০৫.
ডং ডং ডোরবেল বাজাচ্ছিল তোয়া। যেন তর সইছে না। দুপুরবেলার কাঁচাঘুমটা ছেড়ে সবিতা উঠে এসে দরজায় ল্যাচটা ঘোরাবে, এটুকু সময় দিতেও বুঝি রাজি নয়। পাল্লা খোলামাত্র সাঁ করে ঢুকে এল অন্দরে, পরমুহূর্তে তির বেগে নিজের ঘরে। ব্যাগখানা ছুড়ল বিছানায়, ঢুকল বাথরুমে। বেরিয়েই চেঁচাচ্ছে, সবিতামাসি, কিছু খেতে দাও। জলদি।
শনিবার স্কুলে টিফিন নেয় না তোয়া। তাই বাড়ি ফিরে খিদে যেন একটু বেশি পায়। সবিতা জানে, সেইভাবে প্রস্তুতও থাকে। গলা তুলে বলল, হচ্ছে হচ্ছে। ময়দা আমার মাখাই আছে। কী বানাব? পরোটা? না লুচি?
যদি কোনওটাই না খাই? চার পিস ফ্রেঞ্চটোস্ট ভেজে দাও না। সঙ্গে হট অ্যান্ড সুইট সস।
যা বলবে।…লুচি নয় ছেলেটাকেই করে দেব। তারও তো আজ শনিবার, ফেরার সময় হল।
ইউনিফর্ম ছেড়ে তোয়া গাঢ় নীল জিনস্খানা পরছিল। জ়িপার টেনে বোতাম আটকাতে আটকাতে আপন মনে হাসল একটু। ওই লুচি-পরোটা সোহমের মতো মফস্সল পার্টির জন্য খুব আইডিয়াল। সবিতামাসির বিশ্রী আলুভাজাটা ফুলকো লুচি দিয়ে নিশ্চয়ই তারিয়ে তারিয়ে খাবে ছেলেটা। তবে বেশি অবশ্য খায় না সোহম। কালই তো রাত্তিরে আর একটু মাটন নেওয়ার জন্য মা বেজায় ঝুলোঝুলি করছিল, দু’হাতে প্রায় থালা ঢেকে রেখেছিল ছেলেটা। সংকোচ? ঢং? নাকি স্টমাকটাই ছোট? কে জানে!
সোহম সম্পর্কে তোয়ার প্রাথমিক বীতরাগটা এখন আর নেই ততটা। সেদিন বিকেলে ফাঁকা ফ্ল্যাটে সেই বুক কাঁপিয়ে দেওয়া দৃশ্যটা তোয়ার বিরক্তিকে কেমন গুলিয়ে দিয়েছে। নিজের অস্তিত্ব সোহমকে সেদিন টের পেতে দেয়নি তোয়া, সরে এসে চুপটি করে শুয়েছিল ঘরে। কেন যেন মনে হচ্ছিল তার সাম্রাজ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসা ছেলেটাকে বোধহয় শত্রু না ভাবলেও চলে। স্বপনপুরীর এই ফ্ল্যাটে ছেলেটা এতটাই একা বোধ করছে যে নিরালায় হু-হু করে কাঁদে। ভাবলেও তো খারাপ লাগে।
তা বলে মা’র হুকুম মাফিক উপযাচক হয়ে ছেলেটার সঙ্গে ভাব জমাবে, এটা তোয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। তবু কী আশ্চর্য, তোয়াই কিনা এগোল!
দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। টিউটোরিয়াল নেই, তোয়া সেদিন স্কুল থেকে সোজা বাড়ি। মুখহাত ধুয়ে তোয়া জলখাবার খেতে যাচ্ছিল, তাকে দেখামাত্র সোহম ডাইনিং টেবিল ছেড়ে ভাগলবা। তোয়ার ভারী আঁতে লেগেছিল। সামলাতে পারল না নিজেকে, হানা দিয়েছে সোহমের ঘরে। সরাসরি আক্রমণ হানল, অ্যাই, টেবল থেকে পালালে যে বড়?
সোহম আমতা আমতা করছিল। কাঁচুমাচু মুখে বলল, না মানে… ভাবলাম…
হেল উইথ ইয়োর ভাবনা। আমি কি অচ্ছুৎ? নাকি মা বাপি না থাকলে আমার সঙ্গে তোমার এক টেবলে বসা মানা?
না না…ছি ছি…এ কী বলছ? আমার ভুল হয়ে গেছে।
বুঝেছ? গুড। আবার তা হলে চলো।
কিন্তু…আমার খাওয়া তো শেষ।
সো হোয়াট? বসে বসে আমার খাওয়া দেখবে। ধরে নাও এটা আমার সঙ্গে মিসবিহেভিয়ারের পানিশমেন্ট।
ছেলেটা সুড়সুড় করে এল বটে, কিন্তু হুতুম প্যাঁচার মতো মুখ করে বসে ছিল। তোয়ার পেটে সোডার বোতলের বুড়বুড়ি, তবু চাপতে হচ্ছে হাসি! সে যে কী প্রাণান্তকর দশা!
সোহমকে আরও ঘাবড়ে দিতে তোয়া হাওয়ায় কথা ভাসাল, ভালই তো প্যাঁ পোঁ পোঁ বাজানো হয়।
জোর চমকেছে সোহম, কে বলল?
কান থাকলেই শোনা যায়।
সোহম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল একটুক্ষণ। তারপর হঠাৎই ফস করে বলে উঠেছে, ভালই তো ছবি তোলা হয়।
পালটা ধাক্কায় তোয়া প্রায় বিষম খাওয়ার জোগাড়, জানলে কী করে?
চোখ থাকলেই দেখা যায়।
তুমি বুঝি আমার ঘরে ঢোকো? তোয়ার চোখ পলকে সরু, আমার জিনিস ঘাঁটো?
ক্যামেরাটা টেবিলে ফেলে রেখে নীচে চলে গিয়েছিলে। এখানে পড়ে থাকতে দেখে…
পারমিশান না নিয়ে অন্যের জিনিসে কি হাত দেওয়া উচিত? বিশেষ করে ক্যামেরা ট্যামেরার মতন পারসোনাল বিলংগিং?
অমন দামি ক্যামেরাও কি যত্রতত্র ফেলে যাওয়া উচিত?
দিব্যি ভাঁজ মেরে কথা বলতে জানে তো ছেলেটা! তোয়া অবাক। এ ছোকরা তো মোটেই গাঁইয়া গোবেচারা নয়, বরং ছুপা রুস্তম বলা যায়। বাপি আর মা’র সামনে পোজ় মেরে থাকে নাকি?
কথাটা মনে হতেই একটা চোরা উল্লাস জেগেছিল তোয়ার। দ্বিতীয় একটা মুখ থাকা ভীষণ জরুরি। তোয়া হাড়ে হাড়ে জানে। মা আর বাপিও কি সব সময় তাদের আসল মুখখানা দেখায়?
যাই হোক, সেদিনের পর থেকে একটা হালকা হালকা বন্ধুত্ব হয়েছে সোহমের সঙ্গে। খুচখাচ কথা বলে মাঝে মাঝে। লঘু মেজাজে।
তোয়া ডাইনিং টেবিলে এসে ঘড়ি দেখল। তিনটে দশ। সোহম এখনও এল না তো আজ? ডানা গজিয়েছে নাকি? হবেও বা।
সবিতা ফ্রেঞ্চটোস্টের প্লেট এনেছে। বোতল থেকে হড়াস করে খানিকটা টোম্যাটো সস ঢেলে দিয়ে বলল, তুমি কি এক্ষুনি বেরোবে?
ইয়েস।
রাত্তিরে তা হলে ফিরছ না?
আজ রাতটা পায়েলদের বাড়িতে কাটানোর কথা তোয়ার। মধুজা আর বিদ্যাও আসবে। কে এক রিলেটিভ মারা গেছে পায়েলের, তার শ্রাদ্ধতে শিলিগুড়ি গেছে পায়েলের বাবা-মা। ফাঁকা বাড়িতে জোর মস্তি হবে আজ।
তোয়া মুখখানা হাসি হাসি করে সবিতাকে বলল, কারেক্ট। কাল একেবারে ব্রেকফাস্ট সেরে ফিরব।
কদ্দূর যাবে? কোথায় তোমার বন্ধুর বাড়ি?
কাছেই। মুকুন্দপুরে। বাস রিকশা মিলিয়ে মিনিট কুড়ি মতো লাগে।
দেখো বাবা, সাবধানে যেয়ো।
জবাব না দিয়ে ছোট্ট করে মুখ বেঁকাল তোয়া। সবিতামাসির দৃঢ় বিশ্বাস কলকাতার পথঘাটে বাঘভালুক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারা সুযোগ পেলেই কচি মেয়েদের গপাগপ গিলে ফেলে। তোয়া যে স্কুলে ক্যারাটে শিখেছে, সবিতামাসির সেটা খেয়ালই থাকে না।
মোবাইল বাজছে। বিছানায় পড়ে আছে ফোনটা। ধরতে দৌড়োল তোয়া।
হ্যাঁ, যা ভেবেছে তাই। মা।
তোয়া গলা ঝাড়ল, বলো।
তুই কি পায়েলদের বাড়ি চলে গেছিস?
না। এবার স্টার্ট করব।
পায়েলের বাবা কি গাড়ি পাঠাচ্ছে?
পায়েলের বাবা-মা যে থাকছে না, তৃষিতাকে জানায়নি তোয়া। সব কিছু বড়দের বলতে হবে কেন? এটুকু স্বাধীনতা তোয়া নিতেই পারে।
তোয়া নিরীহ গলায় বলল, না মা। আমি পায়েলদের বাড়ি চিনি, নিজেই চলে যেতে পারব।
ঠিক আছে। অন্যের বাড়ি গিয়ে ভদ্রসভ্য হয়ে থেকো। তাদের মা-বাবা যেন না ভাবে…
মেয়েকে আমরা শিক্ষা দিইনি। তৃষিতার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিল তোয়া। হালকা বিদ্রূপের সুরে বলল, প্রত্যেকবার স্লিপ ওভারের আগে ওই ডায়ালগটা শুনে শুনে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে মা। মনে থাকবে।
ও প্রান্তে অকস্মাৎ নীরবতা। বেশি রাত জেগো না, তাড়াতাড়ি শুয়ো, নইলে তো কাল এসে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমোবে-সংলাপের এই বাকি অংশগুলো না বলতে পারার জন্য মা খেই হারিয়ে ফেলল নাকি?
তোয়াই জিজ্ঞেস করল, আর কিছু বলার আছে?
হ্যাঁ। তৃষিতার স্বর বাজল আবার, সবিতাকে জানিয়ে দে, আমার ফিরতে একটু রাত হবে। সাড়ে আটটা, ন’টা।
আচ্ছা।
জানতে চাইলি না তো কেন লেট হবে?
কী সিলি কোয়েশ্চেন! একমাত্র মা-বাবারাই যা করতে পারে। মা’র কেন দেরি হবে, সেটা জেনে তোয়া কী করবে?
তোয়া বাঁকা সুরে বলল, বেশ। জানতে চাইলাম। বলো।
ও কী ছিরির ভাষা! তৃষিতার গলায় রীতিমাফিক শাসন, দিনকে দিন তোমার কিন্তু অবনতি হচ্ছে তোয়া।
এই জন্যই তোমার দেরি হবে বুঝি?
না। তৃষিতার গলা চড়েও নেমে গেল, আমি লেকমার্কেট হয়ে ফিরব। তোর দাদুর ব্রঙ্কাইটিসটা বেড়েছে।
স্বাভাবিক। লাংস তো দাদুর অনেককালই ঝরঝরে।
মানুষটা কিন্তু খুব কষ্ট পাচ্ছে রে।… দেখি, কী করা যায়। হসপিটালে ভরতি করতে হয় কি না…
দ্যাখো।
দাদুর সম্পর্কে তেমন মধুর কিছু স্মৃতি নেই তোয়ার। যা বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি কমেন্ট করত তোয়ার বাবাকে নিয়ে! দিদা পযন্ত বলত, তোয়ার সামনে চুপ থাকো, মেয়েটা কষ্ট পাবে। শুনতই না। এখন তো তোয়ার মনে হয়, দাদু বাড়িয়ে বাড়িয়ে নিন্দে করত বাবার। তা ছাড়া দাদু ওসব মন্তব্য করার কে? দাদুর কোন পাকা ধানে বাবা মই দিয়েছে? মা’র সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল, বনিবনা হয়নি, রিলেশন খতম। এ তো বাবা আর মা’র ব্যক্তিগত ব্যাপার। মাঝে দাদু কেন ফোড়ন কাটবে? তোয়া তাও কিছু বলতে পারে, তুমি কোন হরিদাস পাল…? বাবার মতো ভোলেভালা ইনসানকে অকারণে গাল পেড়েছে বলেই না ফুসফুসটা বেশি খারাপ হয়ে গেছে দাদুর!
ফ্রেঞ্চটোস্ট শেষ। দুধও। এবার বেরিয়ে পড়লেই হয়। তেমন কিছু তো নেওয়ার নেই, শুধু ক্যামেরা মোবাইল আর রাতপোশাক। টকাটক ব্যাগে ভরল তোয়া। কাঁধে চাপিয়ে ঝটিতি ফ্ল্যাটের বাইরে।
সামনের ফ্ল্যাটের মিত্রামাসিও লিফটের প্রতীক্ষায় দণ্ডায়মান। তোয়া প্রমাদ গুনল। মহিলা সারাক্ষণ ফুটছে কৌতূহলে। পরশুই তাকে ধরেছিল নীচে। কী বিদঘুটে প্রশ্ন, তোদের ফ্ল্যাটে কে এসেছে রে ছেলেটা? তোর কোনও কাজিন?
কী জবাব দেবে তোয়া? সোহম তার কে হয়, মিত্রামাসির কাছে বিশ্লেষণ করতে যাবেই বা কেন? ভাগ্যিস তক্ষুনি বি ব্লকের শ্বেতা ডাকল, পালিয়ে বাঁচল তোয়া।
আজ কি তোয়া সিঁড়ি ধরে নেমে যাবে? গুটিগুটি পায়ে সেদিকেই এগোচ্ছিল, লিফট এসে গেছে। ভেতরে আরও দু’-চারজন আছে, তার মধ্যেই মিত্রার প্রশ্ন শুরু, কোথায় যাচ্ছিস রে? টিউটোরিয়াল?
হ্যাঁ বলে দিলেই চুকে যেত, কী কুক্ষণে তোয়ার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, না মাসি। বন্ধুর বাড়ি।
ব্যস, সার্চ ইঞ্জিন চালু, স্কুলের বন্ধু?
হ্যাঁ।
বয়ফ্রেন্ড? না গার্লফ্রেন্ড?
পিত্তি জ্বলে গেল তোয়ার। স্কুলের বন্ধু তো বন্ধুই, তার আবার ছেলেমেয়ে কী? এইসব মাঝবয়সি মাসি পিসিগুলো কিছুই কি সাদা চোখে দেখতে শেখেনি? তোয়া কাঠ কাঠ গলায় বলল, আমার ক্লাসমেট।
লিফট পৌঁছেছে একতলায়। পরবর্তী প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে তোয়া পলকে ধাঁ।
বাইরে একটা ধূসর আকাশ। শ্রাবণের শেষ দিকে আবার হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছে, টানা দশ-বারো দিন মেঘ প্রায় কাটছেই না। আজও দুপুরে ঝরেছে এক পশলা, এখনও চারদিক ভিজে ভিজে। হাওয়া প্রায় নেই, যেটুকু যা বইছে তাও জলীয় বাষ্পে ঠাসা। গা-হাত-পা প্যাচপ্যাচ করে সারাক্ষণ।
স্বপনপুরীর মেন গেটে থামল তোয়া। বড্ড জোরে হেঁটে হাঁপাচ্ছে অল্প অল্প। তোয়ালে-রুমাল বার করে মুখ মুছল।
হঠাৎই চোখের মণি স্থির। ঝোপড়পট্টির টি-স্টলটায় কে ও? সোহম না?
তোয়া এক পা এক পা করে কাছে গেল। সোহমের হাতে চায়ের গ্লাস, দৃষ্টি যেন কোন সুদূরে। তোয়া মাত্র ফুট চার-পাঁচ তফাতে, তাকে খেয়ালই করছে না! মুখখানায় কেমন কাঁদোকাঁদো ভাব। সেই মাউথ অরগ্যান বাজানো বিকেলটার মতো। আশ্চর্য, দিব্যি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, পাশ করলে চাকরি তো মিলবেই, বাবার সঙ্গে মিলজুল হয়ে গেছে, এখনও তবে কীসের দুঃখ? কেন সর্বদাই বিষণ্ণ থাকে সোহম?
তোয়া ডেকেই ফেলল, ব্যাপারটা কী? বাড়ি না গিয়ে এখানে বসে চা খাচ্ছ?
মগ্নতা ভেঙেছে সোহমের। তবে তোয়াকে দেখে চমকাল না। মলিন হেসে বলল, এমনিই।
টাইম পাস?…কিন্তু কমপ্লেক্সের কেউ দেখলে যে তোমার বাবার প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে।
তাই?…আমার জন্য তোমার বাপির অনেক মানমর্যাদাই বোধহয় খোওয়াতে হবে।
কেন?
কত টাকা আমার পিছনে খরচা হচ্ছে। ভরতি হতেই তো এক লাখ কুড়ি হাজার পড়ল। তারপর আবার প্রত্যেকটি সেমেস্টারে পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার খসবে।
তো?
কিন্তু আমি কি এর প্রতিদান দিতে পারব?
যাহ্ বাবা, কীসের প্রতিদান? তোয়া ভুরু নাচাল, ঘ্যামচ্যাক একটা রেজাল্ট হাঁকিয়ে দাও, তা হলেই তো তোমার বাবার পয়সা উশুল।
কী সরল সমাধান। সুখী মেয়ের উপযুক্ত পরামর্শই বটে।
আচমকা কথাটা ছুড়ে দিয়ে বেঞ্চি ছেড়ে উঠল সোহম। হনহনিয়ে হাঁটা দিল স্বপনপুরীর দিকে। তোয়া যে পিছনে হতভম্ব মুখে দাঁড়িয়ে, সে বোধটুকুও নেই।
এ কী বিসদৃশ আচরণ? সোহমের হলটা কী?
নিয়ম মতোই জমে উঠেছিল আসর। পায়েলদের দোতলায়। সন্ধের আগে মধুজা আর দিব্যাও হাজির, শুরু হল হাহা-হিহির ফুলঝুরি। এ ওর লেগপুল করছে, খেপে গিয়ে কেউ চেল্লাচ্ছে, কেউ বা আবার দিব্যি হজম করে নিয়ে আক্রমণ শানাচ্ছে পালটা। কোন ম্যাডামের কী মুদ্রাদোষ, কোন কচি স্যার কার পানে টেরিয়ে টেরিয়ে তাকায়, অভিনয় করে দেখাচ্ছে মধুজা, বাকিরা তো হেসে খুন।
তোয়াও হাসছিল। তবে আজ যেন তার গুলতানিতে মন নেই। তোয়াদের এই মেয়েরা মেয়েরা মিলে বন্ধুগৃহে মাসে-দু’মাসে একদিন রাত কাটানোর প্রথাটা ক্লাস টেন থেকেই চালু। তোয়ার বাড়িতেও বন্ধুরা থেকেছে এক-আধবার। এসব সন্ধেয় বেশ উত্তেজিত থাকে তোয়া, হুল্লোড়ও করে প্রাণ ভরে। তার মন খারাপের ব্যামোটা যেন কাছে ঘেঁষতে না পারে, তাই একটু বেশিরকমই হইচই করে। গান চালিয়ে ঝ্যাং ঝ্যাং নাচছে, বিকট জোরে জোরে হাসছে, ক্যামেরায় এলোমেলো ছবি তুলে যাচ্ছে পটাপট…
আজ কেন যেন উৎসাহ পাচ্ছে না তোয়া। সোহম তাকে ওইভাবে কথা শুনিয়ে দিল? তোয়া ভাল ব্যবহার করছে বলে তার সুযোগ নিল ছেলেটা? টাইট দিতে হবে। টাইট দিতে হবে।
তা এমন বিগড়োনো মেজাজ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে অবিরাম সংলাপ চালিয়ে যাওয়া যে কী কষ্টদায়ক! তবু মুখে একটা সিন্থেটিক হাসি টেনে রেখেছে তোয়া, অকারণ মন্তব্য ছাড়ছে টুকটাক। তার মধ্যেই শেষ হল নৈশাহার। পায়েলের ঠাকুমার হাতে আজ আপ্যায়নের ভার। মহিলা তেমন গায়ে পড়া নয়, তবু নাতনির বন্ধুদের পাশে ঘুরঘুর করছিল সারা সন্ধে। তাতে অবশ্য নাতনিদের কাঁচকলা। বাংলা ইংরিজি হিন্দি মিশিয়ে এমন এক সান্ধ্যভাষায় তারা কথা বলে, বোঝে কোন ঠাকুমার সাধ্যি। তবে জ্বলজ্যান্ত একপিস্ বয়স্ক মানুষ কাছাকাছি থাকলে একটু বাধোবাধো তো ঠেকেই। অবশেষে এই খানিক আগে নাতনিদের খাবার দাবার সাজিয়ে, নিজে ঘুমের ওষুধটি খেয়ে শয্যা নিয়েছে মহিলা, এখন মেয়েরা পরিপূর্ণ স্বাধীন। পিৎজ়া আর কোল্ড ড্রিঙ্কসের পর এখন চলছে তাদের চিপস চিবোনোর পালা। ফ্রিজে আইসক্রিমও আছে, রাতে তার সদগতি হবে।
দাঁতে একটা চিপস কেটে দিব্যা বলল, এবার তা হলে সিডিটা চালানো হোক।
মধুজা জিজ্ঞেস করল, কী মুভি রে?
পায়েল মুচকি হাসল, বেসিক ইন্সটিংক্ট, ওয়ান। পুরো আনকাট্।
ও নো! কোথ্থেকে পেলি?
বিপস দিয়েছে। মালটা নাকি ইউ টিউব থেকে ডাউনলোড করছিল।
ঢপ। ওকে কে একটা যেন সাপ্লাই দেয়। নাম বলে না।
বিপাশা আজ এল না কেন রে?
ওর মা খুব প্রবলেম করছে। এক রাত্তির স্লিপওভারে এলে ওর নাকি লেখাপড়ায় ক্ষতি হতে পারে।
মাগুলো রিয়েলি হরিব্ল। এই তো দুপুর থেকে চার বার আমার মা রিং করেছে। কাল যেন অবশ্যই কোচিং-এ যাই, কোনও এক্সকিউজ়ে না কামাই হয়…
আমার মা তো আর এক টাইপ। রাতদিন এক শাসানি। আই আই টিতে যদি চান্স না পাও, তোমার আমি বিয়ে দিয়ে দেব।
আবার হাসির ছররা। হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে মধুজা আর পায়েল। তোয়ার একঘেয়ে লাগছিল। অবিকল ওই সংলাপ কতবার যে শুনল!
একটা আড়মোড়া ভেঙে তোয়া বলল, আমি একটু কম্পিউটারে বসি রে।
সে কী? মুভি দেখবি না?
ইচ্ছে করছে না রে।
দ্যাখ দ্যাখ। দারুণ থ্রিলিং। ভয়ংকর হট। এমন কুল সিরিয়াল কিলার…
আমি স্টোরিটা জানি। তোরা দ্যাখ। আমি বরং একটু ফেসবুক করি।
জো তেরি মর্জি।
উঠে পাশের ছোট্ট ঘরখানায় ঢুকল তোয়া। পায়েলের স্টাডি। বইপত্র যেমন তেমন ছড়ানো সেখানে। টেবিলে কম্পিউটার।
চেয়ার টেনে বসল তোয়া। ফেসবুক নয়, টুইটার খুলেছে। বেশ কয়েকদিন আগে একটা প্রশ্ন ভাসিয়েছিল। এক মায়ের প্রথম পক্ষের মেয়ে এবং সেই মায়েরই দ্বিতীয় পক্ষের স্বামীর প্রথম পক্ষের ছেলে যদি পাশাপাশি বাস করে, তা হলে তাদের মধ্যে কী সম্পর্ক হওয়া উচিত? বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা কি সংগত? নাকি একটা শত্রুতা থাকবে? নাকি কিছুই না? গত সপ্তাহ অবধি শ’দেড়েক জবাব এসেছিল। তিনটেতেই ভোট প্রায় সমান সমান। আজ একবার চেক করল। আরও গোটা ষাটেক উত্তর আছে। কী জ্বালা, ভোটের প্যাটার্নটা তো একই রয়ে গেছে!
তোয়ার ভেতরের চাপা বিরক্তিটা রাগে পরিণত হচ্ছিল ক্রমশ। নিজেকে সামাল দিতে ফেসবুকে চলে গেল। অজস্র পরিচিত অপরিচিতর ভিড়। কাউকে একটা বেছে নিয়ে এতাল বেতাল চ্যাট শুরু করবে?
ভাবনার মাঝেই পায়েলের আবির্ভাব, অ্যাই তোয়া, একটা জিনিস টেস্ট করবি?
কী রে?
হুইস্কি। খাঁটি স্কচ। বাবার বোতলটা পড়ে আছে, একটু করে খেলে বুঝতে পারবে না।
বিপাশার বাড়িতে একদিন চেখেছিল তোয়া। ভাল লাগেনি, এক চুমুক দিয়ে গা গুলিয়ে উঠেছিল।
পায়েল ফের বলল, খাবি তো বল। মধুজাও নিচ্ছে। দারুণ স্মুদ। এক পেগ খেলে মনটা ফুরফুরে হয়ে যাবে।
সত্যিই কি হয় তাই? তোয়া চোখ কুঁচকোল, দে তা হলে। মাথাটা জ্যাম হয়ে আছে, একটু ছাড়ুক।
এক সেকেন্ড।
বলেই পায়েল সাঁ করে উধাও। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরেছে। এক হাতে কাচের গ্লাসে সোনালি তরল, অন্য হাতে ঠান্ডা জলের বোতল। দু’খানাই একসঙ্গে তোয়াকে দিয়ে বলল, বেশি করে জল মিশিয়ে খাস কিন্তু। মুভিতে এক্ষুনি একটা মার্ডার হবে, আমি যাই।
ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখে বসে আছে তোয়া। পলকা দোলাচল। খাবে? না কি খাবে না? দোষের কী আছে, বাপি তো মাঝে মাঝেই খায়। মা’র সামনেই খায়। আর বেশি লক্ষ্মী মেয়ে সেজে থাকার দরকারটাই বা কী!
ফের সোহমের বাক্যগুলো হাতুড়ি কষাল মাথায়। কী উদ্ধত ভঙ্গিতে চলে গেল ছেলেটা! লাগসই একটা জবাব দেওয়ার ফুরসত পর্যন্ত তোয়া পেল না!
জল না ঢেলেই সোনালি তরলটুকু এক ঢোঁকে গলায় চালান করে দিল তোয়া। সঙ্গে সঙ্গে নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। গোটা ঘরখানা যেন দুলে গেল সহসা। আগুন ছুটছে দু’কান দিয়ে। ঝাঁ ঝাঁ করছে মাথা। রক্তচলাচল যেন বেড়ে গেছে।
ঝট করে মোবাইলটা হাতে নিল তোয়া। নম্বর তো আছে, ফোন লাগাবে সোহমকে? সবে তো সাড়ে এগারোটা, ঘুমোয়নি নিশ্চয়ই? শুনিয়ে দেবে সোহমকে, সে গ্রিন সিগনাল দিয়েছে বলেই না সোহম স্থান পেয়েছে ওই বাড়িতে। সমঝে দেওয়া দরকার, যেন তোয়ার সঙ্গে ভেবেচিন্তে কথা বলে! তোয়া সুখী, না সুখী নয়, তার কতটুকু জানে সোহম?
নম্বরটা টিপতে গিয়েও তোয়া থমকাল। অন্য একখানা মুখ যেন থামিয়ে দিল আঙুল। মাউথ অরগ্যান বাজাচ্ছে সোহম, দু’চোখে জলের ধারা! ওফ্, কেন যে এখন…
.
০৬.
অফিসে এসে ল্যাপটপ খুলেই সুখবরটা পেল সিদ্ধার্থ। দিল্লির বনশাল প্রপার্টিজ গুরগাঁওতে চারশো একর জমি নিয়ে একটা মিনি টাউনশিপ গড়তে চায়, ভারত জুড়ে বেশ কিছু আর্কিটেক্ট ফার্মকে তারা নকশা বানাতে দিয়েছিল, শেষমেশ সিদ্ধার্থর কপালেই শিকেটা ছিঁড়েছে। যতীন বনশালের ইচ্ছা অনুযায়ী সামান্য কিছু পরিমার্জন ঘটাতে হবে ডিজ়াইনে, তার জন্য এ সপ্তাহের মধ্যেই একবার দিল্লি ছুটতে হবে সিদ্ধার্থকে। তখনই পেমেন্টও চুকিয়ে দেবে বনশালরা, হাতে হাতে।
স্বচক্ষে বৈদ্যুতিন বার্তাটি দেখেও সিদ্ধার্থ যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। জীবনে এত বড় কাজ তার এই প্রথম। যত্ন নিয়ে, অনেক খেটেখুটে বানিয়েছিল নকশাটা। নিজে গিয়ে দিয়েও এসেছিল জমা। তবে মনে খুব একটা আশা রাখেনি। হাজার রাঘববোয়াল আর হাঙর কুমিরদের বাজারে কলকাতার একটা মাঝারি প্রতিষ্ঠান বাজিমাত করবে, এ যেন অকল্পনীয়। তিন কোটি টাকা দর রেখেছিল সে, তার থেকে মাত্র দশ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট চেয়েছে বনশালরা। অর্থাৎ দু’কোটি সত্তর লক্ষ পাচ্ছেই সিদ্ধার্থ। ভাবলেই বুক ধড়াস ধড়াস। এত বছর পরে সে বোধহয় পুরোপুরি দাঁড়াতে পারল!
সমাচারটা কীভাবে সেলিব্রেট করা যায়? অফিসের লোকদের খাইয়ে দেবে এক্ষুনি? উঁহু, কোনও একটা হোটেলে বড়সড় পার্টি দিতে হবে। তিনজন জুনিয়র আর্কিটেক্ট কাজ করছে তার সংস্থায়। ড্রাফ্টসম্যান, অফিস স্টাফ ছাড়াও একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্টকেও রেখেছে সে। সকলে মিলে টিম ওয়ার্ক করেই না বরাতটা জুটল! কিছু নগদ উপহারও তো এদের প্রাপ্য।
হঠাৎ পুরনো একটা স্বপ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল সিদ্ধার্থর। এই তো সময়, আর কি তর সয়! সঙ্গে সঙ্গে বিভাসকে ফোন। ছোটবেলাকার বন্ধু। এখন রিয়েল এস্টেটের এজেন্ট। আদতে জমিবাড়ির দালাল। তবে কার্ডে ওই পরিচয়টাই লেখে বিভাস।
ওপার থেকে বিভাসের স্বর উড়ে এল, কী রে, খবর কী তোর? কাজটাজ দিচ্ছিস না একদম?
কাজের কথা বলতেই তো ফোন করছি। সিদ্ধার্থ খুশি খুশি গলায় বলল, নরেন্দ্রপুরে একটা বড় ল্যান্ড আছে বলেছিলি না?
আছে তো। প্রায় আট একর। একদম ক্লিয়ার টাইটেল। মালিক স্টেটসে থাকে, আমি বললেই দলিলে সই করে দিয়ে যাবে। বিভাস উৎসুক স্বরে বলল, কোনও ক্লায়েন্ট পেয়েছিস?
আমিই কিনব ভাবছি।
তুতুইই?
ইয়েস। সিদ্ধার্থ দত্ত স্বয়ং। অনেকদিন তো অন্যের জন্য নকশা এঁকে কাটালাম, এবার নিজের জন্য একটা প্রোজেক্ট বানাব।
বহুৎ দাম হেঁকে রেখেছে কিন্তু। বারো কোটি। মেন রোড থেকে এক কিলোমিটার মতো ভেতরে। অত পাবে বলে মনে হয় না। তবু দশের কমে…
নো প্রবলেম। জমি ক’জনের নামে আছে?
ওসব তোকে ভাবতে হবে না। সাইট সরেজমিনে দ্যাখ, সিগনাল দে, তারপর বাকি ভারটা আমার। এক পারসেন্ট আমাকে কিন্তু ছেড়ো বস।
ও-কে। তুই জমির প্ল্যানটা নিয়ে আয়। মহালয়ার দিন তোতে আমাতে ঘুরে আসব।
কবে যাব?
এনি টাইম ইন নেক্সট উইক। শুধু একটা ফোন করে আসিস। আর মাথায় রাখবি, আমি কিন্তু সিরিয়াসলি ইন্টারেস্টেড।
ও-কে বস। বিভাস হাসছে, তুই মাইরি আমায় বোমকে দিয়েছিস। এক লপ্তে দশ কোটি টাকার ল্যান্ড কিনবি…
সবটাই আমি ঢালব কেন? ব্যাঙ্ক ফাইনান্সও নেব।
সে যাই হোক… কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেছিস তুই!
ফোনটা ছেড়ে আপন মনে একটু হাসল সিদ্ধার্থ। হ্যাঁ, অনেকটাই উঠেছে বটে সে। কড়েয়া রোডে একটা ছোট্ট অফিসঘরের সেলামি গুনতে যে সিদ্ধার্থ দত্ত হিমশিম খেয়েছিল এক সময়ে, আজ সেই সিদ্ধার্থ কিনা দশ কোটির জমি কেনার কথা ভাবতে পারছে! সেখানে স্বপ্নের মতো একটা গ্রামীণ শহর বানাবে। আধুনিক বিলাসবহুল কটেজগুলো দেখতে হবে খড়ের আটচালার মতো। আম জাম লিচু কাঁঠালগাছে ভরা থাকবে গোটা অঞ্চলটা। কাটাবে পুকুর, চরবে হাঁস, থাকবে চণ্ডীমণ্ডপ… সব মিলিয়ে ছায়াসুনিবিড় আস্ত একটা বাংলার গ্রাম উঠে আসবে যেন। এরকম একটা ব্যবস্থার বাজারমূল্য কম হবে কি? এন আর আইরা তো লুফে নেবে। নেবেই। আট একর মানে মোটামুটি চারশো আশি কাঠা… যদি দু’কাঠা জমিসহ একশো থেকে একশো পঁচিশখানা কটেজ বানানো যায়… ফেলে ছড়িয়ে, ব্যাঙ্কের সুদ মিটিয়ে, খরচের অন্তত পঁচিশ ভাগ মুনাফা থাকবে। কত হতে পারে পরিমাণটা? পনেরো কোটি? কুড়ি কোটি?
নাহ, সিদ্ধার্থর এবার থামা দরকার। নইলে কল্পনার ফানুস তো উড়তেই থাকবে। সিদ্ধার্থ টান টান হয়ে বসল। ফোনে ডাকল সুনীতকে। সংবাদটা শোনামাত্র তরুণ স্থপতিটি আহ্লাদে আটখানা। তাকে বেশি উচ্ছ্বাসের সুযোগ না দিয়ে হাতে দু’খানা পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিল। অফিসে প্রথম রাউন্ডটা মিষ্টিই চলুক, পরের চিন্তা দিল্লি থেকে ঘুরে আসার পরে।
যেতে গিয়েও দাঁড়িয়েছে সুনীত। একটু ঝুঁকে বলল, স্যার, আজ কি তা হলে আমরা রাজারহাটের সাইট প্ল্যানটা নিয়ে বসব?
সে হবেখন। লেট আওয়ার্সে দেখা যাবে। নাউ গো, অ্যান্ড এনজয় দা মোমেন্ট।
সুনীত চোখের আড়াল হতেই সিদ্ধার্থর হৃৎপিণ্ড চঞ্চল সহসা। এতবড় একটা গ্র্যান্ড নিউজ এখনও তৃষিতাকে জানানো হল না? অথচ তাকেই তো সর্বাগ্রে বলা উচিত ছিল। কেন যে তৃষিতার কথা প্রথমেই মাথাতেই এল না? ন-ন’টা বছর কাটল একসঙ্গে, কেন যে এখনও তৃষিতায় সম্পৃক্ত হতে পারল না সিদ্ধার্থ?
ফোনে প্রাপ্তিযোগের বহর শুনে তৃষিতা যথারীতি পুলকিত। ডগমগ স্বরে বলল, এ তো দারুণ ব্যাপার গো! সিঁড়ির একেবারে মাথায় পৌঁছে গেলে!
সিদ্ধার্থ হাসতে হাসতে বলল, এই সিঁড়ির কোনও মাথা নেই তৃষিতা। স্কাই ইজ দা লিমিট। বড়জোর বলতে পারো, চার-পাঁচটা ধাপ একলাফে চড়লাম।
সেটাই বা কম কী মশাই? তোমার কিন্তু একটা জব্বর ট্রিট দেওয়া উচিত।
সে তো মাইনর ব্যাপার। তাজবেঙ্গলে একদিন নয় যাব সবাই মিলে। লাল্টুটারও একটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে। বলে একটু থামল সিদ্ধার্থ। তারপর গলা ঝেড়ে বলল, আগে বলো তোমার কী চাই?
আমি আবার কী নেব?
শাড়ি? জুয়েলারি? এনি আদার ফ্যান্সি আইটেম?
একটা কাজ করতে পারো। নতুন একখানা গাড়ি কিনে ফেলো।
এটা বদলে ফেলব? সবেমাত্র দু’বছর হয়েছে?
তা কেন। ওটাও থাক। আমার আর ভিড়ে যাতায়াত পোষাচ্ছে না, একটা ড্রাইভার রাখা হোক, আমি গাড়িটা ইউজ করি। দরকারে তোয়ারও কাজে লাগবে। চাইলে সোহমও…
হুঁ। নট এ ব্যাড আইডিয়া। …তোয়াকে কী দেওয়া যায়?
ওকে আবার কেন? ও তো সর্বক্ষণই পাচ্ছে।
সে বললে চলে? আমার একটা কর্তব্য আছে না? …ও তো খুব মিউজ়িক টিউজ়িক শোনে, একটা আইপড পেলে নিশ্চয়ই…
প্রথমে আইপ্যাড, তারপর আইপড? যা তোমার খুশি। তোয়া তো আনন্দে লাফাবে।
সত্যিই তোয়া তেমন আহ্লাদিত হয় কি? কোনও উপহারেই তো আজকাল তেমন ভাবান্তর ঘটে না। ছোটবেলায় তাও বার্বিটার্বি পেলে জড়িয়ে ধরত বাপিকে। এখন যেন কেমন ছাড়া ছাড়া। ব্র্যান্ডেড ড্রেস, ব্র্যান্ডেড জুতো, সবই তো অবহেলাভরে নেয়। একমাত্র আইপ্যাডটা পেয়েই যা একটু… তাও বোধহয় সারাক্ষণের একটা সঙ্গী হয়েছে বলেই…। বরং ওই অয়ন বিশ্বাস নামের হ্যাগার্ডটা একখানা খেলো টিশার্ট কিনে দিলেও এমন সগর্বে দেখায়! চোখের সামনে পরে পরে ঘোরে!
তুৎ, এসব কী আজেবাজে ভাবনা? অয়ন কি তার প্রতিদ্বন্দ্বী? ছোঃ।
মাথা ঝাঁকিয়ে সিদ্ধার্থ বলল, তা হলে তোয়ার জন্য আইপড ফাইনাল তো?
আর সোহম? তাকেও তো তোমার কিছু দেওয়া উচিত।
হ্যাঁ, সে তো বটেই। লাল্টুকে কী দেবে মনে মনে এঁচে ফেলেছে সিদ্ধার্থ। কিন্তু তৃষিতাকে ভাঙল না। কেন যে ভাঙল না, সিদ্ধার্থ নিজেও বুঝি জানে না। কেজো স্বরে বলল, দেখি, কী কেনা যায়।
দেখাদেখির কিছু নেই, অবশ্যই এনো। তৃষিতার স্বর ঝলমল করছে, একটা কথা ভেবে আমার আরও বেশি আনন্দ হচ্ছে।
কী?
আমার সঙ্গে তোমার যখন বিয়ে হয়, কী অবস্থা ছিল তখন তোমার ভাবো। একখানা সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি, পাঁচমিশেলি পাড়ায় একটা আড়াই কামরার ফ্ল্যাট… আর এখন তুমি কোথায়!
সে তো বললামই। অনেকটাই রাইজ করেছি।
তার পিছনে নিশ্চয়ই এক কণা হলেও আমার অবদান আছে? যথাসাধ্য ঠেলেছি তোমায়। ইন্সপায়ার করেছি।
সিদ্ধার্থ হালকা স্বরে বলল, কিন্তু খাটুনিটা আমার একারই গেছে।
বেশ। কৃতিত্বের ভাগ নয় নাই দিলে। এটুকুনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, আমি তোমার পয়মন্ত বউ?
সে আর বলতে। ধড়ে আমার ক’টা মাথা আছে যে অস্বীকার করব?
হাসতে হাসতেই সিদ্ধার্থ বলল বটে, কিন্তু মন থেকে মানতে পারল? ফোনটা রাখার পরও ভাবছিল সিদ্ধার্থ। তৃষিতার এই নিজেকে পয়মন্ত দাবি করার মধ্যে কোনও অপ্রত্যক্ষ উপমার আভাস আছে কি? বর্ণালি কি তবে অপয়া ছিল? সেই দুঃখী শান্ত নিরীহ মেয়েটা তো সিদ্ধার্থর উচ্চাশার চাপেই মরে গেল। মনের ব্যাধি বর্ণালির হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার মূল কারণ তো একাকিত্ব। কী আকুলভাবে সিদ্ধার্থকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল মেয়েটা! বলত, একা একা আমার সময় কাটে না, টিভি দেখতে ইচ্ছে করে না, কারও সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে না, বই খুললে মন বসে না, ঘড়ির কাঁটা বিচ্ছিরিভাবে থেমে থাকে… তুমি কি আর একটু বেশি সময় আমায় দিতে পারো না লক্ষ্মীটি! সিদ্ধার্থ কি তাকে আমল দিয়েছিল? উলটে সিদ্ধার্থর তখন কী চোটপাট! তুমি কী চাও বলো তো? কাজকর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে তোমার শাড়ির আঁচল ধরে বসে থাকি? নিজের মতো করে একটা কোনও আশ্রয় খুঁজে নাও, নয়তো মরো!
আজ স্মরণ করলে সিদ্ধার্থর গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু সিদ্ধার্থ ওই কথাগুলোও উচ্চারণ করেছিল বই কী! আর ওই আশ্রয়ের সন্ধান করতে গিয়েই তো লাল্টু এল বর্ণালির পেটে। লাল্টু হওয়ার পরও যখন বর্ণালির অবসাদের মাত্রা কমল না, তখনও কি সচেতন হয়েছিল সিদ্ধার্থ? একটু সহানুভূতি কি সে দেখাতে পারত না বর্ণালির প্রতি? শুধু দুটো আয়া রেখে দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ? সারাদিনে একটা ফোন পর্যন্ত করত না। আর সেই মেয়েটা, বাড়িতে ছটফট করছে, নিজেই নিজের মতো করে ভয় রচনা করে শিউরে শিউরে উঠছে, আয়াদের কথা শুনছে না, উদভ্রান্তের মতো বারবার ফোন করছে বরকে। জবাবে নরম ভাষা মেলেনি, বরং প্রতিবারই ধমক খেয়েছে সে। উফ্। সেই দিনগুলোর কথা ভাবলেই এখনও…
তারপর সিদ্ধার্থ তো তিতিবিরক্ত হয়ে মেয়েটাকে চালান করে দিল বাপের বাড়ি। বাচ্চা সমেত। এই নিষ্ঠুরতাও কি সিদ্ধার্থর উন্নতির সোপান নয়?
ইদানীং হঠাৎ হঠাৎ একটা প্রশ্ন বড় আলোড়িত করে সিদ্ধার্থকে। কোনটা তার উচিত ছিল? গোটা দিনটা গিলে খাওয়া স্বাধীন ব্যবসায় না নেমে একটা সরকারি চাকরি জোটানো? কোনওরকমে ফাঁকিজুকি মেরে দশটা পাঁচটার দিনগত পাপক্ষয়? তা হলে হয়তো বর্ণালির পিছনে খানিকটা সময় সে দিতে পারত, বেঁচে যেত মেয়েটা। নাকি যে রাস্তা সে বেছে নিয়েছিল, সেটাই সঠিক? প্রথম পথটা ধরে এগোলে কি স্বস্তি পেত সে? আজ এই সাতচল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছে কি অহর্নিশি মনে হত না, সে একজন অসফল মানুষ? তার মেধা আর কর্মশক্তির জোরে সফল হওয়ার ক্ষমতাকে সে স্রেফ অপচয় করল? একটা নগণ্য অকিঞ্চিৎকর জীবনকে টিঁকিয়ে রাখতে গিয়ে?
কিন্তু আজ তা হলে বিবেক কেন খোঁচা দেয় অহরহ? জীবনে কোনটা বড়? সাফল্য? না আপনজনের প্রাণ? সে যদি একজন ছাপোষা গৃহস্থ হয়ে কাটিয়ে দিত, কী এমন ক্ষতি হত পৃথিবীর?
এ মহা জটিল প্রশ্ন। বুঝি এর সমাধানও নেই। তবে তৃষিতাকে পয়মন্ত ভেবে বর্ণালিকে অপয়ার দলে ঠেলে দেওয়া বুঝি সিদ্ধার্থর পক্ষে সম্ভবও নয়।
বরং বর্ণালিই তো পরোক্ষে তার সাফল্যের দরজা খুলে দিয়েছে। মরে গিয়ে।
এক-একটা মৃত্যু মানুষকে বড্ড ঋণী করে দেয়। বর্ণালির কাছেও বুঝি কিছু ঋণ রয়ে গেছে সিদ্ধার্থর। শুধতে হবে। একটা সুযোগ এসেছে অনেক দিন পর। লাল্টুকে যদি ঠিকঠাকভাবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়…। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে লাল্টু নয় চাকরি নাই করল, সিদ্ধার্থ যদি তাকে নিজের প্রতিষ্ঠানে টেনে নেয়…। সিভিলের ডিগ্রিটা তো থাকছেই, বাবার পাশে দাঁড়িয়ে যদি আর্কিটেক্টের কাজকর্মগুলোও শিখে ফেলে লাল্টু… বাপ ছেলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কোথায় না পৌঁছোতে পারে তখন। লাল্টুর ঝকঝকে ভবিষ্যৎ নির্মাণও তো বর্ণালির খানিকটা ধার চোকানো। নয় কি?
সুনীত ঢুকেছে ঘরে। হুড়মুড়িয়ে অফিসের আরও কয়েকজন। সুনীতের হাতে ইয়া এক বাক্স। সিদ্ধার্থকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনি উদ্বোধন করুন স্যর।
আমি আবার কেন। তোমাদের জন্যই আনতে বললাম তো।
তাতে কী আছে? কোরাসে বেজে উঠল সবাই, প্রথম মিষ্টিটা আপনার।
ব্লাডসুগারটা ভাল মতো না ধরিয়ে ছাড়বে না দেখছি। সিদ্ধার্থ হাসতে হাসতে একখানা লাড্ডু তুলে নিল, চটপট এগুলো শেষ করে ফেলো। তারপর এক রাউন্ড কফি। দেন গেট ব্যাক টু ইয়োর ওয়ার্ক।
দঙ্গলটা বেরিয়ে যেতে সিদ্ধার্থ উঠে জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। বন্ধ কাচের ওপারে একফালি আকাশ। বৃষ্টির মেঘ আর নেই, শরতের নিশান হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা পেঁজা তুলো। সিদ্ধার্থর সম্মানেই কি দিনটা আজ এত মধুর? ফেরার পথে আজ কিছু খাবার দাবার নিয়ে গেলে হয়। তৃষিতা আর তোয়ার তো চাইনিজ় পছন্দ। কিন্তু লাল্টু? সে যে কী ভালবাসে বোঝা দায়। নয় নয় করে তিন মাস হয়ে গেল, এখনও যে লাল্টুর কেন এত সংকোচ!
একটা ফোন করবে লাল্টুকে এখন? করলে হয়?
সন্ধের পর থেকে হঠাৎ বেশ গুমোট। বাতাস থেমে গেছে আচমকা। ক’দিন পর আজ রাতে শোওয়ার ঘরের এসি চালিয়েছে তৃষিতা। মাথার ওপর ঘুরছে ফ্যান, একটা মিহি হিমেল ভাব ছড়িয়ে আছে ঘরটায়। একটু বা কৃত্রিম।
খেয়ে উঠে ফের ল্যাপটপখানা নিয়ে বসেছিল সিদ্ধার্থ। খুটখাট করছিল। বন্ধ করে একটা ছোট্ট আড়মোড়া ভেঙে বলল, টিকিটটা করে ফেললাম, বুঝলে। শুক্রবারে।
তৃষিতা নাইট ক্রিম মাখছিল। গ্রীবা হেলিয়ে বলল, কোথাকার?
দিল্লি। সকালের ফ্লাইট। বনশালদের ব্যাপারটা পুরো সেরে না আসতে পারলে শান্তি পাচ্ছি না। শনিবারই অবশ্য ফিরব।
হ্যাঁ বাবা, কাজটা ভালয় ভালয় হয়ে যাক। যদি কোনওভাবে কেঁচে যায়, আমি খুব বেইজ্জত হব।
কেন?
সব্বাইকে বলা হয়ে গেছে যে।
সে কী? কাকে বললে?
যাদের জানানো উচিত। যারা তোমার উন্নতিতে খুশি হয়। গর্বিত হয়। তৃষিতার স্বরে এবার পলকা অনুযোগ, তুমি তো কাউকে ফোনই করো না। মা তো আজ বলেই ফেলল, খবরটা সিদ্ধার্থর মুখ থেকে পেলে আমাদের আরও বেশি আনন্দ হত রে…!
বড়সড় দাঁও মেরেছে বলে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করতে হবে, এ সিদ্ধার্থর স্বভাবে নেই। তবু তরল স্বরে বলল, ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। ও বাড়িতেও একদিন বিরিয়ানি দিয়ে আসব।
আজ যেখান থেকে এনেছ, ওটা কিন্তু বেশ ভাল। সোহমও তো বেশ তৃপ্তি করে খেল।
মনে মনে একটু হাসল সিদ্ধার্থ। সে যে লাল্টুকে তার ইচ্ছেটা জানতে চেয়েছিল, সেটা আর ভাঙল না।
মুখে সিদ্ধার্থ বলল, খানিক দোনামোনায় ছিলাম। সাধারণত চাইনিজ় তো আনি…
ভাল তো, মুখ বদল হল। তোয়াও তো খেল। খায়নি? একটু-আধটু মানিয়ে নিতে জানলে কোনও কিছুই তেমন খারাপ লাগে না।
বলতে বলতে তৃষিতা লাগোয়া বাথরুমে ঢুকেছে। সিদ্ধার্থর মনে হল, তৃষিতা বোধহয় খুব সরলভাবে বলল না কথাটা। লাল্টু যে এ বাড়ির পরিবেশে এখনও নিজেকে সেট করে নিতে পারেনি, সেটাই শোনাল না তো? একটু ঘুরিয়ে?
আজকাল একটা ধন্দ জাগতে শুরু করেছে সিদ্ধার্থর। লাল্টুর কুণ্ঠিত ভাবটা যে এখনও ঘুচছে না, এতে বোধহয় তৃষিতারও খানিকটা ভূমিকা আছে। লাল্টুর আদরযত্ন যে তৃষিতা কম করে, একথা বলা যাবে না। কিন্তু তার পরও তৃষিতাকে মা না ভাবুক, মাতৃসমা কেউ একজন কেন ভাবতে পারছে না লাল্টু? মা মাসি আন্টি কিছুই ডাকে না তৃষিতাকে, কীরকম যেন ভাববাচ্যে কথা বলে। কেন? তৃষিতার ভালবাসার যান্ত্রিক রূপটা কি লাল্টু ধরে ফেলেছে? লাল্টুর সঙ্গে কথা বলার সময়ে তৃষিতার ঠোঁটে হাসি লেগে থাকে সবসময়ে। কিন্তু ওটা যে হাসি নয়, ঠোঁটের একটা বিশেষ ভঙ্গিমা, লাল্টু কি তাও পড়ে ফেলল? মাত্র এই ক’দিনে? সিদ্ধার্থর তো অনেক সময় লেগেছিল। চোখে মুগ্ধতার মায়াকাজল পরা ছিল বলেই হয়তো…
তৃষিতা বেরিয়েছে বাথরুম থেকে। নাইটি পরে। বিছানায় বসে বলল, ও হ্যাঁ, আমি দুর্গাপুরেও ফোন করেছি।
সেখানেও? সিদ্ধার্থ যেন ঝাঁকুনি খেল, কেন?
তুমি তো আজব লোক। কেন বুঝতে চাও না, ছেলের ভাল কিছু হলে বাবা-মা অন্তর থেকে আনন্দ পায়। সেই ছেলে যদি বাবা-মা’র সঙ্গে সম্পর্ক না রাখে, তবুও।
একেবারে রাখি না কে বলল! বিজয়া করতে যাই তো। আমার এত সময় কোথায় যে মাসে মাসে দুর্গাপুর দৌড়োব? তা ছাড়া বাচ্চু তো ওখানে আছেই, তাদের দেখাশোনার তো কোনও সমস্যা নেই।
হতে পারে। তবে তোমার বাবার কথায় মনে হয়, ওঁরা তোমাকে ফিজিকালি এক্সপেক্ট করেন।
তারা নিজেরাও তো এখানে আসতে পারে। দু’জনের কেউই তো অথর্ব নয়। আসলে নিজের ঘাঁটি ছেড়ে তারা নড়বে না, অথচ আশা করবে ছেলে…
চটে যাচ্ছ কেন? কুল। কুল। তৃষিতা কয়েক পলক থামল, আচ্ছা, তোমার ছেলে যে এখানে আছে, সেটাও বাবা-মাকে জানাওনি?
বাচ্চুকে তো বলেছিলাম। সে নিশ্চয়ই বাড়িতে গোপন রাখেনি!
তবু তোমার তরফ থেকে সরাসরি খবরটা যাওয়া উচিত ছিল। তোমার বাবা বলছিলেন, খোকনের ছেলেটাকে তো সেই জন্মের পর দেখেছিলাম… তারপর থেকে তো দূরে দূরে রইল… সেই ছেলে এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে… খোকন যদি তাকে একবার নিয়ে আসত… বাচ্চুর তো দুটোই মেয়ে, সোহমই বংশের একমাত্র পুত্রসন্তান…
সিদ্ধার্থর মাথাগরম হয়ে উঠছিল। এই ধরনের আলগা পিরিতের কথাবার্তা শুনলে ব্রহ্মতালু অবধি জ্বলে যায়। এখন সবাই গলে গলে পড়ছে, ওদিকে যখন সত্যিই দরকার ছিল, লাল্টুর প্রতি দরদটা ছিল কোথায়! সদ্যোজাত লাল্টু আর বর্ণালিকে নিয়ে সিদ্ধার্থর যখন পাগল পাগল দশা, বাবা মাকে কতবার কলকাতায় এসে থাকতে বলেছে। বাবা-মা রাজি হয়নি। ওই পাগল বউয়ের সঙ্গে বাস করা তাদের পক্ষে নাকি সম্ভবই নয়। অথচ বর্ণালির সঙ্গে বিয়েটা বাবা-মাই দিয়েছিল। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে এগিয়েছিল সম্বন্ধটা। দমদমে এক পিসির বাড়িতে এনে দেখানো হয়েছিল বর্ণালিকে। সেই মেয়ের যখন মানসিক রোগ ধরা পড়ল, কোনও দায়ই নিল না সিদ্ধার্থর বাবা-মা। যদি তারা তখন কলকাতায় এসে থাকত, তাদের স্নেহ ভালবাসার ছত্রছায়ায় বর্ণালি তো সুস্থও হয়ে যেতে পারত!
সিদ্ধার্থ গোমড়া গলায় বলল, ছাড়ো তো। এতকাল যখন নাতিকে না দেখে তাদের চলে গেছে…
ও কী কথা? নয় একবার গেলেই ছেলেকে নিয়ে।
সরি। যার প্রাণ কাঁদবে, সে এসে দেখে যাক।
সোহমকে একবার জিজ্ঞেস করো না। তার তো দাদু-ঠাকুমাকে দেখার ইচ্ছে থাকতে পারে। হয়তো দেখবে তাদের সঙ্গে সোহমের পটে গেছে।
লাল্টুর সঙ্গে সম্পর্ক পাতানো অত সোজা নয়। লাল্টুর বাবাই এখনও পেরে উঠল না। কথাটা মনে এলেও বলল না সিদ্ধার্থ। ল্যাপটপ বিছানা থেকে তুলে রাখল টেবিলে। ড্রয়ার থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করল। লাইটারও। কাজ ছাড়া তার কোনও নেশা নেই, মদের মতো সিগারেটও সে কালেভদ্রে খায়। মাথাটা হঠাৎ কেমন ভার হয়ে গেছে, বুঝি নিকোটিনই এর সেরা উপশম।
ব্যালকনিতে এসে সিগারেট ধরাল সিদ্ধার্থ। বসেছে বেতচেয়ারে। নীচে তাকালেই বাইপাস। চলন্ত গাড়ির হেডলাইট আর পথবাতি রাস্তাটাকে মালার মতো সাজিয়ে রেখেছে। ওপারে অন্ধকারে ঘরবাড়ির ফুটকি ফুটকি আলো। আঁধার আর আলোর মিশেলে রাতটাকে এখন ভারী মায়াবী লাগে। নাকি রহস্যময়ী?
এসির ঠান্ডা থেকে বেরিয়ে হাওয়াটা একটু গরমই লাগছিল সিদ্ধার্থর। সয়েও এল দ্রুত। লাইটার হাতে নিয়ে জ্বালাচ্ছে, নেভাচ্ছে।
বর্ণালির শোচনীয় মৃত্যুর সংবাদটা পেয়ে সিদ্ধার্থ ছুটে গিয়েছিল কৃষ্ণনগরে। তখন লাল্টু পাঁচ কি ছয়। তারপর বেশ কয়েক বছর সিদ্ধার্থ আর কৃষ্ণনগরে পা রাখেনি। যাওয়ার মুখ ছিল না। মনের জোরও ছিল কি? শ্বশুরমশাই মারা যাওয়ার খবর পেয়ে আবার যখন অনেক সাহস সঞ্চয় করে কৃষ্ণনগরে গেল, তখন লাল্টু ক্লাস ফাইভে পড়ছে। ছেলের সঙ্গে আবার আলাপ জমল বটে, কিন্তু লাল্টু খুব কাছে এল কি? কত বছর ধরে চেষ্টা করছে, ব্যবধান একটা রয়েই গেল। ঠিক কী করলে যে সে বাবা হয়ে উঠতে পারবে লাল্টুর? তোয়ারও তো বাপি হয়ে রয়ে গেছে সে, বাবা হতে পারল কই! কোথায় খামতি আছে সিদ্ধার্থর?
তৃষিতা দরজা থেকে ডাকছে, কী গো, শোবে না?
সিদ্ধার্থ চটিতে চেপে সিগারেটটা নেভাল, হ্যাঁ, চলো।
ঘরে নীলাভ রাতবাতি। সিদ্ধার্থ বালিশে মাথা রাখল। চোখটা সবে বুজেছে, পাশ থেকে তৃষিতার গলা, অ্যাই, একটা কথা মাথায় এসেছে, বুঝলে।
কী?
তোয়ার তো কামিং ইয়ারে টুয়েলভ। জয়েন্টেও বসবে। ওকে আর্কিটেকচার পড়ালে কেমন হয়?
কেন? সিদ্ধার্থর স্নায়ু টানটান, ও কি আর্কিটেকচারে ইন্টারেস্টেড?
ও কী বোঝে? ভাবছিলাম… যদি পড়ে… তোয়া আর সোহম দু’দিক দিয়ে তোমার ব্যাবসাটা ধরে রাখতে পারবে। আইডিয়াটা খারাপ, কী বলো?
প্রস্তাবটা অবাস্তব নয়। কিন্তু কেন যেন পরিপাক করতে পারছিল না সিদ্ধার্থ। কেন যে পারছে না? কেন যে হঠাৎ অসহ্য লাগছে তৃষিতাকে?
.
০৭.
স্নান সেরে গামছায় মাথা মুছতে মুছতে কলতলা থেকে বেরোল লাল্টু। হ্যাঁ, তার কৃষ্ণনগরের মামারবাড়িতে স্নানঘরকে এখনও কলতলাই বলে। স্বপনপুরীর মতো টয়লেট নয়। চৌবাচ্চাওয়ালা টিনের দরজা লাগানো শেওলা জমে পিছল হয়ে থাকা অন্ধকার অন্ধকার ঘরখানাকে বুঝি সাহেবি নাম মানায়ও না। বরং দিশি কলতলা শব্দটা অনেক লাগসই। মিউনিসিপ্যালিটির জল আসার কলটা ওখানে আছে যে!
উঠোনের দড়িতে লাল্টু মেলে দিল গামছাটা। হেলেদুলে ঘরে যাচ্ছিল, মোবাইলের আওয়াজ পেয়ে দৌড়োল। তক্তপোশে পড়ে আছে মোবাইল, হাতে তুলে মনিটরে তাকাতেই চমক। মেঘনা! আজ সকাল থেকে এ ভারী মজা হয়েছে তো, একের পর এক সহপাঠীর ফোন আসছে! পুজোর ছুটিটা যে ফুরিয়ে এল, জানান দেওয়ার জন্যে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যেন।
লাল্টু ফোনটা কানে চাপল, শুভ বিজয়া। আছিস কেমন?
এঁহ, শুভ বিজয়া! মেঘনা প্রায় ভেংচে উঠল, আমি না রিং করলে তো বলতিসই না।
কলেজ খুললে বলতাম। পরশুই তো যাচ্ছি।
তুই কিন্তু ব্যাপক আনসোশাল আছিস। গোটা ছুটিতে একবারও তো ফোন করলি না! চুটিয়ে মস্তি করছিস বুঝি?
ফূর্তি মস্তি কোনওটাই তো আসে না লাল্টুর। তবে একথা মানতেই হবে, কৃষ্ণনগরে বেশ আনন্দেই আছে সে। কলকাতা, বিশেষত স্বপনপুরীর ফ্ল্যাটে, বাস মানেই একটা মানসিক চাপ, অন্তত সেটা তো নেই। দিব্য একটা মুক্তির অনুভূতি উপভোগ করছে তারিয়ে তারিয়ে। ডাঙায় হাঁসফাঁস করতে থাকা মাছকে জলে ছেড়ে দিলে যেমনটা হয় আর কী।
লাল্টু হেসে বলল, ওই …কেটে গেল। তোর কেমন কাটল?
ঝিংচ্যাক। দু’দিন হোল নাইট বেরিয়েছিলাম। …দেবাঞ্জন তোকে আজ ফোন করেছিল?
হ্যাঁ। বিষাণও।
কিছু বলল ওরা?
না তো। শুধু জিজ্ঞেস করল পরশুদিন যাচ্ছি কিনা।
শোন…পরশু আমরা ফার্স্ট ইয়ার সিভিলরা একসঙ্গে বসব। বিজয়া সম্মিলনী গোছের কিছু একটা করতে হবে। প্রোগ্রামটা ওইদিনই ফাইনালাইজ় হয়ে যাবে।
কী ধরনের প্রোগ্রাম?
এনিথিং। আমরা দলবেঁধে কোথাও একটা যেতে পারি। কিংবা একসঙ্গে ফিস্ট মতো করলাম। সঙ্গে নাচাগানা…। মাথায় রাখিস কিন্তু। ছাড়ছি। দেখি আর কাকে কাকে এখন ধরা যায়।
লাল্টুর ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠল। না, তার নিস্তার নেই, কলকাতা ফের ঢুকে পড়ছে মগজে। অবশ্য দশমীর পর থেকেই কলকাতাকে মাথায় রাখতে হয়েছে। বাবাকে তো প্রণাম জানাতেই হয়, সঙ্গে ওই ‘স্নেহময়ী’ মহিলাটিকেও। একবার মনে হয়েছিল, তোয়াকেও করে ফোন, পরে নিজেকে নিরস্ত করল। মেয়েটা বড্ড দেমাকি। প্রথম প্রথম অত বোঝা যায়নি, তারপর ক্রমশ তার আচরণটা ফুটে বেরোতে শুরু করল। এখন এমন একটা হাবভাব করে, যেন লাল্টু ওই ফ্ল্যাটে আরশোলা টিকটিকিদের সমগোত্রীয়। যা তার প্রাপ্য নয়, তাও যদি জুটে যায়, তা হলেই এই ধরনের মনোভাব গড়ে ওঠে বোধহয়। তলিয়ে দেখার ক্ষমতা থাকলে বুঝতে, লাল্টুর হকের পাওনাই ভোগ করছে সে। অবশ্য লাল্টুর তাতে কিছু যায় আসে না। তার কোনও দাবিটাবি নেই। বাবার কাছে সে কিছু চাইবেও না কোনওদিন। যেটুকু যা করেছে, বা করছে, তাতেই না লাল্টুর আত্মায় কালি পড়ে যাওয়ার জোগাড়। দুম করে একটা ল্যাপটপ কিনে দিল লাল্টুকে, কোনও মানে হয়!
কাবুল চেঁচাচ্ছে, লাল্টুদা, ভাত তো জুড়িয়ে গেল। চলে এসো।
ঝটপট চুল আঁচড়ে ভেতরবারান্দার খাওয়ার টেবিলে এল লাল্টু। বসতে বসতে থালায় চোখ পড়েছে। উজ্জ্বল মুখে বলল, আইব্বাস! আজ পোস্ত?
কাবুল ফুট কাটল, কলাইয়ের ডালও আছে। তোমার ফেভারিট বলে ঠাম্মা নিজে রাঁধল।
তা হলে তো আজ ডবল ভাত খেতে হবে। ছোটমামি, গন্ধলেবু দিয়ে যাও তো।
বিনতা টেবিলের এক ধারে বসে। দুই নাতির খাওয়া পর্যবেক্ষণ করছে। ঈষৎ তোবড়ানো গালে অল্প হাসি, তোদের কলকাতার বাড়িতে এসব পোস্ত টোস্ত হয় না, না রে?
ওফ দিদা, তোমায় নিয়ে আর পারা যায় না। লাল্টু হেসে ফেলল, লাউ কুমড়ো ঝিঙে পটল সবই রান্না হয় ওখানে। তবে তোমার মতো স্বাদের হয় না। সবিতামাসি রাঁধে তো, সে শুধু গাদাগুচ্ছের তেলমশলা দেয়। তার নুন-চিনিরও তেমন আন্দাজ নেই।
তবে তোর খেতে খুব কষ্ট হয়, বল?
প্রথম প্রথম একটু প্রবলেম হত। এখন জিভ অভ্যেস করে ফেলেছে।
তোর সৎমা কিছু রাঁধে টাধে না?
স্বপ্না দু’টুকরো গন্ধলেবু দু’জনের পাতে রাখছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে বিনতাকে বলল, মাথাটা আপনার একেবারেই গেছে মা। লাল্টু অন্তত বিশবার বলেছে, সে চাকরি বাকরি করে, দস্তুরমতো একটা অফিস চালায়, …আমার মতো গাঁয়ের স্কুলের দিদিমণি তো নয়… হেঁশেলে ঢোকার তার সময় কোথায়!
লাল্টু অপ্রস্তুত স্বরে বলল, না না, বলেছি তো ছুটিছাটায় উনি রাঁধেন। দুটো একটা শৌখিন পদ। এই তো মহালয়ার দিন পোলাও বানিয়েছিলেন। বেশ হয়েছিল খেতে।
তৃষিতা প্রসঙ্গে বিনতাকে সন্তুষ্ট করা কঠিন। যথারীতি খুঁতখুঁতে গলায় বলল, রোজকার রান্নাবান্নাটা কিন্তু বাড়ির গিন্নিরই কাজ।
এ বাড়ির সঙ্গে স্বপনপুরীর ফ্ল্যাটের মানসিকতা একেবারেই মিলবে না, লাল্টু জানে। কথার মোড় ঘোরাতে স্বপ্নাকে বলল, ছোটমামা বড়মামা খেতে বসল না যে?
এই বাড়ির রীতি জানো না? তারা তাদের সময়ে আসবে।
আজ তো শনিবার। বড়মামার তো দোকান বন্ধ!
বন্ধ বলেই তো…। স্বপ্না মুখভঙ্গি করল, যাক গে, আমার আর শরীর চলছে না, চাট্টি মুখে দিয়ে এবার শুয়ে পড়ব। দিদি ওদের ভাত বেড়ে দেবে।
লাল্টুর মাতুলালয়ে একান্নবর্তী ব্যবস্থাটা এখনও টিঁকে। নানা সূক্ষ্ম রেষারেষি সত্ত্বেও। হয়তো মাথার ওপর এখনও বিনতা বেঁচে আছে বলেই। যৌথ ব্যাপারটা ভালই লাগে লাল্টুর। বাড়িটাকে ভারী জ্যান্ত মনে হয়।
খাওয়া শেষ করে লাল্টু ঘরে এল। নামেই তার ঘর, আসলে এটা এখন কাবুলের অধিকারে। তক্তপোশখানা চওড়া বলে লাল্টু কৃষ্ণনগরে এলে দু’জনকে দিব্যি ধরে যায়। এখন অবশ্য কাবুল ঘরে ভিড়বে না, ক্রিকেট খেলতে বেরোবে নির্ঘাত। ছুটি তো ফুরিয়েই এল, লাল্টু এখন একটা ঘুম দিলে কেমন হয়!
শুতে গিয়ে হঠাৎ মাথায় চিড়িক। বিষাণের কয়েন জমানোর নেশা। একদিন গল্পচ্ছলে লাল্টু বলেছিল, তাদের বাড়িতেও প্রাচীন কয়েকটা মুদ্রা আছে। বিষাণ দেখতে চেয়েছিল, সকালে একবার কথাটা স্মরণও করিয়ে দিয়েছে… খুঁজে দেখবে এখন? ভরে রাখবে ব্যাগে?
উঠে তাকটাকগুলো ঘাঁটল লাল্টু। এ ঘরটা একসময়ে তার মা’র ছিল, এখনও সর্বত্র তার স্মৃতি মাখামাখি। ছুঁলেই মনটা উদাস হয়ে যায় লাল্টুর। কিন্তু কয়েনগুলো তো তাকে নেই। অন্য কোথাও নিয়ে গেল কেউ? বড়মামার ঘরে টরে?
কী মনে করে লাল্টু খাটের তলা থেকে ট্রাঙ্কখানা বার করল। অনেক হাবিজাবি জিনিস ট্রাঙ্কে ঢোকানো থাকে, এতে নেই তো?
ডালা খুলতেই একটা প্রাচীন গন্ধ। কোনও মুদ্রার নয়, পিঁজে যাওয়া বেনারসির। কাঁপা কাঁপা হাতে শাড়িটা সরাল লাল্টু। ঘাঁটছে ভেতরটা। উঁহু, কোথায় কয়েন? একটা পেটমোটা খাম বেরিয়ে এল। অনেকবার দেখা ছবি, তবু লাল্টু খাম থেকে ফের বের করেছে ফটোগুলো। বাবা-মা’র বিয়ের। মেঝেয় বসে লাল্টু দেখছে নিবিষ্ট চোখে। আটপৌরে ছবিও আছে কয়েকটা। মা’র কোলে লাল্টু, দাদু-দিদার সঙ্গে লাল্টু…। একটা ফটোয় দৃষ্টি স্থির হল। মা ভাত খাওয়াচ্ছে লাল্টুকে, পরনে সেই ডুরে শাড়িটা…! এই শাড়িটা পরেই না আত্মহত্যা করেছিল মা?
নেহাইয়ের ঘা পড়ল লাল্টুর মাথায়। ভয়ংকর সেই দৃশ্যটা ঝলসে উঠেছে ফের। কড়কড় বাজ ডাকছে বুকে। সকালে ঘুম ভেঙেছে লাল্টুর। মা পাশে নেই। বিছানা থেকে চোখ রগড়াতে রগড়াতে নামতেই পা নিথর। মা চিত হয়ে পড়ে আছে মেঝেয়…। রক্ত রক্ত রক্ত… পিঁপড়ে পিঁপড়ে পিঁপড়ে…!
ধড়াম করে ট্রাঙ্কের ডালা বন্ধ করল লাল্টু। জোড়া পায়ে লাথি মেরে ঢুকিয়ে দিল তক্তপোশের তলায়। শূন্যে দু’হাত ছুড়ছে প্রবল আক্রোশে। দুমদুম ঘুষি মারছে মেঝেয়। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছটফট করতে করতে পায়চারি করছে। উন্মাদের মতো ঝাঁকাচ্ছে মাথা, দু’হাতে খামচে ধরছে চুল। দৌড়ে গিয়ে ব্যাগ হাতড়াল। বার করেছে মাউথ অরগ্যানখানা। ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়।
বাজছে সুর। এক অস্থির মূর্ছনায়। যেন একটা কান্না দুলে দুলে উঠছে সুরে।
হঠাৎই দরজা ঠেলে বড়মামা। পরনে লুঙ্গি পাঞ্জাবি, মুখে পান। বছর পঁয়তাল্লিশের হেমন্ত তারিফের সুরে বলল, বেড়ে বাজাচ্ছিলি তো? প্র্যাক্টিসটা চালিয়ে যাচ্ছিস, অ্যাঁ?
দ্রুত চোখের কোল দুটো মুছে নিল লাল্টু। গলায় জমাট শক্ত ডেলাটাকে কোনওক্রমে গিলে নিয়ে বলল, তেমন একটা সময় পাই না।
ছাড়িস না কিন্তু। তোর মধ্যে মিউজ়িকটা আছে। স্পেশালি স্যাড টিউনটা ভাল খোলে। বলতে বলতে হেমন্ত বসল লাল্টুর পাশে। লাল্টুর পিঠে হাত রেখে বলল, তোর মুখখানা এমন শুকনো শুকনো লাগছে? শরীর ঠিক আছে তো?
লাল্টু ঢোক গিলল, হ্যাঁ।
দেখিস বাবা, কার্তিক মাসটা ভাল নয়। সিজ়ন চেঞ্জের সময় দুম করে ঠান্ডা লেগে যায়। …চাস তো তোকে একটা ট্যাবলেট দিয়ে দিতে পারি। গা ম্যাজম্যাজ করলে খা, শরীর ঝরঝরে হয়ে যাবে।
লাল্টুর কেমন খটকা লাগল। বড়মামা তো এত স্নেহপ্রবণ নয়! লাল্টু বাড়ি আছে কি নেই, সেই খেয়ালটাও রাখে না!
গলা ঝেড়ে লাল্টু বলল, না গো। আমি অকারণে ওষুধ খাই না।
হেমন্ত একটুক্ষণ চুপ। ঘরের এ দেওয়াল ও দেওয়াল দেখছে। হঠাৎ বলে উঠল, তোকে একটা কথা বলার ছিল, বুঝলি।
কী?
দোকানটা তো কিছুতেই দাঁড় করাতে পারছি না রে। একটা-দুটো বড় কোম্পানির ডিলারশিপ যদি ধরা যেত… আর চিন্তা থাকত না, একটা বাঁধা ইনকাম ঘরে আসতই।
একথা আগেও এক-দু’বার বলেছে বড়মামা। খাটতে চায় না তো, বরং কাঁদুনি গাওয়াটাই বড়মামার স্বভাব।
লাল্টু হালকাভাবেই বলল, লড়ো, লড়ো, ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে।
চেষ্টার কি কসুর করছি রে! ব্যাবসার আসল রহস্যটা কী জানিস? পুঁজি। টাকা না ঢাললে টাকা আসে না। কঠোর পরিশ্রমের জোরে দাঁড়িয়ে গেল, এ স্রেফ ভাঁওতা।
তাই বুঝি পরিশ্রম করা ছেড়েই দিলে?
ফাজলামি করিস না। কাজের কথাটা শোন। একমাত্র তুই এখন আমায় সাহায্য করতে পারিস।
কীভাবে?
সিদ্ধার্থ তো এখন বিস্তর কামাচ্ছে। তুই একবার বল না, আমাকে লাখ দুয়েক মতো দিতে। কথাটা বাতাসে ভাসিয়ে দু’-এক সেকেন্ড চুপ হেমন্ত। বুঝি লাল্টুর প্রতিক্রিয়াটা লক্ষ করছে। তারপর আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, না না, দান করতে বলিনি। ধার হিসেবেই নেব। শালার বিপদ আপদে পাশে দাঁড়ানো তো ভগ্নিপতির কর্তব্য, নয় কি বল?
পুরনো একটা ছবি মনে পড়ল লাল্টুর। আবছা হয়ে এসেছে, তবে মেলায়নি পুরোপুরি। মা মারা যাওয়ার পর বাবা এসেছিল এ বাড়িতে। বড়মামা তর্জনী তুলে শাসাচ্ছিল বাবাকে। দাদু থামানোর চেষ্টা করল, পারল না। গাঁকগাঁক চেঁচাচ্ছে, বাবার দিকে তেড়ে তেড়ে যাচ্ছে দুই মামা…।
আজ এত বছর পর তাকে হঠাৎ আপনজন মনে হতে শুরু করল?
লাল্টু গম্ভীর মুখে বলল, বাবার সঙ্গে তোমার স্পিকিং টার্মস নেই তা তো নয়। নিজেই ফোন করে চাও না।
সে তো করাই যায়। একটু লাভের মুখ দেখলেই আমি মাসে মাসে রিটার্নও করে দেব। তবে তুই বললে একটু সুবিধে হয়।
লাল্টু ভেতরে ভেতরে শক্ত হয়ে গেল। সে মুখ ফুটে বললে টাকাটা বাবা দিয়ে দেবে। বড়মামা কষ্মিনকালে ওই টাকা শোধ করবে না। এবং বাবাও মুখ ফুটে চাইবে না কোনওদিন। গোটা ঘটনাক্রমটাই দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছে লাল্টু। কিন্তু যার পয়সায় পড়াশোনা চালাতে হচ্ছে বলে লাল্টু প্রতিমুহূর্তে মরমে মরে থাকে, জেনেবুঝে তার কাছ থেকে খামচা মারবে?
কী ভাবছিস এত? হেমন্ত উৎসুক চোখে তাকাল, আরে দেবে, তুই চাইলেই দেবে। আমার দরকার সে বুঝবে না? তা ছাড়া তার ছেলেটাকে এত বছর ধরে কাছে রাখলাম, খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করলাম, মাঝে মাঝে ক’টা টাকা ফেলা ছাড়া তাকে কিচ্ছুটি ভাবতে হল না, ছেলেকে উপযুক্ত শিক্ষাটিক্ষা দিয়ে এখন তার কাছে ফেরত পাঠিয়েছি… কৃতজ্ঞতা বলে তো একটা শব্দ আছে অভিধানে, না কি?
লাল্টুর শরীর আরও শক্ত হয়ে গেল। তাকে দাবার বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করতে চায় নাকি বড়মামা? কলকাতায় এগিয়ে দেওয়া কি দাবার চাল? যাতে বাবাকে দুর্বল করে দেওয়া যায়?
কী হল, চাইবি তো? হেমন্ত খোঁচাল আবার, বড়লোক বাবার সংসারে ভিড়ে গিয়ে গরিব বড়মামাটাকে ভুলে যাস না বাপ। …টাকাটা পেলে বাড়িটারও একটু সংস্কার করতে পারি। এই তোর ঘরটাতেই দ্যাখ না কেমন ড্যাম্প পড়ে গেছে। পুরনো প্লাস্টারটা ঝরিয়ে একটু মেরামতও করে নিতাম। তারপর ধর ছাদটায় একটু হাত দিতে হবে, ঘরগুলোর কলি ফেরাতে হবে… কাজের তো অন্ত নেই।
বড়মামার মিনতি শুনতে খারাপ লাগছিল লাল্টুর। মৃদুস্বরে বলল, আ-আমাকে এসব বলছ কেন?
আর কাকে বলব? তোর ছোটমামার দায় আছে, না দায়িত্ব আছে? একমাত্র তুইই তো বুঝবি। আর তোর টাকা জোগানোর ক্ষমতাটাও আছে। খপ করে লাল্টুর হাতটা চেপে ধরল হেমন্ত, সিদ্ধার্থকে গিয়ে এবার বলিস, কেমন? শুধু আমার ব্যাবসা নয়, বাড়ি সারাইয়ের কথাটাও একবার জানিয়ে রাখিস।
হেমন্ত উঠে গেছে। প্রায়ান্ধকার ঘরে হতবুদ্ধির মতো বসে আছে লাল্টু। কী যে সে করে এখন? ভবিষ্যতে চাকরি বাকরি করে বাড়ির ভোল বদলে দিতে পারে সে, কিন্তু বাবার কাছে যে টাকা চাইতে পারবে না, এটা নিশ্চিত। তবে সেটাও তো বড়মামাকে স্পষ্টভাবে বলতে পারল না। কেন যে মনের কথা গলা অবধি এসে আটকে যায়! এদিকে বড়মামা হয়তো আশায় আশায় থাকবে…
মেজাজটা ফের তেতো হয়ে গেল লাল্টুর। ঘরে আর থাকতে ইচ্ছে করছে না, পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে লাল্টু বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। দুপুর প্রায় শেষ, তবু এখনও রোদের তাত আছে। একটা বাতাস অবশ্য বইছে। একটু বা এলোমেলো। হাওয়াটা তেমন গরম নয়, মুখেচোখে মিঠে পরশও ছোঁয়াচ্ছে যেন। পরিচিত পাড়া, চেনা পথঘাট, সেই শৈশব থেকে দেখা মানুষজন, দোকানপাট, রিকশা, গাছগাছালি -এসবের মধ্যে দিয়ে হাঁটারও বুঝি এক জাদুময় প্রভাব আছে, মনের তাপটাকে যেন শুষে নেয়।
নেদেরপাড়ার মুখটায় এসে লাল্টু দাঁড়িয়ে পড়ল। কোনদিকে যাবে এখন? পুজোর ছুটিতে এসে প্রায় কোনও বন্ধুর বাড়িই যাওয়া হয়নি। তেমন একটা ইচ্ছেই করত না। বাড়িতেই যে সারাক্ষণ ছিল তা নয়, তবে খুব একটা ঘোরাঘুরিও করেনি। ওই হয়তো পাড়ার প্যান্ডেলে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল, ঢাকের আওয়াজ শুনল খানিকক্ষণ, কিংবা উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটল একটু, ব্যস।
একদিন অবশ্য জলঙ্গির পাড়ে গিয়েছিল। বর্ষার পর নদীতে এখন জল থইথই। পুরনো চেনা ঘাটটায় বসেও ছিল খানিকক্ষণ। উথালপাথাল হাওয়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, স্বপনপুরীর ফ্ল্যাট, তোয়া, তোয়ার মা, কিচ্ছুটি তখন আর মনে নেই।
আজও যাবে নাকি ওদিকে? রিকশা চড়ে? হাওয়া খেতে খেতে? না কি শেষ দুটো দিন সন্ধান করবে বন্ধুদের?
তখনই কাঁধে এক জোরদার চাপড়, কী রে, কার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে?
লাল্টু প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছিল। ফিরে তাকিয়ে হেসে ফেলল। তাপস। তার স্কুলের সহপাঠী। এখানে গভর্নমেন্ট কলেজে পড়ছে। ইতিহাসে অনার্স নিয়ে।
চোখ নাচিয়ে লাল্টু বলল, তুই এখানে কোথায়? এটা তো তোর পাড়া নয়?
কাজে এসেছি। কাঁধের ঝোলাব্যাগখানা দেখাল তাপস, ম্যাটার আসতে শুরু করেছে। নেদেরপাড়ায় একজন বাংলা ডিটিপি করে, তাকে লেখাগুলো ধরিয়ে দিয়ে যাব।
তোদের লৌকিকের?
এরই মধ্যে ‘তোদের’ হয়ে গেল? ছ’মাস আগেও তো ‘আমাদের’ বলতিস।
লাল্টু হেসে বলল, সরি। সরি। আমাদের লৌকিক। তা কোন ইস্যুর কাজ চলছে এখন?
টার্গেট তো এখন একটাই। বইমেলা। এখানে তো ডিসেম্বরের কুড়ি তারিখ থেকে। দেড় মাসও আর বাকি নেই। এখন থেকে উঠে পড়ে না লাগলে চলবে কেন। …তুই আমাদের পুজো ইস্যুটা দেখেছিস?
নাহ। পেলাম কোথায়।
ও। তোকে বুঝি এখন পৌঁছে দিতে হবে? গিয়ে কালেক্ট করতে পারিস না? তাপস ঝোলা থেকে একটা বই বার করল, যাক গে, তোর কপাল ভাল, কপি নিয়ে বেরিয়েছি। এটা রাখ।
পত্রিকাটা হাতে নিয়ে মৃদু শিহরন অনুভব করল লাল্টু। কৃষ্ণনগরের এই লৌকিক পত্রিকাটির যথেষ্ট খ্যাতি আছে। সম্পাদনা করে নরেশ চক্রবর্তী। লাল্টুদের গজাদা। ওই গজা চক্রবর্তী নামেই কলকাতার তাবড় তাবড় লেখক-কবি-প্রাবন্ধিক এক ডাকে চেনে নরেশকে। গত বছর থেকে লাল্টুও চেলা হয়েছিল গজাদার, বইমেলা সংখ্যার কর্মসমিতিতে তার নামও ছাপা হয়েছিল। দু’খানা কবিতাও। জীবনে প্রথম ওই ছাপার অক্ষরে নাম। সেই রোমাঞ্চটাই যেন ফিরে আসছিল লাল্টুর।
কভারটা দেখে লাল্টু সূচিপত্রে আলগা চোখ বোলাল। ভুরু কুঁচকে বলল, এটাও তো থিম ইস্যু দেখছি।
হ্যাঁ। বাংলার লৌকিক দেবদেবীর। গজাদা তো অ্যানাউন্স করে দিয়েছে, বছরে এবার থেকে তিনটে করে সংখ্যা বেরোবে। তিনটেই বিশেষ থিম নিয়ে।
কবিতা থাকবে না?
না না, কবিতাটুকু অ্যালাওড। তাপস চোখ টিপল, লোকাল কবিদের কবিতা না ছাপলে গজাদা পত্রিকা বার করার ছেলেমেয়ে পাবে কোথায়? তুইও কি আসতিস?
যাহ, কী বলছিস! আমার কবিতা না বার করলেও আমি খাটতাম।
শুনে ভাল লাগল। তাপস একটা গ্রাম্ভারী ভাব ফোটাল গলায়, বইমেলা সংখ্যাটা কী নিয়ে হচ্ছে আন্দাজ করতে পারিস?
না।…বাউল? নাকি কবিগান?
নো। এবারের থিম শ্মশান। বেঙ্গলে যতগুলো বড় বড় শ্মশান আছে, সবক’টাকে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। সেই কোচবিহার থেকে গঙ্গাসাগর। মানসাই নদীর ধারের শ্মশানও থাকবে, কঙ্কালিতলাও বাদ পড়বে না। এবারের ইস্যুটা একটা ইউনিক পিস হবে। রিসার্চেও কাজে লাগবে।
গজাদার মাথায় দারুণ দারুণ আইডিয়া আসে বটে।
কিন্তু পত্রিকা বের করতে তো গজাদার পেছন হলুদ হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও। এই পুজোসংখ্যাতেই তো আট হাজার টাকা ডেফিসিট। গজাদা ভয় পাচ্ছে, বইমেলার পর ওটা না বেড়ে তিরিশ-চল্লিশ হাজারে দাঁড়ায়। বলতে বলতে তাপস হঠাৎ থেমেছে। চোখ পিটপিট করে বলল, আচ্ছা, তুই তো এখন বেশ সলভেন্ট পার্টি?
মানে?
সব খবর রাখি গুরু। তোমার বাবা বড় আর্কিটেক্ট… পশ ফ্ল্যাট, মড গাড়ি… ব্যাঙ্কে নাকি তার টাকায় ছাতা পড়ছে… সেই রইস বাপের কাছে গিয়ে আছ… লাখ লাখ টাকা খরচ করে তোমায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছে…। তাপস ফের চোখ টিপল, সে তুমি নয় সুখে থাকো। তবে লৌকিকের জন্যও কিছু মালকড়ি ছাড়ো।
আমি কোত্থেকে পাব?
তোর বাবা তোকে পকেটমানি দেয় না? সেখান থেকেই একটু হাত ঝাড়ো, দু’-পাঁচ হাজার বেরিয়ে যাবে।
লাল্টু থতমত খেল একটু। তাপস ভুল বলেনি। তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এখন হাজার সতেরো তো আছেই। দু’-তিন হাজারের বেশি খরচ করতে পারেনি লাল্টু। ওই টাকা তুলতে তার হাত সরে না। ওখান থেকে তাপসকে একটা চেক লিখে দিলেই তো যথেষ্ট। কিন্তু যা সে উপার্জন করেনি, যে টাকায় নিজের অধিকার আছে বলে সে মনে করে না, তা সে অন্যকে দান করবে কী করে?
লাল্টু হেসেই বলল, অত পারব না রে। চাঁদা হিসেবে এক-দুশো দেব। যেমন দিই প্রতিবার। প্লাস, এই সংখ্যার দামটাও রাখ।
থাক। তোকে বুঝে গেছি। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ঢুকে পাক্কা কেরিয়রিস্ট বনে গেছিস। পত্রিকাটা তোর কাছে এখন ভ্যালুলেস।
হায় রে, কেরিয়ারিস্ট হওয়ার সাধটাও যদি সত্যিই লাল্টুর অন্তরে থাকত! লাল্টু নরম করে বলল, আহা, ঝগড়া করছিস কেন? আমার যতটুকু সাধ্য…
ঢপ মারিস না। তোর ক্ষমতা নেই, অ্যাঁ? গজাদা ঠিকই বলে, দুম করে টাকার পাহাড়ে চড়ে বসলে মানুষের শিকড় টিকড়ের বোধগুলো লোপ পায়। তাপস গুমগুমে গলায় বলল, তুই আর ক’দিন আছিস?
পরশু ভোরে চলে যাব।
কাল তোকে কয়েকটা বিজ্ঞাপনের ফর্ম দিয়ে আসব। তোর বাবার কাছ থেকে একটা কভার পেজ আদায় করবি। প্লাস, ওঁকে বলবি আরও কয়েকটা জোগাড় করে দিতে।
বলেই তাপস হনহনিয়ে হাঁটা লাগিয়েছে। লাল্টু মরিয়া হয়ে ডাকল, অ্যাই? শোন…। আমি বিজ্ঞাপন টিজ্ঞাপন…
পলকের জন্য থামল তাপস। ঘুরে বলল, কোনও ওজর আপত্তি শুনছি না। ফর্ম দেওয়া থাকবে, তোর বিবেক যা চায় তাই করিস।
কী জ্বালা, বিবেকের কথা আসে কেন? তাপস কি অনুভব করতে পারবে, সে যে বাবার কাছে কিছু প্রার্থনা করতে পারবে না, সে তো ওই বিবেকের কারণেই?
দ্রুত অপসৃয়মাণ তাপসকে দেখতে দেখতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল লাল্টু। বিষাদের কণা চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে পড়ছে ভেতরে, ছেয়ে ফেলছে হৃদয়। তার ইঁদুরকলে পড়া দশা কেউ বুঝবে না। বন্ধুরাও না।
আর কোত্থাও যেতে পা সরছিল না লাল্টুর। বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়ল। শুয়েই রইল। বাইরে একটা মনোরম হেমন্তের বিকেল ফুটল, কখন যেন আঁধারে মিশেও গেল, লাল্টু তবু শুয়েই আছে।
সন্ধের পর উঠে লাল্টু চা খেল এক কাপ। সঙ্গে দু’গাল শুকনো মুড়ি। তারপর পায়ে পায়ে উঠে এসেছে ছাদে। গতকাল কোজাগরী পূর্ণিমা গেছে, আজও চাঁদ যথেষ্ট বড়সড়। সামান্য কানাভাঙা, তবু চকচক করছে সোনালি থালা। দিনে দিনে ছোট হবে চাঁদ, একদিন মিলিয়েও যাবে, আবার ফিরবে নিজ লয়ে। লাল্টুর মনোকষ্টের যে কেন হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে না? শুধু বেড়েই চলে?
পিছনে পদশব্দ। কে যেন এসেছে। লাল্টু ঘুরে দেখল। ছোটমামা।
জয়ন্ত হালকা গলায় বলল, কী রে, তোর নাকি খুব মনখারাপ?
লাল্টু জোর করে হাসল, তুৎ, কে বলল?
মা। চলে যেতে হবে বলে তুই নাকি হাঁড়িমুখ করে শয্যা নিয়েছিলি? …মা বলল, ছেলেটার সঙ্গে গিয়ে একটু কথাটথা বল। …তা তুই তো দেখছি দিব্যি জ্যোৎস্না উপভোগ করছিস!
লাল্টু আলতোভাবে বলল, হ্যাঁ, খুব সুন্দর।
বিউটিটাই শুধু চোখে পড়ে? মনে হয় না, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমাচাঁদ যেন ঝলসানো রুটি?
ওফ, সেই বাঁধা গতের বুকনি। ছোটবেলা থেকে শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। লাল্টু তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, না, মনে হয় না।
স্বাভাবিক। এখন যে পরিবেশে আছিস। জয়ন্তর গলায় পালটা ব্যঙ্গ, এখন তো দিব্যি চলছে তোর বাবার স্থাপত্যের ব্যাবসা।
হ্যাঁ, রমরম করে চলছে। ছোটমামাকে চটানোর জন্য লাল্টু একটু উসকে দিল, এই তো কিছুদিন আগেই একটা বিশাল টাকার কাজ পেল।
কত? বিশ লাখ? পঁচিশ লাখ?
অনেক বেশি। প্রায় তিন কোটি।
পরিমাণটা শুনে একটুক্ষণ ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রইল জয়ন্ত। বুঝি মনে মনে শূন্যগুলো গুনছে। তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, জানতাম সিদ্ধার্থদা একদিন পাক্কা ক্যাপিটালিস্ট বনে যাবে।
যাহ বাবা, এতে ক্যাপিটালিস্টের কী হল? খেটেখুটে একটা ডিজ়াইন বানিয়েছে, তার রেমিউনারেশান পেয়েছে। তাও বাবা নিজে পায়নি। পেয়েছে বাবার ফার্ম।
ওটাই তো কায়দা। অফিসের লোকরা খেটে মরে, আর তোর বাবা টাইপের লোকগুলো তাদের পরিশ্রম আত্মসাৎ করে ফুলেফেঁপে উঠছে।
কী যা তা বকছ? বাবা কর্মচারীদের বেশ ভাল মাইনে দেয়। এক একজন পঞ্চাশ হাজার, ষাট হাজার করে পায়। বাবা খাওয়ার টেবিলে গল্প করে। আমি শুনেছি।
বকিস না। যা দেয়, তার অন্তত একশোগুণ মুনাফা লোটে। একে বলে থিয়োরি অফ সারপ্লাস ভ্যালু। স্বয়ং মার্কস বলে গেছেন।
যেন এই মহাবিশ্বের অলঙ্ঘনীয় অপরিবর্তনীয় কোনও চরম সত্য আওড়াল জয়ন্ত। লাল্টু ঠাট্টার সুরে বলল, সময় বদলে যাচ্ছে ছোটমামা। একটু অন্যরকম করেও ভাবো।
তুইও দেখছি তোর বাবার শ্রেণিতে ঢুকে পড়েছিস! তা তোর বাবা তোকে ছাড়ছে তো মালকড়ি?
প্রয়োজন পড়লেই দেয়। এই তো সেদিন একটা ল্যাপটপ গিফ্ট করল।
ওতে আর ক পয়সা লাগে? চুষে নে, চুষে নে, সুযোগ যখন পেয়েছিস, শুষে নে। তোকে অনেক ফাঁকি দিয়েছে, সব এবার তোকে উশুল করতে হবে। ছেলেকে এখানে ফেলে রেখে নতুন এক সেট বউবাচ্চা নিয়ে বহুৎ সুখ ভোগ করেছে, তার মাশুলটা আদায় করতে ছাড়িস না। শেষ অবধি তুইও অবশ্য ওরকম বুর্জোয়া হয়ে যাবি, আমাদের দেখে নাক সিঁটকোবি তখন…
জয়ন্ত বকেই চলেছে। শুনতে একটুও ভাল লাগছিল না লাল্টুর। কৃষ্ণনগর তার বড় শান্তির আশ্রয় ছিল, আজ যেন কেমন দুঃসহ লাগে। সে যেন আর আগের লাল্টু নেই, যেন সে এখন জনৈক সিদ্ধার্থর প্রতিনিধি।
তার স্বতন্ত্র অস্তিত্বটা কি তা হলে এখান থেকেও মুছে যাবে?
রাতে ঘুম আসছিল না লাল্টুর। ছটফট করছিল বিছানায়।
.
০৮.
বহতা জীবনের একটা স্বাভাবিক ছন্দ আছে। কখনও তা ওঠে, কখনও নামে, কখনও বা নিস্তরঙ্গভাবে এগোয়। তবু তার মধ্যেও মূল সুরটা যেন হারায় না। কেবল আকস্মিক কোনও ঘটনাই তাকে ভেঙেচুরে খানখান করে দিতে পারে! জীবন তখন হয়ে পড়ে বেতালা, কর্কশ। অন্তত যতক্ষণ না সে নতুন সুর ছন্দ খুঁজে পায়। নিছক আমোদ করতে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে গাড়ি খাদে পড়ে গেলে পরিবারের এক-আধজন যদি টিকে যায়, তাদের বেঁচে থাকাটা ভারী মর্মান্তিক মনে হয় প্রথম প্রথম। কিন্তু সময়ের আশ্চর্য কেরামতিতে তারাও ক্রমশ একটা ছন্দ বানিয়ে নেয়। হয়তো এই নতুন তাল লয় তাদের কাঙ্ক্ষিত ছিল না, তবু এতেই বুঝি জীবনটা মোটামুটি সহনীয় হয়ে ওঠে। সে যদি বিকলাঙ্গ হয়, কিংবা নিরাশ্রয়, তবুও।
তবে একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, অধিকাংশ আকস্মিক ঘটনাই বুঝি আকস্মিক নয়। কোথাও যেন একটা প্রস্তুতি চলে তার। অলক্ষ্যে। অজান্তে। সেই প্রস্তুতির কারণেই ঘটনাটা স্রেফ ভবিতব্য। এবং ঘটনার ফলটা অবশ্যম্ভাবী।
যেমন ধরা যাক, লাল্টুর মা’র মৃত্যু। স্বামী পরিত্যক্ত, মানসিক অবসাদগ্রস্ত বর্ণালির আত্মহত্যা কি আকস্মিক ঘটনা? এক পা এক পা করে ওইদিকেই কি এগোচ্ছিল না সে? বর্ণালি যদি প্রায় উন্মাদ অবস্থায় কোনওক্রমে বেঁচেও থাকত, সেটা কি বীভৎস আত্মহত্যার চেয়ে অন্যরকম কিছু হত? সে জীবিতই থাকুক, কি হাতের শিরা কেটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ুক, লাল্টুর মনোজগৎকে বর্ণালি এমনভাবে গড়ে দিয়েছে, সেটাও তো প্রায় নিয়তির মতোই অমোঘ।
কিংবা সিদ্ধার্থ তৃষিতার জোড় বাঁধা। আপাত চোখে মনে হতেই পারে, সিদ্ধার্থর গাড়িতে চেপে তৃষিতার বাগনান সাইটে যাওয়া ছিল একটা আকস্মিক ঘটনা। এবং ওই দিন থেকে পরিচয় গাঢ় না হলে হয়তো ওদের বিয়েই হত না। কিন্তু আদতে কি তাই? দু’জনেই কি মনে মনে সঙ্গী খুঁজছিল না? সেই চাওয়াটাই হয়তো অন্য কাউকে এনে দিতে পারত তৃষিতার জীবনে। অথবা সিদ্ধার্থও বাঁধা পড়তে পারত অন্য কোনও রমণীর বৃত্তে। তবে তারা যে যাকে নিয়েই সংসার গড়ুক না কেন, তার চেহারা খুব একটা পৃথক হত কি? নতুন বাবার প্রতি তোয়ার মনে এক চিলতে বিরূপতা হয়তো রয়েই যেত। এই পরিবারে লাল্টুও যে অস্বচ্ছন্দ বোধ করে, এটাও বা কী অস্বাভাবিক? অর্থাৎ তৃষিতার সঙ্গে সিদ্ধার্থর প্রথম কবে কোথায় কীভাবে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তাতে কিছুই যায় আসে না। একটা সংসারে আশ্রয়খোঁজা সিদ্ধার্থ আর হিসেব কষে তৃষিতার দ্বিতীয় বিয়েটা যেমন ভবিতব্য, তোয়া কিংবা লাল্টুর মানসিক জটিলতাও ঠিক ততটাই অবশ্যম্ভাবী।
লাল্টুর ওপর তোয়ার এক ধরনের মায়া গজিয়ে ওঠার ব্যাপারটাও তো এই নিয়মেই পড়ে। লাল্টুকে হঠাৎ একদিন মাউথ অরগ্যান বাজিয়ে কাঁদতে দেখল, ওমনি তার মনটা তুলতুলে হয়ে গেল, হৃদয়ের সমীকরণ বোধহয় এত সরল নয়। এ বাড়িতে নিজের অবস্থানের বাধোবাধো ভাবটাও বুঝি লাল্টুর সম্পর্কে তাকে খানিকটা দুর্বল করে দিয়েছিল। লাল্টু যে তারই মতো নিঃসঙ্গতায় ভুগছে, এটা বোধহয় তোয়ার ষষ্ঠোন্দ্রিয়ই পড়ে ফেলতে পারত। আজ, নয়তো কাল। নিরালা বিকেলে লাল্টুর গোপন কান্নাটা তোয়ার সেই বোধকে ত্বরান্বিত করেছিল, এই যা। এখনও অবশ্য তোয়া সহজভাবে মিশতে পারে না লাল্টুর সঙ্গে। এ অবস্থাও নিতান্তই সাময়িক। কেটে যাবে। হয়তো তার জন্য আবার একটি আকস্মিক ঘটনার প্রয়োজন।
বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে তোয়া চাউমিন খাচ্ছিল। একগাদা টোম্যাটো সস ঢেলে লাল করে নিয়েছে নুডলস। সামনে সবিতা, সে উজাড় করে চলেছে তার দুঃখের ঝাঁপি। গতকাল দুপুরে সে সোনারপুর গিয়েছিল, সেখানে নাকি তার বাড়িতে জোর ধুন্ধুমার চলছে। গত বছর তার ছোট ছেলে নিজে পছন্দ করে বউ আনল, সবিতা ভেবেছিল এবার বোধহয় নেশাটেশা করা কমাবে, কাজে মন দেবে…। একটা বছরও পেরোল না, আবার সে স্বমূর্তি ধরেছে। রিকশা চালিয়ে যেটুকু যা রোজগার হয়, তার বেশিই চলে যায় চুল্লুর ঠেকে। অগত্যা দুলালের বউকে লোকের বাড়ি কাজ ধরতে হয়েছে। তারপরও রেহাই নেই, দুলালের নাকি আর একটা আশনাই হয়েছে, তাই বউটাকে গোবেড়েন দিচ্ছে রোজ।
সবিতামাসির পারিবারিক উপাখ্যান শুনতে এক একদিন ভারী মজা লাগে তোয়ার। এমন চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গল্প করে সবিতামাসি। বলার সময়ে সবিতামাসি যেন ভুলেই যায়, সে এখন ছেলেদের পরিবারে বাইরের লোক, বরং তোয়াদের সংসারেরই অঙ্গ।
সবিতার কথার মাঝে কুটুর কুটুর ফুট কাটে তোয়া। আজ বলে বসল, তোমার ছোটছেলের বউটা কী গো! বরকে ছেড়ে চলে গেলেই তো পারে।
সে একেবারে নেই আঁকড়া মেয়েছেলে। পিটানি খাবে, মুখ ছোটাবে, কিন্তু সোয়ামিকে ছেড়ে নড়বে না। পাছে অন্য মেয়েছেলেটা সংসারে ঢুকে পড়ে!
তা হলে বউটা তোমার ছেলেকে খুব ভালওবাসে, বলো?
ভালবাসা, না ছাই। বাপের বাড়ি গেলে ঘেঁটি ধরে বার করে দেবে, তাই না পড়ে আছে!
ও। তার মানে তোমার ছেলের বউয়ের হেল্পলেস সিচুয়েশানের অ্যাডভান্টেজ নিচ্ছে তোমার দুলাল!
সবিতা যেন কথাটা পুরো বুঝল না। কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, আমার দুলালটার মন কিন্তু খারাপ নয়। জানো, নেশা তো ও ছেড়েই দিয়েছিল, হপ্তায় এক-দু’দিনের বেশি ছুঁতই না। নতুন মেয়েছেলেটাই নষ্টের মূল। তার সঙ্গে পিরিত শুরু হওয়ার পর আবার ওসব গেলা ধরল।
একেই বলে পুত্রস্নেহ। তোয়া ফিক করে হেসে ফেলল। একটা জুতসই মন্তব্য করতে যাচ্ছিল, মোবাইল বেজে উঠল। মনিটরে সুহানা। তোয়াদেরই ব্লকের তিনতলায় থাকে। বয়সে তোয়ার চেয়ে বছর খানেকের বড়।
তোয়া ফোন ধরে বলল, হাই!
সুহানা কলকল করছে, কেয়া কর রহি হ্যায় তু অব তক? উই আর ওয়েটিং ইয়ার। শ্বেতা, বৃন্দা সব এসে গেছে।
যাচ্ছি। যাচ্ছি। দু’মিনিট।
কাম অন, কুইক। সাত বাজে আমার টিউশ্যন আছে।
টেবল টেনিস খেলার আহ্বান। নীচে, স্বপনপুরীর ক্লাবহাউসে। ঝড়ের গতিতে বাকি চাউমিনটুকু মুখে ঠুসতে লাগল তোয়া। সবিতা এদিকে ফের শুরু করেছে তার দুঃখের কাহিনি। তার বড় পুত্তুরটিও নাকি এই সুযোগে খারাপ ব্যবহার করছে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে। সৎ ভাইকে সে কোনও কালেই নাকি সহ্য করতে পারে না, সবিতার গতর খাটানো পয়সায় তোলা ঘরখানাকে সে নাকি এখন দু’ভাগ করতে চায়…
তা তোয়ার আর এখন শোনার ধৈর্য নেই। প্লেট সাফ করে চোঁ চোঁ চুমুক লাগাল দুধে। গ্লাস টেবিলে নামিয়ে দৌড়েছে ঘরে।
টেবিলটেনিস র্যাকেটখানা নিয়ে তোয়া বেরোতে যাচ্ছে, আবার মোবাইলে ডাক। এবার মনিটরে দৃষ্টি পড়তেই কপালে ভাঁজ। শর্বরী আন্টি! কখনও তোয়াকে ফোন করে না এমন নয়, তা বলে এই অসময়ে?
সামান্য বিস্ময়ের সুরে তোয়া বলল, কী ব্যাপার গো আন্টি?
উত্তেজিত হোয়ো না, ঠান্ডা মাথায় শোনো। শর্বরীর গলা যেন নার্ভাস শোনাল, একটা বিপদ ঘটে গেছে।
কী হয়েছে?
অ্যাক্সিডেন্ট। তোমার বাবার।
কথাটা বুঝতে এক-দু’ সেকেন্ড বুঝি সময় লাগল তোয়ার। তারপর গলা দিয়ে আর্তনাদ ঠিকরে এল, কোথায়? কখন? কী অ্যাক্সিডেন্ট?
মিনিবাস ধাক্কা মেরেছে। বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের আশপাশে। রাস্তার লোকজন পিজির এমারজেন্সিতে নিয়ে গেছে।
এখন কেমন আছে বাবা?
আমি ঠিক জানি না গো। যারা হাসপাতালে নিয়ে গেছে, তাদেরই একজন ফোন করেছিল। আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। খবরটা পেয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। এখন ট্যাক্সিতে আছি।
আমি যাব। আমি এক্ষুনি যাব।
চলে এসো।…যা ঘটার সে তো ঘটবেই, টেনশান কোরো না।
বলল বটে শর্বরী, কিন্তু তার গলা রীতিমতো কাঁপছে। সে ফোনটা ছাড়ার পরে তোয়া কয়েক সেকেন্ড অসাড়। শুধু হৃৎপিণ্ড ধড়াস ধড়াস লাফাচ্ছে। কী করবে সে এখন? একা একা যেতে পারবে পিজিতে? খুঁজে পাবে কোথায় আছে বাবা? তুৎ, না পারারই বা কী আছে? সে তো শিশু নয়। মাকে কি জানিয়ে যাওয়া উচিত? কেন জানাবে? কোনও প্রয়োজন নেই। বাবা বেঁচে রইল, কি মরে গেল, তাতে মা’র কী আসে যায়! বরং হাসপাতালে পৌঁছে বাপিকে একটা ফোন করে দেবে। সবিতামাসিকে তো সে বলেই যাচ্ছে, তার কাছ থেকে নয় জেনে নেবে মা।
খেলবে বলে শর্টস পরেছিল তোয়া। সেটা বদলে জিন্সটা গলিয়ে নিল। সামনে যে কুর্তিটা পেল, পরে নিয়েছে ঝটপট। সবিতাকে হাউমাউ করে কী যে বোঝাল, নিজেও জানে না। পার্সে কী আছে খুলেও দেখল না, ব্যাকপকেটে পুরে বেরিয়ে পড়ল ফ্ল্যাট ছেড়ে। লিফ্টের সামনে গিয়ে বোতাম টিপছে ঘনঘন। ওফ্, এত দেরি করে কেন? সময় নেই, তোয়ার সময় নেই। সিঁড়ি দিয়েই নামছে পাগলের মতো।
এ কী! ওভাবে দৌড়োচ্ছ কেন? যাচ্ছ কোথায়?
তোয়ার হুঁশ ফিরল। স্বপনপুরীর বাইরে এসে গেছে! সামনে সোহম!
ধরাধরা গলায় তোয়া বলল, আমার বাবা…অ্যাক্সিডেন্ট… হসপিটালে…
বলেই সোহমকে পাশ কাটিয়ে ছুটতে যাচ্ছিল তোয়া, খপ করে হাত চেপে ধরেছে সোহম। বলল, উঁহু। একা নয়। আমি যাব সঙ্গে।
এমন দৃঢ় স্বরে সোহম বলল কথাটা, আপত্তি তো দূরস্থান, তোয়ার স্বরই ফুটল না। হনহনিয়ে বড় রাস্তায় এল দু’জনে। ট্যাক্সি ধরেছে।
তোয়া কাঠ হয়ে বসে। সোহম আজ মোটেই মুখচোরা নেই, খুচখাচ কথা বলছে। বুঝি বা তোয়ার উদভ্রান্ত ভাবই তাকে মুখর করে দিল।
সোহম জিজ্ঞেস করল, খবরটা কে দিল তোমায়?
শর্বরী আন্টি। আমার স্টেপ মাদার।
ইনজুরি কেমন? খুব সিরিয়াস?
জানি না। আমি কিছু জানি না। তোয়া ফুঁপিয়ে উঠল, বোধহয় বাবা এতক্ষণে…
এত ভেঙে পড়ছ কেন? হয়তো গিয়ে দেখবে তেমন কিছুই হয়নি। অল্পস্বল্প চোট লেগেছে।
বলছ? তোয়া অসহায় চোখে তাকাল, তেমনও তো হতে পারে। তাই না?
অবশ্যই হতে পারে। আমার ছোটমামাই তো একবার গাড়িতে ধাক্কা খেয়েছিল। তাকে একটা দিনও পুরো হাসপাতালে থাকতে হয়নি। কেটেছড়ে গিয়েছিল, ব্যান্ডেজ ট্যান্ডেজ বেঁধে সেদিনই বাড়ি চলে এল। সোহমের দৃষ্টি জানলার বাইরে। মৃদু স্বরে বলল, তোমার মাকে জানিয়েছ?
তোয়ার স্নায়ু সামান্য শিথিল হয়েছিল। ফের টান টান। গোমড়া মুখে বলল, তার কি কোনও দরকার আছে?
আছে। ফোনটা করো।
এমন কর্তৃত্বের সুরে সোহম নির্দেশটা দিল, তোয়া উড়িয়ে দিতে পারল না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও টিপল তৃষিতার নম্বর। তোয়ার মুখে খবরটা শুনে কী আজব প্রতিক্রিয়া, খানিকক্ষণ কোনও সাড়াশব্দ নেই। তারপরই জিজ্ঞাসা, তুই এখন কোথায়?
হসপিটালে যাচ্ছি।
আমি যাব?
না। সোহম আছে সঙ্গে।
ও প্রান্তে আবার ক্ষণিকের নৈঃশব্দ্য। সোহমের নাম শুনে কি চমকাল মা? সে ডাকেনি, সোহম যেচে চলেছে সঙ্গে, মাকে বলবে কি? থাক, পরে তো মা জানতেই পারবে।
আবার তৃষিতার গলা শোনা গেল, টাইম টু টাইম ফোন কোরো। আমি কিন্তু দুশ্চিন্তায় থাকব।
কার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে মা’র? নিশ্চয়ই বাবার জন্যে নয়! আর তোয়ার ভাবনা তো অনেক ভেবেছে, আজ কিছুক্ষণ নয় নাই ভাবল। ফোন অফ করে অপাঙ্গে একবার সোহমকে দেখল তোয়া। পিঠের ব্যাগখানা কোলে নিয়ে কেমন একটা ভারিক্কি মুখ বানিয়ে বসে আছে যেন। এমনিতে তো নিজে থেকে তোয়ার সঙ্গে একটা কথাও বলে না, এখন ঝাঁপিয়ে পড়ে তোয়ার সঙ্গী হল কেন কে জানে! তোয়ার বাবাকে সে জানেও না, চেনেও না। অতএব তার জন্যে মন কেঁদে ওঠার তো প্রশ্নই নেই। তবে কি তোয়ার বিপন্নতা অনুভব করেই…?
নিজের বাইরেও তবে তাকাতে জানে সোহম? আর একটা সোহমও আছে তা হলে?
পিজি হাসপাতালের জরুরি বিভাগ যথারীতি এক হট্টমেলা। এমনিতে তো সারাদিন ভিড় লেগেই থাকে, আজ বিকেল সন্ধের মাঝামাঝি এই মুহূর্তটায় মানুষ যেন উপচে পড়ছে। রোগীদের সঙ্গীসাথিরা ব্যস্ত মুখে ছোটাছুটি করছে, কেউ বা চেঁচামিচি জুড়েছে, কেউ ভয়ার্ত মুখে প্রতীক্ষারত। ডাক্তার নার্স যাতায়াত করছে এলোমেলো। কোনও কোনও রোগী এখনও পড়ে আছে স্ট্রেচারে, কারও ওপর বা সবেমাত্র সদয় হয়েছে ডাক্তার। ওষুধের উৎকট ঝাঁঝ আর তীব্র কোলাহলে সুস্থ মানুষদের অসুস্থ হওয়ার জোগাড়।
লাল্টু কেমন দিশেহারা বোধ করছিল। কৃষ্ণনগরের সদর হাসপাতালে সে দু’-তিন বার গেছে বটে, কিন্তু এই জঙ্গলের তুলনায় তা তো নেহাত ঝোপঝাড়। কোথায় যাবে, কার কাছে অয়ন বিশ্বাসের খোঁজ করবে, কিছুই ঠাহর করতে পারছে না।
হঠাৎ নজরে পড়ল এক মহিলা লাল্টুদের দিকেই এগিয়ে আসছে। বয়স বছর চল্লিশ, শ্যামলা রং, চোখে চশমা, পরনে রঙিন তাঁত, কপালে লাল টিপ। তোয়া তাকে দেখেই দৌড়ে গেল। হাত চেপে ধরে বলল, বাবা কোথায়? কেমন আছে?
বুঝতে অসুবিধে নেই, ইনিই তোয়ার সেই সৎমা। দেখতে তেমন সুন্দরী নয়, তবে চেহারায় একটা স্নিগ্ধ মা মা ভাব। তোয়ার মা’র তুলনায় চেহারা নিতান্ত সাদামাটা হওয়া সত্ত্বেও ওই ঘরোয়া ভাবটাই যেন চোখ টানে।
শর্বরী উদ্বিগ্ন মুখে তোয়াকে বলল, এতক্ষণ তো এখানেই ফেলে রেখেছিল। একটু আগে এমারজেন্সি ওটিতে নিয়ে গেল। বেচারা খুব কাতরাচ্ছিল যন্ত্রণায়। এখন যদি ব্যথার ইঞ্জেকশান টিঞ্জেকশান দেয়।
বাবার তা হলে জ্ঞান আছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ। তবে চোট ভালই লেগেছে। কপাল ফেটে গলগল রক্ত বেরোচ্ছিল, মুখটুখ ফুলে একশা, কাঁধ নাড়াতে পারছে না…। হাঁটুটা কেমন বেঁকে আছে, ছুঁলেই চিৎকার করছে। বলতে বলতে শর্বরীর দৃষ্টি লাল্টুতে, তুমি বুঝি তোয়ার সঙ্গে এসেছ?
তোয়া তাড়াতাড়ি বলল, ও আমার বাপির ছেলে। সোহম।
তুমিই সে? তোমার কথা তোয়ার বাবার মুখে শুনেছি।
সোহম সামান্য দোনামোনা ভাব নিয়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে ফেলল। জিজ্ঞেস করল, অ্যাক্সিডেন্টটা হল কীভাবে?
আর বোলো না, কপালে দুর্ভোগ লেখা থাকলে যা হয়। যারা নিয়ে এসেছিল তারা বলল, একটা মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে…। মেয়েটা নাকি মোবাইল কানে বেমক্কার মতো রাস্তার প্রায় মাঝখান দিয়ে হাঁটছিল। সেন্ট পলস গির্জার সামনেটায়। একটা মিনিবাস আর একটাকে ওভারটেক করতে গিয়ে প্রায় পিষে দিচ্ছিল মেয়েটাকে। তাকে হেঁচকা মেরে সরাতে গিয়ে নাকি এই বিপদ। তাও ভাগ্য ভাল, চাপা পড়েনি, ধাক্কা খেয়ে ছিটকে গেছে।
তোয়া কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, এখন যাওয়া যাবে বাবার কাছে?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। চলো না, চলো। তোমাকে দেখলে ও তো…
শর্বরীর সঙ্গে এগিয়ে গেল তোয়া। ভিড় কাটিয়ে কাটিয়ে। দ্রুত পায়ে। সঙ্গে যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে রইল লাল্টু। অদেখা অয়ন সম্পর্কে কৌতূহল জাগছে ভেতরে ভেতরে। এখনও এমন মানুষ আছে তা হলে, অন্যের জন্য নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করে দেয়? নিশ্চয়ই আছে। সবাই কি আর আপনজনকে দূরে ঠেলে নিজের সৌভাগ্য রচনায় মগ্ন হয়? কার জীবনে কোনটা বেশি জরুরি, কে বলতে পারে!
তোয়া আর শর্বরী ঘুরে এসেছে। বাবাকে চোখের দেখা দেখতে পেরেছে তোয়া, তবে কাছে ঘেঁষতে পারেনি। অপারেশান টেবিলে শুইয়ে কী সব যেন করছিল ডাক্তাররা, নার্স তোয়াদের হটিয়ে দিয়েছে।
তোয়া শুকনো মুখে বলল, বাবা কেমন অসহায়ের মতো পড়ে আছে, তাই না আন্টি?
হুঁ। তবে সেই উঃ-আঃটা আর করছে না।
বাবার কি দরকার ছিল বলো তো মেয়েটাকে বাঁচাতে যাওয়ার?
তোমার বাবার যা স্বভাব। পথেঘাটে কারও বিপদ দেখলে তার তো মাথার ঠিক থাকে না। শর্বরী ঘড়ি দেখল, ওদিকে আমার মেয়েটা যে কী করছে?
রুমকি বাড়িতে একা বুঝি?
এখনও লতা আছে…তবে সেও তো ছ’টা-সাড়ে ছ’টায় চলে যাবে…। আমি অবশ্য বাড়িওয়ালাকে ফোন করে বলে দিয়েছি। লতা ওদের ঘরে রুমকিকে রেখে দিয়ে যাবে।
তা হলে আর ভাবছ কেন? এক দিন ঠিক থাকবে।
তা নয়। সন্ধেবেলা আমাকে না পেলে…। আসলে আমি কিংবা ওর বাবা তো এই সময়টায় ওর কাছে থাকিই…। দাদাকে ফোন করলাম, সেও তো এখনও এসে পৌঁছোল না…
তোয়া যেন শুনেও শুনছিল না শর্বরীর কথাগুলো। হঠাৎ ঘুরে লাল্টুকে বলল, গিয়ে দেখে এসো তো অবস্থাটা। তেমন হলে আমিই নয় থেকে যাব। আফটার অল, আমারই তো বাবা।
মুখখানা কি ঈষৎ বিবর্ণ হয়ে গেল শর্বরীর? একটা চোরা নাটক চলছে যেন, যার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকাটা বেশ অস্বস্তিকর। লাল্টু তাড়াতাড়ি বলল, ডোন্ট ওরি। আমি দেখছি।
লাল্টু সরে এল। তার সাময়িক কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবটা কেটে গেছে, এখন মস্তিষ্ক আশ্চর্য রকমের ঠান্ডা। সহজেই খুঁজে বার করল দুর্ঘটনায় আহত অয়ন বিশ্বাসকে, কথা বলল ডাক্তারদের সঙ্গে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানল রোগীর হাল, এবং কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চলেছে ডাক্তাররা।
ফিরে এসে তোয়াকে বলল, এখানে যা করার ছিল, মোটামুটি হয়ে গেছে। তিনখানা স্টিচ পড়েছে কপালে, ড্রেসিং করে দিয়েছে, ছোটখাটো কাটাছেঁড়ার ওয়াশও কমপ্লিট। ব্যথা আছে খুব, তবে কাঁধ এখন মুভ করাতে পারছেন, সিরিয়াস কোনও হেড ইনজুরিও নেই। তবে…
কী তবে?
হাঁটুর ব্যাপারে ডাক্তাররা খুব একটা আশার কথা শোনালেন না। বলছেন, হাড় তো গেছেই, সম্ভবত মাল্টিপল ফ্র্যাকচার। এক্সরে করা হচ্ছে, তেমন হলে অপারেশন করতে হবে।
আজই করবে?
মনে হল না। আগে বোধহয় অ্যাডমিট করাতে হবে পেশেন্টকে। যদি বেড খালি পাওয়া যায়।
ও। তা হলে আমরা এখন কী করব?
জাস্ট ওয়েট…। ডাক্তাররা কী ডিসিশান দেন দেখি।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, এসে গেছে শর্বরীর দাদা। খুবই করিতকর্মা লোক, এক্সরে রিপোর্ট জেনে নিয়ে সাঁই সাঁই পাক খেতে লাগল হাসপাতালে। ঠিক একজন চেনা লোক খুঁজে নিয়ে সরকারি হাসপাতালে দুষ্প্রাপ্য বেডেরও ব্যবস্থা করে ফেলল।
অয়ন চালান হয়ে গেছে ওয়ার্ডে। তোয়া আর একবার দেখে এল বাবাকে। এবার তোয়াকে নিয়ে লাল্টুর ফেরার পালা।
শহরে সন্ধে নেমেছে বহুক্ষণ। ডিসেম্বর এখনও পড়েনি, তবে এখনই বাতাস যথেষ্ট শুকনো শুকনো। একটা চোরা ঠান্ডা ভাবও যেন টের পাওয়া যায়।
ট্যাক্সিতে উঠে কাচ তুলে দিয়েছিল লাল্টু। দু’জনের কেউই কোনও কথা বলছিল না। হঠাৎ তোয়ার স্বর বেজে উঠল, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো, বাবাটা একেবারে যাচ্ছেতাই। এত বয়স হল, এখনও জ্ঞানবুদ্ধি গজাল না!
লাল্টু নীরব থাকতে পারল না। মৃদু গলায় বলল, ওভাবে বলছ কেন? অ্যাক্সিডেন্ট তো অ্যাক্সিডেন্টই। যখন তখন ঘটতে পারে।
মোটেই না। বাবা অ্যাক্সিডেন্টের দিকে ছুটে যায়। বারবার ধাক্কা খেয়েও শিক্ষা হয় না।
এর আগেও কি ওঁর এরকম কোনও…?
ঢের বড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তোয়ার ঠোঁট বিদ্রূপে বেঁকে গেল, মা’র সঙ্গে বিয়ে হওয়াটাই কি কম ফ্যাটাল ছিল? দুটো বিলকুল ডিফারেন্ট টাইপের স্পেসিমেন কী করে যে পছন্দ করেছিল পরস্পরকে?
তোমার বাবা তো একজন আর্টিস্ট, তাই না?
ছিল এক সময়ে। এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। বোহেমিয়ান লাইফ লিড করে নিজেকে তছনছ করে ফেলেছে। মা কেটে পড়ে আরও বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছে বাবার।
কিন্তু উনি তো এখন একটা সুন্দর ফ্যামিলে লাইফের মধ্যে আছেন…
হ্যাঁ। সে তো আছেই। শর্বরী আন্টি গলায় পুরো বকলশ পরিয়ে রেখেছে। মেয়েকে এক রাত্তিরও কাছে রাখতে হলে বউয়ের কাছে পারমিশান নিতে হয়। ওই দুঃখে তো ও বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না।
যাহ্, ভদ্রমহিলাকে দেখে তো ওরকম লাগল না। বরং মনে হল তোমার ওপর খুব অ্যাফেকশান আছে!
আমার মা-ও তো তোমার প্রতি খুব অ্যাফেকশনেট, নয় কি?
কথাটা যেন বিদ্ধ করল লাল্টুকে। তার মায়ের কৃত্রিম আচরণ কি তোয়ারও চোখে লেগেছে?
বড়সড় একটা শ্বাস ফেলে তোয়া ফের বলল, ইস, বাবা যদি আবার বিয়েটা না করত!
কী লাভ হত? লাল্টু বলব না বলব না করেও বলে ফেলল, তুমি তা হলে তোমার বাবার কাছে গিয়ে থাকতে?
নাহ্, তাও তো হত না। ছেড়ে দেওয়ার জন্যে তো মা আমার দখল নেয়নি। তোয়ার স্বরটা যেন কেমন ভাঙা ভাঙা শোনাল, বাবা-মা বাপি, যে যার ইচ্ছে মতো লাইফ লিড করতে পারে। শুধু আমারই কোনও ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই। থাকার রাইটই নেই কোনও। শুধু লক্ষ্মী হয়ে থাকো, আর তালে তালে সঙ্গত করে যাও…
লাল্টুর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল, আমারও তো তাই।
গলায় কোনও শব্দ এল না, বুক কাঁপিয়ে খানিক বাতাস বেরোল শুধু। উঁহু, বাতাস নয়, শব্দহীন হাহাকার। আস্তে আস্তে দৃষ্টি ঘুরে গেছে তোয়াতে। দাম্ভিক মেয়েটাকে একদম অন্যরকম লাগছে। লাল্টুর চেয়ে অনেক বেশি দুঃখী যেন। অনেক বেশি একা।
তোয়ার হাতখানা ছুঁতে চাইল লাল্টু। পারল না।
.
০৯.
দ্বিধা তো একটা ছিলই। গলিতে গাড়িটা ঢুকতেই মনের দোলাচল যেন আরও বেড়ে গেল তৃষিতার। চলে তো এল, কিন্তু যাওয়াটা শোভন হচ্ছে কি? অয়নের বাড়িতে এই আকস্মিক পদার্পণ কীভাবে নেবে শর্বরী? আগে একবার ফোন করে নেওয়া বোধহয় উচিত ছিল।
তুৎ, এত ভাবাভাবির কী আছে! তৃষিতা তো অয়নের সঙ্গে প্রেম করতে যাচ্ছে না। একদা ঘনিষ্ঠ একটা মানুষ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বিছানায় পড়ে, তাকে দেখতে আসা তো গর্হিত কোনও কাজ নয়। তা ছাড়া তৃষিতার সঙ্গে অয়নের যে একটা সহজ সম্পর্ক আছে এও তো শর্বরীর জানা। দ্বিতীয় বিয়েটার পর একদিন তৃষিতাকে রেস্তরাঁয় ডেকে শর্বরীর সঙ্গে আলাপও করিয়ে দিয়েছিল অয়ন। ফাজলামিতে অয়নের কোনও কালেই মাত্রাজ্ঞান নেই, সেদিন তৃষিতার সামনেই অবলীলায় শর্বরীকে বলেছিল, আমাকে হেলাফেলা কোরো না ডিয়ার, দেখে নাও আমার আগের বউটা কেমন সুন্দরী ছিল! শর্বরী তো সেদিন স্পোর্টিংলি নিয়েছিল মন্তব্যটা। অন্তত তার হাসিটাসি দেখে সেরকমই মনে হয়েছিল। তারপর তো বেশ কয়েক বছর গড়িয়ে গেছে। ন’মাসে-ছ’মাসে হলেও তোয়া এ বাড়িতে এসে থেকে যায় এক-আধদিন, তখন তো শর্বরীর সঙ্গে ফোনে কথাও বলেছে তৃষিতা। তা হলে আজ খামোখা তৃষিতা সংকোচে ভোগে কেন?
কুণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে পুরনো দোতলা বাড়িটার সামনে গাড়ি দাঁড় করাল তৃষিতা। নেমে একবার চকিত চোখ বোলাল চারদিকে। গত বারো-তেরো বছরে বেশ ঘিঞ্জি হয়েছে পাড়াটা। দু’-চারটে ফাঁকা প্লট ছিল এপাশে ওপাশে, এখন সেখানে ফ্ল্যাট। চেনা বাড়িও চোখে পড়ে, তবে তাদের যেন কেমন অচেনা লাগে আজ। ভোল টোলের হেরফের ঘটেছে বলে কি? নাকি সময়ের ব্যবধান চেনাকেও খানিকটা অচেনা করে দেয়?
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে তৃষিতা ঢুকল বাড়িটায়। দু’ধাপ উঠে পরিচিত দরজা। পাশে দেওয়ালের গায়ে নামহীন লেটার বক্স। এটা কি আগেও ছিল? ঠিকঠাক স্মরণ করতে পারল না তৃষিতা। কেন পারছে না? আদৌ চিঠিপত্র আসত না বলেই হয়তো মুছে গেছে স্মৃতি থেকে।
কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে তৃষিতা বেল টিপল। কাঁধের দোপাট্টাটা গুছিয়ে নিল একটু। তেমন একটা অগোছালো নেই, তবুও।
দরজা খুলেছে বছর পঁচিশেকের একটি মেয়ে। তার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে তৃষিতা তাড়াতাড়ি বলল, অয়ন বিশ্বাস…?
উনি তো অসুস্থ। শুয়ে আছেন।
জানি। আমি ওঁকে দেখতে এসেছি।
আসুন।
অন্দরে পা রেখে একটা হালকা শিরশিরে অনুভূতি। সেই পনেরো ফুট বাই বারো ফুট জায়গাটা। অয়ন কায়দা মেরে বলত লিভিং রুম। চেহারাটা অবশ্য খুব মলিন নয় এখন। দেওয়ালে রং টং পড়েছে, এক ধারে পরিপাটিভাবে রাখা বেতের ছোট ছোট সোফাসেট, জানলায় সুদৃশ্য পরদা। ওদিকে, রান্নাঘরের সামনেটায় কাচ বসানো ছোট ডাইনিং টেবিল। তৃষিতার সময়েও অনেকটা এভাবেই সাজানো থাকত, তবে জিনিসগুলো সব বদলে গেছে। সেই হতশ্রী ভাবটা একেবারেই নেই। আগে অয়নের আঁকা বেশ কিছু ছবি ছিল দেওয়ালে, এখন প্রতিটি দেওয়াল অস্বস্তিকর রকমের ফাঁকা। শর্বরী কেন সরাল ছবিগুলো? নাকি অয়নই খুলে রেখেছে?
পলকের জন্য বুঝি বিমনা হয়ে পড়েছিল তৃষিতা। শোওয়ার ঘরের দরজায় চোখ পড়তেই সচকিত হয়েছে। পরদা ধরে দাঁড়িয়ে ফুটফুটে এক মেয়ে, জুলজুল চোখে দেখছে তৃষিতাকে। ওই বয়সের তোয়ার মতোই লাগে যেন। মুখে অয়নের ছাপ এতই প্রকট, স্বচ্ছন্দে তোয়ার বোন বলে বুঝে ফেলা যায়। ইস, কেন যে শর্বরীর আদল পায়নি মেয়েটা! তোয়াই বা কেন তৃষিতার মতো হল না? কত ঠাট্টাই যে জানে প্রকৃতি!
মুখটা হাসি হাসি করে বাচ্চাটাকে হাত নেড়ে ডাকল তৃষিতা। গুটগুট করে কাছে এসেছে মেয়েটা। তৃষিতা ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, তুমি তো রুমকি, তাই না?
হ্যাঁ। তুমি কে?
আমি একটা মাসি। তোমার তোয়াদিদির মা।
রুমকি ভীষণ অবাক হয়েছে। চোখ পিটপিট করে দেখছে তৃষিতাকে।
ঘর থেকে অয়নের স্বর উড়ে এল, কে এসেছে রে রুমকি?
রুমকি তার মতো করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই তৃষিতা পরদা সরিয়ে উঁকি দিয়েছে, কেমন আছ?
বালিশে হেলান দিয়ে আধশোওয়া ছিল অয়ন। গলা দিয়ে বিস্ময় ঠিকরে এল, আরে, কী কাণ্ড! তুমি?
যা একখানা কীর্তি করেছ…। তৃষিতা লঘুভাবে বলল, ভাবলাম, তোয়ার মা হিসেবে একটা ভিজিট দিয়ে আসি।
এসো, এসো। বোসো, বোসো।…লতা, এখানে একটা বসার কিছু দাও।
লতা বুঝি তৈরিই ছিল। একটা মোড়া এনে রাখল খাটের পাশে। জিজ্ঞেস করল, একটু চা করে আনি?
অবশ্যই। দু’কাপ বানিয়ো, আমি আর একবার খাব। লতা বেরিয়ে যেতেই অয়নের গলায় রীতিমত উচ্ছ্বাস, কল্পনাও করতে পারিনি এ বাড়িতে আবার তোমার পায়ের ধুলো পড়বে।
তৃষিতা আলতো হাসল। সে নিজেও কি কল্পনা করতে পেরেছিল? কিন্তু অয়ন তাকে এমনভাবে টানতে শুরু করল…! অয়নের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে পলকের জন্য হিম হয়ে গিয়েছিল তৃষিতার শরীর, হৃৎপিণ্ড যেন থেমে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্ত। তারও কোনও যুক্তিসংগত কারণ ছিল কি? অয়ন আদৌ বেঁচে রইল, কি মরে গেল, তাতেই বা তৃষিতার এখন কী আসে যায়? কিছুই না। তবু কেন যে এরকম উলটোপালটা আচরণ করে মনটা? সমস্ত হিসেব গুলিয়ে দেয়? এই যে এখন পা-জোড়া প্লাস্টার, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, অর্ধশায়িত অয়নকে দেখে বুকের ভেতর একটা চোরা কুলকুল ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে তৃষিতা, এটাই বা কোন হিসেবে পড়ে?
হাঁটুঝুল শর্টস আর টিশার্ট পরা অয়ন দু’হাতে ভর দিয়ে সিধে হয়ে বসল। মুচকি হেসে বলল, আমার তো মিনিবাসের ড্রাইভারটাকে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করছে। এবং ওই মোবাইল কানে মেয়েটাকে। ওদের মিলিত প্রচেষ্টাতেই না আমার আজ এই সৌভাগ্যটা হল!
একটু যেন বেশি উচ্ছল হয়ে পড়েছে অয়ন। তৃষিতা অল্প অল্প অস্বচ্ছন্দ বোধ করছিল। রুমকি কখন এসে উঠে পড়েছে খাটে, বসে আছে বাবার গা ঘেঁষে। তার দিকে চোখ রেখে তৃষিতা বলল, তোমাদের মেয়েটা তো ভারী মিষ্টি হয়েছে।
হুউম। আমার ভীষণ ন্যাওটা। আমাকে পেলে ছাড়েই না। মেয়ের চুল ঘেঁটে দিল অয়ন। স্মিত মুখে বলল, তুমি কি সোজা অফিস থেকে?
হ্যাঁ বলতে গিয়েও কোঁৎ করে গিলে নিল তৃষিতা। স্থান কাল পাত্র অনুযায়ী সত্যিতে আড়াল টানতে হয়, তৃষিতা জানে। জীবনের শিক্ষা। গলা ঝেড়ে বলল, না। এদিকে অফিসেরই একটা কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম ফেরার পথে একটু ঘুরেই যাই।
এদিকে কোথায়?
এই তো, কাছেই। বোড়ালে।
কীসে এলে? অফিসের গাড়িতে?
আন্দাজটা খুব ভুল নয়। অফিসের কাজে এদিক ওদিক গেলে অফিসের গাড়িই ব্যবহার করে তৃষিতা। তবে গত সপ্তাহ থেকে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম চলছে। নতুন গাড়ির ডেলিভারি পেয়ে গেছে সিদ্ধার্থ, পুরনোটা এখন তৃষিতার অধিকারে। আজ সেই গাড়িতেই অফিস থেকে সরাসরি এসেছে তৃষিতা।
মুখ ফুটে এবারও সত্যিটা বলতে পারল না তৃষিতা। এড়ানো গলায় বলল, হ্যাঁ…ওই আর কী…
অফিস তোমায় গাড়ি প্রোভাইড করে? শুনেও ভাল লাগে। অয়নের গলায় তারিফের সুর, তোমার দম আছে। আমার মতো ফেকলু পার্টি হয়ে থাকোনি, নিজের চেষ্টায় অনেকটা উঠেছ।
এটাও সত্যি নয়। নিজের উত্থানের মাত্রা তৃষিতার চেয়ে বেশি আর কে জানে! তার শখ বিলাসিতা সবই তো সিদ্ধার্থর দৌলতে। তবু ঠোঁটে হাসি টেনে তৃষিতা বলল, ছাড়ো তো অফিসের ব্যাপার ট্যাপার।
লজ্জা পাচ্ছ? অয়ন মিটিমিটি হাসছে, তা বোড়ালে তোমাদের কী প্রোজেক্ট হচ্ছে?
ভবঘুরেদের রাত্রিবাসের একটা আস্তানা। এবার সত্যি কথাই বলল তৃষিতা, এমন একটা বন্দোবস্ত যাতে শ দুয়েক ভ্যাগাবন্ড থাকতে পারে।
ভেরি গুড। আমায় ঠিকানাটা দিয়ো তো।
কেন?
কবে শর্বরী ঘাড় ধরে বার করে দেয়…! তখন তো একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলবে।
কী যা তা বলছ! শর্বরী মোটেই ওই টাইপ নয়! সে ঘোরতর সংসারী, তোমার খুব যত্নআত্তি করে…। এ বাড়ির কথা ভুলেও ও বাড়িতে উচ্চারণ করে না তোয়া, তবু তৃষিতা ফস করে বলে উঠল, তোয়া আমায় সব গপ্পো করে।
তাই বুঝি? আর কী বলে?
শর্বরী আন্টিকে তার খুব পছন্দ। শর্বরী নাকি খুব লাভিং, কেয়ারিং…। তৃষিতা ঝলক থমকাল। বানিয়ে বানিয়ে কথা বলার নেশা তাকে পেয়ে বসল নাকি? অয়নের কাছে নিজেকে কী প্রতিপন্ন করতে চায় সে? এক উদারমনা মা? প্রাক্তন স্বামীর বর্তমান স্ত্রীর প্রতি কণামাত্র অসূয়াবিহীন এক অলৌকিক নারী? কোনওক্রমে নিজেকে সংযত করে প্রসঙ্গ ঘোরাল তৃষিতা, শর্বরী কখন ফেরে স্কুল থেকে?
সময় হয়ে গেছে। এবার আসবে।
লতা চা এনেছে। সঙ্গে প্লেটে বিস্কুট আর চানাচুর। শুধু কাপটুকু নিয়ে তৃষিতা জিজ্ঞেস করল, তোমার প্লাস্টার আর কতদিন রাখবে?
মোট সিক্স উইকস বলেছিল। অর্থাৎ আরও চার সপ্তাহ।
তদ্দিনে নিশ্চয়ই হাড় জোড়া লেগে যাবে?
কে জানে! প্লাস্টার কাটার পর ফের এক্স-রে হবে। সঠিক মেরামত না হয়ে থাকলে আবার অপারেশন, আবার প্লাস্টার…এইভাবে আধা অথর্ব দশায় পড়ে থাকা…। আমার স্কুলের চাকরিটা বোধহয় গেল।
নেগেটিভ চিন্তা করছ কেন? এভরিথিং উইল বি ফাইন। তৃষিতা আশ্বাস দিতে চাইল অয়নকে। নরম গলায় বলল, মাঝখান থেকে তোমার ক’দিন ভোগান্তি, এই যা।
আমি তো জীবনকে ওভাবে দেখি না তৃষিতা। কষ্টটষ্টগুলো তো আছেই। থাকবে। কিন্তু…। অয়ন একটু চুপ থেকে বলল, অ্যাক্সিডেন্টটার থেকে আমি তো অনেক কিছু গেনও করেছি।
কীরকম?
এই যেমন…তুমি এলে। এটাও তো এক ধরনের প্রাপ্তি। তারপর ধরো, ইদানীং তোয়ার এ বাড়িতে আসাটা অনেক কমে গিয়েছিল, অ্যাক্সিডেন্টের পর আবার ঘনঘন মেয়েটার দর্শন পাচ্ছি। প্লাস, সিদ্ধার্থবাবুর ছেলেটি… পরিচয় তো হসপিটালেই হয়েছিল। এখন তো সে এ বাড়িতেও আসে। তোয়ার সঙ্গে। অয়ন আলগা মাথা দোলাল, কী ভাল ছেলে, আহা। গল্প করলে মনটা তর হয়ে যায়।
এমন একটা সমাচারের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না তৃষিতা। সোহম আসে এখানে? তোয়ার সঙ্গে? কই, সোহম বা তোয়া কেউ তো বলেনি কিছু! বরং অয়নের শরীরস্বাস্থ্যের খবর নিতে গেলে তোয়া এমন ছাড়া ছাড়া উত্তর দেয়, শুনলে মনে হয় স্রেফ ফোনেই বুঝি বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে মেয়ে। সোহম তোয়ায় এত ভাবই বা হল কোত্থেকে? বাড়িতে তো অতটা বোঝা যায় না!
তৃষিতার ক্ষণিক চিত্তবৈকল্য বুঝি খেয়াল করেনি অয়ন। হাসি হাসি মুখে বলল, সেদিন একটা ভারী মজার গল্প শোনাল সোহম। ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে তারা স্কুলের বন্ধুরা মিলে নাকি একটা পত্রিকা বার করেছিল। প্রেসের টাকা শোধ করতে পারেনি, ছাপাখানার মালিক রাত দশটায় হানা দিয়েছিল বাড়িতে। ভয় পেয়ে সোহম তো বাড়ি ছেড়ে ধাঁ। শেষমেশ ওর দিদা নাকি গাঁটগচ্চা দিয়ে ওকে বিপদ থেকে রক্ষা করে। আয়রনি অফ দা স্টোরি, সোহম একটা গল্প লিখেছিল পত্রিকাটার জন্য, কিন্তু জায়গার অভাবে ওর গল্পটাই ছেঁটে বাদ দিতে হয়। মনের দুঃখে নাকি তখনই ঠিক করেছে, জীবনে আর কখনও গল্প লিখবে না। …আমি তো ওকে খুব সান্ত্বনা দিলাম। বললাম, তুমি একজন ব্যর্থ গল্পকার, আমি একজন ব্যর্থ পেন্টার। তোমার গল্প পত্রিকা থেকে বাদ পড়ে যায়, আর আমার আঁকা কেউ কেনেই না। সুতরাং আমরা দু’জনে এক নৌকোর যাত্রী।
অয়ন বলে চলেছে রসিয়ে রসিয়ে, কিন্তু তৃষিতা একটুও উপভোগ করছিল না। উলটে কান যেন ঝাঁঝাঁ করছে। অপমানে। বাড়িতে যে ছেলে একটি বাড়তি শব্দ উচ্চারণ করে না, এখানে এসে কিনা তার মুখের ফোয়ারা খুলে যায়! বাবার বউয়ের ছাড়াছাড়ি হওয়া বরটির সঙ্গে তার এত দহরম গজায়ই বা কোন হিসেবে? এ তো শুধু তৃষিতাকে নয়, সিদ্ধার্থকেও হেয় করা।
অয়নের চলমান বাক্যসমূহের মাঝে আচমকাই উঠে দাঁড়িয়েছে তৃষিতা। ভ্যানিটিব্যাগ কাঁধে তুলে নিয়ে বলল, আজ আমি চলি, বুঝলে।
সে কী? আর একটু বসে যাও। এক্ষুনি শর্বরী এসে পড়বে।
আমাকে একবার অফিস ফিরতে হবে। স্টাফরা ওয়েট করছে। অম্লান বদনে মিথ্যে বলল তৃষিতা। সামান্য শ্লেষের সুরে বলল, তোমার শর্বরীর সঙ্গে দেখা হওয়া আমার কপালে নেই।
আর একদিন এসো তা হলে। পারলে সিদ্ধার্থবাবুকেও এনো। যদি অবশ্য তাঁর আপত্তি না থাকে।
স্থির চোখে তৃষিতা অয়নকে দেখল একটুক্ষণ। ব্যঙ্গ করছে কি না বোঝার চেষ্টা করল। নাহ্, মুখে তো সহজ আমন্ত্রণের ভাবটাই লেগে আছে অয়নের। কী করে যে এত অনায়াস থাকে পারে লোকটা?
তৃষিতা স্বর অকম্পিত রেখে বলল, দেখি।
বাইরে এসে বুক ভরে বাতাস টানল তৃষিতা। অয়নের ঘরে এত অক্সিজেন কমে গিয়েছিল! গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে নির্দেশ ছুড়ল, চলো।
ড্রাইভার স্টার্ট দিয়েছে গাড়িতে, ম্যাডাম কি আবার অফিসে যাবেন?
না। সোজা বাড়ি।
গড়িয়া বাজারের ভিড়ভাট্টা ছাড়িয়ে গাড়ি বাইপাস ধরেছে। শেষ অঘ্রানের বিকেল ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। বিদায়ী হেমন্তের শুকনো বাতাসে শীতের পদধ্বনি।
সোহমকে নিয়ে চিন্তাটাই ফের দখল করেছে তৃষিতার মস্তিষ্ক। কুরে কুরে খাচ্ছে যেন। শুধু সোহম কেন, তোয়াও তো কম ভাবাচ্ছে না। বাবাকে দেখতে তোয়া যেতেই পারে। তৃষিতা যতই আহত হোক, গড়িয়ায় যাতায়াতটা মা’র কাছে গোপন রাখা তোয়ার পক্ষে চরম অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু সোহম এর মধ্যে ঢুকে পড়ল কীভাবে? ওরা নাকি একসঙ্গে যায়! এটা কী করে সম্ভব? বাড়ি থেকে দু’জনে একসঙ্গে বেরিয়েছে, এমনটা তো সবিতার মুখে কখনও শোনেনি! নাকি সবিতা সেভাবে খেয়াল করে না? উঁহু, ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না, বাড়ি গিয়ে জানতে হবে। নিয়মিত দু’জনে মিলে গড়িয়া যাওয়ার মতো বন্ধুত্ব যদি গড়ে উঠেও থাকে, বাড়িতে তার চিহ্ন টের পাওয়া যায় না কেন? দু’জনে এ ওর ঘরে গিয়ে আড্ডা মারছে, হাসিঠাট্টা করছে, এমনটা তো কদাচ চোখে পড়েনি তৃষিতার! তার অগোচরে কিছু একটা ঘটে চলেছে কি? তলে তলে? সোহমকে নিয়ে হসপিটালে ছোটার দিনই হয়তো যার সূত্রপাত?
হঠাৎই তৃষিতার হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল থরথর। কেন যে কাঁপল? সিদ্ধার্থর ছেলে আর তার মেয়ের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠুক, এমনটাই তো চেয়েছিল তৃষিতা। সোহমের সঙ্গে দোস্তি করছে না বলে মেয়ের ওপর চোটপাটও করেছে অল্পস্বল্প। এখন সত্যি সত্যি বন্ধুত্বটা গড়ে উঠেছে, অথচ এই সম্ভাবনার কথা ভেবে তৃষিতা বিরক্ত হচ্ছে? কেন? তার আড়ালে হয়েছে বলে?
কিন্তু শুধু বিরক্তিই কি জাগছে তৃষিতার মনে? নাকি একটা চোরা আশঙ্কাও…?
ঘি আর আগুনের সেই আদ্যিকালের প্রবাদটা কি ভয় পাইয়ে দিল তৃষিতাকে?
তোয়ার কীই বা জ্ঞানবুদ্ধি হয়েছে, বয়সটাও মারাত্মক, তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সোহম একটা কিছু ঘটিয়ে ফেলতেও তো পারে?
হ্যাঁ, ভুলিয়ে ভালিয়ে। কারণ সোহম মোটেই সোজাসাদা ছেলে নয়। অন্তত সে যে বাড়িতে নিতান্ত গোবেচারা রূপটি প্রদর্শন করে, সেটা যে নিখাদ সত্যি নয়, এ তো অয়নের কথা থেকেই স্পষ্ট। সত্যি যদি ওই ছেলের মনে বাজে মতলব থাকে, তা হলে তো তোয়ার সমূহ বিপদ।
একটা ঘটনা আচমকাই টোকা দিল তৃষিতার মাথায়। তোয়াকে একদিন কথায় কথায় বলেছিল তাকে সে আর্কিটেক্ট বানাতে চায়। তোয়া স্রেফ ঠোঁট উলটেছিল, খুব একটা আমল দেয়নি। এই তো সেদিন তৃষিতা আবার তুলল প্রস্তাবটা। তোয়া তখন বিছানায় উপুড় হয়ে আইপ্যাড খুলে কী যেন করছিল। ফস করে মুখের ওপর বলে দিল, ওই সব ধান্দা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো! আমি তোমার দাবার ঘুঁটি হতে রাজি নই!
কী করে মেয়ে টের পেয়ে গেল তৃষিতার মনোবাসনা? তখন তলিয়ে ভাবেনি, এখন মনে হচ্ছে এর পিছনেও সোহমের উসকানি আছে। নির্ঘাত মগজ ধোলাই করেছে তোয়ার। সত্যিই যদি মেয়েটাকে এতটাই প্রভাবিত করে থাকে সোহম, তা হলে এখন একটা বিপদ ঘটা তো সময়ের অপেক্ষা।
আশ্চর্য, তৃষিতার একটি বারের জন্যও মনে হচ্ছিল না, তার সতেরো ছুঁইছুঁই মেয়েটি মোটেই হাবাগোবা বালিকা নয়। বরং ভাঙা ঘরের সন্তান হওয়ার সুবাদে তার খানিকটা বাড়তি ঘ্রাণশক্তিও আছে। তার জোরেই মাকে পড়তে পারে তোয়া। সোহমের এতে কোনওই ভূমিকা নেই।
বাড়ি ফিরে তৃষিতা দেখল সবিতা একা একা বসে টিভি গিলছে। চটি ছাড়তে ছাড়তে তৃষিতা প্রশ্ন ছুড়ল, তোয়া কোথায়?
তার তো আজ পড়া আছে।
আর সোহম? সে ফেরেনি?
এসেছিল। আবার বেরিয়েছে।
তোয়া গেছে তো টিউটোরিয়ালে? নাকি দু’জনে বাইরে কোথাও…? টিউটোরিয়ালের নাম্বারটা আছে মোবাইলে, খোঁজ নেবে নাকি? থাক। অকারণ সন্দেহ করছে টের পেলে অনর্থ করবে তোয়া।
ঘরে গিয়ে একটুক্ষণ ঝুম হয়ে বসে রইল তৃষিতা। নিজেকে খানিক শান্ত করে মগজ থেকে বার করল নিক্তিখানা। সোহমের সঙ্গে তোয়ার যদি একটা সম্পর্ক হয়েই যায়, সেটা ভাল না মন্দ? ব্লাড রিলেশন যখন নেই, তখন অবৈধও নয়। বড়জোর বাবা-মা আত্মীয়স্বজনদের একটু চোখে লাগবে, এই যা। মেয়ের ভবিষ্যৎ তো একশো পারসেন্ট সুরক্ষিত হয়ে যাবে, নয় কি? মন হয়তো একটু খচখচ করবে, কিন্তু পাল্লাটা লাভের দিকেই ঝুঁকছে। আচ্ছা, সিদ্ধার্থ কী চোখে দেখবে ব্যাপারটা? পাছে সিদ্ধার্থর খারাপ লাগে তাই মনের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও সোহমকে এ বাড়িতে ডেকে নিয়েছিল তৃষিতা। পরে সিদ্ধার্থ তার কদর্থ করবে না তো? ভাববে না কি তোয়ার আখের গোছানোর জন্য এই উদার আহ্বান? তৃষিতার যে সত্যিই কোনও পরিকল্পনা ছিল না, এটা কি সিদ্ধার্থ বুঝবে?
নিজের অজান্তেই তৃষিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাহ্, সিদ্ধার্থর চোখে সে ছোট হতে পারবে না। এক্ষুনি এক্ষুনি সোহম তোয়াকে ঘাঁটানোও বোধহয় ঠিক কাজ নয়। বরং নজর রাখতে হবে তোয়ার ওপর। কথা বলে বলে বুঝতে হবে কী চাইছে মেয়ে। সিদ্ধার্থকেও একটু ছুঁইয়ে রাখবে নাকি? আভাসে ইঙ্গিতে?
সন্ধে গাঢ় হওয়ার আগেই ফিরল সোহম। এসেই বইখাতা খুলে বসে গেছে। তোয়া এল আরও ঘন্টাখানেক পর। ঘরে ঢুকে চিতপাত হয়ে পড়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর পোশাক টোশাক বদলে দু’কানে পুঁটলি গুঁজে গান শুনছে আইপডে। তার মাঝেই চলছে তার অঙ্ক কষা, চোখ বোলাচ্ছে বইয়ের পাতায়। দু’জনের কারও মধ্যে বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিকতার চিহ্ন নেই। রাত্তিরে খাওয়ার টেবিলেও দু’জনকে নজর করল তৃষিতা। কথা বলছে টুকটাক, যেমন বলে। তোয়া ঝড়ের গতিতে খাওয়া শেষ করে আগে উঠে গেল, যেমন যায়। প্রায় নির্বাক সোহম খুটুর খুটুর খুঁটছে রুটি, যেমন খোঁটে রোজ।
তৃষিতার ধন্দ বাড়ছিল। খাওয়া দাওয়ার পর একবার ভাবল সরাসরি হানা দেয় মেয়ের ঘরে। কীভাবে কী প্রশ্ন করবে ভেবে না পেয়ে আজকের মতো নিরস্ত করল নিজেকে। তবে নিজেদের ঘরে এসে আর নিশ্চুপ থাকতে পারল না। মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে বলে উঠল, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।
সিদ্ধার্থর মেজাজ আজ দারুণ ফুরফুরে। নরেন্দ্রপুরের জমিটা বায়না করে এসেছে আজ। পৌষমাস কাটলেই ফাইনাল হয়ে যাবে ডিলটা। নিজের পছন্দমতো প্রোজেক্ট গড়ার কল্পনায় সে এখন বেজায় বিভোর।
ল্যাপটপ খুলে গুনগুন গান গাইছিল সিদ্ধার্থ। সুর করেই বলল, শোনাও, শোনাও।
আমি আজ অয়নকে দেখতে গিয়েছিলাম।
তাই বুঝি? একটু যেন ছন্দপতন হল। গদ্যেই জিজ্ঞেস করল সিদ্ধার্থ, কেমন আছেন এখন অয়নবাবু?
এমনি ঠিকই আছে। তবে প্লাস্টার না কাটলে অবস্থাটা বোঝা যাবে না। তৃষিতা ছোট্ট করে দম নিল। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল, ওখানে গিয়ে একটা আজব খবর শুনলাম, বুঝলে।
কী?
তোয়ার সঙ্গে সোহমও নাকি যায় গড়িয়ায়। শুধু তাই নয়, ওখানে গিয়ে নাকি অনেক কথাটথাও বলে।
ও। সিদ্ধার্থর আনন্দটা যেন একটু চুপসে গেল। কাঠ কাঠ গলায় বলল, তা ভালই তো। কোথাও একটা তবু যাচ্ছে।
আমি তো জানতেই পারতাম না। তোয়া তো কিছু বলেইনি। তৃষিতা হাসিটাকে সামান্য চওড়া করল, আমরা বুঝতে পারি না…তোয়া সোহমে বেশ ভাব হয়ে গেছে।
হলেই ভাল। না হলেই তো অশান্তি। ঠিক কি না?
কথাটা যেন বুঝতে পারল না তৃষিতা। সিদ্ধার্থর প্রতিক্রিয়াটা যেন অজানা রয়ে গেল। আর একটু খোঁচাবে কি সিদ্ধার্থকে?
প্রশ্ন করার সুযোগ হল না। সিদ্ধার্থ ল্যাপটপ বন্ধ করে বাথরুমে চলে গেছে। ফিরে তৃষিতার কাঁধে আলগা চাপ দিল, চলো, শুয়ে পড়া যাক।
ওই স্পর্শটুকুর অর্থ তৃষিতার অজানা নয়। আজ তাকে চাইছে সিদ্ধার্থ। হঠাৎ আজই কেন? এতে অয়নের অপ্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই তো? মুখে যতই নির্বিকারভাব দেখাক, তৃষিতার হঠাৎ গড়িয়া ছোটাই কি পৌরুষ জাগিয়ে তুলল সিদ্ধার্থর? এবং তার অধিকারবোধও?
তা তৃষিতাই বা দিতে কার্পণ্য করবে কেন। বিয়ে যে নেহাতই দেওয়া নেওয়ার খেলা, এটা জেনেই তো সিদ্ধার্থর সঙ্গে ফের ঘর বেঁধেছিল সে।
বড় জোর পাঁচ-সাত মিনিটের উদ্দামতা। মৈথুন শেষে দু’জনেই নিথর। শুয়ে আছে পাশাপাশি।
তৃষিতা উঠে বাথরুমে যাবে ভাবছিল, সিদ্ধার্থর গলা শুনতে পেল, আমি একটা কথা ভাবছিলাম, বুঝলে।
কী?
নরেন্দ্রপুরে যদি দুটো কি তিনটে প্লট নিজের জন্য নিয়ে রাখি… মোটামুটি সাত-আট কাঠা মতন জায়গা…জমিয়ে একখানা বাড়ি হাঁকাব, বেশ বাগানটাগান থাকবে, একখানা সুইমিং পুলও বানিয়ে নেওয়া যায়…
হঠাৎ এরকম বাসনা?
হঠাৎ নয়। অনেকদিনই আছে। সেই যেদিন যাদবপুরে আর্কিটেকচার ক্লাসে জয়েন করলাম, সেদিন থেকেই ভেবে আসছি নিজের ডিজাইন করা বাড়িতে…এই ফ্ল্যাট ট্যাটে থাকা আর আমার পোষাচ্ছে না।
তা হলে এই ফ্ল্যাটটা কী করবে? বেচে দেবে?
প্রশ্নই আসে না। এমন একটা অ্যাসেট কেউ হাতছাড়া করে নাকি? সিদ্ধার্থ পাশ ফিরে দেখল তৃষিতাকে। একটু অবাক সুরে বলল, ভাবলে কী করে এই ফ্ল্যাট আমি বেচে দিতে পারি?
হায় রে, কোন আশঙ্কা যে মায়ের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে তা যদি তৃষিতারই পুরোপুরি জানা থাকত!
তৃষিতা অস্ফুটে বলল, না না, এমনিই মনে হল।
আবার অখণ্ড নীরবতা। নৈঃশব্দ্য বহন করেই বাথরুমে যাচ্ছে তৃষিতা। রাতবাতির নীলাভ আলো মেখে শুয়ে আছে সিদ্ধার্থ।
ঠান্ডা বাড়ছিল। বাইরে। ঘরেও।