০৫. ট্রেন দুঘণ্টা লেট

ট্রেন দুঘণ্টা লেট।

পৌঁছার কথা চারটায়, পৌঁছল ছটায়। নবনীর খুব বিরক্তি লাগছিল। তার ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট। কামরায় আর যারা আছে তাদের মনে হচ্ছে কারোরই টিকিট নেই। একজন আবার উঠেছে ছাগল নিয়ে। ট্রেনের বাথরুমের দরজা বন্ধ হয় না। মাঝে মাঝে এমন শব্দ হয় মনে হয়। দরজা ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। যতই সময় যাচ্ছে ততই তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। মেজাজ খারাপের চূড়ান্ত পর্যায়ে ট্রেন থামল। নবনী ট্রেনের জানোলা দিয়ে মাথা বের করে হঠাৎ করেই মুগ্ধ হয়ে গেল–কী সুন্দর দিন! পিচকারি ভর্তি হলুদ রঙ কেউ যেন বাতাসে ছিটিয়ে দিচ্ছে। আকাশের মেঘ। সূর্যের আলোকে কিছু একটা করেছে। দিনের শেষে আলো যেখানেই পড়ছে সোনা রঙ হয়ে যাচ্ছে। রঙের গান্ধ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। নবনীর মন খারাপ হলো এই ভেবে যে তার সঙ্গে কেউ নেই। কেউ থাকলে কিশোরীদের মতো চেঁচিয়ে বলতে পারত–দেখ দেখা কী সুন্দর! সুন্দর কিছু দেখলেই অন্যকে দেখাতে ইচ্ছা করে।

আরে আরো আফা না?

নবনী তাকাল। প্লাটফরম থেকে দৌড়ে তার দিকে কে যেন আসছে। গোলগাল মুখ, মাথা পরিষ্কার করে কামানো। মনে হচ্ছে আজই কামিয়েছেচকচক করছে। পরনে লুঙ্গি, পায়ে রবারের জুতা। গায়ে ইস্ত্রি করা টি-শার্টে লেখা University of California. লোকটি দাঁত বের করে এমনভাবে হাসছে। যেন নবনী তার দীর্ঘদিনের পরিচিত, অথচ নবনী আজই মানুষটাকে প্রথম দেখছে।

আফা আমারে চিনেছেন? আমি মতি। আপনি যান কই?

এখানেই নামব।

নামলে নামেন। জানোলা দিয়া বেদিশার মতো চাইয়া আছেন। আমি ভাবি ঘটনা। কী? আমরার আফা যায় কই? ট্রেন ছাইড়া দিব আফা।

আমি কিন্তু তোমাকে চিনতে পারছি না।

মতি আনন্দিত গলায় বলল, মাথা কামাইছি বইল্যা চিনতে পারতেছেন না। মাথায় উকুন হইছিল। মাথা কামাইয়া সোডার পানি দিয়া ধুইয়া উকুনের বংশ শেষ করছি। আফনে মনে হয় এখনো চিনেন নাই। ইয়াদ কইরা দেখেন প্ৰথমবার যখন আসছেন ডাক্তার সাবের কাছে আপনেরে কে নিয়া গেছিল?

ও আচ্ছা। মনে পড়েছে। তখন তোমার গাল ভর্তি দাড়ি ছিল।

এই তো চিনেছেন। দাড়িতেও উকুন হয়েছিল। উকুন আমারে ভালো পায়। নামেন আফা, নামেন। জিনিসপত্র কী আছে দেখায়ে দেন।

মতি লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ল। তাড়াহুড়া করার প্রয়োজন নেই। আজ ট্রেন ফাঁকা। মতি তার অভিজ্ঞতায় দেখেছে ট্রেন যখন ফাঁকা থাকে যাত্রীরা ধীরে সুস্থে নামে তখনই জিনিসপত্র ফেলে যায়। প্রচণ্ড ভিড়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটে না।

আফা আপনে যে আসবেন ডাক্তার সাব জানে?

আসব যে জানে। কবে আসব জানে না।

মতি চিন্তিত মুখে বলল, ঘরে বাজার আছে কি-না কে জানে! গিয়া হয়তো দেখবেন দুইটা আলু একটা পিয়াজ ছাড়া কিছু নাই। মহা চিন্তার বিষয় হইল।

নবনী বলল, মতি তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি দেখে শুনে মালগুলো নামাও। ঐ প্যাকেটে বই আছে। প্রচণ্ড ভারি, সাবধানে নামাও।

আফা আপনে নিশ্চিন্ত মনে নিচে গিয়া বসেন। আমার দেখা পাইছেন আর চিন্তা নাই।

নবনী ট্রেন থেকে নামল। পিচকিরি দিয়ে হলুদ রঙ ছোড়ার ব্যাপারটা এখনো ঘটছে। রঙ আরো গাঢ় হচ্ছে। তার কাছেই এ রকম লাগছে, না। অন্য সবার কাছেই লাগছে সে বুঝতে পারছে না। ট্রেন থেকে যারা নামছে তাদের কাউকেই মুগ্ধ চোখে এদিক ওদিক তাকাতে দেখা যাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ যদি ট্রেনে তার সঙ্গে আসতেন তাহলে কী করতেন? চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতেন? হাত বাড়িয়ে হলুদ আলো ছোয়ার চেষ্টা করতেন? প্লাটফরমে নেমে সুটকেসের ওপর বসে কাগজ কলম নিয়ে গান কিংবা কবিতা লিখতে বসতেন?

‘আলো ভাঙ্গার এই আলো।’

রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই ‘কী সুন্দর! কী সুন্দর!’ বলে উচ্ছাস প্রকাশ করতেন না। এত বড় মানুষদের উচ্ছাস মানায় না। তীব্ৰ উচ্ছাস কিশোরীদের এলাকা। কিশোরীদের এলাকায় কিশোরীদেরই মানায় অন্য কাউকে মানায় না। হাতের তালুতে তেতুলের আচার নিয়ে যখন কোনো কিশোরী চোটে চেটে খাবে তাকে মানাবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মানাবে না।

আফা দেখেন জিনিস সব নামছে কিনা।

নেমেছে, থ্যাংক য়ু। এখন একটা ভ্যানগাড়ি দেখ। চল রওনা দেই। এর আগের বার তুমিই তো আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলে?

অবশ্যই আমি। হেইবার আফনের পরনে ছিল কচুয়া রঙের শাড়ি, লাল সুতার হিজিবিজি পাইর।

ঠিকই বলেছ, মতি শোন আমরা দেরি করছি কেন?

পাঁচ দশ মিনিট বসতে হইব আফা।

বসতে হবে কেন?

সইন্ধ্যা মিলাইতাছে তো, এই সময় যাত্ৰা নাস্তি। সইন্ধ্যা মিলাউক। ফ্লাস্কটা দেন–গরম পানি আইন্যা দেই। চা বানায়ে খান। আপনের সঙ্গে চায়ের সরঞ্জাম আছে না আফা? গতবার ছিল।

এবারও আছে।

গরম পানি আইন্যা দিতাছি চা খান–এই ফাঁকে আমি ভ্যানগাড়ি ঠিক করি। দশ মিনিটের মামলা। আফা মাথাত কাপড় দেন–আজান হইতেছে।

নবনী মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিল। মতি লোকটাকে তার কাছে খুবই ইন্টারেষ্টিং মনে হচ্ছে। প্রথমবার যখন দেখা হয়েছে তখন এত ইন্টারেষ্টিং মনে হয় নি। মনে হলে লোকটার কথা মনে থাকত। কোনো মানুষই সবসময় ইন্টারেস্টিং থাকে না। মাঝে মাঝে ইন্টারেস্টিং হয়। আজ এই মুহূর্তে মানুষটাকে ইন্টারেষ্টিং মনে হচ্ছে। সন্ধ্যা মিলাবার পর হয়তো আর মনে হবে না।

মতি প্ৰবল উত্তেজনা বোধ করছে। উত্তেজনার কারণ স্পষ্ট না। সে অতি দ্রুত গরম পানি জোগাড় করল। নবনীর সামনে গরম পানি ভর্তি ফ্রাঙ্ক নামিয়ে ঝড়ের বেগে চলে গেল। খবর পেয়েছে বাজারে গরু জবেহ হয়েছে। ভাগা হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। এক শ টাকা ভাগা। এক ভাগ ডাক্তার সাহেবের জন্যে কিনে নেয়া যায়। এই অঞ্চলে গরুর মাংস সচরাচর পাওয়া যায় না। গরু জবেহ হয়। শুধু হটবার। আজ হাটবার না। ভাগ্যক্রমে পাওয়া গেল। ডাক্তার সাহেবের স্ত্রী এত দিন পর এসেছেন। আলু ভর্তা দিয়ে তিনি যদি রাতে ভাত খান তাতে ডাক্তার সাহেবের ইজ্জত রক্ষা হবে না। ডাক্তার সাহেবের ইজ্জত রক্ষার চিন্তায় মতিকে খুব অস্থির মনে হলো।

নবনী যত্ন করে চা বানাচ্ছে। হ্যান্ডব্যাগ থেকে সুগার কিউব, টি ব্যাগ বের হলো। ফ্লাঙ্কের লাল মুখটা হলো চায়ের কাপ। দূর থেকে কয়েকজন আগ্রহ নিয়ে তার চা বানানো দেখছে। তাদের জন্যে নিশ্চয়ই মজার দৃশ্য। একটা মেয়ে সুটকেসে বসে বেশ আয়েশ করে চা বানাচ্ছে এই দৃশ্য নিশ্চয়ই সচরাচর দেখা या না।

নবনী চায়ের কাপে চুমুক দিল। খেতে ভালো লাগছে। আরেকজন কেউ পাশে থাকলে হয়তোবা আরো ভালো লাগত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাশে থাকলে অসাধারণ একটা ব্যাপার হতো। নবনী তাঁকে কী ডাকত? গুরুদেব? না। গুরুদেব মানে অনেক দূরের কেউ। পাশে বসে যিনি চা খাবেন তিনি দূরের কেউ না। নবনী মনে মনে কথা বলা শুরু করল। সময় কাটানোর এটা একটা ভালো বুদ্ধি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কথোপকথন।

কবি চা খেতে কেমন হয়েছে?

ভালো।

‘আলো ভাঙার আলো’ এটা কবিতা না গান?

কবিতা। তবে বাণীতে সুরের আশ্রয় হলেই তো গান। সেই অর্থে গানও বলতে পার।

শুধু প্রথম লাইন লিখলেন? শেষ তো করলেন না।

প্রথম লাইনটা হলো বীজ। বীজ বপন করা হয়েছে–বৃক্ষ আসবে।

লাইনটার মানে বুঝতে পারলাম না–আলো ভাঙ্গার আলো–এর মানে কী?

তোমার মনে যে অর্থ আসে সেটাই মানে। আরো সহজ করে বুঝিয়ে দেই—যখন আমি কোনো গান বা কবিতা লিখি তখন সেটা থাকে আমার। শুধুই আমার। যখন তুমি সেটা পড় বা গুনগুন করে গানটা গাও তখন সেটা সম্পূর্ণই তোমার। সন্তান জন্ম দেই আমি কিন্তু দত্তক দিয়ে দেয়া হয় তোমাদের।

কবি আপনাকে কি আরেক কাপ চা বানিয়ে দেব?

না। প্রথম চায়ের স্মৃতিটি মাথায় রাখতে চাই। দ্বিতীয় কাপ হয়তো প্রথম বারের মতো ভালো হবে না। সুন্দর স্মৃতি থাকা ভালো না? তুমি যাচ্ছ কোথায়?

আমার স্বামী গ্রামে ডাক্তারি করেন। আপনি চলুন না। আমার সঙ্গে। কয়েকটা দিন থেকে আসবেন। আপনি গ্রামের পোষ্ট মাষ্টার নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলেন–আমার স্বামীকে নিয়েও একটা গল্প লিখতে পারবেন। গল্পটার নাম দেবেন ‘গ্রাম চিকিৎসক’।

তোমার নিমন্ত্রণ মনে থাকল। কোনো এক সময় উপস্থিত হব।

আপনাকে ইস্টিশনে একা ফেলে চলে যেতে খুব খারাপ লাগবে।

আমার কোনো সমস্যা হবে না। হাঁটতে হাঁটতে দিনের আলো কীভাবে নিভে যায়, কী করে নির্জন স্টেশনে আঁধার নামে তাই দেখব। এই দৃশ্য একজীবনে কতকার দেখলাম তারপরেও প্রতিবারই নতুন মনে হয়–যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্থরে…।

 

