ঝগড়ু খোয়াইয়ের মধ্যে একটা ভালো জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়ল।
ওরকম কিছুই হয়নি বুঝলাম, কারণ কঙ্কালটার কাছে গিয়ে দেখলাম মেলা ইগল পাখির পালক ছড়ানো।
ও, তা হলে হয়তো ওকে ইগল পাখিতে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, পাহাড়ের উপরে ইগল পাখির বাসাতে বাচ্চারা খাবে বলে। তারপর নখ থেকে কী করে খুলে ঘোড়াটা খোয়াইয়ে পড়ে মরে গেছিল।
আচ্ছা, রুমু, আবার কী হল?
ইগল পাখিতে ধরবে কেন? আস্তাবলে রাখে না কেন?
কী মুশকিল! আমাকে গল্পটা বলতে দেবে কি না?
ও, গল্প? তা হলে সত্যি নয়?
সত্যি নয় মানে? আমার সব গল্পই সত্যি গল্প।
বলো, তারপর ইগল পাখির পালক দেখে কী করলে?
ভালো করে দেখে বুঝলাম ইগল পাখিরই পালক নয়। ইগল পাখির পালক অত বড়োও হয় না–ওরকম নীল নীলও হয় না।
তবে?
বুঝলাম, তা হলে ওরই পালক।
ওরই পালক মানে? ঘোড়ার আবার পালক হয় নাকি?
ঝগড়ু উঠে পড়ল, কী যে বল! ঘোড়ার পালক হয় না? এবার হয়তো বলবে ঘোড়ার ডানাও হয় না। কঙ্কালটার কাঁধের কাছে দেখলাম, মুরগিদের ডানার হাড়ের মতো বিরাট দুই হাড়।
রুমু হাত দিয়ে নিজের মুখ চাপা দিয়ে চাপা গলায় বলল, তবে কি তবে কি ওটা পক্ষীরাজ ছিল ঝগড়ু?
তা জানি না, তবে শুনেছি পক্ষীরাজরা বুড়ো হলে, পুরোনো দেহটাকে ছেড়ে নতুন দেহ গজিয়ে নেয়!
বোগি বলল, না, তুমি ভীষণ গাঁজাখুরি গল্প বল, ঝগড়ু, নতুন দেহ গজিয়ে নেয় আবার কী?
তা তোমাদের এখানে কী হয় না হয়, সে বিষয় আমি তো কিছু বলতে পারি না, কিন্তু দুমকাতে হয় না এমন আশ্চর্য জিনিস নেই। তা ছাড়া টিকটিকির ল্যাজ গজাতে পারে, আর পক্ষীরাজ দেহ গজাতে পারে না বললেই হল!
ঘোড়ার কঙ্কাল তো এখানে পেয়েছিলে বললে।
এখানে পেলেই তাকে এখানকার ঘোড়া হতে হবে? আমিও তো এখানে আছি, তা হলে কি আমিও দুমকার ছেলে নই?
ঠিক এই সময় ওদের কানে এল স্পষ্ট ঘোড়ার খুরের শব্দ! সবাই অবাক। তারপরে পাশের গর্ত মতন জায়গা থেকে হাঁচড়-পাঁচড় করতে করতে উঠে এল একটা হাড়-জিরজিরে সাদা ঘোড়া।
তার খুর ছাড়া সবটা সাদা। গায়ের লোম, চুল, ল্যাজ, চোখের পাতি সব সাদা। খালি খুর চারটে আর চোখের মণিটা কুচকুচে কালো।
ওদের দেখে ঘোড়াটা চারটে পা এক জায়গায় জড়ো করে থমকে দাঁড়াল, তার সমস্ত শরীরটা থরথর করে কাঁপতে লাগল, চোখের কালো মণির চার ধারে অনেকখানি করে সাদা দেখা গেল। ঠোঁটের কোনায় একটু সাদা ফেনা লেগে রয়েছে, বুকটা হাপরের মতো উঠছে পড়ছে।
বোগি রুমুর মুখে কথা নেই। ঘোড়াটার প্রত্যেকটা পাঁজর গোনা যায়, আর কাঁধের উপর দুটো হাড় অদ্ভুতরকম উঁচু হয়ে রয়েছে। ঝগডুওদের কানে কানে বলল, নড়বে না, খবরদার আওয়াজ করবে না।
তারপর দু-হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে, মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত পাখি-ডাকার মতো নরম শব্দ করতে করতে ঝগড়ু ঘোড়াটার দিকে এগোতে লাগল। আস্তে আস্তে ঘোড়াটার কাঁপুনি থেমে গেল, চোখ দুটো কালো মখমলের মতো হয়ে গেল, সেও একটু এগিয়ে এসে মাথা নীচু করে ঝগড়ুর হাতের তেলোয় মুখ গুঁজে দিল। ঝগড়ু, অন্য হাতটা দিয়ে তার পিঠে হাত বুলোতে লাগল।
এবার তোমরা কাছে আসতে পারো, দিদি, ও আর কিছু বলবে না। কিন্তু সামনে দিয়ে এসো, ঘোড়ার পিছন দিক দিয়ে কখনো আসতে হয় না।
তুমি এত কথা কী করে জানলে, ঝগড়ু?
ঝগড়ু মুখটা তুলে, দূরে যেখানে গাছের পিছনে সূর্য ডুবে যায়, সেই দিকে চেয়ে বলল, বলেছি তোমাদের, হলদে পাখির ডানার ঝাঁপটা লেগেছে আমার গায়ে, দেশে আমি তিষ্ঠুতে পারি না। কোথায় কোথায় যে সে আমাকে নিয়ে বেড়িয়েছে সে আর কী বলব। বললেও তোমরা বিশ্বাস করবে না, তোমাদের কেতাবে সেসব জায়গার কথা লেখে না। ঘোড়দৌড়ের মাঠে কাজ করেছি আমি পাঁচ বচ্ছর। বোগিদাদা, ভালো ঘোড়া রেসের দিনে কেন দৌড়োয় না তাও জানি, খারাপ ঘোড়া কেন হঠাৎ ঝড়ের মুখে খড়ের কুটোর মতো ছুটে চলে তাও জানি। চলো, ওঠো, ঘরে যাবার সময় হয়েছে।
সাদা ঘোড়াটা দুটো কান খাড়া করে ঝগড়ুর কথা শুনছিল, এবার মুখ তুলে ঝগড়ুর চোখের দিকে চেয়ে রইল, ওর চোখ দেখে মনে হল যেন কালো দিঘির জল, তার তল নেই, থই নেই।
বলোনা ঝগড়ু, হলদে পাখির ডানার ঝাঁপটা লাগলে কেন ঘরে তিষ্ঠুনো যায় না?
বুকের মধ্যে খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়, ফোঁপরা হয়ে যায়, দুনিয়াতে হরেকরকম ভালো জিনিস আছে, কিন্তু কিছুদিয়েই আর সে ফাঁকা ভরানো যায় না, বোগিদাদা; ঘর ছেড়ে, ঘরের মানুষ ছেড়ে তাই বেরিয়ে পড়তে হয়। চলো, আঁধার নামছে।
কিন্তু তাহলে সাদা ঘোড়ার কী হবে? ওকে বাড়ি নিয়ে গেলে হয় না, ঝগড়ু?
থাকবে কোথায়? খাবে কী? তোমাদের দিদিমা কেন থাকতে দেবে?
তোমার ঘরে থাকবে, ঝগড়ু, তরকারির খোসা খাবে, দিদিমা জানতেও পারবে না।
রুমু বলল, আর জানলেই-বা কী হবে? তোমার ঘরে যে কালো ছেলেটা এসেছে, দিদিমা বলেছে কিছু?
ঝগড়ু মাথা উঁচু করে বলল, ও তো দুমকার ছেলে। আর তা ছাড়া ও হল পক্ষীরাজ, এদের ঘরে বেঁধে রাখা যায় না।
পক্ষীরাজ তো ডানা কোথায়, ঝগড়ু?
ঝগড়ু অবাক হয়ে গেল। সব পক্ষীরাজের কি ডানা গজায় ভেবেছ নাকি? দেখছনা ওর কাঁধের উপরকার হাড় কেমন উঁচু হয়ে রয়েছে? ওর যে ডানার কুঁড়ি রয়েছে, বোগিদাদা। ডানার কুঁড়ি থাকলেও সকলের ডানা গজায় না, গায়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে থাকে, একটুখানি জিরুতে দেয় না, সারাটা জীবন জ্বালিয়ে খায়।
এই বলে ঝগড়ু ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিল। ঘোড়াটাও একবার ঘাড় কঁকি দিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে একবার চিহি করে ডাক ছেড়ে, পেছনের দুটো পায়ের উপর একবার দাঁড়িয়ে উঠে, খোয়াইয়ের উপর দিয়ে খটাখট শব্দ করে দৌড় দিল। চারটে খুর থেকে আগুনের হলকা ছুটতে লাগল, চারিদিকে ধুলো উড়তে লাগল, কাশবনের মধ্যে দিয়ে, তিরের বেগে ছুটে, দেখতে দেখতে সাদা ঘোড়া অদৃশ্য হয়ে গেল।
সারাটা পথ কারো মুখে কথা নেই। ভুলো সেদিনও ফিরল না। ঝগডুর ঘরে কালো ছেলেটা অঘোরে ঘুমুচ্ছে বোগি গিয়ে দেখে এল। রাতে খেতে বসে দাদু বললেন, কী হে, নেড়িকুত্তোর দুঃখ ঘুচল? আনবে নাকি সেজো মামা বিলিতি কুকুরের ছানা?
রুমু বোগির মুখের দিকে চেয়ে দেখে, বোগি মাথা নাড়ছে।
দিদিমা বললেন, কী জানি, পায়ে পায়ে অষ্টপ্রহর ঘুরঘুর করত, ভারি বিরক্ত লাগত, এখন আবার যেন খালি খালি লাগে।
বোগি তবুও কিছুনা বলে, একটা পরিষ্কার চুলের কাটা দিয়ে নলি হাড়ের ভিতর থেকে রস বের করে খেতে লাগল।
রুমু বলল, ভুলো ছাড়া আর কাউকে আমরা চাই না, দাদু।