সুবাস্তর বাঁদিকে সবুজে ঢাকা পর্বতমালা, পাহাড় থেকে আছড়ে-পড়া ঝর্ণার ধার, আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে আন্দোলিত গমের ক্ষেতে সুশোভিত এই অঞ্চল গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে। কিন্তু এই অঞ্চলের আর্যভাষীদের সবচেয়ে বেশি গর্ব ছিল পাথরের দেওয়াল ও পাইন শাখার আচ্ছাদিত গৃহচূড়া নির্মিত নিজেদের বাসস্থান সম্পর্কে। আর এই জন্যই এই প্রদেশের নামও তারা দিয়েছিল সুবাস্তু, অর্থাৎ স্বাতসুন্দর গৃহসজ্জিত প্রদেশ। বক্ষুতট পরিত্যাগ করে আর্যভাষীগণ পারমীর ও হিন্দুকুশের দুর্গমগিরিপথ এবং কুনার ও পঞ্জ-কোরার নদী অতিক্রম করে এসেছিল। অতীতের সেই স্মৃতি সম্ভবত অনেক দিন অম্লান ছিল। মঙ্গলপুরের (মঙ্গলোরের) ইন্দ্র উৎসব হচ্ছে আজ। উৎসবের এই বিরাট প্রস্তুতির কারণও বোধহয় ইন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞান– কারণ আপন ইন্দ্রের পরিচালনায় দুর্গম পার্বত্যপথ তারা একদিন নিরাপদেই অতিক্রম করেছিল।
মঙ্গলপুরের পুরুরা তাদের সুন্দর ঘরগুলি পাইন শাখায় ও রঙ বেরঙের পতাকায় সাজিয়েছিল। পুরুধান তার ঘর সাজাচ্ছিল এক বিশেষ ধরনের রক্ত পতাকা দিয়ে। তা দেখে প্রতিবেশী সুমেধ বলল। ‘‘মিত্র পুরু। তোমার পতাকাগুলো বেশ হালকা ও চিকন দেখছি। আমাদের এখানে তো এ রকম কাপড় বোনা হয় না, এতে বোধহয় অন্য কোনো ধরনের ভেড়ার লোম ব্যবহার করা হয়েছে?’’
‘‘না, এ-তো কোনো ভেড়ার লোমে বোনা হয়নি সুমেধ!’’
‘‘তা’হলে?’’
‘‘এ এক রকমের পশম— গাছে জন্মায়। আমরা ভেড়ার গা থেকে পশম নিয়ে কাপড় বুনি, আর এই পশম জন্মায় জঙ্গলের গাছে।’’
‘‘এ রকম শোনা যায় বটে কিন্তু নিজের চোখে এ ধরনের গাছ কখনও দেখিনি।’’
উরুর ওপর তকলী ঘষে সেটা ঘুরিয়ে দিয়ে ভেড়ার লোমের ফেটি লাগাতে লাগাতে সুমেধ বলল, ‘‘কী ভাগ্যবান তারা, যাদের গাছে এই পশম জন্মায়। আচ্ছা, আমাদের এখানে ওই গাছ লাগানো যায় না?’’
‘‘তা বলতে পারি না। কতটা শীত-তাপ সে গাছ সহ্য করতে পারে তাও জানি না। কিন্তু সুমেধ। মাংস তো আর গাছে জন্মাতে পারে না।’’
‘‘কোনো দেশে যদি গাছে পশম জন্মাতে পারে— কে জানে হয়ত এমন দেশও আছে যেখানে গাছেই খাবার মাংস পাওয়া যায়। যাক্, এ কাপড়ের দাম কত?’’
‘‘পশমী কাপড়ের চেয়ে অনেক কম, তবে টেকে না বেশীদিন।’’
‘‘কোথায় খরিদ করলে?’’
‘‘অসুরদের কাছ থেকে। এখান থেকে প্রায় পঞ্চাশ ক্রোশ দূরে তাদের দেশ, সেখানকার লোকেরা গাছের পশমের কাপড় পরে।’’
‘‘এত সস্তা যখন, তখন আমরাই বা পরি না কেন?’’
‘‘ওই কাপড়ে শীত কাটে না।’’
‘‘তবে অসুররা পরে কি করে?’’
‘‘ওদের দেশে ঠাণ্ডা কম, বরফ পড়েই না।’’
‘‘আচ্ছা পুরু, তুমি কেবল দক্ষিণ দিকেই ব্যবসা করতে যাও কেন?’’
‘‘লাভ বেশী হয়— সেই জন্যেই! আর বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্রও পাওয়া যায়। তবে খুব কষ্টও হয়। ওদিকে গরম প্রচণ্ড, একটু ঠাণ্ডা জলের জন্য প্রাণ ছটফট করে।’’
‘‘ওখানকার লোকেরা সব কেমন পুরুধান?’’
‘‘লোকগুলো বেঁটে বেঁটে, রঙ তামাটে। বড়ই কুৎসিত। আর নাক আছে কি নেই সেটা বোঝা যায় না— খুব চেপ্টা ও ভোঁতা। আর সবচেয়ে খারাপ হল যে, সেখানে মানুষ কেনা-বেচা চলে।’’
‘‘কি বললে? মানুষ কেনা-বেচা!’’
‘‘হ্যাঁ, ওরা এই ব্যবসাকে বলে দাস-ব্যবসা।’’
‘‘দাস ও তাদের প্রভুদের মধ্যে কি চেহারার কোনো পার্থক্য আছে?’’
‘‘না। তবে দাসরা খুব গরিব ও পরাধীন— দেহ-মন সবই প্রভুদের অধীনে।’’
‘‘ইন্দ্র রক্ষা করুন, এমন লোকের মুখ যেন দেখতে না হয়।’’
‘‘মিত্র সুমেধ! তোমার তকলী তো ঘুরছেই— যজ্ঞে যাবে না?’’
‘‘যাব না কেন! ইন্দ্রের দয়াতেই তো আমরা নধর পশু আর মধুর সোমরস পাচ্ছি। এমন কোন হতভাগা আছে যে এই ইন্দ্রপূজায় মিলিত হবে না?’’
‘‘তোমার বউটির খবর কি? তাকে তো আজকাল দেখা-ই যায় না!’’
‘‘কেন, তুমি তার প্রেমে মজেছ না-কি, পুরুধান?’’
‘‘মজবার কথা হচ্ছে না। তুমি তো জেনেশুনেই বুড়ো বয়সে তরুণীর সঙ্গে প্রণয়ের জিদ ধরেছিলে!’’
‘‘পঞ্চাশে লোক বুড়ো হয় না।’’
‘‘কিন্তু পঞ্চাশ আর বিশ বছর বয়সের পার্থক্য কত, জান?’’
‘‘বেশ তো, সে তা’হলে তখনই আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেই পারত!’’
‘‘তুমি তখন গোঁফ-দাড়ি মুড়িয়ে চেহারা করেছিলে যেন আঠারো বছরের ছোকরা! আর ঊষার মা-বাপের নজর ছিল তোমার পালিত পশুদের ওপর।’’
‘‘এ সব কথা বন্ধ কর পুরু। তোমরা ছেলেছোকরা তো খালি…।’’
‘‘বেশ, এ সব কথা না হয় বলব না। ওদিকে কিন্তু বাজনা আরম্ভ হয়ে গেছে— উৎসব এ বার শুরু হবে।’’
‘‘দিলে তো এখানে দেরি করিয়ে— বেচারা সুমেধ এখন গাল খাক আর কি।’’
‘‘বেশ তো চল, ঊষাকেও সঙ্গে নেওয়া যাক্।’’
‘‘সে কি এখনো বাড়ি বসে আছে না-কি।’’
‘‘যাক্, এই পশম আর তকলীটা রেখে চল এখন।’’
‘‘আরে, এগুলো সঙ্গে থাকলে যজ্ঞের কিছু অঙ্গহানি হবে না।’’
‘‘এই জন্যেই তো ঊষা তোমায় পছন্দ করে না।’’
‘‘পছন্দ ঠিকই করে— অবশ্য তোমরা মঙ্গলপুরের তরুণরা যদি তাকে পছন্দ করতে না দাও— তা’হলে আমার আর দোষ কি?’’
কথা বলতে বলতে দুই সঙ্গী শহরের সীমা ছাড়িয়ে এগুতে লাগল যজ্ঞ-বেদির দিকে। পথে যে কোনো যুবক বা যুবতীর সঙ্গে পুরুধানের চোখাচোখি হয়— সেই মুচকি হেসে চলে যায় ; পুরুধানও চোখ ঠেরে মাথা ঘুরিয়ে নেয়। এই অবস্থায় একজন তরুণকে সুমেধ পাকড়াও করে বকে উঠল, ‘‘এই তরুণরাই হচ্ছে মঙ্গলপুরের কলঙ্ক।’’
‘‘কি ব্যাপার, মিত্র !’’
‘‘মিত্র-টিত্র নয়, ওরা আমাকে দেখে হাসছে।’’
‘‘আরে, বন্ধু, ও তো বদমাস— তুমিও সেটা জান। ওর কথা ভাবছ কেন?’’
‘‘আমি তো মঙ্গলপুরের কাউকে ভালো দেখি না।’’
যজ্ঞ-বেদির পাশে বিস্তৃত ময়দান—তাতে এখানে-ওখানে মঞ্চ এবং পাইন পাতায় সজ্জিত তোরণ প্রস্তুত হয়েছিল অতিথিদের স্বাগত জানাবার জন্য। গ্রামের বহুসংখ্যক স্ত্রী-পুরুষ বেদির চতুর্দিকে জমায়েত হয়েছিল কিন্তু আসল বড় সমাবেশটা সন্ধ্যার পরই হওয়ার কথা, তখন সারা পুরু-জনের স্ত্রী পুরুষ এই উৎসবে যোগ দেবে— স্বাত নদীর অপর পারের মাদ্র-জনের স্ত্রী-পুরুষেরাও আসবে।
ঊষা দুই বন্ধুকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি তাদের কাছে গিয়ে সুমেধের হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে তরুণী প্রেমিকার মতো চটুল ভঙ্গীতে বলল, ‘‘প্রিয় সুমেধ। সারা সকাল তোমায় খুঁজে খুঁজে আমি প্রায় শেষ হয়ে গেলাম, তবু তোমার পাত্তাই নেই।’’
‘‘কেন, আমি কি মরে ভূত হয়েছিলাম!’’
‘‘এমন কথা মুখে এনো না। বেঁচে থেকে আমাকে বিধবা বানিয়ো না।’’
‘‘পুরু-জনের বিধবাদের ভাবনা কি, দেবরের অভাব নেই।’’
‘‘কেন, সধবাদের কাছে দেবররা কি বিষতুল্য?’’—পুরুধান প্রশ্ন করল।
সুমেধ বলল, ‘‘ঠিক বলেছ পুরু। ও আমাকে শেখাতে এসেছে। নিজে কোন ভোরে বেরিয়েছে—না জানি এর মধ্যে কত ঘর ঘুরে এসেছে। সন্ধ্যার পর এ বলবে আমার সঙ্গে নাচ, ও বলবে— না আমার সঙ্গে। এই নিয়ে বেধে যাবে ঝগড়া, রক্তারক্তি। আর এই বঊ-এর জন্যে বদনাম হবে বেচারা সুমেধের।’’
ঊষা সুমেধের হাত ছেড়ে দিয়ে চাউনি ও কন্ঠের স্বর বদলে চিৎকার করে বলল, ‘‘তুমি কি আমাকে বাক্সে বন্ধ করে রাখতে চাও না-কি? যাও না— রান্না ভাঁড়ারের ভার নাও গে, আমিও নিজের পথ দেখে নিই।’’ যাবার সময় পুরুধানকে একান্তে মুচকি হাসির ইসারা দিয়ে বেদি সংলগ্ন ভিড়ের মধ্যে ঊষা হারিয়ে গেল।
বছরে একটা বিশেষ দিন বলে এই দিনটা গণ্য হত। বক্ষু তটে (অক্সাসের তীরে) স্বাত উপত্যকায় অতীতের পুরু-জনের প্রথা অনুসারে পশুপালের সেরা ঘোড়াটি বলি দেওয়া হত। সারা স্বাত উপত্যকায় এই সময় ঘোড়া খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না—তবু ইন্দ্রপূজার বলি হিসাবে সকলেই ভক্তিভরে প্রসাদ নিত। জনের মহাপিতর—যাকে এখানে জনপতি বলা হয়—আজ আপন জনপরিষদের সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রপূজার প্রিয় অশ্বমেধ যজ্ঞে যোগ দিত। এই বলিদানের সব বিধি-বিধান প্রত্যেকেরই জানা। বক্ষু উপত্যকায় অধিবাসীরা যে মন্ত্র পড়ে ঘোড়া ইন্দ্রের নামে উৎসর্গ করত— তা তাদের সবটাই মুখস্থ ছিল। বাদ্য ও মন্ত্রস্তুতির সঙ্গে অশ্বকে স্পর্শ করে এবং প্রক্ষালন থেকে বলি পর্যন্ত সমস্ত ক্রিয়া সম্পন্ন হল। তারপরে ঘোড়াটির চামড়া ছাড়িয়ে তার দেহ খণ্ড খণ্ড করে কাটা হল— পরে কয়েক খণ্ড মাংসে মশলা মাখিয়ে আহুতি হিসাবে আগুনের মধ্যে দেওয়া হল।
যজ্ঞের বলি, প্রসাদ বিতরণ করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ইতিমধ্যে যজ্ঞভূমি নর-নারীতে ভরে গেছে। এই দিন সকলেই আপন আপন শ্রেষ্ঠ বসন-ভূষণে সজ্জিত হয়ে এসেছে। মেয়েদের দেহে ছিল সূক্ষ্ম রঙিন কম্বল—কোমরের কাছে বাঁধা কারুকার্যখচিত নানা রঙের কোমরবন্ধনী, আর নীচে সুন্দর লোমবস্ত্রের আবরণ। প্রায় প্রত্যেকের কানেই সোনার কুণ্ডল। বসন্ত শেষ হয়ে আসছে—সারা উপত্যকায় ফুল যেন আজকের দিনটিকে লক্ষ্য করে বিকশিত হয়েছে। আজকের রাত নর-নারীর স্বচ্ছন্দ বিহারের রাত—ইচ্ছামতো প্রণয় ও কামনা-ভোগের রাত। রাত্রে যখন উৎসবের সজ্জায় সুসজ্জিতা ঊষা পুরুধানের হাতে হাত মিলিয়ে ঘুরছিল তখন সুমেধের নজরে পড়ল, কিন্তু কি বা করতে পারে সে— হতাশ ভঙ্গীতে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ইন্দ্রের উৎসবের দিনে নর-নারীর যথেচ্ছ মিলনে রাগ করার পর্যন্ত অধিকার কারুর নেই।
রাতে মধু ও ভাঙ-এর নদী বয়ে যাচ্ছিল। সারা গাঁয়ের মানুষ জড়ো করেছে, ভোগ দেওয়ার জন্য সুস্বাদু গোমাংস আর সোমরস। সর্বত্রই অভিনব প্রেমের মাদকতাপূর্ণ জড়ানো কন্ঠের সম্ভাষণ আর যুগ্ম তরুণ-তরুণীর পদচারন নজরে পড়ছে। এক টুকরো মাংস মুখে পুরে এক পেয়ালা সোমরসে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে। বাজনা বেজে উঠছে—আর বাজনার তালে তালে নাচছে তারা। শ্রান্ত হলে বিশ্রামের পর অপর গ্রামের আগন্তুকদের গিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। সারা গোষ্ঠীর লোকদের উদ্যোগে উৎসবের আয়োজনও বিরাট—আর নাচের জন্য আসরও ছিল বিস্তৃত। ইন্দ্র উৎসব ছিল যুবজনের মহোৎসব। এদিন তাদের কোনো কিছু করতেই বাধা-নিষেধ ছিল না।
২.
উপরি-স্বাতের এই অংশ পশু এবং শস্যসম্ভারে পরিপূৰ্ণ – এখানকার লোকেরা সুখী এবং সমৃদ্ধ । এদের যে সব জিনিসের অভাব সোনা-রূপা ও কয়েকটি রত্ন যার অভাব দিন-দিনই বেড়ে চলেছে। এইসব জিনিসের জন্য স্বাত এবং কুভা (কাবুল) নদীর সঙ্গমস্থলে অসুর-নগর রয়েছে। মনে হয়, এই আর্যভাষীরা অসুর-নগরকে পুষ্কলাবতী (=চরসদদা) নামে ডাকে আর আমরাও এখানে এই নামকে স্বীকার করে নিচ্ছি। শীতের মাঝামাঝি —স্বাত, পঞ্জকোরা, এবং অন্যান্য উপত্যকাবাসী পাহাড়ী গোষ্ঠীসমূহ, যথা পুরু, কুরু, গান্ধার, মাদ্র, মল্ল, শিবি, উশীনার ইত্যাদি – নিজ নিজ ঘোড়া, কম্বল এবং অপরাপর বস্তু নিয়ে পুষ্কলবতীর বহির্ভাগে অবস্থিত ময়দানে ডেরা (তাঁবু) বেঁধে বসত। বহু শতা্ব্দী ধরে এই নিয়ম ভালোভাবেই চলে আসছিল, এ বছর পুরুদের যে সার্থ (ক্যারাভান) বা বণিকদল পুষ্কলাবতী গেল তাদের নেতা ছিল পুরুধান। এদিকে কয়েক বছর থেকে পাহাড়ীদের ধারণা হচ্ছিল যে, অসুররা ভয়ানক ঠকাচ্ছে। অসুর নাগরিকেরা এই পাহাড়িদের চেয়ে বেশি চতুর, এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। তবে নীল চোখ বিশিষ্ট আর্যভাষী ঘোড়সওয়ার কখনই নিজেকে অসুর নাগরিকদের চেয়ে হীন বলে মানতে রাজী ছিল না। ধীরে ধীরে যখন আর্যভাষীদের মধ্যে থেকে পুরুত্থানের মতো বহু লোক অসুরদের ভাষা বুঝতে শিখল এবং তাদের সমাজে চলাফেরা করবার সুযোগ পেল। তখন জানল, অসুররা আর্যভাষীদের পশু-মানব বলে মনে করে।
অসুরদের নগরগুলি সুন্দর, সেখানে পাঁকা ইটের বাড়ি, স্নানাগান, সড়ক ইত্যাদি তৈরী হত। আর্যভাষীরাও পুষ্কলাবতীর সৌন্দর্যকে অস্বীকার করত না। অসুর তরুণীর নাক, কেশ ও উচ্চতা পছন্দ মতো না হলেও তাদের সৌন্দর্যকে তারা মানতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু এ কথা তারা কখনোই স্বীকার করত না যে, দেবদারু-সমাচ্ছাদিত পর্ত-মেখলার মাঝে অবস্থিত চিত্র-বিচিত্র কাঠের অট্টালিকা যুক্ত মঙ্গলপুরের সুসজ্জিত স্বচ্ছগৃহপংক্তি থেকে কোনো অংশে হীন। পুষ্কলাবতীতে এক মাস কাটানোও তাদের পক্ষে মুশকিল হত, এবং বারবার আপনি জন্মভূমির কথা স্মরণে আসত। যদিও ওই স্বাত নদী পুষ্কলাবতীর ধারা দিয়েও বয়ে চলেছে, কিন্তু তারা দেখত নদীর জলে সেই স্বাদ নেই। তাদের বক্তব্য ছিল, অসুরদের স্পর্শে এই পবিত্ৰ জল কলুষিত হয়ে গেছে। সে যাই হোক না কেন, আর্যভাষীরা কোনো রকমেই অসুরদের আপনি সমকক্ষ বলে মানতে রাজী ছিল না। বিশেষ করে যখন তারা হাজার হাজার দাস-দাসী এবং ঘরে বসে আপন দেহ বিক্রয়কারিণী বেশ্যাদের দেখত। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আর্ভাষীদের অসুরদের মধ্যে অসুরদের আর্যভাষীদের মধ্যে বহু মিত্র ছিল। অসুরগণের রাজা পুষ্কলাবতী থেকে কিছু দূরে সিন্ধুতটের পার্শ্ববর্তী কোনো নগরে বাস করত। এ জন্য পুরুধান তাকে কোনোদিন চোখে দেখেনি। হ্যা, রাজার স্থানীয় অমাত্যকে দেখেছিল সে – বেঁটে, মোটা আর অত্যন্ত অলস, সুরার প্রভাবে তার চোখের পাতা সর্বদাই বুজে থাকত। সারা দেহে বহুবিধ সোনা-রূপার অলংকারে সজ্জিত এই রাজকর্মচারীটি পুরুধানের চোখে কুরূপতা এবং বুদ্ধিহীনতার প্রতীক বলে মনে হত। যে রাজ্যের এমন প্রতিনিধি তার প্রতি পুরুধানের মতো লোকের উঁচু ধারণা থাকতে পারে না। পুরুধান শুনেছিল যে, সে অসুররাজের শালা এবং এই একটি মাত্র গুণের জোরে সে এই পদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছে।
কয়েক বছরের সাময়িক সংস্পর্শ হেতু অসুররাজের ভিতরকার বহু দুর্বলতা পুরুত্থানের চোখে ধরা পড়ে। উচ্চশ্রেণীর অসুররা আপন অধীনস্থ ভট্ট এবং দাসদের শক্তির জোরে শত্রুর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চায়। দুর্বল শক্রকে জয় করতে এরা ভালোভাবেই সফল হয়, কিন্তু বলবান শক্রুর সামনে লড়তেই পারে না। অসুরদের শাসক, রাজা, সামন্ত ভোগ বিলাসকেই জীবনের একমাত্ৰ উদ্দেশ্য বলে মনে করত। প্রত্যেক সামন্তরেই শত শত স্ত্রী এবং দাসী থাকত। স্ত্রীদের তারা দাসীর মতো করেই রাখত। হালে কিছু পাহাড়ী স্ত্রীকেও বলপূর্বক অসুররাজা আপন অন্তপূরে এনে রেখেছিল। এর ফলে আর্যভাষী জনের ভিতরে প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু অসুবিধা এই ছিল যে, অসুররাজের রাজধানী সীমান্ত থেকে বহুদূরে, আর্যভাষী-জনের পক্ষে সেখানে উপস্থিত হওয়া মুখের কথা নয়। তাই আর্যভাষী রমণীদের অসুরদের নিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে আর্যভাষী জনেরা কিংবদন্তী বলেই মনে করত।পুষ্কলাবতীর রাজার কাছ থেকে নানাপ্রকার অলঙ্কার, কার্পাস-বস্ত্র, অস্ত্র-শস্ত্র এবং অপরাপর দ্রব্যসম্ভার, সুব্যস্ত কুনারের উপরিভাগে কাঠার ছাউনিতে পৌছাতে আরম্ভ করেছিল। সুবাস্তুর স্বর্ণকেশী আর্যভাষী রমণীরা দক্ষ অসুর শিল্পীদের হাতে গড়া অলঙ্কারে মুগ্ধ হয়ে প্রতি বছর অধিকতর সংখ্যায় পুষ্কলাবতী আসতে আরম্ভ করল।
সুমেধ বেচারা সত্যি সত্যি উষাকে বিধবা বানিয়ে চলে গিয়েছিল, ঊষা এখন তার খুড়তুতো দেবীর পুরুত্থানের পত্নী। এ বছর সেও পুষ্কলাবতীতে এসেছিল। পুষ্কলাবতীর নগরাধিপতির লোকজনেরা আর্যভাষীদেরে তাঁবুর ভিতর বহু সুন্দরী সেই খবর আপন প্রভুর কাছে পৌঁছে দিল। তারা ঠিক করুল, সার্থ যখন ফিরে যেতে থাকবে তখন পাহাড়ে ঢুকতেই হামলা করে তাদের লুট নিয়ে যাবে। যদিও এই কাজ বুদ্ধিহীনতার লক্ষণ, কারণ পীতকেশীরা অত্যন্ত যুদ্ধকুশল – এ খবর তাদেরও জানা ছিল। কিন্তু নগরাধিপতির মগজে বুদ্ধির লেশমাত্র ছিল না। নগরের বড় বড় শেঠ সাহুকারেরা তাকে ঘৃণা করত। যে ব্যাপারীর সঙ্গে পুরুধানের মিত্ৰতা ছিল, তার সুন্দরী কন্যাকে হালে নগরাধিপতি জবরদস্তি করে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছিল, এ জন্য সে তার সারা জীবনের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঊষাও এই অসুর সওদাগরের বাড়ি কয়েকবার গিয়েছে। যদিও ওই সওদাগর পত্নীর একটি কথাও সে বুঝতে পারত না, তবুও পুরুধানের দোভাষীর কাজে এবং শেঠগিন্নীর ব্যবহারে দুই নারীর ভিতর সখিত্ব সুদৃঢ় হয়ে উঠেছিল। বিদায় নেবার দিন দুই আগে সওদাগর তার বড় গ্রাহক পুরুধানকে নিমন্ত্রণে আপ্যায়িত করল। সেই সময় সে পুরুধানের কানে নগরাধিপতির ঘূণ্য মতলবের কথা জানিয়ে দিল।
সমস্ত আর্যভাষী সাৰ্থ নায়ককে ডেকে সারারাত পরামর্শ করল পুরুধান। যাসের হাতে অস্ত্র কম ছিল, তারা নতুন অস্ত্র কিনল। বিক্রি করবার জন্যে আনীত ঘোড়া এবং অন্যান্য ভারী মোট তারা বেচে দিল। শুধু নিজেদের চড়বার ঘোড়া এবং অন্যান্য কেনা জিনিসপত্র, যেমন অলঙ্কার এবং অন্যান্য ধাতব দ্রব্য রেখে কিছুটা হালকা হল। আর্যভাষী রমনীদের মধ্যে অলঙ্কার-প্রতি অত্যন্ত প্রবল ছিল, কিন্তু এই সময় পর্যন্ত তাদের শিক্ষায় নৃত্যগীতের সঙ্গে শস্ত্ৰ-শিক্ষাও চলে আসছিল, এ জন্য সঙ্কটের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারাও আপন-আপন খড়গ এবং চামড়ার ঢাল তুলে নিল ।
পুরুধানের এ খবর জানা ছিল যে, অসুর সৈন্য সীমান্তের গিরিবর্তে আগে থেকে রাস্তা আটকে আক্রমণ করবে এবং সেই সময় তাদের এক অংশ পিছন থেকেও ঘিরে ফেলতে চাইবে। এ জন্য পুরুধান পুরোদস্তুর তৈরী হয়ে গেল, আর প্রথমেই খবর পাওয়া গেল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। যদিও শক্রকে জানতে না দেবার জন্য তারা পুঙ্খলাবতী থেকে দু-একদিন আগে পিছে রওনা দিল, কিন্তু ঠিক হল যে অজার (অবাজই) দ্বারে সকলেই এক সঙ্গে পৌঁছাবে। দ্বার যখন ক্রোশ দুই বাকি পুরুধান তখন পাঁচশ জন সওয়ারীকে আগে পাঠাল। যে সময় সওয়ারীরা দ্বারের ভিতরে এগুতে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে অসুর সৈন্যরা তাদের ওপর বাণ খুঁড়তে আরম্ভ করল। আক্রমণের সংবাদ সত্যে পরিণত হল, সওয়ারীরা পিছু হট আপন সার্থ-নায়কদের সংবাদ দিল। পুরুধান প্রথমে পিছন থেকে এগিয়ে আসা শক্রর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে চাইল। এতে সুবিধাও ছিল, কারণ যদিও অসুরেরা প্রতি বছর আর্যভাষীদের কাছ থেকে হাজার হাজার ঘোড়া কিনেছিল বটে কিন্তু তখনো পর্যন্ত সুদক্ষ অশ্বারোহী সৈনিক হয়ে উঠতে পারেনি।
সাৰ্থ রক্ষার জন্য বহুসংখ্যক উটকে সেখানে ছেড়ে বাকি সওয়ারীদের সঙ্গে পেছনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। অসুর-সেনা প্রত্যাশা করেনি যে, পীতকেশীরা এভাবে পাল্টা মার দেবে। গীতকেশীদের দীর্ঘ বল্লম এবং খড়গের সামনে তারা বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারল না, কিন্তু আর্যরা এদের শুধু পরাজিত করেই ছাড়তে চাইল না। তারা এইসব বোঁচা নাক, কালো অসুরদের বুঝিয়ে দিতে চাইল যে, পীতকেশীদের ওপর নজর দেওয়া কি ভয়ঙ্কর বিপদের কাজ। অসুর-সেনাদের পলায়ন করতে দেখে পুরুধান সার্থকে খবর পাঠাল এবং নিজে ঘোড়সওয়ার নিয়ে পুষ্কলাবতীতে এসে পড়ল। অসুর সেনানীদের মতো তাদের নগরাধিপতিও এমনটি আশা করেনি। অসুরেরা তাদের পূর্ণ শক্তিকে সংগঠিত করবার সুযোগ পেল না এবং সহজেই অসুর-দুর্ এবং নগরাধিপতি, পীতকেশীদের অধিকারে চলে এল।
তারা খুব নিষ্ঠুরভাবে অসুর পুরুষদের বধ করল। আর নগরাধিপতিকে নগরের চৌরাস্তায় এনে অসুর প্রজাদের সামনে তার এক-একটি অঙ্গচ্ছেদ করে হত্যা করল। স্ত্রীলোক, শিশু এবং ব্যাপারীদের তারা মারল না।ওই সময়ে অসুরদের যদি দাস ইচ্ছা থাকত তবে এত অধিকসংখ্যক অসুর নিহত হত না। পুষ্কলাবতীর বহুলাংশ তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলল। অসুর দুর্গর এই প্রথম পতন ঘটল। অসুর এবং পীতকেশীদের মহান বিগ্রহের, দেবাসুরের সংগ্রাম – এইভাবেই সূত্রপাত হল।
পুরুধান ফিরে এসে অজাগিরিবর্তে অসুর সৈন্যবাহিনীকে নির্মুল করল। তারপর সমগ্ৰ গীতকেশী সাৰ্থ আপনি আপনি জন্ম-ভূমিতে ফিরে গেল। কয়েক বছরের জন্য পুষ্কলাবতীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। গীতকেশীর অসুর-পণ্য নিতে অস্বীকার করুল, কিন্তু তামা, পিতলকে কতদিন দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে?