পঞ্চম অধ্যায় – পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার প্রবর্তন ও প্রসার
১. ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তন
ইংরেজী বণিকদিগের সহিত ব্যবসা-সংক্রান্ত কথাবার্তা চালাইবার জন্যই প্রথমে অল্পসংখ্যক বাঙ্গালী ইংরেজী শিখিবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ইংরেজশাসন প্রবর্তিত হওয়ার ফলে এই প্রয়োজন আরও বাড়িয়া যায়। কিন্তু ইংরেজ সরকার এদেশীয় লোককে ইংরেজী বা পাশ্চাত্ত্য জ্ঞান ও বিজ্ঞান শিখাইবার জন্য বহুদিন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থাই করে নাই; তাহারা সংস্কৃত ও আরবী ফার্সী শিক্ষার জন্যই কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। খ্রীষ্টীয় মিশনারীরা ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে নিজেরা বাংলা শিক্ষা করেন এবং বাঙ্গালীদিগকে ইংরেজী শিখাইবার জন্য সচেষ্ট হন। প্রধানতঃ তাঁহাদের চেষ্টাতেই সর্বপ্রথমে ইংরেজী ও পাশ্চাত্ত্য বিদ্যা শিখাইবার ব্যবস্থা হয়। ১৭৩১ খ্রীষ্টাব্দে অর্থাৎ পলাশির যুদ্ধের ২৬ বৎসর পূর্বেই সেন্ট অ্যান্ড্রুজ প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ (St. Andrews Presbyterian Church) একটি অবৈতনিক স্কুল স্থাপন করে। এখানে এবং এইরূপ আরও কয়েকটি মিশনারী প্রতিষ্ঠানে ইংরেজী এবং আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞান শেখান হইত। অষ্টাদশ শতাব্দী শেষ হইবার পূর্বে সর্বসাধারণের এইরূপ শিক্ষার জন্য অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের কথা জানা যায় না। তবে অনেক সম্ভ্রান্ত লোক ভালরূপ ইংরেজী শিখিতেন এবং সাধারণ লোকও কেহ কেহ জীবিকা অর্জনের উপায়স্বরূপ মুটামুটি ইংরেজী শিখিবার চেষ্টা করিতেন। ইহারা নিজের অধ্যবসায়ে, কতকটা ইংরেজ বা ইংরেজীতে অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাহচর্যে ও সহায়তায়, এবং কতকটা কাৰ্যব্যপদেশে ইংরেজী শিখিয়া যথেষ্ট সাংসারিক উন্নতি করিয়াছিলেন। প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও দ্বারকানাথ ঠাকুর কোন বিদ্যালয়ে না পড়িয়াও উত্তম ইংরেজী শিখিয়াছিলেন। প্রসন্নকুমার আইনজীবী ছিলেন এবং যথেষ্ট খ্যাতি ও অর্থ লাভ করিয়াছিলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্যবসায়ের নানা ক্ষেত্রে কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়া প্রভূত সম্পদের অধিকারী হইয়াছিলেন। সাধারণ গৃহস্থ-ঘরে জন্মিয়া নীলমণি দত্ত ইংরেজব্যবসায়ীর বেনিয়ানগিরি করিয়া ধনী হইয়াছিলেন। তাঁহার পুত্র রসময় দত্ত (১৭৯৯-১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দ) ১৬ টাকা বেতনে এক ইংরেজ সওদাগরী অফিসের কেরানীরূপে জীবন আরম্ভ করিয়া কলিকাতা স্মল কজ কোর্টের (Small Cause Court) জজ হইয়াছিলেন এবং মৃত্যুকালে ছয় লক্ষ টাকার সম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছিলেন। সুপ্রীম কোর্ট স্থাপিত হওয়ার ফলে ইংরেজীশিক্ষার প্রসার হয় ও ইহার অর্থোপার্জন শক্তিরও বৃদ্ধি হয়। এই সমুদয় কারণে ইংরেজীশিক্ষার জন্য কোন ভাল প্রতিষ্ঠান
থাকিলেও আঠারো শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের প্রথমভাগে বাঙ্গালীরা অনেকে মোটামুটি ইংরেজীভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করিতে চেষ্টা করিতেন। ইউরোশিয়ান বালকদেরও ইংরেজীতে শিক্ষালাভের বিশেষ প্রয়োজন ও আগ্রহ ছিল। ক্রমে ক্রমে এই সমুদয় কারণে ছোটখাটো একাধিক ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮০০ সনে বা তাহার কাছাকাছি সময়ে কলিকাতার উপকণ্ঠে ভবানীপুরে জগমোহন বসু একটি এবং মধ্য কলিকাতায় ড্রাম সাহেব ধর্মতলা একাডেমী নামে আর একটি ইংরেজী স্কুল স্থাপন করেন। প্রসিদ্ধ শিক্ষক ডিরোজিও এই শেষোক্ত স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ইহার প্রতিষ্ঠাতা স্কজাতীয় ড্রামণ্ড ইংরেজী সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্রে ব্যুৎপন্ন ছিলেন। তাঁহার বাঙ্গালী ও ফিরিঙ্গী ছাত্রেরা তাঁহার শিক্ষায় যুক্তিবাদী দর্শনের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হইত। ডিরোজিও ও তাঁহার হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে এই প্রগতিশীল প্রভাব কিরূপ শক্তিশালী ছিল তাহা পরে উল্লিখিত হইবে। ১৮১৪ সনে ম্যাজিষ্ট্রেট ফর্বেশ (Forbes) সাহেব চুঁচুড়ায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।
যে সমুদয় খ্রীষ্টান মিশনারী বাংলা দেশে পাশ্চাত্ত্য প্রণালীতে শিক্ষার প্রবর্তন করেন তাঁহাদের মধ্যে ব্যাপটিষ্ট উইলিয়ম কেরীর নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। কেরী ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে এদেশে আসেন এবং এক বৎসরের মধ্যেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তখন ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী তাহাদের এলাকায় মিশনারীদিগকে প্রচারকার্য চালাইবার অনুমতি দিতেন না। সুতরাং কেরী ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে ডেন জাতির এলাকা শ্রীরামপুরে যাইয়া বসবাস করেন। এখানে জশুয়া মার্শম্যান (Joshua Marshman) ও উইলিয়ম ওয়ার্ড (William Ward) নামে ব্যাপটিষ্ট মিশনের আর দুইজন তাঁহার সঙ্গে যোগ দেন। এখানে তাঁহারা একটি বিদ্যালয় ও একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় ব্যাকরণ সঙ্কলন করেন, এবং সাহিত্য ও বিজ্ঞানের পুস্তক প্রকাশিত করেন। কেরীর চেষ্টায় হুগলী, দিনাজপুর ও যশোহর জিলায় আরও কয়েকটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমুদয় বিদ্যালয়ে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় আধুনিক প্রণালীতে শেখান হইত। তৎকালে মনিটোরিয়াল (monitorial) পদ্ধতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিল। এই পদ্ধতিতে স্কুলের উচ্চশ্রেণীর ছাত্রেরা শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে নিম্নশ্রেণীর ছাত্রদিগকে পড়াইত। ইহার প্রবর্তক অ্যান্ড্রু বেলের (Andrew Bell) নামানুসারে ইহা ‘বেল পদ্ধতি’ নামেও পরিচিত ছিল। শ্রীরামপুরের মিশনারীগণ এই পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া বহু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১৭ সনে এইপ্রকার শতাধিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল এবং ছাত্রসংখ্যা ছিল ৬৭০০।
এই সময় রবার্ট মে (Robert May) নামে লণ্ডন মিশনারী সোসাইটির একজন পাদ্রী চুঁচুড়ায় তাহার নিজ বাটীতে ‘বেল পদ্ধতিতে শিক্ষা দিবার জন্য একটি স্কুল স্থাপন করেন। ক্রমে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ায় ইহা স্বতন্ত্র বাটীতে স্থানান্তরিত হয় এবং আরও ১৫টি স্কুল স্থাপিত হয়। গভর্নমেন্ট এই সমুদয় স্কুলের ব্যয়নির্বাহের জন্য প্রথমে ৬০০, পরে ৮০০ টাকা মাসিক সাহায্য করেন। স্কুলের জন্য সরকারী দানের ইহাই সম্ভবতঃ প্রথম দৃষ্টান্ত। ১৮১৮ সনে মৃত্যুর পূর্বে মে সাহেব মোট ৩৬টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।
চার্চ মিশনারী সোসাইটি ১৮১৬ সনে খিদিরপুরে জমিদার কালীশঙ্কর ঘোষালের প্রদত্ত ভূমিখণ্ডে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই সময়ে সৈন্যবিভাগের কাপ্তেন স্টুয়ার্ট (Captain Stewart) বর্ধমানে কয়েকটি স্কুল স্থাপন করেন। চার্চ মিশনারী সোসাইটি তাঁহাকে অর্থসাহায্য করেন ও স্কুলগুলির তত্ত্বাবধানের জন্য কয়েকজন মিশনারী পাঠান। ১৮২৩ সনে এই স্কুলগুলির সংখ্যা ছিল ১৬ এবং ছাত্রসংখ্যা ছিল ১২০০। ইহা ছাড়া একটি কেন্দ্রীয় স্কুলে ৫৫ জন ছাত্রকে ইংরেজী ও ফার্সী শেখান হইত।
আর একটি মিশনারী সোসাইটি (Society for Promoting Christian Knowledge) ১৮১৮ সনে কলিকাতা ও তাহার নিকটবর্তী স্থানে কয়েকটি স্কুল স্থাপন করে। ১৮২৩ সনে ইহাদের সংখ্যা ছিল ১২। ইহাদের মধ্যে দুইটিতে ইংরেজী শেখান হইত।
উল্লিখিত মিশনারী স্কুলের অনেকগুলিতেই প্রথমে বাংলায় পড়ান হইত। কোন কোনটিতে পরে ইংরেজী শিক্ষা দেওয়া হইত। আবার কতকগুলি স্কুলে প্রথম হইতেই ইংরেজী শেখান হইত। কিন্তু সব স্কুলেই সাহিত্য, অঙ্ক, ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয় আধুনিক পদ্ধতিতে শেখান হইত। দেশীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়
এবং টোল চতুস্পাঠীর ছাত্রগণ পুরাণে বর্ণিত ইতিহাস ভূগোল প্রভৃতি অনুযায়ী দধি-সমুদ্র, ক্ষীর-সমুদ্র, প্রভৃতি বেষ্টিত জম্বুদ্বীপ এবং সত্যযুগ, ত্রেতাযুগের শতসহস্র বৎসরজীবী রাজগণের বিবরণ শিক্ষা করিত। এইসব নূতন বিদ্যালয়ে পড়িয়া তাহারা এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা প্রভৃতি দেশের অবস্থান জানিত ও ভারতের প্রাচীন ঐতিহাসিক রাজবংশ প্রভৃতির কাহিনী পড়িত। পৃথিবীটা যে সমতল নহে গোলাকার, ইহা যে সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এবং চন্দ্রগ্রহণ যে রাহুর গ্রাসের ফল নহে–এ সমুদয় অনেক নূতন জ্ঞান তাহারা লাভ করিত। যাহাতে নূতন বিষয়ে জ্ঞানলাভের ইচ্ছা জন্মে ও ভাল মন্দ বিচার করিবার প্রবৃত্তি হয় এদিকেও শিক্ষকদের লক্ষ্য ছিল।
তবে মিশনারী স্কুলে যে খ্রীষ্টানধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারিত হইত এবং কোন স্থলে যে হিন্দুধর্মের দেব-দেবী পূজা ও সামাজিক আচার-ব্যবহারের নিন্দা করা হইত সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু অধিকাংশ স্কুলেই ইহা অপ্রত্যক্ষভাবেই হইত। সোজাসুজি খ্রীষ্টধর্ম প্রচার করিবার জন্য স্কুলগুলি ব্যবহার করা হইত এরূপ মনে করিবার কারণ নাই।
মিশনারীদের ব্যাপকভাবে শিক্ষাপ্রদানের চেষ্টার পূর্ব হইতেই কলিকাতার বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যে ইংরেজী শিখিবার জন্য বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়। ইহার ফলে ১৮১৭ সনে কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি ও হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায়–তথা ভারতে-ইংরেজীশিক্ষা প্রচলনের ইতিহাসে এই দুইটি বিশেষ স্মরণীয় ঘটনা।
স্কুলের উপযোগী ইংরেজী ও বাংলা পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ ও প্রকাশের জন্যই স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বইগুলি স্বল্পমূল্যে, কখনও বিনামূল্যে বিতরিত হইত। সে-যুগের কয়েকজন উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারী ও মিশনারী এবং সম্ভ্রান্ত হিন্দু ভদ্রলোকের হস্তে এই সোসাইটির পরিচালনার ভার ন্যস্ত ছিল। ১৮১৮ সনের ১১ই জুলাই এই সভার প্রথম বার্ষিক অধিবেশন হয়। ইহার বিবরণী হইতে জানা যায় যে, ঐ বৎসরে সোসাইটির মোট আয় ছিল ১৭,০০০ টাকা এবং পুস্তক প্রচারের জন্য ব্যয় হইয়াছিল মোট পাঁচ হাজার টাকা। ইংরেজ ও বাঙ্গালীর চাঁদা দ্বারাই এই সোসাইটি প্রতিপালিত হইত। এই সোসাইটি প্রধানতঃ স্কুলপাঠ্য বাংলা বই প্রকাশ করিত, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত, আরবী ও ইংরেজী বইও ছাপাইত।
১৮১৮ সনে কলিকাতার পাঠশালার উন্নতিকল্পে কলিকাতা স্কুল সোসাইটি স্থাপিত হয়। শ্রীরামপুরের মিশনারীরা এই উদ্দেশ্যে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র প্রভৃতি সম্বন্ধে আধুনিককালের উপযোগী পাঠ্যপুস্তক লিখিয়া প্রাথমিক স্কুলে বিতরণ করেন এবং কোন স্কুলে বিশেষ উন্নতির পরিচয় পাইলে ঐ সমুদয় স্কুলের শিক্ষকদিগকে নির্দিষ্ট মাহিনার অতিরিক্ত কিছু টাকা পুরস্কার দিতেন। রাধাকান্ত দেব প্রমুখ কয়েকজন বাঙ্গালী নেতা ও ইংরেজ মিশনারীরা স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করিয়া ব্যাপকভাবে এই প্রণালীতে কাজ করেন। এইসব প্রাথমিক স্কুলের ভাল ভাল ছাত্রদের ইংরেজীশিক্ষার জন্য প্রথমে তাহাদিগকে হিন্দু কলেজে পড়িবার সাহায্যার্থে বৃত্তি দেন, এবং পরে নিজেরাই ইংরেজী শিখিবার জন্য স্কুল করেন। সঙ্গে সঙ্গে অনেক মিশনারী স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে গোঁড়া হিন্দুদের মিশনারী স্কুলের বিরুদ্ধে আপত্তি থাকিলেও পরে এগুলি খুব জনপ্রিয় হয়। গ্রামের লোকে স্কুলের বাড়ী করিয়া দিত এবং হরিপাল গ্রামের ৮৩ জন বাসিন্দা মাসিক চারি আনা হইতে ছয় টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিত। রাধাকান্ত দেব, কালীশঙ্কর ঘোষাল, রসময় দত্ত প্রভৃতি কলিকাতার ধনী লোকেরা অনেক টাকা চাঁদা দিয়া এই উন্নত শ্রেণীর শিক্ষালয়গুলির ভরণপোষণের ব্যবস্থা করিতেন।
পূর্বোল্লিখিত বিদ্যালয়গুলিতে পাশ্চাত্ত্য জ্ঞানবিজ্ঞান ও ইংরেজী শিক্ষার যে সূচনা হয়, হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে তাহা আশাতীতরূপে বৃদ্ধি পায়। বস্তুতঃ ইহা বাংলা দেশে ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণে যেরূপ সহায়তা করিয়াছিল আর কোন একটি প্রতিষ্ঠান দ্বারা তাহার শতাংশও সাধিত হয় নাই–ইহা বলিলে বিশেষ অত্যুক্তি হইবে না। বোধ হয় এই কারণেই পরবর্তীকালে একাধিক ব্যক্তিকে এই প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনার কৃতিত্ব দেওয়া হইয়াছে। এখন পর্যন্তও এদেশে অনেকের বিশ্বাস যে, রামমোহন রায়ই হিন্দু কলেজের পরিকল্পক। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে রামমোহনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনপ্রকার যোগাযোগ ছিল না। এ সম্বন্ধে বিস্তৃত বাদানুবাদ ও আলোচনা না করিয়া হিন্দু কলেজের কল্পনা ও প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে যে-কয়েকটি নিশ্চিত তথ্য জানা গিয়াছে তাহারই উল্লেখ করিব। ১৮১৬ সনের ১৮ই মে তারিখে কলিকাতা সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সার হাইড ঈষ্ট (Sir Hyde East) তাঁহার সহকর্মী ও বন্ধু হ্যাঁরিংটন সাহেবকে বিলাতে যে চিঠি লেখেন তাহাতেই হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও নির্ভরযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায়। ইহাতে তিনি লেখেন, মে মাসের প্রথমে তাঁহার পরিচিত একজন ব্রাহ্মণ তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলেন যে হিন্দুদের মধ্যে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির ইচ্ছা ইউরোপে যে উদার প্রণালীতে শিক্ষা দেওয়া হয় কলিকাতায়ও সেইরূপ শিক্ষাদানের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপিত হউক। এই বিষয়টি আলোচনার জন্য তিনি হাইড ঈষ্টকে একটি সভা আহ্বান করিতে অনুরোধ করেন। এই সময়ে ইংরেজ সরকার ভারতীয়দের ইংরেজীশিক্ষা বিষয়ে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করার বিরুদ্ধে ছিলেন। ঈষ্ট গভর্নর-জেনারেলের ও সুপ্রীম কাউন্সিলের অনুমতি লইয়া একটি সভা আহ্বান করিলেন। ১৮১৬ সনের ১৪ই মে এই সভার অধিবেশন হইল। সভায় ৫০ জনেরও অধিক ধনীমানী ও বিশেষ সম্ভ্রান্ত হিন্দু-প্রধান উপস্থিত ছিলেন এবং ইহাদের মধ্যে কয়েকজন প্রসিদ্ধ সংস্কৃত পণ্ডিতও ছিলেন। সভায় পঞ্চাশ হাজার টাকা চাঁদা স্বাক্ষরিত হইল এবং আরও চাদার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেল। এই সভায় স্থির হইল যে “চাঁদার টাকায় জমি কিনিয়া কলেজের জন্য বাড়ী তৈরী করা হইবে। এই কলেজে বিশেষভাবে বাংলা ও ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য এবং সম্ভব হইলে হিন্দুস্থানী ও ফার্সী, ইংরেজী ধরনে নীতিশিক্ষা, ভগবদ্ভক্তি, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি, এবং যথেষ্ট অর্থ সংগ্রহ হইলে উচ্চাঙ্গের ইংরেজী কাব্য ও সুকুমার সাহিত্য (belles-lettres) প্রভৃতি বিষয় অনুশীলিত হইবে।”
এই সমুদয় বর্ণনা করিয়া ঈষ্ট ঐ পত্রে লিখিয়াছেন :
“এই সভার একটি বিশেষ লক্ষণীয় এই যে নানা জাতির লোক–যাহারা একত্রে বসিয়া ভোজন করিবেন না–তাঁহারাও তাঁহাদের শিশুদের একত্রে শিক্ষা দিবার ব্যবস্থার জন্য এই সভায় সমবেত হইয়াছিলেন।
আর একটি লক্ষণীয় বিষয় এই যে উপস্থিত প্রধান প্রধান পণ্ডিতগণ পূর্বোক্ত শিক্ষণীয় বিষয়গুলির পূর্ণ সমর্থন করিলেন এবং তাঁহাদের মুখপাত্র হিসাবে প্রধান পণ্ডিত সভাভঙ্গের পূর্বে এই বলিয়া আনন্দ প্রকাশ করিলেন যে লুপ্তপ্রায় ভারতের সাহিত্যচর্চা যে তাঁহাদের জীবিতকালেই আবার পুনরুজ্জীবিত হইবে এতদিনে ইহার সম্ভাবনা দেখা দিল।”
পত্রের উপসংহারে ঈষ্ট লিখিয়াছেন :
“স্থির হইল যে এক সপ্তাহ পরেই আর একটি সভার অধিবেশন হইবে। এই কয়দিনের মধ্যেই বহুলোক ঐ সভায় যোগদান করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া আমার অনুমতির জন্য চিঠি লিখিয়াছেন। চারদিক হইতেই প্রস্তাবিত কলেজের সম্পূর্ণ অনুমোদনের সংবাদ পাইতেছি এবং প্রারম্ভেই এক লক্ষ টাকার চাঁদার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়াছে। আপাততঃ এই কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থার জন্য একটি কমিটি গঠিত হইবে- ইহার বেশীর ভাগ সদস্যই হইবেন হিন্দু-তবে দুই তিনজন ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞকেও সাহায্য ও পরামর্শের জন্য ইহার সদস্য করা হইবে।”
ঈষ্ট সাহেবের পরবর্তী চিঠি হইতে জানা যায় এইরূপ একটি কমিটি গঠিত হইয়াছিল এবং প্রস্তাবিত কলেজের নিয়মাবলী প্রস্তুত করা হইয়াছিল। ইহার মুলনীতি হইল যে হিন্দু ভিন্ন অন্য কেহ এই কলেজে ভর্তি হইতে পারিবে না। এই কমিটি বা প্রথম ও দ্বিতীয় সভায় উপস্থিত সভ্যবৃন্দের মধ্যে রামমোহন রায় বা ডেভিড হেয়ারের নাম নাই। যে ব্রাহ্মণ প্রথমে হাইড ঈষ্টের সহিত দেখা করিয়াছিলেন তাঁহার নাম বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়।
হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর হইতেই এই শ্রেণীর প্রগতিশীল বিদ্যালয়ের সংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ১৮৩৫ সালের পূর্বেই কলিকাতায় এরূপ অন্ততঃ ২৫টি বিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছিল। সমসাময়িক বাংলা সংবাদপত্রে এই সমুদয় বিদ্যালয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা হইতে জানা যায় যে ১৮২৮ সনে হিন্দু কলেজে চারিশত ও অন্যান্য স্কুলে একশত ছাত্র ইংরেজী পড়িত ও আধুনিক প্রণালীতে শিক্ষিত হইত। ১৮৩৪ সনের একটি পত্রিকায় কলিকাতার কয়েকটি প্রসিদ্ধ বিদ্যালয়ের নাম ও প্রত্যেকের ছাত্রসংখ্যার উল্লেখ আছে। এই তালিকা হইতে কয়েকটির নাম উদ্ধৃত করিতেছি–
কলেজ — ছাত্রসংখ্যা
হিন্দু কলেজ — ৩৩৮
কলিকাতা স্কুল সোসাইটির বিদ্যালয়গুলি — ৩০০
ডাফ স্কুল — ৩৫০
চার্চ মিশনারী স্কুল — ২০০
অরিয়েন্টাল সেমিনারী — ২০০
হিন্দু অবৈতনিক বিদ্যালয় — ১০০
শেষোক্ত স্কুলে ছাত্রেরা বিনাবেতনে পড়িতে পারিত এবং অর্ধমূল্যে পুস্তক ক্রয় করিতে পারিত। প্রথমে কয়েকজন ধনীব্যক্তি ইহার খরচ দিতেন, পরে চাঁদা তুলিয়া ইহার ব্যয় নির্বাহ হয়। চাঁদাদাতাগণের মধ্যে দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্নকুমার ঠাকুরের নাম পাওয়া যায়। বস্তুতঃ ইংরেজ ও বাঙ্গালী উভয় সম্প্রদায়ের ধনী লোকেরাই এই সমুদয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ দিতেন। কয়েকজন বাঙ্গালী মোটা রকমের দান করিয়াছিলেন। নিম্নে তিনজনের নাম দিতেছি–
দাতার নাম — অর্থের পরিমাণ
বৈদ্যনাথ রায় — ৭০,০০০ টাকা
নরসিংহ চন্দ্র রায় — ৪৬,০০০ টাকা
বনওয়ারীলাল রায় — ৩০,০০০ টাকা
ইহা ছাড়া আরও চারিজন প্রত্যেকে ২০,০০০ টাকা এবং একজন ১০,০০০ টাকা দিয়াছিলেন। ১৮২২ সনে রাজা রামমোহন রায় নিজব্যয়ে একটি ইংরেজী স্কুল স্থাপন করেন।
ডেভিড হেয়ার ও জি. এ. টার্নবুলও প্রত্যেকে একটি করিয়া ইংরেজী স্কুল স্থাপন করেন। কলিকাতার লর্ড বিশপ ১৮২০ সনে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা কনে এবং স্কচ্ মিশনারীরা ডাফ সাহেবের নামে একটি স্কুল করেন। হিন্দু কলেজের ছাত্রেরা কতকগুলি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৩১ সনে তাহারা ছয়টি প্রাতঃকালীন স্কুল পরিচালনা করিত। বাঙ্গালী হিন্দু ও খ্রীষ্টান মিশনারীরা আরও অনেক স্কুল স্থাপিত করেন।
প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও শিক্ষাবি হোরেস হেম্যান উইলসন ১৮৩৬ সনে কলিকাতা ত্যাগ করার প্রাক্কালে লিখিয়াছেন যে, তখন প্রায় ছয়সহস্র যুবক ইংরেজীশিক্ষা লাভ করিত।
কলিকাতার বাহিরেও অনেক নূতন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এই শহরের সন্নিকটে আন্দুল, চনক, পানিহাটি, সুখচর, বরাহনগর প্রভৃতি স্থানে এবং দূর মফঃস্বলে শ্রীরামপুর, টাকী, বারাসত, বর্ধমান, চন্দননগর, শান্তিপুর, মুর্শিদাবাদ, কৃষ্ণনগর, ঢাকা প্রভৃতি শহরে স্কুলপ্রতিষ্ঠার সংবাদ জানা যায়। ১৮১৮ সনে শ্রীরামপুরের মিশনারীরা একটি কলেজ স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। ১৮২১ সনে কলেজের গৃহনির্মাণকার্য শেষ হয়। ইহার জন্য মোট খরচ হয় প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা।
পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, ইংরেজ সরকার এইরূপ আধুনিক প্রণালীতে শিক্ষাদান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। ১৮১৩ সনে ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী যে নূতন সনদ পান তাহাতে শিক্ষার জন্য এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের বরাদ্দ আছে। কিন্তু ইহা বহুকাল পর্যন্ত পাশ্চাত্ত্য জ্ঞানবিজ্ঞানে শিক্ষাদানের জন্য ব্যয় করা হয় নাই। পূর্বে যে সমুদয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা বলা হইল তাহা জনসাধারণের মধ্যে তৎকালে ইংরেজীশিক্ষার প্রবল আগ্রহের ফল বলিয়াই গ্রহণ করিতে হইবে। বস্তুতঃ ১৮৩৫ সনের পূর্বে ইংরেজ গভর্নমেন্ট প্রাচ্য ভাষা ও সাহিত্য অর্থাৎ সংস্কৃত, আরবী, ফার্সী প্রভৃতির মাধ্যমে শিক্ষাদানেই বিশেষ আগ্রহশীল ছিলেন। অপরপক্ষে বাঙ্গালী হিন্দুপ্রধানদের মধ্যে অনেকে ইংরেজীশিক্ষার বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন। খ্রীষ্টান মিশনারী ছাড়াও অনেক ইংরেজ এইপ্রকার শিক্ষার পক্ষপাতী ও বিশেষ উৎসাহদাতা ছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে ডেভিড হেয়ারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
একবার রাজা রামমোহন রায় ধর্মসভা প্রভৃতি অনুষ্ঠানের দ্বারা এদেশীয় যুবকদের উন্নতির প্রস্তাব করিলে হেয়ার সাহেব ইহার প্রতিবাদ করিয়া বলেন যে, আধুনিক যুগোচিত ইউরোপীয় প্রথায় উচ্চশিক্ষা দানই এইরূপ উন্নতির প্রকৃত উপায়। উপস্থিত সকলেই ইহার অনুমোদন করেন। হেয়ার সাহেব ঘড়ির ব্যবসা করিতেন, কিন্তু এদেশের আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন।
ইংরেজী শিখিবার জন্য বাঙ্গালী জনসাধারণের মধ্যেও প্রবল আগ্রহের পরিচয় পাওয়া যায়। ইংরেজী শেখার ব্যবস্থা করার দাবী জানাইয়া ছেলের দল সাহেবদের পাল্কীর পেছনে পেছনে ছুটিত এবং করুণ মিনতি জানাইত। সমসাময়িক ইংরেজ লেখকও ইহার উল্লেখ করিয়াছেন। ইহার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণস্বরূপ একজন সমসাময়িক ইংরেজ লিখিয়াছেন যে, স্কুল বুক সোসাইটির প্রকাশিত ইংরেজী বই দুই বৎসরে ৩১,০০০ খানা বিক্রী হইয়াছিল, কিন্তু গভর্নমেন্টের তরফ হইতে যে সমুদয় আরবী ও সংস্কৃত বই ছাপা হইয়াছিল তাহার বিক্রীর টাকায় এই পুস্তকগুলির দুই মাসের রাখার খরচও ওঠে নাই। মেকলে লিখিয়াছেন যে প্রতি বৎসর বিশ হাজার টাকা ব্যয় করিয়াও তিন বছরে এক হাজার টাকার সংস্কৃত ও আরবী বই বিক্রী হয় নাই। কিন্তু স্কুল বুক সোসাইটি প্রতি বৎসর সাত-আট হাজার বই বিক্রয় করে এবং ছাপাখরচ কুলাইয়া শতকরা কুড়ি টাকা লাভ করে।
অনেক শিক্ষিত লোকের মনেও একটি দৃঢ়মূল সংস্কার আছে যে, কেরানী সম্প্রদায় তৈরী করিবার জন্যই ইংরেজ গভর্নমেন্ট এদেশে ইংরেজীশিক্ষার প্রচলন করে। কিন্তু ইহা সম্পূর্ণ ভ্রমাত্মক ধারণা। উপরে যাহা বলা হইয়াছে তাহা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, গভর্নমেন্ট এদেশে ইংরেজীশিক্ষার জন্য মোটেই আগ্রহশীল ছিল না এবং ১৮৩৫ সনের পূর্বে এ-সম্বন্ধে কোন ব্যবস্থাই করে নাই। বাংলার জনসাধারণের আগ্রহে ও হিন্দুপ্রধানদের উৎসাহেই ইংরেজীশিক্ষার প্রবর্তন হয়। আর এই শিক্ষা যে কেরানীকুল তৈরী করিবার উদ্দেশ্যেই প্রবর্তিত হয় নাই, তৎকালে ইউরোপীয় প্রথায় যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তা ও ভাবনার ভিত্তিতে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা বিভাগের অনুশীলনদ্বারা মানসিক উন্নতি এবং জ্ঞান, বুদ্ধি, ও কর্মশক্তির নব নব উদ্দীপনাই যে ইহার আদর্শ ছিল তৎকালের নূতন প্রণালীতে শিক্ষিত ছাত্রবৃন্দের চিন্তা ও কার্যধারা আলোচনা করিলেই তাহা বেশ বুঝা যাইবে। এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনার পূর্বে এই নূতন আদর্শ বাঙ্গালী নেতা ও সর্বসাধারণের মধ্যে কিরূপ আকার ধারণ করিয়াছিল এবং কতদূর বিস্তৃত হইয়াছিল তাহার দুইটি দৃষ্টান্ত দিতেছি।
গভর্নমেন্ট সংস্কৃতসাহিত্যের নানা বিভাগে উচ্চশিক্ষা প্রদানের জন্য পণ্ডিতদের দ্বারা পরিচালিত একটি সংস্কৃত কলেজ করিবার প্রস্তাব করিলে, রাজা রামমোহন রায় ইহার প্রতিবাদ করিয়া ১৮২৩ সনে ডিসেম্বর মাসে বড়লাট লর্ড আমহার্ষ্টকে যে পত্র লেখেন, তাহার সারমর্ম নিম্নে লিপিবদ্ধ হইল :
“এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হইলে যুবক ছাত্রেরা নূতন কিছুই শিখিবে না। দুই হাজার বছর পূৰ্ব্বেকার ব্যাকরণ ও ন্যায়, দর্শন, মীমাংসা ও বেদ বেদান্তের সূক্ষ্ম ও শুষ্ক বিচার–যাহা বহুকাল যাবৎ ও এখনও ভারতের সর্বত্র প্রচলিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত– তাহারই টীকার টীকা তস্য টীকা প্রভৃতির আলোচনায় জীবনের শ্রেষ্ঠ দ্বাদশ বৎসর অতিবাহিত করিবে। এক কথায় বলিতে গেলে বিলাতে লর্ড বেকনের পূর্বে যেরূপ শিক্ষা প্রচলিত ছিল তাহারই পুনরাবৃত্তি হইবে এবং বিলাতে লর্ড বেকনের পরে যে নূতন প্রণালীতে সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা যুগান্তর উপস্থিত করিয়াছে তাহার সহিত তুলনা করিলেই পূর্বোক্ত প্রাচীন প্রথা ও তৎসদৃশ ভারতে গভর্নমেন্টের প্রস্তাবিত সংস্কৃত শিক্ষার অসারতা প্রতিপন্ন হইবে। ইংরেজ জাতিকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে রাখাই যদি উদ্দেশ্য হইত তবে মধ্যযুগের শিক্ষা প্রণালীর পরিবর্তে বেকনের দর্শন প্রভৃতি পড়াইবার ব্যবস্থা প্রচলিত হইত না। সেইরূপ যদি ইংরেজ গভর্নমেন্ট ভারতবাসীকে অজ্ঞান তিমিরেই রাখিতে চাহেন তবে সংস্কৃত কলেজ করিলেই সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে সাধিত হইবে। কিন্তু যদি এ দেশবাসীর মানসিক উন্নতি ও উদার জ্ঞানলাভই গভর্নমেন্টের লক্ষ্য ও আদর্শ হয় তাহা হইলে আধুনিকভাবে ও উন্নত পাশ্চাত্ত্য প্রণালীতে গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, শরীর-সংস্থান বিদ্যা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান প্রভৃতি শিখাইবার জন্য উপযুক্ত ইউরোপীয় শিক্ষক পরিচালিত একটি কলেজ স্থাপন এবং ইহার সঙ্গে প্রয়োজনীয় গ্রন্থাগার ও যন্ত্রপাতি প্রভৃতি সংগ্রহ করিতে হইবে।”
এইরূপ ধারণা যে কেবল রাজা রামমোহন রায়ের মনেই উদয় হয় নাই এবং তাঁহার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁহার পূর্বেই এইরূপ আদর্শ রূপায়িত করিবার জন্য হিন্দু কলেজ ও পূর্বোক্ত অন্যান্য শিক্ষালয়গুলির প্রতিষ্ঠাই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। কারণ, এই সকল বিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্য ও ব্যাকরণ, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র, ভূগোল (আধুনিক পদ্ধতি), ভারতীয় ও ইউরোপীয় দর্শন, প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাস, চিত্রকলা ও নানাবিধ শিল্পকলা শিক্ষা দেওয়া হইত।
শিক্ষার এই উন্নত আদর্শ বাংলা দেশের সর্বসাধারণের মধ্যে কিরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল ‘সুধাকর’ নামক একটি বাংলা পত্রিকার ১২৪০ সালের ২০শে ভাদ্রের (১৮৩৩ খ্র., ৭ই সেপ্টেম্বর) সংখ্যায় প্রকাশিত একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ হইতে তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। ইহার কিয়দংশ এখানে উদ্ধৃত করিতেছি :
“ভারতবর্ষের মধ্যে বিস্তীর্ণরূপে বিদ্যাপ্রচারের নিমিত্তে সমাচার পত্র সম্পাদকেরা যতই লিখেন বোধহয় গভর্নমেন্ট তাহাতে শ্রুতিপাতই করেন না। …যে বিদ্যায় খরচ করা উচিত বুঝেন তদর্থেই খরচ করিতেছেন। কিন্তু এইমাত্র কহিতে পারি ঐ খরচের দ্বারা ভারতবর্ষের সর্বসাধারণের কি উপকার দর্শিতেছে আমরা এ পর্যন্ত তাহার কিছু জানিতে পারি নাই।…সংস্কৃত বিদ্যালয়েতে গভর্নমেন্টের খরচ সত্য বটে কিন্তু তদ্দারা সৰ্বসাধারণের বিশেষ উপকার নাই কেননা সেখানে কেবল ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য জাতির বিদ্যাভ্যাস হয় না। যখন গভর্নমেন্ট সংস্কৃত বিদ্যালয় স্থাপিত না করিয়াছিলেন তখনও স্থানে স্থানে চতুস্পাঠী ছিল, এবং তাহাতেই ব্রাহ্মণ সন্তানের বিদ্যাভ্যাস নির্বাহ হইত। আর এখনও দেশে দেশে সংস্কৃত বিদ্যাভ্যাসের চতুস্পাঠী আছে, অতএব গভর্নমেন্টের আনুকূল্য ব্যতিরেকেও সংস্কৃত বিদ্যাভ্যাসের বড় ক্ষতি হয় না, এবং সে বিদ্যার দ্বারা কেবল ব্যবস্থাদি দান ভিন্ন শাসনাদি কর্মেরও কোন উপকার নাই। অতএব যে বিদ্যা শিক্ষাতে লোকের অন্ধকার দূর হইয়া রাজশাসনাদিতে নৈপুণ্য জন্মে তাবদ্দেশ ব্যাপিয়া সেই বিদ্যার বীজ রোপণ করাই ধাৰ্মিক দয়ালু রাজার উচিত কৰ্ম্ম…কিন্তু গ্রামে গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন না করিলেও তাহা দূর হইবেক না। যদি কহেন তাবদধিকারের গ্রামে গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপিত করা অনেক ব্যয়সাধ্য, তাহা সুসিদ্ধ হওয়া কঠিন তবে তাহার এই এক উপায় আমরা দেখিতেছি…তাহা এই যে গভর্নমেন্ট যদ্যপি অনুগ্রহপূর্বক তাঁহার অধিকারের প্রতি গ্রামের প্রজারদের উপর যোত্রানুসারে এক এক চাঁদার আজ্ঞা করেন তবে তাঁহার আজ্ঞাবরোধ কোনপ্রকারে হইবেক না সুতরাং যাঁহার যেমত সাধ্য তদনুসারে ঐ চাদাতে অবশ্যই দিবেন…অবশিষ্ট খরচ এডুকেশন কমিটি হইতে দিলেই স্বচ্ছন্দে সর্বত্র বিদ্যালয় চলিতে পারিবেক…নতুবা আমরা যে দেখিব কেবল গভর্নমেন্টের খরচে প্রতি গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপিত হইয়া লোকের অন্ধকার দূর হইতেছে এখনও সে কাল কালের মধ্যে গণিত হয় নাই।”
এই প্রবন্ধের কয়েকটি উক্তি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমতঃ, জ্ঞানাঞ্জনশলাকা দ্বারা মনের অন্ধকার দূর করা বিদ্যাশিক্ষার আদর্শ এবং শাস্ত্রের ব্যবস্থায় আবদ্ধ না থাকিয়া শিক্ষা যে যুগোপযোগী ও কার্যকরী হওয়া উচিত, এই ধারণাটি খুব
স্পষ্টভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ, বিদ্যাশিক্ষা যে সর্বসাধারণের মধ্যে বিস্তৃত হওয়া দরকার এবং ইহার জন্য কেবল শহরে নহে, প্রতি গ্রামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন তাহার উপর খুব জোর দেওয়া হইয়াছে। তৃতীয়তঃ, ইহার ব্যয়ের জন্য কেবলমাত্র গভর্নমেন্ট মুখাপেক্ষী না হইয়া সাধারণের নিকট হইতে চাঁদা আদায় করা বাঞ্ছনীয় ও প্রয়োজনবোধ করিলে গভর্নমেন্ট তাহার ব্যবস্থা করিবেন, এই প্রস্তাবে শিক্ষাপ্রসারের প্রতি গভীর আন্তরিক সহানুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়।
২. শিক্ষা সম্বন্ধে সরকারী নীতি
প্রবল জনমতের প্রভাবে এবং সম্ভবতঃ অন্য কয়েকটি কারণে ইংরেজীর মাধ্যমে পাশ্চাত্ত্য প্রণালীতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা সম্বন্ধে গভর্নমেন্টের মনোভাব ক্রমশঃ পরিবর্তিত হইল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজদের প্রভুত্ব বাংলা দেশে প্রতিষ্ঠিত হইলে প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্বন্ধে তাহাদের উচ্চধারণা জন্মে–সুতরাং প্রথমে সেই সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ ও শিক্ষাদান করাই তাহাদের প্রধান লক্ষ্য হয়। কয়েকজন মুসলমান-প্রধানের অনুরোধে আরবী, ফারসী ও মুসলিম আইন-কানুন শিক্ষা দিবার জন্য ওয়ারেন হেষ্টিংস ১৭৮১ সনে কলিকাতা মাদ্রাসা স্থাপন করেন। ১৭৯১ সনে হিন্দুশাস্ত্র, সাহিত্য, আইন প্রভৃতি শিক্ষার জন্য রেসিডেন্ট জোনাথান ডানকান কাশীতে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এই সময়ে বিলাতে কয়েকজন মনস্বী ও ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির উপর প্রভাবশালী ব্যক্তি ভারতীয়দের শিক্ষাদান সম্বন্ধে আন্দোলন করেন। ইঁহাদের মধ্যে দুই দল ছিল। এক দলের মতে ভারতীয়দের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতা দূর করিবার জন্য খ্রীষ্টধর্মের ভিত্তিতে শিক্ষাদান করাই কর্তব্য। আর এক দল বেন্থামের জনহিতবাদের (Utilitarianism) আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া আধুনিককালের উপযোগী শিক্ষাদানের সপক্ষে মত প্রকাশ করেন। প্রথম দলের আন্দোলনের ফলে ১৮১৩ সনে কোম্পানিকে যে নূতন সনদ দেওয়া হয় তাহাতে খ্রীষ্টীয় ধর্মযাজকদের এদেশে বসবাসের অনুমতি এবং এদেশে শিক্ষার উন্নতিকল্পে প্রধানতঃ ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কোম্পানির ভারতীয় উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের অনেকেই-ওয়ারেন হেষ্টিংস, ম্যালকম, মনরো প্রভৃতি এদেশে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের বিরোধী ছিলেন, সুতরাং দশ বৎসরের মধ্যে শিক্ষা সম্বন্ধে কোন নির্দিষ্ট নীতির অভাবে ঐ বরাদ্দ টাকা ব্যয় করা হইল না। গভর্নমেন্ট প্রাচীন চিন্তা, ধারণা ও সংস্কৃতির শিক্ষাই আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করেন এবং ১৮২৩ সনে কলিকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। ইহার প্রতিবাদ করিয়া রাজা রামমোহন রায় বড়লাটকে যে চিঠি লিখিয়াছিলেন তাহা পূর্বেই উদ্ধৃত হইয়াছে। গভর্নমেন্ট নিরপেক্ষ বা উদাসীন থাকিলেও পাশ্চাত্ত্য প্রণালীতে শিক্ষার জন্য মিশনারীগণ ও বাঙ্গালী জনসাধারণের চেষ্টায় যে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইতেছিল তাহাও পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। এই সমুদয় কারণে ১৮২৩ সনে গভর্নমেন্ট শিক্ষাপ্রণালী স্থির করা ও তদনুসারে বার্ষিক বরাদ্দ এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের জন্য একটি কমিটি গঠন করিলেন (General Committee of Public Instruction)। এই সময় বিলাতে বেন্থামের শিষ্য জেমস্ মিল ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন এবং তাঁহারই পরামর্শে কোর্ট অব ডিরেক্টরস্ (Court of Directors) ১৮২৪ সনের ১৮ ফেব্রুআরি তারিখের নির্দেশপত্রে হিন্দু বা মুসলমান শাস্ত্রের পরিবর্তে আধুনিক প্রণালীকে জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার সমর্থন করিলেন। ইহা সত্ত্বেও পূর্বোক্ত কমিটি এযাবৎ কাল পর্যন্ত গভর্নমেন্টের অনুসৃত নীতি একেবারে পরিত্যাগ করিলেন না। কিন্তু ক্রমে ইহার সদস্যদের মধ্যে মতভেদ হইল। একদল পুরাতন প্রথায় সংস্কৃত, আরবী, ফারসীর পক্ষপাতী; আর একদল পাশ্চাত্ত্য প্রণালীতে শিক্ষাদানের সমর্থনকারী। ১৮২৮ সনে লর্ড বেন্টিঙ্ক বড়লাট হইয়া ভারতে আসিলেন। তিনি বেন্থাম ও মিলের ভক্ত ছিলেন। ১৮২৯ সনের ১৯শে নভেম্বর বেন্থাম নিজে তাঁহাকে পত্র লিখিয়া উৎসাহিত করিলেন। ফলে তিনি ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার অনুমোদন করিলেন।
কিন্তু ইহা সত্ত্বেও শিক্ষা-কমিটির সদস্যগণের মধ্যে পূর্বের ন্যায় এ-বিষয়ে তীব্র মতভেদ উপস্থিত হইল। প্রায় অর্ধেক সদস্য প্রাচীন সংস্কৃতিমূলক শিক্ষার, আর বাকী অর্ধেক আধুনিক যুগোপযোগী প্রগতিশীল শিক্ষাপদ্ধতির সমর্থন করিলেন। এই সময়ে (১৮৩৪ খ্রী.) মেকলে গভর্নর জেনারেলের সভার আইন সদস্যরূপে ভারতে আসিলেন। এই সভায় এই দুই বিরুদ্ধমতের আলোচনা প্রসঙ্গে মেকলে ১৮৩৫ সনের ২রা ফেব্রুআরি এই সম্বন্ধে এক সুদীর্ঘ মন্তব্য (minute) লিপিবদ্ধ করিয়া সভায় পেশ করিলেন। ইহাতে তাঁহার অননুকরণীয় ভাষায় নানারূপ যুক্তিতর্ক এবং ব্যঙ্গ ও শ্লেষসহকারে প্রাচীন পদ্ধতির তীব্র নিন্দা করিয়া খুব জোরের সহিত ইংরেজীভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্ত্য প্রণালীতে শিক্ষা প্রবর্তনের সমর্থন করিলেন। এই সমর্থন পাইয়া বেন্টিঙ্ক আর কালবিলম্ব করিলেন না। ১৮৩৫ সনের ৭ই মার্চ গভর্নমেন্টের সিদ্ধান্ত (Resolution) প্রচারিত হইল। ইহার মর্ম এই, অতঃপর এদেশে ইংরেজীভাষার মাধ্যমে ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারই সরকারী নীতি বলিয়া গৃহীত হইবে এবং শিক্ষার জন্য নির্ধারিত টাকা এই উদ্দেশ্যেই ব্যয়িত হইবে। এইরূপে সরকারের সাহায্যে ইংরেজীশিক্ষা এদেশে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হইল।
মেকলের সুদীর্ঘ মন্তব্য একখানি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ দলিল। ইহাতে ইংরেজীশিক্ষা যেভাবে ও যে-ভাষায় সমর্থন করা হইয়াছে ইহার পূর্বে আর কেহ তাহা করেন নাই। এদেশে এখনও অনেকের ধারণা যে মেকলেই এদেশে ইংরেজীশিক্ষার প্রবর্তক। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ সত্য নহে। এদেশের দেশীয় ও বিদেশীয় অনেক ব্যক্তি এবং জনসাধারণের একটি বিশিষ্ট অংশ বহুকাল হইতেই যে এই প্রণালীর শিক্ষার দাবি করিতেছিল তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। তারপর ইহাও স্মরণ রাখিতে হইবে যে, মেকলে এদেশে আসিবার পূর্বেই বিলাতের কোর্ট অব ডিরেক্টরস্ এইরূপ শিক্ষাপ্রণালীর অনুমোদন করিয়াছিলেন এবং বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্কও বেন্থামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া এই জনহিতকর শিক্ষাপ্রণালী প্রবর্তনের জন্য মনস্থির করিয়াছিলেন। সুতরাং মেকলের সুদীর্ঘ মন্তব্য গভর্নমেন্টের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি ত্বরান্বিত এবং ইহা গ্রহণের পথ সুগম করিলেও ইহার সবটুকু কৃতিত্বই মেকলেকে দেওয়া যায় না।
ইংরেজীশিক্ষার এই সরকারী সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে আর-একটি ভ্রান্ত ধারণা এখনও প্রচলিত। অনেকে মনে করেন যে, ইহার ফলেই বাংলাভাষার পরিবর্তে ইংরেজীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। কিন্তু স্মরণ রাখিতে হইবে, তখন মীমাংসার বিষয় ছিল উচ্চশিক্ষার বাহন সংস্কৃত, আরবী ও ফারসী ভাষা হইবে, না ইংরেজী ভাষা হইবে। বাংলাভাষার কোন প্রশ্নই তখন ওঠে নাই এবং বাংলাভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার কোন সম্ভাবনাও তখন ছিল না-কমিটির মধ্যে ইহার যে বিরোধীদল ছিল তাহারাও বাংলাভাষায় উচ্চশিক্ষা দিবার প্রস্তাব করে নাই। অপরপক্ষে, উক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারী রিপোর্টে স্পষ্ট ঘোষণা করা হইল, বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা এখনও যেরূপ চলিতেছে সেইরূপই চলিতে থাকিবে। অবশ্য একথা ঠিক, ইংরেজীশিক্ষা একবার চালু হইলে বাঙ্গালী হিন্দুরা ইহার প্রতি এতই ঝুঁকিয়া পড়িল যে বাংলাভাষায় শিক্ষাদান ক্রমেই হ্রাস পাইতে লাগিল। কিন্তু ইহা কোন সরকারী সিদ্ধান্তের ফল নহে, লোকের রুচি ও মতিগতির পরিবর্তনের ফলেই তাহা ঘটিয়াছিল। ইংরেজীসাহিত্যের উচ্চমান এবং এই শিক্ষার অর্থোপার্জন ও উচ্চপদ অধিকারের সম্ভাবনাও ইহার কারণ।
বর্তমানকালে প্রচলিত আর-একটি ধারণা, একদল কেরানী সৃষ্টি করার জন্যই ইংরেজ সরকার এদেশে ইংরেজীশিক্ষার প্রচলন করে। সরকার কর্তৃক এই শিক্ষার প্রচলনের বহুপূর্ব হইতেই জনসাধারণ ইহা আগ্রহসহকারে গ্রহণ করিয়াছিল, তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। আর এই শিক্ষাপ্রচলন সম্বন্ধীয় চিঠিপত্র ও সরকারী দলিল প্রভৃতি দেখিলেই বুঝা যাইবে, কেরানীর দল সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যেই কোর্ট অব ডিরেক্টরস, মিল, বেন্টিঙ্ক বা মেকলে ইংরেজীশিক্ষার প্রবর্তন অনুমোদন করেন নাই। আর কেরানীকুল সৃষ্টি করাই যদি ইংরেজ গভর্নমেন্টের মতলব হইত তাহা হইলে প্রথম হইতেই তাহারা সংস্কৃত, আরবী, ফারসীতে উচ্চশিক্ষাদানের জন্য অর্থব্যয় করিতেন না। তবে একথা অস্বীকার করা যায় না, যখন বিশ্ববিদ্যালয় ও বহুসংখ্যক স্কুল-কলেজের প্রতিষ্ঠায় ইংরেজীশিক্ষিতদের দল বৃদ্ধি পাইল, ফারসীর পরিবর্তে ইংরেজীভাষা শাসন ও বিচারকার্যে ব্যবহৃত হইতে লাগিল, তখন ইংরেজীভাষার জ্ঞান জীবিকার্জনের একটি উৎকৃষ্ট উপায়ে পরিগণিত হইল। ফলে ক্রমশঃই ইংরেজীশিক্ষিত লোক কেরানীকুলের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে লাগিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই শিক্ষার ফলে যে বাঙ্গালীরা উত্তরোত্তর উচ্চ রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইল, এবং ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে আধুনিক চিন্তার ধারা দেশে প্রবর্তিত করিল সেকথাও স্মরণ রাখা কর্তব্য।
প্রথমে যাহারা ইংরেজীশিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষে ছিলেন তাঁহারা কেরানীসৃষ্টির জন্যই ব্যাকুল ছিলেন এরূপ মনে করিবার কারণ নাই। তবে তাঁহারা সকলেই যে নিঃস্বার্থভাবে নিছক ভারতীয়দের মানসিক উন্নতি ও যুগোপযোগী উদার ভাবধারা ও মনোবৃত্তি সৃজনের জন্য এই কার্যে তীব্র হইয়াছিলেন তাহাও সত্য নহে। খ্রীষ্টান মিশনারীদের আশা ছিল যে ইংরেজীশিক্ষার ফলে হিন্দুরা খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হইবে। ইংরেজীশিক্ষার প্রধান পৃষ্ঠপোষক মেকলেও তাঁহার পিতার নিকট চিঠিতে লিখিয়াছিলেন, “আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইংরেজীশিক্ষার ফলে ত্রিশ বৎসর পরে সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের মধ্য হইতে পৌত্তলিকতা একেবারে লোপ পাইবে।” অনেক হিন্দুপ্রধানও মনে করিতেন, ইংরেজীশিক্ষার প্রবর্তন হইলে সমাজের অনেক কুসংস্কার এবং অসঙ্গত ও অযৌক্তিক কদাচার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস দূরীভূত হইবে। আবার অন্যদিকে অনেক ইংরেজ মনে করিতেন, ইংরেজীশিক্ষার ফলে ইউরোপের ইতিহাস, সাহিত্য প্রভৃতি পাঠ করিয়া ভারতবাসী ইংরেজের প্রভুত্ব না মানিয়া স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা করিবে। মেকলে ১৮৩৩ সনে পালিয়ামেন্টে বলিয়াছিলেন, যদি এমন দিন সত্যসত্যই আসে তবে আমি তাহার প্রতিবন্ধকতা করিব না–ইহা ইংলণ্ডের সর্বাপেক্ষা গৌরব ও অহঙ্কারের দিন বলিয়া গণ্য করিব। মেজর জেনারেল লায়নেল স্মিথ ১৮৩১ সনে বিলাতের কমনস্ সভার একটি কমিটিতে সাক্ষ্যদানকালে বলিয়াছিলেন যে ভারতীয়েরা যে-পরিমাণে আধুনিক শিক্ষা পাইবে সেই পরিমাণে স্বাধীনতার দাবি করিবে। এলফিমষ্টোন একবার একগাদা পাঠ্যপুস্তক দেখাইয়া এক বন্ধুকে বলিয়াছিলেন যে, এগুলি আমাদের বিলাতে ফিরিয়া যাইবার টিকিট। বস্তুতঃ এইরূপ আশঙ্কায় একদল ইংরেজ বিলাতে কমনস্ সভায় এদেশে ইংরেজীশিক্ষার প্রবর্তনের বিরোধিতা করিয়াছিলেন। সুতরাং কেরানীকুল সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই তাঁহারা ইহা করিয়াছিলেন, এরূপ ধারণা অসঙ্গত ও অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক।
৩. হিন্দু কলেজের শিক্ষা
ইংরেজীর মাধ্যমে পাশ্চাত্ত্য প্রণালীতে শিক্ষালাভের ফলে বাংলা দেশে ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতির অন্যান্য বিভাগে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়াছিল তাহার প্রকৃতি বা স্বরূপ ও কারণ বুঝিতে হইলে সে-সময়কার কলেজের ছাত্রগণের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা এবং অন্যান্য উপায়ে জ্ঞানার্জন ও মানসিক বৃত্তির অনুশীলন সম্বন্ধে আলোচনা করা আবশ্যক। হিন্দু কলেজ এই বিষয়ে আদর্শস্থানীয় ছিল, সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানটি সম্বন্ধেই প্রথমে কিছু বলিব।
এই প্রসঙ্গে প্রথমেই এই কলেজের তরুণ অধ্যাপক লুই হেনরী ভিভিয়ান ডিরোজিও-র নাম উল্লেখ করিতে হয়। ইনি কলিকাতাবাসী একজন ইউরেশিয়ান (পর্তুগীজ বংশোদ্ভব) এবং ১৮০৮ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি পূর্বোক্ত ধর্মতলার ড্রাম সাহেবের স্কুলে শিক্ষালাভ করেন। স্কচ জাতীয় ড্রাম ছিলেন সর্বসংস্কারমুক্ত যুক্তিবাদী ও স্বাধীন চিন্তার উপাসক। ডিরোজিও তাঁহার দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার হিন্দু কলেজের ছাত্রদিগকেও অনুপ্রাণিত করিয়াছিলেন। ১৮২৬ সনের মে মাসে তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষক নিযুক্ত হন এবং পাঁচবৎসর তথায় শিক্ষকতা করেন। কিন্তু এই স্বল্পকালের মধ্যেই তাহার আদর্শে ও ভাবধারায় তিনি ছাত্রদের উপর যেরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন ভারতবর্ষে শিক্ষার ইতিহাসে তাহার তুলনা নাই। ক্লাসের বাহিরে ডিরোজিও ছাত্রগণের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মিশিতেন এবং আলোচনামূলক ছাত্রপ্রতিষ্ঠানে ও কলেজের পত্রিকার মাধ্যমে বিবিধ বিষয় আলোচনা করিতেন। শাসন ও সামাজিক সংস্কার হইতে আরম্ভ করিয়া, অদৃষ্টবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ঈশ্বরের অস্তিত্ব, প্রতিমাপূজা, পুরোহিত সম্প্রদায়, পাপ-পুণ্য, স্বদেশপ্রীতি, স্ত্রীশিক্ষা প্রভৃতি সর্ববিষয়ে স্বাধীন যুক্তিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রকার সংস্কারমুক্ত মতামত প্রকাশ করিতেন এবং ছাত্রদিগকেও এইসব বিষয়ে নির্ভীক ও স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতে উৎসাহ দিতেন। মনস্বী প্যারীচাঁদ মিত্র ডিরোজিও সম্বন্ধে একস্থানে লিখিয়াছেন :
“তিনি ছাত্রদের মনে কতকগুলি মহান আদর্শনীতি গভীরভাবে অনুপ্রবিষ্ট করাইয়াছিলেন–যথা, স্বাধীন চিন্তার দ্বারা জীবনে মত ও পথ স্থির করিবে, কোন প্রচলিত সংস্কার অন্ধভাবে অনুসরণ করিবে না, জীবনে ও মরণে একমাত্র সত্যকেই অবলম্বন করিবে, সকল প্রকার সদ্গুণ অনুশীলন করিবে এবং যাহা কিছু অসৎ ও অন্যায় তাহা পরিহার করিবে। তিনি প্রাচীন ইতিহাস হইতে ন্যায়পরায়ণতা, দেশপ্রেম, মানবিকতা ও স্বার্থত্যাগের দৃষ্টান্ত ছাত্রদের পড়িয়া শুনাইতেন। যে ভাবে তিনি এই আদর্শ গুণগুলি বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়া ফুটাইয়া তুলিতেন তাহাতে ছাত্রেরা অভিভূত হইত এবং পূর্বোক্ত বিভিন্ন আদর্শ গুণগুলি বিভিন্ন ছাত্রদের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করিত।”
ডিরোজিওর মৃত্যুর পর তাঁহার ছাত্রদের পরিচালিত পত্রিকায় (Bengal Spectator) নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছিল :
“হেনরী ডিরোজিও তাঁহার জ্ঞান, ধীশক্তি ও উৎসাহ, হিন্দু কলেজের ভিতরে ও বাহিরে অক্লান্ত কৰ্ম্মপ্রবণতা, হেয়ার সাহেবের স্কুলে বক্তৃতামালা, কলেজের সাপ্তাহিক বিতর্ক সভায় (Academic Institution, a debating club) farzufato বক্তৃতা ও উপদেশ, এবং সর্বোপরি তাঁহার উদ্দীপনাময়, জ্ঞানালোকদীপ্ত স্বচ্ছন্দ কথাবার্তা দ্বারা ভারতীয় যুবকদিগের চিত্তে যে গভীর পরিবর্তন আনিয়াছিলেন তাহা আজও আছে এবং তাহার ছাত্রদের মনে অক্ষয় স্মৃতিরূপে চিরকাল বিরাজ করিবে।”
দেশাত্মবোধ বা দেশপ্রেম বলিতে আমরা যাহা বুঝি, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বাঙ্গালীর মনে তাহার অস্তিত্ব ছিল না। ডিরোজিও নিজেকে ভারতীয় বলিয়া মনে করিতেন এবং দেশাত্মবোধক ইংরেজী কবিতা লিখিয়াছিলেন। জন্মভূমি ভারতের প্রতি কবিতৃময় উচ্ছ্বাসের ইহাই বোধ হয় প্রথম দৃষ্টান্ত। ইহাতে অনুপ্রাণিত হইয়া তাঁহার হিন্দু কলেজের ছাত্র কাশীপ্রসাদ ঘোষও ১৮৩০ সনে ইংরেজীতে অনুরূপ কবিতা রচনা করিয়াছিলেন। ছাত্রদের উপর তাহার রাজনীতিক মতের প্রভাব কিরূপ ছিল, দুইটি দৃষ্টান্ত হইতে তাহা বুঝা যায়। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ১৮৩০ সনের জুলাই মাসে যে বিদ্রোহ হয় তাহার স্মরণার্থে ঐ বৎসর ১০ই ডিসেম্বর দুইশত ছাত্র কলিকাতা টাউন হলে মিলিত হইয়া উৎসব করে। ঐ বৎসর বড়দিনের উৎসবে ফরাসী বিদ্রোহের প্রতীক ত্রিবর্ণ পতাকা ময়দানে মনুমেন্টের উপর উড়িতে দেখা যায়। ইহা যে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের কীর্তি সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।
ছাত্রদের উপর যুক্তিবাদী সংস্কারমুক্ত ডিরোজিওর অতুলনীয় প্রভাব দেখিয়া একদল হিন্দু বিশেষ শঙ্কিত হন এবং তাঁহাদের চেষ্টায় ডিরোজিওকে পদত্যাগ করিতে হয়। কিন্তু কয়েক মাস পরেই কলেরা রোগে তাঁহার মৃত্যু হয় (২৬ ডিসেম্বর, ১৮৩১ খ্রী.)। তখন তাঁহার বয়স মাত্র ২৩ বৎসর ৮ মাস। বাংলা দেশে ইংরেজীশিক্ষা ও পাশ্চাত্ত্য ভাবের প্রবর্তনের ইতিহাসে ডিরোজিওর নাম চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে।
ডিরোজিও হিন্দু কলেজ ত্যাগ করিলেও তাঁহার মত ও ব্যক্তিত্বের প্রভাব হিন্দু কলেজ হইতে বিলুপ্ত হয় নাই। সামাজিক, রাজনীতিক, অর্থনীতিক প্রভৃতি সকল বিষয়েই হিন্দু কলেজের ছাত্রেরা সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল উদার মত পোষণ করিত। এ বিষয়ে ১৮৩৬ সনের মে মাসে ‘Englishman’ পত্রিকায় প্রকাশিত নিম্নলিখিত মন্তব্যটি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য :
“রাজনীতি বিষয়ে হিন্দু কলেজের ছাত্ররা উগ্রপন্থী (radicals) এবং বেন্থামের নীতির অনুগামী। ‘টোরি’ এই নামটি তাহাদের ঘৃণার উদ্রেক করে। তাহারা মনে করে গভর্নমেন্ট সৰ্ব্বপ্রকার মতের প্রতিই সহানুভূতি দেখাইবেন এবং সর্বপ্রকার অসভ্য রীতি ও প্রথা দূর করিবার একমাত্র উপায় শিক্ষাবিস্তার। অর্থনীতি বিষয়ে তাহারা অ্যাডাম স্মিথের মতবাদ গ্রহণ করে। তাহারা মনে করে যে একচেটিয়া অধিকার (monopoly) কোনপ্রকার বাণিজ্য-নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং অনেক দেশের আন্তর্জাতিক নিয়মাবলী কৃষি ও উৎপাদনের উন্নতির প্রতিবন্ধক এবং ব্যবসায়ের স্বাভাবিক গতির প্রতিরোধক।”
ইউরোপের উদারতাবাদী লেখক বেকন, হিউম, টম, পেইন প্রভৃতি হিন্দু কলেজের ছাত্রদের উপর খুব প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। একজন পুস্তকবিক্রেতা টম পেইন প্রণীত “Age of Reason” (যুক্তির যুগ) নামক গ্রন্থ এক টাকা মুল্যে বিক্রয়ের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। কিন্তু হিন্দু কলেজের ছাত্রদের এই বই কেনার ঝোঁক দেখিয়া দাম বাড়াইয়া পাঁচ টাকা করিল। কিছুকাল পরে ইহার এক অংশের বাংলা অনুবাদ একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হইল।
প্রগতিশীল মতবাদের আলোচনার জন্য হিন্দু কলেজে কয়েকটি ছাত্রপরিষদ্ ও পত্রিকা ছিল। ইহার মধ্যে সর্বপ্রথমটি- Academic Association ডিরোজিও কর্তৃক ১৮২৮ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, দেশপ্রেম প্রভৃতি এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও স্বরূপ বিষয়ে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মতামত আলোচিত হইত। যুক্তির মানদণ্ডে বিচার করিয়া, হিন্দুধর্ম ও সমাজের অনেক রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার তাহারা নিন্দা করিত। খাদ্যাখাদ্য বিচার, গুরু-পুরোহিতের আধিপত্য, জাতিভেদ, স্ত্রীজাতির অবনতি, প্রতিমাপূজা প্রভৃতি তাহাদের বিরুদ্ধ-আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। তাহাদের একদল যুক্তিনিষ্ঠ ভাবনা কার্যে পরিণত করিবার প্রয়াস পাইল। ইহারই ফলে হিন্দু অভিভাবকদের প্ররোচনায় ডিরোজিওকে হিন্দু কলেজ হইতে অপসৃত করা হইল।
১৮৩৮ সনের ১৬ মে সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভার (Society for the Acquistion of General Knowledge) প্রথম অধিবেশন হয়। দেশের সর্ববিধ অবস্থাসম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন ও বিস্তার করাই ছিল ইহার প্রধান উদ্দেশ্য। সভায় ইংরেজী ও বাংলা উভয় ভাষাই ব্যবহৃত হইত। বাংলাভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ও বাংলাসাহিত্যের উন্নতিবিষয়ে এই সভায় আলোচনা হইত। “ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজ প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে সভার অধিবেশনে প্রবন্ধপাঠ ও পাঠান্তে আলোচনা করা হইত। উৎকৃষ্ট প্রবন্ধগুলি নির্বাচন করিয়া গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হইত। সভায় পঠিত এইরকম প্রবন্ধ-সঙ্কলনের তিনটি খণ্ড ১৮৪০, ১৮৪২ ও ১৮৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। সঙ্কলনের নাম– Selection of Discourses Delivered at the Meeting of the Society for the Acquistion of General Knowledge.”[৫]
হিন্দু কলেজের ছাত্রেরা ১৮২৮ হইতে ১৮৪৩ সনের মধ্যে নিম্নলিখিত পত্রিকাগুলি পরিচালনা করিত—
Parthenon (১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দ), জ্ঞানান্বেষণ (Gyananneshun-১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দ), Hindu Pioneer, Bengal Spectator (১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দ)।
এই সমুদয় পত্রিকায় দেশের যাবতীয় বিষয় আলোচিত হইত। রাজনীতি বিষয়ে ইংরেজ গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করা হইত-পরে ইহার উল্লেখ করা যাইবে। রাজা রামমোহন রায়ের ধর্ম ও সমাজের সংস্কারপ্রচেষ্টা হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মতে পর্যাপ্ত ছিল না–অনেক বিষয়েই তাহারা অধিকতর উদার ও অগ্রগতিশীল মতামত প্রচার করিত।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি সম্বন্ধেও হিন্দু কলেজের একদল ছাত্র খুব আগ্রহশীল ছিলেন। বঙ্গভাষার আলোচনার জন্য ১৮৩৩ সনের ১৯ জানুআরি তারিখে ‘সর্বতত্ত্ব দীপিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সভায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলিলেন : “এক্ষণে ইংলণ্ডীয় ভাষা আলোচনাৰ্থ অনেক সভা দৃষ্টি গোচর হইতেছে এবং তত্তৎ সভার দ্বারা উক্ত ভাষায় অনেকে বিচক্ষণ হইতেছেন। অতএব গৌড়ীয় সাধুভাষা আলোচনাৰ্থ এই সভা সংস্থাপিত হইলে সভ্যগণেরা ক্রমশঃ উত্তমরূপে উক্ত ভাষাজ্ঞ হইতে পারিবেন।” রামমোহন রায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ রায় এই সভার সভাপতি এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইহার সম্পাদক হইলেন। স্থির হইল যে, প্রতি রবিবার দুই প্রহর চারিদণ্ড সময়ে এই সভার অধিবেশন হইবে এবং “বঙ্গভাষা ভিন্ন এ সভাতে কোন ভাষায় কথোপকথন হইবেক না”।[৬]
ইংরেজীশিক্ষিত নব্যবঙ্গের দলও যে বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের প্রতি উদাসীন ছিলেন না, এই সভা তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। গভর্নমেন্টের সহায়তায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ভূদেব মুখোপাধ্যায় বাংলা বিদ্যালয়গুলির অনেক উন্নতি সাধন করেন।
হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মনে যে স্বদেশপ্রীতি ও জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হইয়াছিল তাহার আভাস পূর্বেই দিয়াছি। ইহার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত দিতেছি। রাজা রামমোহন রায় ও তাঁহার সহযোগিগণ বিশ্বাস করিতেন যে ভারতবর্ষে ইংরেজরা স্থায়ীভাবে বসবাস করিলে তাহাদের সাহচর্যে ও দৃষ্টান্তে ভারতবাসীরা অনেক বিষয়ে লাভবান হইবে। হিন্দু কলেজের একদল ছাত্র ইহার বিরোধী ছিলেন। Hindu Literary Society-র এক সভায় এ-বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পঠিত হয় এবং ইহা পরে ১৮৩০ সনের ১২ ফেব্রুআরি India Gazette-এ প্রকাশিত হয়। গ্রীক, রোম, ফিনিসিয়া প্রভৃতি প্রাচীন, এবং ইংলণ্ড, হল্যাণ্ড ও স্পেন প্রভৃতি আধুনিক দেশের উপনিবেশগুলির সবিস্তারে আলোচনা করিয়া লেখক ইহার কুফলসমূহ প্রদর্শন করেন। পরে ব্যঙ্গসহকারে মন্তব্য করেন : “ইউরোপীয়গণ ভারতে আসিয়াই এদেশের লোকের দুঃখে ব্যথিত হইয়া তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতীকার করিতে বদ্ধপরিকর হইলেন। নানা জাতীয় মদ্য-রাম, গিন, ব্র্যাণ্ডি ও আধুনিক সভ্যতার অনুরূপ অন্যান্য উপকরণ আমদানী করিয়া কিরূপ অল্পসময়ের মধ্যে তাঁহারা এই বব্বর জাতিকে সভ্য করিয়া তুলিলেন তাহা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়।”
এই প্রবন্ধ হইতে বেশ বুঝা যায় যে ইংরেজীশিক্ষার ফলে যে বাঙ্গালী যুবকগণ একেবারে পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণই সভ্যতা বলিয়া মনে করিতেন, এ ধারণা সত্য নহে। ইহাও সহজেই অনুমিত হয় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইংরেজজাতির প্রতি যে ভক্তি ও শ্রদ্ধার জোয়ার বহিয়াছিল তাহাতে ভাটা পড়িয়া আসিতেছিল।
ইহার অন্য প্রমাণও আছে। ইংরেজীশিক্ষিত যুবকগণ বৃটিশ-শাসননীতির তীব্র প্রতিবাদ করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। হিন্দু কলেজের একজন প্রসিদ্ধ ছাত্র ও ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকার সম্পাদক রসিককৃষ্ণ মল্লিক (১৮১০-৫৮ খ্র.) কলিকাতার পুলিশ ও বিচার বিভাগের সম্বন্ধে মন্তব্য করেন যে, ইহা সকল রকমেই সুশাসন প্রণালীর বিরোধী। নিরপেক্ষভাবে সুবিচার করাই প্রত্যেক শাসনপ্রণালীর আদর্শ হওয়া উচিত। কিন্তু, ভারতের বৃটিশশাসনে তাহা সম্ভবপর হয় নাই, কারণ এক বণিকদলের হাতে দেশশাসনের ভার থাকায় তাহারা কেবল লাভ-লোকসানের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই শাসনকার্য পরিচালনা করে।
হিন্দু কলেজের আর-একজন প্রসিদ্ধ ছাত্র দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় (১৮১৪ ১৮৭৮ খ্র.) এই মত প্রচার করেন যে, জগতে সকল মানুষেরই সমান অধিকার এবং মুষ্টিমেয়ের স্বার্থসাধনের পরিবর্তে বহুজনের হিতসাধনই গভর্নমেন্টের লক্ষ্য হওয়া উচিত। সুতরাং বিদেশীর শাসন কখনও শুভ হইতে পারে না। কারণ বিদেশী শাসনকর্তারা নিজেদের স্বার্থের দিকেই দৃষ্টি রাখে, এদেশীয়দের সুখ সুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখার মত মানবিকতা তাহাদের মধ্যে কদাচিৎ দেখা যায়। উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীর সহিত ব্যবহারেও হিন্দু কলেজের ছাত্রগণ কিরূপ আত্মসম্মান ও স্বাধীন মনোবৃত্তির পরিচয় দিতেন তাহার একটি চমৎকার দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিয়াই এই প্রসঙ্গ শেষ করিব।
১৮৪৩ সনের ৮ই ফেব্রুআরি হিন্দু কলেজের হলে সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা’র একটি অধিবেশন হয়। এই সভায় দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন, তাহার বিষয়বস্তু ছিল “বাংলা দেশে ঈষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পুলিশ বিভাগ ও ফৌজদারি বিচারের বর্তমান অবস্থা”। প্রবন্ধটি কতকদূর পড়া হইলে কলেজের প্রিন্সিপাল ডি. এল. রিচার্ডসন (D. L. Richardson) তাহাকে বাধা দিয়া বলিলেন যে, তাঁহার কলেজ হল তিনি এরূপ রাজদ্রোহীদের সমাবেশের জন্য ব্যবহার করিতে দিবেন না। এই সভার সভাপতি ছিলেন হিন্দু কলেজের ছাত্র তারাচাঁদ চক্রবর্তী। তিনি রিচার্ডসনকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, “এই সভার সভাপতি এবং দক্ষিণারঞ্জনের বন্ধু হিসাবে বলিতেছি যে আপনার মন্তব্য অতিশয় অশোভন এবং আমি এই সভায় এরূপ আচরণ অনুমোদন করিতে পারি না। ইহা আমাদের সভার পক্ষে অপমানজনক এবং আপনি যদি আপনার মন্তব্য প্রত্যাহারপূৰ্ব্বক ক্ষমা প্রার্থনা না করেন তাহা হইলে আমরা এ বিষয়ে হিন্দু কলেজের কমিটি এবং প্রয়োজন হইলে গভর্নমেন্টের কর্ণগোচর করিব। আমরা কমিটির নিকট হইতে এই হলে সভা করিবার অনুমতি পাইয়াছি-আপনার অনুগ্রহে নহে। আপনি এখানে দর্শকমাত্র, সুতরাং এই সভার কোন বক্তাকে বাধা দিবার কোন অধিকার নাই। আমি আশা করি আপনি বক্তা ও উপস্থিত সভ্যগণের নিকট ক্ষমা প্রার্থনার ঔচিত্য সহজেই বুঝিতে পারিবেন।”
ইংরেজীশিক্ষায় যে কেবল কেরানীকুলেরই সৃষ্টি হয় নাই, উল্লিখিত দৃষ্টান্ত গুলিই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
হিন্দু কলেজের শিক্ষাপ্রণালী ও তৎসম্বন্ধে সাধারণের মতামত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় (আশ্বিন ১৭৭২ শক) বিস্তারিতভাবে আলোচিত হইয়াছে।
ইংরেজীশিক্ষার ফলে দেশের রাজনীতিক, সামাজিক, অর্থনীতিক প্রভৃতি বিবিধ বিষয় আলোচনা করিবার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান ও সভা-সমিতির কথা সাময়িক সংবাদপত্রে জানা যায়। ইহার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করিতেছি।
১। তত্ত্ববোধিনী সভা। রামমোহন রায়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হিন্দু কলেজের ছাত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৩৯ সনে এই সভা স্থাপন করেন। ব্রাহ্মধর্মের প্রচার ছাড়াও বাঙ্গালীর আধুনিক প্রণালীতে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য প্রভৃতির উন্নয়ন উদ্দেশ্যেই এই সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সভা হইতে “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হয় এবং ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা প্রভৃতি দেশের কল্যাণকর সকল বিষয়েই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীতে এই পত্রিকায় আলোচিত হইত। এই পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত বাংলায় বিজ্ঞান-পুস্তক রচনা করেন এবং বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সংকলন করেন।
২। বঙ্গভাষানুবাদ সমাজ। ১৮৫০ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজীসাহিত্যের কতকগুলি উৎকৃষ্ট গ্রন্থের বাংলায় অনুবাদ করিয়া লোকশিক্ষার উন্নতি করাই ছিল এই সমাজের প্রধান উদ্দেশ্য। পরবর্তী বৎসরে এই সমাজের পক্ষ হইতে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদনায় “বিবিধার্থ সংগ্রহ” নামক মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
৩। বেথুন সোসাইটি। বাংলা দেশে স্ত্রীশিক্ষার উন্নতিবিধায়ক ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনের মৃত্যুর পর তাঁহার নামানুসারে ইহা প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮৫১ খ্রী.)। ধর্ম ও রাজনীতি ব্যতীত দেশের ও সমাজের কল্যাণকর সকল বিষয়ই এখানে আলোচিত হইত। “শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পৌরসংস্কার, জ্ঞানবিজ্ঞান, কৃষি, শিল্প, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ভারতীয় সঙ্গীত প্রভৃতি বিষয় অবলম্বনে বাংলা দেশের মনীষিবৃন্দ ইংরেজী, বাংলা ও উর্দুভাষায় বক্তৃতা করিতেন–এবং নির্বাচিত প্রবন্ধগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইত। বৈজ্ঞানিকগণ চিত্রের সাহায্যে জ্ঞানগর্ভ আলেচনাদ্বারা বিদ্যুৎ, রসায়ণ, ভূতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে লোকশিক্ষার সহায়তা করিতেন।” ১৮৫৪ সনে কর্ণেল গুডউইন ভারতে শিল্পচর্চা ও শিল্পের প্রতি অনুরাগবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন। ইহার ফলে এই সোসাইটির কয়েকজন সভ্যের চেষ্টায় ঐ বৎসরই “শিল্প বিদ্যোৎসাহিনীসভা” এবং Scholl of Industrial Art নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। দশ বৎসর পরে গভর্নমেন্ট ইহার ভার গ্রহণ করেন এবং প্রথমে Government School of Art ও বর্তমানে Art College নামে পরিচিত এই প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি সমগ্র বঙ্গদেশে-তথা ভারতে-কারুশিল্পবিদ্যায় যুগান্তর আনয়ন করিয়াছে।
৪. ইংরেজীশিক্ষার প্রসার
হিন্দু কলেজে ইংরেজীশিক্ষার প্রবর্তন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে লর্ড বেন্টিঙ্ক ও মেকলের আমলে রাজশক্তির সহায়তা পাইয়া দ্রুতবেগে ইংরেজীশিক্ষার প্রসার হইল। ইংরেজীশিক্ষা প্রসারের জন্য একটি এডুকেশন কাউন্সিল (Education Council) স্থাপিত হইল এবং ইহার তত্ত্বাবধানে বড় বড় শহরে কয়েকটি সরকারী কলেজ ও স্কুল প্রতিষ্ঠিত হইল। সর্বসাধারণের আগ্রহ ও চেষ্টায় কলিকাতায় কয়েকটি কলেজ ও বহু স্কুল স্থাপিত হইল। উনিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ পর্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এইরূপ দ্রুত সংখ্যায় বৃদ্ধি, বাংলা দেশের ইংরেজীশিক্ষার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায়। ইহার সবিস্তারে উল্লেখ সম্ভবপর নহে। একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ মাত্র দিতেছি।
উনিশ শতকের মধ্যভাগে বা তাহার কিছু পূর্বে হুগলী, ঢাকা, কৃষ্ণনগর প্রভৃতি স্থানে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই শতকের মধ্যভাগে কলিকাতায় প্রেসিডেন্সী কলেজের প্রতিষ্ঠা ইংরেজীশিক্ষার ইতিহাসে এক নূতন যুগ আনয়ন করে বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। ইহার উৎপত্তি সংক্ষেপে বিবৃত করিতেছি।
১৮৫২ সনে জনরব উঠিল যে, হিন্দু কলেজে অহিন্দু ছাত্র অর্থাৎ মুসলমান ও খ্রীষ্টান ভর্তি করা হইবে। ইহাতে হিন্দু সমাজ বিক্ষুব্ধ হইয়া তীব্র প্রতিবাদ করে। ১৮৫২ সনের ২১ ডিসেম্বর ‘সংবাদ প্রভাকরে’ লেখা হয় :
“সম্ভ্রান্ত হিন্দুমণ্ডলী চাঁদা দ্বারা বহু অর্থ সংগ্রহ করিয়া হিন্দু কালেজ নামক বিখ্যাত বিদ্যালয় সংস্থাপন করেন, তখন হিন্দু মাত্রেরই অন্তঃকরণে এমত বিশ্বাস হইয়াছিল যে হিন্দু বালক ব্যতীত তথায় অন্য ধর্মাবলম্বী ছাত্র নিযুক্ত হইবেক না। কালেজ সংস্থাপন কাল অবধি এ পর্যন্ত ঐ নিয়ম প্রচলিত হইয়া আসিয়াছে, কোন ব্যক্তি তাহার প্রতি কোন আপত্তি করেন নাই, কিন্তু কি চমৎকার! শিক্ষা কৌন্সেলের বর্তমান অধ্যক্ষ ও মেম্বারগণ অধুনা ঐ নিয়ম পরিবর্তন করিবার অভিপ্রায় কাৰ্য্য করিয়াছেন …পরন্তু হিন্দু কালেজ প্রভৃতি বিদ্যালয়ে যখন সৰ্ব্বধৰ্ম্মাবলম্বি বালকদিগকে নিযুক্ত হইবার নিয়ম হইল ইহার পর আবার মিসনারি সাহেবেরা তথাকার শিক্ষকের পদে নিযুক্ত হইতে পারিবেন, তাহা হইলেই চূড়ান্ত হইয়া উঠিবেক, বাইবেল পুস্তকের অধ্যয়ন হইবার আর বড় বিলম্ব থাকিবেক না, অতএব স্বধৰ্ম্মতৎপর হিন্দুমণ্ডলী এই সময়ে সতর্ক হউন।”[১০]
১২৫৩ সনে ১১ই ফেব্রুআরি তারিখে উক্ত পত্রিকায় নিম্নলিখিত মন্তব্য বাহির হইল–
“এতন্নগরের সৰ্ব্বত্র এমত জনরব হইয়াছে যে নেপাল দেশীয় একটি বেশ্যানন্দন অধ্যয়নার্থ হিন্দু কালেজে নিযুক্ত হইয়াছে, কি আক্ষেপ! যবন ও খ্রীষ্টান এই দুই দোষ ছিল এইক্ষণে বেশ্যাপুত্র আসিয়া ত্রিদোষ প্রাপ্ত করাইল। আর বড় অপেক্ষা নাই, ত্র্যহস্পর্শ হইয়াছে, ইহার পর “মঘা এড়াবি ক ঘা” যাহা হউক নাগরিক হিন্দু বালক বৃন্দের ইংরেজী শিক্ষার যে এক প্রধান স্থান ছিল সংপ্রতি সে স্থানের অগ্রে অদ্য (আদ্যঃ) বর্ণের সংযোগ হইল, সুতরাং সম্ভ্রান্ত হিন্দু মহাশয়েরা আর তথায় বালক প্রেরণে সাহসী হইতে পারেন না, আমরা বিশেষরূপে শ্রবণ করিলাম অনেক ধনি লোকেরা হিন্দু কালেজ হইতে অবিলম্বে আপনাপন সন্তানদিগ্যে ছাড়াইয়া অন্য বিদ্যালয়ে প্রেরণ করিবেন…..
“কেবল হিন্দুর দানে মূলধন নির্দিষ্ট হইয়া হিন্দু কালেজ স্থাপিত হয় এবং কেবল হিন্দুদিগের কর্তৃত্বাধীনে ঐ কালেজের কৰ্ম্ম নিৰ্বাহ হইবে এমত নিয়ম নির্ধারিত হয়, অতএব যখন হিন্দুরাই ক্ষমতাহীন হইলেন এবং যখন সেই নিয়মেরই অন্যথা হইল তখন হিন্দু ধনদাতারা আপনারদিগের প্রদত্ত ধন পুনৰ্ব্বার গ্রহণ করিতে পারেন, ঐ ধনে আর গভর্নমেন্টের স্বত্ব থাকিতে পারে না কেননা নিয়মাতিক্রম করাতেই তাঁহারা স্বত্বহীন হইলেন।”[১১]
হিন্দু কলেজে খ্রীষ্টান, মুসলমান ও বেশ্যানন্দনকে ভর্তি করার জন্য ক্ষুব্ধ হইয়া হিন্দুরা ১৮৫৩ সনে হিন্দু মেট্রোপলিটন কলেজ স্থাপন করেন। হিন্দু কলেজের অনেক ছাত্র এই নূতন বিদ্যালয়ে ভর্তি হইল।
অপরপক্ষে ‘হরকরা’ (Harkara) নামক ইংরেজী দৈনিক সংবাদপত্রে এই নূতন বিধান সমর্থন করিয়া নিম্নলিখিত মন্তব্য বাহির হইল–
“This measure, although opposed to the spirit in which the College was originally established, is nevertheless a very desirable one, and is decidedly a move in the right direction. We shall be happy to hear that the opening thus afforded has been freely availed of by all classes which the prohibitory rules hitherto shut out. This liberal measure will tend much to extend the utility of the institution. Distinctions of caste and creed are bad enough in private life, much more so in public institutions like a government College.”[১২]
হিন্দুদের প্রতিবাদে বিচলিত হইয়া সরকার এডুকেশন কাউন্সিলের সেক্রেটারীকে পত্র লিখিলেন। সেক্রেটারী প্রায় ছয় মাস পরে ঐ পত্রের যে উত্তর দিলেন তাহার তাৎপর্য এই : “নূতন নিয়ম কিছুই করা হয় নাই, পূৰ্ব্ব নিয়মানুরূপ কাৰ্য্য নিৰ্ব্বাহ হইতেছে, বেশ্যাপুত্র যে নিযুক্ত হইয়াছিল তাহা আমারদিগের জ্ঞাতসারে হয় নাই, যখন তাহাকে বারাঙ্গানা সুত জানিতে পারিলাম তখনই বিদায় করিয়া দিলাম, এবং খ্রীষ্টান ও মুসলমান বালক নিযুক্ত করণের বিষয় এজুইকেস কৌন্সেলের বিবেচনাধীনে রহিয়াছে, অদ্যাপি সে বিষয় নিষ্পন্ন করাণ যায় নাই” ইত্যাদি।
অনেক বিচার-বিতর্কের পর সরকার স্থির করিলেন যে, হিন্দু কলেজের ছাত্রগণ দুইভাগে বিভক্ত হইবে–জুনিয়ার ভাগে কেবল হিন্দু বালকেরাই অধ্যয়ন করিবে, সিনিয়র বিভাগে জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সকলেই পড়িতে পারিবে। পরিণামে এই জুনিয়র বিভাগ হিন্দু স্কুল ও সিনিয়র বিভাগ প্রেসিডেন্সী কলেজে পরিণত হইল। সঙ্গে সঙ্গে ইহাও স্থির হইল যে হেয়ার সাহেবের স্কুলও এই কলেজের সঙ্গে যুক্ত হইবে, এই স্কুলে সকল জাতির ছাত্ৰই পড়িতে পারিবে। বর্তমান কাল পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই প্রচলিত আছে।
অতঃপর প্রেসিডেন্সী কলেজ একটি প্রধান বিদ্যালয়ে পরিণত হইল। এখানে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে আইন ও ইঞ্জিনিয়ারীং বিদ্যা শিক্ষারও ব্যবস্থা। ছিল। সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদকও ইহাতে সন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন :
“যেহেতু নূতন কলেজে আইন শিক্ষা করণের নূতন পদ্ধতি হইবেক এবং তাহাতে ছাত্রেরা সুশিক্ষিত হইলে, সুপ্রিম কোর্টে ও সদর আদালতে ওকালতি ও মুন্সেফি, সদর আমিনী এবং ডেপুটী মাজিষ্ট্রেট প্রভৃতি সম্ভ্রান্ত কাৰ্য্য সকল নির্বাহ করিতে পারিবেন, সুপ্রিম কোর্টের কোন সম্ভ্রান্ত কৌন্সেলি সাহেব নূতন কলেজের আইন শিক্ষকের পদে অভিযুক্ত হইবার কল্পনা আছে।”[১৩]
সরকারী কলেজ ছাড়াও এই সময়ে বেসরকারী অনেক কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।১৪ ইহাদের মধ্যে হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজ, ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, এবং শীলস্ ফ্রি কলেজ, হিন্দু হিতার্থ বিদ্যালয়, ও ইণ্ডিয়ান ফ্রি স্কুল নামক তিনটি অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রভৃতির উল্লেখ করা যাইতে পারে। খ্রীষ্টান পাদ্রীদিগের “অবৈতনিক বিদ্যালয় কিশোর হিন্দু ছাত্রদের খ্ৰীষ্টধর্মের দীক্ষা কেন্দ্র হয়ে ওঠার” ফলেই এই সমুদয় অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
ইংরেজীশিক্ষার ফলে যে দেশের বহু উপকার হইতেছে, জনসাধারণের মনে এই ভাব ক্রমেই দৃঢ়মূল হইতেছিল। এই বিষয়ে উদারমতাবলম্বী তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় (১৭৬৫ শক ১ ভাদ্র সংখ্যা) মুসলমান ও ইংরেজ শাসনের নিম্নলিখিত তুলনামূলক মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।[১৪]
“ইহার ৪০০০ বৎসর পূর্বে নেত্রপাত করিলে এইক্ষণকার আমারদিগের এই অবস্থাকে কি দুরবস্থা বোধ হয়। তৎকালে বিদ্যার আলোচনা কি পরিপাটী রূপ ছিল ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য তিনবর্ণ বিদ্যাভ্যাসে তৎপর ছিলেন, শূদ্র জাতিদিগের বিদ্যার অনুশীলনা ছিল না কিন্তু তাহারা সমুদয় লোকমধ্যে চারিভাগের এক ভাগ মাত্র, কোন দেশীয় লোকের মধ্যে এখনও পর্যন্ত চতুর্থাংশের একাংশকে মূর্খ না পাওয়া যায়। পরে যখন মুসলমান রূপ পিশাচেরা এই ভাগ্যহীন ভারতবর্ষকে ৯১৯ শকে আক্রমণ করিয়া বিবিধ অত্যাচার দ্বারা খণ্ড বিখণ্ড এবং মুমূর্ষ করিল সেই অবধি ক্রমে বিদ্যার সুতরাং ধৰ্ম্মের বল হ্রাস হইতে লাগিল। ক্ষত্রিয় বর্ণ অন্য অন্য বর্ণের আশ্রয় হইয়াছেন অতএব ক্ষত্রিয়ের পরাজয়ে এবং ক্ষয়ে অন্য অন্য বর্ণেরও নাশ হইতে লাগিল, এ নিমিত্তেও আমারদিগের বঙ্গদেশে এইক্ষণে ব্রাহ্মণ ও শূদ্র জাতি কেবল বাহুল্যে দৃষ্ট হয়, এবং এইক্ষণকার এই শূদ্ৰজাতি বঙ্গদেশীয় বর্তমান ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের ন্যায় যে বর্ণসঙ্কর নহেন এমত প্রমাণ দ্বারা সম্যক্রূপে স্থাপিত করা যায় না। মুসলমানদিগের উন্নতিকালে ব্রাহ্মণেরা আপনারদিগের ধর্ম সুন্দর রূপে রক্ষণে ক্রমে অশক্ত হইতে লাগিলেন। অনেক ব্রাহ্মণ কেহবা জীবন ধারণার্থে কেহবা সম্মান উপচয়ার্থে শূদ্রদিগের দৃষ্টান্তে মুসলমানদিগের দাসত্ব স্বীকার করিতে বাধ্য হইলেন এবং সেই জাতীয়েরদিগের পারস্য ভাষা শিখিতে লাগিলেন যে ভাষাতে কেবল কতকগুলীন উন্মাদ প্রলাপের ন্যায় গদ্য পদ্য রচনা ভিন্ন যাহাকে বিদ্যা বলা যায় এমত কোন বিদ্যার বাষ্পও নাই, তাহার অভ্যাসে মনের বিকার ব্যতীত সংস্কার কুত্রাপি সম্ভব হয় না। মুসলমানের বিদ্যা অর্থকারী বিদ্যা হইল সুতরাং বালক কালাবধি ধনের উদ্দেশ্যে ধৰ্মনাশের শিক্ষা পিতার শাসনে শিখিতেই হইল, তদবধি সকলের মনে এই এক কুসংস্কার হইল যে কেবল ধনের নিমিত্তে বিদ্যাশিক্ষার প্রয়োজন, যে বিদ্যায় ধনের আয় নাই যে বিদ্যা অভ্যাস করা পরিশ্রম মাত্র, এইরূপ গাঢ় সংস্কার বশতঃ আপনারদিগের শাস্ত্র দেখিবার ও শুনিবার প্রয়োজন থাকিল না। সুতরাং শাস্ত্রজ্ঞানাভাবে আমারদিগের সনাতন ধর্মেরও নানাবিধ বিকৃতি হইয়া উঠিল। এইক্ষণে ইংলণ্ডীয়দিগের প্রাদুর্ভাবে এদেশ উজ্জ্বল হইবার উন্মুখ হইয়াছে, ক্রমে প্রায় ৮০০ বছর পর্যন্ত যে দুঃখ এদেশে সঞ্চিত হইয়াছে তাহা ক্রমে দূরীকৃত হইতেছে।”[১৪ক]
তৎকালে মুসলমানদের প্রতি উদারপন্থী হিন্দুদেরও কিরূপ মনোভাব ছিল উদ্ধৃত অংশ হইতে তাহার স্পষ্ট ধারণা করা যায়। ইংরেজীশিক্ষা যে জীবনযাত্রার পক্ষে বিশেষ সহায়ক হওয়ায় লোকে ইহার পৃষ্ঠপোষকতা করিত সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু, জ্ঞানের গভীরতা ও প্রসার এবং বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন ও উন্নতিসাধন যে ইহার বিশিষ্ট ফল তাহাও পুনঃপুনঃ স্বীকৃত হইয়াছে।
বর্তমানকালে ইংরেজীর পরিবর্তে দেশীয় ভাষাকে শিক্ষার বাহন করা সম্বন্ধে যে তুমুল আন্দোলন চলিতেছে ইহার পূর্বাভাস শতাধিক বর্ষ পূর্বেও পাওয়া যায়। ১৮৪৮ সনে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার মন্তব্যের কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি
“বাঙ্গালা ও ইংরাজী এই উভয় ভাষার মধ্যে কোন্ ভাষার দ্বারা এতদ্দেশীয় ব্যক্তিদিগ্যে জ্ঞানশিক্ষা প্রদান করা কর্তব্য? অধুনা এই প্রস্তাব বিষয়ে সংবাদপত্রে ভারি বাদানুবাদ উপস্থিত হইয়াছে, বিশেষতঃ বিজ্ঞবর শ্ৰীযুত মেং হাজসন সাহেব বঙ্গভাষার অনুকূলে স্বীয় অভিপ্রায় ব্যক্ত করাতে অনেকানেক সাহেব তাহার বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করিয়াছেন, কিন্তু হাজসন সাহেব আপন লেখায় যে সকল যুক্তি ও প্রমাণ প্রয়োগ করিয়াছেন, তাঁহার বিপক্ষেরা তাহার কোন কথার উত্তর করিতে পারেন নাই কেবল বাহুল্যরূপে ইংরাজী ভাষার প্রশংসাই লিখিয়াছেন।…
“ব্রিটিস গবর্ণমেণ্ট এতদ্দেশে আগমনাবধি একাল পর্যন্ত স্বদেশীয় ভাষার বিস্ত রি জন্য অর্থব্যয় ও পরিশ্রম করিতে বিশেষ মনোযোগী হইয়াছেন, ফলতঃ তাহার সুফল সিদ্ধির বিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যাঘাত হইতেছে, দেশের অধিকাংশ স্থানে বিদ্যার আলোক বিস্তীর্ণ হয় নাই, প্রজারা অজ্ঞানতার অন্ধকারে আবৃত হইয়া অত্যন্ত দীন ও মলিন হইয়াছে…রাজপুরুষেরা ঐ অর্থদ্বারা যদ্যপি এতদ্দেশীয় ভাষানুশীলনের পথ পরিষ্কার করিতেন, এবং ঐ ভাষায় এতদ্দেশীয় ব্যক্তিদিগ্যে জ্ঞান শিক্ষা প্রদান করণে অনুরাগি হইতেন তবে আমরা তাহাদিগ্যে এই বঙ্গদেশের যথার্থ উপকারি বন্ধু বলিয়া গণ্য করিতাম…কিন্তু কি আক্ষেপ ইংরাজ জাতি সুসভ্য ও বহুদর্শি হইয়াও…বাঙ্গালিদিগ্যে মনুষ্য বলিয়া গণ্য করেন না, বঙ্গভাষার প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করিয়া থাকেন….তাঁহারা জাতীয় ভাষার মূলোৎপাটনেই যত্ন করিতেছেন, অপিচ তাঁহারদিগের ঐ দুরাশা কোন মতেই সিদ্ধ হইবেক না।”[১৫]
কিন্তু দুই বৎসর পর এ-বিষয়ে সম্পাদকের মতের পরিবর্তন দেখা যায় :
“….ইংলণ্ডীয় ভাষা যকালীন এতদ্দেশে পদার্পণ করে নাই তৎকালে কোন পণ্ডিত ব্যক্তিও দেশীয় বৃত্তান্ত ব্যতিরিক্ত অন্যান্য দেশের নাম শ্রুত হয়েন নাই, অতএব ইংলণ্ডীয় বিদ্যাধ্যয়নে জ্ঞানের প্রশস্ততা হয়, তজ্জন্য বঙ্গদেশীয় লোকেরা স্বেচ্ছাতে উক্ত দেশীয় ভাষাভ্যাস করিয়া থাকেন।…”
“ইংলণ্ডীয় বিদ্যাভ্যাসে এতাধিক উপকার কিন্তু স্বীয় ভাষাতে সৰ্ব্বাগ্রে নিপুণ হইয়া তদনন্তরে ইংলণ্ডীয় ও আর আর অপর দেশীয় ভাষাভ্যাস করত সাধ্যানুসারে জ্ঞানোন্নতি করিয়া পারদর্শি হইতে চেষ্টা করা উচিত, কারণ স্বদেশীয় বিদ্যা অগ্রে না শিখিয়া পরদেশীয় ভাষাভ্যাস করিলে দেশীয় ও বিদেশীয় নর সমূহের সমীপে নিন্দনীয় ও উপহাসের যোগ্য ও লজ্জিত হইতে হয়।”[১৬]
বাংলাশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে যে তৎকালে শিক্ষিত জনসাধারণ খুবই সচেতন ছিলেন, সমসাময়িক পত্রিকাগুলি হইতে তাহার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। আরও জানা যায় যে বাংলাশিক্ষার প্রচার ও প্রসার বিষয়ে সরকার ও জনসাধারণ উভয়েরই সমান আগ্রহ ছিল। শিক্ষা কাউন্সিলের সভাপতি বেথুন সাহেব নির্দেশ দিয়াছিলেন যে “কালেজ প্রভৃতি বিদ্যালয়ের এতদ্দেশীয় শিক্ষকগণের বঙ্গভাষা নিপুণতা বিষয়ের পরীক্ষা হইবেক, এবং যাহারা ঐ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবেন তাঁহারাই পদস্থ থাকিতে পারিবেন।”[১৭]
সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক ইহাও স্বীকার করিয়াছেন যে “মহানুভব সুবিচক্ষণ লর্ড হার্ডিঞ্জ বাহাদুর বঙ্গরাজ্যে শতাধিক বাঙ্গালা পাঠশালা সংস্থাপনের নির্দেশ দিয়াছিলেন। কিন্তু রাজপুরুষদের উপযুক্ত তত্ত্বাবধানের ও মনোযোগের অভাবে “মফঃসলের বাঙ্গালা পাঠশালার বর্তমান দশা স্মরণ করিলে যুগপৎ মনস্তাপ ও বিস্ময় উদয় হয়। প্রায় অনেকগুলিই উঠিয়া গিয়াছে তবে অদ্যাপিও যে কয়েকটা টামটুম্ করিতেছে তাহারও দশমী দশা মাত্র অবশিষ্ট আছে।…
“আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি যশোহর জিলার অন্তঃপাতি কোন বাঙ্গালা পাঠশালার তিন বৎসর মধ্যেও ছাত্রগণ বর্ণমালা ও নীতিকথা পুস্তক শেষ করিতে পারে নাই।”[১৮]
শিক্ষা কাউন্সিল এই বিষয়ে উদাসীন ছিলেন না, এবং জিলার ম্যাজিষ্ট্রেট ও শিক্ষিত জনসাধারণের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট করিয়াছিলেন। তথাপি বাংলা পাঠশালার দুরবস্থা তখনও ঘুচে নাই এবং শতাধিক বর্ষ পরে এখনও প্রায় তদ্রূপই আছে। কিন্তু এই দুরবস্থার জন্য প্রধানতঃ যে বঙ্গবাসীরাই দায়ী তাহাও কেহ কেহ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন। একজন লিখিয়াছেন :
“একবার বিবেচনা করিয়া দেখিলে কেবল ইহাই প্রতীতি হইবে, যে অসামান্য ধী শক্তি সম্পন্ন রাজপুরুষগণই এই সৰ্ব্ব শুভকর ব্যাপার সাধনার্থ প্রধান উদোগি হইয়াছেন, কেননা, তাঁহারা আপনারদিগের রাজকোষ হইতে বিপুল বিত্ত ব্যয় করিয়া নগরে নগরে গ্রামে গ্রামে অসংখ্য বিদ্যামন্দির সংস্থাপন করিতেছেন…হায়! আমরা কি মূঢ়! দুর্ভাগা মাতৃভাষার পুনরুদ্ধারে যত্নবান হওয়া দূরে থাকুক, স্বপ্নেও ইহার একবার শুভ প্রত্যাশা করি নাই, অধিকন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে, যাহারা সংস্থাপিত বিদ্যালয় সকলের মানেজর অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়করূপে নিযুক্ত আছেন। তাঁহারদিগের মধ্যে সকলে না হউন, প্রায় অনেকেই এতৎ মহৎ রসের আস্বাদনে সম্যক অনভিজ্ঞ..সম্পাদক মহাশয়। বলিতে কি, যে রূপ কষ্টে শিক্ষকগণ মাসিক বেতন প্রাপ্ত হইয়া থাকেন, তাহা সৰ্বান্তর্যামী সৰ্ব্বজ্ঞ জগদীশ্বরই জানেন। আহা, ইহা কি সামান্য দুঃখের বিষয়! যে তাহারদিগের বেতন পঞ্চদশ মুদ্রার অধিক এক কর্পদ্দকও নহে, তাহারা মাসদ্বয়াতীত না হইলে এক মাসের বেতন লাভ করিতে পারেন না,…শ্রীযুক্ত মানেজর বাবুদিগের আলস্যে ও ঔদাস্যে এইরূপ নানাবিধ বিষমতর মর্মান্তিক ক্লেশের উৎপত্তি হইতেছে। সে যাহা হউক, যদিস্যাৎ শ্ৰীশ্ৰীযুতেরা এরূপ বেতন বিষয়ে শিক্ষক সমূহকে সমূহ কষ্ট প্রদান করিয়াও সাবকাশানুসারে এক একবার আপনারদিগের অধিনস্থ বঙ্গ বিদ্যালয়ে উপস্থিত হইয়া তত্ত্বাবধারণ করেন, তাহা হইলেও পরম আনন্দের বিষয় হয়।…দেখুন তাঁহারা রোজপুরুষগণ] বিদেশীয় ধবলাঙ্গ বণিক হইয়া যখন আমাদিগের হিতার্থে অস্মদাদির মাতৃভাষায় এতদূর গৌরব বৃদ্ধি করিতেছেন, তখন আমাদিগের যে কি পৰ্য্যন্ত যত্নবান হওয়া কর্তব্য তাহা বিবেচনারও অতীত।”[১৯]
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তিন বৎসর পর ইহার ফলাফল সম্বন্ধে সোমপ্রকাশ পত্রিকায় যে মন্তব্য করা হয় তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :
“এই তিনবৎসরের মধ্যে বাঙ্গালা দেশে প্রায় ২১০ জন ইংরেজী ছাত্র প্রবেশ পরীক্ষায় এবং প্রায় ২২ জন কৃতবিদ্য ছাত্র বি. এ. উপাধি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছে।…
“আমরা মনে করিয়াছিলাম রাজধানীতে ইংলণ্ডীয়রীতিমতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হইলে আমাদের দেশীয় ভাষার শ্রীবৃদ্ধি সহকারে তাহার আদর ও গৌরব। বৃদ্ধি হইবে, সকলেই পূৰ্ব্ববৎ ঘৃণা পরিত্যাগ করিয়া আদর পূর্বক দেশীয় ভাষার অনুশীলন আরম্ভ করিবে এবং অবিলম্বেই দেশীয় ভাষা ও বিদ্যা সুসংস্কৃত ও সুসম্পন্ন হইয়া উঠিবে। কৈ এক্ষণে তাহার কিছুই দেখিতে পাই না বরং দিন দিন দেশীয় ভাষার শ্রীহাস সহকারে তাহার সঞ্চিত গৌরবের হানি হইতেছে ইহা সাধারণ দুঃখের বিষয় নহে।
“কলিকাতা রাজধানীতে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনাবধি বিদ্যালয়ের সমুদায় ছাত্রগণেরই মন ইঙ্গরেজী ভাষার প্রতি আসক্ত হইয়াছে। ইঙ্গরেজী ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়া উপাধি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইব ইহাই সকল ছাত্রের ইচ্ছা।….
“দেশীয় ভাষার উন্নতি সাধন গভর্নমেণ্টের ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রে কর্তব্য। ইঙ্গরেজী ভাষা ও আমাদের সংস্কৃত ভাষার যেরূপ উপাধি পরীক্ষা ও উপাধি গ্রহণের রীতি আছে, আমাদের মতে বাঙ্গালা ভাষাতেও সেইরূপ রীতি প্রচলিত করা অতি আবশ্যক।”[২০]
বাংলাভাষার উন্নতির জন্য এদেশীয় কেহ কেহ ও কোন কোন সাহেবও যে বিশেষ আগ্রহশীল ছিলেন, সমসাময়িক পত্রিকায় তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। এ বিষয়ে রেভারেণ্ড লং (Rev Long) সাহেবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক এজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া লিখিয়াছেন–
“মেং লং সাহেব অতি উদার চিত্ত, সৰ্ব্বতোভাবে সুগুণজ্ঞ, এই মহাশয় প্রায় মধ্যে মধ্যে সামান্য গুরুমহাশয়দিগের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাঠালয়ে গমনান্তর তাহার তত্ত্বাবধারণ এবং ছাত্রগণের পরীক্ষা লইয়া থাকেন, আর তাহারদের উৎসাহ। বৰ্ধনার্থ সাধ্যানুসারে সাহায্য করণে ত্রুটি করেন না।”[২১]
লং সাহেব বঙ্গীয় পুস্তকালয় স্থাপনের জন্য বহু আয়াস করিয়াছিলেন। ১৮৫১ সনে সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশিত তাঁহার একখানি চিঠির কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছিঃ “শ্রীযুক্ত সংবাদ প্রভাকর সম্পাদক মহাশয়েষু।
“যে যে মহাশয়েরা এবং যে যে সভাস্থ লোকেরা সাধারণ জনগণের পাঠাৰ্থ বঙ্গীয় পুস্তকালয় স্থাপনের প্রসঙ্গে গত বৎসরে আমার বক্তৃতায় সানন্দচিত্তে মনোযোগ করিয়াছিলেন, আমি তাঁহারদিগের নিকট এক্ষণে মনের সহিত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতেছি।
পশ্চাল্লিখিত দশস্থানে দশটী পুস্তকালয় স্থাপিত হইয়াছে এবং ইউরোপীয় লোকের অধ্যক্ষতায় তাহার কাৰ্যনিৰ্বাহ হইতেছে, যথা ঠাকুরপুকুর, কলিকাতা, আগড়পাড়া, বর্ধমান, কৃষ্ণনগর, ছাপা, সোলো, বল্লভপুর, রত্নপুর এবং কার্পাসডাঙ্গা। রত্নপুরস্থ দেশীয় খ্রীষ্টিয়ানেরা অতিরিক্ত পুস্তক সংগ্রহ করণার্থ একেবারে ১২ টাকা স্বাক্ষর করিয়াছে।
উক্ত দশ পুস্তকালয়ের নিমিত্ত ১৪০০ বঙ্গীয় পুস্তক ক্রীত অথবা দত্ত হইয়াছে। কলিকাতাস্থ পুস্তকালয়ে বিশেষ বিশেষ দান হইয়াছে, তন্মধ্য নানাবিধ বঙ্গীয় পুস্তক চারিশত আছে।
ঐ সকল পুস্তকালয়ের তাৎপৰ্য্য এই যে ইংরেজী ভাষায় অনভিজ্ঞ এতদ্দেশীয় লোকেরা উত্তম বিষয়ে গ্রন্থ পাঠ করিতে পায় এবং ইউরোপীয় লোকেরাও গৌড়ীয় বিদ্যা এবং বাক্য বিন্যাসের পরিচয় পায়েন। নূতন প্রকাশিত পুস্তক সংগ্রহ করিয়া পুস্তকালয় বৃদ্ধি করিবারও উপায় হইয়াছে।
উক্ত পুস্তকালয়ে এই এই গ্রন্থ আছে যথা ইংলণ্ড, গ্রীস, রোম, ইজিপ্ত, বঙ্গ, ভারতবর্ষ এই সকল দেশের এবং খ্রীষ্টীয় সভার পুরাবৃত্ত, তথা পদার্থ, জ্যোতিষ, যন্ত্রাধ্যায়, ক্ষেত্রতত্ত্ব এবং পশুপক্ষীর প্রকৃতি ও চেম্বরের নির্বাচিত জীবনবৃত্তান্ত, রেসেলস্ এবং নীতিবোধক ইতিহাস।
পূর্বোক্ত স্থানের মধ্যে পাঁচ গ্রামের ইংরাজী ভাষাজ্ঞ লোকের অধ্যয়নার্থ ইংরাজী পুস্তকালয় পূৰ্ব্বে স্থাপিত ছিল।
লোকে ঐ সকল পুস্তকালয় কেমন উপকারক জ্ঞান করে তদৃবিষয়ের নানাবিধ প্রমাণ পাইয়া আমি সন্তুষ্ট হইয়াছি, তদ্ধারা মফঃসলের লোকেরা অবসর মতে জ্ঞানোপাৰ্জন করিতে পায়, গ্রন্থাধ্যায়নে তাহারদের অনুরাগ জন্মে এবং তাহারা কলিকাতায় মুদ্রাঙ্কিত অথচ পল্লীগ্রামে অপ্রসিদ্ধ নূতন নূতন পুস্তক পাঠ করিতে পায়।”[২২]
বংশবাটী গ্রামে “তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা”র প্রতিষ্ঠা ও এই উপলক্ষে অক্ষয়কুমার দত্ত যে বক্তৃতা করেন এই প্রসঙ্গে তাহাও বিশেষ উল্লেখযোগ্য।[২২ক]
বাংলাশিক্ষার উন্নতির জন্য আরও কতকগুলি কার্যপ্রণালী অবলম্বন করা হইয়াছিল। স্থানে স্থানে ‘বঙ্গানুশীলন সভা স্থাপিত হইয়াছিল। উৎকৃষ্ট গ্রন্থরচনা করার জন্য পুরস্কার দেওয়া হইত। পাঁচজন প্রসিদ্ধ ইংরেজ ও দুইজন প্রসিদ্ধ বাঙ্গালীর স্বাক্ষরিত নিম্নলিখিত বিজ্ঞপ্তি-পত্র বিশেষ প্রণিধানযোগ্য
“বঙ্গীয় ভাষায় ইতিবৃত্ত রচনা। পশ্চাল্লিখিত বিষয়ে যে ব্যক্তি সৰ্বোকৃষ্ট রচনা করিতে পারিবেন তাঁহাকে ৩০০ টাকা এবং যে ব্যক্তির রচনা দ্বিতীয় রূপে গণ্য হইবে তাহাকে ১০০ টাকা পারিতোষিক দেওয়া হইবে।
“ইউরোপ এবং এস্যা খণ্ডস্থ নারীগণের চরিত্র অবস্থা এবং প্রভাবে যে তারতম্য আছে তাহার তুলনা এবং ঐ তারতম্যের সাধারণ কারণ কি? আর সেই সকল কারণের সহিত খ্রীষ্টীয় ধর্মের কিরূপ সংযোগ এতদ্বিষয়ে বর্ণনা।
“প্রথম পারিতোষিক ৩০০ টাকা কেবল বিবি লোকের বদান্যতায় সংগৃহীত হইয়াছে।”[২৩]
ইংরেজী গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ দ্বারা বঙ্গভাষার উন্নতি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে কলিকাতায় বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল (সম্ভবতঃ ১৮৫০ সনে)। কাউয়েল (Cowell) সাহেব ইহার অধ্যক্ষ ছিলেন। অনেকে ইহার সমর্থন করিয়াছিলেন, কিন্তু কেহ কেহ ইহার বিরোধিতা করিয়াছিলেন। সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক মূল উদ্দেশ্য সমর্থন করিলেও অনূদিত গ্রন্থের রচনা-প্রণালী “রীতি বিশুদ্ধ ও উৎকৃষ্ট হয় নাই এরূপ মন্তব্য করিয়াছেন এবং দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘ক্রোড়ে লওতঃ ‘ভাত খাওতঃ’ প্রভৃতি অসমাপিকা ক্রিয়ার ভূরি ভূরি প্রয়োগের উল্লেখ করিয়াছেন। বস্তুতঃ, বাংলাগদ্য রচনা তখনও সাধারণভাবে খুব উৎকর্ষ লাভ না-করার জন্যই এই সমুদয় অনুবাদ-গ্রন্থ জনপ্রিয়তা লাভ করে নাই–এইরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। সংবাদ প্রভাকর সম্পাদক বলিয়াছেন যে উক্ত সমাজ প্রতি অনুমোদিত গ্রন্থের পারিশ্রমিক মাত্র ২০০ টাকা নির্ধারিত করায় কোন সৎ লেখক এই অসাধারণ পরিশ্রমে অগ্রসর হন না।’ তিনি আরও লিখিয়াছেন : “সমাজে বাঙ্গলা ভাষার রসজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ লোক প্রায় নাই।” সুতরাং কয়েকখানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ প্রকাশিত হইলেও অনেক গ্রন্থই পাঠশালা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযোগী হয় নাই।[২৩ক] এই মন্তব্য হইতে বেশ বোঝা যায় যে ইংরেজীশিক্ষা একশ্রেণীর লোকের নিকট যেরূপ আদৃত হইয়াছিল বাংলাশিক্ষা সম্বন্ধে কোন শ্রেণীরই সেরূপ আগ্রহ ছিল না, এবং ইহাই বাংলাশিক্ষার যথোচিত উন্নতি না-হওয়ার প্রকৃত কারণ। ইহার জন্য ইংরাজীশিক্ষার প্রচলনকে প্রধানতঃ দায়ী করা অসঙ্গত। এ সম্বন্ধে শিক্ষাকমিটির প্রথম বার্ষিক রিপোর্টে সরকারী নীতি সম্বন্ধে নিম্নলিখিত উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য–
“আমরা বিবেচনা করে দেখেছি যে পাশ্চাত্ত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান এদেশে ক্লাসিকাল ভাষা সংস্কৃত ও আরবীর মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে ইংরেজীর মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া অনেক ভাল। সংস্কৃত বা আরবী এদেশের কারও মাতৃভাষা নয়। অতএব পাশ্চাত্ত্য বিদ্যা শিক্ষার আবশ্যকতা স্বীকার করে নিয়ে আমরা কেবল এই সিদ্ধান্ত করেছি যে সংস্কৃত-আরবী অপেক্ষা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাহনরূপে ইংরেজী ভাষা অনেক উন্নত। মাতৃভাষার গুরুত্বকে আমরা অস্বীকার করিনি। ভবিষ্যতে যাতে সমস্ত শিক্ষাই মাতৃভাষাতে হতে পারে, সেদিকে আমাদের বরাবরই লক্ষ্য ছিল।”[২৪]
কিন্তু বাংলাশিক্ষা প্রসারের উদ্যোগিগণও ইংরেজীশিক্ষার সঙ্কোচ করার সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। যখন লর্ড লরেন্স ও লর্ড মেয়ো ইংরেজীশিক্ষা বন্ধ করিয়া দেশীয় ভাষা ভিন্ন অন্য ভাষায় যাহাতে শিক্ষা দেওয়া না হয় তাহার ব্যবস্থা করিতে প্রবৃত্ত হন, তখন সোমপ্রকাশ পত্রিকা ইহার প্রতিবাদ করিয়া লিখিয়াছিলেন “আমাদিগকে পশুবৎ করিয়া রাখিয়া শাসন করা তাঁহাদের অভীষ্ট।”[২৪ক]
বাংলাশিক্ষার দুরবস্থা ব্যতীত প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির আরও কয়েকটি ত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা সম্বন্ধে সাধারণের দৃষ্টি বেশ সজাগ ছিল। প্রথমতঃ, নীতিশিক্ষার অভাব। এই প্রসঙ্গে সমসাময়িক পত্রিকার আলোচনা হইতে মনে হয় যে, শিক্ষার আদর্শ সম্বন্ধে সে-সময়কার ধারণা বেশ উচ্চ ও উদার ছিল। সংবাদ প্রভাকরে লেখা হইয়াছে
“আজকাল আমাদিগের সমাজের যে প্রকার শোচনীয় অবস্থা হইয়াছে তাহাতে কোন প্রকার উন্নতির আশা করা কেবল দুরাশা মাত্র। বালক বালিকাদিগকে সম্যক প্রকারের সুনীতি শিক্ষা না দিলে সমাজের কোন উন্নতি হইবার সম্ভাবনা নাই।
“আমাদিগের দেশের বালক বালিকাদিগকে এরূপ নীতিশিক্ষা প্রদান করা কর্তব্য, যাহাতে তাহাদিগের মন মধ্যে স্বধৰ্ম্মানুরাগ, স্বদেশানুরাগ, স্বজাতি অনুরাগ প্রভৃতি উদ্ভাবিত হইতে পারে।”[২৫]
১৮৪২ সনে একজন লিখিয়াছেন যে “শিক্ষা দ্বারা বুদ্ধি এবং অন্তঃকরণ উভয়কেই উৎকৃষ্ট করা উচিত।
“বিশেষতঃ বুদ্ধি অপেক্ষা অন্তঃকরণের উৎকর্ষের অধিক প্রয়োজন যেহেতু বুদ্ধি দ্বারা কোন বিষয়ে সত্য মিথ্যা জ্ঞান হয় বটে কিন্তু অন্তঃকরণের যোগ ব্যতিরেকে তাহাতে মগ্ন হওয়া যায় না এবং বুদ্ধি তীক্ষ্ণ অথচ অন্তঃকরণ মন্দ হইলে ধার্মিক হইতে পারে না ও সেই অন্তঃকরণে দয়া ধৰ্ম্ম ইত্যাদির বীজ থাকিলেও তাহার অঙ্কুর হইয়া ফল জন্মে না।”[২৬]
এই লেখকই বলিয়াছেন যে, প্রত্যেক বিদ্যালয়েই নীতিশিক্ষা প্রদান আবশ্যক। তিনি মন্তব্য করিয়াছেন যে প্রধান বিদ্যালয়ে “কাব্য ইতিহাসাদি রেখাগণিত, ক্ষেত্র পরিমাণ বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ইত্যাদি শাস্ত্রাধ্যয়ন হয়। কিন্তু “ছাত্রদের বুদ্ধি বৃদ্ধির নিমিত্তে যাদৃশ মনোযোগ নীতি বিদ্যানুশীলনের প্রতি তাদৃশ নাই।” কিন্তু কেহ কেহ এই বলিয়া আপত্তি করিয়াছেন যে ধর্মনিরপেক্ষ নীতিশিক্ষায় খুব বেশী ফল হইবার সম্ভাবনা নাই এবং এদেশে বিভিন্ন ধর্ম থাকায় বিদ্যালয়ে ধর্মালোচনা বাঞ্ছনীয় নহে। শতাধিক বর্ষ পরে আজও আমাদের দেশে শিক্ষার আর দুইটি ত্রুটির পুনঃপুনঃ উল্লেখ দেখা যায়। প্রথমতঃ, কী প্রকারে বাণিজ্য ব্যবসায় করিতে হয় সে-বিষয়ে শিক্ষাদান করা হয় না এবং শিল্প ও বিজ্ঞান শেখার ব্যবস্থাও খুব সামান্য। সুতরাং কেবল কয়েকটি রাজকীয় কর্ম ছাড়া আর কোন উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করা শিক্ষিতদের পক্ষে সম্ভবপর হয় না, শিক্ষকের পদের বেতন অতিশয় অল্প এবং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়িতেছে। “বাঙ্গালীরা দাসত্বের মনোভাব হইতে মুক্ত হইয়া স্বাধীন বাণিজ্য না করিলে উন্নতি করিতে পারিবে না।”[২৭]
লেখাপড়া শিক্ষা যাহাতে ছাত্রদের উপজীবিকার উপায় হয় সে-সম্বন্ধে বহু আলোচনা হইয়াছে। এ-সম্বন্ধে সংবাদ প্রভাকরের নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য
“কি পরিতাপ! ছাত্ররা ১৫। ১৬ বৎসর নিয়ত পরিশ্রম করত বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়া পরিশেষে কৰ্ম্মাভাবে অন্নাভাব জন্য হাহাকার করিতে থাকে। “সিবিল ইঞ্জিনিয়রী” ও আর আর বিদ্যায় নিপুণ হইলে অনায়াসেই নানা উপায়ে উপজীবিকা নির্দিষ্ট করিতে পারে, অতএব যাহাতে দুই প্রকার উপকার অর্থাৎ একটা মহতী বিদ্যা নৈপুণ্য এবং তৎসহযোগে সৌভাগ্য সঞ্চয়, এমত মহল্কল্পে নিরুৎসাহি হওয়া অতিশয় অনুচিত হইতেছে, অনেকে অনুমান করেন গভর্নমেন্ট দুই কারণে ইহাতে বিরত আছেন, প্রথম কারণ এই যে এতদ্দেশীয় লোকেরা বিজ্ঞান বিদ্যায় তৎপর হইলে কতকগুলিন ইংরাজের এদেশে প্রভুত্ব থাকিতে পারে না, দ্বিতীয় কারণ ভয়, কেননা কালেজের ছাত্রেরা যুদ্ধ সম্পর্কীয় অস্ত্র-সস্ত্রাদি প্রস্তুত করিতে শিখিলে ভবিষ্যতে গোলযোগ করিতে পারে।”[২৮]
শিল্পবিদ্যা সম্বন্ধে সরকারের ঔদাসীন্যে দুঃখ প্রকাশ করিয়া সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক ১৮৪৫ সনে মন্তব্য করিয়াছেন :
“পরমেশ্বরের প্রসাদে এই ভারতবর্ষ মধ্যে সোরা, গন্ধক, নীল, হরিতাল, তাম্র, শেলাক, লাকড়াই, পাট, শোন, পসম, তুলা, লৌহ, সীসক ইত্যাদি বিবিধ বস্তু প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হইয়া থাকে। সেই সমস্ত দ্রব্য জাহাজ যোগে বিলাতে প্রেরিত হওয়াতে তথাকার লোকে শিল্পাদি বিদ্যা প্রভাবে বিচিত্র বিচিত্র বস্তু প্রস্তুত করিয়া পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশে প্রেরণ করেন ও সেই দ্রব্যসকল ভারতবর্ষেও আসিয়া থাকে তাহাতে জাহাজ ভাড়া মহাজনের লাভ, রাজার মাশুল ইত্যাদিতে অনেক ব্যয় হইয়াও বণিকেরা সেই সকল দ্রব্য বিক্রয় পূৰ্ব্বক বিপুল বিত্ত লাভ করিতেছে। এতদ্দেশীয় লোকেরা শিল্পবিদ্যায় শিক্ষিত হইলে, তাঁহার স্বদেশজাত বহু বস্তুর দ্বারা বিবিধ দ্রব্য প্রস্তুত করিতে পারিবেন, তাহাদিগকে জাহাজ ভাড়া, মাশুল ও মহাজনের লাভ ইত্যাদি কিছুই দিতে হইবেক না। যাহারা দ্রব্যাদি বিক্রয় করে তাহাদিগের নিকট হইতে ক্রয় করিয়া নানা প্রকার শোভাকর ও মনোহর ও অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্য সকল প্রস্তুত করিতে পারিবেন এবং তত্তাবৎ অতি সুলভ মুল্যে এদেশে বিক্রয় হইতে পারিবেক।”[২৯]
এই প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত মন্তব্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য–
“রাজার সাহায্য ব্যতীত কোন দেশেই কোন প্রকার শিক্ষার আতিশয্য হয় না। পূৰ্ব্বে নৃপতিরা এতদ্দেশীয় ব্যক্তিদিগের শিল্পবিদ্যা শিক্ষার সাতিশয় সমাদর করিতেন, একারণ তাহার বিলক্ষণ বৃদ্ধি হইয়াছিল, আধুনিক রাজ্যাধিপতি মহাশয়দিগের এরূপ এক প্রবল ভ্রান্তি আছে যে তাঁহারা স্বদেশ ব্যতীত অন্যদেশজাত কোন দ্রব্যের প্রশংসা বা ব্যবহার করেন না।…”[৩০]
এই মন্তব্য প্রকাশের অল্পকাল পরেই একটি শিল্পবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে সম্পাদক বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করিয়াছেন। এই বিদ্যালয়ের নাম The Calcutta School of Industrial Arts। এখানে কাঠের কাজ, মাটির কাজ, চিত্রাঙ্কন, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, লিথোগ্রাফি ও ফটোগ্রাফি প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া হইত। এই বিদ্যালয়ে প্রথমে “চিত্রবিদ্যায় শিক্ষার শ্রেণীতে ৫০ জন ও মৃত প্রতিমূর্তি প্রস্তুত করণ বিদ্যা শিক্ষার শ্রেণীতে ৪৫ জন” গ্রহণ করার প্রস্তাব হয়, কিন্তু ঐ সংখ্যক ছাত্র প্রথমদিনই ভর্তি হয় এবং বহু ছাত্র ফিরিয়া যায়। সম্পাদক লিখিয়াছেন যে উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকিলে “৪৫ দিনের মধ্যেই ছাত্রসংখ্যা ৫০০ হইতে পারে।”[৩১]
প্রস্তাবিত শিল্পবিদ্যালয়ে বা পৃথকভাবে যাহাতে ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা, জাহাজ নির্মাণ, কাঁচের পাত্রাদি নির্মাণের শিক্ষা প্রভৃতির ব্যবস্থা হয় সে-সম্বন্ধেও আলোচনা হইয়াছে এবং ইহার জন্য রাজপুরুষদের প্রতি তীব্র কটাক্ষ করিয়া বলা হইয়াছে : “বিজ্ঞান বিদ্যার প্রাদুর্ভাব না হইলে কোন রূপেই দেশের মঙ্গল সম্ভাবনা নাই।”৩২ যন্ত্র দ্বারা সুতা ও কাপড়ের নির্মাণ হওয়ায় এক্ষণে ঐরূপ যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখান হইয়াছে এবং মন্তব্য করা হইয়াছে
“ইংরাজ প্রভৃতি জাতি বিজ্ঞান বিদ্যায় বিলক্ষণ পারদর্শি হওয়াতে এই সমস্ত অচিন্তনীয় কার্য নির্বাহ করিয়া সাধারণের উপকার করিতেছেন অতএব ঐ বিজ্ঞান বিদ্যার অনুশীলন নিমিত্ত এদেশে এক স্বতন্ত্র বিদ্যালয় স্থাপন করা অতি আবশ্যক বোধ হইতেছে, বহুদিবস হইল কোন সম্ভ্রান্ত ইংরাজ মিকনিক্স ইনষ্টিটিউট নামে বিজ্ঞান বিদ্যানুশীলনের এক বিদ্যালয় সংস্থাপন করিয়াছিলেন, কিন্তু গবর্ণমেন্ট তাহার প্রতি কোনরকম সাহায্য না করায় ও সাধারণেরও উৎসাহ বৃদ্ধি না হইবায় তাহা পত্তনেই পতন হইয়াছে। যাহা হউক…এতদ্দেশীয় ব্যক্তিদিগকে এই বিদ্যা দিয়া চিরোপকার করা অবশ্য কর্তব্য হয়।”৩৩
এই উদ্ধৃতিতে যে Mechanics Institute সম্বন্ধে উল্লেখ করা হইয়াছে তাহা বিলাতের আদর্শে ১৮৩৯ সনে কলিকাতায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, কিন্তু শীঘ্রই ইহার বিলোপ হয়। কৃষিশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও এ-বিষয়ে সরকারের ঔদাসীন্য সম্বন্ধেও তীব্র সমালোচনা করা হইয়াছে। শ্রমজীবী ও কৃষকদিগের শিক্ষাদানের সম্বন্ধেও অনেক আলোচনা হইয়াছে।৩৪
সমসাময়িক পত্রিকার পূর্বোদ্ধৃত ও অনুরূপ আরও বহু মন্তব্য হইতে বেশ বুঝা যায় যে, শিক্ষাব্যবস্থার যে ত্রুটি আমাদের বর্তমান আর্থিক দুরবস্থার জন্য প্রধানতঃ দায়ী, শতাধিক বত্সর পূর্বেই শিক্ষিত বাঙ্গালীরা সেদিকে সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়াছেন, কিন্তু বিশেষ কোন ফল হয় নাই। ঠিক একশত বর্ষ পূর্বে সোমপ্রকাশ পত্রিকায় এ বিষয়ে একটি সুচিন্তিত মন্তব্য প্রকাশিত হয়। তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি–
“ভারতবর্ষে প্রকৃত বিজ্ঞানের অনুশীলন নাই বলিলে হয়। রুড়কি কালেজ ও মেডিকাল কলেজ সমূহে যে কিছু আছে এই মাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ কৃতবিদ্য ছাত্রকে একটি পুষ্প প্রদর্শন করিয়া তাহার জাতি জিজ্ঞাসা করিলে ঊর্ধনয়ন হইয়া থাকেন। আসিয়াটিক সোসাইটী বিজ্ঞানের এই শোচনীয় দশা দর্শন করিয়া প্রস্তাব করিয়াছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের যাহাতে বিজ্ঞানের সমধিক চর্চা হয়, তাহা করা কর্তব্য। তাহারা প্রবেশিকা শ্রেণী হইতে ইহার আরম্ভ করিতে বলেন; কিন্তু আমরা দুঃখিত হইলাম, ভারতবর্ষীয় গবর্ণমেণ্ট এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিয়া সে সময় অদ্যাপি আইসে নাই এই মাত্র উত্তরদান করিয়াছেন। শিখিবার সময় আইসে নাই, চমৎকার কথা! আরম্ভ না করিলে সেই সময় কখনই হইবে না।…
“অতএব সোসাইটির প্রস্তাবানুসারে কাজ করা অতিশয় আবশ্যক হইয়াছে। সর্বত্রই প্রকৃত বিজ্ঞান-শিক্ষার আরম্ভ করিয়া দেওয়া উচিত। বাঙ্গালা বিদ্যালয়েও ইহার অনুশীলন আবশ্যক।”৩৫
৫. ইংরেজীশিক্ষার প্রথম প্রতিক্রিয়া
গভর্নমেন্ট কর্তৃক ইংরেজীর মাধ্যমে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার প্রবর্তনের পূর্বেই বঙ্গদেশে সহস্রাধিক যুবক ইংরেজী শিক্ষা করিয়াছিল। এই সময় ইংরেজীশিক্ষার ফল সম্বন্ধে সাধারণের কী ধারণা ছিল তাহা সমসাময়িক সংবাদপত্র হইতে জানা যায়।
ইংরেজীশিক্ষার ফলে যে যুক্তিবাদ ও স্বাধীন চিন্তার উদ্ভব হইয়াছিল তাহার প্রতিক্রিয়ায় প্রথম প্রথম একশ্রেণীর ছাত্রের মনে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের চিরাচরিত প্রথা, সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের প্রতি প্রবল বিদ্রোহের ভাব দেখা দিল। এই শ্রেণীর মুখপাত্র মাধবচন্দ্র মল্লিক বাংলা ১২৩৮ সালের ২৩ আশ্বিন (৮ অক্টোবর, ১৮৩১ খ্র.) অবৈতনিক হিন্দু ফ্রি স্কুল সম্বন্ধে যে একখানি সুদীর্ঘ পত্র লেখেন তাহাতে এই মনোভাবের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। ইহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।
“যে অযুক্ত (অযৌক্তিক?) ধৰ্ম্মেয় শৃঙ্খলে বহুঁকালাবধি আমাদের মন বদ্ধ আছে তাহার দৃঢ়করণে যদ্যপি আমারদিগের অভিপ্রায় থাকিত তবে আমরা কখন হিন্দু ফ্রি স্কুল স্থাপন করিতাম না।….ফলোপদায়ক বিদ্যা বর্ধনার্থ এবং ঐ বিদ্যার দ্বারা ধর্মবিষয়ক মোহ দূরীকরণাভিপ্রায়ে ঐ হিন্দু ফ্রি স্কুল সংস্থাপিত হইয়া যে তাহার পৌষ্টিকতা হইয়াছে ইহা আমি সুন্দর অবগত আছি।…পৃথিবীর মধ্যে আমি ও আমার মিত্রেরা যদ্রপ হিন্দুধৰ্ম্ম ঘৃণা করি তদ্রূপ আমারদের অপর কোন ঘৃণ্য বস্তু নাই। হিন্দুধৰ্ম্ম কুকর্মের যদ্রপ কারণ তদ্রূপ অপর কুকর্মের কারণ জ্ঞান করি না। হিন্দুধর্মের দ্বারা যদ্রপ কুক্রিয়ায় প্রবৃত্তি হয় এমত অপর কোন বিষয়ে আমরা বোধ করি না এবং সৰ্বসাধারণের লোকের শান্তি ও কুশল ও সুখের হিন্দুধৰ্ম্মে যেরূপ ব্যাঘাত জন্মে তদ্রূপ অপর কোন বিষয়ে আমরা বুঝি না! এবং অযুক্ত ধর্ম বিনাশার্থ আমাদের যে অভিপ্রায় তাহা কি ব্যঙ্গোক্তি কি তোষামদ কি ভয় কি তাড়না কোন প্রকারেই আমরা ত্যাগ করিব না।”৩৬
পত্রলেখক ঐ স্কুলের শিক্ষক ছিলেন–সুতরাং ছাত্রদেরও কেহ কেহ যে অনুরূপ চিন্তা ও আচরণ করিবে, তাহাতে আশ্চর্য বোধ করিবার কিছু নাই।
সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় হিন্দু কলেজের ছাত্রদের শিক্ষা-দীক্ষা ও আচার ব্যবহার সম্বন্ধে অভিভাবকদের বহু চিঠি প্রকাশিত হইয়াছিল–তাহা হইতে কিছু কিছু উদ্ধৃত করিতেছি।
১। “আমি নিৰ্দ্ধন মনুষ্য পুত্রটি ঘরের কৰ্ম্ম কখন কখন দেখিত ও ডাকিলেই নিকটে আসিত কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেই উত্তর দিত। কিন্তু (হিন্দু কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে) কিছুকালের মধ্যে বিপরীত রীতি হইতে লাগিল। পরে দেশের রীত্যনুসারে আচার ব্যবহার ও পোষাক ত্যাগ করিলেক অর্থাৎ চুল কাটা সাপাতু জুতাধারি মালাহীন স্নান বিহীন প্রাপ্ত মাত্রেই ভোজন করে শুচি অশুচি দুই সমান জ্ঞান জাতীয় বিষয় অভিমান ত্যাগি উপদেশ কথা হইলেই Nonsense কহে ইত্যাদি”।৩৭ (৬ নবেম্বর, ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দ)
২। “এতদ্দেশীয়দিগের মধ্যে ইদানিং যাহারা ইংরাজী বিদ্যাভ্যাস করিয়াছে তাহারদিগের মধ্যে যাহারা ভাল শিক্ষা করিয়াছে তাহারা প্রায় পরস্পর ইংরাজী ভাষা ভিন্ন পত্রাদি লেখে না এবং ইংরাজী কথা কহিতে পাইলে বাঙ্গালা বাক্য ব্যবহার করে না।”৩৮ (৯ মে, ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দ)
৩। “কতিপয় দিবস গত হইল কলিকাতার একজন গৃহস্থ আপন পুত্রকে সঙ্গে লইয়া জগদম্বার দর্শনে কালীঘাটে আসিয়া…জগদীশ্বরীর সন্নিধানে উপনীত হইয়া তাবতের সহিত অষ্টাঙ্গে প্রণাম করিলেন। কিন্তু উক্ত গৃহস্থের সুসন্তানটি প্রণাম করিলেন না। ব্রহ্মাদি দেবতার দুরারাধ্যা যিনি তাঁহাকে ঐ ব্যলীক বালক কেবল বাক্যের দ্বারা সম্মান রাখিল যথা “গুড মর্ণিং ম্যাডম’…তাহাতে ঐ বালীকের পিতা আক্ষেপ করিয়া কহিল ওরে আমি কি ঝকমারি করে তোরে হিন্দু কালেজে দিয়াছিলাম যে তোর জন্য আমার জাতি মান সমুদায় গেল।”৩৯ (১৪ মে, ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দ)
তৎকালে প্রচলিত কতকগুলি আচার-ব্যবহার হিন্দু কলেজের ছাত্রেরা না মানিয়া চলায় একজন পত্রলেখক কলেজের কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করিতেছেন যে, তাঁহারা যেন নিম্নলিখিত আজ্ঞা দেন :
৪। “হিন্দু কালেজের ছাত্রেরা ফিরিঙ্গির মত পরিচ্ছদ না করিতে পায় যথা ফিরিঙ্গি জুতা পায় সবচুল মাথায় খালি আঙ্গরাখা গায় মালা নাই গলায় নেচরের গুণে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় হয় এবং দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে ইত্যাদি পরিবর্তে মাথা কামায় ফিরিঙ্গি জুতা পায় না দিতে পায় উড়ানি কিম্বা একলাই দেয় গায়, মালা দেয় গলায়, অস্পৃশ্য দ্রব্য না খায়, তিলক সেবা করে, ত্রিকচ্ছ করে ধুতী পরে, ঈশ্বরের গুণানুকীৰ্ত্তনে সৰ্ব্বদা রত হয়, কাছা খুলে প্রস্রাব ত্যাগ করে, জল লয়।”৪০ (১৬ জুলাই, ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দ)
কিন্তু হিন্দু কলেজের সমর্থকও একদল ছিলেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ পূর্বোক্ত ১নং চিঠি সমাচার চন্দ্রিকায় প্রকাশিত হইলে, তাহার প্রত্যুত্তরস্বরূপ একজন লেখেন :
৫। “হিন্দুকালেজনামক যে বিদ্যালয় কএক বৎসরাবধি এদেশে স্থাপিত হওয়াতে সৰ্বসাধারণের যে উপকার হইতেছে বিশেষতঃ যাহারা যযাত্রহীন তাঁহারদিগের সন্তানদিগের বিদ্যাভ্যাসের বিষয়ে যে মহোপকার হইয়াছে এবং হইতেছে তাহা ভদ্রলোকের অবিদিত কি আছে। কিন্তু চন্দ্রিকাকার তদ্বিষয়ে নিতান্ত অসুখী তিনি যে কালেজস্থ অল্পবয়স্ক ছাত্রদিগের অল্প অল্প দোষে তাহারদিগের প্রতি নানা দোষারোপ করিয়া চন্দ্রিকায় প্রকাশ করিয়াছেন ইহাতেই ব্যক্ত হইতেছে যে তিনি উক্ত কালেজের বিপক্ষ…আমি চন্দ্রিকাকার মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করি যে হিন্দুকলেজ স্থাপিত হওনের পূৰ্ব্বে কি হিন্দু বালকদিগের কখন কোন কদাচার হইত না কেবল বহু পরিশ্রমপূৰ্ব্বক কালেজে বিদ্যাভ্যাস করিয়া কি তাঁহারা সহস্র অপরাধে অপরাধী হইয়াছেন। কাজেই স্থাপিত হওনের পূর্বে এতদ্দেশীয় কয়েকজন বাঁকা বাবুরা তাঁহারদিগের স্ব স্ব পিতৃবিয়োগের পর পৈতৃক ধনাধিকারী হইয়া ধন যৌবন এবং মূর্খপ্রযুক্ত মদ্যপান এবং যবনীগমনাদি কোন কোন অবৈধ কর্ম না করিয়াছেন এবং পৈতৃক ধন কি কি রূপ অসদ্ব্যয়ে না নষ্ট করিয়াছেন…গাঁজাখুরী ঝকমারি সবলোট ইত্যাদি তৎকালে বিদ্যার অপ্রাচুর্যহেতুক ভদ্রলোকের সন্তানের কোন কোন অসঙ্কৰ্ম্ম না করিয়াছেন। এইক্ষণে…এতদ্দেশে হিন্দুকালেজ প্রভৃতি কএকটা পাঠশালা স্থাপিত হওয়াতে উপরের লিখিত কুনীতি বা রীতি আর প্রায় দেখা যায় না বরং হিন্দু বালকেরা ক্রমে জ্ঞানবান এবং বিদ্বান হইতেছেন এবং তদৃষ্টে অনেকেরি বিদ্যাভ্যাসে উৎসাহ জন্মিতেছে।”৪১ (২২ জানুআরি, ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দ)।
ইংরেজীভাষার সাহায্যে পাশ্চাত্ত্য জ্ঞানের প্রসার ও তাহার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে কয়েকটি অনুকূল সম্পাদকীয় মন্তব্য উদ্ধৃত করিতেছি।
১। “গত পাঁচ ছয় বৎসরের মধ্যে এ দেশে ইংলণ্ডীয় ভাষা ও বিদ্যাশিক্ষা করণার্থে যে উদ্যোগ হইতেছে তাহা অত্যাশ্চর্য্য। ইহার পূর্বে আমরা শুনিতাম যে ইংলণ্ডীয় ভাষার ছাত্রেরা যৎকিঞ্চিৎ পড়াশুনা করিয়া কেরাণিদের পদপ্রাপণার্থে সেই ভাষা শিক্ষা করিত। কিন্তু আমরা এখন অত্যাশ্চর্য্য দেখিতেছি যে এতদ্দেশীয় বালকেরা ইংলণ্ডীয় অতিশয় কঠিন পুস্তক ও গূঢ় বিদ্যা আক্রমণ করিতে সাহসিক হইয়াছে এবং ভাষার মধ্যে যাহা অতিশয় দুঃশিক্ষণীয় তাহা আপনাদের অধিকারে আনিয়াছে।…এতদ্বিষয়ে যে প্রশংসা আমরা ইংলণ্ডীয় সাহেব লোকের নিকটে শ্রবণ করিয়াছি তাহা যদি লিখি তবে তাহা খোসামোদের ন্যায় জ্ঞান হইবেক।”৪২ (৭ই মার্চ, ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দ)।
হিন্দু কলেজের ছাত্র কাশীপ্রসাদ ঘোষ সম্বন্ধে নিম্নলিখিত মন্তব্যটি প্রকাশিত হয় :
২। “শ্রীযুক্ত বাবু কাশীপ্রসাদ ঘোষ ইংলণ্ডীয় কাব্যের স্বকপোল রচিত এক গ্রন্থ প্রকাশ করিতে মনস্থ করিয়াছেন। ইংলণ্ডীয় কাব্যক্ষেত্রে এতদ্দেশীয় লোকের প্রথম অধিকার এই…তৎ পুস্তক হইতে সংগৃহীত যে কিয়ৎ প্রকরণ আমাদের দৃষ্টিগোচর হইয়াছে তাহাতে তৎ কবির কাব্যীয় গুণ এবং ইঙ্গরেজী ভাষায় নিপুণতমতা প্রকাশ হইতেছে। ইঙ্গরেজী ভাষার মধ্যে যাহা দুঃসাধ্য তাহাতে এতদ্দেশীয় লোকেরদের অধিকারকরণ ক্ষমতাতে যদি আমারদের মনে কিছু সন্দেহ থাকিত তবে এই কাব্যের দ্বারা তাহা দূরীকৃত হইত।…গত দশ বৎসরের মধ্যে এতদ্দেশীয় লোকেরদের ইঙ্গরেজী বিদ্যার অনুশীলনেতে তাঁহারা যেরূপ কৃতকার্য হইয়াছেন তাহা অতি বিস্মরণীয়…এক্ষণে কলিকাতা নগরে স্বীয় ভাষার তুল্য ইঙ্গরেজী ভাষাভিজ্ঞ শতাবধি দুইশত যুব মহাশয়েরদিগকে দর্শায়ন যায়। তাহাদের মধ্যে কএকজন…ইঙ্গরেজী ভাষাধ্যয়নে এমত দৃঢ়তরাভিনিবেশ করিয়াছেন যে ইংলণ্ডীয় লোকের অধিকাংশেরা যে পুস্তক রচনায় উৎসাহ রহিত সেই পুস্তক প্রস্তুত করণে সক্ষম হইয়াছেন।”৪৩ (২৭ ফেব্রুআরি, ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দ)
হিন্দু কলেজের পরীক্ষা প্রসঙ্গে মন্তব্য :
৩। “পূৰ্ব্বে ইংরাজেরা এমত বুঝিতেন যে বাঙ্গালিরা কেবল কেরাণীগিরির উপযুক্ত যৎকিঞ্চিৎ ইংরাজি শিক্ষা করে। কিন্তু এখন দেখা গেল যে তাহারা আপনারদের দেশভাষার ন্যায় ইংরাজি শিক্ষা করিতেছে-অতএব আদালতের মধ্যে ইংরাজি ভাষায সওয়াল ও জবাব করিবার কি আটক। এখন বাঙ্গালা দেশের মধ্যে তাবৎ আদালতে পারসি ভাষা চলিতেছে তাহা জজসাহেবের ভাষা নয় ও উকীলদের ভাষা নয় আসামী ফরিয়াদীর ভাষা নয় এবং সাক্ষিরদের ভাষাও নয়। আমাদের বিবেচনায় এই হয় যে যদি আদালতে কোন বিদেশীয় ভাষা চালান উচিত হয় তবে ইংরাজি ভাষা চালান উপযুক্ত (ইহার যে বাধা ছিল তাহা এখন ঘুচিয়াছে কারণ কলিকাতায় ইস্কুলে যত বালক ইংরাজি শিখিতেছে তাহারদের সংখ্যা করিলে এক হাজারের নূন হইবে না)”।৪৪ (২৬শে জানুআরি, ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দ)
হিন্দু কলেজের ছাত্রগণের যে সমুদয় আচার-ব্যবহারে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ ক্ষুব্ধ হইয়াছিল, পূর্বোক্ত চিঠিপত্রাদি প্রকাশের বহুকাল পরেও যে তাহা কতক পরিমাণে প্রচলিত ছিল সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিতে তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি লিখিয়াছেন যে, বর্তমান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের সম্মুখে গোলদীঘির নিকট যে একটি উদ্যান ছিল যেখানে তিনি ও তাঁহার বন্ধুগণ সমবেত হইয়া মদ্যপান ও নিষিদ্ধ মাংস আহার করিতেন। অপরিমিত মদ্যপানের ফলে তাঁহার স্বাস্থ্য এরূপ ভাঙ্গিয়া যায় যে ১৮৪৪ সনে তিনি হিন্দু কলেজ ছাড়িয়া যাইতে বাধ্য হন। তিনি এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করিয়াছেন যে, সে-যুগে হিন্দু কলেজের ছাত্রেরা মদ্যপান সভ্যতার অঙ্গ বলিয়া গ্রহণ করিত এবং ইহা কোনপ্রকারেই দূষণীয় মনে করিত না। ইহার সমর্থনে তিনি বলিলেন যে, হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্ববর্তী ছাত্রসম্প্রদায় মদ্যপান করিত না বটে, কিন্তু তাহারা গাঁজা ও চরস খাইত, বেশ্যাগৃহে গমন করিত এবং বুলবুলের চড়াই ও ঘুড়ি ওড়ানোর জুয়া খেলিত। হিন্দু কলেজের ছাত্রেরা এইসব কদাচার হইতে মুক্ত ছিল এবং সভ্যতার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ হিসাবেই মদ্যপান করিত। ইহার প্রমাণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করিয়াছেন যে, তাঁহার পিতার আদেশে তিনি গৃহে তাঁহার সঙ্গে একত্রে পরিমিত মদ্যপান করিতেন এবং মুসলমান বাবুর্চির তৈরী খাদ্যদ্রব্য ভোজন করিতেন।
৬. পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার স্থায়ী প্রভাব
ইংরেজীশিক্ষার স্থায়ী প্রভাব নির্ণয় করিতে হইলে পূর্বোক্ত আচার-ব্যবহারের পরিবর্তনের কতটুকু ভাল ও কতটুকু মন্দ, ইহার কতটা সাময়িক এবং কতটা চিরস্থায়ী কেবলমাত্র তাহার বিচার করিলে চলিবে না। পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার প্রভাবে বাঙ্গালীর যে সমুদয় গুরুতর মানসিক পরিবর্তন ঘটিয়াছিল তাহার উপরেও জোর দিতে হইবে। এই বিষয়টির বিস্তৃত আলোচনা এই গ্রন্থে সম্ভবপর নহে, সুতরাং মাত্র সাধারণভাবে বিশেষ কতকগুলি পরিবর্তনের উল্লেখ করিব।
প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার শেষযুগে ইহার মধ্যে যে একটি গুরুতর অশুভ ঘটনা দেখা দিয়াছিল সে-সম্বন্ধে মুসলমান পণ্ডিত আলবেরুণী বিশেষভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিলেন। খ্রীষ্টজন্মের প্রায় একসহস্র বৎসর পরে তিনি ভারতে আসিয়াছিলেন এবং এদেশের বহু গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করিয়া ইহার সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে বহু তথ্য লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, হিন্দুরা বহির্জগৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং পাশ্চাত্ত্য জগতে জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্প প্রভৃতির যে সমুদয় উন্নতি হইয়াছে। তাহার কোন খবরই রাখে না। সুতরাং তাহারা মনে করে যে তাহারাই জগতের শ্রেষ্ঠ জাতি, অন্য কোন জাতির কাছে তাহাদের শিখিবার কিছুই নাই। কিন্তু তাহাদের পূর্বপুরুষদের এরূপ মনোবৃত্তি ছিল না। আলবেরুণীর এই উক্তি যে সম্পূর্ণ সত্য সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। প্রাচীনকালে হিন্দুরা উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপন করিয়াছিল এবং এই সমুদয় দেশের অনেক অংশে হিন্দুসভ্যতার বিস্তার হইয়াছিল। কিন্তু আলবেরুণীর সময় অথবা তাহার পূর্ব হইতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এই আটশত কি হাজার বৎসর বহির্জগতের সহিত তাহাদের যে বিশেষ কোন পরিচয় ছিল এরূপ প্রমাণ নাই। বাণিজ্যব্যপদেশে বণিকগণ ভারতের বাহিরে যাইত, কিন্তু বিদেশের কোন বিবরণ যে ভারতবাসীদের জানা ছিল তাহা মনে করিবার কোন কারণ নাই। মধ্যযুগে সমুদ্রযাত্রা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ হইয়াছিল। ভারতের বাহিরে সকল দেশেই ম্লেচ্ছজাতির বাস, এই কারণে স্থলপথেও বিদেশযাত্রা রহিত হইয়াছিল। এই কূপমণ্ডুকতা যে মধ্যযুগে হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবনতির একটি প্রধান কারণ তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।
দুই-একটি দৃষ্টান্ত দিলেই এই উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হইবে। পাশ্চাত্ত্য জগতে মধ্যযুগের শেষভাগে নূতন নূতন চিন্তাধারার বিকাশ ও জ্ঞানবিজ্ঞানের যে অদ্ভুত উন্নতিসাধন হইতেছিল, তাহার কোন সংবাদই বঙ্গদেশে কথা ভারতে পৌঁছায় নাই। যে সময়ে ইউরোপে নিউটন, লাইবনিজ, বেকন প্রভৃতি মনীষিগণ মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিস্তার করিতেছিলেন সেই সময় বাঙ্গালী তাহার কোন সংবাদ পায় নাই এবং বাঙ্গালী হিন্দুর মনীষা নব্যন্যায়ের শুষ্ক তর্কে স্বকীয়া ও পরকীয়া প্রেমের আপেক্ষিক শ্ৰেষ্ঠতা বিচারে মাসের পর মাস ব্যস্ত ছিল। প্রতিবেশী চীনদেশের তিনটি আবিষ্কার পৃথিবীতে যুগান্তর আনয়ন করিয়াছিল। মুদ্রণযন্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্র ও চুম্বক দিগদর্শন যন্ত্র যথাক্রমে শিক্ষা ও চিন্তা জগতে, যুদ্ধে এবং সমুদ্রযাত্রার ক্ষেত্রে অদ্ভুত উন্নতি করিয়াছিল। তাহার ফলে পাশ্চাত্ত্য জগতে রেণেসস বা নবজাগরণ আসিয়াছিল কিন্তু প্রতিবেশী বাঙ্গালী এই সমুদয় আবিষ্কারের কোন খবরই রাখে নাই–অথচ এইসব আবিষ্কারের পরে বহু চীনদেশীয় রাজদূত বাংলার সুলতানের দরবারে আসিয়াছিল।
অকস্মাৎ ইংরেজের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিয়া ইংরেজীশিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্ত্য ভাবের সঙ্গে পরিচয় ঘটায়, সহস্র বৎসরের অবরুদ্ধ পঙ্কিল জলাশয়ের বাঁধ ভাঙ্গিয়া গেল এবং নূতন নূতন ভাবধারা ও জ্ঞানের বেগবতী স্রোতস্বতী প্রবাহিত হইল।
প্রধানত নূতন নূতন স্কুল, কলেজ এবং আলোচনা ও বিতর্কসভার মাধ্যমেই যে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার ও সংস্কৃতি বঙ্গদেশে প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল তাহা পূর্বে বলিয়াছি। কিন্তু ইহা ছাড়া অন্যান্য কতকগুলি নূতন প্রতিষ্ঠানও এ-বিষয়ে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ এশিয়াটিক সোসাইটির (Asiatic Society) উল্লেখ করা যাইতে পারে। সার উইলিয়ম জোন্স ১৭৮৪ সনে কলিকাতায় ইহার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইহা এখনও বর্তমান। এই সুদীর্ঘকাল ধরিয়া ইহা ভারতবাসীর জ্ঞানভাণ্ডার কিরূপ সমৃদ্ধশালী করিয়াছে তাহা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়; ভারতের প্রাচীন সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আধুনিক বিজ্ঞানের প্রায় সকল বিভাগে আধুনিক প্রণালীতে চর্চা ও গবেষণার পথ উন্মুক্ত করিয়া ইহা ভারতের এক নবযুগ আনয়ন করিয়াছে বলিলে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হইবে না। প্রথম ৪০। ৫০ বৎসর বিদেশীরাই ইহার পরিচালনা করিত, কোন ভারতবাসী ইহার সদস্য ছিল না। তারপর ক্রমে ক্রমে বহু ভারতবাসী ইহাতে যোগদান করিয়া ইহার উন্নতিবিধান করেন।
১৮০০ সনে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ, ১৮৬১ সনে প্রতিষ্ঠিত পুরাকীর্তি সন্ধান বিভাগ (Archaeological Survey of India) এবং এইরূপ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে উনিশ শতকে পাশ্চাত্ত্য জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে ভারতে এক নবজাগরণের সূত্রপাত হইয়াছে।
ভাগ্যক্রমে ইউরোপে এই সময় যুক্তিবাদ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রবল বন্যা বহিতেছিল। অন্ধবিশ্বাস ও সংস্কারের উপর যুক্তির প্রাধান্য, শাস্ত্রের অনুশাসন অপেক্ষা বিবেক ও ন্যায়বিচারের শ্রেষ্ঠতা, জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে রাজ্যে ও সমাজে সকলের তুল্য অধিকার প্রভৃতি ধারণা মানুষের মনে দৃঢ়মূল হইয়া উঠিয়াছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া সে সমুদয় ধর্মবিশ্বাস ও সামাজিক প্রথা মানুষ বিনাবিচারে ভগবানের অমোঘ বিধান বলিয়া নিঃসংশয়ে গ্রহণ করিয়াছিল; এখন যুক্তির সাহায্যে তাহার ভালমন্দ বিচার করিতে লাগিল এবং ধর্মে ও সমাজে যাহা কিছু প্রচলিত আছে তাহাই সত্য-এই বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত হইল। নির্বিচারে প্রচলিত মত, প্রথা, বিশ্বাস ও সংস্কার প্রভৃতি গ্রহণ ও স্বীকার করার বিরুদ্ধে চিন্তার স্বাধীনতা, মানুষের মনে বিদ্রোহ জাগাইল। ইউরোপের এই সমুদয় বিশেষ শিক্ষা ও নূতন চিন্তাধারা বাঙ্গালীর মনকে উদ্বুদ্ধ করিল, ফলে ইংরেজীশিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইহার প্রভাবও বিস্তৃত ও চিরস্থায়ী হইল।
আবহমানকাল হইতে হিন্দুরা দেবদেবীর মূর্তি গড়িয়া পূজা করিত, পতির মৃত্যু হইলে সদ্যবিধবাকে পতির সহিত জ্বলন্ত চিতায় পোড়াইয়া মারিত, দেবদেবীর কাছে মানত করিয়া শিশুপুত্রকে গঙ্গার জলে বিসর্জন দিত, উচ্চ নীচ জাতির মধ্যে সর্ববিষয়ে কঠোর প্রভেদ রক্ষা করিয়া চলিত, ৫০। ৬০টি কুলীন ব্রাহ্মণকন্যাকে একসঙ্গে মৃত্যুপথযাত্রী কুলীনের সঙ্গে বিবাহ দিয়া জাতি রক্ষা করিত, দিল্লীশ্বরকে জগদীশ্বর জ্ঞান করিত এবং ইংরেজপ্রভুকে সাদরে আহ্বান করিয়া আজ্ঞাপালনে ও দাসত্বশৃঙ্খল পরিতে বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃ করিত না, হিন্দুস্থানী বা মারাঠা ও পাঞ্জাবী অপেক্ষা ইংরেজকে অধিকতর আত্মীয় মনে করিত–বিনাবিচারে এই সমুদয় মানিয়া লইতে তাহারা কখনও দ্বিধাবোধ করিত না। কিন্তু পাশ্চাত্ত্য শিক্ষা ও আদর্শের প্রভাবে এই সমুদয় স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাস, ক্রিয়া ও মতের বিরুদ্ধে তাহারা অনুপ্রাণিত হইল। এককথায় বলিতে গেলে ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি প্রভৃতি মানুষের সকল কর্মক্ষেত্রেই এই নূতন আদর্শের প্রভাব লক্ষিত হইল। এই প্রভাবের ফলে এইসকল ক্ষেত্রে বঙ্গদেশে ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে গুরুতর পরিবর্তন ঘটিয়াছিল, অতঃপর পৃথকভাবে তাহারই আলোচনা করিব।
***
পাদটীকা
১. সং. সে. ক. ১। ৪১ (শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্কলিত ও সম্পাদিত সংবাদপত্রে সেকালের কথা’, প্রথম খণ্ড, ৪১ পৃ.)।
২. এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনার জন্য Journal of Asiatic Society, Letters, Vol, XXI. (1955) pp. 39-51 দ্রষ্টব্য।
৩. Andrews and Mookerjis, The Rise and Growth of the Congress, pp. 70-71.
৪. সং. সে. ক., ২। ১৩১, ৩২ পৃ.।
৫. ঘোষ, ৩। ৬০২ (বিনয় ঘোষ প্রণীত সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র’-প্রথম সংখ্যাটি খণ্ড ও দ্বিতীয় সংখ্যাটি পৃষ্ঠার নির্দেশক)।
৬. সং. সে, ক, ২। ১২৪।
৭. The Bengal Harukaru, 13 February 1843. History of Political. Thought’ by B. Majumdar, p. 108.
৮. ঘোষ, ২। ৪২০-২৯।
৯. বিস্তৃত বিবরণের জন্য যোগেশচন্দ্র বাগল প্রণীত ‘বাংলার নবজাগরণের কথা’, ৫২ পৃ. দ্রষ্টব্য।
১০. ঘোষ, ১। ৩৩৫-৩৬
১১. ঐ. ১। ৩৩৭-৩৮
১২. ঐ, ১। ৩৪০
১৩. ঐ, ১। ৩৫২-৫৩
১৪. ঐ, ২। ৪০৬-১৫, ৬৩৫
১৪ক. ঐ, ২। ৩৯৩-৯৪
১৫. ঐ, ১। ৩০১
১৬. ঐ, ১।৩২২
১৭. ঐ, ঐ
১৮. ঐ, ১। ৩৩৪
১৯. ঐ, ১। ৩৭৭-৭৮
২০. ঐ, ১। ৩৮০-৮১
২১. ঐ, ১। ৩২৭
২২. ঐ, ১। ৩২৭-২৮ ২২ক, ঐ, ২। ৩৯৬-৯৭
২৩. ঐ, ১। ৩২৮ ২৩ক, ঐ, ১। ৪৭১-৭৩
২৪. ঐ, ১। ৫৩১ ২৪কঐ, ৪। ৫৬০
২৫. ঐ, ১। ৩৮৫
২৬. ঐ, ৩। ১৭৭, ১৮৩
২৭. ঐ, ১। ২০৩
২৮. ঐ, ১। ২২৯
২৯. ঐ, ১। ৩৫৭
৩০. ঐ, ১। ৩৫৮
৩১. ঐ, ৩৫৯-৬০
৩২. ঐ, ১। ৭১
৩৩. ঐ, ১। ৯৪,
৩৪. ঐ, ১। ৩৮৬-৮৮, ৪৯৩; ৪। ৫২৭, ৫৪৯,৫৭৩
৩৫. ঐ, ৪। ৫৩০
৩৬. সং. সে, ক. ২। ৫২
৩৭. ঐ, ২। ২৩১
৩৮. ঐ, ২। ২৩৬
৩৯. ঐ, ২। ২৩৭
৪০. ঐ, ২। ২৩৮
৪১. ঐ, ২। ২৩৩-৩৪
৪২. ঐ, ১৪২
৪৩. ঐ, ১। ৬৪
৪৪. ঐ, ৩। ৯-১০