০৫. ডুয়েল

ডুয়েল

সামাজিক প্রথা সহজে লোপ পায় না, যুগ যুগ ধরে তা উদ্বর্তিত হয় মানুষের অভ্যাস-আচরণের সঙ্গে। ডুয়েল (duel) এইরকম একটি প্রথা, যার প্রভাব থেকে দীর্ঘকাল ধরে সভ্য মানুষও মুক্ত হতে পারেনি। তার প্রমাণ, ইংরেজরা শিল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক উন্নত হয়েও, উনিশ শতকে প্রথম পর্ব পর্যন্ত নিজেদের দেশে, এবং আমাদের দেশেও, কথায় কথায় মধ্যযুগের বীরপুরুষদের মতন দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন। আঠার শতকের ইংলণ্ড সম্বন্ধে ট্রেভেলিয়ান লিখেছেন :

The drinking and gambling habits of society, and the fierceness of political faction, led to frequent duels of which many ended ill…It was the priviledge of all gentlemen, from a Duke downwards, to wear swords and to murder one another by rule. London and the country capitals were the commonest scenes of such duels as Thackeray has immortalised in Esmond–English social History, ৩১৬

জুয়াখেলা, মদ্যপান, রাজনৈতিক দলাদলি প্রভৃতি বহু বদভ্যাসের সঙ্গে ইংরেজরা এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের অভ্যাসটিকে এদেশে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। অনেকদিন পর্যন্ত তাঁরা অভ্যাসটিকে ছাড়তে পারেননি। এদেশের লোক প্রাচীন মহাকাব্যে, সাহিত্যে ও ইতিহাসে দ্বৈরথ যুদ্ধ ও দ্বন্দ্বযুদ্ধের বিবরণ পাঠ করেছে। মধ্যে মধ্যে বিবাদরত দুই ব্যক্তির মধ্যে হাতাহাতি ও লাঠালাঠি হয়েছে। কিন্তু যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের লক্ষ্য হল ‘to murder one another by rule’, তা তারা কোনোদিন দেখতে বিশেষ অভ্যস্ত ছিল না। ইংরেজরা আসার পর, পিস্তল ও তরবারি নিয়ে ডুয়েল, প্রকাশ্য মাঠে-ময়দানে, তাদের কাছে একটি তাজ্জব ও উপভোগ্য দৃশ্য হয়ে উঠল। ইংলণ্ডে যেমন ‘from a Duke downwards’ সকলের কাছেই ডুয়েল লড়াইটা একটা মস্তবড় বাহাদুরির ব্যাপার ছিল, তেমনি এদেশেও ইংরেজ বড়লাট থেকে আরম্ভ করে সাধারণ টম-ডিক পর্যন্ত সকলে যে-কোনো অজুহাতে ডুয়েলে অবতীর্ণ হওয়াটা রীতিমত সম্মানের ব্যাপার বলে মনে করতেন।

রাজনৈতিক দলাদলি ও ব্যক্তিগত ঈর্ষা-বিদ্বেষের ফলে কলকাতা শহরে যে দু’-একটি ঐতিহাসিক ডুয়েল হয়েছিল, তার মধ্যে ওয়ারেন হেস্টিংস-বনাম-ফিলিপ ফ্রান্সিসের ডুয়েলটি অন্যতম। ইতিহাসের ছাত্ররা সকলেই জানেন হেস্টিংস আমাদের বাংলাদেশের প্রথম গবর্ণর-জেলারেল অর্থাৎ সারা ভারতের নয়, Presidency of Fort William’-এর। তাঁকে প্রথম গবর্ণর-জেনারেল নিযুক্ত করেও, কোম্পানির ডিরেক্টররা তাঁর কৌন্সিলের চারজন সদস্যের উপর সমান কর্তৃত্বের ভার দিয়ে তাঁর ক্ষমতাকে অনেকটা নিয়ন্ত্রিত করেছিলেন। এই চারজন সদস্যের মধ্যে ফ্রান্সিস ছিলেন অন্যতম, এবং গোড়া থেকেই তিনি হেস্টিংসের কার্যকলাপের ও শাসননীতির বিরোধিতা করেছেন। চারজনের মধ্যে ফ্রান্সিস ছাড়া আরও দুজন ছিলেন হেস্টিংস বিরোধী, ক্লোভারিং ও মনসন। একমাত্র রিচার্ড বারওয়েল ছিলেন হেস্টিংসের সমর্থক। সুতরাং কৌন্সিলের সভায় ভোটাভুটির সময় হেস্টিংস প্রায়ই ফ্রান্সিসের কাছে তিন দুই ভোটে পরাজিত হতেন, এবং তার ফলে তাঁর কাজে পদে পদে ব্যাঘাত ঘটত। এই ব্যাঘাত ক্রমে উভয়ের বিরোধ তীব্রতর করে তুলতে থাকে। শোনা যায়, মহারাজা নন্দকুমার ফ্রান্সিস ও তাঁর সমর্থকদের সহযোগিতায় হেস্টিংসের বিরুদ্ধে জাল অভিযোগ-পত্র বোর্ডের কাছে পেশ করেন। মনিবেগম, মহম্মদ রেজা খাঁ ও অন্যান্যদের কাছ থেকে হেস্টিংস উৎকোচ গ্রহণ করেছেন বলে নন্দকুমার অভিযোগ করেন। ১১ মার্চ, ১৭৭৫ ফ্রান্সিস আলোচনার জন্য পত্রটি বোর্ডের সভায় পেশ করেন। দুদিন পরে, তাঁর অভিযোগের সপক্ষে, দলিলপত্রসহ সাক্ষী দিতে প্রস্তুত আছেন বলে নন্দকুমার আর-একখানি চিঠি লেখেন। নন্দকুমারের প্রস্তাবটি ফ্রান্সিস ভোটাধিক্যে পাশ করিয়ে নেবার চেষ্টা করেন। হেস্টিংস কৌন্সিল ‘dissolve’ করে দেন, এবং বারওয়েলসহ সভাকক্ষ ত্যাগ করে চলে যান।

পরে সুপ্রীমকোর্টের বিচারে নন্দকুমারের ফাঁসি হয়। ৫ আগস্ট ১৭৭৫ মহারাজা নন্দকুমার জালিয়াতির অভিযোগে দণ্ডিত হয়ে ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যু বরণ করেন। ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করা হয় কুলিবাজারে ‘within a few paces of Fort William’ বর্তমান হেস্টিংস ব্রিজের উত্তর-পূর্ব কোণে। হাজার হাজার কলকাতার অধিবাসী এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখার জন্য সেদিন গঙ্গাতীরে ভিড় করেছিল, এবং ব্রাহ্মণহত্যার দৃশ্য পাপ মনে করে গঙ্গাস্নানান্তে পবিত্র হয়েছিল। শোনা যায়, এই সময় কলকাতার ব্রাহ্মণরা অপবিত্র শহর ত্যাগ করে, গঙ্গার পশ্চিমতীরে বালি-উত্তরপাড়া অঞ্চলে দলে দলে যাত্রা করেছিলেন।

নন্দকুমারের ফাঁসির পর হেস্টিংসের আরও দু’জন শত্রুর অকস্মাৎ পর পর মৃত্যু হল, মনসন ও ক্লেভারিঙের। মনসনের মৃত্যু হয় ১৭৭৬ সালে, ক্লেভারিঙের ১৭৭৭ সালে। ১৭৮০ সালের শেষে ফ্রান্সিস নিজে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত করেন। কিন্তু তার মাত্র কয়েকমাস আগে তাঁর সঙ্গে হেস্টিংসের একটি নাটকীয় ঘটনা ঘটে যায়। কৌন্সিলের এক সভায় হেস্টিংস তাঁর চিরশত্রু ফ্রান্সিস সম্বন্ধে একটি প্রস্তাব পাঠ করেন, এবং সেটি সরকারি কনসাল্টেশনে রেকর্ড করা হয়। প্রস্তাবটি এই :

I do not trust to Mr. Francis’s promises of candour, convinced that he is incapable of it. I judge of his public conduct by his private, which I have found to be void of truth and honour.

সভা শেষ হলে ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন এবং গবর্ণর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে পাশের একটি নির্জন কক্ষে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাঁর হাতে একটি লিখিত ‘চ্যালেঞ্জ’-পত্র গুঁজে দেন। চ্যালেঞ্জ যে ডুয়েল লড়ার চ্যালেঞ্জ তা বলাই বাহুল্য। আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য হেস্টিংসও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। আলিপুর জেলখানার কাছে হেস্টিংস ও ফ্রান্সিস ৭ আগস্ট ১৭৮০, দ্বন্দ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হন। ফ্রান্সিসের দক্ষিণ অঙ্গে হেস্টিংস তাঁর রিভলভারের গুলি বিদ্ধ করে তাঁকে ধরাশায়ী করেন। ডুয়েলের নিয়মকানুনে হেস্টিংস যে রীতিমত অভ্যস্ত ছিলেন তা বোঝাই যায়, কারণ তা না হলে, তাঁর অসাবধানী গুলিতে ফ্রান্সিসের মৃত্যুও হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি, এবং সেই বছরেরই শেষে ফ্রান্সিস পদত্যাগ করে সশরীরে ইংলণ্ডে ফিরে যান।

হেস্টিংস-ফ্রান্সিসের দ্বন্দ্বযুদ্ধ নানা কারণে ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধিলাভ করেছে। প্রধান কারণ অবশ্য দ্বন্দ্বমান দুই ব্যক্তিই স্বনামধন্য, এবং তাঁদের পারস্পরিক বিরোধও ঐতিহাসিক। এ রকম আর-একজন বিখ্যাত গবর্ণর-জেনারেলের ডুয়েলের কাহিনী ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর নাম জন ম্যকফার্সন। স্যার জন ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় জেমস ব্রাউন সম্বন্ধে এমন একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন, যাতে তিনি অপমানিত বোধ করেন। তারপরেই মেজর সাহেব স্যার জনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেন। ২৮ মার্চ, ১৭৮৮ কোম্পানির ডিরেক্টররা এই দ্বন্দ্বযুদ্ধ সম্বন্ধে তাঁদের ‘ডেসপ্যাচে’ মেজর ব্রাউনকে তিরস্কার করে লেখেন :

Having read and deliberately considered a publication which appeard in the newspapers entitled ‘Narrative relative to the duel between Sir John Macpherson and Major James Browne,’ we came to the following resolution, viz, that the apology required from Sir John Macpherson by Major Brownes shows that the offence taken by Major Browne arose from an act of Sir John Macpherson in his station of Governor-General of Bengal, and not in his private capacity, the paragraph which gave the offence appeared in the Calcutta Gazette, by the authority of the Government, at the head of which he (Sir. John) then was as Governor General of Bengal. That the calling upon any person acting in the character of the Governor-General of Bengal, or Governor of either of the Company’s other Presidencies, or as a Councillor or in any other station, in respect of an official act, in the way Sir John Macpherson has been called upon is highly improper, tends to a subversion of due subordination, may be highly injurious the Company’s service, and ought not to be suffered ; more especially as this Court is ready at all times to hear the complaints, and give redress to any of their servants, who either .wilfully, or by mistake, may have been injured by their superiors.

সামরিক কর্মচারীদের বিশেষ করে, এবং অন্যান্য ইংরেজদেরও, দ্বন্দ্বযুদ্ধের সংবাদ সমসাময়িক পত্রিকায় প্রচুর পাওয়া যায়। মধ্যযুগের রীতি অনুযায়ীও ডুয়েল লড়লে তাতে কারও প্রাণহানি হবার কথা নয়, কেবল জখম হবার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে এসে ইংরেজরা যে ধরনের ডুয়েল লড়তেন, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘fatal’ হত। অর্থাৎ এদেশে আসার পর, মনে হয়, ইংরেজরা বেশ কিছুদিন পর্যন্ত সভ্যতার সদগুণগুলি বিসর্জন দিয়ে আত্মঘাতী রেষারেষি ও হানাহানিতে নিমগ্ন ছিলেন। তাঁদের ব্যক্তিগত ঈর্ষা, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা-কাতরতা ডুয়েলের মধ্যে তাই বীভৎস মূর্তিতে প্রকাশ পেত। ডুয়েলের সংবাদ যা তখনকার পত্রিকায় পাওয়া যায়, তা বেশির ভাগ এই ধরনের ভয়াবহ : ‘Died on Monday evening, Mr. Webb, who was unfortunately wounded in a duel a few days ago’ (ক্যালকাটা গেজেট, ২ সেপ্টেম্বর ১৭৯০)।

ডুয়েল দিন দিন এত বেড়ে যাচ্ছিল এবং তার চেহারাও ক্রমে এত বন্য ও হিংস্র হয়ে উঠছিল, যে তার বিরুদ্ধে একদল ইংরেজ সংবাদপত্র ও পুস্তক-পুস্তিকা মারফত সংগ্রাম আরম্ভ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে যে কেউ কেউ এবিষয়ে বই লিখে প্রচার আরম্ভ করেছিলেন, তা ১৭৯৩ সালের ২৮শে নভেম্বর তারিখের ক্যালকাটা গেজেট পত্রিকায় এই বিজ্ঞাপন দেখে বুঝা যায় :

In a few days will be published ‘Thoughts on duelling’, by a writer in the Honorable Company’s Service, to which will be added, (by another hand),

Observations on suicide and assasination, with a view to ascertain their origin and effect in society; price eight Rupees.

The proceed of the work will be applied to a charitable purpopse, and no greater number printed than shall be subscribed for before the 5th December.

কিন্তু তা সত্ত্বেও ডুয়েল বন্ধ হয়নি। ডুয়েল ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে, এবং দেখা যায় যে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে একজনের ডুয়েলের ফলে প্রাণহানিও হয়। যিনি জয়লাভ করেন, অবশেষে তিনিও খুনের দায়ে জড়িয়ে পড়েন, এবং আদালতের বিচারে অনেক সময় প্রাণদণ্ডেও দণ্ডিত হন। অর্থাৎ ডুয়েলের ফলে শেষ পর্যন্ত দুই বীরেরই মৃত্যু হয়। ৮ ডিসেম্বর ১৮০৮, কলকাতার সুপ্রীমকোর্টে ডুয়েল-বিজয়ী জনৈক সামরিক কর্মচারী খুনের অপরাধে অপরাধ কি না, তা বিচার হয়। বিচারপ্রসঙ্গে জাস্টিস উইলিয়ম বারোজ গ্র্যাণ্ড জুরিকে আহ্বান করে বলেন যে, তাঁর মতে বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী খুনের অপরাধে অপরাধী। তাঁর ভাষণে তিনি প্রসঙ্গত বলেন যে, প্রকৃত সভ্যসমাজে, যে-কোনো কারণেই হোক, ডুয়েল লড়ার কোনো সার্থকতা নেই। অতীতে কোনোকালে হয়ত ব্যক্তিগত শৌর্যবীর্যের প্রকাশ পেত ডুয়েলের মধ্যে। কিন্তু তার কোনো চিহ্ন বর্তমানের ডুয়েল বা তার যোদ্ধাদের মধ্যে নেই। এখন তার বাইরের বীরত্বের খোলসটি মাত্র পড়ে আছে, ভিতরের ষিষ্টতা ও সাহসকিতা দুইই চলে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডুয়েল এখন হিংসাবিদ্বেষপরায়ণ কাপুরুষের বদভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই দেখা যায়, ডুয়েলের শোচনীয় পরিণতি হয় প্রতিদ্বন্দ্বীর মৃত্যুতে। জাষ্টিস বারোজ বলেন :

The practice of Duelling, which has long been a reproach to the superior orders of society, in almost every part of Europe, is I am happy to believe, wearing gradually away. The professed Duellist in this country, I hope, is utterly unknown, and has long been consigned in every other, to all the infamy, which so brutal a character deserves.

এটি ১৮০৮ সালের ঘটনা। এর প্রায় কুড়ি বছর পরেও দেখা যায়, সাময়িক পত্রিকায় ডুয়েলের অনেক মর্মান্তিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এই ধরনের সংবাদ : ‘A most distressing event took place at Barracpore on Saturday last, a young Officer having been shot dead in a duel’ (Calcutta Gazette, 16 July 1829)। এ রকম আরও অনেক ডুয়েলের শোচনীয় সংবাদ ১৮২৯-৩০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হতে থাকে। এ বিষয়ে ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকা এই বলে মন্তব্য করেন :

Such a catastrophe raturally gives rise to painful reflections upon a practice derived from our Gothic ancestors. To dilate upon it here would be as trite as we fear it would be vain-for as long as human nature is what it is, and society is constituted as at present, duels will occur.

পত্রিকার সম্পাদক বলতে চান যে ডুয়েলিঙের অভ্যাসটি তাঁরা তাঁদের গথিক পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পেয়েছেন। এখনও তাঁরা সেই পুরাতন অভ্যাস ছাড়তে পারেন নি, কারণ মানুষের স্বভাব বদলায়নি, এবং সমাজেরও কোনো পরিবর্তন হয় নি। যতদিন তা না হবে, ততদিন ডুয়েলিঙের রীতিও সমাজে প্রচলিত থাকবে।

মানুষের যে স্বভাব ও সমাজের যে অবস্থার কথা এখানে বলা হয়েছে, তা কি রকম? একজন বিখ্যাত লেখক ডুয়েলিঙের প্রতি জার্মান ও ইংরেজদের মনোভাব তুলনা করে বলেছেন যে সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে ডুয়েলিঙের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই, জাতীয় চরিত্রের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তা যদি না থাকত, তা হলে আধুনিক জার্মানি অনেকদিন থেকে আধুনিক ইংলণ্ডের তুলনায় উন্নত হওয়া সত্ত্বেও, সেখানকার সমাজে ডুয়েলিঙের এত প্রবল আধিপত্য কখনই বজায় থাকত না। জার্মানদের চরিত্র অনেক দৃঢ় ও উদ্ধত বলে, সভ্যতার অগ্রগতির মধ্যেও তারা দ্বন্দ্ব যুদ্ধের অভ্যাস ছাড়তে পারে নি। নিজেদের জাতীয় চরিত্রের জন্য একটি প্রাচীন রীতিকে আধুনিক যুগেও তারা আঁকড়ে ধরে রয়েছে।

কিন্তু সত্যিই কি ডুয়েলিং জাতীয় চরিত্রের প্রকাশ, না কোনো বিশেষ সামাজিক শ্রেণিচরিত্রের প্রকাশ? ঐতিহাসিক পোলার্ড বলেছেন যে, ‘duelling is a class, and not a national characteristic’. তিনি বলেছেন যে জার্মানিতে এই প্রথার প্রাদুর্ভাবের কারণ হল দুটি : (১) জার্মান সমাজে একটা অভিজাত আত্মমুখী মনোভাবের দীর্ঘস্থায়িত্ব; (২) জার্মানিতে সুসভ্য ও মার্জিত মধ্যবিত্তশ্রেণি নিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্র বা গণতন্ত্রের অভাব। পোলার্ডের প্রধান বক্তব্য হল যে জার্মান সমাজে উচ্চশ্রেণির মধ্যে একটা মধ্যযুগীয় আভিজাত্যের বোধ দীর্ঘকাল পর্যন্ত জাগ্রত ছিল। আধুনিক যুগে মধ্যবিত্তশ্রেণির বিকাশের ফলে সেই আভিজাত্যের গণতান্ত্রিক রূপায়ণ সম্ভব হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু জার্মানির বিশেষ সামাজিক অবস্থার জন্য তা হয়নি। সেইজন্য জার্মানিতে বহু মধ্যযুগীয় প্রথা ও রীতিনীতি আধুনিক যুগ পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে ছিল দেখা যায়। ডুয়েলিং তার মধ্যে অন্যতম, কারণ মধ্যযুগের ব্যক্তি-যুদ্ধের শেষ রূপ হল একালের ডুয়েলিং।

Its prevalence in Germany is due partly to the rigidity and exclusiveness of the aristocratic sentiment which has not been pervaded and civilised by middle-class opinion, and partly to the fact that no strong central monarchy, based on the middle-class, arose in Germany to deal with feudal turbulence, for duelling is simply the last surviving from of the private war-fare of the Middle Ages.

ইংলণ্ডে মধ্যবিত্তশ্রেণির দ্রুত বিকাশ হয়েছিল বলে ইংরেজরা মধ্যযুগের কুসংস্কারগুলিকে বর্জন করে আধুনিক যুগের চারিত্রিক গুণগুলিকে অর্জন করতে পেরেছিলেন। উচ্চশ্রেণির আভিজাত্যবোধ সেখানে থাকলেও তা সমগ্র সমাজ মানসের উপর তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। পোলার্ডের এই যুক্তি সত্য হলেও, পূর্বের বিবরণ থেকে বোঝা যায়, ইংরেজদের মধ্যেও অনেক মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের প্রাদুর্ভাব ছিল আধুনিক যুগ পর্যন্ত। তার মধ্যে ডুয়েলিং নিশ্চয় অন্যতম। উনিশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত দেখা যায়, পদস্থ ও শিক্ষিত ইংরেজ কর্মচারীরা অনেকে এদেশে সামান্য ব্যক্তিগত কারণে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। নিজেদের দেশে শিল্প-বিপ্লবের পরেও যে তাঁরা এরকম একটি অশোভন ও অসভ্য প্রথার প্রভাব থেকে একেবারে মুক্ত হতে পারেননি, একথা ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়। সত্যিই তখন মনে হয়, সামাজিক প্রথার বা আচারের মৃত্যু হয় না সহজে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *