দুটি খাট পাশাপাশি। হরিপ্রসন্ন বাবু এক খাটে–অন্য খাটে মিস্টার আগস্ট। রাত প্রায় দশটা বাজে। কাজের মেয়ে ঘরেই রাতের খাবার দিয়ে গিয়েছিল। খাওয়া শেষ হয়েছে। হরিবাবু কিছুই প্রায় খেতে পারেননি। সন্ধ্যা থেকেই তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এখন বেশ বেড়েছে। তার মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস ঠিকই। নিতে পারছেন–ফেলতে পারছেন না। ফুসফুসে বাতাস ক্রমেই জমা হচ্ছে।
মিস্টার আগস্ট বলল, ভাই আপনার শরীরটা কি খারাপ?
হরিবাবু হঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?
হুঁ।
লুডু খেলবেন? মিতুর লুডু সেটটা আমার কাছে আছে।
হরিবাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, লুডু?
হ্যাঁ লুডু। সাপ লুডু। এই খেলায় এক ধরনের উত্তেজনা আছে। উত্তেজনার কারণে–শারিরীক কষ্ট অনেকটা কমে যাবে। খেলবেন?
না।
খেলে দেখুন না। ভাল না লাগলে বন্ধ করে দেবেন।
হরিবাবু অবাক হয়ে দেখলেন লোকটা লুডু বোর্ড মেলে ধরেছে। পাগল নাকি লোকটা? তিনি শুনেছেন লোকটা গাড়ির ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল। স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। মাথাও যে খারাপ হয়ে গেছে সে কথা তাকে কেউ বলে নি।
তাই খেলবেন? নিন আপনি প্রথম দান দিন। সাপ লুডুর নিয়ম জানেন তো–এক না উঠলে ঘুটি ঘর থেকে বেরুবে না।
আমি খেলব না।
আপনার দানগুলি আমি চেলে দেব। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
না–আমার শরীর ভাল না।
তা হলে তো আমাকে একা একাই খেলতে হয়।
হরিবাবু শুয়ে পড়লেন। কাজের মেয়েটা মশারী খাটিয়ে দিয়ে গিয়েছে। ঘরে বাতি জ্বলছে। সেই বাতির আলো চোখে লাগছে। পাশের খাটে বসে লোকটা খট খট শব্দে লুডুর দান ফেলছে। হরিবাবু বললেন, বাতিটা নেভাবেন? চোখে আলো লাগছে।
ও আচ্ছা আচ্ছা। নিভিয়ে দিচ্ছি, আপনি ঘুমুনোর চেষ্টা করুন।
লোকটা বাতি নিভিয়ে বাইরে বেরুতেই–ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়তে লাগল। হরিবাবুর তন্দ্রার মত এসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তন্দ্রাও কেটে গেল। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। কারণ অনেক অনেকদিন আগের একটা ঘটনা তার মনে পড়ে গেছে। সেই ঘটনার সঙ্গে আজকের রাতের ঘটনার এত অদ্ভুত মিল–হরিবাবুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
বিয়ের পর প্রথম শ্বশুর বাড়ি গিয়েছেন। চৈত্র মাস–অসহ্য গরম। আরতী অনেক রাতে ঘুমুতে এসে বলল–এই গরমে তুমি ঘুমুতে পারবে না–এক কাজ করলে কেমন হয়–এসো আমরা লুডু খেলি। সাপ লুডু।
তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, পাগল নাকি?
আরতী লুডু বোর্ড মেলে দিয়ে বলল, সাপ লুডু খেলার নিয়ম জাননা তো? এক না পড়লে ঘুটি বের হবে না।
আমি খেলব না। কি সব ছেলেমানুষী করছ।
তোমার দানগুলি আমি চেলে দেব। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি প্রথম দান দেই কেমন?
তিনি চুপ করে রইলেন। আরতী একা একাই খেলে যাচ্ছে। চাল দিচ্ছে। উত্তেজনায় তার মুখ ইষৎ লালচে। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, অন্য কোথাও গিয়ে খেল তো। কানের কাছে খট খট করবে না। ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে যাও।
আরতী মুখ কালো করে ঘরের বাতি নিভিয়ে বাইরে চলে গেল। আর তখনি ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল।
এতদিন পর একই ঘটনা আবার কি করে ঘটল? রহস্যটা কি? হরিবাবু ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। লোকটাকে দেখতে পেলেন না।
মিস্টার আগস্ট দোতলায় উঠে এসেছে।
সাবেরের ঘরে হালকা টোকা দিয়েছে। সাবের সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে বলল, ভাই আসুন।
এখনো জেগে আছেন?
আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। জানতাম রাত তিনটার দিকে আপনি আসবেন। বসুন, ঐ চেয়ারে বসুন। আমার কাছে আসবেন না।
কেন?
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হয়েছে। আমাকে ডাবল অসুখে ধরেছে।
ডাবল নিউমোনিয়া?
জি না। নিউমোনিয়া শুধু বাঁ লাংসটা ধরেছে। ডানটা ঠিক আছে।
ডাবল অসুখ বললেন যে?
চিকেন পক্স হয়ে গেছে রে ভাই। সারা শরীরে ফুটে বের হয়েছে। দারুণ ইন্টারেস্টিং। একসঙ্গে কয়েকটি অসুখ সম্পর্কে জানতে পারছি।
চিকিৎসা করাচ্ছেন?
না। রোগের গতি-প্রকৃতি দেখছি, চিকিৎসা করাটা ঠিক হবে না।
আবার যদি মরে টরে যান।
সেই সম্ভাবনা তো আছেই। নো রিস্ক নো গেইন।
আমার মনে হয় না আপনি মরবেন। মানুষের মনের জোর যখন পুরোপুরি চলে যায় মৃত্যু তখনি আসে। আপনার মন শক্তই আছে।
সত্যি কথা বলেছেন। আমার মনের জোর একশগুণ বেড়ে গেছে। আমার যে এত বড় অসুখ বাসার কেউ জানেই না। হসমুখে সবার সঙ্গে গল্প করি। সবার ধারণা সামান্য ঠাণ্ডা। এদিকে চিকেন পক্সে গা পচে যাচ্ছে।
তাই না-কি।
হ্যাঁ ঘা হয়ে গেছে। ইনফেকশন। এন্টিবায়োটিক শুরু করা উচিৎ।
শুরু করবেন না?
না। দেখি। আরো কিছুদিন দেখি।
জ্বর আছে?
জ্বর তো আছেই। জ্বর থাকবে না?
সাবের উঠে বসল। গলার স্বর নামিয়ে ফিস ফিস করে বলল, আসল ব্যাপার আমি এখনো আপনাকে বলিনি। আমার স্মৃতিশক্তি এখন স্বাভাবিক পর্যায়ে আছে। যা পড়ি মনে থাকে।
অসুখের মধ্যেও পড়ছেন?
পড়ব না? কি বলেন আপনি? ক্রমাগত পড়ে যাচ্ছি।
কবিতা? কবিতাও পড়ছেন নাকি?
সাবের লজ্জিত মুখে বলল, জ্বি তাও মাঝে মধ্যে পড়ছি। জানি কাজটা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু কেন জানি ভাই ভাল লাগে।
লোকটা চেয়ারে পা উঠিয়ে বসল। সহজ গলায় বলল, সবশেষে যে কবিতাটা পড়লেন সেটা শোনান তো।
সত্যি শুনতে চান?
হ্যাঁ চাই।
সাবের বালিশের নীচ থেকে রুলটানা খাতা বের করল। লাজুক গলায় আবৃত্তি শুরু করল–
নারে মেয়ে, নারে বোকা মেয়ে,
আমি ঘুমোবো না। আমি নির্জন পথের দিকে চেয়ে
এমন জেগেছি কত রাত,
এমন অনেক ব্যথা আকাঙ্ক্ষার দাঁত
ছিঁড়েছে আমাকে। তুই ঘুমো দেখি, শান্ত হয়ে ঘুমো।
শিশিরে লাগেনি তার চুমো,
বাতাসে উঠেনি তার গান।
ওরে বোকা,
এখনো রয়েছে রাতি, দরজায় পড়েনি তার টোকা
কবিতা পড়তে পড়তে সাবেরের চোখে পানি এসে গেল। সে লজ্জিত চোখে তাকিয়ে অপ্রস্তুতের হাসি হাসল।
লোকটা বলল, সাবের সাহেব আমার একটা কথা রাখবেন?
অবশ্যই রাখব। কি কথা বলুন তো?
আপনি ডাক্তারী পড়শোনাটা ছেড়ে দিন। কবিতা লিখতে শুরু করুন। আপনি পারবেন। সবাই সব কিছু পারে না। একেক জনকে একেক ধরনের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়।
কে পাঠান?
লোকটি এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
সাকের দুঃখিত গলায় বলল, চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
কেন বলুন তো?
দেখছেন না–ঝুম বৃষ্টি নেমেছে।
ভাবছি বৃষ্টিতে খানিকক্ষণ ভিজব।
বৃষ্টিতে ভিজবেন? আপনি খুবই স্ট্রেঞ্জ মানুষ।
সব মানুষই স্ট্রেঞ্জ।
হ্যাঁ তাও ঠিক। আমারো বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে।
খুব বেশী করছে?
হ্যাঁ খুব বেশী। মনে হচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজতে না পারলে মরে যাব।
তাহলে চলে আসুন।
চলে আসব? বাসার কেউ দেখে ফেললে দারুণ হৈ চৈ করবে।
কেউ দেখবে না। ঠাণ্ডা হাওয়ায় সবাই আরাম করে ঘুমুচ্ছে।
তাহলে চলে আসি কি বলেন?
আসুন।
উঠতে পারছি না–হাতটা ধরে টেনে তুলুন।
তারা দুজন কাঁঠাল গাছের নীচে গিয়ে বসল। সাবের মুগ্ধ গলায় বলল, অপূর্ব! অপূর্ব!