০৫. পাথরের পিরামিড

৪১ অধ্যায়

রবার্ট ল্যাংডন পাথরের পিরামিডটা পরীক্ষা করে। এটা সম্ভব না।

একটা প্রাচীন সাঙ্কেতিক ভাষা, সাটো তার দিকে না তাকিয়ে বলে। আমাকে খালি বল এটা উতরে যায় কিনা?

পিরামিডের প্রকাশ পাওয়া নতুন পার্শ্বদেশে, মসৃণ পাথরের উপরে ষোলটা চিহ্ন নিখুঁতভাবে খোদাই করা হয়েছে।

The-Lost-Symbol-41

ল্যাংডনের পাশে এণ্ডারসনের চোয়াল ঝুলে পড়েছে, ল্যাংডনের নিজের বেকুব হবার প্রতিলিপি হয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। নিরাপত্তা প্রধানকে দেখে মনে হবে সে এই মাত্র কোন এলিয়েন কিপ্যাড দেখেছে।

প্রফেসর? সাটো বলে। আমার মনে হয় তুমি এটা পড়তে জান।

ল্যাংডন ঘুরে তাকায়। এমন মনে হবার কারণ?।

কারণ তোমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে, প্রফেসর। তুমি নির্বাচিত। এই শিলালিপি দেখে মনে হচ্ছে কোন এক ধরণের সঙ্কেতলিপি এবং তোমার খ্যাতির কথা মাথায় রেখে, এটা আমার কাছে পরিষ্কার যে তোমাকে এখানে আনাই হয়েছে মর্মোদ্ধার করতে।

ল্যাংডনকে স্বীকার করতেই হবে প্যারিস আর রোমের অভিজ্ঞতার পরে ইতিহাসের অনেক অমীমাংসিত সঙ্কেত-দি ফাঁইসটোস ডিস্ক, দি ডোরাবেলা সাইফার, রহস্যময় দি ভয়নিক পাণ্ডুলিপি, মর্মোদ্ধারে তার সাহায্য চেয়ে প্রচুর অনুরোধ সে পেতে শুরু করেছে।

শিলালিপির উপরে সাটো হাত বুলায়। তুমি আমাকে এসব প্রতিমার অর্থ বলতে পারবে?

এগুলো কোন প্রতিমা নয়, ল্যাংডন ভাবে। এগুলো সব প্রতীক। ভাষাটা সে দেখা মাত্রই চিনতে পেরেছে-সপ্তদশ শতকে ব্যবহৃত একটা গুপ্তলিখন পদ্ধতি। ল্যাংডন খুব ভালো করেই এটা পাঠোদ্ধার করতে জানে।

ম্যাম, ইতস্তত করে সে বলে। এই পিরামিডটা পিটারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি।

ব্যক্তিগত হোক আর যাই হোক, এই সংকেতের কারনেই যদি তোমাকে ওয়াশিংটনে নিয়ে আসা হয়ে থাকে, আমি তবে তোমাকে এ বিষয়ে কোন ছাড় দিতে রাজি নই। আমি জানতে চাই এতে কি বলা হয়েছে।

সাটোর ব্ল্যাকবেরী আবার আওয়াজ করে উঠলে সে পকেট থেকে থাবা দিয়ে সেটা বের করে, কয়েক মুহূর্ত ইনকামিং মেসেজটা মনোযোগ দিয়ে দেখে। ল্যাংডন অবাক হয়ে দেখে ক্যাপিটলের আভ্যন্তরীণ ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক মাটির এত নীচেও সার্ভিস পৌঁছে দিতে সক্ষম।

সাটো গুঙিয়ে উঠে, চোখের ভ্রু কুচকায় এবং কড়া চোখে ল্যাংডনের দিকে তাকায়।

চীফ এনডারসন? তার দিকে ঘুরতে ঘুরতে সে বলে। আমি আপনার সাথে একান্তে একটু কথা বলতে চাই? ডিরেকটর এনডারসনকে তার সাথে আসতে ইঙ্গিত করে এবং তারা বাইরের গাঢ় অন্ধকার হলওয়েতে যায়, ল্যাংডন পিটারের চেম্বার অব রিফ্লেকশনে নিভু নিভু মোমবাতির আলোয় একলা দাঁড়িয়ে থাকে।

.

চীফ এনডারসন কেবল ভাবতে চেষ্টা করেন আজকের এই রাতটা কি শেষ হবে না? রোটানায় প্রথমে কাটা একটা কব্জি পাওয়া গেল? আমার বেসমেন্টে দেখলাম একটা মৃতের মন্দির রয়েছে? পাথরের পিরামিডের গায়ে উদ্ভট শিলালিপি? কোনভাবে, অবশ্য এখন আর রেডস্কিনের খেলাটাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না।

সাটোকে হলওয়ের অন্ধকারে অনুসরণ করার সময়ে, এনডারসন তার ফ্ল্যাশ লাইট অন করে। মৃদু আলো কিন্তু কিছু না থাকার চেয়ে অন্তত ভাল। সাটো তাকে নিয়ে অন্ধকার হলওয়েতে কিছু দূর এগিয়ে যায়, যাতে ল্যাংডন দেখতে না পায়।

এটা একবার দেখো? সে ফিসফিস করে কথাটা বলে এণ্ডারসনের হাতে ব্ল্যাকবেরীটা ধরিয়ে দেয়।

এনডারসন ডিভাইসটা নিয়ে চোখ কুচকে এর আলোকিত স্ক্রিনের দিকে তাকায়। সেখানে একটা সাদাকালো ছবি-ল্যাংডনের ব্যাগের এক্সরে যেটা সে সাটোর ডিভাইসে পাঠাতে বলেছিল। সব এক্সরের মতই এতেও বেশি ঘনত্বযুক্ত বস্তু সাদা দেখাচ্ছে। ল্যাংডনের ব্যাগে একটা বস্তু সবকিছুকে ম্লান করে দিয়েছে। নিশ্চিতভাবে অসম্ভব কঠিন, অন্যসব অনুষঙ্গের ভিতরে সেটা একটা রত্বের ন্যায় চিকচিক করছে। আঁকৃতি দেখে ভুল হবার কোন কারণ নেই।

ব্যাটা পুরো সন্ধ্যা জিনিসটা ব্যাগে নিয়ে তাদের সাথে ঘুরছে? এনডারসন বিস্মিত দৃষ্টিতে সাটোর দিকে তাকায়। ল্যাংডন এর কথা কেন উল্লেখ করেনি?

ভাল প্রশ্ন? সাটো আস্তে করে বলে।

আকৃতি… ব্যাপারটা কাকতালীয় হতে পারে না?

না, সাটোর কণ্ঠে উম্মা প্রকাশ পায়। আমি সেটা বলবো না।

করিডোরে একটা মৃদু নড়াচড়ার শব্দ এণ্ডারসনের মনোযোগ আকর্ষণ করে। চমকে উঠে, সে অন্ধকার প্যাসেজের দিকে আলোটা ঘুরায়। আলোতে সারি সারি খোলা দরজা আর ফাঁকা করিডোর দেখা যায়।

হ্যালো? এনডারসন চিৎকার করে। ওখানে কি কেউ আছেন?

নিরবতা।

সাটো অবাক চোখে তাকায়, বোঝা যায় সে কোন শব্দ শোনেনি।

এনডারসন আরেকটুক্ষণ চুপ করে কিছু শোনা যায় কিনা দেখে এবং তারপরে প্রসঙ্গটা বাদ দেয়। আমাকে দ্রুত এখান থেকে বের হতে হবে।

.

মোমের আলোয় একাকী সেই চেম্বারে পিরামিডের খোদাইয়ের উপরে ভাল করে হাত বুলায়। এখানে কি বলা হয়েছে সে জানতে আগ্রহী, কিন্তু একই সাথে সে পিটার সলোমনের বিনিক্ততায় আজ রাতে তারা যেভাবে হামলা করেছে সে। রকম কিছু করতে রাজি না। আর এই হদ্দ পাগলা এই ক্ষুদে বস্তুটার প্রতি এত আগ্রহী কেন?

প্রফেসর আমরা একটা সমস্যায় পড়েছি, তার পেছন থেকে সাটো জোরালো কণ্ঠে বলে। আমি এইমাত্র একটা নতুন তথ্য পেয়েছি আর অনেক হয়েছে তোমার মিথ্যা কথা।

ল্যাংডন ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে ওএস ডিরেকটর হাতে ব্ল্যাকবেরী নিয়ে দুমদাম করে ভিতরে প্রবেশ করছে তার চোখে স্পষ্ট ফুটে আছে ক্রোধ। অবাক হয়ে, ল্যাংডন এণ্ডারসনের দিকে সাহায্যের আশায় তাকিয়ে দেখে চীফ এখন দরজা পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাটো ল্যাংডনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাকবেরীটা তার মুখের সামনে ধরে।

বিহ্বল হয়ে ল্যাংডন স্ক্রিনের দিকে তাকায়, যেখানে একটা সাদা কালো বস্তু উল্টো হয়ে ফুটে আছে, ভৌতিক ফিল্ম নেগেটিভের ন্যায়। ছবিটায় অনেক বস্তু একটা জটলা এবং তাদের ভিতরে একটা বস্তু খুব বেশী চমকাচ্ছে। যদিও বেকে আছে এবং কেন্দ্র থেকে দূরে, ছোট বস্তুটা স্পষ্টতই একটা ছোট চূড়াবিশিষ্ট পিরামিড।

একটা ক্ষুদে পিরামিড ল্যাংডন সাটোর দিকে তাকায়। এটা কি?

প্রশ্নটা শুনে সাটো যেন ক্রোধে পাগল হয়ে যায়। তুমি এমনভাব করছো যে তুমি কিছুই জানো না, না?

ল্যাংডন এবার ফুঁসে উঠে। আমি কোন ভণিতা করছি না! আমি আমার জীবনে এটা দেখিনি!

যত্তসব! সাটো ধমকে উঠে, বাসি গন্ধযুক্ত বাতাস চিরে দেয় তার কণ্ঠস্বর। আজ পুরোটা সময় তুমি এটা তোমার ব্যাগে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে!

আমি বাক্যের মাঝে ল্যাংডন থেকে যায়। তার চোখ ধীরে ধীরে নিজের কাঁধের ডেব্যাগের দিকে নিবদ্ধ হয়। তারপরে সে আবার ব্ল্যাকবেরীর দিকে। তাকায়। আরো খোদা…প্যাকেটটা। সে এবার ভাল করে ইমেজটা দেখে। এবার সে বিষয়টা বুঝতে পারে। একটা ভৌতিক বাক্স, ভেতরে পিরামিড। চমকে উঠে, ল্যাংডন বুঝতে পারে সে তার ব্যাগের এক্সরের দিকে তাকিয়ে আছে…আর সেই সাথে পিটারের রহস্যময় বাক্স আঁকৃতির প্যাকেজের দিকে। বাক্সটা আসলে, একটা খালি কৌটা…ভেতরে একটা ক্ষুদে পিরামিড রয়েছে।

ল্যাংডন কথা বলার জন্য মুখ খুলতে যায়, কিন্তু বলার মত কিছু খুঁজে পায়। নতুন তথ্য তার ফুসফুস থেকে সব বাতাস যেন বের করে দিয়েছে।

সাধারন। খাঁটি। বিধ্বংসী।

খোদা। ডেস্কের উপরে রাখা অবিচছন্ন পিরামিডের দিকে সে তাকায়। এর অগ্রভাগ সমতল-একটা ছোট বর্গাকার এলাকা-একটা খালি জায়গা প্রতীকিভাবে। শেষ টুকরোর জন্য প্রতিক্ষা করছে…যে টুকরোটা একে অসমাপ্ত থেকে সম্পূর্ণ পিরামিডে রূপান্তরিত করবে।

ল্যাংডন এবার বুঝতে পারে সে ব্যাগে যে ক্ষুদে পিরামিডটা বহন করছে। সেটা আদতে কোন পিরামিডই না। জিনিসটা একটা ক্যাপস্টোন। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে, সে বুঝতে পারে কেন কেবল তারপক্ষেই এই পিরামিডের রহস্য ভেদ করা সম্ভব।

আমার কাছেই রয়েছে শেষ টুকরোটা।

আর জিনিসটা আসলেই…একটা টালিসমান।

পিটার যখন ল্যাংডনকে বলেছিল যে প্যাকেটটার ভিতরে একটা টালিসমান রয়েছে, ল্যাংডন হেসেছিল। এখন সে বুঝতে পারে তার বন্ধু সত্যি কথাই বলেছিল। এই ক্ষুদে ক্যাপস্টোনটা একটা টালিসমান, কিন্তু জাদুকরী প্রকৃতির না…আরো অনেক প্রাচীন প্রকৃতির। টালিসমান জাদুকরী অর্থ পরিগ্রহণের আগে, এর অর্থ প্রচলিত ছিল-সমাপ্তি। গ্রীক শব্দ টেলেসমা থেকে গৃহীত, মানে সমাপ্ত, টালিসমান কোন বস্তু বা ধারণা হতে পারে যা অন্য কিছুকে সমাপ্ত বা পরিপূর্ণ করে। সমাপ্তিকারী উপাদান। ক্যাপস্টোন, প্রতীকিভাবে বলতে গেলে, চূড়ান্ত টালিসমান, অসমাপ্ত পিরামিডকে সমাপ্তির সম্পূর্ণতার প্রতাঁকে পরিণত করে।

একটা আতঙ্কিত বোধ ল্যাংডনকে অভিভূত করে ফেলে যা তাকে একটা অদ্ভুত সত্য বিশ্বাস করতে বাধ্য করে: আঁকৃতি যাই হোক, পিটারের চেম্বার অব রিফ্লেকশনে প্রাপ্ত পাথরের পিরামিড নিজেকে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত করছে ম্যাসনিক পিরামিডের সাথে যার একটা অস্পষ্ট সাদৃশ্য আছে।

এক্স-রে ইমেজে ক্যাপস্টোনটা যেভাবে চমকাচ্ছে ল্যাংডন সন্দেহ করে জিনিসটা সম্ভবত ধাতুর তৈরী…খুব ভারী ধাতু। খাঁটি সোনার তৈরী কিনা, তার জানার কোন উপায় নেই এবং সে চায় না তার মন তাকে উল্টোপাল্টা কিছু করতে প্ররোচিত করুক। এই পিরামিডটা বড় ছোট। সংকেতটাও বড় বেশি সরল। এবং,, এটা একটা মিথ, সবচেয়ে বড় কথা।

সাটো কড়া চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রফেসর, আপনার মত একজন বুদ্ধিমান মানুষ আজ রাতে অনেকগুলো ভুল করেছেন। ইন্টিলিজেন্স কর্মকর্তার কাছে মিথ্যা কথা বলেছেন? ইচ্ছাকৃতভাবে সিআইএর অনুসন্ধানে বিঘ্ন ঘটাতে চেয়েছেন?

আমাকে সুযোগ দিলে আমি সব কটা অভিযোগই ব্যাখ্যা করতে পারি।

সিআইএ সদরদপ্তরে গিয়ে আপনি সেটা করার সুযোগ পাবেন। কারণ এই মুহূর্তে আমি আপনাকে গ্রেফতার করছি।

ল্যাংডনের পুরো শরীর আড়ষ্ট হয়ে যায়। আপনি নিশ্চয়ই সিরিয়াসলি কথাটা বলেননি।

ডেডলি সিরিয়াস। আমি আপনাকে শুরুতেই বলেছিলাম যে আজ রাতে অনেক কিছু বিপন্ন হয়ে পড়েছে, এবং আপনি ইচ্ছা করেই সহযোগিতা করা থেকে বিরত ছিলেন। আমি আপনাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি পিরামিডে উকীর্ণ লিপি ব্যাখ্যা করবেন কিভাবে সেটা ভাবতে শুরু করেন কারণ আমরা যখন সিআইএ সদরদপ্তরে পৌঁছাব…সে তার ব্ল্যাকবেরীতে এবার পিরামিডে উত্তীর্ণ লিপির একটা ছবি তুলে। আমার বিশ্লেষকের দল একটু এগিয়ে থাকবে।

ল্যাংডন প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে কিন্তু সাটো ততক্ষণে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা এণ্ডারসনের দিকে ঘুরতে আরম্ভ করেছে। চীফ, সে বলে, পাথরের পিরামিডটা ল্যাংডনের ব্যাগে রেখে সেটা নিজের কাছেই রাখ। ল্যাংডনকে আমি আমার জিম্মায় রাখছি। তোমার অস্ত্রটা, আমাকে দেবে?

