পাগলা দাশু
মেয়েটা যে চোর নয় তা আমি জানি। এর আগেও ওকে একদিন ফুল চুরি করতে দেখেছি। তবে ফুল চুরি সত্যিকারের চুরির মধ্যে পড়ে না বলে আমি ওকে ধরিনি।
লিচুদের হারমোনিয়াম ফেরত দিয়েছি। লিচুর বাবা আমাকে পঁচিশটা টাকা দিয়ে বলেছেন বাকিটা পরে দেবেন।
পশুপতি সব খবরই রাখে। হারমোনিয়াম ফেরত দেওয়ার পরের দিন এসে এক গাল হেসে বলল, ও টাকা আর পেয়েছেন।
আমি বললাম, ওরা লোক খারাপ নয়।
আপনি ওদের কতটুকু চেনেন? আমি বহুকাল ধরে ওদের জানি।
কী জানেন?
জানি যে হারমোনিয়ামের টাকা আপনি ফেরত পাবেন। ওই যে পঁচিশটা টাকা ঠেকিয়েছে ওই ঢের। বরং আমাকে অর্ধেক দামে দিলেও আর তাকে টাকা উসুল হত।
আমি একটু সন্দিহান হই। কেন যেন মনেহটেকটি আমি সত্যিই পাবনা। তবুদৃঢ়স্বরে বলি, ওদের আত্মমর্যাদার বোধ বেশ টনটনে।
আপনি সবাইকেই ভাল দ্যাখেন। অভ্যেসটা খারাপ নয়। কিন্তু এটা ভালমানুষীর যুগ নয় কিনা। বলেই পশুপতি আচমকা জিজ্ঞেস করে, লিচুকে আপনার কেমন লাগে?
আমি একটু থতমত খেয়ে বলি, হঠাৎ একথা কেন?
কারণ আছে বলেই জানতে চাইছি। পশুপতি মিটিমিটি হাসে।
আমি পশুপতির মতলবটা বুঝতে না পেরে অস্বস্তি বোধ করে বলি, খারাপ কী? ভালই তো।
কচু বুঝেছেন।
তার মানে?
পশুপতি একটা খাস ফেলে বলে, বেশি ভেঙে বলতে চাই না তবে এবার থেকে লিচু বোধহয় আপনার কাছে একটু ঘন ঘন যাতায়াত করবে।
কেন?
যুবতী মেয়েদের দিয়ে অনেক কাজ উদ্ধার হয় কিনা। আপনি পাত্র হিসেবেও ভাল।
ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে আমি বিরক্ত হয়ে বলি, খোলসা করে বলুন তো! কাজ উদ্ধারের কথাটা কী?
দূর মশাই! এ তো আজকাল বাচ্চারাও বোঝে।
আমি বাচ্চাদেরও অধম।
পশুপতি কথাটা স্বীকার করে মাথা নাড়ল, সেটা মিথ্যে বলেননি। নইলে কেউ ভাঙা হারমোনিয়ামের জন্য দুশো টাকা দেয়। সে তো না হয় টাকার ওপর দিয়ে গেছে, কিন্তু এখন যে আপনার জীবন নিয়ে টানাটানি।
তার মানে?–আমি অবাক হই, একটু চমকেও যাই।
লিচুকে আপনার সঙ্গে ভজানোর তাল করেছে। লিচুর বাবা একটু গবেট বটে, কিন্তু মা অতি ঘড়েল। মতলবটা তারই।
বাজে কথা। ওরা ওরকম নয়।
পশুপতি মিটিমিটি হাসে। বলে, লিচুর মা তোক চেনে, যে মানুষ ভাঙা হারমোনিয়াম দুশো টাকায় কিনতে পারে সে কালো কুচ্ছিত মেয়েকেও বিনা পণে ঘরে তুলতে পারে। দুনিয়ায় কিছু বোকা লোক না থাকলে চালাকদের পেট চলত কী ভাবে?
আমি কথা খুঁজে না পেয়ে বলি, লিচু মোটেই কালো কুচ্ছিত নয়।
ও বাবা! তাহলে কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। পশুপতি খুব আহ্লাদের হাসি হেসে বলে, বলে কী! লিচু কালো কুচ্ছিত নয়? লিচুর মা সত্যিই লোক চেনে দেখছি!
আমি শ্লেষের হাসি হেসে বলি, আমি অত বোকা লোক নই।
না হলেই ভাল। সুপাত্ররা হচ্ছে উঁচু গাছের ফল। পাড়তে আঁকশি লাগে। মেহনত লাগে। শুধু লক্ষ রাখবেন যেন নজরটা ছোট করতে না হয়।
আপনার সন্দেহটা অমূলক। লিচু আমার কাছে অ্যাপ্রোচ করেনি।
পশুপতি বলল, এবার করবে, যাতে আপনি টাকার তাগাদাটা না করতে পারেন। আপনি মল্লিকবাবুর ভাইপো, তায় ভাল চাকরি করেন। লিচু যদি আপনাকে ভজাতে পারে তো হারমোনিয়ামের ফেরত-টাকাটাও ঘরে রইল। ভাল জামাইও জুটল।
যাঃ!
পশুপতি নিচু স্বরে বলল, আমি ওদের হারমোনিয়ামটার জন্য গতকালই পঁচাত্তর টাকা অফার দিয়ে এসেছি। কিন্তু ওদের নজর আপনি উঁচু করে দিয়ে এসেছেন। পঁচাত্তর শুনে বাড়িশুদ্ধ লোক হেসে উঠল। লিচুর মা এখন পৌনে দুশো হাঁকছে। যাক সে কথা। কাল ওই দরাদরির ফাঁকেই লিচুর মা বলে ফেলল, কর্ণবাবুর সঙ্গে লিচুকে বেশ মানায়। মনে হয় কর্ণবাবুরও লিচুকে পছন্দ।
আমি কথাটার মধ্যে খারাপ কিছু খুঁজে না পেয়ে বলি, তাতে কী হল?
এখনও কিছু হয়নি বটে, তবে সাবধান করে দিলাম। উঁচু গাছের ফল উঁচুতেই ঝুলে থাকবার চেষ্টা করবেন। টুক করে যার তার কোচড়ে খসে পড়লে না। আর একটা কথা।
কী?
টাকাটা যদিও ওরা দেবে না, তবু আপনি তাগাদা দিতেও ছাড়বেন না। আমার এক চেনা লোককে একবার পঁচিশটা টাকা ধার দিয়েছিলাম। মহা ধুরন্ধর লোক, ছ’ মাস ঘুরিয়ে কুড়িটা টাকা শোধ দিল, পাঁচটা টাকা আর দেয় না। ভেবেছিল কুড়ি টাকা পেয়ে ওই পাঁচটা টাকা বোধহয় আমি ছেড়ে দেব। আমি কিন্তু ছাড়িনি। প্রতি সপ্তাহে গিয়ে তার দোকানে দেখা করেছি, চা খেয়েছি, গল্প করেছি, উঠে আসবার সময় বলেছি, আমার সেই পাঁচটা টাকা কবে দেবেন? মনে মনে জানতাম, দেওয়ার মতলব নেই, তবু তাগাদা দেওয়াটা ধর্ম হিসেবে নিয়ে গেছি। শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছর পরে লোকটা তিতিবিরক্ত হয়ে শেষ পাঁচটা টাকা একদিন ঝপ করে দিয়ে ফেলল। তাই বলছি, লোককে তাগাদা দিতে ছাড়বেন না। দেনাদারকে তার দেনার কথা ভুলে যাওয়ার সুযোগ দিতে নেই। সবসময়ে তাগাদায় রাখলে সে তার অন্যমনস্কতা বা কুমতলব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।
আমি মাথা নেড়ে বলি, সে আমি পারব না।
পশুপতি খুব আন্তরিকভাবে বলে, কথাটা অন্যদিক দিয়ে ভেবে দেখুন। যদি আপনার টাকাটা ওরা মেরেই দেয় তবে সেটা তো ওদের পাপই হল? জেনেশুনে একটা লোককে পাপের ভাগী হতে দেওয়াটা কি ভাল? শক্ত কাজ কিছু তো নয়!
অগাদা দিতে আমার লজ্জা করবে। থাকগে টাকা।
পশুপতি স্নেহের সঙ্গে বলে, আপনি ভীষণ ছেলেমানুষ। একটু শক্ত-পোক্ত না হলে, চক্ষুলজ্জা-টজ্জা বাদ না দিলে এই মতলববাজদের দুনিয়ার টিকে থাকবেন কী করে? কী করতে হবে তা শিখিয়ে দিচ্ছি। বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে হিলকার্ট রোডে লিচুর বাবার সাইকেলের দোকানে বেড়াতে বেড়াতে গিয়ে হাজির হবেন। বৃষ্টি বাদলার কথা বলবেন, বাজার দরের কথা বলবেন, চলে আসবার সময় খুব আলতো করে বলে আসবেন, সেই হারমোনিয়ামের টাকাটার কথা মনে আছে তো? ব্যস, ওতেই হবে। শুধু মনে করিয়ে দেবেন মাঝে মাঝে।
আমি চুপ করে আছি দেখে পশুপতি মিটিমিটি হেসে বলল, দাসীর কথা বাসি হলে কাজে লাগে। একটা পরামর্শ দিয়ে রাখি। লিচু যদি বেশি মাখামাখি করতে আসে, আর আপনিও যদি ভজে যান, আর তারপর যদি কখনও ওর হাত থেকে বাঁচবার জন্য আঁকুপাঁকু করেন তাহলে মাঝে মাঝে লিচুকেও টাকার কথাটা বলবেন। প্রেম কাটানোর এমন ওষুধ আর নেই। টাকার তাগাদা হল হাতুড়ির ঘা, আর প্রেম হল ঠনঠুন পেয়ালা।
ব্যাপারটা এই পর্যন্ত হয়ে থেমে আছে। পশুপতির কথায় আমি গুরুত্ব দিইনি বটে কিন্তু ভারী একটা অস্বস্তি হচ্ছে সেই থেকে। গতকাল সকালেই লিচুর বাবা এসে ওঁদের বাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজোর নেমন্তন্ন করে গিয়েছিল। আমি যাইনি অস্বস্তিতে। নিজের ওপর আমার কোনও বিশ্বাস নেই। এই সেদিনও হারমোনিয়ামটা কিনতে গিয়ে আমার মন কনে কই, কনে কই’ বলে নাচানাচি জুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে আমার কমে তো ঠিক হয়েই আছে, কতকাল ধরে। কলকাতার হিদারাম বাঁড়ুজ্জে লেনের সায়ন্তনীই আমার সেই ভাবী কনে। তবু যে আমার মন মাঝে মাঝে দুর্বল হয় তার কারণ বোধ হয়, সায়ন্তনী আর আমার মাঝখানে কয়েকশো মাইলের মাঠ-ঘাট, জল-জঙ্গল, নদী-নালার দূরত্ব। তারপর উত্তরের এই হিমালয়-ঘেঁষা জায়গাটার দোষ আছে। প্রথম প্রথম এখানে এসে আমার কলকাতার জন্য মন কেমন করলেও ধীরে ধীরে এ জায়গার বাতাসে একটা গভীর বনজঙ্গলের মাতলা গন্ধ, উত্তরে ভোরের ব্রোঞ্জ রঙা পাহাড়ের ধীরে ধীরে রং পালটানো, উদাস আকাশ আমাকে নানা ব্যঞ্জন দিয়ে ধীরে ধীরে মেখে ফেলেছে। ছুটির দিনে নতুন নতুন পাহাড় আর জঙ্গল খুঁজতে গিয়ে এমন গভীর নির্জনতার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় যে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না। তাই ধীরে ধীরে কলকাতার কথা ভুলে যাচ্ছি। কলকাতার কথা মনে না পড়লে কিছুতেই সায়ন্তনীর কথাও মনে পড়ে না। আর যত সায়ন্তনীর কথা মনে না পড়ে তত আমি নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি।
আজকাল আমি নিয়ম করে রোজ সকাল বিকেল দু’ঘণ্টা করে কলকাতা আর সায়ন্তনীর কথা ভাবতে চেষ্টা করি। ঠিক পরীক্ষার পড়ার মতো করে। কিন্তু খারাপ পড়ুয়া যেমন বারবার ঘ্যান ঘ্যান করে মুখস্থ করেও পড়া ভুলে যায়, আমারও অবিকল সেই অবস্থা।
আজও ভোরবেলা উঠে আমি জানালা দিয়ে ব্রোঞ্জ রঙের পাহাড়ের দিকে চেয়েই বুঝলাম, ওই চুম্বক পাহাড় রোজই একটু একটু করে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার মগজ ধোলাই করছে। কলকাতাকে মনে হয় পিকিং বা আডেলেডের মতো দূরের শহর।
ফলে আজ সকালে আমি উঠে প্রথমে কিছুক্ষণ কলকাতার অলিগলি, আবর্জনা, ডবলডেকার, ট্রাম, মনুমেন্ট, ভিক্টোরিয়া আর হাওড়ার ব্রিজের ছবি ধ্যান করলাম। খুবই অস্পষ্ট ছায়া-ছায়া দেখাল। এরপর কিছুক্ষণ সায়ন্তনীর কথা ভাবতে গিয়ে আতঙ্কে আমার বুক হিম হয়ে গেল। কালও সায়ন্তনীর ছোট কপাল, থুতনি আর কানের বড় বড় লতি ধ্যানে দেখতে পেয়েছিলাম। আজ শুধু কপালটা ধ্যানে এল, বাকিটা একদম মনে পড়ল না। আগামীকাল যদি ধ্যানে সেই কপালটুকুও না আসে!
প্রাণপণে সেই কপালটাকেই যখন স্মৃতিতে ধরে রাখার চেষ্টা করছি তখনই ফটকে শব্দ। ফুলচোরের আগমন।
এই মেয়েটাকে আমি আগেও একবার ফুল চুরি করতে দেখেছি। কিছু বলিনি। আজও ভাবলাম কিছু বলব না। বাগান থেকে কিছু ফুল চুরি গেলে কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। আমার মনের বাগানের সব ফুলই যে চুরি হয়ে গেল! কলকাতা নেই, সায়ন্তনী নেই! তবু যে কী করে বেঁচে আছি!
জানালাটা ভেজিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে পড়ে রইলাম চোখ বুজে।
কিন্তু ফুলচোরের সাহস আজ মাত্রা ছাড়িয়েছে। আমার জানালার নীচে দোলনচাপার গাছের নরম ডগাগুলো ভাঙছে মটমট করে, গন্ধরাজের গাছে প্রায় ঝড় তুলল কিছুক্ষণ, তারপর চন্দ্রমল্লিকার ঝোপ মাড়িয়ে বাগানের পশ্চিমধারে কলাবতীর বনে ঢুকল মত্ত হাতির মতো।
এতটা সহ্য করা যায় না। তড়াক করে উঠে পড়লাম।
বাগানে যখন পা দিয়েছি তখন চারদিক বেশ ফরসা। সবই প্রায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গন্ধরাজ গাছের পাশে ফুলচোরকেও জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। এবং আশ্চর্যের কথা, ফুলচোরও আমাকে বড় বড় চোখে দেখছে। ভয় পাচ্ছে না, পালাচ্ছেও না।
চোর যদি চোরের মতো আচরণ না করে তবে যারা চোর ধরতে যায় তাদের বড় মুশকিল।
চোরের সঙ্গে চোখাচোখি হলে কী বলতে হয় তা ভেবে না পেয়ে আমি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম! যেন দেখিনি। একটু গলা খাকারি দিয়ে বুঝতে দিলাম যে, সে এখন চলে গেলে আমি কিছু বলব না।
কিন্তু ফুলচোর গেল না। বরং পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। আমি চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, ফুলচোর যথেষ্ট কাছে এসে গেছে।
ফুলচোর আমাকে অবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনিই কি পাগলা দাশু?
সত্য বটে, এখানকার চ্যাংড়া ছেলেরা আমার খ্যাপানো নাম রেখেছে পাগলা দাশু।
ফাজিল মেয়েটার দিকে আমি কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি, আপনাকে এর আগেও আমি একদিন এই বাগান থেকে ফুল চুরি করতে দেখেছি। কী ব্যাপার বলুন তো!
ফুলচের যথেষ্ট সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী। গন্ধরাজের বাগানে সে পঁড়িয়ে। পিছনে ব্রোঞ্জ রঙা পাহাড়, ফিরোজা আকাশ, গাছপালার চালচিত্র নিয়ে খুব ঢিলাঢালা ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যেন গোটা দুনিয়াটাই ওর। ডোনট কেয়ার গলায় বলল, ফুল দেখলেই আমার তুলতে ইচ্ছে করে যে! কী করব বলুন।
তা কথাটা মেয়েটার মুখে মানিয়েও গেল। সুন্দরীদের হয়তো সবই মানায়। বলতে নেই, ফুলচোর দেখতে বেশ। পেট-কোচড়ে এক কাড়ি ফুল থাকায় গর্ভিণীর মতো দেখাচ্ছিল বটে, কিন্তু সেই সামান্য অপ্রাসঙ্গিক জিনিসটা উপেক্ষা করলে ফুলচোরের যথেষ্ট ফরসা রং, লম্বাটে প্রখর শরীর, নরুন দিয়ে চাছা তীব্র সুন্দর মুখখানা রীতিমতো আক্রমণ করে। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে ওর দৃষ্টিতে দুঃখহীন অকারণ আনন্দের উজ্জ্বলতা। হয়তো ফুলচোর রোজ ভাল খায় এবং হজম করে। হয়তো বড় ঘরের মেয়ে। সম্ভবত কোনওদিনই ও রাতে দুঃস্বপ্ন দ্যাখে না। ভাল বরও ঠিক হয়ে গেছে কি? নইলে এমন উজ্জ্বলতা চোখে আসার কোনও কারণ নেই। আমার মন বেহায়া বেশরম রকমে নেচে উঠে বলতে লাগল, এই কি কনে? এই কি কনে?
ফুল তোলা নিয়ে বার্নার্ড শ-এর একটা বেশ জুতসই কথা আছে। এই মওকায় কথাটা লাগাতে পারলে হত। কিন্তু আমার কখনও ঠিক সময়ে ঠিক জিনিসটি মনে পড়ে না। এ বারেও পড়ল না। গম্ভীর হলে আমাকে চারলি চ্যাপলিনের মতো দেখায় জেনেও আমি যথাসাধ্য গম্ভীর হয়ে বললাম, ও।
মেয়েটা খুব ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল, রাগ করলেন?
বঙ্কিমের বিড়াল প্রবন্ধে একটা কথা আছে নাঃ দুধ আমার বাপেরও নয়, দুধ মঙ্গলার, দুহিয়াছে। প্রসন্ন। অতএব সে দুগ্ধে আমারও যে অধিকার, বিড়ালেরও তাই। সুতরাং রাগ করিতে পারি না। এই ব্যাপারেও তাই। ফুল গাছের, তুলেছে ফুলচোর। এ ফুলে আমার বা কাকার যে অধিকার, ফুলচোরেরও তাই।
বললাম, না, রাগ করার কী?
মনে মনে ভাবলাম, কোনও খেদি-পেঁচি এরকম চোখের সামনে দিনেদুপুরে পুকুরচুরির মতো ফুল চুরি করতে এলে এত সহজে আমি কঠিন থেকে তরল হতে পারতাম না। মনে হচ্ছিল সৌন্দর্যটা চোরদের একটা বাড়তি সুবিধে। ভাবলে, সৌন্দর্যটা সকলের পক্ষেই বেশ সুবিধাজনক। আদতে ওটা একটা ফালতু উপরি জিনিস। কেউ কেউ ওই ফালতু জিনিসটা নিয়েই জন্মায়, আর তারাই দুনিয়ার বেশির ভাগ পুরুষের মনোযোগ কজ্জা করে রাখে। যারা সমান অধিকার নিয়ে পৃথিবীতে বিস্তর মারদাঙ্গা, হামলা, আন্দোলন চালাচ্ছে তারা এ ব্যাপারটা বুঝতে চায় না। একজন সুন্দরীর যে অধিকার, একজন খেদি বা পেঁচি কোনওকালে সে অধিকার অর্জন করতে পারে না, প্রকৃতির নিয়মেই সমান অধিকার বলে কিছু নেই।
ফুলচোর করুণ মুখ করে বলল, তা হলে মাঝে মাঝে এ বাগানে ফুল তুলতে আসব তো! কিছু মনে করবেন না?
আমি বললাম, না, মনে করার কী?
বারবারই আমার মনে কী যেন পড়িপড়ি করেও পড়ছে না। সুন্দর বলে নয়, আমি ফুলচোরকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বার বার দেখছি অন্য কারণে। মুখটা চেনা। ভীষণ চেনা। এক্ষুনি চিনে ফেলব বলে মনে হচ্ছে, অথচ স্পষ্ট মনে পড়ছে না।
মেয়েটি বলল, পাগলা দাশু বলেছি বলে কিছু মনে করেননি তো! আপনার একটা পোশাকি নামও যেন শুনেছিলাম কার কাছে। লিচু? হ্যাঁ লিচুই বলছিল সেদিন। কী যেন!কানমলা না ওরকমই শুনতে অনেকটা–কী যেন!
আমি ফাজিল মেয়েদের ভালই চিনি। কোনও কোনও মেয়ে এ ব্যাপারটা নিয়েই জন্মায়। ফাজলামিতে তাদের ক্ষমতা এতই উঁচু দরের যে টক্কর দিতে যাওয়াটা বোকামি।
আমি বললাম, অনেকটা ওরকমই শুনতে। কর্ণ মল্লিক।
মেয়েটা আবার করুশ মুখ করল। বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ। কী যে ভুল হয় না মানুষের। লিচুকে আপনি চেনেন? আমার বন্ধু। খুব বন্ধু আমার। আপনি লিচুদের হারমোনিয়াম কিনেছিলেন, তাও জানি।
আমি দুঃখের সঙ্গে বললাম, হারমোনিয়াম ফেরত দিয়েছি।
তাই নাকি? ও মাঃ, ফুলচোর তার চোখ কপালে তুলে বলল, তা হলে কী হবে! গান শেখা ছেড়ে দিলেন বুঝি?
মাথা নেড়ে বলি, ঠিক তা নয়। তবে অনেকটা এরকমই। আসলে গান বোধ হয় আমার লাইন নয়।
করুণ মুখ করে ফুলচোর বলে, আমারও নয়। তবু শিখতে হচ্ছে, জানেন!
কেন?
বিয়ের জন্য। ফুলচোর খুব হেসে বলল, গান না জানলে বিয়েই হবে না যে!
ফাজলামি বুঝে আমি গম্ভীর হয়ে বলি, কারও কারও বিয়ের জন্য না ভাবলেও চলে।
হাতে ভাল পাত্র আছে বুঝি?
ব্যথিত হয়ে বলি, থাকলেই বা কী? সুন্দরীরা সুপাত্রের হাতে বড় একটা পড়ে না।
ফুলচোর হেসে ফেলে এবং গজদন্ত সমেত তার অসমান দাঁত দেখে আবার মন উথাল পাথাল করতে থাকে। একে আমি কোথায় দেখেছি! ভীষণ চেনা মুখ যে!
ফুলচোর বলল, আমার কিন্তু ভীষণ সুপাত্রের হাতে পড়ার ইচ্ছে। সেইজন্যই কোয়ালিফিকেশন বাড়াচ্ছি। সুপাত্রের খোঁজ পেলে আমার জন্য দেখবেন তো!
সেজোকাকা উঠে পড়েছে, টের পাচ্ছি! ভিতরবাড়িতে তার হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। কাকিমা কাল রাতে বোধ হয় ত্রিফলার জল দিতে ভুলে গেছেন। সেজোকাকা চেঁচিয়ে বলছেন, এখন সকালে কোষ্ঠ পরিষ্কার হবে কী করে? কোষ্ঠ পরিষ্কার না হলে দিনটাই যে মাটি!
সুন্দরীদের এইসব প্রসঙ্গ না শোনাই ভাল। তারা আলো আর বুলবুলির মতো জীবনের গাছে ডালে ডালে খেলা করবে। কোষ্ঠ পরিষ্কারের মতো বস্তুগত বিষয়ে তাদের না থাকাই উচিত।
আমি বললাম, আপনি এবার চলে যান। বেলা হয়েছে। আমার কাকা-কাকিমা উঠে পড়েছে।
ফুলচোর একটু ফিচকে হাসি হেসে কোচড়টা আগলে ফটকের দিকে যেতে যেতে মুখ ফিরিয়ে বলল, আবার দেখা হবে কিন্তু।
হবেই তো। আমি জানি, দেখা হবে! বললাম, নিশ্চয়ই, রোজ আসবেন!