প্রাচীন ভারতে গণিকা
প্রাচীন ভারতের সমাজে গণিকার কী পরিচয় ও স্থান ছিল তা বিচার বা বিশ্লেষণ করার পূর্বে দেখা যেতে পারে প্রাচীন সংস্কৃতসাহিত্যে গণিকার সংজ্ঞা ও পর্যায়বাচক কী কী শব্দ ছিল। এই প্রতিশব্দগুলির মধ্যে দিয়েই সমাজ গণিকাকে কোন চোখে দেখত তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
ঋগ্বেদই ভারতের প্রাচীনতম সাহিত্য এবং এখানেই গণিকাবাচক বেশ কয়েকটি শব্দ পাই: হস্রা, অগ্রু। (৪:১৬:১৯:৩০; ৪:১৯:৯); সাধারণী (১:১৬৭:৪; ২:১৩:১২, ১৫, ১৭) এর কিছু পরে অথর্ববেদে আছে পুংশ্চলী। (১৫:১:৩৬; ২০:১৩৬:৫) শুক্ল যজুর্বেদ-এর বাজসনেয়ী সংহিতায় সাধারণী ও সামান্যা; (৩০:১২) কৃষ্ণ যজুর্বেদ-এর তৈত্তিরীয় সংহিতাতেও এ শব্দ দুটি পাওয়া যায়। (৩:৪৭) আরও কিছু পরে তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে নতুন দুটি শব্দ পাই, অতিস্কদ্বরী ও অপস্কদ্বরী, যে (নিয়ম) উল্লঙ্ঘন করে। (৩:৪:১১:১) আর পাই ব্রজয়িত্রী, যে আনন্দ দেয় (বাজসনেয়ী সংহিতা ৩০:১; তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, ৩:৪:৭:১) পালি বিনয়পিটক-এ একটি শব্দ পাই মুহুত্তিয়া (সংস্কৃত মুহূর্তিকা), যে ক্ষণকালের সঙ্গিনী, (৩:১৩৮) জাতকে পাই রূপদাসী, বগ্নদাসী, বেশ্যা, নারিষের, গামনী ও নগরশোভিনী ইত্থি (১:৪৩) এবং জনপদকল্যাণী। এদের মধ্যে রূপদাসী ও বন্নদাসী অন্য প্রধানা গণিকার অধীনে অথবা স্বতন্ত্র ভাবে প্রার্থীকে আপ্যায়ন করতে পারত (অর্থশাস্ত্র ২:২৭); জাতক-এও এদের কথা পাই। (২:৩৮০; ৩:৫৯-৬৩, ৬৯-৭২; ৪৭৫:৮)
এর পরবর্তীকালে গণিকার প্রতিশব্দ সংখ্যায় বেড়েই চলে। মহাকাব্যে পুরাণগুলিতে ও সাহিত্যে যাদের দেখা পাই তাদের নানা নাম— কুলটা, স্বৈরিণী, বারাঙ্গনা, বারস্ত্রী, বারবনিতা, স্বতন্ত্রা ও স্বাধীনযৌবনা। নটী ও শিল্পকারিকাও মাঝে মাঝে গণিকার প্রতিশব্দ হিসেবে দেখা দিয়েছে, যেমন দিয়েছে কুন্তদাসী এবং পরিচারিকাও। বাৎস্যায়নের কামসূত্র-তে গণিকা ও রূপাজীবা (৭:৬:৫৪) নাম পাই। জটাধরের শব্দরত্নাবলী অভিধানে পাই শালভঞ্জিকা, বারবাণী, বর্বটী, ভণ্ডহাসিনী, কামরেখা, শূলা এবং বারবিলাসিনী। শব্দমালা অভিধানে পাই লঞ্জিকা। বৈশিকতন্ত্র-তে আরও কিছু নাম এসেছে: বৃষলী (যার অভিধাগত মুখ্য অর্থ শূদ্রা এবং যার গৌণ একটি অর্থ গণিকা: শূদ্রনারীকে অন্য বর্ণের ভোগ্যা মনে করা হত, তাই এতে স্পষ্ট)। এ ছাড়া পাংশুলা (মলিনা), লঞ্জিকা, বন্ধুরা, কুত্তা (শূলার মতো এও একটি বিদ্ধ করার অস্ত্র), কামরেখা, বর্বটী ও রণ্ডা (এ বিটের রক্ষিতা)। হেমচন্দ্রের অভিধানচিন্তামণি-তে পাই সাধারণস্ত্রী, পণ্যাঙ্গনা, ক্ষুদ্রা, ভুঞ্জিকা ও বারবধূ। রাজনির্ঘণ্ট অভিধানে আছে ভোগ্যা ও স্মরবীথিকা এবং অমরকোষ-এ পাই বেশ্যা, বারস্ত্রী, গণিকা ও রূপজীবা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ বলে পতিব্রতা হল একপত্নী, স্বামী ছাড়া দ্বিতীয় পুরুষের প্রতি আসক্ত নারী কুলটা, তিন জনের প্রতি হলে বৃষলী বা পুংশ্চলী, চার থেকে ছ’জনের প্রতি হলে বেশ্যা; সাত আট হলে যুঙ্গী, তদূর্ধ্বে মহাবেশ্যা; কোনও বর্ণের লোকই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। (প্রকৃতি খণ্ড, অধ্যায় ২২৭-২৮)
বলা বাহুল্য, এই প্রায় পঞ্চাশটি প্রতিশব্দের উদ্ভব এক সময়ে হয়নি, এক স্থানেও হয়নি, ধীরে ধীরে আঞ্চলিক ও কালিক বিকল্পের মধ্যেই নামগুলি সৃষ্ট হয়েছিল। প্রশ্ন করা যেতে পারে, ভারতবর্ষে গণিকাবৃত্তি কত প্রাচীন? এর উত্তরে বলা যায়, ভারতবর্ষে শুধু নয়, তখন থেকে সর্বত্রই গোষ্ঠী ও কৌম ভেঙে পরিবারের পত্তন হচ্ছিল। অর্থাৎ, নারীর উপর যখন পুরুষের স্বত্বাধিকার সমাজ মেনে নিতে শুরু করেছে তখন থেকেই আছে গণিকাবৃত্তি। তখন থেকেই পরিবারের নির্দিষ্ট সীমার বাইরে কোনও নারী যখন অন্য পুরুষকে অর্থ বা বস্তু প্রাপ্তির বিনিময়ে দেহদান করে তখনই সে গণিকা বলে চিহ্নিত হয়। এর মধ্যেও প্রথম পর্যায়ে নিশ্চয়ই নানা স্তর ছিল: দু’জনের সম্মতিক্রমে বিবাহগণ্ডির বাইরে পুরুষ বা নারীর এমন সম্বন্ধ ঘটলে তারা ‘জার’ বা ‘জারিণী’ বলে অভিহিত হত। এ শব্দ দুটি ঋগ্বেদে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে, এমনকী উপমায় উপমানরূপেও। কাজেই ঋগ্বেদের সমাজ নিশ্চয়ই বিবাহিত নরনারীর ‘অবৈধ’ প্রণয় একটি পরিচিত ঘটনাই ছিল। এছাড়াও সেখানে নানা বিকল্প সম্পর্কের চিহ্ন পাওয়া যায়। উপহারের বিনিময়ে মিলনেও গণিকাবৃত্তি না-ও থাকতে পারে, যেহেতু উপহার প্রীতির চিহ্নও হতে পারে। সে উপহার কখন মূল্যের বিকল্প তা নির্ধারণ করা কঠিন, কারণ প্রাক-মুদ্রা সমাজের অর্থনীতিতে বস্তু অর্থের বিকল্প, এবং এ-বস্তু মূল্যরূপেও দেওয়া যায় প্রীতি উপহাররূপেও দেওয়া যায়। কাজেই মনে করা যেতে পারে, বিবাহ সম্পর্কের বাইরে বিবাহিতা বা অবিবাহিতা নারী যখন বিবাহিত বা অবিবাহিত পুরুষের ইন্দ্রিয়তৃপ্তিবিধানের ‘মূল্য’ রূপে অর্থ বা উপহার গ্রহণ করে তখন সেইটিই গণিকাত্বের লক্ষণ, সে মূল্যগ্রহণ মধ্যে মধ্যেই হোক অথবা নিয়মিত বৃত্তিরূপেই হোক। কাজেই গণিকাবৃত্তি ‘বিবাহবন্ধনের বাইরে’ একটি নিয়ামক লক্ষণ এবং ‘মূল্যগ্রহণ’— এ দুটির দ্বারা চিহ্নিত। ঋগ্বেদ-এর জার বা জারিণী, উপপতি বা উপপত্নী কিংবা অবৈধ প্রণয়ী বা প্রণয়িনী, মূল্য দান বা গ্রহণ অনুপস্থিত বলেই এই সম্পর্কে গণিকাবৃত্তির অন্তর্গত নয়।
কবে কীভাবে মূল্যের বিনিময়ে নারী দেহদান করতে শুরু করে তার ইতিহাস উদঘাটন করা আজ বোধহয় সম্ভব নয়; তবে সম্ভবত বলা চলে যে, সমাজে বিবাহ ও পরিবার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে, নারী যখন স্বাতন্ত্র্য হারায় তখন থেকেই এর শুরু (এ ব্যাপারটা সূত্রসাহিত্যে দেখতে পাই, সেখানে শুনি ‘পিতা রক্ষতি কৌমারে, ভর্তা রক্ষতি যৌবনে/রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বতন্ত্রমহর্হতি।’ অর্থাৎ কৌমারে পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্র নারীকে রক্ষা করে; নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়)। এবং পিতা স্বামী বা পুত্রের রক্ষণীয়া অর্থাৎ যথাক্রমে লালনীয়া ভোগ্যা-ভরণীয়া এবং পোষণীয়া হয়ে ওঠে তখন এ বন্ধনের বাইরে মূল্য দিয়ে যাকে পাওয়া যায় সে-ই গণিকা। এরই সঙ্গে বা অনুক্রমে আরও একটা ব্যাপার গণিকাবৃত্তির প্রসারে সহায়তা করে। তা হল সমাজে কিছু মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত বিত্তের সঞ্চয়, যা সে জীবনধারণের প্রয়োজন মেটাবার পর বিলাসে সম্ভোগে ব্যয় করতে পারে।
আগে আমরা যে পঞ্চাশটি প্রতিশব্দ পেলাম, খুঁটিয়ে দেখলে তার সব কটিই পর্যায়শব্দ নয়; তাদের মধ্যে স্তরবিভাগ আছে। কুরুধম্মজাতক অনুযায়ী রাষ্ট্রে সবচেয়ে নিচু কর্মচারী হল দ্বারিক (দরওয়ান) এবং তারও নিচে গণিকা। আবার গণিকাই কিন্তু ওই বৃত্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠ শ্রেণির নাম। আর এক নাম নগরশোভিনী বা জনপদকল্যাণী। একটা সম্পূর্ণ জনপদের (প্রাচীনকালে জনপদের জনসংখ্যা হয়তো খুব বেশি ছিলও না) সাধারণ ভাবে ভোগ্যা নারীর নাম জনপদকল্যাণী। (কল্যাণ শব্দের আদিমতম অর্থ সুন্দর, গ্রিক Kale-র পর্যায়বাচক। মনে হয় জনপদের শ্রেষ্ঠা সুন্দরী যাতে কেবলমাত্র একজনের ভোগ্যা না হয়, তাই সে-ই জনপদকল্যাণী ছিল সাধারণী।’ অর্থশাস্ত্র, কামসূত্র এবং অন্যান্য গ্রন্থ থেকে যা তথ্য পাই তাতে দেখি গণিকার স্থান সবচেয়ে ওপরে, রূপে যৌবনে শিক্ষাদীক্ষায় সেই শ্রেষ্ঠ। (কামসূত্র ১:৩:২০) তার নিচে রূপাজীবা যে শিক্ষাদীক্ষা ও রূপযৌবন, ধনসম্পদ এবং সামাজিক প্রতিপত্তিতে গণিকার চেয়ে নিচে। তারও নিচে বেশ্যা— নাম শুনেই বোঝা যায় তার মূলধন বস্ত্রালংকারে, সাজগোজে। গণিকা যখন গণিকালয়ে বাস করত তখন রাষ্ট্র তার শিক্ষার ব্যয়বহন করত, তার আয় থেকে নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায় করত এবং কৌটিল্য বার্ধক্যে তাকে কিছু বৃত্তি দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছেন। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব এং অধিকার দুই-ই তার ছিল। রূপাজীবার শিক্ষার দায় তার নিজের বা তার মায়ের অথবা তার গ্রাহকের, এ ছাড়া ছিল অবরুদ্ধা অর্থাৎ রক্ষিতা, যার সমস্ত দায়িত্ব তার পৃষ্ঠপোষকের অর্থাৎ যে তার আর্থিক সব দায়িত্ব বহন করত এবং বিনিময়ে সে একাই তার কাছে আসতে পারত, এর স্বাচ্ছন্দ্য এবং আর্থিক অবস্থা সম্পূর্ণই ওই একজন পৃষ্ঠপোষকের অবস্থা এবং মর্জির ওপরে নির্ভর করত। এর নিচে আমরা নানা রকম বৃত্তিধারিণীর কথা শুনি যেমন সৈরিন্ধ্রী, শিল্পকারিকা বা শিল্পদারিকা কৌশিকস্ত্রী, কুম্ভদাসী, বগ্গদাসী, রূপদাসী, নটী, ক্ষুদ্রা, ভুঞ্জিকা, ইত্যাদি। এরা রাজপ্রাসাদে বা ধনীর প্রাসাদে নিজের শিক্ষা অনুসারে কায়িক শ্রম করে জীবিকানির্বাহ করত কিন্তু এদের প্রত্যেকেই গৃহস্বামীর ভোগ্যও ছিল।
এর বাইরে ছিল অশিক্ষিতা, অর্ধশিক্ষিতা, রূপহীনা, কখনও বা বিগত যৌবনা, নির্বিত্ত বৃহৎ একটি রূপোপজীবিনীর দল, এদের পরিচয় পুংশ্চলী, কুলটা, স্বৈরিণী, বারবণিতা (বারমুখ্যা, বারাঙ্গনা, বারস্ত্রী সবই পর্যায়বাচক শব্দ, অর্থাৎ বার [= পালা] অনুসারে যারা পারিশ্রমিক নিত) আয়ের পরিমাপে কতকটা সামাজিক অবস্থান বোঝা যায়: গণিকা রাষ্ট্র থেকে মাসিক ১০০০ পণ পেত, তার চতুঃষষ্টিকলা শিক্ষার জন্য রাষ্ট্র নিজ ব্যয়ে বিভিন্ন শিক্ষক নিযুক্ত করত। বৌদ্ধসাহিত্যে দেখি গণিকা সালাবতীর জন্যে তার মা সিরিমা একরাত্রে ১০০০ কাহাপণ (কার্যাপণ=স্বর্ণমুদ্রা) নিত।` সামাজাতকে পড়ি কাশীর গণিকা সামার ৫০০ অনুচারিণী ছিল (জাতক৩:৫৯-৬৩), এরাই সম্ভবত গণিকাদাসী। গণিকা অম্বাপালীর দক্ষিণা নিয়ে রাজগৃহ ও বৈশালীর মধ্যে রীতিমতো কলহই হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞাত ধর্মকথা নামে জৈন গ্রন্থে দেখি সর্বাঙ্গসুন্দরী ও শিক্ষিতা গণিকার প্রতি রাত্রের আয় ছিল সহস্র কার্যার্পণ মৃচ্ছকটিকে পড়ি বসন্তসেনাকে একবার নিয়ে যাওয়ার জন্য দশ হাজার টাকার গহনাসমেত গাড়ি পাঠিয়েছে রাজশ্যালক শকার। কাজেই ওপরের দিকে রূপযৌবন-যশ-অর্থে প্রখ্যাত গণিকার আয়ের কোনও লেখাজোখা ছিল না। এঁদের দানের পরিমাণ দেখলেই সেটা কতকটা বোঝা যায়— কেউ বা বুদ্ধ ও একসহস্র শিষ্যকে আহারে আমন্ত্রণ করছেন ও পরিতৃপ্ত অতিথিদের প্রয়োজন মেটাচ্ছেন অর্থ দিয়ে, কেউ বা আমবাগান দান করছেন, কেউ বা মঠ, কেউ বিহার, কেউ কানন, চৈত্য, স্তূপ, সেতু, কূপ আবার কেউ বা চিত্রশালা। অবরুদ্ধা গ্রাসাচ্ছাদন ছাড়াও মাসে এক পণ নগদ পেত। উল্টোদিকে বিগত যৌবনা রূপহীনা অশিক্ষিতা যে বৃহৎ দলটি ছিল, গণিকাজগতেও তারা অপাঙক্তেয় ছিল। এই পুংশ্চলী স্বৈরিণীদের কাছে যারা আসত তারা যা দিত তাই এদের নিতে হত। এরা সংখ্যায় বেশি, আকর্ষণ কম, কাজেই চাহিদা এবং মূল্যও কম। ফলে এরা অধিকাংশই খুব দরিদ্র ছিল, অধিকাংশের কাচে গ্রাসাচ্ছাদনটাই ছিল বড় সমস্যা।
এ ছাড়া ছিল দেবদাসী যার অন্য নাম ত্রিদশালয়বনিতা। প্রাচীন গ্রিস, রোম, মিশর, ফিনিশিয়া, কলডিয়া, ব্যাবিলন এবং ভারতবর্ষ সর্বত্রই মন্দিরগণিকার একটা ভূমিকা ছিল। যেখানেই নগর-সভ্যতার পত্তন হয়েছে এবং কোনও কোনও মন্দির সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছে সেখানেই দেবদাসীর প্রাদুর্ভাব ছিল। মন্দিরপুরোহিত রাষ্ট্র থেকে বৃত্তি পেতেন, তা দিয়ে তিনি দেবদাসীদের ভরণপোষণ করতেন, কখনও কখনও দেবদাসীরাও বৃত্তি পেতেন। দামোদরগুপ্তের কুট্টনীমতে দেবদাসীদের রাষ্ট্র থেকে বৃত্তি পাওয়ার কথা আছে, আবার সংযুক্তনিকায়-তে দেখি তারা খাদ্যশস্য পায়। জোগিমারা গুহালিপিতে (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের) রূপদক্ষ দেবদত্তের দেবদাসী সুতনুকার প্রতি প্রেমের উল্লেখ পাই। দেবদাসীদের কাজ ছিল পূজা আরাত্রিকের সময়ে মন্দিরে বা মন্দির প্রাঙ্গণে দেবতার উদ্দেশ্যে নৃত্য করা; এটিই তাদের মুখ্য করণীয়, এরই বিনিময়ে তারা বৃত্তি, খাদ্যশস্য বা ভরণপোষণ পেত। তাদের গৌণ অথচ সর্বজনবিদিত ভূমিকা ছিল পুরোহিতের কামনা চরিতার্থ করা। এই জন্যেই ১৯২৯ সালে মাদ্রাজে দেবদাসী প্রথার উচ্ছেদমূলক আইন প্রবর্তিত হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘকাল এ-প্রথা দেশে বহাল ছিল। ১৯৪৭ সালে আবার আইন করে এটা উচ্ছেদ করার চেষ্টা হয়, তথাপি দেশের আনাচে-কানাচে নানা মন্দিরে এখনও দেবদাসী প্রথা ভোল পাল্টে রয়েছে।
দেবদাসী তরুণী, সুন্দরী ও নৃত্যকুশলা হলেই চলত কিন্তু গণিকা বা রূপজীবার এবং কখনও কখনও অবরুদ্ধার পাঠ্যতালিকা দীর্ঘ ছিল। জৈন গ্রন্থ বৃহৎকল্প (পুণ্যবিজয়জি ভাবনগর রচিত, ১৯৩৩-৩৮) গ্রন্থে দেখি এদের শিখতে হত লেখা, গণিত, নানা রকম শিল্প, সংগীত, বাদ্যযন্ত্র (বীণা, পটহ, বংশী, ইত্যাদি), দ্যুতক্রীড়া অক্ষক্রীড়া, কাব্যরচনা (সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ), গন্ধযুক্তি (আতর তৈরি) অলংকারনির্মাণ, সজ্জা, অলংকরণ, সুলক্ষণ ও দুর্লক্ষণ পুরুষ ও নারীর বিচার, অশ্ববিদ্যা, হস্তীবিদ্যা, রন্ধনবিদ্যা, রত্নপরীক্ষা, বিষনির্ণয় ও প্রতিবিধান, স্থাপত্য, শিবির নির্মাণ, সেনা সন্নিবেশ, যুদ্ধবিদ্যা, ধনুর্বিদ্যা, নিমিত্তনিদান, ইত্যাদি মোট বাহাত্তরটি বিষয়। (মনুসংহিতা-তেও এ সম্বন্ধে কিছু কিছু নির্দেশ আছে। ২:৬৭)
গণিকা ও রূপাজীবা যেমন রাষ্ট্রকে আয়কর দিত তেমনই বিনিময়ে সামান্য কিছু নিরাপত্তার ব্যবস্থাও পেত।। গণিকাকন্যাকে ধর্ষণ করলে ৫৪ পণ ও তার মায়ের আয়ের ১৬ গুণ অর্থদণ্ড দিতে হত। গণিকার বিদেশি প্রার্থীকে তার নির্দিষ্ট মূল্য ছাড়া পাঁচ পণ বেশি দিতে হত। পুংশ্চলী বা কুলটার নির্দিষ্ট কোনও মূল্য ছিল না, কিন্তু সে যদি বেশি টাকা আদায়ের চেষ্টা করত, তাহলে তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকেও সে বঞ্চিত হত। রূপাজীবার বার্ষিক বৃত্তি ছিল আটচল্লিশ পণ; অভিনেতা, অন্নবিক্রেতা, মাংসবিক্রেতা বা বৈশ্যের সঙ্গে তার সম্বন্ধ থাকত। গণিকা বা রূপাজীবা যদি টাকা নেওয়ার পরে আপত্তি করে তাহলে তার প্রাপ্যের দ্বিগুণ অর্থ তার দণ্ড, আর টাকা নেওয়ার আগে আপত্তি করলে প্রাপ্য থেকে সে বঞ্চিত হত। যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি (২:২৯৫) অনুসারে গণিকার শারীরিক নিরাপত্তার জন্যেও নানা রকম দণ্ড ছিল যার পরিমাণ এক হাজার থেকে আটচল্লিশ হাজার পণ। অন্য দিকে ব্যতিক্রমও প্রচুর পাই; মনু বলেছেন সব গণিকাই চোর ও প্রতারণাপরায়ণ (৯:২৫৯-৬০) আর ধর্মসূত্রকার গৌতম বলেছেন বেশ্যাকে হত্যা করা দণ্ডনীয় অপরাধই নয় (গৌতমধর্ম সূত্র ২২:২) কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-তে দেখি গণিকাকে প্রকাশ্যে অপমান করার দণ্ড চব্বিশ পণ, শারীরিক অত্যাচার করার দণ্ড আটচল্লিশ পণ, কান কেটে নিলে পৌনে বাহান্ন পণ ও সেই সঙ্গে কারাবাস। যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি বলে, গণিকাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করার দণ্ড পঞ্চাশ পণ এবং বহুজনে পরপর ওই ভাবে ধর্ষণ করলে তাদের প্রত্যেকের দণ্ড চব্বিশ পণ। (২:২:৯৩)
গণিকা কী ধরনের প্রার্থী খুঁজবে তারও নির্দেশ দিয়েছেন বাৎস্যায়ন; তরুণ, ধনী, পারিবারিক দায়িত্ব যার নেই, উচ্চপদস্থ, সদ্বংশজাত, প্রাণবান, শিক্ষিত, কবি গাথা-কাহিনি-উপাখ্যানে কুশল, বাগ্মী, নানা কলায় পারদর্শী, সুরাসক্ত, বন্ধুভাবাপন্ন, নারীসঙ্গমকারী কিন্তু কোনও নারীর বশংবদ নয়, নিষ্ঠুর বা ঈর্ষাকাতর নয় (কামসূত্র ৬:১:১০, ১২) রাজার হুকুমে ছাড়া অন্য কোনও কারণেই তার ওপরে কোনও প্রার্থী চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। রাজার প্রেরিত প্রার্থীকে বিমুখ করলে তার দণ্ড পাঁচশো পণ এবং এক হাজার বেত্রাঘাত। কাজেই দেখছি, তার দেহের উপরে তার আত্যন্তিক কোনও অধিকার নেই। অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী (৪:১৩) কোনও একজন পুরুষের প্রতি দীর্ঘকাল আসক্ত থাকা গণিকার উচিত নয়। (কামসূত্র ৬:৫:১-৬) দরিদ্র প্রার্থীকে সে সর্বদাই প্রত্যাখ্যান করবে (কামসূত্র ৬:৬:৩১) এবং প্রার্থীর আগ্রহ কমে যাচ্ছে কিনা সে বিষয়ে অবহিত থাকবে, তার লক্ষণগুলিও বলা আছে। (কামসূত্র ৬:৩:২৮-৩১) কলাবিলাস গ্রন্থে যে চৌষট্টি রকমে গণিকা তার প্রার্থীকে ঠকাতে পারে তার তালিকা দেওয়া আছে।
দ্বাদশ শতকের গ্রন্থ মৃন্ময়সুন্দরীকথা-তে দেখি গণিকার আয়ের শতকরা পঁচিশ থেকে ত্রিশ ভাগ ছিল রাষ্ট্রের প্রাপ্য অর্থাৎ রাজস্ব। বৌদ্ধ গ্রন্থে গণিকার ‘ভট্টি’ (সংস্কৃত ‘ভৃতি’) অর্থাৎ বেতন এবং পরিব্বয়’ (সংস্কৃত পরিব্যয়ম্) খরচের উল্লেখ পাই। মথুরার বাসবদত্তার পারিশ্রমিকও অত্যন্ত উচ্চহারের ছিল।৩ রাজগৃহের সালাবতী প্রতি রাত্রে একশো কার্যপণ উপার্জন করত। এ ছাড়াও ইতস্তত খুব উচ্চহারের উপার্জনের উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পত্তির— অন্তত স্থাবর সম্পত্তির উপরে তাদের একান্ত অধিকার ছিল না।ধ শিশু, দাস ও গণিকার সম্পত্তিতে অধিকার নেই এ কথা মহাভারত-এ বারবার আছে। (আদিপর্ব ১৮২:২২, সভাপর্ব ৭১:১; উদ্যোগপর্ব ৩৩:৬৪) গণিকা ও তার বিকল্প, প্রতিগণিকা মাসিক বৃত্তি পেত সরকার থেকে; নিজস্ব উপার্জনের কোনও কোনও অংশে তার অধিকার ছিল এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মধ্যে মধ্যে সে দানও করতে পারত। কিন্তু তার মৃত্যুর পরে তার কন্যার অধিকারে মায়ের সম্পত্তি যখন আসত তখন সে-ও ওই জীবনসত্ত্বের মধ্যে; বন্ধক, বিক্রয়, দায় ও পরিবর্ত এ সবে তার অধিকার থাকত না। রাষ্ট্রের বিপদ হলে তার আয়ের অর্ধেকই বাজেয়াপ্ত হত; (অর্থশাস্ত্র ৫:২) প্রয়োজন হলে তাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়ারও ব্যবস্থা ছিল। (অর্থশাস্ত্র ১:২০) রক্ষিতা বা অবরুদ্ধার ওপরে একটি পুরুষ— তার ভরণকর্তারই একান্ত অধিকার ছিল, সেখানে অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করলে তার দণ্ড ছিল আটচল্লিশ পণ। (অর্থশাস্ত্র ৩:২০) গণিকাকে গণিকাত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল দু’ রকম: প্রথমত, রাজা ইচ্ছা করলে যে কোনও গণিকাকে কুলনারী বলে ঘোষণা করতে পারতেন, তখন সে গণিকাত্বের সামাজিক গ্লানি ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি পেত এবং কুলনারীর প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার পেত। (মৃচ্ছকটিক নাটকের দশম অঙ্কে গণিকা বসন্তসেনা রাজা আর্যকের প্রসাদে কুলনারীতে পরিণত হয় এবং চারুদত্তের সঙ্গে বিবাহিত হয়ে কূলবধূ বলে গণ্য হয়)। দ্বিতীয়ত, যে ভাবে সে গণিকাত্ব থেকে মুক্তি পেত তা হল নিষ্ক্রয়, অর্থাৎ কোনও পুরুষ তাকে বিবাহ করতে চাইলে বা মুক্তি দিতে চাইলে গণিকালয়ের কর্ত্রীকে চব্বিশ হাজার পণ দিলে সে মুক্ত হত। (মৃচ্ছকটিক নাটকে গণিকা মদনিকার প্রেমিক শলিক নিষ্ক্রয়মূল্য অর্জন করবার কোনও পথ খোলা না পেয়ে অলংকার চুরি করে।)
নানা স্তরের গণিকার কার্যক্রমেরও পার্থক্য ছিল— রাজার, বণিকের বা ধনীর প্রাসাদে নানা ভূমিকায় দেখা যেত গণিকাকে। গান্ধারী গর্ভবতী হলে ধৃতরাষ্ট্রের গণিকার প্রয়োজন হয়েছিল। (মহাভারত, আদিপর্ব ১১৫:৩৯)। জৈন গ্রন্থ বাসুদেবহিণ্ডি-তে স্ত্রীর বিকল্পের কাহিনি আছে, সেখানে কৌমপতি ভরতের প্রাসাদে স্ত্রী ছাড়াও একটি ভোগ্যা নারী থাকত। একবার কৌমের অধীনের সকলেই নিজের নিজের মেয়েকে ভরতের কাছে পাঠালেন এবং এরা সকলেই এক সঙ্গে ভরতের প্রাসাদে এসে উপস্থিত হলেন; তখন নারী চলে যেতে উদ্যত হলেন। তারপরে ঠিক হল যে এরা অন্তঃপুরের বাইরে রাজার পরিচর্যা করবে এবং পরে এদের ‘গণ’ বা গোষ্ঠীর কাছে দেওয়া হবে; তখন এরা গণিকা হবে। এ যেন গণিকা শব্দের ব্যুৎপত্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি উপাখ্যান রচনা করা হয়েছে। রামায়ণ মহাভারতে গণিকার নানা ভূমিকার কথা পড়ি। যুদ্ধযাত্রার সময়ে পাণ্ডবসেনার সঙ্গে যুদ্ধের উপকরণ ও বহু গণিকা গাড়িতে ছিল। (মহাভারত উদ্যোগপর্ব ১৯৫:১৮-২৯) যুদ্ধের আগে যুধিষ্ঠির গণিকাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। (উদ্যোগপর্ব ১৫:৫১-৫৮) বনে যাওয়ার সময়েও পাণ্ডবদের সঙ্গে রথ, পণ্যদ্রব্য ও গণিকারা ছিল, সম্ভবত সৈন্যদের বিনোদনের জন্যে। (বনপর্ব ২৩৮ থেকে যুদ্ধে জয়লাভ করবার পরে বিরাট রাজা সুন্দরী নারীদের সুসজ্জিত হয়ে এসে সমবেত জনতার মনোরঞ্জন করার নির্দেশ দেন। (বিরাটপর্ব ৬৪:২৪-২৯) স্পষ্ট যে, এ ধরনের মনোরঞ্জন করার আদেশ কুলনারীকে দেওয়া সম্ভব ছিল না, শুধু গণিকাকেই দেওয়া চলত। কৃষ্ণ যখন যুদ্ধনিরোধের চেষ্টায় হস্তিনাপুরে গেলেন, দুর্যোধন তাঁর আপ্যায়নের যে ব্যবস্থা করেছিলেন তার মধ্যে ছিল একটি বিরামাগার ও সেখানে পরিচর্যারত বহু নারী। এবং, ধৃতরাষ্ট্র আদেশ দেন যেন বেশ্যারা তাঁর পুত্রদের সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণকে প্রত্যুদগমন করে। রামায়ণে বিলাসের উপকরণের তালিকায় বেশ্যা ও গণিকার নামের উল্লেখ আছে। স্পষ্টই বোঝা যায় গণিকা ছিল ঐশ্বর্যের পরিচায়ক এবং তাদের সংখ্যাও থাকত গৃহ স্বামীর সম্পদের অনুপাতে এবং এটা সম্ভব হয়েছিল সমাজে এক শ্রেণির বিত্তবান লোকের হাতে প্রচুর উদ্বৃত্ত অর্থের সঞ্চয়ের দ্বারা। নাগরিক সভ্যতার বিকাশ ও বাণিজ্যের প্রসার হওয়ার আগে এ অবস্থা আসা সম্ভব ছিল না। শস্য, গোধন, সোনাদানা যেমন ধনীর বিজ্ঞাপন, ক্রীতদাস ও ভোগ্যা নারীর সংখ্যাও তেমনই আর একটি বিজ্ঞাপন। রাজার বা ধনীর প্রাসাদে এই যে শত শত নারী থাকত তারা সকলেই মুখ্যত বেশ্যাপরিচয়ে থাকত না, নানা রকম বৃত্তিই ছিল তাদের সামাজিক পরিচয়। কিন্তু, তারা ভূজিয্যা, যার শ্রম ভোগ করে তারা প্রভু; এবং সে শ্রম শুধু বৃত্তিরই হত না। ছত্রধারিণী, চামরগ্রাহিণী, সংবাহিকা, তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী ছাড়াও এরা গৃহস্বামীর এবং পরিবারের অন্যদেরও স্নান, অভ্যঞ্জন, বস্ত্রালংকারধারণ, ইত্যাদিতে পরিচর্যা করত। শিল্পদারিকা, সৈরিন্ধ্রী, কৌশিকস্ত্রী, কুম্বদাসী, ইত্যাদি দানা বৃত্তি অবলম্বন করে এরা রাজা বা ধনীর অন্তঃপুরে আসত।
গণিকার ভূমিকা সম্বন্ধে কামশাস্ত্র-তে পড়ি যে, রাজা অথবা ধনী নাগরিকের দলবলের সঙ্গে কাব্য নাটক শিল্প ইত্যাদির আলোচনা করা; ধনীর গৃহে অনুষ্ঠিত উৎসব ‘গোষ্ঠী’তে অংশগ্রহণ করা— এ সব ছিল তার অন্তর্ভুক্ত। ভিন্ন ভিন্ন বণিক বা ধনী নাগরিকের গৃহে এই গোষ্ঠীর আয়োজন হত। সেখানে প্রচুর পানভোজনের ব্যবস্থা থাকত এবং গণিকাদেরই প্রথমে পরিবেশন করা হত— যেন তারাই প্রধান অতিথি। মাঝে মাঝে সমস্ত দলটাই যানবাহনের সাহায্যে নগরের বাইরে যেত। সেখানে মোরগের বা ভেড়ার লড়াই অথবা অভিনয় হত; সন্ধেয় সকলে ফিরে আসত। গ্রীষ্মকালে জলক্রীড়া, বসন্তে বসন্তোৎসব, ইত্যাদি বিভিন্ন ঋতু উপযোগী উৎসব হত। (কামসূত্র ১:৪:৩৪-৪১, ৪২) গ্রামবাসীরা এদের উৎসব দেখে বর্ণনা করবে ও অনুকরণ করবে। (কামসূত্র ১:৪:৪৯) এই সব উৎসব গণিকারাও নিশ্চয়ই উপভোগ করত; কিন্তু এগুলো অনুষ্ঠিত হত প্রধানত রাজা, বণিক বা ধনী নাগরিকের স্বার্থে ও নির্দেশে। গণিকারা ছিল কতকটা অলংকরণ, কতকটা মার্জিত বিনোদনের উপকরণ।
এ কথা ভুললে চলবে না যে, সমাজে কুলনারীর শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না; মনুসংহিতায় পড়ি নারীর পক্ষে বিবাহই উপনয়ন, পতিসেবা বেদাধ্যয়ন এবং পতিগৃহে বাস হল গুরুগৃহে বাস। (২:৬৭) অতএব বিদ্যাশিক্ষার কোনও সুযোগই কুলনারীর ছিল না, গৃহকর্ম ও সন্তানের জন্ম দেওয়া, শ্বশুরবাড়ির সকলের এবং স্বামী ও সন্তানদের পরিচর্যায় তার দিন কাটত। ফলে, রূপযৌবন চলে গেলে তার সাহচর্য হয়তো অনেক স্বামীর পক্ষে চিত্তাকর্ষক হত না। অন্য দিকে গণিকার শিক্ষাতালিকা প্রকাণ্ড— স্বয়ং কাব্যনাটক রচনা, গীতবাদ্য অভিনয় এবং সকল শিল্পকলা সম্বন্ধে আলোচনা করার ক্ষমতাও তার থাকত। কাজেই ফ্রান্সের ‘সাল’গুলির অধিকর্ত্রীর মতো বা জাপানের সুশিক্ষিতা ‘গেইশা’ নারীদের মতো এদের মানসিক উৎকর্ষ পুরুষকে আকর্ষণ করত। উপযুকক্ত শিক্ষাদীক্ষার অভাবে এ ভাবে আকর্ষণ করার যোগ্যতা কুলনারীর থাকত না। গণিকার শিক্ষা হত রাষ্ট্রের ব্যয়ে এবং সে শিক্ষার মানও যথেষ্ট উন্নত থাকত, অর্থাৎ রাষ্ট্রের পরিচালকদের উদ্দেশ্যই ছিল মার্জিত রুচি এবং শিক্ষার অধিকারী যে মানুষ সে যেন গণিকার কাছেই মানসিক সাহচর্য পায়, বধূর কাছে নয়। প্রথমত, রাষ্ট্র গণিকার কাছে উচ্চহারে রাজস্ব পেত, দ্বিতীয়ত, গণিকারা রাষ্ট্রের চরের কাজও করত। শিক্ষাদীক্ষা-রুচির উৎকর্ষে রূপ যৌবনের মাদকতায় শত্রুপক্ষীয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করে গুপ্ত সংবাদ জেনে গণিকাধ্যক্ষ মারফত রাষ্ট্রের মন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া, প্রয়োজন মতো শত্রুকে ধরিয়ে দেওয়াও এদের করণীয়ের অন্তর্গত ছিল। কাজেই গণিকা এবং গণিকালয় রাষ্ট্রের স্বার্থই সিদ্ধ করত।
এ ছাড়াও ধর্মগ্রন্থে ও সাহিত্যে বারে বারে দেখছি দক্ষিণার বস্তুসম্ভারের তালিকায় হস্তী, অশ্ব, রথ, ভূমি, অলংকারের সঙ্গেই উল্লেখ নারীর। লক্ষণীয় এ দক্ষিণা দেওয়া হত যজ্ঞের পুরোহিতকে এবং দেওয়া হত শয়ে শয়ে, হাজার হাজারে। এর নানা পৃথক শ্রেণিও ছিল, যেমন, সন্তানবতী, নিঃসন্তানা, বিবাহিতা ও কুমারী। মনে প্রশ্ন আসে ঋত্বিক পুরোহিত কী করত এতগুলি নারী নিয়ে? অবশ্যই কিছু সংখ্যককে ভোগ্যবস্তুর মতোই ভোগ করত, কিন্তু বাকিরা? ক্রীতদাসী বা গণিকায় পরিণত হওয়া ছাড়া কি গতি ছিল তাদের?
উদ্দ্যোতন সূরির রচিত কুবলয়মালা গ্রন্থে দেখি স্বর্গে ইন্দ্রের অপ্সরারা ভৃঙ্গারবহন করত; ছত্র, মুকুর, ব্যজন, বীণা, বস্ত্র, মুরজ, ইত্যাদিও বহন করত। ললিতবিস্তার বইতে পড়ি পূর্ণকুম্ভ, মাল্য, অলংকার, সিংহাসন, ছত্র, চামর, গন্ধবারিকুম্ভ, ইত্যাদি বহন করছে প্রাসাদের গণিকারা। বাণভট্টে গণিকারা রাজাকে স্নান করাচ্ছে। নানা স্থানে এদের নানা নাম: মন্দিরে দেববেশ্যা, প্রাসাদে রাজবেশ্যা, ব্রাহ্মণের ব্রহ্মবেশ্যা, তীর্থে তীর্থগা। ব্রহ্মপুরাণ-এ পড়ি একাস্রতীর্থে বহুসংখ্যক বেশ্যার বাস। (৪০:৩০-৩৫) বৌদ্ধ সমাজ বা উৎসবে, যুদ্ধ যাত্রায়, বিজয়োৎসবে, রাজার বিবাহ বা পুত্রজন্ম, যজ্ঞ বা অন্য উপলক্ষে সব সময়েই গণিকারা দলে দলে সমবেত অতিথিদের বিনোদনে নিযুক্ত থাকত। যুধিষ্ঠির যখন অশ্বমেধ যজ্ঞ করছেন তখন অন্যান্য বন্ধুরাজারা যজ্ঞের নানাবিধ উপকরণের সঙ্গে বহু নারীও পাঠালেন। (আশ্বমেধিকপর্ব ৮৫:১৮) যুধিষ্ঠির নিজেও সেই যজ্ঞে দানে দক্ষিণায় বহু শত নারীকে দিচ্ছেন অতিথিরাজাদের আপ্যায়নেও। (আশ্বমেধিকপর্ব ৮০:৩২) রাজা শশবিন্দু তাঁর অশ্বমেধ যজ্ঞে হাজার হাজার নারী দান করেছেন। (দ্রোণপর্ব ৬৫:৬) ভগীরথও হাজারে হাজারে সুসজ্জিত সুন্দরী নারী দক্ষিণা দিয়েছিলেন। (দ্রোণপর্ব ৬০:১, ২; শান্তিপর্ব ২৯:৬৫) শ্রাদ্ধের দক্ষিণার তালিকাতেও বহু নারী দেওয়ার কথা আছে। (আশ্রমবাসিকপর্ব ১৪:৪; ৩৯:২০, মহাপ্রস্থানপর্ব ১:৪, স্বর্গারোহণপর্ব ৬:১২, ১৩) বীরের মতো যুদ্ধ করে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিলে স্বর্গে পুরস্কার পাওয়া যায় অসংখ্য সুন্দরী। (বনপর্ব ১৮৬৮৭, কর্ণপর্ব ৪৯:৭৬-৭৮; শান্তিপর্ব ৬৪:১৭, ৩০; ৯৬:১৮, ১৯, ৮৩, ৮৫-৮৬, ৮৮, ১০৬; রামায়ণ অযোধ্যাকাণ্ড ৭১:২২, ২৫, ২৬; সুন্দরকাণ্ড ২০:১৩) পরবর্তীকালের সংস্কৃত সাহিত্যেও এ ধরনের কথা বিস্তর পাওয়া যায়। (কুমারসম্ভব ১৬:৩৬, ৪৮; রঘুবংশ ৭:৫০; কিরাতার্জনীয় ৯:৫১; শিশুপালবধ ১৮:৬০, ৬১) এছাড়া সুবন্ধুবাণ এবং অন্যত্র এর বহু নিদর্শন পাওয়া যায়।
গণিকার পরিবারের অণুক্রম কোথাও কোথাও পাওয়া যায়। গণিকার মাতাই হল গণিকালয়ের কর্ত্রী; তার বোন হত প্রতিগণিকা, অর্থাৎ প্রয়োজন হলে তার বিকল্প। ভাইকে গীতবাদ্যে কুশল অথবা অভিনেতা হতে হত এবং রাষ্ট্রের পরিচালিত মঞ্চে অন্তত আট বছর অভিনয় করতে অথবা সংগীতে বাদ্যে অংশগ্রহণ করতে হত; তার শিক্ষার ব্যবস্থা এবং আর্থিক দায়িত্বও রাষ্ট্রই বহন করত। তার মুক্তির মূল্য গণিকার চেয়েও বেশি, তার অবস্থা গ্রিক বা রোম সাম্রাজ্যের ক্রীতদাসের মতোই ছিল— অন্তত ওই আট বছর। কোনও কোনও ক্ষেত্রে গণিকার বিবাহের কথাও পাওয়া যায়; গণিকার স্বামীকেও সংগীতে ও অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতে হত; এ অভিনয় গণিকালয়ে রাষ্ট্রের ব্যয়ে ও নির্দেশনাতেই হত (কামসূত্র ৭:২৩, ২৪)। কখনও কখনও গণিকার বিবাহ শুধুমাত্র একটা প্রতীকী অনুষ্ঠান মাত্রেই পর্যবসিত হত। নারদস্মৃতি বলে অব্রাহ্মণের পক্ষে নিম্নবর্ণের স্বৈরিণী, বেশ্যা, দাসী বা নিকাশিনীর (অর্থাৎ যে অন্তঃপুরচারিণী নয়) সঙ্গে সম্পর্ক— যদি তারা অন্যের স্ত্রী না হয়— দোষের নয়; (৭৪, ৭৯) অর্থাৎ, তাঁরা অন্যের স্ত্রী হতে পারত। যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিও এতে কোনও দোষ দেখে না। (২:২৯০) স্কন্দপুরাণ বলে বেশ্যা এক স্বতন্ত্র জাতি, তার স্ববর্ণের বা উচ্চতর বর্ণের কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ঘটলে সে ক্ষেত্রে পুরুষটি দণ্ডনীয় নয়, যদি না সে অবরুদ্ধা অর্থাৎ একটি পুরুষের রক্ষিতা হয়। যদি হয় তারও প্রায়শ্চিত্ত এবং কোনও বেশ্যাগামীর প্রাজাপত্য প্রায়শ্চিত্ত করার কোনও নজির সাহিত্যে মেলে না। বাৎস্যায়নের কাছে গণিকার জীবনে প্রেমের সম্ভাবনাও তাত্ত্বিক ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। (কামসূত্র ১:৬২-৬৫) অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকেও তার মধ্যে মানবীসুলভ আবেগের সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যেমনটা হয়েছে পরবর্তীকালের শাস্ত্রে। অশ্ব ঘোষের একটি অংশত প্রাপ্ত নাট্যখণ্ডে এবং শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকে গণিকার প্রেমের কথা আছে এবং সে প্রেম যথার্থ খাঁটি আবেগ, তাতে কোনও সন্দেহে অবকাশ থাকে না। আরও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সাহিত্যে, কথাসরিৎসাগর, কলাবিলাস এবং অন্যত্রও এ কথা আছে।
কলাবিলাস-এ একটি উপাখ্যান আছে। রাজ্যচ্যুত রাজা বিক্রম নিরাশ্রয় হয়ে অবশেষে এসে পড়লেন গণিকা বিলাসবতীর কাছে। দু’জনের প্রেমের বর্ণনা আছে সবিস্তারে। বিলাসবতী বিত্তশালিনী, সে তার সম্পত্তি সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে বিক্রমকে তাঁর লুপ্ত রাজ্য ফিরে পেতে সাহায্য করল। কৃতজ্ঞতায় বিক্রম তাকে বিবাহ করলেন। একদিন তাকে বিমর্ষ দেখে বিক্রম তার কারণ জানতে চাইলে বিলাসবতী স্বীকার করল তার এক পূর্বপ্রণয়ী আছে, তাকে পাওয়ার জন্যেই তার চিত্ত ব্যাকুল। রাজার আনুকূল্যে প্রেমিকযুগল মিলিত হল। কিন্তু তারপরে রাজার মনে পড়ল মন্ত্রীর সতর্কবাণী; গণিকাকে কখনও বিশ্বাস কোরো না। এ কাহিনিতে গণিকার প্রতি সমাজের তাচ্ছিল্য, বিদ্বেষ ও বিরূপতা তার চিত্তচাঞ্চল্য সম্পর্কে দ্বিধাহীন বিশ্বাস সবই প্রকাশ পেয়েছে, পায়নি শুধু কাহিনির পূর্বার্ধে রাজার মঙ্গলের জন্য তার অকুণ্ঠিত এবং অযাচিত স্বার্থত্যাগ; শেষ পর্যন্ত রাজা তার মনস্কামনা পূর্ণ না-ও করতে পারেন এই সম্ভাবনা মনে রেখেও সে অকৃপণ ভাবে রাজার জন্যে আত্মত্যাগ করেছিল। সমাজের স্বার্থসর্বস্ব অকৃতজ্ঞতার এটি একটি ভাল নিদর্শন।
গণিকালয়ের কর্ত্রী গণিকামাতার কাজ ছিল গণিকা যাতে কোনও ভাবে প্রতারিত বা লাঞ্ছিত না হয় তা দেখা। এবং যথাসম্ভব সর্বপ্রকারে তার স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করা। নানা গ্রন্থে (যেমন কুট্টনীমত, দেশোপদেশ) এ বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশ দেওয়া আছে যার অনেকটাই হল সাধ্যমত প্রার্থীকে বঞ্চিত করা— কন্যা অসুস্থ, পরিশ্রান্ত, বিমর্ষ, ইত্যাদি বলা বা অন্য কেউ আরও বেশি পারিশ্রমিক বস্ত্রালংকার দিতে প্রস্তুত সে কথা জানানো কিংবা কন্যার ঋণ, অভাব, অসুবিধার খবর দেওয়া। (দশরূপক ২:৩৪, সময়মাতৃকা ১:৪-০, ৪৫, কামসূত্র ৭:১:১৩-১৭) এ ছাড়াও ছিল কুট্টনী, সে গণিকামাতা না হলে বৃদ্ধা গণিকাও হতে পারত। তার প্রধান কর্তব্য ছিল উপযুক্ত ধনী, উদার, সৎ এবং বাঞ্ছনীয় প্রার্থীর সন্ধান করা— উভয়ের মধ্যস্ততা করা, কলহ ঘটানো এবং মেটানো, গণিকার স্বার্থে প্রার্থীকে বঞ্চনার ব্যবস্থা করা, ইত্যাদি। কুট্টনী বা শম্ভলী বিগতযৌবনা গণিকা, স্বয়ং গণিকাবৃত্তিতে উপার্জন করবার বয়স পেরিয়ে গেলেও এই বিকল্প বৃত্তিতে সে ভরণপোষণ এবং কিছু কিছু উপার্জনও হয়তো করতে পারত। কামসূত্র-তে কুট্টনীর উল্লেখ আছে চণ্ডালী, মুণ্ডিতা ও বৃদ্ধা গণিকার সঙ্গে; কুট্টনম-তেও তাই। (৫৩২) সময়মাতৃকা (৮:১০২, ৩, ১২) এবং শাঙ্গধর পদ্ধতি-তেও এদের উপার্জন অক্ষমতা ও দারিদ্র্যের কথা আছে। সব বৃদ্ধা গণিকাই তো কুট্টনী বা শম্ভুলী হতে পারত না, যারা ওই পদ পেত না তারাই সংখ্যায় বেশি এবং তাদের দুর্দশা অকল্পনীয়। এর উপার্জনের সুদিনে কতকটা আরামে হয়তো বা অল্প কিছু বিলাসেও অভ্যস্ত ছিল, যৌবনের অন্তে যখন উপার্জনের ক্ষমতা গেছে তখন এদের জন্যে কোথাও কোনও ব্যবস্থা নেই। শুধু ওপরের দিকের কিছু সুপরিচিতা রূপবতী ও গুণবতী বা ধনবতী হিসেবে যারা প্রখ্যাত ছিল সম্ভবত তাদের জন্যেই বিকল্প বৃত্তি (রান্নাঘর, পশম বা তুলো বোনার কাজ)-তে বা রাষ্ট্র থেকে অর্থদানের ব্যবস্থা ছিল। সহজেই অনুমান করা যায় রাষ্ট্র যদি এ কর্তব্যপালনে বিমুখ হয় তো জরতী গণিকার কিছুই করবার থাকে না। একে তো সেযুগে শ্রমিকসঙ্ঘের ব্যবস্থার দ্বারা সাধারণ শ্রমিকেরই স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা দুর্লভ ছিল তার ওপরে গণিকাবৃত্তি এতই ঘৃণিত যে বৃদ্ধা গণিকাকে সমাজ আবর্জনা ছাড়া অন্য কিছুই মনে করত না। ফলে আইনে ব্যবস্থা থাকলেও তা আদায় করার উপায় তার ছিল না। আর অর্থশাস্ত্র ছাড়া অন্যত্র আইনের ব্যবস্থারও উল্লেখ নেই।
দেশোপদেশ-এ দেখি ষাট বছরের বৃদ্ধা গণিকা তরুণী সেজে ব্যবসায়ে অবতীর্ণ হয়ে নিগ্রহ ভোগ করছে। (৩:৩৩) সবচেয়ে করুণ কাহিনি পাই সময়মাতৃকা-য় দীর্ঘ একটি উপাখ্যানে।
‘কঙ্কালী নামে এক সরাইখানার মালিকের মেয়ে শৈশবে, সাত বছর বয়সেই বাজারে বিক্রি হয়ে যায়। সমস্ত যৌবনকাল কাটে হার-ফেরতা হতে হতে গণিকাবৃত্তি অবলম্বন করে। রূপ যৌবন যখন নিঃশেষিত তখন পর পর নানা বৃত্তি অবলম্বন করে গ্রাসাচ্ছাদন করার দুশ্চেষ্টার পালা শুরু হল। সে তীর্থক্ষেত্রে তীর্থযাত্রীদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে ধরা পড়ে যায় ও জেল খাটে। সেখানে কারারক্ষীকে হত্যা করে পালিয়ে যায় এক মঠে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত আয়াসের জীবনে অভ্যস্ত বলে মঠের কষ্ট সহ্য হয় না, তাই ভিক্ষা করে দিনযাত্রা নির্বাহ করতে থাকে। এমন সময়ে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ, বন্ধ হয়ে গেল ভিক্ষা পাওয়া। তখন একটি শিশুকন্যার ধাত্রীর চাকরি নেয়। অনভ্যাসে এবং প্রৌঢ় শরীরে পরিশ্রম সইছিল না বলে একদিন শিশুটির সোনার হার চুরি করে পালায়। হার বিক্রির টাকা ফুরোলে জুয়ো খেলার ঘুঁটি নিয়ে প্রতারণা করে রোজগার শুরু করে। কিছুদিন বেশ চলে, কিন্তু একদিন ধরা পড়ে গেল, তখন আবার ভিক্ষা। অসহ্য হলে খিদের জ্বালায় এক মন্দিরে লুকিয়ে থেকে দেবতার নৈবেদ্য চুরি করে উদরপূর্তির ব্যবস্থা করে। সেখানেও ধরা পড়ে যায়, তখন শুরু করে মদ বিক্রি। তাতে পোষাল না যখন তখন তাকে দেখা গেল গণৎকারের ভূমিকায়। তাতেও ধরা পড়ে, তখন অভিনেত্রী হয়ে চালায় কিছুদিন। কিন্তু তার পক্ষেও যোগ্যতা নেই বলে নিরুপায় হয়ে পাগলীর ভান করে ঘুরে বেড়ায়। হঠাৎ মাথায় একটা কূটকৌশলের উদয় হয়; কঙ্কালী ঘোষণা করে যে শত্রুসৈন্যকে জাদুবলে পক্ষাঘাতে অসাড় করে দিতে পারে। আশ্চর্য নয়, এতে স্বয়ং রাজা তাকে সাগ্রহে প্রাসাদে স্থান দিলেন। বেশ চলল কিছুকাল, হঠাৎ খবর এল সে রাজ্য আক্রান্ত হতে চলেছে। কঙ্কালী বুঝল এখন যঃ পলায়তে স জীবতি। দেশে ফিরে অগত্যা কুট্টনীবৃত্তিতে দিনপাত করতে শুরু করল।’ (সময়মাতৃকা ২:২৮-৮০)
বোঝাই যায় একাধিক বৃদ্ধা গণিকার অভিজ্ঞতার সমাহার পাওয়া যায় এই কঙ্কালী উপাখ্যানে। এ-কাহিনিতে কৌতুকের অন্তরালে একটি অসহায় বৃদ্ধার শুধুমাত্র বেঁচে থাকার চেষ্টা এবং সমাজের কোনও দরজা খোলা না পেয়ে কুট্টনীবৃত্তিতে ফিরে আসার করুণ ইতিহাসটি বিধৃত আছে। অল্প বয়সে রূপযৌবনের দিনে খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার তরুণ কায়িক পরিশ্রমের অভ্যাস তাদের থাকে না; বেশি বয়সে আর নতুন করে তা পারে না; ফলে গ্রাসাচ্ছাদনের কোনও রাস্তাই খোলা থাকে না বৃদ্ধা গণিকার। কঙ্কালীর সেদিক থেকে ভাগ্য ভাল, কুট্টনীর পদ পেল সে; কিন্তু শতকরা নিরানব্বইটি বৃদ্ধা গণিকার সহায় সম্বল, আত্মীয়বল, সঞ্চয় বা অর্থোপার্জনের উপযুক্ত বিকল্প কোনও বৃত্তির শিক্ষা থাকে না; ফলে বার্ধক্যে জীবনসংগ্রামে তারা তরঙ্গতাড়িত কাষ্ঠখণ্ডের মতোই ভেসে বেড়ায়।
কুট্টনী ছাড়াও গণিকার সহায়ক থাকে— পীঠমর্দ ও বিট। পীঠমদ হল নাগরকের শিক্ষক ও সহচর; তার ইপ্সিত নারীকে লাভ করাতে সহায়তা করে। (দশরূপক ২:৮) বিট নাগরকেরও থাকত, গণিকারও থাকত। গণিকার বিট হত ধনীগৃহের সন্তান, অপচয়ের ফলে দরিদ্র; শিক্ষিত, বাগ্মী, গণিকার পরিচর্যায় কুশল, মধুরস্বভাব, বুদ্ধিমান; কোন কথা উচ্চারণ করে বলবার আর কোনটা নয় তা জানে, অনুক্ত কথাও প্রয়োজন মতো বুঝতে পারে। সে প্রার্থী ও গণিকার মিলন ঘটায়, কলহ মেটায়, গণিকার সব রকম স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সচেষ্ট থাকে, কথায় ও কাজে তার আনুকূল্য করে। চতুর্ভাণী ও অন্যান্য ভাণ গোত্রের একাঙ্ক একচরিত্রক নাটকে বিটের ভূমিকা বেশ বোঝা যায়। মৃচ্ছকটিক নাটকেও বসন্তসেনার বিট এক তাৎপর্যপূর্ণ চরিত্র।
বৈদিক যুগ থেকেই সাহিত্যে গণিকার দেখা পাওয়া যায়; শাঙ্খায়ন আরণ্যক-এ পুংশ্চলী ও ব্রহ্মচারীর আলাপ ও অথর্ববেদ-এর ব্রাত্যসূক্তে পুংশ্চলীর সঙ্গে মাগধের উপস্থিতির কথা আছে। পরবর্তী সাহিত্যে গণিকার উৎপত্তি বিষয়ে নানা কাল্পনিক উপাখ্যান পাই। মহাভারতের মৌষলপর্বে দেখি যাদব-বৃষ্ণিবংশের নারীদের দস্যুরা হরণ করে নিয়ে যায়, ফলে তারা গণিকা হয়ে যায়। ঋষি দাল্ভ্যচৈকিতায়ন ও শ্বেতকেতুর ভ্রাতুষ্পুত্র অষ্টাবক্র মদ্র-অধ্যুষিত কুরুপাঞ্চাল ও সিন্ধসৌবীর অঞ্চলে কামশাস্ত্র শিক্ষা দিতেন, এর একটি অংশ গাণিক্য বা গণিকাবিষয়ক। মহাভারত-এ (কর্ণপর্ব ২৭:৩০, ৫৭:৫৯) ও মৎস্যপুরাণ (৭০ অধ্যায়)-এ গণিকার উদ্ভব সম্বন্ধে অন্য উপাখ্যান পাওয়া যায়। ক্ষেমেন্দ্র তাঁর সময়মাতৃকা গ্রন্থে বলেছেন দুশ্চরিত্রা জননীরা পরপুরুষের দ্বারা ভুক্ত তাদের কন্যাদের অন্যদেরকে দান করত; এরাই গণিকা হয়ে যেত। (সময়মাতৃকা ৩:১৮)
ঠিক কেমন করে গণিকা সমাজে গণিকারূপে দেখা দিল তা আজ নির্ণয় করা কঠিন; তবে সাহিত্যে কিছু কিছু সূত্র পাওয়া যায় যার থেকে অনুমান করা যায় গণিকারা সমাজের কোন কোন পথ ধরে আসত। যেমন বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্র-তে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন কেমন করে কুলকন্যাকে কোনও পুরুষ প্রলুব্ধ করে নিজের অনুকূলে এনে ভোগ করতে পারে। (কামসূত্র ৩:৫:১৪-১৬) ভোগের পরে এই কন্যাদের সমাজে কী স্থান হতে পারে? সহজেই অনুমান করা যায় যে, তাদের অধিকাংশই গণিকালয়ে যেতে বাধ্য হত। সংস্কৃতে দুটি শব্দ আছে; জায়াজীবী ও জায়োপজীবী, অর্থাৎ যে পুরুষ স্ত্রীর উপার্জনে দিনপাত করে। এ উপার্জন গণিকাবৃত্তি থেকে। জায়াজীবীর পাপটা গুরুতর নয়, উপপাতক মাত্র। সামান্য চন্দ্রোয়ণ ব্রতেই তার প্রায়শ্চিত্ত হত। (বিষ্ণুপুরাণ ৩৭ অধ্যায়; যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি ২৪০) এই স্ত্রীরা বাড়িতে থেকেই গণিকাবৃত্তি অবলম্বন করে উপার্জন করে পরিবারের ভরণপোষণ করত। উৎসবে, যুদ্ধজয়ে, যজ্ঞে, দানে, দক্ষিণায়, নারীকে বস্তুর মতোই দান করা হত। এদের মধ্যে এমনও দুর্ভাগিনী আছেন যাঁদের দেহের বিনিময় মূল্যে অন্য একজন পুণ্য অর্জন করছে (মহাভারতে উদ্যোগপর্বে ১১৪-১৮)। আবার এক ধনী শ্রেষ্ঠীর কথা শুনি তাঁর অসামান্য রূপবতী কন্যারা একরাত্রে যে মূল্য নিরূপণ করেন তা সমগ্র কাশীরাজ্যের রাজস্ব; ফলে কোনও প্রার্থীই পাওয়া যায় না। শেষে কন্যা তার মূল্য অর্ধেক বলে ঘোষণা করায় তার নাম হল ‘অর্ধকাশী’। কাজেই দেখছি শুধু জায়াজীবীর স্বামী নয়, দুস্থ, হতভাগ্য বা অর্থলোভী, নিষ্ঠুর পিতাও গণিকাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে দেখলে দেখি দানে দক্ষিণায় যাদের বিতরণ করা হত তারাই যথার্থ ভাবে গণিকাবৃত্তির সংখ্যাবৃদ্ধি করত কারণ এরা সত্যিই অগণ্য। নারীকে, প্রধানত সুন্দরী তরুণীকে, যজ্ঞে, যৌতুকে, শ্রাদ্ধে, যুদ্ধজয়ে, দানে ও দক্ষিণায় দেওয়ার অসংখ্য উল্লেখ রামায়ণ-এ আছে। (অযোধ্যাকাণ্ড ১১, ২২, ২৫, ২৬; কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড ২০:১৩; ২৪, ৩৪) মহাভারত-এও (বনপর্ব ১৮৬:৭, কর্ণপর্ব ৪৯:৭৬-৭৮; শান্তিপর্ব ৯৮:৪৫; অনুশাসনপর্ব ৯৬:১৮, ১৯, ৮২) গণিকা সভামণ্ডনা এবং যুদ্ধে ও মৃগয়ায় বিনোদিনী। অভিজ্ঞানশকুন্তলম-এ দ্বিতীয় অঙ্কে দুষ্যন্তের মৃগয়াসহচারিণী যবনীদের কথা পাই। কুমারসম্ভব-এ (১৬:৩৮, ৪৮) রঘুবংশ-তে (৭:৫০) এবং পরবর্তীকাব্যে বিলাসের উপকরণরূপে বহুবার নারীকে দেখা যায়। অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পরাজিতপক্ষের নারীদের জয়লব্ধ অন্যান্য সম্পদের মতোই নিয়ে আসেন। (বনপর্ব ৮:২৭) বিরাটরাজা অর্জুনের শৌর্যে এবং জয়ে প্রীত হয়ে পারিতোষিক দিয়েছিলেন বহু সুন্দরী তরুণী। (বিরাটপর্ব ৩৪:৫) যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণ ঘোষণা করেছিলেন, যে অর্জুনকে চিনিয়ে দেবে তাকে একশত সুন্দরী দান করবেন। (দ্রোণপর্ব ৩৮:৪ থেকে) যে রাজা সুন্দরী নারী দান করেন না তাঁর নিন্দাসূচক নাম ‘রাজকলি’, অর্থাৎ রাজাদের মধ্যে কলিস্বরূপ (শান্তিপর্ব ১২:৩৬৬)। দ্রৌপদীর বিবাহে যৌতুকের সঙ্গে একশত সুন্দরী তরুণী ছিল; (আদিপর্ব ১৯৮:১৬) সুভদ্রার বিবাহে এক হাজার সুন্দরী তরুণী অতিথিদের স্নান, সুরাপান, ইত্যাদির সহচরী ছিল। (আদিপর্ব ২২১:৪৯, ৫০) যুধিষ্ঠির, শশবিন্দু, ভগীরথ, সগর,— সকলেই সুন্দরী কন্যাদের ‘বিতরণ’ করেছিলেন। এমন কথাও শুনি যে, সুন্দরী তরুণী ব্রাহ্মণদের দান করা অতি প্রশস্ত। (বনপর্ব ৩১৫:২, ৬; ২৩৩:৪; বিরাটপর্ব ১৮-২১; শান্তিপর্ব ৬৮:৩৩, ১৭১:৫, ১৭৩:১৬) এর দ্বারা দাতা স্বর্গে প্রচুর পুরস্কার লাভ করে, অর্থাৎ স্বর্গে বহুসংখ্যক অপ্সরা তার তৃপ্তিবিধান করে (অনুশাসন পর্ব ১৪৫:২)।
স্পষ্ট, এই ধরনের পুণ্য ও পুরস্কারের লোভ দেখানোর দ্বারা ব্রাহ্মণরা বহু সুন্দরী নারীকে দান হিসেবে লাভ করতেন; দাতাকে অবশ্য প্রতীক্ষা করতে হত মৃত্যু পর্যন্ত স্বর্গের অপ্সরার সঙ্গ লাভের জন্যে। সহজেই বোঝা যায়, পৃথিবীর গণিকার কাল্পনিক রূপায়ণ স্বর্গের অপ্সরার মধ্যে। পিতা বা পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধেও দানসামগ্রীর তালিকায় হাজারে হাজারে সুন্দরী তরুণীর উল্লেখ আছে। পেতেন পুরোহিত ব্রাহ্মণেরা। (আশ্রমবাসিবপর্ব ১৪:৪, ২, ৩৯; মহাপ্রস্থানপর্ব ১:৪; স্বর্গারোহণপর্ব ৬:১২, ১৩) সহজেই বোঝা যায় এই সব অগণিত নারীর কী পরিণতি হত। বোঝা যায় ঋত্বিক-পুরোহিতদের সাধ্য ছিল না এতগুলি নারীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার। অতিশয়োক্তি বাদ দিলেও তো এদের সংখ্যা শঙ্কাবহরূপে বেশি, কাজেই কিছুদিন পরেই এরা ক্রীতদাসী বা গণিকায় পরিণত হত। এবং ব্যাপারটা ঘটত ধর্মযাজকদের মাধ্যমেই, কারণ, এ সব দক্ষিণার গ্রহীতা তাঁরাই। অন্য যাঁরা, অতিথি বন্ধু প্রিয়জন, উৎসবে বা কোনও উপলক্ষে দানস্বরূপে অনেক নারী লাভ করতেন তাঁরাও নিশ্চয়ই এদের অনেককেই বিক্রি করতেন দাসীত্বে বা গণিকাত্বে। এ ছাড়াও অন্য বহু সূত্র ধরে নারী আসত গণিকালয়ে। বিবাহে নারীর কৌমার্য— পুরুষের নয়(!)— যখন অত্যাবশ্যক মানদণ্ড হয়ে উঠেছে তখন যে কোনও কারণে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যে তরুণীর কৌমার্য নষ্ট হয়েছে সে বিবাহের অযোগ্য বলে পরিগণিত হত। এবং বিবাহ যে নারীর পক্ষে কেমন অলঙ্ঘনীয় বিধান হয়ে উঠেছিল— খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক বা তারও বহু আগে থেকে— তার প্রমাণ মহাভারতের বহু কাহিনিতে আছে, যেখানে বৃদ্ধা তপস্বিনীকে শুনতে হয়েছে অন্তত একরাত্রির জন্যে কোনও পুরুষের ভার্যাত্ব না স্বীকার করলে স্বর্গে তার প্রবেশও নিষেধ। এ ক্ষেত্রে বিবাহিত জীবনের বাইরে নারীর কোনও ভূমিকাই ছিল না; দু-একটি ব্রহ্মবাদিনী বা পণ্ডিতকৌশিকীর উল্লেখ করে এ সত্য খণ্ডন করা যায় না। অতএব যে হৃতকৌমার্য নারী বিবাহের জগতে অচল বলে গণ্য হল, তার অন্য যে প্রশস্ত পথটি খোলা ছিল তা গণিকালয়ের অভিমুখে। যে সমাজ নারীর ‘সতীত্ব’ সংরক্ষণে এতই তৎপর সেই সমাজই এ ভাবে অনিবার্য করে তুলেছিল নারীর গণিকাত্ব স্বীকার করা। এর পিছনে তার স্বার্থও ছিল, তা পরে আলোচনা করছি। এ ছাড়াও, রাজারও অধিকার ছিল গ্রামের বা শহরের সুন্দরী তরুণীকে যথেচ্ছ ভোগ করার। বিদর্ভে রাজারা কয়েক দিনের জন্যে সুন্দরী তরুণীদের ভোগ করে পাঠিয়ে দিত; বৎসগুল্ম রাজ্যে মন্ত্রীপত্নীদের রাজা প্রাসাদে ডেকে পাঠলেই যেতে হত। এরা ফিরে এলে, ধরে নেওয়া যায় কখনও কখনও রাজার অনুগত কেউ কেউ এদের বিয়ে করত; কিন্তু বাকি অধিকাংশের পরিণতি কী হত তা সহজেই অনুমান করা যায়।
সুন্দরী নারী কিনে দেবালয়ে উপহার দিলে দাতার পুণ্য হয়; অতএব দেবদাসী দানের পুণ্য অর্জনের জন্যে দুস্থ পিতামাতার কন্যাদের কিনে দলে দলে মন্দিরে পাঠিয়ে পুরোহিতের ভোগ্যা করে তুললে দু’বার পুণ্য হয়: দেবতা প্রীত হন, পুরোহিতও। যুদ্ধে পাওয়া বন্দিনী নারী অনাদিকাল থেকে সকল সমাজেই গণিকালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। অবশ্য এরা অনেক সময়েই অনেকটা ঘুরপথে এসে পৌঁছত। প্রথমে সেনাপতি বা রাজার অন্তঃপুরে অন্যান্য বহু নারীর সঙ্গে একান্ত একটি পুরুষের ভোগ্যবস্তু হয়ে দিন কাটাত; পরে গৃহস্বামীর অন্যান্য পুরুষ আত্মীয়দের; এবং সবশেষে গণিকালয়ে এসে পৌঁছত এরা। যুদ্ধ ছাড়াও দেশের দুর্দিনে দুর্ভিক্ষে বা রাষ্ট্রবিপ্লবে দুস্থ পিতামাতা ভরণপোষণে অক্ষম হয়ে কখনও কখনও কন্যা বিক্রয় করতেন প্রথমে তারা ধনীগৃহে, রাজঅন্তঃপুরে, মন্দিরে স্থান পেত এবং রূপযৌবন খানিকটা ম্লান হলে গণিকালয়ে আসত। আবার সরাসরি গণিকালয়েও কন্যা বিক্রয় করার ব্যবস্থা ছিল।
গণিকার কন্যারাও গণিকাই হত। পুত্ররা বন্ধুল। মৃচ্ছকটিক নাটকে বড় করুণ ভাবে আত্মপরিচয় দিয়েছে বন্ধুলরা: ‘পরের গৃহে লালিত, পরের অন্নে পুষ্ট, পরপুরুষের দ্বারা পরনারীতে জন্ম আমাদের।’ এ পরিচয় গণিকাকন্যারও; কাজেই তার কাছে সমাজে সদর রাস্তা সবই বন্ধ, গণিকাবৃত্তিই তার জীবনধারণের একমাত্র উপায়। কখনও সে গণিকা, কখনও রূপাজীবা, কখনও অবরুদ্ধা এবং রূপ-যৌবন বিদ্যা গুণ না থাকলে সাধারণ বেশ্যা।
যে সমাজে ‘সতী’ শব্দের পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ ছিল না, যেখানে ‘চরিত্র’ বলতে শুধু যৌন ‘শুচিতা’ই বোঝায় এবং যেখানে চিরকাল পুরুষের যৌন মাধুকরীবৃত্তিকে বহু ভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়ে এসেছে, সেখানে নারীর সামান্যতম পদস্খলন বরাবরই চূড়ান্ত ভাবে দণ্ডিত হয়ে এসেছে। সমাজের কঠোর দণ্ডে, আত্মধিক্কারে পিতৃগৃহ ও স্বামীগৃহের দরজা যখন সহজেই বন্ধ হয়েছে তথাকথিত ‘ভ্রষ্টা’ নারীকে সেখানে মুহূর্তের ভ্রান্তির চড়া দাম শোধ দিতে হয়েছে গণিকালয়ে জীবন অতিবাহিত করে। বিশেষত, সমাজ যেখানে প্রায় দু’ হাজার বছর ধরে নারীকে অর্থকরী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে এসেছে, এবং ফলে, সসম্মানে সৎপথে থেকে জীবিকা অর্জন তার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব সেখানে এই বৃত্তি তাকে গ্রাসাচ্ছাদনের একটা আশ্বাস দিত। দানে দক্ষিণায় যৌতুকে (স্মরণীয়, শর্মিষ্ঠা দেবযানীর উপাখ্যান) যে নারী অন্যের ভোগ্যা হয়ে উঠত সেখানে গ্রাসাচ্ছদন ছাড়া আর কিছু পাওয়ার তার অধিকার থাকত না, একমাত্র গণিকারূপেই সে অর্থমূল্য পেত।
কিন্তু মানুষ হিসেবে সমাজের কাছে তার পাওনা ছিল অবিমিশ্র অবজ্ঞা, ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য। ধরা যাক মৃচ্ছকটিক-এর নায়িকা বসন্তসেনার কথাই (একমাত্র তারই পূর্ণাবয়ব চিত্র আমরা সাহিত্যে পাই)। রূপে যৌবনে সে অতুলনীয়া, শিক্ষাদীক্ষায়, রুচিতে চরিত্রে মহানুভবতায় সে অনন্যা— উজ্জয়িনীর নগরলক্ষ্মী। কিন্তু তার নিজের অনুচর বিটই বারে বারে তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, সে শ্মশানের জুঁই গাছের ফুলের মতোই, কোনও শুভকাজে লাগে না; সে বেশ্যা, সর্বজনভোগ্যা, পণ্যদ্রব্যের মতোই, তার পছন্দ-অপছন্দ ভাললাগা-মন্দলাগা থাকতে পারে না। এই তাচ্ছিল্য যদি গণিকাশ্রেষ্ঠা বসন্তসেনার প্রাপ্য হয় তবে অন্যদের কথা না বলাই ভাল। যার নাম নগরশোভনা, নগরমগুনা, জনপদকল্যাণী তার অন্যান্য নামগুলির মধ্যে প্রগাঢ় অবজ্ঞা ঘৃণা প্রকাশ পায়। গণিকা সম্বন্ধে সমাজের এ দ্বৈধমনস্কতা একটা লক্ষণীয় ব্যাপার।
গণিকাগমনে পাপ, যদিও প্রায়শ্চিত্ত যৎসামান্য। গণিকাসংসর্গের পাপের জন্যে প্রাজাপত্য প্রায়শ্চিত্ত বিধান অনেক ধর্মশাস্ত্রকারই দিয়েছেন। (বিষ্ণুপুরাণ ১০৩:৪; অত্রিসংহিতা ২৬৭; সংবর্তসূত্র ১৬১; পরাশর সংহিতা ১০:১৫) মহাভারত-এও শান্তিপর্ব ও অনুশাসনপর্বে গণিকা সম্বন্ধে অনেক নিন্দাসূচক কথা আছে এবং গণিকাসংসর্গে পাপ হয় এ কথাও বলা হয়েছে। গণিকার অন্নগ্রহণে পাপ, গণিকাস্পর্শ বর্জনীয়। লেখা আছে নগরের দক্ষিণ দিকে, যমের দিকে গণিকালয় নির্মাণ করতে হবে; মানসোল্লাস নামে মধ্যযুগের এক গ্রন্থ বলে, গ্রাম বা নগরের প্রত্যন্তদেশে, অর্থাৎ লোকালয়ের সীমান্তের বাইরে থাকবে গণিকালয়। (গ্রিসে কিন্তু নগরের সুন্দরতম অঞ্চলে থাকত গণিকালয়। মৃচ্ছকটিক নাটকেও মনে হয়, নগরের মধ্যেই ছিল বসন্তসেনার সাতমহলা প্রাসাদ; চতুৰ্ভাণী-তেও সেই ধারণা হয়।) ‘গণিকা’ পদ পাওয়া যেত রূপ গুণ বিদ্যাবুদ্ধি আকর্ষণী মাধুরী ইত্যাদির সমন্বয়ে। (কামসূত্র ১:৩:২০) কৌটিল্য বলেন, মার্জিত, গুণবতী সুন্দরী তরুণীকেই গণিকাধ্যক্ষ ‘গণিকা’ আখ্যা দেবেন। (অর্থশাস্ত্র ২:২৭) সেই গণিকারই সমাজের দৃষ্টিতে এই স্থান, তাহলে রূপাজীবা বেশ্যা স্বৈরিণীদের কী চোখে দেখা হত তা তো স্পষ্টই বোঝা যায়।
গণিকার প্রধান প্রত্যক্ষ অপরাধ হল এই যে সে তার রূপেগুণে শিক্ষাদীক্ষায় কুলপুত্রকে প্রলুব্ধ করে। দ্বিতীয় অপরাধ হল সে কুলপুত্রের অর্থ শোষণ করে নানা ছলে ও কৌশলে। প্রায় সব বৈশিকতন্ত্র জাতীয় গণিকাসম্বন্ধীয় গ্রন্থই বিস্তারিত নির্দেশ দিয়েছে কী ভাবে ছলনা করে গণিকামাতা বা গণিকালয়ের কর্ত্রী বা গণিকা স্বয়ং তার প্রার্থীর কাছ থেকে অর্থ নিষ্কাশন করে নিতে পারে। কামসূত্র-তে বাৎস্যায়ন স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন গণিকা নাগরকের কাছে নিজের এবং নাগরকের বস্ত্র ও অলংকার চুরি হয়ে যাওয়ার মিথ্যা গল্প করবে; সে যে অভাবগ্রস্ত তা বারে বারে বলবে; অন্য নাগরক তাকে আরও বেশি অর্থ, বস্ত্র ও অলংকার দিতে প্রস্তুত এ কথাও সুযোগ মতো শোনাবে, যাতে নাগরক তাকে এমনিতে যা দিত তার চেয়ে বেশি দেয়। (৬:২:৩-২৩) এ সব শিক্ষা পুরুষের রচিত গ্রন্থেই পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, বাৎস্যায়নের এই সুদীর্ঘ নির্দেশাবলির পিছনে যে চেতনা সক্রিয় তা হল গণিকার প্রবঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা— তাকে যে নিজের স্বার্থ নিজেকেই দেখতে হবে সর্ব উপায়ে যথাসম্ভব বেশি অর্থাগমের চেষ্টা করতে হবে তার বর্তমানের দিনপাতের জন্যে এবং অসমর্থ বার্ধক্যের জন্যেও এই বোধ।
গণিকাবৃত্তির মূল কথাটা একটা ব্যবসায়িক সম্পর্ক এবং অর্থশাস্ত্র-তে বণিককে তার শ্রীবৃদ্ধির জন্যে যে ভাবে উপদেশ দেওয়া যেতে পারত, কামশাস্ত্র-তে গণিকার স্বার্থরক্ষার জন্যে সেই রকমই উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এ সব গ্রন্থ গণিকার রচিত নয়, পুরুষেরই রচিত এবং বহু-অনুপুঙ্খযুক্ত নির্দেশাবলির একটিই উদ্দেশ্য: প্রার্থীকে প্রতারণা করে বা যথাসম্ভব বঞ্চিত করে অর্থ সংগ্রহ করা। গণিকা যখন এই নির্দেশ অনুসারে আচরণ করে তখন তার ওপরে বর্ষিত হয় ভর্ৎসনা ও নিন্দা। অন্য দিকে আইনের দিকে যখন তাকাই তখন দেখি গণিকার স্বার্থরক্ষার জন্যে যে আইন আছে অর্থদণ্ডের তার ভিন্ন ভিন্ন ধারায় কত নির্যাতনের কথা আছে। গণিকা এবং তার কন্যাকে অনিচ্ছায় ধর্ষণ থেকে শুরু করে অপমান, লাঞ্ছনা, অঙ্গচ্ছেদ (হাত বা কান কেটে দেওয়া), অন্যান্য শারীরিক অত্যাচার, সম্পত্তিহরণ, ইত্যাদি নানা রকম নির্যাতন ও লাঞ্ছনাই তার কপালে জুটত। সমাজে তার মূল্য বা স্থান নেই; উপার্জনই তার একমাত্র ভরসা এবং সে উপার্জনও ধূর্ত লম্পটের কবল থেকে নিরাপদ নয়। তার রোগে দেখবার কেউ নেই, বার্ধক্যে ভরণ করবার কেউ নেই, আত্মীয়বান্ধবদের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে সে যে সর্বতো ভাবে নিজের সম্পত্তিটুকু বজায় রাখবার এবং বাড়াবার চেষ্টা করবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এবং কী ভাবে সে তা করতে পারে, নানা গ্রন্থ তাকে সে সম্বন্ধে উপদেশ দিয়েছে। তার তবে করণীয় কী? নিজের স্বার্থ, ভবিষ্যৎ ও গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থানের চেষ্টা না করা? এটা তো স্পষ্ট যে তাকে ঠকাবার জন্যে কুলপুত্রের কোনও দ্বিধা নেই। কাজেই সমস্ত ব্যাপারটারই প্রতিষ্ঠা পারস্পরিক প্রতারণার ওপরে, কিন্তু গঞ্জনা জোটে গণিকারই ভাগ্যে, কুলপুত্রের নয়।
সময়প্রদীপ গ্রন্থে অনুকূল যাত্রার যে সমস্ত লক্ষণ দেওয়া আছে তার মধ্যে বৎসযুক্তা ধেনু, বৃষ, অশ্ব, রথ, দক্ষিণাবর্তবহ্নি, দেবীপ্রতিমা, পূর্ণকুন্ত, মাল্য, পতাকা, শ্বেততণ্ডুল, ইত্যাদির সঙ্গেই আছে “দ্বিজনৃপগরিকাঃ’। এ গুলি ‘দ্রষ্ট্র বা শ্রুত্বা পঠিত্বা চ, ফলমিহ লভতে মানবো গন্তু কামঃ— দেখে, শুনে, পড়ে, যাত্রায় উদ্যত ব্যক্তি ফললাভ করে’ (বিষ্ণুস্মৃতি ২৯-এও আছে)। তেমনই দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণের জন্যে যে যে স্থানের মৃত্তিকা সংগ্রহ করতে হয় তার মধ্যে গণিকাগৃহের মৃত্তিকা একটি আবশ্যিক উপাদান। এ রহস্যের কতকটা সমাধান হয়তো হয় যখন মনে পড়ে মহাব্রতা যাগে পুংশ্চলীর সঙ্গে ব্রহ্মচারীর সংলাপ কিংবা ব্রাত্যস্তোমে পুংশ্চলী ও মাগধ হচ্ছে ব্রাত্যের সহচর। নৃতত্ত্বের গ্রন্থে দেখি— যা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হত— ক্ষেত্রকে ফলপ্রসূ করার একটি প্রণালী হল ক্ষেত্রের ওপরেই নারীপুরুষের মিলন। যৌনশক্তির প্রতীক হিসেবেই গণিকা এই সব যজ্ঞীয় অনুষ্ঠানে স্থান পেয়েছে; ক্রমে সে যৌনতারই প্রতীক হয়ে উঠেছে; তাই তার গৃহমৃত্তিকা শস্যের অধিষ্ঠাত্রীদেবী দুর্গার মূর্তি নির্মাণে অপরিহার্য, এবং অন্যান্য শুভবস্তুর সঙ্গে তারও উল্লেখ যাত্রায় সুলক্ষণ হিসেবে। এই শ্লোকে মূল শব্দ ক’টি লক্ষণীয়: ফলমিহ লভতে। যদিও গণিকার জননীত্ব গৌণ তবু তার যৌনত্বই উর্বরতার আবহ বহন করে বলে বেদ থেকে দুর্গাপূজা পর্যন্ত কৃষিজীবী সমাজে তার এই স্থান।
সমাজের এই দ্বৈধমনস্কতা সত্যিই খুব তাৎপর্যপূর্ণ: কোনও মতেই সমাজের কর্তারা স্থির করতে পারছে না গণিকা সম্বন্ধে তাদের মনোভাব কী হবে। কামসূত্র ও অর্থশাস্ত্র-তে দেখি রাজা, ধনী, বণিক, নাগরক সকলে অকুণ্ঠ ভাবে গণিকাসঙ্গ করেন, শাস্ত্র তার নির্দেশ দেয়। গ্রামীণ ও নাগরিকরা এই ‘গোষ্ঠী’ উৎসব দেখে আনন্দ অনুষ্ঠানের, ভোগবিলাসের প্রক্রিয়া বলে বর্ণনা করবে ও অনুকরণ করবে। পুরাণ গণিকার জন্যে স্বতন্ত্র এক ব্রতেরও বিধান দেয়, এর নাম অনঙ্গব্রত (বিষ্ণুপুরাণ ৭০ অধ্যায়) যাতে তার বৃত্তি সাফল্যযুক্ত হয়। অতএব সমাজে স্পষ্ট দুটি মনোভাব যেন বিদ্যমান। প্রথমটি হল গণিকা একটি প্রয়োজনীয় অশুভবৃত্তি আর দ্বিতীয়টি হল গণিকা সর্বতো ভাবে অশুভ ও পরিহার্য।
মানুষ তো জানে অন্য সব বৃত্তির মতোই এ বৃত্তিরও সৃষ্টি হয়েছে সমাজের একটি অংশের পুরুষের প্রয়োজন মেটাতে। কোনও শিশুকন্যাই জন্মাবধি গণিকা হয় না, সমাজই তাকে গণিকায় পরিণত করে নিজের প্রয়োজন মেটাতে। যদিও অধিকাংশ গণিকাবৃত্তিধারিণীই ছিল রুপেগুণে হীন অতএব উপার্জনে দীন, তবুও যে ক’জন শিক্ষিতা নারীর মোহে কুলপুত্র আকৃষ্ট হয় তাদের সম্বন্ধে বিদ্বেষের ভাব থাকে, কারণ গৃহে স্ত্রীপুত্রকে অবহেলা করে অর্থ ও অনুরক্তি অন্য এক নারীকে উৎসর্গ করার মধ্যে গ্লানি ও অপরাধবোধ থাকে। এর জন্যে সে নিজেকে দোষ দেয় না, দেয় গণিকাকে কারণ সে-ই নরকের দ্বার। সমস্ত প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে যে মৌলিক বহু অন্যায় নিহিত তা তার চোখে ধরা পড়ে না, যদিও সম্ভবত অবচেতন মনে সে অবহিত বলেই তার চেতন সত্তা সমস্ত অপরাধের দায়িত্ব গণিকার ওপরে চাপিয়ে নিজের দোষস্খালনের চেষ্টা করে। নিজের স্ত্রীতে তৃপ্তি নেই বলে যে পুরুষ অন্য নারীর সঙ্গ কামনা করে সে-তো জানে নিজের স্বামীতে যে নারী চরিতার্থ বোধ করে না সমাজ তার জন্যে কোনও বিকল্প ব্যবস্থা রাখেনি। ব্যবস্থা থাকলেও সম্পত্তিতে অধিকার নেই যে নারীর তার পক্ষে বাসনা চরিতার্থ করার মতো অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। কাজেই এই অসম সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেও তো পুরুষের একটা আত্মগ্লানির হেতু ছিল। তৃতীয়ত, এবং প্রধানত, যে সমাজ ব্যবস্থা একটি নারীর সুস্থ জীবনযাত্রার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে তাকে এই বিকৃত জীবনযাপনে বাধ্য করে, যে বৃত্তিতে তার সুস্থ হৃদয়বৃত্তির এবং সর্বোপরি তার মনুষ্যত্বের চূড়ান্ত অপমান ঘটছে— সে সমাজ অগত্যাই নিজের সমস্ত কলঙ্কের বোঝা চাপিয়েছে গণিকার প্রতিকারহীন বৃত্তির ওপরে। চাহিদা না থাকলে গণিকা সৃষ্টিই হত না; চাহিদা এসেছে পুরুষের কাছ থেকে; শুধু তাই নয় প্রধানত উদ্বৃত্তভোগী অপেক্ষাকৃত ধনী পুরুষের কাছ থেকে। এ চাহিদা মেটানোর মধ্যে এক দিকে যেমন সম্পূর্ণ অসহায় কুলস্ত্রীর অপমান অন্য দিকে তেমনই আর একটি অসহায় নারীর—গণিকারও মনুষ্যসত্তার ঐকান্তিক অপমান ঘটেছে। সমস্ত প্রাচীন সাহিত্যে এ অপমানের কোনও উল্লেখমাত্র নেই। বাৎস্যায়ন স্পষ্টই বলেছেন অর্থীর সন্ধানে যাওয়ার সময়ে গণিকা ভাল করে সাজগোজ করে যাবে ‘কারণ সে পণ্যদ্রব্য’। (কামসূত্র ৬:১:৪) একটি ব্যক্তিকে দ্রব্যে পরিণত করার মধ্যে তো সমাজব্যবস্থারই কলঙ্ক; কিন্তু সে বোধের কোনও চিহ্নমাত্রও ছিল না। শিক্ষা এবং অর্থের অসম বণ্টনের ফলেই ব্যক্তি ও তার শ্রম হয়ে ওঠে অপরের ভোগ্যবস্তু। এই অসাম্য এক দিকে সৃষ্টি করেছে দাস, ক্রীতদাস, অন্য দিকে গণিকা। অবশ্য এ কথাও স্বীকার্য যে, কুলবধূর অবস্থাও খুব ঈর্ষা করার মতো ছিল না— বহু সুযোগ-সুবিধা ও মানবিক মর্যাদা থেকে সে-ও বহু ভাবে বঞ্চিত ছিল, কিন্তু সে বঞ্চনার বিনিময়ে গণিকার এই অতিরিক্ত কলঙ্ক ও গ্লানি থেকে সে মুক্ত ছিল, তার সঙ্গ প্রায়শ্চিত্তাই পাপ নয়, তার অন্নগ্রহণ করা চলত এবং তার স্পর্শও বর্জনীয় ছিল না (পরপুরুষের পক্ষে ছাড়া)।
গ্রিসে ও রোমে এরিস্টোফেনিস, মিনাণ্ডার বা টেরেন্সের নাটকে কিংবা সংস্কৃত ভাণগুলিতে গণিকা সম্পর্কে এত লাঞ্ছনার চিত্র নেই। কিন্তু ‘ভাণ’ হল সমাজের নিচের তলার সাহিত্য; হয়তো তাই তাদের পক্ষে যা বাস্তবে আছে, সমাজ যাকে নিজের প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছে, নিজের গরজে চালু রেখেছে তাকে স্বীকার করা আরও একটু সহজ হয়েছে। সংস্কৃত সাহিত্যের মূল সম্ভ্রান্ত ধারার মধ্যে ওই দ্বৈধমনস্কতা, গণিকার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য অথচ সমাজে যে গণিকা আছে তার স্বীকৃতি বারেবারেই দেখা দিয়েছে— দুটি আদি মহাকাব্যে ও পুরাণে তো বটেই, কালিদাস, ভারবি, মাঘ, নৈষধ, কল্হণ, ইত্যাদিতেও। অবৈধ প্রণয়ের হাজার হাজার সরস বিবরণ যেখানে অলংকারশাস্ত্রের প্রতি পৃষ্ঠা অলংকৃত করেছে সেখানে গণিকা সম্পর্কে এই কৃত্রিম উন্নাসিকতা কৌতুকাবহ। যে উচ্চতর শ্রেণির স্বার্থে সম্ভ্রান্ত সাহিত্য সৃষ্টি হয়, গণিকালয়ে যাওয়ার মতো বিত্ত তাদেরই আয়ত্তে এবং তারা তার প্রভূত্ব সদ্ব্যবহার করত এ বিষয়ে প্রচুর প্রমাণ আছে।
এই দ্বৈধমনস্কতার আর এটি প্রমাণ হচ্ছে, গণিকা যদি পাপীয়সীই হয় তো তার পাপের অর্থে দেওয়া দান তো সমাজের প্রত্যাখ্যান করাই উচিত— পাপের সংস্পর্শ পরিহার করার নীতিতে। কিন্তু বাস্তবে দেখি তার অর্থের ফল ভোগ করতে সমাজের কোনও দ্বিধা নেই। গণিকা অর্ধকাশী বহু জনহিতকর কাজে তার বিপুল সম্পত্তি দান করে এবং বহু অর্থ এনে বুদ্ধের পদতলে অর্পণ করে। বুদ্ধ বা উপকৃত জনতা কেউই কিছু প্রত্যাখ্যান করেনি। জৈন গ্রন্থ বৃহৎকল্পভাত-এ দেখি এক গণিকা একটি চিত্রশালা প্রতিষ্ঠা করেন, অন্যেরা দরিদ্রদের এবং জৈন মঠে প্রচুর অর্থ দান করেন। ধনী গণিকারা সেতু, কূপ, উদ্যান, মন্দির, মঠ, চৈত্য, কুঞ্জ, পুষ্করিণী, ইত্যাদি দিয়ে দেবদাসীর উপকার করেন। দেবদাসীরাও অনেকে জনহিতকর অনেক কাজ করেছিলেন। বৌদ্ধ সাহিত্যে গণিকা আম্রপালী বুদ্ধ ও তাঁর ভক্তদের উদ্দেশ্যে আম্রকানন দান করেন। বলাই বাহুল্য এ সবই সমাজের লোক যথাবিধি ভোগ করেছে যদিও এদের স্পর্শ করলে তাদের পাপ হত, এদের অন্ন গ্রহণ করলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত।
অসম্মান বঞ্চনা অত্যাচার ও লাঞ্ছনার মধ্যেই যারা জীবননির্বাহ করত তাদের পুরোপুরি মানুষ বলে কখনও গ্রহণ করা হয়নি। অথচ যে পুরুষ এত ধার্মিকমন্য, এত পুণ্যচরিত্র যে সে বারেবারে গণিকাকে পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছে সেই পুরুষেরই অপ্রতিহত কামনা নারীকে গণিকায় পরিণত করেছে। বহির্বাণিজ্যের দীর্ঘ পথটির ধারে ধারে গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ জনপদ ও নগর। বিত্তবান ধনিকের হাতে সঞ্চিত হয়েছে উদ্বৃত্ত অর্থ। বিশেষত বাণিজ্য ও যুদ্ধের দায়ে যে পুরুষকে দীর্ঘদিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রবাসে থাকতে হয় সে তার উদ্বৃত্ত কাঁচা টাকার বিনিময়ে যেমন বিদেশে খাদ্যবস্তু ক্রয় করে তেমনই ভোগ্য নারীও ক্রয় করে। তারই আনাগোনার পথের দু’ধারে সমৃদ্ধ রাজধানী ও নগরে প্রতিষ্ঠিত হয় বিলাসের সাহচর্যে, তাকে নাম দেয় মুহূর্তিকা, ক্ষণকালের সঙ্গিনী। এবং এ সব প্রখ্যাত গণিকাপল্লীর থেকে অনেক দূরে নগরের ও গ্রামের প্রত্যন্তদেশে ছিল অপেক্ষাকৃত রূপযৌবনহীনা শিক্ষাদীক্ষায় বঞ্চিতা কুলটা স্বৈরিণী বারাঙ্গনা। এদের আকর্ষণও যেমন কম উপার্জনও তেমনই কম। নিরাপত্তাও অনিশ্চিত। নিরাপত্তার জন্য যে সব আইন জরতী গণিকার জন্য সেই ভৃতির বা বৃত্তির ব্যবস্থা ওই অসহায় দরিদ্র উপহাস্য গণিকার হয়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কে তাদের প্রাপ্য আদায় করবে? কাজেই ধরে নেওয়া চলে যে, এই প্রান্তবাসিনীদের জীবনে জীবনসংগ্রাম কঠোরতম রূপে দেখা দিত। যে দেশে কুলকামিনীর স্থান ছিল পুরুষের পায়ের তলায় সেখানে রূপযৌবনে ও শিক্ষাদীক্ষায় সমৃদ্ধা গণিকা যদিবা পেত ঘৃণামিশ্রিত এক জটিল আকর্ষণ, কিন্তু সহায় সম্বলহীনা কুরূপা বা বর্ষীয়সী বেশ্যার ভাগ্যে ছিল সমাজের পুঞ্জীভূত ঘৃণা ও অবজ্ঞা এবং এরাই ছিল সংখ্যায় বেশি। যে বৃত্তি কুলপুত্রের বা অন্য স্বাধীন পুরুষের কামনায় সৃষ্টি এবং তাদের নিরন্তর সাহচর্য ছাড়া সম্পূর্ণই অচল হয়ে উঠত, সেই পুরুষেরা সমাজে অর্থে শিক্ষায় ও প্রতিপত্তিতে প্রতিষ্ঠিতই থাকত বরং গণিকাসাহচর্য তাদের প্রতিপত্তি বাড়িয়ে তুলত, কিন্তু তারা যে গণিকার সাহচর্য করত তার ভাগ্যে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। রোগে, শোকে, নিঃসঙ্গতায়, বার্ধক্যের অক্ষমতায় নিরাপত্তার কোনও আশ্বাসই তার ছিল না, তার ওপরে ছিল সমাজে প্রায় অস্পৃশ্যতা এবং দুরপনেয় গ্লানি। সমাজ যেখানে নিজের স্বার্থে এই অত্যন্ত অসুস্থ এবং অপমানজনক বৃত্তিটিকে জিইয়ে রেখেছিল সেখানে গণিকা সম্বন্ধে তার কিছু দায়িত্বও ছিল যা সমাজ পালন করেনি।
***
টীকা
১. দীর্ঘণিকায়র রাহুল সাংকৃত্যায়নকৃত হিন্দি সংস্করণ; বারাণসী, ১৯৩৬, পৃ. ৭৩-৭৪। মজ্ঝিমনিকায়, ঐ ১৯৬৪, পৃ. ২০-২৫, সংযুত্তনিকায় ৪৭:২০:২৩
২. ধম্মপদটীকা, পালি টেক্সট সোসাইটি, লন্ডন, ১৯০৬-১৪, পৃ. ৩০৮-৯
৩. শ্রী পি এল বৈদ্যের সংস্করণের দিব্যাবদান, ২১৮ পৃষ্ঠা
৪. “There is every likelihood that their palatial establishments and gardens were state property with life interest.” Moti Chandra, 1973, The World of Courtesous, Bombay, Vikash, p-48