০৫. টেলিগ্রামে লেখা ছিল

টেলিগ্রামে লেখা ছিল–ফরিদা সিরিয়াস, কাম ইমমিডিয়েটলি। মামুন ধরেই নিয়েছিল। সে মারা গেছে। আলম সাহেবকে যাবার বেলায় বলেও গেল, বোনটা মারা গেছে বোধহয়। মৃত্যুর খবরে লোকজন সব সময়ই হকচাকিয়ে যায়, আলম সাহেবও হকচাকিয়ে গেলেন।

কীভাবে মারা গেছে? সে সব কিছু লেখেনি অসুস্থ ছিল। ওর মৃত্যুটা আমাদের সবার জন্যেই রিলিফ। বড় কষ্টে छ्लि।

তাই নাকি? জি। বাড়িতে গেলে ঘুমাতে পারতাম না। চিৎকার করত। সারা রাত। চোখে দেখা যায় না। এমন কষ্ট।

হয়েছে কি? স্নায়ুর মধ্যে কি যেন হয়েছে। চিকিৎসা নেই কোনো। ব্যথা কমানোর ইনজেকশন দিয়েও কিছু হয় না। বাড়ি যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলাম।

কথা খুবই সত্যি। মামুন গত এক বছরে একবার মাত্র গিয়েছিল এক’দিন থেকে পালিয়ে এসেছে। সারারাত উঠোনে মোড়া পেতে কাটিয়েছে। ভয়ংকর একটা রাত। এখন বাড়িতে গেলে সে রকম কোন ঝামেলা হবে না। ঘুমানো যাবে না।

তাদের গ্রামের বাড়িটি সুন্দর। পাকা দালান। পেছনের পুকুরটি বুজে গেছে। এটা ঠিকঠাক করতে হবে। মুনাকে নিয়ে গ্রামে আসতে হবে। সে কোনোদিন গ্রাম দেখেনি। গ্রাম সম্পর্কে তার ধারণা খুবই খারাপ। ধারণা পাল্টে যাবে।

মামুন বাড়ি পৌঁছল সন্ধ্যার পর। চারদিকে কেমন অস্বাভাবিক নীরবতা। বসার ঘরের বারান্দায় হারিকেন জ্বলিয়ে কয়েকজন মুরব্বি বসে আছেন। মামুনকে দেখে তাঁরা এগিয়ে এলেন। মৃদু স্বরে কি সব যেন বলতে লাগলেন। কিছুই বোঝা গেল না। মামুনের বড় চাচা বললেন, তোমার লাগি অপেক্ষা। তুমি না। আওনে দম বাইর হইতাছে না। যাও ভিতরের বাড়িতে যাও। ভইনের সাথে কথা কও;

ফরিদা বড় খাটটায় পড়ে আছে। ঘরে দুটো হারিকেন। একটা কুপী। অনেক মেয়েদের ভিড়। মামুন ঘরে ঢুকতেই ফরিদার গোঙানি থেমে গেল। সে পরিষ্কার গলায় ডাকল, ভাইজান!

মামুন অসাহায়ের মত তাকাল চারদিকে।

ভাইজান বড় কষ্ট।

হারিকেনেব আলোয় চকচক করছে ফরিদার চোখ। চোখগুলো এখনো এত সুন্দর?

ফরিদার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। মামুনের কি উচিত কাছে গিয়ে বসা? হাতে হাত রাখা। কিন্তু জন্তুর মত শব্দ যে করছে সে কি ফরিদা? একজন কে হারিকেন উঁচু করে ধরলেন। ভালমত দেখাতে চান বোধ হয়। কী আছে দেখানোর?

ফরিদা শ্বাস টানার ফাঁকে ফাঁকে বলল, গত বছর আপনি আসছিলেন। কিন্তু আমার সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। আমার মনে কষ্ট হয়েছে।

এমন কোনো মনের কষ্ট আছে যা এই তীব্র শারীরিক যন্ত্রণাকে স্পর্শ করতে পারে? মামুন ঘোলাটে চোখে তাকাতে লাগল চারদিকে।

একজন বুড়ো মহিলা বললেন, পশ্চিম দিকে মুখ কইরা দেন। কলমা তৈয়াব পড়েন। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুলাল্লাহ।

শ্বাসকষ্ট সন্ধ্যা রাত্ৰিতে শুরু হলেও ফরিদা মারা গেল পরদিন সকাল নটায়। একেকবার কষ্টটা কমে যায়, সে চোখ বড় বড় করে তাকায় সবার দিকে। সেই তাকানো দেখেই মনে হয়। সে বুঝতে পারছে সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং তার জন্যে সে খুশি। সে অপেক্ষা করছে আগ্রহ নিয়ে।

মামুন বাড়ি যাবার সময় ঠিক করে রেখেছিল দু’দিন থাকবে। কলেজ থেকে ছুটি নেয়া হয়নি। কাউকে কিছু বলে যাওয়া হয়নি। দুদিনের বেশি থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সে থাকল এগারো দিন। বারো দিনের মাথায় ঢাকায় ফিরে এল। তার মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অনিদ্রাজনিত কারণে চোখ লাল। আলম সাহেব তাকে দেখে আঁতকে উঠলেন। মামুন শুকনো হাসি হেসে বলল, সব ভাল তো?

ভাল, সবই ভাল। আপনি কেমন?

ভালই। চিঠিপত্র আছে কিছু?

জিনা, চিঠিপত্র নেই।

মুনা খোঁজ করেছিল?

জি, এসেছিল এক’দিন।

মামুন আর কিছুই জিজ্ঞেস করল না। সারাদিন কাটাল ঘুমিয়ে। সন্ধ্যাবেলা একা একা একটা সিনেমা দেখতে গেল–দি বিস্ট। একজন মানুষ পূর্ণিমা রাতে কেমন করে নেকড়ে হয়ে যায় তার গল্প। প্রথমদিকে গল্পটি কিছুই ধরা যাচ্ছিল না। শেষ দিকে দারুণ জমে গেল। মামুন অবাক হয়ে লক্ষ্য করল সে বেশ উত্তেজনা অনুভব করছে। শেষ দৃশ্যে সুন্দরী একটি তরুণী মেয়ের কৌশলের কাছে জন্তুটির পরাজিত হবার ঘটনাটি তাকে অভিভূত করে ফেলল। চারদিকে হাততালি পড়ছে। সে বহু কষ্টে হাততালি দেবার লোভ সামলাল। প্রথম থেকে ছবিটি মন দিয়ে না দেখার জন্যে তার আফসোসের সীমা রইল না।

মেসে রাতে খাবার ব্যবস্থা আছে। তবুও সে হেঁটে হেঁটে নবাবপুরের এক দোকানে বিরিয়ানী খেতে গেল। ছাত্র থাকাকালীন দল বেঁধে এখানে আসত। অনেক দিন পর আবার আসা। সব কিছু আগের মত আছে। একশ বছর পরেও বোধ হয় দোকানটা এ রকমই থাকবে। তবে বিরিয়ানী আগের মত লাগল না, চাল পুরোপুরি সেদ্ধ হয়নি। লবণও কম হয়েছে। আগে তেঁতুলের টক দিত। এখন বোধ হয় দিচ্ছে না। কাঁচা মরিচে কোনো ঝাল নেই। মিষ্টি মিষ্টি লাগছে খেতে। মামুন প্লেট শেষ না করেই উঠে পড়ল। ঘুম ঘুম লাগছে কিন্তু মেসে ফিরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোরও কোনো অর্থ হয় না।

মামুন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে চলে গেল। অনেককাল আগে দল বেঁধে সবাই আসত। এখানে। একবার নৌকা ভাড়া করেছিল আধা ঘণ্টার জন্যে। বশিরের জন্যে নৌকা ডোবার উপক্রম হয়েছিল। মামুন একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। লঞ্চ টার্মিনাল আগের মত নেই। অনেক দিন আসা হয় না। এদিকে। সব বদলে যাচ্ছে।

আলম সাহেব জেগে বসে ছিলেন। মামুনকে আসতে দেখে উঠে এলেন কোথায় ছিলেন এত রাত পর্যন্ত? মামুন অস্পষ্ট ভাবে হাসল। আপনি যাওয়ার পরপরই আপনার বান্ধবী এসেছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলেন। মামুন কোনো উৎসাহ দেখাল না।

আপনাকে কাল সকালে তাদের বাসায় যেতে বলেছেন।

কাল যাব কিভাবে, কাল কলেজ আছে।

কাল শুক্রবার না। কাল তো ছুটি।

ও হ্যাঁ।

চিঠিও লিখে গেছেন একটা। আপনার টেবিলে রেখে দিয়েছি। আর ভাত-তরকারিও ঢাকা দিয়ে রেখেছি। আপনার শরীর ভাল তো মামুন সাহেব?

জি ভাল।

চোখ লাল হয়ে আছে।

সারাদিন ঘুমিয়েছি তো তাই।

সন্ধ্যাবেলা কোথায় গিয়েছিলেন?

একটা ছবি দেখলাম। নাজ সিনেমায়। দি বিসিট। ভাল ছবি।

আলম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন?

জি। মনটা ভাল ছিল না। তাই ভাবলাম যাই দেখে আসি।

ভালই করেছেন।

ছাত্র জীবনে খুব ছবি দেখতাম। রোমান হলিডে ছবিটা মোট এগারো বার দেখেছিলাম। ঐ মেয়েটার প্ৰেমে পড়ে গিয়েছিলাম।

মামুন চিঠিটা পড়ল। দুলাইনের চিঠি। আগামীকাল আমাদের বাসায় দুপুরে ভাত খাধে। সকালে চলে আসবে। ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। ওদের এখানে যাওয়ার ব্যাপারে মুনার খুবই আপত্তি। মামা পছন্দ করেন না। একবার গিয়ে তো বেইজাতী অবস্থা। ভদ্রলোক একটা কথাও বললেন না! সালামের জবাব পর্যন্ত দিলেন না। রাগ দেখাবার জন্যে তার সামনেই কাজের মেয়েটাকে বিনা কারণে এমন একটা চড় দিলেন যে মেয়েটা উল্টে চেয়ারের ওপর পড়ে গেল। বিশ্ৰী অবস্থা।

মামুন সাহেব।

জি।

ভাত খান।

না ভাত খাব না। ভাত খেয়ে এসেছি।

চা খাবেন? চলেন মোড়ের দোকান থেকে চা খেয়ে আসি।

মামুন কোনো রকম আপত্তি করল না। চা খেতে গেল। আলম সাহেব হালকা স্বরে বললেন, দুঃখ-কষ্ট সংসারে থাকেই। দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বাঁচতে হয়। জন্ম নিলেই মৃত্যু লেখা হয়ে যায়। কি বলেন?

তা তো বটেই।

আপনি এই সব নিয়ে ভাববেন না।

না আমি ভাবি না।

চা খেতে খেতে আলম সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, দাড়ি-টাড়িগুলি কেটে ফেলেন। ভাল লাগছে

জি কাটব। কালই কাটব।

 

মুনা সকাল থেকেই মামুনের জন্যে অপেক্ষা করছিল। এগারোটার দিকে তার কেন যেন মনে হল মামুন আসবে না। এ রকম মনে হবার কারণ নেই। কিন্তু মনে যখন হচ্ছে তখন মুনার মনে হয় মামুনের সঙ্গে দেখা হবে না, তখন হয় না।

শওকত সাহেব ফর্সা একটা পাঞ্জাবি পরে অপেক্ষা করছিল। মুনা গিয়ে বলল, মামা, তোমার কোথাও যাবার থাকলে যাও, ও আসবে না।

আসবে না কেন?

তা আমি কি করে বলি। হয়ত খবর পায়নি।

শওকত সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। রাগী গলায় বললেন, আসতে বললে আসবে না। এর মানে কি? যখন আসতে বলা হয় না। তখন তো দশবার আসে।

এটা তো মামা ঠিক বললেন না। সে এ বাসায় একবারই এসেছিল। তুমি একটি কথাও বলনি। উল্টো এমন ব্যবহার করেছ লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। তোমার বোধ হয় মনে নেই।

শওকত সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, বাবুকে ঠিকানা দিয়ে পাঠা, ও গিয়ে নিয়ে আসুক।

তুমি হঠাৎ এত ব্যস্ত কেন?

বিয়েটা কবে হবে কি, এইটা ফয়সালা করতে চাই। লোকজন কথা বলাবলি শুরু করেছে।

মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, কে আবার কী কথা বলল?

নওয়াব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ভাগীর বিয়ে দিচ্ছেন। কবে? তিনি তোদের দেখেছেন এক রিকশায় যেতে। আমি লজ্জায় বাচি না। বিয়ের আগে কোনো মেয়ে ছেলের সঙ্গে এক রিকশায় যেতে পারে? দেশটা তো বিলাত-আমেরিকা এখনো হয়নি।

মুনা কিছু বলল না। শওকত সাহেব সিগারেট ধরলেন। দামী সিগারেট। আজকের এই বিশেষ উপলক্ষে তিনি পাঁচটি ফাইভ ফাইভ কিনেছেন।

মুনা, যা বাবুকে ঠিকানা দিয়ে পাঠা।

না, ওর যেতে হবে না।

মুনা রান্নাঘরে ঢুকল। বকুল সারা সকাল চুলোর পাশে বসে। তার ফর্সা গাল লাল টুকটুক করছে। মুনাকে ঢুকতে দেখে সে হাসিমুখে বলল, পোলাওটা খুব ভাল হয়েছে আপা।

পোল ও কেন? পোলা ও কে করতে বলেছে?

বাধা।

আমি না বললাম সিম্পল ব্যবস্থা করতে … আমরা যা খাই।

বকুল কিছু বলল না, মুখ টিপে হাসল। মুনা বিরক্ত মুখে বলল, হাসছিস কেন?

তুমি আসলে আপা খুশিই হয়েছ, কিন্তু মুখে বলছ এই কথা, এ জন্যেই হাসছি।

কি সব পাকা পাকা কথা বলছিস। গা জ্বালান কথা। এই বয়সে এত পাকা কথা বলা লাগে না।

বকুল বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, রাগছ কেন আপা? ঠাট্টা করছিলাম।

এ রকম ঠাট্টা আমার ভাল লাগে না।

গোসতের লবণ একটু দেখবে আপা।

আমি দেখতে পারব না, তুই দেখ! চুলা খালি থাকলে আমাকে একটু চা করে দে। মাথা ধরেছে। আমি শুয়ে থাকব।

মামুন ভাই এত দেরি করছে কেন আপা? তুমি কখন আসতে বলেছ?

মুনা তার কথার জবাব না দিয়েই চলে গেল। বকুল ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। গত কয়েক দিন থেকেই মুনা আপা তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। কেন করছে কে জানে। রেহানা আপা ছবি চাইলে সে কী করতে পারে? সে তো বলতে পারে না না। আপনি ছবি চাইতে পারবেন না। কেন ছবি চাইবেন?

বকুল চায়ের কাঁপে চা ঢালল। আর তখনই বাবু এসে গম্ভীর স্বরে বলল–ডাক্তার সাহেব এসেছে। বকুলের হাত কেঁপে গেল। বাবুর মুখ রাগী রাগী। যেন ডাক্তারের আসা একটা অপরাধ। এবং এর জন্যে বকুল দায়ী। বকুল বলল, ডাক্তার এসেছে তো আমি কি করব? বাবু বলল, কথা বলছে বাবার সঙ্গে।

বলছে বলুক, যা তুই মুনা। আপাকে চা দিয়ে আয়।

বাবু আগের চেয়েও গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে কেন?

বকুল চমকে উঠল। ক্ষীণ স্বরে বলল, কে বলল?

আমি দেখলাম।

ডেকেছিল তাই গিয়েছিলাম।–কী হয়েছে তাতে?

আমি মুনা। আপাকে বলে দেব।

দিস। যা এখন চা নিয়ে যা।

বাবু চা নিয়ে চলে গেল। সে অবশ্যি মুনা আপাকে কিছুই বলবে না। তার স্বভাবের মধ্যে এটা নেই। একজনের কথা অন্যজনকে কখনো বলবে না। তবু বকুলের হাত-পা কাঁপতে লাগল।

ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা এমন কিছু নয়। সে স্কুল থেকে ফিরছিল চিশতি মেডিকেল কর্নারের কাছে আসতেই দেখে ডাক্তার সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখেই ডাকলেন, এই যে বকুল, এই! এস দেখি। বকুল নিশ্চয়ই না-শোনার ভান করে চলে যেতে পারে না। সে গিয়েছে। ডাক্তার সাহেব বলেছেন, ইস ঘেমে-টেমে কি অবস্থা। ভেতরে এসে ফ্যানটার নিচে দাঁড়াও তো। ঠাণ্ডা কিছু খাবে? বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, জি না। তিনি শুনলেন না। একটা ছেলেকে পাঠালেন খুব ঠাণ্ডা দেখে এক বোতল পেপসি কিংবা কোক নিয়ে আসতে। বকুল বলতে গেলে কোনো কথাই বলেনি। পেপসি অর্ধেক শেষ করে চলে এসেছে। ভয়ে তার সমস্ত শরীর কঁপিছিল। কেউ যদি দেখে ফেলে। তার ধারণা ছিল কেউ দেখেনি। কিন্তু ধারণা সত্যি নয়। বাবু দেখেছে। বকুলের কান্না পেতে লাগল। তার ভয় হচ্ছিল এক্ষুণি কেউ এসে বলবে, ডাক্তার সাহেব তোমাকে ডাকে। কিন্তু কেউ সে রকম কিছু বলল না। বকুল নিজের মনে রান্না সারতে লাগল। সে ভেবে পেল না। তাকে নিয়ে কেন এত ঝামেলা হচ্ছে।

বাবু এসে বলল, ডাক্তার সাহেবকে এক কাপ চা দাও। বকুল নিঃশব্দে চা বানাতে লাগল। বাবু বলল, ডাক্তার সাহেব মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। তার এক বোনের মেয়ে হয়েছে এই জন্যে। বকুল কিছুই বলল না।

 

কড়া নাড়ার শব্দে মামুনের ঘুম ভাঙল। সে দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়েছিল। চারদিক অন্ধকার। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে নাকি? মামুন ক্লান্ত স্বরে বলল, কে?

আমি। আমি মুনা।

মামুন তেমন কোনো আবেগ অনুভব করল না। আজ দুপুরে ওদের ওখানে খেতে যাবার কথা। যাওয়া হয়নি। তার জন্যে তেমন অনুশোচনাও হল না।

মুনা বলল, কি হয়েছে তোমার?

কিছু হয়নি।

যাওনি কেন?

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শরীরটা ভাল না;

মামুন হাই তুলল। টেনে টেনে বলল, এস ভেতরে এসে বস।

মুনা একবার ভাবল বলবে না বসব না। এবং গভীর মুখ করে চলে যাবে। কিন্তু যেতে পারল না। মুখ ভর্তি দাড়িতে এমন অদ্ভুত লাগছে মামুনকে। মুখের ভাব ধরা যাচ্ছে না। মুখ কেমন রোগা রোগা। সারাদিন ঘুমানোর জন্যে চোখ লাল। মুনা ভেতরে ঢুকাল।

বস, চেয়ারটায় বস। চা খাবে?

হুঁ।

কাউকে পেলে হয়। ছুটির দিন তো। লোকজন থাকে না। এই বলেই মামুন বেশ শব্দ করে হাসতে লাগল, যেন খুব-একটা হাসির কথা। মুনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগল।

তুমি বসে থাক। আমি হাত-মুখটা ধুয়ে আসি। একা একা বসে থাকতে ভয় লাগবে না তো?

ভয় লাগবে কেন?

মামুন আবার হেসে উঠল। সুস্থ মানুষের হাসি না। ছাড়া ছাড়া হাসি; হাসার সময় কেমন অদ্ভুত ভাবে গা দোলাচ্ছে। r

হাত-মুখ ধুতে মামুনের অনেক সময় লাগল। তার মনেই রইল না ঘরে একজন অপেক্ষা করছে। কাজের ছেলেটি দুকাপ চা দিয়ে গেছে। সেই চা পিরিচ ঢেকে রাখা সত্ত্বেও জুড়িয়ে জল হয়েছে।

মামুন বিস্বাদ ঠাণ্ডা চাতেও চুমুক দিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মুনা বলল, চা ভাল লাগছে?

হ্যাঁ ভালই তো।

ঠাণ্ডা না?

একটু অবশ্যি ঠাণ্ডা।

আগে তো ঠাণ্ডা চা মুখেই দিতে পারতে না।

মামুন চুপ করে রইল। মুনা বলল, দুপুরে কিছু খেয়েছে?

না!

কেন, খাওনি কেন?

ঘুমিয়ে পড়লাম। দশটার দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম। ক্ষিধেও হয়নি।

এখন হয়েছে?

হুঁ।

চল আমার সঙ্গে।

কোথায়?

আমাদের বাসায়। রাতে খাবে।

ঠিক আছে চল।

কাপড় বদলাতে বদলাতে মামুন বলল, তোমার শরীর ভাল মুনা?

হ্যাঁ ভাল।

টনসিালের ঐটা কমেছে, তাই না?

হ্যাঁ। তুমি দাড়ি রেখেছ কেন?

দাড়ি রাখব কেন? কয়েক’দিন কাটা হয়নি সেই জন্যে।

তোমাদের বাড়ির খবর কি বল।

বাড়ির কোনো খবর নেই। ছোট বোনটা মারা গেছে।

ওর কথা তো তুমি আমাকে কখনো কিছু বলনি।

মামুন চুপ করে রইল।

মুনা বলল, তুমি নিজের কথা কখনো কাউকে কিছু বল না। এটা ঠিক না। এতে মনের ওপর চাপ পড়ে।

হুঁ।

তোমার ভাই-বোনদের কথা আমি কিছুই জানি না।

মামুন চাপা স্বরে বলল, ঐ একটি বোন আমার। মরবার সময় খুব কষ্ট পেয়েছে। খুব কষ্টের মৃত্যু।

সব মৃত্যুই কষ্টের, সুখের মৃত্যু তো কিছু নেই।

তাও ঠিক।

মামুন হাসতে চেষ্টা করল। সিগারেট ধরিয়ে খুব উৎসাহের সঙ্গে টানতে শুরু করল। মুনা ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, কষ্টের ব্যাপারগুলি নিয়ে বেশি চিন্তা করা ঠিক না।

না চিন্তা করি না তো। ঐ সব নিয়ে আমি ভাবি না। চল যাই।

মুনা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, দাড়িটা কেটে ফেল। খুব খারাপ দেখাচ্ছে।

খুব খারাপ লাগছে, না?

হুঁ।

কোনো একটা সেলুনে গিয়ে কাটাতে হবে। দাড়ি বেশি বড় হয়ে গেছে, নিজে নিজে কাটা যাবে না। মেসের সামনেই একটা আছে সেখানে কাটাব।

একটি ছেলে শেভ করাচ্ছে। তার পাশেই একটি রূপসী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে–দৃশ্যটি অদ্ভুত। লোকজন কৌতূহলী হয়ে দেখছে। মামুন খানিকটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। বিব্রত স্বরে বলল–তুমি বাইরে যাও না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার কি? মুনা কিছু বলল না, বাইরেও গেল না। তার কেন জানি পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভাল লাগছে।

দাড়ি কাটার পর মামুনকে আরো রোগা এবং ফর্সা দেখাচ্ছে। তারা একটা রিকশা নিল। রিকশায় উঠলেই মামুন এক হাতে মুনাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। আজ সে রকম কিছু করল না। লাজুক প্রেমিকের মত সংকুচিত ভাবে বসে রইল। মুনা বলল, তোমরা কভাই-বোন? মামুন জবাব দিল না। মুনার মনে হল এই প্রশ্নটি সে আগেও করেছে–মামুন। এড়িয়ে গেছে। মনের ভুলও হতে পারে। হয়ত জবাব দিয়েছে, মুনার মনে নেই। নাকি এই প্রশ্ন সে কোনোদিন করেনি?

মুনা আবার জিজ্ঞেস করল, কভাই-বোন তোমার?

দু’ভাই এক বোন।

অন্য ভাইটি কি করে?

ছোটবেলায় মারা গেছে। পানিতে ডুবে মারা গেছে।

মুনা কিছু বলল না। মামুন বলতে লাগল–আমরা দুভাই পুকুরে গোসল করতে গিয়েছিলাম। আমি সাঁতার জানি না ও জানে। একটা পেতলের কলসী উল্টে তার কানায় ধরে সাঁতার কাটছি, হঠাৎ,…। মুনা বলল থাক বলার দরকার নেই। শুনতে চাই না।

শুনতে চাইবে না কেন? শোন। কলসী হাতছাড়া হয়ে গেল। হঠাৎ। ডুবে যেতে ধরেছি, বড় ভাই সাঁতরে এসে আমাকে ধরল। মরিয়া হয়ে আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম এবং ডুবে গেলাম দুজনেই।

মুনা প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল হুঁডটা তুলে দাও না।

মামুন হুঁড তুলল না। গাঢ় স্বরে গল্প শেষ করতে লাগল তারপর কি হয়েছে শোন, দু’জনকে আধমরা অবস্থায় উদ্ধার করা হল। একজন বাঁচল, একজন বাঁচল না।

মুনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মামুন বলল–আমরা ছিলাম তিনজন। এখন আমি একজন। এবং আমার কি মনে হয় জানো? আমার মনে হয়। আমিও থাকব না।

সে তো কেই থাকবে না।

না তুমি বুঝতে পারছি না। আমি নিজেও বেশিদিন বাঁচব না।

রিকশা থামিয়ে মামুন সিগারেট কিনল। জর্দা দিয়ে পান বানিয়ে রিকশায় উঠে এল। মুনা অবাক হয়ে বলল–পান খাবে নাকি?

হুঁ। কেমন যেন বমি বমি আসছে। আমার শরীরটা বেশি ভাল না। মুনা।

মুনা তার হাত ধরল। তাদের পরিচয় প্রায় তিন বছরের। এই দীর্ঘদিনে আজই প্রথমবারের মত মুনা নিজ থেকে তার হাত বাড়াল এবং এর জন্যে তার কোনো লজ্জা লাগল না। মুনা নরম স্বরে বলল–তোমার গা গরম। মনে হয় জ্বর আছে।

থাকতে পারে। মাথা ধরে আছে।

এই মাথা ধরা নিয়ে সিগারেট টানছ?

অভ্যাস। অভ্যাসের বসে টানছি। টানতে ভাল লাগছে না। তবু টানছি।

ফেলে দাও।

মামুন সিগারেট ফেলে দিয়ে হালকা স্বরে বলল, এখন কেমন জানি একা এক লাগে। এই মাসের মধ্যে একটা বিয়ের তারিখ হলে তোমার আপত্তি আছে? কল্যাণপুরের বাসাটাও তোমাকে দেখিয়ে আনব। কাল সময় হবে?

অফিস ছুটির পর হবে।

আজ তোমার মামার সঙ্গে কথা বলে একটা ডেট করে ফেলি। কি বল?

এত বড় একটা দুঃসংবাদের পর হুঁট করে বিয়ের তারিখ ফেলা কি ঠিক হবে? যাক কয়েকটা দিন।

না। আমার ভাল লাগছে না। আজই সব ঠিকঠাক করব।

বাকি রাস্তা কাটল চুপচাপ। দুজনের কেউই কথা বলল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *