০৫. জয়নালের মন খারাপ

জয়নালের মন খারাপ ভাবটা কিছুতেই যাচ্ছে না। ওভারব্রিজের উপর উঠে তা যেন আরো বাড়ল। ওপর থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়া রেললাইন চোখে পড়ে। মন আপন থেকে উদাস হয়। তার ওপর অনেক দিন পর বেলায়েতকে দেখা যাচ্ছে। বেলায়েত গান গেয়ে ভিক্ষা করে। তার পাশে বসে থেকে তার মেয়ে আপন মনে খেলে। কখনো ইচ্ছা হলে আচমকা মিষ্টি নিরিনে গলায় বাপের গলার সঙ্গে সুর মেলায়। শুনতে বড় মিষ্টি লাগে। বেলায়েত বেসুরা গলায় মাথা নেড়ে নেড়ে গাইছে…

… দিনের নবী মোস্তফায়
রাস্তা দিয়া হাইট্টা যায়
একটা পাখি সেই সুময়ে
ডাকতে ছিল আপন মনে
গাছের পাতায় গো গাছের পাতায়…।

আজ বোধ হয় বেলায়েতের মেয়ের মনটা ভালো। বাপ থামার সঙ্গে-সঙ্গেই ছোট্ট মাথা দুলিয়ে গেয়ে উঠল…গাছের পাতায় রে গাছের পাতায়।

জয়নাল পাঁচ টাকার একটা নোট থালায় ফেলে দিল। বেলায়েত বিস্মিত হয়ে জয়নালকে এক পলক দেখেই নোট সরিয়ে ফেলল। পাঁচ টাকার নোট একটা পড়ে আছে দেখলে অন্যরা ভিক্ষা দেবে না।

বেলায়েত ভাইরে অনেকদিন পরে দেখলাম। গেছিলেন কই?

শম্ভুগঞ্জ।

শইল ভালা তো?

আল্লায় রাখছে।

শম্ভুগঞ্জে আয় রোজগার কিছু হইছে?

হইছে কিছু।

হইলে মেয়েটারে জামা টামা কিন্যা দেন। শীতের মইদ্যে খালি গাও।

বেলায়েত নিচু গলায় বলল, জামা আছে। সুয়েটারও আছে। খালিগাও থাকলে ভিক্ষার সুবিধা। বেলায়েতের মেয়েটা মুচকি-মুচকি হাসছে। হাতে চারটা কড়ি। কড়ি খেলছে—হিসেব করছে। এই মেয়েটাকে দেখলেই জয়নালের শাহেদার কথা মনে হয়। শাহেদাও বাপজানের পাশে বসে আপন মনে কড়ি খেলত। বেলায়েত এখন যে জায়গায় বসে ভিক্ষা করছে টিনের একটা থালা নিয়ে, ঠিক এই জায়গায় বসতেন বাপজান। ভিক্ষা করতে লজ্জায় তাঁর মাথা কাটা যেত—শুধু তোতাপাখির মত বলতেন,

বাপধন গরিবরে সাহায্য করেন।

বাপধন গরিবরে সাহায্য করেন।

মাঝে-মাঝে বাপজানকে ভেংচি কাটত শাহেদা। অবিকল তাঁর মতো গলায় বলতো—

বাপধন গরিবরে সাহায্য করেন।

বাপধন গরিবরে সাহায্য করেন।

জয়নালের বাবা রাগ করার বদলে হেসে ফেলতেন।

গরমের সময় তারা ঘুমুহতা ওভারব্রিজে। মশা কম, ফুরফুরা বাতাস। শাহেদা বলত, একটা কিচ্ছা কও, বাজান। এই কথাটার জন্যেই যেন অপেক্ষা। বলা মাত্র গল্প শুরু হত। শুরু হত–

কিচ্ছা যত…

মিচ্ছা তত—এই প্রস্তাবনা দিয়ে। মজার মজার সব গল্প। ওভারব্রিজে তাদের সেই জীবন খুব খারাপ ছিল না। বেলায়েত এবং তার কন্যার জীবনও বোধ হয় খারাপ না। আল্লাহতায়ালার বড় একটা গুণ হচ্ছে কাউকে দুঃখ দিলে সমপরিমাণ সুখ দিয়ে তা পূরণ করার চেষ্টা করেন।

জয়নাল বলল, বেলায়েত ভাই—যাই। সন্ধ্যার আগেই মেয়েটারে জামা পরাইয়েন। ঠাণ্ডা লাগলে মুশকিল। এই বচ্ছর শীত পড়ছে বেজায়।

বেলায়েত জবাব দিল না। গানে টান দিল। এইবার নূতন গান—মনে বড় আশা ছিল—যাব মদিনায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *