রাস্ট্রপতি এরশাদ জনগণের এরশাদ হঠাও আন্দোলনের চাপে পারলৌকিক মুলো ঝুলিয়েছেন সামনে। সংবিধানে নতুন একটি জিনিস তিনি বলা নেই কওয়া নেই ঢুকিয়ে দিলেন, জিনিসটির নাম রাষ্ট্রধর্ম। এখন থেকে এ দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। কেউ কি দাবি করেছে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা চাই? না কেউ করেনি। দেশে কি মুসলমানদের ধর্ম পালনে কিছু অসুবিধে হচ্ছিল যে রাষ্ট্রধর্ম না হলে তাদের আর চলছিল না? তাও নয়, খুব চলছিল, বেশ চলছিল। বহাল তবিয়তেই ছিল মুসলমানরা। মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে গড়ে দেশের বারোটাই বাজাচ্ছিল, যেখানে সেখানে যখন তখন গজাচ্ছিল লোক ঠকানোর পীর, এখন এরশাদ নিজেই ধর্মের ঢোল নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন। নাচুনে বুড়োদের তাল দিচ্ছেন বেশ। রাষ্ট্রের কি কোনও ধর্মের প্রয়োজন হয়! মানুষের না হয় হয়, কিন্তু রাষ্ট্র কি কোনও মানুষ! রাষ্ট্র তো সব ধর্মের সব সংস্কৃতির সব ভাষার মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। রাষ্ট্র যদি নিরপেক্ষ না হয়, রাষ্ট্র যদি অনেকগুলো সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সম্প্রদায়ের পক্ষ নেয়, তবে সেই রাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে বিরোধ আর বিশৃংখলার সৃষ্টি হবে। হতে বাধ্য। অমুসলমানরা এ দেশে নিরাপত্তার অভাবে ভুগবে, ভুগতে বাধ্য। সভ্যতার দিকে যেতে হলে যে প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করতে হয়, তা রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করা। সভ্য দেশগুলোয় তাই হয়েছে। যে যুগে ধর্ম ছিল রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র, সে যুগকে বলা হয় অন্ধকার যৃগ। অন্ধকার যুগে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হত। অন্ধকার যুগে মানুষের বাক স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। আমার আশঙ্কা হয় এই দেশটি ধীরে ধীরে অন্ধকারের অতল গহবরে তলিয়ে যাচ্ছে। আমার আশঙ্কা হয় ধর্ম নামের কালব্যাধির যে জীবাণু ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এতে ভীষণ রকম আক্রান্ত হতে যাচ্ছে দেশের মানুষ। এরশাদ নিজের গদি বাঁচাতে নানারকম ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছেন, সংসদ বাতিল করে নির্বাচন করলেন, কোনও বড় দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি যেহেতু, ছোট কিছু দল আর সতন্ত্র কিছু লোক নিয়েই লোক ভুলোনো নির্বাচনের খেলা সারলেন। খেলায় জিতে দেখাতে চাইলেন তাঁর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা কিছুমাত্র অবৈধ নয়। কিন্তু তাঁর এই টোপ কেউ গিলছে না। ক্ষমতার লোভ এমনই লোভ যে আন্দোলনের ভূমিকম্প যখন তার গদি নাড়িয়ে দিচ্ছে, খুঁটি আঁকড়ে ধরার মত করে তিনি রাষ্ট্রধর্ম আঁকড়ে ধরলেন। জনগণের নাকের ওপর পারলৌকিক মুলো ঝুলিয়ে দিলেন। এবার যাবে কোথায় ধর্মভীরুর দল! বিরোধী দলগুলো জোট বেঁধেছে, নানারকম সাংস্কৃতিক দলও জোট বেঁধেছে শহরে গ্রামে সবখানে। এরশাদ বিরোধী রাজনৈতিক জোট থেকে রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ে খুব যে কথা বলা হচ্ছে, তা নয়। কারণ ইসলাম যদি কোথাও এসে বসে, সে বসা অবৈধ হোক, একে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করার বুকের পাটা সবার থাকে না। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দলগুলো থেকে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর। হাতে গোণা কিছু সাহিত্যিক সাংবাদিক রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি করছেন, এটুকুই। এর বেশি উচ্চবাচ্য নেই।
একাত্তরে বাঙালি মুসলমান অত্যাচারি অবাঙালি মুসলমান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রমাণ করেছে মুসলমান হলেই এক সঙ্গে বাস করা যায় না। একাত্তরে বাঙালিরা প্রমাণ করেছে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতভাগ ছিল সম্পূর্ণ ভুল একটি সিদ্ধান্ত। একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙালির স্বপ্ন ছিল অবাঙালি মুসলমানদের বিদেয় করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালবেসে বাংলা নামের একটি দেশ গড়ে তোলা। দীর্ঘ ন মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন একটি দেশ জুটল। শেখ মুজিবুর রহমান দেশ চালাতে শুরু করলেন। একশ একটা ভুল তাঁর থাকতে পারে, নেতা হিসেবে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় হলেও রাষ্ট্রপরিচালনায় তাঁর হাত কাঁচা হতে পারে, কিন্তু বলিষ্ঠ একটি সংবিধান তৈরি করেছিলেন, যে সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর সমাজতন্ত্র সহ ধর্মনিরপেক্ষতা স্থান পেয়েছিল। কোথায় সেই ধর্মনিরপেক্ষতা এখন! কোত্থেকে কোন এক মেজর জিয়া এসে ক্ষমতা দখল করে কোনও কারণ নেই কিছু নেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঘাড় ধরে বিদেয় করে দিলেন। জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও এক সেনানায়ক একটি চরম অন্যায় করলেন সংশোধনের নামে সংবিধানে একটি কালসাপ ঢুকিয়ে দিয়ে। হা কপাল! দেশের কপালে এই ছিল! বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি! এই গান গাওয়ার মত আর বুঝি কোনও মঞ্চ রইল না। জুন মাসের সাত তারিখ, ১৯৮৮ সাল, বাংলার ইতিহাসে একটি কালি মাখা দিন। চমৎকার একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করার দিন। অনেকটা সামনে এসে বিস্তর অর্জন করে পেছনে শূন্যতার দিকে ফেরার দিন, অসত্য অন্যায় অবিচার আর অন্ধকারের দিকে ফেরার দিন। এক দুই বছর পেছনে নয়, হাজার বছর পিছিয়ে যাবার দিন।
এ সময় শেখ হাসিনাই হতে পারেন সহায়। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছেন একাশি সালে, আওয়ামী লীগের সভানেষনী হয়েছেন। ফিরে আসার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ, যারা জিয়াউর রহমানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি স্বাধীনতার শত্রুদের এমনকী গোলাম আযমের মত একাত্তরের গণহত্যাকারীকে দেশে ঢোকার অনুমতি এবং অবৈধ ধর্মীয় রাজনীতিকে বৈধতা দিয়েছিলেন বলে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ যোগ করা, ধর্ম নিরপেক্ষতা তুলে দেওয়া এসব দুস্কর্ম তো আছেই— শেখ হাসিনার ওপর ভরসা করলেন। কিন্তু এই হাসিনাই এরশাদের ফাঁদে পা দিয়ে জামাতে ইসলামিকে নিয়ে নির্বাচনে যোগ দিলেন ছিয়াশি সালে। খালেদা জিয়া কিন্তু এরশাদের টোপ মোটেও গেলেননি। এরশাদ নিজের ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন, তা বুঝে হাসিনা শেষ পর্যন্ত সংসদ বর্জন করলেন কিন্তু জামাতে ইসলামির মত দলের সঙ্গে ভিড়ে যে কালিটি তিনি লাগিয়েছেন গায়ে, তা খুব সহজে দূর হবে না। তারপরও প্রগতিশীল মানুষের আশা তিনি ক্ষমতায় এলে তাঁর বাবার আদর্শে সংবিধানের হারিয়ে যাওয়া সম্পদ আবার পুনরুদ্ধার করতে পারেন। কিন্তু আপাতত এরশাদ বিরোধী জোটকে সমর্থন করা যাক, জোটের আন্দোলন যেন দুশ্চরিত্র স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে পারে। সাত বছর আগে ক্ষমতা দখল করেছে ব্যাটা, আজও ছাড়ার নাম নেই। দেশের লোক চাইছে না তাকে, তাতে কি আসে যায়, আমার কাছে অস্ত্র আছে, ধর্ম আছে, আমি এগুলোর ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে গদিতে বসে আয়েশ করব।
কোনও রাজনৈতিক দলের আমি কোনও সদস্য নই, তবু এ মুহূর্তে দুর্যোগের দিন পার হয়ে একটি সুন্দর আগামীর দিকে যাবে বলে যারা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাঁদের ওপর বিশ্বাস রেখে একটি সম্ভাবনার অংকুরের গোড়ায় আমি জল সার দিই।
ময়মনসিংহ সাহিত্য পরিষদ, সকাল কবিতা পরিষদ এবং আরও সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক দল মিলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠন করা হয়েছে। কবি, সাহিত্যিক, গানের নাচের নাটকের শিল্পী সব জড়ো হল এই জোটে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীপ্ত এক একজন মানুষ, সমাজ সচেতন মানুষ, সকলে দেশের মঙ্গল কামনা করে, সকলেই চায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সত্যিকার গণতন্ত্র, সুস্থ সামাজিক পরিবেশ। আমীর হোসেন রতনকে জোটের প্রধান করা হল। আশ্চর্যরকম পরিশ্রমী আর শক্তিমান মানুষ এই রতন। নিজের উদ্যোগে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে তিনি মুকুল নিকেতন নামে একটি ইশকুল খুলেছেন মহারাজা রোডে। সেই ইশকুল ছোট্ট একটি বাঁশের ঘর থেকে ধাঁ ধাঁ করে দালান হয়ে গেল। বছর বছর ছাত্র ছাত্রী বাড়ছে। গাধা পিটিয়ে মানুষ করার মত তিনি ছাত্র ছাত্রী মানুষ করেন মুকুল নিকেতনে। তিনি একটি শব্দ খুব পছন্দ করেন, ডিসিপ্লিন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের এই ডিসিপ্লিনের শিক্ষা দেন। যে কোনও জাতীয় দিবসে সার্কিট হাউজের মাঠে যখন কুচকাওয়াজ হয়, মুকুল ফৌজএর প্যারেড দেখতে হয় অপলক মুগ্ধতা নিয়ে। ময়মনসিংহের গ্রাম যখন বন্যায় ভাসছে, মানুষের বাড়িঘর ডুবে গেছে, গরুছাগল মরে গেছে, ভাত নেই কাপড় নেই, সেসময় রতন তাঁর বাহিনী নিয়ে জল পেরিয়ে পৌঁছে গেলেন দুর্গত এলাকায় ত্রাণ সাহায্য পৌঁছে দিতে। পাহাড় সমান কাজ রতনের, তাঁর ঘুমোবার গোসল করবার খাবার সময় নেই। সকলের আগ্রহে অনুরোধে রতন জোটের কাজ হাতে নিলেন। তাঁর হাজার কাজের মধ্যে আরেকটি কাজ যোগ হল। কাজ পেলেই খুশি থাকেন রতন, সকলের প্রিয় রতনদা। বুড়ো বয়সে আত্মীয় স্বজনের চাপে তিনি বিয়ে একটি করেছিলেন, কিন্তু সুন্দরী বালিকা বধূটিও তাঁকে ঘরে বাঁধতে পারেনি। রতন পড়ে থাকেন বাহির নিয়ে। রতনের মত অমন বেপরোয়া না হলেও, আমারও অনেকটা বাহির নিয়ে কাটে। সকাল কবিতা পরিষদে কবির ভিড় তো আছেই, যেহেতু বেশির ভাগ কবিই আবৃত্তিতে কাঁচা, কবি নয় কিন্তু কবিতা যারা ভাল পড়ে, তাদেরও সদস্য করে নিই। মূল কাজটি এখন আগুন আগুন কবিতা নিয়ে পাণ্ডুলিপি তৈরি করা, বৃন্দ আবৃত্তির কায়দা কানুন শিখিয়ে দেওয়া। পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে হয় রাত জেগে , একশ কবিতার বই ঘেঁটে। নতুন ছেলেমেয়ে নিয়ে প্রায় বিকেলে অবকাশের সামনের ঘরে মহড়া চলে। কবির চেয়ে বেশি আমি আবৃত্তিশিল্পী হয়ে উঠি। ঘরে দিন রাত্তির কাজী সব্যসাচী থেকে শুরু করে হালের জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের আবৃত্তি চলছে। কবিতা লেখাই শুধু শিল্প নয়, কবিতা পড়াও একটি শিল্প। এই শিল্পের তরে সময়পাত করে বেশ ভাল কাজই হয়, জোটের অনুষ্ঠানে কখনও একক কণ্ঠে কখনও সমস্বরে পড়া সকাল কবিতা পরিষদের কবিতা শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করে। অল্প দিনেই সংগঠনটি খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শহরে। সকালের ডাক পড়তে টাউন হলে, পাবলিক হলে, বড় ছোট যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। জোটের মধ্যে সকাল কবিতা পরিষদ অন্যতম একটি দল, সকাল না হলে এ অনুষ্ঠান জমবে না, ও অনুষ্ঠান ভেস্তে যাবে, শেষে এমন। রাজনৈতিক এই দুঃসময়ে রুখে ওঠার প্রেরণা চাই, উত্তেজনা চাই, গায়ের লোম দাঁড়িয়ে করিয়ে দেওয়ার মত কবিতা চাই – এমন সব কবিতাই আছে সকাল কবিতা পরিষদের আবৃত্তিশিল্পীদের কণ্ঠে। বেশির ভাগ কবিতাই রুদ্রর, নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রাহমান, মহাদেব সাহাও আছেন, পশ্চিমবঙ্গের কবিদের কবিতায় জ্বালাও পোড়াও সাধারণত থাকে না, তাই তাদের কবিতা থেকে খুব কমই বাছাইএ টিকেছে। দলের নাম হলে আবৃত্তিশিল্পীর ভিড় বাড়তে থাকে। ভিড়ের মধ্য থেকে যাচাই করে বাছাই করি। প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে সকাল কবিতা পরিষদ থেকে সমাজ পরিবর্তনের কবিতা এই বক্তব্য দিয়ে চমৎকার একটি অনুষ্ঠান করে ফেলি, পুরো অনুষ্ঠানটি আমি পরিচালনা করি নেপথ্যে থেকে। সৈয়দ শামসুল হককে বলেছিলাম অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ার, তিনি এককথায় রাজি হয়ে ঢাকা থেকে চলে এলেন। সৈয়দ হক কথা বলায় বেশ পারদর্শী, তিনি মুগ্ধ করলেন অনুষ্ঠানের শ্রোতাদের। প্রতিবাদের কবিতা, শান্তির জন্য কবিতা এসব কোনও রকম বারোই দিবস তেরোই দিবস ছাড়াই হচ্ছে, পঁচিশে মার্চ, ষোলই ডিসেম্বরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট থেকে মৌন মিছিলে নেমে পড়ছি। একুশে ফেব্রয়ারিতে অনেকবছর ময়মনসিংহে থাকা হয়নি, একুশের ভোরবেলায় চিরকালই আমার ঘুম ভাঙত আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি গাইতে পারি র সুর শুনে। রাস্তায় সাদা পোশাক পরে খালি পায়ে ফুল হাতে গান গাইতে গাইতে শহীদ মিনারের দিকে ফুল দিতে যাচ্ছে মানুষ, এর চেয়ে সুন্দর এর চেয়ে পবিত্র দৃশ্য আমার মনে হয় না জগতে আর কিছু আছে। এই পথশোভা আমাকে কেবল ঘুম থেকে জাগাতো না, চেতনার দুয়োর হাট করে খুলে স্পন্দিত করত জীবন। রফিক সালাম বরকতের জন্য আমার খুব গৌরব হয়, বাঙালি বলে নিজের জন্যও গৌরব হয়। ভোরের হাওয়া আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো সুরটি তার পাখায় করে নিয়ে এসে আমাকে এমন গভীর করে স্পর্শ করে যে আমাকে কাঁদতে হত। এখনও কাঁদতে হয়। ষোলই ডিসেম্বরে জোটের মিছিলে যখন আমরা ময়মনসিংহের পথে ফুলের স্তবক হাতে হাঁটছি বিজয় স্তম্ভের দিকে, মিছিলে যারা গান জানে গাইছে বিজয়ের গান, স্বাধীনতার গান, গানের কণ্ঠ থেমে এলে যতীন সরকার বললেন জয় বাংলা বাংলার জয় গাও, ওরা গাইতে শুরু করলে মিছিলের এক প্রান্ত থেকে গুনগুন আপত্তি ওঠে, আপত্তির দিকে তাকান যতীন সরকার, আমিও। আপত্তির প্রতিবাদ জানালে জয় বাংলা বা একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি এসব গান আওয়ামী লীগের গান বলে অভিযোগ করে কেউ কেউ। এই মিছিলে দলমত নির্বিশেষে সকলে বিজয় দিবসের আনন্দ করছি, সুতরাং কোনও নির্দিষ্ট দলের গান গাওয়া চলবে না। যতীন সরকার চেঁচিয়ে ওঠেন, এগুলো আওয়ামী লীগের গান হবে কেন? এগুলো মুক্তিযুদ্ধের গান। আমি মাথা নোয়াই লজ্জায়। একাত্তরে যুদ্ধের সময় যে গানগুলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বাজত, যে গান শুনে মুক্তিযোদ্ধারা প্রেরণা পেয়েছে, যে গান শুনে দেশ স্বাধীন করার উৎসাহ নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়েছে, দেশকে বাঁচাতে গিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে প্রাণ দিতে দ্বিধা করেনি, সে গানগুলোকে আজ আমাদের সবার গান বলে অস্বীকার করার যে লজ্জা, সেই লজ্জায় আমি মাথা নোয়াই। মিছিলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সমর্থক আছেন অনুমান করি। গানের দলীয়করণ নতুন নয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালীন শাহনাজ রহমতুল্লাহর প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ গানটি রেডিও টেলিভিশনে খবরের আগে পরে আকছার বাজানো হত। সুতরাং গানটি জাতীয়তাবাদী দলের গান হিসেবে নাম লেখালো। এরশাদও জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে একটি দেশাতব্ববোধক গান বেছে নিলেন নিজের দলের জন্য। হা কপাল! গানেরও মুক্তি নেই, গানকেও কোনও না কোনও দলে নাম লেখাতে হয়। বিজয় স্তম্ভে জোটের পক্ষ থেকে যতীন সরকার আর আমাকে এগিয়ে দেওয়া হয় ফুলের স্তবক অর্পণ করতে। যতীন সরকারের মত এত বড় একজন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এই কাজটি করতে পেরে ধন্য হই। তাঁর মত জ্ঞানী লোকের সংস্পর্শে আসার যোগ্যতা আমি খুব ভাল করে জানি যে আমার নেই।
আমি খুব কম লোকেরই দীর্ঘ বক্তৃতা শুনতে পছন্দ করি, যতীন সরকার সেই কম লোকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান একজন। যে কোনও বিষয়ে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনর্গল কথা বলে যেতে পারেন। সে সব কথা কেবল বলার জন্য কথা নয়। বিষয়ের সংজ্ঞা থেকে বিষয়ের গভীরে গিয়ে নাড়ি নক্ষত্র তুলে দেখান, মস্তিস্কের কোষে কোষে ঢুকিয়ে দেন সে বিষয়ের আদ্যোপান্ত। নাসিরাবাদ কলেজের বাংলার অধ্যাপক তিনি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে মূল্যবান সব বই লিখেছেন। ঘরের বাইরে তাঁর একটিই পোশাক, শাদা ধুতি পাঞ্জাবি। ধুতি পরা লোকদের লোকে খুব সহজে হিন্দু বলে বিচার করে। অথচ যতীন সরকারের মত অসাম্প্রদায়িক বাঙালি এ দেশে খুব কমই আছেন। আপাদমস্তক নাস্তিক তিনি। খাঁটি কমুনিস্ট। ধুতি তাঁর প্রিয় পোশাক বলেই ধুতি পরেন। রবীন্দ্রনজরুলসুকান্ত জয়ন্তীতে পাবলিক লাইব্রেরির অনুষ্ঠানে তাঁর দীর্ঘ দীর্ঘ বক্তব্য শুনেছি। তিনি প্রায়ই যে কবিকে বেছে নেন প্রশংসা করার জন্য, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। অবলীলায় নেত্রকোণার আঞ্চলিক সূরে কথা বলে যাচ্ছেন। জীবন যাপন করছেন অতি সাধারণ, দিন এনে দিন খাওয়া লোকদের মত। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হলেও তাঁর মত এমন ত্যাগী হওয়া আমি জানি, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। একটি গাড়ি পেলে রিক্সা ছেড়ে গাড়িতে উঠব, যতীন সরকার গাড়িতে উঠবেন না, রিক্সাও নেবেন না, পায়ে হেঁটে পার হবেন পথ। ধন দৌলত বিলাস ব্যসন ছেড়ে নির্লোভ হওয়ার কথা বলা যত সহজ, জীবনে অভ্যেস করা তত সহজ নয়। তবে এই আদর্শকে আজও সম্মান করা হয়, আজও এ শহরের লোকেরা যতীন সরকারকে দেখলে পথ ছেড়ে দাঁড়ায়, আর্শীবাদ কামনা করে। তবে একজনই একবার দেখেছি মোটে ফিরে তাকাননি। তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ঢাকায় এসেছিলেন, সৈয়দ শামসুল হক শক্তিকে প্রস্তাব করলেন ময়মনসিংহে যাওয়ার, শক্তি রাজি, একদিনের নোটিশে তিনি শক্তিকে নিয়ে ময়মনসিংহে চলে এলেন। ফোনে খবর জানিয়ে দিয়েছিলেন ইয়াসমিনকে। আমি তখন ঢাকায়। সৈয়দ হক আমাকে ঢাকা থেকে তুলে নিয়েছেন গাড়িতে। সকাল থেকে ইয়াসমিন বাড়িঘর গুছিয়ে ঝা তকতকে করে রেখেছে। বড় কবি সাহিত্যিকের নাম শুনলে দাদা আবার বরাবরই খুব বিগলিত। কই মাছ থেকে শুরু করে বড় বড় চিংড়ি, ইলিশ, রুই সব তিনি কিনে আনলেন নতুন বাজার থেকে। মা রান্না করলেন। খাবার ঘরে দাদার বিশাল খাবার টেবিলে সাজিয়ে দেওয়া হল খাবার। বিস্তর খাওয়া দাওয়া হল সেদিন দুপুরবেলা। বিকেলে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য যতীন সরকার আর ছড়াকার প্রণব রায়কে খবর পাঠিয়ে আনিয়েছি বাড়িতে। পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর সৈয়দ হক কী, কেমন আছেন? এই বাক্যটিই শুধু আওড়েছিলেন তিনি। শক্তি সৌজন্য করেও দুটো কথা বললেন না। সৈয়দ হক আর শক্তি নিজেদের মধ্যেই কথা বলে গেলেন। যতীন সরকার আর প্রণব রায় চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে চা বিস্কুট খেয়ে কিছু করার নেই বলে টেবিল থেকে সাপ্তাহিক পত্রিকা টেনে নিয়ে চোখ বুলিয়ে শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন। চমৎকার সাহিত্যের আড্ডা জমানোর উদ্দেশ্যটি আমার সম্পূর্ণই বিফলে গেল। শক্তি সারাক্ষণই বড় বড় ঢেঁকুর তুলছিলেন। সম্ভবত গত রাতে মদ্যপান অতিরিক্তই হয়েছে। কী জানি মদ্যপানে এরকম উদ্ভট রকম ঢেঁকুর বেরোয় কী না! মদে অভ্যেস নেই, জানি না। শক্তিকে খাতির যত্ন করে খাইয়ে দাইয়ে শশিকান্ত মহারাজার বাড়ি আর সত্যজিৎ রায়ের ঠাকরদার ইশকুলটি দেখিয়ে সন্ধেবেলা হাসিমুখে বিদেয় দেওয়া হল। দাদা কৃপা না করলে মুশকিল ছিল। হাড়কেপ্পন হলেও কবি সাহিত্যিকদের বেলায় উদার হতে দ্বিধা করেন না দাদা । একবার যখন হুমায়ূন আহমেদ ময়মনসিংহ শহরে আমার বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে ঠিকানা জানেন না, কিছু না, আমার লেখা পড়ে তাঁর মনে হয়েছে আমি ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে একটি লাল রঙের বাড়িতে থাকি, এবং তার মনে হওয়াকে অনুসরণ করে পাড়ের অনেক বাড়ির কড়া নেড়ে ও বাড়িতে আমি থাকি কি না জিজ্ঞেস করে, থাকি না জেনে, রাস্তায় বেরিয়ে রাস্তার লোকদের জিজ্ঞেস করে করে অবকাশে এসে কড়া নেড়েছেন— চোখের সামনে লেখক হুমায়ূন আহমেদকে দেখে দাদা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি। অনেকক্ষণ কোনও কথা ফোটেনি মুখে, তারপর, এক দমে ‘বসেন বসেন, দুপুড়ে কী খাবেন বলেন, মাছ পছন্দ কড়েন তো! আমাড় ওয়াইফ ড়ান্না কড়বে, খুব ভাল ড়ান্না করে। ইস, আগে জানলে তো আমার বন্ধু বান্ধবদেড় খবড় দিতে পাড়তাম’ বলে তক্ষুনি দৌড়ে বাজারে চলে গেলেন বড় বড় তাজা মাছ কিনে আনতে। খেতে খেতে হুমায়ূন আহমেদ গল্প বললেন, অন্যের গল্প নয়, নিজের গল্পই বললেন, সে শুনে হেসে পেট ফাটে দাদার, আমাদেরও। যে গল্প বলতে ভাল পারে, সে ভাল গল্প লিখতে পারে, এরকম একটি ধারণা দাদার জন্মে। আমি যদিও গল্প বলতে একেবারেই জানি না, কিন্তু বেশ কটা গল্প লিখে ফেলেছি এরমধ্যে। গল্পগুলো দৈনিক সংবাদের মেয়েদের পাতা বিভাগে পাঠিয়ে দেখেছি ঝটপট সব ছাপা হয়ে গেছে। মেয়েদের পাতার ধারণাটি আমার একেবারেই পছন্দ হয় না। মেয়েদের পাতার মত ছেলেদের পাতা বলে কোনও বিভাগ থাকে না পত্রিকায়। মেয়েদের আলাদা করে দেওয়া হয়, শিশুদের যেমন আলাদা করা হয়। মেয়ে, শিশু, পঙ্গু বৃদ্ধবৃদ্ধাদের জন্য সবসময়ই সবকিছু আলাদা। এদের, আমি নিশ্চিত, দুর্বল বলে ভাবা হয়। সাহিত্যের পাতার জন্য গল্প পাঠালে যেহেতু আমি গল্প লেখক বলে পরিচিত নই, আমার গল্প মুড়ির ঠোঙার মত কুঁচকে ফেলে দেওয়া হয় হাবিজিবি কাগজের ঝুড়িতে।
এরশাদকে ক্ষমতাচ্যূত করতে রাজনৈতিক জোটের সভা চলছে , মিছিলে কাঁপছে নগরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ছাত্রছাত্রী সংগঠনও বড় ভূমিকা পালন করছে এই আন্দোলনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলের ওপর ট্রাক চালিয়ে দিয়ে অনেককে হত্যা করেছে এরশাদের পুলিশবহিনী। এখনও রক্তের দাগ মোছেনি ওই এলাকা থেকে। সাংস্কৃতিক জোটও নিরলস অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে বিক্ষোভের, প্রতিবাদের। গাঢ় অন্ধকারে নিরাশার খরস্রোতা নদীতে সাঁতরে সাঁতরে আশার একটি ক্ষীণ আলোর দিকে যেতে থাকি। এই আলো কি সত্যিই আলো, নাকি মরীচিকা! যতীন সরকার আগামীর দিকে তাকিয়ে আছেন, সমাজতান্ত্রিক দল ক্ষমতায় এলে, তাঁর বিশ্বাস, এরশাদের এই পারলৈাকিক মুলোকে পরলোকে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু কবে ক্ষমতায় আসবে ওই দল! দলটি জামাতে ইসলামির চেয়েও দিনে দিনে ছোট আকার ধারণ করেছে। কমরেড ফরহাদ মারা গেলে বিশাল জানাজার আয়োজন হল ইসলামি নিয়মে। কমিউনিস্টরাই যদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে, হোক না সে লোক দেখানো, বেরোতে না পারে, তবে বাকি দলগুলো কী করে বেরোবে! ধর্ম এমনই এক সর্বনাশা জিনিস, এটিকে না মানো ক্ষতি নেই, কিন্তু এটিকে দূর করতে গেলেই গোল বাঁধে। অশিক্ষা আর অজ্ঞানতার কারণে মানুষের ভেতরে একটি অন্ধবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। এই বিশ্বাস কোনও যুক্তি মানে না। মুক্তবুদ্ধিকে পুরোয়া করে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে যদি বিদেয় না করা হয়, তবে দেশটি হয়ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হতে সময় নেবে না। ধর্ম হল কর্কট রোগের মত, একবার পেয়ে বসলে একের পর এক ধ্বংস করতে থাকে হাতের কাছে যা পায় তা-ই। এর কোনও নিরাময় নেই। সুস্থতার দিকে কিছুতে মুখ ফেরাতে দেয় না এই রোগ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কারণে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ধর্ম বিশ্বাসী মানুষকে অথবা ধর্মে বিশ্বাস না করলেও যারা ওই ধর্মাবলম্বীদের সন্তান, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে। কেউ যদি ইসলামের প্রেরণায় আল্লাহর আদেশ পালন করে সাচ্চা মুসলমান হতে চায়, তবে পবিত্র গ্রন্থ কোরান থেকে খুব সহজেই দীক্ষা নিতে পারে যেখানে লেখা ইহুদি আর খিস্টানদের সঙ্গে অর্থাৎ বিধর্মীদের সঙ্গে কোনওরকম বন্ধুত্ব না করার, করলে তাদেরও আল্লাহ ওই বিধর্মীদের সঙ্গে দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করবেন। কেবল এই নয়, যেখানে বিধর্মী পাও, ধ্বংস কর, খতম কর। যেখানেই অবিশ্বাসী পাও, কেটে ফেলো এক কোপে বাম হাত আর ডান পা, আরেক কোপে ডান হাত আর বাম পা। মুসলমানরাই যে খুব সুখে থাকবে তা নয়। মেয়েদের ওপর চলবে ধর্মের বুলডোজার। বুলডোজারের তলায় পড়ে মেয়েরা আর মেয়ে থাকবে না, খণ্ড খণ্ড মাংসপিণ্ডে পরিণত হবে।
যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ,
তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষতরা।
জাতির রক্তে আজ তেম্নি দেখ দূরারোগ্য ব্যাধি
ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ী রূপে
ঘউ²মশ উঠছে ফুটে ক্ষয়রোগ, রোগের প্রকোপ।
ধর্মান্ধের ধর্ম নেই, আছে লোভ, ঘৃণ্য চতুরতা,
মানুষের পৃথিবীকে শতখণ্ডে বিভক্ত করেছে
তারা টিকিয়ে রেখেছে শ্রেণীভেদ ঈশ্বরের নামে।
ঈশ্বরের নামে তারা অনাচার করেছে জায়েজ।
হা অন্ধতা! হা মুর্খামি! কতদূর কোথায় ঈশ্বর!
অজানা শক্তির নামে হত্যাযজ্ঞ কত রক্তপাত,
কত যে নির্মম ঝড় বয়ে গেল হাজার বছরে!
কোন সেই বেহেস্তের হুর আর তহুরা শরাব?
অন্তহীন যৌনাচারে নিমজ্জিত অনন্ত সময়
যার লোভে মানুষও হয়ে যায় পশুর অধম!
আর কোন দোযখ বা আছে এর চেয়ে ভয়াবহ?
ক্ষুধার আগুন সে কি হাবিয়ার চেয়ে খুব কম??
সে কি রৌরবের চেয়ে নম্র কোনও নরম আগুন?
ইহকাল ভূলে যারা পরকালে মত্ত হয়ে আছে
চলে যাক তারা সব পরপারে বেহেস্তে তাদের।
আমরা থাকব এই পৃথিবীর মাটি জলে নীলে।
দ্বন্দ্ব ময় সভ্যতার গতিশীল স্রোতের ধারায়
আগামীর স্বপ্নে মুগ্ধ বুনে যাবো সমতার বীজ।
একদার অন্ধকারে ধর্ম এনে দিয়েছিল আলো
আজ তার কঙ্কালের হাড় আর পচা মাংসগুলো
ফেরি করে ফেরে কিছু স্বার্থান্বেষী ফাউল মানুষ—
রুদ্র ক্ষেপেছে। কবিতার মধ্যে সে ফাউল শব্দটি ব্যবহার করেছে। মুখের শব্দ অবলীলায় পুরে দিয়েছে কবিতায়। এমনিতে সে প্রচুর গালাগাল দিয়ে কবিতা লিখে যাচ্ছে । কিন্তু ফাউল শব্দটি আমাকে খানিকটা আড়ষ্টতা দিলেও শেষ দুটি স্তবক বারবার আওড়াই – সৃষ্টির অজানা অংশ পূর্ণ করে গাল গল্প দিয়ে
আফিম তবুও ভাল, ধর্ম সে তো হেমলক বিষ।
কাছে থাকলে তার সঙ্গে আমার একদফা তর্ক হয়ে যেত। কিছুতেই আমি মেনে নিতে পারি না ধর্ম কোনও আলো এনেছিল কোনও কালে। অন্ধকার ছাড়া আর কিছু পৃথিবীতে ছড়ায়নি ধর্ম। মানুষের অজ্ঞানতা আর মৃত্যুভয় থেকে জন্ম নিয়েছে ধর্ম। একেশ্বরবাদী পুরুষেরা ধর্ম তৈরি করেছে তাদের আনন্দের জন্য, ইহলৌকিক সুখভোগের জন্য। ইসলামের ইতিহাস বলছে আরবের লোকেরা গুহায় বাস করত, কন্যা জন্ম নিলে জীবন্ত কবর দিত আর সেই দুরবস্থার অবসান ঘটিয়েছেন মোহাম্মদ। দুরবস্থা, আমার যা বিশ্বাস, আগের চেয়ে বেশি এসেছে ইসলাম আসার পর। আগে মেয়েরা বাণিজ্য করত, যুদ্ধে অংশ নিত, নিজের পছন্দমত বিয়ে করত, তালাকও দিত স্বামীদের। মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা ব্যবসায়ী ছিলেন, মোহাম্মদ ছিলেন তাঁর তিন নম্বর স্বামী, বয়সেও তাঁর অনেক ছোট ছিলেন। মেয়েদের জ্যান্ত পুঁতে ফেললে তো মেয়ের সংখ্যা কম হওয়ার কথা। এই যে এত গুলো বিয়ে করত পুরুষেরা, এত মেয়ে কোথায় পেত তবে! মেয়ে পুঁতে ফেললে তো মেয়ের অভাব হওয়ার কথা। তা কিন্তু হয়নি। আরবের লোকেরা স্ফূর্তিতে আমোদে দিন কাটাতো, খেতো, পান করত, বিশ্বাস করত এই জীবনের পরে আর কোনও জীবন নেই, এই জীবনেই যত আনন্দ আছে করে নিত। এই বিশ্বাসের ওপর ধ্বস নামালেন মোহাম্মদ। নিজের সৃষ্ট এই ধর্মকে ক্ষমতা দখল করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। নিদ্বির্ধায় মানুষ খুন করে, ভিন্ন গোত্রের লোকদের রক্তে স্নান করে, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে, ইহুদি এলাকায় নিজের সৈন্য নামিয়ে দিয়ে তাদের সম্পদ লুঠ করে মেয়েদের ধর্ষণ করে তিনি বিজয় নিশান উড়িয়ে দিলেন। এই ধর্ম কখনও তাঁর আধ্যাত্মিক ব্যপার ছিল না, ছিল প্রথম থেকে শেষ অবদি, রাজনৈতিক। ইহলৌকিক কোনও আনন্দ থেকে নিজেকে তিনি বঞ্চিত করেনি। যখন যা ইচ্ছে হয়েছে, করেছেন। দোহাই দিয়েছেন আল্লাহর। কাউকে খুন করে এসে বলেছেন আল্লাহ তাঁকে খুন করতে বলেছেন, তাই করেছেন। আল্লাহর আদেশের ওপর যে কোনও কথা বলা যাবে না তা আগে ভাগেই অবশ্য বলে রেখেছিলেন। হারেমের এক ডজনেরও বেশি স্ত্রীর সঙ্গে কাটানোর জন্য মোহাম্মদ রাত ভাগ করে নিয়েছিলেন। স্ত্রী হাফসার সঙ্গে যে রাতটি তাঁর কাটাবার কথা, সেদিন তিনি একটি কাণ্ড ঘটিয়েছিলে। সে দিন হাফসা বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগে বাড়ি ফিরে দেখেন শোবার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বন্ধ কেন? ঘরে কে? ঘরে তাঁর পয়গম্বর স্বামী, আল্লাহর পেয়ারা নবী, মোহাম্মদ, মারিয়া নামের এক ক্রীতদাসীর সঙ্গে সম্ভোগে রত। হাফসা রেগে আগুন হয়ে হারেমের বাকি বউদের এ কথা জানিয়ে দিলেন। নিজের দোষ ঢাকতে মোহাম্মদ আকাশ থেকে আল্লাহকে নামালেন, বললেন, এ তাঁর নিজের ইচ্ছেয় ঘটেনি, ঘটেছে আল্লাহর ইচ্ছেয়, আল্লাহর হুকুম তিনি পালন করেছেন, এর বেশি কিছু নয়। বাংলায় একটি কথা আছে, চুরি আবার সিনা জুড়ি। ব্যপারটি এরকমই। দোষ করার পর কোথায় একটু নতমস্তকে দাঁড়িয়ে নম্রস্বরে কথা বলবেন স্ত্রীদের সঙ্গে, তা নয়, বরং উঁচু গলায় সাবধান বাণী দিয়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে, আল্লাহ নাকি তাঁকে বলেছেন, ‘যদি তুমি তোমার কোনও স্ত্রীকে তালাক দাও, তবে আল্লাহ তোমার জন্য আরও সুন্দরী, আরও সহনশীল, আরও পবিত্র, আরও নত, আরও লজ্জাবতী, আরও বিশ্বস্ত কুমারী বা বিধবা মেয়ে দেবেন বিয়ে করার জন্য।’ নিজের ছেলের বউ জয়নবকে বিয়ে করেও মোহাম্মদ তাঁর অপকর্মকে জায়েজ করেছেন আল্লাহর ওহি নাজেল করে, আল্লাহ নাকি তাঁকে বলেছেন তাঁর ছেলের বউকে বিয়ে করার জন্য। মোহাম্মদের অল্পপবয়সী সুন্দরী এবং বিচক্ষণ স্ত্রী আয়শা চমৎকার একটি কথা বলেছিল, বলেছিল, ‘তোমার প্রভুটি তোমার সব শখ মেটাতে দেখি খুব দ্রুত এগিয়ে আসেন।’ এই আয়শার দিকে তাঁর বন্ধুরা তাকাতো বলে হিংসেয় জ্বলে পুড়ে নিজের স্ত্রীদের পর্দার আড়াল করলেন, এরপর ধীরে ধীরে সব মুসলিম মেয়ের শরীরে বাড়তি কাপড় ঝুলিয়ে দেওয়ার আইন করলেন। ইসলাম নাকি মেয়েদের মর্যাদা দিয়েছে খুব। এই হল মর্যাদার নমুনা। আল্লাহর গমগমে আওয়াজ ভেসে আসে সাত আসমানের ওপর থেকে, ‘পুরুষের অধিকার আছে নারীর ওপর আধিপত্য করার, কারণ আল্লাহ পুরুষকে নারীর চেয়ে উন্নততর মানুষ হিসেবে তৈরি করা করেছেন এবং পুরুষ তার ধন সম্পদ ব্যয় করে।’
কী বলবা এই হল আমাদের পয়গম্বর ব্যাটার চরিত্র, আর তার জোব্বার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আল্লাহ নামের ধোঁকা। এই ইসলামকে পৃথিবীর কোটি কোটি বুদ্ধু আজও টিকিয়ে রাখছে, এর পেছনে আর কিছু না, আছে রাজনীতির খেলা।
বাংলাদেশের অবস্থাও তথৈবচ। তরী ডুবছে এরশাদের তাই উপায়ান্তর না দেখে ইসলাম কে আঁকড়ে ধরে তিনি কূলে ভিড়তে চাইছেন।
ঝুলিয়ে দিয়েছে সম্মুখে এক পারলৌকিক মুলো,
ভীতি ও লালসা নাকের ডগায় কেবলি ওড়ায় ধুলো। .
এইবার চোখে পরে নাও কালো অন্ধত্বের ঠুলি,
যে যত অন্ধ তার তত বেশি বিশ্বাসী বলে নাম।
বিশ্বাস কর, তাহলেই হবে, পেয়ে যাবে রোশনাই।
এই বিশ্বাসে চোখ দুটো খুলে ছুঁড়ে দাও ইহকালে,
আর মগজের সচেতন কোষে তালাচাবি এঁটে দাও।
এই তো সাবাস! এখনি তুমি প্রকৃত ঈমানদার।