চেম্বারে প্রবেশ করার সময়ে এণ্ডারসনের মুখটা পাথরে খোদাই করা বলে মনে হয়, হাটার ভিতরেই সে হোলস্টারের ঢাকনা খোলে। পিস্তলটা সাটোর হাতে দিলে সে সেটা সাথে সাথে ল্যাংডনের দিকে তাক করে।

ল্যাংডনকে দেখে মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছে। এসব সত্যি সত্যি হচ্ছে না।

এনডারসন ল্যাংডনের কাছে এসে তার কাঁধ থেকে ডেব্যাগটা নিয়ে ডেস্কের কাছে যায় এবং চেয়ারের উপরে সেটা রাখে। সে ব্যাগের চেন খুলে এবং ভারী পাথরের পিরামিডটা ডেস্ক থেকে তুলে সেটা ব্যাগে ল্যাংডনের নোট আর ক্ষুদে প্যাকেটটার সাথে একসঙ্গে রাখে।

সহসা প্যাসেজ থেকে একটা খসখস শব্দ ভেসে আসে। দরজার কাছে ফুটে উঠা একটা লোকের এবং, চেম্বারের ভিতরে দৌড়ে প্রবেশ করে এবং এণ্ডারসনের দিকে দ্রুত পেছন থেকে এগিয়ে আসে। চীফ তাকে আসতেই দেখেনি। নিমেষের ভিতরে আগন্তুক কাঁধ নীচু করে এণ্ডারসনের পিঠে একটা রামধাক্কা দেয়। এনভারসন উড়ে গিয়ে সামনে পাথরের কুলুঙ্গির কোণায় মাথা দিয়ে আঘাত করে। হাড় আর টেবিলের অন্যসব জিনিস ছিটকে দিয়ে সে ডেস্কের উপরে দড়াম করে আছড়ে পড়ে। বালিঘড়ি মেঝেতে পড়ে ভেঙে বালি ছিটিয়ে যায়। মোমবাতি মেঝেতে ছিটকে যায় পড়ে না নিভে জ্বলতে থাকে।

বিশৃঙ্খলার ভিতরে সাটো পিস্তল উচিয়ে টলমল করতে থাকে, কিন্তু আগন্তুক একটা হাড় তুলে নিয়ে সেটাকে লাঠিরমত ব্যবহার করে, পায়ের হাড়ের ফিমার দিয়ে তার কাঁধে আধমনী এক ঘা বসিয়ে দেয়। সাটো ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠে এবং পিছিয়ে যায়, পিস্তল হাত থেকে পড়ে গেছে। ঝড়ের মত উদয় হওয়া লোকটা লম্বা আর সুঠামদেহী, সৌম্য চেহারার একজন আফ্রিকান আমেরিকান যাকে ল্যাংডন জীবনেও আগে কখনও দেখেনি।

পিরামিডটা ধর! লোকটা হুকুমের সুরে বলে। আমাকে অনুসরণ কর!

.

৪২ অধ্যায়

আফ্রিকান আমেরিকান যে লোকটা ল্যাংডনকে ক্যাপিটলের ভূ-গর্ভস্থ গোলকধাঁধাঁর মাঝে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে স্পষ্টতই বোঝা যায় ক্ষমতাবানদের একজন। প্রতিটা বিকল্প করিডোর আর পেছনের কক্ষ ভাল করে চেনার চেয়েও, সৌম্য দর্শন আগুন্তকের হাতে একটা চাবির গোছা রয়েছে তাদের চলার পথে যে দরজাই সামনে পড়ক প্রতিটার জন্য চাবি যেন সেখানে মজুদ আছে।

ল্যাংডন অনুসরণ করে, দ্রুত একটা অপরিচিত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে। আসে। তারা যখন উপরে উঠছে, সে বুঝতে পারে চামড়ার ডেব্যাগের ফিতে তার কাঁধে চেপে বসছে। পাথরের পিরামিডটা এত ভারী যে তার ভয় হয়। ব্যাগের স্ট্র্যাপ বোধহয় হিল্লে ছেড়ে দেবে।

গত কয়েক মিনিটের ঘটনা সব যুক্তিবোধ গুলিয়ে দেবার মত, এবং ল্যাংডন এখন কেবল প্রবৃত্তির উপরে নির্ভর করে এগিয়ে চলেছে। তার সহজাত প্রবৃত্তি তাকে বলে আগুন্তককে বিশ্বাস করতে। সাটোর গ্রেফতার থেকে তাকে বাঁচান ছাড়াও, পিটার সলোমনের পিরামিড রক্ষা করতে সে বিপজ্জনক পদক্ষেপ নিয়েছে। পিরামিডটা যাই হোক। তার প্রণোদনা রহস্যময় হলেও ল্যাংডন লোকটার হাতে একটা সোনার আংটি দেখেছে যা থেকে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে- একটা ম্যাসনিক আংটি- দুই মাথা বিশিষ্ট ফিনিক্স যার বুকে ৩৩ খোদাই করা। এই লোকটা আর পিটার সলোমন বিশ্বস্ত বন্ধুর চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল। তারা ছিল সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী ম্যাসনিক ভাই।

ল্যাংডন তাকে অনুসরণ করে সিঁড়ির মাথায় আরেকটা করিডোরে উঠে আসে এবং তারপরে একটা স্মারকহীন দরজা দিয়ে ভৃত্যদের চলাচলের করিডোরে পৌঁছায়। তারা স্তূপকরে রাখা সাপ্লাইয়ের বাক্স এবং ময়লাভর্তি ব্যাগের ভিতর দিয়ে এগিয়ে সহসা একটা সার্ভিস দরজা ঠেলে একদমই অপ্রত্যাশিত একটা জায়গায় নিজেদের আবিষ্কার করে বিলাসবহুল প্রেক্ষাগৃহই হবে জায়গাটা। পাশের সংকীর্ণ পথ দিয়ে বয়স্ক লোকটা উপরে উঠে যায় এবং প্রধান দরজা ঠেলে বিশাল একটা আলোকিত এট্রিয়ামে বেরিয়ে আসে। ল্যাংডন এখন বুঝতে পারে তার দর্শনার্থীদের এলাকায় এসে পড়েছে যেখান দিয়ে আজ রাতেই সে ভিতরে প্রবেশ করেছিল।

দুর্ভাগ্যবশত, এক ক্যাপিটল পুলিশ কর্মকর্তাও সে মুহূর্তে সেখানে প্রবেশ করে।

তারা অফিসারের মুখোমুখি হতে, তিনজনই থমকে থেকে পরস্পরের দিকে তাকায়। ল্যাংডন লোকটাকে চিনতে পারে আজ রাতে ভেতরে প্রবেশের সময়ে। এই তরুণ স্প্যানিশ বংশোদ্ভুত অফিসারটাই এক্স-রে মেশিনের কাছে ছিল।

অফিসার ন্যুনেজজ, আফ্রিকান আমেরিকান লোকটা আদেশের কণ্ঠে বলেন। কোন কথা না। আমাকে অনুসরণ কর।

অফিসারকে স্পষ্টতই অস্বস্তিতে পড়তে দেখা যায় কিন্তু প্রশ্ন না করে সে কথামত কাজ করে।

এই লোকটা কে?

দর্শনার্থী কেন্দ্রের দক্ষিণপূর্ব দিকে তিনজন দ্রুত এগিয়ে যায়, সেখানে তারা একটা ছোট ফয়ার এবং কমলা রঙের পাইলন দিয়ে আটকান একজোড়া ভারী দরজার কাছে পৌঁছে। দরজাগুলো মাস্কিং টেপ দিয়ে সিল করা স্পষ্টতই ওপাশের ধূলো যাতে দর্শনার্থী কেন্দ্রে পৌঁছাতে না পারে সেজন্যই এই বন্দোবস্ত। বয়স্ক লোকটা সামনে এগিয়ে যায় এবং দরজায় লাগান টেপ খুলতে থাকে। তারপরে সে তার চাবির গোছা থেকে চাবি বাছার অবসরে গার্ডের সাথে কথা বলে। আমাদের বন্ধু চীফ এনডারসন সাববেসমেন্টে রয়েছেন। তিনি সম্ভবত আহত। তাকে দেখতে তুমি সেখানে যাবে।

হ্যাঁ, স্যার। ন্যুনেজজকে বিভ্রান্ত আর একই সাথে আতঙ্কিতও দেখায়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের তুমি দেখোনি। লোকটা কাঙ্খিত চাবিটা খুঁজে পেতে সেটা গোছা থেকে বের করে আনে এবং ভারী দরজার ডেডবোল্ট খুলতে সেটা ব্যবহার করে। ইস্পাতের দরজাটা টেনে খুলে সে চাবিটা ন্যুনেজজের দিকে ছুঁড়ে দেয়। আমাদের পেছনের দরজাটা বন্ধ করে দাও। যতটা সম্ভব টেপ লাগিয়ে দিতে ভুলো না। চাবিটা পকেটে রেখে সবকিছু ভুলে যাবে। কারো সাথে এবিষয়ে কোন আলাপ করবে না। চীফের সাথেও না। অফিসার ন্যুনেজজ আমার কথা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছো?

ন্যুনেজজ চাবিটার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন এইমাত্র কোহিনূর তার কাছে জিম্মা দেয়া হয়েছে। স্যার, এইই।

বয়স্ক লোকটা কোন কথা না বলে দরজা দিয়ে বের হতে ল্যাংডন তাকে অনুসরন করে। ন্যুনেজজ ভারী দরজাটা তাদের পেছনে বন্ধ করে দেয় এবং ল্যাংডন শব্দ শুনে বোঝে মাস্কিং টেপও সে পুনরায় লাগিয়ে দিচ্ছে।

প্রফেসর ল্যাংডন, একটা আধুনিক দর্শন করিডোরের যা নিশ্চিতভাবে নির্মাণাধীন, ভিতর দিয়ে দ্রুত হাঁটার সময়ে লোকটা বলে। আমার নাম ওয়ারেন। বেল্লামি। পিটার সলোমন আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

ল্যাংডন চমকে উঠে সৌম্যদর্শন লোকটার দিকে তাকায়। আপনিই ওয়ারেন বেল্লামি? ক্যাপিটলের স্থপতির সাথে ল্যাংডনের আগে কখনও পরিচয় হয়নি, কিন্তু সে তার নাম শুনেছে।

আপনার প্রশংসা পিটারের কাছে অনেক শুনেছি, বেল্লামি বলেন, এবং এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মাঝে আমাদের পরিচয় হল বলে আমি দুঃখিত।

পিটার ভয়াবহ বিপদে পড়েছে। তার হাত…

আমি জানি, বেল্লামির কণ্ঠে বেদনার রঙ। আমার ভয়, এর অর্ধেকও সেটা না।

আলোকিত করিডোরের শেষ সীমায় তারা পৌঁছে এবং সেখানে প্যাসেজটা হঠাৎ বামে বাঁক নিয়েছে। করিডোরের বাকী অংশটুকু…

সেটা যেখানেই যাক, গাঢ় অন্ধকার।

অপেক্ষা কর, বেল্লামি বলেন, এবং পাশের একটা ইলেকট্রিকাল রুমে প্রবেশ করেন যেখান থেকে কমলা রঙের হেভীডিউটি এক্সটেনশন কর্ড বের হয়ে এসে করিডোরের অন্ধকারের ভিতরে হারিয়ে গেছে। বেল্লামি ভিতরে খুটখাট করার সময়ে ল্যাংডন বাইরে অপেক্ষা করে। স্থপতি নিশ্চয়ই এক্সটেনশন কর্ডে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের সুইচ খুঁজে পেয়েছেন কারণ সহসা তাদের সামনের পথ আলোকিত হয়ে উঠে।

ল্যাংডন বেকুবের মত তাকিয়ে থাকে।

ওয়াশিংটন ডি.সি- রোমের মত- ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ আর গোপন গলিপথে আঁকীর্ণ একটা শহর। তাদের সামনের প্যাসেজটা ভ্যাটিকানকে সান্টএ্যাঞ্জেলো দূর্গের সাথে সংযোগকারী প্যাসেট্টোর কথা মনে করিয়ে দেয়। লম্বা। অন্ধকার। সংকীর্ণ। প্রাচীন প্যাসেট্টোর মত অবশ্য না, এটা আধুনিক আর নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। এটা একটা অপ্রতুল নির্মাণ স্থান যা এতটাই লম্বা দূরবর্তী প্রান্ত মনে হয় সংকীর্ণ হতে হতে মিলিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে নির্মাণ কাজে সহায়তার জন্য স্থাপিত বাই একমাত্র আলোর উৎস যা কেবল সুড়ঙ্গের অসম্ভব বিস্তারের আভাস দিচ্ছে।

বেল্লামি প্যাসেজ ধরে হাঁটতে আরম্ভ করে। আমাকে অনুসরণ কর। দেখে হাটো।

সুড়ঙ্গটা কোথায় শেষ হয়েছে ভাবতে ভাবতে ল্যাংডন বেল্লামিকে অনুসরণ করতে শুরু করে।

.

সেই মুহূর্তে, মাল’আখও পড় তিন থেকে বের হয়ে আসে এবং এসএমএসসির নির্জন প্রধান করিডোর দিয়ে দ্রুত পড পাঁচের দিকে হাঁটতে থাকে। ত্রিশের কিকার্ড আঁকড়ে ধরে সে মৃদু কণ্ঠে বলতে থাকে, শূন্য-আট শূন্য-চার।

তার মনে অন্য একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। মাল’আখ এই মাত্র ক্যাপিটল ভবন থেকে একটা জরুরী ম্যাসেজ পেয়েছে। আমার কনট্যাক্ট অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। তারপরেও অবশ্য, সবকিছু এখনও আশাব্যঞ্জক: রবার্ট ল্যাংডনের কাছে এখন পিরামিড আর ক্যাডস্টোন দুটোই রয়েছে। অপ্রত্যাশিত উপায়ে সেটা সম্ভব হলেও, গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ঠিকমতই আপতিত হয়েছে। আজরাতের ঘটনাসমূহ যেন নিয়তি নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ করছে, মাল’আখের বিজয় নিশ্চিত করতে।

.

৪৩ অধ্যায়

দীর্ঘ সুড়ঙ্গে কোন কথা না বলে হাঁটবার সময়ে বেল্লামির দ্রুত পদক্ষেপের সাথে তাল রাখতে ল্যাংডনকে প্রায় দৌড়াতে হয়। এখন পর্যন্ত, ক্যাপিটলের স্থপতি সাটো আর পাথরের পিরামিডের মাঝে দূরত্ব তৈরীকেই বেশি গুরুত্ব দেখিয়েছেন। কি ঘটছে সেটা ল্যাংডনকে ব্যাখ্যা করার বদলে। ল্যাংডনের কেবলই মনে হচ্ছে। তার কল্পনার চেয়েও বেশি কিছু ঘটছে আজ রাতে।

দি সিআইএ ক্যাপিটলের স্থপতি? দুইজন তেত্রিস ডিগ্রীধারী ম্যাসন?

ল্যাংডনের ফোনের আওয়াজে চিন্তার রেশ কেটে যায়। জ্যাকেটের পকেট থেকে সে ফোনটা বের করে। বুঝতে পারে না ধরাটা ঠিক হবে কিনা। হ্যালো?

অপরপাশ থেকে রহস্যময় পরিচিত ফিসফিস কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। প্রফেসর, আমি শুনেছি অপ্রত্যাশিত সঙ্গ আপনি লাভ করেছেন।

বরফের মত শীতল একটা শিহরন ল্যাংডনকে কাঁপিয়ে দেয়। পিটার কোথায় কেমন আছে বলো?? সে জানতে চায়, তার কণ্ঠস্বর বন্ধ সুড়ঙ্গে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়। পাশে হাঁটতে থাকা ওয়ারেন বেল্লামি আড়চোখে তাকায়, তাকে উদ্বিগ্ন দেখায় এবং ইঙ্গিতে ল্যাংডনকে হাটা অব্যাহত রাখতে বলেন।

দুশ্চিন্তা কোরোনা, কণ্ঠস্বরটা বলে। আমি তোমাকে যা বলেছি, পিটার নিরাপদেই কোথাও আছে।

ঈশ্বরের দিব্যি, তুমি তার হাত কব্জি থেকে কেটে নিয়েছো! তাকে ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন!

তার দরকার একজন পাদ্রী, লোকটা উত্তর দেয়। কিন্তু তুমি তাকে বাঁচাতে পার। আমার আদেশ মত কাজ করলে পিটার প্রাণে বেঁচে যাবে। আমি তোমাকে কথা দিলাম।

পাগলের প্রতিশ্রুতির কোন দাম নেই আমার কাছে।

পাগল? প্রফেসর, আজ রাতে আমি যে শ্রদ্ধার সাথে প্রাচীন আঁচার পালনে অনুগত থেকেছি নিশ্চয়ই তুমি সেটার প্রশংসা করবে। রহস্যময়তার হাত তোমাকে একটা সিংহদ্বারে-পিরামিড়টার কাছে যা প্রাচীন জ্ঞান উন্মোচনে। প্রতিশ্রুত, পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে। আমি জানি সেটা এখন তোমার কাছেই আছে।

তোমার ধারণা এটাই সেই ম্যাসনিক পিরামিড? ল্যাংডন জানতে চায়। এটা একটা ভারী পাথরের টুকরো।

লাইনের অপরপ্রান্ত অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। মিল্যাংডন আপনি অভিনয়ে একেবারেই কাঁচা। আপনি ভাল করেই জানেন আজ রাতে আপনি কি খুঁজে পেয়েছেন। একটা পাথরের পিরামিড. …..একজন ক্ষমতাবান ম্যাসনের দ্বারা…ওয়াশিংটন ডি.সির অভ্যন্তরে প্রোথিত?

তুমি একটা কিংবদন্তির পেছনে ধাওয়া করছো! পিটার তোমাকে যাই বলে থাকুক সেটা সে ভয়ে বলেছে। ম্যাসনিক পিরামিডের কিংবদন্তি একটা ফিকশন। প্রাচীন জ্ঞান রক্ষা করতে ম্যাসনরা কখনও কোন পিরামিড নির্মাণ করেনি। এবং তুমি যা মনে করছো এটাকে, তারা যদি পিরামিড নির্মাণ করেও থাকে তবে সেটা ধারণের পক্ষে এই পিরামিডটা বড্ড ছোট।

লোকটা খিকখিক করে হাসে। বুঝেছি পিটার তোমাকে আসলে কিছুই বলেনি। যাই হোক, মি. ল্যাংডন আপনার কাছে যেটা রয়েছে আপনি সেটাতে বিশ্বাস করেন বা না করেন, আমার কথামত আপনি কাজ করবেন। আমি খুব ভাল করেই জানি যে পিরামিডটা আপনি কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন সেটাতে একটা সাঙ্কেতিক শিলালিপি রয়েছে। আমার জন্য আপনি সেটার পাঠোদ্ধার করবেন। তারপরে এবং তারপরেই কেবল, আমি পিটার সলোমনকে আপনার কাছে ফেরত দেবো।

এই শিলালিপি যা প্রকাশ করবে বলে আপনি বিশ্বাস করেন, ল্যাংডন বলে, সেটা কখনও প্রাচীন জ্ঞান হতে পারে না।

অবশ্যই না, সে উত্তর দেয়। একটা ছোট পিরামিডের পাশে লেখার পক্ষে রহস্যের বিস্তার অনেক ব্যাপক।

অপর প্রান্তের উত্তর শুনে ল্যাংডন বেকুব বনে যায়। কিন্তু এই শিলালিপি যদি প্রাচীন রহস্য না হয়ে থাকে তাহলে এই পিরামিডটা ম্যাসনিক পিরামিড না। কিংবদন্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে প্রাচীন রহস্য সুরক্ষিত রাখার জন্যই ম্যাসনিক পিরামিড নির্মিত হয়েছিল।

লোকটার কণ্ঠস্বরে এখন প্রসন্নতার ছোঁয়া। মি. ল্যাংডন ম্যাসনিক পিরামিড প্রাচীন জ্ঞান সংরক্ষণার্থে নির্মিত হয়নি কিন্তু একটা মারপ্যাঁচ থাকায় আপনি এখনও বোধহয় সেটা বুঝতে পারেননি। পিটার কি কখনও আপনাকে বলেনি? রহস্যময়তা প্রকাশের ক্ষমতা ম্যাসনিক পিরামিডের নেই…কিন্তু যেখানে এই রহস্য চাপা আছে বরং সেখানকার গোপন অবস্থান প্রকাশই এর আসল ক্ষমতা।

ল্যাংডন বিস্মিত দৃষ্টিতে হাতের ফোনের দিকে তাকায়।

শিলালিপির পাঠোদ্ধার কর, কণ্ঠস্বর বলে চলে, এবং সেটা তোমাকে বলে দেবে মানবজাতির সবচেয়ে মূল্যবান গুপ্তধন কোথায় লুকান রয়েছে। সে হাসে। প্রফেসর, পিটার গুপ্তধনের জিম্মা তোমাকে দেয়নি।

সুড়ঙ্গের ভিতরেই ল্যাংডন বেমক্কা দাঁড়িয়ে পড়ে। দাঁড়াও। তুমি বলতে চাইছো এই পিরামিডটা…একটা ম্যাপ?

বেল্লামিও এখন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে, তার চেহারায় যুগপৎ আশঙ্কা আর উদ্বেগ ফুটে উঠে। পরিষ্কার বোঝা যায়, ফোনের কণ্ঠস্বর এইমাত্র এক ঝটকায় অস্পষ্টতার ঘোর ভেঙে দিয়েছে। পিরামিডটা একটা মানচিত্র।

এই মানচিত্র, কণ্ঠস্বরটা ফিসফিস করে বলে, বা পিরামিড, বা সিংহদ্বার, বা অন্য যে নামেই একে অভিহিত কর…অনেক আগে তৈরী করা হয়েছিল যাতে প্রাচীন রহস্য গোপন রাখার স্থান মানুষ বিস্মৃত না হয়, যাতে এটা কখনও হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের ভাগ্য বরণ না করে।

যোলটা প্রতাঁকের একটা গ্রীডের সাথে মানচিত্রের খুব একটা মিল নেই।

অভিব্যক্তি ছলনাময় হতে পারে, প্রফেসর। কিন্তু সে যাই হোক, কেবল তোমারই ক্ষমতা আছে এই শিলালিপির পাঠোদ্ধার করার।

তুমি ভুল ভেবেছো, মনে মনে সাধারন গুপ্তলিখন প্রণালীর কথা চিন্তা করে, ল্যাংডন চেঁচিয়ে উঠে। যেকেউ এই শিলালিপির পাঠোদ্ধার করতে পারবে। খুব একটা পরিশীলিত লেখা না।

আমার সন্দেহ খালি চোখে যা দৃশ্যমান তার চেয়েও বেশি কিছু পিরামিডটায় আছে। যাই হোক, ক্যাপস্টোনটা কেবল তোমার কাছেই আছে।

ল্যাংডন তার ব্যাগে থাকা ক্যাপস্টোনটার কথা মনে মনে ভাবে। বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলায়? কি বিশ্বাস করা উচিত সেই বোধটাই তার গুলিয়ে গেছে, কিন্তু তার ব্যাগে রাখা পাথরের পিরামিডটার ওজন যেন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে।

.

মাল’আখ সেলফোনটা কানে চেপে ধরে অপরপ্রান্তে ল্যাংডনের আতঙ্কিত শ্বাসপ্রশ্বাস বেশ উপভোগ করে। প্রফেসর, এই মুহূর্তে আমার হাতে অনেক কাজ জমে আছে, এবং সেই তোমারও। ম্যাপটার পাঠোদ্ধার করা মাত্র আমাকে ফোন করে জানাবে। আমরা দুজন একসাথে গোপনস্থানে যাব এবং আমাদের কাঙ্খিত বস্তু বিনিময় করে নেব। পিটারের জীবন…বিনিময় সর্বকালের সঞ্চিত জ্ঞান।

আমি কিছুই করব না, ল্যাংডন ঘোষণা করে। বিশেষ করে পিটার জীবিত আছে সেটার প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত তো কিছুই করব না।

আমি তোমাকে পরামর্শ দেবো আমাকে চাপে না ফেলার জন্য। তুমি একটা বিশাল ব্যবস্থার নগণ্য একটা পুলি। তুমি যদি আমাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা কর, বা আমার কথা অমান্য কর, পিটার মারা যাবে। আমি কথা দিচ্ছি।

আমার বুদ্ধিতে যতটা বুঝি, পিটার ইতিমধ্যে মারা গেছে।

প্রফেসর, সে বহাল তবিয়তে আছে, কিন্তু তোমার সাহায্য তার ভীষণ প্রয়োজন।

তুমি আসলে কি চাও? ল্যাংডন ফোনের ভিতরেই চিৎকার করে উঠে।

মাল’আখ উত্তর দেবার আগে চুপ করে থাকে। অনেকেই প্রাচীন জ্ঞান সন্ধান করেছে এবং তার ক্ষমতা নিয়ে বিতর্কে মেতেছে। আজ রাতে, আমি প্রমাণ করবো রহস্যটা বাস্তব।

ল্যাংডন চুপ করে থাকে।

আমি বলব, তুমি দ্রুত ম্যাপটা নিয়ে কাজে লেগে পড়, মাল’আখ বলে। আজ রাতেই তথ্যটা আমার প্রয়োজন।

আজই?! এখন নয়টা বেজে গেছে!

ঠিক তাই। Tempus Fugit.

.

৪৪ অধ্যায়

নিউ ইয়র্ক সম্পাদক জোনাস ফকম্যান তার ম্যানহাটন অফিসের আলো মাত্র বন্ধ করবে এমন সময় ফোন বেজে উঠে। এই সময়ে ফোনটা ধরা তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না- সেটা অবশ্য, ডিসপ্লের কলার আইডি দেখার আগের কথা। এটা নির্ঘাত কাজের হবে, রিসিভারের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে সে ভাবে।

আমরা কি এখনও তোমার প্রকাশক? ফকম্যান কাজের সুরে কথা বলে।

জোনাস! রবার্ট ল্যাংডনের কণ্ঠে উদ্বেগের ছোঁয়া। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তুমি এখনও অফিসে আছো। তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন।

ফম্যানের মনটা নেচে উঠে। সম্পাদনার জন্য তোমার লেখা জমা হয়েছে, রবার্ট? অবশেষে?

না, আমার একটা তথ্য দরকার। গত বছর, ক্যাথরিন সলোমন নামে এক বৈজ্ঞানিকের সাথে আমি তোমাকে পরিচিত করিয়েছিলাম, পিটার সলোমনের বোন?

ফকম্যান ভ্রূ কুচকায়। লেখা নেই।

নিওটিক সাইন্স বিষয়ে একটা বই প্রকাশের জন্য সে প্রকাশক খুঁজছিল? তার কথা তোমার মনে আছে?

ফকম্যান চোখ মটকায়। অবশ্যই। আমার তাকে মনে আছে। আর সহস্র ধন্যবাদ তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। তার গবেষণার কোন কিছুই সে আমাকে পড়তে তো দেয়ইনি, ভবিষ্যতে কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণের আগে সে তার কোন কাজই প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক।

জোনাস, মন দিয়ে আমার কথা শোন, বেশি সময় নেই আমার হাতে। আমার ক্যাথরিনের ফোন নাম্বার দরকার। এখনই। তোমার কাছে তার নাম্বার আছে?

আমি তোমাকে আগে সতর্ক করে দেই…তুমি একটু বেশি বেপরোয় হয়ে উঠেছো। সে দেখতে নিঃসন্দেহে সুন্দরী, কিন্তু তুমি তাকে কেবল তোমার ব্যক্তিত্ব দ্বারা প্রভাবিত করতে

জোনাস, ফাজলামো বন্ধ কর, আমার এখনই তার নাম্বার প্রয়োজন।

ঠিক আছে…লাইনে থাকো। ফকম্যান আর জোনাস বহুদিনের পুরানো বন্ধু, সে জানে কখন ল্যাংডন সত্যিই সিরিয়াস। জোনাস ক্যাথরিন সলোমন নামটা একটা সার্চ উইনণ্ডোতে টাইপ করে এবং কোম্পানী ই-মেইল সার্ভার সার্চ করতে শুরু করে।

আমি এই মুহূর্তে খুঁজছি, সে ফোনে বলে। আমি জানিনা কেন তোমার দরকার, তবে দোহাই তোমার হার্ভাডের সুইমিং পুল থেকে অন্তত তাকে ফোন কোরো না। কেমন জানি কোন অভয়ারণ্যে আছে বলে মনে হয়।

আমি পুলে ভাসছি না, এই মুহূর্তে আমি ইউ,এস ক্যাপিটলের নীচে একটা সুড়ঙ্গে হাটছি।

ফকম্যান ল্যাংডনের কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারে যে সে মজা করছে না। এই লোকটার কাজের কোন ঠিক ঠিকানা নেই? রবার্ট তুমি বাড়িতে বসে সুস্থির মত লিখতে পার না? তার কম্পিউটার সার্চ শেষ করে। ঠিক আছে, অপেক্ষা কর…খুঁজে পেয়েছি। সে পুরানো ই-মেইলে মাউস লেলিয়ে দেয়। মনে হচ্ছে আমার কাছে কেবল তার সেল নাম্বার রয়েছে।

আমার তাতেই হবে।

ফকম্যান তাকে নাম্বারটা বলে।

জোনাস, তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞচিত্তে ল্যাংডন বলে। আমার কাছে তোমার একটা পাওনা রইল।

রবার্ট আমি তোমার কাছে একটা পাণ্ডুলিপি পাই। তোমার কোন ধারণা আছে কতদিন-

লাইন কেটে গেছে।

ফকম্যান বেকুবের মত রিসিভারের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ে। লেখক ছাড়া বই প্রকাশ করাটা যে কত সহজ হতো।

.

৪৫ অধ্যায়

ক্যাথরিন সলোমন কলার আইডির নামটা দেখে আরেকবার ভাল করে তাকিয়ে দেখে। সে ভেবেছিল ইনকামিং কলটা ত্রিশের, ক্রিস্টোফার অ্যাবাড্ডন আর তার আসতে কেন এত দেরী হচ্ছে সেটা বলার জন্য ফোন করেছে। কিন্তু কলার ত্রিস

একেবারেই অপ্রত্যাশিত একজন।

ক্যাথরিনের ঠোঁটের কোণে একটা লাজুক হাসি খেলে যায়। আজকের রাতটার ঝুলিতে আরও কত বিস্ময় অপেক্ষা করছে? সে ফোনটা টুসকি দিয়ে খোলে।

আমি কি ভুল দেখেছি, আমুদে কণ্ঠে সে আলাপ শুরু করে। বইপাগল অবিবাহিত একজন নিঃসঙ্গ নিওটিক বিজ্ঞানীর সঙ্গ চাইছে?

ক্যাথরিন! ভারী কণ্ঠস্বরটা নিঃসন্দেহে রবার্ট ল্যাংডনের। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তুমি এখনও বেঁচে আছে।

অবশ্যই আমি বেঁচে আছি, বিভ্রান্ত কণ্ঠে সে উত্তর দেয়। পিটারের বাসায় গত গ্রীষ্মের সেই অনুষ্ঠানের পরে তুমি সেই যে ডুব দিয়েছে সেটা ছাড়া আর সবই ভাল আছে।

আজ রাতে অনেক কিছু ঘটেছে। দয়া করে ভাল করে শোন। তার সাধারনত কোমল কণ্ঠস্বর কেমন কর্কশ শোনায়। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত যে আমাকেই কথাটা বলতে হচ্ছে…কিন্তু পিটার ভয়াবহ বিপদে পড়েছে।

ক্যাথরিনের মুখের হাসি উবে যায়। তুমি কি আবোলতাবোল কথা বলছো?

পিটার…ল্যাংডন ইতস্তত করে যেন শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না কি বলবে? আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে কথাটা বলবো…নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি এখনও নিশ্চিত নই কে বা কারা এর পেছনে রয়েছে কিন্তু-

নিয়ে যাওয়া হয়েছে? ক্যাথরিন জেরার সুরে বলে। রবার্ট তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। নিয়ে গিয়েছে…কোথায়?

অপহরণ করেছে। ল্যাংডনের গলার স্বর বিকৃত শোনায় যেন সে আচ্ছন্ন। হয়ে আছে। ঘটনাটা সম্ভবত আজ সকালে কিংবা গতকাল ঘটেছে।

এটা মোটেই ঠাট্টার বিষয় না, সে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে। আমার ভাই ভালই আছে। পনের মিনিট আগেই তার সাথে আমার কথা হয়েছে!

তুমি কথা বলেছো?! এবার ল্যাংডনের বেকুব বনার পালা।

অবশ্যই! সে এইমাত্র আমাকে টেক্সট ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানিয়েছে যে সে ল্যাবে আসছে।

সে টেক্সট পাঠিয়েছে তোমাকে…ল্যাংডন জোরে জোরে ভাবে। কিন্তু তুমি আসলে তার কণ্ঠস্বর শোননি?

না কিন্তু।

আমার কথা শোন খুকী। তুমি যে টেক্সট পেয়েছে সেটা তোমার ভাই করেনি। পিটারের ফোন কারো কাছে আছে। সে বিপজ্জনক। সে যেই হোক আমাকেও চালাকি করে আজরাতে ওয়াশিংটনে নিয়ে এসেছে।

তোমার সাথে চালাকি করেছে? তোমার কথার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না!

আমি দুঃখিত, আমি নিজেও কিছু বুঝছি না। ল্যাংডনের আঁচরণ তার চরিত্রের সাথে ঠিক খাপ খায়না। ক্যাথরিন, আমার মনে হয় তুমিও বিপদে আছো।

ক্যাথরিন সলোমন জানে রবার্ট ল্যাংডন কখনও এধরণের বিষয় নিয়ে। রসিকতা করবে না কিন্তু তারপরেও তার মনে হয় রবার্টের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি ভালই আছি, সে বলে। আমি একটা নিরাপদ ভবনের ভিতরে রয়েছি।

পিটারের ফোন থেকে আসা ম্যাসেজটা আমাকে পড়ে শোনাও। জলদি।

বিভ্রান্ত, ক্যাথরিন ম্যাসেজটা বের করে, ল্যাংডনকে সেটা পড়ে শোনায়, ম্যাসেজের শেষ অংশে ড. আবাত্সনের প্রসঙ্গ আসতে একটা তার ভিতরে একটা শিরশিরে শীতল অনুভূতি হয়। যদি সম্ভব হয়, ড,অ্যাবাড়নকে ভিতরে আমাদের সাথে যোগ দিতে অনুরোধ কর। আমি তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি…

.

হা খোদা…ল্যাংডনের কণ্ঠে ভয়ের রেশ। তুমি এই লোককে ভেতরে আমন্ত্রণ করেছো?

হ্যাঁ! আমার সহকারী এইমাত্র লবিতে গিয়েছে তাকে নিয়ে আসতে। আমি আশা করছি যে কোন সময়ে-

ক্যাথরিন পালাও ওখান থেকে! ল্যাংডন চিৎকার করে উঠে। এখনই!

.

এসএমএসসির অন্যপ্রান্তে, সিকিউরিটে রুমের ভিতরে, রেডস্কিনের খেলার শব্দ ছাপিয়ে একটা ফোন বাজতে শুরু করে। নিরাপত্তা রক্ষী অনিচ্ছাসত্ত্বেও আরো একবার নিজের কান থেকে এয়ারপ্লাগ খুলে।

লবি, সে উত্তর দেয়। কাইল বলছি। কাইল, আমি ক্যাথরিন সলোমন! তার রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে আশঙ্কার ছায়া। ম্যাম আপনার ভাই এখনও-

ত্রিস কোথায়?? সে জানতে চায়। মনিটরে তুমি কি তাকে দেখতে পাচ্ছো?

নিরাপত্তা প্রহরী তার চেয়ার ঘুরায় মনিটর দেখতে। সে এখনও কিউবে পৌঁছায়নি?

না ক্যাথরিন জানতে চায়, কণ্ঠস্বর সচকিত শোনায়।

নিরাপত্তা কর্মী এবার বুঝতে পারে ক্যাথরিন সলোমন হাপাচ্ছে দৌড়াবার সময়ে যেমন হয়। ভেতরে হচ্ছেটা কি?

নিরাপত্তা কর্মী এবার দ্রুত ভিডিও জয়স্টিক নাড়ায়, ক্ষিপ্রবেগে ডিজিটাল ভিডিওর ফ্রেমে চোখ বুলিয়ে যায়। ঠিক আছে, একটু অপেক্ষা করেন…ত্রিশের আপনার অতিথিকে নিয়ে লবি থেকে বের হবার ফ্রেম পেয়েছি…তারা স্ট্রিট দিয়ে যাচ্ছে…ফাস্টফরওয়ার্ডিং…এই যে পেয়েছি, তারা ওয়েট পডে ঢুকছে…ত্রিস তার কিকার্ড দিয়ে দরজা খুলছে…দুজনেই ওয়েট পড়ে প্রবেশ করল…ফাস্টফরওয়ার্ডিং…ওকে মাত্র একমিনিট আগে তারা ওয়েট পড় থেকে বেরিয়ে এসেছে…এগিয়ে যাচ্ছে…সে প্লেব্যাকের গতি হ্রাস করে, তার মাথা খাড়া হয়ে রয়েছে। এক মিনিট অপেক্ষা কর। এটা অদ্ভুত।

কি?

ওয়েট পড় থেকে ভদ্রলোক একা বেরিয়ে এসেছেন।

ত্রিস ভেতরে রয়েছে?

হ্যাঁ, সেরকমই মনে হচ্ছে। আমি এই মুহূর্তে আপনার অতিথিকেই কেবল দেখতে পাচ্ছি…হলে সে একেবারে একা।

ত্রিস কোথায়? ক্যাথরিন আরো উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

আমি তাকে ভিডিও ফিডে দেখতে পাচ্ছি না, সে উত্তর দেয়, তার কণ্ঠে আশঙ্কার রেশ ভর করতে শুরু করেছে। সে আবার স্ক্রিনের দিকে তাকায় এবং খেয়াল করে লোকটার জ্যাকেটের হাতা কেমন ভিজে মনে হচ্ছে…একেবারে কনুই পর্যন্ত ভিজে রয়েছে। ওয়েট পডে ঢুকে সে কি করেছে? লোকটাকে মেইন হলওয়ে দিয়ে পড় পাঁচের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করতে দেখে নিরাপত্তা কর্মী, তার হাতে কিছু একটা ধরা রয়েছে দেখতে অনেকটা…একটা কিকার্ড।

নিরাপত্তা কর্মী টের পায় তার ঘাড়ের চুল সড়সড় করে দাঁড়িয়ে পড়েছে।মিস,সলোমন, আমরা একটা ভয়ানক সমস্যায় পড়েছি।

.

ক্যাথরিন সলোমনের জন্য রাতটা অনায়াসে অনেক প্রথমের একটা রাত।

গত দুবছরে, সে তার ফোন কখনও বাইরের শূন্যতায় ব্যবহার করেনি। শূন্যতাটা সে কখনও ঝাড়া এক দৌড়ে অতিক্রমও করেনি। এই মুহূর্তে, অবশ্য সে কানে সেলফোন নিয়ে অন্ধের মত শেষ না হওয়া কার্পেটের উপর দিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে। প্রতিবার কার্পেট থেকে পা বাইরে ফেলেছে অনুভব করলে, সেটা শুধরে নিয়ে সে মাঝে ফিরে আসে, গাঢ় অন্ধকারের ভিতর দিয়ে সে ছুটে চলে।

সে এই মুহূর্তে কোথায়, ক্যাথরিন রুদ্ধশ্বাসে গার্ডকে জিজ্ঞেস করে। ফর্মা-১৩

।দেখছি দাঁড়ান, গার্ড উত্তর দেয়। ফাস্টফরওয়ার্ডিং…এই যে পেয়েছি সে হল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে…পড পাঁচের দিকে…

ক্যাথরিন প্রাণপনে দৌড়াতে থাকে, আশা করে এখানে আটকা পড়বার আগেই সে এক্সিটে পৌঁছাতে পারবে। পড পাঁচের প্রবেশ পথের সামনে আসতে তার আর কত দেরী?

গার্ড চুপ করে থাকে। ম্যাম আপনি আমার কথা বুঝতে পারেননি। আমি এখনও ফাস্টফরওয়ার্ড করছি। এটা পূর্বে ধারণকৃত। এসব ইতিমধ্যে ঘটে গিয়েছে। সে আবার চুপ করে যায়। দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি এন্ট্রি ইভেন্ট মনিটরটা একটু দেখে নেই। সে আবার চুপ করে এবং তারপরে বলে, ম্যাম, মিস.ত্রিশের এন্ট্রি কার্ডে মিনিট খানেক আগে পড় পাঁচে এন্ট্রির একটা ঘটনা দেখাচ্ছে।

ক্যাথরিন থেমে যায়, অন্ধকার গহ্বরের মাঝে সে দাঁড়িয়ে পড়ে। সে ইতিমধ্যে পড় পাঁচের প্রবেশ পথ খুলেছে? সে ফিসফিস করে ফোনে জিজ্ঞেস করে।

গার্ড এখন ঝড়ের বেগে উন্মত্তের মত টাইপ করছে। হ্যাঁ, দেখে মনে হচ্ছে সে …নব্বই সেকেণ্ড আগে ভিতরে প্রবেশ করেছে।

ক্যাথরিনের পুরো দেহ আড়ষ্ট হয়ে যায়। সে শ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চারপাশের অন্ধকার যেন সহসাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

সে এখন ভিতরে আমার সাথে।

সেই মুহূর্তে, ক্যাথরিন উপলব্ধি করে যে পুরো জায়গাটায় একমাত্র তার সেলফোন থেকে আলো বিকিরিত হয়ে, তার মুখের একপাশ আলোকিত করে রেখেছে। সাহায্য পাঠাও, সে ফিসফিস করে গার্ডকে বলে। আর তুমি ওয়েট পড়ে যাও ব্রিসকে সাহায্য করতে। তারপরে সে নিরবে লাইন কেটে দেয়, আলো নিভিয়ে ফেলে।

পরম অন্ধকার নিমেষে তাকে আপন করে নেয়।

সে গাছের গুঁড়ির মত দাঁড়িয়ে থাকে এবং যতটা সন্তপনে সম্ভব নিঃশ্বাস নেয়। কয়েক সেকেণ্ড পরে ইথানলের তীব্র গন্ধের ঝলক অন্ধকারের ভিতরে তার সামনে থেকে ভেসে আসে। গন্ধ তীব্রতর হতে থাকে। সে তার সামনে কয়েক ফিট দূরে কার্পেটের উপরে, কারও উপস্থিতি অনুভব করতে পারে। নিরবতার মাঝে, ক্যাথরিনের মনে হয় তার হৃৎপিণ্ডের শব্দই তার অবস্থান ফাঁস করে দেবে। নিরবে, সে তার জুতো খুলে ফেলে এবং একটু একটু করে কার্পেটের উপর থেকে বাম পাশে সরতে শুরু করে। তার পায়ের নীচে সিমেন্টের মেঝে শীতল অনুভূত হয়। সে আরও একপা পাশে গিয়ে কার্পেট থেকে সরে আসে।

তার পায়ের একটা আঙ্গুল মট করে ফোটে।

নিস্তব্ধতার মাঝে সেটাকেই গুলির আওয়াজের মত শোনায়।

কয়েক গজ দূর থেকে, কাপড়ের খসখস শব্দ সহসা অন্ধকারের ভিতর থেকে তার দিকে ছুটে আসে। ক্যাথরিন সরে যেতে এক পল দেরী করে ফেলে এবং একটা শক্তিশালী হাত তাকে স্পর্শ করে, অন্ধকারে হাতড়াতে থাকে, মওকা মত ধরতে উন্মত্তের মত প্রয়াস নেয়। সাড়াশির মত হাত তার ল্যাব কোট আঁকড়ে ধরে, পেছনে টানলে, তাকে গুটিয়ে নিতে চাইলে, সে ঘুরে যায়।

ক্যাথরিন হাত পিছনে দিয়ে, ল্যাবকোটের ভিতর থেকে পিছলে বের হয়ে আসে এবং মুক্ত হয়ে যায়। সহসা, বের হবার পথ কোন দিকে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা শূন্য, ক্যাথরিন নিজেকে ক্ষিপ্র গতিতে শেষ না হওয়া অন্ধকারের মাঝে একেবারে অন্ধের মত ছুটতে দেখে।

.

৪৬ অধ্যায়

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কক্ষ বলে অনেকে যাকে অভিহিত করে থাকে, সেটা এখানে অবস্থিত হলেও, লাইব্রেরী অব কংগ্রেস তার বিশাল সংগ্রহের জন্য যতটা পরিচিত তারচেয়ে অনেক কম পরিচিত এর শ্বাসরুদ্ধকর চমৎকারিত। পাঁচশ মাইলের চেয়ে বেশি শেলফ দৈর্ঘ্য- ওয়াশিংটন, ডি.সিকে বস্টনের সাথে সংযুক্ত করার জন্য যথেষ্ট- একে অনায়াসে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগারের খেতাবে ভূষিত করার জন্য যথেষ্ট। এবং তারপরেও এর কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে, প্রতিদিন প্রায় দশ হাজার নতুন টাইটেল এর সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করছে।

টমাস জেফারসনের বিজ্ঞান আর দর্শনের বইয়ের প্রাথমিক সংগ্রহশালা, আজ জ্ঞানের বিকাশে আমেরিকার প্রতিশ্রুতির প্রতাঁকে পরিণত হয়েছে। ওয়াশিংটনে বৈদ্যুতিক বাতি প্রথম আলোকিত করেছে যে ভবনগুলোকে তাদের ভিতরে অন্যতম, আক্ষরিক অর্থেই নতুন পৃথিবীর অন্ধকারে আলোক বর্তিকার ন্যায় জ্বাজ্যলমান।

নাম থেকেই যেমন বোঝা যায়, লাইব্রেরী অব কংগ্রেস মূলত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কংগ্রেসকে সাহায্য করতে, যার সম্মানিত সদস্যদের পদভাবে ক্যাপিটলের সড়ক মুখরিত থাকত। লাইব্রেরী আর ক্যাপিটলের এই সুপ্রাচীন বন্ধন সম্প্রতি একটা পার্থিব সংযোগ নির্মাণের দ্বারা আরো দৃঢ় হয়েছে- স্বাধীনতা সরণীর নীচ দিয়ে একটা লম্বা টানেল এই দুটো ভবনকে যুক্ত করেছে।

আজরাতে, এই স্বল্পালোকিত টানেলে, রবার্ট ল্যাংডন একটা নির্মান স্থানের ভিতরে, ক্যাথরিনকে নিয়ে সৃষ্ট নতুন আশঙ্কার স্রোতকে প্রশমিত করার চেষ্টা করে, ওয়ারেন বেল্লামিকে অনুসরন করছে। বদ্ধ উন্মাদটা তার ল্যাবে উপস্থিত হয়েছে?! কারণটা ল্যাংডন ভাবতেও চায় না। সতর্ক করার জন্য ল্যাংডন যখন তাকে ফোন করেছিল, লাইট কাটার আগে সে ক্যাথরিনকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে কোথায় তার সাথে দেখা করবে। মড়ার সড়ঙ্গটা শেষও হয় না? তার মাথা ব্যথা করতে আরম্ভ করেছে, পারস্পরিক আন্তসম্পর্কিত ভাবনার ঢেউ ঢলের আঁকার নিতে শুরু: ক্যাথরিন, পিটার, দি ম্যাসনস, বেল্লামি, পিরামিড, প্রাচীন ভবিষ্যতবাণী…এবং এই সবকিছুর সাথে জড়িয়ে একটা ম্যাপ।

ল্যাংডন মাথা নেড়ে ভাবনাগুলো দূরে সরিয়ে দিয়ে জোরে হাঁটতে শুরু করে। বেল্লামি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে বলেছে।

সুড়ঙ্গটার শেষ প্রান্তে যখন তারা দুজন পৌঁছে, বেল্লামি ল্যাংডনকে নির্মাণাধীন বেশ একটা ডবলডোরের ভিতর নিয়ে আসে। অসমাপ্ত দরজাটা আটকাবার কোন উপায় না পেয়ে বেল্লামি বুদ্ধি খাটায় নির্মাণ এলাকা থেকে একটা এ্যালুমিনিয়ামের মই নিয়ে সেটাকে বাঁকা করে দরজার বাইরে থেকে ঠেস দিয়ে রাখে। তারপরে সে একটা ধাতব বালতি সেটার উপরে ঝুলিয়ে দেয়। কেউ দরজাটা খোলার চেষ্টা করলেই বিকট শব্দে বালতিটা মেঝেতে আছড়ে পড়বে।

আমাদের সতর্ক ব্যবস্থা? ঝুলতে থাকা বালতির দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন ভাবে বেল্লামির আজ রাতে আরও বিশদ নিরাপত্তা পরিকল্পনার প্রয়োজন হবে তাদের চামড়া বাঁচাতে হলে। সবকিছুই এত দ্রুত ঘটছে এবং ল্যাংডন এখন কেবল বেল্লামির সাথে পালিয়ে আসবার ফলে কি কি ঘটতে পারে সে বিষয়ে ভাববার প্রয়াস পেয়েছে। আমি এখন সিআইএর কবল থেকে পালিয়ে।

বেল্লামি একটা বাঁক ঘুরে, যেখানে তারা দুজন একটা প্রশস্থ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে যা কমলা রঙের পাইলনের বেষ্টনী দেয়া। ল্যাংডনের ডেব্যাগ উপরে ওঠার সময়ে নিজের ওজনের কথা জানান দেয়। পাথরের পিরামিডটা, সে বলে, আমি এখনও বুঝতে পারছি না।

এখানে না, বেল্লামি থামিয়ে দিয়ে বলে। আমরা সেটা আলোতে পরীক্ষা করে দেখবো। আমি একটা নিরাপদ জায়গা চিনি।

ল্যাংডনের সন্দেহ আছে সিআইএর অফিস সিকিউরিটির ডিরেকটরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার পরে সে রকম কোন স্থান আদৌ আছে কিনা।

তারা সিঁড়ির উপরিভাগে উঠে এসে, সোনার পাতা, স্ট্যাকো আর ইতালিয়ান মার্বেলে শোভিত একটা প্রশস্থ হলওয়েতে প্রবেশ করে। হলটাতে সারিবদ্ধভাবে আটজোড়া মূর্তি সাজান- সবগুলোই দেবী মিনার্ভার বিভিন্ন রূপ। বেল্লামি না থেমে এগিয়ে যায়, ল্যাংডনকে পথ দেখিয়ে একটা ভল্টেড আর্চওয়ের মধ্যে দিয়ে আরও রাজকীয় একটা জায়গায় নিয়ে আসে।

কাজ শেষের আলোকসজ্জার মৃদু আলোতেও, লাইব্রেরীর গ্রেটহল ইউরোপের যে কোন রুচিশীল প্রাসাদের ধ্রুপদী মহিমায় ভাস্বর। মাথার উপরের ছাদে পঁচাত্তর ফিট উপরে বিরল এ্যালুমিনিয়াম লিফ- একটা ধাতু একসময়ে যা সোনার চেয়েও দামী ছিল, দিয়ে কারুকাজ করা প্যানেল বীমের মাঝে রঙিন, কাঁচের স্কাইগ্লাস চমকাচ্ছে। ঠিক নীচে, জোড়া স্তম্ভের একটা রাজসিক কোর্স দোতলার ব্যালকনি ঘিরে আছে, যেখানে দুটো চমৎকার বাঁকান সিঁড়ি দিয়ে পৌঁছান যায়, সিঁড়ি দুটোর নিউয়েল পোস্ট অতিকায় ব্রোঞ্জের নারী মূর্তি যাদের উঁচু করে ধরা হাতে রয়েছে জ্ঞানের মশাল।

আধুনিক আলোকবর্তিকার ধারণার প্রতিফলন ঘটাবার এক উদ্ভট প্রয়াস থেকে এবং বেঁনেসাস স্থাপত্যশৈলীর নান্দনিক পরিধির ভিতরে অবস্থান করেই সিঁড়ির রেলিংএর গরাদে আধুনিক বৈজ্ঞানিকদের কিউপিডের মত খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দেবদূতের মত দেখতে ইলেকট্রিশিয়ানের হাতে টেলিফোন ধরা। নমুনা সংগ্রহের বাক্স হাতে নধরকান্তি প্রকৃতিবিদ? ল্যাংডন কল্পনা করে বার্নিনি আসলে কি ভেবেছিল।

আমরা এখানে কথা বলবো, বুলেটপ্রুফ ডিসপ্লেকেসে প্রদর্শিত গ্রন্থাগারের সবচেয়ে মূল্যবান দুটো স্মারকের- মেইনজের দি জায়ান্ট বাইবেল, ১৪৫০ সালে হাতে লেখা আর আমেরিকার গুটেনবার্গের কপি, সারা পৃথিবীতে চামড়া দিয়ে বাধান কেবল তিনটে কপি আছে, পাশ দিয়ে যাবার সময় ওয়ারেন ল্যাংডনকে বলেন। পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে মাথার উপরের ছাদে ছয়টা প্যানেলে অঙ্কিত জন হোয়াইট আলেকজাণ্ডারের দি ইভোলিউশন অব দি বুক শোভা পাচ্ছে।

পূর্বদিকের করিডোরের দেয়ালের কেন্দ্রে সাথে একজোড়া মার্জিত দুইপাল্লা বিশিষ্ট দরজার দিকে এগিয়ে যায়। ল্যাংডন জানে ঐ দেয়ালের পিছনে কি আছে, কিন্তু আলোচনার জন্য এই জায়গাটা নির্বাচন করাটা তার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। আর তাছাড়া, সর্বত্র নিরবতা বজায় রাখুন চিহ্নে চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে কথা বলাটাও একটা বিড়ম্বনা, এই কামড়াটাকে একেবারেই নিরাপদ স্থান বলে মনে হয় না। গ্রন্থাগারের ক্রশাকৃতির নক্সার ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত এই কামড়াটা ভবনটার মূল আঁকৰ্ষণ। এখানে লুকিয়ে থাকার অর্থ মসজিদে জুতা পরে ঢুকে মিম্বারে লুকিয়ে থাকা।

সে যাই হোক, বেন্নামি দরজা খুলে, ভেতরের অন্ধকারে প্রবেশ করে এবং আলো জ্বালাবার জন্য হাতড়ায়। সে সুইচ অন করলে আমেরিকার মহানতম স্থাপত্য নিদর্শন চোখের সামনে ভেসে উঠে।

বিখ্যাত রিডিং রুমটা চোখের জন্য বড়ই প্রীতিকর একটা দৃশ্য। বিশাল অষ্টভূজাকৃতি কামরাটার কেন্দ্র ঠিক ১৬০ ফিট উঁচু, এর আটটা দেয়াল চকলেট ব্রাউন টেনেসী মার্বেল, ক্রিম কালারের সিয়েনা মার্বেল আর আপেলের মত লাল আলজেরিয়ান মার্বেলে ঢাকা। আটটা ভিন্ন কোণ থেকে আলোকিত বলে কোথাও কোন ছায়া পড়েনা, ফলে মনে হয় কামরাটা যেন নিজে থেকেই জ্বলছে।

কেউ কেউ বলে এটা ওয়াশিংটনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কামরা, ল্যাংডনকে পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে আসবার সময়ে বেল্লামি বলে।

সম্ভবত সারা পৃথিবীতে, চৌকাঠ অতিক্রম করে ভিতরে প্রবেশ করার সময়ে ল্যাংডন ভাবে। বরাবরের মতই, প্রথমেই তার নজর যায় উপরের সুউচ্চ সেন্ট্রাল কলারের দিকে, সেখান থেকে কারুকার্যখচিত আড়া গম্বুজের তলদেশ দিয়ে বেকে উপরের ব্যালকনি পর্যন্ত নেমে এসেছে। পুরো ঘরটা ঘিরে ষোলটা আবক্ষ ব্রোঞ্জের মূর্তি পরিক্ষেপ বা দেহলি থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের নীচে দৃষ্টিনন্দন ধনুকাকৃতি খিলানের একটা আর্কেড নীচের ব্যালকনি তৈরী করেছে। মেঝের উপরে বিশাল অষ্টভূজাকৃতি সাকুলেশন ডেস্ক থেকে এককেন্দ্র বিশিষ্ট তিনটা বৃত্তাকার বার্নিশ করা কাঠের ডেস্ক বাইরের দিকে ছড়িয়ে গেছে।

ল্যাংডন তার দৃষ্টি বেল্লামির উপরে আপতিত করতে দেখে, সে এখন ঘরের দুই পাল্লার দরজা হাট করে খুলে দিচ্ছে। আমি মনে করেছিলাম আমরা লুকিয়ে আছি, ল্যাংডন বিভ্রান্ত কণ্ঠে বলে।

কেউ যদি ভবনে প্রবেশ করে, বেল্লামি বলে, আমি তাদের আসবার শব্দ শুনতে চাই।

কিন্তু এখানে কি তারা আমাদের এক মুহূর্তে খুঁজে পাবে না।

আমরা যেখানেই লুকিয়ে থাকি তারা আমাদের ঠিকই খুঁজে বের করবে। কিন্তু কেউ যদি আমাদের এই ভবনের ভিতরে কোণঠাসা করে ফেলে, তখন তুমি

আমাকে ধন্যবাদ দেবে এই কামরাটা বেছে নেবার জন্য।

ল্যাংডনের কোন ধারণা নেই কেন, কিন্তু বেল্লামিও সেটা ব্যাখ্যা করার আগ্রহ দেখায় না। সে ততক্ষণে ঘরের মধ্যস্থান লক্ষ্য করে হাটা দিয়েছে যেখানে সে একটা রিডিং ডেস্ক বেছে নিয়ে, দুটো চেয়ার বের করে এবং রিডিং লাইট জ্বালায়। তারপরে সে ইশারায় ল্যাংডনের ব্যাগটা দেখায়।

ঠিক আছে প্রফেসর, তোমার ব্যাগটা এবার ভাল করে দেখা যাক।

বার্নিশের মসৃণ সমতল গ্রানাইটের রুক্ষ উপরিভাগের ঘষায় যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য ল্যাংডন ব্যাগটাই টেবিলে তুলে নেয় এবং চেইন খুলে দুপাশ মুড়িয়ে। ভিতরের পিরামিডটা বের করে আনে। ওয়ারেন বেল্লামি রিডিং ল্যাম্পের আলো ঠিক করে পিরামিডটা খুব ভাল করে দেখে। সে অদ্ভুত খোদাইয়ের উপরে হাত বুলায়।

আমার মনে হয় ভাষাটা তুমি বুঝতে পেরেছো? বেল্লামি জানতে চায়।

অবশ্যই, ষোলটা প্রতাঁকের দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন বলে।

ফ্রিম্যাসনদের গুপ্তলিপি হিসাবে পরিচিত, এই সাঙ্কেতিক ভাষা প্রথম দিকে ম্যাসনরা নিজেদের ভিতরে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র লিখতে ব্যবহার করতো। সাঙ্কেতিক পদ্ধতিটা বহু আগে বাতিল করা হয়েছে একটা খুব সাধারন কারণে–সংকেতের পাঠোদ্ধার খুবই সহজ বিধায়। ল্যাংডনের সিনিয়র সিম্বলজি সেমিনারের বেশিরভাগ ছাত্রই এই কেডি পাঁচ মিনিটে ভাঙতে পারবে। ল্যাংডন কাগজ পেনসিল নিয়ে সেটা ষাট সেকেণ্ডে করতে পারবে।

শতাব্দি প্রাচীন সাঙ্কেতিক লিপির পাঠোদ্ধার পদ্ধতির এই খুঁত এখন কয়েকটা স্ববিরোধী বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত, পৃথিবীতে কেবল ল্যাংডনই এটার পাঠোদ্ধারের ক্ষমতা রাখে এই দাবী মেনে নেয়া যায় না। দ্বিতীয়, সাটো যখন এই ম্যাসনিক পিরামিড জাতীয় নিরাপত্তার একটা বিষয় বলে উল্লেখ করে তখন ব্যাপারটা দাঁড়ায় কেউ ক্র্যাকজ্যাকের সাথে দেয়া পাজল দিয়ে সাঙ্কেতিক রাষ্ট্রীয় তারবার্তার পাঠোদ্ধার করছে। ল্যাংডনের দুটোর কোনটাই এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। এই পিরামিডটা একটা ম্যাপ? সর্বকালের হারিয়ে যাওয়া জ্ঞানর নির্দেশক?

রবার্ট, বেল্লামি গম্ভীর কণ্ঠে বলেন। ডিরেকটর সাটো কি তোমাকে বলেছে সে কেন এই বিষয়ে আগ্রহী?

ল্যাংডন মাথা নাড়ে। নির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি। সে কেবল একটা কথাই বারবার বলেছে জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত। আমার মনে হয় সে মিথ্যা। বলেছে।

সম্ভবত, ঘাড়ের পেছনে ডলতে ডলতে বেল্লামি বলেন। তাকে দেখে মনে হয় সে কোন কিছু নিয়ে বিব্রত। কিন্তু তারচেয়েও মারাত্মক একটা সম্ভাবনা আছে। সে ঘুরে ল্যাংডনের চোখের দিকে তাকায়। এটাওতো সম্ভব যে ডিরেকটর সাটো পিরামিডের আসল সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছে।

.

৪৭ অধ্যায়

ক্যাথরিন সলোমনের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া অন্ধকারকে পরম অন্ধকার বলে মনে হয়।

কার্পেটের পরিচিত নিরাপত্তা থেকে পালিয়ে সে এখন অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সামনে এগোয়, সেই নির্জন শূন্যতায় তার বাড়িয়ে থাকা হাত কেবল আরো শূন্যস্থান স্পর্শ করে। তার স্টকিং আবৃত পায়ের নীচে শীতল সিমেন্টের শেষ না হওয়া বিস্তারকে মনে হয় কোন অজানা বরফাবৃত লেক…একটা বিরূপ। পরিবেশ যেখান থেকে তাকে এখন পালাতে হবে।

ইথানলের গন্ধ বাতাস থেকে মিলিয়ে যেতে, সে থামে এবং অন্ধকারে অপেক্ষা করতে থাকে। স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে, সে কান পাতে, সাধ্য থাকলে ঢাকের মত নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দটারও সে গলা টিপে ধরত। তাকে ধাওয়া করা ভারী পায়ের শব্দ মনে হয় থেমেছে। আমি কি তার নাগাল এড়িয়েছি? ক্যাথরিন চোখ বন্ধ করে ভাবতে চেষ্টা করে সে কোথায় আছে। আমি কোন দিকে দৌড়েছিলাম? দরজাটা কোনদিকে কোন কাজ হয়না। সে এতবার দিক পরিবর্তন করেছে যে বের হবার দরজা যেকোন দিকে হতে পারে।

ভয়, ক্যাথরিন কোথায় যেন পড়েছিল একবার, উদ্দীপকের মত কাজ করে, মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি তীক্ষ্ণ করে দেয়। এই মুহূর্তে অবশ্য ভয় তার মনে আতঙ্ক আর বিভ্রান্তির বেনোজলে ডুবিয়ে দিয়েছে। আমি যদি বের হবার পথ খুঁজেও পাই, আমি বের হতে পারব না। তার কিকার্ড ল্যাব কোটের সাথে থেকে গেছে। তার একমাত্র আশা এই বিশাল অন্ধকারে সে খড়ের গাদায় কেবল একটা সুইয়ের মত- ত্রিস হাজার বর্গফুটের গ্রিডে একটা জীবন্ত বিন্দু। দৌড় দেবার প্রবল প্রবণতা সত্ত্বেও ক্যাথরিনের বিশ্লেষক মস্তিষ্ক তাকে বদলে একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য কাজটা করতে বলে- একেবারেই নড়াচড়া না করা। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। একটা শব্দও করবে না। নিরাপত্তা রক্ষী আসছে, এবং কোন একটা অজানা কারণে তার আক্রমণকারীর গা থেকে তীব্র ইথানলের গন্ধ বের হচ্ছে। সে আমার কাছে আসলে আমি আগেই টের পাব।

ক্যাথরিন নিরবে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে, ল্যাংডনের কথাই কেবল তার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। তোমার ভাই…তাকে অপহরণ করা হয়েছে। সে টের পায় ঘামে একটা শীতল বিন্দু তার বাহুতে সৃষ্টি হয়ে সেলফোন মুঠো করে ধরা ডান হাতের দিকে গড়িয়ে যায়। এই বিপদের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। ফোনটা বাজলেই তার অবস্থান ফাঁস করে দেবে এবং ফোনটা খুলে এর ডিসপ্লে আলোকিত না করে সে সেটা বন্ধ করতে পারবে না।

ফোনটা নামিয়ে রাখো…এবং এর থেকে দূরে সরে যাও।

কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তার ডানদিক থেকে ইথানলের গন্ধ ভেসে আসে। এবং সেটা প্রতি মুহূর্তে তীব্র হতে থাকে। ক্যাথরিন শান্ত থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে, দৌড় দেবার প্রবৃত্তি দমন করে। ধীরে অতি সাবধানে সে নিজের বাম পাশে এক পা সরে আসে। তার কাপড়ের সামান্য নড়াচড়ার শব্দ শোনার জন্য তার আক্রমণকারী ওত পেতে ছিল। সে তার সামনে এগিয়ে আসবার শব্দ শুনতে পায়, এবং একটা শক্ত হাত তার কাঁধ আঁকড়ে ধরলে ইথানলের গন্ধ তাকে পাগল করে তুলে। সে মোচড় খায়, পাশবিক আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরে। গাণিতিক সম্ভাবনা মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং ক্যাথরিন অন্ধের মত আবার দৌড় দেয়। সে বামদিকে দৌড়াতে থাকে, দিক বদলায় এবং শূন্যতার ভিতরে এখন সে পাগলের মত ছুটছে।

দেয়ালটা আঁচমকা সামনে এসে হাজির হয়।

ক্যাথরিন সজোরে ধাক্কা খায় এবং তার ফুসফুস খালি হয়ে যায়। ব্যথা যেন ফুলের মত তার কাঁধে আর বাহুতে ফুটে উঠে কিন্তু সে কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকে। আড়াআড়িভাবে এসে দেয়ালে ধাক্কা খাবার কারণে আঘাতের পুরো শক্তি তাকে হজম করতে হয়নি কিন্তু তারপরেও ব্যথাটা কোন অংশে কম না। শব্দটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সে এখন জানে আমি কোথায়। ব্যথা নিয়েই সে দৌড় দেয় এবং মাথা ঘুরিয়ে অন্ধকারে দেখে আর তার মনে সে বুঝি তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।

নিজের অবস্থান পরিবর্তন কর। এখনই!

এখনও পুরোপুরি দম ফিরে না পাওয়া সত্ত্বেও, সে দেয়াল বরাবর হাঁটতে শুরু করে এবং নিরবে বামহাত দিয়ে ইস্পাতের উন্মুক্ত গজালের মাথা স্পর্শ করে। দেয়ালের কাছে থাকে। তোমাকে কোণঠাসা করার আগেই তাকে এড়িয়ে যাও। তার ডানহাতে ক্যাথরিন তথনও তার সেলফোনটা ধরে রয়েছে যাতে প্রয়োজন পড়লে সেটা ঢিলের মত ছুঁড়ে মারতে পারে।

ক্যাথরিন এখন যে শব্দটা শুনে সেটা শোনার জন্য সে মোটেই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না- কাপড়ের স্পষ্ট খরখর শব্দ ঠিক তার সামনে…দেয়ালের কাছ থেকে ভেসে আসে। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে, গাছের গুঁড়ির মত জমে যায়। এত দ্রুত সে দেয়ালের কাছে কিভাবে পৌঁছাল? ইথানলের গন্ধ যুক্ত হাল্কা বাতাসের পরশ সে তার মুখে অনুভব করে। হলের দিক থেকে সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে!

ক্যাথরিন অন্ধকারে কয়েক পা পিছিয়ে আসে। তারপরে, নিরবে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে দেয়ালের বিপরীত দিক ধরে হাঁটতে আরম্ভ করে। বিশ ফিট অতিক্রম করেছে এমন সময় অসম্ভব একটা ঘটনা ঘটে। আরো একবার তার সামনে থেকে কাপড়ের খরখর শব্দ ভেসে আসে। তারপরে আবার সেই ইথানলের গন্ধ। মিশ্রিত বাতাসের ঝাঁপটা। ক্যাথরিন সলোমন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

খোদা, সে দেখছি সব জায়গাতেই ছড়িয়ে আছে!

.

খোলা বুকে মাল’আখ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাতায় লেগে থাকা ইথানলের গন্ধ একটা উপদ্রব বলে প্রতিয়মান হলেও সে সেটাকেই অস্ত্রে পরিণত করে, শার্ট আর জ্যাকেট খুলে ফেলে সে তার শিকারকে কোণঠাসা করতে সেগুলো ব্যবহার করেছে। ডানদিকের দেয়াল লক্ষ্য করে সে তার শার্ট ছুঁড়ে দেয়, সে ক্যাথরিনের দাঁড়িয়ে পড়ে দিক পরিবর্তন করার শব্দ শুনতে পেয়েছে। এখন, বামদিকে সামনে শার্ট ছুঁড়ে দিয়ে, মাল’আখ আবার তার থামার শব্দ শুনতে পেয়েছে। সে তাকে দেয়ালের পাশে দুটো বিন্দু স্থাপন করে তাকে তার মাঝে কার্যকরভাবে আটকে ফেলেছে যা অতিক্রম করার সাহস সে দেখাবে না।

এখন সে নিরবে কান পেতে অপেক্ষা করে। সে এখন কেবল একদিকেই আসতে পারবে- সরাসরি আমার দিকে। তারপরেও মাল’আখ কোন শব্দ শুনতে পায় না। ক্যাথরিন হয় আতঙ্কে পঙ্গু হয়ে গেছে অথবা সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে পড় পাঁচে বাইরে থেকে সাহায্য প্রবেশ না করা পর্যন্ত সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে বলে স্থির করেছে। দুভাবেই তার পরাজয় নিশ্চিত। শীঘ্রই কেউ পড় পাঁচে প্রবেশ করতে পারছে না; মাল’আখ বাইরের কিপ্যাড একটা স্কুল কিন্তু খুবই কার্যকরী পদ্ধতিতে অকেজো করে দিয়েছে। ত্রিশের কিকার্ড ব্যবহার করে সে একটা সিকি কিকার্ডের স্লটে ঢুকিয়ে দিয়েছে ফলে পুরো মেক্যানিজম না খুলে কাউকে আর ভিতরে প্রবেশ করতে হচ্ছে না।

ক্যাথরিন তুমি আর কেবল আমি. ..যতক্ষণ সময় লাগে।

মাল’আখ নিরবে সামনে এগোয়, নড়াচড়ার শব্দ শোনার জন্য কান খাড়া করে রাখে। ক্যাথরিন সলোমন আজ রাতে তার ভাইয়ের জাদুঘরে বেঘোরে মারা পড়বে। কি কাব্যিক মৃত্যু। তার ভাইয়ের সাথে ক্যাথরিনের মৃত্যু সংবাদ ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। বুড়ো মানুষটার আক্ষেপই বহু প্রতিক্ষিত প্রতিশোধ।

সহসা অন্ধকারে মাল’আখকে চমকে দিয়ে দূরে আলোর একটা ছোট আভা দেখা দেয় এবং সে বুঝতে পারে ক্যাথরিনের বিচারবুদ্ধি এই মাত্র মারাত্মক একটা ভুল করে বসেছে। সে ফোন করছে সাহায্যের আশায়?! কোমরের সমান উচ্চতায় ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে এইমাত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে ঠিক তার বিশ গজ সামনে, অন্ধকার সমুদ্রে একটা আলোকবর্তিকার মত। মাল’আখ ক্যাথরিনের হাল ছেড়ে দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার জন্য প্রস্তুত ছিল কিন্তু এখন আর তাকে সেটা করতে হবে না।

মাল’আখ নিরবে দৌড় শুরু করে, ভাসতে থাকা আলোর উৎস লক্ষ্য করে, জানে সাহায্য চেয়ে ফোনটা শেষ করার আগেই তাকে তার কাছে পৌঁছাতে হবে। চোখের নিমেষে সে সেখানে পৌঁছে যায় এবং তার জ্বলজ্বল করতে থাকা সেলফোনের দুপাশে দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে সে সামনে ঝাঁপ দেয়, তাকে সে জাপটে ধরতে প্রস্তুত।

মাল’আখের আঙ্গুল নিরেট দেয়ালে বাঁধা পায়, পেছনে বেঁকে আসে আর একটু হলেও ভেঙে যেত। তার মাথা এর পরে ইস্পাতের বীমে গিয়ে আছড়ে পড়ে। দেয়ালের পাশে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে পড়তে সে অসহ্য ব্যথায়। গুঙিয়ে উঠে। গাল বকতে বকতে সে কোনমতে কোমড় সমান উঁচু আনুভূমিক ধাতব টুকরোটা ধরে উঠে দাঁড়ায় যার উপরে ক্যাথরিন সলোমন খুবই চালাকির সাথে খোলা সেলফোন রেখে দিয়েছিল।

.

ক্যাথরিন আবার দৌড়াতে শুরু করে এবার আর পড পাঁচের ভেতরের দেয়ালে সমান দূরত্বে স্থাপিত ধাতব গোজের মাথায় ছন্দোবদ্ধভাবে তার হাতের। আঘাতে সৃষ্ট শব্দের জন্য সে কোন তোয়াক্কা করে না। দৌড়াও! সে যদি পডের ভিতরে দেয়াল ধরে পুরোটা একবার চক্কর দেয় তবে সে জানে যে এক সময়ে না এক সময়ে সে বের হবার দরজা খুঁজে পাবেই।

গার্ড ব্যাটা কোন চুলায় গিয়েছে?

সমান দূরত্বে স্থাপিত গোজ অবিরাম আসতে থাকে পাশের দেয়াল স্পর্শ করে সে বাম দিকে দৌড়াতে থাকলে এবং সে ডান হাত সামনে বাড়িয়ে রাখে। আত্মরক্ষার জন্য। কোনাটা কখন আসবে? পাশের দেয়াল যেন শেষ হতেই চায়।

কিন্তু সহসা গোজের অবস্থানের ছন্দপতন ঘটে। তার বামহাত বেশ কয়েক পা পর্যন্ত কিছুই অনুভব করে না তারপরে আবার গোজের সারি ফিরে আসে। ক্যাথরিন দাঁড়িয়ে পড়ে এবং পিছিয়ে এসে ধাতব মসৃন প্যানেলটার কাছে ফিরে আসে। এখানে কোন গোজ দেয়া নেই কেন?

সে শুনতে পায় তার আক্রমণকারী হাঁসফাস করে তার পিছু ধাওয়া করছে, দেয়াল হাতড়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। কিন্তু ভিন্ন একটা শব্দ ক্যাথরিনকে আরও বেশি আতঙ্কিত করে তোলে দূর থেকে পড পাঁচের দরজায় সিকিউরিটি গার্ডের হাতের ফ্ল্যাশলাইটের ছন্দোবদ্ধ আঘাত।

গার্ড ভিতরে প্রবেশ করতে পারেনি।

ভাবনাটা যদিও ভীতিকর, তার আঘাত করার অবস্থান- তার ডান দিকে কোণাকুণি-সাথে সাথে ক্যাথরিনকে নিজের যথার্থ অবস্থান নির্ণয়ে সাহায্য করে। সে এখন ভাল করেই জানে পড পাঁচের ঠিক কোথায় সে দাঁড়িয়ে আছে। মানস চক্ষে দৃশ্যমান প্রেক্ষাপট আরেকটা অপ্রত্যাশিত উপলব্ধি সাথে নিয়ে আসে। সে এখন জানে দেয়ালের সমতল প্যানেলটা কি।

প্রতিটা পড়ে একটা নমুনা বের হয়েছে- একটা বিশাল স্থানান্তরযোগ্য দেয়াল যা সরিয়ে অতিকায় আঁকৃতির নমুনা ভিতরে বা বাইরে বের করা হয়। অনেকটা ঠিক বিমানের হ্যাঙ্গারের মত, এই দরজাটাও বিশাল আর ক্যাথরিন। তার অবাস্তব কল্পনাতেও কখনও এটা খোলার কথা চিন্তা করেনি। এই মুহূর্তে এটাই তার বাঁচার একমাত্র আশা বলে প্রতিয়মান হয়।

এটা কি ভোলা সম্ভব?

ক্যাথরিন আধারের ভিতরে অন্ধের মত হোঁচট খেতে থাকে, বের দরজার হাতল খুঁজতে গিয়ে, যতক্ষণ না সেটার হাতল সে খুঁজে পায়। আঁকড়ে ধরে, সে তার দেহের পুরো ভর দিয়ে পেছনের দিকে টানে, চেষ্টা করে দরজাটা পাশে খুলতে। কিছুই হয় না। সে আবার চেষ্টা করে। একই ফলাফল।

সে পেছনে তার আক্রমণকারীর এগিয়ে আসবার শব্দ শুনতে পায়, দরজা খোলার শব্দ শুনে এগিয়ে আসছে। বের দরজা বন্ধ! আতঙ্কে পাগল হয়ে সে। দরজার চারপাশে হাতড়াতে থাকে, কোন লিভার বা ছিটকিনি আছে কিনা দেখে। সে হঠাৎ একটা খাড়া পেপালের মত মনে হয় জিনিস খুঁজে পায়। সে পোলটা অনুসরণ করে মেঝেতে বসে এবং হাত দিয়ে বুঝতে পারে সেটা একটা গর্তের ভিতর ঢুকান রয়েছে। একটা নিরাপত্তা রড! সে উঠে দাঁড়ায়, পোলটা শক্ত করে ধরে এবং পায়ের উপরে দাঁড়িয়ে গর্ত থেকে রডটা বের করে আনে।

সে প্রায় পৌঁছে গেছে!

ক্যাথরিন এবার হাতলটা আবার খুঁজতে থাকে, পায় এবং দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে পেছনের দিকে টানে। বিশাল প্যানেলটা বোধহয় হাল্কা নড়ে উঠে কারণ বাইরের আলো একটা পাতের মত পড় পাঁচে প্রবেশ করে। ক্যাথরিন আবার টানে। বাইরে থেকে আসা আলোর পথ আরেকটু প্রশস্ত হয়। আর একটু! সে শেষবারের মত টান দেয়, টের পায় তার আক্রমণকারী মাত্র কয়েকপা পেছনে রয়েছে।

আলোর দিকে জোনাকির মত ঝাঁপিয়ে, ক্যাথরিন তার হাল্কাপাতলা দেহটা খোলা স্থানটা দিয়ে আড়াআড়িভাবে মোচড়িয়ে বের করে নেয়। আধারের ভেতরে একটা হাত এগিয়ে আসে, তাকে আঁকড়ে ধরে ভিতরে টেনে আনতে। চেষ্টা করে। খোলা স্থানটা দিয়ে সে নিজেকে হেচকা টানে বের করে নেয়, তার পেছনে আশের উল্কিতে ঢাকা একটা নগ্ন হাত তাকে অনুসরণ করে। ভীতিকর বাহুটা ক্রুদ্ধ সাপের মত ছোবল দেয় চেষ্টা করে তাকে ধরতে।

পড পাঁচের বাইরের লম্বা ধুসর দেয়াল বরাবর ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্যাথরিন দৌড় শুরু করে। সে দৌড়াতে থাকলে এসএমএসসির পুরো চত্বরে ছড়ান পাথরকুচি তার খালি পায়ের স্টকিঙ ভেদ করে কেটে বসে যায় কিন্তু সেসব পাত্তা না দিয়ে সে প্রধান ফটক লক্ষ্য করে দৌড়াতে থাকে। বাইরেটা অন্ধকার কিন্তু পড পাঁচের গাঢ় অন্ধকারে চোখের মণি পুরোপুরি প্রসারিত থাকায়, সে নিখুঁতভাবে সব কিছু দেখতে পায়- যেন চারপাশে রাত না দিনের আলো। তার পেছনে, বের ভারী দরজাটা ঘড়ঘড় শব্দে খুলে যায় এবং সে ভবনের পাশ দিয়ে তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসা ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পায়। পায়ের গতি অসম্ভব দ্রুত।

আমি তার আগে কখনও প্রধান ফটকে পৌঁছাতে পারব না। সে জানে তার ভলভো কাছেই আছে, কিন্তু সেটাও একহিসেবে এখন অনেক দূরে। আমি হেরে যাচ্ছি।

তারপরেই ক্যাথরিনের মনে হয় এখনও শেষ একটা চাল বাকি আছে।

সে পড় পাঁচের কোনায় পৌঁছাতে পেছন থেকে আধারের মধ্যে তার দ্রুত এগিয়ে আসার পায়ের শব্দ শুনতে পায়। এখন অথবা কখনওই না। বাক ঘোরার বদলে, ক্যাথরিন হঠাৎ বামদিকে, ভবন থেকে উল্টো দিকে ঘুরে, ঘাসের ভিতরে নেমে আসে। ঘাসে নামবার সময়ে সে শক্ত করে নিজের চোখ বন্ধ করে রাখে, মুখ দুহাত দিয়ে ঢাকে এবং একেবারে অন্ধের মত লনের উপর দিয়ে দৌড়াতে থাকে।

গতি-সংবেদনশীল নিরাপত্তা আলো যা পড পাঁচের চারপাশে জ্বলে উঠে তা নিমেষে অন্ধকারকে দিনের আলোতে রূপান্তরিত করে। ক্যাথরিন তার পেছন থেকে ব্যথায় গুঙিয়ে ওঠার আর্তনাদ শুনতে পায় উজ্জ্বল ফ্লাডলাইটের আলো পঁচিশ মিলিয়ন মোমবাতির সমপরিমাণ উজ্জ্বলতা তার আক্রমণকারীর অন্ধকারে হাইপার-ডিলেটেড চোখের মণিকে ঝলসে দিয়েছে। পাথরের উপরে সে তার হোঁচট খাবার শব্দ শুনতে পায়।

ক্যাথরিন তার চোখ শক্ত করে বন্ধ করে রাখে, খোলা লনে নির্ভরতায় নিজেকে ছেড়ে দেয়। যখন সে অনুভব করে ভবনটা আর তার আলো থেকে যথেষ্ট দূরে এসেছে, সে চোখ খুলে, দিক ঠিক করে এবং অন্ধকারে পাগলের মত আবার দৌড়াতে থাকে।

তার ভলভোর চাবি ঠিক যেখানে রেখে গিয়েছিল সেখানেই সে খুঁজে পায়, কনসোলর মধ্যেখানে। কাঁপা কাঁপা হাতে সে হাপাতে হাপাতে চাবি নেয় এবং ইগনিশনে চাবি ঢুকায়। ইঞ্জিন গর্জে উঠে হেডলাইট জ্বলতেই সামনে একটা আতঙ্কিত দৃশ্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।

একটা বীভৎস ভয়ানক আঁকৃতি তার দিকে দৌড়ে আসছে।

ক্যাথরিন এক মুহূর্তের জন্য জমে যায়।

তার হেডলাইটের আলোতে ধরা পড়া জন্তুটা টাক মাথা খালি গায়ের একটা প্রাণী, তার পুরো ত্বক আশ, প্রতীক আর লেখায় আবৃত। উজ্জ্বলতার দিকে ধেয়ে আসার সময়ে সে হুঙ্কার দেয়, হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রাখে যেন কোন গুহাবাসী জন্তু জীবনে প্রথম সূর্যের দিকে তাকিয়েছে। ক্যাথরিন গিয়ারের খোঁজে হাত বাড়ায় কিন্তু ততক্ষণে সে পৌঁছে গেছে, কনুই দিয়ে পাশের জানালায় আঘাত করতে তার কোলে নিরাপদ কাঁচের এক ঝলক বৃষ্টি নেমে আসে।

একটা বিশাল আশ আবৃত হাত জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে, আধা অন্ধের মত হাতড়ে তার গলা খুঁজে নেয়। ক্যাথরিন গাড়ি পিছনে চালায়, কিন্তু আক্রমণকারী গলা আঁকড়ে থাকে, অমানুষিক শক্তিতে চাপ দেয়। সে তার হাতের নাগাল থেকে বাচতে মাথা ঘুরায় এবং সহসা দেখে সে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তিনটা গভীর দাগ, অনেকটা আঙ্গুলের খামচির মত, তার মুখের মেকআপ উঠিয়ে নীচের উল্কি উন্মোচিত করেছে। তার চোখের দৃষ্টি নির্মম আর বুনো।

দশ বছর আগে আমার উচিত ছিল তোমাকে হত্যা করা, সে গড়গড় করতে করতে বলে। যে রাতে আমি তোমার মাকে হত্যা করি।

তার শব্দগুলো মস্তিষ্কে বসতেই একটা ভয়াবহ স্মৃতি ক্যাথরিনকে আচ্ছন্ন করে তার চোখের সেই পাশবিক দৃষ্টি- ক্যাথরিন আগেও দেখেছে। সেই লোক? সাড়াশির মত গলার চারপাশে আঁকড়ে ধরা হাত না থাকলে সে হয়ত চিৎকার করে উঠত।

সে পায়ের পুরো ভর এক্সিলেটারের উপর চাপিয়ে দেয় এবং গাড়িটা লাফিয়ে উঠে পিছনে যায়, তার গাড়ির পাশে সেও হেচড়ে এগোলে আরেকটু হলে তার ঘাড়ই মটকে যাচ্ছিল। ভলভো কাত হয়ে একটা ঢালে উঠে এবং ক্যাথরিন টের পায় জানোয়ারটার ওজনের কাছে তার গলা হার মানতে যাচ্ছে। সহসা তার গাড়ির পাশে গাছের ডালপালা আঁচড় কাটে, পাশের জানালায় ঝাঁপটা দেয় এবং ওজনটা গলা থেকে নেমে যায়।

গাড়িটা সবুজ ঘাসের ভিতর দিয়ে উপরের পার্কিং লটে উঠে আসলে ক্যাথরিন ব্রেক করে। তার নীচে, অর্ধনগ্ন লোকটা তড়বড় করে উঠে দাঁড়ায়, তার হেডলাইটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ভীতিকর রকমের স্থিরতায় সে তার আশ আবৃত এক হাত তুলে সরাসরি তার দিকে নির্দেশ করে।

ক্যাথরিনের রক্তে উগ্র ঘৃণা আর ভয় একসাথে দাবড়ে বেড়ায় যখন সে হুইল ঘুরিয়ে গ্যাস পেডাল চাপ দেয়। নিমেষ পরে, সিলভার হিল রোড দিয়ে মাতালের মত টলতে টলতে তার গাড়ি এগিয়ে যায়।

.

৪৮ অধ্যায়

ক্যাপিটল পুলিশ অফিসার ন্যুনেজজের, সেই মুহূর্তের দাবীর কাছে নতি স্বীকার করে ক্যাপিটলের স্থপতি আর রবার্ট ল্যাংডনকে পালাতে সাহায্য করা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। এখন, অবশ্য, বেসমেন্টে পুলিশ সদর দপ্তরে ফিরে, ন্যুনেজজ দেখতে পায় চারপাশে দ্রুত মেঘ জমে উঠছে আসন্ন ঝড়ের সম্ভাবনায়।

চীফ ট্রেন্ট এনডারসন মাথায় বরফের প্যাক ধরে বসে আছে আর সাটোর কালশিটের পরিচর্যা করছে অন্য আরেকজন অফিসার। দুজনেই ভিডিও সার্ভেলেন্সের দলের সাথে দাঁড়িয়ে, ডিজিটাল প্লেব্যাক ফাইল দেখে ল্যাংডন আর বেল্লামিকে খোঁজার চেষ্টা করছে।

প্রতিটা হলওয়ে আর এক্সিটের ভিডিও চেক কর, সাটো দাবী করে। আমি জানতে চাই তারা কোন চুলায় গেছে!

ন্যুনেজজ তাকিয়ে থাকতে গিয়ে অসুস্থ বোধ করে। সে জানে এটা কেবল সময়ের ব্যাপার তাদের সঠিক ক্লিপ খুঁজে বের করাটা এবং সত্যটা জানার।

আমি তাদের পালাতে সাহায্য করেছি। পুরো ব্যাপারটা আরো জটিল করে। তুলেছে চারজনের সিআইএ ফিল্ড টিমের উপস্থিতি, তারা এখন নিকটেই দাঁড়িয়ে আছে, ল্যাংডন আর বোমিকে অনুসরন শুরু করার জন্য অপেক্ষা করছে। চারজনের সাথে ক্যাপিটল পুলিশের কোনই সাদৃশ্য নেই। লোকগুলোকে দেখেই বোঝা যায় পুরোদস্তুর সৈনিক…কালো কেমোফ্লেজ, নাইট ভিশন, ফিউঁচুারিস্টিক পিস্তল।

ন্যুনেজজের মনে হয় সে বমি করে দেবে। মন ঠিক করে, সে সবার চোখ এড়িয়ে চীফ এনডারসনকে ইশারা করে। চীফ একটা কথা ছিল?

তোমার আবার কি হল? এনডারসন ন্যুনেজজকে অনুসরণ করে হলে আসে।

চীফ, আমার দ্বারা একটা ভীষণ ভুল হয়ে গেছে, ঘেমে নেয়ে একাকার ন্যুনেজজ কোনমতে বলে। আমি দুঃখিত আর আমি পদত্যাগ করছি। কয়েক মিনিটের ভিতরে অবশ্য আপনিই আমাকে বরখাস্ত করবেন।

তোমার কথা বুঝতে পারলাম না?

ন্যুনেজজ ঢোক গিলে। আমি একটু আগেই স্থপতি বেল্লামি আর ল্যাংডনকে দর্শনাথী কেন্দ্র দিয়ে ভবনের বাইরে যেতে দেখেছি।

কি? এনডারসন গর্জে উঠে। কোন কথা বলছো না কেন?

স্থপতি আমাকে কোন কথা বলতে মানা করেছিল।

তুমি আমার অধীনে কাজ কর, আহাম্মক কোথাকার!এণ্ডারসনের কণ্ঠস্বর করিডোরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। বেল্লামি আমার মাথা দেয়ালে ঠুকে দিয়েছিল, যীশুর দিব্যি দিয়ে বলছি!

ন্যুনেজজ এণ্ডারসনের দিকে বেল্লামির দেয়া চাবিটা এগিয়ে দেয়।

এটা আবার কি? এনডারসন জানতে চায়।

স্বাধীনতা স্বরণীর নীচে অবস্থিত নতুন টানেলে প্রবেশের চাবি। স্থপতি বেল্লামির কাছে ছিল। তারা সেখান দিয়েই বের হয়ে গেছে।

নির্বাক হয়ে এনডারসন চাবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

জিজ্ঞাসু চোখে সাটো হলওয়েতে উঁকি দেয়। এখানে কিসের বৈঠক চলছে?

ন্যুনেজজ টের পায় তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এনভারসন এখনও চাবিটা ধরে আছে আর সেটা সাটো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। ভয়ঙ্কর দর্শন মহিলা কাছে আসতে, চীফকে বাঁচাতে নিজের বুদ্ধিতে যা কুলায় তাই করে ন্যুনেজজ। আমি সাববেসমেন্টের ফ্লোরে একটা চাবি খুঁজে পেয়েছি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করছিলাম যদি সে চাবিটা চিনতে পারে।

সাটো এগিয়ে এসে চাবিটা দেখে। আর চীফ কি সেটা জানে?

ন্যুনেজজ এণ্ডারসনের দিকে তাকিয়ে দেখে, সে কথা বলার আগে সম্ভাব্য সব কিছুমনে মনে বিবেচনা করে দেখছে। অবশেষে চীফ মাথা নাড়ে। সাথে সাথে কিছু বলতে পারছি না। আমাকে দেখতে হবে—

ওটা নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই, সাটো বলে। দশনার্থী কেন্দ্রের নীচে একটা টানেলে ঢোকার চাবি ওটা।

সত্যি? এন্ডারসন বলে। তুমি কিভাবে জানলে?

আমরা এই মাত্র সার্ভেলেন্স ক্লিপটা খুঁজে পেয়েছি। অফিসার ন্যুনেজজ বেল্লামি আর ল্যাংডনকে পালাতে সাহায্য করেছে এবং তারপরে তাদের বের করে দিয়ে দরজাটায় আবার তালা দিয়ে দিয়েছে। বেল্লামিই চাবিটা ন্যুনেজজকে দিয়েছে।

এনডারসন ন্যুনেজজের দিকে রক্তচক্ষু করে তাকায়। এসব কি সত্যি?!

ন্যুনেজজ জোরে মাথা নাড়ে এবং চেষ্টা করে কেবল নিজেকেই জড়াতে। আমি দুঃখিত স্যার। স্থপতি আমাকে বলেছিল কাউকে কিছু না বলতে।

স্থপতি কি বললো আমি তার মুখে মুতেদি! এনডারসন খেঁকিয়ে উঠে। আমি আশা—

চুপ, একদম চুপ থাক, ট্রেন্ট, সাটো গর্জে উঠে। তোমরা দুজনেই জঘন্য রকমের অপদার্থ মিথ্যেবাদী। সে এণ্ডারসনের কাছ থেকে স্থপতির দেয়া টানেলের চাবিটা ছিনিয়ে নেয়। তোমার এখানে আর কোন কাজ নেই।

.

৪৯ অধ্যায়

রবার্ট লাঙ্গডন সেলফোন বন্ধ করে, তার দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। ক্যাথরিন ফোন ধরছে না? ল্যাব থেকে নিরাপদে বের হয়ে এখানে তার সাথে দেখা করতে আসবার আগে ক্যাথরিন তাকে ফোন করবে বলেছিল কিন্তু সে ফোন করেনি।

রিডিং ডেস্কের সামনে বেল্লামি ল্যাংডনের পাশে এসে বসে। সেও এইমাত্র একটা ফোন করেছে, তার ফোনটার উদ্দেশ্য জনৈক ভদ্রলোক তার দাবী যে তাদের আশ্রয় দিতে পারবে-লুকিয়ে থাকবার একটা নিরাপদ স্থান। দুর্ভাগ্যবশত, সেই লোকও ফোন ধরছে না আর বেল্লামি তাই ম্যাসেজ রেখে। এসেছে, বলেছে যতদ্রুত সম্ভব ল্যাংডনের সেলে যেন সে ফোন করে।

আমি চেষ্টা করছি, সে ল্যাংডনকে বলে, কিন্তু এই মুহূর্তে আমরাই আমাদের সহায়। আর এই পিরামিডটার কি করা যায় সেটা আমাদের একটু আলোচনা করা উচিত।

পিরামিডটা। ল্যাংডনের চোখের সামনে থেকে রিডিং রুমের দর্শনীয় প্রেক্ষাপট উধাও হয়ে সেখানে কেবল তার সামনে যা আছে সেটাই ভাসতে থাকে- একটা পাথরের পিরামিড, একটা সীল করা প্যাকেট যার ভিতরে একটা ক্যাপস্টোন রয়েছে এবং একজন সৌম্য দর্শন আফ্রিকান আমেরিকান যিনি আক্ষরিক অর্থে অন্ধকার থেকে উদয় হয়ে সিআইএর নিশ্চিত জেরার হাত থেকে তাকে রক্ষা করেছে।

ক্যাপিটলের স্থপতির কাছে থেকে সে সামান্য হলেও মানসিক সুস্থতা সে আশা করেছিল কিন্তু কার্যত দেখা যায় যে বদ্ধ উন্মাদটা দাবী করছে পিটার শুদ্ধিক্ষেত্রের ফুলসিরাতে আছে ওয়ারেন বেল্লামির আক্কেলবোধ তারচেয়ে খুব। একটা বেশি না। বেল্লামি দাবী করে এই পাথরের পিরামিডটাই কিংবদন্তির ম্যাসনিক পিরামিড়। একটা প্রাচীন ম্যাপ? যা আমাদের শক্তিশালী জ্ঞানর পথে দিক নির্দেশনা দেয়?

মি. বেল্লামি,ল্যাংডন মার্জিত স্বরে বলে, একটা প্রাচীন জ্ঞান যা মানুষের ভিতরে অমিত শক্তির স্ফুরণ ঘটাতে সক্ষম এই ধারণাটাই…মানে আমি বিষয়টা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতেই পারছি না।

বেল্লামির চোখে একই সাথে নিরাশা আর আন্তরিকতা ফুটে উঠে, ল্যাংডনের সংশয়কে আরও বেশি বিব্রতকর করে তুলে। হ্যাঁ, প্রফেসর, তুমি হয়ত এভাবে ভাবতে পার সেটা আমার মনে হয়েছে কিন্তু আমার মনে হয় তাতে আমি বিস্মিত হইনি। তুমি একজন বহিরাগতের দৃষ্টিতে দেখছো। কিছু নির্দিষ্ট ম্যাসনিক বাস্ত বতা রয়েছে যা তোমার কাছে কিংবদন্তি বলে মনে হতে পারে কারণ যথাযথভাবে তোমার দীক্ষা হয়নি আর তাই সেটা বোঝার জন্য তুমি প্রস্তুত নও।

এখন, ল্যাংডনের মনে হয় তাকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। আমি কখনও ওডেসিয়াস নাবিকসঘের সদস্য ছিলাম না কিন্তু আমি ভাল করেই জানি সাইক্লপস একটা কিংবদন্তি। মি. বেল্লামি কিংবদন্তিটা যদি সত্যিও হয়…এই পিরামিডটার তার পরেও ম্যাসনিক পিরামিড হওয়া সম্ভব না।

না? বেল্লামি পাথরে খোদাই করা ম্যাসনিক গুপ্তলিপির উপরে হাত বুলায়। আমার কাছে মনে হয়েছে বর্ণনার সাথে এটার পুরোপুরি মিল আছে। একটা পাথরের পিরামিড যার শীর্ষে একটা চকচকে শিরোশোভা রয়েছে, সাটোর এক্স-রে অনুযায়ী পিটার ঠিক সেটাই তোমার জিম্মায় রেখেছিল। বেল্লামি ছোট চারকোনা প্যাকেটটা তুলে হাতে নিয়ে ওজন দেখে।

এই পাথরের পিরামিডটা এক ফুটেরও কম লম্বা, ল্যাংডন প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করে। আমি ম্যাসনিক পিরামিডের যতগুলো বর্ণনা শুনেছি সবগুলোতেই সেটাকে অতিকায় বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

বেল্লামি পরিষ্কারভাবেই যুক্তিটা আগে অনুমান করেছিল। তুমি হয়ত জানো, কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে এমন একটা পিরামিডের কথা যা এত উঁচু যে ঈশ্বর নিজে সেটা হাত বাড়িয়ে চাইলে স্পর্শ করতে পারেন।

ঠিক তাই।

আমি তোমার গ্যাড়াকলটা বুঝতে পেরেছি, প্রফেসর। অবশ্য, প্রাচীন রহস্যময়তা আর ম্যাসনিক দর্শন দুটোই আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে দেবত্বের সম্ভাবনার ব্যাপারে আশাবাদী। রূপক অর্থে বলতে গেলে, একজন দাবী করতে পারে যে একজন দীক্ষাপ্রাপ্ত মানুষের নাগালের ভিতরে সবকিছুই…দেবতার নাগালের ভিতরে রয়েছে।

কথার ফুলঝুড়ি সত্ত্বেও ল্যাংডন নিজের মতেই অনড় থাকে।

এমনকি বাইবেলেও স্বীকার করা হয়েছে, বেল্লামি বলে, আমরা যদি মেনে নেই, জেনেসিসে যেমনটা বলা হয়েছে, যে ঈশ্বর তার নিজের আদলে মানুষকে সৃষ্টি করেছে, তাহলে এটা যা ইঙ্গিত করে সেটাও আমাদের গ্রহণ করা উচিত- যে মানবজাতিকে ঈশ্বরের চেয়ে নিকৃষ্ট করে সৃষ্টি করা হয়নি। সূক ১৭:২০এ আমরা পাই, ঈশ্বরের রাজত্ব তোমার ভেতরেই রয়েছে।

আমি দুঃখিত, কিন্তু আমি এমন কোন খ্রিস্টানকে চিনি না যে নিজেকে ঈশ্বরের সমকক্ষ বলে মনে করে।

অবশ্যই না, বেল্লামি রূঢ় কণ্ঠে বলে। কারণ বেশিরভাগ খ্রিস্টানই এটা দুভাবেই চায়। তারা চায় গর্বিত ভঙ্গিতে ঘোষণা করতে যে তারা বাইবেলে বিশ্বাসী এবং সেই সাথে কঠিন বা যে অংশগুলো বিশ্বাস করতে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে সেগুলো ভুলে যেতে।

ল্যাংডন কোন উত্তর দেয় না।

যাই হোক, বেল্লামি বলে, ম্যাসনিক পিরামিডের প্রাচীন বর্ণনায় একে এতটাই লম্বা বলা হয়েছে যাতে ঈশ্বরও সেটা স্পর্শ করতে পারেন…আর এটাই বহুঁকাল ধরে এর আঁকৃতি সম্বন্ধে ভুল ধারণার সৃষ্টি করেছে। এর একটা সুবিধা আছে, তোমাদের মত বুদ্ধিজীবিরা পিরামিডকে কিংবদন্তি বলে দাবী করেছো আর সাধারণ মানুষ সেটা খোঁজার চেষ্টাও করেনি।

ল্যাংডন আবার পাথরের পিরামিডটার দিকে দেখে। আমাকে মাফ করবেন যে আমি আমি আপনাকে বিরক্ত করছি, সে বলে, আমি সবসময়েই ম্যাসনিক পিরামিড একটা মিথ ভেবে এসেছি।

তোমার কাছে ব্যাপারটা কি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়নি যে স্টোনম্যাসনদের তৈরী করা ম্যাপ তারা পাথরেই খোদাই করবে? পুরো ইতিহাসে, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সব উপদেশাবলী পাথরেই খোদাই করা হয়েছিল- এমনকি মোজেসকে দেয়া ঈশ্বরের ট্যাবলেট টেন কমাণ্ডমেন্টস আমাদের মানবিক আঁচরণ নির্দেশ করে।

আমি বুঝেছি কিন্তু এটার উল্লেখ করার সময়ে সবসময়েই লিজেণ্ড অব ম্যাসনিক পিরামিড বলা হয়েছে। লিজেরে মানে এটা পৌরাণিক।

হ্যাঁ, লিজেণ্ড, বেল্লামি মুচকি হাসে। আমার মনে হয় তুমি মোজেস যে সমস্যায় পড়েছিল ঠিক একই সমস্যায় পড়েছে।

আমি বুঝতে পারলাম না?

বেল্লামি প্রায় উৎফুল্ল চিত্তে চেয়ারে বসা অবস্থায় ঘুরে, ব্যালকনির দ্বিতীয় সারিতে তাকায় যেখানে অবস্থিত ষোলটা ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তুমি মোজেসকে দেখতে পাচ্ছ?

ল্যাংডন মাথা উঁচু করে গ্রন্থাগারের বিখ্যাত মোজেসের ভাস্কর্যের দিকে তাকায়। হ্যাঁ।

তার শিং আছে।

আমি সেটা জানি।

কিন্তু তুমি কি আসলেই জান কেন তার মাথায় শিং?

বেশিরভাগ শিক্ষকের মত ল্যাংডনও অন্য কারো লেকচার শুনতে পছন্দ করে না। তাদের মাথার উপরের মোজেসের শিং আছে যে কারণে ঠিক একই। কারণে মোজেসের হাজারো খ্রিস্টান প্রতিকৃতিতে শিং আছে- বুক অব এক্সোডাসের ভুল অনুবাদ। আসল হিব্রু পাণ্ডুলিপিতে বর্ণনা করা হয়েছিল মোজেসের karan obr panav আছে বলে- মুখের ত্বক যাতে আলো পড়লে জ্বলজ্বল করে-কিন্তু গোল বাধে যখন রোমান ক্যাথলিক চার্চ বাইবেলের স্বীকৃত ল্যাটিন অনুবাদ করার সময়ে, অনুবাদক মোজেসের বর্ণনার দফারফা। করে ছাড়েন, তিনি একে অনুবাদ করেন cornuta esset facies sua যার মানে তার মুখে শিং ছিল।সেই মুহূর্ত থেকে ভাস্কর আর চিত্রকরের দল প্রত্যাঘাতের ভয়ে যে বাইবেলের প্রতি তারা বস্তুনিষ্ট না মোজেসকে শিং বাগিয়ে আঁকতে শুরু করে দেয়।

এটা একটা সাধারণ ভুল, ল্যাংডন বলে। চতুর্থ শতকে সেন্ট জেরোমের হাতে ঘটে যাওয়া ভুল অনুবাদ।

বেল্লামিকে প্রসন্ন দেখায়। ঠিক তাই। ভুল অনুবাদ। আর ফলাফল…বেচারা মোজেস শিং বানিয়ে ইতিহাসকে ঢুস দিয়ে বেড়াচ্ছে।

ভুলক্রমে সংঘটিত কথাটা শুনতে ভালই লাগে। ল্যাংডন তার ছেলে বেলায় মাইকেলেঞ্জেলোর নারকীয় শিংযুক্ত মোজেস দেখে আতঙ্কিত হয়েছিল-রোমের শিকলাবৃত ব্যাসিলিকা অব সেন্ট পিটার্সের মূল আকর্ষণ।

আমি শিংঅলা মোজেসের উল্লেখ করছি, বেল্লাম বলে, বোঝাতে যে কিভাবে একটা শব্দ ভুল বোঝার কারণে পুরো ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারে।

আপনি মায়ের কাছে মামাবাড়ির গল্প করছেন, ল্যাংডন ভাবে, কয়েক বছর আগে প্যারিসে হাড়ে হাড়ে বিষয়টা বুঝেছি। স্যাঙগ্ৰেল: হলি গ্রেইল; স্যাঙরিয়েল: রয়েল ব্লাড।

ম্যাসনিক পিরামিডের ক্ষেত্রে, বেল্লামি বলতে থাকে, লোকজন একটা কিংবদন্তির কথা গুঞ্জনের মত শুনতে পায়। আর ব্যাপারটা তখনই সবার মাথায় আসে। দি লিজেণ্ড অব ম্যাসনিক পিরামিড শুনতে মিথের মত মনে হয়। কিন্তু এখানের লিজেণ্ড শব্দটা অন্যকিছু বোঝাচ্ছে। এটার ভুল মনে করা হয়। অনেকটাই টালিসমান শব্দের মত। সে হাসে। সত্য গোপনে ভাষা এক কুশলী কারিগর।

সেটা ঠিক আছে, কিন্তু আপনার একটা কথা বুঝতে পারছি না।

রবার্ট, ম্যাসনিক পিরামিডটা একটা ম্যাপ। এবং প্রতিটা ম্যাপের মত এর লিজেণ্ড রয়েছে- একটা সূচী যা বলবে কিভাবে মানচিত্রটা পাঠ করতে হবে। বেল্লামি চারকোণা প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দেখায়। তুমি বুঝতে পারছো না? এই শিরোশোভাটাই এই পিরামিডের লিজেণ্ড। এটাই সেই সূচী যা তোমাকে বলে দেবে কিভাবে পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে শক্তিশালী আর্টিফ্যাক্টের পাঠ কিভাবে করতে হবে…একটা মানচিত্র যা মানব জাতির মূল্যবান সম্পদ লুকিয়ে রাখার স্থানটা দেখিয়ে দেবে-সর্বকালের হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান।

ল্যাংডন ভাবুক বনে যায়।

আমি বিনয়ের সাথে স্বীকার করছি, বেল্লামি বলে, তোমার সুউচ্চ মাসনিক পিরামিড কেবল এটা …একটা মামুলি পাথর যার সোনার শিরোশোভা ঈশ্বরের স্পর্শ পাবার উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম। এতটাই উঁচু যে কেবল আলোকপ্রাপ্ত মানুষই হাত বাড়িয়ে এটা স্পর্শ করতে পারে।

কয়েক সেকেণ্ড দুজনের মাঝে নিস্তব্ধতা চাঁদরের মত ঝুলে থাকে।

ল্যাংডন একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পিরামিডটার দিকে তাকাতে একটা অপ্রত্যাশিত উত্তেজনা নিজের ভিতরে অনুভব করে। তার চোখ আবার ম্যাসনিক গুপ্তলিপির দিকে আবদ্ধ হয়। কিন্তু এই সংকেতটা…এটাকে এত সহজ মনে হয়…

সহজ?

ল্যাংডন মাথা নাড়ে। প্রায় যেকেউই এটার পাঠোদ্ধার করতে পারবে।

বেল্লামি হেসে ল্যাংডনকে কাগজ আর পেনসিল বের করে দেয়। তাহলে বোধহয় তোমার উচিত আমাদের আলোকিত করা?

ল্যাংডন সংকেতটা পড়তে অস্বস্তিবোধ করে কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এটাকে পিটারের বিশ্বাসের প্রতি একটা ফুলের আঘাতের সাথে। তুলনা করা চলে। তারচেয়ে বড় কথা, শিলালিপিতে যাই বলা থাকুক তার মনে হয় না যে সেটা কোন গোপন স্থানের কথা প্রকাশ করবে…ইতিহাসের অন্যতম সম্পদের কথা না হয় ছেড়ে দেয়া গেল।

বেল্লামির কাছ থেকে পেনসিলটা নেয় ল্যাংডন এবং গুপ্তলিপিটার দিকে তাকিয়ে সেটা দিয়ে নিজের চিবুকে আলতো করে ঠোকা দেয়। সংকেতটা এতটাই সোজা যে তার পেনসিলেরও প্রয়োজন নেই। কেবল ভুল যাতে না হয় সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে সে নিয়ম করে কাগজের উপরে ম্যাসনিক। গুপ্তলিপির পাঠোদ্ধারে সবচেয়ে সাধারণ সংকেত লেখে। সংকেতটা চারটা জালি নিয়ে গঠিত- দুটোতে ডট আছে বাকি দুটোতে ডট নেই- বর্ণমালা তাদের ভিতরে ক্রমঅনুসারে সাজান। বর্ণমালার প্রতিটা বর্ণ এখন অনন্য আঁকৃতির এনক্লোজার বা পেন খোয়াড়ে আবদ্ধ। প্রতিটা বর্ণের খোয়ারের আঁকৃতি বর্ণের সংকেতে পরিণত হয়েছে।

পুরো প্রক্রিয়াটা এতটাই সহজ যে বালখিল্যসুলভ অনেকটা।

The-Lost-Symbol-49

ল্যাংডন দুবার তার হাতের লেখা পরীক্ষা করে। পাঠোদ্ধারের সংকেত ঠিক আছে অনুভব করে, সে পিরামিডে খোদাই করা গুপ্তলিপির দিকে এবার মনোযোগ দেয়। পাঠোদ্ধার করতে এখন কেবল সংকেত লেখা কাগজের সাথে আঁকৃতি মিলিয়ে বর্ণটা কাগজে লিখতে হবে।

পিরামিডে খোদাই করা প্রথম চিহ্নটা দেখতে অনেকটা নিম্নমুখী তীর বা। পর্বে ব্যবহৃত পানপাত্রের মত। ল্যাংডন সংকেত লেখা কাগজে দ্রুত বর্ণটা খুঁজে বের করে, নীচের জালির উপরের অংশ আর আবদ্ধ বর্ণ এস।

ল্যাংডন এস লিখে।

পিরামিডের পরের প্রতাঁকের মধ্যে ডট দেয়া একটা বর্গক্ষেত্র যার ডান বাহু উধাও। সংকেত লেখা কাগজে দেখা যায় সেটার মধ্যবর্তী বর্ণ ও।

ল্যাংডন ও লেখে।

তৃতীয় প্রতীকটা একটা সাধারণ বর্গ, যার ভিতরে আবদ্ধ বর্ণ ই।

ল্যাংডন ই লেখে।

এস ও ই…

সে এভাবে লেখতে থাকে যতক্ষণ না পুরো গ্রিড শেষ হয়।

লেখা শেষ হতে সে অনুবাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা বিভ্রান্ত দীর্ঘশ্বাস সে ত্যাগ করে। মোটেই ইউরেকা বলার উপযুক্ত মুহূর্ত না।

বেল্লামির মুখে একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে। প্রফেসর তুমি হয়ত জান, প্রাচীন রহস্যময়তা কেবল সত্যিকারের আলোকপ্রাপ্তদের জন্য সংরক্ষিত।

ঠিক, ল্যাংডন ভ্রু কুচকে বলে। বোঝাই যাচ্ছে, আমি এর যোগ্য নই।

.

৫০ অধ্যায়

ল্যাঙ্গলিতে অবস্থিত সিআইএ সদর দপ্তরের অভ্যন্তরে বেসমেন্টে একটা অফিসে ম্যাসনিক গুপ্তলিপির এই মোলটা প্রতীক হাই- ওএস অ্যানালিস্ট নোলা কায়া। একা বসে দশ মিনিট আগে বস ইনউ সাটোর ই-মেইলে প্রেরিত ইমেজ পরীক্ষা করে।

এটা কি কোন ধরণের রসিকতা? নোলা জানে সেটা অবশ্য সম্ভব না; ডিরেকটর সাটোর রসিকতা জ্ঞান ভয়াবহ আর আজ রাতের ঘটনাবলী মোটেই রসিকতা বিষয় না। সিআইএর অভ্যন্তরে সব বিষয়ে নাক গলাবার অধিকারী অফিস অব সিকিউরিটির উচ্চমাত্রা নিরাপত্তা ছাড় পাওয়া নোলা ক্ষমতার আলো আধারির অন্ধিসন্ধি ভাল করেই জানে। কিন্তু গত চব্বিশ ঘন্টায় নোলা যা প্রত্যক্ষ করেছে, তা ক্ষমতাবান মানুষদের গোপন রহস্যের ব্যাপারে তার ধারণা আমূল বদলে দিয়েছে।

হ্যাঁ, ডিরেকটর, নোলা এখন ফোনটা কাঁধে রেখে সাটোর সাথে কথা বলে। শিলালিপিটা আসলেই ম্যাসনিক গুপ্তসংকেত। অবশ্য পাঠোদ্ধারকৃত ভাষ্য একেবারেই অর্থহীন। এটা দেখা যাচ্ছে একটা হাবিজাবি র‍্যানডম বর্ণমালার গ্রিড। পাঠোদ্ধারের দিকে সে তাকিয়ে থাকে।

The-Lost-Symbol-50

কিছু একটা নিশ্চয়ই বলা হয়েছে, সাটো জোর দিয়ে বলে।

সেটা দ্বিতীয় পর্যায়ের পাঠোদ্ধারের পরেই বলা সম্ভব যা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই।

কোন সম্ভাবনা? সাটো জানতে চায়।

এটা একটা গ্রিড বেসড ম্যাট্রিক্স, আমি তাই পরিচিত ভিগেনেরী গ্রিল, ট্রেলীস এবং আরো কিছু চেষ্টা করে দেখতে পারি কিন্তু কোন প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না বিশেষ করে যদি এটা একবার ব্যবহার যোগ্য সংকেতসূচী হয়ে থাকে।

দেখো যা তোমার সাধ্যে কুলায়। এবং তাড়াতাড়ি। আর এক্স-রেটার কি অবস্থা?

নোলা তার চেয়ারটায় ঘুরে দ্বিতীয় আরেকটা সিস্টেমের সামনে বসে, এখানে কারো ব্যাগের একটা সিকিউরিটি এক্স-রে দেখা যায়। সাটো ব্যাগের ভিতরে একটা ছোট বাক্সে অবস্থিত পিরামিড আঁকৃতির জিনিসটা সম্পর্কে তথ্য জানতে চেয়েছে। সাধারনত একটা দু ইঞ্চি লম্বা বন্তু জাতীয় নিরাপত্তার কোন বিষয় হতে পারে না যদি না সেটা সমৃদ্ধ পুটোনিয়ামে তৈরী না হয়ে থাকে। এই জিনিসটা সেটা না। এটা একই ধরণের চমকপ্রদ আরেকটা ধাতুর তৈরী।

ইমেজটার ঘণত্ব বিশ্লেষণ নিস্পত্তিমূলক, নোলা বলে। উনিশ দশমিক তিন গ্রাম প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে। নিখাদ সোনা। খবুই মূল্যবান।

আর কিছু?

আসলে হ্যাঁ, আরো আছে। সোনার পিরামিডের পৃষ্টদেশে ঘনত্ব স্ক্যান কিন্তু সামান্য অনিয়ম ধরতে পেরেছে। বোঝা গেছে সোনার উপরে লিপি খোদাই করা আছে।

সত্যি? সাটোর কণ্ঠে আশার ঝলক বোঝা যায়। কি লেখা আছে?

আমি এখনও সেটা বলতে পারছি না। খোদাইটা অসম্ভব হাল্কা। আমি ফিল্টার দিয়ে সেটাকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করছি কিন্তু এক্স-রে রেজুলিউশন খুব একটা ভাল না।

ঠিক আছে, চেষ্টা চালিয়ে যাও। কিছু পেলে আমাকে সাথে সাথে জানাবে।

ইয়েস ম্যাম।

আর, নোলা, সাটোর কণ্ঠ নিমেষে ভয়ঙ্কর শোনায়। গত চব্বিশ ঘন্টায় তুমি যা জেনেছো পাথরের পিরামিড আর সোনার শিরোশোভা সেসবের সাথেই সর্বোচ্চ মাত্রার নিরাপত্তা স্মারক প্রাপ্ত। তুমি কারো সাথে আলাপ করতে পারবে না। আমাকে তুমি সরাসরি রিপোর্ট করবে। আমি চাই বিষয়টা তোমার কাছে যেন স্পষ্ট থাকে।

অবশ্যই, ম্যাম।

বেশ, লক্ষী মেয়ে। আমাকে সবসময়ে কি হচ্ছে জানাতে থাকো। সাটো লাইন কেটে দেয়।

নোলা চোখ ডলে এবং ঝাঁপসা চোখে সামনের কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে তাকায়। গত ছত্রিশ ঘন্টা সে এক ফোঁটা ঘুমায়নি এবং সে ভাল করেই জানে এই বিপর্যয়ের সমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত কপালে ঘুম নেই।

সমাপ্তি যাই হোক না কেন।

.

ক্যাপিটল দর্শনার্থী কেন্দ্রে সেই সময়ে, কালো পোষাক পরিহিত সিআইএর চারজন ফিল্ড অপারেশন স্পেশালিস্ট সুড়ঙ্গের প্রবেশ মুখে দাঁড়িয়ে, শিকারী কুকুরের উৎসাহে হাল্কা আলোকিত পথে উঁকি দেয়।

সাটো ফোন বন্ধ করতে করতে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। ছেলেরা, স্থপতির চাবিটা তখনও তারা হাতে ধরা, সে তাদের সম্ভাষণ জানিয়ে বলে, তোমাদের মিশন প্যারামিটার পরিষ্কার হয়েছে?

ইতিবাচক, লিড এজেন্ট উত্তর দেয়। আমাদের টার্গেট দুটো। প্রথমটা একটা খোদাই করা পাথরের পিরামিড, আনুমানিক একফুট উঁচু। দ্বিতীয়টা একটা ছোট বর্গাকৃতি বাক্স, আনুমানিক দুই ইঞ্চি হবে জিনিসটা। দুটোই রবার্ট ল্যাংডনের ডেব্যাগে শেষবার দেখা গিয়েছে।

ঠিক আছে, সাটো বলে। এই দুটো জিনিসই দ্রুত উদ্ধার করতে হবে এবং অক্ষত অবস্থায়। কোন প্রশ্ন আছে?

বল প্রয়োগের প্যারামিটার?

বেল্লামি হাড় দিয়ে সাটোর কাঁধে আঘাত করায় জায়গাটা এখনও দবদব করছে। আমি যেমন বলেছি, জিনিস দুটো উদ্ধার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বুঝেছি। চারজন বিনাবাক্য ব্যায়ে ঘুরে দাঁড়ায় এবং সুড়ঙ্গের আধো আলোকিত পথের দিকে হাটা ধরে।

সাটো পেছনে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে তাদের সুড়ঙ্গের ভিতরে হারিয়ে যেতে দেখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *