মবিন উদ্দিনের এখন প্রধান কাজ হল—নেত্রকোনা রেল স্টেশনে বসে থাকা। তিনি সকালবেলা নাশতা খান। খেয়ে খুব তাড়া আছে এমন ভঙ্গিতে বের হয়ে আসেন। দেরি হলে খানিকটা রাগারাগিও করেন—দোকান খুলতে হবে না? কাস্টমার দু’একটা এলে সকালবেলার দিকেই আসে। তোমাদের নিয়ে তো দেখি যন্ত্রণায় পড়লাম। সামান্য নাশতা দিতেই দুপুর।
দোকান বিক্রির কথা তিনি সুরমাকে এখনও বলেননি। কীভাবে বলবেন এবং ভবিষ্যৎ জীবনটা কীভাবে চালাবেন তার পরিকল্পনার জন্যে সময় দরকার। চিন্তা-ভাবনা দরকার। সেই চিন্তা-ভাবনার জন্যেই রেল স্টেশনে আসা।
রেল স্টেশনের উত্তর প্রান্ত নিরিবিলি। বিশাল এক রেন্ট্রি গাছ। নীচে যাত্রীদের বসার জন্যে কংক্রিটের বেঞ্চ বানানো আছে। তিনি একটা খবরের কাগজ কেনেন। ধীরে সুস্থে কাগজ পড়েন। সবচেয়ে আগে পড়েন হারানো বিজ্ঞপ্তি। তাঁর ইদানিংকালে মনে হচ্ছে হারানো বিজ্ঞপ্তি পড়তে পড়তে হঠাৎ একদিন দেখবেন ম্যাজিশিয়ানের ছবি ছাপা হয়েছে। তার বাবা-মা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন—
সন্ধানপ্রার্থী।
টুনু তুমি যেখানেই থাক ফিরিয়া আস। তোমার মা
শয্যাশায়ী। তোমার কনিষ্ঠ ভগ্নির বিবাহ ঠিক
হইয়াছে। তোমার কোন ভয় নাই ফিরিয়া আসিলে
তোমাকে কিছুই জিজ্ঞাস করা হইবে না। অর্থের
প্রয়োজন হইলে টেলিগ্রামে জানাও।
ইতি— তোমার পিতা-মাতা।
এখনও এধরনের বিজ্ঞাপন চোখে পড়েনি। কাগজ পড়া শেষ হলে ভাবতে বসেন—কী করা যায়? যখন ট্রেন আসে ভাবনা চিন্তায় বাধা পড়ে। যাত্রীদের ওঠা-নামা, হৈ চৈ। সেই হৈ চৈ দেখতেও ভঁর ভাল লাগে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
সুপ্তি একটু বড় হলে, তার বিয়ে দিয়ে দেয়া যেত। এমনতো না যে অন্ধ মেয়েদের বিয়ে হয় না। সবারই বিয়ে হয়। আল্লাহপাক সবকিছু জোড়া মিলিয়ে পাঠান। প্রতিটি মেয়ে পাখির জন্যে থাকে একটা পুরুষ পাখি তেমনি প্রতিটি মেয়ের জন্যে একজন স্বামী থাকে। আল্লাহপাক নিজেই জোড়া মিলিয়ে দেন। কাজেই সুপ্তির অবশ্যই বিয়ে হবে। সুপ্তির বিয়ে হয়ে গেলে সংসারে মানুষ থাকে মাত্র দু’জন। তিনি আর সুপ্তির মা। তারা দুজন গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে পারেন। গ্রামের বসতবাড়ি ঠিকঠাক করে সেখানে থাকা। জমির কিছু আয় আছে। একটা পুকুর আছে। পুকুরে মাছের চাষ করতে পারেন। জমি বর্গা না দিয়ে নিজেরাই চাষ করবেন। বাবলু আছে সে সাহায্য করবে…
চিন্তার এই পর্যায়ে মবিন উদ্দিন থমকে যান। বাবলু তাদের সঙ্গে আছে এটা ঠিক না। বাবলু কে? কেউ না। হুট করে যে ভাবে এসেছিল—সেই ভাবেই চলে যাবে। তিনি যদি আজ তাকে যেতে বলেন সে আজই যাবে।
বাবলু ছেলেটার ব্যাপারেও একটা কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। আরো আগেই নেয়া উচিত ছিল। দেরি হয়ে গেছে। বাবলু চলে গেলে সুপ্তি এবং সুপ্তির মা দু’জনই কষ্ট পাবে। কষ্ট পেলেও কিছু করার নেই। এই সংসারে বাস করতে হলে মাঝেমধ্যে কষ্ট পেতে হয়। সংসারের অনেক নিয়মের একটা নিয়ম হল কষ্ট পাওয়া। শুধু তারা কেন তিনি নিজেও কষ্ট পাবেন। ছেলেটার উপর তার মমতা পড়ে গেছে। মমতার কারণেই তিনি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। তাঁর মনে বিচিত্র সব প্রশ্ন আসে, তিনি সব প্রশ্ন চাপা দিয়ে রাখেন। নিজেকে এই বলে বুঝান যে বেশী কৌতূহল ভাল না। অতিরিক্ত কৌতূহলের কারণেই আদম এবং বিবি হাওয়া গন্ধম ফল খেয়েছিলেন। তারা দেখতে চেয়েছেন ফল খেলে কী হয়। তাদের সেই অতিরিক্ত কৌতূহলের ফল তারা হাতে হাতে পেয়েছেন। বেহেশত থেকে পৃথিবীতে নির্বাসন। কৌতূহলের শান্তি শুধু যে তারা পেয়েছেন তা না। তিনিও পাচ্ছেন। আদম হাওয়ার কৌতূহল যদি কম থাকতো তাহলে এখন তাঁকে রেল স্টেশনে বসে দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হতে হত না। তিনি পরম সুখে বেহেশতে বাস করতেন। ফল-ফুট খেতেন।
রেল স্টেশনে বসে তিনি ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার কথাই বেশি ভাবেন। ব্যাপারটা কী? সে কে? তার যে কিছু কিছু ক্ষমতা আছে সে সম্পর্কে তিনি মোটামুটি নিশ্চিত। আবার কিছু ব্যাপারে নিশ্চিত না। ছেলেটাকে পুরোপুরি বিদেয় করে দেবার আগে তিনি সেইসব ব্যাপার জেনে নেবেন। কী জিজ্ঞেস করবেন কীভাবে করবেন–তিনি সেইসব ব্যাপার ভাবার চেষ্টা করেন। প্রশ্নগুলি গুছিয়ে রাখেন।
তিনি ঠিক করেছেন যাদুকর ছেলেটাকে নিয়ে এক সকালে রেল স্টেশনে আসবেন। তাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন তা বাড়ির কাউকে বলবেন না। রেল স্টেশনে এনে এই বেঞ্চিতে বসাবেন এবং নরম গলায় বলবেন—বাবা শোন। তোমাকে আমরা সবাই খুব পছন্দ করি। তুমি তা ভালই জান–এখনকথা হচ্ছে কী…
বাকিটা বলার দরকার পড়বেনা, সেই ছেলে অবশ্যই বুঝে ফেলবে। সে নিজ থেকেই বলবে–আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি। তখন তিনি তার জন্যে একটা টিকিট কেটে আনবেন। ময়মনসিংহ যেতে চাইলে ময়মনসিংহের টিকেট, ঢাকা যেতে চাইলে ঢাকার টিকিট। তারপর তাকে ট্রেনে তুলে দেবেন। কিছু টাকাও তার হাতে দিয়ে দেবেন। হাজারখানেক টাকা। আরো বেশি দিতেন, কিন্তু তাঁর সামর্থ নেই।
ছেলেটাকে কিছু জিজ্ঞস করা বোধ ঠিক হবে না। সে বিব্রত হবে। যাবার মুহূর্তে তাকে বিব্রত করে কী লাভ? যদিও তাঁর অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে। বিশেষ করে গাছের ব্যাপারটা। সে নিজেকে গাছ বলে কেন? এটা কি কোন ধরনের ঠাট্টা। না-কি সে সত্যি সত্যি গাছে? তা কী করে হয়? মানুষ গাছ হবে কীভাবে?
একদিন তিনি বারান্দায় বসে আছেন হঠাৎ শুনলেন, সুপ্তি ছেলেটাকে বলছে–গাছভাইয়া আমার বই-এর মলাট লাগিয়ে দাও।
তিনি সুপ্তিকে ডেকে বললেন, গাছ ভাইয়া ডাকছিস কেন? গাছ ভাইয়াটা কী?
উনি নিজেকে গাছ বলেন তো তাই গাছ ভাইয়া বলে ক্ষেপাই।
বাবুল নিজেকে গাছ বলে?
হুঁ। বলে আমি মানুষ না, আমি গাছ।
সে গাছ হবে কেন?
আহ বাবা তুমিও দেখি কিছু বোঝ না। ঠাট্টা করে বলে। মানুষ কি কখনো গাছ হয়?
ঠাট্টা করে বলে?
অবশ্যই ঠাট্টা করে বলে। তোমার কী ধারণা—উনি সত্যি গাছ?
মবিন উদ্দিনের কোনো ধারণা নেই। তাঁর মাখা এলোমেলো হয়ে আছে। বাবলু যদি তাকে বলে—আমি কাঁঠাল গাছ। তিনি হয়তোবা বিশ্বাস করবেন। তার গা থেকে কাঁঠাল বের হলেও তেমন অবাক হবেন না। পেরে ঘরের কোণায় রেখে দেবেন পাকাবার জন্যে।
দুপুর একটার মতো বাজে। মবিন উদ্দিন খবরের কাগজ ভাঁজ করে উঠে দাঁড়ালেন। ক্ষিধে পেয়েছে বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করবেন। কিছুক্ষণ ঘুমাবেন। ঐ দিন সুরমা বলছিল—আচ্ছা এখন তুমি আর দুপুরের পর দোকানে যাও না কেন?
বিক্রিবাটা নেই। কাজেই যাই না। রেস্ট নেই। তাছাড়া শরীরটাও ভাল
বাবলুকে পাঠিয়ে দাও, ও দোকানে বসুক। দিনের পর দিন দোকান বন্ধ রাখলে লোকজন ভাববে তুমি দোকান বিক্রি করে দিয়েছ।
মবিন উদ্দিন রাগী গলায় বললেন, দোকান বিক্রি করব কেন? কী সব আজগুবি কথা বল।
হঠাৎ এমন রেগে গেলে কেন? রাগার মতো কিছুতো বলিনি। তোমার শরীরতো আসলেই খারাপ করেছে। আজকাল খুব অল্পতেই রেগে যাচ্ছ। তোমার বিশ্রাম দরকার।
বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টাইতো করছি—তুমি এসে বকবক করে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলে।
আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। তুমি ঘুমাও।
সুরমা চলে যায় ঠিকই, কিন্তু যাবার আগে কিছুক্ষণ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে। সে কি কিছু আঁচ করছে? আঁচ করা বিচিত্র না। এত বড় ঘটনা বেশিদিন গোপন করে রাখা যাবে না। প্রকাশ হয়ে পড়বেই। তাঁরই উচিত সুরমাকে জানানো। কীভাবে জানাবেন মাথায় আসছে না।
মোহনগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ আপ ট্রেন আসছে। স্টেশনে তুমুল ব্যস্ততা। চার-পাঁচ কামরার ছোট্ট ট্রেন, প্ল্যাটফরমে চার-পাঁচশ যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেনে তিল ধারণের জায়গা থাকবে না, অথচ স্টেশনের সব যাত্রী ট্রেনে উঠে যাবে। কীভাবে উঠবে সেটাও এক রহস্য। আসলে পৃথিবীটাই রহস্যময়। কালো যাদুকরের রহসই একমাত্র রহস্য না। মবিন উদ্দিন বাড়ির দিকে রওনা হলেন।
দরজা খুলে দিলেন সুরমা।
সুরমার মুথ অসম্ভব গম্ভীর। চোখ ফোলা ফোলা। অনেকক্ষণ কাঁদলেই চোখ এমনভাবে ফুলে উঠে। মবিন উদ্দিন শংকিত গলায় বললেন, তোমার কী হয়েছে?
সুরমা ধরা গলায় বললেন, কিছু হয়নি। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
মবিন উদ্দিন নিচু গলায় বললেন, কী কথা?
খাওয়া-দাওয়া কর তারপর বলব।
এখনি বল শুনি।
তুমি নাকি রোজ স্টেশনে বসে থাক?
কে বলেছে?
কে বলেছে সেটা পরের কথা। বসে থাক কি-না সেটা বল।
হ্যাঁ বসে থাকি।
স্টেশনে বসে কী কর?
খবরের কাগজ পড়ি।
খবরের কাগজ পড়ার জন্যে স্টেশনে যেতে হয়। আগেতো দোকানে বসেই কাগজ পড়তে। এখন দোকানে বস না কেন?
মবিন উদ্দিন চুপ করে রইলেন। চুপ করে থাকা ছাড়া তার পথও নেই। কী বলবেন? সুরমা এমনভাবে তাকাচ্ছে যে তাঁর তৈরী মিথ্যা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। মাথা কঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে।
তুমি না-কি দোকান বিক্রি করে দিয়েছ?
হুঁ।
কেন?
আব্দুল মজিদের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করেছিলাম। তার মেয়ের বিয়ে, টাকাটা তাকে দেয়া দরকার।
টাকা কবে ধার করেছিলে?
অনেকদিন আগেই নিয়েছিলাম। তোমাকে বলা হয়নি।
আমাকে তো তুমি কিছুই জানাও না। কেন জানাও না? এই ব্যাপারটা জানাতে কি কোনো সমস্যা ছিল?
ছিল না।
ছিল না, তাহলে জানাওনি কেন?
সুপ্তি কোথায়?
সুপ্তি কোথায় জিজ্ঞেস করছ কেন? আমার প্রশ্নের জবাব দাও। তুমি আমাকে কখনো কিছু জানাও না কেন?
মবিন উদ্দিন চুপ করে রইলেন। সুরমা বললেন, এখন আমরা খাব কী? বাঁচব কীভাবে কিছু ভেবেছ?
মবিন উদ্দিন চুপ করে রইলেন। সুরমার কঠিন আক্রমণ সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। সুপ্তি থাকলে ভাল হত। সে বাবাকে রক্ষা করার চেষ্টা করত। মবিন উদ্দিন অসহায় বোধ করছেন।
সুরমা শান্ত গলায় বললেন, শোন আমি আজ বিকেলের ট্রেনে বারহাট্টা যাব। সুপ্তিকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
মবিন উদ্দিন বললেন, আচ্ছা।
এখন স্ত্রীর প্রতিটি কথায় রাজি হওয়াই হবে সর্বোত্তম পন্থা। বারহাট্টা তার শ্বশুরবাড়ি। সুরমা যদি সুপ্তিকে নিয়ে কয়েকদিন তার বাবা-মার কাছে যেয়ে থেকে আসে সেটা ভালই হবে। তার রাগ কমবে। তিনিও নিরিবিলি কিছুদিন ভাবার সময় পাবেন। চিন্তা-ভাবনার জন্যে তাকে আর রোজ রোজ স্টেশনে যেতে হবে না।
সুরমা তীব্র গলায় বললেন, মানুষকে তুমি মানুষ মনে কর না। মানুষকে ভাব—’গাছ’।
মবিন উদ্দিন মনে মনে বললেন, গাছকে এত তুচ্ছ মনে করো না। গাছ ভয়াবহ ব্যাপার। শুধু আমিই মানুষকে গাছ ভাবি না। অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদের গাছ ভাবে। উদাহরণের জন্যে দূরে যেতে হবে না। উদাহরণ ঘরেই আছে।
মুখ ভোতা করে থাকবে না। ভাত খাও। আমার কাজ-কর্ম আছে জিনিসপত্র গুছাতে হবে।
সত্যি সত্যি যাবে?
আমি কি তোমার সঙ্গে তামাশা করছি। তুমি কি আমার দুলাভাই?
বাবলু কোথায়?
ও ঘরেই আছে। কেন ওকে দরকার কেন?
এম্নি জিজ্ঞেস করলাম। কোন দরকার নেই।
দরকার তো থাকবেই না। কাউকেই তোমার দরকার নেই। তুমি একাই একশ। তুমি তো মহামানব।
মবিন উদ্দিন একা একা খেলেন। এবং যথারীতি শুয়ে পড়লেন। দোকান বিক্রির খবরটা যে তাকে বলতে হয়নি সুরমা নিজে নিজেই বের করেছেন এতে তাঁর ভালই লাগছে। আল্লাহ্ যা করেন ভালই করেন।
মবিন উদ্দিন চোখ বন্ধ করে আছেন। সুপ্তির সঙ্গে তাঁর মা’র কথা-বার্তা কানে আসছে।
আমরা কোথায় যাচ্ছি মা? নানার বাড়ি?
একবার তো বললাম। আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?
হঠাৎ যাচ্ছি কেন?
কাজ আছে তাই হঠাৎ যাচ্ছি।
আমার স্কুল খোলা মা।
থাকুক স্কুল খোলা। অন্ধ মেয়ে তার আবার স্কুল স্কুল খেলা।
এমন বিশ্রী করে কথা বলছ কেন?
মিষ্টি কথা শুনতে চাস? যা তোর বাবার কাছে। সে মিষ্টি কথা বলবে।
আমাদের সঙ্গে আর কে যাচ্ছে?
আমি আর তুই।
সে-কী! বাবা যাবে না? গাছ ভাইয়া যাবে না?
সুরমা কী জবাব দিলেন, মবিন উদ্দিন ধরতে পারলেন না। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছে ওরা আসলে যাবে না। বিকেল আসতে আসতে সুরমার রাগ পড়ে যাবে। সুপ্তি বাবাকে ছাড়া কোথাও যাবে না বলে বেঁকে বসবে। সব মিলিয়ে যাওয়া বাতিল হয়ে যাবে। মবিন উদ্দিন ঘুমিয়ে পড়লেন। অনেক দিন পর তাঁর গাঢ় ঘুম হল।
ঘুম ভাঙ্গল সন্ধ্যাবেলা। ঘর অন্ধকার। কারো কোনো সাড়া-শব্দ নেই। তিনি ডাকলেন——সুপ্তি। সুপ্তি। কেউ সাড়া দিল না। তিনি বিস্মিত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দেখেন ভেতরের বারান্দায় মোড়ার উপর ম্যাজিশিয়ান বসে আছে।
ওরা কোথায়?
বারহাট্টা গিয়েছে।
বারহাট্টা গিয়েছে মানে? কখন গেল?
বিকালের ট্রেনে।
তুমি কী বল? সুপ্তি আমাকে কিছু না জানিয়েই চলে গেল?
আপনি ঘুমাচ্ছেন এই জন্যে মনে হয় জাগায়নি।
কবে আসবে কিছু বলে গেছে?
না।
মবিন উদ্দিন হতভম্ব হয়ে গেলেন। যত রাগই করুক সুরমা তাকে কিছু না বলে চলে যেতে পারল?
ম্যাজিশিয়ান বলল, ওরা কাল পরশু চলে আসবে। আপনি দুঃশ্চিন্তা করবেন না।
কাল পরশু চলে আসবে তোমাকে বলে গেছে?
জ্বি না। কিন্তু আমি জানি চলে আসবে।
কীভাবে জান?
ম্যাজিশিয়ান চুপ করে রইল। মবিন উদ্দিন লক্ষ্য করলেন তিনি রেগে যাচ্ছেন। স্ত্রী কন্যার উপরের রাগটা ম্যাজিশিয়ান ছেলেটার দিকে চলে যাচ্ছে।
চুপ করে আছ কেন? বল কীভাবে জান? না বলতে কোনো অসুবিধা আছে?
জ্বি-না বলতে অসুবিধা নেই।
শোন–তোমার ব্যাপার-স্যাপার আমার ভাল লাগে না। তুমি যা জান তার নাম ম্যাজিক না, তার নাম যাদুবিদ্যা। যাদুবিদ্যা ভাল জিনিস না। যাদুবিদ্যা খারাপ বিদ্যা। এই বিদ্যার চর্চা করাও খারাপ। ধর্মে নিষেধ আছে।
আমি কোনো যাদুবিদ্যা জানি না।
ফালতু কথা বলবে না। অবশ্যই তুমি যাদুবিদ্যা জান? তুমি সুপ্তিকে বলেছ। তুমি গাছ? বল নাই?
জ্বি বলেছি।
কী জন্যে বলেছ? ঠাট্টা করে বলেছ?
ঠাট্টা করে বলিনি।
তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ তুমি গাছ?
ম্যাজিশিয়ান কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে আছে। মবিন উদ্দিন চাপা গলায় বললেন, আচ্ছা যাও স্বীকার করলাম তুমি গাছ। গাছ কেন সেটা বল।
এক দুই কথায় বলা যাবে না।
এক দুই কথায় বলা না গেলে বেশি কথাতেই বল! আরেকটা কথা…
মবিন উদ্দিনের কথা বলার আগেই ম্যাজিশিয়ান বলল, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমি জানি। আপনি বলতে চাচ্ছেন–আমি যেন চলে যাই।
তুমি ঠিকই ধরেছ। আমি তাই চাই।
জ্বি আমি চলে যাব।
তুমি যাবে কোথায়?
ঠিক করিনি কিছু।
দেশের বাড়িতে চলে যাও। পথে পথে ঘুরবে কেন? বাবা মার কাছে যাও।
বাবা-মা নেই।
বাবা-মা না থাকলেও আত্মীয়-স্বজন তো আছে। তাদের কাছে যাও। এমন তো না যে তোমার কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। পথে পথে ঘুরে যে ফকির তারও চল্লিশটা আত্মীয় থাকে।
ম্যাজিশিয়ান হাসতে হাসতে বলল, আমার নেই।
মবিন উদ্দিন বিরক্ত হয়ে বললেন, তোমার থাকবে না কেন? তুমি তো। আকাশ থেকে নামনি। না-কি আকাশ থেকে নেমেছ?
ম্যাজিশিয়ান এখনও হাসছে।
দরজায় ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে কেউ কড়া নাড়ছে। কে এসেছে? সুরমা ফিরে এসেছে না-কী? বারহাট্টা থেকে এখন আসার কোন ট্রেন নেই—তবে বাসে করে চলে আসতে পারে। সুরমা বাবার বাড়িতে পৌঁছেই হয়ত বুঝতে পেরেছে সে কাজটা ভাল করেনি। তারপর বাসে করে চলে এসেছে। তবে ম্যাজিশিয়ান বলছিল তারা কাল-পরশু আসবে। ম্যাজিশিয়ানের কথাতো ভুল হবে
মবিন উদ্দিন ম্যাজিশিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন, কে এসেছে?
ম্যাজিশিয়ান সঙ্গে সঙ্গে বলল, আপনার বোনের স্বামী মজিদ সাহেব এসেছেন। মবিন উদ্দিন ম্যাজিশিয়ানের চোখে মুখে সুক্ষ্ম হাসি লক্ষ্য করলেন। ম্যাজিশিয়ানরা বড় ধরনের কোন ম্যাজিক দেখাবার আগে আগে যে বিশেষ ভঙ্গিতে হাসে। সেই ভঙ্গির হাসি।
মবিন উদ্দিন তীব্র গলায় বললেন, না দেখে বলে ফেললে? তারপরেও বলতে চাও তুমি যাদুবিদ্যা জান না?
মবিন উদ্দিন দরজা খুললেন। হ্যাঁ আব্দুল মজিদই এসেছে। সে অন্যদিনের মতোই হাসিখুশি। তার মুখ উজ্জ্বল। হাতে মিষ্টির হাড়ি।
কী খবর আব্দুল মজিদ?
জি খবর ভাল।
হাতে কী?
রসোগোল্লা। সুপ্তির জন্যে এনেছি। নিধু সাহার কাপড়ের দোকানে এসেছিলাম, ভাবলাম আপনাদের খোঁজ নিয়ে যাই। চায়েরও পিপাসা পেয়েছে। এক কাপ চা খেয়ে যাই।
চা খাওয়াতে পারব না। সুরমা-সুপ্তি কেউ বাসায় নাই।
সে-কী! ওরা কোথায়?
বারহাট্টা গিয়েছে।
সঙ্গে কে গিয়েছে, ম্যাজিশিয়ান ছেলেটা? ভাইজান আপনি নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনছেন। ছেলেটাকে এখনও তাড়ান নাই?
ওই প্রসঙ্গ বাদ দাও।
বাদ দিব কেন? বাদ দেয়ার মতো বিষয় তো না। শেষ পর্যন্ত একটা কেলেংকারী হবে।
যখন হবে তখন দেখা যাবে। তুমি কি কোন কাজে এসেছ না এমি এসেছ?
আব্দুল মজিদ বসতে বসতে বলল, একটা কাজেই এসেছি। বুঝলেন ভাইজান ওইদিন টাকাটা গুণে না নিয়ে ভুল করেছি। গুণে নেয়ার দরকার ছিল।
মবিন উদ্দিন হতভম্ব হয়ে বললেন, সে-কী টাকা কম ছিল না-কী?
আব্দুল মজিদ হাসতে হাসতে বলল, জ্বি না। একটা পাঁচশ টাকার নোট বেশি ছিল। ব্যাংকও মাঝে মাঝে ভুল করে। নোর্টটা নিয়ে এসেছি।
আব্দুল মজিদ মানিব্যাগ বের করল আর তখন ঠিক আগের বারের মতো আব্দুল মজিদ কী ভাবছে তিনি বুঝতে পারলেন। আব্দুল মজিদ ভাবছে টাকা ঠিকই ছিল তারপরেও পাঁচশ টাকা দিচ্ছি বুঝানোর জন্যে যে আমি মানুষটা অতি সৎ। আমার মধ্যে কোন অসৎ ব্যাপার নাই।
মবিন উদ্দিন বললেন, সত্যি সত্যি পাঁচশ টাকা ছিল?
জ্বি ছিল।
মবিন উদ্দিন টাকাটা হাতে নিলেন। মনে মনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি কি আসলেই আব্দুল মজিদের মনের কথা বুঝতে পারছেন, না এটাও তার কল্পনা।
ভাইজান একটা বিষয় শুনে খুবই মনে কষ্ট পেয়েছি।
বিষয়টা কী?
শুনলাম আপনি না-কি দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন।
হ্যাঁ।
আমাকে টাকা দেয়ার জন্যে দোকান বিক্রি করতে হল? ছি ছি।
না ছি ছি কিছু না। এম্নিতেও বিক্রি বাটা হচ্ছিল না।
এখন কী করবেন বলে ঠিক করেছেন?
গ্রামের বাড়িতে চলে যাব বলে ঠিক করেছি। কিছু ধানী জমি আছে। পুকুর আছে। শহরের এই বাড়ি বিক্রি করলে কিছু টাকা পাব।
বুদ্ধিটা খারাপ না ভাইজান। পুকুরে যদি মাছের চাষ করেন—ভাল আয় হবে। আর আপনারা তিনজন মোটে মানুষ–আপনাদের আর খরচ কী?
মবিন উদ্দিন কিছু বললেন না। এই আলোচনা চালিয়ে যেতে তাঁর ইচ্ছা করছে না।
পুকুরে গ্রাস কার্প ছাড়বেন, সিলভার কাপ ছাড়বেন, সরপুটিও ভাল হয়। ফিসারী ডিপার্টমেন্টের এক অফিসারের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। নিয়ে আসব আপনার কাছে।
আচ্ছা।
মাছের চাষে অভিজ্ঞতা আছে এমন একজন কর্মচারী রেখে দেবেন। আছে, আমার জানামতে বিশ্বাসী লোক আছে। হ্যাচারীতে কাজ করেছে। ওকে নিয়ে আসব।
মবিন উদ্দিন ভেবে পেলেন না, তার মাছের চাষ নিয়ে আব্দুল মজিদ এত উৎসাহী কেন? রহস্যটা কী? রহস্য কিছু নিশ্চয়ই আছে কিন্তু তিনি ধরতে পারছেন না।
হঠাৎ রহস্য পরিষ্কার হয়ে গেল। আব্দুল মজিদ কি ভাবছে তিনি বুঝতে পারছেন। আব্দুল মজিদ এসেছে বাড়িটা কিনে নিতে। শহরের উপর ভাল জায়গায় বাড়ি। চারতলা দালান তুলে ভাড়া দিলে ভাল টাকা আসবে।
ভাইজান! বিল।
দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন শুনে খুবই কষ্ট পেয়েছি। হুট করে বিক্রি করলেন, দামও তো ভাল পান নি।
তা ঠিক দাম ভাল পাই নি।
বাড়ি বিক্রি করার সময় তাড়াহুড়া করবেন না। আমাকে আগে জানাবেন।
তুমি কিনতে চাও? তুমি তো বলছিলে তোমার টাকা পয়সার সমস্যা।
সমস্যা তো আছেই। সমস্যা যাই থাকুক জোগাড় করব। আপনি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তা ঠিক না। বাড়ি কবে-নাগদে বিক্রি করার কথা ভাবছেন?
এখনও এই বিষয়ে কিছু ভাবি নি।
দেরী করা ঠিক হবে না। দেরী করা মানে জমা টাকা খরচ করা। তাড়াতাড়ি ডিসিসান নিয়ে কাজ কর্ম শুরু করে দেয়া দরকার। আমি কালপরশুর মধ্যে হ্যাচারীর লোকের সঙ্গে কথা বলব। আপনার একটা ভাল ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত মনে শান্তি পাচ্ছি না ভাইজান।
ও আচ্ছা।
ভাইজান আমি আজ তাহলে উঠি?
মর্কিন উদ্দিন আব্দুল মজিদকে বিদায় দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। ম্যাজিশিয়ান ছেলেটা ঠিক আগের জায়গাতেই বসে আছে। তাকে এখন লাগছে পাথরের মূর্তির মতো। মবিন উদ্দিনকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। মবিন উদ্দিন বললেন, তুমি কি কিছু বলবে?
সে না সূচক মাথা নাড়ল।
মবিন উদ্দিন বললেন, তোমাকে আমার একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। জিজ্ঞেস করলে জবাব দেবে?
জ্বি দেব।
আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমি আব্দুল মজিদের মনের কথা বুঝতে পারছি—এটা কি সত্যি।
জ্বি সত্যি।
এটা কীভাবে সত্যি হয়?
আমি আপনাকে সাহায্য করেছি।
তুমি এইসব শিখলে কীভাবে?
আমি একটা খাতায় আমার ব্যাপারটা লিখেছি। খাতাটা আপনাকে দিয়ে যাব। আপনি পড়বেন। পড়া শেষ হলে খাতাটা নষ্ট করে ফেলবেন।
মবিন উদ্দিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমাকে আমি খুবই পছন্দ করি। কিন্তু এইসব ব্যাপার আমার ভাল লাগে না। মানুষ হবে সহজ, সরল স্বাভাবিক—এইসব কী?
আমার দুর্ভাগ্য যে আমি অন্য রকম হয়ে গেছি।
কীভাবে হলে?
আমি সব লিখেছি। পড়লেই আপনার কাছে পরিষ্কার হবে। আমি চলে যাচ্ছি, আপনি পড়ন। আজ রাতেই পড়ুন।
তুমি চলে যাচ্ছ তার মানে কি! কোথায় যাচ্ছ?
বুঝতে পারছি না কোথায় যাচ্ছি। আপনার কাছে আমার একটা ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারও আছে। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।
মবিন উদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি কী করেছ যে তোমাকে ক্ষমা করতে হবে?
আমি নিজেকে আপনার ছেলের মতো করে উপস্থিত করেছি। তার চেহারা তার গলার স্বর অনুকরণ করেছি। এমন কি নিজের নামও বলেছি টুনু। আমি এই ব্যাপারগুলি করতে পারি। আমার অনেক ক্ষমতা।
তুমি কি এখনি চলে যাচ্ছ? তুমি যে ভঙ্গিতে কথা বলছ তাতে সে রকমই মনে হচ্ছে।
জ্বি আমি এখনি চলে যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।
সুপ্তি আর তার মার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যাবে?
জ্বি।
তোমার কষ্ট হবে না? মন খারাপ করবে না?
আমি অর্ধেক বৃক্ষ, মানুষের আবেগ আমার নেই। আপনি যে স্নেহ করেছেন—সেই স্নেহ অপাত্রে করেছেন।
মবিন উদ্দিন আগে লক্ষ্য করেন নি, এখন লক্ষ্য করলেন ঠিক যে পোষাকে কাল যাদুকর এই বাড়িতে ঢুকেছিল সে সেই পোষাকেই পরে আছে। পাতলা একটা শার্ট, খালি পা। কাঁধে ছেড়া সুতা ওঠা কাপড়ের ব্যাগ। টুনুর মুখের কোন আদল তার মুখে এখন আর নেই। নিগ্রোদের চুলের মতো ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল। চোখের শাদা অংশ অতিরিক্ত শাদা। মনে হয় অন্ধকারে জ্বলছে।
মবিন উদ্দিন হতভম্ব গলায় বললেন, তোমার নাম কী?
এখন আমার কোন নাম নেই। তবে এক সময় সুন্দর একটা নাম ছিল।
সেই নামটা কী?
টগর।
কালো যাদুকর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল। একবারও বলল না—আপনারা আমাকে পুত্র স্নেহে রেখে দিলেন। এই স্নেহের ঋণ আমি স্বীকার করছি।
সে এমনভাবে ঘর থেকে বের হল যেন কারো কাছেই তার কোন ঋণ নেই।