ঢাকায় নেমে বুক ভরে শ্বাস নেয় তন্ময়। ইমিগ্রেশন পার হলে দূর থেকে দেখতে পায় মার্কে। সঙ্গে সখিনা আছে। আহ, অনিমা এখানে থাকলে ছবিটা পূর্ণ হয়ে যেত। আকস্মিকভাবে ওর মন খারাপ হয়। বেরিয়ে এলে সাবিহা বানু ওকে জড়িয়ে ধরে।
মাগো, আজ রাতে তোমার সঙ্গে আমি ঘুমুব। তোমার গন্ধ না নিয়ে আমি ঘুমুতে পারব না।
সত্যি?
একদম সত্যি।
মাকে না বলে পালাবি না তো?
তন্ময় মৃদু হাসে। সাবিহা বানু বলে, পালাতে হবে না। সব ব্যবস্থা ঠিক। টুকটাক কিছু কাজ বাকি আছে।
দিল্লিতে ওয়ার্কশপ?
মাত্র পনেরো দিনের। আমি চাই তুই ঘুরে আয়।
যদি না যাই? অনিমার সঙ্গে দেখা করব না?
মাত্র পনেরো দিন।
ঠিক আছে মা, ঠিক আছে। এই তুই কেমন আছিস সখিনা?
ও ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে বলে, আপনি আমারে এতক্ষণে দেখলেন? আমি কতক্ষণ আপনের দিকে চেয়ে আছি।
আমি তো তোর মাথায় হাত রেখেছি। মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম, বোকা মেয়ে। তোর জন্য একটা সুন্দর পুতুল এনেছি। দেখলে তোর কান্না থেমে যাবে। পাগল মেয়ে, আয়।
পাঁচ দিনের মাথায় ওকে আবার ঢাকা ছাড়তে হলো। আধঘণ্টার মধ্যে এসে পৌঁছাল কলকাতায়।
ট্রলিতে স্যুটকেস ঠেলে বিমানবন্দরের বাইরে এসে দাঁড়াতেই গরম বাতাসের হলকা এসে লাগে চোখে-মুখে–আশপাশে মানুষের ঠেলাঠেলি কিন্তু কোথাও তন্ময়ের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে কাউকে দেখতে পায় না। দময়ন্তীর আসার কথা আছে–আসেনি–হয়তো দেরি হবে আসতে–বেশ কিছুক্ষণ, ট্রলিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে–তারপর ভাবে, একটা ফোন করে দেখা যাক ওর কী হলো–ট্রলি ঠেলে ফোনের কাউন্টারে এগিয়ে যায়, লাইনে দাঁড়াতে হয়–গালের মধ্যে পান ঢুকিয়ে ফোনে চিৎকার করে কথা বলছে লোকেরা–নিজেকে শান্ত করে তন্ময় হায় বাঙালি বলে।
এক সময় লাইন পায়–ফোনের ওপাশ থেকে দময়ন্তী বলে, তোমার তো কাল আসার কথা–ই-মেইলে তুমি একুশ তারিখ লিখেছ–ঠিক আছে অপেক্ষা করো, আমি আসছি। ওকে আর কিছু বলার সুযোগ নেই তন্ময়ের–নিজেই বিস্ময়ে থ–কুড়ির জায়গায় একুশ লিখেছি আমি–নিশ্চয় আমার মগজ ঘোল হয়ে গেছে–নিজের বোকামিতে নিজেকে শাপান্ত করে।
বিমানবন্দরের বাইরে লোকজন তেমন নেই–যারা আছে তারা। গালগল্প করছে–যাত্রীরা যে যার গন্তব্যে উধাও। কতবার এসেছে কলকাতায়–একটা ট্যাক্সি নিয়ে দময়ন্তীর সল্ট লেকের বাড়িতে চলে যেতে পারে–কিন্তু ওকে এ কথা বলারই সুযোগ পায়নি–দুজনেই ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে যায়–ওকে আর এ কথা বলার সুযোগ নেই–নিশ্চয় এতক্ষণে ও বেরিয়ে পড়েছে। এদিক-ওদিক। তাকিয়ে দেখে বসার জায়গা নেই, ট্রলিটা ভরসা–ওটাতে ঠেস দেয়া যায়। একজন ট্যাক্সি-ড্রাইভার এগিয়ে আসে, কোথায় যাবেন দাদা? আমার ট্যাক্সি আছে–বলুন কোথায় যাবেন?
জানি না কোথায় যাব।
জানেন না?
বললাম তো না।
আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?
হ্যাঁ।
তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলুন পৌঁছে দি। কেউ নিতে আসবে আপনাকে?
হ্যাঁ।
ও তাই বলুন। আগে বলবেন তো। আমি শুধু শুধু গ্যাজাচ্ছি।
শুধু শুধু গ্যাজাওনি।
গ্যাজাইনি? ওর দুই ভ্রূ কপালে ওঠে।
না, গ্যাজাওনি। তোমার কথা শুনতে আমার ভালো লাগছিল।
তাই বলুন। আমার বাপ-ঠাকুরদার ভিটা কিন্তু বাংলাদেশের ফরিদপুরে।
এই তোমাদের এক দোষ। বাংলাদেশের কাউকে দেখলে ওই দেশটায় একটা ভিটে আবিষ্কার করে ফেল।
না দাদা, মিথ্যা বলিনি। সত্যি আমার ঠাকুরদাদার ভিটা ছিল। স্বাধীনতার পরে আমি দেখতে গিয়েছিলাম।
ভিটে তো আর তোমাদের নেই।
তা কি আর থাকে! কত বছর পার হয়ে গেল–আমার জন্মের আগে। যাই বলুন দেশটা খুব সুন্দর।
সুন্দর? তুমি সুন্দর দেখেছ?
হ্যাঁ, তাই দেখেছি। খুব সুন্দর।
সুন্দর না ছাই, একটা ডাস্টবিন।
আপনি না কেমন যেন, যাই।
ও হতাশ হয়ে চলে যায়, বিপ্ন দেখায় ওকে এবং আশাভঙ্গের ম্রিয়মাণ ভঙ্গি ওর পায়ের নিচে জমে যায়–তন্ময়ের মনে হয় ওর পা টানতে কষ্ট হচ্ছে–তাকিয়ে থাকে ও–ওকে দেখে–একজন পোড়খাওয়া জীবনসংগ্রামের রাস্তায় তাড়িত যুবক–কালো রঙের ট্যাক্সির দরজা খুলে বাইরে পা রেখে বসে থাকে। একটু পরে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে একটি চিকন কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচায়। তন্ময়ের ভীষণ হাসি পায়–মানুষের বিচিত্র অভ্যেসের সঙ্গে পরিচিত নয় বলে নানা বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে যায়। ছবি তুলবে কি না ভাবে–অল্পক্ষণে একটি মেয়ে কাছে এসে হাত বাড়ায়–ও তখনো ডলার ভাঙায়নি তাই ভারতীয় টাকা ওর কাছে নেই–সে কথা বলতে মেয়েটি ওকে ভেংচি কাটে–শরীরের আকার দেখে মনে হয় তরুণী মেয়ে–উনিশ-কুড়ি বছর হতে পারে–আশ্চর্য, ও রেগে ওঠে না–জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবে?
তাতে তোমার দরকার কী?
ও অন্য পাশে চলে যায়–ভীষণ নোংরা একটা শাড়ি পরে আছে–ব্লাউজটা ছেড়া–পেটিকোটও পায়ের দিকে হেঁড়া–কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ–ব্যাগের পেট ফোলা, কী ঢুকিয়েছে কে জানে–ওর ডান হাত ব্যাগের ভেতরে–আধা খাওয়া একটা পাউরুটি বের করে সেটা চিবুতে থাকে–ওকে তন্ময়ের পাগল মনে হয়নি–পাশ থেকে দশ-বারো বছরের একটি বালক ওকে খ্যাপায়–ওই পাগলি দুধ খাবি?
ও ছেলেটির দিকে তাকায় না। ট্যাক্সিঅলার কাছে গেলে ড্রাইভার পেছনের দরজা খুলে দিলে ও ভেতরে ঢুকে বসে–দরজা খোলা থাকে–হুহু বাতাস ঢোকে সেই পথে–লোকটি মেয়েটির সঙ্গে গল্পে মাতে। তন্ময় ওদের হাত নেড়ে কথা বলার ভঙ্গি দেখে। বছর পাঁচেক আগে দেবাশিষের আমন্ত্রণে কলকাতায় এসেছিল–দমদমের কাছে তাপস আর কল্পনার বাসায় ছিল ব্যবস্থাটা দেবাশিষ করেছিল–খুব ভোরে ফ্লাইট ধরতে হবে বলে বিমানবন্দরের কাছাকাছি থাকা। রাতে কল্পনা বলল, তন্ময় ভোরে আমার বাসায় কাজ করতে যে মেয়েটি আসে ও বাংলাদেশের। খুলনায় বাড়ি, ভোরে তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।
মনে করে দিও কিন্তু, আবার যেন কাজ করে চলে না যায়।
কবে থেকে কাজ করছে?
তিন-চার মাস হবে। বাড়িতে স্বামী আছে, দুই ছেলেমেয়ে আছে। ওদেরকে শাশুড়ির কাছে রেখে কাজ করতে আসে। কিছু উপার্জন করে ফিরে যায়।
কীভাবে আসে? পাসপোর্ট আছে?
ওসবের বালাই নেই। সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আসে। নয়তো কিছু টাকা-পয়সা দেয় হয়তো।
অভাবী মানুষের দেশ নেই কল্পনা। নিজেদের শ্রমটুকু যাদের মূলধন তাদের সামনে দেশের সীমানাও মুছে যায়। ওরা খোঁজে শ্রম বিক্রির বাজার।
তাপস আর কল্পনা মাথা নাড়ে। কল্পনা বাড়তি যোগ করে বলে, ওরা শ্রম দেয় বলে আমরাও নিজেদের কাজে যেতে খানিকটুকু শান্তি পাই। নইলে ঘরের এত কাজ করে অফিসে যেতে টায়ার্ড হয়ে পড়ি।
অনেক রাত জেগে কল্পনা আর তাপসের কণ্ঠে গান শুনে–আচ্ছা দেয়–মাত্র গতকাল ওরা শান্তিনিকেতন থেকে ফিরেছে–সেই প্রসঙ্গে কথা হয়–ভবিষ্যতে ওরা কী ধরনের অনুষ্ঠান করবে তার কথা বলে। তন্ময় বারবার বলে, আমি কিন্তু ওই মহিলার ছবি তুলব। মনে রেখো।
ভোরে ঘুম ভাঙে একটু দেরিতে–তাড়াহুড়ো করে তৈরি হতে থাকে ও। কল্পনার কাজের লোক বাসনকোসন ধুচ্ছে টের পায়–ভাবে, ও নিশ্চয় ওর জন্য অপেক্ষা করবে–একটু পরে কল্পনা এসে বলে, মেয়েটা তোমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলো না।
খানিকটা আহত হয় ও–অপমানিতও–কী হয়েছে ওর–ওর অপরাধটা কোথায়–কল্পনা ওর মনোভাব বুঝতে পেরে বলে, ও তোমাকে ভয় পাচেছ।
কেন?
ওর তো পাসপোর্ট নেই–লুকিয়ে এখানে কাজ করতে এসেছে–তুমি যদি পুলিশকে বলে দাও। তোমাকে বিশ্বাস কি?
তাই তো, আমাকে বিশ্বাস কি–আমি তো ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি কে জানে ও এমন অভিজ্ঞতাই অর্জন করেছে–মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সহযোগিতা না করে বিরুদ্ধাচারণ তো বেশিরভাগ মানুষের স্বভাব–আমি কি এর বাইরে? ও পৃথিবীর দরিদ্রতম ক্ষুদ্র একটি দেশের জনসংখ্যা অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর একজন–এই আঁস্তাকুড়ের মতো ক্ষুদ্র একটি জায়গায় ও তো পায়ের নিচে পিষ্ট মানুষের দলে–ওর কাছে বেঁচে থাকা সত্য–বেঁচে থাকার জন্য ও কাজ খোঁজে–কাজ থেকে টাকা চায়–তা দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করতে চায়–কে জানে ওর পরিবার কেমন, ওর বাচ্চারা পরিত্যক্ত শিশু কি না, স্বামী কাজ খুঁজতে গিয়ে ঢাকা শহরে হারিয়ে গেছে কি না–আমি কে যে ও আমাকে সময় দেবে–ওর সময়ের মূল্য আছে–ভোরবেলাতেই ওকে চার-পাঁচটা বাড়িতে কাজ সারতে হয়। ভিন দেশে কাজ করতে এসে সময় নষ্ট করবে কেন ও–আর অবিশ্বাস? অবিশ্বাস তো করবেই–বিশ্বাসের কোনো ক্ষেত্র তো কেউ ওদের জন্য তৈরি করে না–ওরা নিজের গায়ের জোরটুকু সম্বল করে ফাঁকফোকর খুঁজে বেঁচে থাকার রাস্তা বের করে–সেখানে ওর মতো ক্ষুদ্র মানুষের সঙ্গে দেখা করা সময়ের অপচয়–অর্থহীন নিরন্ন হাহাকারের পালে বাতাস লাগা–হায় পৃথিবী, আমাদেরকে আস্তাবলের বাইরে নিয়ে যাও–বুক ভরে বাতাস টানতে দাও।
পেছন থেকে দময়ন্তী এসে ঘাড়ে হাত রাখে।
তুমি নিশ্চয় আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছ?
তন্ময় ওর দিকে তাকিয়ে বলে, তাই তো মনে হয় দময়ন্তী।
তারিখ ভুল লেখার খেসারত দিলে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে। নিশ্চয় খুব খারাপ লেগেছে?
একটুও না। দাঁড়িয়ে থেকে মানুষ দেখেছি–এই দমদমের কোনো এক বাসার কাজের ঝিকে নিয়ে ভেবেছি। ছবি তোলার কথা ভেবেছি, কিন্তু তোলা হয়নি।
ভারি অদ্ভুত তো! তোমার সময় তাহলে ভালো কেটেছে বলতে পারো।
দারুণ কেটেছে। সময়কে আমি অর্থহীন হতে দেই না।
এই সময়টুকু তোমার কী কাজে লাগবে?
নিঃসন্দেহে কোনো কিছু পরিকল্পনা করার কাজে লাগবে।
দময়ন্তী হো-হো করে হেসে বলে, চলো। তারিখ ভুল করার আরো একটি খেসারত তোমার জন্য আছে।
তুমি আমাকে ঘাবড়ে দিতে পারবে না। বিদেশে যত অ্যাডভেঞ্চার তত মজা। বলো খেসারতটা কী?
এই দুপুরবেলা তোমাকে আমি বাসায় নিয়ে খাওয়াতে পারব না। রেস্টুরেন্টে খেতে হবে।
তথাস্তু। তোমার বাড়ির খাওয়া আমার জন্য তোলা রইল।
শোনো, তুমি তো সন্ধ্যার ফ্লাইটে দিল্লি যাবে। দিল্লি থেকে ফেরার পথে আমার এখানে দুদিন থেকে যেও।
উঁহু, তা হবে না। সময় নেই, আমার দেশে কাজ। অনিমা অপেক্ষা করে আছে।
দময়ন্তী আর তন্ময় ট্রলি ঠেলে ওর গাড়ির কাছে যায়। গাড়ি ও নিজে। চালায়–ড্রাইভার নেই–দুজনে টেনেটুনে স্যুটকেস গাড়িতে তোলে–দময়ন্তী সাদার ওপর কাজ করা চমৎকার একটা শাড়ি পরেছে–গলায় লম্বা মালা–বয়স তো পঞ্চাশের ওপরে–কিন্তু দেখে মনে হয় কম–লম্বায় বেশি না–খানিকটা মটুসটু–ফ্যাটজনিত ত্বকের কারণে মুখে লাবণ্য থির হয়ে আছে। ওর দুই ছেলে আমেরিকায়–কলকাতার ফ্ল্যাটে একা থাকে–বন্ধুবান্ধব অনেক–পুরুষ বন্ধুর সংখ্যা বেশি–বিদেশি স্বামী অনেককাল আগে ওকে ছেড়ে চলে গেছে–সেটা নিয়ে ওর মাতম নেই–বরং বেপরোয়া উন্মাদনায় জীবন উপভোগের তৃষ্ণায় ছটফটানি আছে–সমাজসেবা করে ও তো ভালো আছে–ভালোই থাকবে।
ওরা যে রেস্তোরাঁয় ঢোকে তার নাম নীলাঞ্জনা’।
তন্ময় বলে, নাম দেখেই বুঝতে পারছি প্যানপেনি বাঙালিয়ানার মধ্যে ঢোকালে আমাকে।
ও হালকা কর্তৃত্বের সুরে বলে, বসে পড়ো। আশপাশে আর ভালো রেস্টুরেন্ট নেই। আমারও ক্ষিদে পেয়েছে।
দময়ন্তী দুই চেয়ারঅলা একটি ছোট টেবিল দখল করে। খদ্দের কম নেই–ধুম খাচেছ সব–ভর্তা, ভাজি, ডাল, মাছ এসব পরিবেশ দেখে তন্ময়ের খাওয়া মাথায় ওঠে–দেশের বাইরে ও নিজের দেশের খাবার খেতে চায় না। কী আর করা, চেয়ার টেনে বসে। হঠাৎ করেই ওর লন্ডনের নান্দোস রেস্টুরেন্টের কথা মনে হয়–প্রচুর ঝাল দিয়ে চিকেনের ডিশটা ওর জিভে জল আনে। স্বাদ এমনই যে জিহ্বা পুড়ে গেলেও সেদিকে খেয়ালই থাকে না।
কী খাবে বলো? এই যে মেনু।
তুমি যা খুশি তা অর্ডার দাও। আমার কোনো বাছাবাছি নাই। কারণ খাবারটা আমি খাচ্ছি তোমার পাল্লায় পড়ে–অনুরোধে পেঁকি গেলা আর কি!
দময়ন্তী মৃদু হেসে বলে, তাহলে কলকাতার একটা জিনিস তোমাকে খাওয়াতে পারি, সেটা তুমি পৃথিবীর যত দেশে গেছ সেসব দেশের
কোথাও খাওনি।
স্বাদ কেমন?
খেয়ে বুঝে দেখো। তাহলে অন্যখানে যেতে হবে।
না বাপু, আমি আর লড়ালড়ি করতে পারব না। জিনিসটা কী বলে? দময়ন্তী তন্ময়ের চোখে চোখ রেখে দাঁত কিড়মিড় করে বলে, বিষ।
তন্ময় শব্দ করে হেসে ওঠে। আশাপাশের টেবিলের লোকজন ওদের দিকে তাকায়। তন্ময় ক্ৰক্ষেপ করে না। জোরে জোরেই বলে, মাত্র গতকাল ঘটেছে এমন একটি ঘটনার কথা কি আমি তোমাকে বলব?
দময়ন্তীর কণ্ঠস্বর এবার একটু নরম হয়। আস্তে করে বলে, বলো।
গত কয়েক দিন বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের ফলে ভেসে গেছে বাংলাদেশের অসংখ্য এলাকা–গরিব মানুষের দুর্দশা সীমাহীন–ঘর ড়ুবে গেছে–ঘুমুনোর জায়গা নেই–কাজ নেই তো চাল কেনার পয়সা নেই–রিলিফের কত তোড়জোড় টেলিভিশনের পর্দায়–গুটিকতক মানুষের কাছে পৌঁছে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য–বাকিরা ঠুটো জগন্নাথ–এক ঘঁটে কুড়ানি মা তিনদিন ধরে ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু জোগাড় করতে পারেনি–চৌদ্দ বছরের কিশোরী মেয়েটি মায়ের কাছে ভাত চায়–মা ভাত কোথায় পাবে–ভাত জোগাড় করতে না পারার বেদনার সঙ্গে ওর ক্রোধও আছে বুকের ভেতরে–অক্ষমতার যন্ত্রণা বড় নির্মম–মেয়ে আবার ভাত চাইলে মা বলল, ভাত নাই, বিষ খা।
এই পর্যন্ত বলে তন্ময় চুপ করে যায়। গ্লাসে পানি রেখে গেছে বেয়ারা। ঢকঢকিয়ে এক গ্লাস পানি খায়। টিস্যু দিয়ে মুখ মোছে। দময়ন্তীকে বলে, খাবারের অর্ডার দাও। ও উত্তর দেয় না। আশপাশের টেবিলের লোকেরা ওর দিকে তাকিয়েই আছে। কেউ ভাত খাওয়ায় মনোযোগী নয়। ও বুঝতে পারে যে ওরা পরেরটুকু শুনতে চায়। তখন কাছে দাঁড়িয়ে থাকা রেস্তোরাঁর কিশোর বয়টি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, মেয়েটি কী করল?
রাতে কীটনাশক পান করল। আশপাশের লোকজন হুড়োহুড়ি করে। হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার জানা মরে গেছে।
ছেলেটি দু-হাতে চোখের জল মুছে বলল, আমার বাড়ি সাতক্ষীরায়। আমার নাম গোপাল।
ও তুইও সেই ডাস্টবিন থেকে উঠে এসেছিস গোপাল?
ডাস্টবিন!
চারপাশে গুঞ্জন ওঠে–মানুষেরা পরস্পরের দিকে তাকায়–কেউ ভাত খাওয়ায় মনোযোগী হয়–যাদের খাওয়া শেষ হয়েছে তারা উঠে পড়ে–কেউ বিল দেয়ার জন্য কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে–দময়ন্তী কড়া স্বরে বলে, তুমি এত অসহিষ্ণু কেন? তোমার চিঠি পড়ে এমন মনে হয়নি–চিঠি পড়ে মনে হতো তুমি শান্ত, ধীরস্থির, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও।
তন্ময় দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে–রাস্তায় গাড়ি-ট্রাক লোক চলাচল দেখে–মানুষের মুখচ্ছবিতে স্বদেশের চিত্র ফোটে না–মানুষ বিষণ্ণ এবং ক্লান্ত–গুটি কয়েক ক্ষমতাবান মানুষের হাতে কোটি কোটি মানুষ জিম্মি–মানুষের জীবনের জন্য তাদের কোনো তোয়াক্কা নেই–নিজেদের পকেট বোঝাই হলেই হলো–সেটা ডোনারের টাকাই হোক বা বিদেশ থেকে আসা রিলিফের সামগ্রীই হোক–ওদের ধর্ম লুট করা, ওদের প্রার্থনা বেশি বেশি টাকা কিংবা খাদ্যসামগ্রী আসা, ওদের বিনোদন অস্ত্র এবং মানুষ মারার মহোৎসবে অংশগ্রহণ–আমি অসহিষ্ণু হবো না তো কে হবে–অসহিষ্ণু হওয়ার এত কিছুর মধ্যে বাস করে কেইবা সহিষ্ণু থাকতে পারে–আমি তো নই-ই–কারণ এই জুনে আমি সাতাশ বছর বয়সে দাঁড়িয়েছি। দময়ন্তীর সঙ্গে ইন্টারনেটে পরিচয়–তারপর চিঠি লেখালেখি, পরিচয় অনেক দিনের হলেও ওর সঙ্গে দময়ন্তীর দেখা তো এই প্রথম, ওকে নিয়ে ও যেন আর ব্ৰিত না হয়। দেখতে পায় দময়ন্তী খাবারের অর্ডার দিয়েছে গোপালকে–গোপাল খাবার আনতে যায়। দময়ন্তী ওর দিকে তাকায়।
অভিমানী মেয়েটি এভাবে জীবনের মূল্য দিল?
অভিমানী নয় সাহসী–সাহসের সঙ্গে মৃত্যুকে বরণ করেছে মেয়েটি।
খুব কষ্টের মৃত্যু–দময়ন্তীর কণ্ঠে আফসোস।
মরেছে ভালো হয়েছে–পোকার মতো বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো–বাবা-মা তো যৌন সুখ মেটাতে গিয়ে সন্তান উৎপাদন করে, সে জন্য বেঁচে থাকার দায় না রাখলেইবা কী!
তন্ময়ের কথায় ব্ৰিত হয় দময়ন্তী।তি কণ্ঠে বলে, আজ আমি তোমাকে একটুও বুঝতে পারছি না–চিঠিতে তুমি জীবনের পক্ষে কথা। লিখতে প্রবলভাবে, আশাবাদী মানুষ হিসেবেই তোমাকে আমি চিনেছিলাম। আজ তুমি এমন ক্রুদ্ধ কেন?
ভাত খাও। তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। কতটা রাস্তা গাড়ি চালালে!
গাড়ি চালালেই ক্ষিদে পায় না।
পায়। তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে।
মুখ শুকিয়েছে তোমার কথা শুনে।
দময়ন্তী গম্ভীর হয়ে বলে–ও তন্ময়ের দিকে তাকায় না–তন্ময় বেশ মজা পায়–বিষয়টি উপভোগ করে–মনে হয় আজ যেন ওর উড়াল দেবার দিন–বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ও এক ভীষণ মুক্ত মানুষ–এখানে ওর চারপাশে কেউ নেই যার জন্য ওর দায় আছে–যার কথা ভেবে কষ্ট পাবে–কিংবা তার জন্য খানিকটুকু করার জন্য এক পা এগোবে।
গোপাল ভাত-তরকারি এনে টেবিলে রাখে। দারুণ অর্ডার দিয়েছে দময়ন্তী–কই মাছ, পাবদা মাছ, মুড়িঘন্ট, পটোল ভাজি, বেগুন ভাজি, টক দই–তন্ময় চোখ বড় করে বলে, করেছ কি?
খাও, খেয়ে মাথা ঠান্ডা করো।
আমার মাথা একদম ঠান্ডা–এন্টার্কটিকা মহাদেশের মতো বরফে ঠাসা।
কথা শুনে মনে হয় না। রেগে আছ? তা বলতে পারো। ও বাব্বা, এটা আবার মুখে স্বীকার করছ!
দময়ন্তী কথা না বলে ভাত খায়–প্লেটের দিকে ওর গভীর মনোযোগ–সন্তর্পণে কই মাছের কাঁটা বাছছে।
তুমি কই মাছ পছন্দ করো দময়ন্তী?
ভীষণ। তুমি?
পছন্দ করি, তবে কাঁটাটা বিরক্তিকর। কেউ কাঁটা বেছে দিলে খুশি হই।
বেছে দেব?
উঁহু, এটা বাড়ি না। রেস্তোরাঁয় বসে এসব চলে না। নিজেই বেছে খাব। অসুবিধা হবে না। মাছের সাইজটা বেশ বড়, ভালো লাগছে। খেতে।
এমন সময় গোপাল ছোট একটি বাটিতে একটুখানি আচার নিয়ে এসে তন্ময়ের সামনে রেখে বলে, এটা আপনার জন্য।
কেন, আমার জন্য কেন?
আপনি যে আমার দেশের লোক। আপনাকে আমি আর কী দেব! পারলে তো নেমন্তন্ন করতাম, কিন্তু আমার তো বাড়ি নাই। এই আচারটুকু লুকিয়ে আপনার জন্য নিয়ে এসেছি। খান। খেলে আমি খুব খুশি হবো।
আমার বান্ধবীকে না দিয়ে কি খাওয়া যায়? ওকে দিই?
দিন। দুজনে খান।
গোপাল ওদের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। তন্ময় জিজ্ঞেস করে, কত দিন হয় দেশ থেকে এসেছিস গোপাল?
তিন বছর।
একা এসেছিস?
না, দুই বোনের সঙ্গে।
বাবা-মা কোথায়?
দেশেই আছে। ভিটে-জমি আছে যে। ছেড়ে আসবে কেন?
তোরা এলি কেন?
গোপাল মুখ নিচু করে চুপ করে থাকে।
তন্ময় নরম স্বরে বলে, তোদের কী হয়েছিল গোপাল?
আমার দুবোনকে সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে গিয়ে…
হয়েছে, আর বলতে হবে না। বুঝেছি। ছাড়া পাওয়ার পর বাবা-মা এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে, না?
হ্যাঁ, গোপাল কাঁদকাঁদ কণ্ঠে বলে।
তোদের তাও পালিয়ে আসার জায়গা আছে। আমার নেই। আমি মানে আমার মতো কোটি মানুষ।
তন্ময় গোপালের দেয়া আচার তর্জনি দিয়ে চেটে খায়। মিষ্টি আমের। আচার–চমৎকার বানিয়েছে। জিজ্ঞেস করে, এই তিন বছরে দেশে যাসনি?
না। বোনরা যেতে দেয় না। ওদের ধারণা, আমি গেলে সন্ত্রাসীরা আমাকে মেরে ফেলবে।
যাসনি ভালো করেছিস। ডাস্টবিন থেকে বেরিয়েছিস ঠিক করেছিস।
গোপাল চোখ মুছে বলে, আমার দেশে ফিরতে খুব ইচ্ছে হয়। এখানে আমার পরান টিকে না। আমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর। এসএসসি পাস করে যে পড়তে পারলাম না এজন্য খুব কষ্ট হয়। স্কুলে আমি জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ খুব ভালো গাইতে পারতাম। সব অনুষ্ঠানে–
ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলে গোপাল। কাউন্টারে বসে থাকা ম্যানেজার ছুটে আসে।
ছেলেটা যখন-তখন দেশের কথা মনে করবে আর কাঁদবে। ওকে আমি ফেলতেও পারছি না, গিলতেও পারছি না! আপনি বুঝি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? দেশের লোক দেখলে ওর দুঃখ আরো বেড়ে যায়।
তন্ময় ক্রুদ্ধ কঠে মুখ ভেংচিয়ে বলে, দুঃখ আরো বেড়ে যায়–ন্যাকামি–দুবোন ধর্ষিত হয়েছে, তাতেও হুঁশ হয় না।
হবে কেন? ও তো আপনের চেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক। আয় গোপাল।
দুজনে হনহনিয়ে চলে যায়।
দময়ন্তী অসন্তুষ্ট চোখে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, হলো তো ভালো শিক্ষা পেয়েছ–ওরা কি তোমার তিক্ততা বুঝতে পারবে–আমার সঙ্গে রাগ ঝাড়ছ ঝড়ো–সবখানে ঝেড়ো না–সবার মাথা সূক্ষ্ম নয়।
দময়ন্তী, চলো অন্য কোথাও যাই। কোথায় যাবে?
রাত সাড়ে আটটায় আমার ফ্লাইট–এখনো অনেক সময় হাতে আছে।
চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই–সেখানে গেলে এক জায়গায় অনেক কিছু দেখতে পারবে।
ওরা যখন রেস্তোরাঁ থেকে বের হয় তখন গোপাল এসে সামনে দাঁড়ায়–তন্ময় আগেই দময়ন্তীর কাছ থেকে কয়েকটা টাকা নিয়েছিল ওকে দেবে বলে–টাকাগুলো ওর পকেটে দিয়ে দেয়–ভালো থাকিস গোপাল–অনেক ভালো, খুব ভালো–
দেশ ছাড়া আমি ভালো থাকতে পারি না–বিদেশে বেশি দিন থাকলে আমার পরান পোড়ে–
আবার ওর চোখ জলে ভরে যায়–ওর জন্য তন্ময়ের ভীষণ মায়া হয়।
দময়ন্তী মৃদুস্বরে বলে, তোমাদের দুজনের দুরকম এক্সপ্রেশন–আমার বেশ অভিজ্ঞতা হলো–আমি ভুলব না–গোপাল তোমার মতো বোঝে না বলে রাগে না–কেঁদে ভাসায়–তুমি অনেক কিছু বোঝ বলে রাগ ঝাড়ো।
তোমার এমন পরিস্থিতি হলে তুমি কী করতে?
আমি দুটোই করতাম। কখনো রেগে যেতাম, কখনো কেঁদে ভাসাতাম।
তন্ময় হা-হা করে হেসে বলে, আমিও তাই করি–তোমাকে পেয়ে আমার মনে হয়েছে তুমি আমার রাগ ঝাড়ার জায়গা–চলো কোথায় যাবে বলছিলে।
দময়ন্তী গাড়ি ড্রাইভ করে–পথের দুপাশে বাড়িঘর, মানুষ ছুটে চলার প্রচণ্ড গতি–অকস্মাৎ ও সব কিছু থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে–ওর বমি পায়–কান্না পায়–ওর মাথায় বিতৃষ্ণার ঘূর্ণি জন্মায়–কলকাতা শহর দেখবে না বলে চোখ বোজে।
তোমার খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ। তন্ময় ক্লান্ত কণ্ঠে বলে।
রেস্ট করবে? ঘুমুতে চাও?
ধুত বাজে বকো না। কোথায় যাচ্ছিলে যাও।
তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা–অথচ তুমি এমন ঢঙে কথা বলছ যেন আমাদের হাজার বছরের পরিচয়।
তন্ময় শব্দ করে হাসতে থাকে–ওর কথার উত্তরে কিছু বলে না–ছোটখাটো মটুসটু দময়ন্তী একা থাকে–ওর বেশ কয়েকজন ছেলে বন্ধু আছে–ওদের সঙ্গে আড্ডা হয়–কারও সঙ্গে রাতও কাটায়–কিন্তু ওকে তন্ময়ের ভীষণ বোকা মনে হয়–খানিকটা গ্রাম্যও–যে সূক্ষ্মতা থাকলে কাউকে ও নিজের বিচারের মাত্রার উপরে ওঠাতে পারে দময়ন্তী তেমন নয়–মাত্রার নিচে আধুনিকতার ভান আছে–কিন্তু বোঝে না–তবে ওর সঙ্গে ঘুরে কখনো ওর সরল মাধুর্য ওকে আকৃষ্ট করে। ও অসম বয়সের বন্ধুত্ব উপভোগ করে। এত চিঠি লেখালেখি হয়েছে যে মনেই হয় না এই প্রথম দেখা! শুরু থেকেই চেনা মানুষের মতো আচরণ করছে।
ও তন্ময়কে একটি জায়গায় নিয়ে যায়–কী যেন একটা নাম বলে তা ওর মনে থাকে না–তবে এখানে বিচিত্র জিনিসের সমাহার আছে–পেইন্টিং গ্যালারি–আকারে ছোট–কিন্তু পুরনো পেইন্টিংগুলো অ্যান্টিকের মতো—-কোনোটা আকারে বেশ বড়, নতুন-পুরনো মিলিয়ে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা ছবিগুলো অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দেখে ও–বাইরে চনমনে দুপুর–ভেতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ–বসার জায়গা আছে–চেয়ারগুলোরও অ্যান্টিক চরিত্র–পরিচ্ছন্ন-রুচিশীল। ও দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে বলে, থ্যা দময়ন্তী।
হঠাৎ থ্যাঙ্কু? ও ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
জায়গাটা দারুণ।
যাক তবু একটু প্রশংসা পেলাম। তোমার ই-মেইল পাওয়ার পর থেকেই ঠিক করেছিলাম তোমাকে এখানে নিয়ে আসব।
তুমি সরাসরি এখানে চলে এলেই পারতে। ভাত খাওয়ার দরকার ছিল না।
হো-হো করে হাসে দময়ন্তী–ওকে বেশ আত্মতৃপ্ত দেখায়–এটুকুই ওর গ্রাম্যতা, ওর গ্রাম্যতায় ও বিরক্ত হয়–ওর হাসির শব্দও শুনতে চায় না–বরং গণেশ পাইনের আঁকা বড় ছবিটার সামনে গভীর মনোযোগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে–দারুণ এঁকেছে–একসঙ্গে অনেক মানুষ–একটি গ্রামের হাট–কিন্তু প্রতিটি ফিগারের আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য আর রঙের সংবেদনশীল ব্যবহারে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই–অনেকক্ষণ পর যখন গ্যালারি থেকে বের হয় তখন ভাবে কতবার কলকাতা এলো অথচ কারো কাছেই এই জায়গার কথা শোনেনি–দময়ন্তীর নির্বাচনে ওকে আধুনিক মানুষের খানিকটুকু প্রশংসা দেয়–কিন্তু মুখে আর কিছু বলে না–পাছে ওই উদ্ভট হাসি শুনতে হয়।
জায়গাটার কোনো এক দিক থেকে পপ সংগীতের সুর ভেসে আসছে–সঙ্গে ড্রামের শব্দ–ও নয়েজ পলিউশনে আক্রান্ত মানুষ–তারস্বরে ভেসে আসা কণ্ঠ এবং বাজনার শব্দ ওকে অস্থির করে তোলে–কিন্তু দময়ন্তীকে সে কথা বলার আগে ও তন্ময়কে নিয়ে ছোট একটি দোকানে ঢোকে–মুখোশ, টেরাকোটার খণ্ড, মাটি ও পেতলের মূর্তি, নানা ধরনের ধাতুর গয়না, ছোট আকারের পুরনো পেইন্টিং–কিছু বই ইত্যাদি দিয়ে সাজানো দোকান–বেশ চমৎকার–এমন একটি দোকান ঢাকায় আছে কি না ও জানে না–থাকতেও পারে–পৃথিবীর সব খবর ওর নখদর্পণে থাকবে এটা ভাবার কারণ নেই।
দময়ন্তী বলে, কেমন দোকানটা?
সুন্দর।
কিনবে কিছু?
হ্যাঁ, একটা মুখোশ।
পছন্দ করো।
একটি চিকন লম্বা কাঠের ওপর সারি করে লাগানো ঘোট ঘোট বারোটা মুখোশের একটি পিস ও কেনে। দময়ন্তীকে বলে, এটা দিল্লি হয়ে ঢাকা পর্যন্ত যাবে তো? নাকি টুকরো হয়ে যাবে?
তুমি কীভাবে নেবে তা তোমার ওপর নির্ভর করবে।
তোমার কোনো কায়দা জানা নেই?
আমি দোকানদারকে বলছি ভালো করে প্যাক করে দেয়ার জন্য।
এটা যদি ভেঙে যায় তুমি কিন্তু আমাকে আর একটি কিনে পাঠিও।
পাঠাব। এটা কোনো কঠিন কাজ নয়। আমার মনে হয়েছিল তুমি এমন জিনিসই বেশি পছন্দ করবে।
থ্যাঙ্কু। তন্ময় গম্ভীর হয়ে ওকে ধন্যবাদ জানায়। যেন ওর কাছ থেকে জিনিসটি পেয়েছে এমন ভাব দেখায়। দময়ন্তী সেটি খেয়াল না করেই খুশি হয়। বলে, চলো শাড়ি দেখবে। এখানে বেশ কয়েকটা শাড়ির দোকান আছে, অনিমার জন্য কিনতে পারো।
চলো দেখি। কী ধরনের শাড়ি আছে।
বুটিক শপ দেখতে পারো। সুচের কাজ করা শাড়িও তোমার পছন্দ হবে আমার বিশ্বাস।
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি আমার নাড়ি-নক্ষত্র সবকিছু জেনে বসে আছ। মায়ের জন্য শাড়ি কিনব না?
চলো, শাড়ি দেখার আগে চা খাই।
ছোট্ট একটি চায়ের দোকান–পরিচ্ছন্ন–দু’জনে বেশ আমুদে মেজাজে চেয়ার টেনে বসে–ওখানে বসেই দেখা যায় সামনের গোল চত্বর–মাঝখানে মঞ্চ আছে খোলা মঞ্চ–চারপাশে ছেলেমেয়েরা ভিড় করে আছে–গানের প্রবল শব্দে তন্ময়ের কানে তালা লাগার উপক্রম–কিন্তু পপ গানের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের অনেকে নাচছে–তারুণ্যের উদ্দীপনা দেখতে বেশ লাগে।
ওদেরকে চা সার্ভ করার আগেই একজন ঢোকে–তাকে দেখে দময়ন্তী মৃদু হেসে বলে, এসো। তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার বন্ধু অবনীশ। এ সময়ে আমি ওকে এখানে আসতে বলেছিলাম তোমার সঙ্গে পরিচয় করে দেব বলে।
কেমন লাগল দময়ন্তীকে?
অবনীশ মৃদু হেসে বলে।
কেন এমন প্রশ্ন করলেন?
আপনাদের ই-মেইলে বন্ধুত্ব। কেউ কাউকে তো আগে দেখেননি, তাই।
আপনার কেমন লাগে দময়ন্তীকে?
একজন বন্ধুকে যেমন লাগা উচিত তেমন। নিশ্চয় ভালো লাগে, নইলে তো বন্ধুত্ব টিকত না।
বেয়ারা চা দিয়ে যায়। দময়ন্তী আর এক কাপ দিতে বলে। অবনীশ তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলে, স্যান্ডউইচের অর্ডার দেই?
আমি খেতে পারব না। দুপুরে গাদা গাদা খাওয়া হয়ে গেছে।
দময়ন্তী দারুণ হোস্ট।
বুঝেছি আপনার অভিজ্ঞতা বেশ কড়কড়ে। আপনি ভীষণভাবে আপ্যায়িত হন ওর বাড়িতে, না?
অবনীশ স্মার্টলি বলে, তা হই। স্বীকার করতে কোনো সংকোচ নেই।
তন্ময় পূর্ণ দৃষ্টিতে অবনীশকে দেখে–বেশ লাগে দেখতে–যেমন হলে নারীরা প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয় তেমন চেহারা–নিজেই খানিকটা দুর্বলতা অনুভব করে এবং একই সঙ্গে লজ্জিত নিজেকে বকা দেয় এই ভেবে যে, লাটাইয়ের সুতো ছাড়ার সীমা থাকা উচিত–ও সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
অবনীশ কণ্ঠে কৌতুক নিয়ে বলে, কিছু ভাবছেন?
ও সপ্রতিভভাবে বলে, হ্যাঁ।
কী? অবনীশের কণ্ঠ বেশ ভারী।
ও চুপ করে থাকে–চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দেয়–বেশ স্বস্তি হয়–অবনীশের দিকে তাকায় এবং মুগ্ধতা প্রকাশে দ্বিধা করে না।
আপনার ভাবনার কথা বললেন না?
আপনি কি আমাকে পৌঁছে দিতে এয়ারপোর্টে যাবেন?
সেজন্যই তো এখানে জড়ো হয়েছি। দময়ন্তীর হুকুম।
তাই তো, ও মিনমিন করে।
দময়ন্তী আর অবনীশ হো-হো করে হাসে–ওর ভীষণ ক্রোধ হয়–কিন্তু প্রবলভাবে নিজেকে সংযত রাখে, মনে হয় ও দময়ন্তীকে বোকা-গাছা ভেবেছে–আসলে গাধা ও নিজেই–কারো কারো ছদ্ম আবরণ খুলতে সময় লাগে। দময়ন্তী ছদ্ম আবরণে ঢাকা নারী–ওর কাছে অস্পষ্ট এবং রহস্যময়ী। ও আকস্মিকভাবে বলে, আমার এখন এয়ারপোর্টে চলে যাওয়া উচিত।
তুমি এখনো অনায়াসে আমাদের সঙ্গে আরো এক ঘণ্টা কাটাতে পারো।
বিমানবন্দরে যাই–আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে অনেক সময় বেশ সময় লেগে যায়।
আপনার আর আমাদের সঙ্গ ভালো লাগছে না?
অবনীশ বাঁকা চোখে তাকায়।
আপনি বিগড়ে গেলেন কেন বলুন তো?
বিগড়াইনি তো।
বিগড়াচ্ছ কি না জানি না। তবে তোমার মুড অফ হয়ে গেছে। যাকগে, চলো যাই। ওঠো অবনীশ। তবে মনে রেখো ঢাকায় গেলে আমি আর অবনীশ একসঙ্গে যাব। একই রুমে থাকতে দিও কিন্তু।
থাকবে। তার জন্য আবার অনুরোধ করছ কেন?
শহরটা তো অচেনা।
তাতে কী? তুমি তো জনে জনে বলে বেড়াবে না যে তুমি আর অবনীশ বন্ধু।
যদি বলি?
তাতে অসুবিধে হবে না। বলেছি না ডাস্টবিন। এখানেও নানা কিছু চলে। তোমাদের ভয় নেই অবনীশ এবং দময়ন্তী।
তন্ময় হো-হো করে হাসে–হেসে উড়িয়ে দেয় নিজের ভেতরের নানা অর্বাচীন চিন্তা–এই তো মাত্র গতকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে জবাই করে ফেলে রেখে গেল ধর্ষকরা–বিশ্ববিদ্যালয়ের মালি ওর বাঁচাও বাঁচাও ডাক শুনে তিন দিন পরে ঘন গাছপালার ভেতর থেকে উঠিয়ে এনে হাসপাতালে ভর্তি করে–ধর্ষিত, গলাকাটা মেয়েটি কীভাবে এ ক’দিন বেঁচে ছিল এটা একটি প্রচণ্ড বিস্ময়–ওই অবস্থায় মেয়েটি ধর্ষকদের বিচার চেয়েছে–বিচারের আশায় ও মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে–ও এখন সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আছে।
বিচার! ডাস্টবিনের ভেতরে বাস করা মানুষেরা এভাবেই খুন হয় এবং বিচার পাওয়া কঠিন–প্রায়শ হয়ই না–যে শহরে ওর প্রতিদিনের জীবনযাপন করা–যেখানে বিচার সাধারণ মানুষের বাইরে–যেখানে ধর্ষকরা ক্রমাগত আইনের বাইরে থাকে–সেখানে অবনীশ এবং দময়ন্তী তো মিউচুয়ালি একসঙ্গে একঘরে থাকবে–তারা তো পরস্পরের দায় নিয়ে থাকবে–তার সঙ্গে ধর্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই–তবে কেন ও ওই গার্মেন্টস কারখানার মেয়েটিকে মাথায় নিয়ে দিল্লিতে যাচ্ছে–কারণ দিল্লির শান্তি-সংগঠকরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে–তাদের শান্তি-ভাবনা নারীর জীবন থেকে ছুটে যায়–তারা কোনো দিনই খুঁজে পাবে না সেই গলাকাটা মেয়েটিকে যে বেঁচে থাকার শেষ মুহূর্তে বিচার চেয়েছে। তন্ময় সে কথা ওদের না বলে ওঠার তাড়া দেয়।
চলো যাই।
অবনীশ স্থলিত কণ্ঠে বলে, ট্রেঞ্জ।
তন্ময় ওর দিকে তাকায় না জানে ওর অভিব্যক্তি এমনই–যে কেউই চট করে বলতে পারবে না যে ওর ভেতরে কোথায় কী তোলপাড় হচ্ছে।