০৫. পদ্মাবতীর অন্বেষণ
সবরমতী গিয়ে অনুত্তম দেখল আশ্রম তো নয় শিবির। সন্ন্যাসী তো নন সেনানায়ক। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঊনপঞ্চাশ বায়ুর মতো ছুটে আসছে ছোটো বড়ো সৈনিক। একই জ্বালা তাদের সকলের অন্তরে। পরাধীনতার জ্বালা, পরাজয়ের জ্বালা।
আবার কবে লড়াই শুরু হবে? কে জানে!
কত কাল আমরা অপেক্ষা করব? কে জানে!
তত দিন আমরা কী করব? গঠনের কাজ।
গঠনের কাজ কেন করব? না করলে পরের বারে সংঘর্ষে হার হবে।
পার্লামেন্টারি কাজ কেন নয়? তাতে জনগণের সঙ্গে সংযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে।
অনুত্তমের মনে সন্দেহ ছিল না যে গান্ধীজির নির্দেশ অভ্রান্ত। কিন্তু তার সহকর্মীদের অনেকে পরিবর্তনের জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিল। গঠনকর্মে তাদের মন নেই। তারা চায় পার্লামেন্টারি কর্মক্রম। নয়তো চিরাচরিত অস্ত্র। বন্দুক তলোয়ার বোমা রিভলবার। হিংসা।
জাতির জীবনে জোয়ার আছে, ভাটা আছে। জোয়ার আজ নেই বটে, কিন্তু কাল আবার আসবে। এ বিশ্বাস যদি হারিয়ে গিয়ে থাকে তবে গোড়ায় গলদ। সে গলদ সারবে না নির্দেশ পরিবর্তনে। সারবে, যদি বিশ্বাস ফিরে আসে। তখন জোয়ারের জন্যে ধৈর্য ধরতে হবে। ধৈর্যের সঙ্গে পালন করতে হবে সেনানায়কের নির্দেশ। অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। না করলে পরের বারও পরাজয়।
তিন দিন অনুত্তম গান্ধীজির সঙ্গে ছিল। লক্ষ করল তিনি যেমন জ্বলছেন আর কেউ তেমন নয়। আর সকলের জ্বালা বাইরে বিকীর্ণ হয়ে জুড়িয়ে যাচ্ছে, ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাঁর জ্বালা বাইরে আসতে পায় না, জ্বলতে জ্বলতে বাইরেটাকে খাক করে দেয়। বাইরের রূপ ভস্ম হয়ে গেছে, তাই তাঁকে সন্ন্যাসীর মতো দেখতে। আসলে তিনি সন্ন্যাসী নন, বীর। সীতা উদ্ধার করবেন বলে কৃতসংকল্প। তাই রামের মতো বল্কল পরিহিত কৌপীনবন্ত ফলাহারী জিতেন্দ্রিয়।
সবরমতী থেকে অনুত্তম নতুন কোনো নির্দেশ নিয়ে ফিরল না, কিন্তু তার অন্তর্জ্বালা আরও তীব্র হল। গান্ধীজি যেন তাকে আরও উজ্জ্বল করে জ্বালিয়ে দিলেন। অথচ জ্বলে ওঠা আগুন যাতে জুড়িয়ে না যায়, ফুরিয়ে না যায়, ধোঁয়ায় ঢেকে না যায়, সে সংকেত শেখাবেন। তাঁর পরামর্শে অনুত্তম পূর্ববঙ্গে শিবির স্থাপন করল।
ওদিকে জীবনমোহনের কাছে সে যা শিখেছিল তাও ভুলে গেল না। ধ্যান করতে লাগল সেই বিদ্যুৎপ্রভার যাকে দেখতে পাওয়া যায় শুধু দুর্যোগের রাত্রে। অন্য সময় তার অন্বেষণ করে কী হবে! পদ্মাবতীর অন্বেষণ দিনের পর দিন নয়। তার জন্যে প্রতীক্ষা করতে হয় ঝড়-বাদলের। যে পটভূমিকায় বিদ্যুৎবিকাশ হয়।
এই যে শিবির স্থাপন, এই যে গঠনের কাজ, এও তো সেই বিদ্যুৎপ্রভার জন্যে, তার স্ফূরণের উপযোগী পটভূমিকার জন্যে। এমনি করেই তো সে জনগণকে জাগাচ্ছে, আইন অমান্যের জন্যে তৈরি করছে, শাসকদের রাগাচ্ছে, ঝড়-বাদলকে ডেকে আনছে। ঝড় যদি আসে বিজলি কি আসবে না?
অনুত্তম বিশ্বাস করে যে তার সাধন ব্যর্থ হবে না। ঝড়ও ডাকবে, বিজলিও চমকাবে। সে প্রাণভরে দেখবে সেই দৃশ্য। তার দেখেই আনন্দ। আর কোনো আনন্দে কাজ নেই। বিদ্যুতের সঙ্গে ঘর করা কি সত্যি সত্যি সে চায় নাকি! বিদ্যুতের বিদ্যুৎপনা যদি মিলিয়ে যায় তা হলে তার সঙ্গে বাস করায় কী সুখ? আর যদি নিত্যকার হয় তা হলেও সুখ বলতে যা বোঝায় তা কি সম্ভবপর? সুখের স্বপ্ন অনুত্তমের জন্য নয়। দাম্পত্য সুখের স্বপ্ন। তা বলে আনন্দ থাকবে না কেন জীবনে? থাকবে সাক্ষাতে পরিচয়ে সহযোগিতায়। থাকবে অশরীরী প্রেমে।
ত্যাগী কর্মী বলে অনুত্তমের যশ ছড়িয়ে পড়ল। সন্ন্যাসী বলে শ্রদ্ধা করল কত শত লোক। কিন্তু অন্তর্যামী জানলেন যে সে সাধু নয়, বীর। ত্যাগী নয়, প্রেমিক। কর্মী নয়, সৈনিক। তার জীবনদর্শনে নারীর স্থান আছে। সে নারী সামান্য মানবী নয়, চিরন্তনী নারী, সে কোথায় আছে কে জানে! কিন্তু আছে কোথাও! না থাকলে সব মিথ্যা। এই কর্মপ্রয়াস, এই বিষয়বিরাগ, এই পল্লি অঞ্চলে স্বেচ্ছানির্বাসন।
অনুত্তম সারা দিন খাটে আর সব আশ্রমিকের মতো। সন্ধ্যার পর যখন ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে, কেরোসিনের দাম জোটে না, তখন একে একে সকলের সুনিদ্রা হয়। তার হয় অনিদ্রা। রাত কেটে যায় আকাশের দিকে চেয়ে। প্রসন্ন আকাশ। শান্ত আকাশ। তারায় তারায় ধবল। এই একদিন কাজল হবে মেঘে মেঘে। মেঘের কালো কষ্টিপাথরে সোনার আঁচড় লাগবে। বিজলির সোনার। তখন চোখ ঝলসে যাবে, চাইতে পারবে না। তবু প্রাণ ভরে উঠবে অব্যক্ত আবেগে। বন্দে প্রিয়াং।
হায়! ১৯২৫ সালের আকাশে মেঘ কোথায়! কিংবা ১৯২৬ সালের আকাশে! অনুত্তমের মনে হল ১৯২৭ সালের আকাশে মেঘ করে আসছে, কিন্তু সে কেবল বাক্যের ঘনঘটা। তার চরম দেখা গেল ১৯২৮-এর আকাশে। কলকাতা কংগ্রেসে তুমুল উত্তেজনার মধ্যে এক বছরের চরমপত্র দেওয়া হল। এই এক বছর অনুত্তম অনুক্ষণ আকাশের দিকে চাতকের মতো তাকিয়ে কাটাল, হ্যাঁ, মেঘ দেখা যাচ্ছে বটে। এবার হয়তো বিদ্যুৎ দেখা দেবে।
বছর যেন আর ফুরোয় না। চলল অনেক দিন ধরে শাসকদের মুখ চাওয়া, কী তাঁরা দেন না দেন। ইংল্যাণ্ডে লেবার পার্টির জয় হল। আশাবাদীরা আশা করলেন এইবার ভারতের কপালে শিকে ছিঁড়বে। কিন্তু যা হবার নয় তা হল না। অনুত্তম হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে তো বিনা দ্বন্দ্বে স্বাধীনতা চায় না। চায় দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে। শুনতে চায় বজ্রের গর্জন, দেখতে চায় বিদ্যুতের ফণা। ইংল্যাণ্ড যদি দয়া করে কিছু দেয় তা হলে তো সব মাটি। এত দিনের প্রতীক্ষা নিষ্ফল।
সেইজন্যে ৩১ ডিসেম্বর রাত যখন পোহাল অনুত্তমের মুখ ভরে গেল হাসিতে। বিদায় ১৯২৯ সাল। বিদায় শান্তি স্বস্তি আরাম। স্বাগত ১৯৩০। স্বাগত দ্বন্দ্ব দুঃখ পদ্মিনীর দর্শন। আকাশ মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে। বজ্রের আর কত দেরি? বিদ্যুতের?
মার্চ মাসে গান্ধীজি ডান্ডি যাত্রা করলেন। লবণ সত্যাগ্রহ মানসে। অনুত্তম চুপ করে বসে থাকবার পাত্র নয়। আশ্রমিকদের তাড়া দিয়ে বলল, এত দিন আমরা জনগণের নুন খেয়েছি, নিমকের ঋণ শোধ করি চলো।
চলল তারা সদলবলে লবণ সত্যাগ্রহ করতে। কাছে কোথাও সমুদ্র ছিল না। যেতে হল চট্টগ্রাম। অনেক দূরের পথ। পায়ে হেঁটে যেতে মাসখানেক লাগে। পথের শেষে পৌঁছোবার আগে খবর এল চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুঠ হয়েছে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরকারের সংগ্রাম চলছে। রোমাঞ্চকর বিবরণ। কেউ বলে, চট্টগ্রামের ইংরেজরা জাহাজে করে পালিয়ে গেছে। কেউ বলে, পালাবার পথ বন্ধ। বিদ্রোহীরা রেল স্টিমার টেলিগ্রাফ দখল করে ফেলেছে। ইংরেজরা এখন জেলে। কেউ বলে, একে একে কুমিল্লা নোয়াখালি সব বিদ্রোহিদের হাতে চলে যাবে। দ্বিতীয় সিপাহিবিদ্রোহ!
অনুত্তম বিস্ময়ে হতবাক হল। দ্বিতীয় সিপাহিবিদ্রোহ? সিপাহিরা যোগ দেবে তা হলে? কই, এমন তো কথা ছিল না? গণ সত্যাগ্রহ কি তা হলে সিপাহিবিদ্রোহের অর্গল খুলে দিতে! কেন তবে অহিংসার উপর এত জোর দেওয়া? অনুত্তম ঘন ঘন রোমাঞ্চবোধ করল। কী হবে লবণ আইন ভঙ্গ করে! সিপাহিদের বলো বিদ্রোহী হতে। ভারতময় যদি সিপাহিবিদ্রোহ ঘটে, এক প্রান্তের ঢেউ চার প্রান্তে পৌঁছোয় তা হলে তো দেশ স্বাধীন।
কিন্তু আশ্রমিকদের মধ্যে ভয় ঢুকল। চট্টগ্রামের দিকে কেউ এগোতে চায় না। গ্রামের লোক ভয়ে আশ্রয় দেয় না। ভিক্ষা দেয় না। পুলিশ আসছে শুনে তারা তটস্থ। অনুত্তম আশ্চর্য হল তাদের মনোভাব দেখে। কেউ তারা বিশ্বাস করবে না যে বিদ্রোহীরা জিতবে, সরকার হারবে। ইংরেজ রাজত্ব কোনোদিন অস্ত যাবে এ তারা ভাবতেই পারে না। দাদাবাবুরা যাই বলুন মহারানির নাতি কখনো গদি ছাড়বে না, কারও সাধ্য নেই যে তাকে গদি থেকে হটায়।
আশ্রমিকরা একে একে আশ্রমে ফিরে গেল। সেখান থেকে আর কিছু করে জেলে যাবে। জেলে যাওয়াটাই যেন লক্ষ্য। কিন্তু অনুত্তমের মনে কাঁটা ফুটল। না, তা তো লক্ষ্য নয়। দেশ জয় করাটাই লক্ষ্য। আমাদের দেশ আমরা জিনে নেব। চট্টগ্রামের বিদ্রোহীরা দেখিয়ে দিয়েছে কেমন করে তা সম্ভব।
ভিতরে ভিতরে সে অধীর হয়ে উঠেছিল তার পদ্মাবতীর জন্যে। গণ সত্যাগ্রহ চলছে চলুক। সঙ্গে সঙ্গে চলুক সশস্ত্র বিদ্রোহ। এমনি করে গগন সঘন হবে। হাওয়া উঠবে। তুফান আসবে। বাজ পড়বে। বিজলি ঝলকাবে। ভয় কীসের! এই তো সুযোগ। শুভদৃষ্টি এমনি করেই ঘটবে। ঘটনা! ঘটনা! ঘটনার পর ঘটনা! ঘটনাই তার কাম্য।
অনুত্তম একা চট্টগ্রামের দিকে পা বাড়াল। কী ঘটছে সে নিজের চোখে দেখবে। সম্ভব হলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করবে।
কিন্তু তাকে বেশি দূর যেতে হল না। খবর এল বিদ্রোহীরা হেরে গেছে। রেল স্টিমার টেলিগ্রাফ সরকারের হাতে ফিরে গেছে। ইংরেজরা এখন বেড়াজাল দিয়ে বন্দি করছে যাকে পাচ্ছে তাকে। গ্রামকে গ্রাম তাঁবু দিয়ে ছাওয়া। সেখানে ইংরেজ সৈন্য, ইংরেজের পুলিশ। হা ভগবান! তারা আমাদেরই দেশের লোক।
অনুত্তম শুনল ইংরেজ দারুণ অত্যাচার করছে। করবেই তো। এবার তার হাতে চাবুক। তার দয়াধর্মের কাছে মায়াকান্না কেঁদে কী হবে! যারা দেশ জয় করে নেবার স্পর্ধা রাখে তারা অত সহজে কাকুতিমিনতি করে কেন? যারা যুদ্ধে নেমেছে তারা কি সব জেনেশুনে নামেনি? তা হলে কি বলতে হবে ওই কয়টি মাথাপাগলা যুবক ভুল করছে?
চট্টগ্রামে পৌঁছে অনুত্তম দেখল সকলে প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে তারা এর মধ্যে নেই, তারা জানতই না যে এ-রকম কিছু ঘটবে বা ঘটতে পারে, তারাও বিস্ময়ে থ হয়ে গেছে। ইংরেজ সে-কথা শুনবে কেন? তার বিশ্বাস ভেঙে চুরমার। হিন্দুকে সে আর বিশ্বাস করে না। মুসলমানই তার একমাত্র আশা ভরসা। ওই বিদ্রোহের নিট ফল হল হিন্দু-মুসলমানে মন কষাকষি। কারণ এক জনের যাতে শাস্তি আরেকজনের তাতে পুরস্কার।
কী যে করবে অনুত্তম কিছুই বুঝতে পারল না। ব্যথায় তার বুক টনটন করছে, রক্ত ঝরছে কলিজা থেকে। ইচ্ছা করলেই কারাগারে গিয়ে শাস্তি পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা হবে বিপদ থেকে পলায়ন। না, সে পালাবে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাবে। চট্টগ্রামেই সে তার দাঁড়াবার জায়গা করে নিল। সন্ত্রস্তদের বলল, ভয় কী? আমি আছি।
রইল তার গণসত্যাগ্রহ, রইল তার পদ্মাবতীর অন্বেষণ। একেবারে ভুলে গেল যে পদ্মাবতী বলে কেউ আছে ও তার দেখা পাওয়া যায় এমনি দুর্যোগে। তার বেলা দুর্যোগই সুযোগ।
সন্ধ্যার পরে বাইরে যাওয়া বারণ। ‘কারফিউ’ চলছে। অনুত্তম পারমিট চাইতে পারত, কিন্তু তাতে অপমানের মাত্রা বাড়ত। চুপচাপ বাড়ি বসে থাকতেও ভালো লাগে না, মনে হয় কী যেন একটা কর্তব্য ছিল বাইরে। অভ্যাসমতো তকলি নিয়ে বসে, সুতো কাটে। কিন্তু তাতেও আগের মতো আস্থা নেই। হায়! সে যদি গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে মরতে পারত।
এই যখন তার মনের অবস্থা তখন তাকে ডাক দিল তার বন্ধু সরিৎ। সেও চট্টগ্রামে এসেছে আর একটা দল থেকে। সে পুলিশের মার্কামারা লোক, কাজেই গা-ঢাকা দিয়েছে। কে জানে কী তার কাজ। অনুত্তম তার সঙ্গে দেখা করতেই সে বলল, ‘তোর সাহায্য না পেলে চলছে না। খুশি মনে রাজি না হলে কিন্তু চাইনে। ভয়ানক ঝুঁকি। পদে পদে বিপদ।’
অনুত্তম তো মরতে পারলে বাঁচে। মরার চেয়ে কী এমন ঝুঁকি থাকতে পারে।
‘হ্যাঁ, তার চেয়েও ভয়ানক ঝুঁকি আছে। ধরা পড়লে ওরা এমন যাতনা দেবে যে পেটের কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। তা হলে ধরা পড়বে আর সকলে। ধরা পড়লে তুই সায়ানাইড খেতে রাজি আছিস?’
অনুত্তম ক্ষণকাল অবাক হয়ে ভাবল। বলল, ‘রাজি।’
‘কী জানি, বাবা! তোরা অহিংসাবাদী। শেষকালে বলে বসবি তোর বিবেকে বাধছে।’
অনুত্তম তাকে আশ্বাস দিল। ধরা পড়লে বেঁচে থাকতে তার রুচি ছিল না।
‘তা হলে আজকেই তুই তৈরি হয়ে নে। কারফিউ অমান্য করেই তোকে আজ রাত্রে আমার সঙ্গে দেখা করতে হবে সংকেতস্থানে। আমি তোর সঙ্গে একজনকে দেব। তাকে কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে তোর ছুটি। কী করে পৌঁছে দিবি সেটা তোর মাথাব্যথা। আমার নয়। মনে রাখিস, ধরা পড়ার ঝুঁকি প্রতি পদে। গোয়েন্দায় ছেয়ে গেছে এ জেলা। আমি হলে মৌলবি সাহেব সাজতুম।’
অনুত্তম তার গুরুদায়িত্বের জন্যে অবিলম্বে প্রস্তুত হল। সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র নিল না। নিল পটাসিয়াম সায়ানাইড। কয়েক বছর হল সে দাড়ি কামানো ছেড়ে দিয়েছিল। তাই তাকে দেখাত মৌলবির মতো। মুসলমানি পোশাক জোগাড় করে সে পুরোদস্তুর মৌলবি বনে গেল। চট্টগ্রামে প্রচলিত কেচ্ছা পুঁথি এককালে তার পড়া ছিল। এক বস্তানি পুঁথি, একটা বদনা, একটা ব্যাগ ও তার সেই বিখ্যাত নীল চশমা তার সম্বল হল। এই নিয়ে সে সন্ধ্যার পর অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ল।
এতিমখানার কাছে একটি গাছের আড়ালে সরিৎ লুকিয়েছিল, তার সঙ্গে ছিল আরও একজন। অনুত্তম অন্ধকারেও নীল চশমা পরেছিল, তবু তার ঠাহর করতে এক লহমাও লাগল না যে ওই আর একজনটি মেয়ে। তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মেয়ে! সন্ন্যাসী না হলেও তার সন্ন্যাসীসুলভ সংস্কার ছিল। তার সেই সংস্কার তাকে বলল, দেখছ কী! দৌড় দাও। দৌড়োতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরো, সেও ভালো। কিন্তু এ যে মেয়ে!
সরিৎ তার হাতে একতাড়া নোট গুঁজে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। মেয়েটির নাম পর্যন্ত বলে গেল না। পরিচয় দেওয়া দূরের কথা। এমন অদ্ভুত অবস্থা কেউ কখনো কল্পনা করেছে? অনুত্তম তো করেনি। তার কাজ তা হলে এই মেয়েটিকে পুলিশের নজর বাঁচিয়ে কলকাতা নিয়ে যাওয়া। কিন্তু ওদিকে যে হিন্দুর মেয়েকে অপহরণ করার অভিযোগে মৌলবি সাহেবের কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়া পড়বে। পা দুটো যে একটু একটু কাঁপছিল না তা নয়। কেন যে মরতে মৌলবি সেজে এল!
অন্ধকারে অমন একটা জায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। অত্যন্ত দুঃসাহসের সঙ্গে অনুত্তম বলল, ‘আমার নাম শা মুহম্মদ রুকনুদ্দিন হায়দার এছলামাবাদী। আপনার নাম যদি কেউ পুছ করে জওয়াব দেবেন মুসম্মৎ রওশন জাহান। কেমন? বোঝলেন?’
মেয়েটি বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘হ্যাঁ নয়। জি হ্যাঁ।’
‘জি হাঁ।’
এক অপরিচিতা নারী, বোরখায় তার সর্বাঙ্গ ঢাকা। ভিতর থেকে তার চোখ দু-টি জুল-জুল করছে আঁধার রাতে জোনাকির মতো। কে জানে তার বয়স কত! পনেরো না পঁচিশ না পঁয়ত্রিশ। তবে কথার সুর থেকে অনুমান হয় একুশ-বাইশ হবে। এতদিন কি কেউ অবিবাহিতা থাকে? হয়তো বিধবা। সধবা যে নয় তাই বা কী করে বোঝা যাবে?
তবু চলতে চলতে অনুত্তম বলল, ‘কেউ পুছলে এ ভি বলবেন কি আমি আপনার খসম।’
‘জি হাঁ’।
অনেক ঘুরে-ফিরে মিলিটারি পেট্রোল এড়িয়ে ছিপে ছিপে ওরা চলল। চলল শহর ছাড়িয়ে, মাঠের আইল ধরে, গোরুর গাড়ির হালট ধরে, গোপাট ধরে, গ্রামের লোককে না জাগিয়ে, চৌকিদারকে দূরে রেখে। অনুত্তম আগে আগে, রওশন তার পিছন পিছন।
রাত যখন পোহাল তখন ওরা চাটগাঁ ও সীতাকুন্ডুর মাঝামাঝি একটা রেলস্টেশনের কাছাকাছি এসে পড়েছে। অনুত্তম অন্যমনস্ক ছিল। রওশন বলল, ‘দেখবেন সামনে জল।’
‘সামনে জল নয়। ছামনে পানি।’
‘জি হাঁ। ছামনে পানি।’
মেয়েদের ওয়েটিং রুমে রওশনকে বসিয়ে অনুত্তম গেল টিকিটের খোঁজে। ট্রেনের তদারকে। কলকাতার টিকিট চাইলে পাছে সন্দেহ করে সেই জন্যে বলল, কুমিল্লার টিকিট। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সেদিকে যাবার ট্রেন পাওয়া গেল। তখন মেয়েদের কামরায় বিবিকে উঠিয়ে দিয়ে মৌলবি সাহেব উঠলেন যেখানে সবচেয়ে বেশি ভিড়। বলাবাহুল্য থার্ড ক্লাসে।
ফেনীতে কিছু হেনস্তা হতে হল বিবিকে দেখতে গিয়ে। একচোট অন্যান্য বিবিদের হাতে, একচোট তাদের খসমদের হাতে, শেষে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। তওবা তওবা করে নিজের জায়গায় ফিরে যেতে হল। লাকসামে যখন গাড়ি দাঁড়াল অনুত্তম দেখল রওশনের কামরা খালি হয়ে যাচ্ছে। তার নিজের কামরাও। তখন সে চট করে বেরিয়ে গিয়ে ফরিদপুরের টিকিট কেটে নিয়ে এল। রওশনকে বলল, ‘শোনছেন? এ গাড়ি চাঁদপুর যাবে না। গাড়ি বদল করতে হবে।’ আবার তারা দু-জনে দুই কামরায় উঠে বসল।
চাঁদপুরের স্টিমারে কিন্তু মেয়েদের কাঠরায় ঠাঁই হল না। ডেকের এক কোণে মাথা গুঁজতে হল রওশনকে আরও কয়েকজন বিবির সঙ্গে। পর্দা ছিল না। কাছেই ছিল অনুত্তম প্রভৃতি পুরুষ। মাঝখানে কোনো বেড়া ছিল না। শুধু ছিল বোরখা। বোরখাও ক্ষণে ক্ষণে খুলে যাচ্ছিল খেতে ও খাওয়াতে। শিশু ছিল সঙ্গে। এমনি এক অসতর্ক মুহূর্তে চার চোখ এক হল। অনুত্তমের। রওশনের।
সে চোখে পাঞ্চালীর তেজ, পাঞ্চালীর রোষ, পাঞ্চালীর লাঞ্ছনা। অপমানে নীল হয়ে গেছে তার মুখ। নইলে এমনিতে বেশ ফর্সা। একরাশ কোঁকড়া কালো কেশ অবিন্যস্ত এলায়িত। যেন পাঞ্চালীর মতো প্রতিজ্ঞা করেছে দুঃশাসন বেঁচে থাকতে বেণী বাঁধবে না। ইস্পাতের ফলার মতো ছিপছিপে গড়ন। কাপড়ে আগুন লেগেছে। সে আগুন ধরে গেছে প্রতি অঙ্গে, ঢেউ খেলিয়ে যাচ্ছে অঙ্গচালনায়, সাপ খেলিয়ে যাচ্ছে অঙ্গভঙ্গিতে। অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে তার সর্বশরীর। জ্বলছে আর তাপ বিকিরণ করছে। তপ্ত হয়ে উঠছে আবহাওয়া।
এ কোন নতুন স্নেহলতা! কেন এমন করে আত্মহত্যা করছে। অনুত্তম ভুলে গেল যে সে নিজেও জ্বলছে, তার মতো জ্বলছে কত সোনার চাঁদ ছেলে, জ্বলবে না কেন সোনার প্রতিমা মেয়েরাও? বাংলার এই কুরুক্ষেত্রে পাঞ্চালীরাও থাকবে পান্ডবদের জ্বালা জোগাতে, ভারতের এই নব রাজপুতানার পদ্মিনীরাও থাকবে বীরদের প্রেরণা দিতে। মনে পড়ল অনুত্তমের।
মনে পড়ল আর মনে হল এই সেই পদ্মাবতী যার ধ্যান করে এসেছে সে এতদিন। এই সেই বিপ্লবী নায়িকা, সেই চিরন্তনী নারী। কে জানে কী এর নাম, কিন্তু রওশন নামটাও সার্থক। রওশন রোশনি রোশনাই। তুমি যে আছ, তোমাকে যে দেখেছি, এই আমার অনেক। তোমার কাজে লাগতে পেরেছি, এই আমার ভাগ্য। আমি ধন্য যে আমি তোমার দু-দিনের দু-রাত্রির সহযাত্রী। এখন বিপদ কাটেনি, ধরা পড়বার সম্ভাবনা ফি পদে। তবু ধন্য, তবু আমি ধন্য।
গোয়ালন্দে নেমে অনুত্তমরা ফরিদপুরের দিকে গেল না, কাটল নাটোরের টিকিট। আবার আলাদা আলাদা কামরায় ওঠা। দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ। তারপর পোড়াদায় নেমে কলকাতার টিকিট কেটে গাড়ি বদল করল। এবার আলাদা আলাদা কামরায় নয়, একত্র। সময় ছিল না অত খুঁজতে। ভয় নেই বলে মুখ খুলে রাখল রওশন। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল জানলার বাইরে মুখ বাড়িয়ে। বোরখা পরে কি মানুষ বাঁচে। অনুত্তমকে বলল, ‘হুজুরের আপত্তি নেই তো?’
অনুত্তম কী যেন ভাবছিল। অন্য মনে বলল, ‘না, আপত্তি কীসের?’
কলকাতায় নেমে ঘোড়ার গাড়ি করে ওরা শ্যামবাজার যায়। সেখানে ওদের ছাড়াছাড়ি। গাড়িতে রওশন বলেছিল সে আত্মরক্ষার জন্যে পালিয়ে আসেনি, এসেছে পার্টির কাজে।