ইট বিছানো রাস্তা। মাঝে মাঝে ইট উঠে গেছে। রাস্তা গেছে ডেবে। ভ্যানগাড়িতে খুব ঝাঁকুনি হচ্ছে। ঝাঁকুনির চেয়েও বড় সমস্যা ধূলা উড়ছে। নবনীর ডাস্ট এলাৰ্জি আছে। এলাৰ্জির এটাক হলে হাঁচি উঠতে থাকবে। নবনী শাড়ির আঁচলে নাক মুখ ঢেকে রেখেছে। ইট বিছানো রাস্তায় এত ধূলা ওড়ার কথা না। কেন উড়ছে কে বলবে! রাস্তার দু’পাশে শিমুল গাছের সারি। একেকটা গাছ কাটাওয়ালা দৈত্যের মতো। রাস্তা পাহারা দিতে দৈত্যের সারি নেমেছে।

মতি ভ্যানগাড়ির পেছনে পা ঝুলিয়ে বসেছে। তার হাতে কচুপাতায় মোড়া গরুর গোশত। জিনিসটা সে আড়াল করে রাখছে। অতিথিকে রাতে যে খাবার খাওয়ানো হবে সেই খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এটা অতিথির জন্যে অপমানসূচক। অতিথি যেন দেখতে না পায়।

মতি মাথা ঘুরিয়ে বলল, আফারে একটু সাবধান কইরা দেই। রাইতে ঘর থাইক্যা বাইর হইবেন না। মনে করবেন। কাফু জারি হইছে। যদি বাইর হইতেই হয়। হারিকেন হাতে বাইর হইবেন। টর্চ না, হারিকেন।

নবনী বলল, কেন? রাতে বের হলে সমস্যা কী?

সমস্যা আছে। ইমাম সাব বড় ত্যক্ত করতেছে।

মানে কী? পরিষ্কার করে বল। পরিষ্কার করে না বললে বুঝতে পারছি না।

ডাক্তার সাব চিঠিতে কিছু লেখে নাই?

না।

মতি আগ্রহ নিয়ে গল্প শুরু করল। গলা নামিয়ে গোপন খবর ফাঁস করার ভঙ্গিতে বলল–এইটা একটা মারাত্মক ইতিহাস। আমরার বিরাটনগরের ইমাম সাব তেতুলগাছে ফাঁস দিয়া মারা গেছিল।

নবনী বিস্মিত হয়ে বলল, কোন ইমাম সাহেব? খুব সুন্দর চেহারা মাথায় পাগড়ি পরেন?

জ্বি উনি।

উনাকে তো চিনি। আমার জন্যে পাকা তেতুল নিয়ে এসেছিলেন। উনি ফাঁস নিয়ে মারা গেছেন? কেন?

সেইটা অন্য ইতিহাস, আরেক দিন শুনবেন। বর্তমান ইতিহাসটা শুনেনফাঁসের মরার জানাজা হয় না, এইটা তো আপনে জানেন। জানেন না?

না, জানি না।

অপঘাতে মৃত্যুর জানাজা হওনের নিয়ম নাই। কবর খুইড়া বিসমিল্লাহ বইল্যা লাশ নামাইয়া দিতে হবে, এইটাই নিয়ম। ইমাম সাবেরে তাই করা হইল। প্ৰথমে অবশ্যি চেষ্টা করা হয়েছে দেশের বাড়িতে লাশ পাঠাইতে। দেশের বাড়িত ইমাম সাবের মেয়ে আছে, পরিবার আছে। তারার যা ইচ্ছা করব। দেশের বাড়ির ঠিকানা কেউ জানে না। এইদিকে ফাঁসির মরা সুরতহাল করা লাগে। সব মিলাইয়া বেড়া ছেড়া। লাশ গেল পইচ্যা–নাড়ি উল্টাইয়া যাওয়ার মতো বাস ছুটল। তখন সিদ্ধান্ত হইল জানাজা ছাড়াই তেতুল গাছের নিচে কবর হইব।

তারপর?

কবর হইল–শুরু হইল ইতিহাস। বিরাটনগরের কোনো মানুষ এখন আর রাইতে একলা বাইর হইতে পারে না। কেউ যদি একলা বাইর হয়–পিছন থাইক্যা ইমাম সাব তারে চিকন গলায় ডাক দেয়।

নবনী অবাক হয়ে বলল, যে মরে গেছে সে পেছন থেকে ডাক দিবে কীভাবে?

এইটাই তো ইতিহাস। ইমাম সাহেব পিছন থাইক্যা ডাক দিয়া বলে, জনাব আমার জানাজাটা পড়েন। জানাজা ছাড়া কবরে শুইয়া আছি–বড় কষ্ট!

কী বল এইসব!

সত্য কথা বলতেছি আফা। যদি মিথ্যা বলি তাইলে যেন আমার মাথাত ঠাড়া পড়ে। আমার যেন কলেরা হয়। গু মুতের মধ্যে যেন মইরা পইরা থাকি। আমারে এক রাইতে নিয়া পুসকুনিত ফেলছে।

ভ্যানগাড়ির চালক পেছন ফিরে বলল, ঘটনা সত্য। বিরাটনগরের কোনো মানুষ সইন্ধ্যার পরে ঘর থাইক্যা বাইর হয় না। পিসাব পায়খানাও ঘরের মধ্যে করে।

মতি বলল, হাতে আগুন থাকলে ভয়ের কিছু নাই। আগুন না থাকলে সমস্যা। এরা আগুন ভয় পায়। আগুন হইল। ভূতের সাক্ষাত যম।

নবনী বলল, একটা মানুষ ভূত হয়ে সবাইকে ভয় দেখাচ্ছে?

মতি বলল, ভয় না আফা, হে চায় তার জানাজা হউক এর বেশি কিছু না। তবে আজিজ মিয়ারে এক রাইতে দৌড়ান দিছে। আজিজ মিয়া দৌড়াইতে দৌড়াইতে পুসকুনির মধ্যে লাফ দিয়া পড়ছে। চিৎকার শুরু করছে মাঝপুকুর থাইক্যা। লোকজন হারিকেন দা বল্লম নিয়া তারে উদ্ধার করছে। এখন আজিজ মিয়া আর গেরামে থাকে না। বাজারে থাকে। বাজারে তার দুইটা দোকান আছে। তার থাকার অসুবিধা নাই। তার মতো অবস্থা তো অন্য সবের না। বাড়ি ঘর ছাইড়া যাইব কই?

