৫
এখন বাজছে সকাল ১১টা। কিছুক্ষণ আগে আমি নাস্তা খেয়ে লিখতে বসেছি। সকালের চা এখনো খাওয়া হয় নি। চা দিয়ে গেছে। চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। আমার চায়ের কাপের ধোঁয়া দেখতে খুব ভালো লাগে। মিসির আলি সাহেব আপনার কি চায়ের কাপের ধোঁয়া দেখতে ভালো লাগে? মানুষের ভালোলাগাগুলি একরকম হয় না কেন বলুন তো? মানুষকে তো নানান ভাবে ভাগ করা হয়। তাদের ভালোলাগা, মন্দলাগা নিয়ে তাদের ভাগ করা হয় না কেন? আপনারা সাইকিয়াট্রিস্টরা সেরকম ভাগ করতে পারেন না?
যেমন ধরুন যেসব মানুষ—
ক) চায়ের কাপের ধোয়া ভালবাসেন।
খ) বেলি ফুলের গন্ধ ভালবাসেন।
গ) চাঁপা রঙ ভালবাসেন।
তাদের মানসিকতা এক ধরনের। (আমার মত।) তাদের চিন্তাভাবনায় খুব মিল থাকবে।
আচ্ছা আপনি কি আমার জ্ঞানী টাইপ কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছেন?
থাক আর বিরক্ত হতে হবে না, এখন আমি মূল গল্পে ফিরে যাই। এখন যে চ্যাপ্টারটা বলব সেই চ্যাপ্টারের নাম—নীতু আন্টি।
আমি ঘুমাচ্ছিলাম—রাত দশটাটশটা হবে। আমার ঘরের দরজা খোলা। ছোট মানুষ তো কাজেই দরজা খোলা থাকত। যাতে রাতে-বিরাতে বাবা এসে আমাকে দেখে যেতে পারতেন। এই কাজটা বাবা করতেন—রাতে খুব কম করে হলেও দু বার এসে দেখে যেতেন। তখন ঘুম ভেঙে গেলেও আমি ঘুমিয়ে থাকার ভান করতাম। কারণ কী জানেন? কারণ হচ্ছে আমি যখন জেগে থাকতাম তখন বাবা আমাকে আদর করতেন না। ঘুমন্ত অবস্থাতেই শুধু আদর করতেন। মাথার চুলে বিলি কেটে দিতেন। হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করতেন। এমনকি মাঝে মাঝে ঘুমপাড়ানি গানও গাইতেন। যদিও আমি তখন বড় হয়ে গেছি। ঘুমপাড়ানি গান শোনার কাল শেষ হয়েছে। ঘুমন্ত মানুষকে গান শুনানো— খুব মজার ব্যাপার না? আমার বাবা আসলেই বেশ মজার মানুষ। ভালবাসার প্রকাশকে তিনি দুর্বলতা বলে ভাবেন। (আরেকটা ব্যাপারও হতে পারে, বাবা হয়তো আমাকে ভালবাসতেন না। ভালবাসার ভান করতেন। মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে ভান করা যায় না বলেই আমি যখন ঘুমাতাম তখন ভান করতেন।)
নীতু আন্টির মধ্যেও এই ব্যাপার ছিল। ভালবাসার প্রকাশকে তিনিও দুর্বলতা মনে করতেন। তাঁর প্রধান চেষ্টা ছিল কেউ যেন তাঁর দুর্বলতা ধরে না ফেলে। তিনি শুরু থেকেই আমাকে পছন্দ করতেন। কিন্তু তাঁর দুর্বলতা আমি যেন ধরতে না পারি এটা নিয়ে সব সময় অস্থির থাকতেন।
তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখার গল্পটা শুনুন। আমি শুয়ে আছি। ঘুমাচ্ছি। হঠাৎ ঘুম ভাঙল। দেখি কে একজন আমার চুলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রথম ভাবলাম ছোট মা। তারপরই মনে হল, না ছোট মা না—ইনার গায়ের গন্ধ অন্যরকম। বেলি ফুলের গন্ধের মতো গন্ধ। আমি চোখ মেললাম। তিনি হাত সরিয়ে নিয়ে শুকনো গলায় বললেন, ঘুম ভাঙিয়ে ফেললাম?
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। তিনি আমার পাশে বসতে বসতে বললেন, ‘শোন মেয়ে আমি এখন থেকে তোমাদের বাড়িতে থাকব। তোমার বাবার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে।’ আমি তাকিয়ে রইলাম। কিছু বললাম না। তিনি আগের মতোই শুকনো গলায় বললেন, তুমি তো ইতিমধ্যে দুজনকে মা ডেকে ফেলছ। আমাকে মা ডাকার দরকার নেই। আমাকে আন্টি ডাকতে পার। অসুবিধা নেই। আমার নাম নীতা। তুমি ইচ্ছে করলে নীতু আন্টিও ডাকতে পার।
‘জি আচ্ছা।’
‘ঘর এত নোংরা কেন? চারদিকে খেলনা। কাল সকালেই ঘর পরিষ্কার করবে।’
‘জি আচ্ছা।’
‘শোবার ঘরে স্যান্ডেল কেন? স্যান্ডেল থাকবে শোবার ঘরের বাইরে। শোবার ঘরটা থাকবে ঝকঝকে তকতকে, একদানা বালিও সেখানে থাকবে না। বুঝতে পারছ?’
‘জি।’
‘এখন থেকে শোবার আগে চুল বেঁধে শোবে। এতদিন তো চুল বাঁধার কেউ ছিল না। এখন থেকে আমি বেঁধে দেব। আরেকটা কথা শুনে রাখ—আমি কিন্তু আহ্লাদ পছন্দ করি না। আমার সাথে কখনো আহ্লাদী করবে না। না ডাকলে আমাকে এসে বিরক্ত করবে না। মনে থাকবে?’
‘থাকবে।’
‘বাহ্ তোমার চুল তো খুব সুন্দর। সিল্কি চুল।’
এই বলে তিনি আমার মাথার চুল নিয়ে খেলা করতে লাগলেন। আমি তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেললাম—ইনি চমৎকার একজন মহিলা। ইনার সঙ্গে সব রকম আহ্লাদ করা যাবে। এবং আহ্লাদ করলেও তিনি রাগ করবেন না। আমি আরো বুঝলাম এই মহিলার ভেতরও অনেক ধরনের আহ্লাদীপনা আছে।
নীতু আন্টি খুব সুন্দর ছিলেন। তাঁর মুখ ছিল গোলাকার। চোখ বড় বড়। তবে বেশিরভাগ সময়ই চোখ ছোট করে ভুরু কুঁচকে তাকাতেন। ভাবটা এরকম যে তিনি খুব বিরক্ত হচ্ছেন।
তিনি বাড়িতে এসেই বাড়ির কিছু নিয়মকানুন পাল্টে দিলেন—যেমন আগে একতলা থেকে কাজের মানুষরা কেউ দোতলায় আসতে পারত না। এখন থেকে পারবে। শুধু যে পারবে তাই না—একটা কাজের মেয়ে রাখা হল, যার একমাত্র কাজ আমার ঘর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা এবং রাতে আমার ঘরেই ঘুমানো। তার জন্যে একটা ক্যাম্প খাটের ব্যবস্থা করা হল। সে ঘুমাতে যাবার আগে আগে আমার শোবার ঘরে সেই ক্যাম্প খাট পাতা হত। কাজের মেয়েটার নাম শরিফা। পনের-ষোল বছর বয়স। ভারী শরীর। দেখতে খুব মায়া-কাড়া। তার ছিল কথা বলা রোগ। অন্যদের সামনে সে চুপ করে থাকত। রাতে ঘুমাতে যাবার সময় যখন আমি ছাড়া আর কেউ থাকত না তখন সে শুরু করত গল্প। ভয়ঙ্কর সব গল্প সে অবলীলায় বলত। গল্প শেষ করে সে নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘুমাতে যেত। বাকি রাতটা আমার ঘুম হত না।
ভয়ঙ্কর গল্পগুলি কী আপনি নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছেন। আপনার ধারণা ভয়ঙ্কর গল্প মানে ভূতপ্রেতের গল্প। আসলে তা না। ভয়ঙ্কর গল্প মানে নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের গল্প। আমার কাছে ভয়ঙ্কর লাগত কারণ এই ব্যাপারটা অস্পষ্টভাবে জানতাম। আমার কাছে তা নোংরা, অরুচিকর এবং কুৎসিত মনে হত। আমি শরিফার গল্পের একটা নমুনা দিচ্ছি। আপনি আমার মানসিক অবস্থা ধরার চেষ্টা করছেন বলেই দিচ্ছি। অন্য কাউকে এ ধরনের গল্প আমি কখনো বলব না। আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। শরিফার যে গল্পটি আমি বলছি তা হচ্ছে তার কাছ থেকে শোনা সবচে ভদ্র গল্প। আমি শরিফার ভাষাতেই বলার চেষ্টা করি
‘বুঝছেন আফা—আমরা তো গরিব মানুষ—আমরার গেরামের বাড়িত টাট্টিখানা নাই। টাট্টিখানা বুঝেন আফা? পাইখানারে আমরা কই টাট্টিখানা। উজান দেশে কয় টাট্টি ঘর। তখন সইন্ধা রাইত—আমার ধরছে ‘পেসাব’। বাড়ির পিছনে রওনা হইছি হঠাৎ কে জানি আমার মুখ চাইপ্যা ধরছে। চিক্কুর দিমু হেই উপায় নাই। আন্ধাইরে পরিষ্কার কিছু দেখা যায় না। খালি বুজতাছি দুইটা গুণ্ডা কিসিমের লোক আমারে টাইন্যা লইয়া যাইতাছে। আমি ছাড়া পাওনের জন্যে হাত পাও মুচড়াইতাছি। কোনো লাভ নাই। এরা আমারে নিয়া গেল ইস্কুল ঘরে। এরার মতলবটা তো আফা আমি বুঝতে পারতাছি। আমার কইলজা গেছে শুকাইয়া। এক মনে দোয়া ইউনুস পড়তাছি। এর মধ্যে ওরা আমারে শুয়াইয়া ফেলছে। একজনে টান দিয়া শাড়ি খুইল্যা ফেলছে
গল্পের বাকি অংশ আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। আপনি অনুমান করে নিন। এ জাতীয় গল্প রোজ রাতে আমি শুনতাম। আমার শরীর ঝিমঝিম করত। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অনুভূতি। যার সঙ্গে আমি পরিচিত না। তখন আমার বয়স—মাত্র তের।
মিসির আলি সাহেব, শরিফার গল্প শোনার জন্যে আমি অপেক্ষা করতাম। ‘ভয়ঙ্কর’ ভালো লাগত। আপনি লক্ষ করুন আমি ভালো শব্দের আগে ‘ভয়ঙ্কর’ বিশেষণ ব্যবহার করেছি।
নীতু আন্টিও আমাকে গল্প বলতেন। সুন্দর সুন্দর সব গল্প। তার কিশোরী বয়সের সব গল্প। একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ হয়েছেন। চাচাতো বোন ভাই সব মিলিয়ে বাড়িতে অনেকগুলি মানুষ। সারা দিন কোথাও না কোথাও মজার কিছু হচ্ছে। নীতু আন্টির এক বোন আবার প্ল্যানচেট করা জানত। সে রোজই আত্মা নিয়ে আসত। বিখ্যাত ব্যক্তিদের আত্মা—রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, শেকসপীয়র, আইনস্টাইন, এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আসতেন খুব ঘন ঘন। প্ল্যানচেট করলেই তিনি চলে আসতেন। দু লাইন, চার লাইনের কবিতা লিখে যেতেন। সেসব কবিতা খুব উচ্চমানের হত না। কে জানে কবিরা হয়তো মৃত্যুর পর তাদের কাব্যশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ওনার লেখা একটা কবিতার নমুনা
‘আকাশে মেঘমালা
বাতাসে মধু
নীতু নব সাজে সেজে
নবীনা বধূ’
একবার নীতু আন্টির বিয়ের কথা হচ্ছিল তখন রবীন্দ্রনাথ প্লানচেটে এই কবিতা লিখে যান। সেই বিয়ে অবশ্য হয় নি।
আমি নীতু আন্টিকে খুব করে ধরলাম আমাকে প্ল্যানচেট শিখিয়ে দিতে। তিনি শিখিয়ে দিলেন। খুব সহজ, একটা কাগজে এ বি সি ডি লেখা থাকে। একটা বোতামে আঙুল রেখে বসতে হয়। মুখোমুখি দুজন বসতে হয়। মুখে বলতে হয়—If any good soul passes by, please come. তখন মৃত আত্মা চলে আসেন এবং বোতামে আশ্রয় নেন। এবং বোতাম নড়তে শুরু করে। আত্মাকে প্রশ্ন করলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে সেই প্রশ্নের জবাব আসে। এক অক্ষর থেকে আরেক অক্ষরে গিয়ে পুরো বাক্য তৈরি হয়। এ বি সি ডি না লিখে অ, আ, লিখেও হয়। তবে A B C D লেখাই সহজ।
.
নীতু আন্টির কাছ থেকে শিখে আমি খুব আত্মা আনা শুরু করলাম। বেশিরভাগ সময়ই রবীন্দ্রনাথ আসেন। মনে হয় তাঁর অবসরই সবচেয়ে বেশি।
এক রাতে ছোট মা চলে এলেন। সে রাতে বাসায় কেউ ছিল না। বাবা এবং নীতু আন্টি গিয়েছেন বিয়েতে। ফিরতে রাত হবে। শরিফা গিয়েছে দেশের বাড়িতে। তার মামা এসে তাকে নিয়ে গেছে। তার বিয়ের কথা হচ্ছে। বিয়ে হয়ে গেলে সে আর ফিরবে না। একা একা প্ল্যানচেট নিয়ে বসেছি। বোতামে আঙুল রাখতেই বোতাম নড়তে শুরু করল। আমি বললাম, আপনি কি এসেছেন?
বোতাম চলে গেল ‘Yes’ লেখা ঘরে। অর্থাৎ তিনি এসেছেন।
আমি বললাম, আপনি কে?
বোতাম চলে গেল ‘R’ অক্ষরে। অর্থাৎ যিনি এসেছেন তাঁর নামের প্রথম অক্ষর ‘R’ খুব সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ আবার এসেছেন। আমি বললাম, আপনার নামের শেষ অক্ষরও কি ‘R’ বোতাম চলে গেল ‘Yes’ এ। রবীন্দ্রনাথ যে এসেছেন তাতে আর সন্দেহ নেই। আমি বললাম আমার মতো ছোট্ট একটা মেয়ের ডাকে যে আপনি এসেছেন তাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন। এই সব হচ্ছে গৎ বাঁধা কথা। মৃত আত্মাকে সম্মান দেখানোর জন্য এইসব বলতে হয়। তবে শুধু ভালো আত্মাদের বেলায় বলতে হয়। খারাপ আত্মাদের বেলায় কিছু বলতে হয় না। খারাপ আত্মাদের অতি দ্রুত বিদেয় করার ব্যবস্থা করতে হয়।
আমি ধন্যবাদ দেয়া শেষ করার পরপর এক কাণ্ড হল। দরজার পরদা সরিয়ে ছোট মা ঘরে ঢুকলেন। অনেক অনেক দিন পর তাঁর দেখা পেলাম। আগে ছোট মাকে দেখে কখনো ভয় পাই নি—সে রাতে হঠাৎ বুক ধক করে উঠল। ভয় পাবার প্রধান কারণ বাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, আমার ভয় হচ্ছিল—এই বুঝি ইলেকট্রিসিটি চলে যাবে। আমার ঘরে একটা চার্জার আছে। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে চার্জার জ্বলে ওঠার কথা। আমার ঘরের চার্জারটা নষ্ট। মাঝে মাঝে ইলেকট্রিসিটি চলে যায় কিন্তু চার্জার জ্বলে না। টেবিলের ড্রয়ারে অবিশ্যি মোমবাতি আছে। দেয়াশলাই আছে কি না জানি না। মনে হয় নেই। ভয়ে আমার বুক ধকধক করছে—আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ছোট মার দিকে। তিনি বললেন, ফারজানা কেমন আছ?
এইরে আমার আসল নাম বলে ফেললাম। যাই হোক আমার ধারণা ইতিমধ্যে আপনি আমার নাম জেনে ফেলেছেন। ভালো কথা চিত্রাও কিন্তু আমার নাম। আমার আসল মা আমার নাম রেখেছিলেন চিত্রা। মার মৃত্যুর পর কেন জানি এই নামটা আর ডাকা হত না। আমার আরো দুটা ডাকনাম আছে—বিবি, বাবা এই নামে আমাকে ডাকেন। আরেকটা হল—নিশি। বাবা ছাড়া বাকি সবাই আমাকে নিশি নামে ডাকে। বাকি সবাই বলতে আমি স্কুলের বন্ধুদের কথা বলছি।
যে কথা বলছিলাম, ছোট মা বললেন, ‘ফারজানা কেমন আছ?’
আমি বললাম, ‘ভালো।’
‘তুমি, একা, তাই না?’
অমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘অনেক দিন পর তোমাকে দেখতে এসেছি। তোমার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। চুল খুব সুন্দর করে কেটেছ। কে কেটে দিয়েছে?’
‘নীতু আন্টি।’
‘তিনি তোমাকে খুব ভালবাসেন?’
‘হুঁ।’
‘তাঁকে কি তুমি আমার কথা বলেছ?’
‘না।’
‘খুব ভালো করেছ। শরিফাকে আমার কথা বলেছ?’
‘না।’
‘শরিফা মেয়েটা খুব খারাপ তুমি কি তা জান?’
‘না।’
‘মেয়েটা তোমাকে খারাপ করে দিচ্ছে তা কি বুঝতে পারছ? মেয়েটাকে তুমি পছন্দ কর। তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছ কেন? তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ।
‘ভয় পেও না।’
‘আচ্ছা।’
‘ভূত নামানোর খেলা কেন খেলছ? এইগুলি ভালো না। আর কখনো খেলবে না।’
‘আচ্ছা!’
‘নীতু আন্টিকে তুমি খুব পছন্দ কর?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাকে আমার কথা কখনো বলবে না।’
‘আচ্ছা।’
‘আমি এখন চলে যাব।’
‘আর আসবেন না?’
‘আসব। শরিফাকে শাস্তি দেবার জন্য আসব। ওকে আমি কঠিন শাস্তি দেব।
একটা ব্যাপার আপনাকে বলি যে ছোট মা আমার কাছে আসতেন এই ছোট মা সেরকম নন। তাঁর চোখের দৃষ্টি কঠিন, গলার স্বর কঠিন। অথচ আগে যিনি আসতেন— তিনি ছিলেন আলাভোলা ধরনের। তাঁর মধ্যে ছিল অস্বাভাবিক মমতা। তিনি এসেই আমার মাথায় হাত দিতেন—অথচ ইনি দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। একবারও মাথায় হাত দিলেন না বা কাছেও এলেন না।
নিচে গাড়ির শব্দ হল। ছোট মা পরদা সরিয়ে বের হয়ে গেলেন। নীতু আন্টি তার কিছুক্ষণ পরই ঘরে ঢুকলেন। আমি জানি তিনি এখন কী করবেন—বিয়েবাড়িতে মজার ঘটনা কী কী ঘটল তা বলবেন। বলতে বলতে হেসে ভেঙে পড়বেন। যেসব ঘটনা বলতে বলতে তিনি হেসে গড়িয়ে পড়েন সাধারণত সেসব ঘটনা তেমন হাসির হয় না। তবু আমি তাঁকে খুশি করার জন্যে হাসি। আজ অন্যান্য দিনের মতো হল না। ঘরে ঢুকেই তিনি ভুরু কুঁচকে ফেললেন—তাঁর হাসি হাসি মুখ হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি শীতল গলায় বললেন, এই মেয়ে কেউ কি এসেছিল?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, না তো।
‘ঘরে বিশ্রী গন্ধ কেন?
‘বিশ্রী গন্ধ?’
‘অবশ্যই বিশ্রী গন্ধ। মনে হচ্ছে নর্দমা থেকে কেউ উঠে এসে ঘরে হাঁটাহাঁটি করেছে।’
আমি কথা ঘুরাবার জন্য বললাম, আন্টি বিয়েবাড়িতে আজ কী হল?
আন্টি বললেন, তোমার ঘরে কোনো কোনায় ইঁদুর মরে নেই তো? মরা মরা গন্ধ পাচ্ছি। তুমি পাচ্ছ না?
‘না।’
‘দাঁড়াও। ঘর ঝাড় দেবার ব্যবস্থা করি।’
নীতু আন্টি উপস্থিত থেকে ঘর ঝাঁট দেয়ালেন। স্যাভলন পানি দিয়ে মেঝে মুছালেন—তারপরও তার নাকে মরা মরা গন্ধ লেগে রইল। তিনি বাবাকে ডেকে নিয়ে এসে বললেন, তুমি কি কোনো গন্ধ পাচ্ছ?
বাবা বললেন, পাচ্ছি।
‘কিসের গন্ধ?’
‘স্যাভলনের গন্ধ।’
‘পচা—কটু কোনো গন্ধ পাচ্ছ না?’
‘না তো।’
‘আমি পাচ্ছি।’
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, তোমার সুপার সেনসেটিভ নাক তুমি তো পাবেই। আমাদের পূর্বপুরুষ বানর ছিলেন। তোমার পূর্বপুরুষ সম্ভবত কুকুর।
‘রসিকতা করবে না।’
নীতু আন্টি চিন্তিত মুখে বের হয়ে গেলেন। রাতে আমার ঘরে ঘুমাতে এলেন। এটা নতুন কিছু না। তিনি প্রায়ই রাতে আমার ঘরে ঘুমাতেন। না, প্রায়ই বলাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। সপ্তাহে একদিন বলাটা যুক্তিযুক্ত হবে। স্কুলের সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন তিনি গভীর রাত পর্যন্ত গুটুর গুটুর করে গল্প করতেন। আমার জন্য সেই রাতগুলি খুব আনন্দময় হত। শরিফার ভয়ঙ্কর গল্পগুলি শুনতে পেতাম না, তার জন্যে অবিশ্যি একটু খারাপ লাগত।
নীতু আন্টি আমার ঘরে ঘুমাতে এসেছেন আমার এত ভালো লাগল। আন্টি বললেন—আজ শরিফা নেই তো তাই তোমার সঙ্গে ঘুমাতে এসেছি। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে— একা ঘুমাতে ভয়ও পেতে পার। আজ কিন্তু গল্প হবে না। কাল তোমার স্কুল আছে। আমি বললাম, আন্টি খারাপ গন্ধটা কি এখনো পাচ্ছেন?
‘হ্যাঁ পাচ্ছি।’
আন্টি বাতি নিভিয়ে আমাকে কাছে টেনে শুতে গেলেন। আমি হঠাৎ বললাম, আন্টি আপনাকে একটা কথা বলি-তিনি হাই তুলতে তুলতে বললেন, বল। লম্বা-চওড়া কথা না তো? রাত জেগে গল্প শুনতে পারব না। আমার ঘুম পাচ্ছে।
আমি চাপা গলায় বললাম, আন্টি মৃত মানুষ কি আসতে পারে?
‘তার মানে?’
‘না, কিছু না।’
আন্টি বিছানায় উঠে বসলেন। হাত বের করে টেবিলল্যাম্প জ্বালিয়ে বললেন, কী বলতে চাও ভালো করে বল। অর্ধেক কথা বলবে, অর্ধেক পেটে রাখবে তা হবে না।
আমি চুপ করে রইলাম। নীতু আন্টি কঠিন গলায় বললেন, উঠে বস।
আমি উঠে বসলাম।
‘এখন বল মৃত মানুষের আসার কথা আসছে কেন? তুমি কি কোনো মৃত মানুষকে আসতে দেখেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘সে কি আজ এসেছিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘মৃত মানুষটা কি তোমার মা?’
‘না, আমার ছোট মা।’
‘পুরো ঘটনাটা আমাকে বল। কিছু বাদ দেবে না।
‘বলতে ইচ্ছা করছে না।’
‘ইচ্ছে না করলেও বল। পুরো ব্যাপারটা আমাকে তুমি তোমার ভালোর জন্যে বলবে।’
‘এটা বললে আমার ভালো হবে না।’
‘তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে—কিসে তোমার মঙ্গল, কিসে তোমার অমঙ্গল তা বোঝার ক্ষমতা তোমার হয় নি। বল ব্যাপারটা কী?’
‘আরেক দিন বলব।
‘আরেক দিন না। আজই বলবে। এখনই বলবে।
আমি বলতে শুরু করলাম। কিছুই বাদ দিলাম না। নীতু আন্টি চুপ করে শুনে গেলেন। কথার মাঝখানে একবারও বললেন না—তুমি এসব কী বলছ!
গল্প বলা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝলাম—আমি কী বলছি না বলছি সবই ছোট মা শুনছেন। তিনি ঘরের ভেতর নেই—কিন্তু কাছেই আছেন। পরদার ওপাশেই আছেন। পরদার বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি যে নিশ্বাস ফেলছেন আমি তাও শুনতে পাচ্ছিলাম। গল্প শেষ করার পরপর নীতু আন্টি বললেন, ঘুমিয়ে পড়। বলেই তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি সারা রাত জেগে রইলাম। এক ফোঁটা ঘুম হল না। শুরু হল আমার রাত জাগার কাল।
ছোটদের উদ্ভট অস্বাভাবিক কথা বড়রা সব সময় হেসে উড়িয়ে দেন। সেটাই স্বাভাবিক। ছোটদের উদ্ভট গল্প গুরুত্বের সঙ্গে কখনো গ্রহণ করা হয় না। গ্রহণ করা হয়তো ঠিকও নয়। আন্টি আমার গল্প কীভাবে গ্রহণ করলেন কিছুদিন আমি তা বুঝতেই পারলাম না। ছোট মার প্রসঙ্গ তিনি আমার সঙ্গে দ্বিতীয়বার তুললেন না। যেন কিছু শোনেন নি। পুরোপুরি স্বাভাবিক আচার আচরণ। শুধু রাতে আমার সঙ্গে ঘুমাতে আসেন। তখন অনেক গল্পটল্প হয়—ছোট মার প্রসঙ্গ কখনো আসে না।
আপনাকে তো আগেই বলেছি আমার ইনসমনিয়ার মতো হয়ে গিয়েছিল। শেষ রাতের দিকে ঘুম আসত। রাত একটার দিকে বাড়ি পুরোপুরি নিঃশব্দ হয়ে যেত তখন বিচিত্র সব শব্দ শুনতে পেতাম। যেমন খাটের চারপাশে কে যেন হাঁটত। সে কে তা আমার কাছে পরিষ্কার না। ছোট মা হতে পারেন—অন্য কেউও হতে পারে। প্রচণ্ড ভয়ে আমি অস্থির হয়ে থাকতাম। যেহেতু রাতে ঘুম আসত না—দিনটা কাটত ঝিমুনিতে। ক্লাসে বসে আছি, স্যার অংক করাচ্ছেন। আমার তন্দ্রার মতো চলে এল। আধো ঘুম আধো জাগরণে চলে গেলাম। স্যারের দিকে তাকিয়ে থেকেই স্বপ্ন পর্যন্ত দেখতে শুরু করতাম। এই স্বপ্নগুলি খুব অদ্ভুত। অদ্ভুত এই কারণে যে আমি তন্দ্রায় যেসব স্বপ্ন দেখতাম তার প্রতিটি সত্য হয়েছে। আমি তন্দ্রায় যা দেখতাম তাই ঘটত। তারচেয়ে মজার ব্যাপার, স্বপ্নগুলিকে আমি ইচ্ছামতো বদলাতে পারতাম। তবে আমি যে স্বপ্ন বদলাতেও পারি এটা বুঝতে সময় লেগেছিল। আগে বুঝতে পারলে খুব ভালো হত। আমি বোধহয় ব্যাপারটা আপনাকে বুঝাতে পারছি না। উদাহরণ দিয়ে বুঝাই।
ধরুন আমি স্বপ্নে দেখলাম বাবা চেয়ারে বসে লিখছেন। তিনি বসেছেন সিলিং ফ্যানের নিচে, হঠাৎ সিলিং ফ্যানটা খুলে তাঁর মাথায় পড়ে গেল। রক্তে চারদিক ভেসে যাচ্ছে। আমার তন্দ্রা ভেঙে গেল। আমার এই স্বপ্ন দেখা মানে—ব্যাপারটা ঘটবে। আমি তৎক্ষণাৎ ঠিক করলাম—না ব্যাপারটা এরকম হবে না। স্বপ্নটা যেভাবেই হোক বদলে দিতে হবে তখন নতুন স্বপ্নের কথা ভাবলাম। যেমন ধরুন আমি ভাবলাম—বাবা লেখার টেবিলে বসেছেন। কী মনে করে হঠাৎ সিলিং ফ্যানের দিকে তাকালেন। তারপর সরে দাঁড়ালেন—অমনি ঝপাং শব্দ করে ফ্যান পড়ে গেল। বাবার কিছু হল না। পুরো ব্যাপারটা ভেবে রাখার পর—অবিকল যেমন ভেবে রেখেছি তেমনি স্বপ্ন দেখতাম। আপনি এটাকে কি বলবেন, কোনো ক্ষমতা?
না আপনি তা বলবেন না। মানুষের যে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা থাকতে পারে এইসব আপনি বিশ্বাস করেন না। আপনার কাছে মানুষ যন্ত্রের মতো। একটা ছেলে যদি একটা মেয়েকে ভালবাসে তা হলে আপনি ধরেই নেবেন—ব্যাপারটা আর কিছুই না একজন আরেকজনের প্রতি শারীরিক আকর্ষণ বোধ করছে। শারীরিক আকর্ষণ যেহেতু নোংরা একটা ব্যাপার কাজেই ভালবাসা নামক মিষ্টি একটা শব্দ ব্যবহার করছে। কুইনাইনকে সুগার কোটেড করা হচ্ছে। আমি কি ভুল বললাম?
আমি ভুল বলি নি। আপনি যাই ভাবেন—কিন্তু শুনুন স্বপ্ন তৈরি করার ক্ষমতা আমার আছে। এবং আমি এখনো পারি। ঘটনা বলি। ঘটনা বললেই আপনি বুঝবেন
শরিফা তো বাড়ি থেকে চলে গেল। ওর বিয়ে হবার কথা। বিয়ে হলে আর ফিরবে না। আমি একদিন স্বপ্ন দেখলাম ওর বিয়ে হচ্ছে। চেংড়া টাইপের ছেলে। পান খেয়ে দাঁত লাল করে আছে—আর ভ্যাক ভ্যাক করে হাসছে। স্বপ্ন দেখে খুব মেজাজ খারাপ হল। তখন ভাবলাম, বিয়ে হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু বরের সঙ্গে ওর খুব ঝগড়া হয়েছে, ও চলে এসেছে আমাদের বাড়িতে। যেরকম ভাবলাম অবিকল সেরকম স্বপ্ন দেখলাম। হলও তাই। এক সন্ধ্যাবেলা শরিফা উপস্থিত। তার বিয়ে হয়ে গেছে কিন্তু বর তাকে নিচ্ছে না। বিয়ের সময় কথা হয়েছিল বরকে একটা সাইকেল এবং নগদ পাঁচ হাজার এক টাকা দেয়া হবে। কোনোটাই দেয়া হয় নি বলে তারা কনে উঠিয়ে নেবে না। যেদিন সাইকেল এবং টাকা দেয়া হবে সেদিনই মেয়ে তুলে নেবে। আমি শরিফাকে বললাম, তোমার কি মন খারাপ?
‘শরিফা বলল, মন খারাপ কইরা লাভ আছে আফা?’
‘তোমাকে যে তুলে নিচ্ছে না তোমার রাগ লাগছে না?’
‘না। সাইকেল আর টেকা দিব বইল্যা দেয় নাই। তারার তো আফা কোনো দোষ নাই। একটা জিনিস দিবেন বলবেন, তারপরে দিবেন না—এইটা কেমন কথা?’
‘তোমার বর পছন্দ হয়েছে?’
‘হুঁ।’
‘তোমার সঙ্গে তোমার বরের কথা হয়েছে?’
‘ওমা কথা আবার হয় নাই? এক রাইত তার লগে ছিলাম না?
‘রাতে তোমরা কী করলে?’
‘কওন যাইব না আফা। বড়ই শরমের কথা। লোকটার কোনো লজ্জা নাই। এমন বেহায়া মানুষ জন্মে দেখি নাই। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।’
‘না, বল আমি শুনব।
‘অসাম্ভাব কথা আফা। ছিঃ।’
‘তুমি বলবে না?’
‘জীবন থাকতে না।’
আমি নিষিদ্ধ কথা শোনার জন্যে ছটফট করছিলাম। এবং আমি জানি শরিফাও নিষিদ্ধ কথাগুলি বলার জন্যে ছটফট করছিল।
দেখলেন তো স্বপ্ন পাল্টে কীভাবে শরিফাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম? আপনি বলবেন, কাকতালীয়। মোটেই না, শরিফার বরকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করল, কাজেই একদিন খুব ভাবলাম, শরিফার বর এসেছে। যেমন ভাবলাম, ঠিক সেরকম স্বপ্ন দেখলাম। শরিফার বর চলে এল। নীল রঙের একটা লুঙ্গি। রবারের জুতা। সিল্কের চক্রাবক্রা একটা শার্ট। এসেই বাসার সবাইকে পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলল। এমনকি আমাকেও। শরিফার বরের নাম সিরাজ মিয়া। সে নারায়ণগঞ্জে একটা লেদ মেশিনের হেল্পার।
আন্টি তাকে খুব বকা দিলেন। কঠিন গলায় বললেন, তুমি পেয়েছ কী? যৌতুক পাও নি বলে বউ ঘরে নেবে না। তুমি কি জান পুলিশে খবর দিলে তোমার পাঁচ বছরের জেল হয়ে যাবে। বাংলাদেশে যৌতুক নিবারণী আইন পাস হয়েছে। দেব পুলিশে খবর?
সিরাজ মিয়া বলল, ইচ্ছা হইলে দেন। আফনেরা বড়লোক। আফনেরা যা বলবেন সেইটাই ন্যায়।
আন্টি আরো রেগে গেলেন। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল এখনই তিনি ধানমন্ডি থানার ওসিকে খবর দেবেন। আমাকে বললেন, ফারজানা দাও তো টেলিফোনটা। ওসি সাহেবকে আসতে বলি।
আমি টেলিফোন এনে দিলাম। আমার একটু ভয় ভয় করছিল, কিন্তু সিরাজ মিয়া নির্বিকার। তাকে চা আর কেক খেতে দেয়া হয়েছে। সে চায়ে কেক ডুবিয়ে বেশ মজা করে খাচ্ছে।
আন্টি ধানমন্ডি থানার ওসিকে খবর দিলেন না। কাকে যেন টেলিফোন করে বললেন, একটা নতুন সাইকেল কিনে বাসায় নিয়ে আসতে।
সিরাজ মিয়া নির্লজ্জের মতো বলল, আমারে টেকা দেন। আমি দেইখ্যা শুইন্যা কিনব। বাজারে নানান পদের সাইকেল—সব সাইকেল ভালো না।
আন্টি বললেন, তোমাকে দেখেশুনে কিছুই কিনতে হবে না। তুমি তোমার আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে আস। আমি তোমাকে সাইকেল আর পাঁচ হাজার এক টাকা দিয়ে দেব। তুমি শরিফাকে নিয়ে যাবে। যদি শুনি এই মেয়ের উপর কোনো অত্যাচার হয়েছে আমি তোমার চামড়া খুলে ফেলব। গরুর চামড়া যেভাবে খোলে ঠিক সেইভাবে খোলা হবে।
সিরাজ মিয়া চা কেক খেয়ে হাসিমুখে চলে গেল। বলে গেল আগামী বুধবার সে তার বাবাকে নিয়ে আসবে। এবং সেদিনই বউ নিয়ে চলে যাবে।
আন্টির এই ব্যাপারটা আমার কী যে ভালো লাগল। আনন্দে আমার চোখে প্ৰায় পানি এসে গেল। আর শরিফা যে কী খুশি হল। এক্কেবারে পাগলের মতো আচরণ। এই হাসছে। এই কাঁদছে।
বুধবার সকালে শরিফাকে নিয়ে যাবে। আন্টি তার বরের জন্যে শুধু যে সাইকেল আনালেন তা না—একটা নতুন শার্ট কেনালেন। শরিফাকে দিলেন দুটা শাড়ি—কানের দুল। শরিফা নিজেই দোকান থেকে রুপার নূপুর কিনে এনে পায়ে পরেছে। যখন হাঁটে ঝমঝম শব্দ হয়। খুব হাস্যকর ব্যাপার।
মঙ্গলবার আমাদের স্কুল ছুটি ছিল। বৌদ্ধ পূর্ণিমার ছুটি। আমি দুপুরে শুয়ে আছি- হঠাৎ স্বপ্নে দেখি—ছোট মা এসে আমাকে বলছেন, ফারজানা আমি বলেছিলাম না এই মেয়েটাকে শাস্তি দেব? ও চলে যাচ্ছে—যাবার আগে শাস্তি দিয়ে দেয়া দরকার তাই না?
আমি চুপ করে রইলাম। ছোট মা বললেন-কথা বলছ না কেন? কী ধরনের শাস্তি দেয়া যায় বল তো। তুমি যেরকম শাস্তির কথা বলবে আমি ঠিক সেরকম শাস্তি দেব।
‘আপনি তাকে ক্ষমা করে দিন।’
‘না আমি ক্ষমা করব না। ওকে শাস্তি পেতেই হবে। ওর চোখ দুটা গেলে দি—কী বল? উলের কাঁটা দিয়ে চোখ গেলে দি?’
আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। তবে খুব চিন্তিত হলাম না। কারণ আমি স্বপ্ন বদলাতে পারি। আমি স্বপ্নটা বদলে ফেলব। কীভাবে বদলাব সেটাও ঠিক করে ফেললাম। বিকেলে গানের টিচার চলে যাবার পর দরজা বন্ধ করে আমি স্বপ্নটা বদলাব। গানের টিচার গেলেন সন্ধ্যাবেলা। আমি আমার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই শরিফার গলা শুনতে পেলাম। সে ফিসফিস করে ডাকছে—আফা। ও আফা।
শব্দটা আসছে খাটের নিচ থেকে। আমি নিচু হয়ে দেখি শরিফা হামাগুড়ি দিয়ে খাটের নিচে বসে আছে। কুকুর যেভাবে বসে থাকে ঠিক সেভাবে শরিফা বসে আছে। কুকুরের মতো জিভ বের করে খানিকটা হাঁপাচ্ছেও। তাকে কেমন যেন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। আমি বললাম, তুমি এখানে কী করছ? বের হয়ে আস। খাটের নিচ থেকে বের হয়ে আস।
সে বলল, আফাগো আমি বাঁইচ্যা নাই। আমারে মাইরা ফেলছে। ছাদে কাপড় আনতে গেছিলাম আমারে ধাক্কা দিয়া ফেলছে। আমি অনেক দূর চইল্যা যাব। যাওনের আগে আফনেরে শেষ দেখা দেখতে আইছি গো।
এই বলেই সে হামাগুড়ি দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে গেল। আমি চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। সবাই ছুটে এলেও তখনই আমার ঘরে ঢুকতে পারল না। আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তাদের ঢুকতে হল দরজা ভেঙে।
আমি বলছি সন্ধ্যাবেলার ঘটনা। শরিফা যে সত্যি সত্যি মারা গেছে এই খবর জানা গেল রাত আটটার দিকে। আমাদের বাড়ির পেছনের দেয়ালে পড়ে তার মাথা থেঁতলে গিয়েছিল। কেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। প্রচণ্ড শক্তিশালী কেউ— কারণ দেয়ালটা বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে—ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে এত দূরে ফেলতে অনেক শক্তি দরকার।
আমার মাথা ধরছে। আমি আপাতত লেখা বন্ধ করলাম।
এই মুহূর্তে আপনি আমার সম্পর্কে কী ভাবছেন বলব?
আমি অন্তর্যামী নই। অন্য একজনের মনের খবর আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু আপনি কী ভাবছেন তা আমি বলতে পারব। কারণ আপনার চিন্তার পদ্ধতি আমি জানি। আপনি আমার লেখা পড়ছেন। যতই পড়ছেন আমার সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে উঠছে। ধারণাগুলি করছেন যুক্তির ভেতর দিয়ে। পুরোপুরি অংক কষা হচ্ছে দুই যোগ তিন হচ্ছে পাঁচ, কখনো ছয় বা সাত নয়। এ জাতীয় মানুষের মনের ভাব আঁচ করা মোটেই কঠিন না।
অতিপ্রাকৃত কোনো ব্যাপারে আপনার সামান্যতম বিশ্বাসও নেই। যেই আমি ছোট মাকে দেখার কথা বলেছি অমনি আপনি ভুরু কুঁচকেছেন। কঠিন কিছু শব্দ মনে মনে আওড়েছেন, যেমন স্কিজোফ্রেনিক, সাইকোপ্যাথ …তাই না?
শরিফার মৃত্যুর খবর শুনে আপনি খানিকক্ষণ ঝিম মেরে ছিলেন। তারপর সিগারেট ধরালেন। ধূমপায়ী মানুষরা সামান্যতম সমস্যার মুখোমুখি হলেই ফস করে সিগারেট ধরায়। ভাবটা এমন যে নিকোটিনের ধোঁয়া সব সমস্যা উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সিগারেট ধরিয়ে মনে মনে বলেছেন—খুনটা কে করেছে? কারণ আপনার কাছে অতিপ্রাকৃত ব্যাপার বলে কিছু নেই। একটা মেয়ে খুন হয়েছে। ভূতপ্রেত তাকে খুন করবে না। মানুষ খুন করবে। সেই মানুষটা কে?
ডিটেকটিভ গল্পে কী থাকে? একটা খুন হয়—আশপাশের সবাইকে সন্দেহ করা হয়। সবচে কম সন্দেহ যাকে করা হয় দেখা যায় সে-ই খুন করেছে। গল্প-উপন্যাসের ডিটেকটিভদের মতো আপনি যদি খুন রহস্যের সমাধান করতে চান তা হলে প্রধান সন্দেহভাজন ব্যক্তি হচ্ছি আমি। এখন আপনি ভাবছেন মেয়েটা যে খুন করল তার মোটিভ কী? একটু চিন্তা করলে আপনি মোটিভও পেয়ে যাবেন। আমি আপনাকে সাহায্য করি?
ক) মেয়েটি মানসিকভাবে অসুস্থ। স্কিজোফ্রেনিক এবং সাইকোপ্যাথ। একজন অসুস্থ মানুষ যে কোনো অপরাধ করতে পারে। অসুস্থতাই তার মোটিভ।
খ) শরিফা মেয়েটি তার স্বামীর কাছে বুধবার চলে যাবে। সে ছিল ফারজানার সঙ্গিনী। ফারজানা চাচ্ছিল মেয়েটিকে রেখে দিতে। খুন করা হয়েছে সে কারণে। অসুস্থ মেয়েটি ভাবছে শরিফা খুন হয়েছে ঠিকই কিন্তু চলে যায় নি—এই তো সে বাস করছে খাটের নিচে। কুকুরের মতো হাঁটু গেড়ে বসে আছে।
.
মিসির আলি সাহেব আপনি কি তাই ভাবছেন? না আপনি তা ভাবছেন না। মানুষের মনের ভেতরে যে আরেকটি মন বাস করে আপনি সেই মন নিয়ে কাজ করেন। যুক্তির ক্ষমতা আপনি যেমন জানেন যুক্তির অসারতাও আপনি জানেন। দুই যোগ তিন পাঁচ হয় এটা আপনি যেমন জানেন ঠিক তেমনি জানেন মাঝে মাঝে সংখ্যাকে যুক্ত করা যায় না। যোগ চিহ্ন কোনো কাজে আসে না। এই তথ্য জানেন বলেই—আমি আমার জীবনের বইটি আপনার সামনে খুলে দিয়েছি। আপনাকে পড়তে দিয়েছি।
আপনি হয়তো ভাবছেন—এতে লাভ কী? মেয়েটির সঙ্গে তো আমার কখনো দেখা হবে না। সে তার ঠিকানা দেয় নি। ঠিকানা দেই নি এটা ঠিক না। ব্যাখ্যা এবং বর্ণনা এমনভাবে দিয়েছি যেন ইচ্ছা করলেই আপনি বের করতে পারেন আমাদের বাড়িটা কোথায়। ধানমন্ডি থানার ওসিকে আন্টি টেলিফোন করতে চাচ্ছে তা থেকে আপনি কি অনুমান করতে পারছেন না আমাদের বাড়ি ধানমন্ডিতে। টু ইউনিট বাড়ি এটিও বলেছি। আরো অনেক কিছু বলেছি। থাক এখন টেলিফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি। যদি মনে করেন আমার সঙ্গে কথা বলা দরকার টেলিফোন করবেন। নাম্বারটা হচ্ছে ষষ্ঠ মৌলিক সংখ্যা, পঞ্চম মৌলিক সংখ্যা, চতুর্থ মৌলিক সংখ্যা, তৃতীয় মৌলিক সংখ্যা। সংখ্যাগুলির আগে আট বসাবেন।
সরাসরি টেলিফোন নাম্বার লিখে দিলে হত। সেটা আপনার মনে থাকত না। এইভাবে বলায় আর কখনো ভুলবেন না।
৮, (ষষ্ঠ মৌলিক সংখ্যা = ১১), (পঞ্চম মৌলিক সংখ্যা = ৭), (চতুর্থ মৌলিক সংখ্যা=৫), (তৃতীয় মৌলিক সংখ্যা=৩)
অর্থাৎ আমার টেলিফোন নাম্বার হচ্ছে-
৮১১৭৫৩
আমাদের টেলিফোন নাম্বারটা রহস্যময় না? আমাদের বাসায় তিনটা টেলিফোন আছে। সবচে রহস্যময় নাম্বারটা আপনাকে দিলাম। এই টেলিফোন বাবা আমাকে দিয়েছেন। নাম্বারটা আমি কাউকে দেই নি। কাজেই আমার টেলিফোনে কেউ আমাকে পায় না। অথচ আমি অন্যদের পাই। ব্যাপারটা মজার না? তোমরা আমাকে খুঁজে পাবে না—কিন্তু আমি ইচ্ছা করলেই তোমাদের পেয়ে যাব।
মাঝে মাঝে আমার যখন ইনসমনিয়ার মতো হয়—আমি এলোমেলোভাবে টেলিফোনের ডায়াল ঘুরাতে থাকি। অচেনা কোনো একটা জায়গায় রিং বেজে ওঠে। সদ্য ঘুম ভাঙা গলায় কেউ একজন ভারী গলায় বলে— কে?
আমি করুণ গলায় বলি, আমার নাম ফারজানা।
কাকে চাই?
কাউকে চাই না। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব, প্লিজ টেলিফোন রেখে দেবেন না। প্লিজ! প্লিজ! এই সময় পুরুষ মানুষরা যে কী অদ্ভুত আচরণ করে আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। শতকরা সত্তর ভাগ পুরুষ প্রেম করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অতি মিষ্টি গলায় উত্তর দিতে থাকে। শতকরা দশ ভাগ কুৎসিত সব কথা বলে। অতি নোংরা, অতি কুৎসিত সব বাক্য। গলার স্বর থেকে মনে হয় মধ্যবয়স্ক পুরুষরা এই নোংরামিগুলি বেশি করেন। এই পুরুষরাই হয়তো স্নেহময় পিতা, প্রেমময় স্বামী। অফিসে আদর্শ অফিসার। কী অদ্ভুত বৈচিত্র্যের ভেতরই না আমাদের জীবনটা কাটে।
আমরা সবাই ড. জেকিল এবং মিস্টার হাইড। আপনিও কিন্তু তাই—একদিকে অসম্ভব যুক্তিবাদী মানুষ অন্যদিকে… যুক্তিহীন জগতেও চরম আস্থা আছে এমন একজন। তাই না? খুব ভুল কি বলেছি?