পদ্ম প্রতীক্ষা করিয়াই বসিয়া ছিল।
প্রতীক্ষা করিয়া থাকিয়া অনেকদিন পর আজ আবার সে তৃপ্তি পাইয়াছে। একসময় অনিরুদ্ধের। জন্য প্রতীক্ষা করিয়া কতদিন সারারাত জাগিয়া থাকিত। তারপর আসিয়াছিল যতীন।
পদ্মের রিক্ত জীবনে যতীনের আসাটা যেন একটা স্বপ্ন। ছেলেটি হঠাৎ আসিয়াছিল। বিধাতা যেন ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছিলেন। ভাবিতেও বিস্ময় লাগে হঠাৎ থানার লোক আসিয়া তাহাদের একখানা ঘর ভাড়া লইল। কে নজরবন্দি আসিবে। তাহার পর আসিল যতীন।
অনিরুদ্ধের একখানা ঘর ভাড়া লইয়া পুলিশ-কর্তৃপক্ষ কলিকাতার এই ছেলেটিকে এই সুদূর পল্লীগ্রামের উত্তেজনাহীন আবেষ্টনীর মধ্যে আনিয়া রাখিয়াছিল। কর্তৃপক্ষ নিশ্চিন্ত হইয়া ভাবিয়াছিল বাংলার মুমূর্ষ সমাজের অসুস্থ নিশ্বাস ইহাদের অন্তরেও সংক্রামিত হইয়া পড়িবে। বর্ষার জলভরা মেঘের প্রাণদশক্তিকে নিষ্ফল করিবার জন্য মরুভূমির আকাশে পাঠাইয়াছিলেন যেন ক্রুদ্ধ দেবতা। কিন্তু একদিন দেবতা সবিস্ময়ে চাহিয়া দেখিলেন প্রাণশক্তি ব্যর্থ হয় নাই; ঊষর মরু-বুকে মধ্যে মধ্যে সবুজের ছোপ ধরিয়াছে, ওয়েসিস্ শিশু জাগিয়াছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন পল্লীগ্রামের তাপতৃষ্ণাময় নিরুদ্যম জীবনে এই রাজবন্দিগুলির প্রাণশক্তির স্পর্শে মরূদ্যানআবির্ভাবের মত নবজাগরণের আভাস ফুটিয়া উঠিতে আরম্ভ করিয়াছিল। দেখিয়া-শুনিয়া সরকার রাজবন্দিদের এই পল্লীনির্বাসন প্রথা তুলিয়া দিয়া তাহাদিগকে সরাইয়া লইলেন। বাংলাদেশের সরকারি রিপোর্টে এবং বাংলার রাজনীতিক ইতিহাসে এ তথ্য স্বীকৃত এবং সত্য।
সে কথা থাক্। পদ্মের কথা বলি। পদ্ম তখন অপ্রকৃতিস্থ ছিল। রাজবন্দি যতীনবাবুকে লইয়া পদ্ম কয়েকদিন পর প্রকৃতিস্থ হইয়াছিল, সে সাজিয়া বসিয়াছিল তাহার মা। মেয়েদের মা সাজিবার শক্তি সহজাত। তিন-চার বছরের মেয়ে যেমন তাহার সমান আকারের সেলুলয়েডের পুতুল লইয়া মা সাজিয়া খেলা করে তেমনি করিয়াই পদ্ম কয়েকদিন যতীনকে লইয়া খেলাঘর পাতিয়াছিল। যতীন আবার জুটাইয়াছিল এই গ্রামেরই পিতৃমাতৃহীন একটা বাচ্চাকে উচ্চিংড়েকে। উচ্চিংড়ে আবার আনিয়াছিল আর একটাকে সেটার নাম ছিল গোবরা।
দিনকতক খেলাঘর জমিয়া উঠিয়াছিল। হঠাৎ ঘরটা ভাঙিয়া গেল। পুলিশ-কর্তৃপক্ষ যতীনকে সরাইয়া লইতেই পদ্মর জীবনে আর এক বিপর্যয় আসিয়া পড়িয়াছে। তাহার একমাত্র আর্থিক সংস্থান ঘরভাড়া বন্ধ হইয়া গিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে উচ্চিংড়ে এবং গোবরাও পদ্মকে ছাড়িয়া পলাইয়াছে। কারণ আহারের কষ্ট সহ্য করিতে তাহারা রাজি নয়। জীবনে ইহারই মধ্যে তাহারা উপার্জনের পন্থা আবিষ্কার করিয়াছে। ময়ূরাক্ষীর ওপারের বড় রেলওয়ে জংশন-স্টেশন। ব্যবসায় সেখানে দিন-দিন সমৃদ্ধ হইয়া উঠিতেছে; মাড়োয়ারি মহাজনদের গদি বড় বড় ধানকল, তেল-কল, ময়দাকল, মোটর-মেরামতের কারখানা প্রভৃতিতে অহরহ টাকা-পয়সার লেনদেন চলিতেছে—বর্ষার জলের মত; মাঠের মাছের মত বন্যার জলের সন্ধান পাইয়া উচ্চিংড়ে ও গোবরা সেইখানে গিয়া জুটিয়াছে। কয়েকদিন ভিক্ষা করে; কয়েকদিন চায়ের দোকানে ফাই-ফরমাশ খাটে; কখনও মোটর সার্ভিসের বাস ধুইবার জন্য জল তুলিয়া দেয়; আর সুযোগ পাইলে গভীর রাত্রে স্টেশন-প্ল্যাটফর্মে ঘুমন্ত যাত্রীদের দুই-একটা ছোটখাটো জিনিস লইয়া সরিয়া পড়ে।
পদ্ম যে তাহাদের ভালবাসিয়াছিল, সেও বোধহয় তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে। কোনোদিন একবারের জন্যও তাহারা আসেও না। অনিরুদ্ধ জেলে। পদ্ম আবার বিশ্ব-সংসারে একা হইয়া পড়িয়াছে, ধীরে ধীরে তাহার মানসিক অসুস্থতা আবার বাড়িতেছিল। একা উদাস দৃষ্টিতে জনহীন বাড়িটার মাথার উপরের আকাশের দিকে চাহিয়া সে এখন নিথর হইয়া বসিয়া থাকে। মধ্যে মধ্যে খুটখাট শব্দ ওঠে। বিড়াল অথবা ইদুরে শব্দ করে; অথবা কাক আসিয়া নামে। সেই শব্দে দৃষ্টি নামাইয়া সেদিকে একবার চাহিয়া দেখিয়া এক টুকরা বিচিত্ৰ হাসিয়া আবার সে আকাশের দিকে চোখ তুলিয়া তাকায়। উদ্দিংড়ে-গোবরা যে পরের ছেলে, তাহারা যে চলিয়া গিয়াছে এ কথাটা তাহার মনে পড়িয়া যায়।
একমাত্র দুর্গা-মুচিনী তাহার খোঁজখবর করে। দুর্গা তাহাকে বলে, মিতেনী। এককালে স্বৈরিণী দুর্গা অনিরুদ্ধের সঙ্গে মিতে পাতাইয়াছিল; শ্লেষ এবং ব্যঙ্গ করিবার জন্যই পদ্মকে তখন সে মিতেনী বলিত। কিন্তু এখন সম্বন্ধটা হইয়া উঠিয়াছে পরম সত্য। দুর্গাই দেবু ঘোষকে পদ্মের সমস্ত কথা খুলিয়া বলিয়াছিল। বলিয়াছিল—একটা উপায় না করলে তো চলবে না জামাই!
দেবু চিন্তিত হইয়া উত্তর দিয়াছিল—তাই তো দুৰ্গা!
—তাই তো বলে চুপ করলে তো হবে না। তোমার মত লোক গাঁয়ে থাকতে একটা মেয়ে। ভেসে যাবে?
–কামার-বউয়ের বাপের বাড়িতে কে আছে?
–মা-বাপ নাই, ভাই-ভাজ আছে—তারা বলে দিয়েছে ঠাঁইঠুনো তারা দিতে পারবে না।
–তা হলে?
–তাই তো বলছি। শেষকালে কি ছিরু পালের–
–ছিরু পালের? দেবু চমকিয়া উঠিয়াছিল।
হাসিয়া দুর্গা বলিয়াছিল—ছিরু পালকে তো জান? ঢের দিন থেকে তার নজর পড়ে আছে। কামার-বউয়ের ওপর। ওর দিকে নজর দিয়ে আমাকে ছেড়েছিল সে। তাই তো আমি ইচ্ছে করে ওকে দেখাবার জন্যে অনিরুদ্ধের সঙ্গে মিতে পাতিয়েছিলাম।
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া দেবু বলিয়াছিল-খাওয়া-পরার কথা আমি ভাবছি না দুর্গা। একটি অনাথা মেয়ে, তার ওপর অনি-ভাই আমার বন্ধু ছিল, বিলুও কামার-বউকে ভালবাসত। খাওয়া-পরার ভার না হয় আমি নিলাম, কিন্তু ওকে দেখবে-শুনবে কে? একা মেয়েলোক
শুনিয়া লঘু হাস্য ফুটিয়াছিল দুর্গার মুখে।
দেবু বলিয়াছিলহাসির কথা নয় দুৰ্গা।
এ কথায় দুর্গা আরও একটু হাসিয়া বলিয়াছিল—জামাই, তুমি পণ্ডিত মানুষ। কিন্তু–
সহসা সে আপনার আঁচলটা মুখে চাপা দিয়া বেশ খানিকটা হাসিয়া লইয়া বলিয়াছিল এই সব ব্যাপারে আমি কিন্তু তোমার চেয়ে বড় পণ্ডিত।
দেবু স্বীকার করিয়া হাসিয়াছিল।
—পোড়ার মুখের হাসিকে আর কি বলব? বলিয়া সে হাসি সংবরণ করিয়া অকৃত্রিম গাম্ভীর্যের সঙ্গেই বলিয়াছিল—জান জামাই! মেয়েলোক নষ্ট হয় পেটের জ্বালায় আর লোভে। ভালবেসে নষ্ট হয় না—তা নয়, ভালবেসেও হয়। কিন্তু সে আর কটা? একশোটার মধ্যে একটা। লোভে পড়ে টাকার লোভে, গয়না-কাপড়ের লোভে মেয়েরা নষ্ট হয় বটে। কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, পণ্ডিত। তুমি তাকে পেটের জ্বালা থেকে বাঁচাও। কৰ্মকার পেটের ভাত রেখে যায় নাই, কিন্তু একখানা বগিদা রেখে গিয়েছে; বলত এ দা দিয়ে বাঘ কাটা যায়। সেই দাখানা পদ্ম-বউ পাশে নিয়ে শুয়ে থাকে। কাজ করে, কর্ম করে দাখানা রাখে হাতের কাছাকাছি। তার লেগে তুমি ভেবো না। আর যদি দেহের জ্বালায় সে থাকতে না পারে, খারাপই হয়, তা হলে তোমার ভাত আর সে তখন খাবে না। চলে যাবে।
দেবু সেই দিন হইতে পদ্মের ভরণপোষণের ভার লইয়াছে। দুর্গা দেখাশুনা করে। আজ। পদ্মের বাড়িতেই দুৰ্গা ময়দা কিনিয়া দিয়া দেবুর জন্য রুটি গড়াইয়া রাখিয়াছে।
খাবারের আয়োজন সামান্যই, রুটি, একটা তরকারি, দুই টুকরা মাছ, একটু মসুরকলাইয়ের ডাল ও খানিকটা গুড়। কিন্তু আয়োজনের পারিপাট্য একটু অসাধারণ রকমের। থালা-গেলাসবাটিগুলি ঝকঝক করিতেছে রুপার মত; ছেঁড়া কাপড়ের পাড়ের সুতা দিয়া তৈরি করা আসনখানি ভারি সুন্দর। তাহার নিজের হাতের তৈরি। কয়েকটি কচি পদ্মপাতা সুনিপুণভাবে
গোল করিয়া কাটিয়া জলের গেলাসের ঢাকা করিয়াছে, ডালের বাটিও পদ্মপাতায় ঢাকা; সব। চেয়ে ছোট যেটি সেটির উপর দিয়াছে একটু নুন, ইহাতেই সামান্য যেন অসামান্য হইয়া উঠিয়াছে; প্রথম দৃষ্টিতেই মন অপূর্ব প্রসন্নতায় ভরিয়া ওঠে। পদ্মের ঘরের দাওয়ায় উঠিয়া, শুচিশ্ৰদ্ধা-মাখা এই আয়োজন দেখিয়া দেবু বেশ একটু লজ্জিত হইল।
–আরে বাপ রে! মিতেনী এসব করেছে কি দুৰ্গাঃ।
দাওয়ার উপর এক প্রান্তে দুর্গা বসিয়া ছিল, সে হাসিয়া বলিল—আর বেলো না বাপু, নুন দেবে কিসে—এই নিয়ে ভেবে সারা। আমি বললাম একটু শালপাতা ছিঁড়ে তারই উপর দাও উঁহুঁ। শেষে এই রাত্তিরে গিয়ে পদ্মপাতা নিয়ে এল। তারপর ওইসব তৈরি হল।
পদ্ম খাবারের থালা নামাইয়া দিয়া, রান্নাঘরের দরজার পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। কথাগুলি শুনিয়া তাহার মাথাটা অবসন্ন হইয়া দেওয়ালের গায়ে হেলিয়া পড়িল, স্থির উদাস দৃষ্টিভরা বড় চোখ দুটিও মুহূর্তে বন্ধ হইয়া আসিল, দেহ মন যেন বড় ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে, চোখে স্বস্তির ঘুম জড়াইয়া আসিতেছে।
আসনে বসিয়া দেবুরও বড় ভাল লাগিল। বহুদিন—বিলুর মৃত্যুর পর হইতে এমন যত্ব করিয়া তাহাকে কেহ খাইতে দেয় নাই। গ্লাসে জল গড়াইয়া হাত ধুইয়া সে হাসিয়া বলিল–দুর্গা, বিলু যাওয়ার পর থেকে এত যত্ন করে আমাকে কেউ খেতে দেয় নাই।
দুর্গা দেবুকে কোনো জবাব দিল না, রান্নাঘরের দিকে মুখ ফিরাইয়া ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে বলিল—শুনছ হে মিতেনী, তোমার মিতে কি বলছে? ঘরের মধ্যে পদ্মের মুখে একটু হাসি ফুটিয়া উঠিল। দুৰ্গা দেবুকে বলিল—বেশ মিতেনী তোমার, জামাই! খেতে দিয়ে ঘরে ঢুকেছে। কি চাই—কোনটা ভাল হয়েছে, শুধোবে কেবল তো?
দেবু বলিলনা, না, আমার আর কিছু চাই না। আর রান্না সবই ভাল হয়েছে।
—তা হলেও এসে দুটো কথা বলুক। গল্প না করলে খাওয়া হবে কি করে?
–তুই বড় ফাজিল দুর্গা।
–আমি যে তোমার শালী গো!—বলিয়া সে হাসিয়া সারা হইল, তারপর বলিল—আমার হাতে তো তুমি খাবে না ভাই, নইলে দেখতে এর চেয়ে কত ভাল করে খাওয়াতাম তোমাকে।
দেবু কোনো উত্তর দিল না, গম্ভীরভাবে খাওয়া শেষ করিয়া উঠিয়া পড়িল; বলিল-আচ্ছা, এখন চললাম।
আলোটা তুলিয়া লইয়া দুর্গা অগ্রসর হইল। দেবু বলিল—তোকে যেতে হবে না, আলোটা আমাকে দে।
তাহার মুখের দিকে চাহিয়া দুৰ্গা আলোটা নামাইয়া দিল। বাড়ি হইতে দেবু বাহির হইতেই কিন্তু সে আবার ডাকিয়া বলিল—শোন জামাই, একটু দাঁড়াও।
দেবু দাঁড়াইয়া বলিল—কি?
দুর্গা অগ্রসর হইয়া আসিল, বলিল—একটা কথা বলছিলাম।
—বল।
–চল, যেতে যেতে বলছি।
একটু অগ্রসর হইয়া দুর্গা বলিল—কামার-বউকে কিছু ধানভানা কোটার কাজ দেখে দাও, জামাই। একটা পেট তো, ওতেই চলে যাবে। তারপর যদি কিছু লাগে তা বরং তুমি দিও।
ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া দেবু শুধু বলিল–হুঁ!
আরও কিছুটা আসিয়া দুর্গা বলিল—এ গলির পথে আমি বাড়ি যাই।
দেবু কোনো উত্তর দিল না। দুর্গা ডাকিল—জামাই!
–কি?
–আমার উপর রাগ করেছ?
দেবু এবার তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল–না।
–হুঁ, রাগ করেছ। রাগ যদি না করেছ তো কই হাঁস দেখি একটুকুন।
দেবু এবার হাসিয়া ফেলিল, বলিল—যা ভাগ।
কৃত্রিম ভয়ে দুর্গা বলিয়া উঠিল—বাবা রে! এইবারে জামাই মারবে বাবা! পালাই।–বলিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া এক-হাত কাচের চুড়িতে যেন বাজনার ঝঙ্কার তুলিয়া গলিপথের অন্ধকারের মধ্যে মিশিয়া গেল।
দেবু সস্নেহে একটু হাসিল। তারপর ধীরে ধীরে আসিয়া সে যখন বাড়িতে পৌঁছিল, তখন দেখে পাতু শুইতে আসিয়া বসিয়া আছে। দুর্গার দাদা পাতু মুচি দেবুর বাড়িতেই শোয়।
বিছানায় শুইয়াও দেবুর ঘুম আসিল না।
যাহাকে বলে খাঁটি চাষী, সেই খাঁটি চাষীর ঘরের ছেলে সে। রাপ তাহার নিজের হাতে লাঙল ধরিয়া চাষ করিত, কাঁধে করিয়া বাঁক বহিত, সারের ঝুড়ি মাথায় তুলিয়া গাড়ি বোঝাই করিত, ধানের বোঝ মাঠ হইতে মাথায় বহিয়া ঘরে আনিত, গরুর সেবা করিত। দেবুও ছেলেবেলায় ভাগের রাখালের পালে গরু দিয়া আসিয়াছে, গরুর সেবা সেও সে-সময় নিয়মিত করিত, চাষের সময় বাপের জন্য জলখাবার মাঠে লইয়া যাইত। তাহার বাপ জল খাইতে বসিলেবাপের ভারী কোদালখানা চালাইয়া অভ্যাস করিত; বাড়িতে কোদালের যাহা কিছু কাজকর্ম সে-বয়সে সেই করিয়া যাইত। তারপর একদা গ্রাম্য পাঠশালা হইতে সে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় বৃত্তি পাইল। পাঠশালায় পণ্ডিত ছিল ওই বৃদ্ধ, বর্তমানে দৃষ্টিহীন কেনারাম। কেনারামই সেদিন তাহার বাপকে বলিয়াছিল—তুমি ছেলেকে পড়তে দাও দাদা। ছেলে হতে তোমার দুঃখ ঘুচবে। দেবু যেমনতেমন বৃত্তি পায় নাই, গোটা জেলার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে। কঙ্কণার ইস্কুলে মাইনে লাগবে না, তার ওপর মাসে দু-টাকা বৃত্তি পাবে। না পড়লে বৃত্তিটা পাবে না বেচারি।…
কেনারাম কঙ্কণার স্কুলে তাহার মণ্ডল উপাধি বাদ দিয়া ঘোষ লিখাইয়া ছিল। তারপর প্রতিবারই সে ফার্স্ট অথবা সেকেন্ড হইয়া ফার্স্ট ক্লাস পর্যন্ত উঠিয়াছে। এই কালটির মধ্যে তাহার বাপ তাহাকে কোনো কাজ করিতে দেয় নাই। তাহার বাপ হাসিয়া তাহার মাকে কতবার বলিয়াছে—দেবু আমার হাকিম হবে। … দেবুও সেই আশা করিত।
কথাগুলো মনে করিয়া দেবু আজ বিছানায় শুইয়া হাসিল।
তারপর অকস্মাৎ বিনামেঘে বজ্ৰাঘাতের মত তাহার জীবনে নামিয়া আসিল জীবনের প্রথম দুর্যোগ, বাপ-মা প্রায় একসঙ্গেই মারা গেলেন। ফার্স্ট ক্লাস হইতেই দেবুকে বাধ্য হইয়া পড়া ছাড়িতে হইল। তাহাকে অবলম্বন করিতে হইল তাহার পৈতৃক বৃত্তি। হাল-গরু লইয়া বাপপিতামহের মত সে চাষ আরম্ভ করিল। তারপর পাইয়া গেল সে ইউনিয়ন বোর্ডের ফ্রি প্রাইমারি। পাঠশালার পণ্ডিতের পদটি। বেশ ছিল সে। শান্ত-শিষ্ট বিন্দুর মত স্ত্রী, পুতুলের মত খোকামণি, মাসিক বার টাকা বেতন, তাহার উপর চাষবাসের আয়। মরাইয়ের ধান, ভাঁড়ারে মাটির জালায় কলাই, গম, তিল, সরিষা, মষনে; গোয়ালে গাই, পুকুরে মাছ, দুই চারিটি আম-কঁঠালের গাছ, রাজার চেয়েও সুখ ছিল তাহার। অকস্মাৎ তাহার দুৰ্ম্মতি জাগিল। দুৰ্ম্মতিটা অবশ্য সে কঙ্কণার স্কুল হইতেই আয়ত্ত করিয়াছিল। পৃথিবীতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার দুৰ্ম্মতি স্কুল হইতে তাহাকে নেশার মত পাইয়া বসিয়াছিল। সেই নেশায়—সেটলমেন্টের কানুনগোর অন্যায়ের প্রতিবাদ করিতে গিয়া-কানুনগোর চক্রান্তে জেল খাঁটিল।
জেল হইতে ফিরিয়া নেশাটা যেন পেশা হইয়া ঘাড়ে চাপিয়া বসিয়াছে। নেশা ছাড়িলেও ছাড়া যায়, কিন্তু পেশা ছাড়াটা মানুষের সম্পূর্ণ নিজের হাতে নয়। ব্যবসা বা পেশা ছাড়িব বলিলেই ছাড়া যায় না; যাহাদের সঙ্গে দেনা-পাওনার সম্বন্ধ আছে তাহারা ছাড়ে না। চাষ যাহার পেশা; সে চাষ ছাড়িলে জমিদার বাকি খাজনার দাবি ছাড়ে না। জমি বিক্রয় হইয়া গেলেও খাজনার দায়ে অস্থাবরে টান পড়ে। সংসারে শুধু কি পাওনাদারেই ছাড়ে না? দেনাদারেও ছাড়ে না যে! মহাজন যদি বলে—মহাজনী ব্যবসা করিব না, তবে দেনাদারেরা যে কাতর অনুরোধ জানায়—সেও তো নৈতিক দাবি, সে-দাবি আদালতের দাবি হইতে কম নয়। আজ তাহারও হইয়াছে সেই দশা। আজ সংসারে তাহার নিজের প্রয়োজন কতটুকু? কিন্তু পাঁচখানা গ্রামের প্রয়োজন তাহার ঘাড়ে চাপিয়া বসিয়াছে।
ছাড়িয়া দিব বলিলে একদিকে লোক ছাড়ে না, অন্যদিকে পাওনাদার ছাড়ে না। তাহার পাওনাদার ভগবান। ন্যায়রত্ন মহাশয়ের গল্প মনে পড়িল; মেছুনীর ডালা হইতে শালগ্রাম-শিলা আনিয়াছিলেন এক ব্রাহ্মণ। সেই শিলারূপী ভগবানের পূজার ফলে ব্রাহ্মণ সংসারে নিঃস্ব হইয়াও শিলাটিকে পরিত্যাগ করেন নাই। ন্যায়রত্ন বলিয়াছিলেন, এই দুর্গত মানুষের মধ্যে যে ভগবান, তিনি ওই মেছুনীর ডালার শিলা। … তাহার বিলু গিয়াছে, খোকন গিয়াছে, এখন তাহাকে লইয়া তাহার অন্তর-দেবতা কি খেলা খেলিবেন তিনিই জানেন।
একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া দেবু মনে মনেই বলিল—তাই হোক ঠাকুর, দেখি। তোমার দৌড়টা কতদূর! স্ত্রী-পুত্র নিয়েছ, এখন পাঁচখানা গ্রামের লোকের দায়ের বোঝা হয়ে তুমি আমার মাথায় চেপে বসেছ! বস, তাই বস।…
বাহিরে মেঘ ডাকিয়া উঠিল। বর্ষার জলভরা মেঘের গুরুগম্ভীর ডাক। গাঢ় ঘন অন্ধকারের মধ্যে অবিরাম রিমিঝিমি বর্ষণ চলিয়াছে। বড় বড় ব্যাঙগুলা পরমানন্দে ডাক তুলিয়াছে। ঝিঝির ডাক আজ শোনা যায় না। এতক্ষণ দেবুর এ সম্পর্কে সচেতনতা ছিল না। সে চিন্তার মধ্যে ড়ুবিয়া ছিল। সে জানালার বাহিরের দিকে তাকাইল। বাহিরে ঘন অন্ধকার। কিছুক্ষণ পর সেই অন্ধকারের মধ্যে আলো ভাসিয়া আসিল। রাস্তায় কেহ আলো লইয়া চলিয়াছে। এত রাত্রে এই বর্ষণের মধ্যে কে চলিয়াছে? চলায় অবশ্য এমন আশ্চর্যের কিছু নাই। তবু সে ডাকিল—কে? কে যাচ্ছ আলো নিয়ে?
উত্তর আসিল—আজ্ঞে পণ্ডিত মশাই, আমরাই গো, আমি সতীশ।
–সতীশ?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। মাঠে একটা কাঠ বাঁধতে হবে। ভেবেছিলাম কাল বাঁধব। তা যে রকম দেবতা নেমেছে, তাতে রেতেই না বাঁধলে—মাটি-ফাটি সব খুলে চেঁচে নিয়ে যাবে।
সতীশ চলিয়া গেল, দেবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, নিতান্তই অকারণেই ফেলিল। সংসারে সবচেয়ে দুঃখী ইহারাই। চাষী গৃহস্থ তো ঘরে ঘুমাইতেছে, এই গরিব কৃষণেরা ভাগীদারেরা গভীর রাত্রে চলিয়াছে ভাঙন হইতে তাহাদের জমি রক্ষা করিতে। অথচ ইহাদিগকে খাদ্য হিসেবে ধান ধার দিয়া তাহার উপর সুদ নেয় শতকরা পঞ্চাশ। প্রথাটির নাম দেড়ী।
অন্ধকারের দিকে চাহিয়া দেবু ওই কথাই ভাবিতেছিল। আজ এই ঘটনাটি এই মুহূর্তে তাহার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। অথচ চাষীর গ্রামে এ অতি সাধারণ ঘটনা।
কিছুক্ষণ পর জানালার নিচে দাঁড়াইয়া ভয়ার্ত মৃদুস্বরে চুপি চুপি কে ডাকিল–পণ্ডিত মশাই! কণ্ঠস্বরে ভয়াৰ্ততার স্পর্শে দেবু চমকিয়া উঠিয়া বলিল—কে?
–আমি সতীশ।
–সতীশ? কি সতীশ?
–আজ্ঞে, মৌলকিনীর বটতলায় মনে হচ্ছে জমাট-বস্তী হয়েছে।
–জমাট-বস্তী? সে কি?
–আজ্ঞে হ্যাঁ। গাঁ থেকে বেরিয়েই দেখি মাঠের মধ্যে আলো, আজ্ঞে এই জলের মধ্যেও বেশ জোর আলো। লাল বরন আলো দপদপ করে জ্বলছে। ঠাওর করে দেখলাম, মৌলকিনীর পাড়ে বটতলায় মশালের আলো জ্বলছে।
জমাট-বস্তী—অর্থাৎ রাত্রে আলো জ্বালাইয়া ডাকাতের দলের সমাবেশ। দেবু দ্বার খুলিয়া বাহিরে আসিল, বলিল—তুমি ভূপাল চৌকিদারকে তাড়াতাড়ি ডাক দেখি।
—আপনি ঘরের ভেতরে যান পণ্ডিতমশায়। আমি এখুনি ডেকে আনছি।
দেবু অন্ধকারের দিকে চাহিয়া বলিল-আচ্ছা, তুমি যাও, শিগগির যাবে। আমি ঘরেই। দাঁড়িয়ে আছি।
সতীশ চলিয়া গেল, দেবু অন্ধকারের মধ্যেই স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। জমাট-বস্তী। বিশ্বাস নাই। বর্ষার সময় এখন গরিবদের ঘরে ঘরে অভাব-অনটন ঘনাইয়া উঠিয়াছে, তাহার। উপর আকাশে মেঘ, বর্ষণ রাত্রিকে দুর্যোগময়ী করিয়া তুলিয়াছে। চুরি-ডাকাতি যাহারা করে, সংসারের অভাব-অনটনে তাহাদের সুপ্ত আক্রোশ যখন এই হিংস্র পাপ-প্রবৃত্তিকে খোঁচা দিয়া জাগায়, তখন বহির্জগতের এই দুর্যোগের সুযোগ তাহাদের হাতছানি দিয়া ডাকে; ক্রমে তাহারা। পরস্পরের সহিত যোগাযোগ স্থাপন করে। তারপর একদিন তাহারা বাহির হইয়া পড়ে নিষ্ঠুর উল্লাসে। নির্দিষ্ট স্থানে আসিয়া একজন হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়া অদ্ভুত এক রুদ্র রব তুলিয়া ধ্বনিটাকে ছড়াইয়া দেয় স্তব্ধ রাত্রে দিদিগন্তরে। সেই সঙ্কেতে সকলে আসিয়া সমবেত হয় ঠিক স্থানটিতে; তারপর তাহারা অভিযানে বাহির হইয়া পড়ে। সে সময় তাদের মায়া নাই, দয়া নেই, চোখে জ্বলিয়া ওঠে এক পরুষ কঠিন বিস্মৃতিময় দৃষ্টিতখন আপন সন্তানকেও তাহারা চিনিতে পারে না; দেহে মনে জাগিয়া ওঠে এক ধ্বংসশক্তির দুর্বার চাঞ্চল্য। তখন যে বাধা দেয়, তাহার মাথাটা ছিঁড়িয়া লইয়া গেণ্ডুয়ার মত ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দেয় অথবা নিজেরাই মরে। নিজেদের কেহ মরিলে তাহারা মৃতের মাথাটা কাটিয়া লইয়া চলিয়া যায়।
কথাগুলো ভাবিতে ভাবিতে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া দেবু শিহরিয়া উঠিল। এখনি কোথায় কোন্ পল্লীতে হা-হা শব্দে একটা ভয়ানক অট্টশব্দ তুলিয়া উহারা ঝাঁপাইয়া পড়িবে। ভূপাল এখনও আসিতেছে না কেন? ভূপালের আসিবার পথের দিকে সে স্থির ব্যগ্ৰ দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। বর্ষণমুখর রাত্রি, একটানা ব্যাঙের ডাক, কোথায় জলে ভিজিয়া পেঁচা ডাকিতেছে। দুর্যোগময়ী রজনী যেন ওই নিশাচরদের মতই উল্লাসময়ী হইয়া উঠিয়াছে। পা হইতে মাথা পর্যন্ত তাহার শরীরে একটা উত্তেজনার প্রবাহ ক্রমশ তেজোময় হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু ভগবান তোমার পৃথিবীতে এত পাপ কেন? কেন মানুষের এই নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর প্রবৃত্তি? কেন তুমি মানুষকে পেট পুরিয়া খাইতে দাও না? তুমিই তো নিত্য নিয়মিত প্রতিটি জনের জন্য আহার্যের ব্যবস্থা কর! মহামারীতে, ভূমিকম্পে, জলোচ্ছাসে, অগ্নিদাহে, ঝড়ে তুমি নিষ্ঠুর খেলা খেল, তুমি ভয়ঙ্কর হইয়া ওঠ, বুঝিতে পারি; তখন তোমাকে হাতজোড় করিয়া ডাকি—হে প্ৰভু, তোমার এর রুদ্ররূপ সংবরণ কর। সে ডাক তুমি না শুনিলেও সে বিরাট মহিমময় রুদ্ররূপের সম্মুখে নিতান্ত অসহায় কীটের মত মরিয়া যাই, তাহাতে আক্ষেপ করিবার মত শক্তিও থাকে না। কিন্তু মানুষের এ ভয়ঙ্কর প্রকাশকে তো তোমার সে রুদ্ররূপ বলিয়া মানিতে পারি না। এ যে পাপ! এ পাপ কেন? কোথা হইতে এ পাপ মানুষের মধ্যে আসিল?
কিছুক্ষণ পর।
ভূপাল ডাকিল—পণ্ডিত মশাই!
–হ্যাঁ চল।–দেবু লাফ দিয়া পথে নামিল।
–হাঁক্ দোব পণ্ডিত?
–না, আগে চল, গ্রামের ধারে দাঁড়িয়ে দেখি, ব্যাপার কি!
—দাঁড়ান গো।–পিছন হইতে সতীশ বাউরি ডাকিল। সে তাহার পাড়ার আরও কয়েকজনকে জাগাইয়া সঙ্গে লইয়া আসিয়াছে।