পূর্ণপ্রজ্ঞ দর্শন / পূর্ণপ্রজ্ঞদর্শন / পূর্ণপ্রজ্ঞ-দর্শন
পূর্ণপ্রজ্ঞ, আনন্দতীর্থকৃত ভাষ্যের মতানুসারে নিজ দর্শন সংকলন করিয়াছেন। জীব সূক্ষ্ম ও ঈশ্বরসেবক, বেদ অপৌরুষেয় সিদ্ধার্থবোধক ও স্বতঃ প্রমাণ, প্রত্যক্ষ অনুমান ও আগম এই তিন প্রমাণ, এবং প্রপঞ্চ সত্য এই সকল বিষয়ে পূর্ণপ্রজ্ঞ ও রামানুজ উভয়েরই মতের ঐক্য আছে, কিন্তু রামানুজ যে ভেদ অভেদ ও ভেদাভেদ এই তিন তত্ত্ব স্বীকার করিয়াছেন, তাহা পূর্ণপ্রজ্ঞ স্বীকার করেন না। তিনি কহেন রামানুজ পূর্ব্বোক্ত বিরুদ্ধ তত্ত্ব ত্রয় অঙ্গীকার করিয়া শঙ্করাচার্য্যের মতের প্রতিপোষকতা করিয়াছেন অতএব তাঁহার মত অতি অশ্রেদ্ধেয়। আনন্দ তীর্থ শারীরক মীমাংসার যে ভাষ্য করিয়াছেন তাহাতে দৃষ্টিপাত করিলে জীব ও ঈশ্বরের পরস্পর যে ভেদ আছে তদ্বিষয়ে আর কোন সংশয়ই থাকে না। ঐ ভাষ্যে লিখিত হইয়াছে “স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো,” এই শ্রুতির, জীব ও ঈশ্বরের পরস্পর ভেদ নাই এরূপ তাৎপর্য্য নহে। কিন্তু “তস্য ত্বং” অর্থাৎ “তাঁহার তুমি” এই ষষ্ঠী সমাজ দ্বারা উহাতে “জীব, ঈশ্বরের সেবক” এই অর্থই বুঝাইবে। আর এরূপ যোজনা দ্বারা এমন অর্থও বুঝাইতে পারে যে জীব, ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন। এই মতে দুই তত্ত্ব স্বতন্ত্র ও অস্বতন্ত্র। তন্মধ্যে ভগবান সর্ব্বদোষবিবর্জিত অশেষ সদগুণের আশ্রয় স্বরূপ বিষ্ণুই স্বতন্ত্রতত্ত্ব। এবং জীবগণ অস্বতন্ত্রতত্ত্ব অর্থাৎ ঈশ্বরায়ত্ত। এই রূপে সেব্যসেবক ভাবাবলম্বী ঈশ্বর জীবের পরস্পর ভেদও যুক্তিসিদ্ধ হইতেছে, যেমন রাজা ও ভৃত্যের পরস্পর ভেদ দৃষ্ট হইয়া থাকে। অতএব যাঁহারা জীব ও ঈশ্বরের অভেদ চিন্তাকে উপাসনা করিয়া থাকেন এবং সেই উপাসনার অনুষ্ঠান করেন তাঁহাদিগের পরলোক কিছু মাত্র সুখ লাভ হয় না, প্রত্যুত ঘোরতর নরকে পতিত হইতে হয়। দেখ যদি ভৃত্যপদবীস্থ কোন ব্যক্তি রাজপদের অভিলাষ করে অথবা “আমি রাজা” এই রূপ ব্যক্ত করে তাহা হইলে ভূপতি তাঁহার বিলক্ষণ দণ্ড বিধান করেন, আর যে ব্যক্তি স্বীয় অপকর্ষ দ্যোতন পূর্ব্বক নৃপতির গুণোৎকীর্ত্তন করে, রাজা পরিতুষ্ট হইয়া তাহাকে সমুচিত পারিতোষিক প্রদান করিয়া থাকেন। অতএব ঈশ্বরের গুনোৎকর্ষাদির সমুৎকীর্ত্তন রূপ সেবা ব্যতিরেকে কোন ক্রমেই অভিলষিত ফলপ্রাপ্তির সম্ভাবনা নাই।
এই মতে ঈশ্বরের সেবা তিন প্রকার; অঙ্কন, নামকরণ ও ভজন। তন্মধ্যে অঙ্কনের পদ্ধতিসকল সাকল্যসংহিতাপরিশিষ্টে বিশেষরূপে লিখিত হইয়াছে, এবং উহার অবশ্যকর্ত্তব্যতা তৈত্তিরীয়ক উপনিষদে প্রতিপাদিত হইয়াছে। নারায়ণের চক্রাদি অস্ত্রের চিহ্ন যাহাতে অঙ্গে চিরকাল বিরাজিত থাকে তপ্তলৌহাদিযন্ত্রের দ্বারা তাহা করিবে, দক্ষিণ হস্তে সুদর্শন চক্রের এবং বামহস্তে শঙ্খের চিহ্ন ধারণ করিবে, যেহেতু ঐ চিহ্ন দর্শনে অনুক্ষণ ভগবানের স্মরণ হইবেক এবং তদ্দ্বারা বাঞ্ছিত ফলেরও সিদ্ধি হইবেক। অঙ্কনের এই সমস্ত প্রক্রিয়া অগ্নিপুরাণে লিখিত আছে। দ্বিতীয় সেবা নামকরণ। নিজ পুত্রাদির কেশবাদি নাম রাখিবে, তাহা হইলে কথায় কথায় ভগবানের নাম সংকীর্ত্তন হইবে। তৃতীয় সেবা ভজন, এই ভজন ত্রিবিধ; কায়িক, বাচিক ও মানসিক। তন্মধ্যে কায়িক ভজন, তিন প্রকার; সত্য, হিত, প্রিয় ও স্বাধ্যায় অর্থাৎ শাস্ত্রপাঠ। এবং মানসিকও তিন প্রকার; দয়া, স্পৃহা ও শ্রদ্ধা।
যেমন “সম্পূজ্য ব্রাহ্মণং ভক্ত্যা শূদ্রোহপি ব্রহ্মণোভবেৎ” এই বাক্য দ্বারা, শূদ্রও ভক্তিসহকারে ব্রাহ্মণের পূজা করিলে ব্রাহ্মণের ন্যায় পবিত্রতাদি গুণবিশিষ্ট হয়, এই অর্থই বুঝায়, সেই রূপ “ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মৈব ভবতি” এই শ্রুতিবাক্য দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞ ও ব্রহ্মের অভেদ না বুঝাইয়া এই অর্থ বুঝাইবে যে ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তি ব্রহ্মের ন্যায় সর্ব্বজ্ঞত্বাদিগুণসম্পন্ন হন। শ্রুতিতে “মায়া, অবিদ্যা, নিয়তি, মোহিনী, প্রকৃতি ও বাসনা,” এই যে ছয়টি শব্দের প্রয়োগ আছে, তাহার অর্থ ভগবানের ইচ্ছামাত্র অদ্বৈতবাদিদিগের কল্পিত অবিদ্যা নহে। আর যে প্রপঞ্চ শব্দ উক্ত আছে, তাহার অর্থ প্রকৃষ্ট পঞ্চভেদ, সেই পঞ্চভেদ এই; যথা জীবেশ্বরভেদ, জড়েশ্বরভেদ, জড়জীবভেদ, ও জীবগণের এবং জড়পদার্থের পরস্পরভেদ। ঐ প্রপঞ্চ সত্য ও অনাদিসিদ্ধ।
সকল আগমেরই বিষ্ণুর সর্ব্বোৎকর্ষ প্রতিপাদন করা প্রধান উদ্দেশ্য। ধর্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চারিটি পুরুষার্থ। তন্মাধ্যে মোক্ষই নিত্য, অপর তিন পুরুষার্থ অস্থায়ী। অতএব বুদ্ধিমান্ ব্যক্তির প্রধান পুরুষার্থমোক্ষলাভ যত্ন করা সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। কিন্তু ঈশ্বরের প্রসন্নতা ব্যতিরেকে ঐ মোক্ষের প্রাপ্তি হয় না, এবং জ্ঞান ব্যতিরেকে ঐ প্রসন্নতাও সম্পন্ন হয় না। ঐ জ্ঞানশব্দে বিষ্ণুর সর্ব্বোৎকর্ষজ্ঞানকে বুঝায়। কেমন মন্দবুদ্ধিরাই জীবপ্রেরক বিষ্ণুকে জীব হইতে পৃথক বলিয়া বিবেচনা করিতে পারেনা, কিন্তু সুবুদ্ধি ব্যক্তিদিগের অন্তঃকরণে বিষ্ণু ও জীবের পরস্পর ভেদ আছে, ইহা সুস্পষ্টরূপে প্রতীত হইয়া থাকে। ব্রহ্মা, শিব, ইন্দ্র প্রভৃতি সমুদায় দেবগণই অনিত্য ও ক্ষর শব্দবাচ্য এবং লক্ষ্মী অক্ষর শব্দবাচ্য। ঐ ক্ষরাক্ষর হইতে বিষ্ণু প্রধান, ও স্বাতন্ত্র্য শক্তি বিজ্ঞান সুখাদি গুণ সমূহের আধারস্বরূপ, অপর সকলেই বিষ্ণুর অধীন। এই সমস্ত সম্যক জানিতে পারিলে বিষ্ণুর সহিত বসবাস হয়, সমুদায় দুঃখ দূরে যায় এবং নিত্য সুখের উপভোগ হয়।
শ্রুতিতে লিখিত আছে, এক বস্তুর অর্থাৎ ব্রহ্মের তত্ত্বজ্ঞান হইলে সকল বস্তুকেই জানিতে পারা যায়, ইহার তাৎপর্য্য এই, যেমন গ্রামস্থ প্রধান ব্যক্তিদিগকে জানিতে পারিলে গ্রাম জানা হয় এবং পিতাকে জানিতে পারিলে পুত্র জানা হয়, অর্থাৎ পুত্রকে জানিতে আর অপেক্ষা থাকে না, সেইরূপ এই জগতের প্রধানভূত ও পিতার স্বরূপ যে ব্রহ্ম তাঁহাকে জানিতে পারিলেই সমুদায় জানা হয় অর্থাৎ অন্যকে জানিবার আর অপেক্ষা থাকে না; এই মাত্র, নতুবা এ শ্রুতিদ্বারা বাস্তবিক অভেদ বুঝাইবে না। অদ্বৈতমতাবলম্বীরা যে ব্যাসকৃত বেদান্তসূত্রের কূটার্থ করিয়া থাকেন, সে কিছু নহে। ঐ সূত্রসকলের মধ্যে কয়েকটি সূত্রের যথাশ্রুত তাৎপর্য্যার্থ লিখিত হইতেছে। যথা, “অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা” এই সূত্রস্থ “অথ” শব্দের আনন্তর্য্য, অধিকার ও মঙ্গল এই তিন অর্থ। আর “অতঃ” এই শব্দের হেতু অর্থ, ইহা গরুড়-পুরাণে ব্রহ্ম-নারদ সংবাদে লিখিত আছে। যখন নারায়ণের প্রসন্নতা ব্যতিরেকে মোক্ষ হয় না, এবং তাঁহার জ্ঞান ব্যতিরেকে তাঁহার প্রসন্নতা হয় না, তখন ব্রহ্মজিজ্ঞাসা অর্থাৎ ব্রহ্মকে জানিতে ইচ্ছা করা অবশ্য কর্ত্তব্য, ইহা ঐ সূত্রের ফলিতার্থ। “জন্মদ্যস্য যতঃ” এই সূত্রে ব্রহ্মের লক্ষণ কথিত হইয়াছে। ঐ সূত্রের অর্থ এই, যাহা হইতে এই জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহার হইয়া থাকে, নিত্য নির্দ্দোষ অশেষসদ্গুনাশ্রয় সেই নারায়ণই ব্রহ্ম। তাদৃশ ব্রহ্মে প্রমাণ কি? এই জিজ্ঞাসায় কহিয়াছেন “শাস্ত্রযোনিত্বাৎ” শাস্ত্রসকলই নিরুক্ত ব্রহ্মে প্রমাণ, যেহেতু ব্রহ্মই শাস্ত্রসকলের প্রতিপাদ্য। ঐ সূত্রোক্ত শাস্ত্রশব্দে চারি বেদ, মহাভারত, নারদপঞ্চরাত্র, রামায়ণ এবং ঐ সমস্ত গ্রন্থের প্রতিপোষক গ্রন্থসকল বুঝাইবে। কিরূপে ব্রহ্মের শাস্ত্রপ্রতিপাদ্যত্ব স্বীকার করা যায়, এই আশঙ্কায় কহিতেছেন, “তত্তু সমন্বয়াৎ” শাস্ত্র সকলের উপক্রমে ও উপসংহারে ব্রহ্মই প্রতিপাদিত হওয়ায় ঐ আশঙ্কার সমন্বয় অর্থাৎ সমাধা হইয়াছে।
আনন্দতীর্থভাষ্যে সমুদায় বিষয় বিস্তারিত রূপে লিখিত হইয়াছে। পূর্ণপ্রজ্ঞ ঐ ভাষ্যের মতানুসারে এই সমস্ত রহস্য উদ্ভাবন করিয়াছেন। পূর্ণপ্রজ্ঞের আর এই দুই সংজ্ঞা, মধ্যমন্দির ও মধ্ব। পূর্ণপ্রজ্ঞ স্বকীয় মাধ্বভাষ্যে লিখিয়াছেন, তিনি বায়ুর তৃতীয় অবতার, বায়ুর প্রথম অবতার হনুমান এবং দ্বিতীয় অবতার ভীম।