস্টধর্মের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন কঠিন, এবং এটা অসম্ভব নয় এদের মধ্যেকার পারস্পরিক বিরুদ্ধাচারণ নাৎসিদের পতন ঘটাবে। কি জার্মানি কিংবা অন্য কোথাও আধুনিক অযৌক্তিকতার সঙ্গে প্রথাগত খ্রিস্টধর্মের আরো একটা কারণে সহাবস্থান সম্ভব নয়। ইহুদি ধর্ম-দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম, সত্যের ধারণার সঙ্গে পরস্পরসূত্রে বিশ্বাসের পুণ্য গ্রহণ করে। ঐ ধারণা ও পুণ্য সৎ সংশয়ের মধ্যে বেঁচে থাকে, যেমন ভিক্টোরীয় যুগের সকল মুক্তচিন্তাবিদদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মের সকল পুণ্য স্থান লাভ করেছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে সংশয়বাদ এবং বিজ্ঞাপনের প্রভাবে দেখা গেল সত্য আবিষ্কার নৈরাশ্যজনক। কিন্তু মিথ্যাচারের উপর জোর দেয়া লাভজনক। হিটলার নাৎসী দলের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে বলেছেন:
জাতীয় রাষ্ট্র বিজ্ঞানকে দেখবে জাতীয় গর্ব বৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে। শুধু পৃথিবীর ইতিহাস নয়, সভ্যতার ইতিহাসও এই দৃষ্টিকোণ থেকে শেখাতে হবে। উদ্ভাবক শুধুমাত্র উদ্ভাবক হিসেবে আবির্ভূত হবেন না, তার উপস্থাপন হবে স্বদেশবাসী হিসেবে। কোনো বৃহৎ কীর্তির প্রতি সম্ভ্রমের সঙ্গে গৌরব যুক্ত করতে হবে, কারণ ঐ ভাগ্যবান কৃতিপুরুষ আমাদের জাতির সদস্য। আমরা অবশ্যই জার্মান ইতিহাসের মহৎ নামের ভিড়ের ভেতর থেকে মহত্তমদের বের করে আনবো এবং তাদের স্থাপন করবো যুবকদের সামনে, এবং এটা করতে হবে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক উপায়ে যাতে তারা জাতীয় অনুভূতির অটল স্তম্ভ হতে পারে।
সত্যানুসন্ধান হিসেবে বিজ্ঞানের ধারণা হিটলারের কাছ থেকে এতটা দূরীভূত হয়েছে যে, তিনি বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার যুক্তি বিস্তার করেন না। আমরা যেমন জানি, আপেক্ষিকতা-সূত্র মন্দ বিবেচিত হয়েছে, কারণ উক্ত সূত্রের আবিষ্কর্তা একজন ইহুদি। ইনকুইজিশন গ্যালিলিও-র মতবাদ বাতিল করে দেয় এই বিবেচনায় যে, উক্ত মতবাদ অসত্য; হিটলার কিন্তু কোনো মতবাদ গ্রহণ কিংবা বর্জন করেন রাজনৈতিক কারণে, তাঁর কাছে সত্য বা মিথ্যা কোনো ব্যাপার নয়। হতভাগা উইলিয়াম জেমস, যিনি এই দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভাবক, অবশ্যই আতংকগ্রস্ত হতেন দেখে যে তার দৃষ্টিভঙ্গির কী অপব্যবহার শুরু হয়েছে; কিন্তু যখন একবার বস্তুগত সত্যের ধারণা বর্জিত হলো, এটা পরিষ্কার যে আমি কি বিশ্বাস করবো? এই প্রশ্নের মীমাংসা তখন করতে হবে- আমি যেমন ১৯০৭ সালে লিখেছিলাম, বল প্রয়োগ এবং বৃহৎ সৈন্যদলের মধ্যস্থতা দ্বারা, ধর্মতত্ত্ব কিংবা বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে নয়। যে রাষ্ট্রের নীতির ভিত্তি যুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সে রাষ্ট্র অবশ্যই দেখতে পাবে যে তাদের সঙ্গে শুধু জ্ঞান বিজ্ঞানের বিরোধ বাধেনি। গির্জাগুলোর সঙ্গেও বিরোধ দেখা দিয়েছে; অবশ্য যেখানে খ্রিষ্টধম খাঁটি অবস্থায় টিকে আছে।
যুক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অনেক সমর্থ এবং উদ্যোগী পুরুষ ক্ষমতাপ্রীতি চরিতার্থ করার পথ খুঁজে পায় না, ফলে হয়ে পড়ে নাশকতামূলক চরিত্রের। অতীতে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো অধিক মানুষকে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করতে দিয়েছে, এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা অধিক সংখ্যক লোককে দিয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা। ভেবে দেখুন এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কথা, যারা ঘুমায় শহরতলিতে, কাজ করে বড়-বড় নগরে। এদের ট্রেনে লন্ডন শহরে আসতে হয়, পথের দুপাশে দেখতে পায় বিরাট এলাকা জুড়ে ছোট-ছোট বাগান বাড়ি। এই বাড়িগুলোর পরিবারসমূহ শ্রমজীবীদের সঙ্গে কোনো প্রকার সংহতি বোধ করে না; পরিবারগুলোর লোকেরা স্থানীয় ব্যাপারেও অংশগ্রহণ করে না। কারণ নিয়োগকর্তার আদেশ পালন করতেই এদের দিন ফুরিয়ে যায়। তাদের উদ্যোগশীলতা চরিতার্থ করার একমাত্র উপায় হলো সপ্তাহান্তে বাড়ির পেছনে বাগান পরিচর্যা। রাজনৈতিকভাবে শ্রমজীবী শ্রেণির জন্য কিছু করা হলে তারা ঈর্ষা বোধ করে এবং যদিও নিজেরা যে দরিদ্র সেটা অনুভব করে, কিন্তু নাক উঁচু ভাবটা বজায় রাখার জন্য সমাজতন্ত্র এবং ট্রেড ইউনিয়নের পদ্ধতি গ্রহণ করে না। তাদের শহরতলী হয়তো প্রাচীন কালের বিখ্যাত নগরগুলোর মতো জনবহুল, কিন্তু তাদের সামাজিক জীবন ক্লান্তিকর, এবং সামাজিক জীবনে উৎসাহী হওয়ার মতো সময়ও নেই। এ ধরনের লোকের কাছে যদি অসন্তোষ প্রকাশের মতো যথেষ্ট শক্তি থাকে তাহলে ফ্যাসিবাদী আন্দোলন তাদের কাছে মুক্তিদাতা বলে প্রতিভাত হয়।
রাজনীতিতে যুক্তির অবক্ষয় দুটি উপাদানের সৃষ্টি; একদিকে যেমন বিভিন্ন শ্রেণি ও চরিত্রের ব্যক্তি রয়েছে যাদের চলতি দুনিয়া কোনো সুযোগ দেয় না, এরা সমাজতন্ত্রেও কোনো ভরসা দেখে না, কারণ তারা শ্রমজীবী নয়; অপরদিকে, অনেক সমর্থ এবং শক্তিশালী লোক রয়েছেন যাদের স্বার্থ বৃহত্তর সমাজের বিরোধী, ফলে তারা কেবলমাত্র নানা ধরনের ভুল ভাবাবেগের পক্ষে কাজ করে। ক্যুনিজম-বিরোধিতা, বৈদেশিক অস্ত্রভাণ্ডারের ভীতি এবং বৈদেশিক প্রতিযোগিতার প্রতি ঘৃণা, ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জুজু। এতে আমি বোঝাচ্ছি যে, তারা বাস্তব সমস্যার বুদ্ধিমান বিবেচনা বাদ দিয়ে চলতেই অভ্যস্ত। এই পৃথিবীর যে দুটি জিনিসের সবচেয়ে বেশি দরকার তা হলো সমাজতন্ত্র ও শান্তি, কিন্তু এই দুটি জিনিসই আমাদের সময়ের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের স্বার্থের বিরোধী। এমন পদক্ষেপ নেয়া খুব কঠিন নয়, যাতে এটা জনসংখ্যার বৃহৎ অংশের কাছে স্বার্থবিরোধী মনে হবে এবং কাজটি করার সহজ উপায় হলো গণভাবাবেগ সৃষ্টি করা। সমাজতন্ত্র ও শান্তির জন্য বিপদ যত বড় হবে সরকারসমূহ ততই প্রজাদের প্রলোভন দেখিয়ে বিপথগামী করবে; জনগণের চলিত আর্থিক কষ্ট যত বড় হবে, দুর্ভোগপীড়িত জনগণের বুদ্ধিগত মিতাচার হবে ততই বিনষ্ট, ক্রমাত্মক আলেয়ার পেছনে ছোটায় হবে অতিরিক্ত অভ্যস্ত।
জাতীয়তাবাদের জ্বর, যা ১৮৪৮ সাল থেকে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, যুক্তিহীনতাতত্ত্বের একটা রূপ মাত্র। এক ও অদ্বিতীয় সর্বজনীন সত্যের ধারণা বর্জন করা হয়েছে; এখন সত্যের নানা ভেদ, ইংরেজ সত্য, ফরাসি সত্য, জার্মান সত্য, মন্টেনেগ্রান সত্য, রাজশাসিত মোনোকো রাষ্ট্রের জন্যও একটা সত্য রয়েছে। অনুরূপভাবে শ্রমজীবীর জন্য রয়েছে একটা সত্য, পুঁজিবাদীদের জন্য ভিন্ন সত্য। এইসব বিভিন্ন সত্যের মধ্যে, যৌক্তিক প্রক্রিয়া যদি হতাশ হয়, তাহলে একমাত্র সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় যুদ্ধ, এবং অপপ্রচারকারী উন্মাদগ্রস্ততার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বিভিন্ন জাতি ও শ্রেণির মধ্যে বিরাজিত গভীর বিরোধ, যা আমাদের জগৎকে সংক্রমিত করেছে, সমাধা না করা পর্যন্ত মানুষ যুক্তিশীলভাবে চিন্তার অভ্যাসে প্রত্যাবর্তন করবে, এমন প্রত্যাশা করা যায় না। অসুবিধাটা এখানে যে, যত দীর্ঘকাল যুক্তিহীনতা বিরাজ করবে, আমাদের অসুবিধাগুলোর সমাধানে পৌঁছানো ততই দৈবাধীন হয়ে পড়বে। কারণ যুক্তি নৈর্ব্যক্তিক বলে সর্বজনীন সহযোগিতা সম্ভব করে তোলে। যুক্তিহীনতা যেহেতু গোপন আসক্তির প্রতিনিধিত্বকারী, ফলে বিবাদ হয়ে পড়ে অনিবার্য। এই কারণেই যুক্তিশীলতা, সত্যের সর্বজনীন ও নৈর্ব্যক্তিক মানের কাছে আবেদনের অর্থে, মানব-বংশের উন্নতির জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ, শুধু সেই সময়ের জন্যই নয় যখন সহজে এর প্রাদুর্ভাব ঘটে, বরং আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই সব মন্দ-ভাগ্যের সময়ের জন্য যখন একে এক শ্রেণির পুরুষের অসার স্বপ্ন হিসেবে ঘৃণা ও বাতিল করা হয়।