ফুল ঝরিয়া যায়, আবার ফোটে। কালের তালে তালে ঘুম-পাড়ানিয়া গানের মত বিস্মরণীয় গান গাহিয়া মানুষের দুঃখের স্মৃতি ভুলইয়া দিতেছেন মা-বসুমতী। কমলিনীও দিনে দিনে মায়ের শোক কতকটা ভুলিল। দিনের সঙ্গে সঙ্গে সে চোখের জল মুছিল, তারপর আবার হাসিল, আবার কীর্তন গাহিল। বাউল রসিক যেন হাঁপ ছাড়িয়া বীচিল। সেও সঙ্গে সঙ্গে হাসিল। ব্যথাতুর শিশু বেদনার উপশমে কান্না ভুলিয়া হাসিলে মায়ের বুকে যে হাসি দেখা দেয়, রসিকের মুখেও তেমনই হাসি দেখা দিল।
রসিক ভিক্ষা করিয়া আনে, কমল রাধে-বাড়ে। দিন এমনই করিয়া চলিতেছিল, মাস তিনেক পর একদিন রসিক বলিল, রাইকমল, একটা কথা বলছিলাম।
তাঁর কণ্ঠস্বরে, ভঙ্গিতে যেন একটা কুষ্ঠা ছিল। এটুকু কমলের বড় ভাল লাগিল। চটুল রসিকতায় বাউলকে আরও সে কুণ্ঠিত করিয়া তুলিল।
বলিল, বল?
রসিক বলিল, বলছিলাম কি—
কমল বলিয়া উঠিল, কি বলছিলে?
রসিক আরও কুণ্ঠিতভাবে বলিল, তা হলে—
কমলিনীর হাসি ফুট হইয়া উঠিল, বলিল, তা হলে? কি তা হলে বল না গে? বগ-বাবাজীর গলায় কি কাটা আটকাল নাকি?
বিব্রত রসিক অকারণে গলাটা খাকি দিয়া ঝাড়িয়া লইল। বলিল, না-তা—
স্বভাবগত কলহাস্যে সমস্ত মুখরিত করিয়া কমল বলিল, তবে গলা ঝাড়লে যে?
রসিক এবার বলিয়া ফেলিল, তোমার মোলাচন্দনের কথা। আমি-ধর, আমার—
কথাটা শুনিবামাত্র চঞ্চল কমলিনী এক মুহূর্তে স্থির হইয়া গিয়াছিল। একদৃষ্টি সে রসিকের মুখের দিকে চাহিয়াছিল। কথাটার শেষের দিকে রসিকদাসের কুষ্ঠা দেখিয়া তবুও তাহার মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিল—ম্লান হাসি, বলিল, তোমার?
রসিক বলিল, আমি বাউল। তা ছাড়া আমার কাছে থাকলে লোকেও মন্দ—
সে আর বলিতে পারিল না। কমল আবার ঈষৎ ম্লান হাসিয়া বলিল, গলার কাঁটোটা ঝেড়ে ফেলতে পারলে না? আচ্ছা, এ বেলাটা সবুর কর মহান্ত, ও বেলায়–
কথাটা সে শেষ করিল না, তাহার পূর্বেই ঘরের মধ্যে গিয়া প্রবেশ করিল। সারাটা দিন বাহির হইল না।
রসিকদোসও সারাটা দিন বাহিরে মাথায় হাত দিয়া মাটির দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। সন্ধ্যার কিছু আগে কমল ঘর হইতে বাহির হইল।
রসিক বসিয়া ছিল পূর্বমুখে। সে মুখ তুলিয়া চাহিল। সন্ধ্যার অস্তমান সূর্যের স্বৰ্ণাভা কমলের মুখে আসিয়া পড়িয়াছে; কিন্তু আজ তবু পদাবলীর কোনো কলি মনে পড়িল না। অপরাধীর মতই রসিক বলিল, রাইকমল!
বিচিত্ৰ হাসি হাসিয়া কমল বলিল, মালার জন্যে যে ফুল চাই মহান্ত।
সবিস্ময়ে রসিক তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
কমল বলিল, আজই আমার মোলাচন্দন হবে মহান্ত। ফুল চাই। আয়োজন চাই।
পরম আনন্দে উঠিয়া রসিক বলিল, সুবল—সখাকে ডেকে আনি আমি।
বাধা দিয়া কমল বলিল, পরে। এখন থাক। আগে ফুল নিয়ে এস তুমি।
রসিক বালকের মত আনন্দবিহ্বল হইয়া চলিয়া গেল। কতক্ষণ পরে সিক্তবস্ত্ৰে কতকগুলি পদ্মফুল লইয়া সে ফিরিল। বলিল, রাইকমল, কমলফুলই এনেছি। আমি।
আরও বোধহয় কিছু বলিবার ছিল। কিন্তু কমলিনীর রূপ দেখিয়া সে-কথা আর রসিকদাস উচ্চারণ করিতে পারিল না। কমলের চুলের রাশি ছিল এলানো। পরনে টকটকে রাঙাপাড় তসরের শাড়ি একখানি। নাকে ক্ষীণ রেখায় আঁকা শুক্ল-প্রতিপদের চন্দ্রকলার মত রসিকলিটি যেন উঁকি মারিয়া হাসিতেছিল। কপালে সন্ধ্যার গোধূলি-তারার মত শুভ্ৰ টিপ একটি। গলায় তুলসীকাঠের মালা, হাতে দুইগাছি রাঙা রুলি। অঙ্গে আর কোনো আভরণ নাই; কিন্তু তাই যেন ভাল।
কমলিনী হাসিল।
রসিক বলিল, একটু খুঁত হয়েছে রাইকমল। নীলাম্বরী পরলেই ভাল হত।
কমল বলিল, সে বাসরে পরব। নীল কালো বিয়ের সময় পরতে নেই যে। এখন তুমি কাপড়টা ছাড় দেখি। ওই দেখ, কাপড় রেখেছি।
রসিক দেখিল, কমলিনীর শখ করিয়া সেদিনের কেনা সেই নূতন শান্তিপুরে ধুতিখানি রহিয়াছে। পরমানন্দে কাপড়খানা সে পরিধান করিয়া বলিল, শিরোপা যে মজুরির চেয়েও দামী গো! তারপর, এইবার হুকুম কর, সুবল—সখাকে ডাকি।
চন্দন ঘষা শেষ করিয়া কমল বলিল, পরে। আগে মালা দুগাছা গেঁথে ফেলি, এস! তুমি একগাছা গাথ, আমি একগাছা গাঁথি।
রসিকের আজ আর আনন্দ যেন ধরিতেছিল না। সে তাড়াতাড়ি মালা গাঁথিতে বসিয়া গেল। বলিল, খুব ভাল হবে রাইকমল। সুবল-সখা আসবামাত্র মালা পরিয়ে দেবে। সে অবাক হয়ে যাবে।
কমলের হাতের মালা শেষ হইয়া আসিল। সে তাগিদ দিল মহান্তকে, বলি, আর দেরি কত? আমার শেষ হল যে!
রসিক রসিকতা করিয়া উত্তর দিল, রাই ধৈৰ্যং—
তারপর সুতার গিঠ বাঁধিতে বাঁধিতে বলিল, আমার মালাও তৈরি গো।
কমলিনী আপন হাতের মালাগাছি রসিকের গলায় পরাইয়া দিয়া বলিল, গোবিন্দ সাক্ষী।
রসিকের মুখ হইয়া গিয়াছিল বিবৰ্ণ পাংশু। কমল তাহাকে প্ৰণাম করিয়া সম্মুখে নতজানু হইয়া বসিয়া বলিল, এইবার তোমার মালা আমায় দাও।
এতক্ষণে রসিকের কথা সরিল। সে আর্তস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল, কি করলে রাইকমল?
কমল সুন্দর হাসি হাসিয়া বলিল, মালার প্রসাদ দেবে না। আমায়?
বলিয়া চন্দন লইয়া রসিকের জরাজীর্ণ পাণ্ডুর ললাট চর্চিত করিয়া দিল।
মুখপানে চাহিয়া সে হাসিল। তারপর আপন হাতের খসিয়া-পড়া মালাগাছি তুলিয়া লইয়া কমলের গলায় পরাইয়া দিল। তাহার সুন্দর মসৃণ তরুণ ললাটে সুন্দর ছাদে আঁকিয়া দিল সুবঙ্কিম রেখায় চন্দনবিন্দুর অলকা-তিলকার সারি। আঁকিতে আঁকিতে সে গাহিতেছিল–
কৃষ্ণপূজার কমল আমি রেখে দিব মাথায় করে।
কমল লীলাকৌতুকে বলিয়া উঠিল, কত দেরি তোমার? বাসর সাজাতে হবে যে!
রসিক বলিল, না গো সখি, না। বাসর সাজাব আমি। আমাদের লীলা হবে উলটো–এ লীলায় তুমি কাঁদবে, আমি কাঁদব।
কমল বলিল, চল এখন গৌরাঙ্গ-মন্দিরে চল। মহান্তের কাছে। যাই। যেগুলো করতে হবে, সেগুলো করা চাই তো!
***
রসিকদোসই বাসর সাজাইল। কমল দেখিল, বাসর সাজানো হইয়াছে-একদিকে টাটকা ফুলে, অন্যদিকে শুকনো ফুলে। কমল মুখ তুলিয়া মহান্তের দিকে চাহিল। রসিক ঈষৎ হাসিয়া বলিল, তুমি আর আমি।
কমল বলিল, তার চেয়ে আঙারে সাজালে না কেন? তাহার কণ্ঠস্বরা যেন কাঁপিতেছিল।
রসিক অপ্ৰস্তুত হাসি হাসিয়া বলিল, না না, শুকনো ফুল ফেলে দিই।
কমল বাধা দিল। সে শুষ্ক ফুলশয্যার উপর বসিয়া বলিল, এ শয্যে আমার। তোমার শুকনো শয্যে হবে না, তোমার হবে টাটকা। শয্যে।
কথা শেষ করিয়াই সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
অকস্মাৎ একটা অননুভূত তীব্রতায় জীর্ণদেহ প্রৌঢ়ের বক্ষপঞ্জরের অভ্যন্তরটা গুরগুর করিয়া কাঁপয়া উঠিল। ক্ষীণ কম্পনের রেশে সর্বদেহ কাঁপিতেছিল।
প্রৌঢ় বাউল কয় পা পিছাইয়া গেল, কম্পিত কণ্ঠে সে বলিয়া উঠিল, থাক রাইকমল, থাক।
কমল সমান হাসি হাসিয়া কহিল, তা কি হয় গো? এ যে নিয়ম। আর আমার বিয়ের সাধআহলাদ তো একটা আছে।
ধীরে ধীরে আপনাকে দৃঢ় করিয়া লইয়া মহান্ত বিকশিত কোমল কুসুম-শয্যার উপর গিয়া বসিল। তারপর কমলের হাতখানি আপনার হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া কহিল, রাইকমল, আধুলির বদলে শেষে আধলার মালা গলায় গাঁথলে?
বাউল বিচিত্ৰ হাসি হাসিল।
কমল হাসিল। বলিল, সোনায় তামায় বড় ধাঁধা লাগে গো। সোনা বলেই তো গলায় গাথলাম। তোমা যদি হয়, তবুও জানব, ওই আমার সোনা। সোনা-তামায় তফাত তো মনের ভুল। এ তো শুধু আমার রইল। কদর করব আমি। পরের সঙ্গে দীর করতে হাটে তো যাচ্ছি না।
ঘরের কোণে কমল ঘৃত প্ৰদীপ জ্বলিয়াছিল। প্রদীপটা জ্বলিতেছিলও বেশ উজ্জ্বলভাবে। রসিক কমলের মুখখানি পরিপূর্ণ আলোর ধারার সম্মুখে তুলিয়া ধরিল। কমল হাসিল।
রসিকের দেখিয়া যেন আর তৃপ্তি হয় না।–আশা মেটে না। কমল বলিল, ছাড়।
সে কেমন ভয় পাইয়া গেল। জীৰ্ণ বাউলের বার্ধক্যমলিন চোখের কি তীব্র জ্বলজ্বলে একাগ্র দৃষ্টি!
সে সরিয়া যাইবার চেষ্টা করিল। কিন্তু রসিক সহসা উন্মত্তের মত প্ৰবল আকর্ষণে কমলের পুষ্পিত দেহখানিকে বুকের মধ্যে টানিয়া লইল। কমল ছাড়াইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। ওই শীর্ণ বাহুতে যেন মুক্ত হস্তীর শক্তি! কঙ্কাল যেন ফাঁসির দড়ির মত দৃঢ় হইয়া উঠিয়াছে।
কমলের মুখ বিবৰ্ণ হইয়া গেল, সে আর্তম্বরে প্রার্থনা করিল, মহান্তী! মহান্ত!
উন্মত্ত বাউল যেন অন্ধ বধির হইয়া গিয়াছে।