রাত নটা। টগরদের বাড়িতে সাইকিয়াট্রিস্ট এসেছে। ভদ্রলোকের নাম এম শামসুল হক। নামের শেষে পিএইচডি আছে।
টগর দূর থেকে এই পিএইচডিওয়ালাকে দেখেছে। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি জ্ঞানী। জ্ঞান তার কথাবার্তা এবং চেহারায় ঝরে পড়ছে। ভদ্ৰলোকের হাসির মধ্যেও জ্ঞান-জ্ঞান ভাব আছে। মাথা সামান্য নিচু করে হাসেন। হাসির সময় চশমার ফাক দিয়ে তাকান। যার দিকে তাকিয়ে হাসেন তার বুক সামান্য হলেও ধক করে ওঠে। সে হাসি দেখে মনে করে, তার সব গোপন কথা এই ভদ্ৰলোক জেনে ফেলেছেন। অন্তত টগরের সে রকমই মনে হচ্ছে।
ভদ্ৰলোক তার দিকে তাকিয়ে তার বিখ্যাত হাসি হেসে বললেন, তোমার নাম কী খোকা?
টগর।
তুমি ট্যারা নাকি?
টগর সঙ্গে সঙ্গে চোখ ঠিক করে বলল, হ্যাঁ।
ট্যারা হওয়া সে এখন মোটামুটি শিখেছে। বাড়িতে নতুন কাউকে দেখলেই ট্যারা হয়ে তার দিকে তাকায়। সাইকিয়াট্রিস্টের দিকে তাকানো বোধ হয় ঠিক হয়নি। সে সামনে থেকে সরে গেল, তবে বেশি দূরে গেল না। আশপাশেই থাকল। ভদ্রলোক কোন পদ্ধতিতে ছোট মামার মাথা থেকে হিমু ভূত দূর করেন তা ভালোমতো দেখার আগ্রহ টগরের প্রবল। ভদ্রলোকের কাণ্ডকারখানা পছন্দ হলে সে নিজেও বড় হয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট হবে।
চৌধুরী আজমল হোসেন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে আলাদা বসেছেন। ঘরে আর কেউ নেই। জানালার পর্দার ওপাশে টগার দাঁড়িয়ে। এখান থেকে দুজনকে দেখা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কথাবার্তা তেমন শোনা যাচ্ছে না।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, শুভ্ৰ নামের রোগীটির যে মনোবিকার ঘটেছে, সেটা চিন্তিত হওয়ার মতো কিছু না। একে বলে ডিলিউশান। তার ধারণা হয়েছে, সে হিমু নামক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে।
ডিলিউশান কেন হয়েছে?
ডিলিউশান তৈরির নানা কারণ থাকতে পারে। রোগীর সঙ্গে ভালোমতো কথা না বলে তা বলা যাবে না। তবে আমরা সবাই কিছু না কিছু ডিলিউশন নিয়ে বাস করি। বিরাট বড় মিথ্যাবাদীর মনেও ডিলিউশন তৈরি হয় যে সে মিথ্যাবাদী না, সত্যবাদী। যা বলছে সবই সত্যি বলছে।
এই জিনিস দূর করার উপায় কী?
শরীরের রোগের চিকিৎসা ডাক্তাররা ওষুধপত্র দিয়ে করেন। শরীরের রোগের নির্দিষ্ট ওষুধ আছে। সেখানে মনের রোগ নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না। একেক জনের জন্য এই রোগ একেক রকম। চিকিৎসার ধরনও সেই জন্যই নানা রকম। যে ডিলিউশানে ভুগছে, প্রথমে তার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। যে সাইকিয়াট্রিস্ট এই কাজটা পারবেন, তিনিই শুধু রোগীর চিকিৎসা করতে পারবেন।
আপনি সেই বিশ্বাস অর্জন কীভাবে করবেন?
শুভ্ৰ নামধারী যে ডিলিউশানে ভুগছে আমি তা স্বীকার করে নেব। সে যখন বলবে, আমি হিমু। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলব। অবশ্যই তুমি হিমু। ভালো কথা, আপনি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো হিমু জিনিসটা কী?
আমিও ঠিকমতো জানি না জিনিসটা কী।
অসুবিধা নেই, আমি জেনে নেব। তারপর অগ্রসর হব সেই পথে।
চলুন, আপনাকে নিয়ে যাই।
না, আপনারা কেউ যাবেন না। আমি একা তার সঙ্গে কথা বলব।
আজমল হোসেন বললেন, শুভ্রর কাছে যাওয়ার আগে আরেকটা ছোট্ট কথা বলি। শুভ্ৰ পানিতে নামার পর থেকে এ বাড়িতে কিছু ভৌতিক ঘটনা ঘটছে, তার কি কোনো ব্যাখ্যা আপনার কাছে আছে?
অবশ্যই আছে। কেউ যখন ডিলিউশানে আক্রান্ত হয় তখন তার ছায়া আশপাশের সবার ওপর খানিকটা হলেও পড়ে। যেকোনো একটা ভৌতিক ঘটনার কথা বলুন, আমি তার ব্যাখ্যা দেই।
আজমল হোসেন বললেন, আমার নিজের কথাই বলি। আমি দুপুরবেলা এক স্লাইস রুটি আর একটা কলা খাই। আমাকে এই ঘরে খাবার দিয়ে গেছে। আমি ঘরেই আছি। ঘর থেকে বের হইনি। হঠাৎ দেখি কলা-রুটি কোনোটাই নেই। উধাও। কলার খোসাটা শুধু পড়ে আছে।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, কলা এবং রুটি আপনি নিজেই খেয়ে ফেলেছেন। বাসার ঝামেলায় আপনার মন ছিল বিক্ষিপ্ত। কখন খেয়েছেন সেটা ভুলে গেছেন। সাইকিয়াট্রিস্টের ভাষায় একে বলে সাময়িক এমনেশিয়া।
আমি নিজেই খেয়েছি?
অবশ্যই। যদি ভাত-মাছ খেতেন। হাতে ঝোল লেগে থাকত। সেখান থেকে বুঝতে পারতেন। আপনি নিজেই খাবারটা খেয়েছেন। যেহেতু খাবারটা ছিল শুকনা, হাতে কিছু লেগে ছিল না।
আপনার ধারণা আমি নিজে খেয়ে তুলে গেছি?
ব্যাখ্যা তো দিলাম। ব্যাখ্যা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না?
আপনি যা বলছেন তা হতে পারে। শুভ্ৰকে পানি থেকে তুলতে আপনার কতক্ষণ লাগবে।
আধঘণ্টার বেশি লাগার তো কথা না। অবস্থাটা দেখি। আপনারা কেউ আমার সঙ্গে যাবেন না। প্লিজ। কেউ যেন উঁকিঝুঁকিও না দেয়।
সাইকিয়াট্রিস্ট এম শামসুল হক পিএইচডি কলঘরে ঢুকে একটা ধাক্কার মতো খেলেন। তিনি ভেবেছিলেন অল্পবয়সী একটা ছেলে চৌবাচ্চার পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকবে। অথচ দেখা যাচ্ছে থলথলে মোটাসোটা এক বৃদ্ধ বসে আছে। বৃদ্ধের মাথার সব চুল সাদা।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, কেমন আছেন?
জি জনাব, ভালো আছি।
কতক্ষণ আছেন। পানিতে?
অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল।
আপনার নামটা কি আমি জানতে পারি?
রকিবউদ্দিন ভূইয়া।
সাইকিয়াট্রিস্টের ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি শুনেছেন পেশেন্টের নাম শুভ্ৰ। এখন পেশেন্ট বলছে তার নাম রকিবউদ্দিন ভূইয়া। এ রকম অবশ্য হয়। ডিলিউশনের পেশেন্ট নিজের নাম নিয়েও বিভ্রান্ত হয়। একেক সময় নিজেকে একেক রকম কল্পনা করে।
সাইকিয়াট্রিস্ট বললেন, হিমু বলে কাউকে চিনেন? হিমু নাম শুনেছেন?
আগে কোনো দিন শুনি নাই। পানিতে নামার পরে শুনেছি।
সাইকিয়াট্রিস্ট মনে মনে হাসলেন। রোগ কতদূর অগ্রসর হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। পানিতে নেমেই সে হিমুর সন্ধান পেয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধুর মতো গলায় বললেন, হিমু সম্পর্কে কিছু বলুন শুনি।
রকিবউদ্দিন বললেন, পানিতে নামেন তারপর বলব। দুইজন দুই জায়গায় থেকে কীসের কথা?
পানিতে নামতে বলছেন?
হুঁ। নেমে দেখেন আরাম লাগবে। শরীর হালকা হয়ে যাবে। শরীরের ভিতরই বাস করে মন। যেহেতু শরীর হালকা সেই কারণে মনও হবে হালকা।
এইসব কি আপনার কথা?
জি না। হিমুর কথা। হিমুর আরো অনেক কথা জানি। পানিতে নামেন বলব। শুভ্ৰ থাকলে সে গুছিয়ে বলতে পারত। সে কিছুক্ষণ আগে উঠে গেল।
সাইকিয়াট্রিস্ট আবারো মনে মনে হাসলেন। ডিলিউশানের গতি-প্রকৃতি ধরা পড়ছে। এখন এই লোক শুভ্রের নাম নিচ্ছে। শুভ্ৰ উঠে গেছে, সে বসে আছে। সাইকিয়াট্রিস্ট রোগীকে প্যাচে ফেলাবার ভঙ্গিতে বললেন। শুভ্র? শুভ্ৰ কে?
সে হিমু।
শুভ্ৰ, হিমু আর আপনি একই মানুষ, না? চট করে জবাব দেবেন না। ভেবেচিন্তে বলুন।
জি না। এক মানুষ হব কেন?
আমি যদি বলি আপনি শুভ্র আবার আপনিই হিমু। পানির এক রূপ বরফ, আরেক রূপ বাম্প। আপনি সাপ আবার আপনিই ওঝা।
আপনি বললে তো হবে না। আমি কী, সেটা আমি জানি।
না, আপনি জানেন না। যাই হোক বুঝিয়ে বলছি।
বুঝিয়ে বলার আগে পানিতে নামেন। তারপর যত ইচ্ছা বুঝান।
নামছি। নামছি।
আজমল হোসেন ইজিচেয়ারে বি॥ম ধরে বসে আছেন। তাকে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। তিনি খবর পেয়েছেন। শুভ্ৰ পানি থেকে উঠেছে। নিজের ঘরে বসে চা খাচ্ছে। তবে সাইকিয়াট্রিস্ট নেমে পড়েছে পানিতে। সে পানিতেই আছে।