অনেকক্ষণ ধরে দরজার কড়া নাড়ছে।
আমাদের বাসায় কলিংবেল নেই। কেউ এলে কড়া নাড়ে। বিশ্ৰী খটাং খটাং শব্দ হয়। আমি বাথরুমে গায়ে পানি ঢালছি আর কড়া নাড়ার শব্দ শুনছি। কে এসেছে ভর দুপুরে? আমি কি করব? ভেজা গায়ে দরজা খুলিব? কে হতে পারে?
তাড়াতাড়ি গায়ে কোনমতে একটা শাড়ি জড়িয়ে দরজা খুলে দেখি বড়মামা। বড়মামার পেছনে ছোট্ট টিনের ট্রাঙ্ক হাতে নয় দশ বছর বয়েসী একটা মেয়ে। আমি চেঁচিয়ে বললাম, বড়মামা। আপনি?
কেমন আছিস মা?
ভাল। সাথে এটা কে?
তোর জন্যে কাজের মেয়ে নিয়ে এসেছি। তুই ইরার কাছে চিঠি লিখেছিস। চিঠি পড়ে বুঝলাম ঘরে কাজের লোক নেই। তাই নিয়ে এসেছি। এর নাম মদিনা। তুই কাপড় বদলে আয় ভেজা গায়ে ঠাণ্ডা লাগাবি। জামাই কোথায়?
ও ঢাকার বাইরে আছে।
তুই এক?
জ্বি।
আচ্ছা যা কাপড় বদলে আয়। পরে কথা বলব।
বড়মামা বেশিক্ষণ থাকলেন না। দুপুরে কিছু খেলেনও না। রোজা রেখে এসেছেন। সন্ধ্যাবেলা ইফতার করবেন। অফিসের কাজ নিয়ে এসেছেন। এখন কােজ সারিতে যাবেন। রাতে আমার সঙ্গে দেখা করে ট্রেনে উঠবেন।
চিঠি লেখার থাকলে লিখে রাখিস। হাতে হাতে নিয়ে যাব। জামাই কদিন ধরে বাইরে?
চার দিন।
আসবে কবে?
ঠিক নেই মামা। সপ্তাহ খানিক লাগবে বলেছিল। ছবির কি একটা কাজ করছে।
একা ফেলে চলে গেল। এটা ঠিক হয় নাই। আমাকে খবর দিলে তোকে এসে নিয়ে যেতাম।
আমার অসুবিধা হচ্ছে না মামা। রাতে দারোয়ানের বউটা এসে বারান্দায় শুয়ে থাকে।
মামা কৌতূহলী চোখে আমার সংসার দেখছেন। খাটের নিচটাও এক ফাঁকে দেখলেন। চেয়ারে বসেছিলেন, চেয়ার ছেড়ে খাটে বসলেন। খাটটা নড়ে উঠল। ব্যাপারটা বোধহয় পছন্দ হল না। তিনি নিঃশ্বাস ফেললেন।
এখানকার খবরাখবর সব ভালতো?
জ্বি ভাল।
কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ও আমাকে নিয়ে গিয়েছিল।
ওরা আসে না?
জ্বি না।
তোর আগের ব্যাপার ট্যাপার কিছু জানতে চায় নি তো?
জ্বি-না।
নিজ থেকে কিছু বলার দরকার নেই।
বাবার শরীর কেমন আছে মামা?
কিছু বুঝতে পারছি না। কখনো বলে ভাল। কখনো বলে মন্দ।
ইরার খবর কি?
ভাল। ওর বিয়ের সম্বন্ধ আসছে। জামাই মংলা পোর্টের ইনজিনিয়ার। দেখে গেছে। পছন্দ হয়েছে বলেইতো মনে হয়। দেখি আল্লাহ আল্লাহ করছি। বিয়ে শাদীর ব্যাপার কলমা না পড়ানো পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। তোর বাসাটা বড় থাকলে তোর এখানে এনে রাখতাম। বিয়ের কোন আলাপ-আলোচনায় নেত্রকোনা হওয়া উচিত না। ফন্ট করে কেউ কান ভাঙনি দিবে। তোর বাসাওতো ছোট।
জ্বি।
জামাই কি বলে? বড় বাসা নেবে না। এইখানেই থাকবে?
এই নিয়ে কথা হয় নি মামা।
তুই কিছু বলতে যাবি না। চাপ দেয়া ঠিক না। শুরুতে একটু কষ্ট করাই ভাল। কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। সংসারে ভালবাসা থাকলে আর কিছু লাগে না। চাঁদের আলো ঢোকে ভাঙা ঘরে।
পাকা দালানের জানোলা খুলে দিলেও আলো ঢোকে মামা।
তার জন্যে জানোলা খুলতে হয় রে বড় খুকী। কয়জন আর জানালা খুলে? কেউ খুলে না।
বড়মামা শুধু যে মদিনাকে নিয়ে এসেছেন। তাই না। কয়েক ধরনের আচার এনেছেন। আমের আচার, তেঁতুলের আচার, চালতার আচার। একটিন মুড়ি এনেছেন। হরলিক্সের কোটায় এক কৌটা গাওয়া ঘি। একটা প্যাকেট খুলে দেখি ঘরে পরার দুটা শাড়ি। একটা গামছা।
বড় খুকী!
জ্বি মামা।
জামাইয়ের জন্যে স্যুটের কাপড় কিনে দেব বলে ঠিক করেছিলাম। ওকে সাথে নিয়েই কেনার ইচ্ছা ছিল। স্যুট কিনে দোকানে দিয়ে দরজির খরচটাও দিয়ে দেয়া। নয়ত খাজনার থেকে বাজনা বড় হয়ে যায়। এখন কি করি বলতো।
সুটের কাপড় লাগবে না মামা। ও সুট পরে না। ছোট চাকরি করে। এই চাকরিতে স্যুট পরলে লোকে হাসবে।
ওর ছোট চাকরির জন্যে মন খারাপ করিস না মা।
এম্নি বললাম। আমার মন খারাপ না। আলহামদুলিল্লাহ শুনে ভাল লাগল। আচ্ছা পরের বার যখন আসব। তখন বানিয়ে দিয়ে যাব।
মামা আপনার শরীর কেমন?
আছে ভালই আছে। মাথা ব্যথাটা হয়। টিউমার হয়েছে কি-না কে জানে। আমাদের এখানে একজন ডাক্তার আছেন ওয়াদুদ সাহেব–বন্ধু মানুষ। তিনি বলছিলেন টিউমারের টেস্ট ফেস্ট করাতে। কাগজে কি সব লিখেও দিয়েছেন।
করাবেন না?
করাব। পরের বার করাব। ও আচ্ছা ভুলে গেছি–ছোট খুকীর চিঠিটা নে। জবাব লিখে রাখিস। বার বার বলে দিয়েছে জবাব নিয়ে যেতে। জবাব ছাড়া গেলে খুব রাগ করবে। আর মদিনাকে কিছু খেতে দে। ওর বোধহয় ক্ষিধে পেয়েছে। এদের কিন্তু পেটের আন্দাজ নেই। যা দিবি তাই খেয়ে পেটের অসুখ বাঁধাবে। হিসেব করে দিস। আমি এখন উঠি রে মা…
মদিনাকে খেতে দিয়ে আমি ইরার চিঠি নিয়ে বসলাম। ইরা লিখেছে–
আপা,
তোমার চিঠি লিখতে এত দেরী হল কেন? তোমার এত কি কাজ? তুমি বিশ্বাস করবে না, আমি নিজে প্রতিদিন একবার পোস্টাপিসে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছি— চিঠি এসেছে কি-না!
এর মধ্যে এমন এক কাণ্ড হল–বাবা গভীর রাতে চেঁচামেচি শুরু করলেন–নবনী এসেছে। নবনী এসেছে। সে কি হৈ চৈ। আমরা দরজা খুললাম। কেউ নেই। আসলে বাবা স্বপ্ন-টপ্ল দেখে এই কাণ্ড করেছেন। বাবার শরীর আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে।। হলে কি হবে চিকিৎসা করাবেন না। এখন কোন ওষুধ খাচ্ছেন না। একজন জ্বীন সাধকের খোঁজ পাওয়া গেছে। তার কাছ থেকে ওষুধ নিচ্ছেন। সেই ওষুধ না-কি জুীনারা এনে দিচ্ছে কোহিকাফা নগর থেকে। গাছের কি সব শিকড় বাকড়। মা সেসব হামানদিস্তায় পিষে পিষে দিচ্ছেন। আমি খানিকটা চোখে দেখেছি–বিশ্রণী দুৰ্গন্ধ। খানিকটা মুখে দিলে মুখ আঠা আঠা হয়ে থাকে।
ভাল কথা–মা স্বপ্নে দেখেছেন তোমার ছেলে হয়েছে। ছেলের নামও স্বপ্নে দেখেছেন। ছেলের নাম জুলহাস। আমি মাকে বললাম— ছেলে হওয়া স্বপ্নে দেখেছ ভাল কথা। ছেলের নাম কিভাবে স্বপ্নে দেখলে? আর দেখলেই যখন একটু ভাল নাম দেখতে পারলে না?
অন্তু ভাইয়ারও খবর আছে। সে ফুটবল খেলতে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছে।
লোকজন বল খেলতে গিয়ে পায়ে চোট পায়। ভাইয়ার সবই উল্টা সে চোট পেয়েছে মাথায়। তোমার ঘরটা এখন ভাইয়ার দখলে। এত সুন্দর ঘরটা সে যে কি করেছে তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না। তার উপর একদিন তার ঘরে ঢুকে দেখি–না থাক এখন বলব না। খুবই মজার ব্যাপার মুখোমুখি বলতে হবে।
আপা তুমি কবে আসছে? আমি দুলাভাইকে তার অফিসের ঠিকানায় খুব করুণ একটা চিঠি লিখেছি। এত করুণ যে চিঠি পড়ার পরপরই অন্তত কিছুদিনের জন্যে দুলাভাই তোমাকে আমাদের এখানে রেখে যাবেন।
আমার যে বিয়ের কথা হচ্ছে তা নিশ্চয়ই এর মধ্যে বড় মামা তোমাকে বলেছেন। ছেলে নিজেই আমাকে দেখতে এসেছে। গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করল–রবীন্দ্রনাথ কবে নবেল পুরস্কার পান বলতে পারেন?
আমার এমন রাগ লাগছিল যে ইচ্ছা করল বলি–রবীন্দ্ৰনাথ কে? নাম শুনিনিতো? এরকম বলতে পারি নি। শুধু বলেছি কবে নবেল পুরস্কার পেয়েছেন জানি না।
আপা তুমি কি জান? আমার মনে হয় এখন আমার একটা সাধারণ জ্ঞানের বই দরকার। নিয়ত কখন কি প্রশ্ন করবে–জবাব দিতে পারব না। বিয়ে আটকে যাবে।
তবে জবাব দিতে না পারলেও ঐ লোক আমাকে পছন্দ করেছে। সেটা আমি ঐ লোকের ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকা থেকেই বুঝেছি। বড় কোন সমস্যা না হলে এই শীতে বিয়ে হয়ে যাবে। আপা কিছু ভাল লাগছে না। তুমি আস।
মামা বিকেলে একটা ইলিশ মাছ হাতে নিয়ে এলেন। তাঁর গায়ে জ্বর। বেশ জ্বর। ইফতার কিছু খেতে পারলেন না। আমি বললাম, চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকুন। কাল যাবেন। মামা রাজি হলেন না। রাজি হবেন না জানতাম। তাকে ফেরানো মুশকিল। নিজে যা ভাল মনে করবেন। তাই করবেন। অন্যের কোন
কথাই শুনবেন না।
বড় খুকী!
জ্বি মামা।
ছোট খুকীর বিয়েটা মনে হয় হয়েই যাবে। ওরা মুখে অবশ্যি কিছু বলে নাই। ছোট খুকীকে কি সব প্রশ্ন ট্রশ্ন করেছে উত্তর দিতে পারে নাই। তারপরেও মনে হয় পছন্দ হয়েছে বিয়েটা হয়ে গেলে দায়িত্ব শেষ হয়। একটু দোয়া করিস মা।
দোয়ায় কি কাজ হয় মামা?
অবশ্যই হয়। হবে না কেন?
আপনাকে লেবুর সরবত বানিয়ে দেব?
দে। লেবুর সরবত বলকারক। ঘরে কি লেবু আছে?
আছে।
আমি লেবুর সরবত বানিয়ে এনে দেখি দরজায় হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। বড়মামা ঘরে ঢোকার মূল দরজায় হাতুড়ি দিয়ে কি যেন করছেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কি করছেন মামা? ছিটিকিনি লাগাচ্ছি। ডাবল প্ৰটেকশান থাকা দরকার। আগের ছিটকানিটা দুর্বল।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম মামা হাতুড়ি, ছিটিকিনি সব কিনে এনেছেন। একটা স্কু ড্রাইভারও আছে। কি আশ্চর্য মানুষ।
হাতুড়ি টাতুড়ি সব কিনে নিয়ে এসেছেন? হুঁ। কাজ ফেলে রাখলেতো হয় নারে মা। যখনকার কাজ তখন করতে হয়। মামা ছিটিকিনি ফিট করে খাটটা ঠিক করলেন। খাটের পায়ার নিচে কাগজ দিয়ে পাগুলি সমান করলেন। লেবুর সরবত খেলেন। মদিনাকে দশটা টাকা দিয়ে নানান উপদেশ দিলেন। বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে আমার মাথায় ফুঁ দিয়ে বললেন, এবার তাহলে যেতে হয় রে বড় খুকী। একটা চিঠি আন। জামাইকে দু লাইনের চিঠি লিখে যাই।
দু লাইনের চিঠি লিখতে মামার অনেক সময় লাগল। টপ টপ করে মাথা থেকে ঘাম ঝড়ছে। পানি চেয়ে পানি খেলেন।
আপনার শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে মামা?
না। ঘাম হচ্ছে জ্বর ছেড়ে দিচ্ছে বলে মনে হয়।
চিঠি শেষ করে মামা উঠে দাঁড়ালেন। দোয়া পড়ে ফুঁ দেয়ার পর্ব। আবার হল। আমি বললাম, মামা আমার ধারণা আপনার শরীর বেশি খারাপ আপনি রাতটা থেকে যান।
না রে বেটি না। জামাই এলেই চিঠিটা দিবি।
আমি কি পড়তে পারব মামা।
অবশ্যই পারবি। না পারার কি আছে?
ঘর থেকে বের হবার ঠিক আগে মামা বাথরুমে ঢুকে বমি করলেন। আমি মাথা মুছিয়ে দিলাম। মামা বললেন, বমি হয়ে যাওয়ায় ভাল হয়েছে। শরীরটা ফ্রেশ লাগছে। তুই আমাকে নিয়ে শুধু শুধু চিন্তা করিস না।
কি হয় একটা রাত থেকে গেলে।
খালি বাসা ফেলে এসেছি। না গেলে হবে না।
খালি বাসা কেন? মামী কোথায়?
আর বলিস না। খামাখা ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। কয়েকবার আনতে গেছি আসে না। ঝগড়া করে জীবনটা শেষ করল। বড়ই আফসোস। ঝগড়া দিয়ে জীবন শুরু করলে— ঝগড়া দিয়ে শেষ করতে হয়। এটাই নিয়তি।
মামা সিঁড়ি দিয়ে নামছেন আমি তাকিয়ে আছি। আমার খুব খারাপ লাগছে। বিচিত্র একটা মানুষ, সবার সমস্যাই তাঁর সমস্যা। কিন্তু কেউ জানতে চায় না–এই মানুষটার নিজস্ব কোন সমস্যা কি আছে।
নোমানের কাছে লেখা চিঠিটা পারলাম। মামা লিখেছেন–
বাবা নোমান,
দোয়াপর সমাচার এই যে, ঢাকায় কার্যোপলক্ষে আসিয়াছিলাম। তোমার সাহিত সাক্ষাত হয় নাই। বড় খুকীর নিকট সমস্ত বিস্তারিত জানিয়া সুখী হইয়াছি। এক্ষণে আমার একটি আবদার। বড় খুকীকে নিয়া এক দুই দিনের জন্য হইলেও নেত্রকোনা যাইবা। বড় খুকীর মাতা তাহার কন্যার জন্য বড়ই ব্যস্ত হইয়াছে। তাহাছাড়া ছোট খুকীরও বিবাহের কথাবার্তা হইতেছে। এমতাবস্থায় দুই বোন কিছু দিন একত্ৰ থাকিলে বড় ভাল হয়। বিবাহ সম্পন্ন হইলে কে কোথায় যাইবে কেহই বলিতে পারে না। হয়ত দীর্ঘদিন আর দুই বোনের সাক্ষাত হইবে না। কাজেই বাবা এই বৃদ্ধের প্রস্তাব একটু বিবেচনা করিবে।
আমি দেখলাম বড়মামা চিঠিতে নাম সই করতে ভুলে গেছেন। তাঁর শরীরটা তাহলে সত্যি সত্যি খারাপ করেছে। এত বড় ভুল মামা কখনোই করবেন না। পরিষ্কার করে নাম লিখবেন। তারিখ দেবেন, ঠিকানা দেবেন। নাম তারিখ এবং ঠিকানা ছাড়া চিঠি আমিও লিখেছি। দুটা চিঠি। দুটাই স্যারকে লেখা। প্রথমটা যখন লিখি তখন থর থর আমার হাত পা কাঁপছে। কি লিখছি নিজেই জানি না। কাউকে চিঠি লিখতে হলে গুছিয়ে লিখতে হয় সুন্দর করে লিখতে হয়। এসব কিছুই আমার মাথায় নেই। তাঁকে চিঠি লিখছি। এই আনন্দেই আমার তখন শরীর কাঁপছে। প্রথম চিঠিতে তাঁকে কি লিখেছিলাম। আমার কিছুই মনে নেই। আমার স্মৃতিশক্তি ভাল। সবকিছুই আমার মনে থাকে। কিন্তু ঐ চিঠিটির কথা কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে রোলটানা কাগজে চিঠিটা লেখা। যে বল পয়েন্টে লিখছিলাম। সেই বল পয়েন্টটা ঠিকমত কালি ছাড়ছিল না। অনেকগুলো অক্ষর ছিল অস্পষ্ট। চিঠি শেষ করে আমি দুহাতে মুখ ঢেকে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। আমি পোষ্ট আপিস থেকে নিজেই খাম। কিনলাম। খাম কেনার সময় মনে হল যিনি খাম দিচ্ছেন তিনি সব বুঝে ফেলেছেন। তিনি জেনে গেছেন–এই চিঠি আমি কাকে দিচ্ছি। কি আছে চিঠিতে।
ইকনমিক্সের একটা বাইয়ের ভেতর খামটা লুকিয়ে আমি যাচ্ছি। চিঠি পোস্ট করতে পথে বাবার সঙ্গে দেখা। বাবা বললেন, কই যাচ্ছিস রে? আমার শরীর কেঁপে উঠল। আর মনে হল বাবা বুঝে ফেলেছেন আমি কোথায় যাচ্ছি। তিনি জানেন আমার এই বইটার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা খাম আছে।
কি রে কথা বলছিস না কেন? কি হয়েছে তোর?
বন্ধুর বাসায় যাচ্ছি।
এখন কলেজ আছে না? কলেজ বাদ দিয়ে বন্ধুর বাসায় কি?
ওখান থেকে কলেজে যাব।
আচ্ছা যা। তোর কি শরীর খারাপ?
না। বাবা শরীর ভাল।
আচ্ছা আচ্ছা।
চিঠি পোস্ট করে আমি কলেজে গেলাম। থার্ড পিরিয়ডে স্যারের ক্লাস। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। স্যার ক্লাসে ঢুকলেন সব মেয়েরা উঠে দাঁড়াল। আমি দাঁড়াতে পারলাম না। মনে হচ্ছে আমার হাত-পা পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে।
স্যার রোল কল করছেন। মেয়েরা নানান রকম ফাজলামি করছে। ইয়েস স্যার না বলে সবাই বলছে হাজির হুজুর। একজন বললো— বান্দা হাজির হুজুর। হাসির হল্লা শুরু হল। স্যার রোল কল বন্ধ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। মনে হল কিছু বলবেন। বললেন না। রোল কল করে যেতে লাগলেন। আমার রোল তিপান্ন। যখন তিনি ডাকলেন রোল ফিফটি খ্ৰী। আমি চুপ করে রইলাম। কোন শব্দ করলাম না। স্যার আবার ডাকলেন রোল ফিফটি থ্রী। আমি চুপ করে রইলাম। স্যার কৌতূহলী হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথা নিচু করে আছি। আমার ধারণা হয়েছে স্যার আমার চোখের দিকে তাকালেই সব জেনে যাবেন। তখন আমি কি করব। এ লজ্জা আমি কোথায় রাখব?
স্যার সেদিন পড়ালেন সমাট বাবরের সিংহাসনের আরোহণ পর্ব। ক্লাসের হৈচৈ একসময় থেমে গেল। তিনি ভারী এবং খানিকটা কাঁপা গলায় গল্প বলার ভঙ্গিতে কথা বলছেন। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে হাত নাড়ছেন—
বাবরের মার নাম হযরত খানম।
দেখেছ কি অদ্ভুত নাম। এই নাম মনে রাখা সহজ না? খুব সহজ। আবার শোন বাবরের মা হযরত খানম। ৯১০ হিজরীর কথা। রবিউস-সানি। রবিউস সানি কি আগে একবার বলেছি। আজ আর বলব না।
এই সময় কি হল? হযরত খানম জ্বরে পড়লেন। মাত্র ছয় দিনের জ্বরে তিনি মারা গেলেন। বাবরের বয়স তখন কত? কে বলতে পারে কত? নবনী তুমি বলতে পোর।
আমার শরীর কেঁপে উঠল। স্যার কি সুন্দর করে ডাকলেন নবনী। আর কেউ কি কোনদিন এত সুন্দর করে আমার নাম ডাকবে?
নবনী তুমি জান তখন বাবরের বয়স কত?
আমি চুপ করে আছি। আমার পেছন থেকে বেনু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার নবনী জানে কিন্তু বলবে না।
ক্লাসের সবাই হাসছে। স্যার সবার হাসি অগ্রাহ্য করে পড়াতে শুরু করলেন–হযরত খানমের মৃত্যুর চার দিনের দিন আরেকটি ঘটনা ঘটল…
ঘটনা সামান্য হলেও মুঘল সাম্রাজ্যে তার ফল ছিল সুদূর প্রসারী। আজ সেই সামান্য ঘটনা এবং তার পরবর্তী ঘটনা প্ৰবাহ তোমাদের বলব…। ইতিহাস থেকে আমাদের অনেক কিছু শিখতে হবে। আপাতত তুচ্ছ ব্যাপার যে এক সময় সাম্রাজ্য পরিবর্তনের মত বড় ব্যাপারে রূপান্তরিত হতে পারে। এই শিক্ষা বার বার ইতিহাস আমাদের দেয়। প্ৰথম চিঠিটি পাঠাবার এক সপ্তাহ পর আমি দ্বিতীয় চিঠিটি পাঠালাম। কোন চিঠিতে নাম ঠিকানা ছিল না। তবু স্যার ব্যাপারটা বুঝে ফেললেন। একদিন কলেজে রওয়ানা হচ্ছি। ওনার সঙ্গে দেখা। ওনি বললেন, নবনী শোন। তোমার তো পরীক্ষা এসে গেলো। এখন মন দিয়ে পড়াশুনা করা উচিত তাই না?
জ্বি।
তোমার হাতের লেখা সুন্দর। তবে হাতের লেখা সুন্দর হলেই তো হয় না–বানানের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। মুহূর্ত বানানে হ-য়ের নীচে আছে দীর্ঘ উকার।
আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললাম— আমাকে এসব কেন বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি সেদিন কলেজে গেলাম না। বাড়িতে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে সারাদিন কাঁদলাম। সন্ধ্যাবেলা ছাদে উঠে মনে হল— ছাদ থেকে যদি নিচে লাফিয়ে পড়তে পারতাম তাহলে কি সুন্দর হত। কেন মানুষ শুধু শুধু পৃথিবীতে বেঁচে থাকে?…