দাসপাড়ায় হইচই পড়ে গেল। একজন মরা মানুষ ফিরে এসেছে।
দলে দলে তোক দেখতে এল তাকে। শিশুরা মায়ের পেছনে লুকিয়ে ভয়ে ভয়ে উঁকি মারছে, যেন তারা ভূত দেখছে।
দাওয়ায় বসে আছে লালু। একটা লুঙ্গি পরা, খালি গা। সারা গায়ে আর মুখেও কালো কালো বসন্তের দাগ, একটা চক্ষু বোজা। তার চেহারা বদলে গেছে অনেক।
দু-চারজন ফিসফিস করে কানাকানি করতে লাগল। এ পদ্মাবতীর ছেলে লালু নয়। এ অন্য মানুষ। ক
নিতান্ত উড়ো খবর তো নয়, বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্বয়ং কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্ন এসে বলেছেন যে, তারা লালুকে মরতে দেখেছেন। কবিরাজমশাই ধন্বন্তরীর মতন, তিনি কারুর মৃত্যু ঘোষণা করলে তার পক্ষে কি আর বেঁচে থাকা সম্ভব? তা ছাড়া তার মুখাগ্নি করা হয়েছিল। সেই মানুষ বেঁচে ফিরে আসছে। এ একটা গাঁজাখুরি কথা নয়। ও নাকি এখন মুসলমান? বাড়ি থেকে বেরুল হিন্দুর ছেলে, ফিরে এল মুসলমান হয়ে, ছি ছি, এমন কথা শোনাও পাপ! একে কোনওক্রমেই আর লালু বলে মানা যাবে না।
পদ্মাবতী প্রথমে গুপি-তাহেরের সঙ্গে লালুকে উঠোনে পা দিতে দেখে চিৎকার করে উঠেছিলেন, কে? কে? এ কি আমার লালু? আঁ? লালু?
এত বেশি আবেগ যে, তিনি পড়ে গিয়েছিলেন মাটিতে। তখন তার মাথায় জল দিতে হয়। তিনি আবার চোখ মেলার পর লালু বলেছিল, হ মা, আমি।
তারপর আত্মস্থ হয়ে পদ্মাবতী তাহেরদের কাছ থেকে সব শুনলেন। তখন আবার অন্যরকম আবেগ শুরু হল। তিনি কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন, হা আমার পোড়া কপাল। আমি ভাবলাম, ভগবান বুঝি মুখ তুলে চেয়েছেন। কিন্তু এ কী হল? ছেলে মোছলমানের ঘরে ভাত খেয়েছে। মোছলমান মেয়েমানুষকে মা বলে ডেকেছে। এখন আমি এ ছেলেকে ঘরে নিই কী করে? এর থেকে যে আমার মরণুও ভালো ছিল। আমি আগেই। মরলাম না কেন?
গোলাপি ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। তার চক্ষু থেকেও অশ্রুবর্ষণ হচ্ছে, হয়তো তা আনন্দের অশ্রু, কিন্তু মুখে কোনও কথা নেই।
বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন মতামত কয়েকজন বলল, মন্ত্র উচ্চারণ করে যে মানুষের শ্রাদ্ধ পর্যন্ত হয়ে গেছে, তাকে আবার জীবিত বলে গণ্য করা যায়। কীভাবে? কয়েকজন বলল, ও যখন মোছলমান হয়েছে, তখন তো আর হিন্দু সমাজের মধ্যে থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ওর মা যদিও বা ওকে রাখে, তা হলে ওদের একঘরে করা হবে। ওরা কোনও কাজ পাবে না। খাবে কী করে?
লালুর সঙ্গে কেউ কথা বলছে না, পদ্মাবতীকে আড়ালে ডেকে নানাজনে নানা পরামর্শ দিচ্ছে।
কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্ন সেনের কাছেও খবর পৌঁছোল। প্রথমে তিনি একবার ভাবলেন, স্বয়ং এই আগন্তুককে দেখতে আসবেন। তারপর মত বদল করলেন। দেখার কী আছে, তিনি তো ভালোভাবেই জানেন, লালু বেঁচে নেই। একটুও প্রাণের চিহ্ন থাকলে কি তিনি তাকে বাঁচাবার সবরকম চেষ্টা করতেন না? মুখাগ্নি করতে তো তিনিই বলেছিলেন। অন্য কেউ এসেছে। কুমতলবে, তিনি তার মুখ দর্শনও করতে চান না।
এমনকী ফুলু ঠাকুরানি, বন্যার সময় লালু যাঁর প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করেছিল, এ-সংবাদ শোনার পর তিনি মৃগী রোগীর মতন ছটফট করতে লাগলেন। চক্ষু কপালে তুলে বলতে লাগলেন, আঁ! কস কী? অমন ভালোমানুষের পোলাড়া ধম্ম খাইছে? জাইত গেছে? দেখিস যেন সে আমার বাড়ির ত্রিসীমানাতেও আর না-আসে।
সব লোকই সন্ধের পর বিদেয় নেয়। অন্ধকার নেমে এলে গ্রামের মানুষ বিশেষ। প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে থাকে না। এই সময় সাপখোপের বড় ভয়।
ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নেমে গেল।
লালুর থেকে খানিকটা দূরত্ব রেখে গালে হাত দিয়ে বসে রইলেন পদ্মাবতী। গোলাপি এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে দরজার ধারে। কোনও কথা নেই। এরপর কী হবে?
খানিক বাদে, পদ্মাবতীর খেয়াল হল যে, লালু কতক্ষণ আগে এসেছে, তাকে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি। এবেলার ডাল-ভাত ওবেলাই রান্না করা থাকে।
রান্নাঘরের পেছনে গোটাকতক কলাগাছ। একটা কলাপাতা কেটে আনলেন পদ্মাবতী লালুর সামনে কলাপাতাটা পেতে দিয়ে একটু দূর থেকে ভাত বেড়ে দিলেন।
ক্ষুধার্ত লালু হাত বাড়াতেই পদ্মাবতী বললেন, দেখিস বাবা, আমারে ছুঁয়ে দিস না যেন।
লালুর নিজস্ব একটা কাঁসার থালা আছে। বরাবর সে তাতেই খায়। কলাপাতা দেখে সে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, আমার থালাটা বিক্রি করে দিয়েছ নাকি?
পদ্মাবতী বললেন, না, দিই নাই। এখন তো বাড়ির থালা-বাসনে খেতে নাই। কলাপাতাও তত ভালো। বউমা, একটা কুপি জ্বা।
লালু বলল, বৃষ্টির ছাঁট আসতেছে। ঘরের মইধ্যে যেতে হবে।
পদ্মাবতী বললেন, না রে, ঘরেও তো যাওয়া যাবে না। ঘরে যে রাধা কৃষ্ণ, লক্ষ্মী-জনার্দন আছেন।
লালু বলল, ঠাকুরের ছবি আর সরা? সেগুলান একপাশে সরায়ে রাখলে হয় না?
পদ্মাবতী বললেন, ছিঃ বাবা, ও কথা বলতে নাই। ঠাকুর-দেবতাদের কি সরাতে আছে?
লালু জিজ্ঞেস করল, রাত্তিরে আমি শোব কোথায়?
পদ্মাবতী করুণ কণ্ঠে বললেন, তোকে একটু কষ্ট করে বাইরেই শুতে হবে। তুই মুসলমান হইছিস। হিন্দুর ঠাকুর-দেবতার সামনে তোর তো আর যাইতে নাই।
লালু একটু গলা তুলে অসহিষ্ণুভাবে বলল, তোমরা তখন থেকে বলতেছ, আমি মোছলমান হইছি। মোছলমান হইছি, কই, আমি তো কমা পড়ে মোছলমান হই নাই! আমি তো যেমন ছিলাম, তেমনই আছি।
পদ্মাবতী বললেন, তুই যে যবনের হাতের অন্ন খেয়েছিস, তাতেই হিন্দুদের জাত চলে যায়।
লালু জিজ্ঞেস করল, কীভাবে জাত গেল? শরীল থিকা কি ফুস কইরা বাইরাইয়া যায়? জানতে পারলে ধরে রাখতাম। কিছু ট্যারও পাইলাম না!
পদ্মাবতী বললেন, ওরে, এসব নিয়া তর্ক করতে নাই। আমরা আর কতটুকু জানি। সমাজের মাথারা যা বলেন, আমরা তাই শুনি।
লালুর চকিতে মনে পড়ল সিরাজ সাঁই-এর কথা। তিনি বলেছিলেন, তর্ক করতে নাই। তর্কে কোনও লাভ হয় না।
সে আবার শান্তভাবে বলল, আমার জাত গেছে। আমি আর ঘরের মইধ্যে ঢোকতে পারব না। ঝড়বাদল যাই হোক, আমারে এই দাওয়ায় থাকতে হবে?
পদ্মাবতী বললেন, দেখি কী করা যায়। কয়েকটা দিন একটু কষ্ট কর। একজন বুঝদার লোক কইল, তুই যদি চিত্তির করোস, পুরুত ডাইক্যা শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করা যায় আর গ্রামের মানুষদের একবেলা ভোজন করানো যায়, তাইলে সব শোধন হয়ে যাঝে কিন্তু তাতে যে অনেক খরচ। আমার তো টাকাপয়সা কিছু নাই, দেখি যদি কেউ হাওলাত দেয়।
ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের সুরে নয়, খুব সহজভাবে লালু বলল, আমি শুধু প্রায়শ্চিত্ত করলে হবে না, পুরুতকে টাকা দিতে হবে। গ্রামের মানুষদের খাওয়াতে হবে। অনেক টাকা খরচ করলে তবে আমি জাত ফিরে পাব!
অন্নস্পর্শ করেনি সে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, অমন জাতে আমার দরকার নাই মা। তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি।
পদ্মাবতী ব্যাকুল হয়ে বললেন, সে কী! কোথায় যাবি! কোথায় যাবি। লালু বলল, বুঝে গেছি। এ-বাড়িতে আমার ঠাঁই নাই। তোমারে আর আমি বিপদে ফেলতে চাই না।
পদ্মাবতী বললেন, ওরে লালু, আমি তো জানি, তুই আমার বুকের ধন। তুই আমার একমাত্র সন্তান। তোকে ফিরে পেয়েও আবার ছেড়ে দিলে আমি বাঁচব কেমন করে?
লালু বলল, যার জাত চলে যায় সে আর তোমার সন্তান থাকে না। আমি তো প্রায় মরেই গেছিলাম, ধরে নাও আমি বাঁইচ্যা উঠি নাই। যেখানে জাত পাতের ঠেলাঠেলি নাই, আমি তেমন জায়গায় চলে যাব।
পদ্মাবতী হাহাকার করে বললেন, তেমন জায়গা কি কোথাও আছে? সবখানেই তো দেখি হিন্দু, না মোছলমান না কেরেস্তান নিজের নিজের ধর্ম নিয়ে থাকে। একসময় দেখি সকলের মইধ্যেই গলাগলি ভাব, আবার এক এক সময় হাতাহাতি, হাঙ্গামা, কাজিয়া।
লালু বলল, আছে। বন-জঙ্গলের পশুপাখিরা জাত-ধর্ম কিছু মানে না। জাত নাই, তাই জাতও হারায় না। আমি তাদের সাথে গিয়ে থাকব।
এবার সে গোলাপির দিকে ফিরে বলল, তুমি যাবা আমার সাথে? গোলাপি বলল, আমি কোথায় যাব। আমি কোথায় যাব? লালু বলল, আমি যেখানে যাব, তুমি আমার সাথে থাকবে। গোলাপি বলল, আমার ভয় করে, আমার ভয় করে। লালু ঠিক তিনবার ওই একই প্রশ্ন করল তার স্ত্রীকে। তারপর বলল, তয় তুমিও থাকো আমার মায়ের কাছে।
দাওয়া থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল লালু।
পদ্মাবতী পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে চিৎকার করতে লাগলেন, লালু, দাঁড়া, দাঁড়া। শোন আমার কথা।
লালুও তখন দৌড়োত শুরু করেছে। আজ আকাশে জ্যোৎস্না নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল লালু।