 

আনিস ঘরে ছিল না। কলে গিয়েছে। বাড়িতে আছে সুজাত মিয়া। সে বলতে পারল না। ডাক্তার সাহেব কলে কোথায় গিয়েছেন, কখন ফিরবেন।

মতি বলল, আফা কোনো দুশ্চিন্তা নাই। ডাক্তার সাব না ফিরা পর্যন্ত আমি আছি। ডাক্তার সাবের হাতে আপনেরে সোপার্দ কইরা দিয়া তারপরে বিদায়।

নবনী বলল, তোমার থাকার দরকার নেই। তুমি তোমার কাজে যাও। আমার অসুবিধা হবে না।

আমি পাহারা দেই। বাংলা ঘরের বারান্দাত বইস্যা থাকি; ভয় টয় যদি পান। সময় খারাপ। এখন আবার চলতাছে কৃষ্ণপক্ষ।

কৃষ্ণপক্ষ হোক বা শুক্লপক্ষ হোক তোমাকে পাহারা দিতে হবে না। আমার ভয় কম। তেলাপোকা আর টিকটিকি এই দুটা জিনিস ছাড়া কোনো কিছুকেই ভয় পাই না।

মতির মন খারাপ হয়ে গেল।

ভ্যানগাড়ি চলে গেছে। এখন নান্দাইল রোড়ে যেতে হলে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। তাছাড়া সেখানে গিয়েইবা করবে। কী? বাতাসীর কাছে যাওয়া যাবে না। বাতাসী জেনে গেছে মতি বিরাটনগর হাইস্কুলের শিক্ষক না। এতে সে খুবই রেগেছে। আগে সে মতিকে ‘আপনি আপনি’ করে বলত। ঘটনা জানার পর থেকে সে। ‘তুই তুকারি’ করছে। এটিও অত্যন্ত অপমানসূচক ব্যাপার। বাতাসী চোখ কপালে তুলে সাপের মতো হিসহিস শব্দ করতে করতে বলেছে—তুই না কুলি? ইস্টিশনে কুলির কাম করস। আমারে বলছস তুই মাস্টর।

মতি উদাস গলায় বলেছে, তুই তোকারি বন কর।

হারামজাদা মিসকুর। তুই ভাবছস কী?

মতি অতি বিরক্ত হয়ে বলেছে, আমি যেমন কুলি তুইও তেমন বাজারের নটি বেটি। কাটাকাটি।

তুই বাইর হ। বাইর হ কইলাম।

মতি বের হয়ে চলে এসেছে। এরপর আর বাতাসীর ঘরে যাবার প্রশ্ন ওঠে না। মতি যা পারে তা হলো নিজের বাড়িতে গিয়ে শুয়ে থাকতে পারে–সেখানেও সমস্যা আছে। তার বাড়ি মসজিদের ইমাম সাহেবের বাড়ির কাছাকাছি। নিশি রাতে ইমাম সাহেব এসে যদি বলেন–মতিরে, আমার জানাজার ব্যবস্থা কর। তখন কী হবে? মতি মন খারাপ করে রাস্তায় নামল।

 

নবনী সুজাত মিয়াকে গরম পানি করতে বলল। বালিতে শরীর কিচকিচ করছে। গরম পানিতে ভালো গোসল দিতে হবে। আগের বারে গোসলখানা বলে আলাদা কিছু ছিল না। এখন গোসলখানা বানানো হয়েছে। চৌবাচ্চা ভর্তি পানি। চৌবাচ্চা ব্যাপারটা ঢাকা শহর থেকে উঠেই গেছে। নবনী অনেক দিন পর চৌবাচ্চা দেখল। চৌবাচ্চা দেখলেই চৌবাচ্চার অঙ্কের কথা মনে পড়ে। একটা নল দিয়ে পানি আসছে, অন্য একটা নল দিয়ে পানি চলে যাচ্ছে। কত সময়ে চৌবাচ্চাটি শূন্য হয়ে যাবে?

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলায়–অঙ্কের ধরনও বদলাবে। একটা সময়ে অঙ্ক বইতে চৌবাচ্চার অঙ্ক বলে কিছু থাকবে না। নতুন ধরনের অঙ্ক থাকবে–মোবাইল ফোন নিয়ে অঙ্ক। ‘যদি একটি মোবাইল টেলিফোনে ইনকামিং চার্জ প্রতি মিনিটে দুই টাকা হয় তবে…।’

নবনীর ভালো লাগছে। ভ্যানগাড়ির ঝাঁকুনিতে শরীরের কলকজা নড়ে গিয়েছিল–এখন মনে হচ্ছে জায়গামতো বসছে। চৌবাচ্চার পানি হিমা শীতল, শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে।

বাড়িঘর সুন্দর করে গোছানো এটা দেখতেও ভালো লাগছে। খাটের চাদর টানটান করে বিছানো। খাটের পাশের টেবিলে টেবিল ল্যাম্প। আগের বার টেবিল ল্যাম্প ছিল না। নতুন কেনা হয়েছে। আনিস চিঠিতে লিখেছিল, ঘরে ইলেকট্রিক তার ছিঁড়ে গেছে বলে ঘরে ফ্যান ঘুরছে না, বাতি জ্বলছে না। নবনী দেখল ইলেকট্রিসিটি আছে। মাথার ওপর দুর্বলভাবে ফ্যান ঘুরছে।

রাত অনেক হয়েছে। ঘরের বারান্দায় নবনী বসে আছে। বারান্দায় আলো নেই! খোলা জানালা থেকে কিছু আলো এসে পড়েছে তার পায়ে। নবনীর কোলে একটা মোটা বঁধানো বই। বই পড়ার মতো আলো নেই। নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে বই হাতে রাখা। মাঝে মাঝে পাতা ওল্টানো। চারদিক অসম্ভব নীরব। রাত আটটার দিকে ঝিঝি ডাকছিল। এরাও চুপ করে গেছে। শহরের কোলাহল থেকে হঠাৎ এ ধরনের শব্দহীনতা মনের ওপর চাপ ফেলে। নবনীর কিছু ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণ আগেও ক্ষিধে পাচ্ছিল, এখন সে ক্ষিধেও নেই। মতি নামের মানুষটাকে বিদেয় করে দেয়া ঠিক হয় নি। সে থাকলে তার সঙ্গে গল্প করা যেত।

আনিস ফিরলেও খুব যে গল্প করা যাবে তা না। আনিস চুপচাপ ধরনের মানুষ। কথা বললে মন দিয়ে কথা শুনবে। নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কখনোই কিছু বলবে না। সে যে কৌতূহলশূন্য মানুষ তাও না। তার কৌতূহল আছে, কিন্তু কৌতূহলের কোনো প্রকাশ নেই। এর কোনো মানে হয়? মানুষের ভেতর যা থাকবে তার প্রকাশও থাকা উচিত। আবেগ থাকবে অথচ আবেগের প্রকাশ থাকবে না, এটা কেমন ব্যাপার?

সুজাত মিয়া কয়েকবার এসে নবনীকে দেখে গেছে। তাকে বলা হয়েছে। সে যেন খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়ে। সে হ্যা-সূচক মাথা নেড়েছে কিন্তু খেতে বসে নি–ঘুরঘুর করছে।

যে যেমন সে তার আশেপাশের মানুষগুলোও সে রকম জোগাড় করে। সুজাত মিয়ার মুখে কোনো কথা নেই। প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে সে চেষ্টা করে হ্যানা বলে জবাব দিয়ে দিতে। মনে হচ্ছে তাকে কথা না-বলার ট্রেনিং দেয়া হয়েছে।

রাস্তায় কাকে যেন দেখা যাচ্ছে। টর্চের আলো ফেলে এগুচ্ছে। মানুষটার গায়ে চান্দর। চাদরে মাথাও ঢাকা। আনিস ফিরছে কি? তার সাইকেল চুরি গেছে। হেঁটে হেঁটেই ফেরার কথা। এই গরমে সে মাথায় চাদর দিয়ে আছে কেন? শরীর খারাপ করেছে কি? ডাক্তারদের শরীর খারাপ শুনতে খুব হাস্যকর লাগে, কিন্তু ডাক্তারদের শরীর খারাপ হয়–ভালোমতোই হয়। নবনী বুঝতে পারছে না, সে বারান্দায় বসে থাকবে না-কি আনিসকে চমকে দেবার জন্যে কিছু করবে? বারান্দা থেকে নেমে উঠোনের কাঁঠাল গাছের আড়ালে চলে যাওয়া যায়। তারপর হঠাৎ আনিসের সামনে কাপ দিয়ে পড়ে বিকট চিৎকার দেয়া। একঘেয়েমির জীবনকে ইন্টারেস্টিং করার জন্যে মাঝে মাঝে লবণ এবং গোলমরিচের গুড়ে ছিটিয়ে দিতে হয়। বেঁচে থাকা ব্যাপারটার মধ্যেই একঘেয়েমি আছে। যে মানুষটা সত্তর বছর বাঁচে তাকে এই দীর্ঘ সত্তর বছর ধরেই যথানিয়মে রাতে ঘুমুতে যেতে হয়। সত্ত্বর বছর প্রতিদিন তিনবেলা খেতে হয়। ক্লান্তিকর একটা ব্যাপার। নিম্নশ্রেণীর কীট পতঙ্গের বেঁচে থাকার মধ্যে কিছু বৈচিত্ৰ্য আছে। সামান্য পিঁপড়া এক সময় পাখা পেয়ে আকাশে ওড়ে। কুৎসিত দর্শন শুয়োপোকা একদিন সুন্দর প্রজাপতি হয়। মানুষের মধ্যে এরকম কিছু নেই – মানুষ বদলায় না।

টাৰ্চ হাতে লোকটা অনেক কাছে এসে গেছে। সে আনিস না, মতি। কোথেকে চাদর জোগাড় করে হন হন করে যাচ্ছে। নবনী কোলের ওপর রাখা বইটার পাতা উল্টাল। তার সামান্য ভয় ভয় লাগছে। চাদর গায়ে মানুষটাকে দেখে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও মনে হয়েছিল–বিরাটনগরের ইমাম সাহেব। সেই মানুষটাও ছিল মতির মতো ছোটখাট।

 

আনিস গিয়েছে মিঠাপুরে।

বিরাটনগর থেকে মিঠাপুরের দূরত্ব সাত মাইল। গ্রামের হিসাবে দুই ক্রোশের সামান্য বেশি। বর্ষাকালে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো। ইনজিনের নৌকা চলে। সমস্যা হয় শীতের সময়। শুকিয়ে যাওয়া বিলের ভেতর দিয়ে হাঁটা পথ। গ্রামের মানুষদের জন্যে হাটা কোনো বড় ব্যাপার না। তারা মাইলের পর মাইল নির্বিকার ভঙ্গিতে হাঁটতে পারে। আনিস পারে না। তার কষ্ট হয়। পা ফুলে যায়। সাইকেল চুরি যাওয়াতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে। সে অনেকবারই ভেবেছে এমন গভীর গ্রামে রোগী দেখতে যাবে না। রোগীদের হাসপাতালে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। হাসপাতালের ব্যাপারে এখনো গ্রামের মানুষদের ভেতর প্ৰবল ভীতি কাজ করছে। হাসপাতালে যাওয়া মানে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়া। তাদের হিসেবে হাসপাতাল থেকে জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা শূন্য।

ডাক্তার বাড়িতে নিয়ে আসার পেছনে আরেকটি মানসিকতা কাজ করে। ক্ষমতা প্ৰতিপত্তি জাহির করার মানসিকতা –হে গ্রামবাসী তোমরা দেখ, পাস করা এমবিবিএস ‘ডাক্তার বাড়িতে নিয়ে এসেছি।’

আনিস যে রোগী দেখতে যাচ্ছে তার বয়স অল্প–এগারো বারো বছরের কিশোর। নাম কাদের। হঠাৎ তার শরীর ফুলে গেছে। কথা বলতে পারছে না, কাউকে চিনতে পারছে না। অন্য ডাক্তার তার চিকিৎসা করছিলেন। চিকিৎসায় কোনো ফল হয় নি। বরং রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। সেই ডাক্তার শেষ কথা বলে এসেছেন–রোগী ঢাকায় নিতে হবে। রোগীর আত্মীয়স্বজন রোগীকে ঢাকায় নিতে প্রস্তুত। কিন্তু শেষ চিকিৎসা হিসেবে আনিসকে দেখাতে চায়। অল্প বয়স্ক গম্ভীর ধরনের এই ডাক্তার সম্পর্কে নানান কথা শোনা যায়। এই ডাক্তারের সাইকেলের ঘণ্টা না-কি আজরাইল সহ্য করতে পারে না। আজরাইলের কানে যন্ত্রণা হয়। সে দূরে সরে যায়। মরণাপন্ন রোগী বিছানায় উঠে বসে চিকন গলায় বলে–কৈ মাছের সালুন দিয়া ভাত খামু।

রোগীর বাড়ির কাছাকাছি পৌছার পর রোয়াইল বাজারের এমবিবিএস ডাক্তার সাইফুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আনিসের দেখা হলো। সাইফুদ্দিন সাহেব মোটর সাইকেলে করে এসেছেন। মোটর সাইকেলের কেরিয়ারে ডাক্তারি ব্যাগ নিয়ে তার এসিসটেন্ট বসা। এসিসটেন্টের মুখও গম্ভীর। তাকে রোগী দেখার জন্যে আনা হয়েছে। তিনি আনিসকে দেখে ভুরু কুঁচকে ফেললেন। মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে আনিসকে হাতের ইশারায় এক পাশে নিয়ে গেলেন। গোপন কিছু কথা বলবেন–এইসব গোপন কথা রোগীর বাড়ির যে দু’জন আনিসকে নিয়ে আসছে তাদের শোনানো যাবে না।

সাইফুদ্দিন সাহেব গলা নামিয়ে বললেন–রোগী দেখার কিছু নাই। শেষ অবস্থা। ডাক্তার শিলাপটায় বেটে শরীরে মাখিয়ে দিলেও কিছু হবে না।

আনিস বলল, হয়েছে কী?

পানি এসে শরীর ফুলে গেছে। শ্বাসনালিও ফুলে প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে–ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। রাতটা টিকবে না। ভিজিটের টাকা নিয়ে দ্রুত চলে আসবেন। অঞ্চলটা খারাপ। ডাক্তারের উপস্থিতিতে রোগী মারা গেলে খবর আছে।

আনিস চুপ করে রইল। সাইফুদ্দিন সাহেব গলা আরো নামিয়ে এনে বললেন–ভিজিটের টাকা নিয়ে এরা ঝামেলা করে নাই। দুইশ টাকা ভিজিট চেয়েছিলাম দিয়েছে। মোটর সাইকেলের তেলের খরচ দিয়েছে। আর আমার এসিসটেন্টকে দিয়েছে কুড়ি টাকা। এদের পয়সাকড়ি আছে।

আনিস বলল, চিকিৎসা কী করেছেন?

সাইফুদ্দিন সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন–চিকিৎসার কিছু নাই। আপনে যান। দেখলেই বুঝবেন। এখন একমাত্ৰ চিকিৎসা দোয়া দরুদ। একটা স্যালাইন দিতে পারলে ভালো হতো। গ্রামের মানুষ স্যালাইন দেয়াটা বড় চিকিৎসা মনে করে। স্যালাইন দিলাম না। দেড় দুই ঘণ্টা সময় দরকার। এর মধ্যে যদি রোগী মরে যায় আত্মীয়স্বজনরা বলবে ভুল চিকিৎসা করে মেরে ফেলেছি। কী দরকার?

 

রোগীর বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসছে। মেয়েরা কাঁদছে। বুঝাই যাচ্ছে রোগী মারা গেছে। গ্রাম অঞ্চলে মৃত্যুশোকের প্রাথমিক প্রকাশ অসম্ভব তীব্র। নিকটজনরা মাটিতে গড়াগড়ি করতে করতে বুকফাটা আর্তনাদ করতে থাকেন।

আনিস থমকে দাঁড়িয়ে গেল। এই অবস্থায় রোগীর বাড়িতে না ঢোকাই ভালো। আনিস পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করল। তার সিগারেট খাবার অভ্যাস ছিল না। গ্রামে এসে এই অভ্যাস হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে অভ্যাস তত বাড়ছে।

বৃদ্ধ এক ভদ্রলোক লাঠিতে ভর দিয়ে এগুচ্ছেন। লুঙ্গি পরা খালি গা, কিন্তু তার এগিয়ে আসার ভঙ্গিতেই মনে হচ্ছে অতি প্ৰতাপশালী একজন। রোগীর দাদা বা এই স্থানীয় হবেন।

ডাক্তার সাব না?

জ্বি। আপনের অনেক সুনাম শুনেছি। আমার আফসোস আপনেরে এরা শেষ সময়ে এনেছে। আপনে গিয়া রোগীর কাছে বসেন। লোকজনরে বলতে পারব।–নাতির চিকিৎসার ক্রটি হয় নাই। তার মৃত্যুর সময়ও বড় একজন ডাক্তার তার বিছানার পাশে বসাইয়া রাখছিলাম।

আনিস হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল–চলুন।

মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব না। কিন্তু মৃত্যুকে সহনীয় করার চেষ্টা একজন ডাক্তারকে করতে হয়।

ঘর ভর্তি মানুষ। খাটের ওপর রোগী পড়ে আছে। নিঃশ্বাস নিতে তার ভয়ঙ্কর কষ্ট হচ্ছে। ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ট্রেসেকটামী করতে হবে। ফুসফুসে অক্সিজেন ঢোকার ব্যবস্থা করতে হবে। এখনি করতে হবে। দেরি করা যাবে না।

আনিস দ্রুত চিন্তা করছে–এলাৰ্জিক কোনো রিএকশান কি? মাঝে মাঝে এলাৰ্জি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

এলাৰ্জির কারণে শরীরে এভাবে পানি আসতে পারে না। কোনো সাইড এফেক্ট কি? শরীরের পানি বের করার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে সবার আগে যা দরকার তা হলো–ছেলেটার নিঃশ্বাস নেবার ব্যবস্থা করা। এলাৰ্জির চিকিৎসা করে শ্বাসনালির ফোলাটা একটু যদি কমানো যায়। শেষ চেষ্টা ট্রেসেকটামী। ইশ যদি অক্সিজেনের বোতল থাকত!

আনিস বলল, ঘর খালি করে দিন। গরম পানি দিন। একটা বড় চামুচ আনুন।

আনিস তার ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছে। তার মনে হচ্ছে স্কুলের স্পোর্টস হচ্ছে। একশ মিটার দৌড়ে সে নাম দিয়েছে। রেফারি হুইসেল দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্ৰাণপণে দৌড়াতে হবে। তার সঙ্গে যে দৌড়াবে তার নাম মৃত্যু। দৌড়ে মৃত্যুকে হারাতে হবে।

একজন মহিলা গরুর মতো বড় বড় চোখে আনিসের দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু পর পর তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন। ডাক্তারের মনে হলো উনি ছেলের মা। অসংখ্য মহিলার মধ্যেও রোগীর মা’কে সব সময় আলাদা করা যায়।

আনিস মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি রোগীর গলায় ফুটো করব। ভয় পাবেন না। এ ছাড়া অন্য উপায় নেই।

মহিলা পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

 

দুই ঘন্টার মতো সময় পার হয়েছে।

রোগীর দাদা উঠোনে জলচৌকিতে বসে তামাক খাচ্ছিলেন। তাঁকে একজন দৌড়ে এসে বলল, কাদের ভালো আছে। শ্বাস কষ্ট কমেছে। পানি খাইতে চায়।

বৃদ্ধ বললেন, ডাক্তার সাব কী করতেছে?

উনি সিগারেট ধরাইছেন। বারান্দাত খাড়াইয়া সিগারেট খাইতেছেন।

বৃদ্ধ বললেন, আমারে অজুর পানি দেও। অজু কইরা দুই রাকাত শোকরানা নামাজ পড়বা। দুইটা গরু জবেহ কইরা মেহমানি দেও, আমার মানত ছিল। আরেকটা কথা, ডাক্তার সাবরে ভিজিটের টাকা দিবা না। এইটাতে উনার অপমান হবে। বৌমারে বল ডাক্তারের পা ছুঁইয়া যেন সালাম করে।

বৃদ্ধ হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলেন।

 

নবনী, কখন এসেছ?

নবনী বই হাতে উঠে দাঁড়াল। প্রশ্নের জবাব দিল না। কিছু প্রশ্ন আছে–জবাব দিতে হয় না। প্রশ্নকর্তা জবাব পাবার আশায় প্রশ্ন করেন না। আনিসের এই প্রশ্নটাও সেই গোত্রের। জবাব দিলে ক্ষতি নেই, না দিলেও ক্ষতি নেই।

আনিস বলল, মিঠাপুর বলে একটা জায়গায় রোগী দেখতে গিয়েছিলাম। রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ–ওরা আমাকে রেখে দিতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস থাকি নি।

নবনী বলল, রোদে পুড়ে তুমি তো দেখি ঝলসে গেছ।

আনিস হাসতে হাসতে বলল, তুমি খুব সুন্দর হয়েছ। চুল কেটেছ—তাই না?

হুঁ।

পথে অসুবিধা হয়েছে? একা একা আস কেন? কাউকে সঙ্গে নিয়ে এলেই হয়। এমন তো না যে তোমাদের বাড়িতে মানুষের অভাব।

নবনী হালকা গলায় বলল, একা আসি নি তো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নান্দাইল রোড স্টেশন পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন। আমি তোমার এখানে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। রাজি হন নি।

আনিস অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। নবনী গম্ভীর গলায় বলল, উনার মাথায় হঠাৎ করে গান এসে গেল বলে আমিও জোর করি নি। গানের একটা লাইনই এসেছে, অন্য লাইনগুলো আসে নি। লাইনটা হলো—

‘আলো ভাঙার এই আলো।’

লাইনটা সুন্দর না?

আনিস বলল, কিছুই বুঝতে পারছি না। কার সঙ্গে তোমার দেখা? কোন রবীন্দ্ৰনাথ?

জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু।

আনিসের মুখের হতভম্ব ভাব আরো প্রবল হলো। নবনী হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে বলল–তুমি এমন কাঠখোট্টা হয়ে যাচ্ছ কীভাবে? ঠাট্টা বুঝ না। ঠাট্টা করছিলাম।

ঠাট্টা করছিলে?

ইয়েস ডাক্তার সাহেব। তোমার চোখ মুখ শক্ত হয়ে যাচ্ছে, মনে হয় তুমি রেগে গেছ।

না। রাগি নি। তোমার মধ্যে ঠাট্টা করার প্রবণতা আছে। এটা ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমার ঠাট্টাগুলো অন্যরকম। হঠাৎ শুনলে ধাক্কার মতো লাগে।

নবনী বলল, গোসল করে এসো। খেতে বসব। আমার ক্ষিধে চলে গিয়েছিল আবার ফিরে এসেছে। এখন যদি চলে যায়। আর ফিরে আসবে না। আচ্ছা শোন, তোমাদের এখানকার ইমাম সাহেব না-কি ভূত হয়ে লোকজনদের ভয় দেখাচ্ছেন? মাতিকে শুনলাম আড়া করে পুকুরে নিয়ে ফেলেছে। সে আমাকে বলছিল।

আনিস চুপ করে রইল। নবনী বলল, হ্যাঁ না একটা কিছু বল।

আনিস বলল, এ রকম কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।

তোমাকে উনি কখনো তাড়া করেন নি?

না। এই প্ৰসঙ্গটা থাক।

থাকবে কেন?

সব আলাপ এক সঙ্গে করে ফেললে কীভাবে? কিছু তোলা থাক।

থাক, তোলা থাক।

নবনীর ঘুম পাচ্ছে। সে হাই তুলতে তুলতে বলল, তোমার টেবিলের ড্রয়ারে দেখলাম একটা মেয়ের কয়েকটা ছবি। খুবই সুন্দর মেয়ে। সে কে?

জহির খাঁ সাহেবের ভাইস্তি।

তোমার ড্রয়ারে তার ছবি কেন?

চেয়ারম্যান সাহেব মেয়েটার বিয়ে দিতে চান। আমাকে পাত্র খুঁজতে বলেছেন। এইসব ছবি পাত্রিপক্ষকে দেবার জন্যে।

এই মেয়ের পাত্ৰ খোঁজার দরকার কী? পাত্ররাই তাকে খুঁজবে।

তা ঠিক।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠতে উঠতে রাত এগারোটা বেজে গেল। আনিস বলল, টায়ার্ড হয়ে এসেছ শুয়ে পড়। আজ গরম কম আছে–ভালো ঘুম হবে। এই কদিন প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। তুমি তো আবার গরম একেবারেই সহ্য করতে পার না।

নবনী বলল, আমি শীতও সহ্য করতে পারি না। দুটাই আমার অসহ্য। তবে গরমটা বেশি অসহ্য। তোমাদের এখানে মশা কেমন?

মশা নেই।

তাহলে মশারি খাটাবে না। মশারির ভেতর আমার দমবন্ধ হয়ে যায়। নিঃশ্বাস নিতে পারি না।

বেশ তো মশারি খাটাব না।

তোমার কাছে আরেকটা অনুরোধ আছে।

কী অনুরোধ?

আগে বল অনুরোধ শুনে রাগ করবে না।

আনিস বিস্মিত হয়ে বলল, এমন কী অনুরোধ আছে যা শুনে রাগ করতে পারি?

রাগ করার সম্ভাবনা আছে বলেই তো বলছি। বল রাগ করবে না।

রাগ করব না।

নবনী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অনুরোধটা হচ্ছে। আমি একা ঘুমুতে যাব। দু’জন আলাদা শোব।

আনিসের মনে হলো নবনী ঠাট্টা করছে। সে বিচিত্র ধরনের ঠাট্টা করে–তার এই কথাটাও ঠাট্টা। আনিস যখন বলবে, আচ্ছা আলাদা খাটে ঘুমাও; তখনি নবনী খিলখিল করে হেসে উঠবে।

নবনী বলল, গম্ভীর হয়ে আছ কেন? কিছু বল।

আনিস বলল, কোনো সমস্যা নেই। আলাদা খাটে ঘুমাও।

নবনী বলল, থ্যাংক য়্যু।

তাকে দেখে মনে হলো সে এক ধরনের টেনশান বোধ করছিল, এখন আর সেই টেনশান নেই। সে নিশ্চিত বোধ করছে।

নবনী বলল, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আগে আমি হালকা লিকার দিয়ে এক কাপ চা খাই। তুমি খাবে?

আনিস বলল, না।

নবনী বলল, তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার ওপর রাগ করেছ। রাগটা চেপে আছ।

আমি রাগ করি নি। তুমি এই খাটে শোও। আমি পাশের ঘরে আছি।

ঐ ঘরে তো ফ্যান নেই। ঘুমুবে কীভাবে?

আমার অভ্যাস আছে।

নবনী বলল, রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে যদি চিৎকার করতে থাকি তুমি কিন্তু ধাক্ক দিয়ে আমার ঘুম ভাঙাবে।

দুঃস্বপ্ন কি রোজ রাতেই দেখ?

হ্যাঁ। আজ যে দেখব। এটা প্ৰায় নিশ্চিত। আজ হয়তো দেখব। ইমাম সাহেব আমাকে তাড়া করছেন।

আনিস বলল, ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাও। ঘুম গাঢ় হবে, স্বপ্ন দেখবে না।

নবনী ওষুধ খেয়ে সহজ গলায় বলল, ঘুম না। আসা পর্যন্ত এসো কিছুক্ষণ গল্প করি।

আনিস বলল, বেশ তো গল্প কর।

তুমি কি কিংবদন্তী ডাক্তার হয়ে গেছ? লোকজন তোমাকে নিয়ে নতুন কোনো গল্প বানিয়েছে? নাম কি এখনো ‘সাইকেল ডাক্তার’ আছে? সাইকেল নেই, ‘সাইকেল ডাক্তার’ নাম থাকার তো কথা না।

আনিস কিছু বলল না। নবনী বলল, আমি বড় মাছ রান্না করা শিখেছি। একদিন বড় মাছ আনিও তো। রান্না করে খাওয়াব।

আচ্ছা।

রান্না শিখেছি তোমার মা’র কাছে। ও বলতে ভুলে গেছি–এখানে আসার আগে তোমার বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা করে এসেছি। তাঁরা ভালো আছেন। তবে দুজনের মধ্যে আবার ঝগড়া হয়েছে। কথা বন্ধ। তোমার বাবা বাসায় খাচ্ছেনও না। হোটেল থেকে খেয়ে আসছেন।

আনিস বলল, এটা নতুন কিছু না।

নবনী বলল, ওনাদের ঝগড়া মান অভিমান আমার কিন্তু খুব পছন্দ। তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই আমার এরকম মজার ঝগড়া হবে না।

আনিস বলল, তা হবে না। আমি তাদের মতো না।

তুমি কী রকম?

একটু আলাদা।

কী রকম আলাদা?

আনিস জবাব দিল না। তার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। নবনীর সামনে সিগারেট খাওয়া যাবে না। সে উঠে পড়ল। নবনী বলল, কোথায় যাও?

তুমি ঘুমানোর চেষ্টা কর। আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসি।

আমার সামনেই খাও। কিছু হবে না।

আনিস বলল, না।

নবনীর দুঃস্বপ্নটা শুরু হয়েছে। শুরুটা সুন্দর। ঘুমের মধ্যেই নবনী বুঝতে পারছে এই সুন্দরের শেষটা ভালো না। শেষটা ভয়ঙ্কর। শেষটা সে আন্দাজও করতে পারছে। নবনী হাঁটছে। রেললাইনের স্ত্রীপারে পা রেখে রেখে। সামনেই বীজ, যাচ্ছে ব্রীজের দিকে। চারদিক খুব সুন্দর। সবুজে। সবুজ হয়ে আছে। বনজঙ্গল ঝোপ ঝাড় কিছু নেই। দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে না। আকাশ দেখা যাচ্ছে। সেই আকাশের রঙও হালকা সবুজ। নবনী বুঝতে পারছে, ব্রীজের ওপর ওঠা মাত্ৰই দুঃস্বপ্ন শুরু হবে। উল্টো দিক থেকে ট্রেন আসতে শুরু করবে। সে তখন না। পারবে ব্রীজ থেকে লাফ দিয়ে নিচে নদীতে পড়তে, না পারবে রেললাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে। সবচে’ ভালোবুদ্ধি হচ্ছে এক্ষুণি ট্রেনের লাইন থেকে সরে দাঁড়ানো। সেটাও সম্ভব না। স্বপ্নে স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু নেই। স্বপ্ন হলো পরিপূর্ণ সমৰ্পণ। যিনি স্বপ্নে তাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি নবনীকে অবশ্যই ব্রীজে নিয়ে তুলবেন। মাঝামাঝি পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে যাবেন, তারপর উল্টো দিক থেকে কোনো এক আন্তঃনগর ট্রেন ছেড়ে দেবেন। সেই ট্রেন দিগন্ত কাঁপিয়ে ঝড়ের গতিতে আসতে শুরু করবে। স্বপ্নের নিঃসঙ্গ জগতে তাকে রক্ষা করার কেউ থাকবে না।

নবনী এখনো বীজ পর্যন্ত পৌছায় নি, তার আগেই সে ঘুমের মধ্যে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল–আমাকে বাঁচাও। প্লীজ আমাকে বাঁচাও। ট্রেনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নবনী ছটফট করছে। তার ঘুম ভাঙানোর জন্য কেউ আসছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *