না চাচা, মাফ কর। এ আমি পারব না। পাতলা অয়েল পেপারের মোড়কটা ফিরিয়ে দেয় কদম।
ভাইর ব্যাটার এমনধারা বেয়াদবিতে খুশি হবার কথা নয় মন্তু সারেংয়ের।
মুখটাকে কালো গোমরা এবং কিছুটা কঠিন করে বলল মন্তু সারেং, এই কামটুকু করতে পারবি না, তবে তুই আমার কিসের ভাতিজা রে? তা ছাড়া আমদানি যা আসবে তার ভাগ তো তোকে দেবই বলেছি!
রাগলে কদমকে তুই বলে মন্তু সারেং।
চাচা ভাগের আমার দরকার নেই। এ বড় খারাপ কাম।
খারাপ কাম? এমন উদ্ভট উক্তিতে সত্যি অবাক হয় মন্তু সারেং।
হ্যাঁ, খারাপই তো। কেমন গোঁয়ারের মতো বলে কদম। তারপর সেই খারাপটাকে আরো ব্যাখ্যা নিয়ে বুঝিয়ে দেয়। এ হলো গিয়ে বিঝাড়া বেআইনি মাল। শুল্ককে ফাঁকি দিয়ে বন্দরে নিয়ে যাবে তুমি। এটা খারাপ কাম না?
এত বড় সমুদ্রটাকে হাতের তালুতে লয়ে খেলিয়ে বেড়ায় যে ঝানু নাবিক, সে-ই তো মন্তু সারেং। তিন মহাসমুদ্রের কোন রহস্য অজানা নয় তার। অজানা। নয় সমুদ্রপথের নানা গুপ্ত সড়ক, বিচিত্র লেনদেন আমদানি-রপ্তানি আর এই সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়ায় যে জাহাজি তাদের মনের বিচিত্র খেলা, মনের যত অন্ধিসন্ধি অজানা নয়। ত্রিশ বছরের ঝানু নাবিক মন্তু সারেং– তাই হাল ছাড়ে না মন্তু সারেং বলে, অন্যায় নয়রে, অন্যায় নয়। এ কাম যে সবাই করে। যারা করে না তারা আহাম্মক, বেকুব। তারা ঠকে।
করুক সবাই। এসব ঝঞ্ঝাটে নেই আমি। স্পষ্ট উত্তর কদমের।
আপন অজ্ঞতায় জব্বর সারেংয়ের নিষিদ্ধ মাল পাচার করতে গিয়ে তিনটি বছর যে জেল খেটে এলো সেটা কোনদিন ভুলবে কদম? না কোনদিন ক্ষমা করবে জব্বর সারেংকে?
কদমের কাটা উত্তরটায় দস্তুরমতো নাখোশ হয় মন্তু সারেং। এসব বিশেষ আর গোপনীয় কাজে সহায়তার জন্যই লোক নিয়োগের সময় বাছাবাছা বিশ্বাসী লোকই জাহাজে বহাল করে বড় সারেং। কিন্তু কদম যে এমন ধারা বেঁকে বসবে এটা কখনো ভাবতে পারেনি মন্তু সারেং।
একাধারে আমার দোস্ত আর মুরুব্বি ছিলেন মজল ভাই। তারই ছেলে তুই কদম। যেমন আমার নিজের ছেলে তেমনি তুই। উমেদার কি কম ছিল? তবু তোকেই বহাল করলাম আমি। আর তুই কিছু না কাগজের একটা হাল্কা মোড়ক পকেটে ফেলে আমার সাথে সাথে নেবে আসবি বন্দরে, তাতেও তোর আপত্তি? আবার কত বক্তিমা শুনাচ্ছিস। মন্তু সারেংয়ের কথায় এবার একটু খোঁচা, একটু অভিমানও।
নিরুত্তরে পায়ের নিচে জোড়া জোড়া কাঠের পাটাতনটার দিকে চেয়ে থাকে কদম।
যেদিন থেকে জাহাজের কামে ঢুকেছে কদম সেদিন থেকেই ওর পরিচয় বন্দরে বন্দরে অসংখ্য গোপন পথের এই বিচিত্র কেনা-বেচার সাথে। এই করে বাড়িতে দালান তুলেছে মন্তু সারেং। একটা ছেলেকে বি. এ. পাস করিয়েছে। আর একটা ছেলেকে বসিয়েছে তেজারতে। এই করে কলকাতার মতো শহরে তিনটে বাড়ি কিনেছে এই রুতুন্দা জাহাজের বাটলার খবির মিয়া।
কিন্তু কদম সারেং? কদম সারেংয়ের মনে পড়ে বাপজানের কসম। বাপজানের সাথে একই জাহাজে কদমের প্রথম সমুদ্রযাত্রা। আসরের নামাজ পড়ছিল বাপজান। জায়নামাজটার এক পাশে বসিয়েছিল কদমকে। কদমকে পশ্চিম দিকে মুখ করিয়ে এক রকম কসম খাইয়ে নিয়েছিল বাপজান। বলেছিল, বাবা, হারামের রুজিতে কখনো হাত দিবি না। হারাম খাবি না। হারাম ছুঁবি না। হারামের রুজিতে কখনো বরকত নেই। তারপর হাত তুলে নামাজ অন্তে মোনাজাতটা শেষ করেছিল মজল সারেং। জায়নামাজটা গুটোতে গুটোতে বলেছিল আবার, যদি এসব করিস তবে আমার ব্যাটা নস তুই।
