ছোটবেলা গাছের তল দিয়ে যাতায়াতের সময় ‘গেছো ভূত’-এর ভয়ে গা ছমছম করত, এখন শুনি পুরুষের নাকি গা ছমছম করে ‘গেছো মেয়ে’র ভয়ে। বৃক্ষারোহণপ্রিয় ছেলে নিয়ে নয়, মেয়ে নিয়েই যত বিপত্তি। প্রকৃতি পুরুষ ও নারীকে আলাদা করে দেখে না, কিন্তু সমাজ দেখে। গাছে যখন একটি পেয়ারা পাকে, সেটি প্রথম হাতে নেবার জন্য বালকের চেয়ে বালিকার আগ্রহ কম থাকে না। সম্মান যদি কচুপাতা, মেয়ে তার উপর একফোঁটা জল। সম্মান নড়ল চড়ল, তো মেয়ে গেল। সম্মানকে আশ্রয় করে, সম্বল করে মেয়েরা বেঁচে থাকে।
সেই দুরন্ত কৈশোরে একটি ফলবতী বৃক্ষেও মা আমাকে আরোহণ করতে দেননি, বলেছেন-‘মেয়েরা গাছে উঠলে গাছ মরে যায়।’ বড় হয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞান ঘেঁটে নারী-স্পর্শের সঙ্গে বৃক্ষ বাঁচা-মরার কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাইনি।
‘গেছো’ বলতে একধরনের দস্যিপনা বোঝায় যা মেয়েদের ঠিক মানায় না। মেয়েরা লজ্জাবনত না হলে, পরনির্ভর, ভীতু ও দিধান্বিত না হলে, স্বল্পভাষী ও নিচুকন্ঠী না হলে সমাজ ভাল চোখে দেখে না। কোনও পুরুষের চরিত্রে উপরোক্ত দোষগুলো দেখা দিলে তাকে ‘মেয়েলি’ বলে দোষারোপ করা হয়। অন্যদিকে দুঃসাহস, দর্প, দম্ভ, ক্রোধ, চাঞ্চল্য, স্বয়ম্ভরতা, অকুণ্ঠচিত্ততা ইত্যাদি গুনাবলি কোনও মেয়ের মধ্যে থাকলে ‘পুরুষালি’ বলে দোষ দেয়া হয়। অথচ ‘মেয়েলি’ এবং ‘পুরুষালি’ বৈশিষ্ট্য কারও শারীরিক গঠন বা চরিত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। যে মানুষ তার আগ্রহকে দমন করতে শেখে, যে তার দৃষ্টিকে নত করতে শেখে, যে তার পদক্ষেপকে সীমাবদ্ধ করতে, বাহুকে সঙ্কুচিত করতে, জিহ্বাকে সংযত করতে শেখে, সে অবশ্যই তার শারীরিক বৈশিষ্টের সঙ্গে প্রতারণা করে। করে, কারণ শরীর নয়-সমাজ দ্বারা নির্ধারিত মেয়েলি স্বভাব তার শরীরে আরোপ করতে হয়, তা না হলে সম্মান যায়।
বাঙালি মেয়েদের জন্য ‘সতীত্ব রক্ষা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ একগামিতা শুধু নারীর জন্য অবশ্য পালনীয়, পুরুষের জন্য নয়। পরপুরুষ সঙ্গমে পাতিব্রত্য ধর্মের লোপ হলে সতীত্বনাশ হয়। সামাজিক বৈধতা অতিক্রম করলে নারীকে ‘পতিতা’ হতে হয়, কিন্তু পুরুষ যথেচ্ছাচারী হলে তাকে ‘পতিত’ হতে হয় না। একটি পুরুষ যত বহুগামী হোক না কেন, বিয়ে করার বেলায় কুমারী ছাড়া নৈব নৈব চ। আমি কিছু প্রগতিশীল শিক্ষিত পুরুষের কথা জানি, যারা স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে গিয়ে বিছানায় সাদা চাদর বিছিয়েছে স্ত্রীর কুমারীত্ব প্রমান করার উদ্যেশ্যে। চাদরে রক্তের দাগ না পাওয়ায় তারা স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। নারীর যোনিমুখে একটি অসম্পূর্ণ পাতলা আবরণ থাকে, গ্রিকদের বিয়ের দেবতা ‘হাইমেন’-এর নাম অনুসারে আবরণটির নাম হাইমেন (সতীচ্ছেদ) রাখা হয়েছে। বিখ্যাত গাইনোকোলোজিস্ট স্যার নরম্যান জেফকট বলেছেন-‘প্রথম সঙ্গমে হাইমেন বিদীর্ণ হয়, এর ফলে সামান্য রক্তপাত হতে পারে অথবা নাও হতে পারে। হাইমেন বিদীর্ণ ছাড়াও সঙ্গম সম্ভব। সুতরাং কুমারীত্ব প্রমান করবার জন্য এটি একটি চিহ্ন বটে কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য নয়।’
সৎ এবং সততার সঙ্গে ‘সতী’ শব্দটির যদি সামান্য সম্পর্ক থেকে থাকে তবে আমি মনে করি একটি মেয়ে দশটি পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেও ‘সতী’ থাকতে পারে এবং একটি মেয়ে কেবল একটি পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেও ‘অসতী’ হতে পারে।
‘নষ্ট’ শব্দটি পুরুষের জন্য নয়, মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য। ডিম নষ্ট হয়, দুধ নষ্ট হয়, নারকেল নষ্ট হয় এবং মেয়ে নষ্ট হয়। যে কনও বস্তুর মত আমাদের সমাজ একটি মেয়েকে ‘নষ্ট’ বলে চিহ্নিত করে। এদেশের শিক্ষিত রুচিশীল মেয়েরা এইসব ‘নষ্ট মেয়ে’ থেকে নিজেদের আলাদা করবার ব্যপারে বড় সতর্ক। আলাদা হতে চাওয়াটা আসলে বোকামি। কোনও না কোনওভাবে সকল নারীই যেখানে নির্যাতিত, সেখানে শ্রেণীভেদের প্রশ্ন আসে না। এই নষ্ট সমাজ ওত পেতে আছে, ফাঁক পেলেই মেয়েদের ‘নষ্ট’ উপাধি দেবে। সমাজের নষ্টামি এত দূর বিস্তৃত যে, ইচ্ছে করলেই মেয়েরা তার থাবা থেকে গা বাঁচাতে পারে না।
গত ২০ অক্টোবর’ ৮৯ জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রে ‘বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ’ বিষয়ক একটি সেমিনারে অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করেন এইজন্য যে, বইয়ের প্রকাশকরা বইকে ‘মাল’ বলে উল্লেখ করেন। এটি অবশ্যই একটি অন্যায় উচ্চারন। আমি ভেবে অবাক হই তবে কতটুকু অন্যায় হয়, যদি মানুষকে ‘মাল’ বলে? মাল একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ পণ্যদ্রব্য। মুসলিম হাদিস শরীফে লেখা-‘দুনিয়ার সবকিছু ভোগের সামগ্রী আর দুনিয়ার সর্বোত্তম সামগ্রী হচ্ছে মেয়েমানুষ।’ বিনিময় পণ্য হিসাবে, মুল্যবান দাসী হিসাবে, দামি সামগ্রী হিসাবে সমাজে নারীর অবস্থান বলেই নারীকে ‘মাল’ বলে ডাকতে কারও দ্বিধা নেই। ওরা ডাকে, কারণ ধর্ম ওদের ইন্ধন জোগাচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্র ওদের আশকারা দিচ্ছে।