০৫. দীননাথবাবুকে টেলিফোন

॥ ৫ ॥

কাল রাত্রে বাড়ি ফিরেই দীননাথবাবুকে ঘটনাটা টেলিফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উনি তো শুনে একেবারে থ। বললেন, ‘এরকম একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। এক যদি হয় যে এমনি ছ্যাঁচড়া চোর, ব্যাগটায় কিছু আছে মনে করে আপনাকে আক্রমণ করে সেটা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়েছে—যেমন কলকাতায় প্রায়ই ঘটে। কিন্তু তাও তো একটা ব্যাপার রয়েই যাচ্ছে—চারের দুই বলে তো কোনো বাড়িই নেই প্রিটোরিয়া স্ট্রীটে। অর্থাৎ মিস্টার পুরি ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। অর্থাৎ মিস্টার ধমীজার রেলওয়েতে খোঁজ করার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ধাপ্পা। টেলিফোনটা হলে করল কে?’

ফেলুদা বলল, ‘সেটা জানতে পারলে তো তদন্ত ফুরিয়ে যেত মিস্টার লাহিড়ী।’

‘কিন্তু আপনারই বা সন্দেহটা হল কী করে বলুন তো?’

‘আসল খট্‌কা লাগল লোকটার এত রাত্রে আপনাকে টেলিফোন করা থেকে। ধমীজা গেছেন কালকে। তা হলে পুরি কাল কিংবা আজ দিনের বেলা ফোন করল না কেন?’

‘হুঁ!…তাহলে তো সেই সিমলা যাবার প্ল্যানটাই রাখতে হয়। কিন্তু ব্যাপারটা যে দিকে টার্ন নিচ্ছে, তাতে তো আপনাকে পাঠাতে আমার ভয়ই করছে।’

ফেলুদা হেসে বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না মিস্টার লাহিড়ী। কেসটাকে এখন আর নিরামিষ বলা চলে না—বেশ পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে আমিও এখন অনেকটা আশ্বস্ত বোধ করছি। নইলে আপনার টাকাগুলো নিতে রীতিমত লজ্জা করত। যাই হোক, আপনি এখন একটা কাজ করতে পারলে ভালো হয়।’

‘বলুন।’

‘আপনার বাক্সে কী কী জিনিস ছিল সেটার একটা ফর্দ করে যদি আমায় পাঠিয়ে দেন তা হলে বাক্স ফেরত নেবার সময় মিলিয়ে নিতে সুবিধে হবে।’

‘কিছুই বিশেষ ছিল না, কাজেই কাজটা খুবই সহজ। যখন আপনাদের যাবার টিকিট ইত্যাদি পাঠাবো, তার সঙ্গেই লিস্টটাও দিয়ে দেব।’

কাল চলে যাচ্ছি বলে আজ সারাটা দিন ফেলুদাকে বেশ ব্যস্ত থাকতে হল। এই একদিনেই ওর হাবভাব একেবারে বদলে গেছে। ওর মনটা যে অস্থির হয়ে আছে, সেটা ওর ঘন ঘন আঙুল মটকানো থেকেই বুঝতে পারছি। আরো বুঝতে পারছি এই যে, যে বাক্সের মধ্যে দামী কিছু নেই, তার পিছনে শয়তানের দৃষ্টি কেন যাবে—এই রহস্যের কিনারা আমারই মতো ও-ও এখনো করে উঠতে পারেনি। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টায় কাল ও আবার বাক্স থেকে প্রত্যেকটা জিনিস বার করে খুঁটিয়ে দেখেছে। এমন কি টুথপেস্ট আর শেভিং ক্রীমের টিউব টিপে টিপে দেখেছে, ব্লেডগুলো খাপ থেকে বার করে দেখেছে, খবরের কাগজের ভাঁজ খুলে দেখেছে। এত করেও সন্দেহজনক কিছুই খুঁজে পায়নি।

ফেলুদা বেরিয়ে গেল আটটার মধ্যে। কী আর করি—কোনো রকমে কয়েক ঘণ্টা একা বাড়িতে বসে কাটানোর জন্য মনটা তৈরি করে নিলাম। বাবা ম্যাসানজোর গেছেন দিন পনেরর জন্য। ওঁকে একটা চিঠি লিখে সিমলা যাবার কথাটা জানিয়ে দিতে হবে। ফেলুদা যাবার সময় বলে গেছে, তিন ঘণ্টার মধ্যে যদি কেউ কলিং বেল টেপে তা হলে তুই নিজে দরজা খুলবি না, শ্রীনাথকে বলবি। আমি এগারোটার মধ্যে ফিরে আসব।’

বাবাকে চিঠি লিখে হাতে একটা গল্পের বই নিয়ে বৈঠকখানার সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে বাক্সের ব্যাপারটা সম্বন্ধে ভাবতে ভাবতে সমস্ত ঘটনাগুলো ক্রমেই আরো ধোঁয়াটে হয়ে আসতে লাগল। দীননাথবাবু তাঁর সেই ফিল্মে অ্যাকটিং করা ভাইপো, খিটখিটে নরেশ পাকড়াশী, আপেলওয়ালা, সিমলাবাসী মিস্টার ধমীজা, সুদের কারবারি বৃজমোহন, সবাই—যেন মনে হল মুখোশ পরা মানুষ। এমন কি, এয়ার ইন্ডিয়ার বাক্স আর তার ভিতরের প্রত্যেকটা জিনিসও যেন মুখোশ পরে বসে আছে। আর তার উপরে কাল রাত্রে প্রিটোরিয়া স্ট্রীটের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা…

শেষটায় ভাবা বন্ধ করে তাক থেকে একটা পত্রিকা নিয়ে পাতা উলটাতে লাগলাম। সিনেমা পত্রিকা—নাম ‘তারাবাজি’। এই তো সেই পত্রিকা—যাতে অমরকুমারের ছবি দেখেছিলাম। এই তো—‘শ্রীগুরু পিকচার্সের নির্মীয়মাণ “অশরীরী” ছায়াচিত্রে নবাগত অমরকুমার।’ মাথায় দেব আনন্দের জুয়েল থীফের ধাঁচের টুপি, গলায় মাফলার, সরু গোঁফের নীচে ঠোঁটের কোণে যাকে বলে ক্রূর হাসি। হাতে আবার একটা রিভলবার—সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ফাঁকি। নিশ্চয়ই কাঠের তৈরি।

হঠাৎ কী মনে হল, টেলিফোন ডিরেক্টরিটা খুলে একটা নাম বার করলাম। শ্রীগুরু পিকচার্স। তিপ্পান্ন নম্বর বেনটিঙ্ক স্ট্রীট। টু ফোর ফাইভ ফাইভ ফোর।

নম্বর ডায়াল করলাম। ওদিকে রিং হচ্ছে। এইবার টেলিফোন তুলল।

‘হ্যালো—’

‘শ্রীগুরু পিকচার্স?’

আমার গলাটা মাস ছয়েক হল ভেঙে মোটার দিকে যেতে শুরু করেছে, তাই আমার বয়স যে মাত্র সাড়ে পনের, সেটা নিশ্চয়ই এরা বুঝতে পারবে না।

‘হ্যাঁ, শ্রীগুরু পিকচার্স।’

‘আপনাদের অশরীরী ছবিতে যে নবাগত অমরকুমার কাজ করছেন, তাঁর সম্বন্ধে একটু—’

‘আপনি মিস্টার মল্লিকের সঙ্গে কথা বলুন।’

লাইনটা বোধ হয় মিস্টার মল্লিককে দেওয়া হল।

‘হ্যালো।’

‘মিস্টার মল্লিক?’

‘কথা বলছি।’

‘আপনাদের একটা ছবিতে অমরকুমার বলে একজন নবাগত অ্যাকটিং করছেন কি?’

‘তিনি তো বাদ হয়ে গেছেন—’

‘বাদ হয়ে গেছেন?’

‘আপনি কে কথা বলছেন?’

‘আমি’—কী নাম বলব কিছু ভেবে না পেয়ে বোকার মতো খট্ করে টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে দিলাম। অমরকুমার বাদ হয়ে গেছে! নিশ্চয়ই ওর গলার আওয়াজের জন্য। কাগজে ছবি-টবি বেরিয়ে যাবার পরে বাদ। অথচ ভদ্রলোক কি সে-খবরটা জানেন না? নাকি জেনেও আমাদের কাছে বেমালুম চেপে গেলেন?

বসে বসে এই সব ভাবছি এমন সময় টেলিফোনটা হঠাৎ বেজে উঠে আমাকে বেশ খানিকটা চমকে দিল। আমি হন্তদন্ত রিসিভারটা তুলে হ্যালো বলার পর বেশ কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা নেই। তারপর একটা খট করে শব্দ পেলাম। বুঝেছি। পাবলিক টেলিফোন থেকে কলটা আসছে। আমি আবার বললাম, ‘হ্যালো।’ এবারে কথা এলো—চাপা কিন্তু স্পষ্ট।

‘সিমলা যাওয়া হচ্ছে?’

একটা অচেনা গলায় হঠাৎ কেউ এ প্রশ্ন করতে পারে এটা ভাবতেই পারিনি। তাই আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ঢোক গিলে চুপ করে রইলাম।

আবার কথা এলো। খস্‌খসে গলায় রক্ত-জল-করা-কথা—

‘গেলে বিপদ। বুঝেছ? বিপদ।’

আবার খট্। এবার টেলিফোন রেখে দেওয়া হল। আর কথা শুনব না। কিন্তু যেটুকু শুনেছি তাতেই আমার হয়ে গেছে। সেই নেশাখোর রাণার হাতে বাঘ-মারা বন্দুক যেভাবে কাঁপত, ঠিক সেইভাবে কাঁপা হাতে আমি টেলিফোনটা রেখে দিয়ে চেয়ারের উপর কাঠ হয়ে বসে রইলাম।

প্রায় আধ ঘণ্টা পরে চেয়ারে বসা অবস্থাতেই আবার ক্রিং শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল, কিন্তু তার পরেই বুঝলাম এটা টেলিফোন নয়, কলিং বেল। তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে দেখে নিজেই দরজা খুলতে ফেলুদা ঢুকল। তার হাতে পেল্লায় প্যাকেটটা দেখে বুঝলাম লন্ড্রি থেকে আনা আমাদের দুজনের গরম কাপড়। ফেলুদা আমার দিকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে বলল, ঠোঁট চাটছিস কেন? কোনো গোলমেলে টেলিফোন এসেছিল নাকি?’

আমি তো অবাক। ‘কী করে বুঝলে?’

‘রিসিভারটা যেভাবে রেখেছিস তাতেই বোঝা যাচ্ছে। তা ছাড়া জটপাকানো কেস—ও রকম দু-একটা টেলিফোন না এলেই ভাবনার কারণ হতো। কে করেছিল? কী বলল?’

‘কে করেছিল জানি না। বলল, সিমলা গেলে বিপদ আছে।’

ফেলুদা পাখাটা ফুল স্পীডে করে তক্তপোশের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুই কী বললি?’

‘কিচ্ছু না।’

‘ইডিয়ট। তোর বলা উচিত ছিল যে আজকাল কলকাতার রাস্তাঘাটে চলতে গেলে যে বিপদ, তেমন বিপদ এক যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া আর কোথাও নেই—সিমলা তো কোন্ ছার।’

ফেলুদা হুমকিটা এমনভাবে উড়িয়ে দিল যে আমিও আর ও বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না করে বললাম, ‘লন্ড্রি ছাড়া আর কোথায় গেলে?’

‘এস এম কেদিয়ার আপিসে।’

‘কিছু জানতে পারলে?’

‘বৃজমোহন বাইরে মাইডিয়ার লোক। পরিষ্কার বাংলা বলে, তিন পুরুষ কলকাতায় আছে। নরেশ পাকড়াশীর সঙ্গে সত্যিই ওর লেনদেনের সম্পর্ক ছিল। মনে হল পাকড়াশী এখনো কিছু টাকা ধারে। ধমীজার আপেল বৃজমোহনও খেয়েছিল। নীল এয়ার ইন্ডিয়ার ব্যাগ ওর নেই। ট্রেনে বেশির ভাগ সময়টাই হয় ঘুমিয়ে না হয় চোখ বুজে শুয়ে কাটিয়েছে।’

আমার দিক থেকেও একটা খবর দেবার ছিল—তাই অমরকুমারের বাদ হয়ে যাওয়ার কথাটা ওকে বললাম। তাতে ফেলুদা বলল, ‘তা হলে মনে হয় ছেলেটা হয়ত সত্যিই ভালো অভিনয় করে।’

সারাদিনে আমরা আমাদের গোছগাছটা সেরে ফেললাম। কাল আর সময় পাব না কারণ ভোর সাড়ে চারটায় উঠতে হবে। মাত্র চারদিনের জন্য যাচ্ছি বলে খুব বেশি জামা-কাপড় নিলাম না। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার সময় জটায়ু, অর্থাৎ লালমোহনবাবুর কাছ থেকে একটা টেলিফোন এলো। বললেন, ‘একটা নতুন রকমের অস্ত্র নিয়েছি—দিল্লী গিয়ে দেখাব।’ লালমোহনবাবুর আবার অস্ত্রশস্ত্র জমানোর শখ। রাজস্থানে একটা ভুজালি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন—যদিও সেটা কাজে লাগেনি। ভদ্রলোকের টিকিট কেনা হয়ে গেছে, বললেন, ‘কাল সকালে সেই দমদমে দেখা হবে।’

রাত আটটার কিছু পরে দীননাথবাবুর ড্রাইভার এসে আমাদের দিল্লীর প্লেন ও সিমলার ট্রেনের টিকিট, আর দীননাথবাবুর কাছ থেকে একটা চিঠি দিয়ে গেল। চিঠিটায় লেখা আছে—

প্রিয় মিস্টার মিত্তির,

দিল্লীতে জনপথ হোটেলে একদিন ও সিমলায় ক্লার্কস হোটেলে চার দিনের রিজার্ভেশন হয়ে গেছে। আপনার কথা মতো সিমলাতে মিঃ ধমীজার নামে একটা টেলিগ্রাম করেছিলাম, এইমাত্র তার জবাব এসেছে। তিনি জানিয়েছেন আমার বাক্স তার কাছে সযত্নে রাখা আছে। তিনি পরশু বিকালে চারটার সময় আপনাকে তাঁর বাড়িতে যেতে বলেছেন। ঠিকানা আপনার কাছে আছে, তাই আর দিলাম না। আপনি আমার বাক্সের জিনিসপত্রের একটা তালিকা চেয়েছিলেন, কিন্তু এখন ভেবে দেখছি যে ওতে একটিমাত্র জিনিসই ছিল যেটা আমার কাছে কিছুটা মূল্যবান। সেটি হল বিলাতে তৈরি এক শিশি এনটারোভয়োফর্ম ট্যাবলেট। দিশীর চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরী। আপনাদের যাত্রা নিরাপদ ও সফল হোক এই প্রার্থনা করি। ইতি ভবদীয়—

দীননাথ লাহিড়ী

কাল খুব ভোরে উঠতে হবে বলে তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে দশটার মধ্যে শুয়ে পড়ব ভেবেছিলাম, কিন্তু পৌনে দশটায় আমাদের দরজায় কে যেন বেল টিপল। দরজা খুলে যাকে দেখলাম, তিনি যে কোনো দিন আমাদের বাড়িতে আসবেন সেটা ভাবতেই পারিনি। ফেলুদা ভিতরে ভিতরে অবাক হলেও, বাইরে একটও সেরকম ভাব না দেখিয়ে বলল, ‘গুড ইভনিং মিস্টার পাকড়াশী—আসুন ভেতরে।’

ভদ্রলোকের খিট্‌খিটে ভাবটা তো আর নেই দেখছি। ঠোঁটের কোণে একটা অপ্রস্তুত হাসি, একটা কিন্তু কিন্তু ভাব, একদিনের মধ্যেই একেবারে আশ্চর্য পরিবর্তন। এত রাত্রে কী বলতে এসেছেন উনি?

নরেশবাবু কৌচের বদলে চেয়ারটাতে বসে বললেন, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে—ফোন করেছিলাম বার পাঁচেক—কানেকশন হচ্ছিল না—তাই ভাবলাম চলেই আসি। অপরাধ নেবেন না—’

‘মোটেই না। কী ব্যাপার বলুন।’

‘একটা অনুরোধ—একটা বিশেষ রকম অনুরোধ—বলতে পারেন একটা বেয়াড়া অনুরোধ নিয়ে এসেছি আমি।’

‘বলুন—’

‘দীননাথের বাক্সে যে লেখাটার কথা বলছিলেন, সেটা কি তেরাই-রচয়িতা শম্ভুচরণের কোনো রচনা?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তাঁর তিব্বত ভ্রমণের কাহিনী।’

‘মাই গড!’

ফেলুদা চুপ। নরেশ পাকড়াশীও কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ। দেখেই বোঝা যায় তার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনার ভাব। তারপর মুখ খুললেন—

‘আপনি জানেন কী যে ভ্রমণ-কাহিনীর বই আমার সংগ্রহে যতো আছে তেমন আর কলকাতায় কারুর কাছে নেই?’

ফেলুদা বলল, ‘সেটা বিশ্বাস করা কঠিন নয়। আপনার বইয়ের আলমারির দিকে যে আমার দৃষ্টি যায়নি তা নয়। সোনার জলে লেখা কতকগুলো নামও চোখে পড়েছে—স্বেন হেদিন, ইব্‌ন বাতুতা, তাভেরনিয়ে, হুকার…’

‘আশ্চর্য দৃষ্টি তো আপনার।’

‘ওইটেই তো ভরসা।’

নরেশবাবু তাঁর বাঁকানো পাইপটা ঠোঁট থেকে নামিয়ে একদৃষ্টে ফেলুদার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি সিমলা যাচ্ছেন তো?’

এবার ফেলুদার অবাক হবার পালা। ‘কী করে জানলেন’ প্রশ্নটা মুখে না বললেও তার চাহনিতে বোঝা যাচ্ছিল। নরেশবাব একটু হেসে বললেন, ‘দীনু লাহিড়ীর বাক্স যে ধমীজার সঙ্গে বদল হয়ে গেছে সেটা আপনার মতো তুখোড় লোকের পক্ষে বের করা নিশ্চয়ই অসম্ভব নয়। ধমীজার নামটা তার সুটকেসে লেখা ছিল, আর এয়ার ইন্ডিয়ার ব্যাগটা তাকে আমি নিজে ব্যবহার করতে দেখেছি। সেই বাক্স থেকে শেভিং-এর সরঞ্জাম বার করে দাড়ি কামিয়েছেন ভদ্রলোক।’

‘কিন্তু কাল সে কথাটা বললেন না কেন?’

‘আমি বলে দেওয়ার চেয়ে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে বার করার মধ্যে অনেক বেশি আনন্দ নয় কি? কেসটা তো আপনার। আপনি মাথা খাটাবেন এবং তার জন্য আপনি পারিশ্রমিক পাবেন। গায়ে পড়ে আমি কেন হেল্‌প করব বলুন?’

ফেলুদার ভাব দেখে বুঝলাম সে নরেশবাবুর কথাটা অস্বীকার করছে না। সে বলল, ‘কিন্তু আপনার বেয়াড়া অনুরোধটা কী সেটা তে বললেন না।’

‘সেটা আর কিছুই না। লাহিড়ীর বাক্স আপনি উদ্ধার করতে পারবেন নিশ্চয়ই। আর সেই সঙ্গে সেই লেখাটাও। আমার অনুরোধ আপনি ওটা ওকে ফেরত দেবেন না।’

‘সে কি!’ ফেলুদা অবাক। আমিও।

‘তার বদলে ওটা আমাকে দিন।’

‘আপনাকে?’ ফেলুদার গলার আওয়াজ তিন ধাপ চড়ে গেছে।

‘বললাম তো অনুরোধটা একটু বেয়াড়া। কিন্তু এ অনুরোধ আপনাকে রাখতেই হবে।’ ভদ্রলোক তার কনুই দুটো হাঁটুর উপর রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘তার প্রথম কারণ হচ্ছে—ওই লেখার মূল্য দীননাথ লাহিড়ীর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তার বাড়ির আলমারিতে একটাও ভালো বই দেখেছেন? দেখেননি। দ্বিতীয়ত, কাজটা আমি আপনাকে বিনা কম্পেনসেশনে করতে বলছি না। এর জন্যে আমি আপনাকে—’

ভদ্রলোক কথা থামিয়ে তাঁর কোটের বুক-পকেট থেকে একটা নীল রঙের খাম টেনে বার করলেন। তারপর খামের ঢাকনা খুলে সেটা ফেলুদার দিকে এগিয়ে ধরলেন। ঢাকনা খুলতেই একটা চেনা গন্ধ আমার নাকে এসেছিল। সেটা হল করকরে নতুন নোটের গন্ধ। এখন দেখলাম খামের মধ্যে একশো টাকার নোটের তাড়া।

‘এতে দু’ হাজার আছে,’ নরেশবাবু বললেন, ‘এটা আগাম। লেখাটা হাতে এলে আরো টু দেবো আপনাকে।’

ফেলুদা খামটা যেন দেখেও দেখল না। পকেটে হাত দিয়ে চারমিনারের প্যাকেট বার করে দিব্যি একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘আমার মনে হয় দীননাথ লাহিড়ী ও-লেখার কদর করেন কি না করেন সেটা এখানে অবান্তর। আমি যে কাজের ভারটা নিয়েছি সেটা হল তাঁর বাক্সটা সিমলা থেকে এনে তাঁর হাতে তুলে দেওয়া—সমস্ত জিনিসপত্র সমেত। ব্যস্—ফুরিয়ে গেল।’

নরেশবাবু বোধ হয় কথাটার কোনো জুতসই জবাব পেলেন না।

বললেন, ‘বেশ-ওসব না হয় ছেড়েই দিলাম। আমার অনুরোধের কথাটাতেই ফিরে আসছি। লেখাটা আপনি আমায় এনে দিন। দীনু লাহিড়ীকে বলবেন সেটা মিসিং। ধমীজা বলেছে লেখাটা বাক্সে ছিল না।’

ফেলুদা বলল, ‘তাতে ধমীজার পোজিশনটা কী হচ্ছে সেটা ভেবে দেখেছেন কি? একটা সম্পূর্ণ নির্দোষ লোকের ঘাড়ে আমি এভাবে অপরাধের বোঝা চাপাতে রাজী হব—এটা আপনি কী করে ভাবলেন? মাপ করবেন মিস্টার পাকড়াশী, আপনার এ অনুরোধ রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

ফেলুদা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেশ ভদ্র ভাবেই বলল, ‘গুড নাইট, মিস্টার পাকড়াশী। আশা করি আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না।’

নরেশবাবু কয়েক মুহূর্ত থুম্ হয়ে বসে থেকে টাকা সমেত খামটা পকেটে পুরে ফেলুদার দিকে তাকিয়ে একটা শুক্‌নো হাসি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন। তিনি রাগ করেছেন, না হতাশ হয়েছেন, না অপমানিত হয়েছেন, সেটা তাঁর মুখ দেখে কিছুই বোঝা গেল না।

আমি মনে মনে বললাম, ফেলুদা ছাড়া অন্য কোনো গোয়েন্দা যদি অতগুলো করকরে নোটের সামনে পড়ত, তা হলে কি সে এভাবে লোভ সামলাতে পারত? বোধ হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *