তাহেরের নার্ভ শক্ত।
শুধু শক্ত না, বেশ শক্ত। চরম বিপদেও তার মাথা ঠাণ্ডা থাকে। ভিয়েনায় সে কোনো বিপদের মধ্যে নেই। সুখেই আছে বলা চলে। সেমিনার চলছে। পেপার পড়া হচ্ছে, তবে আড্ডা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। প্ৰতি সন্ধ্যায় ককটেল পার্টি। হৈচৈ, নাচানাচি। তাহের এই হৈচৈ-এ নিজেকে মেশাতে পারছে না। মনে হচ্ছে তার ইস্পাতের নার্ভে ও মরিচা ধরে গেছে। গত রাতে এক ফোঁটা ঘুম হয় নি। এরকম অদ্ভুত ঘটনা তাহেরের জীবনে খুব বেশি ঘটে নি। বিছানায় যাবার আগেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। তার অনিদ্রার কারণ লিলিয়ান। লিলিয়ানের সমস্যাটা সে ঠিক ধরতে পারছে না। টেলিফোনে প্যাচানো সিঁড়ির কথা কেন জিজ্ঞেস করল? তাহেরকে এত আগ্রহ করে সে কেনইবা বিয়ে করল? আমেরিকান মেয়েগুলির কাছে বিয়ে এবং ডিভোর্স দুই-ই ডালভাত। চব্বিশ ঘণ্টার পরিচয়ে তারা বিয়ে করে ফেলে, আবার এক সপ্তাহ পর ছাড়াছাড়ি। দুজন দুদিকে গিয়ে অন্য দুজনকে খুঁজে নেয়। কিন্তু লিলিয়ান এ রকম মেয়ে নয়। সে কেন তাহেরের মতো আধা-বাউণ্ডেল একজনের জন্যে এতটা ভালোবাসা জমিয়ে রাখবো?
লিলিয়ান কোনো একটি ব্যাপারে কষ্ট পাচ্ছে। সেই কষ্টের প্রকৃতি তাহের জানে না। জানার চেষ্টা করা কি উচিত? স্বামী-স্ত্রীর ভেতরও কিছু গোপন ব্যাপার থাকা প্রয়োজন বলে তাহের মনে করে। অবশ্যি ভিয়েনায় পা দেয়ার পর থেকে তাহেরের মনে হচ্ছে, সে ভুল করছে। তার উচিত ছিল লিলিয়ানের গোপন কষ্টের ব্যাপারগুলি জানা।
লিলিয়ানকে টেলিফোনে ধরার সব চেষ্টা বিফল হলো। সারা দিনে তাহের ছবার চেষ্টা করল। রিং হয়, কেউ টেলিফোন ধরে না। লিলিয়ান কি ঘর তালাবন্ধ করে কোথাও গেছে? না-কি ষ্ট্রোক হয়ে ঘরে মারে পড়ে আছে? তাহের খুব অস্থির বোধ করতে লাগল। সেমিনারে একেবারেই মন বসছে না। ইচ্ছা করছে ব্যাগ গুছিয়ে প্লেনে উঠে বসতে। রাতদুপুরে বাড়িতে পৌঁছে আমেরিকানদের মতো চেঁচিয়ে বলতে—Honey I am home.
সেমিনারে Cataract solvent-এর উপর বিরক্তিকর এক বক্তৃতা হচ্ছে। বক্তা মাঝে মাঝে হাসাবার চেষ্টা করছেন, পারছেন না।
বক্তৃতার মাঝখানে তাহেরের কাছে স্নিপ এলো, আমেরিকা থেকে জরুরি কল। তাহের টেলিফোন ধরবার জন্যে প্রায় ছুটে গেল। যিনি পেপার পড়ছিলেন তিনি পড়া বন্ধ করে কড়া চোখে তাকিয়ে রইলেন।
টেলিফোন করেছে লিলিয়ান। তাহের বলল, কেমন আছ লিলিয়ান?
ভালো আছি।
কোনো বিশেষ কারণে টেলিফোন করেছ, না এমনি?
এমনি করেছি। আমি কি তোমাকে বিরক্ত করলাম?
মোটেও বিরক্ত কর নি, বরং খুব আনন্দিত করেছ। আমি তোমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছিলাম। ঐদিন হঠাৎ টেলিফোন রেখে দিলে…
খুব ঘুম পাচ্ছিল, শরীর ভালো লাগছিল না।
প্যাচানো সিড়ির কথা জিজ্ঞেস করছিলে কেন?
ও কিছু না। বাদ দাও।
লিলিয়ান, এখন তোমার শরীর কেমন?
শরীর ভালো। তুমি আমাকে নিয়ে মোটেও চিন্তা করবে না। তুমি ঠিকমতো তোমার সেমিনার কর। কোর্স ওয়ার্ক কবে থেকে শুরু হচ্ছে?
তাহের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে খুব নরম গলায় বলল, লিলিয়ান, তুমি কি আমার একটা প্রশ্লেব জবাব দেবে?
অবশ্যই দেব?
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তুমি এক ধরনেব ক্রাইসিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ক্রাইসিসের কারণটা কি আমি জানতে পারি?
না।
বেশ, জানাতে না চাইলে জানাতে হবে না। এমন কিছু কি আছে যা তুমি আমাকে বলতে চাও?
হ্যাঁ।
তাহলে বলো।
I love you.
অন্য সময় হলে তাহের হো-হো করে হেসে ফেলত। আজ পারল না। তার অসম্ভব মন খারাপ হয়ে গেল। টেলিফোন নামিয়ে রেখে সে দুটা কাজ করল। প্রথম কাজ, কোর্স কো-অর্ডিনেটরকে বলল, আমার একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমি আমেরিকা ফিরে যাচ্ছি। দ্বিতীয় কাজ, ট্র্যাভেল এজেন্সিতে টেলিফোন করে বলল, আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে দুমাস ঘুরে বেড়াব। খুব ইন্টারেস্টিং একটা ট্যুর প্ল্যান তুমি তৈরি করে দাও। ট্যুর প্ল্যানে সমুদ্র, পাহাড়, অরণ্য–এই তিনটি জিনিসই থাকতে হবে। আমরা বিয়ের পর একসঙ্গে বাইরে কোথাও যাই নি। এটা হবে আমাদের হানিমুন ট্যুর।
অ্যাডভেঞ্চার চাও, না smooth প্ল্যান চাও?
দুই-ই চাই।
ট্যুর প্ল্যানে হোটেলের ব্যবস্থাও থাকবে?
হ্যাঁ থাকবে।
ইকনমি হোটেল, না এক্সপেনসিভ হোটেল?
এক্সপেনসিভ হোটেল। ইকনমি হোটেলে আমি থাকতে পারি না–দম বন্ধ হয়ে আসে।
কোন মহাদেশ ঘুরতে চাও? ইউরোপ, এশিয়া? ইন্ডিয়া দেখে আস। ইন্ডিয়া এবং নেপাল। পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্য–সবই পাবে। তাজমহল আছে–সপ্তম আশ্চর্য…
তাহের হঠাৎ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি বরং আমাদের দুজনের জন্যে বাংলাদেশে একটা টুরের ব্যবস্থা কর।
বাংলাদেশ খুব ইন্টারেস্টিং হবে বলে আমার মনে হয় না।
আমার নিজেরও মনে হয় না। তবু কর।।
পুরো ট্যুরটাই হবে বাংলাদেশে?
হ্যাঁ।
কিছু মনে করবে না–বাংলাদেশে হানিমুন টুরে যেতে চাওয়ার কারণ কী জানতে পারি?
হ্যাঁ পার। এটা আমার নিজের দেশ। হো হো হো। হা হা হা।
অনেক দিন পর তাহের প্রাণখুলে হাসল। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, হ্যালো মিস, আমাকে মন্টানা যাবার একটা টিকিটের ব্যবস্থা করে দাও। এমনভাবে করবে যেন আমি রাতদুপুরে উপস্থিত হতে পারি। আমি আমার স্ত্রীকে চমকে দিতে চাই। হা হা হা।
রাত তিনটায় লিলিয়ান দরজা খুলল।
তাহের দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাদের খেলনার দোকান থেকে অদ্ভুত একটা মুখোশ কিনে মুখে পরেছে। মুখোশে তাকে ভয়ঙ্কর দেখানোর কথা। কেন জানি তা দেখাচ্ছে না। বরং হাস্যকর লাগছে। লিলিয়ান শিশুদের মতো চেঁচিয়ে উঠে বলল–এ কী। তুমি?
তাহের মুখোশের আড়াল থেকে হাসতে হাসতে বলল, ইয়েস বিদেশিনী, আমি।
চলে এলে যে?
তোমাকে দেখতে এলাম, তুমি কেমন আছ?
লিলিয়ান ঝলমলে গলায় বলল, খুব খারাপ ছিলাম। এখন আর খারাপ নেই। আমি এখন ভালো আছি। খুব ভালো আছি।
ভালো থাকলে চমৎকার করে কাঁপাচিনো কফি বানাও। প্রচুর ফেনা যেন হয়, এবং জিনিসপত্র গোছগাছ করা শুরু কর।
আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আমরা যাচ্ছি। বাংলাদেশের একটি জেলা নেত্রকোনায়। নেত্রকোনা থেকে নান্দাইল রোড স্টেশন বলে অখ্যাত একটা রেলস্টেশনে। সেখান থেকেও কুড়ি মাইল দূরের অতি দুৰ্গম এক স্থানে। যেখানে আমার পূর্বপুরুষরা বোকার মতো এক বিশাল অট্টালিকা বানিয়েছিলেন। সেই অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে আসব। ঐ অঞ্চলে পৌঁছতে যেসব যানবাহনে আমরা চড়ব সেসব হচ্ছে–প্লেন, রেল, নৌকা, মহিষের গাড়ি, সবশেষে হন্টন।
হান্টন মানে কী?
হন্টন মানে আমি বলব না। বাংলাদেশে যাচ্ছ, কাজেই এখন থেকে কথাবার্তা হবে বাংলায়। তুমি বুঝতে পারলে ভালো কথা, বুঝতে না পারলে নেই।
এত দ্রুত কথা বললে বুঝব কী করে? স্নোলি বলো, আমি সবই বুঝব।
বাংলা এমনই ভাষা যা স্নো বলা যায় না। অতি দ্রুত বলতে হয়। দ্রুত কথা বলা শিখে নাও। আমাদের দেশের লোকজন কাজকর্ম করে টিমাতালে কিন্তু কথা বলে দ্রুত। হা হা হা।