তৃষা বিছানা ছাড়ে শেষ রাতে। শীতকাল বলে এখন ঘুটঘুট্টি অন্ধকার থাকে। আকাশভরা জমকালো তারার ঝিকিমিকি। কখনও-সখনও ক্ষয়া চাঁদের ফ্যাকাসে জ্যোৎস্নাও। পাখি ডাকে কি ডাকে না। এত নিঃঝুম যে, নিজের শ্বাস বা হৃৎপিণ্ডের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়।
বৃন্দা ঘরের দরজা জানালা খুলে ঘর আর বারান্দা ঝাঁটাতে থাকে আর গুন গুন করে প্রভাতী গায়—ভজ গৌরাঙ্গ কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে…। এমন পাষণ্ড কে আছে যার ভোরবেলার ছাঁকা নির্জনতায় ওই আপনভোলা নদীর মতো বয়ে যাওয়া সুরের প্রভাতী ভাল না লাগবে। যার ভক্তি নেই সেও ওই গান শুনে মাঝে মাঝে প্রশ্নের সামনে দাঁড়ায়। তৃষার কোনওকালে ভক্তি ছিল না, আজকাল হয়েছে কি একটু!
তামাক দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে তৃষা কলঘরে চলে যায়। প্রাতঃকৃত্য সেরে এই মারুনে শীতে লোহার মতো ঠান্ডা জলে আকণ্ঠ স্নান করে সে। তামাকের ধ্বক ওই স্নান পর্যন্ত গলায় আটকে থাকে তার। স্নান করতে করতেই শুনতে পায় বাগানে ফুলচোরদের আনাগোনার শব্দ। নিচু দেয়াল টপকে লাফিয়ে নামছে ছোট ছোট পা, ফুল ছিড়ছে পুট পুট করে, চাপা গলার কথা। কুয়োর ধারে স্থলপদ্ম গাছটার ওপরেই ওদের নজর বেশি।
এই ভোরবেলায় মনে কোনও রাগ সহজে ওঠে না। তৃষা কান পেতে শোনে একটু। বাড়াবাড়ি টের পেলে গম্ভীর গলাটা একটু উঁচুতে তুলে বলে, কে রে? বৃন্দা, দ্যাখ তো!
ওইতেই কাজ হয়ে যায়। ঝুপ ঝাপ করে ফুলচোরেরা পালাতে থাকে। খ্যাপা নিতাইয়ের কুকুরটা মাঝে মাঝে তাড়া করে উপর। ঝড় পাহারাদার অবশ্য ফুলচোরদের নিয়ে মাথা ঘামায় না। সারারাত পাহারা দিয়ে তৃষা উঠবার পর সে ঘুমোতে চলে যায়। এ সময়টায় তাই বাড়ির তেমন প্রতিরক্ষা নেই। কিন্তু তৃষা একাই একশো।
কলঘর থেকে বেরোতে একটু সময় লাগে তৃষার। নিজের যত্ন বলতে তার এই ভোরে স্নানটুকু। তাই সে সময় নেয়। এই সময়েই সে নিজের কথাও একটু ভাবে। দিনের মধ্যে বলতে গেলে এই একবারই।
কলঘর থেকে বেরোলেই দেখে পুব আকাশে ফিকে ফিরোজা রং ধরেছে। মিলিয়ে যাচ্ছে তারার আলো। ভোৱের হয়তো বা একটা সৌন্দর্য আছে। তৃষা তা কোনওদিনই তেমন টের পায় না। মস্ত দুই টিন-ভর্তি খেজুর রস বারান্দায় নামিয়ে রেখে যায় লক্ষ্মণ। হাঁস মুরগির ঘর থেকে ডিমের আঁকা এনেও বারান্দা-সই করে দিয়ে যায় সে। নিতাই কাঠকুটো কুড়িয়ে এনে উঠোনের পশ্চিম ধারে ডাই করে। রেলবাবুদের বাড়ি থেকে দুধ নিতে ছোট ছোট ঘটিবাটি হাতে নিয়ে কচি কাচা বুড়ো মন্দারা এসে জুটে যায়। ঢতুদিকে চোখ রাখতে হয় তৃষার।
গোটা সাতেক দুধেল গোরুর পনেরো-যোলো সের দুধ দুইয়ে মংলু গয়লা একটা মস্ত অ্যালুমিনিয়ামের ঘ্রামে ঢেলে দিয়ে যায়। ড্রামের মধ্যে তৃষার কিছু কারচুপি থাকে। দু’-তিন সের পরিষ্কার জল আগে থেকেই ড্রামে ভরে রাখে সে। অন্য গয়লারা যেমন গোরুকে আঁক দেয় বা দুধে মিল্ক পাউডার, চক খড়ির গুঁড়া বা হাবিজাবি মেশায় তৃষা তা কখনও করে না। তার বাড়ির দুধ খায় বহু বাড়ির আদর যত্নের বাচ্চারা। হিসেব করলে তিন টাকা সের দরে সে যথেষ্ট খাঁটি দুধই দেয়। অতটা দুধে এই সামান্য জল মেশানোটা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। তৃষার অন্তত কিছু মনে হয় না। শ্রানাথ টের পেয়ে একদিন খুব রাগ দেখিয়েছিল, ভদ্রলোকের মেয়ে হয়ে কেমন করে যে তুমি এত নীচে নামতে পারলে! যদি এই কাজই করবে তবে সারাজীবন গয়লাদের সঙ্গে দুধে জল দেওয়ার জন্য। খিটিমিটি করে এলে কেন?
শ্রীনাথের রাগ অবশ্য বাওয়া ডিমের মতো। সারবস্তু নেই। সংসারে সে হচ্ছে বোঁটা আলগা ফল। যে-কোনওদিন খসে পড়বে। তৃষা বথটায় কানই দেয়নি। সামান্য মাইনের প্রুফ-রিডারের সংসার চালিয়ে সে জীবনের অনেক সত্য ও সারবস্তু চিনে গেছে। ব্যক্তিগতভাবে তৃষার নিজের তেমন কোনও লোভ নেই। সে সোনার গয়নার জন্য হেঁদিয়ে মরে না, শাড়ি বা রূপটানের জন্য আকণ্ঠ কোনও অতৃপ্তি নেই। সে শুধু চায় একটা ছোটখাটো রাজত্বের ওপর নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব করতে।
বাড়ির জন্য আলাদাভাবে দু-তিন সের দুধ দোয়ানো হয়। ফেনিল, ঘন, ননী ওঠা সুস্বাদু বালতি ভরা সেই দুধ দেখে কোনওদিন এক চুমুকও খাওয়ার কথা মনে হয় না স্যার। দুধের গ্লাস মুখের কাছে আনার কথা ভাবলেও পেট গুলিয়ে ওঠে। কয়েকবার চেষ্টা করে পারেনি। সকালে সে তাই বড় পাথরের গ্লাস ভর্তি চা খায়। রোদ ভাল করে ফোটার আগেই বৃন্দা তার জন্য মাটির হাঁড়ি করে ফেনাভাত নামিয়ে দেয়। খাঁটি আঁঝালো সর্ষের তেল, ঝাল লঙ্কা আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে তৃষা জলখাবার খায়। ভাত ছাড়া আর কিছু খাওয়ার আছে সংসারে, এ তার মনেই হয় না।
কুটনো কোটা বা রান্না করার মতো মেয়েলি কাজ তুষ আজকাল করে না। তার জন্য লোক আছে। সকালের দিকে রোদ উঠলে সে উঠোনে জলচৌকি পেতে বসে। কোলে থাকে তার নিজস্ব হিসাব-নিকাশের খাতা। কে কত পাবে, কার কাছে কত পাওনা, কাকে কোন কাজ দেওয়া হবে, কাকে রাখবে, কাকেই বা ছাড়াবে তা সব ওই খাতায় লেখা। বন্ধকি ঋণের একটা মস্ত হিসেবও রয়েছে তার। সোনা-রুপোর গয়না থেকে ঘটি-বাটি এমনকী গোরু পর্যন্ত বাঁধা রাখে সে। কখনও এক পয়সা ছাড়ে না।
ছেলেমেয়েরা কোনওদিনই খুব একটা ঘেঁষে না তার কাছে। তবে ওর মধ্যে সজলই তবু একটু সাহস রাখে। একটু মান্যাওটাও সে-ই। কিন্তু সজল যখন সুন্দর নধরকান্তি শিশু ছিল তখনও তাকে তৃষা কোনওদিন হামলে আদর করেনি। আজও এক কঠোর শীতল শাসনের দূরত্ব বজায় আছে।
কয়েকদিন জ্বরে ভুগে উঠে সজল এখন ভারী রোগা আর দুর্বল। বেলায় ঘুম থেকে উঠে একটা ব্যাপার জড়িয়ে উঠোনের রোদে এসে গুটি গুটি বসেছে। তুষার জলচৌকি থেকে অল্প দূরে।
তৃষা এক পলক তাকিয়ে বলল, পায়ে চটি নেই কেন?
ভুলে গেছি।
যাও পরে এসো।
সজল উঠল না। দুর্বল ঘাড়ের নলিতে মাথাটা খাড়া রাখতে না পেরে কাত করে মায়ের দিকে চেয়ে বলে, একটু খেজুর রস খাব মা?
না। সারারাত হিম পড়ে রস এখন বরফ হয়ে আছে। জাল দিলে গুড় খেয়ো। বেশি নয়, কৃমি হবে।
সজল চুপ করে মায়ের দিকে চেয়ে থাকে।
তৃষা একবার ছেলের দিকে চেয়ে বৃন্দাকে ডেকে ওর চটিজোড়া দিয়ে যেতে বলে।
সজল উদাস চোখে আকাশের দিকে চেয়ে ছিল। হঠাৎ বলল, বাবা কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি মা?
তৃষা সব জানে। তার অজান্তে কিছুই ঘটে না। গভীর রাতে খ্যাপা নিতাই তার জানালায় টোকা দিয়ে খবরটা দিয়ে গেছে, শেষ গাড়ি চলে গেল মা। বাবু কিন্তু ফেরেনি আজ।
খবরটা শুনে তৃষা কিছুক্ষণ জেগে ছিল। বলতে নেই, শ্রীনাথের জন্য তার খুব একটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল না। তার সন্দেহ শ্রীনাথ আজকাল বাইরে ফুর্তি করার স্বাদ পেয়েছে। তৃষার খুব ভুল হয়েছিল শ্রীনাথের সঙ্গে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলে। প্রথম থেকে শ্রীনাথ দু হাতে টাকা তুলত। তৃষা সাবধান হয়েছে এখন? জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের টাকা যতদূর সম্ভব টেনে নিয়ে ডাকঘরে রেখেছে। কিছু টাকা তার বন্ধকির ব্যাবসাতে চলে এসেছে। তবু যা টেনে নিয়েছে শ্রীনাথ তাও ফ্যালনা নয়। বদ্রীর মারফত জমিজমা কেনার চেষ্টা করছে, এ খবর মদন ঠিকাদারের কাছে শুনেছে তৃষা। শ্রীনাথের কথা খুবই ঘেন্নার সঙ্গে ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমিয়েছে তৃষা, সকালে আর ব্যাপারটা মনে ছিল না। ছেলের দিকে চেয়ে বলল, তোমার বাবা কাজে আটকে পড়েছে তাই আসেনি।
সজল এ কথায় জবাব দিল না, আর জানতেও চাইল না কিছু। কিন্তু তৃষা জানে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা মুখে যতই না বোঝার ভাব দেখাক, ভিতরে ভিতরে অনেক কিছু বোঝে।
পাশদোলানি চালে তৃষার হাঁসের পাল লাইন ধরে ধপধপে ফর্সা উঠোন পেরিয়ে পুকুরের দিকে যাচ্ছে। তার মধ্যেই একটা হাঁস টপ করে দুলদুলে একটা ডিম প্রসব করে ফেলল মাটিতে, আর সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা হাঁস কপ কপ করে সেটা খেয়ে নিল। দৃশ্যটা গম্ভীর চোখে দেখল তৃষা। নন্দর কাছে ডিম বাবদ আড়াইশো টাকার মতো পাওনা। তাগাদার ভয়ে তিন-চারদিন হল সে আর এ তল্লাট মাড়ায় না। তিন-চার দিনের ডিম ডাঁই হয়ে জমে আছে। বেশিদিন জমা থাকলে দু’-চারটে করে পচতে শুরু করবে। আজকালের মধ্যেই নতুন লোক না দেখলে নয়, নন্দ অবশ্য পালাতে পারবে না। টাকা তাকে দিতেই হবে, নইলে যে ঘোর বিপদ তা সে জানে। তৃষারা যখন প্রথমে এখানে আসে তখন কাঙাল ভিখিরি প্রার্থীদের খুব আনাগোনা ছিল। কাছাখোলা বাস্তববুদ্ধিহীন এবং লোকচরিত্র সম্পর্কে অজ্ঞ মল্লিনাথ তাদের দু’হাতে বিলোত। তৃষা হাল ধরার পর সব বন্ধ হয়। বিনা কাজে ফালতু একটি পয়সাও সে কাউকে দিত না। ভিখিরি-টিখিরি এলে সে বলত, কাজ দিচ্ছি, করলে পয়সা পাবে, ভাত পাবে। নইলে রাস্তা দেখো। তৃষার পাল্লায় পড়ে কিছু কিছু নিষ্কর্মা মাগুনে লোক এখন শুধরেছে। তৃষা তাদের খাঁটিয়ে পয়সা দেয়। নন্দ তাদেরই একজন। তুষার টাকা মেরে দেওয়ার মতো অকৃতজ্ঞ হলেও সে হতে পারে কিন্তু প্রাণের ভয়েই সে তা করবে না। সুতরাং তৃষার দুশ্চিন্তা নেই।
তার পায়ের কাছে সজলের মাথার ছায়াটা পড়ে ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ তৃষা চেয়ে দেখে, সজল নেই। কোথাও উঠে গেছে। হয়তো বাপের খোঁজ করতেই গেল। অবশ্য বাপের জন্য এক পয়সার টান নেই ওর। থাকবে কেন? তৃষা তো জানে, শ্রীনাথ ওকে কী চোখে দেখে। সজলও সেই বিষ মনোভাব টের পায়। শুধু শ্রীনাথ নয়, মল্লিনাথ ও তৃষার সম্পর্ক নিয়ে আরও অনেকেরই অন্যরকম ধারণা আছে। তৃষা সেসব ধারণা ভেঙে দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করেনি। নিন্দের হাওয়াকে রুখতে নেই। চুপ করে থাকলে তা একদিন আপনিই কেটে যায়। গেছেও অনেকটা।
চারদিকে তাকিয়ে দেখলে এই সাদা রোদে যে নিরুদ্বেগ সম্পন্ন গৃহস্থালির দৃশ্যটা দেখা যায় তার সবটা অত সরল গল্প নয়। তৃষা তার মেধা, বোধ, কূটবুদ্ধি, দেহ ও মনকে যতদূর সম্ভব নিংড়ে এ শাখা-প্রশাখাময় ছায়াঘন সংসারবৃক্ষটিতে সার ও সেচ জুগিয়েছে। উদ্যমহীন, আচ্ছা ও অবসরপ্রিয়, হতদরিদ্র শ্রীনাথের ঘর করতে গিয়েই সে টের পেত, সতীত্ব বা এককেন্দ্রিক জীবন কত না অর্থহীন। কতই না হাস্যকর শব্দ ভালবাসা। রাজার আমলের টাকার মতোই তা অচল। তাই মল্লিনাথের। সংস্পর্শে এসে সে যখন দারিদ্র্য মোচনের পথ দেখল তখন কোনও মানসিক বাধাই তাকে আটকে রাখেনি। লোকে বলে, অবৈধ সম্পর্ক। কিন্তু তাই কি? তৃষা কোনও পুরুষকেই ভালবাসে না বটে, কিন্তু তবু তার যেটুকু স্নেহ এখনও বুকের তলানিতে পড়ে আছে তার যোগ্য পুরুষ সারাজীবনে ওই একজনকেই পেয়েছিল তৃষা। সে মল্লিনাথ। ওই একজনকেই তার তেমন পরপুরুষ বলে মনে হয়নি কোনওদিন। বরং ওই একজনের প্রতি মানসিক বিশ্বস্ততাই তাকে খানিকটা সতীত্ব বা ওই ধরনের কিছু দিয়েছে। শরীরের কোনও বোধই কোনওদিন ছিল না তৃষার। কিন্তু আজও সে দেখতে শুনতে অতীব লোভনীয় এক যুবতী। হয়তো তরুণী নয়, কিন্তু জোয়ারি যুবতী। লম্বা মজবুত চেহারা তার। শরীরের হাড় বেশ চওড়া এবং শক্ত। যথেষ্ট পুরুষালি ভাব রয়েছে তার চেহারায় এবং চালচলনে। চোখের দৃষ্টিতে মেয়েমানুষি লজ্জা বা কমনীয়তা নেই। এতগুলো ছেলেমেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তার। বুকের আকার প্রকারে কোনও শ্লথ ভাব নেই, মাতৃত্বের আর্ত স্নেহশীলা নম্রভাবও নেই তার মধ্যে। এখনও সে হেঁটে গেলে মনে হয়, এই মেয়েটি কোনও পার্থিব সম্পর্কে আবদ্ধ নয়। এ একা।
তৃষা বাস্তবিকই তাই। এত সুন্দর লোভনীয় চেহারা থাকা সত্ত্বেও তৃষার দেহের কোনও চাহিদা নেই। কোনওদিনই তার যৌন মিলনের কোনও আকাঙ্ক্ষা ছিল না। বিয়ের পর সে অত্যন্ত নিরুত্তাপভাবে এবং খানিকটা বিরক্তির সঙ্গে দৈহিক মিলনটা মেনে নিয়েছিল মাত্র। তবে কোনওদিনই নিজে সাগ্রহে অংশ নেয়নি। কোনওদিন ওতে কোনও তৃপ্তিও বোধ করেনি সে। এ যেন স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রতিদিন ব্যায়াম করার মতোই একটি কর্তব্য কাজ। কিন্তু মেয়েমানুষের শরীরের যে বিপুল চাহিদা জগতে বিদ্যমান সে সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল টনটনে। তাই কাম সম্পর্কে অতি শীতল মনোভাব সত্ত্বেও এই দেহ সে কাজে লাগিয়েছে কখনও-সখনও। তেমনি মনোভাব নিয়েই সে মল্লিনাথকে প্রশ্রয় দিয়েছিল। দেহের শীতলতার জন্যই সে দেহের সতীত্ব সম্পর্কে উদাসীন। মল্লিনাথকে সে তাই বাধা দেয়নি। এমনকী দেহ দিয়ে মল্লিনাথকে খুব বেশি কিছু দেওয়া হয়েছে বলে কখনও ভাবেওনি সে। উপরন্তু তাই সে অবিবাহিত মল্লিনাথকে দিয়েছিল স্নেহ, সেবা ও সঙ্গ। শেষ জীবনটা মল্লিনাথ তার দয়ায় উদ্ভাসিত আনন্দে কাটিয়ে গেছে। মল্লিনাথের বিষয়-সম্পত্তি ভোগ করতে তাই কোনও সংকোচ নেই তৃষার। সে জানে মল্লিনাথের আপনার জন বলতে ছিল একমাত্র সে-ই। লোভী শকুনরা হেঁ মারতে চেয়েছিল বটে, কিন্তু তৃষার অধিকার অনেক বেশি গভীর।
তাই চারদিকে চেয়ে সংসারের সম্পন্ন দৃশ্যগুলি দেখে তৃষা নিশ্চিন্ত থাকে না, তৃপ্তি বোধ করে। গল্পটা তো অত সরল নয়। কিন্তু লড়াইটা সে খুব উপভোগ করে।
মুরগির ঘর থেকে লক্ষ্মণ ঝিমুনি রোগে ধরা তিনটে লেগহর্ন মুরগি বের করে এনে বলল, এ তিনটের হয়ে গেছে মা, আরও গোটা পাঁচেক কাল-পরশুই যাবে।
তৃষা নিরাসক্ত গলায় বলে, পাঠশালার মাঠে গর্ত খোড় গে। আমি যাচ্ছি।
লক্ষ্মণ মুরগি তিনটের পা বেঁধে তৃষার অদূরে উঠোনে ফেলে রেখে শাবল নিয়ে চলে যায়। তৃষা আবার তার হিসেবের খাতায় ঝুঁকে পড়ে। মুরগিগুলো নড়ে না, শুধু বসে বসে ঝিমোয়।
হিসেব শেষ করে উঠে পড়ে তৃষা। কাজের অন্ত নেই। কাজ ছাড়া থাকতে ভালবাসে না সে। খাতাটা ঘরে রেখে আসতে না আসতেই লক্ষ্মণ এসে পড়ে।
গর্ত হয়ে গেছে, মা। চলুন।
পাঠশালা বলতে আসলে এখন কিছুই নেই। মল্লিনাথ ভাল ভেবে তার জমির মধ্যেই পাঠশালা খুলতে জায়গাটা ছেড়ে দিয়েছিল। বাঁশের বেড়া আর টিনের চালওলা খানকয়েক ঘরও উঠেছিল এবং জনা বিশ-চল্লিশ পড়ুয়া আর তিন-চারজন মাস্টারমশাইকে নিয়ে একটা পাঠশালা চালুও হয়েছিল। তবে পাঠশালার জমি কতটা হবে তা চিহ্নিত করে রাখেনি মল্লিনাথ, লিখিত কোনও দলিলও ছিল না। তৃষা সাকসেসন পাওয়ার পর পাঠশালার জমি নিয়ে দাঙ্গা লাগার উপক্রম। মাস্টারমশাই বা ছাত্ররা নয়, কোমর বেঁধে বাগড়া দিতে এল স্থানীয় লোকজন। তাদের পান্ডা ছিল অল্পবয়সী এক ছোকরা রাজনৈতিক নেতা। তার তেজ দেখবার মতো। ছোকরা আলটিমেটাম দিয়ে বলল, তিন বিঘে জমি ছেড়ে দিতে হবে। নইলে ও জমি আপনি কোনও কাজে লাগাতে পারবেন না। আদালতের রায় পেলেও না। গণ্ডগোল আরও গাঢ় হয়ে উঠল ক’দিনের মধ্যেই। সমস্ত এলাকার লোক তুষার বিরুদ্ধে। এমনকী পাঠশালার পাশ দিয়ে বাড়ির লোকের যাতায়াতের পথ। একদিন কাঁটাতারের ব্যারিকেড তুলে বন্ধ করে দিল বিরুদ্ধপক্ষ। পুলিশের কাছে গিয়ে কোনও লাভ হয়নি।
এখন এই সকালের রোদে জারুল আর শিমুলের দীর্ঘ ছায়া, লম্বা ঘাসের জমির স্নিগ্ধ শ্যামল গালিচা, ইস্কুল ঘরের নিস্তব্ধতা যে শান্তির ইঙ্গিত দেয় গল্পটা অত সরল নয় মোটেই। দুঃসহ মানসিক জ্বালা, রাগ, বিদ্বেষ, অসহায় অপমান কতদিন ধরে নীরবে সহ্য করতে হয়েছিল তাকে। সে তবু গো। ছাড়েনি, হাল ছাড়েনি, প্রতিপক্ষের কোনও দাবিই মেনে নেয়নি। শুধু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে, বিশ্লেষণ করে মনে মনে স্থির করল, ছোকরা রাজনৈতিক নেতাটিকে হাত করতে পারলেই বোধহয় হবে। সেটাও একটা দুরন্ত ঝুঁকি বটে। জল এত দূর গড়িয়েছিল যে, একজনকে হাত করলেই সেটা মিটবে এমনটা মনে হচ্ছিল না। তবু ঝুঁকি নিয়েছিল তৃষা।
মদন ঠিকাদারই ছিল একমাত্র নিরপেক্ষ লোক। ঝুট ঝামেলায় নেই, আপনমনে কাজ করে, টাকা কামায়, গম্ভীর, শান্ত, নিরুদ্বেগ মানুষ। হয়তো তৃষাদের প্রতি তার খানিকটা অপ্রকাশ্য সহানুভূতি ছিল। তাকে দিয়েই একদিন ছোকরা নেতা শুভঙ্করকে নেমন্তন্ন করাল তৃষা। পোলাও, মুরগি, পাকা মাছ দিয়ে এলাহি খাওয়া। ছোকরা নির্লজ্জের মতো এল এবং খেল। যাওয়ার সময় যে পাঁচশো টাকা একটা ন্যাকড়ার থলিতে ভরে হাতে দিল তৃষা, তাও নিল নির্বিবাদে, যেন পাওনা টাকা। হাসিমুখে চলেও গেল। তৃষার মন বলল, চালে ভুল হল না তো? ভুলই হয়েছিল। কারণ গণ্ডগোল মিটল না। কোনও ফয়সালা হল না। সেই ছোকরা সামনা-সামনি আর তড়পাত না বটে, কিন্তু আড়াল থেকে উস্কানি দিত। আবার সে নেমন্তন্ন খেতে এল এবং যাওয়ার সময় বেশ স্পষ্ট গলাতেই বলল, হাজারখানেক দিন। পার্টিফান্ডের জন্য চাইছি। এবার কথা দিচ্ছি, মিটে যাবে।
দাঁতে দাঁত চেপে তাও দিয়েছিল তৃষা। ফলে সামনাসামনি লড়াই বন্ধ হয়ে গেল বটে, কিন্তু জমির গণ্ডগোল মিটল না। শুভঙ্কর অত্যন্ত উগ্র এবং ঘোড়েল। এখানকার সব লোক, মায় পুলিশ পর্যন্ত তাকে ভয় খায়। মাঝে মাঝেই সে আসত এবং নির্লজ্জের মতো টাকা নিত। দিতেও হত তৃষাকে। তবে তৃষা প্রতিটি দেওয়া পয়সার হিসেব রাখত। সুযোগ পেলে সুদে-আসলে উসুল করবে বলে। যারা খুব দাপের সঙ্গে চলে তারা অন্যায় করলেও লোকে কিছু বলতে সাহস পায় না। শুভঙ্কর যা করত অত্যন্ত তেজ ও জোরের সঙ্গে করত। কারও পরোয়া করত না। বেশ বড়সড় অনুকারীদের। একটা দল ছিল তার। এ জায়গা শাসন করত তারাই। আশ্চর্যের বিষয়, তুষার কাছ থেকে শুভঙ্কর। যে টাকা নিত তা ঠিকঠাক তার পার্টি ফান্ডেই জমা দিত। এক পয়সাও এদিক ওদিক করত না। চুল থেকে পা পর্যন্ত সে ছিল রাজনীতির মানুষ। তার ব্যক্তিগত কোনও দুর্বলতা আছে কি না তা অনেক খুঁজেছে তৃষা। আর কিছু না হোক কাঁচা বয়সের ছেলেদের মেয়েমানুষ সম্পর্কে কৌতূহল তো থাকেই।
সেবার মাসির বাড়ি এলাহাবাদ থেকে বহুকাল বাদে দু’মাসের জন্য মা-বাবার কাছে এসে ছিল চিত্রলেখা। এমনিতেই চিত্রা দেখতে সুন্দর, তার ওপর মাসির কাছে সে একদম মেমসাহেবি কেতায়। থাকে। দিঘল, ফর্সা যৌবনাক্রান্ত ঢলঢলে কিশোরী। বব চুল, দারুণ সব পোশাক, চলাফেরার কায়দাই অন্যরকম। কাউকেই মানুষ বলে গ্রাহ্য করে না তেমন। সে এই জায়গায় পা দিতেই চারদিকে যেন চাপা শোরগোল পড়ে গেল। শুভঙ্করকে সেই সময় পরপর কয়েকদিন নেমন্তন্ন করে খাওয়াল তৃষা। গেল নদীর ধারে সপরিবারে পিকনিক করতে, সঙ্গে শুভঙ্কর। চিত্রলেখাকে শুভঙ্করের সঙ্গেই একদিন পাঠাল কলকাতা দেখতে। গেঁয়ো জায়গার কাঁচা ছেলের মাথা কঁহাতক ঠিক থাকে? ততদিনে শুভঙ্কর হয়ে গেছে তৃষার একান্ত বাধ্য, ভীষণ রকমের পোষমানা। সুতরাং নদীর ধারে কাঠা পাঁচেক সস্তা জমি কিনে পাঠশালাকে একটা দানপত্র লিখে দিয়ে তৃষার পক্ষে ঘরের কোণে ঘোগের বাসা তুলে দিতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। পাঠশালা নিয়ে স্বয়ং শুভঙ্কর তখন তুষার পক্ষে জান দিতে প্রস্তুত। পাঠশালা নদীর ধারে উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তৃষা জায়গাটা ঘিরে ফেলল দেয়াল দিয়ে। চিত্রলেখা এলাহাবাদে ফিরে যাওয়ার আগে একদিন তৃষাকে বলল, ওই বুদ্ধ ছেলেটার সঙ্গে তোমাদেব এত মাখামাখি কেন? তৃষা কিছু বলেনি। চিত্রলেখা এলাহাবাদে ফিরে যাওয়ার পর থেকেই শুভঙ্কর তৃষাকে মা বলে ডাকতে থাকে। রোজ আসত। দেখা করত। এলাহাবাদে চিঠিপত্রও লিখত বলে শুনেছে তুষা। শুভঙ্করকে আর তেমন খাতির করত না সে, তবে চটাতও না। চিত্রলেখার প্রেমে পড়েই কি না কে জানে, ক্রমে ক্রমে শুভঙ্করের সেই দীপ্ত তেজ। আস্তে আস্তে নিভে আসছিল। মাস ছয়েক বাদে আসানসোলে একটা চাকরি পেয়ে সে চলে যায়। এলে তৃষার সঙ্গে দেখা করে যায়, মা বলে এখনও ডাকে। কিন্তু পুরোটাই নখদন্তহীন হয়ে গেছে শুভঙ্কর।
পাঠশালার মাঠের নরম শিশিরে সিক্ত ঘাসের জমিতে পা দিয়ে চারদিকের মনোরম নির্জনতা দেখতে দেখতে তৃষা ভাবে, এতটা সরল নয় এই জমিটুকুর ইতিহাস।
একটা শিমুল গাছের নীচে হাত দেডেক গভীর গর্তের ধারে তিনটে ঝিম-ধরা মুরগিকে শাবলের ঘায়ে এক এক করে মারল লক্ষ্মণ! এই মুরগি মারার ব্যাপারটা সবসময়ে আজকাল তৃষা নিজেই তদারক করে। এর আগে লক্ষ্মণ বহুবার ঝিমুনি মুরগি নিয়ে গিয়ে বাজারে বেচে এসেছে। লোকে খেয়ে অসুখে পড়লে তৃষার বদনাম হবে।
মুরগি তিনটের মৃতদেহ দুর থেকে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে দেখে তৃষা। রক্ত, ছেঁড়া পালক, ঘাড় গোঁজা ওই অসহায় মৃত্যুর দৃশ্য দেখে তার ভিতরটা একটুও নাড়া খায় না। এইসব দুর্বলতা নেই বলে সে খুশি।
লক্ষ্মণ পা দিয়ে ঠেলে মুরগি তিনটেকে গর্তের মধ্যে ফেলে মাটি চাপা দেয়। কবর হয়ে গেল। তৃষা গিয়ে চটি পরা পায়ে আলগা মাটি চেপে দেয় আরও একটু।
এমন সময় লক্ষ্মণ চাপা স্বরে হঠাৎ বলে ওঠে, বাবু ওই আসছে, মা।
তৃষা শুনল কিন্তু পথের দিকে তাকাল না। অন্য বউরা হলে তাকাত। কিন্তু তার আর শ্রীনাথের সম্পর্ক ততটা সরল নেই আর। শ্রীনাথ আসছে আসুক। তা কী?
সজল দাঁড়িয়ে ছিল পুকুরের ধারে। দু’ পকেটে চার-পাঁচটা ডিম। লম্বালম্বি একটা ডিমকে দু’ হাতের চাপে কিছুতেই ভাঙা যায় না, বলেছিল ছোটন নন্দী। এখন সে ডিম নিয়ে পরীক্ষাটা করছিল। তার শরীর ভাল নেই। জ্বর থেকে উঠে খুব একটা জোর পাচ্ছে না হাতে-পায়ে। তবু প্রাণপণে ডিমে চাপ দিয়ে দেখছিল, বাস্তবিকই ভাঙে না। ইলিপস বা উপবৃত্তে যে-কোনও চাপই কাটাকুটি হয়ে যায়, বিজ্ঞানের বইতে সে এমন কথা পড়েছে। তবু বইতে যা লেখা থাকে তার সবই তো সত্যি না হতে পারে! তাই সে পরীক্ষা করে দেখছিল। আসলে সকালে এক ঝুড়ি ডিম চোখের সামনে দেখলে আজকাল তার ভারী রাগ হয়। এত ডিমের কোনও মানেই হয় না। রোজ সকালে বিকেলে ডিম দেখলে কার না ইচ্ছে করে দু’-চারটে নষ্ট করতে?
ডিমগুলো হাতের চাপে ভাঙল না ঠিকই, তবে সজল একটার পর একটা ডিম বুড়ো একটা মহানিমের গায়ে ছুড়ে মারল। ফনাক করে ফেটে কুসম আর কাথ গড়িয়ে পড়ছে কাণ্ড বেয়ে। দু’-তিনটে কাক তাই দেখে লাফিয়ে কাছে এসে খা খা করতে থাকে। পুকুরে হাঁসগুলো ভ্যাক ভ্যাক করছিল, তাদের দিকেও একটা ডিম ছুড়ে দিল সে। ডিমটা ভাসল, ড়ুবল, ভাসল এবং ড়ুবে গেল।
তারপর হঠাৎই বাবাকে দেখতে পেল। উসকোখুসকো চুল, বাসি দাডি, তুসেব চাদর গায়ে বাবা বাড়ির ভিতরে ঢুকছে। সজল চট করে সরে আসে একটা গাছের আড়ালে। সাবধানে দেখে। কিছুই দেখার নেই অবশ্য। বাবা বাড়ি ফিরছে, এইমাত্র ঘটনা। এত বেলায় যখন ফিরল, তখন আজ আর অফিসে যাবে না। তার মানে সারাদিনের মতো একটা দুশ্চিন্তা, ভয় তার অস্বস্তি থাকবে সজলের। তাকে বাবা দু চোখে দেখতে পারে না।
ঘুরতে ঘুরতে সজল খ্যাপা নিতাইয়ের ঘরে এসে হানা দেয়। নিতাই নেই। ইস্পাতকে নিয়ে কোথায় গেছে। ঘরের দরজা হাঁ হাঁ করছে খোলা। চুরি যাওয়ার মতো কিছুই নিতাইয়ের নেই। তবু অনেক কিছু আছে। বাঁশের মাচানে একটা কম্বলের বিছানায় সে শোয়। মাথার কাছে একটা কুলুঙ্গিতে কালীমূর্তি তেল-সিঁদুরে বীভৎস নোংরা হয়ে আছে। মেঝের এক ধারে পঞ্চমুন্ডির আসন। সামনে মাটিতে একটা চক্র আঁকা। নিতাই কামাবের তৈরি কাঠের বাঁটওলা পাকা লোহার কয়েকটা ছুরি পড়ে আছে পাশে। নিতাই রোজ রাতে বিভিন্ন লোককে বাণ মারে। সবচেয়ে বেশি মারে তার বউ পুতুলরাণীকে উদ্দেশ্য করে।
এ সবই সজল জানে। নিতাই একদিন তাকে খুব গুমোর করে বলেছিল, তোমার যদি কাউকে বাণ মারার থাকে তো আমায় বোলো। মেরে দেব।
সজল সঙ্গে সঙ্গে আলটপকা বলে ফেলেছিল, আছে। মারবে?
বলো। ঠিক মেরে দেব। লোকটা কে?
লোভী মুখে সজল বলেছিল, বাবা।
শুনে নিতাই খুব গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ছিঃ ছিঃ। দাঁড়াও, বাবাকে বলে দেব।
তখন খুব নিতাইয়ের হাতে-পায়ে ধরেছিল সজল।
এখন নিতাইয়ের ঝোপড়ায় সে একা পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে ছুরি ক’টা হাতে তুলে নেয় এবং মন দিয়ে ছকটা দেখতে থাকে। মংলু, লক্ষ্মণ, বামুনদি, বৃন্দা সকলেরই বিশ্বাস খ্যাপা নিতাই মারণ উচাটন বশীকরণ জানে। আবার মদনকাকা বলে, ওটা একটা ফ্রড। পাঠশালা নিয়ে গণ্ডগোলের সময় খ্যাপা নিতাইয়ের কুকুর ইস্পাত একটা ছেলেকে কামড়ে দিয়েছিল। কোথায় তার জন্য ক্ষমা চাইবে, বরং উলটে সেই ছেলেটার ওপর গিয়ে তম্বি করে এল। ফলে শুভঙ্করদা খুব মেরেছিল নিতাইকে। তারপর সেই রাতেই খ্যাপা নিতাই শুভঙ্করদাকে বশীকরণ বাণ মারে। বাণের গুণ কিছু আছেই। নইলে তারপর থেকেই শুভঙ্করদা ওরকম অন্য মানুষ হয়ে গেল কেন?
বাণ মারা না জানলেও সজল আপনমনে ছুরিগুলো ছকটার মধ্যে সজোরে ছুড়ে ছুড়ে গাঁথতে লাগল। আপনমনে বলতে লাগল, মর, মর, এ বাড়ির সবাই মরে যা।
দূর থেকে খুব চেঁচিয়ে ভীষণ রাগের গলায় বাবা ডাকছে, সজল! এই সজল!
সজল নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। এ ডাককে অগ্রাহ্য করতে খুব একটা সাহস পায় না সে। ইচ্ছে করছিল দৌড়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু এখন এই দুর্বল বুকে অতটা দম নেই।
সে একটা ছুরি প্যান্টের পকেটে নিয়ে উঠে পড়ে।
বেরিয়ে দুর থেকেই দেখতে পায়, বাবা ভাবন-ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। গালে দাড়ি কামানোর সাবানের ফেনা, হাতে ভোলা জার্মান ক্ষুর। দৃশ্যটা দেখেই সে বুঝতে পারে, কেন তাকে এই তলব।
জড়ানো পায়ে ধীরে ধীরে কাছে যেতেই শ্রীনাথ গলা ফাটিয়ে বলে ওঠে, কে আমার ঘরে ঢুকেছিল?
সজল জবাব দিতে পারে না। বুক ধুকপুক করছে।
কে আমার ক্ষুরে হাত দিয়েছিল?
সজল চুপ করে থাকে। মিথ্যে কথা বলতে পারে বটে, কিন্তু ওই বিকট রাগের মুখে সেটুকুও সাহস হয় না।
বলো, কে হাত দিয়েছিল?
আমি জানি না।—কোনওরকমে বলল সজল।
জানো না! জানো না!বলতে বলতে শ্রীনাথ বারান্দা থেকে দু’ ধাপ সিঁড়ি নেমে এসে প্রকাণ্ড একটা চড় আকাশ সমান তুলল।
উঠোনের দিক থেকে মা আসছে, টের পাচ্ছিল সজল। চড়টা পড়ার আগেই তৃষা একটু তফাত থেকে চেঁচিয়ে বলল, খবরদার! রোগা ছেলেটাকে মারবে না।
চড়টা পড়ল না। কেমন একটু নিভে গেল শ্রীনাথ। কোনও জবাব না দিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে গেল ঘরে। তৃষা কলাঝোপ পর্যন্ত এসেছিল। তারপর আর এগিয়ে এল না।
সজল মার খেল না। বুঝতে পারল, মা-বাবার মধ্যে আবার একটা ঘোরালো ঝড় পাকিয়ে উঠছে বোধহয়। যদি কিছু হয় তবে সজল বাবাকে ছাড়বে না। যতই ভয় পাক সে, একদিন কিন্তু ঠিক প্রতিশোধ নিয়ে নেবে।
বাবা ঘরে গেল। মাও ফিরে গেল উঠোনে। একা সজল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শরীরে ভয়ের কাঁপুনি টের পেতে লাগল।
ভাবন-ঘর সম্পর্কে তার অগাধ কৌতূহল। ঘরে বই আছে, পুরনো দেরাজে আছে অনেক টুকিটাকি জিনিস, আছে ভাঙা দুরবিন, একটা বহু পুরনো ইঞ্জিনিয়ারিং টুল বক্স, আছে জমি-জরিপের যন্ত্রপাতি, মাপজোখ করার জন্য গোল চামড়ার খাপে ইস্পাতের লম্বা ফিতে, লোহা কাটার করাত, বৈদ্যুতিক তুরপুন, আরও কত কী। বেশিরভাগই জেঠুর জিনিস, এখন আর কেউ ব্যবহার করে না।
শ্রীনাথের শাসনের ভয় সত্ত্বেও মাঝে মাঝে সে চুরি করে ঢোকে সেই ঘরে। জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে। করাত দিয়ে লোহা কাটে, ডেসকের পায়া কাটে। জরিপের যন্ত্রপাতি বের করে বাগানটা মাপবার চেষ্টা করে। কাল সন্ধের কিছু আগে সে ঘরে ঢুকে বাবার ক্ষুর দিয়ে হাতের নরম লোম চেঁচেছিল। তারপর ধার পরীক্ষা করতে কয়েকটা ফুল গাছের ডাল কেটে দেখেছিল। গাছের কষে ক্ষুরটায় ছোপ ধরতেই সে ধার দেওয়ার চামড়ার টুকরোয় অনেকক্ষণ ঘষেছিল বটে, কিন্তু দাগ ওঠেনি।
এ বাড়ির মধ্যে ভাবন-ঘরটাই তার সবচেয়ে প্রিয়। পুরনো জিনিস তো আছেই। তা ছাড়া চারদিকে নিবিড় সবুজ গাছপালার ঘেরাটোপের মধ্যে নিঃঝুম ঠান্ডা ঘরখানি। ভারী খোলামেলা। সারাদিন পাখির ডাক ঝরে পড়ে, সারাদিন নিবিড় হাওয়া খেলা করে, খুব স্পষ্ট শোনা যায় ট্রেনের আওয়াজ।
একদিন সে এই ঘরখানা দখল করে থাকবে।
মনে মনে সে জানে, বাবা এই সংসারে বেশিদিন থাকতে পারবে না। এসব জিনিসপত্র, বাড়িঘর সব মায়ের। বাবা বসে বসে খায়। বাবাকে দু চোখে দেখতে পারে না মা। আর মা যা চায় তাই হয়। মা বাবাকে ইচ্ছে করলেই বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে। দেবেও একদিন। মাকে সে বাবার অনেক খবর দেয়, যাতে মা চটে যায় লোকটার ওপর। অনেক কথা সে বানিয়েও বলে। মা সব কথা বিশ্বাস করে না, কখনও চুকলির জন্য বকে, কিন্তু তবু বাবার ওপর মা চটেও যায় ঠিকই।
সজল এসে পুকুরের ধারে দাঁড়ায়। কালো গভীর জলের দিকে চেয়ে থাকে। হাঁসগুলো উঠে গেছে। জল এখন নিথর। ভারী ভাল লাগে এই পুকুরের ধারটা। চারদিকে ঝোপঝাড়ে একটা বুনো গন্ধ উঠছে রোদের তাপে। এই পুকুরটার ধারে এসে দাঁড়ালে তার মনে হয়, কেউ তাকে ডাকছে, টানছে। নইলে আর কারও টান সে কখনও টের পায় না।
বাবা মা দিদিরা কাউকেই তেমন গভীরভাবে ভালবাসে না সে। মাকে একটু। আর কাউকে একবিন্দুও নয়। সবচেয়ে দুর আর পর হল বাবা।
বাবা? সজল মুখ টিপে আপনমনে হাসে। সে শুনেছে শ্রীনাথ তার বাবাও নয়। তার আসল বাবা হল জেঠু।
জেঠুই বাবা? ভাবতে একরকম রোমহর্ষ আর আনন্দ হয় তার। লম্বা চওড়া হুল্লোড়বাজ ওই লোকটার কথা মনে হলেই তার ভাল লাগে।
হে ভগবান, জেঠুই যেন তার আসল বাবা হয়।