আচ্ছা নে, আধাআধি বখরা। টোপের রশিটাকে আর একটু ঢিলে করে চোখের ঠারে হাসল মন্তু সারেং। বলল আবার, উঠতি বয়স তোর। এদিকে ওদিকে খরচা একটু হবেই। যখন যা লাগে চেয়ে নিস। তোর জন্য আমার না নেই বুঝলি? ব্যাপারটা যেন এখানেই ফয়সালা হয়ে গেল তেমনি করে কদমের কাঁধে হাত রাখল মন্তু সারেং। আর একবার চোখ টিপে হাসল। তারপর ক্যাবিনের দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেল।
বললাম তো চাচা, এসব বদকামে আমি নেই। বখরা-ফখরাও দরকার নেই আমার। উত্ত্যক্ত হয়েই যেন বলল কদম। কিন্তু ততক্ষণে মন্তু সারেংয়ের পেছনে বন্ধ হয়ে গেছে ক্যাবিনের দরজাটা। কদমের কথাগুলো ক্যাবিনের ভিতরেই রয়ে গেল।
বিচিত্র স্বভাব এই জাহাজি মানুষগুলোর। যতক্ষণ ওরা সাগরের বুকে আপন তরীর নিরাপদ যাত্রায় কাণ্ডারি, তখন ওরা ধীর, ওরা হুঁশিয়ার। ফুঁসে-ওঠা, গর্জে ওঠা সমুদ্র আর ভয়ংকর তরঙ্গ আঘাতের মুখে ওরা নির্ভীক, ওরা শান্ত। ঝড়ো দুর্যোগে টাল খাওয়া, ছিটকে পড়া তরীর মাঝে ওরা অকম্প, ওরা সাবধানী নাবিক। শক্ত হাতে ধরে থাকে হাল। অকুতোভয়ে পাড়ি দেয় দুর্যোগ।
কিন্তু তীরে পা রেখেই ওরা ভিন্ন মানুষ, বুনো মানুষ। ডাঙার মাটির স্পর্শ পেয়ে হিতাহিত ন্যায়-অন্যায় জ্ঞান যেন থাকে না ওদের। যতক্ষণ ওরা পানির রাজ্যে, তৃষিত চাতকের মতো চেয়ে থাকে ওরা, কখন দেখা যাবে মাটির রেখা, কখন পোতাশ্রয়ে এসে নোঙর ফেলবে ক্লান্ত তরী। কিন্তু তীরের ক্ষীণ রেখাটি দৃশ্যমান হবার সাথে সাথে ওরা অস্থির। তীরের হাতছানি ছাড়া আর সবকিছুই ভুলে যায় ওরা। মাটিতে পা রেখে ওরা উন্মাদ, বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল। তখন ওদের দেখে মনে হয় ওরা বুঝি হাজার হাজার বছরের ক্ষুধার্ত পশু, শিকার পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে উন্মত্ত, সেই ক্ষুধার তাড়নায়।
হাজার ক্ষুধা, হাজার লালসা– লক্ষ মুখের লক্ষ হাঁ মেলে, লক্ষ নখরের ক্রূর তীক্ষ্ণতায় শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তৃপ্তি খোঁজে। তবু বুভুক্ষু নাবিকের ক্ষুধা কি মেটে? তৃপ্তি আসে? ক্লান্ত হয়?
রুতুন্দা জাহাজটা বন্দরে ভিড়বার সাথে সাথে কি কাণ্ডটাই না বাধিয়ে তুলল ওরা।
প্রথমেই নাবিক হিকস। সাথে তার পেটোয়া ক্রূ বাহিনীটি।
গোসল করে সাজগোজ করতে একটু দেরি হয়ে গেল কদমের। মাটিতে নেমে দেখল ধেইধেই করে নাচছে হিক সাহেব আর ওকেই খুঁজছে।
নেবেই চিঠিপত্রের খোঁজ করছে হিকস। ভালো খবর। বৌ তার সুস্থ এবং নিরাময় হয়ে বাড়িতেই আছে এখন। তাই আনন্দের চোটে রাস্তার উপরই নাচতে লেগেছে হিকস। নাচতে নাচতেই ও জড়িয়ে ধরল কদমকে, বলল, কডম, টুমিই ঠিক বলেছ। বৌ আমার অলরাইট। তারপর হিকস কয়েকটা নোট গুঁজে দিল কদমের পকেটে। বলল আবার, কডম, আজ রাত নাবিকের রাত। ডু ফুর্তি। মৌজ বানাও। আমি যাই। আমার ডার্লিং অপেক্ষা করছে।
কদম কোন কিছু বলবার আগেই আলিঙ্গন থেকে ওকে ছেড়ে দিয়ে দূর দাঁড়ানো এক শ্বেতাঙ্গিনীর দিকে এগিয়ে যায় হিকস। তারপর মেয়েটার একখানি হাত বগলদাবা করে অদৃশ্য হয়ে যায় রাস্তার মোড়ে।
নতুন শুধু জায়গাটি, অন্য কিছু বুঝি নতুন নয় কদমের চোখে। এ হাটের বাতির ধাঁ ধাঁ, হাল্কা উদ্দাম ফোয়ারা, দোকানির হাসি বিলোল কটাক্ষ প্রসারিণী, সবই ওর চেনা। বলগাহীন ফেনিল উন্মত্ত এই আনন্দের হাট দেখেছে হংকংয়ে, এডেনে, সিংগাপুরে। ভূমধ্যসাগরের একাধিক বন্দরে। ওদিকে লন্ডনেও। রক্তে রক্তে নেশা জাগানো, উন্মত্ততার তরঙ্গ ছড়ানো এই ফুর্তির হাট বুঝি সব বন্দরেই। পৃথিবীর সব বন্দরেই উপবাসী নাবিকের ক্ষুধা মিটোবার এমনি আয়োজন।
সমুদ্র তরঙ্গের ফণায় কত উচ্ছ্বাস, কত আবেগ, কত বিষ! সমুদ্রের ডাক প্রলয়ের ডাক। সমুদ্রের বুকে শুধু গর্জন আর আলোড়ন–শক্তির, ক্রুদ্ধ হিংস্র ভীষণ এক শক্তির আলোড়ন।
সাগরতরীর হুঁশিয়ারি কাণ্ডারি আপন অটলতার মাঝে বুঝি সঞ্চয় করে রাখে, ধরে রাখে সেই আবেগ, সেই উচ্ছ্বাস, সাগরবারির সেই ভীষণ শক্তির ক্রুদ্ধ উত্তেজনাটা। এমনি করে দিন যায়।
তারপর আসে তীরের ডাক বন্দরের হাতছানি। আপন বুকে সঞ্চয় করে রাখা সমুদ্রের সেই আদিম ভয়ংকরতার শক্তি লয়ে ওরা আছড়ে পড়ে তটের বুকে। লোকালয়ের শান্ত মাটিতে গোটা সমুদ্রটাকেই যেন তুলে এনে অকস্মাৎ ছেড়ে দেয় ওরা। ভেসে যায় বন্দর। ভেসে যায় বন্দরের আশপাশের পাড়াগুলোও। লোকালয়ের মানুষ বিরক্তিতে নাক সিটকায়, দোরে দেয় খিল। কিন্তু ওরা কি জানে কোন আদিম বিক্ষোভকে বুকের নিভৃতে বন্দি রেখে দিন কাটে নিঃসঙ্গ নাবিকের? ওরা কি খোঁজ রাখে কত অশ্রু মিশে থাকে সমুদ্রের লোনা জলে? ওরা জানে না বন্দরের ক্ষণিক নীড়ে মাটির গন্ধ খোঁজা নাবিক সমুদ্রেরই দীর্ঘশ্বাস।
কেউ চেনে না কদমকে। কেউ বিরক্ত করছে না ওকে। ভালো লাগে কদমের, পেট ভরে খেয়ে নিয়েছে ও। ভর্তি পেটের আরামে আস্তে-আস্তে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। চায়ের সাথে গিলছে সিগারেটের ধোঁয়া।
পায়ের নিচে ডাঙার শক্ত মাটি। চারপাশে ডাঙার মানুষের ভিড়।
ডাঙার গন্ধ গরম আর টাটকা সব খাবার। সকল নাবিকের মতোই কানায় কানায় ভরে ওঠে কদমের মনটা।
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেয় কদম। সিগারেট টানে। ধোঁয়া ছাড়ে। আর চেয়ে চেয়ে দেখে বাতি-জ্বলা এই আনন্দ হাটের কত নেশা, কত রূপ, কত আকর্ষণ। এই নেশা এই আনন্দ মাটির। এই আনন্দ সকল নাবিকের। এই আনন্দ কদমের।
বুড়ো হলেও ফুর্তির হাটে পিছিয়ে নেই মন্তু সারেং। জুটিয়ে নিয়েছে এক শ্বেতাঙ্গিনী সখী। টেবিলে বসে বিয়ার টানছে ওরা। অনর্গল কথা বলে চলেছে। মেয়েটি মাঝে মাঝে কি এক রসে হেসে ঢলে মাথাটা ছেড়ে দিচ্ছে মন্তু সারেংয়ের কাঁধে। অকস্মাৎ মাথাটা নিয়ে মন্তু সারেংয়ের সাদা পাকা দাড়িগুলোর প্রতি মনোযোগ দিয়েছে মেয়েটি। দাড়িগুলো নিয়ে খেলা শুরু করে দিয়েছে। যেন মহাকৌতুকের বস্তু খুঁজে পেয়েছে ও। মন্তু সারেং যেন খেলার পুতুল। খেলনা পুতুলের মতো বিনা প্রতিবাদে আপনাকে সঁপে দেয় মেয়েটির হাতে। মন্তু সারেংয়ের দাড়িগুলো মুঠোর ভেতর পুরে নেয় মেয়েটি, মুঠোর ভেতর কচলে যায় ঘন আগাছার মতো দাড়ির জঙ্গলটা! দুহাতে ধরা দাড়িগুলো কাছে টেনে নেয়। মেয়েটি। অমনিই যেন কোন স্প্রিং আঁটা পুতুলের মতোই এগিয়ে আসে মন্তু সারেংয়ের মুখখানিও। আচমকা মুঠো খুলে হাতটা ছেড়ে দেয় মেয়েটি, যেন ধাক্কা খেয়েই পিছিয়ে গেল মন্তু সারেংয়ের মুখ। খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে শ্বেতাঙ্গিনী সখী।
চিকন একগোছা দাড়ি ঝুট করে টান মারে মেয়েটি। উহ্ করে সরে বসে মন্ত্র সারেং কিন্তু ওর সকৌতুক আনন্দ।
এবার ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে মেয়েটি। মন্তু সারেংয়ের বিপর্যস্ত দাড়ির উপর বুলিয়ে যায় ওর চিকন আঙুলের চিরুনি। চিকন আঙুলে প্যাঁচিয়ে নেয় শুকনো খড়ের মতো দাড়িগুলো। খেলা করছে মেয়েটি আর কথা বলে চলেছে।
অবাক চোখে চেয়ে থাকে কদম। মন্তু সারেং আর ওর শ্বেতাঙ্গিনী সখী। ওদের জাত আলাদা, ভাষা আলাদা। কত তফাৎ ওদের দুটো দেশের, ওদের গায়ের বর্ণের। কিন্তু সব তফাৎকে এই মুহূর্তে যেন জয় করে নিয়েছে ওরা। পরস্পরের কথাগুলো বুঝতে একটুও যেন কষ্ট হচ্ছে না ওদের। ভাষার ব্যবধান এতটুকু অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারছে না ওদের ভাবের আদানে।
অথবা এ হলো সেই বন্দরের ভাষা যা বোঝে পৃথিবীর সকল নাবিক আর বন্দরের যত মেয়েমানুষ। অনাদিকাল থেকেই নাবিক আসে বন্দরে। এ ভাষায় কথা বলে নাবিক। এ ভাষায় ওদের বরণ করে নেয় বন্দরের ক্ষণপ্রেয়সীরা। পূর্ববঙ্গের মেঘনা পারে আমতলী গ্রামে যার বাড়ি সেই মন্তু সারেং আর দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গী মেয়ে সেই আদ্যিকালের ভাষাতেই বুঝি কথা বলে চলেছে ওরা।
রাত বাড়ছে। বাতির রোশনিটাও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। উলটোদিকের সরু রাস্তা থেকে হল্লা আসছে, বন্দর নগরের পরিচিত নাবিক হল্লা। কদম দেখল রুতুন্দা জাহাজের দুনম্বর সাহেব ডি সিলভা কোন কৃষ্ণাঙ্গিনীকে বগলে লয়ে বড় রাস্তা ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ফিটফাট পোশাক-পরা জনৈক শ্বেতাঙ্গ এসে দাঁড়িয়ে পড়ল মন্তু সারেংয়ের টেবিল ঘেঁষে। বন্দরেরই কোন নিগূঢ় সংকেতে চোখে চোখে কি যেন কথা হয়ে গেল ওদের। লোকটি চলে গেল কাফের পেছন দিকে। মন্তু সারেং আর একটা বোতলের ফরমাশ দিয়ে কি যেন বলল ওর আজকে–রাতের প্রেয়সীকে। ঘাড় নেড়ে বুঝি সম্মতি দিল মেয়েটি। মন্তু সারেং উঠে এলো কদমের টেবিলের দিকে। বলল, ভাতিজা একটু কথা আছে। একটু আগে শ্বেতাঙ্গ সাহেবটা যে দিকে মিলিয়ে গেছিল কাফের সেই পেছনের দিকটাতে কদমকে নিয়ে এলো মন্তু সারেং।
যেন আলাদা, কিন্তু কাফেরই একটি প্রসারিত অংশ এ জায়গাটুকু। একটু খোলামেলা, নিরিবিলি। অন্ধকার। পাশাপাশি ছোট ছোট কতগুলো ঘর। ঘরের ভেতরে প্রায় না-জ্বলার মতো টিমটিমে আলো।
কদমকে নিয়ে একটি ঘরের পর্দা সরিয়ে ঢুকে পড়ল মন্তু সারেং। বসে আছে সেই সাহেবটি। নিজের দুপকেট থেকে বড় রকমের দুটো কাগজের মোড়ক বের করল মন্তু সারেং। তারপর অকস্মাৎ কদমের লং-কোটটির পকেটে হাত চালিয়ে দিল মন্তু সারেং। বের করে আনল সেই অয়েল পেপারে জড়ানো মোড়কটি। হতভম্বের মতো চেয়ে রইল কদম।
তিনটি মোড়কই সাহেবের হাতে তুলে দিল মন্তু সারেং। এক তাড়া নোট ধরাই ছিল সাহেবের হাতে। নোটগুলো মন্তু সারেংয়ের হাতে ফেলে ত্বরিত বেরিয়ে গেল সাহেব।
এ কী চাচা? আমার পকেটে ওটা কখন রেখে দিয়েছিলে তুমি? ছিঃ ছিঃ ধরা পড়ে গেলে কি কাণ্ডটা হতো বলো দেখি? বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে চিৎকার করে উঠল কদম।
চুপ চুপ। ওকে এক রকম টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এলো মন্তু সারেং। বাইরে এসে বলল, ও– বুঝলে ভাতিজা, চাচা ভাইপোর জন্য দুটো ঘরই ঠিক করে রেখেছি। এই যে দেখলে, এটা আমার। এর পরেরটা তোমার। এই দেখ। পাশের দরজার পর্দাটা সরিয়ে ফিটফাট বিছানার শূন্য ঘরখানা কদমকে দেখিয়ে দিল মন্তু সারেং।
কিন্তু…।
কদমকে মুখটা খুলতেই দেয় না মন্তু সারেং। আগের কথাটাই ছেদ না টেনে বলে চলেছে সে যখন খুশি এসে পড় ঘরে। সারা রাত তোমার দখলে। আহা, এত শরম কিসের। চাচাই হই আর ভাইপোই হই, হলাম গিয়ে জাহাজি, জাহাজিদের অত শরম রাখলে চলে?
নোটের সেই তারা থেকে কয়েকখানা নোট আলাদা করে নিল মন্তু সারেং। গুঁজে দিল কদমের পকেটে। কদমের মুখ থেকে ছোট্ট একটা প্রতিবাদ বেরিয়ে আসার আগেই নিজের টেবিলের দিকে রওনা দিয়েছে মন্তু সারেং।
কদমের বাপের দোস্ত মন্তু সারেং। কদমের শ্রদ্ধার জন মন্তু সারেং, শুধু বয়সের জন্য নয়, তার বিরাট অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের জন্যও। সাগরের নাড়িনক্ষত্র মন্তু সারেংয়ের নখদর্পণে। রুতুন্দা জাহাজটার সূক্ষ্ম যত কলকব্জা মন্তু সারেংয়ের ইশারার দাস। কামেল, লায়েক, এমেলদার জাহাজি মম্ভ সারেং।
সেই মন্তু সারেং এমন?
কেমন দমে যায় কদমের মনটা। ফেলে যাওয়া সেই টেবিলটা এখনো খালি। চেয়ারটা টেনে ধপ করে বসে পড়ে কদম।
ভাবতে গিয়ে অবাক লাগে কদমের। কানে শোনা আর চোখে দেখায় কত তফাৎ। মন্তু সারেংয়ের বিচিত্র বেচাকেনার কাহিনী কতজনের মুখে কত বর্ণনায় শুনেছে কদম। তবু ওর চোখে মন্তু সারেং যেন ছোট হয়নি কখনো, যেমনটি হলো আজ।
বিল মিটিয়ে দিল মন্তু সারেং। তারপর শ্বেতাঙ্গিনী সখীটির হাত ধরে উঠে গেল কাফের পেছনে অন্ধকার সেই ঘরগুলোর দিকে। মেয়েটি এখন আর কথা বলছে না।
যেখানে উঁচু বেদি মতন জায়গায় ইংরেজি বাজনা বাজছে সেখানে বেদিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। ও দেখছিল মন্তু সারেং বেশ কয়েকটা কাগজের টাকা গুঁজে দিল কদমের পকেটে। সেই থেকে কী এক চোখে কদমকেই দেখে চলেছে মেয়েটি।
কদম মুখ তুলল। চোখাচোখি হয়ে গেল মেয়েটির সাথে। চকচকিয়ে গেল মেয়েটির চোখ। মেয়েটির মুখে নিলাজ আমন্ত্রণ। মেয়েটির টকটকে লাল ঠোঁটে কামনা দুর্নিবার।
চমকে উঠল কদম। বিলোল কটাক্ষ মেয়েটির মুখে বন্দরের ভাষা। মুখ ঘুরিয়ে নিল কদম।
আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করল না মেয়েটি। এসে বসল কদমের পাশের চেয়ারটিতে। চাইল একটু তৃষ্ণার পানি।
কদম এক বোতল বিয়ার আনিয়ে দিল ওকে। বিয়ারের বোতলটা শেষ করে কিছু খেতে চাইল মেয়েটি। বড় খিদে পেয়েছে ওর। খাবার এলো।
খেতে খেতে বন্দরের ভাষায় কথা বলে চলল মেয়েটি। একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল মেয়েটি। কদমের হাতের পাশেই টেবিলের উপর রাখল বাম কনুইটি। শঙ্খশুভ্র বাহু মেয়েটির। শঙ্খশুভ্র বাহুর স্পর্শ লাগল কদমের হাতে। তুলোর মতো তুলতুলে মেয়েটির বাহু। ফুলের পাপড়ির মতো নরম তার স্পর্শ। সে স্পর্শটি লেগে থাকল কদমের বাহুতে।
আবারও চমকে উঠল কদম। কিন্তু সরে বসতে পারল না ও। পারল না শঙ্খশুভ্র তুলো-কোমল সে বাহু স্পর্শের মায়া কাটিয়ে নিজের হাতখানি সরিয়ে নিতে। বন্দরের মেয়ের স্পর্শে কী এক জাদু।
পরম তৃপ্তির সাথে রয়ে গেল মেয়েটি। খাবারগুলো শেষ হলে তাকাল কদমের দিকে। খেয়ে বড় তৃপ্তি পেয়েছে ও, খুশি হয়েছে তারই জন্য ধন্যবাদ বিদেশী নাবিককে। কদম দেখল মেয়েটির চোখে সেই নিঃশব্দ ধন্যবাদ।
হঠাৎ মেয়েটির পেট ফুঁড়ে যেন গলা গলিয়ে বেরিয়ে এলো হাসি। রাশি রাশি হাসি। হাসির তোড়ে যেন এলোপাতাড়ি ছিটকে পড়ছে ওর হাতগুলো, পাগুলো। হাসতে হাসতেই ওর মুখটা এসে ছুঁয়ে গেল কোটের কলারের উপর জেগে থাকা কদমের খোলা কাঁধটুকু।
অচিন মেয়েটির এমন দম ফাটিয়ে হাসবার এমন কি কারণ ঘটল ভেবে পায় না কদম।
অবশেষে হাসির ওপর লাগাম টেনে বলল মেয়েটি– তুমি কি বোবা নাকি গো! কথা বলছ না কেন? বলতে বলতেই লাগামটা হাতছাড়া হয়ে গেল মেয়েটির। আবার হাসছে ও।
হাসি আর কৌতুক, এ বুঝি বন্দরের মেয়েদের স্বভাবের অঙ্গ। কদমের মনে পড়ল মন্তু সারেংয়ের ক্ষণপ্রেয়সীর কথা। সেও মহাকৌতুকে খেলছিল মন্তু সারেংয়ের দাড়ির ঝোপে আঙুলের সুড়সুড়ি চালিয়ে।
অচিন মেয়েটি এখনো হাসছে। হাসতে হাসতেই বুঝি মেয়েটির একখানি পা এসে বসে গেল, দেবে গেল টেবিলের নিচে কদমের উরুটার ওপর। আর সেই শঙ্খশুভ্র বাহুখানা আরো সরে এসে লেগে থাকল কদমের বুকের সাথে। কদম নির্বাক।
এ বুঝি বন্দরের নেশা, বন্দরের ভাষায় বন্দর মেয়ের একান্ত আপন কথা। নেচে ওঠে রক্ত কণিকারা। কনকনিয়ে যায় শিরা-উপশিরা। শিখায় শিখায় জ্বলে ওঠে কী এক দাহ, জ্বলে ওঠে সেই স্ফুলিঙ্গ কীটগুলো, মাংসের নিচে অসংখ্য ঝিল্লিরন্ধ্রে যাদের গোপন বাসর। উগ্র উন্মত্ত এক নেশা, বন্দরের নেশায় চঞ্চল হয়ে ওঠে উপবাসী নাবিক কদম।
বস্তুপিণ্ডের একটি জড় জগৎ কদম সারেং। সে জগৎটাকে প্রচণ্ড আঁচে ঝলসে দেয় বন্দরের মেয়ে। ভীষণ এক শক্তি বন্দরের মেয়েটি। সে শক্তির টানে উৎক্ষিপ্ত ছিন্নভিন্ন কদম সারেং। সহসা সে শক্তিটি ওকে ধপ করে ফেলে দিল শক্ত মাটিতে। সরে বসল বন্দরের মেয়ে। আবারও খিলখিলিয়ে গা দুলিয়ে হাসল ও। বলল, আইসক্রিম খাওয়াবে? আইসক্রিম এলো।
ওমা, কেমন লোক গো তুমি। এতক্ষণ না হয় একলা একলাই খেলাম। এবারও একলাই খাব?
আর এক পেয়ালা আইসক্রিমের হুকুম দিল কদম।
কিন্তু, অমন করে খিলখিলিয়ে হাসল কেন মেয়েটি? হয়তো ভেবেছে মেয়েটি– একেবারে আনাড়ি আনকোরা নাবিক বন্দরের ঢং ফং বোঝে না কিছু। সে জন্যই কদমের মনে হলো, কদমের মুখের দিকে তাকিয়ে অমন করে হাসল মেয়েটি।
বাহ্, ভারি চমৎকার আইসক্রিম। আর এক পেয়ালা খাওয়াবে না… না না। দুজনের জন্য। তুমিও খাও।
দুপেয়ালা আইসক্রিম খেয়ে, চোখের নিঃশব্দ ভাষায় নয়, মুখ ফুটিয়েই কদমকে ধন্যবাদ দিল মেয়েটি। ধন্যবাদ দিয়ে বলল, এবার কফি খাব। কেমন অবলীলায় চেয়ে নেয় মেয়েটি। যেন চিরদিনের চেনাজানা, চিরদিনের ঘনিষ্ঠতা কদমের সাথে। অথবা এটাই রীতি বন্দরের দেশে। পরিচয় বাহুল্য, ভূমিকা অপ্রয়োজনীয় এখানে। সৌজন্য বর্জনীয়। আমন্ত্রণের দরকার পড়ে না। এ রীতিই চলে আসছে আবহমানকাল থেকে, যেদিন ইতিহাসের প্রথম দুঃসাহসী সপ্তডিংগায় পাল উড়িয়েছিল নিরুদ্দেশের পথে সেদিন থেকে।
সেদিন থেকেই ক্লান্ত উপবাসী নাবিক খুঁজে নিয়েছে বন্দরের মেয়েকে।
সেদিন থেকেই অপেক্ষা করে থাকে বন্দরের মেয়ে, কখন আসবে ওর নাবিক নাগর। বন্দরের মেয়ে আপন অঙ্গে তুলে নেবে প্রবাসী নাবিকের সমস্ত শ্রান্তি, ক্লান্তি, নিঃসঙ্গতার যত বেদনা। আপন দেহের কোমল উষ্ণতা দিয়ে আপন বুকের সুধা দিয়ে ভরিয়ে তুলবে নাবিকের শূন্য মন। তৃপ্ত নাবিক আবার পাড়ি দেবে সমুদ্রের অজানায়। তাই তো অত আবদার বন্দর মেয়ের।
তাই তো পরিচয় ওদের যুগযুগান্তরের; মজল সারেংয়ের ব্যাটা কদম সারেং আর ওই শুভ্রবাহু মেয়েটির। তাই তো কদম সারেংয়ের রক্তে আজ আদ্যিকালের সেই প্রথম নাবিকের জাগরণ। প্রথম নাবিকের পিপাসা।
গভীর হয়েছে রাত। গাঢ় হয়েছে বন্দরের নেশা। নাবিক আর ওদের ক্ষণপ্রেয়সীরা জোড়ায় জোড়ায় বার রেস্তোরাঁর হল ছেড়ে উঠে যাচ্ছে একটুখানি নিভৃতির খোঁজে। যারা এখনো রয়ে গেছে তাদের বোধহয় শক্তি নেই দুপায়ে উঠে দাঁড়াবার। ওদের নেতিয়ে পড়া মাথাগুলো কাঁধের উপর ধরে রেখেছে বন্দর মেয়েরা।
এবার বুঝি আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল মেয়েটি। কদমের গলায় পরিয়ে দিল ওর শঙ্খশুভ্র হাতের বলয়। অন্য টেবিলের মেয়েগুলোর মতো সেও বুঝি আপন কাঁধে ধরতে চায় কদমের মুখের ভাব, অনুভব করতে চায় ওর ঘন নৈকট্যের উষ্ণতা। আর চায় ওর মাঝে সব ভার ছেড়ে দিয়ে বিশ্রাম করুক, ঘুমিয়ে পড়ুক ওর ক্লান্ত নাবিকটি।
এতক্ষণে, বুঝি এই প্রথম মেয়েটিকে ভালো করে দেখল কদম। মেয়েটির চোখে চোখ রাখল কদম। চোখ রেখে যেন শিউরে উঠল, কেঁপে উঠল কদম। বন্দরের মেয়ের চোখে এ কোন সমুদ্রের ছবি দেখছে কদম? ওর নীল চোখের কোলে যেন সমুদ্রের ফেনিল উন্মত্ততা। ওর গোটা দেহের ভাঁজ যেন সমুদ্রের তরঙ্গোচ্ছ্বাস, তরঙ্গে বেপরোয়া উদ্দামতার ডাক। ওর শরীরের উষ্ণতায় যেন সেই সাগরের আহ্বান, যে আহ্বানে রিনরিনিয়ে যায় নাবিকের ধমনি। চঞ্চল হয়, অস্থির হয় নাবিক। ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুব্ধ-তরঙ্গে সেই উন্মত্ততার বুকে।
তবে কি বন্দরের মেয়ে নয় পোতাশ্রয়ের ক্ষণিক শান্তি? বন্দরের মেয়ে আর এক সমুদ্র ফেনিল? রুতুন্দা জাহাজের তরুণ নাবিক কদম, ওর রক্তেও সে সমুদ্রের স্রোত অশান্ত, নির্মম। ও কেমন করে ঠেকিয়ে রাখবে আর এক সমুদ্রের দুর্নিবার আকর্ষণ?
বন্দরের মেয়েটির কাঁধে ঢলে পড়ে কদমের মুখখানি। কদমের মুখ, কদমের ঠোঁট স্পর্শ পেল কী এক উষ্ণতার, তীব্রতার, উগ্রতার, জাদুকরি এক মাদকতার। বিশাল এক সমুদ্র বুঝি আর এক সমুদ্রের বুকে এসে আছড়ে পড়বে, দুই সমুদ্র লীন হবে অনন্ত বারির মহাকল্লোলে।
বাহুর কোমল বলয়ে কদমের মুখখানি ধরে রাখল মেয়েটি। কদমের মুখখানি কাঁধের উপর তেমনি ধরে রেখেই উঠে দাঁড়াল মেয়েটি। আস্তে-আস্তে যেন পা ফেলল ওরা। পা ফেলল সেই আধো-আঁধারের নিভৃতির দিকে।
কিন্তু… নবিতুন…?
কদম যে কসম খেয়েছে। নবিতুনের কসম। তবে?
মুহূর্তে ছিটকে এলো কদম। ছিটকে এসে বসে পড়ল চেয়ারে। বসে বসে হাঁপিয়ে চলল দৌড় প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া প্রতিযোগীর মতো। বুঝি অবাক বন্দরের মেয়ে। বন্দরের মেয়ে এমন নাবিক দেখেনি কখনো। কদমের পাশে এসে বসে ও। শুধায় কি হলো?
এমনি সময় নৈশ নেশায় গাঢ় পর্দা ছিঁড়ে বেজে উঠল তীক্ষ্ণ হুইল। বুকের মড়মড় কড়কড়, হৈ হাক, ব্যানটের অকারণ আস্ফালন। চারদিকে পলায়নের হিড়িক। নিমিষের মাঝেই আনন্দের হাট রূপান্তরিত হলো আতঙ্কের হাটে।
সাদায়-কালোয় মেলামেশা করে রাজ্যের আইন ভঙ্গ করেছে বন্দরের মেয়ে আর ভিনদেশী নাবিক। তাই আইন রক্ষা করতে ছুটে এসেছে রাজ্যের কোটাল বাহিনী।
পলকে উঠে দাঁড়াল মেয়েটি। খপ করে ওর একখানি হাত ধরে নিল কদম। পকেট থেকে বের করল হিকস আর মন্তু সারেংয়ের দেয়া সেই টাকাগুলো। টাকাগুলো খুঁজে দিল মেয়েটির হাতে।
কি যেন ভাবল মেয়েটি। তাকাল কদমের দিকে। আশ্চর্য হয়েই দেখল কদম, এখন সমুদ্র নেই বন্দর-মেয়ের চোখে। তিরোহিত সেই ফেনিল উন্মত্ততা। বন্দর মেয়ের চোখ স্নিগ্ধ। কী এক কৃতজ্ঞতার শিশিরে টলমল তার চোখের তারা। বন্দরের মেয়ে এখন যেন গৃহের বধূ নবিতুন।
এখনো ভাবছে মেয়েটি। নোটগুলো নাড়াচাড়া করল ও। উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখল যেন। তারপর কম্পিত কুণ্ঠিত দুটো আঙুলে তুলে নিল মাত্র দুখানি নোট। ব্যাগের ভিতর ভরে নিল নোট দুখানি। কৃতজ্ঞতার ক্ষণিক দৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিল কদমকে। বাকি নোটগুলো টেবিলের উপর রেখে ছুটে গেল দরজার দিকে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে কদম বুঝি পা বাড়াল মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে আইনের প্রহরীরা ঘিরে নিয়েছে ওকে। আইনের প্রহরী হাত বাড়িয়ে তুলে নিল টেবিলে পড়ে থাকা নোটের টাকাগুলো, অবলীলায় ছেড়ে দিল পকেটে। তারপর এক ধাক্কায় পাঠিয়ে দিল কদমকে খোলা দরজার বাইরে রাস্তার দিকে।
বন্দরের বিপণিতে শেষ রাতের অবসাদ। বন্দরের পথে কাঁচ ভাঙা, বোতল ভাঙা। বন্দরের আলো নিষ্প্রভ, বুঝি রাতভর জেগে জেগে এখন একটু তন্দ্রার ঘোর লেগেছে ওদের চোখে। আস্তে-আস্তে ভাঙা কাঁচ গুঁড়িয়ে জাহাজে ফিরে এলো কদম।
শুয়ে শুয়ে বৃথাই এপাশ-ওপাশ করল কদম। ঘুম বুঝি আসবে না আজ। বোজা চোখের সুমুখে বারবার ভেসে উঠছে একখানি মুখ। স্বচ্ছ আর স্পষ্ট করে কদম দেখতে চায় সে মুখ। কিন্তু নবিতুনের মুখখানি যেন কিছুতেই মনে করতে পারে না ও। যে মুখ ভেসে ওঠে সে আর এক মুখ, বন্দর মেয়ের চটুল মুখ।
বিছানা ছেড়ে উঠে যায় কদম। খোলা ডেকটায় এসে দাঁড়ায় ও। চোখ দুটোকে ছেড়ে দেয় বন্দর আলোর উল্কি-আঁকা জলের বুকে। দূরে দেখা যায় একটি উপকূলবাহী জাহাজ। মনে হয় অনেক আলো হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে জলের উপর দিয়ে।
মাথার উপর তারাভরা আফ্রিকার আকাশ। পায়ের নিচে নৃত্যচঞ্চলা সমুদ্র। কলকল ছলছল কি এক আনন্দগুঞ্জন।
নবিতুনের সম্পূর্ণ মুখটা কেন আজ মনে করতে পারছে না কদম? একটুখানি আভাস দিয়েই আবার যেন মিলিয়ে যায়। ভাসাভাসা আদল, কপালটুকু অথবা ঠোঁটের কিনারে কবেকার কাটা দাগজাগা চিবুকের অংশটুকু, ভেসে উঠেই ডুবে যায়, ভেঙে যায় ঢেউয়ের বুকে বন্দর বাতির ইলিবিলি রেখাগুলোর মতো। আর কী আশ্চর্য! সেই অস্বচ্ছতা, সেই অস্পষ্টতার আবছায়া ডিংগিয়ে জেগে ওঠে শঙ্খশুভ্র নিটোল দুখানি বাহু, নীল একজোড়া চোখ– স্পষ্ট, অতি স্পষ্ট নেই বন্দরের মেয়ে।
কি হলো কদম সারেংয়ের? বন্দরের মেয়ে কি জাদু করল ওকে? ভুলিয়ে দিল শান্ত বৌ নবিতুনের মসৃণ পাটিপাতা সহজ মুখখানি? জাদুকরি বিদেশিনী। এই জাদুকেই তো যত ডর নবিতুনের!
সমগ্র দুনিয়া জাহানের বিরুদ্ধে অশ্রাব্য যত গালিগালাজ বর্ষণ করতে করতে উঠে আসছে হিক সাহেব। অসংযত তার পা। ওর সেই বন্দর সঙ্গিনীর কাঁধে মাথা রেখে আস্তে-আস্তে চলেছে। হঠাৎ পা ফসকে পাটাতনের উপর পড়ে যায় হিক সাহেব। অসহায় মেয়েটি চোখ ফেলছে এদিক-ওদিক একটু সাহায্যের আশায়।
কদম গিয়ে উঠিয়ে নিল সাহেবকে। ওর কাঁধে ভর রেখে বলল, হিক সাহেব, কডম তুমি নাইছ বয়। আমার ডার্লিং পা ফসকে পড়ে গেছে, ওকে একটু সাহায্য করবে?
মেয়েটি হাসল।
বিড়বিড়িয়ে রাগ ঝাড়ে কদম, পথেঘাটেই শালার গণ্ডাগণ্ডা ডার্লিং।
হিকস আর তার ডার্লিংকে ক্যাবিনে রেখে এসে অকারণেই জাহাজটার এপাশ-ওপাশ ঘুরে বেড়ায় কদম।
বঞ্জেড অর্থাৎ, শুল্কাধীন ঘরটার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায় কদম। ফার্স্ট মেট ডি সিলভা আর মন্তু সারেং খুলে ফেলেছে সেই নিষিদ্ধ ঘর। অতিদ্রুত বের করে এনেছে প্লাইউডের কতগুলি বাক্স।
বাক্সগুলো ওরা নামিয়ে দিল নিচে অপেক্ষমাণ একটি স্টিমবোটে। নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল স্টিমবোট। দেখেও না দেখার ভান করে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে এলো কদম। উঠে এলো ছাদে। ব্রিজটার উপর দাঁড়িয়ে আপনাকে ছেড়ে দিল হু-হু হাওয়ার মাতমের মুখে।