ডাঃ ওয়াদুদকে নিয়ে ফিরলাম রাত আড়াইটার দিকে। এসে দেখি দাদাকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। তাঁর মুখের শিরাগুলি নীল হয়ে ফুলে উঠেছে। রমিজ সাহেব দাদার বিছানার পাশে তসবি হাতে বসে আছেন। এই ভড়ৎ-এর কী মানে? দোয়া-দরুদ যদি পড়তেই হয়, তাহলে মনে মনে পড়লেই হয়। লোকদেখান একটা তসবির দরকার কি? আমি তাকিয়ে দেখলাম রমিজ সাহেব তাঁর মুখ দারুণ চিন্তাক্লিষ্ট করে রেখেছেন। দাদা মারা গেলে সবচেয়ে উঁচু গলায় যে তিনি কাঁদবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লোকটি নিবেধি। এ-রকম একটি নিবেধি লোকের বাচ্চাগুলি এ-রকম বুদ্ধিমান হয়েছে কীভাবে কে জানে? সব কটি বাচ্চার এমন বুদ্ধি। বিশেষ করে ক্লাস সেভেনে পড়ে যে-মেয়েটি-বিলু। সব সময় একটা না একটা মজার কথা বলে। হাসি চেপে রাখা মুশকিল। মেয়েরা সাধারণত রসিকতা করা দূরে থাকুক, রসিকতা বুঝতে পর্যন্ত পারে না। কিন্তু বিলু খুব রসিক।
কয়েক দিন আগে সে বারান্দায় বসে কী-যেন বানাচ্ছিল। আমাকে দেখেই বলল, বলুন তো পাঁচ থেকে এক বাদ গেলে কখন ছয় হয়? আমি উত্তরের জন্যে আকাশপাতাল হাতড়াচ্ছি–সে গম্ভীর হয়ে বলল, পারলেন না তো? যখন ভুল হয়, তখন হয় ছয়।
আমার প্রায়ই মনে হয়, একটা নিবেধি অপদাৰ্থ বাবার জন্যে সব কটি মেয়ে এখন কষ্ট পাচ্ছে, ভবিষ্যতেও পাবে।
রমিজ সাহেব আমাকে দেখে হাসিমুখে (তাঁর মুখ সব সময়ই হাসি—হাসি। নিবোধ লোকদের মুখ সব সময় হাসি-হাসি থাকে।) এগিয়ে এল।
ভাই সাহেব, আপনার সঙ্গে একটা প্ৰাইভেট কথা ছিল।
বলুন, শুনি।
চলেন, একটু বাইরে যাই।
বাইরে যাবার দরকার কি? এখানেই বলুন।
রামিজ সাহেব ইতস্তত করতে লাগলেন। তাঁর এই ভঙ্গিটা আমার চেনা। ধার চাইবার ভঙ্গি। কিন্তু রামিজ সাহেব আমাকে অবাক করে দিয়ে সম্পূৰ্ণ অন্য প্রসঙ্গ আনলেন।
কথাটা নীলুর প্রসঙ্গে।
নীলুর প্রসঙ্গে কী কথা?
নীলুর একটা ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসছে, ছেলে টাক্সেশান অফিসার। ময়মনসিংহে নিজেদের বাড়ি আছে।
ভালোই তো, বিয়ে দিন।
দিতেই চাই। কিন্তু নীলু রাজি না। এখন যদি ভাই আপনি একটু বুঝিয়ে বলেন……।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি বলব কী জন্যে? আমি কে?
রামিজ সাহেব আমতা-আমতা করতে লাগলেন, না, ইয়ে মানে–
আশ্চৰ্য, মেয়ে রাজি হচ্ছে না সেটা আমাকে বলছেন কী জন্যে?
রমিজ সাহেবের মুখ অনেকখানি লম্বা হয়ে গেল। তবু তিনি দেতে হাসি হাসতে লাগলেন। গা জ্বলে যাবার মতো অবস্থা। আমি গলার স্বর আর এক ধাপ উঁচু করে বললাম, শোনেন রমিজ সাহেব, সব কিছুর একটা সময়-অসময় আছে। একটা মানুষ মারা যাচ্ছে, এই সময় আপনি আজগুবি কথাবার্তা শুরু করলেন। আশ্চর্য!
রমিজ সাহেবের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। তিনি কাঁপতে শুরু করলেন। দুর্বল লোকের উপর কঠিন হতে ভালো লাগে। তার উপর এই লোকটিকে আমি পছন্দ করি না। কড়া-কড়া ধরনের কথা বলার সুযোগ পেয়ে অঘূমজনিত ক্লান্তি আমার অনেকখানি কমে গেল। রামিজ সাহেব অস্পষ্ট স্বরে বললেন, আচ্ছা ভাইসব, যাই তাহলে।
যান।
রমিজ সাহেব গেটের কাছে চলে গেলেন। সেখানে আগুনের একটা ফুলকি জ্বলে উঠতে দেখা গেল। বিড়ি বা সিগারেট কিছু একটা ধরিয়েছেন। এতটা কড়া না। হলেও চলত বোধ হয়। কিন্তু লোকটিকে আমি সহ্য করতে পারি না। এক দিন দুপুরে তাকে দেখলাম মীরপুর রোডের কাছে এক রেস্টুরেন্টে বসে খুব তরিবত করে মোরগপোলাও খাচ্ছে। ছুটির দিন। সকালেও তাকে বাসায় দেখে এসেছি। আমি এগিয়ে গেলাম।
কি ব্যাপার রমিজ সাহেব, বাইরে খাচ্ছেন যে?
রামিজ সাহেব আমতা-আমতা করে যা বললেন, তার সারমর্ম হচ্ছে–তাঁর গ্যাষ্টিকের প্রবলেম আছে। খিদে লাগলে সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা খেতে হয়। বাসায় ফিরতে একটু দেরি হবে তাই… ..।
গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেমে পোলাও-টোলাও চালাচ্ছেন?
রামিজ সাহেব তার উত্তর দিলেন না। আরো এক দিন তাঁর সঙ্গে এরকম দেখা! রিকশা করে যাচ্ছি, দেখি এলিফ্যান্ট রোডের এক কাবাব-ঘরের সামনে খোলা জায়গায় চেয়ারে পা তুলে বসা। তাঁর সামনে দু-তিন ধরনের কাবাব। আমি রিকশা থেকেই চৌচালাম, এই যে রমিজ সাহেব। তিনি আমার কথা শুনতে পেলেন না। তার চেয়েও আশ্চর্যের ব্যাপার, পরদিনই নীলু। এল টাকার জন্যে। এটা তার প্রথম আসা নয়, আগেও অনেক বার এসেছে। ধার চাইতে আসার লজ্জায় তাঁর ফর্স মুখ লালাভ। চোখ দেখেই মনে হয় আসার আগে ঘরে বসে খানিকক্ষণ কানাকাটি করেছে। চোখ ফোলা–ফোলা। আমি লজ্জা কমাবার জন্যেই বললাম (এই সময় আমি তুই করেই বলি), তোর যন্ত্রণায় তো সঙ্গে টাকা পয়সা রাখাই মুসিবত। কত টাকা দরকার?
দুই শ। যদি না থাকে-এক শ…
দেখি পারা যায় কিনা। পড়াশোনা হচ্ছে ঠিকমতো?
জ্বি।
গুড। এখন যা, রান্নাঘর থেকে দুধ-ছাড়া হালকা লিকারে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়। আমি ততক্ষণে ভেবে দেখি টাকা দেওয়া যায় কি না।
নীলু যেন পালিয়ে বাঁচে। চা নিয়ে এসে অনেকখানি সহজ হয়। এবং চায়ে চুমু দিয়ে আমি প্রতিবারের মতোই গম্ভীর হয়ে ভাবি, রমিজ সাহেব কি ইচ্ছা করেই মেয়েকে আমার কাছে পাঠান? তাঁর কি এক বারও মনে হয় না যে, আমি নীলুকে অনায়াসেই বলতে পারি, টাকা দিচ্ছি, কিন্তু তার আগে দরজাটা একটু ভেজিয়ে দে তো নীলু। আমি কোনো মহাপুরুষ নই। পৃথিবীর কোনো পুরুষই নয়। মহাপুরুষদের পাওয়া যায় ধর্মগ্রন্থে।
যে–লোক ভোর হতেই মেয়েকে টাকার জন্যে পাঠায়, সে কী করে আগের রাতে পায়ের উপর পা তুলে চপ-কাটলেট খায়! আমি নীলুকে বললাম, তোর বাবাকে প্রায়ই দেখি বাইরে হেভি খানাপিনা করে। নীলু। নরম গলায় বলল, প্রায়ই না, মাঝে মাঝে।
ঘরের খাওয়া রোচে না বুঝি?
নীলু অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বাবার ভালো খাওয়া খুব পছন্দ। ঘরে তো আর এইসব করা সম্ভব না। তাই কখনো কখনো……
তাই বলে বক রাক্ষসের মতো একা-একা খাবে?
নীলু চোখ নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল, আমাদের এইসব খেতে ইচ্ছেও করে না। এক বার বটি-কাবাব না। কী যেন এনেছিলেন, একগাদা লবণ। মুখে দেওয়া যায় না!
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, তোদের চার কন্যাকে আমি এক দিন ভালো একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাব।
সত্যি?
হুঁ।
কবে নোবেন?
আগে থেকে দিন-তারিখ বলতে হবে নাকি? ভাগ।
আমাদের যেতে দেবে না।
সেটা দেখা যাবে।
সবাইকে নিয়ে অবশ্য যাওয়া হল না। নীলুকে নিয়ে গেলাম। সেটাও হঠাৎ করে। হাতির পুলের কাছে নীলুর সঙ্গে দেখা। সে একগাদা বই বুকের কাছে ধরে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে হাঁটছে। আমি রিকশা থামিয়ে গলা বের করলাম, এই নীলু, যাস কই?
বাসায় যাই, আর কোথায় যাব? এই দিক দিয়ে একটা শর্টকাট রাস্তা আছে!
উঠে আয়।
আপনি বাসায় যাচ্ছেন?
সেটা দেখা যাবে, তুই ওঠ তো।
নীলু উঠে এল।
রোজ এই রোদের মধ্যে হেঁটে-হেঁটে বাড়ি যাস?
রোজ না। যেদিন আমাদের গাড়িটা নষ্ট থাকে কিংবা ড্রাইভার আসে না সেদিন যাই।
নীলু, শাড়ির অচল দিয়ে মুখ মুছল।
কলেজে গিয়ে খুব কথা শিখেছিস দেখি! আয়, তোকে একটা ক্লাশ ওয়ান রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাই।
এখন?
হুঁ।
আজ তো যাওয়া যাবে না।
আজ কী অসুবিধা?
আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন। আম্মার স্যাণ্ডেল নিয়ে এসেছি। এইগুলি পরে কেউ কোথাও যায়? আমাকে মনে করবে আপনার কোনো চাকরানী।
ঠিক আছে, আয় স্যাণ্ডেল কিনে দিই।
নীলু, শাড়ির অচল দিয়ে আবার কপালের ঘাম মুছল। ক্লান্ত স্বরে বলল, আপনাদের খুব মজা, না? যখন যা ইচ্ছা হয় কিনতে পারেন।
তা পারি।
টাকা খরচ করতেও আপনি ওস্তাদ।
তাও ঠিক।
হঠাৎ এই নতুন স্যাণ্ডেল নিয়ে গিয়ে বাসায় কী বলব? আপনি দিয়েছেন, এই কথা বলব?
বলতে অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে, আপনি বুঝবেন না।
নীলু আবার কপালের ঘাম মুছল।
স্যাণ্ডেল কিনতে হবে না, যেটা আছে সেটা পরেই যাব।
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, তোদের মেয়েদের মধ্যে শুধু প্যাঁচ।
মেয়েদের মনের সব কথা আপনি জানেন, তাই না?
তা জানি।
জানাই তো উচিত, এত মেয়ে বন্ধু আপনার। সেদিন দেখলাম রিকশা করে একটি মেয়ের সঙ্গে যাচ্ছেন।
নীলু ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলল।