এরই মধ্যে একদিন গিয়ে আমি অত্যন্ত সসঙ্কোচে আমার থিসিসের কথাটা তুললাম। স্যার জানতে চাইলেন, এর মধ্যে লেখাপড়া কদ্দূর করছেন? আমি কিছু বইয়ের নাম করলাম, যেমন বি. বি. মিশ্রের ইন্ডিয়ান মিডল ক্লাসেস, উইলিয়াম হান্টারের অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল এজাতীয় আরও কিছু বই। রাজ্জাক স্যার জিগ্গেস করলেন, পড়ার সময় দরকারি অংশ টুইক্যা রাখার অভ্যাসটা করছেন কি না?
আমি চুপ করে রইলাম। তার অর্থ এই যে আমি কোনো নোট রাখিনি।
স্যার মন্তব্য করলেন, তাইলে ত কোনো কামে আইব না। ক্ষেত চাষবার সময় জমির আইল বাইন্ধ্যা রাখতে অয়।
তারপর রাজ্জাক স্যার শেলফের লেনিন রচনাবলীর ভেতর থেকে একটা বই টেনে বের করলেন। গায়ের চাদর দিয়ে মলাট মুছে নিয়ে বললেন, আপনেরা তো অখন বিপ্লব টিপ্লব অনেক কথা কইবার লাগছেন। দেখি লেনিন সাহেবের এই বইটা আগাগোড়া পইড়া সারসংক্ষেপ কইর্যা দেখান।
সেদিন আর বিশেষ কথাবার্তা হলো না। স্যারের কোনো একজন আত্মীয়ের অসুখ, হাসপাতালে যাওয়ার তাড়া ছিলো। আমি লেনিনের ইকোনমিক হিস্টরি অব রাশিয়া বইটি নিয়ে হোস্টেলে ফিরে এলাম। পুরো বই আদ্যোপান্ত পাঠ করে প্রাতিটা অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ করতে আমার জান কাবার হওয়ার দশা। ইংরেজি ভাষাতে সে সময়ে আমার দখল ছিলো যৎসামান্য। তা ছাড়া অর্থনৈতিক পরিভাষাগুলোর অর্থ কোনোরকমে বুঝতে পারলেও আমি নিজে সেগুলো ব্যবহার করার পারঙ্গমতা অর্জন করতে পারিনি। তথাপি লেনিনের রাশিয়ার অর্থনীতির ইতিহাসের বিশ্লেষণগুলো পাঠ করে আমি ভীষণ উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিলাম এবং লেনিনের অন্তর্দৃষ্টি আমাকে বিস্ময়াবিষ্ট করে তুলেছিল। একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। লেনিন সাহেব দেখিয়েছেন বৃহৎ জোতের জমি চাষের প্রচলন শুরু হওয়ার পরে উন্নত জাতের ঘোড়া জমি চাষার কাজে ব্যবহার হওয়ার কারণে উৎকৃষ্ট অশ্ব-প্রজননের ধুম পড়ে যায়। ভালো জাতের ঘোড়ার প্রজননবৃদ্ধির জন্য ঘোড়ার বৈদ্য একটি অর্থনৈতিক শ্ৰেণী সৃষ্টি হয়েছে, সেই জিনিসটিও উল্লেখ করতে ভুল করেননি।
রাশিয়ার অর্থনৈতিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে রাশিয়াতে কেনো সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করা প্রয়োজন, তার পক্ষে যে নৈতিক যুক্তিগুলো দাড় করিয়েছিলেন লেনিন, সেটাকেই গ্রন্থটির আকর্ষণীয় অংশ বলে আমার মনে হয়েছিল। লেনিনের মূল বক্তব্য ছিল এরকম : যান্ত্রিক প্রযুক্তি সম্প্রসারিত হচ্ছে, রাশিয়া তার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারবে না। রাশিয়ার উৎপাদন-ব্যবস্থার মধ্যেও একটি পরিবর্তন আসন্ন হয়ে উঠেছে। রাশিয়া মান্ধাতার আমলের অর্থনীতি ইচ্ছা করলেও টিকিয়ে রাখতে পারবে না। ইতিহাসে পেছনে ফেরা নেই, যেতে হবে সম্মুখের দিকে। কিন্তু রাশিয়ান সমাজের পরিবর্তনের সূচনাটা কে করবে? পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে বুর্জোয়া শ্রেণী নেতৃত্ব দিয়ে সমাজের খোল নলচে দুইই বদলে ফেলেছে। কিন্তু রাশিয়াতে পশ্চিমের মতো কোনো সুগঠিত বুর্জোয়া জন্মায়নি। সামন্তবাদ রাশিয়ান সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সামন্ত শাসকদের দৃষ্টি ঐতিহাসিকভাবে পশ্চাৎমুখী। আধুনিক কৃৎকৌশল প্রয়োগ করে সমাজের উৎপাদনব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন আনার ক্ষমতা তাদের নেই। আর পরিবর্তনসাধনের কাজটা যদি তাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়, তারা রাশিয়ার শিল্প কৃষি সর্বত্র পশ্চিম ইউরোপের বুর্জোয়াদের ডেকে আনবে। পশ্চিমা বুর্জোয়ারা তাদের শোষণের নাগপাশ বিস্তার করে ভারত কিংবা এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলোর মতো রাশিয়াকেও তাদের উপনিবেশে পরিণত করবে। রাশিয়ার সামান্তরা নিজেদের স্থায়িত্বের জন্য আপনা থেকেই পশ্চিমা বুর্জোয়াদের আগ বাড়িয়ে ডেকে আনবে। এই ধরনের একটা অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে লেনিনের যুক্তি হল, রাশিয়াতে পশ্চিমের তুলনায় খুব অল্পই শিল্পায়ন হয়েছে। শিল্প-শ্রমিকের সংখ্যাও পশ্চিমের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। তার পরেও লেনিন মনে করেন, শ্রমিকশ্রেণীর হাতেই রাশিয়ার ভবিষ্যৎকে সোপর্দ করতে হবে। যেহেতু শ্রমিকরা যন্ত্রপাতি কলকবজা ব্যবহারের অধিক জ্ঞান রাখে, রাশিয়ার ভাবী শিল্পায়নের দায়িত্বও শ্রমিকশ্রেণীর ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
মার্কসের হিসাবমতো গ্রেট ব্রিটেন কিংবা শিল্পসমৃদ্ধ জার্মানিতেই বিপ্লব হওয়ার কথা। মার্কসীয় থিসিস অনুসারে রাশিয়াতে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লব কিছুতেই সম্ভব নয়। লেনিন মার্কসীয় চিন্তা-পদ্ধতিতে একটু অদলবদল ঘটিয়ে রাশিয়াতে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে একটা বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্যই রাশিয়ার অর্থনৈতিক ইতিহাসটি লিখেছিলেন।
এই বৃহৎ কলেবারের গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ের সারসংক্ষেপ করতে গিয়ে প্রায় পনেরো দিন দৈনিক ছয় সাত ঘণ্টা করে আমাকে খাটতে হয়েছে। কঠোর পরিশ্রম করে কাজটা শেষ করার পর যখন এক সকালবেলা স্যারকে দেখাতে নিয়ে গেলাম, তিনি বললেন, ওইখানে পিছনের টেবিলে রাইখ্যা যান, সময় অইলে দেখুমনে। তার পরে যেমন বই পড়ছিলেন, পড়তে থাকলেন। আমি একটু দামে গেলাম। এত কষ্ট করে কাজটা করলাম, আমার ধারণা ছিল তিনি দেখামাত্রই কাগজের শিটগুলো আমার হাত থেকে তুলে নিয়ে বলবেন, হায় হায় করছেন কী, এক্কেরে বেবাক বইটা সারসংক্ষেপ কইর্যা ফেলাইছেন! সেদিন তিনি এক কাপ চাও খেতে বলেননি। অগত্যা আমাকে মনোবেদনা চেপে গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে হলো।
কিছুদিন ফাঁক দিয়ে আমি আবার স্যারের কাছে গেলাম। তিনি নাস্তা খাওয়ার পর কাগজ পড়ছিলেন। সেই চিরাচরিত হাসিটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। বুঝলাম স্যারের মেজাজ বেশ ফুরফুরে। চোখ থেকে চশমা নামিয়ে বললেন, মৌলবি আহমদ ছফা, লেনিনরে নিয়া বেশ মেহন্নত করছেন দেখলাম। ইংরেজি না লেইখ্যা বাংলাতে লিখলে পারতেন।
যাক বাঁচা গেল, তিনি আমার সিরিয়াসনেসটা অনুধাবন করতে পেরেছেন, এটাই আমার বড় সান্ত্বনা!
একথা সেকথার পর সমাজতন্ত্রের ভালোমন্দ নিয়ে কথা উঠলো। আমি সরাসরিই একটা প্রশ্ন করে বসলাম। স্যার, সমাজতন্ত্রের কোন জিনিসটা আপুনার ভালো লাগে?
তিনি বললেন, কেমনে কই কোন জিনিস ভাল লাগে। তবে আমার একটা অভিজ্ঞতার কথা কইবার পারি। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পরে একজন রাশিয়ান আইছিল ঢাকায়। তখন ত অন্যরকম সময়। একজন রাশিয়ান ভদ্রলোকের লগে মাখামাখি করলে ইন্টিলিজেন্সের কাছে জবাবদিহি করতে আয়, এই ভয়ে অর কাছে কেউ ঘোষবার চাইত না। অখন নামটা মনে করবার পারছি না। একসময় ভদ্ৰলোকের সঙ্গে আমার বেশ খাতির অইয়া গেল। একসময় তিনি আমাগো লগে থাকতে অইলেন। হেই সময় আমি শান্তিনগর থাকতাম। একদিন দুপুরবেলা ইউনিভার্সিটি থেইক্ক্যা যখন বাড়িতে ফিরবার লাইছি। সেই ভদ্রলোক আমার লগে আছিল। তখন দুপুরবেলা। খুব গরম। রিকশার বদলির সময়। সহজে রিকশা পাওন যায় না। যেই চড়বার লাইছি, সেই ভদ্রলোক আমার হাত ধইর্যা টাইন্যা নিয়া কইল, এইটাতে চড়ন। যাইত না, দেখছেন না কেমন হাড়জিরজিইর্যা মানুষ! আমি যত রিকশা ঠিক করি, একটা একটা অছিলা বাইর কইরা বিদায় কইর্যা দেয়। হেইদিন বেবাক পথটা হাইট্যা বাড়িত ফিরতে অইছিল। মেহন্নতি মানুষের ওপর এই যে জাগ্রত সহানুভূতি আমার মনে অইছে এইডাই সমাজতন্ত্রের সবচাইতে বড় কস্ট্রিবিউশন।
রুশ বিপ্লবের অন্যতম নায়ক ট্রটস্কির প্রতি আমি ভীষণ অনুরক্ত ছিলাম। এই দেশে ট্রটস্কি ভীষণ ঘৃণিত মানুষ। আমার ইচ্ছা হল ট্রটস্কির প্রতি স্যারের মনোভাবটা জেনে নিই। তাই জিগ্গেস করলাম, ট্রটস্কি সম্পর্কে কিছু বলেন।
তিনি স্মিত হেসে বললেন, আমি বিলাত থেইক্কা ফিইর্যা ট্রটস্কির ‘থিয়োরি অব পার্মানেন্ট রেভ্যুল্যুশনে’র বাংলা তরজমা করছিলাম। তারপর চুরুটা ধরিয়ে একটুখানি লাজুক ভঙ্গিতে বললেন, বিলাত থেইক্কা আইস্যা আরও একটা তরজমার কাজ আমি করছিলাম।
আমি আগ্রহসহকারে বললাম, কী কাজ স্যার?। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলার ব্ৰত’ কইর্যা একটা ছোট বই আছে না, হেইডার ইংরেজি অনুবাদ।
রাজ্জাক স্যারের অনুবাদকর্মের কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। অধীর আগ্রহে জিগ্রগেস করলাম, পাণ্ডুলিপিগুলো কোথায়?
তিনি ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে ডান হাত দিয়ে এমন একটা ভঙ্গি করলেন, দেখে আমার রবীন্দ্রনাথের একটি গানের দুটি পঙক্তি মনে পড়ে গেল। পথিক পরান চলরে ওরে তুই/ যে পথ দিয়ে গেছে চলে বিকেলবেলার জুঁই।
এখানে আমি কিছু নিজের কথা বলবো। পরবর্তীকালে রাজ্জাক সাহেব সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, সাহিত্য, নন্দনতত্ত্ববিষয়ক যেসব কথাবার্তা বলেছেন আমার কাছে, আমি মনেমনে সেগুলোকে অবন ঠাকুরের ‘বাংলার ব্ৰত’ এবং ট্রটস্কির ‘থিয়োরি অব পার্মানেন্ট রেভ্যুল্যুশন’-এর মধ্যিখানে রেখে একটা গড় করে গ্রহণ করেছি। রাজ্জাক সাহেব সারাজীবনে কিছু লেখেননি কেনো, এই নালিশ আমি সকলের কাছে অহরহ শুনে আসছি। রাজ্জাক সাহেব উল্লেখ করার মতো কিছু লেখেননি কেনো, সে কৈফিয়ত একমাত্র তিনিই দিতে পারেন। তার হয়ে কিছু বলা আমার উচিত হবে না। তথাপি আমি আমার যে ধারণা জন্মেছে, সেটা বলতে পারি। যৌবনে যে মানুষ ট্রটস্কির থিয়োরি অব পার্মানেন্ট রেভ্যুলুশনের বাংলা এবং অবন ঠাকুরের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন, সেই মানুষের পক্ষে অন্য কোনো মামুলি বিষয়ে কাজ করা অসম্ভব ছিলো, তার মানসিক সূক্ষ্মতার এমন একটা সমুন্নত উত্তরণ ঘটেছিল, সেখান থেকে তৎকালীন বিদ্যাচর্চার স্তরটিতে নেমে আসা সত্যি সত্যি দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। জ্ঞানচর্চার সামাজিক প্রেক্ষিতটির কথা অবশ্যই ধর্তব্যের মধ্যে আনতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয়ে থাকে। কেনো এ তুলনাটা করা হয় তার হেতু অদ্যাবধি আমি আবিষ্কার করতে পারিনি। ঘর, বাড়ি, দালান, অট্টালিকা এসকল ভৌত কাঠামোগত কারণে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অক্সফোর্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়, আমার বলার কিছু থাকে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে কেউ-কেউ ছিলেন, যাঁরা জ্ঞানচর্চার নানা ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা ছিলেন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোডাক্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেসকল ছাত্র পাশ করেছেন, তাঁরা জ্ঞানচর্চায় কোন ক্ষেত্রটিতে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, সেই জিনিসটি নতুন করে যাচিয়ে দেখা প্রয়োজন। উনিশশো একুশ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে। উনিশশো একুশ থেকে সাতচল্লিশ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও আইসিএস পাশ করেনি। একথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলবার উপায় নেই।
ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের তিনটি প্রধান অবদানের একটি হল পাকিস্তান আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ভিতটি তৈরি করা। দ্বিতীয় অবদান বাংলা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদান এবং তৃতীয় অবদান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংকল্প ও কর্মপন্থার দিকনির্দেশনা। এই জনগোষ্ঠীর জীবনে ওই তিনটিই অত্যন্ত তাৎপৰ্যপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু জ্ঞানচর্চার যে আরও একটা বৈশ্বিক মানদণ্ড রয়েছে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বিশেষ কিছু নেই। বিশেষত পাকিস্তান সৃষ্টির পরে জ্ঞানচর্চার উত্তাপ আরও অবসিত হয়েছিলো। পাকিস্তান-সৃষ্টির পরে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো নিবেদিতপ্রাণ মানুষও নতুন কোনো গবেষণাকর্মে আত্মনিয়োগ করেননি। তিনি বিয়ে পড়ানো এবং মিলাদ শরিফ করে সময় কাটাতেন। জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যক্তির সাধনায় বিকশিত হয়, কিন্তু সমাজের মধ্যে জ্ঞানের প্রয়োজন অনুভূত হওয়া চাই। বৃহত্তর অর্থে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনাও বৃহত্তর সমাজপ্রক্রিয়ার একটি অংশ। অনেক সময় উৎকৃষ্ট বীজও পাথরে পড়ে নষ্ট হয়। আমার ধারণা রাজ্জাক সাহেবের ক্ষেত্রেও সেটি ঘটেছিলো। হ্যাঁ, রাজ্জাক সাহেবের যদি চাকুরিবাকুরির ক্ষেত্রে উন্নতি করার আকাঙ্খা থাকত অবশ্যই তাঁকে লিখতে হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা বিষয়ে যে গবেষণা হয়েছে তার বেশিরভাগই চাকুরির প্রমোশনের উদ্দেশ্যে লেখা। রাজ্জাক সাহেবের যদি সে বালাই থাকত লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকসের হ্যারন্ড লাস্কির মৃত্যুর পর তাঁর লেখা থিসিসটা বগলে নিয়ে বিনা ডিগ্রিতে লন্ডন থেকে ফিরে আসতেন না। গোঁড়া ইংরেজ সুপারভাইজারের নির্দেশ মোতাবেক যেন-তেন প্রকারের একটি থিসিস লিখে ডিগ্রিটা অর্জন করতেন। রাজ্জাক সাহেব যদি সংসারধর্ম পালন করতেন, তা হলেও হয়তো জাগতিক উন্নতির প্রয়োজনে তাঁকে কিছু লেখালেখি করতে হতো।
অনেকে, তার মধ্যে রাজ্জাক সাহেবের প্রিয়তম ছাত্রও রয়েছেন, মনে করেন রাজ্জাক সাহেব একজন গোড়া মুসলিম লীগ সমর্থক। কিন্তু আমার মূল্যায়ন একটু ভিন্ন রকমের। তাঁর অবস্থান কিছু অংশে মুসলিম লীগ পাটাতনে ছিল একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি যদি মুসলিম লীগ না করতেন, তাকে অবশ্যই কমিউনিস্টদের সঙ্গে যেতে হতো। কিন্তু সেখানেও একটা বড় অসুবিধা ছিলো। কৃষিপ্রশ্নে লেনিন এবং কাউটিস্কির মধ্যে যে বিতর্ক হয়েছিলো তাতে রাজ্জাক সাহেবের সায় ছিল কাউটিস্কির অনুকূলে। লেনিন, রেনিগেড কাউটিস্কি শিরোনামে একটি পুস্তিকা লিখে কাউটিস্কিকে কষে গালাগাল দিয়েছিলেন। এখন অনেকেই মনে করছেন কৃষিপ্রশ্নে লেনিন-কাউটস্কি যে বিতর্ক হয়েছিলো, তাতে কাউটিস্কির অবস্থানটিই সঠিক ছিল। রাজ্জাক সাহেবকে এভাবে বোধ করি বিচার করা যায়, এ ট্রটস্কিয়াইট এ্যামাং দ্যা মুসলিম লীগারস।
আমি রাজ্জাক সাহেবের হয়ে কৈফিয়ত দেয়ার কেউ নই। তথাপি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা বিরাট অংশের কাছ থেকে শুনে আসছি, আসলে অকারণে একটা রাজ্জাক মিথ খাড়া করা হয়েছে। রাজ্জাক সাহেবের ভেতরে সারপদার্থ অধিক নেই। যদি কিছু বলার থাকত অবশ্যই তিনি লিখে প্রকাশ করতেন। রাজ্জাক সাহেব কেনো লেখেননি সে জবাব দেয়ার আমি কেউ নই। তার পরেও একটা কারণে রাজ্জাক সাহেবকে আমি ধন্যবাদ না দিয়ে পারি না, তিনি এই মহাজনদের পন্থা অনুসরণ করে তাঁদের স্তরে নেমে আসেননি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে আরও একটা ধারণা চালু আছে। সেটা হলো এই, রাজ্জাক সাহেব আগাগোড়া কোনো বই পড়েন না। তাঁর ভক্তদের চমক লাগাবার জন্য বইয়ের ফ্ল্যাপ এবং গ্রন্থপরিচিতি মাত্র পাঠ করে সকলের সামনে তিনি যে কত বড় মহাজ্ঞানী সেটা প্রমাণ করে থাকেন। এই অভিযোগটির জবাব দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যারা অভিযোগ উচ্চারণ করেন, তাদের অপকৃষ্ট রুচি দেখে ব্যথিত অনুভব করি মাত্র। আমি রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করে কোনোদিন বাক্যালাপ করিনি। তিনি কথা বলেছেন আমি শুনেছি। তিনি যে স্পিরিটে কথা বলেছেন, আমি সেভাবে গ্রহণ করতে পেরেছি এমন দাবিও করতে পারবো না। যা শুনেছি, তার সবটাও স্মৃতিতে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
আমার এ রচনায় রাজ্জাক সাহেবের পাণ্ডিত্য এবং মননশীলতার কতিপয় প্রান্ত আমি তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। আমার মতো একজন সামান্য মানুষের পক্ষে রাজ্জাক সাহেবের অগাধ পাণ্ডিত্য পরিমাপ করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তার সমালোচকদের অভিযোগের জবাব প্রত্যাশা করাও সমীচীন হবে না। আমি তাঁকে নানা সময়ে যেভাবে অনুভব করেছি, সেই অনুভবটুকু সকলের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র।
আমার সন-তারিখের ঠিক থাকে না। আর ডায়েরি লেখার অভ্যাসও আমার নেই। স্মৃতির গভীর থেকে এই বিষয়গুলো টেনে টেনে বার করছি। কোনটা আগে কোনটা পরে পারম্পর্য রক্ষা হচ্ছে না। আমি একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলাম। আমরা তৎকালীন সরকারবিরোধী একটা প্যানেল দিয়েছিলাম। একজন ছাড়া অন্য প্রার্থীদের নাম মনে পড়ছে না। তিনি মীর্জা গোলাম হাফিজ। নামকরা উকিল এবং বিএনপি সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী। রাজ্জাক সাহেবকে আমি আমাকে ভোট দিতে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন, আপনে আবার ওইগুলার মধ্যে গেছেন ক্যান?
আমি বললাম, স্যার, সকলে ধরে বসলেন, আমি না করতে পারলাম না। স্যার হুঁকা টানতে টানতে বললেন, ঠিক আছে আপনে যখন এক্কেরে খাড়াইয়া গেছেন, একটা ভোট আপনেরে দিমুনি।
স্যার সত্যি সত্যি আমাকে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ওই নির্বাচনে আমি হেরেছিলাম। একজন ছাড়া আমাদের প্যানেলের কেউ জিততে পারে নি। তিনি মীর্জা গোলাম হাফিজ। হাফিজ সাহেব তলায়-তলায় আমাদের বিরোধী প্যানেলের সঙ্গেও একটা বোঝাপড়া করে ফেলেছিলেন। এই এক মজার লোক! যে কথা তিনি শুনতে চান না, কেউ যদি বলেন, তিনি হাত-পা নেড়ে জানিয়ে দেন, তুমি কী বলছো আমি শুনতে পাচ্ছি না। কারণ আমি কানে কম শুনি। যে কথা তিনি পছন্দ করেন, ঠিকই শুনে ফেলেন। একবৰ্ণও বাদ পড়ে না। নির্বাচনে আমার অবস্থাটা হয়েছিলো সবচাইতে করুণ। আমাদের এজেন্ট ড. আহমেদ কামাল জানিয়েছিলেন, আমার নিজের ভোটটাও বাতিল হয়ে গিয়েছিলো। কোথায় টিকচিহ্ন দিতে কোথায় দিয়ে ফেলেছি!
নির্বাচনে হেরে একটু একটু জ্বালা করছিলো। তার পরের দিন স্যারের বাড়িতে গেলাম। তিনি বোধহয় আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিলেন। সেজন্য লম্বা-চওড়া এক গল্প ফেঁদে বসলেন। পাকিস্তান হওয়ার আগে সিনেট নির্বাচনে কিভাবে হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো সেকথা জানালেন। নওয়াববাড়ির খাজা শাহাবুদ্দিন নির্বাচনের ফন্দিাফিকির খুব ভালো করে বুঝতেন। সেই সময়ে মুসলিম রেজিস্ট্রার্ডড গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ছিলো হিন্দুদের তুলনায় খুবই সামান্য। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভোটারদের কাছে হাজির হয়ে ব্যালটপেপার সই করিয়ে নিয়ে আসতো। রাজ্জাক স্যার জানালেন, তিনি একবার অনেকদূর পায়ে হেঁটে কুমিল্লা জেলার নবীনগর থানায় গিয়েছিলেন। নবীনগরে একজন সাব রেজিস্ট্রার থাকতেন। তার কাছ থেকে ব্যালটপেপারটা হাতে-হাতে নিয়ে আসার জন্য স্যারকে পায়ে হেঁটে অতোদূর যেতে হয়েছিলো।
দিল্লি থেকে প্রকাশিত ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অভ ইন্ডিয়া পত্রিকাটি সেই সময়ে খুব সম্ভাবতো প্রখ্যাত শিখ লেখক খুশবন্ত সিং সম্পাদনা করতেন। ওই পত্রিকাটির একটি সংখ্যায় রাজ্জাক স্যারের ওপর প্রধান রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমানে মার্কিনপ্রবাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষিক ড. রওনক জাহানের ওপর অপর একটি রচনা ইলাস্ট্রেটেড উইকলিতে প্ৰকাশিত হয়েছিলো। পাশাপাশি রাজ্জাক স্যার এবং ড. রওনক জাহানের ছবি প্রকাশিত হয়েছিলো।
রাজ্জাক স্যারের ওপর লিখিত রচনাটিতে তার সম্পর্কে যেসকল কথা লিখিত হয়েছিলো, তার সবকিছু অক্ষরে—অক্ষরে আমি মনে করতে পারবো না। ইলাস্ট্রেটেড উইকলির প্রতিবেদন তাঁকে গ্রীক দার্শনিকের ডায়োজিনিসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন এটা নতুন কথা নয়। এখানে অনেকেই তাকে ডায়োজিনিস বলে ডাকতেন। ওই পত্রিকায় তাকে ছয় দফার মূল প্রণেতা বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো। ড. রওনক জাহান ‘পাকিস্তান : ফেলিউর অভ ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন’ গ্রন্থটিতে দু’অঞ্চলের বৈষম্যের তুলনা করে দেখিয়েছিলেন পাকিস্তানের অখণ্ডতা স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
তার কিছুদিন পরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় রাজ্জাক স্যারকে ডিলিট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। এই ডিলিট ডিগ্রিপ্রাপ্তির ঘটনাটিকে উপলক্ষ করে আমি স্যারকে একটা সিল্কের পাঞ্জাবি, পাজামা, একটি ভালো ফাউন্টেন পেন এবং খুব দামি কিছু লেখার কাগজ উপহার দিয়েছিলাম। আমি অনুরোধ করেছিলাম, স্যার যেনো আমার উপহার দেয়া কলম এবং কাগজে তার আত্মজীবনীটা লেখা শুরু করেন।
আত্মজীবনী লেখার কথা যখন উঠল স্যার হাসতে হাসতে একটা ঘটনার উল্লেখ করলেন, আমি একবার মিস্টার এ কে ফজলুল হকরে যাইয়া কইলাম, আমি আপনের জীবনীটা লেখবার চাই। আপনে যদি দয়া কইর্যা পারমিশনটা দেন, কাজ শুরু করবার পারি। হক সাহেব তখন ইস্ট পাকিস্তানের গভর্নর। আমার প্রস্তাব শুইন্যা খেকাইয়া উইঠ্যা কইলেন, আমার জীবনী লেখতে চাও, নিশ্চয়ই তোমার একটা মতলব আছে। আমি কইলাম, মতলব ত একটা অবশ্যই আছে। হক সাহেব কইলেন, আগে হেইডা কও। আমি কইলাম, আপনে যখন গাও গোরামে যান, মাইনষের লগে এমন ব্যবহার করেন, তারা মনে করে জনম ভইর্যা আপনে গাও গেরামে কাটাইয়া তাগো সুখদুঃখের অংশ লাইতাছেন। তারপরে গাও গেরাম থেইক্যা ঢাহা শহরে আইস্যা আহসান মঞ্জিলের ছাদে উইঠা নওয়াব হাবিবুল্লাহর লগে যখন ঘুড্ডি উড়ান, লোকজন দেইখ্যা আপনেরে নওয়াববাড়ির ফরজন্দ মনে করে। তারপরে আবার যখন কলিকাতায় যাইয়া শ্যামাপ্রসাদের লগে গলা মিলাইয়া শ্যামাপ্রসাদরে ভাই বইলা ডাক দেন কলিকাতার মানুষ চিন্তা করে আপনে শ্যামপ্রসাদের আরেকটা ভাই। বাংলার বাইরে লখনৌ কিংবা এলাহাবাদে গিয়া মুসলিম নাইট নবাবগো লগে যখন বয়েন, দেখলে মনে আইব আপনে তাগো একজন। এই এতগুলা ভূমিকায় আপনে এত সুন্দর সাকসেসফুল অভিনয় করতে পারেন, এইডা ত একটা মস্ত ক্ষমতা। এই ক্ষমতা স্যার অলিভার লরেন্সেরও নাই। এই অভিনয়ক্ষমতার একটা এনকোয়ারি আমি করবার চাই। আর নইলে আপনের আসল গুণাপনা কোথায় হেইডা ত আমাগো অজানা নাই। হক সাহেব হুঙ্কার ছাইড়া জিগাইতে লাগল, তুমি আমার সম্পর্কে কী জান? আমি কইলাম, আপনে সুন্দর সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য মিছা কথা কইবার পারেন। আমার জবাব শুইন্যা হক সাহেব হ হ কইর্যা হাইস্যা উঠলেন।
হক সাহেব সম্পর্কে কথাবার্তা আর বেশিদূর অগ্রসর হতে পারলো না। মিসেস হামিদা হোসেন এসে গেছেন। মিসেস হোসেন শেখ সাহেবের কেবিনেটের জাদরেল মন্ত্রী ব্যারিষ্টার কামাল হোসেনের বেগম এই ভদ্রমহিলা রাজ্জাক স্যারের বিশেষ স্নেহের পাত্রী। তিনি ছাত্রী থাকাকালীন বিলেতের অক্সফোর্ড না ক্যামব্রিজে এ কে ফজলুল হকের ওপর গবেষণা করছিলেন। ফজলুল হক সম্পর্কিত তথ্যাদি জানার জন্য ঢাকায় রাজ্জাক সাহেবের কাছে এসেছিলেন। রাজ্জাক সাহেবের বাড়িতেই হামিদার সঙ্গে ড. কামালের পরিচয়। পরিচয়ের পর প্ৰেম, তারপর বিয়ে।
রাজ্জাক সাহেবের পছন্দের মানুষ আছেন। তার মধ্যে ড. কামাল সাহেব বিশিষ্ট একজন। ড. কামাল হোসেন, বদরুদ্দীন উমর, ড. আনিসুজ্জামান, ড. রওনক জাহান, সরদার ফজলুল করিম, ড. সালাউদ্দিন আহমদ, ড. মোশাররফ হোসেন, ড. মমতাজুর রহমান তরফদার এঁরা তার পছন্দের মানুষ। এ ছাড়া নিশ্চয়ই অনেকে আছেন, কিন্তু আমি তাদের নাম জানি না। ড. আনিসুজ্জামানের প্রতি তার এক বিশেষ ধরনের স্নেহ রয়েছে। সরদার ফজলুল করিমকে তিনি প্রায় সময়ে স্মরণ করতেন। সমুদ্রের জোয়ারভাটার মতো তার সম্পর্কেরাও ওঠানামা আছে। একসময় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মরহুম সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে তাঁর উষ্ণ সম্পর্ক ছিলো। নানা সামাজিক রাজনৈতিক প্রশ্নে তাদের মধ্যে মতান্তর ঘটে যায়। তাঁর পছন্দ অপছন্দের বোধটি এত প্রবল যে মতান্তর ঘটলেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মনান্তর ঘটে যায়। কবি সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে সম্পর্কটা সেই উনিশশো নব্বই একানব্বই পর্যন্ত আমি বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ লক্ষ করেছি। আরেকজন মানুষকে তিনি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা করতেন। সেই ভদ্রলোকটি ছিলেন মরহুম ড. খোন্দকার মোকাররম হোসেন। খোন্দকার সাহেবের মৃত্যুর পরেও তাঁর পরিবারের দেখাশোনা করতে দেখেছি। মোকাররম সাহেবের ছেলের সঙ্গে নিজের ভ্রাতুষ্পুত্রী দীপ্তীর বিয়ে দিয়েছিলেন। কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর প্রাক্তন ডিরেকটর এবং জিয়া সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব আজিজুল হককে ভীষণ পছন্দ করতেন। আমার কাছে প্রায়ই বলতেন, তাঁর যোগ্যতা বিশ্বমানের।
রাজ্জাক স্যার একটা কথা প্রায়ই বলতেন। আমরা শিক্ষকেরা প্রতি বছরই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু প্রতিটা নতুন বছরে আমাদের কাছে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এসে হাজির হয়। এই তরুণদের চাহিদা, চাওয়া-পাওয়ার খবর আমাদের মতো লোলচর্মের বৃদ্ধদের জানার কথা নয়। এটাই হল শিক্ষক-জীবনের সবচাইতে বড় ট্র্যাজেডি। তার পরেও রাজ্জাক সাহেবের চরিত্রের মধ্যে এমন একটা আকর্ষণী শক্তি ছিলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান বিভাগের দীপ্তিমান ছাত্রদের তিনি চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতেন। কারও মধ্যে সামান্যতম গুণের প্রকাশ দেখলেও তিনি সাধ্যমতো সাহায্য করতে চেষ্টা করতেন। একবার আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারারের চাকুরির দরখাস্ত করেছিলাম। আমার ধারণা তিনি আমাকে স্নেহ করেন। কিন্তু আমার জন্য সুপারিশ না করে মাদ্রাসা থেকে আগত এক ভদ্ৰলোকের জন্য সুপারিশ করেছিলেন এবং তার চাকুরিটি হয়েছিলো। ভদ্রলোক আরব দার্শনিক আল মাওয়ারদির একটি লেখা আরবি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দেখিয়েছিলেন। রাজ্জাক স্যার প্রায়ই আফসোস করতেন, আরবি ফারসি এবং সংস্কৃত পালি জনা লোকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে দুর্লভ হয়ে উঠছে। এই ভাষাগুলোর অভাবে ওরিজিনাল সোর্স ব্যবহার করার ক্ষমতা কারও জন্মাবে না। সেকেন্ড হ্যান্ড সোর্স পর্যালোচনা করে যেসব গবেষণাকর্ম করা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে বিস্তর অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছে।
রাজ্জার স্যার ব্যক্তিগতভাবে অঙ্কের শিক্ষক রমজান আলী সরকারকে পছন্দ করতেন এমন মনে হয়নি। কিন্তু তিনি তার খুব প্রশংসা করতেন। সরদারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্র যিনি অক্সফোর্ডে র্যাংলার হতে পেরেছিলেন। রাজ্জাক স্যার মনে করতেন সরদার যদি তার সাধনার প্রতি যত্নবান হতেন, পৃথিবীর শ্ৰেষ্ঠ অঙ্কবিদদের একজন হতে পারতেন। সলিমুল্লাহ খানের বয়স আমার চাইতে অন্তত পনেরো বছর কম। সে রাজ্জাক সাহেবকে নির্জলা বকাঝকা করে আস্ত একটা বই লিখে ফেলেছিলো। বইটি পড়ে শুধু আমি নই, রাজ্জার স্যারের ঘনিষ্ঠদের অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সলিমুল্লাহ খান পুস্তক রচনা করে বসে থাকেনি। এক কপি নিজের হাতে লিখে বাড়িতে গিয়ে উপহার দিয়ে এসেছিলো। সাহস করে স্যারের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করিনি। একবার সলিমুল্লাহর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বৃত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলো। দু’জন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির সার্টিফিকেট খুবই প্রয়োজন। তার মধ্যে একজন প্রফেসর রাজ্জাক, অন্যজন ড. কামাল হোসেন। সলিমুল্লাহ আমাকে বারবার অনুরোধ করতে লাগলো আমি যেনো তাকে স্যারের কাছে নিয়ে যাই। স্যারকে তো তাকে প্রশংসাপত্র দিতে হবে। অধিকন্তু ড. কামালের প্রশংসাপত্ৰও সংগ্রহ করে দিতে হবে। আমি বারবার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সলিমুল্লাহ নাছোড়বান্দা। অগত্যা একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে স্যারকে গিয়ে বললাম, কাল সকালে আপনার ওখানে নাস্তা করতে যাবো। স্যার বললেন, ঠিক আছে আয়েন। একথা বলে স্যার দাবাখেলায় মন দিলেন। আমি আবার স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, স্যার সলিমুল্লাহ খানও আমার সঙ্গে আসার বায়না ধরেছে। স্যার বললেন, ঠিক আছে লইয়া আয়েন।
স্যার তখন একা থাকতেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা গুলশানের বাড়িতে চলে গেছেন। সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে যথারীতি কথাবার্তা বললেন। কোন বিষয়ের ওপর গবেষণা করতে চায়, ও নিয়েও আলাপ করলেন। চলে আসার সময় সলিমুল্লাহকে বললেন, ঠিক আছে দুইদিন বাদে আয়েন। কাইল আমি কামাল হোসেনের কাছে যামুনে। সেবার সলিমুল্লাহর ক্যামব্রিজ যাওয়া হয়নি। কিন্তু রাজ্জাক স্যার নিজে প্রশংসাপত্র লিখে দিয়েছিলেন এবং ড. কামাল হোসেনের কাছ থেকেও প্রশংসাপত্র সংগ্রহ করে এনে দিয়েছিলেন।
কিছুদিন পর আমি স্যারের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম, সলিমুল্লাহর বইটি তিনি পড়েছেন কি না। স্যার বললেন, হ্যাঁ পড়ছি। তাতে কী অইছে। ছেলেটার তা ট্যালেন্ট আছে। কী লিখছে না- লিখছে হেইডা মনে কইর্যা কী লাভ। হের ত কিছু করার ক্ষমতা আছে। হামিদাও আমারে একই কথা কইল। আমি যখন কামালরে কইলাম দুই লাইন লেইখ্যা দাও, হামিদা কয় হেই ছেলেটা না যে আপনের ওপর বই লেখছে? হেরে আমি ঘরে ঢুকবার দিমু না। আমি কইলাম, হেইডা কি একটা কথা অইল, একটা প্রমিসিং ছেলে, এমন কয়জন পাওন যায়, দাও দুই কলম লেইখ্যা। সলিমুল্লাহ খান যখন আমেরিকা গেলো, প্লেনভাড়ার টাকার এক অংশ রাজ্জাক স্যার দিয়েছিলেন। এখনও সলিমুল্লাহর খবরাখবর জানতে চান।
রাজ্জাক সাহেবকে একেবারে বৈষ্ণব মনে করাও ঠিক হবে না। কারও ওপর যদি তার মনে উঠে যায়, ফেরানো প্রায় একরকম অসম্ভব। আমি কোনো কারণে গত বিশ পঁচিশ বছর ধরে রাজ্জাক স্যারের স্নেহ পেয়ে আসছি, সেটা আমার নিজের কাছে একটা বিস্ময়ের ব্যাপার মনে হয়। আমি রাজ্জাক স্যারের কোনো কথা শুনিনি। তিনি যা বলেছেন, উলটো কাজ করেছি। পরিচিত হওয়ার কয়েকদিন পর থেকেই তার সামনে সিগারেট খেতে আরম্ভ করেছি। আমি সে সময়ে বাঁশি বাজাতে চেষ্টা করছিলাম। এমন কিছু বাজাতে শিখিনি, তবু শুধু তাকে নয়, তার পরিবারের প্রায় সবাইকে আমার সে বর্বর বাজনা শুনতে বাধ্য করেছি। আমি একসময়ে কাঠ কয়লা, আলকাতরা, বাটা হলুদ, ফুলের রঙ হাতের কাছে যা পাই, তা দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করেছিলাম। যেহেতু আমার অর্থসংকট যাচ্ছিলো, সেজন্য এক ছবি তিন-তিনবার কিনতে তাকে রাজি করিয়েছি। মহাকবি গ্যোতের ফাউস্ট যখন অনুবাদ করছিলাম, দিনে রাতে তাকে কত বিরক্ত করেছি। যখনই টাকার অভাব পড়েছে, হুকুম করেছি। অতো টাকা অমুক দিন আমার চাই। উনার হাতে টাকা আছে কি না সে খবর নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করিনি। সেই পেছনের দিনগুলোর কথা যখন ভাবি, আমি অবাক হয়ে যাই। রাজাক স্যার আমাকে এতটা প্রশ্ৰয় দিয়েছিলেন কেমন করে!
সে সময়ে আমেরিকান পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশে এসেছিলেন। এই ইহুদি বংশোদ্ভূত কুশাগ্ৰ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিটি ছিলেন বাংলাদেশের পয়লা নম্বরের শত্রু। তিনি নিকসন প্রশাসনকে প্রভাবিত করে মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাঙালি জনগণের বিপক্ষে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন এই কিসিঞ্জার সাহেবই। বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে চিহ্নিত করেছিলেন। তখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দেয়নি। তথাপি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করে কিসিঞ্জারকে বরণ করতে হচ্ছিলো। এই মার্কিন কুটনীতিবিশারদের নেক নজরে পড়ার জন্য মন্ত্রিসভা থেকে সোভিয়েটঘেঁষা সহকর্মীদের বাদ দিতে হল। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দীন আহমদও রেহাই পেলেন না।
কিসিঞ্জারের সম্মানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক সংবর্ধনাসভার আয়োজন করা হয়েছিলো। হোটেল শেরাটনের নাম ছিল তখন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল। নিমন্ত্রিত অতিথির তালিকায় রাজাক স্যারের নামও ছিল। এখন ঠিক মনে আসছে না। অনুষ্ঠানটি কখন ছিল, সকালবেলা না বিকেলবেলা। সেদিন স্যারের বাড়িতে আমি ছিলাম। ড. রওনক জাহানও ছিলেন। আমার মনে নেই ড. রওনক জাহান স্যারকে কিসিঞ্জারের অনুষ্ঠানে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য গিয়েছিলেন কি না। হুঁকোর নলটি রেখে খদ্দরের চাদরটি কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে বললেন, একটু ঘুইর্যা আহি। ড. রওনক জাহান বললেন, ওমা, এই বেশে আপনি কোথায় চললেন?
স্যার বললেন, ওই যে লোকে কয় কিসিঞ্জার সাব আইছেন, একটু মোলাকাত কইর্যা আহি।
ড. রওনক জাহান বললেন, এই কাপড়ে আপনি সেখানে যাবেন?
রাজ্জাক স্যার ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধী বালকের মতো মুখ নিচু করে বললেন, আমার আর কোনো কাপড়াচোপড় নাইক্যা।
আমি বললাম, সেদিন তো স্যার আপনাকে একটা সিল্কের সুন্দর পাঞ্জাবি দিলাম, কোথায় রাখছেন?
স্যার বললেন, দিছিলেন তা ঠিকই, অখন কই রাখছি মনে পড়ে না। আমরা সকলে মিলে ঘরের আনাচে কানাচে খুঁজতে লাগলাম। একসময় পাঞ্জাবির সন্ধান পাওয়া গেল। তিনি মুড়ির টিনের মধ্যে সুখে নিদ্রা দিচ্ছিলেন।
কিছুদিন পরে ডিক উইলসন সাহেবের লেখা বৃহৎ কলেবরের গ্রন্থ ‘এশিয়া অ্যাওয়েকস’ প্ৰকাশিত হল। উইলসন সাহেব তার গ্রন্থের উৎসর্গের বাক্যটা এভাবে লিখেছেন, ‘টু আবদুর রাজ্জাক অব ঢাকা, হু ব্রট ইস্ট ইন মাই মাইন্ড’। আজিজুল হক মন্তব্য করলেন, ডিক উইলসন সাহেবের গ্রন্থটি মানের দিক দিয়ে গুনার মিরডালের এশিয়ান ড্রামার কাছাকাছি। ‘এশিয়ান ড্রামা’র জন্য গুনার মির ডালকে পরে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিলো। তখনও আমি ‘এশিয়ান ড্রামা’ পড়িনি। কিছুদিনের মধ্যেই ‘এশিয়ান ড্রামা’ এবং ‘এশিয়া অ্যাওয়েকস’ দুটো বই পাশাপাশি পড়ার সুযোগ হলো।
ডিক উইলসনের উৎসর্গবাক্যটি পাঠ করেই আমার দৃষ্টি থেকে একটা পর্দা সরে গেলো। ডিক উইলসনের মতো একজন বিশ্বনন্দিত স্কলারকে যিনি প্রভাবিত করতে পারেন, তার মেধা এবং মনীষা কতদূর প্রসারিত হতে পারে, ধারণা করার ক্ষমতাও তার চারপাশে যে-সমস্ত মানুষ ঘুরে বেড়ান, যাঁরা তার চাটুকারিতা করেন, কিংবা নিন্দা করেন তাদের নেই। তার পর থেকে রাজ্জাক স্যারকে আমি পাটক্ষেতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বটবৃক্ষের মতো দেখে আসছি। তার সামনে গেলে সবসময়েই আমার মনে হতো আমি বিশাল কিছু, গভীর কিছুর সন্নিধানে উপনীত হয়েছি।
রাজ্জাক স্যারের সঙ্গে একটা বিষয়ে শিল্পী জয়নুল আবেদীন সাহেবের চমৎকার মিল লক্ষ করেছি। আবেদীন সাহেব প্রকৃত কাজের মানুষদের চিনতে পারতেন। রায়ের বাজারের মৃৎশিল্পীদের পল্লী থেকে আবেদীন সাহেব মরণচাঁদকে আবিষ্কার করেছিলেন। মরণচাঁদের দক্ষতা এবং সততায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে আর্ট কলেজে একটা চাকুরি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। উত্তরকালে মরণাচাঁদের একজন ভাস্কর হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। ঋজুতা এবং চারিত্রিক স্বচ্ছতার দিকটি বিচার করে আর্ট কলেজের শিক্ষক হিসেবে মোস্তফাকে নিয়োগ করেছিলেন। আবেদীন সাহেবের পছন্দের মানুষ দুটি রাজ্জাক সাহেবেরও বিশেষ প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছিলেন। আর মোস্তফা রাজ্জাক স্যারের অনুগৃহীতদের মধ্যে বিশেষ একজন হয়ে গিয়েছিলেন।