॥ ৫ ॥
পরদিন ব্রেকফাস্ট শেষ করতে না করতে পুলক ঘোষালের কাছ থেকে গাড়ি নিয়ে লোক এসে গেল লালমোহনবাবুর জন্য। আগেরদিন রাত্রে ফেলুদার কাছ থেকে তালিম নিয়ে লালমোহনবাবু তাঁর সাড়ে তিন লাইন ডায়লগটা তৈরি করে নিয়েছিলেন। যে লোকটি তাঁকে নিতে এল সে বাঙালি, নাম নীতিশ সোম। সে বলল আজ প্রথম দিন তাই শুটিং আরম্ভ হতে হতে বারোটা হবে। কিন্তু লালমোহনবাবুর মেক-আপ আছে। তাই তাঁকে আগে প্রয়োজন। জামাকাপড়ের কথা পুলকবাবু আগেই বলে দিয়েছিলেন ফোন করে; লালমোহনবাবু নিজের কোট-প্যান্টই পরবেন, তবে কী রঙের সেটা এখনো ঠিক হয়নি, তাই তিনি সঙ্গে যা এনেছেন সবই নিয়ে যেতে হবে। আমিও যেতে চাই শুনে নীতিশবাবু বললেন, ‘আপনি বরং এগারটা নাগাত আসবেন। ততক্ষণে আমাদের তোড়জোড় প্রায় শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া আজ ত মহরৎ, তাই একটা ছোট অনুষ্ঠান আছে। সেটা এগোরাটায় এলে দেখতে পাবেন। আপনি দুপুরের লাঞ্চটাও না হয় আমাদের সঙ্গেই করবেন; হোটেল থেকে প্যাক্ড লাঞ্চ আসবে।’
সাড়ে আটটার মধ্যেই একটা সুটকেস নিয়ে দুগ্গা বলে লালমোহনবাবু বেরিয়ে পড়লেন।
আমি আর ফেলুদা নটা নাগাত হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আজ আমরা একটু জালাপাহাড় রোড দিয়ে হাঁটব। ফেলুদা বলল, ‘দার্জিলিং-এ এসে সকালটা হোটেলে বসে থাকার কোনো মানে হয় না।’
আজকের দিনটাও রোদ ঝলমল, উত্তরে কাঞ্চনজঙ্ঘা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ম্যালের বেঞ্চিতে লোক ভর্তি, কারণ পুজোয় অনেক চেঞ্জার এসেছে। আমরা ঘোড়ার স্ট্যাণ্ড ছাড়িয়ে জালাপাহাড় রোড দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। ফেলুদা সিগারেট খাওয়া অনেক কমিয়ে দিলেও ব্রেকফাস্টের পর একটা না খেয়ে পারে না। একটা চারমিনার ধরিয়ে দৃশ্য দেখতে দেখতেই আমাকে প্রশ্ন করল, ‘হালচাল কিরকম বুঝছিস?’
আমি বললাম, ‘এখন পর্যন্ত বিরূপাক্ষ মজুমদারকেই সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লোক বলে মনে হচ্ছে।’
‘সেটা ঠিক। অবিশ্যি তার একটা কারণ হচ্ছে যে একমাত্র এই ভদ্রলোক সম্বন্ধেই আমরা বেশ কিছু তথ্য জেনেছি, আর সেগুলো খুবই ইন্টারেস্টিং। যে লোক দিনে ঘুমোয় আর রাত্রে জাগে, যে তোক গরম গরম খবর কাগজ থেকে কেটে খাতায় সেঁটে রাখে, যে বলে যে তার জীবনে একটা রহস্য আছে কিন্তু সেটা সে প্রকাশ করতে চায় না, আর যে একটা মহামূল্য জিনিস সিন্দুকে না রেখে তার ঘরের তাকে রাখে, তাকে কোনোমতেই স্বাভাবিক মানুষের পর্যায়ে ফেলা চলে না।’
‘ওঁর ছেলে ত প্রায় কথাই বললেন না।’
‘হ্যাঁ। আমার কাছে ভদ্রলোককে বেশ রহস্যজনক বলে মনে হল। ভাবটা যেন বেশি কথা বললে কোনো রহস্য প্রকাশ পেয়ে যাবে, তাই সামলে চলছে।’
‘আর রজতবাবু?’
‘তোর কী মনে হল?’
‘মনে হল যে লোকটার চোখ খারাপ কিন্তু চশমা নেয়নি। একটা মোড়ায় ধাক্কা খেলেন দেখলে না?’
‘একসেলেন্ট! একদম ঠিক বলেছিস। চশমাটা হয়ত ভেঙেছে; আর মাইনাস পাওয়ার তাতে সন্দেহ নেই—অর্থাৎ দূরের জিনিস দেখতে পায় না, কাছের জিনিস পায়—তা নাহলে ঠিকঠিক খাতাগুলো আনতে পারত না।’
‘আর বম্বের হিরো আর ভিলেন?’
‘তোর কী মনে হয়? আজকে তোর পরীক্ষাই হোক।’
‘কাল একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম।’
‘কী?’
‘লালমোহনবাবু যখন নদু মল্লিকের পাখোয়াজের বোলটা বলছিলেন, তখন রায়না আর ভার্মা দুজনের ঠোঁটের কোণেই হাসি দেখা দিল।’
‘এটাও দুর্দান্ত বলেছিস।’
‘তার মানে কি ওরা বাংলা জানে?’
‘আসলে বম্বের ফিল্ম জগতে এত বাঙালি কাজ করে যে বাংলাটা অল্প বিস্তর অনেকেই বুঝতে পারে, বলতে না পারলেও।’
‘ওদের দুজনকে দেখে মিঃ মজুমদার একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন সেটা লক্ষ করেছিলে নিশ্চয়ই।’
‘তা ত বটেই।’
‘অবিশ্যি মিঃ মজুমদারের মনটা যেন মাঝে মাঝেই অন্যদিকে চলে যায়, তাই না?’
‘হ্যাঁ, লোকটা সবসময় যেন কিছু একটা ভাবছে। সেটা হয়ত বোঝা যাবে ওঁর সম্বন্ধে গুজবটা কী সেটা জানলে।’
আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা ঘোরার পর হোটেলে ফিরলাম। ফেলুদা বলল, ‘তুই আজ মনের আনন্দে শুটিং দেখিস; আমার কথা চিন্তা করিস না। আমি ভাবছি একবার অবজারভেটরি হিলের মাথায় গুম্ফাটা দেখে আসব।’
আমি ঠিক সময় সাড়ে এগারটায় বেরিয়ে কুড়ি-পঁচিশ মিনিটে নয়নপুর ভিলা পৌঁছে গেলাম। ফট ফট শব্দ শুনে বুঝলাম যে জেনারেটর চালু হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা যে কোথায় রাখা হয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম না। আমাকে দেখে ওদের দলের একজন এগিয়ে এসে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেল। এদিকটা বাড়ির দক্ষিণ দিক, এদিকে কাল আসিনি। একটা ঘরের মধ্যে কাজ হচ্ছে, সেখানে জোরালো স্টুডিওর আলো জ্বলছে। জানালা বন্ধ করে বাইরে থেকে দিনের আলো আসার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। বুঝলাম দৃশ্যটা বোধহয় রাত্রের দৃশ্য, যদিও তোলা হচ্ছে দিনের বেলা।
কিন্তু আমাদের জটায়ু কোথায়?
ওমা—ওই ত ভদ্রলোক! কিন্তু প্রথম দেখে একেবারেই চিনতে পারিনি—দাড়ি আর পরচুলায় চেহারা এত বদলে গেছে। দিব্যি ভিলেন-ভিলেন লাগছে ভদ্রলোককে। আমায় দেখতে পেয়ে চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে এসে বেশ ভারিক্কি চালে জিগ্যেস করলেন, ‘কী মনে হচ্ছে? চলবে?’
আমি ভদ্রলোকের চেহারার তারিফ করে বললাম, ‘আপনার কথাগুলো মনে আছে ত?’
‘আলবৎ!’ ভীষণ কনফিডেন্সের সঙ্গে বললেন ভদ্রলোক।
অন্য একটা সোফায় বসে মহাদেব ভার্মা। তাঁর গোঁফে চাড়া দিচ্ছিলেন। এবার পুলক ঘোষালের গলা পেলাম।
‘লালুদা!’
লালমোহনবাবু তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁর চেয়ারে বসলেন। আমি একটা সুবিধের জায়গা বেছে নিয়ে সেখান থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।
পুলক ঘোষাল এবার লালমোহনবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে হাত পা নেড়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন।
‘লালুদা, আপনি প্রথমে বুক পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে মুখে পুরবেন; সেই সঙ্গে মহাদেবও একটা সিগারেট মুখে পুরবে। তারপর আপনি পকেট থেকে দেশলাই বার করে মহাদেবের সিগারেটটা ধরিয়ে দেবেন, তারপর নিজের চুরুটটা ধরাবেন। তারপরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসবেন। তখন আমি “ইয়েস” বলব। তাতে আপনি চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে আপনার প্রথম কথাটা বলবেন। এর পরেই শট্ শেষ। এই শট্টা কিন্তু প্রধানত আপনারই শট। ক্যামেরা আপনারই মুখ দেখছে, আর মহাদেবের দেখছে পিঠ। বুঝেছেন?’
‘ইয়েস,’ বললেন লালমোহনবাবু। ‘তবে একটা কথা।’
‘বলুন।’
‘এ দেশলাইটা জ্বলবে ত?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। একেবারে টাট্কা। আজই সকালে কেনা।’
‘ভেরি গুড।’
মিনিটখানেক আরো আমড়াগাছির পর শট্ আরম্ভ হল। ক্যামেরা আর সাউণ্ড চালু হল, আর পুলকবাবু বলে উঠলেন, ‘অ্যাকশন!’
লালমোহনবাবু মুখে চুরুট পুরলেন ঠিকই, কিন্তু দেশলাইটা ধরাতে গিয়ে বারুদের দিকটা হাতে ধরে উল্টো দিকটা ঘষতে লাগলেন দেশলাইয়ের গায়ে। খচ্ খচ্ খচ্ খচ্—দেশলাই আর জ্বলে না, এদিকে ক্যামেরা চলেছে ঘড় ঘড় শব্দ করে।
“কাট, কাট!’ চেঁচিয়ে উঠলেন পুলক ঘোষাল। ‘লালুদা, আপনার বোধহয়—’
‘সরি ভাই, ভেরি সরি। এবার আর ভুল হবে না।’
দ্বিতীয়বার অবিশ্যি চুরুট আর সিগারেট ঠিকই জ্বলল, কিন্তু চুরুটে টানটা একটু বেশি মাত্রায় হওয়ায় লালমোহনবাবুর বিষম লেগে শট্টা নষ্ট হয়ে গেল, আর পুলক ঘোষালকে আবার চেঁচিয়ে বলতে হল, ‘কাট, কাট!’
তিনবারের বার আর কোনো ভুল না। ‘ও. কে.?’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন পুলক ঘোষাল, আর সকলে লালমোহনবাবুকে তারিফ করে হাততালি দিয়ে উঠল।
আশ্চর্য এই যে, আরো পাঁচ ঘণ্টা লালমোহনবাবুকে নিয়ে কাজ হল আর তার মধ্যে ভদ্রলোক একটাও ভুল করলেন না। এর মধ্যে অবিশ্যি ভদ্রলোককে দুবার বাথরুম যেতে হয়েছিল; সেটা শীতের জন্যও হতে পারে আবার নার্ভাসনেসের জন্যও হতে পারে। মোটকথা, পুলক ঘোষাল স্যাটিসফাইড।
‘কাল আবার সেম টাইমে লোক যাবে কিন্তু,’ বললেন পুলকবাবু।
‘লোক যাবার কোনো দরকার ছিল না ভাই,’ বললেন লালমোহনবাবু।
‘আমি এমনিই চলে আসতে পারতাম।’
‘না না, তা কি হয়?’ বললেন পুলকবাবু। ‘আমরা সকলের জন্যই লোক পাঠাই। ওটা আমাদের একটা নিয়ম।’
লালমোহনবাবুর মেক-আপ তুলতে লাগল দশ মিনিট, তারপর প্রোডাকশনের একটা জীপে করে আমরা আমাদের হোটেলে ফিরে এলাম।
নিজের ঘরে না গিয়ে আমাদের ডাবল রুমে এসে লালমোহনবাবু বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি ফেলুদাকে বলে দিলাম লালমোহনবাবুর কাজ খুব ভালো হয়েছে আর সকলে খুব তারিফ করেছে।
‘বাঃ, তাহলে আর কী,’ বলল ফেলুদা, ‘তাহলে ত বাজিমাৎ। একটা নতুন দিক খুলে গেল। এবার আর শুধু রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক নয়, চলচ্চিত্রাভিনেতাও বটে।’
লালমোহনবাবু এতক্ষণ চোখ বুজে পড়ে ছিলেন, হঠাৎ চোখ খুলে উঠে বসে ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, ‘দেখেছেন, আরেকটু হলে ভুলেই যাচ্ছিলাম। আপনাকে যে একটা অত্যন্ত জরুরী কথা বলার আছে।’
‘কী ব্যাপার?’
‘শুনুন মন দিয়ে। আজ দেড়টায় লাঞ্চ ব্রেক হয়েছে। আমি সেই ফাঁকে টুক্ করে একবার স্মল ওয়র্ক সারতে গিয়েছিলাম বাথরুমে। বাড়ির দক্ষিণে আমাদের কাজ হচ্ছে; সেদিকে বাথরুম আছে, কিন্তু তার ভেতর এরা শুটিং-এর যাবতীয় মালপত্তর রেখেছে; তাই আমাকে যেতে হল উত্তরদিকে—অর্থাৎ যেদিকে মিঃ মজুমদার থাকেন। প্রোডাকশনের একজন ছোকরাই আমাকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিল। আমি গেলুম। এটা একটা আলাদা বাথরুম, বেডরুমের সঙ্গে অ্যাটাচড্ নয়। আমি কাজ সেরে হাত ধুয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বাইরে এসেই কাছের কোনো একটা ঘর থেকে শুনি মিঃ মজুমদারের গলা। ভদ্রলোক কাকে যেন কড়া গলায় শাসনের সুরে বলছেন, “ইউ আর এ লায়ার; তোমার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না।” যদিও গলার স্বর চাপা, কিন্তু তাতে যে ঘোর বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
‘বাংলায় বললেন কথাটা?’
‘ঠিক আমি যেমন বললাম। প্রথম অংশ ইংরিজি, বাকিটা বাংলা।’
‘তার মানে ভদ্রলোক তখনো ঘুমোননি?’
‘না; কারণ কাল যখন লাঞ্চ ব্রেক হয় তখনও ভদ্রলোককে দক্ষিণের বারান্দায় দেখেছি। উনি শুটিং দেখতে এসেছিলেন। সকালে আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি দেড়টায় বড়িটা খান, তারপর ঘুমোন। আমি যখনকার কথা বলছি, তখন দেড়টা বেজে মিনিট সাতেক হয়ে গেছে।’
‘ভদ্রলোকের কথার উত্তরে অন্য লোকটি কিছু বললেন না?’
‘বলে থাকলেও সেটা এত চাপা গলায় যে আমি শুনতে পাইনি। আমার আবার তখন তাড়া—লাঞ্চ রেডি—তাই আর অপেক্ষা না করে চলে এলাম। কিন্তু মিঃ মজুমদারই যে কথাটা বলেছেন সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই।’
‘তার মানে হয় রজত বোস না হয় নিজের ছেলে সমীরণ মজুমদারকে বলেছেন কথাটা।’
লালমোহনবাবু হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে বললেন, ‘তবে একটা কথা কিন্তু বলতেই হবে মশাই। এই সব বোম্বাই অভিনেতাদের বিষয়ে যতকিছু শোনা যায়, আসলে তত কিছু নয়।’
‘এটা কেন বলছেন?’
‘লাঞ্চের পর রায়নার সঙ্গে একটা শট ছিল, সেটা ছোকরার ভুলের জন্য পাঁচবার করে নিতে হল। সামান্য ডায়ালগ, তবু বার বার ভুল করছে।’
‘ওরকম হয়েই থাকে,’ বলল ফেলুদা, ‘সেরা অভিনেতারও হঠাৎ হঠাৎ নার্ভ ফেল করতে পারে।’
সব শেষে জটায়ু বললেন, ‘যেটুকু নার্ভাসনেস ছিল আজ সম্পূর্ণ কেটে গেছে। আর কোনো ভাবনা নেই।’