০৫. জেলখানার রক্তদান শিবির

সেদিন জেলখানার রক্তদান শিবির বসেছে। সে সময় মানুষের মধ্যে আজকের মত এত সচেতনতা ছিল না। যে পাড়ায় পাড়ায় ক্লাবে ক্লাবে রক্ত সংগ্রহের জন্য উদ্যোগ নিয়ে রক্তদান শিবির চালাবে। তখনকার সময়ে রক্ত যোগান দেবার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল দেশের কারাগারগুলো। এখানে যদি সাজা প্রাপ্ত বন্দী একবার রক্ত দেয় তাহলে তার সাজা কুড়ি দিন কমে যায়। পরে আবার দিলে বাইশ দিন–এইভাবে প্রতিবারে দুদিন করে বেড়ে যায়। আর যারা বিচারাধীন বন্দী তারা রক্ত দিলে পায় নগদ কুড়ি টাকা। জানি না, এখন এই টাকার পরিমাণ কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

যারা সাজা প্রাপ্ত বন্দী, তারা মাসে সামান্য কিছু মাইনে পায়। যা দিয়ে তারা তাদের তেল সাবান বিড়ি সিগারেট এবং অন্য যা প্রয়োজন কিনে নিতে পারে। কিন্তু যারা বিচারাধীন–যাদের জেলের বাইরে সহায়ক কেউ নেই তারা কী করবে? তারা রক্তদান করে পাওয়া টাকায় নিজের প্রয়োজন অনুসারে কিছু জিনিস কিনে নিতে পারে। জেল গেটের খাতায় নাম আর মাল লিখিয়ে দিলে কর্তৃপক্ষ সেগুলো আনিয়ে দেয়।

দিন দুয়েক আগে খবর পেয়েছিলাম–শিবির বসবে। তখনই মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বসেছিলাম। আজ হিষ্ট্রি টিকিট হাতে নিয়ে রওনা দিলাম রক্ত দেবার জন্য হাসপাতালের দিকে। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে আগের আট-দশ জনের রক্ত টেনে নেবার পরে আমার ডাক এল। জীবনে এই প্রথম। একটু ভয় ভয় তো করছিলই। চিৎ করে আমাকে শুইয়ে ফেলা হল হাসপাতালের বেডে। বা হাতের তালুতে দেওয়া হল একটা শক্ত রবারের টুকরো কষে ধরে থাকার জন্য। দাবনায় বাধা হল একটা রবার নল। এবার একটা মোটা সূঁচ ফুটিয়ে দেওয়া হল হাতের ফুলে ওঠা শিরায়। যে সুচের সাথে লাগানো নল লম্বা হয়ে পৌঁছে গেছে একটা বোতলের মধ্যে। এবার আমি নির্দেশ মত হাতের তালুর রবারটা চাপছি আর ছাড়ছি। ছাড়ছি আবার চাপছি। এতে বেগে রক্ত বের হয়। কিছুক্ষনের মধ্যে কলকল করে ভরে গেল বোতল–আমার লাল গরম রক্তে।

এরপর জেলগেটের খাতায় কার কি লাগবে লেখানোর পালা। কেউ লেখাচ্ছে চিড়েগুড় বিড়ি সাবান। কেউ বিড়ি গামছা ছাতু। আমি বললাম-আমাকে এই টাকায় যতটা হয় কাগজ আর পেন দেওয়া হোক। খাতা লিখছিলেন ডেপুটি জেলার। পাঁচ ফুট উচ্চতা, মাথায় টাক চোখে চশমা, নাকে বড় বড় লোম, যাতে নস্যি মাখানো, তাকাবার সময় তাকায় চশমার উপর দিয়ে। বলে সে–কি চাই? আইজ্ঞা কলম আর কাগোচ। ও দিয়ে কী হবে? লেখাপড়া শিখমু। তার চোখে ঠোঁটে বিদ্রূপ ছলকায়, লেখপড়া শিখে কী বিদ্যাসাগর হবি নাকি! বিনয়ের সাথে বলি, আমি ছার “রাইটার” হইতে চাই।

জেলখানায় সাজা হয়ে গেলে তাকে হয় চৌকা নয় ডাল চাকি, নয় কম্বলঘর কোথাও না কোথাও “খাটনি” দিতে যেতে হয়। এসব খুব শ্রমের কাজ। যা সাধারণতঃ নিরক্ষর, বা অল্প শিক্ষিত কয়েদিরা করতে বাধ্য হয়। আর যারা লেখাপড়া জানে অফিসিয়াল কাজ পায়। এর মধ্যে সবচেয়ে সম্মানীয় পদের নাম রাইটার। পরিস্কার পোষাক পরে পকেটে পেন গুঁজে সারা জেল ঘুরে বেড়ায়। কে কোর্টে যাবে, কার ইন্টারভিউ তাদের নাম ডেকে বেড়ায়। আমার লোভ ওই পদের দিকে।

আমার জবাব শুনে ওহঃ করে একটা শব্দ ছেড়ে বলেন তিনি–আন্ডার ট্রায়াল প্রিজনারকে কাগজ কলম দেবার নিয়ম জেলকোডে নেই। অন্য কিছু বল। নরম গলায় বলি, কিন্তু আমাদের ওয়ার্ডে একটা ছেলে থাকে। ও তো সব পায়!

বলে ডেপুটি জেলার, ওর জন্য মেজিস্ট্রেটের স্পেশাল পারমিশান আছে। পারমিশান করিয়ে আন। তুইও পাবি।

মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল আমার। মেজিস্ট্রেট আমার কথা শুনবে না। শুনবে কালো কোট পরা উকিলের কথা। আমার তো কোন উকিল নেই। তাছাড়া এখন তো আমার সাথে মেজিস্ট্রেটের দেখা হবার কোন পথও নেই। কোর্টে যাই, চৌদ্দদিন অন্তর। কোর্ট লকআপে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসি। সে বড় কষ্ট। তাই মাঝে মাঝে শরীর খারাপ বলে কোর্টে যাওয়া থেকে রেহাই নিয়ে নিই। চোখে এখন জল এসে যায় আমার। ডেপুটি জেলারকে বলি, কাগজ কলম যদি না দিতে পারেন আমার আর কিছু চাই না।

যখন আমি ডেপুটি জেলারের অফিস থেকে বের হয়ে ওয়ার্ডের দিকে আসছি কেস টেবিলের সামনে দেখা হয়ে গেল ভুবন সেপাইয়ের সাথে। বার বার গামছায় চোখ মুছতে দেখে জিজ্ঞাসা করে সে–কী হয়েছে, কাঁদছিস কেন?তখন যাযা হয়েছে খুলে বলার পর সব শুনে বলে সে আমার সাথে আয় দেখি। তারপর ডেপুটি জেলারের সামনে গিয়ে বলে–স্যার এখন জেলখানার নাম বদলিয়ে সংশোধনাগার রাখা হয়েছে। একটা ছেলে নিজেকে সংশোধন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে চাইছে। সেই সুযোগটা আমরা যদি তাকে না দিই, খুব অন্যায় হবে। একবার ওর মনের ইচ্ছার কথাটা ভেবে দেখুন। ছেলেটা রক্ত দিয়ে কাগজ কলম কেনার চেষ্টা করেছে। এমন ছেলে তো আমাদের প্রশংসার পাত্র হবার যোগ্য। আমি অনুরোধ করছি, ওকে কাগজ কলম দিয়ে দিন স্যার।

অফিসারদের সাথে এমন জোরের সাথে কথা বলার ক্ষমতা অধঃস্তন কর্মচারীদের থাকে না। এই ক্ষমতা, সততা সাহস আর ন্যায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকলে তবেই আসে। ভুবন সেপাই কোন রকম কোন দুর্নীতি, কোন অনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত নয়। যা কমবেশি সব সেপাই করে থাকে। তাছাড়া সে কারারক্ষী সমিতির একজন বিশিষ্ট কর্মকর্তা। সে যখন কারও সাপোর্টে দাঁড়িয়ে যায়, ঠেলে ফেলা কঠিন। বলে ডেপুটি জেলার জেলার বাবুর সাথে কথা বলে দেখি কি করা যায়। তখন আমার দিকে তাকিয়ে বলে ভুবন সেপাই–তুই যা। চিন্তা করিস না, পেন কাগজ পেয়ে যাবি।

দিন দুই তিন পরে পেয়ে গিয়েছিলাম পেন আর কাগজ। কুড়ি টাকায় ছয় দিস্তা কাগজ আর একটা কালির পেন পেয়েছিলাম। তবে সব আমাকে একবারে দেওয়া হয়নি। রাখা ছিল অফিসে। শর্ত ছিল রোজ আমাকে দু খানা তিনখানা করে কাগজ দেওয়া হবে। সেগুলোর লিখে জমা দেবার পর আবার দেওয়া হবে। যদি আমি এই কাগজ হারিয়ে ফেলি, নকশাল বন্দীদের দিয়ে দিই তাহলে সাজা পেতে হবে। আসলে জেলকর্তৃপক্ষের এই ভয়টাই ছিল যদি কেউ ওই কাগজে চিঠি ফিটি লিখে কোন পত্র পত্রিকার দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়। জরুরি অবস্থায় জেলখানায় যে অমানুষিক বর্বরতা, যে অন্যায় অত্যাচার চলছে, তাহলে সব প্রকাশ হয়ে যাবে।

একজন বিখ্যাত মানুষ বলে গেছেন–রাজনীতি হচ্ছে দুষ্কৃতকারীদের শেষ স্মরণ স্থল।বর্তমান সময়ের রাজনেতা ও তার সঙ্গিসাথীদের দেখে মনে হতেই পারে যে উনি খুব একটা ভুল বলেননি। এমন কোন অপরাধ আছে যা এরা করে না? তবে ওই বিখ্যাত ব্যক্তি সম্ভবতঃ নকশাল পার্টির কর্মীদের (আমি যাদের দেখেছি) দেখার সুযোগ পাননি। তা যদি পেতেন, আমার ধারণায় ওই কথাটা বলার আগে দুবার ভাবতেন।

আমার ভাগ্য আমাকে অল্প কিছু সময়ের জন্যে ওই মানুষগুলোকে সেইসময় জেলের বাইরে এবং জেলের ভিতরে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ দিয়েছে। কী তাদের ছিল না? বিদ্যা ছিল, বিত্ত ছিল, প্রভাবশালী দাদা কাকা মামা ছিল। চাইলে এই সব সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে যেতে পারতো। ইহলৌকিক যাবতীয় সুখ ভোগ বিলাসে কাটাতে পারতো সারাটা জীবন। তারা সে সব না করে এই দেশটাকে ভালোবেসে–দেশের শ্রমিক কৃষক দরিদ্র মানুষের কষ্টে কাতর হয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল এই বিপদ সংকুল পথে। কতো কষ্ট সয়েছে তারা কী ভীষণ সাহসে প্রাণ দিয়েছে একর পর এক। জেলখানার নির্মম দেওয়ালের পিছনে কী অবর্ণনীয় অত্যাচার চালিয়েছে শাসক শ্রেণির পোষা গুণ্ডারা তাদের উপর। সবকিছু শুধু এই কারণে যেন তাদের মনোবল চুরমার করে দিতে পারে। মন থেকে ভুলিয়ে দিতে পারে মানুষকে ভালোবাসার আর শ্রেণিহীন এক সমাজ গড়ার সব স্বপ্ন। ভুলিয়ে দিতে পারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রবণতা।

নকশাল আন্দোলন শুরুর আগে পর্যন্ত জেলখানায় কোন ভালো লোক তো আসেনি, যারা আসত সবই ছিল চোর ডাকাত খুনি। তারা নিজেরা অন্যায়কারী, ফলে মানসিক দিক থেকে দুর্বল। জেল কর্তৃপক্ষের কোন অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মত সাহস তাদের হতো না। যে কারণে সুপার-জেলার-ওয়ার্ডার সবাই যে যার সাধ্যমত জেলখানাকে লুঠ করে নিতে পারত। একে তো জেল কর্তৃপক্ষ আর কন্ট্রাকটারদের যোগ সাজশে যে সব মাল জেলখানায় সাপ্লাই আসত তা ছিল সবই নিকৃষ্ট মানের। আবার সেই মাল যেমন চাল ডাল তেল মশলা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে ঢের কম কয়েদিদের জন্য খরচ করে, বেচে যাওয়া সেই সব মাল পাচার করে দেওয়া হতো ব্যাগে ব্যাগে।

আমার মনে আছে একবার প্রায় মাস দেড়েক ধরে দুবেলাই মটর ডাল দেওয়া হচ্ছিল আমাদের। এক হাতা সেই ডালে সরু চালের জলে ভেজা মুড়ির মত ভাসতে দেখা যেত সাদা সাদা পোকা। একটা দুটো নয়, এক হাতা ডালে কমপক্ষে কুড়ি পঁচিশটা। সাধারণ কয়েদির সাহস ছিলো না। এই নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল নকশাল বন্দিরা। ডাল সহ ভাতের থালা দেখিয়ে তারা জেল সুপারের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিল, এই ডাল মানুষ খায়? মানুষ কোথায় জেলে, সব তত কয়েদি! সে কথা বলেনি সুপার। শুধু মুচকে হেসে বলেছিল, যদিনা খেতে চাও খেও না। ফেলে দাও। যা গোডাউনে আছে তাই দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ জানিয়ে কোন লাভ নেই।

ডালটা ফেলে তো দেওয়াই যায়, কিন্তু তাহলে পেটটা ভরবে কী করে? ভাত তো মাত্র ছাপান্ন গ্রাম চালের। যাদের বাড়ির অবস্থা ভালো বাইরের খাবার পায়, তাদের অসুবিধা হয় না। যাদের সে অবস্থা নেই পোকা বেছে ফেলে ওই ডালই খেয়ে নেয়। ডালে পোকা, সকালে যে টিফিন দেওয়া হয় মটর ছোলা সেদ্ধ, তাতে পোকা, ভাতে ধুলো কঁকর এ সব অখাদ্য ফেলে দিতে হলে বন্দী আর বাঁচবে না।

খাদ্য দ্রব্য নিয়ে যেমন, তেমন ওষুধ পত্র নিয়েও নকশাল ছেলেরা প্রতিবাদ জানাতে সে নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে বিরোধ তো লেগেই ছিল তার উপর ছিল তাদের রাজনৈতিক মতবাদ যা অবিনীত অবাধ্য ও সাহসী। তারা কোন ব্যাপারেই জেল কর্তৃপক্ষকে কোন সহযোগিতা করতে না। ফলে তারা এদের উপর ভয়ানক ক্রুদ্ধ ছিল। যখন তখন ছল ছুতোয় নকশালদের উপর হামলা করে দিত। যে সব খবর বাইরের জগতের লোক জানত না।

এই জেলের একটা ওয়ার্ডে জেল কর্তৃপক্ষের কিছু অনুগত গুন্ডা বদমাশকে রাখা হয়েছিল। নিজস্ব উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য জেলার এদের বিশেষ সুখ সুবিধার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। নকশালদের মধ্যে যে সব ছেলে জেলকর্তৃপক্ষের বিষ নজরে এসে যেত তাকে ওয়ার্ড বদলি করে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো এই নম্বরে। আর সন্ধ্যে ছটার গুনতির পর যখন ওয়ার্ড “লকআপ”করা হয়ে যেত, ওই গুন্ডারা এক যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ত নকশাল বন্দিটির উপর। এ সব খবর বাইরে বের হবার কোন উপায় ছিল না। যদিবা বের হয় কর্তৃপক্ষ একে দুদল কয়েদির মারামারি বলে ব্যাপারটা হালকা করে দিত।

এটা সেই জরুরি অবস্থার কাল। তখন যেন সরকার আর সরকারের পোষ্য জেল সেপাই গুন্ডা বদমাশ সবাই মিলে একদল নিরস্ত্র অসহায় নকশাল বন্দিদের ধ্বংস করে ফেলার সর্বাত্মক সন্ত্রাস ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছিল। যদি ছুতোনাতা পেত যেমন ভাবে নিরীহ হরিণ ছানার উপর শেয়ালের পাল ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত। যদি ছুতো না পায় ছুতো তৈরি করে নিত।

কবি নবারুণ ভট্টাচার্য লিখেছেন–এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়।…কিন্তু সত্যি এটাই যে সারা দেশটাই তখন মৃত্যু উপত্যকা, জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ। যার সবচেয়ে নগ্ন নির্লজ্জ বিভৎস নৃত্যভূমি ছিল এই জেলখানাই। লোক চক্ষুর অন্তরালে দিনের পর দিন যে অত্যাচার শাসকদের প্রশ্রয়ে এখানে সংগঠিত হয়েছিল তা যে কোন সভ্যদেশ বা জাতির পক্ষে চরম লজ্জা-ঘৃণা-নিন্দার।

নকশালরা সব শিক্ষিত ছেলে। জেলারের ডেপুটি জেলারের ভয় ছিল যদি তাদের হাতে পেন কাগজ পৌঁছে যায়, সব বিস্তারিত লিখে যদি বাইরে পাচার করে দেয় মহা হাঙ্গামা হয়ে যাবে। তাই আমার প্রতি এই কঠোর নির্দেশ। তবে তারা আমার কাছে কোনদিন কাগজ পেন চায়নি। চাইলে দিতাম কী দিতাম না সে আমি জানি না।

পেন কাগজ হাতে পেয়ে আমার উদ্যমের নদীতে এবার পূর্ণ জোয়ার এসে গেল। প্রথমে বড় তারপর মেজ তারপর ছোট–আরও ছোট অক্ষর লেখায় হাত রপ্ত হয়ে উঠল। ওয়ার্ডের পড়ুয়া ছেলেটার কাছে অনেক বই আছে তার কাছ থেকে একখানা বই চেয়ে নিয়ে বানান করে করে বেশ খানিকটা পড়েও ফেলতে পারলাম। শুধু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল যুক্তাক্ষর আর তার মানে। অন্বয়, এই শব্দের অর্থ যে অনুবৃত্তি অর্থাৎ বাক্যের মধ্যে কর্তা কর্ম ক্রিয়া প্রভৃতির পরস্পর সম্বন্ধ সে আমি তখন বুঝে নিতে অপারগ।

একটি শব্দ দেখিয়ে মাস্টার মশাইয়ের কাছে জানতে চাই–এটা কী? তিনি পড়ে বলেন কুম্ভীলক। এর মানে? চোর। তবে কোন সাধারণ চোর নয়, বিদ্বান চোর। যে অন্য কোন লেখকের লেখা তার ভাব ভাষা নিজের বলে চালিয়ে দেয়। তাকে বলে কুম্ভীলক বৃত্তি। ওই বই থেকে দেখে দেখে হুবহু দু তিন পাতা লিখে ফেলে দিই। অক্ষর তেমন সুন্দর হয় না। আঁকাবাঁকা অক্ষরের সে লেখার উপরে লিখে দেই আমার না। এটা আর কারও নয়–আমারই।

“এই পৃথিবীর যা কিছু মহান যা কিছু শ্ৰেষ্ঠ যা কিছু সুন্দর সব সব কিছুর স্রষ্টা আমি। সব আমারই। বেদের সুক্ত কুরআনের আয়াত আমারই রচনা। আমি নিজে হাতে লিখিনি–যে লিখেছে সে আমারই প্রতিনিধি। আমারই মনের ভাবকথা মূর্ত করেছে পুথিগ্রন্থের পাতায়। আমারই জন্যে।”

এর কিছুদিন পরে মাস্টার মশাই চলে গেলেন। যে বোধিবৃক্ষের নিভৃত ছায়ায় বসেতপশ্চর‍্যা করবার সৌভাগ্য হয়েছিল একরাতে ঝড়ে বৃক্ষটি উপরে গেল। বড় বিকল্পহীন বিপন্নতার মধ্যে পতিত হলাম আমি। আমার পাশেই শুয়ে ছিলেন। হঠাৎ মাঝরাতে বুকে অসহ্য ব্যথা। চিৎকার করে সেপাইকে ডাকলাম। তারা ওনাকে নিয়ে গেল বাইরের কোন হাসপাতালে সেখান থেকে উনি আর এলেন না।

উনি চলে গেলেন। কিন্তু জ্বালিয়ে রেখে গেলেন আমার মনের মধ্যে অনির্বাণ এক দাউদাউ আগুন। রেখে গেলেন আমাকে চির ঋণী করে!

এখন আমি অনুভব করতে পারছি আমার মনের মধ্যে ধীরে ধীরে মাথা তুলছে ভীষণ এক রাক্ষুসে খিদে। সে খিদে শেখবার আর জানবার অদম্য লালসা অভিলাষায় পূর্ণ। যে খিদেকে তৃপ্ত করতে চাই বই। বই কোথায় পাবো! মনে পড়ে, বই আছে সেলে। সেলের বন্দীরা গাদা গাদা বই পড়ে। এই বই দিয়ে যায়, ফিরিয়ে নিয়ে যায় তাদের বাড়ির লোকজন। ওদের কাছে যদি যাই বই পাবো। যে কঠিন শব্দের অর্থ বুঝতে অসুবিধা হবে ওরা বুঝিয়ে দেবে। তাই অনেকদিন পরে আবার ফালতু হয়ে পৌঁছে যাই সেলে।

ঠিক মনে পড়ছে না, কে যেন বলেছেন–যদি তুমি কোন কিছু একান্তভাবে কামনা করো, সমস্ত জগত তোমার জন্য সচেষ্ট হবে সেটি পৌঁছে দিতে। আমি বই চেয়েছিলাম বই পেয়ে গেলাম। গাদা গাদা বই। পড়তে শেখার পর আমি প্রথম যে বইখানা নিজের চেষ্টায় পড়ে শেষ করতে সমর্থ হই তার নাম নিশিকুটুম্ব। পরের বই লৌহকপাট। বইয়ের পাতায় চোখ রেখে পার হয়ে যেতে থাকে দিন রাত শীত গ্রীষ্ম বর্ষা। আমার চোখের সামনে খুলে যেতে থাকে একটার পর একটা অজানা অদেখা জগতের দরজা। আমি সেই দরজা পার হয়ে হাঁটতে থাকি।

জেলখানায় সেকেন্ড গুনতির আগে সেলে আসি। আমাদের ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে দু দশ পা দক্ষিণ মুখো হেঁটে, বেঁকে যেতে হবে ডানদিকেবাঁদিকে পড়বে কেস টেবিল। তারপর আমদানি ওয়ার্ড তার পাশে সেল। যারা কাল জেলে নতুন এসেছে সব রাখা হয়েছে আমদানি ওয়ার্ডে। এটাই নিয়ম। আজ তাদের পাঠানো হবে ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে। তার আগে, আমদানি থেকে বের করে সব নবাগত বন্দিকে কেস টেবিলে জোড়া জোড়া লাইন দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়। আমি যেদিন জেলখানায় এসেছি, সেদিন থেকে রোজ সকালে পায়খানায় যাবার সময়ে একবার কেস টেবিলের এপারে দাঁড়িয়ে লোহার রেলিংয়ের ফঁক ফোকর থেকে উঁকি মেরে দেখে নিতাম ওইনবাগতের মধ্যে আমার কোন পরিচিত আছে কিনা! এটা আমার দিনকার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।

পরিচিত মানুষ দু একজনের দেখা যে মেলে না এমন নয়। একদিন দেখি বিজয়গড়ের যুব কংগ্রেস কর্মী কানাই ঢাকুরিয়া লেকে কী এক গন্ডগোলে গুলি চালিয়ে কাকে যেন মেরে ফেলে জেলে এসেছে। তার খুটির জোর আছে, কয়েকদিন পরে জামিন করিয়ে বের হয়ে যায় জেল থেকে।

আজ যখন সেলে যাচ্ছি, এদিকে তাকাতেই চোখে পড়ল আর একটা চেনা মুখ, বসে আছে। কেসটেবিলের লাইনে। পরিমল না পরিতোষ তা জানি না, আমি ওকে জানি পরি বলে। ওই নামে সবাই ডাকে। পরি একজন দক্ষ পকেটমার। সে আমাকে যেমন চেনে, চেনে আমার পিতাতুল্য নরেশ ঠাকুরকেও।

পকেটমারি–এটি “জেলখাট্টু” ক্রিমিনালদের কাছে সবচেয়ে ছোট কেস। যদি কেউ উকিল দাঁড় করিয়ে জামিন নাও নিতে পারে, এমনি এমনি তিনমাস পরে কে খালাস হয়ে যাবে। আর উকিল দাঁড় করালে “একপেসি” অর্থাৎ চৌদ্দ দিন। তারপর মুক্ত।

বড় জমাদারকে বলে কয়ে পরিকে আমাদের ওয়ার্ডে নিয়ে এলাম। চৌদ্দদিন সে আমার সাথে রইল। তারপর এসে গেল তার কোর্টে যাবার দিন। বিল্টুদায় নেবার দিন। বললাম তাকে–বের হয়ে তুই একটু গিয়ে নরেশ ঠাকুরকে বলিস, আমি মারা যাইনি। জেলে আছি। জেলে যখন আছি। একদিন না একদিন নিশ্চয় ছাড়া পাবো। তখন অবশ্যই তার সাথে গিয়ে দেখা করব। আর যদি মন কেমন কেমন করে তবে যেন কোর্টের তারিখে কোর্টে এসে আমাকে দেখে যায়। পরি আমার এই উপকারটুকু করেছিল। সে নরেশ ঠাকুরের কাছে আমার বার্তা এবং কোর্টের তারিখটা পৌঁছে দিয়েছিল।

আমার কোর্টের তারিখ ছিল সাত-আটদিন পরে। আলিপুর কোর্টের যে লকআপে আমাদের রাখা হোত তার একটা দরজা একটা জানালা। আমি সবদিনই কোর্টে গিয়ে আগে ভাগে জানালাটা দখল করে নিতাম। রড ধরে ঝুলে বসে থাকতাম বাইরের দিকে তাকিয়ে। দেখতাম কে আসে, কে যায়। আজ দেখলাম খবর পেয়ে নরেশ ঠাকুর এসেছে। সাধারণতঃ সে খুবই ভীতু প্রকৃতির লোক। তবে কোন এককালে মামলা মকদ্দমা চালিয়েছিল। যে কারণে কোর্টকাছারি উকিল মুহুরি এসব ভীতি তার কম। জানালায় দাঁড়িয়ে সে আমার খবরাখবর নিল, চা পাউরুটি বিড়ি এসব পাঠাল। তারপর পাঠাল বুড়ো প্রায় আধমরা এক মুহুরিকে–বলল বেল অর্ডারটা তো করিয়ে রাখি। কত কী বেলবণ্ড দিতে হবে দেখি। যদি সাধ্যে কুলায় ছাড়িয়ে নেব। না কুলালে পড়ে থাকবি। আমি আর কী করব। যা তোর ভাগ্যে আছে তা হবে।

আমি পুলিশের হাতে ধরা পরার পর, যাদের সাথে আমাকে বা আমার সাথে যাদের জুড়ে দেওয়া হয়েছিল সেই ছয়জন আর্থিক দিক থেকে সক্ষম, তারা সব জামিন নিয়ে বাইরে চলে গেছে। সে-ও প্রায় বছর খানেক হয়ে গেল। হিসেব করলে আমার জেলবাস দু বছর হয়ে গেল। এর মধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে কোন চার্জশিটও দেওয়া হয়নি। যারা একদিন বলেছিল আমার দশ বছর জেল হতে পারে। তারাই এখন বলছে এই কেসে কোন দম নেই। সেটা আমারও বিশ্বাস হল যখন মেজিস্ট্রেট আমার বেল মঞ্জুর করলেন–এক হাজার টাকায়। বুড়ো রতন মুহুরি আমার হয়ে কোর্টে এক হাজার টাকার বন্ড জমা করবে এর জন্য আমাদের তাকে দিতে হবে দশ শতাংশ অর্থাৎ একশো টাকা। কী অভাগা আমি। এতগুলো দিন তো জেলে গেছে আবার মাত্র একশো টাকার জন্য আরও চৌদ্দদিন জেলে থাকতে হল।তখন নরেশ ঠাকুরের কাছে একশো টাকা ছিল না। জেলখানায় আমার চেয়েও আর এক হতভাগাকে দেখেছিলাম–যে পঁচিশ কিলো নুন চুরি করে এগারো মাস জেলে পঁচেছিল। একশো টাকার জামিন দিয়েছিল মেজিস্ট্রেট স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে। মালমুদ্দা কেস, তার খালাস দেবার ক্ষমতা ছিল না। তবু বন্দী লোকটা দশটাকা দিয়ে মুক্তি কিনতে পারেনি। পড়েছিল কে খালাস না হওয়া পর্যন্ত।

সে যাইহোক, এরপর একদিন জামিনে মুক্ত হলাম আমি। ততদিনে দুই বছরের চেয়ে সামান্য কিছুদিন বেশি হয়ে গিয়েছিল আমার জেলবাস। তবে তার জন্য তখন আর আমার কোন আক্ষেপ ছিল না। আমার একটা দিনের একটা মিনিটও অপচয় হয়নি। প্রতিটি দিন আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করবার কাজে ব্যায় হয়েছে। যিনি আমার এতবড় উপকার করেছেন, আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর পরে ২০০৬ সালে, সেই পুলিশ অফিসারকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে শুনব, তিনি রিটায়ার্ড হয়ে গেছেন।

এই পর্ব আমি এখানে শেষ করার আগে আর একটা কথা বলে নিতে চাই ওই কেসে পরে আমি বেকসুর প্রমাণিত হয়ে খালাস হই। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে কেউ যদি কোন অপরাধ করে আর পুলিশ যদি তাকে ধরে নিশ্চয় সাজা হবে। কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয়। কাউকে শাস্তি দিতে হলে প্রচুর তথ্য প্রমাণ সাক্ষী সাবুদের প্রয়োজন হয়। যেগুলো সংগ্রহের ক্ষেত্রে পুলিশের অনেক ত্রুটি থেকে যায়। যে ফাঁক দিয়ে অপরাধ করেও তোক ছাড়া পেয়ে যায়।

.

আবার আমি ফিরে এসেছি আমার একান্ত আপন বড়প্রিয় ভীষণ ভালোবাসার ভূমি যাদবপুরে। এই শহরটা আমাকে কোনদিন ভালোবাসেনি। অনেক অপমান অত্যাচার দিয়েছে। অনেক রক্তপাত ঘটিয়েছে। তবু একে আমি ভালোবাসি। এই শহরের পথঘাটইট পাথর আমার বড় চেনা। এখানকার গাছপালা রোদ হাওয়া শীত বৃষ্টি সব আমার আপন। আমি জানি, এখনও এই শহরে আমার কিছু শত্রু আছে। তবু এই শহর ছেড়ে কোথাও যেতে মনে সায় পাই না। স্থির করে নিই এখানেই থাকব। এতদিন পরে গণেশ গোপালরা আমাকে কাছে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা, দাদা তুই আমাদের সাথে থাক। আর কোথাও যাস না।

অনেকদিন পরে আজ দলবেধে গরফার ঝিলে গিয়ে চান করলাম। শরীর মন সব হালকা হয়ে গেল। তারপর সবাই মিলে একসাথে ছেচনের হোটেলে গিয়ে খেলাম। আজ যেন এক উৎসব। বড়ভাই বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে, সেই খুশিতে সব মাতোয়ারা। খাওয়া দাওয়ার পরে বলে গণেশ, কার্তিক মরে গেছে।

যতদূর মনে পড়ে, সে সময় সাতাত্তরের নির্বাচন হয়ে গিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতা দখল করেছিল বামফ্রন্ট। তাতা দত্ত, নানু দাস, শিবু রায়চৌধুরী সব পাড়াছাড়া মানুষগুলো ফিরে এসেছিল যে যার পাড়ায়। জেলবন্দী রাজনৈতিক কর্মীদেরও মুক্তি দেবার তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

আমি তখন আর কিছুই চাই না। শুধু পড়তেই চাই। মহাবিশ্বের কত কিছু অজানা, তাকে জানতে চাই। হাজার হাজার প্রজ্ঞাবান মানুষের হাজার বছরের অধ্যবসায়ে অর্জিত গুপ্তধন রক্ষিত আছে দু মলাটের মধ্যে। আমি এক পথিক। আমি তা থেকে পথ চলার রসদ আহরণ করে নিতে চাই। সারস্বত অঙ্গনে গলবস্ত্র হয়ে নিতে চাই সেই মহাপাঠ যার সামনে কুড়ি লক্ষ কাঞ্চনমুদ্রা খোলামকুচি হয়ে যায়।

।আমি এখন একবদ্ধ উন্মাদ। জেলখানা থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা নেশা আমাকে অনবরত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। বই কোথায় পাবো, বই। স্টেশনে এক হকার বসে। তার কাছে পাওয়া যায় আনন্দবাজার, যুগান্তর, বসুমতি তিনখানা দৈনিক পত্রিকা আর দেশ সহ কিছু ম্যাগাজিন। সকালে সেগুলো খাই। একজন আছে বই বিক্রেতা তার কাছে পাওয়া যায় ঠাকুরমার ঝুলি, শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম, সরল এ্যালোপাথি চিকিৎসা, বনৌষধি, লতাপাতার গুণ, স্বপন কুমারের গোয়েন্দা গল্প, কোক শাস্ত্র, রতিবিজ্ঞান, পঞ্জিকা, হস্তরেখা দেখে ভাগ্য জানুন ইত্যাদি। দুপুরে এগুলো হয় আহার। ছেচন সাউয়ের বড় ছেলের “পুরানা শিশি বোতল খবর কাগজ” এর দোকান। এখানে মেলে শুকতারা, উল্টোরথ, প্রসাদ সহ বিভিন্ন পূজা বার্ষিকী। এই পুরানো বাতিল বইপত্রের মধ্যে একবার পেয়ে গিয়েছিলাম একখানা প্রবাসী পত্রিকা। পেয়েছিলাম পোকাকাটা হলুদ পাতা একখানা সঞ্চয়িতা। এতসব গোগ্রাসে গিলেও আমার খিদে মিটল না। উত্তরোত্তর বেড়েই চলল।

টিবি হাসপাতালের সেই তাতা দত্ত, একদিন হামলে পড়লাম তার ঘরে। ওখানে পেলাম ম্যাকসিম গোর্কির মা, জন রীডের দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন সহ প্রচুর মার্কসবাদী সাহিত্য। ভারত সুইটস হোমের দোতলায় ভাড়া থাকতেন অমরনাদ দে নামে এক পত্রিকা-প্রতিবেদক। ওনার সংগ্রহে ছিল বিদেশী সাহিত্যের বাংলা অনুবাদের এক বিশাল ভাণ্ডার। তবে বই তিনি নিয়ে আসতে দিতেন না। ওনার রুমে বসে যতক্ষণ ইচ্ছা পড়ে আসায় বাধা ছিল না কোন। এখানে এসে বই পড়ায় আমার লাভই হোত। সকালে টিফিন দুপুরে ভাত পাওয়া যেত। আমি সামনে বসে থাকলে অমরদা কী করে আমাকে না দিয়ে খেতে পারেন?

শ্যামা কলোনীতে ছিলেন সুবোধ চক্রবর্তী নামে এক মাষ্টার মশাই। রবীন্দ্র রচনা সমগ্র, বিভূতি মানিক তারাশংকর এই তিন বাড়ুজ্জে শরৎ আর সতীনাথ ভাদুড়ির বহু বই ছিল ওনার আলমারিতে। উনি বই নিয়ে আসতে দিতেন। পড়ে ফেরত দিয়ে আসতাম। এ ছাড়া কিছুদিন পরে কালীবাড়ি লেনের বিদ্যাসাগর পাঠাগারেরও আমি মেম্বার হয়েছিলাম। মহাশ্বেতা দেবী, সুনীল, সমরেশ, শ্যামল, শীর্ষেন্দু, শংকর সহ বর্তমান সময়ে বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য লেখকদের বিভিন্ন রচনা এখান থেকে নিয়ে পড়েছিলাম।

বই মনের খিদে মেটায়, কিন্তু জঠরের আগুন কে নেভাবে? তখন বাধ্য হয়ে আবার সেই পুরনো পেশায় ফিরে যেতে হয়। আবার রিকশা চালাতে শুরু করি। আগে আমার রিকশার গদির নিচে একখানা ভোজালি রাখা থাকত। কখন কোন দরকারে লাগে। এখন সেই জায়গাটি অধিগ্রহণ করে নেয় বই। নশ নিরানব্বই জন মানুষের প্রাণ হরণকারী অঙ্গুলিমাল বুদ্ধের সংস্পর্শে এসে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন এক অহিংসার পুজারিতে। চণ্ডাশোক হয়েছিলেন ধর্মাশোক। পুস্তকের পূত পবিত্র স্পর্শে হয়ে যাই আমি এক অন্যমানুষ। এক গ্রন্থকীট চন্দ্ররেণু। জ্ঞানবান প্রজ্ঞাবান বিদ্বজনের শ্রমের ফসল আত্মসাৎ করে ভরে তুলতে থাকি আমার শূন্যঝুলি। আমার চারপাশে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা সংঘটিত হয়, যা আমার মনের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া শয়তানটাকে জাগিয়ে দিতে চায়। আমি আমার মনকে ধমক দেই আর বলি দূর হটো রত্নাকর, কাছে এসো বাল্মীকি।

আমি এখন ভীষণ রকম স্বার্থপর হয়ে উঠেছি। বিশ্বজগতের বিঘটন আমাকে বিচলিত করে ব্যথিত করে, সক্রিয় করে না। বন্ধু নারান বাস চাপা পড়ে মারা যায়। মোমিনপুর গিয়ে লাশ ময়নাতদন্তের পর আমাদের হাতে দিতে দুঘন্টা দেরি দেখে সেই লাশঘরের পাশে বসে পড়ি মরণের পারে’বইয়ের পাতা খুলে। বন্ধুর মৃত্যুশোক ভুলতে বই আমার বন্ধু হয়। যাদবপুর স্টেশনে সম্প্রতি একটা বইয়ের স্টল হয়েছে। যেখানে একখানা পোস্টার টাঙানো আছে, যদি একদিনের সুখ চাও ভোজন করো, যদি একমাস সুখ চাও ভ্রমণ করো, যদি এক বছরের সুখ চাও বিবাহ করো, যদি সারা জীবন সুখে থাকতে চাও বই পড়ো। ঠিক এখন মনে করতে পারছি না, কে যেন বলেছেন–মেহনতি মানুষ বই ধরো, ওটা হাতিয়ার। আমি সুখের সন্ধানে হাতিয়ার করি বইকে। বই আমার কাছে হয়ে ওঠে সেই বন্ধু যে কখনও বেইমানি করেনা। ৭৭ থেকে ৮১–চারটে বছর কেটে যায় কথাসাহিত্য লোক-সাহিত্য অনুবাদ সাহিত্য ভ্রমণ কাহিনী ধর্মগ্রন্থ প্রবৃন্ধ নিবন্ধ গল্পগ্রন্থ এই সব নিয়ে। সময়ের কোন খেয়াল থাকে না। কেউ আমার পাঠমগ্নতার প্রশংসা করে, কেউ উপহাস। সব “বাইপাস” করে দিই। কোনটাই মনে দাগ কেটে বসে না।

.

কী বিচ্ছিরি আর বিড়ম্বনাময় জীবন। যখন আমি আমার জীবনস্মৃতির পাতা উল্টে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করি কোথাও কোন শুভ বা মঙ্গলের সরল প্রাপ্তি আছে কী না তখন বড়ো বিস্ময়ে দেখি তা যদি এসে থাকে, তবে এসেছে কোন না কোন অশুভ অন্যায়ের পথ ধরে। সেই যে একটা গান আছে–আমি যদি হাসি আমার সাথে হাসে–চোখের জল, আমি কাদলে কাঁদে আমার চোখের জল। অর্থাৎ হাসি কান্না সুখ বা দুঃখ সবটাই আবর্তিত হয় অশ্রুকে অবলম্বন করে। আমার জীবনেও তেমনি ভালো বা মন্দ যাই ঘটে থাকুক, ঘটেছে এক অস্বাভাবিক অপরাধীক উপায়ে।

এক সময় আমি সম্পূর্ণ “অন্ধ” অজ্ঞ নিরক্ষর ছিলাম। অন্ধ থেকে চক্ষুন্মান নিরক্ষর থেকে সাক্ষর–জীবনের এতবড় পরিবর্তন সে কি জেলে না গেলে হতো? জেলযাত্রার চেয়ে জীবনে বড়ো অশুভ আর কী কিছু হয়?

এই রকম আর একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে গিয়েছিল একদিন। যা আমার জীবনে এক বিরাট আশীর্বাদ হয়ে ফিরে এসেছিল। যাকে জীবনের এক মহান সূর্যোদয় বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না।

সেটা ছিল এক গ্রীষ্মকালের উত্তপ্ত দুপুর। সেদিন রোদ যেন গলানো সোনার মত ঝরে ঝরে পড়ছিল মাথার উপর স্থিতরাগী সূর্যের শরীর থেকে। সেইদিন আমি একটু চোলাই মদ খেয়েছিলাম। জেলে যাবার আগে তো ব্যাপক খেতাম। এখন “পেলে খাই-পার্বণে খাই”। একেবারে মাদক মুক্ত মহাপুরুষ হয়ে যেতে পারিনি। তা বোধহয় হতেও চাইনি। একটু বইটই পড়তে শিখেছি, আগে যা জানতাম না এখন তা জানি, কিন্তু আমি তো এক জেল খাটা আসামিই। এক রিকশাঅলাও। জগতে কিছু লোক যেমন দুধ ঘি, মাখন খাবার জন্যে জন্মেছে, কিছু লোক তেমনই অখাদ্য কুখাদ্য খাবে। সাক্ষর হয়ে আমার লেজ শিং কিছুই গজায়নি। আছি সেই আগের মতোই অপদার্থের দলে। তাই অখাদ্য খাওয়া অকথা বলা অকাজ করা।

.

সেদিন টিবি হাসপাতালে গুরুপদর ঠেকে বসে এক পাঁইট চোলাই টেনে হাসপাতালের পুকুরে চান টান করে এসে খেতে বসেছি হরির হোটেলে। হরি আগে রিকশা চালাতো। একটা কঠিন রোগ হয়ে যাবার পর আর পারে না। ওকে আমরাই রিকশা লাইনের পেছনে একটা গুমটি বসাবার মতো জায়গা করে দিয়েছি। হাত সাতেক লম্বা হাত তিনের চওড়া এই গুমটিতে বসে হরি ভাত ডাল তরকারি বানায়, বেঁচে। পঁচা-ভাঙা, পুরানো টিন ছাওয়া গুমটির সামনে একটা সরু বেঞ্চ রাখা, এতে চেপে চুপে তিনজন বসা যায়। বেশির ভাগ রিকশাওলাই এখানে খায়। অন্য হোটেলের চেয়ে হরির খাবার পরিমাণে বেশি আর দামেও কম। রান্নাটাও বেশ ভালো। যেমন ভালো গ্রামবাংলার গরিব গুর্বো মানুষেরা পছন্দ করে। একটু ঝাল ঝাল ঝোল ঝোল।

সেদিন হরির হোটেলে খেতে বসেছে এক নব যুবক স্বামী আর তার যুবতী স্ত্রী। এরা লক্ষ্মীকান্তপুরের দিকের লোক। স্বামী ছেলেটির শহর কলকাতায় আসা যাওয়া আছে। হতে পারে জন মজুর খাটে বা রিকশা টিকশা চালায়। ফলে শহরের বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞ। আর গ্রামদেশের লোকের সাধারণত যে শহরভীতি থাকে তা তার নেই। সে তার স্ত্রীকে নিয়ে বাঙুর হাসপাতালে গিয়েছিল ওয়ান-এ বাস ধরে। স্ত্রীর পেটে বাচ্চা। তাকে রুটিন চেকআপ করিয়ে ফিরে এসেছে যাদবপুর স্টেশনে। এবার এখান থেকে ট্রেন ধরে নিজের গ্রামে ফিরে যাবে। বেলা অনেক হয়ে গেছে তাই সস্তার হোটেলে দুটো ডাল ভাত খেতে বসেছে।

কে যেন বলেছেন—”মদ খেলে আমার নেশা হয় না, একথা যে বলে হয় সে মিথ্যা কথা বলে নতুবা মদের বদলে জল খায়।” আমি জল খাইনি তাই নেশা হয়েছে আমার। নেশা হলে আমার চোখ লাল হয়ে যায়, জিভ জড়িয়ে আসে, পা টলে। টলোমলো পায়ে গিয়ে ঝুপ করে বসে পড়ি হরির বেঞ্চিতে—’মাছ ভাত দে হরিদা’! আমার ডানদিকে সেই যুবতী, তার ডান পাশে সেই স্বামী, তারা তখন খাচ্ছে। বাটা মশলা দিয়ে রাঁধা চারাপোনার ঝোল আর ধোয়া ওঠা গরম ভাত, ক্ষিদের সময় তার কী অপূর্ব স্বাদ। প্রথম গ্রাস মুখে দিতেই মনপ্রাণ শীতল। কিন্তু দ্বিতীয় গ্রাস আর মুখে গেল না, ছিটকে ছড়িয়ে গেল মুখ মণ্ডলে-চোখে। কিছুনা বলে আচমকাই স্বামী আমার ডান হাতের কনুইয়ে একটা চড় মেরে দিয়েছে, এসব তারই ফলাফল।

আগেই বলেছি বেঞ্চিষ্টা ছোট, কোনক্রমে তিনজন বসা যায়। আমরা বসেছি তিনজনই, তবে পুরুষ হলে অসুবিধা হতো না। অসুবিধা হয়ে গেছে একজন মেয়ে হওয়ায়। প্রকৃতি মেয়েদের যে স্তন দিয়েছে। আর এই মেয়ে–যার স্তন দুটি সত্যিই অসাধারণ। যেন অহঙ্কারী উদ্ধত্বে বিশ্বদৃষ্টিকে বিধবে বলে ধনুকে জোড়া বাণের মতো তাক করে আছে। মেয়েটির যে স্বামী–সে পুরুষ হবার সুবাদে জানে–নারীর ওই অঙ্গটির কী আকর্ষণ। ট্রেনে বাসে পথে লোভি পুরুষ ও দুটোকে স্পর্শ-মর্দন-পিষ্টন করার জন্য কতরকমের না সুযোগ খোঁজে। তাই সে তার স্ত্রীর ওই অমূল্য সম্পদ দুটিকে আগলে আগলে রাখে। সব সময় সতর্ক দৃষ্টি থাকে যেন কেউ ছুঁয়ে না দেয়–পিষে না দেয়।

আমি নেশার খেয়ালে ছিলাম, বুঝতে পারিনি ভাত মেখে মুখে ভোলার সময় আমার ডান হাতের কনুই মেয়েটি বা স্তনকে ছুঁয়ে ফেলেছে। এমনিতে তো মদ্যপ লোক সাধারণের চোখে এক দুবৃত্ত। আমি মেয়েটির পাশে বসা মাত্রই স্বামী বুঝে গিয়েছিল নিশ্চয় বদ মতলব আছে। এখন হাত বুকে ঠেকা মাত্র তার সন্দেহ সত্যি হয়ে গেল। আর তখনই তার রাগে শরীর জ্বলে উঠল-পেয়েছে কী ব্যাটা মদখোর। আমি বসে আছি, আর আমার সামনে আমার বউকে…। দেখাচ্ছি এর মজা। দ্বিতীয়বার যখন কনুই বুকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এক চড়ে থামিয়ে দিল সে। ফাজলামো হচ্ছে। ভাত খাওয়া কারে বলে দেখিয়ে দেবো।

এটা যাদবপুর স্টেশন। এখানে সবাই আমাকে চেনে। আমার হাতে বা হাতে নয়–মাথায় যেন লাথি পড়ে গেছে। হরি দেখেছে, সবাই দেখেছে, ওই একটা ছোট্ট চড়ে স্বামী যেন আমাকে দশহাত মাটির মধ্যে সেধিয়ে দিয়েছে। কাল সবাই বলবে–মদন একটা বউয়ের বুক টিপে মার খেয়েছে। এই লজ্জা আমি কোথায় রাখব। কী দিয়ে ঢাকব? স্বামী ছেলেটা বোকা। ওর সাথে গর্ভবতী স্ত্রী রয়েছে। এই সময় একটু মাথা ঠাণ্ডা রাখা উচিৎ ছিল। কিন্তু আমি এখন কী করি? আমার যে পিছিয়ে আসার উপায় নেই। অন্য কোথাও হলে সরে পড়া যেত। এটা যে আমার নিজের ঘাটি। এখানে আমার অনেক সম্মান। তাই আর এক মুহূর্ত দেরি করিনি, ঘুরিয়ে এক ঘুষি মেরে দিয়েছি স্বামীর মুখে। ঠোঁট ফেটে গরম রক্ত গড়িয়ে পড়ল সামনের ভাতের থালার উপর। কিন্তু সেও হার মানবার ছেলে নয়, উঠে ছুটে গিয়ে তুলে নিল একটা আধলা ইট আর সেটা ছুঁড়ে দিল আমার শরীর লক্ষ্য করে। ইট আমার গায়ে লাগেনি, পাশে পড়েছে। এবার সেই ইটের টুকরো

আমি কুড়িয়ে নিলাম–তুই আমাকে ইট দিয়ে মেরেছিস। এবার আমিও তোকে ইট দিয়েই মারব। ছুঁড়ে দিলাম সেটা স্বামী ছেলেটার দিকে। কিন্তু লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে আধলাটা গিয়ে লাগল বউটার গায়ে। সে বাবা গো বলে ঘুরে পড়ে গেল পথের উপর। বউটার পেটে বাচ্চা। এই অবস্থায় জনতা আমার বিরুদ্ধে চলে যাবার কথা। গেলও তাই। স্থানীয় তো নয়, যারা ট্রেনে আসা যাওয়া করে সেই পাবলিক খেপে গেল আমার উপর। বুঝলাম যে এখন অবস্থা খারাপ। আর এখানে থাকা ঠিক নয়। পাবলিক বড়ো ভয়ানক জীব। তারা যা ইচ্ছা তা করে ফেলতে পারে। তাই পালালাম। লাফিয়ে পার হয়ে গেলাম টিবি হাসপাতালের পাঁচিল। ওপারে পড়ে দে দৌড়। আর আমার নাগাল কে পায়।

এরপর পাবলিক স্বামী স্ত্রী দুজনকে নিয়ে স্টেশনস্থ জিআরপিতে আমার নামে একটা অভিযোগ দায়ের করল। আর স্থানীয় কিছু ছেলে হামলা করে দিল স্টেশন ঘিরে ব্যবসা চালান চোলাই ঠেক গুলোর উপর। যত নষ্টের গোড়া তো এই মদই। আজ আমি যা করেছি মদ খেয়ে, কাল তা আর কেউ করে বসবে। তাই চোলাই ঠেক গুঁড়িয়ে দাও। এই তাদের যুক্তি।

সে তো যা হবার তা হলো এবার আমার কী হবে? স্টেশনে যে আর আসা যাবে না। এলেই জি.আর.পি ধরবে। এখন রিকশা কোথায় চালাবো? রিকশা না চালালে পেট চলবে কী করে? তাই চলে এলাম এইট বি বাসস্ট্যান্ডে। এখানেরিকশার কোন ইউনিয়ান এখন নেই। তেমনশৃঙ্খলাবদ্ধভাবে কেউ ভাড়া তোলে না। যে কেউ এখানে খাটতে পারে। এলাকা গরম, এক দুমাস আমাকে এখানে থাকতে হবে। স্টেশন এলাকা একটু ঠাণ্ডা হয়ে গেলে, যে পুলিশগুলো এখন জি.আর.পি ক্যাম্পে থাকে ওরা বদলি হয়ে গেলে আবার স্টেশনে ফিরে যাব। এটা তো নতুন নয়, এই রকম আগে যে কতবার স্টেশন ছেড়ে পালাতে হয়েছে তার কোন গোনাগাথা নেই। সময় এখন বড় বেগবান, ঘটনাবহুল ও সংঘাতময়। মানুষ এক সপ্তাহ আগে কী ঘটেছিল এক সপ্তাহ পরে আর মনে রাখতে পারে না। অথবা আগের ঘটনাকে চাপা দিয়ে দেয় সদ্য সদ্য ঘটে যাওয়া আরো বড় কোন ঘটনা। মানুষ সেটা নিয়ে মেতে ওঠে।

এইট বি স্ট্যান্ডে এসে আমিও ভুলে যাই এক দুপুরে মদ খেয়ে কী করেছিলাম আর না করেছিলাম। সময়ের বেগবান স্রোতে ভেসে যায় আমার সব গতকাল। থাকে শুধু বর্তমান। আর থাকে অদেখা এক ভবিষ্যৎ।

একদিন এখান থেকে ভাড়া নিয়ে গেছি বিজয়গড়ে জাগরণী ক্লাবে। ওখানে একটা রিকশা লাইন আছে। যারা ভাড়া নিয়ে আসে আমরা একটা ফিরতি ভাড়া দিয়ে দিই। ওরাও তাই করে। আমরা গেলে একটা ভাড়া দিয়ে দেয়। এখন তাকিয়ে দেখি আমার আগে আটদশখানা রিকশা লাইন দিয়ে রয়েছে। এখন দুপুর, পথঘাট ফাঁকা তাই রিকশায় সওয়ারি কম ওঠে। যদি প্রতি দশ মিনিটেও একজন সওয়ারি হয় আমার লাইন আসতে দেড় দুঘন্টা। এত সময় ফালতু নষ্ট করা যায় না। তাই রিকশার উপর বসে চোখের সামনে মেলে ধরি একখানা বই।

আমি এই করে থাকি। রিকশা লাইনে লাগিয়ে তার উপর বসে বসে বই পড়ি। সওয়ারি নিয়ে যেখানে যাই, সওয়ারিলমিয়ে কোনলাইনেরিকশা লাগিয়ে যতক্ষশফিরতি ভাড়া না পাই-বই পড়ি। এইভাবে সওয়ারি আনা নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে যতটা পারি পড়ে নিই। আমার হাতে সময় যে বড় কম। এর মধ্যে অপচয় করার মত সময় এক সেকেণ্ডও নেই। ভাবি জীবনটা কেন হাজার বছর হল না। কেন এক একটা দিন হল না আটচল্লিশ ঘন্টার! এত ছোট দিন আর এতক্ষুদ্র জীবনে কি করে আমি এমন বইয়ের বিশাল পাহাড় পড়ে শেষ করতে পারব। বোদ্ধা পাঠকেরা বলেন, শুধু রবীন্দ্রনাথই এক জীবনে পড়ে শেষ করা যায় না। তাহলে বিদ্যাসাগর পাঠাগারের ওই হাজার হাজার বই তার কতটুকু আমি আত্মসাৎ আর আত্তীকরণ করে নিতে পারব? আমার যে সব বই পড়তে হবে। কালিদাস থেকে কোকো পণ্ডিত, রবিবাসরীয় থেকে রবি ঠাকুর, মপাশা থেকে মহাশ্বেতা দেবী, রামায়ণ থেকে রাহুল সংস্কৃতায়ন সব আমার চাই। প্রতিটি বই থেকে আমি কিছু না কিছু শিখি। নতুন কিছু জানতে পারি। বইয়ের সাহায্যে আমি এক অদ্ভুত ভালোলাগার জগতের সন্ধান জেনে গেছি। যে জগতের সন্ধানে পরিব্রাজক হাজার মাইল পথ হেঁটে পৌঁছায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। প্রাণ হাতে করে ডুবুরি নামে মহা সমুদ্রের অতলে। পর্বতারোহী ওঠে হিমালয় চূড়ায়। বইয়ের মধ্যে আমি পেয়ে যাই সেই সত্য যার সন্ধানে যোগীগণ নির্জন গুহায় কাটান বছরের পর বছর। আগে আমি অন্ধ ছিলাম। এখন ফিরে এসেছে চোখের আলো। সেই আলোয় আমি খুঁজে পেয়েছি চেনা জগতের মধ্যে এক অদেখা অচেনা ভূবন।এ এক নতুন বিস্ময়। এক অনাস্বাদিত স্বাদে অবগাহন।

সেইদিন–এটাও প্রতিদিনের মত একটা অতি সাধারণ দিন। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজেও কোথাও অন্যদিনের চেয়ে কোন পার্থক্য চোখে পড়ার মত নয়। তবে আজ ছিল শনিবার এবং এ বছরের সর্বাপেক্ষা উত্তাপময় একটা দিন। রোদের তাপে পথের পিচগুলো এই সময়ে ফুটছিল বুডবুড করে। একটুও হাওয়া ছিল না। তাই একটা গাছের পাতাও নড়ছিল না। দাবদাহে চারদিক যেন জ্বলে যাচ্ছিল। আকাশ আর মাটির মাঝামাঝি যেন এক অদৃশ্য সুতোয় ঝুলেছিল মধ্যাহ্ন সূর্য। তার বর্শামুখ তীব্র রশ্মিচ্ছটা আছড়ে পড়ে বিঁধছিল আমাদের। এই নিদাঘ দুপুরে আমি রিকশা নিয়ে বসেছিলাম জ্যোতিষ রায় কলেজের পাশে, জাগরণী ক্লাবের সামনে। আর ডুবে গিয়েছিলাম অক্ষরের যক্ষপুরীতে বর্ণময় খেলায়। মসিবর্ণ খুদে খুদে এই অক্ষরগুলোর এক সম্মোহনী শক্তি আছে। যারা কথা বলে, হাঁসায় কাঁদায়, ভাবায় স্বপ্ন দেখায়, সাহসী করে খিদে ভোলায় এবং কোথা থেকে কি ভাবে যেন টের পাবার আগে সময় পার করে দেয়।

এখন যে বইখানা খুলে বসেছি বইখানার নাম অগ্নিগর্ভ। এটা একটা গল্প সংকলন। এর প্রতিটি গল্পের সব চরিত্রই মনে হয় আমার খুব চেনা। আপনজন। সব গল্পেরই কেন্দ্রীয় চরিত্র নিম্নবর্গের একজন শ্রমজীবী মানুষ। সে যেন ওই সমাজের এক প্রতিবাদী প্রতিনিধি। যে হেরে যেতে জানে না। লড়াই করে, মরে, আবার লড়াই করে।

এই বইয়ের লেখিকার প্রতি আমার একটা বিশেষ দুর্বলতা আছে। এক কালে ঘটনাচক্রে নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলাম। জেলখানাতেও এদের সাথে অনেকটা সময় কাটিয়েছি। তাদের মুখে বারবার এনার নাম শুনেছি। নকশাল আন্দোলনের এক শহীদ “ব্রতাঁকে নিয়ে ওনার উপন্যাস হাজার চুরাশির মা। যা লিখে উনি নকশালদের মাতৃসমা হয়ে গেছেন। আমি হাজার চুরাশির মা ছাড়াও ওনার অরণ্যের অধিকার পড়েছি। আর এখন পড়ছি অগ্নিগর্ভ। এরপর পড়ব নৈঋতে মেঘ!

বইয়ের মধ্যে এমন ডুবে গিয়েছিলাম যে কখন আমার আগের রিকশাগুলো সব ভাড়া নিয়ে চলে গেছে টের পাইনি। এবার আমরা যাবার পালা। বইখানার আর মাত্র ছয়-সাত পাতা বাকি ছিল। দেখতে পাচ্ছি জ্যোতিষ রায় কলেজের দিক থেকে একজন প্রৌঢ়া মহিলা আসছেন। উনি একা নন সাথে একটি বছর পঁচিশের ছেলেও আছে।এনাকে রিকশাওয়ালা সবাই চেনে। উনি ওই কলেজে পড়ান।এখান থেকে রিকশায় ওঠেন এইট বি বাসস্ট্যান্ডের মোড়ে গিয়ে নামেন। এখনও উঠবেন রিকশায়।

আমার একটু সামান্য ক পাতা পড়া বাকি আছে। পরবর্তী যাত্রী আসার আগে শেষ হয়ে যাবে। তাই আমার পিছনের রিকশাওলাকে বলি, এই প্যাসেঞ্জারটা তুই নিয়ে যা। আমি তোর পরে যাব। বইটার আর পাতা কয়েক বাকি।

ঝাঁঝিয়ে ওঠে সে–বেশি কায়দা করিসনা। তোর চালাকি সব বুঝি। ডবল প্যাসেঞ্জার দেখে নাটক কচ্ছিস। তোর ভাগ্যে যা এসেছে তাই নিয়ে তুই সরে পড়। আমার ভাগ্যে যা আসবে আমি তাই নেব। আমিও তোর মত মানুষ। গরমে তোর যেমন কষ্ট হয় আমারও হয়। বই রাখ আর প্যাসেঞ্জার নিয়ে লাইন খালি কর।

“আমার ভাগ্যে যা এসেছে”। আমার ভাগ্য। সত্যিই আমার ভাগ্য। না হলে উনি আজ আমার রিকশায় উঠবেন কেন?

আমি নাস্তিক এবং তা অতি সচেতন ভাবে। অথবা স্বামী বিবেকানন্দের মত সচেতন আস্তিক যিনি বলেছেন—”যে ভগবান ক্ষুধার্তকে অন্ন দিতে পারে না বিধবার চোখের জল মোছাতে পারে না, মানুষের দুঃখ দূর করতে পারে না আমি সেই ভগবানকে বিশ্বাস করি না।” ভগবানে বিশ্বাস না থাকলে তার ভাগ্যতেও বিশ্বাস থাকার কথা নয়। তবে আমার জীবনে বারবার এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে-সেই “সংযোগ”গুলোকে অন্যকোন শব্দ দিয়ে বোঝাতে না পারা গেলে ভাগ্য শব্দের সাহায্য না নিয়ে উপায় থাকে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বইখানা রিকশার গদির নিচে চালান করে দিয়ে প্রস্তুত হই আমি।

বেলা সামান্য হেলে গেলেও রোদের তেজ এখনও সমান আছে।শরীর বেয়ে নামছে কুলকুল ঘাম। পথের জনসংখ্যা এখন একটু বেড়েছে। শনিবার হবার কারণে এ সময়ে স্কুল কলেজ ছুটি হয়ে গেছে। যে জন্য ছাত্রছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকারা সব পথে। চলেছে বাড়ির দিকে।

যে প্রৌঢ়া মহিলা এখন এসে দাঁড়ালেন আমার রিকশার সামনে, আমি আগে কখনও দেখিনি। মাথায় কাঁচা পাকা চুল, চোখে চশমা, কাঁধে সাইড ব্যাগ। গভীর গম্ভীর মুখ। দেখেই মনে হয়–উনি শিক্ষিকা। এবং তিনি তাই। জ্যোতিষ রায় কলেজে পড়ান।

উনি যাদবপুরে যাবেন। ওনাকে রিকশায় বসিয়ে চালাতে শুরু করি রিকশা। মাত্র অল্প কিছু পথই পার হয়েছিলাম। তখনই মনে পড়ে যায়, কদিন আগে চাণক্য সেনের একখানা বই পড়েছিলাম। যার মধ্যে একটা শব্দ ছিল–জিজীবিষা। যার মানে আমি জানি না। এখন আমার নাগালে এক বিদ্বান মানুষ পেয়ে মাথায় কিলবিল করে ওঠে আপৃচ্ছা পোঁকারা। এনাকে জিজ্ঞাসা করলে কেমন হয়? আর তখন আগপাছ সাতসতেরো না ভেবে বলে বসি—দিদি কিছু মনে করবেন না, আপনাকে একটা কথা জিগ্যেস করব? জিজীবিষা মানে কি?

উনি সেদিন এক রিকশা চালকের মুখে এমন একটা কঠিন শব্দের অর্থ জানার আকুতি দেখে অবাক হয়েছিলেন নিশ্চয়। বলেছিলেন–জিজীবিষার মানে হচ্ছে বেঁচে থাকা বা বাঁচিবার ইচ্ছা। তারপর পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন এই শব্দ তুমি পেলে কোথা থেকে?

বলি আমি–একটা বই থেকে।

নিস্তব্ধ উত্তপ্ত এক দুপুর। মাথার উপর আগুনের গোলক, ঘাম ঝরছে শরীর থেকে। ভিজে জবজবে হয়ে যাচ্ছি। আমার দৃষ্টি সামনের দিকে। বুঝতে পারছি না তখন উনি রিকশার সিটে বসে কি ভাবছিলেন আমাকে দেখে। কিছু সময় পরে আবার প্রশ্ন করেন উনি–তোমার পড়াশোনা কতদূর। মাঝ পথে তখন ওনার সাথের ছেলেটা নেমে চলে গেছে।

বলি–আমি কোন ইস্কুলে যেতে পারিনি।

–তবে বই পড়ো কি করে?

–নিজের চেষ্টায় সামান্য একটু শিখেছি।

চাকা ঘুরছে। রিকশা এগিয়ে চলেছে। পথ ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু কীসের চাকা ঘুরছে? রিকশার না ভাগ্যের? কে এগিয়ে চলেছে?রিকশা, না আমি?কীসের পথ ফুরাচ্ছে। এক সাওয়ারিকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার? নাকি অপমানিত অপরিচিত অন্ধকার জগতের এক জীবের সম্মানীয় আলোক মঞ্চে দিকে অভিগমনের?

এক সময় বলেন তিনি–আমি একটি পত্রিকা বের করি। তাতে তোমার মতই যারা অল্প লেখাপড়া জানা মানুষ তারা তাদের নিজেদের কথা লেখে। তুমি তোমার কথা লিখবে? লিখলে আমি সেটা ছাপাবো।

আমার ধারণায় যাদের নাম ছাপার অক্ষরে থাকে, যাদের গলা রেডিওতে শোনা যায়, যাদের মুখ টিভি কিংবা সিনেমার পর্দায় ভেসে ওঠে তারা সব এক উচ্চমার্গের মানব। যারা খায় দায় বাজার করে, অফিসে যায় রাস্তায় হাঁটে–তাদের মতো সাধারণ মানুষ কখনই নয়। এবং রিকশা চালাবার মতো ছোটকাজ তো কখনই করতে পারে না। ইনি এক রিকশাঅলাকে সেই অবিশ্বাস্য উচ্চতায় নিয়ে যাবার লোভ দেখাচ্ছেন। যা বিশ্বাস করতে বড় ভয় হয়। একী হয়! হওয়া সম্ভব?

আশ্চর্য হয়ে বলি–আপনি আমার লেখা ছাপাবেন?

–হ্যাঁ। সেটাই তো বললাম। পারবে লিখতে?

–কিন্তু কি বিষয়ে লিখব।

তোমার এই রিকশাচালান সংক্রান্ত জীবন। কিভাবে রিকশা চালাতে এলে। দিনে কত রোজগার হয়। সংসার কি ভাবে চলে। পারবে?

ভয়ে ভয়ে বলি–কোনদিন তো লিখিনি। দেখি চেষ্টা করে। যদি লিখতে পারি গিয়ে আপনাকে দিয়ে আসব। আপনার ঠিকানাটা একটু দিয়ে যান। যাদবপুরের মোড়ে এসে গেছি। রিকশা থামাতে উনি নিচে নেমে ব্যাগ খুলে পেন আর কাগজ বের করে তাতে ওনার নাম আর ঠিকানা লিখে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন–এই নাও। চিরকুটে চোখ বুলিয়ে সারা পৃথিবী দুলে গেল আমার। এই পথ, পথের উপর দাঁড়ানো মানুষ, বাস লরি দোকানপাট আকাশ সূর্য-আরও যা কিছু সব দুলছে। দুলে যাচ্ছে আমার জীবন, আমার বর্তমান আমার ভবিষ্যৎ। আমি যেন সেই ছেঁড়া বস্তা কাঁধে এক কাগজ কুড়ানো বালক যে পেয়ে গেছে ছেঁড়া কাগজের গাদায় লুকানো কোন হীরা জহরতের ভাণ্ডার। একী অবিশ্বাস্য ব্যাপার! এমন ঘটনা তো গল্প উপন্যাস সিনেমায় দেখা যায়। বাস্তবে কি সম্ভব? আমি কি এখন জেগে আছি, না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কোন অলীক স্বপ্ন দেখছি? তখন আমার গলা চিরে বুকের ভিতর থেকে বের হয়ে আসে এক মহাবিস্ময়–আপনি!

–চেনো আমাকে?

চিনি। ভীষণ ভাবে আপনাকে আমি চিনি হে বরেণ্য কথাশিল্পী। সে চেনা শ্রমে ঘামে প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংগ্রামে। শোষিত বঞ্চিত মানুষের জন্য আপনার কলম সূর্য সমান ক্রোধে ঝলসে ওঠে। আপনার দ্রৌপদী গল্প পড়ে ওই ধর্ষকদের খুন করব বলে খুঁজে বেড়িয়েছি একদিন, সারাটা দিন। তাদের না পাই তাদের মতো কেউ একজনকে পেলেও চলবে। এসব কথা ওনাকে বলা হয় না। শুধু বলি–আপনার অনেক বই পড়েছি। আপনার ‘অগ্নিগর্ভ’ আমার রিকশার নিচে রাখা আছে। এটাই পড়ছিলাম কিছুক্ষণ আগে। কথা শেষ করে রিকশার গদি খুলে বের করি সেই বইখানা। যার গর্ভে লুকিয়ে আছে আগুন।

বইখানা হাতে নিয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে উনি তখন কি ভাবছিলেন তা আমি জানিনা। তবে ওনার সারা মুখমণ্ডল জুড়ে ফুটে ওঠা অদ্ভুত এক প্রশান্তির ছবি আমি সেদিন দেখেছিলাম। একজন জনবাদী সাহিত্যিক, যে শ্রমজীবী মানুষদের জন্য লেখেন সেই মানুষরা পরম নিষ্ঠায় তার লেখা পড়ছে, সম্ভবতঃ এটা ওনার ভালো লাগছে।

আমি তখন বিহ্বল হয়ে গেছি। যেন ডুবে গেছি এক মহাঘোরের মধ্যে। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছি না। আনন্দে-উত্তেজনায় আমার বুকটা উথাল পাথাল হচ্ছে। যেন এক্ষুণি ফেটে চারদিকে ছড়িয়ে যাবে। আলিবাবার গুপ্তগুহার দরজা যেন হাট হয়ে খুলে গেছে। মহার্ঘ সব সম্পদের সামনে দাঁড়িয়ে আমি দিশেহারা। পাগল পাগল অবস্থা আমার। মন কাঁপছে, শরীর কাঁপছে, জীবন কাঁপছে। আর আমি নিজেকে দুপায়ের উপর দাঁড় করিয়ে রাখতে পারিনা। মাথা আর উঁচু করে রাখতে পারি না। মাথা উঁচু করে রাখার সুযোগ জীবনে বারবার আসে। আসে না নত করার সুযোগ! প্রণাম করার এমন পা আর কবে পাবো। পথের ধুলোয় আভূমি লুটিয়ে পড়ি আমি। রিফিউজি ক্যাম্পের ভাঙা স্কুল ঘরে যে মায়ের পীযুষপানে এক রাখাল বালক তার দগ্ধ জীবন জুড়িয়েছিল। সেই হংসবাহিনী বিদ্যার দেবী এখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন মহাশ্বেতা দেবীর রূপ ধরে। সরস্বতীর আর এক নামই তো মহাশ্বেতা। বোকা কালিদাস সরস্বতী দেবীর বরে মহাকবি হয়েছিলেন। আমি সেই দেবীর পায়ের ধুলো পেয়েছি। একটা লেখা লিখতে পারব না?

এক সময় বলেন তিনি-কাল, কালকে তুমি একবার আমার ওখানে এসো। দুপুরে আমার সাথে খাবে। বাস এসে গিয়েছিল। উনি বাসে উঠে আমাকে হাত নাড়লেন। সে হাতে যেন বরাভয় মুদ্রা। যে হাতে চেপে ধরা কলম কামানের নলের মতো আগুন ওগড়ায়, সেই হাত এখন আশিস ছুড়ছে আমার মস্তকে। সেদিন সারাটা দিন সারাটা রাত কেটেছিল অসহনীয় অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। কোন কাজে মন বসেনি খিদে লাগেনি ঘুম আসেনি। পরের দিন সকাল সাতটা বাজার আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম বালিগঞ্জ রোডের সেই ঠিকানায় যেখানে থাকেন মানবী মহাশ্বেতা। আমার সামনে লোহার সেই পেঁচানো সিঁড়ি যা পাক খেয়ে খেয়ে উঠে গেছে ওপরের দিকে। যার একটা প্রান্ত সেই মাটিতে প্রোথিত, যেখানে ফুল ফোটে, ফসল ফলে। হ্যাঁ, সেখানে ঘাস আগাছাও আছে। সাপ জোঁক বিছেও থাকে। আর একটা প্রান্ত যা সব মাথা ছাড়িয়ে সব উচ্চতা মাড়িয়ে উঠে গেছে কোন মহাকাশে, যার পরিমাপ করার ক্ষমতা বর্তমানের নেই, সেখানে গোপন রয়েছে অনাগত ভবিষ্যত কালের ইতিবৃত্তের গোপন কন্দরে।

আমি সেই সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠি। ক্যাচকোচ করে সে আমাকে তার নিজের ভাষায় স্বাগত জানায়। সে যেন বলে–আমি সেই সিঁড়ি যেখানে পা রেখে দাঁড়াতে পারলে সব নিচুতা সব নীচতা হীনতা পায়ের কাছে পড়ে থাকে। জিজীবিষা প্রাণ জিতামিত্র জিতাহব হয়ে যায়। আমি সেই সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠি। দোতলা নয় আমি যেন উঠেছি সেই উচ্চতায় যেখানে পৌঁছাবার পর মনে হল আমার সাধনা সফল, জীবন সার্থক হয়ে গেল।

দরজার কড়া নাড়তেই বন্ধ দরজার ওপার থেকে ওনার উচ্চগলা ভেসে এল দরজা খোলা আছে ভিতরে এসে বসো মদন। আমাকে তো উনি দেখতে পাননি, তাহলে কী করে বুঝলেন আমি এসেছি? তবে কী এই সাত সকালে “উতলভীরু” কড়ার শব্দ বলে দিয়েছে ওনার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কাছে কোন সাংকেতিক ভাষায়–এই সেই কালকের দেখা হওয়া পাগলটা। সারারাত ও ঘুমাবেনা আর এই সাত সকালে আপনার ঘুম ভাঙাতে ছুটে আসবে।

এ সেই ঘর যেখানে বসে উনি লেখেন। আমার সামনে সেই টেবিল, যার উপর লেখার সাজসরঞ্জাম। ওই ঘরে একটা চেয়ারে আমি বসে থাকি। মিনিট দশ-বারো পরে উনি এসে ওনার লেখার টেবিলে বসে পড়েন। একটি মেয়ে এসে দু কাপ চা দিয়ে যায়। এককাপ আমাকে দেয়। চা খেয়ে আমার সঙ্গে নানা রকম গল্প শুরু করেন। আজ রবিবার, ওনার ছুটি। যারা আসছেন তাদেরও ছুটি। আলোচনা হতে থাকল দেশের নানা সমস্যা নিয়ে। যে আসছে তারই সঙ্গে উনি আমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এক লেখক বলে। একে দেখে নাও, আমার নতুন লেখক। বর্তিকার আগামী সংখ্যায় এর লেখা থাকবে, উনি আমাকে লেখক বলছেন। লেখক।

তারপর? তারপর শুরু হল আমার জীবনের সবচেয়ে দুরূহ সবচেয়ে কঠিন এক যাত্রা। যা বোমা পাইপগান চালাবার চেয়েও ভীষণ ভয়ংকর ভয়ানক ভয়াল এক যুদ্ধযাত্রার সমতুল জিগীষা। একটি লেখা তৈরি করার দুর্মর প্রয়াশ। সে যে কী দুরূপ প্রয়াশ! একটা লাইন বেঁকে আর একটা লাইনের উপর উঠে যায়। একটা শব্দের বানান নানা জায়গায় নানা রকম লেখা হয়। কোন শব্দ কোথায় বসালে বাক্য শুদ্ধ এবং সম্পূর্ণ অর্থবহ হয় মাথায় আসে না। পড়ে মনে হয় ধুস। তখন আবার তাকে ছিঁড়ে কুচিকুচি করে নতুন করে লিখতে বসি। কয়েক দিস্তা কাগজ কয়েক লিটার কেরোসিন, কয়েক দিনের কাজ কামাই করে অনেক ধস্তাধস্তির পর একটা লেখা মোটামুটি তৈরি করা যায়। “রিকশা চালাই” শিরোনামে ১৯৮১ সালের জানুয়ারি-মার্চ সংখ্যায় বর্তিকা পত্রিকার পাতায় স্থান পায়।

কবি মনীষ ঘটকের কন্যা ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি, নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের স্ত্রী অকাদেমি সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানীয় মহাশ্বেতা দেবীতখন তো আর শুধুমাত্র একজন সাহিত্যিকই নন–পাঠক সমাজে সাহিত্যের এক বিশিষ্ট প্রতিবাদী ধারা রূপে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। সেই মহাশ্বেতা দেবীর সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকা বর্তিকায় আমার লেখাটি স্থান পেয়ে যাওয়ায়–মানুষের দৃষ্টিপথে এসে গেলাম আমি। যাতে আর একটি বিশেষ মাত্রা যোগ হল যখন যুগান্তর পত্রিকার পাতায় এক পুস্তক সমালোচক আমার লেখাটির প্রশংসা করে দু লাইন লিখে দিলেন। যা আমার উৎসাহকে দশগুণ বাড়িয়ে দিল–আমি পারি। আমি পেরেছি।

সে সময় আমার অবস্থা পাগলের চেয়ে খুব একটা ভালো ছিল না। ফুটপাতবাসী আজন্ম দরিদ্র কোন মানুষ যদি ঘুম থেকে উঠে শোনে সে কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে তখন তার যা অবস্থা হবে, আমার অবস্থা এখন তাই। কাল পর্যন্ত আমি ছিলাম একজন ফালতু রিকশাঅলা। আজ আমাকে শিক্ষিত মানুষরাও সমীহের চোখে দেখছে। ডেকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়াচ্ছে। সবার সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছে। এর দেখো, আর শেখো। অধ্যবসায় কাকে বলে। তখন মনে হয় আমি ধন্য। জীবন আমার সার্থক।

সকাল হলেই আমি সব কাজ ফেলে ছুটে যাই বালিগঞ্জ। ট্রেনের টিকিট কাটার পয়সা নেই। বিনা টিকিটে শেষ কামরায় চেপে রানিং ট্রেন থেকে নেমে পিছন দিক থেকে পালাই। এদিকে চেকার থাকে না, তারা ওদিকে–সামনে। সকাল বেলা ও বাড়ি গিয়ে দুপুরে ওখানে খেয়ে ফিরি বিকেল বেলা। মহাশ্বেতা দেবীর ঘরে আলমারি, তাক, ঠাসা গাদাগাদা বই। কোন বাধা নেই, আমি যেটা খুশি নিয়ে পড়তে পারি। এই অল্য রত্ন ভাণ্ডার আমাকে টানে, আটকে রাখে চুম্বক আকর্ষণে। আমার কাছে তখন বিশ্বজগত অসার। সারাক্ষণ শুধু পড়া আর লেখা। রিকশা চালানো, চাল, ডাল, ঘরভাড়া সব তার পরে।

আমি সম্ভবতঃ সেই ভাগ্যবান লেখকদের একজন–যাকে লেখা নিয়ে পায়ের চপ্পল ক্ষয় করে সম্পাদক প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াতে হয়নি। সময়াভাবে লিখতে পেরেছি খুবই কম, তবে যা লিখেছি, কেউ না কেউ এসে সমাদরে নিয়ে গেছে। যে পত্রিকায় পাঠিয়েছি, ছাপা হয়ে গেছে। একদিন জিজীবি ছদ্মনামে পাঁচটা কাগজে পাঁচটা ছোট গল্প পাঠাই হাতিয়ার, রানার, লোক বিজ্ঞান, সিসৃক্ষা এবং বঙ্গবার্তায়। সব কাগজেই আমার গল্প ছাপা হয়ে যায়। এ কারণে আত্মবিশ্বাস আমার আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। পারি, আমিও পারি। পিরবো, আমিও পারবো……।

জেলখানা থেকে বের হয়ে রিকশা চালানো শুরু করার কিছুদিন পরে আমি চেয়েছিলাম–কোথাও একটু থিতু হই। হোটেলে খেয়ে–রিকশার পর্দা বিছিয়ে রিকশার গদি মাথায় দিয়ে রেল স্টেশনে ফুটপাতে শুয়ে রাত কাটানো যে জীবন, বৃষ্টি এলে ভেজা, শীত এলে কাঁপা, পুলিশ এলে রাত দুপুরে লাথি মেরে তুলে দেওয়া যে জীবন তা আর তখন ভালো লাগছিল না। চাইছিলাম, আমার একখানা ছোট ঘর হোক। নিভৃতে বসে সারস্বত সাধনার জন্য একটা নিরিবিলি কোণ হোক। কিন্তু তা চাইলেই তো পাওয়া যাবে না।

এই শহরতলিতে কোন বস্তি বা কলোনিতে আমাদের মত নিম্নআয়ের দরিদ্র মানুষকে–বিশেষ করে যারা রিকশা চালায়, তাদের বয়স যদি কম হয়, কোন বাড়িঅলা বিশ্বাস করে একা থাকার জন্য ঘর দেবে না। এমন ধরনের মানুষ, তাদের ধারণায় নির্ভরযোগ্য নয়। ভাড়া বাকি ফেলে পালিয়ে যেতে পারে। পালাবার সময় কার ও মেয়ে কারও বউ ফুঁসলে নিয়ে যেতে পারে। এর চেয়েও যেটা বেশি ভয়ের-হয়ত এ কোথাও কোন ক্রাইম করে এসে এই শহরে রিকশাঅলার ছদ্মবেশে গা টাকা দিয়ে আছে। এমন কেস আগে দু একটা ধরা পড়েছে। যাতে বাড়িওয়ালা ঝুলে গেছে। তাই তারা আর কোন ঝুঁকি নিতে চায় না। তাদের পছন্দ ফ্যামিলি ম্যান ভাড়াটিয়া। তাও যেন ছোট হয়–স্বামী স্ত্রী আর একটা বাচ্চা।

তখন আমার মনে পড়ে গেল পাগলা সরদারের মেয়ের কথা। প্রায় আড়াই বছর তার খবর জানি না। সে কেমন আছে কী করছে, সব অজানা। তবু তাকে একবার এখন খুঁজে দেখা আমার মানবিক কর্তব্য বলে মনে হল। খবর পেলাম সে আজকাল গ্রাম থেকে কলসি ভরে তাড়ি নিয়ে গিয়ে পার্কসার্কাস স্টেশনের কাছে রেল লাইনের উপর বসে বিক্রি করে। বেশ কয়েক দিন খোঁজবার পরে তাকে পেয়ে গেলাম। এবং নিয়ে এলাম সাথে করে। জীবনে আমি আরেকটা ভুল করে বসলাম। প্রথমবার যদি ও ভুল করে থাকে তাবশ্যই এবার আমার।

মানুষ পরিবেশের দাস। জলছাড়া মাছ আর পরিবেশ বিচ্ছিন্ন মানুষ বড় বিপন্ন হয়ে পড়ে। যে পরিবেশ ভাষা ও সংস্কৃতিতে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে অন্যের কাছে তা নিন্দনীয় হলেও তার কাছে বড় প্রিয় ও সাচ্ছন্দের এ আমি জেলখানাতেও দেখেছি। আমাদের যে ভাত মেপে দিত তার নাম অনিল। সে বাইরে মোটেই থাকতে চাইত না। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে চলে যাবার এক দেড় মাসের মধ্যে আবার ফিরে আসত। জেলই ছিল তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ ভূমি।

আমি ওকে নিয়ে এসে একটা পনের টাকা ভাড়ার ঘরে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে রাখলাম। দিতে চাইলাম নিরুপদ্রব নিরুদ্বেগ শান্ত একটা জীবন। যেখানে পুলিশের তাড়া নেই, মাতালের আশ্রাব্য ভাষা নেই। চাইলাম, আমি যেমন নিজেকে বদলে নিয়েছি সে-ও বদলে যাক। কিন্তু সেটা তার পক্ষে সম্ভব হল না। বৃত্তি বদলে গিয়ে ছিল, কিন্তু পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি স্বভাবে, চরিত্রে, ব্যবহারে। সে যে ভাষায় এতদিন তার খরিদ্দারদের সাথে কথা বলেছে, ঝগড়া, নোংরা গালিগালাচ, জামা ধরে টানা সে আমার প্রতিও সেই একই ব্যবহার করে ফেলত। আগেই বলেছি, আমাকে তখন বইপোকায় কামড়ে দিয়েছিল। যে কারণে রিকশা চালানো সে ভাবে পারতাম না। সংসারে অভাব লেগেই ছিল। যা নিয়ে ঝগড়া চেঁচামেচির বিরাম ছিল না। কোন কোনদিন যা মারামারির দিকে গড়িয়ে যেত। কখনও আমি ওকে মারতাম কখনও সে আমাকে। তোক হাসত, বিরক্ত হতো, নিন্দা করত।

আমার তখন লেখক হিসাবে একটু নামটাম হয়ে গেছে। শুধু রিকশাঅলা হলে যা হোত না এখন তা হয়, লোকের নিন্দা মন্দ অপমান বড় গায়ে লাগে।

একদিন খুব ঝগড়া হয়েছিল। ঝগড়ার কারণ সে নাকি কোন বিশ্বস্ত সূত্র থেকে সংবাদ পেয়েছে, আমি কোন একটা মেয়ের সাথে নাকি একটা সম্পর্ক পাতিয়ে রেখেছি। আমার সব রোজগার তারই পিছনে উড়ে যাচ্ছে।

আমি আগে যাদবপুর স্টেশনে থাকতাম। এখনও সেখানে থাকি। আমার রিকশা স্ট্যাণ্ড এখানেই। যে সব মেয়েদের সাথে আগে পরিচয় ছিল তারা সবাই অন্যত্র চলে যায়নি। কেউ কেউ আছে। কেউ কেউ দিল্লী বিহার ঘুরে আবার ফিরে এসেছে। তাদের কারও কারও সাথে দেখা হলে কথা বলে, হয়ত হাসে, নয়তো কাঁদে। তার ধারণায়–এদের সাথে আমার একটা কিছু নিশ্চয় আছে। পুরুষলোক হচ্ছে”কুত্তার জাত”,দশ হাড়ি চেটে বেড়ায়, সেটা সে তার অভিজ্ঞতায় জানে। মেয়েছেলে হচ্ছে “কুত্তির জাত”মদ্দ দেখলেই তার নোলা থেকে লালা গড়ায়, সেটাও তার অজানা নয়। আর চির ধ্রুব হচ্ছে, আগুনের কাছ ঘি থাকলে গলে যায়। আমি গলে গেছি। আমি যে দু কথায় গলে যাই সেটা তার চেয়ে আর বেশি কে জানে!

সেদিন কঁচা কাঁচা খিস্তি খেয়ে মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। আমিও তো খুব ভালো মানুষ নই। আমার মধ্যেও তো ঘুমিয়ে আছে একটা বুনো ষাঁড়। সে সেদিন খেপে গেল। মারধোর করে দিলাম ওকে। তারপর চলে গেলাম নিজের কাজে। রাত্রে বাসায় ফিরে দেখলাম–আমার একটা তিন সাড়ে তিনশো পাতার পাণ্ডুলিপি, যা আমি লিখেছিলাম জেলবাসের দিনগুলোর স্মৃতি নিয়ে–তা কুঁচিকুঁচি করে ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে সে তার কাপড় চোপড় নিয়ে চলে গেছে। প্রায় এক বছরের শ্রম বিফলে চলে গেছে আমার। সারা ঘরময় উড়ছে আমার “জেলখানার দিনগুলি”।

আমি তখন তাকে খুন করব বলে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। আর সে পালাচ্ছিল। এ ভাবেই সম্পর্ক ছেদ হয়ে গেল তার সাথে।

মহাশ্বেতা দেবীর একমাত্র পুত্রের নাম নবারুণ ভট্টাচার্য–আমরা ডাকি বাপ্পাদা বলে। যিনি কবি গল্পকার উপন্যাসিক এবং অভিনেতা। বিজন ভট্টাচার্যের নাটক ‘নবান্ন’ নামে তার একটা নাটকের দল ছিল। আমি সেই দলের প্রয়োজনে দেবী গর্জন নাটকে একটা ছোট পার্টও করেছিলাম। একবার রবীন্দ্র সদনে আর একবার নাট্য অ্যাকাডেমি মঞ্চে।

বাপ্পাদা থাকেন সদ্য গড়ে ওঠা গলগ্রিনের ফ্ল্যাটে। স্বামী স্ত্রী আর পুত্র “বাউ”, তিনজনের সুখী সংসার। আমি এই বাড়িতেও খুব যেতাম। আমার উপর সে সময় বাউকে রিকশা করে স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসার দায়িত্ব বর্তে ছিল। ফলে বালিগঞ্জে মহাশ্বেতা দেবীর ওখানে যাওয়া কমে গিয়েছিল। বাউকে দিয়ে আসা নিয়ে আসার জন্য বাপ্পাদা প্রণতিদি আমাকে মাসে পঞ্চাশ টাকা করে দিতেন। এক বছর পরে বাউয়ের স্কুল বদলে যায়। তখন আর রিকশার দরকার ছিল না।

বাপ্পাদার এক বন্ধু টুলুদা, যিনি নবান্ন নাট্য দলের একজন সদস্য, তিনি ভারত টেলিভিশন কোম্পানীর ক্যাশিয়ার পদে চাকরি করতেন। এই সময় তিনি আমাকে ওই কোম্পানীতে তিনশো পঁচিশ টাকা মাইনের দারোয়ানের কাজ দিয়েছিলেন। প্রায় বছর খানেক করতে পেরেছিলাম সে কাজ! তারপর কোম্পানী সিটু ইউনিয়নের আন্দোলনের জেরে কলকাতা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে হায়দ্রাবাদ চলে যায়। আমারও কাজ আর থাকে না।

সে যাই হোক, যখন আমি চাকরি পেয়েছিলাম, যখন চার-পাঁচ মাস কাজ করে বেতন পেয়ে একটু ভালো জামাকাপড় কিনে–পড়ে কিছুটা ভদ্রগোছের হতে পেরেছিলাম আর এক মহিলা আমার পিছনে পড়ে গেলেন–বিয়ে করো। লাফালাফি নাচানাচি তো অনেক করেছ। এবার একটা ভালো মেয়ে বিয়ে করে সুখে সংসার করো।

আমার সেই বন্ধু যার নাম নানু, সাতাত্তরের নির্বাচনের পর সব সি.পি.এম. কর্মীর মতো সেও পাড়ায় ফিরে এসেছে। এখন আর করার মতো কোন কিছু নেই বলে বিয়ে করেছে। টিবি হাসপাতালে সে ওয়ার্ডবয়ের একটা চাকরিও পেয়ে গেছে। মহিলা এইনানুর বড় শ্যালিকা। যাকে আমি বউদি বলে ডাকি। সে হিন্দুস্থান পার্কে আমার কোম্পানীর কাছে এক বাড়িতে রান্নার কাজ করে। আমার সাথে তার মাঝে মাঝে দেখা হয়। আমি তখন কোম্পানীর আরও তিন বন্ধুর সাথে মেস বানিয়ে কোম্পানীর দেওয়া এক ঘরে থাকি। বউদি আমার নামী কোম্পানীর গাড়ি, কাঁচের দরজা, ঘোরা চেয়ার, সুবেশ পোশাক কর্মী, এ সব দেখে ভুলে গেছে। সে ভাবে, তার এই দেওরটি–যার নাম খবরের কাগজে ওঠে, নিশ্চয় কোন বড় চাকরি করে, ভালো মাইনে পায়। তাই তার নিবেদন একটা মেয়েকে উদ্ধার করো।

ঘরপোড়া গরু আমি। মহিলা সঙ্গ যে কত ভয়ানক, যে যম যন্ত্রণায় ভুগেছি আমি আর ও পথে হাঁটতে মনের সায় পাইনা। যেমন আছি বেশ আছি–সুখে আছি। কিন্তু বউদি নাছোড়বান্দাহাতের পাঁচটা আঙুল সমান হয়না। দুনিয়ার সব মেয়ে এক রকম হলে জগত চলত না। কেউ মন্দ কেউ ভালো। আরে হাঁটতে গিয়ে পায়ে হোঁচট লাগে, তাবলে কী মানুষ হাঁটে না? বোঝয় বউদি-মানুষ একা না বোকা। যে মানুষ বিয়ে থা না করে বাউন্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়ায় কেউ তাকে বিশ্বাসও করে না। একদিন দুদিন নয় দিনের পর দিন বউদি আমাকে বোঝাতে থাকে। আমি বুঝে উঠতে পারি না, সব শালাকে ছেড়ে আমাকে চেপে ধরার কারণ কী!

শেষে একদিন বলি তাকে, তুমি নানুর শালি। আমার কথা তোমার তো কিছু অজানা নেই। সাধারণ মানুষের কাছে আমি এখনও এক গুন্ডা ছাড়া আর কিছুই। জেল খেটেছি, একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। আমার মত মানুষকে কেউ মেয়ে দেবে না।

–দেবে! বলে বউদি–তুমি মত দাও মেয়ে আমি যোগাড় করব। পুরুষ লোকের ও রকম একটু আধটু দোষ থাকেই। গোয় তুলসী পাতা আজকালতোéড়ও সব যা ছিল সে সব তো আগের ব্যাপার। তখন তুমি এক রকম ছিলে এখন আর এক রকম। এখন তোমার কত নাম! বই লেখো, চাকরি করো। যে মেয়ে তোমাকে পাবে তার কী ভাগ্য! হেসে হেসে বলে বউদি-বড় তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি। পাঁচটা বছর পরে যদি জন্মাতাম তোমাকে কী আমার ছাড়া আর কারও হতে দিতাম।

কোনভাবে পাশ কাটাতে না পেরে শেষে একদিন বলি বউদিকে–ঠিক আছে দেখো মেয়ে। তবে আমি চাই, আমার যা দোষগুণ সবটা যেন তাকে অবশ্যই খুলে বলা হয়। কোন কিছু গোপন রাখা চলবে না। যতটুকু তুমি জানো তুমি বলবে আশা করি ওতে হয়ে যাবে। নাহলে আমি বলব। তবু যদি না পিছোয়-মরুক।

–কেমন মেয়ে চাও তুমি?

–যেমন হোক।

–না, তবু বলো।

–শান্ত ভদ্র নম্র, আমাকে যেন লোকের সামনে খানকির ছেলে বলে থান ইট নিয়ে তেড়ে মারতে না যায়। গায়ের রঙ কালো হতে হবে, খুব একটা সুন্দরী হওয়া চলবে না। রূপের দেমাকে তাহলে তার মাটিতে পা পড়বে না। অল্প যেন লেখাপড়া জানে। সারাদিন খেটেখুটে বাসায় গিয়ে ছেলে মেয়েকে অ আ শেখাতে বসবো, সে আমার দ্বারা হবে না। তবে সে যেন কোন ডিগ্রিধারী না হয়। তাহলে আমাকে পাত্তা দেবে না। আর তার যেন বাবা মা ভাইবোন কাকা জেঠা মাসি পিসি কেউ না থাকে। যেন ঝগড়া ঝাটি হলে সেখানে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকতে না পারে।

–আর কিছু? কোন পন ফন?

–না পনফন নেব না। আমি এর বিরোধী।

আমি যখন এসব কথা বলছিলাম, বলেছিলাম একেবারে হাল্কা চালে, কিছুটা রসিকতার মুডে। কারণ আমি জানতাম এতগুলো শর্ত পূরণ হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু আমার কথা শেষ হবার প্রায় সাথে সাথে বলে বউদি, তুমি যেমন যেমন বলেছ ঠিক তেমনই মেয়ে তোমাকে দেব। আছে তেমন একজন। তবে। তবে সব তো একেবারে একশো ভাগ মেলে না, একটু উনিশ বিশ হয়ে থাকে। সেটা একটু মানিয়ে নেওয়া লাগে। তা ধরো রঙটা মেয়ের কালোর বদলে শ্যামলা পড়াশোনার ব্যাপারটা মোটামুটি ঠিক আছে-এইট ফেল। আত্মীয় স্বজন তেমন কেউ নেই, শুধু মা-সেও খুব বুড়ি, বেশিদিন বাঁচবে বলে মনে হয় না।

আমার তখন জানা ছিল না যে বউদির সাথে এসে কবে যেন দূরে দাঁড়িয়ে আমাকে এবং আমার কর্মস্থল দুটোই মেয়ের মা দেখে গেছে। তার নাকি জামাই হিসাবে আমাকে পছন্দ হয়েছে। তারপরই বউদি আদাজল খেয়ে আমার পিছনে ধাওয়া করেছেন। মেয়ের মা যার মাথার সব চুল সাদা বলে লোকে তার নাম রেখেছে পাকা মাথা বুড়ি তার সাথে বউদির বহুদিন ধরে আলাপ পরিচয়। বুড়ির একটি বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে। যে কারণে তিনি সবিশেষ চিন্তিত। এটা শুধু তার একার নয় বর্তমান সময়ে বিবাহযোগ্য সব মা বাপের চিন্তার বিষয়। ফলে সেই চিন্তিত মা বলেছে বউদিকে, যদি তুমি আমার মেয়ের জন্য একটা ভালো পাত্র খুঁজে এনে দাও, আমি তোমাকে ঘটক বিল্টুদায়ের প্রাপ্য স্বরূপ ভালো একখানা শাড়ি দেব সাথে সায়া ব্লাউজ। মেয়েদের শাড়ির প্রতি লোভ সর্বজন বিদিত। তাই সে ছিনে জোঁকের মত লেগে গেছে আমার পিছনে। একটা ভাল শাড়ির পিছনে।

মেয়ের মা আমাকে পছন্দ করেছে সে নিয়ে আমার কোন দুশ্চিন্তা নেই। কেননা এরপর মেয়ে রয়েছে। আট কেলাসে পড়া আধুনিকা মেয়ে। মা যা বলবে, যা এনে দেবে চোখ বুজে সে মেনে নেবে তেমন দিন আজকাল আর নেই। সে ছিল আমাদের মায়েদের কালে। কাজেই শাড়ি পাবার লোভে বউদি যতই চেষ্টা চালাক এ বিয়ে যে হবে না সে বিষয়ে আমি একশো ভাগ নিশ্চিন্ত।

কদিন পরে বউদি আবার এসে আমাকে পাকড়াও করল–কবে মেয়ে দেখতে যাবে বলো? তখন আমি বলি–আমার মেয়ে দেখার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি দেখেছো ওতেই হবে। তুমি বরং মেয়েকে নিয়ে এসে একবার আমাকে দেখিয়ে নিয়ে যাও। সে যদি আমাকে দেখে পছন্দ করে তখন না হয় আমি যাব।

আমি যত পিছলে যেতে চাই বউদি তত চেপে ধরে–সে মেয়ে তোমাকে দেখবে না। কেন দেখবে? আমি দেখেছি তার মা দেখেছে–আমাদের উপর তার ভরসা আছে। সে জানে আমরা যা করব তার ভালোর জন্যই করব।

–বোকা মেয়েটার এই ভালো করছো?

–মন্দ করছি না। না তোমার না তার।

মন্দ করছে না। বউদি একখানা দামি শাড়ি পাবে সেটা মোটেই মন্দ নয়। কিন্তু আমি ভাবছি অন্যকথা। আজকের দিনে যে মেয়ে মায়ের কথায় চোখ কান বুজে বিয়ে করে নেয় সে তো এক নির্বোধ। অথবা খুব স্বভাব চরিত্র খারাপ মেয়ে।নতুবা কোন শারীরিক খুঁত আছে। যে কারণে পাত্র পেতে সমস্যা হচ্ছে। এখন চেষ্টা চলছে যার হোক গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে আইবুড়ো নামটা ঘুচিয়ে নেওয়া নরেশ ঠাকুরের মুখে শুনেছি গলির কুমারী মেয়েদের নাকি শিলনোড়ার সাথে বিয়ে দিয়ে এঁয়োতি বানানো হয়।

জানতে চাই বউদির কাছে–আমার জীবনের সব কথা তাকে কি বলা হয়েছে? বলে বউদি–বলেছি। কতটা? সবটা? না, কিছু রেখে ঢেকে? বলে সে যতটা আমি জানি। তা সে কী বলেছে? বলেছে যা তার ভাগ্যে আছে তাই তো হবে। আর আমিও তার কথা মানি। বলে না, চুড়ি মিলিয়ে দেয় দোকানদার, আর জুড়ি মিলিয়ে দেয় উপরঅলা। সে যার হাড়িতে যার চাল মেপে রেখেছে তাই তার জুটবে।

অনেকক্ষণ পরে বলি–উপরঅলার উপর যখন তোমাদের এত গভীর বিশ্বাস তবে আর কী! যা পারো করো।

–মেয়ে দেখবে না?

–বললাম তো, তুমি দেখেছো ওতেই হবে।

–পাকা কথা দিয়ে দেবো?

–দিয়ে দাও।

আশা করছি, আমি তখনও আশা করছি, বউদিযতই চেষ্টা করুক বিয়েটা শেষ পর্যন্ত কেঁচেই যাবে। মেয়ের মা নাকি বাঘাযতীন স্টেশনের কাছে শহীদ স্মৃতি কলোনিতে থাকে। সেখান থেকে যাদবপুর আর কতদূর! মাত্র এক স্টেশন। তাছাড়া ওই কলোনির সব লোক আগে যাদবপুর রেল কলোনিতে ছিল। তারা অনেকে আমাকে চেনে। কাউকে আমার নাম বললে সে মা মেয়ের কানে এত বিষ ঢেলে দেবে যে তারা এক পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে যাবে।

আমি মেয়ে দেখতে যাব না। মেয়ে দেখব একেবারে বিয়ের পিড়িতে বসে, একথা বলবার পর বলে বউদি–ঠিক আছে, তাই হবে। তবে চাক্ষুস যদি না দেখতে চাও একবার অন্ততঃ ফটোতে দেখে নাও কথা শেষ করে বউদি একখানা পোষ্টকার্ড সাইজের গ্রুপ ফটো আমার চোখের সামনে মেলে ধরে। এতে পাঁচটা মেয়ের ছবি। স্কুলের কোন এক অনুষ্ঠানে ছবিটা তোলা হয়েছে–”চিনে নাও কোন জন, দেখি কেমন পারো।” সে ফটো হাতে নিয়ে আমি যেন বিছের হুল খাই। মাঝখানে বসা এ কে! একটা আর্তনাদের মত গলা চিরে বের হল আমার বিস্ময়, মাঝখানে বসা এই মেয়ে নয় তো?

–হাসে বউদি-চোখ আছে তোমার, ঠিক চিনেছে। এই সেই মেয়ে যাকে তোমার গলায় বেধে দেবো। বলো পছন্দ হয়েছে তো?

বলি–একে আমি চিনি। আগেও দেখেছি।

জোর দিয়ে বলে বউদি-হতেই পারে না। অনিতা নদীয়ায় থাকে। তুমি দেখবে কী করে! গেছো কোনদিন শিমুরালি?

বলি–নদীয়ায় থাকুক আর নাগপুরে এ মেয়ে আমার চেনা। দিন ঠিক করো, যাব মেয়ে দেখতে।

.

সেটা সেই সময়ের কথা যখন হরেন ঘোষ সংক্রান্ত মারামারিটা হয়ে গিয়েছিল, কার্তিকের ব্যাপারটা হয়নি। সেই সময় একরাতে হোটেলে খেয়ে যাদবপুর সুপার মার্কেটের ছাদে ঘুমাতে চলেছি আমি। তখনও সুপার মার্কেট সম্পূর্ণ নির্মাণ হয়নি। তার ছাদ ছিল আমার একটা নিরাপদ আশ্রয়। তখন তো স্থান বদলে বদলে রাত কাটাতে হোত।

সে সময় এইট বি বাস স্ট্যান্ডের সামনের দিকে–রাজা সুবোধ মল্লিক রোডের পাশে একটু উঁচু দেওয়াল দেওয়া ছিল। সেই দেওয়াল ঘেষে ছিল বিল্টুদার ভাঙাচোরা চায়ের দোকান। এ দোকানকে শুধু চা দোকান না বলে পানীয়ের দোকান বলা ভালো। চা চোলাই মদ ডাব সব সে দোকানে পাওয়া যেত। চোলাই বিক্রির জন্যই বিল্টুদা রাত দেড়টা দুটো পর্যন্ত দোকান খুলে বসে থাকত।

আমি যখন তার দোকানের সামনে দিয়ে পার হচ্ছি আমাকে দেখে সেদিন সেই রাত্রিতে তার গলায় ফেটে পড়ল চাপা এক করুণ আর্তি–ডেকে উঠল–মদন, মদন রে, এটু এদিক আয়। আর কাছে গেলে-পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার ছিন্ন মূল মানুষ বিল্টুদা যেন কেঁদে ফেলেছিল–মদন রে, অর মতোন আমারও একখান মাইয়া আছে। বুকটা ফাইটা যায়। যদি পারোস মাইয়াডারে বাঁচা। অর কেউ নাই।

সেদিনটা ছিল শিব চতুর্দশীর অল্প অল্প শীত মাখা শুনশান একটা রাত। সন্ধ্যে বেলার সেই চুড়ির খনখন,হাসির কলকল, পাটভাঙা শাড়ির খসখস, বাতাসে ওড়া সুগন্ধীচুলের মাতাল হাতছানি, সে সবের আর কিছুই ছিল না এসময়ে। সেই রাতের সেই সময় সমস্ত মানুষ বদ্ধ ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে ঢলে পড়েছিল গভীর ঘুমের কোলে। নিঝুম হয়ে গিয়েছিল চারধার। রাজপথ ছিল কিছু জাবর কাটা গরু ছাল ওঠা নেড়ি কুকুর আর টলোমলো পায়ের মাতালদের দখলে। বাস মোড়ে, যেখানে এখন রাজীব গান্ধির মূর্তি, সেখানে বাজার কমিটির তত্ত্বাবধানে প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও ত্রিপল খাঁটিয়ে তার নিচে বসেছিল সংকীর্তনের আসর। রাত অনেক, এ সময়ে তাই ভক্তশ্রোতাদের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে কুড়ি বাইশ জন। যারা অধিকাংশই জীবনের সব ব্যস্ততা থেকে মুক্ত বৃদ্ধ। যাদের এখন একটাই কামনা হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে।

এই বৃদ্ধদের মধ্যে একটি মেয়ে রয়েছে একেবারে একা, একদম বেমানান। যার শরীরে যৌবন চুপিসারে অনুপ্রবেশ করে ফেলেছে কিন্তু কৈশোর বেলা এখনও দখল ছাড়েনি। মেয়েটি মেঝেয় পাতানো চটের ধুলোর মধ্যে শুয়ে ঘুমের ঘোরে অচেতন। তার শ্যাম্পু করা একরাশ চুল খোঁপা খুলে ধুলোয় লুটিয়ে পড়েছে। পরিধানে লাল রঙের ফুল প্যান্ট আর টি শার্ট। কপালে ছোট্ট একটা কচলোকা টিপ, কানে সোনার সরু রিং। বিন্টুদার আর্তনাদ এই মেয়েটির জন্যই।

এই মেয়েটির বাড়ি পূর্ববাংলার খুলনা জেলার গিলেতলা গ্রামে। এদের বাড়িতে দুর্গাপূজা হোত। দত্ত বাড়ি বললে এক ডাকে সবাই চিনত। ১৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধের সময় এর বাবা রমেন দত্তকে খান সেনারা গুলি করে মেরে ফেলে। প্রাণভয়ে তখন এর মা দুই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এপার বাংলায় চলে আসে। কিছুদিন কাটায় মদনপুরে এক আত্মীয়ের বাড়ি। শেষে তারা আর রাখতে চায় না। তখন মেয়ে দুটো নিয়ে চলে আসে যাদবপুরে। থাকতে শুরু করে সদ্য পত্তন হওয়া শহীদ স্মৃতি কলোনির এক অল্প ভাড়ার ঘরে। খুব বেশি টাকা পয়সা দেশ থেকে নিয়ে আসতে পারেনি। যা এনেছিল এক আধ বছরে শেষ হয়ে যায়। তখন নিজে কাজে লেগে পড়ে এক নার্সিংহোমে আর বড় মেয়ে পুতুলকে দেয় এক বাড়িতে রান্নার কাজে, সে কী ভাবে কে জানে গায়ে আগুন লেগে পুড়ে মারা যায়।

এত শোক দুঃখ কষ্টের মধ্যেও মা আর মেয়ে কোনভাবে দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল যেই ছোট মেয়ে অনিতা একটু বেড়ে উঠল। যে পাড়ায় ওরা থাকে সেখানকার এক দুষ্কৃতকারী হার্মাদ লেগে গেল তার পিছনে। তাকে ওখানকার লোক প্রচণ্ড ভয় পায়। ডাকাতির কেসে সে জেল খেটে এসেছে। আমারই আসল নামের সে বদমাশ আগে যাদবপুর রেল কলোনিতে থাকত। সে অনিতাকে বিয়ে করতে চাইল। নানাভাবে প্রলোভন দিয়ে ব্যর্থ হয়ে শেষে হুমকি দিল স্বেচ্ছায় রাজি না হলে জোর করে তুলে নিয়ে যাবে। তারপর এমন অবস্থা করবে যে কারও সামনে আর মুখ দেখাতে পারবে না। এরা গরিব এবং অসহায়। ও পাড়ায় তখন কেউ ওদের পাশে দাঁড়াবার মত ছিল না। সময়টা বড় খারাপ। এ সময়ে কে কার পাশে দাঁড়ায়। তখন এক মাত্র পথ ছিল–এ পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়া। কিন্তু এত অল্প ভাড়ায় অন্য কোথাও ঘর পাওয়া মুশকিল এবং তা খুঁজতে কিছু সময়ও দরকার।

তখনকার সময়ে ওই অঞ্চলে এ রকম জনবসতি ছিল না। চারদিকে মাঠ, মাছের ঘেরী, হোগলা বন। বিদ্যুৎ ছিল না, তাই সন্ধ্যের পর ঘিরে নিত ঘন অন্ধকার। বাধ্য হয়ে মা মেয়েকে পরামর্শ দেয় সারাদিন বাসায় থাকবি, আর সন্ধ্যে নামার আগে চলে আসবি যাদবপুরে। একটু এদিক সেদিক ঘুরবি। আমি আসার সময় তোকে সাথে করে নিয়ে আসব। ভুলেও যেন অন্ধকার হলে একা ঘরে থাকিস না।

সেই থেকে মেয়ে তাই করে। স্টেশনে, বাস মোড়ে কটা বন্ধু হয়েছে, তাদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সময় কাটায়, আর আটটা বেজে গেলে এসে এই মোড়ে দাঁড়ায়। মা মাঝে মাঝে রুগীদের জন্য ডাব নিতে বিল্টুদার দোকানে আসে।সে বলে গেছে তাকে, আমার মেয়েটাকে একটু দেখবেন। বিল্টুদার ইচ্ছা করে মেয়েকে ডেকে দোকানে বসায়। পারে না। মদ বিক্রি হয় যে।

ওর মায়ের ডিউটি বারো ঘন্টা। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা। নাইটে অন্য একজন থাকে। কিন্তু আজ মা আটটায় ভিউটি শেষ করে আসতে পারেনি, একটি ডেলিভারি পেশেন্ট যথা সময়ে সন্তান প্রসব না করার জন্যে। ওদিকে তার যে সহকর্মী সেও আজ আসেনি। এই অবস্থায় তাকে আটকে থাকতে হয়।

তখন সেই মেয়ে কী করে? সারাদিন শিব চতুর্দশীর উপবাস করেছে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর, ক্লান্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে কীর্তন প্যান্ডেলে মায়ের ফেরার আশায় বসে বসে রাত বেড়ে গেলে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল সেই ধুলো ওড়া চটের উপর। সে তো জানে না,শহর কলকাতার রাত কোন মেয়ের পক্ষে এখন নিরাপদ নয়। এই রাতের শরীরে লুকনো আছে হিংস্র দাঁত নখ। যা দিয়ে নিষ্ঠুর ভাবে ফালাফালা করে ফ্যালে নারীর কোমল শরীর। তার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। সমাজে স্বসম্মানে বেঁচে থাকবার মানবী অহংকার।

এই রাত আঁধারে একটা মেয়ে যে সদ্য কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে পাপড়ি মেলতে শুরু করেছে, সে একেবারে একা, অরক্ষিত পড়ে আছে পথের পাশে। সেই খবরটা পৌঁছে গেছেনারী শিকারিদের ঠিকানায়। এরা এক রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়পুষ্টকর্মী। দলের প্রয়োজনে বোমাচাকু নিয়ে দৌড়য়। আর প্রতিপক্ষ দলের হাতে মারা পড়লে শহীদ হয়। রাত নামার সাথে সাথে এরা বদলে যায়। পেটে মদ পড়লেই খুঁজে বেড়ায় নধর নারী মাংস।

এখন এই রাতে নারী শিকারি যে দলটা এসে এইট বি বাসস্ট্যান্ডের পূর্ব দক্ষিণ কোণের অন্ধকারে গাড়ি রেখে দাঁড়িয়ে সুযোগ খুঁজছে তারা দলে ছয়জন। বোঝা যাচ্ছে ট্যাক্সি চালকও এদের দলের একজন সদস্য। সবাই ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো ওত পেতে আছে। একটা সুযোগ পেলেই মেয়েটাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গাড়ি করে কোন নিরুদ্দেশে চলে যাবে তা কে জানে। বিল্টুদা ওদের চেনে। তাই বেশ কিছুক্ষণ ধরে ওদের গতিবিধির উপর নজর রেখে বুঝতে পারছিল–বাঁচানো যাবে না। মেয়েটার আজ চরম সর্বনাশ হবে। যে মানুষ নিজে সৎ নয় সে অন্যের অপকর্মের বিরোধ করতে পারে না। বিলুদা চোলাই মদ বেঁচে। সে যদি ওদের বারণ করে-বাধা দেয়, কাল ওরা বিন্টুদার দোকানে পুলিশ লেলিয়ে দেবে। বন্ধ হয়ে যাবে ব্যবসা। তখন না খেয়ে মরতে হবে। তাই গভীর সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল সে। মেয়েটার অতীত ইতিহাস জানে বলে তার কষ্ট হচ্ছিল।

এটা কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কাল নয়, যখন কোন আইন কানুনের বালাই থাকে না। এটা নয় সেই জল আর জঙ্গল দিয়ে ঘেরা অবরুদ্ধ মরিচঝাঁপিদ্বীপ। যেখানে যা ইচ্ছা তা করার স্বাধীনতা দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল একদল নরপিশাচকে। এটা সভ্য শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মানুষের আবাস কলকাতা মহানগর। এখানে সেই তারা যাদের বাপ ঠাকুরদা একদিন মেয়ে বোন মায়ের সম্মান রক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিল। সময়ের কী নিষ্ঠুর পরিহাস-এখন সেই বাস্তুহারা বাচ্চারা আর এক বাস্তুহারা মেয়ের মান সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিতে উদ্যত।

তখন বিল্টুদা কি ভগবানকে ডাকছিলেন? কাতর প্রার্থনা জানাচ্ছিলেন—হে ভগবান মেয়েটাকে বাঁচাও। ভগবান কী তার ডাক শুনেছিল?

আমি শুনেছি, বিধির যে বিধান, মানুষ তো তুচ্ছ স্বয়ং বিধিও নাকি তা বদলাতে পারেন না। যদি কেউ বদলাতে পারে, সে পারে একমাত্র শয়তান। যদি মানুষের হাতে তা বদলে দেবার ক্ষমতা থাকত, নিঃসন্দেহে মানব সমাজের পক্ষে শুভ হতো। যে হেতু তা শয়তান বদলায়–দেশকালের পক্ষে আরও বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আমি একদা মানুষ ছিলাম। মানুষ হয়েই থাকতে চেয়েছিলাম। মানুষই আমাকে মানুষ থাকতে দেয়নি। তাই শরণাপন্ন হয়েছিলাম শয়তানের। বিল্টুদা জানে আমি এক শয়তান সাধক। আর জানে-লোহা দিয়ে লোহা কাটতে হয়। তাই বড় কাতর গলায় বলে–আমাগো দ্যাশের মাইয়া, অরে বাঁচা।

যে ছেলেগুলো এখানে এসেছে তাদের প্রায় সব কটাকে আমি চিনি। ওরাও আমাকে চেনে। তবে চেনে এক রিকশাঅলা হিসাবে। তাই আমার গায়ে যে বড় মোটা কালো রঙের চাদর তা দিয়ে ডাকাতের মত মাথা মুখ ঢেকে ফেলি। সন্ধ্যে বেলায় খানিকটা মদ খেয়েছিলাম, এখন ঢকঢক করে খেয়ে ফেলি বিন্দুদার এক পাইট চোলাই। মদ সেই মহাঔষধি যে ভীরুকে করে সাহসী, আর সাহসীকে দুঃসাহসী। আর বিল্টদার ডাবকাটা দা খানা লুকিয়ে নিই চাদরের তলায়। তারপর গিয়ে বসে পড়ি ভূ-লুষ্ঠিতা মেয়ের মাথার কাছে। এখন এই রাতে আমি তার স্বঘোষিত অঙ্গরক্ষক। যে তাকে স্পর্শ করবে, যে হাতে স্পর্শ করবে আমি সেই হাতে কোপ মারবো। আমি এক যুদ্ধভূমি ফেরত সেনা। আমি জানি এ সব লড়াইয়ে যে প্রথম আঘাত করে জয় তারই।

ওরা বোকা নয়, মেয়েটার পাশে আমার দৃঢ় নিশ্চল বসে থাকায় বুঝে যায়–বাধা আসবে। যত সহজ ভেবেছিল কাজটা অত সহজ নয়। তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শেষে চলে যায়। হয়ত টালিগঞ্জ বা কালীঘাট। যেখানে সল্পমূল্যে মেয়ে মিলে যায়। কিন্তু আমি তখনও বসে থাকি।

এক সময় মেয়েটার ঘুম ভাঙে। উঠে বসে শরীর থেকে ধুলো ঝাড়ে। তারপর ক্লান্ত পায়ে হাঁটা দেয় রেলস্টেশনের দিকে। এখন সকাল হয়ে গেছে। এবার সে বাসায় ফিরে যাবে। তখন কী আমার বুক থেকে একটা সর্বহারা দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়েছিল। কিন্তু কেন?

আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কাজ বাকি ছিল বিল্টুদার। তাই সে পথের দিকে চোখ পেতে বসে থাকে। কখন অনিতার মা এই পথে যায়। দেখা হবার পর সে গতরাতে যা যা ঘটেছে আর যা যা ঘটবার সম্ভাবনা ছিল সব খুলে বলে। এ-ও বলে এ রাত তো গেছে, কিন্তু কাল বা পরশু যদি আবার এমন হয়, ওকে কে বাঁচাবে? মেয়েকে আর এখানে রাতে রেখো না।

অনিতার মা তখন কপাল চাপড়ে কাঁদে–কী যে করি মেয়েটাকে নিয়ে। জলে কুমির ডাঙায় বাঘ, আমি যাবো কোথায়! সে কান্না তিনি যেখানে কাজ করেন সেই ডাক্তারের কাছে গিয়েও কাঁদেন। তখন ডাক্তার তার এক প্রভাবশালী পেশেন্টকে ফোন করেন মেয়েটার জন্য একটা ব্যবস্থা করে দেবার উদ্দেশ্যে। তিনি উদ্যোগ নিয়ে অনিতাকেনদীয়ার শিমুরালির অনাথ আশ্রম–ভাগীরথ শিল্পাশ্রমে থাকা খাওয়া পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেন। তবে অনিতা খেলাধুলায় যতটা ভালো, পড়াশোনায় ততটা নয়।

ইচ্ছা করলে অনিতার মা অনিতাকে এখানে আরও কিছু বছর রেখে দিতে পারত। কিন্তু তার ইচ্ছা মেয়েকে বিয়ে দেবে। সে সুখে সংসার করছে দেখে তারপর মরবে। বয়েস তত হয়েছে, কবে কী হয়ে যায়। তা ছাড়া তার আর একটা ভয়, শহিদ স্মৃতি কলোনির আমার নামের সেই বদমাশটাকে নিয়ে। সে এখন বিয়ে করে দু ছেলের বাপ। তবু অনিতাকে বিরক্ত করে। মেয়েটা দুর্গাপুজো বা গরমের ছুটিতে মায়ের কাছে গিয়ে দুদিন থাকতে পারে না। খুব জ্বালাতন করে। কবে নাকি সে শিমুরালির আশ্রমে গিয়ে হাজির হয়েছিল। বউদির আমাকে অনিতার বর হিসাবে এই জন্য পছন্দ–আমি তাকে ওই বদমাশের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে পারব। এরপর আর কী! অনিতা দত্ত নামের কন্যার পানিগ্রহণ করে জনৈক মদন দত্ত। বিয়েতে ওইটুকু মিথ্যায় কোন দোষ নেই। যখন উভয় উভয়ের পছন্দ। বিয়ে করার পর বউ নিয়ে গড়িয়া স্টেশনের কাছে এক খাল পাড়ে কুড়ি টাকা ভাড়ার এক ঘরে আস্তানা নিলাম। আমি এখন সংসারী মানুষ, সামাজিক সম্মানের হকদার। এবার আমার ঘর ভাড়া পেতে কোন অসুবিধা নেই। তবে ঘর সংসার পাততে গেলে শুধু বই নয়, আরও অনেক কিছুই লাগে। কিছুই তো নেই আমার। শ্বাশুড়ি ঠাকরুন হাড়িকুঁড়ি বিছানা মাদুর দিয়ে আমাদের নতুন সংসার পাততে সাহায্য করলেন। পাতিয়ে বসলাম আমার নিজের সংসার নিজের বউ” নিয়ে।

একদিন ট্রেন থেকে বালিগঞ্জ স্টেশনের পিছন দিকে নেমে টিকিট চেকারের নাগাল এড়িয়ে ঘুরপথে হিন্দুস্থান পার্কে ভারত টিভি কোম্পানীতে যাচ্ছি, পথে দেখা হয়ে গেল পারাল কোর্টের রসময় বালার সাথে। সে আমার পরিবারের সবাইকে চেনে। তার মুখে পেলাম মর্মান্তিক দুঃ সংবাদ–আমার বাবা ও মেজভাই চিত্ত মারা গেছে। চিত্তর মৃত্যুর কারণ মস্তিষ্ক জ্বর। বাবার মৃত্যুর কারণ বুকের ভেঙে যাওয়া হাড়, তদুপরি পুত্রের মৃত্যুশোক। বাবার বুকের হাড় ফেটে গিয়েছিল বন্দুকের কুঁদোর আঘাতে। কারণ তিনিও ১৯৭৮ সালে মরিচঝাঁপিতে এসেছিলেন। যখন তাদের পুনরায় জোর জবরদস্তি করে দণ্ডকারণ্যে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়, মন তো সেখানে টিকছিল না। তাই অবস্থা একটু শান্ত হলে মেজভাই চিত্ত পরিবারের সবাইকে সেখানে রেখে একা দ্বিতীয়বার পশ্চিমবঙ্গে আসবার চেষ্টা করে। যদি আমার দেখা পায়, যদি কোন কাজকর্ম করতে পারে, সেই আশায়। রায়পুর স্টেশনে এসে তার হঠাৎ জ্বর আসে। রায়পুরের মানাক্যাম্পে তার বিধবা শাশুড়ি থাকে। জ্বর নিয়ে সে কোনভাবে শ্বাশুড়ির কাছে পৌঁছাতে পেরেছিল।কিন্তু তেমন ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় স্ত্রী আর দুই নাবালক পুত্র রেখে মারা যায়।

বাবার পুরনো একটা পেটের ব্যথা–সে তো ছিলই। তার উপর ভাঙা বুকে দু দুটো পুত্র শোক। বড়টা বেঁচে আছে কিনা কোন খবর নেই, মেজটা মরে গেল। আর তার চেয়ে বড় শোক জন্মভূমি থেকে দূরদেশে বনের মধ্যে পড়ে থাকা। এত দুঃখ কষ্ট সয়ে একটা মানুষ বাঁচবে কী করে! এরপরেও তার আরও একটা শোক ছিল–সেটা হচ্ছে প্রিয় পার্টি “উনিষ্ট”-এর প্রিয় নেতা জ্যোতি বসুর বেইমানি। যা তারা করেছে মরিচঝাঁপি দ্বীপে-দণ্ডকারণ্য প্রত্যাগত দরিদ্র মানুষগুলোর উপরে।

মরিচঝাঁপি। আজ থেকে প্রায় তিরিশ বত্রিশ বছর আগে স্বাধীন এই বঙ্গভূমিতে জালিয়ানবাগতুল্য এক নৃশংস নরসংহার আর ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ, লুঠপাটের যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল নদী বেষ্টিত সুন্দরবনের সেই ছোট্ট দ্বীপে, রাষ্ট্রীয় বর্বরতার এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি নেই।

এই দ্বীপটিতে ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে দণ্ডকারণ্যের বিভিন্নস্থানে থেকে প্রায় একলক্ষ মানুষ এসে পৌঁছেছিল এখানে একটু বসবাসের আশায়। তারা রাজ্য বা কেন্দ্র কোন সরকারের কাছে কোনরূপ কোন আর্থিক সহায়তা দাবি করেনি। শুধু চেয়েছিল একটু দয়া–বাবু গো, আমরা এই বাংলার মানুষ। বাংলার জলমাটি আমাদের বড় আপন। প্রাণধারণের পক্ষে অনুকুল।দণ্ডকারণ্যের পাহাড় পাথর মুররাম মাটি–সেখানকার বন জঙ্গল, মানুষের ভাষা সংস্কৃতি, সব আমাদের অচেনা। সেখানকার শাসন প্রশাসন আমাদের প্রতি চরম উদাসীন। সে জায়গা আমাদের বসবাস-জীবন ধারণের পক্ষে অনুপযুক্ত। তাই এই বাংলার এক কোণে এই জনহীন দ্বীপে আমাদের একটু থাকতে দাও। তারা এই আবেদন করেছিল তাদেরই কাছে–যারা নিজেরাই একদিন বলেছিল–দণ্ডকারণ্য বাঙালী রিফিউজিদের বসবাসের উপযুক্ত তাদের দণ্ডকারণ্য পাঠানো চলবে না। এই বাংলাতেই পুনবার্সন দিতে হবে। তারাই বলেছিল-সুন্দরবনে প্রচুর পতিত জমি রয়েছে। যার মধ্যে মরিচঝাঁপি দ্বীপেরও উল্লেখ ছিল।

আমরা শিরমণিপুর ক্যাম্পে গিয়েছিলাম ১৯৫৩ সালে। তার দু বছর আগে ১৯৫১ সালে বিধান চন্দ্র রায়ের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের পর থেকে যারা ক্যাম্পে এসে রয়েছে সেই সব রিফিউজিদের আন্দামানে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। তখন ইউ.সি.আর.সি নামে এক সংগঠন গড়ে কমিউনিষ্ট ও ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতারা তার ঘোর বিরোধিতা করেছিল। ক্যাম্পে ক্যাম্পে সভা করে তারা রিফিউজিদের বারণ করেছিল কালাপানি না যাওয়ার জন্য। তাদের বিরোধিতার কারণেই সেদিন বন্ধ হয়ে যায় আন্দামানে উদ্বাস্তু প্রেরণ।

এরপর ১৯৫৮ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে গঠিত হয়-দণ্ডকারণ্য উন্নয়ন পর্ষদ। এদের মাধ্যমে মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যার জঙ্গল পাহাড়ঘেরা, কঁকর পাথরযুক্ত, জল বিহীন, অনুর্বর যোগাযোগহীন অস্বাস্থ্যকর আদিম জনজাতি অধ্যুষিত এক বিরাট অঞ্চল নিয়ে গঠিত দণ্ডকারণ্যে আবার উদ্বাস্তুদের পাঠানো শুরু হয়। তখন আবার ইউ.সি.আর.সি.র নেতৃবৃন্দ তার বিরোধিতায় নেমে পড়ে। তারা রিফিউজিদের নিয়ে সভাসমিতি মিটিং মিছিল করতে থাকে। দাবি করে বাঙালিদের বাংলার বাইরে পাঠানো চলবে না। তাদের বাংলাতেই পুনর্বাসন দিতে হবে। সেই সময় থেকে রিফিউজিদের পুনর্বাসন দাবির পক্ষে সুন্দরবন তথা মরিচঝাঁপির জনহীন দ্বীপের কথা উপস্থাপিত হয়।

১৯৫৯ সালের ১১ই আগষ্ট তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের কাছে ইউ.সি.আর.সি. এক দাবি সনদ পেশ করে পরিসংখ্যান দিয়ে জানায় যে সুন্দরবনের উন্নয়ন ঘটিয়ে সেখানকার ৬৫.৫ বর্গ মাইল জায়গায় ৬৮৭৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন দেওয়া সম্ভব। এ ছাড়া যারা মৎস্যজীবী মাছের ভেরি থেকে তাদের ১২ হাজার একর এ ৩,৩০০টি পরিবারের পুনর্বাসন তথা অন্নবস্ত্রের সংস্থান করা সম্ভব। বিধান রায়ও এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন যে মরিচঝাঁপি দ্বীপে সরকারের প্রায় ৫০০০ বিঘা জমি পতিত আছে। ফলে দণ্ডকারণ্যে প্রত্যাগত মানুষদের সেখানে যাওয়া এবং বসবাস করার ইচ্ছা মনের মধ্যে সুপ্ত ছিল বহুকাল আগে থেকে। তখনকার সরকার এ দাবি মেনে নেয়নি। তারা রিফিউজিদের সব রকম সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই তারা বাধ্য হয়েছিল দণ্ডকারণ্যে যেতে। আশা ছিল একদিন দেশের মানুষ দেশের মাটিতে ফিরে আসবে।

মোটামুটিভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১৯৫৯ সালে দণ্ডকারণ্যে রিফিউজি পাঠানো শুরু হয়। যা চলে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। আর সমান তালে সেখান থেকে পলায়ন পর্ব চলতে থাকে। যারা এসে ঘর বাঁধে পশ্চিমবঙ্গের কোন খালপাড়ে বা কোন রেললাইনের ধারে।

সেটা ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি। ভিলাই শিল্পাঞ্চলে সভা করতে গিয়েছিলেন সি.পি.এম নেতা জ্যোতি বসু। তিনি তখন মানাক্যাম্প থেকে উদ্বাস্তুদের কয়েকজন নেতাকেভিলাইয়ে ডাকিয়ে এনে বলেন–আমরা যদি কোনদিন ক্ষমতায় আসতে পারি, উদ্বাস্তুদের পশ্চিম বাংলায় পুনর্বাসনের দাবি অবশ্যই পূরণ করব। চরণদাস প্রতিজ্ঞা করেছিল সে কোনদিন রাজা হবে না, সোনার থালায় খাবে না, হাতিতে চড়বে না, রানীকে বিয়ে করবে না। এ প্রতিজ্ঞা করা তখন তার পক্ষে সহজ ছিল। কারণ এমন সৌভাগ্য যে কোন দিন হতে পারে চোর চরণদাসের তা দূরতম কল্পনাতেও ছিল না। যেমন ছিল না জ্যোতি বসুরও। সে কী করে জানবে যে মাত্র দু বছর পরে গদি নাগালে এসে যাবে। আর তখন আজকের দেওয়া প্রতিশ্রুতি সেদিন গলার কাঁটা হয়ে বিধবে।

ওই বছরই মানা ক্যাম্পে মে মাসে অনুষ্ঠিত হয় এক সর্বভারতীয় উদ্বাস্তু সম্মেলন। যাতে যোগ দিয়েছিলেন রাম চ্যাটার্জী, কৃপা সিন্ধু সাহা ও সারা ভারত ফরোয়ার্ড ব্লকের সম্পাদক জম্বুরাও ধৌতে। তারাও সেদিন এই সভায় উদ্বাস্তুদের সুন্দরবনে পুনর্বসনের দাবি সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন। এমনিতে তো জ্যোতি বসুরা প্রথম থেকে রিফিউজিদের দণ্ডকারণ্যে পাঠাবার বিরোধিতা করে আন্দোলন চালিয়ে ছিলেন, তখনকার সেই দাবীর প্রতি এখনও এদের সমর্থন আছে এটা জেনে রিফিউজিদের মনে নিভু নিভু আশার বাতিটা নতুন করে জ্বলে ওঠা অন্যায় কিছু ছিল না।

এরপর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। তখন ১৯৭৭ সালের ১২ই জুলাই দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তুদের পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করে এক স্মারকলিপি দিয়ে তাদের দুরবস্থার কথা জানিয়ে যান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী রাম চ্যাটার্জী বিধান সভার সদস্য রবি শংকর পাণ্ডে ও কিরন্ময় নন্দ ৭৭ সালের ২৮ শে নভেম্বর পুনরায় দণ্ডকারণ্যে যান। তারা চারদিন ধরে বিভিন্নস্থান পরিদর্শনের পর এক সভা করেন। সেখানে রাম চ্যাটার্জী বলেন আমরা তদন্ত করে দেখে বুঝলাম সরকার আপনাদের পুনর্বাসনের নামে নির্বাসন দিয়েছে। আমরা একথা জ্যোতি বসুকে জানাব। এবং এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে। ১৯৭৭ সালের ১৭ই ডিসেম্বর আবার দণ্ডকারণ্য থেকে আর একটা প্রতিনিধি দল আসে। তখন জ্যোতি বসু তাদের বলেন-পশ্চিমবঙ্গের ফুটপাতেও বহু মানুষ বাস করে। আপনারা না হয় তাদের মতবাস করবেন। আমাদের পুলিশ আপনাদের লাঠিপেটা বা গুলি করবে না। পুনরায় রাম চ্যাটার্জী এবং বামফ্রন্ট কমিটির চেয়ারম্যান অশোক ঘোষ ১৯৭৮ সালে ১৬ই জানুয়ারি দণ্ডকারণ্যে যান। তিনদিন ওখানে থাকেন। বিভিন্ন স্থানে সভাও করেন। সেই সভায় অশোক ঘোষ বলেন–আপনারা যদি পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যান, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের পাঁচকোটি মানুষ দশ কোটি হাত তুলে আপনাদের বরণ করে নেবে।

এত নেতার এত প্রতিশ্রুতি–যা উদ্বাস্তুদের উৎসাহিত করার পক্ষে যথেষ্ট। তাই ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে দণ্ডকারণ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে তারা রওনা দেয় পশ্চিমবঙ্গের দিকে। কিন্তু হতভাগা মানুষগুলো কী করে এসব রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ বুঝবে? রাজনীতিতে যে নেতাদের মনের কথা আর মুখের কথা এক হয়না তা তারা অনেক মূল্য দিয়ে বুঝেছিল। তখন সেই জ্যোতি বসুই উল্টো সুর ধরেছে মরিচঝাঁপি দ্বীপে কোনমতেই মানুষকে থাকতে দেওয়া সম্ভব নয়, ওই দ্বীপ বাঘেদের জন্য সংরক্ষিত। তখন তিনি এ-ও বলছেন–গরিব দরদি বামফ্রন্ট সরকারকে বিপদাপন্ন করার জন্য বিরোধী শক্তি নাকি উস্কানি দিয়ে উদ্বাস্তুদের দণ্ডকারণ্য থেকে নিয়ে এসেছে। একেই রাজনৈতিক পরিভাষায় বলে পরিবর্তিত পরিস্থিতি। ভাবা যায়, যে একলক্ষ লোক ঘরবাড়ি গরুবাছুর জমি জিরেতেও নিশ্চিন্তজীবন ফেলে স্রেফ বামফ্রন্ট সরকারকে বিব্রত করার জন্য এত কষ্ট সয়ে মরিচঝাঁপির মতো দুর্গম দ্বীপে এসে উঠেছে? তখন বামফ্রন্ট, সিপিএম তথা জ্যোতি বসুর একটাই লক্ষ্য–যে কোনভাবে মরিচঝাঁপির মাটি থেকে উদ্বাস্তুদের উৎখাত করে দেওয়া। এর জন্য তারা অত্যাচারের যেকোন সীমা পার করে যেতে বদ্ধপরিকর। সত্যি মিথ্যা জানি না, কেউ কেউ বলে, যে জলাশয়গুলো উদ্বাস্তুরা বাগদা চাষ করছিল, মাছ চাষের উপযোগী করে গড়ে তুলে, সেই জলাধার নাকি জ্যোতি বসুর ঘনিষ্ঠ একজনকে লিজ দেবার প্রয়োজনে প্রশাসন অত নির্মম হয়ে উঠেছিল।

৭৭ সালের মার্চ মাসে দণ্ডকারণ্য থেকে বিশাল সংখ্যক মানুষ হাসনাবাদে এসে পৌঁছাবার

পরই নড়েচড়ে বসে জ্যোতি বসুর প্রশাসন। তখন তারা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশের সবকটা রাস্তায়–বিশেষ করে খড়গপুর ও আসানসোল স্টেশনে মোতায়েন করা হয় বিশাল পুলিশবাহিনী। যারা প্রতিটি ট্রেন চেক করে, বৈধ টিকিট থাকা সত্ত্বেও উদ্বাস্তুদের ধরে নামিয়ে এনে জোর করে তুলে দিতে থাকে উল্টো দিকের যে কোন ট্রেনে। রিফিউজিরা তখন মরিয়া। মরিচঝাঁপি যাবার জন্য যে কোন কষ্ট স্বীকার করতে প্রস্তুত। তারা উল্টোদিকে ট্রেনে এক স্টেশন গিয়ে নেমে পড়ে। তারপর মাঠের মাঝখান দিয়ে হেঁটে পাহারা দেওয়া স্টেশন পিছনে ফেলে অন্য এক স্টেশনে এসে ট্রেনে চাপে। এই ভাবে পৌঁছায় হাসনাবাদ।

কিছু মানুষ বর্ধমান জেলার কাশীপুর রিফিউজি ক্যাম্পেও পৌঁছেছিল। যাদের পুলিশ জোর করে দণ্ডকারণ্যে ফেরত পাঠাবার চেষ্টা করলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তখন পুলিশ গুলি চালায় যাতে ছয়জন উদ্বাস্তু মারা যায়। উদ্বাস্তুদের কুড়ুলের আঘাতে একজন পুলিশও মারা পড়ে।

অবশেষে সব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে হাসনাবাদে জমা হওয়া উদ্বাস্তুরা কুমিরমারি দ্বীপ পার হয়ে ১৯৭৮ সালের ১৮ই এপ্রিল মরিচঝাঁপি দ্বীপে গিয়ে পৌঁছায়। পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের ময়না দ্বীপের মত এই দ্বীপভূমিটি প্রায় কুড়ি মাইল লম্বা আর আট মাইল চওড়া। যেখানে মানুষের পদচিহ্ন পড়েছে বলে মনে হয় না, জনহীন এই দ্বীপ দেখতে দেখতে পরিণত হয় একটি জনপদে। গড়ে ওঠে পথঘাট বাজার হাট স্কুল রুটির কারখানা বিড়ির কারখানা। এবং এর সবটাই কোন রকম বাইরের কারও সহায়তা ছাড়াই মানুষের স্বকীয় উদ্যোগে। তারা সরকারের কাছে অন্য কিছু চায়না শুধু একটাই আবেদন জানায়–আমাদের এখান থেকে উৎখাত করে দিও না। একটু থাকতে দাও।

এটা তো এক অতি সাধারণ মানবিক দাবি।কিন্তু সে দাবির অর্থ তো সে বোঝে যার মানবিকতা থাকে। জ্যোতি বসুর সরকার সে দাবির প্রতি কর্ণপাত করল না। লেলিয়ে দিল পুলিশ বাহিনী আর পার্টি ক্যাডারদের। ১৯৭৮ সালের ১৯শে আগষ্ট সকালবেলায় পুলিশের দুটো বাহিনী ৪০/৪২ টা লঞ্চ দিয়ে মরিচ কাঁপ দ্বীপকে চারদিক থেকে ঘিরে নিল। জারি করল ১৪৪ ধারা। দ্বীপের বাইরে থেকে কোন মানুষকে এখানে আসতে দেওয়া হল না। যেতে দেওয়া হল না কাউকে দ্বীপের বাইরে। এমন কী সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবী-লেখক সাহিত্যিক সবাইকে বাধা দেওয়া হল। মরিচঝাঁপিদ্বীপে তখন কোন পানীয় জলের ব্যবস্থা ছিল না। চাল ডাল শাক সজি ওষুধপত্র ও সব সংগ্রহ করা হতো কুমিরমারি দ্বীপ থেকে। পুলিশ সে সব নিয়ে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে অবরুদ্ধ দ্বীপ মরিচঝাঁপির মানুষকে ক্ষুধা তৃষ্ণা বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলার এক জঘন্য অপপ্রয়াস শুরু করে। যারা বাধা না মেনে খাদ্য ও পানীয়ের সন্ধানে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে অন্যদ্বীপে যাবার চেষ্টা করে, পুলিশ লঞ্চ দিয়ে ধাক্কা মেরে তাদের নৌকাগুলো সব ডুবিয়ে দেয়। এই ডুবিয়ে দেওয়া এবং পুলিশ কর্তৃক ছিনতাই করে নেওয়া নৌকার সংখ্যা প্রায় দুশো। লোকে বলে সুন্দরবনের নদীতে জল কম, হাঙর কুমির বেশি, এভাবে ডুবিয়ে দেওয়া নৌকার কত উদ্বাস্তুকে কুমির হাঙরে খেয়ে নিয়েছে তা কে জানে!

মানুষের দ্বারা সৃষ্ট এই ভয়ংকর দুর্বিপাকে উদ্বাস্তুরা যখন ক্ষুধার তাড়নায় দিশেহারা হয়ে জঙ্গলের লতাপাতা ঘাস খাচ্ছে, তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পান করছে নদীর নোনা জল, বিনা চিকিৎসায় মরছে কুকুর বেড়ালের মত ক্রমশ মৃতের সংখ্যা তখন ১৩৬ হয়ে গেছে, তবু যখন মানুষ কিছুতে নত হচ্ছে না, ফিরে যেতে রাজি হচ্ছে না দণ্ডকারণ্যে, তখন ১৯৭৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি পুলিশ এগিয়ে এল দ্বীপের দিকে। নদীর পাড় জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা-শ্লোগান দেওয়া মানুষের দিকে বিনা প্ররোচনায় ছুঁড়ে দিল ২৪/২৫টা কাঁদানে গ্যাসের শেল। ফলে মানুষ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। বিনা বাধায় পুলিশ নেমে পড়ল দ্বীপভূমির মাটিতে। তারপর তারা শুরু করল শতাব্দীর সবচেয়ে কুর বর্বর অমানুষিক আক্রমণ একদল অনাহারী দুর্বল নিরস্ত্র মানুষের উপর। শুরু হল হত্যা ধর্ষণ লুঠপাট আর অগ্নি সংযোগের এক ভয়াবহ অধ্যায়। শোনা যায় তখন মানুষকে গুলি করে লঞ্চ ভরে নিয়ে গিয়ে কিছু ফেলা হয় গভীর সমুদ্রে আর কিছু ফেলা হয় বাঘের খাদ্য হিসাবে বিভিন্ন জঙ্গলে। সুন্দর বনের বাঘ আগে নরখাদক ছিল না। এই প্রথম তারা মানুষের মাংসের স্বাদ পায়, তারপর থেকে তারা নরখাদক হয়ে যায়। ৩১শে জানুয়ারি থেকে ৮ই মে, প্রায় চার মাস ধরে লোক চক্ষুর আড়ালে এক অবরুদ্ধ দ্বীপে বিভৎস তাণ্ডব চালিয়ে ভেঙে ফেলার চেষ্টা হয় উদ্বাস্তুদের মনোবল। শেষে বাধ্য করা হয় তাদের ফিরে যেতে। আর ঘুমিয়ে থাকে পশ্চিমবঙ্গের জাগ্রত বিবেক।

বামফ্রন্ট সরকার বলে থাকে যে–ওই ঘটনায় নাকি একজনও উদ্বাস্তু মারা যায়নি। মাত্র দুজন, তাও স্থানীয় মানুষ মারা যায়। এটা বলতে পারার সব চেয়ে সুবিধা হল ঠিক কতলোক দণ্ডকারণ্য থেকে এসেছিল আর কত ফিরে গেছে কোথাও তার কোন রেকর্ড ছিল না। বিভিন্ন বইপত্র থেকে যা জানা যায় তা হল শুধু মাত্র ৩১শে জানুয়ারির গুলি চালনায় মারা যায় ১৪ জন। এরপর আর যত লোক গুলিতে মারা পড়ে জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল তার বই, “মরিচঝাঁপি নৈঃশব্দের অন্তরালে”তে ১২৮ জনের নাম পরিচয় সংগ্রহ করে দিয়েছেন। নাম দিতে পেরেছেন বিনা চিকিৎসা ও অনাহারে মৃত ২৩৯ জনের। পুলিশ ও ক্যাডারদের দ্বারা ধর্ষিত ২৩ জন মহিলার। আমার মনে হয় এ তথ্য নির্ভুল নয়। আমি পরে দণ্ডকারণ্য গিয়েছি। মরিচঝাঁপি প্রত্যাগত মানুষের মুখে যা শুনেছি তাতে মনে হয়েছে মৃতের সংখ্যা দু হাজারের কম নয়। ধর্ষিতার সংখ্যা দুশোরও বেশি।

যখন কোন কুকুরকে মেরে ফেলতে চাও তো আগে পাগল বলে বদনাম করে দাও, এটা একটা পুরনো প্রবাদ। কুকুর হোক আর মানুষ তার নামে বদনাম ছড়িয়ে দিতে পারলে কাজটা সহজ হয়ে যায়। এই নিয়ম অনুসারে সে সময় সিপিএম পার্টির পক্ষ থেকে জোর প্রচার চালানো হয়েছিল যে দণ্ডকারণ্য প্রত্যাগত এই সব মানুষ প্রতিবেশী–বাংলাদেশের সহযোগিতায় সুন্দরবনে একটা আলাদা রাষ্ট্র বানাবার ষড়যন্ত্র করছে। অতি দুর্বল একটা দেশ–বাংলাদেশ। যে তখন তার নিজের হাজারটা সমস্যা নিয়ে নাজেহাল। সে ভারতবর্ষের মত একটা শক্তিশালী দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে নিজের বিপদ ডেকে আনবে! এ তো কোন পাগলেও করবে না। তবে এই প্রচারে পুলিশ ও পার্টি ক্যাডারদের মানুষের উপর অত্যাচারের একটা অজুহাত খাড়া করতে পেরেছিল এটা বলা চলে। যার ফলে বাংলার মানুষ বাংলায় এসে বাঙালীদের হাতে চরম নিগৃহীত হয়ে ফিরে গিয়েছিল অভিশাপ দিতে দিতে। কোন বঙ্গসন্তান প্রতিবাদে গর্জে ওঠে না। একজনের মুখে শুনেছিলাম তাদের ফিরে যাবার যাত্রা পথের মর্মন্তুদ বিবরণ। তাদের মরিচঝাঁপি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে গরু ছাগলের মত নির্দয় ভাবে গেদে দেওয়া হয়েছিল ট্রেনের কামরায়। যার মধ্যে বহু মানুষ ছিল অসুস্থ-আহত, আত্মীয়, স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন। পথে এদের জন্য কোন খাবার দাবার বা চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। আর সবচেয়ে যেটা নিষ্ঠুর, বিভৎস, পৈশাচিক ট্রেনে যে সব শিশু মারা যাচ্ছিল ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছিল বাইরে।

আমার বাবা যে দণ্ডকারণ্য থেকে হাসনাবাদ এসেছেন তা আমি জানতাম না। আমার ভাই চিত্ত নাকি এসে কোথায় কোথায় একদিন খুঁজে গিয়েছিল। আমাকে পায়নি, না পাবারই কথা। “চলতা যোগী রমতা নদী” সে কী কোথাও স্থির থাকে? আমি পরে যে গিয়ে মরিচঝাঁপিতে খুঁজবো, সে উপায় নেই। তখন মরিচঝাঁপি অবরুদ্ধ। আমার বাবা হাসনাবাদে মাত্র অল্প কয়েকদিনই ছিলেন, তারপরই মরিচঝাঁপিতে যান। ভেবেছিলেন একটু গুছিয়ে বসতে পারলে তখন আবার আমাকে খুঁজতে ভাইকে পাঠাবেন। সে আর পারেননি পুলিশি হামলায়। যে রাতে আমার বাবার বুকের হাড়ে চিড় ধরে পুলিশের লক্ষ্য বাবা ছিলেন না, ছিল আমার মেজভাই চিত্ত। ভাইকে বাঁচাতে গিয়েই বাবা জখম হয়ে পড়েন। কিন্তু সেই হতভাগ্য বাপ শেষ পর্যন্ত পুত্রকেও বাঁচাতে পারলেন না নিজেও বাঁচলেন না।

রসময় বালা দণ্ডকারণ্য থেকে মরিচঝাঁপি গিয়েছিল। সেখান থেকে ফের দণ্ডকারণ্য যায়। কদিন পরে আবার সেখান থেকে পালায়। এখন থাকে ঠাকুরনগর রেলস্টেশনের কাছে লাইনের পাড়ে। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে গামছা বিক্রি করে। তার মুখে বাবা ভাইয়ের কথা জানতে পারি।

আমার বাবা ভাই, দুজন সবচেয়ে নিকট আত্মীয় মারা গেছে সেই শোকে আমি মুহ্যমান। এই সময় আমার একবার দণ্ডকারণ্য গিয়ে মা আর ভাইবোন দুজনকে দেখে আসা দরকার। যখন এই রকম ভাবছি, আগাম কোন পূর্বাভাস না দিয়ে হঠাৎ করে চাকরি চলে গেল আমার। কোম্পানি কলকাতা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেল। বিয়ে করেছি দু মাসও হয়নি। এই সময়ে এমন বিপর্যয়।

সেই সময় আর একটি বিপর্যয় ঘটেছিল নেহেরু পরিবারে। নিহত হয়েছিলেন ইন্দিরাগান্ধি নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে। যে কারণে হাজার হাজার শিখ পরিবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল ইন্দিরা অনুগামীদের হাতে। কী ভীষণ অবিবেচক সংক্রামক দুঃসময়! কিন্তু আমি তখন কী করি?

আমি তখন গড়িয়ার ঘর ছেড়ে হালতু-রাজডাঙা খালপাড়ে নিজে একখানা ঘর বানিয়েছি। এতে আমার মাসে মাসে ভাড়া গোনার চিন্তাটা গেছে। আর নিজের ঘরে স্বাধীনভাবে থাকার যে সুখ সেটাও পাচ্ছি। তখন আর রিকশা চালাইনা! চাকরিতে মাসে যা মাইনে পাই তা দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালিয়ে নিই। ডিউটির পরে হাতে যে সময় থাকে–লেখালেখি করে কেটে যায়। তখন বেশ কটা পত্রিকায় নিয়মিত আমার লেখা প্রকাশ হচ্ছে। মনে আশা জাগছে, আর কিছুদিন এভাবে চালাতে পারলে যে দুরবস্থার মধ্যে সাহিত্যচর্চা করি তা নিশ্চয় কোন সহৃদয় পত্রিকা-প্রকাশক সংস্থার কানে পৌঁছে যাবে। আর তারপরই আমি একটা লেখালেখির কাজ পেয়ে যাব। যাতে এমন বেতন পাব যে খেয়ে পড়ে বাঁচা যায়। সমরেশ বসু, সুবোধ ঘোষ এরা তো সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছিলেন। একদিন আমিও তা হতে পারব। শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা। এই সময় এমন অঘটন।

এক মুদি দোকানে মাসকাবারি মাল নিই। প্রথম মাসে তো দোকানদার কিছু টের পায়নি। মাল দিয়ে দিয়েছে। পরের মাসে বাকি শোধ না করায় শুরু হয়ে গেল তাগাদা। অনিতা–যাকে আমি ডাকি অনু বলে সে বিয়ের সময় তার মায়ের কাছ থেকে চারগাছা চুড়ি এক জোড়া দুল পেয়েছিল। আমি পেয়েছিলাম একটা আংটি একটা ঘড়ি, সে দিয়ে দুমাস চালানো গেল। এমন দিনে ভারত সুইটস হোমের আমার পরিচিত এক আবাসিক আমাকে একটা কাজ যোগাড় করে দিতে সক্ষম হল। উত্তর চব্বিশ পরগনার একস্থানে পশ্চিবঙ্গ সরকার বিশ্বব্যাঙ্কের আর্থিক সহযোগিতায় একটা কোলড স্টোরেজ তৈরি করছিল। আমি কাজ পেলাম সেখানে। পদটার নাম সাইড ইনচার্জ। সবাই বলে এ এমন একটা কাজ যে কাজ কিনা বেতনও লোকে পেলে লুফে নেয়। কী কাজ আমার? ট্রাক আসছে ইট বালি স্টোন চিপ নিয়ে। মালটা বুঝে নিয়ে চালান সই করে দেওয়া। সারাদিন মিস্ত্রিরা কাজ করছে তাদের কত বস্তা সিমেন্ট খরচ হল সে সব হিসেব রাখা। বিনা বেতনে কাজ করার সকল রহস্য লুকিয়ে আছে এই চালান সই আর সিমেন্ট খরচের খাতায়। আমার বেতন মাসে সাড়ে তিনশো। দিনের মজুরি বারো টাকারও কম। তাতে কী! একটা, মাত্র একটা বস্তা সিমেন্ট বেশি খরচ, স্টোন চিপসের লরি মাপে এক ইঞ্চি এদিক সেদিন একটা দুটো লেবারের বাড়তি হাজিরা যা কারও চোখে পড়ার নয়, এতেই দিন গেলে দুশোটাকা কোথাও যাবে না। কিন্তু আমি যে এক মদনা! যুধিষ্ঠিরের কুকুর আমাকে কামড়ে দিয়েছে। রক্তে সতোর ভাইরাস ঢুকে গেছে। গোটা কয়েক লেখা ছাপা হয়েছে অমনি নিজেকে এক মহান লেখক বলে ভাবা শুরু করে দিয়েছি। ছিঃ আমি না একজন স্রষ্টা, শিল্পী, সমাজ সচেতন মানুষ! যে সমার্জনী হাতে সমাজকে জঞ্জাল মুক্ত করতে বের হয়েছে। তার কী ওসব চুরি-চিটিংবাজি করা সাজে। ছিঃ!

এর উপর আছে অনু। আমাকে যদি কুকুরে কামড়ে থাকেতো ওকে বাঘে। সে নিজেকে একজন লেখকের স্ত্রী হিসাবে গর্ববোধ করে। স্কুলে মহাশ্বেতাদেবীর লেখা ঝান্সীর রাণী লক্ষ্মীবাই পড়েছে। আমি মহাশ্বেতা দেবীর স্নেহভাজন তাই তার চোখে বড়। তার সামনে কোন অন্যায় অনৈতিক কাজ করতে মনের সায় পাই না। তার চোখে ছোট হয়ে যেতে বিবেকের দংশন অনুভব করি। অনুকে সাথে নিয়ে আমি তখন খালপাড়ের ঘর তালা বন্ধ করে রেখে কাজের সাইডেই থাকি। আমাদের থাকার জন্য একখানা ঘর দেওয়া হয়েছে।

আমি সৎ থাকতে চাইলে মানুষ আমাকে সৎ থাকতে দেবে কেন? আমি লেখক বলে নয়, চাকরি পেয়েছি জেলখাটা অভ্যাস আছে বলে। যে জেলে যেতে ভয় পায় না তাকে দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেওয়া চলে। এখানে অন্য কেউ নয় আমি যার অধীনে চাকরি করি সেই এ-ওয়ান গ্রেডের কন্ট্রাকটার সান্যাল বাবুই বলছেন চুরি করতে। বলেছেন আমি যত দক্ষতার সাথে ওটা করে যেতে পারব তার মুনাফা হবে। তার মুনাফা হলেই আমার চাকরির নিশ্চয়তা বাড়বে। তিনি রোজ রাত দেড়টা দুটোর সময় একখানা ম্যাটাডোর সাইডে পাঠিয়ে দেন। যাতে নিঃশব্দে আমাকে পঞ্চাশ বস্তা সিমেন্ট তুলে দিতে হয়। যা পরের দিনের খরচের খাতায় তুলে হিসেব সঠিক রাখা হবে।

যিনি আমাকে চাকরি দিয়েছেন একদিন বলি তাকে, এ আপনি কোথায় নিয়ে ফাঁসিয়ে দিলেন, চুরি করতে হচ্ছে আমাকে। বলেন তিনি–তুই কোথায় চুরি করছিস? তুই তো ডিউটি করছিস? ধর তুই যদি পুলিশ কী মিলিটারির চাকরি করতি, তোকে যদি তোর অফিসার কাউকে দেখিয়ে হুকুম দিত, গুলি কর, করতে হোত না? কোন মেয়েকে দেখিয়ে যদি বলত নকশাল রেপ কর–করতিস না? চাকরি বাঁচাবার জন্য লোকে খুন রেপ কত কইনা করে। কী করবি বল! যদি না পারিস ছেড়ে দে চাকরি।

কিছুদিন এভাবে সিমেন্ট পাচার হবার পর টের পেলাম ব্যাপারটা যতই গভীর রাতে সংঘটিত হোক না কেন, পাড়ার ক্লাব এমনকি পুলিশ সেটা জেনে গেছে। যে কোনদিন তারা বমাল গাড়িটা ধরে ফেলতে পারে। তখন কী হবে?

যিনি আমাকে কাজে লাগিয়েছেন বলেন তিনি—ধরুক তো কী?

পুলিশ তো আমাকেই ধরবে। ওরা কী স্বীকার করবে যে তাদের হুকুমে এসব করছি? তারা তো বলবে, আমাদের হুকুমে করছে তার প্রমাণ কী?

আরে বোকা কন্ট্রাকটর তো জানে তুই নির্দোষ! সে তোকে যেমন সাবে আবার ছাড়িয়েও আনবে। তুই তো জেল খেটেছিস। যদি দুদশদিন হাজতে থাকতে হয় থাকবি। তোর বউকে ওরা দেখবে।

এত বলার পরেও আমার ভয় যায় না। যদি ওরা ছাড়িয়ে না আনে? যদি আমার পাঠক, সম্পাদক, প্রকাশক, লেখক বন্ধুদের কানে কথাটা যায়? অনু এখন গর্ভবতী। যখন সে আমার সন্তানকে কোলে করে জেলখানায় আমাকে দেখতে যাবে, তখন যদি সে তার মায়ের কাছে জানতে চায়, সবার বাবা ঘরে আর তার বাবা জেলে কেন? কী জবাব দেবে তার? তাই চাকরিটা ছেড়ে দিলাম আমি।না খাওয়া সহ্য হবে, এত লোকের ছিঃছিঃ সহ্য হবেনা। ফিরে এলাম আমার খালপাড়ের কুঁড়েঘরে।

তখন ইস্টার্ন বাইপাশ তৈরির কাজ চলছে। রুবি হাসপাতাল এবং তৎসংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চলছে ব্যাপক উন্নয়নের কাজ। উচ্ছেদ হচ্ছে গরিবের আবাস গড়ে উঠছেমধ্যবিত্তের উপনগরী। গড়ে উঠছে মদ্যপানের জন্য বার, দেহ ব্যবসার জন্য বড় বড় হোটেল, আরও কত কী!

রাজডাঙায় ফিরে এসে খুঁজে পেতে এক ঠিকাদারের কাছে মুনশির কাজ পেলাম। দিন দশটাকা মজুরিতে প্রায় মাস দুয়েক করলাম সে কাজ। শিখে নিলাম কেমন করে কাজ করাতে হয়। তারপর তারই কাছ থেকে সাবকন্ট্রাক্ট নিয়ে নিলাম পঞ্চান্ন গ্রামের একটা রাস্তা তৈরির। প্রায় দুমাইল লম্বা দশফুট চওড়া এই রাস্তা পাশের পুকুর ডোবা থেকে মাটি কেটে এনে আড়াই ফুট উঁচু করে ফেলতে হবে। আমি যখন উত্তর চব্বিশ পরগনায় গিয়েছিলাম ওখানে ঘটক পুকুর থেকে যে মাটিকাটার দলটি এসেছিল তাদের ঠিকানা লিখে রেখেছিলাম। “জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা,” এবার সেটা কাজে লেগে গেল। চল্লিশ জনের একটা দল এনে লাগিয়ে দিলাম মাটি কাটায়।

এতগুলো মানুষের নানা রকম সমস্যা। সব একা আমার পক্ষে সামলানো মুশকিল বলে আমরা যে খালের পাড়ে থাকি তার উল্টো দিকের একটা ছেলেকে মুনশি রেখেছিলাম। সে আমার চেয়ে বয়সে ছোট কিন্তু লম্বা চওড়ায় বেশ বড়। নিগ্রোদের মতো দেখতে ওই ছেলেটা যে এই এলাকার এক গুন্ডা বিশ্বনাথের ছোটভাই সে তখন আমি জানতাম না। যখন জানলাম ভাবলাম, দাদা গুন্ডা তো ভাইয়ের কী দোষ! থাকুক যেমন আছে আমার কাছে।

“খোকাদা” তিনজন আছে সেই রকম কানা অজিতও দুজন। একজন থাকে বাঘাযতীন আর একজন এই রাজডাঙায়। রাজডাঙায় কানা অজিত বিশ্বনাথের মামা হয়। বিশ্বনাথ আগে কানা অজিতের গ্যাংয়ে ছিল। মামাভাগ্নে দুজনে মিলে এই এলাকায় যারা জমি কিনছে বাড়ি করছে সবাইকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করত। একবার সে বিশ্বনাথকে সাথে নিয়ে এক জমির ক্রেতাকে চমকানি দেয়-কুড়ি হাজার টাকা দিতে হবে। না হলে জমির দখল নিতে দেব না। ভদ্রলোক ভয় পান এবং একটা তারিখ দিয়ে বলেন, ওইদিনে আপনাদের টাকা দিয়ে দেওয়া হবে। তার আগে কানা অজিত অন্য একটা কেসে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে চলে যায়। সেই ফাঁকে ভদ্রলোকের কাছে থেকে বিশ্বনাথ টাকাটা তুলে একা ঝেপে দেয়। কিছুদিন পরে কানা অজীত জেল থেকে ফিরে এসে বিশ্বনাথের কাছে টাকার ভাগ চায়। কিন্তু বিশ্বনাথ দিতে পারে না। টাকা তো সে মদ-মেয়েতে উড়িয়ে দিয়েছে। ফলে দু জনে বিরোধ শুরু হয়। যা এখনও চলছে।

আমি তখন রাস্তার কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি। হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে যায় জেলের এক বন্ধু সুদাশের সাথে। ও কোথা থেকে কী ভাবে যেন অস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়ে এসে সেগুলো বিক্রি করে। সেই কারণে জেলে ছিল। সে আমাকে জেলখানায় দেখেছে। তার দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি আর যাই-ই হই “ভদ্দর লোক” কখনই নই। একটা দুটো একথা সে কথার পর দুম করে বলে সে–দোস্ত একখানা ভালো মাল এসেছে, মেড ইন চায়না। নেবে নাকি? ও কী করে জানবে যে আমি আর মা কালীর নয় মা সরস্বতীর ভক্ত হয়ে গেছি। আগে আমার কোমরে একটা চাকু গোঁজা থাকত, এখন পকেটে পেন থাকে। বলি আমি–নানা আমার আর এসব চাইনা। বিয়ে টিয়ে করে আমি সংসারি হয়ে গেছি।

আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বিশ্বনাথের সেই ভাই যার নাম পোলতা। যাকে দেখে সুদাশ আমার এক সাগরেদ বলে ভেবে নিয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করে–মালটার দাম কত? আমি চোখ টিপে সুদাশকে কিছু না বলার জন্য ইশারা করি। কিন্তু সে তা লক্ষ্য না করে বলে যায়–দুহাজার। বলে পোতো–আমার কাছে খদ্দের আছে। গড়গড় করে বলে দেয় সুদাশ-আমি কসবায় থাকি। বাড়ির ঠিকানা দিয়ে লাভ নেই বাড়িতে খুঁজলে আমাকে পাবে না। পুর্বাসা সিনেমা হলের সামনে যে চায়ের দোকান সন্ধ্যা বেলা কিছুক্ষণ সেখানে আমি বসি। খদ্দের থাকলে খবর দিও মাল নিয়ে এসে দিয়ে যাব।

আমি বিয়ে করেছি, আমার একটি মেয়ে হয়েছে শুনে বলে সুদাশ–আমি তোমার বাসায় যাব। বউদি আর মেয়েকে না দেখে ফিরব না। আমি তাকে তখন আর না বলতে পারি না। নিয়ে আসি বাসায়। কিছুক্ষণ গল্প করে এক কাপ চা খেয়ে সে বিল্টুদায় নিলে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এ সব লোকের সাথে আমার মিলতে মিশতে আর ইচ্ছা করে না। তবে রূঢ় ব্যবহার করে এদের রাগিয়ে দিতেও পারা যায় না। তাই মনের ভাব মনে গোপন রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলি আবার আসিস। অনু এসব মানুষ দুচোখে দেখতে পারে না। সে আমার দিকে কটমট করে তাকায়। এবং সে বা আমি না চাইলেও প্রায় দিন দশ বারো পরে, এক ভোর বেলায়–তখনও সূর্য ওঠেনি–সুদাশ এসে হাজির হল আমার বাসায়। ঘুম ভাঙিয়ে আমাকে ডেকে তুলে বলল-মাল নিয়ে এসেছি। শুনে তো আমার সারা গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর–মাল!

আমি জানতাম না আমাকে অন্ধকারে রেখে একটি গোপন ষড়যন্ত্র রচনা করা হয়েছে। সেদিন আমার বাসায় চা খেয়ে ফিরে গিয়ে পোড়োতার দাদা বিশ্বনাথকে সমস্ত বিষয়টা খুলে বলে। তখন দুভাই ঠিক করে মালটা ওরা কেড়ে নেবে। এ সব অস্ত্র কারও পৈতৃক হয় না। যখন যার হাতে থাকে তখন তার হুকুমে চলে। দেখি মালটা? সুদাশ সেটা দেখার জন্য বিশ্বনাথের হাতে দিলে ঘুরিয়ে যদি সুদাশের বুকে ঠেকিয়ে ধরে বলে–পালা। না হলে গুলি করব। এটা তার এলাকা। এখান থেকে না পালিয়ে গিয়ে আর কোন উপায় আছে? অন্যকোন এলাকা হলে সুদাশ এভাবে যেত কিনা সন্দেহ আছে। তবে এখানে আমি আছি সেই কারণে এমন নির্ভয়ে চলে এসেছে। আমাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করেছে পোতো বিশ্বনাথ। ওরা পূর্বাসা সিনেমা হলের সামনে সেই চায়ের দোকানে গিয়ে সুদাশকে বলেছে–মদনদা পাঠিয়েছে খবর দিয়ে। একটা খদ্দের আছে। কাল সকালে মালটা নিয়ে চলো। মদনদার ঘরে লেনদেন হয়ে যাবে।

যাদবপুর স্টেশনের গনেশ গোপাল আমাকে যে রূপে চেনে পোতো বিশ্বনাথ তো চেনে না। রাজডাঙায় আমি একজন ছাপোষা সংসারী মানুষ। এখানে এমন কোন পরিচয় আমি গড়িনি, যাতে উঠতি গুন্ডা বদমাশরা একটু সামঝে চলে। ওরা দুভাই ভেবে নিয়েছে আমার ঘর থেকে ওটা ছিনতাই করে নিলে আমি কি আর তাদের ঠেকাতে পারব! পারব না! এখানে আমি একা। আমার বউ বাচ্চা আছে ফলে এক দুর্বল মানুষ।

সুদাশ সেয়ানা ছেলে। সে পোতোকে কথা দিয়ে ছিল সকাল সাতটা সাড়ে সাতটায় আসবে। এসে গেছে দেড় ঘন্টা আগে। যদি পোত পথে বা আমার বাসায় কোন দুনাম্বারি করার মতলব এটেও থাকে এখনও প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেনি তারা। এটাই সুদাশের অংক। তাই ভোরবেলার আধো অন্ধকারে পৌঁছে গেছে বিশ্বস্ত মদনদার আস্তানায়। এবার যা পারে সে করুক। আমার কোন চিন্তা নেই।

সুদাশ আমার ঘরে পৌঁছে গেছে, সত্যি সত্যি তখন পোতো বিশ্বনাথ আশেপাশে পজিশন নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তারা তো ঘড়ি দেখছে। সুদাশ বলেছে সাতটা সাড়ে সাতটায় আসবে। বাঙালীর টাইম! আটটার আগে কিছুতে আসবে না। সাতটা বাজতে দশ মিনিট আগে কোমরে ছুরিচাকু গুলো খুঁজে নিলেই চলবে।

আমি যে খাল পাড়ে থাকি পোতোদের ঘর ঠিক উল্টো দিকে। আমার ঘরে কে আসে কে যায় ওরা দেখতে পায়। কিন্তু এখানে আসতে হলে আসতে হবে অনেকটা ঘুরে একটা পোল পার হয়ে। যাতে মিনিট দশেক সময় লেগেই যায়। পোতা আজ একটু আগে ভাগে ঘুম থেকে উঠে খালপাড়ে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছিল আর লক্ষ্য রাখছিল আমার ঘরের দিকে। হঠাৎ তার চোখে পড়ে সুদাশ এসে গেছে। সুদাশ চালাক ছেলে, সে বালিগঞ্জ-কসবা থেকে সোজা পথে এখানে যেভাবে আসা যায় সে ভাবে আসেনি। এসেছে ঘুরপথে, যে পথে কেউ আসা যাওয়া করে না। আমি তার মুখে এখানে আসার কারণ শুনে যা বোঝবার তা বুঝে ফেলেছি। আমার সঙ্গে কোন আলোচনা না করে, সোজা সুদাশের সাথে দেখা করে, আমার নাম বলে ওকে মালসহ ডেকে নিয়ে আসা-এর পিছনে রহস্য আর চক্রান্তের গন্ধ পাই। তাই ওকে আর বসতে বলি না, চা খেতে বলি না, সৌজন্য দেখাইনা। বলি–পরে সব বলব। এখন যত তাড়াতাড়ি পারিস এখান থেকে পালিয়ে যা। ব্যাপার সুবিধার নয়। সে সেয়ানা ছেলে। আর দাঁড়ায় না। খালপাড়ের উত্তর মুখে পথ ধরে উধাও হয়ে যায়। নাটকটা শুরু হল এরপর যখন পোতা আর তার দাদা দুজনে আমার বাসার সামনে এসে দাঁড়াল। জানতে চায় পোতো-দাদা তোমার সেই বন্ধুটা কই? আমি অবাক হয়ে বলি কোন বন্ধু?

–যে মেড ইন চায়না বেচবে বলেছিল।

সে তো আসেনি। আমি ন্যাকা গলায় বলি–কেন আসবে ফালতু।

–একদম ঢপ দেবে না। যখন পোতো আমার কাছে কাজ করত এখন সেই আগের মত গলায় পালিশ আর নেই। তখন সে ছিল আমার কর্মচারী। এখন সে এলাকার নামী দাদার ভাই। আর আমি অন্য এলাকা থেকে তাদের এলাকায় বাস করা এক নিরীহ প্রজাতির জীব। বলে সে আমি নিজের চোখে তাকে তোমার এখানে আসতে দেখেছি। আমি সেই একই কথা আবার বলি–আমার এখানে কেন আসবে?

–আমি তাকে আসতে বলেছিলাম।

–কেন?

–ওই মালটা আমরা কিনবো।

–তোরা মাল কিনবি তা আমার বাসায় কেন আসবে! তোদের বাসায় যাবে!

আমিও তো আগুনখেলালো ছিলাম। যদি আমি এখনও আগের আমি থাকতাম, যদি এলাকাটা রাজডাঙা না হয়ে যাদবপুর স্টেশন এলাকা হতো, ওরা কী আমার সামনে দাঁড়াতে পারত? এতক্ষণে ফাটা নাক নিয়ে বসে পড়ত না? এখন আমার মাথাটাও গরম হয়ে যায়। বলি তোরা কিনবি না কাড়বি সে তোরা জানিস। এর মধ্যে আমাকে জড়ালি কেন? আমি ওসবের মধ্যে থাকতে রাজি নই, তাই আমি তাকে চলে যেতে বলেছি। ও তো কসবায় থাকে, যা সন্ধ্যায় গিয়ে মালটা কিনে নিয়ে আয়।

এখনকার কথা নয় এসব কথা। তখন দুহাজার টাকা অনেক টাকা। তার চেয়ে বড় কথা মেড় ইন চায়না। যা কোমরে রাখলে নিজেকে উচ্চশ্রেণির গুণ্ডা বলে বুকের ছাতি ফুলে ওঠে। এবার বিশ্বনাথের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে যায়। এমন সহজ শিকার হাতের নাগালে এসে ফসকে যাবে সেটা সে আশা করেনি। এবং এটা হয়েছে একমাত্র আমার অসহযোগিতার জন্যে। গরগর করে বলে সে-কাজটা তুমি ভালো করোনি। এর ফল পাবে। আমাদের সাথে গদ্দারি করে কী ভাবে তুমি এখানে থাকো আমি দেখছি। যদি ভালো চাও ওকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছো বার করে নিয়ে এসো।

বিশ্বনাথের এদিন সময় খারাপ ছিল। যখন সে আমার উপর হম্বিতম্বি দেখাচ্ছিল সেটা দূর থেকে দেখছিল দুজন ছেলে। যারা কোন এক সময় বিশ্বনাথের হাতে মার খেয়েছিল। সেই রাগে বদলা নেবার বাসনায় এখন কানা অজিতের দলে গিয়ে ভিড়েছে। তবে এরা এখন পর্যন্ত কোন মাস্তান গুন্ডা নয়। সে হবে বিশ্বনাথকে মেরে। বলে দিয়েছে কানা অজিত–আমি আছি, ওকে মেরে হাত পা ভেঙে আমার কাছে নিয়ে আয়। ছেলে দুটোকে এদিকে আসতে দেখে পোতো আর বিশ্বনাথ সরে পড়ে। ওরা আমার কাছে জানতে চায়–কী ব্যাপার দাদা, ওরা এত তড়পাচ্ছিল কেন? পোত বিশ্বনাথ আমার উপর খেপে গেছে। ওরা যদি আমার উপর কিছু একটা করে তখন আমার লোকাল সাপোর্ট লাগবে। সেই কারণে ওদের কাছে সব খুলে বলি–দেখো ভাই, সুদাশ একটা ডেঞ্জারাস ছেলে। যদি আমার ঘরে তার কোন ক্ষতি হয় সে ভাববে এতে আমিও যুক্ত আছি। তখন সে কি আমাকে ছাড়বে? তোরা রিভালবার কিনবি কী কেড়ে নিবি অন্য জায়গায় গিয়ে কর না! কে বারণ করছে। শুধু আমাকে রেহাই দে। আমি একটা নিরীহ মানুষ। বউ বাচ্চা নিয়ে থাকি খেটে পিটে খাই। আমাকে বিপদে ফেলার কী দরকার!

আমার কথা শুনে তাদের চোখ বড় বড় হয়ে গেল! বিশ্বনাথ তাহলে অরজিনাল কিনছে! অংকটা অনেকটা এই রকম–লাদেনের হাতে পারমাণবিক বোমা মানে আমেরিকার বিপদ। তারপর তারা গিয়ে কানা অজিতের কানে কথাটা দেয়–খুব সাবধান। বিশ্বনাথ তলে তলে তৈরি হচ্ছে–অরজিনাল কিনছে। ওটা একবার হাতে এসে গেলে তোমার প্রাণ সংশয়। সেদিনইবিকালে কানা অজিত এল আমার কাছে। আর একবার আমাকে বলতে হল সম্পূর্ণ বিবরণ। মন দিয়ে সব শুনলো সে। রোগা, কালো পাঁচফুট উচ্চতার কানা অজিতের যে চোখটা ভালো সেই চোখটায় ফুটে উঠল সাপের মত শীতল দৃষ্টি। আমি ওই চোখ চিনি। এই কাহিনীর মধ্যে যে সব কথা কাহিনী আমি সচেতন ভাবে বর্জন করে গেছি, অকথিত সেই কাহিনীর পরতে পরতে এমন দৃষ্টি বেশ কজনার চোখে আমি দেখেছি। কেউ কেউ হয়ত আমার চোখেও দেখে থাকবে। তাই এখন আমার ভয় ভয় করে। বিশ্বনাথের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা হয়।

তখন চিবিয়ে চিবিয়ে আমাকে বলে কানা অজিত–তাহলে এখনও বিশ্বনাথ ওটা হাতে পায়নি।

বলি–না, পায়নি।

–টাকা নিয়ে গেলে পেয়ে যাবে!

–তা পেতে পারে। ওরা তো সুদাশের ঠেক জানে। গিয়ে নিয়ে আসতে কোন অসুবিধা নেই। এটা তো সুদাশের ব্যবসা।

–আমি যে তোমার কাছে এসেছিলাম কাউকে বোলো না। বলে কানা অজিত সেদিন চলে গেল। আর পরের দিন সন্ধ্যায় গুলি করে, চপার দিয়ে কুপিয়ে বিশ্বনাথকে তারই চোলাই ঠেকের সামনে খুন করে দিল। তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। রাজডাঙা ব্রিজের উপর বসেছিলাম আমি আর বাপি নামের একটা ছেলে। এই বাপি পরবর্তী কালে নোনাডাঙ্গা আন্দোলনের এক বিশিষ্ট নেতা হয়ে উঠেছিল। কানা অজিত আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে বিশ্বনাথের মদের ঠেকে গেল, তাকে মেরে ফিরে এল আর চলে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। মাত্র চব্বিশ ঘন্টা আগে আমাকে দেখে নেবে বলে ধমকে ছিল। চব্বিশ ঘন্টা পরে তাকেই দেখে নিল তার মামা।

বিশ্বনাথ তো মারা গেল, কিন্তু একা গেল না। তার পিছনে শুরু হয়ে গেল মৃত্যুর এক মিছিল। রামলাল বাজারের এপাশে লাল গেটে থাকত স্বপন নামে এক মাস্তান। তখন রুবি-গোলপার্ক অঞ্চলে প্রচুর জমি জায়গা বেচাকেনা হচ্ছে। চলছে ঠিকেদারি প্রোমোটারি সাপ্লাইয়ের রমরমা ব্যবসা। এ অঞ্চল যার অধিকারে থাকবে তারই পকেট ভারি হবে। এতকাল কানা অজিতের কারণে স্বপন এখানে নাক গলাবার সুযোগ পায়নি। এখন তার হাতে সুযোগ এল। কানা অজিত তখন পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পোত তারা দাদার বদলা নেবার জন্য ফুঁসছে। স্বপন পোতোকে ডেকে অর্থ অস্ত্র জনশক্তি দিল–মার শালা কানা অজিতকে। পোতো কানা অজিতের তো নাগাল পেল না। পেয়ে গেল বিশ্বনাথ মার্ডারে যুক্ত তার এক শাগরেদকে। গলার নলি কেটে তাকে বস্তায় ভরে ড্রেনে ফেলে দিল। এরপর কানা অজিত দলবল নিয়ে মেরে দিল পোতের দলের একজনকে।

এক সকালে ঘরে ঘুমাচ্ছি। সারারাতে অসহ্য গরমে চোখের পাতা এক করতে পারিনি হাত পাখা নাড়তে নাড়তে রাত কাবার। ভোরের দিকে চোখটা সবে লেগে এসেছে, হঠাৎ দরজায় জোর ধাক্কা। খোল দরজা। দরজা খুলে সারা শরীর কেঁপে গেল আমার। পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। তারা ঘরে ঢুকে আমাকে দেখল। আমার বউ বাচ্চা, চৌকির তলা সব দেখল। তারপর মাঝবয়সী এক অফিসার গর্জন করল তোদের রোজ এইভাবে বিরক্ত করব। একরাতও ঘুমাতে দেব না। যতক্ষণ না তোরা রিকশাঅলা মদনকে ধরিয়ে দিবি।

প্রথমে ভেবেছিলাম ওরা বোধ হয় আমাকেই খুঁজছে। পরে ভুল ভাঙল। আমি তো যাদবপুরের রিকশাওলা মদন। ওরা খুঁজছে কসবার রিকশাঅলা মদনকে। তখন আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।

সে যাই হোক, এর দিন সাতেক পরে আমি মার্ডার হয়ে গেলাম। কারা যেন আমার গলায় গামছায় ফাঁস দিয়ে মেরে বাইপাশে ফেলে এল। সে খবর পেয়ে যাদবপুর স্টেশন থেকে গণেশ গোপাল আমার বাসায় এল, সদ্য বিধবা আমার স্ত্রীকে সমবেদনা জানাবে বলে। এসে আমাকে ঘরে বসে তেজপাতা দেওয়া গুড়ের চা খেতে দেখে তারা তো ভীষণ অবাক কীরে দাদা তুই মারা যাসনি? তবে যে হোসেনপুরের নন্দু বলল রিকশাঅলা মদনকে মেরে বাইপাশে ফেলে দিয়েছে। তখন তাদের বলি–ও মদন কসবার।

মরা মানুষের কোন ভয় থাকে না। যত ভয় জীবিতের। আমার মনে তখন এক অন্য ভয় উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেবঙ্গোমাথা ফাতারকিক নেই। সব যেন পাগলা কুকুরতুল্য হয়ে গেছে। পাগলা কুকুরের আয়ু মাত্র দশদিন। কিন্তু সেই দশ দিনের মধ্যে যাকে কামড়ায় সে-ও মরে যায়। যদি কোন সময় পোতোর হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় এই সব খুনোখুনির আসল কারণ তো আমি। যদি আমি কানা অজিতের কানে রিভালবার বিষয়ক সংবাদটা না দিতাম বিশ্বনাথ মরত না। যদি কেউ পোতোকে সেটা বলে দেয়? তখন যদি পোতো মনে করে পাঁচ মাসে পাঁচটা যখন গেছে, আর একটা যাক! তখন আমার কী হবে? ওরা যদি বলে কয়ে আক্রমণ করে তখন একটা সামলে নেবার সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তা তো করবে না। যদি হামলা করে তা হবে অতর্কিত এবং অসতর্ক সময়ে। নাহঃ, এ বিপদের ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। এতে আমার পাবার কিছু নেই, তাহলে অজিতের দলে নাম লেখাতাম। তবে হারাবার অনেক কিছু আছে। আমার ঘর সংসার সব ভেসে যাবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম–এখান থেকে চলে যাব।

চলে যাব ভেবেছিলাম সকালে। আর দুপুরেই একটা ভ্যান রিকশা ডেকে সব মাল তুলে রওনা দিলাম যাদবপুরের দিকে এক নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। রাত আসছে। এক অদৃশ্য আততায়ী ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজডাঙায়। কে জানে সে এইরাতে আমার উপর হামলে পড়বে কী না! তার চেয়ে নিজের এলাকায় চলো। যেখানে বন্ধু চেনা শত্রু চেনা।

আমি ওখান থেকে চলে আসবার প্রায় একমাস পরে দশমীর দুর্গাপূজার দিন, দুপুরে কানা অজিত মার্ডার হয়ে যায়। এক চা দোকান থেকে তাকে ধরে পিটিয়ে মেরে পা ধরে সারা রাস্তাময় টেনেটেনে নিয়ে গিয়ে তার বাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে আসে তার শত্রুপক্ষ। মোট ছয়টি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে সেই ঘটনার।

যে ভ্যানে মালপত্র তুলেছি তাকে বলা আছে, আমার জন্য যা সময় নষ্ট হবে তার দাম আমি দিয়ে দেব। ভ্যান এনে দাঁড় করালাম সন্তোষপুর জোড়া ব্রিজের কাছে। এখানে তখন এত দালান কোঠা ছিল না। ছিল অগুনতি ঝুপড়ি। জোড়া ব্রিজের কাছে একটা রিকশা লাইন আছে। যার মধ্যে দুচার জন আমার চেনা। বললাম তাদের এখানে কোন বাড়িতে কী ঘর ভাড়া পাওয়া যাবে? সন্ধান জানা আছে? জানতাম পাওয়া যাবে। এক চেনা রিকশাঅলার নিজের বাড়িতে একখানা ঘর পেয়ে গেলাম মাসিক একশো টাকা ভাড়ায়। অন্য সময় হলে ভাড়া কম হোত। এখন ভ্যানের উপর মাল নিয়ে ঘর খুঁজছি ভাড়া তো একটু বেশি লাগবেই। তবু ভালো যে পাওয়া গেল, না হলে রেল স্টেশনে থাকতে হতো।

সে যা হোক, থাকার সমস্যা তো মিটল এখন রোজগারের কি হবে? ওখানে তো ঠিকাদার হয়েছিলাম, এখানে কী হবো? আবার সেই রিকশাঅলা?

একদিন–সেদিনটা ছিল যাদবপুরবাসির কাছে একটা স্বাদ-গন্ধ-বর্ণ বৈচিত্র্যহীন একেবারে নিস্তরঙ্গ দিন। সেদিন কোথাও তেমন কোন কলরব কোলাহল তর্ক বিতর্ক উত্তপ্ত আলোচনা এসব কিছুই ছিল না। বিন্টুদার সেই চা দোকানে খদ্দের আসছিল চা খেয়ে চলে যাচ্ছিল। অন্যদিনের মতো চায়ের পেয়ালায় তুফান ছিল না।

বিল্টুদা এক অতি দরিদ্র দোকানদার। সেই পাঁচ দশ বছর আগে দোকান যেমন ছিল আজও তাই আছে। দোকানের মধ্যে সেই ময়লাতে পাতা নড়বড়ে একখানা চৌকি। যার একটা পায়া পূর্ণ করা হয়েছে থান ইট সাজিয়ে। যার উপর কিছু বয়েম-চায়ের গেলাস সাজানো। একপাশে একটা কয়লার উনুন, আর বিন্টুদার একটা বসার চেয়ার। সব কিছু সেই আগের মতোই। তবে ইদানীং বিল্টুদা তার দোকানে কটা দৈনিক পত্রিকাও রাখে। তার ছেলে পত্রিকার হকার হয়েছে। এখান থেকে সে সাইকেলে পত্রিকা নিয়ে বাড়ি বাড়ি দিতে যায়।

সেদিন আমি একটার পর একটা পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল একটা সংবাদে নাটা মল্লিক অসুস্থ। এই লোকটাকে আমি চিনি। এর এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে যাদবপুর টিবি হাসপাতালে। সেখানে সে আসে। এ কোন কবি শিল্পী সাহিত্যিক নেতা অভিনেতা কিছুই নয়, একজন জল্লাদ। এর অসুস্থতার খবর একটা প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্রে এত গুরুত্ব দিয়ে কেন ছেপেছে, কৌতূহলে সংবাদটার উপর ঝুঁকে পড়ি। লিখছে বিশেষ সংবাদদাতা কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র ফঁসুড়ে নাটা মল্লিক সম্প্রতি গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁর হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ডাক্তারদের অভিমত এমতাবস্থায় তার পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন। এই কারণে আলিপুর কারা কর্তৃপক্ষ ভয়ানক অসুবিধার মধ্যে পড়েছেন। মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত দুই বন্দীকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রাপ্য সাজাদানের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

আমি ওই দুই বন্দীকে চিনি জানি। এই শহর কলকাতার মধ্যে বিশাল ধনবান পিতা এবং পুত্র। এরা একটি বিশাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিক। বাপ আবার সাহিত্যিক। সে তার লেখার জন্য রবীন্দ্র পুরস্কারও পেয়ে বসে আছে। এই স্বনামধন্য পিতা এবং পুত্র একটি অতি ঘৃণীত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার অপরাধে কোর্টের বিচারে মৃত্যুদণ্ডের সাজা পেয়েছে। যে হত্যাকাণ্ড নিয়ে সে সময় সারা দেশ তোলপাড় হয়েছিল। সবাই ছিঃ ছিঃ করেছিল।

বেশ কয়েক বছর ধরে এই মামলা চলে। সাক্ষী সাবুদদের জেরা করে সে সব তথ্য বের হয় তাতে জানা যায় এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আছে বাংলা সিনেমা জগতের এক লাস্যময়ী শরীর সর্বস্ব নায়িকা। সেই নায়িকার শরীরী প্রেমে পাগল হয়ে পুত্র তার স্ত্রীকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে প্রেমের প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তি পেতে চায়। বাপ সহযোগিতা করে লাশ লুকানো এবং প্রমাণ লোপাটের।

লোকগুলোর সাজা হয়েছে জর্জকোটে। এরপর তারা হাই কোর্ট এবং তার পরে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করবে। যতক্ষণ তারা “ন্যায় বিচার”, অর্থাৎ ছাড়া না পাচ্ছে–এটাই তাদের কাছে ন্যায়, ততক্ষণ তারা একটার পর একটা কোর্টের দরজার কড়া নাড়বে। টাকার কুমির এরা, বড় বড় ব্যারিস্টার দেবে, আরো কতভাবে টাকা খরচ করে রক্ষা পাবার চেষ্টা করবে আইনের থাবা থেকে। এবং শেষমেষ তারা সফলও হবে। এই দেশে কোন বড়লোক কখনো কোন অপরাধে জেলে থাকে না। সাজা ঘাটে না। টাকাই তাদের বেকসুর প্রমাণিত করে দেয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ–শঙ্কর গুহ নিয়োগী হত্যা মামলা। সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের খুনিরা সাজা পেল না।

তবে আমার তখন এতদূরের ব্যাপার স্যাপারহাইকোর্ট-সুপ্রীম কোর্ট এত কথা মাথায় ছিল। আমি জেলে ছিলাম। জেলখানার অফিসারদের খুব ভালোভাবে চিনি। তাই তৎক্ষণাৎ যা মনে এসেছিল তা হল–ওই দুই কুখ্যাত খুনি কারা কর্তৃপক্ষকে হাত করে ফেলেছে। পি.জি. হাসপাতালের ডাক্তার আর ফঁসুড়েনাটা মল্লিককেও কিনে নিয়েছে। সবাই মিলে তাই ওদের ফাঁসি যাওয়া থেকে বাঁচাবার একটা ষড়যন্ত্র সাজাচ্ছে। যার প্রথম ধাপ নাটার অসুস্থতা।

আমি জেলখানায় থাকতে শুনেছিলাম যে যদি কারো ফাঁসির হুকুম হয় সাজা ঘোষণার দু বছরের মধ্যে জেলকর্তৃপক্ষকে দণ্ড কার্যকর করে ফেলতে হবে। যদি কোন কারণে তা না করতে পারে, তাহলে মানবিক কারণে বন্দীর ফাসি মকুব হয়ে যাবে। যে মানুষের প্রতিটা দিন রাত মৃত্যু ভয় বুকে নিয়ে কাটাতে হয়েছে, তার যে কঠিন সাজা ভুগতে হয়েছে, এরপর এদেশের আইন আর তার প্রাণ কেড়ে নেবে না। ফাঁসির সাজা মকুব করে যাবজ্জীবন সাজা দেবে।

অবশ্য এটা ঠিক যে এই “মানবিক’আইনও সবার প্রতি সমান সদয় হয় না। এর জন্যও ধনবান হবার দরকার আছে। আইনকে “মানবিক” ন্যায় পরায়ণ আর “সুবিচার” বানাবার প্রতিটা ধাপে ধাপে প্রচুর টাকার খেলা চলে। যে তা না পারে চৌদ্দ বছর জেল, যা একটা যাবজ্জীবন সাজার সমতুল, এর মধ্যে আট বছর মাথার উপর ফাঁসির দড়ি ঝুলে থাকা, তারপরও কেউ কেউ ধনঞ্জয় হয়ে যাবে। সব অপরাধের চেয়ে যেটা তার সবচেয়ে বড় অপরাধ হয়ে দেখা দেবে সেটা হল দারিদ্র্য, অঢেল অর্থ খরচের অক্ষমতা।

আমার তখন ধারণা হয় যে ওই পিতা এবং পুত্রকে নিশ্চয় তার উকিল আইনের এসব গূঢ় তত্ত্ব বুঝিয়ে বলেছে। আর তাদের পক্ষের কেউ গিয়ে নাটা মল্লিকের সাথে দরদাম করে নিয়েছে। এক দু বছর অসুস্থতার মজুরি। নাটা মল্লিক কোন টাকা ছুঁলে শরীর জ্বলে এমন রামপাঠা” তো নয়, সে এক জল্লাদ যে টাকার জন্য মানুষ মারে। যদি মানুষ না মেরেই দুগুণ চারগুণ বেশি টাকা পেয়ে যায়, হাসপাতালের বেডে গিয়ে শুয়ে পড়তে তার অসুবিধা কোথায়?

আর আমাদের দেশের বেশিরভাগ ডাক্তার, যারা মানুষের কিডনি ধোঁকা দিয়ে বের করে নিয়ে বেঁচে দেয়, সে যদি বেশ কিছু টাকার লোভে নাটাকে এটা সেটা পরীক্ষার পর বলে দেয় হার্ট খুব খারাপ, বিশ্রাম এবং চিকিৎসা দরকার, তাতে অবাক হবার কিছু নেই।

পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র ফঁসুড়ে নাটা মল্লিক, সে যদি ফাঁসি না দিতে পারে, কঁসির আসামির ফাঁসি হবে কী করে? মানুষ মারা তো কোন সোজা কাজ নয়। এমনিতে ওই বাপ ছেলের বছর খানেক কি বছর দেড়েক জেল বাস হয়ে গেছে। আর একটু সময় টালবাহানায় কাটিয়ে দিতে পারলেই ফাঁসি রদ হয়ে যাবে। একবার যদি যাবজ্জীবন সাজা হয়ে যায় যা মোটামুটি ভাবে বিশ বছর, তাকেও কমিয়ে আনবার অনেক উপায় আছে। এক তো চার রবি দুই শনি–এমনিতে মাসে ছয়দিন ছুটি। তার মানে চব্বিশ দিনে মাস। তার উপর বন্দীর ভালো আচরণের জন্য বড় জমাদার একদিন, জেলার চারদিন, জেল সুপার সাতদিন সাজা কমাতে পারে। একে বলে রেমিশন। আবার যদি কোনদিন কারামন্ত্রী জেল ভ্রমণে আসেন, একমাস করে রেমিশন, স্বাধীনতা দিবস, গান্ধীজির জন্মদিন সহ সরকারি যে সব ছুটি, এসবও আছে।

তবে সবচেয়ে যাতে বেশি সাজা কমে সেটা হল-রক্তদান করে। প্রথমবার রক্তদান করলে কুড়িদিন, তারপরের বার বাইশদিন তারপরে আবার দিলে চব্বিশদিন এভাবে প্রতিবার দুদিন করে ছুটি বেড়ে যাবে। এখানে একটা মজা আছে–জেলে কিছু বন্দী থাকে যাদের জেলের বাইরে তেমন অর্থবান আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। এদের জেলখানায় খুব কষ্ট। তারা বিড়ি মুড়ি চিড়ে গুড় লুঙ্গি এই সব কেনার জন্য রক্ত বিক্রি করে। তখন সেই গরিব জেলবন্দীর সাথে পয়সাঅলা কোন বন্দী চুক্তি করে। তুমি আমার নামে আমার কেস টিকিটে রক্ত দেবে। যা তোমার দরকার সেই মাল আমি এনে দেব। এই ভাবে রামের নামে শ্যাম রক্ত দেয়। রামের সাজা কমে আর শ্যাম পেয়ে যায় কিছু বাড়তি টাকা। কিছু জেলের ডাক্তারও পেয়ে থাকে। আর রামবাবুর প্রতি দুমাস বারোদিন পরে পরে একবার করে রক্তদান কার্যক্রম চলতে থাকে। সাজা কমতে থাকে।

আমার তখন মনে হয়–নাটা হাসপাতালে গেছে আর কারা কর্তৃপক্ষ একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে দায়মুক্ত হয়ে বস্তে আছেআইন ফঁক ফোকর খুঁজে একটা কোন ষড়যন্ত্র চলছে শয়তানগুলোকে বাঁচিয়ে দেবার জন্য। এটা হতে দেওয়া যাবে না। ফঁসুড়ে নেই, এই অজুহাতে বদমাশগুলোকে ছেড়ে দেওয়া অন্যায় হবে। আর কেউ যদি না দেয় ও দুটোকে আমি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেব।

আমি এক সময় নকশালদের সঙ্গে ছিলাম। “নকশাল” ছিলাম না। নকশাল হওয়া অত সহজ না যে, যে কেউ তা হয়ে যাবে। মানুষকে যে গভীর ভাবে ভালোবেসে নিজের জীবন দিতে পারে সে-ই নকশাল। যে শুধু মানুষ মারার নেশায় মানুষ মারে সে আর যাই হোক, নকশাল নয়। এটা একটা বিপ্লবীর সমার্থক শব্দ। তবে সেই সময় একটা কথা শুনেছিলাম যে কমিউনিষ্ট শ্রেণি শত্রুর রক্তে হাত রাঙায়নি সে কমিউনিষ্টই নয়।

এখন আমার নিজস্ব বিশ্লেষণ বলছে, ওই বাপ আর ছেলে অবশ্যই শ্রেণি শত্রু। অন্ততঃ পক্ষে এদের মেরে পুরো না হোক কিছুটা কমিউনিষ্ট নিশ্চয় হতে পারি এবং ওই দিশায় এক পা এগিয়ে থাকা যায়।

তাই আমি সেই দুপুরে হাঁটা দিলাম জেলগেটের দিকে। যখন সেই আলিপুর প্রেসিডেন্সি জেলের গেটে গিয়ে পৌঁছালাম তখন জেলবন্দী মানুষের আত্মীয় বন্ধুরা সব সাক্ষাৎকার–যাকে জেলের ভাষায় বলে ইন্টারভিউ-তা করতে আসা শুরু করেছে। গেটের সামনে একটা বড় লেটার বক্স, যে যার সাথে দেখা করতে ইচ্ছুক, নাম, বাপের নাম, ঠিকানা লিখে সেই বাক্সে ফেলছে।

ওখানে একজন লোক বসে আছে। যে পয়সা পেলে চিঠি লিখে দেয়। যারা নিরক্ষর একে দিয়ে চিঠি লেখায়। আমি এখন আর নিরক্ষর নই, লিখতে পারি। কিন্তু আমার কাছে কাগজ কলম নেই। তাই তাকে বলি আমাকে কাগজ কলম দাও, আমি লিখে নেব।

বলে সে–“আমি লিখি কী তুমি লেখ দু টাকা লাগবে”। কোন উপায় নেই তাই পকেটের শেষ সম্বল দুটাকা দিয়ে কাগজ কলম নিয়ে সাহিত্যের ভাষায় জেলার বাবুর নামে একটা লম্বা চিঠি লিখে ফেলি। ঠিক কী লিখেছিলাম এখন আর মনে নেই তবে এইটুকু মনে আছে–

মাননীয় জেলারবাবু

আজ সংবাদপত্র মারফত অবগত হলাম যে, জেলখানার দুই কুখ্যাত অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবার জন্য কোন জল্লাদ পাওয়া যাচ্ছেনা। আমি মনে করি এই ধরনের ঘৃণ্য অপরাধীর একদিনও পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার কোন অধিকার নেই। যে বাতাসে এদের নিঃশ্বাস পড়বে সে বাতাস বিষাক্ত হয়ে যাবে। যে মাটিকে এরা স্পর্শ করবে সে মাটি আর ফসল দেবে না রুক্ষ শুষ্ক বন্ধ্যা হয়ে যাবে।

তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দণ্ড কার্যকর করা হোক। আমি এই কাজে সহযোগিতা করতে সম্মত আছি। আমি সানন্দে ফাঁসিটি সম্পাদন করে দেব। আমাকে ওই কাজে নিয়োগ করলে, বাধিত থাকব….।

এরপর চিঠি লেটার বক্সে ফেলে কখন ডাক আসে সেই অপেক্ষায় বসে থাকি। আমার যে জীবনচর্চা তাতে কোথাও কোনদিন কোন বুদ্ধিবৃত্তি চালাকি চাতুরির প্রকাশ-বিকাশ ছিল না। সব অতি মোটা দাগের। সেদিও আমার সেই বোকামো করা হয়ে গেছে। এই চিঠির বাকসো শুধুমাত্র জেলবন্দীদের জন্য, অফিসারদের জন্য নয়। এই বাক্সে যদি কেউ জেলারবাবুর নামে চিঠি ফেলে যায় বুঝতে হবে সে শত্রুজেজাবাবু অপমান করঙ্গোয়। আর না হয় ঘনিষ্ট কোন বন্ধু সে রসিকতা করেছে। আর তা নাহলে বোকা বুন্ধু হাঁদারাম। আমি কী, তা আমি চিঠি ফেলে বলে দিয়েছি।

চিঠি একজন নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে ডেপুটি জেলারের টেবিলে। তিনি চিঠি দেখে একে একে বন্দীদের ডাকতে পাঠাবেন। হঠাৎ তিনি জেলার বাবুর নাম আসামির চিঠির মধ্যে দেখে চমকে উঠলেন। নিচু গলায় সহকর্মীদের সাথে একটু রসিকতাও করলেন সম্ভবতঃ। তারপর এক সেপাই পাঠিয়ে সোজা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন অফিসে। সেখানে জমাদার, কয়েকজন সেপাই, এক দুজন শিক্ষিত—দীর্ঘদিনের বন্দী, অফিস কর্মী বসে আছে। সবারই চোখ হাসছে কিন্তু মুখ গম্ভীর।

আমি তখনো জানি না আমাকে নিয়ে একটা রসিকতা হবে।

বলেন ডেপুটি জেলার–এই চিঠি তোমার?

 বলি–হ্যাঁ স্যার।

–কী কাজকর্ম করা হয়?

–আজ্ঞে তেমন কিছু না। যখন যা পাই তখন তা করি।

–কোন মানুষকে কোনদিন মেরেছো?

–আজ্ঞে এ সব কথা কেন!

–আমি বলতে চাইছি তোমার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে কী না।

–বিনীত গলায় মাথা নিচু করে জানাই–আছে।

–গুড। বলেন তিনি “যে কোনো কাজে সেইসব লোকই অগ্রাধিকার পায় যাদের এক্সপিরিয়েন্স থাকে। তা কী ভাবে মেরেছো? না না কোন ভয় নেই। যাদের দেখছো সব ওই কাজ একটা দুটো করেই এখানে এসেছে।”ওনার স্বরে একটা যেন অবিশ্বাসের আভাস টের পাই। তিনি ঠিক আমার কথা সত্য বলে মানতে পারছেন না।

বলি–আমি তো বলছি আমার অভ্যেস আছে, আমাকে সুযোগ দিয়ে দেখুন, ঠিক পারব। ওদের মারতে আমার হাত পা বুক কাঁপবে না। সত্যি বলছি।

একটু থেমে সবার দিকে চোখ ঘুরিয়ে আবার বলেন তিনি-আমি মেরেছি আমি পারব এসব কোন কথা নয়, তোমাকে পরিষ্কার করে বলতে হবে ফাঁসি দিয়ে কাউকে মেরেছো কী, না! মারলে কবে কোথায় কাকে।

বলি–না স্যার ফাঁসি দিয়ে কাউকে মারিনি। শুধু একজনকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে টেনেছিলাম। আর একটু হলে মরে যেত।

–ওটা পুরো করতে হবে। ফুল হ্যাং। পারবে? হাত পাকিয়ে এসো, তখন বিবেচনা করা হবে তোমার আবেদন বিষয়ে।

আর কোন কথা নেই। সব কথা শেষ। যখন আমি জেল গেট থেকে বাইরে বের হচ্ছি পিছনে টের পাই তুমুল হাসির রোল। ওরা হাসছে আমাকে নিয়ে। আমি একটা হাসির খোরাক হয়ে গেছি সবার কাছে।

এখন আমার কাছে কোন পয়সা নেই। যে দু টাকা ছিল চিঠি লিখতে চলে গেছে। তাই হাঁটা দিই সামনের দিকে। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে যাদবপুর মাইল দশেক পথ।

কালীঘাট ব্রিজ থেকে নেমে সবে বাঁদিকে বেঁকেছি দেখা হয়ে গেল শ্যামা কালোনির সুবোধ চক্রবর্তীর সাথে। উনি শিক্ষক সেটা জানতাম, জানতাম না ওনার স্কুলটা এখানে। তিনি অনেকদিন পরে আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন-কেমন আছিস? আর যে দেখি না? বই টইও আর দিসটিস না! লেখালেখিটা আছে, না গেছে?

এতদিন দেখা না হবার কারণ বলি তাকে। বলি–বিয়ে করেছি, একটা মেয়ে হয়েছে। আর আমার কোন কাজকর্ম নেই।”কালি কলম মন, লেখে তিন জন”মনটা এখন বিক্ষিপ্ত। এই অবস্থায় লেখাপড়া কি করে হবে! শেষে তাকে এ-ও বলি, যদি একটা বাধা ধরা কোন কাজ পাই, দানাপানির সমস্যা যদি মেটে তবে আবার লেখালেখি হবে। না হলে আর পারা যাবে না।

বলেন তিনি কি কাজ করবি বলতো! আজকাল কাজকর্ম পাওয়া খুবই…..। তার কথা শেষ করার আগে বলি আমি আমার কোন বাছ বিচার নেই। ধরাবাধা যে কাজ পাবো তাই করব। সে যদি মেথর জমাদারের কাজও হয় তাই সই। শুধু দুবেলা খেতে পারলেই হল। ওই চিন্তা দুর হলেই নিশ্চিন্তে বসে লিখতে পারব। আর আমি যদি লিখতে পারি, কোন নিন্দা ঘৃণা নোংরা ঘাটার কষ্টও আমাকে কষ্ট দিতে পারবে না। এখন আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট যে লিখতে পারছি না।

কিছুক্ষণ ভেবে শেষে বলেন তিনি–আমি তোকে একটা চাকরি দিতে পারি। যদি সত্যি সত্যি তুই করতে রাজি থাকিস।…. সরকারি!

–চাকরি! কী চাকরি?

–যা তুই বললি! আমার দিকে তাকিয়ে গলার স্বরে খানিকটা কুণ্ঠা মিশিয়ে বলেন তিনি–তুই বললি আমি বললাম। আমার স্কুলে ওই পোষ্টে একজন লোক লাগবে। যদি করিস লাগিয়ে দিতে পারি।

এটা সেই সময় যখন মেথর জমাদারের শোভন নাম–সাফাই কর্মী হয়নি। তখনও কলিকাতা কর্পোরেশনের সাফাই কর্মী হবার জন্যে দলে দলে বামুন কায়েত বদ্যিদের বেকার ছেলেগুলো লাইন দিয়ে দাঁড়ায়নি। তখনও মেথর ঝাড়ুদার সমাজের চোখে পূর্ণ মানুষ নয়। যাদবপুর টিবি হাসপাতালের বড় গেটের সামনে কালির চা দোকানে ঢোকবার অনুমতি পায়নি। বাইরে বসে ভঁড়ে চা খায়। আমি জানি কি অপমানিত সে জীবন! তবু বলি–করব ওই কাজ।

–আর একবার ভেবে দ্যাখ। বলেন সুবোধ চক্রবর্তী।

ভাববার মত সময় আমার হাতে নেই। একটা করে দিন যাচ্ছে আর অভাবের হামুখ একটু একটু প্রশস্ত হচ্ছে। এর থেকে নিষ্কৃতি চাই। আর নির্ভাবনায় বসে লিখে যেতে চাই। যদি কোনদিন কোন উল্লেখযোগ্য রচনা তৈরি করতে পারি তখন কেউ মনে রাখবে না আমি কী ছিলাম।

বলেন সুবোধ দা–তোকে তিন মাস ক্যাজুয়াল থাকতে হবে। তখন মাইনে একটু কম পাবি। একবার পার্মানেন্ট হয়ে গেলে মাইনে হবে সাড়ে সাতশো। সি.এল.মেডিকেল লিভ, পি.এফ, বোনাস, প্রাচুইটি, পেনশন সব পাবি। ধীরে ধীরে তিনি সেইশত বছরের প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুপ্ত ইতিহাস ব্যাখ্যা করেন। এখানে বিশাল বিশাল বিল্ডিং আছে। শিক্ষক অশিক্ষক প্রচুর কর্মচারী আছে। প্রচুর ছাত্র আছে। সব আছে, যা যা একটা মহা বিদ্যালয়ে থাকা দরকার। শুধু নেই শিক্ষার পরিবেশ। স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা সব পরস্পর বিরোধী দুটি রাজনৈতিক দলের সদস্য সমর্থক। যে দল দুটোর মধ্যে নীতি এবং সিদ্ধান্তের সঠিক বেঠিক নির্ণয় হয় পাড়ায় পাড়ায় বোমা পাইপগানের মাধ্যমে। রোজই খবরের কাগজের পাতা জুড়ে থাকে দু দলের হতাহতের খবর। বাইরের সেই লড়াই এই সারস্বত অঙ্গনকে কুস্তির আখাড়া বানিয়ে ছেড়েছে। এখন পড়াশোনা গেছে মায়ের ভোগে। কোক পানি দেবে পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলে তারই প্যাঁচ পয়জার।

বলেন সুবোধদা–স্কুলে সর্বমোট এখন বত্রিশ জন স্টাফ। ষোলজন আমাদের পনের জন ওদের দলের। একজন না আমাদের না ওদের। সে যেদিকে লাভ দেখে সেদিকে ঝুঁকে যায়। সে আমাদের দিকে না এলে বিশেষ সমস্যা হয় না, সমস্যা হয় ওদের দিকে চলে গেলে। দু দিকের লোক সংখ্যা তখন সমান সমান। তোকে অনেক দিন ধরে চিনি। বিশ্বাস করি, তুই আর যা করিস ভোটাভুটির সময় কোনদিনই ওদের দিকে যেতে পারবি না। তোর সমর্থন বামপন্থীদের পক্ষেই থাকবে। তোকে চাকরিটা পাইয়ে দিতে পারলে সেটা হবে আমাদের পক্ষে সবচেয়ে বড় লাভ। তখন আমরা সতের জন হয়ে যাবে। এরপর স্কুলের যে কোন বিষয়ে গরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে আর আমাদের কোন অসুবিধা হবে না।

দু তিনদিন পরে উনি আমাকে অন্য একজন মাষ্টার যিনি নাকি একটি সুবিধাভোগী চরিত্রের লোক সেই রথীন বাবুর সঙ্গে হেডমাষ্টারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সুবোধদা নিজে নিয়ে গেলে হেডমাষ্টার আমাকে বুঝে যাবে বামপন্থী বলে তখন আর নিয়োগ না-ও করতে পারে। সতর্কতার কারণ সেটাই। একবার উঁচ হয়ে ঢুকে যেতে পারলে পরে স্বরূপ ধরা যাবে। বলে দিলেন সুবোধ দা–ঢুকে পড়বার পর তোর প্রথম কাজ হচ্ছে হেড মাষ্টারকে সন্তুষ্ট রেখে চলা। যদি দরকার মনে করিস আমাদের বিরুদ্ধেও একটা দুটো কথা বলে দিবি। এটা হচ্ছে একটা কৌশল। মনে রাখিস, তোর ভবিষ্যৎ হেড মাষ্টারের হাতে। নিয়মানুসারে পরিচালন সমিতির কাছে সে-ই তোর নাম প্রস্তাব করতে পারে। অন্য কারও সে অধিকার নেই। যেই সে তোর নাম প্রস্তাব করে দেবে, পরিচালন সমিতি অনুমোদন দিয়ে দেবে। পরিচালন সমিতির সেক্রেটারি আমাদের লোক। তোর বিষয়ে যা যা বলার আমি তাকে সব বলে ঠিক করে রাখব।

বিশেষ কোন অসুবিধা হয়নি। রথীনবাবু আমাকে হেডমাষ্টারের সামনে নিয়ে যাবার পর আমি কাজটা পেয়ে গেলাম। এ তো এমন কিছু আহামরি কাজ নয়। তা ছাড়া ওনাদের তখন একজন জমাদারের খুবই দরকার ছিল। জমাদার বিহনে স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যে জমা হয়ে আছে স্তূপাকার জঞ্জাল। পায়খানা প্রস্রাবখানার অবস্থা ভয়াবহ যেন নরক তুল্য, পুঁতিগন্ধময়। কলতলায় জল জমে জমে শ্যাওলায় সবুজ। যে কোন সময়ে যে কেউ পা পিছলে দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। এমন বিপন্ন সময়ে আমাকে ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নই ওঠে না। পরের দিন থেকে আমি ঝাটা বালতি অ্যাসিড ফিনাইল নিয়ে নেমে পড়লাম সেই সৃষ্টির উন্মেষক্ষণ থেকে স্তূপাকার হয়ে ওঠা মল, বিষ্ঠা পায়খানা, ভেদ দাস্ত গু, বাহ্যে, নিহারা, উবদ্ধ, টাট্টি, নাদ, নাদি, শমল, শকৃৎ, উচ্চার–আদির টিবি পাহাড় পর্বতের মাঝখানে। যে সব ঢিবি পাহাড় আবার কালের করাল থাবায় কিছু ধ্বসে গলে পচে হেজে মজে নদী নালা ডোবা পুকুরে পরিণত। সেই জলে নালা ডোবায় জন্ম নিয়েছে লক্ষ কোটি সাদা সাদা প্রাণ। প্রাণময় পৃথিবীর ক্ষুদ্র সন্তান। যারা দলে দলে জননী জন্মভূমি পরিত্যাগ করে পরিব্রাজকের মত রওনা দিয়েছে বিশ্ব পরিক্রমায়।কলঘর, জল নিকাশিনালা পেরিয়ে পৌঁছে গেছে সিঁড়ির তলে, বারান্দায়, ক্লাশরুমে, অফিসে। সময়টা বর্ষাকাল বলে তাদের বিচরণ অবাধ এবং অনুকুল। ছাত্র এবং শিক্ষকদের জুতোয় পরিবহন হচ্ছে এইসব বিষ্টাকীট। এই পুঁতিগন্ধময় পুন্নাম নরককে পরিচ্ছন্ন–শিশুদের বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার মহান দায়িত্ব আজ সমর্পিত হয়েছে আমার কাঁধে। এর জন্য প্রতিমাসে এখন আমার মাইনে মিলবে-দুশো টাকা, পার্মানেন্ট হলে গেলে সাড়ে সাতশো।

মনকে বোঝাই, মনরে, কোন কাজ নেয় যে সৈনিক রণাঙ্গনে বসে রাইফেল চালায় আর ঘরে বসে যে তার জন্য পুই চচ্চড়ি রাধে কেউ কারও চেয়ে কম বা ছোট নয়। ক্লাশরুমে যে মাষ্টার বেত চালায়, আর যে জমাদার পায়খানায় ঝাটা চালায়–সমাজে সবাই সমান।সবাইমহান। সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই মানুষেরা মানুষ থেকে শিক্ষিত হয়। গটগট করে বিদ্বান লোকের মত কথা বলে। কাজেই কোন কাজই ফ্যালনা নয়। কাজকে ভালোবাসতে শেখো। চালাও ঝাটা। তুমি তো মহাত্মা গান্ধির জীবনী পড়েছ। উনিও তো পায়খানা পরিষ্কার করতেন। তবে?

দিন গোনা শুরু হয়ে গেল আমার। তিনমাস, মানে নব্বই দিন। তারপরই ভাগ্য ফিরে যাবে আমার।মিলবে খেয়ে পড়ে বাঁচবার মত বেতন। আটঘন্টা কাজের পরে ষোলঘন্টা মিলবে নিশ্চিন্তে লেখার অবসর।নাকে গামছা বেঁধে হাতে আঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি মল মূত্রের মহা সমুদ্রে। হামা দিই, হাটি, সাঁতারকাটি। এইভাবে তিনমাস পেরিয়ে ছয়মাস তারপর নয় মাস শেষে বছর ঘুরে গেল। প্রতি মাসে পরিচালন সমিতির বৈঠক বসে, বহু কথা হয়। শুধু হয়না আমার কথা। প্রতি বৈঠকের আগে হেডস্যার আমাকে বলেন–এবার তোমার ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলব এবং প্রতিবারই ভুলে যান। আমার ব্যাপারটা তো তুচ্ছ একটা ব্যাপার, বড় লোকদের কী করে মনে থাকে?

এর মধ্যে এসে গেল স্কুলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। সেই সময় সুবোধদা আমাকে বললেন–”এবার আমরা স্কুল থেকে একটা পত্রিকা বের করব। সব ভার আমার উপর পড়েছে। তুই একটা লেখা দিস তো?” নাচের পা আমার বাজনা শুনলে আর স্থির থাকতে পারে না। দুলে ওঠে আর আমাকেও দুলিয়ে দেয়। সেদিন আনন্দে উত্তেজনায় বাস্তব বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল। বুঝতে পারলাম না মোহের বশে কী বিরাট ভুল হয়ে যাচ্ছে। আর তার জন্য কী ভীষণ মূল্য দিতে হবে। বসে গেলাম কাগজ কলম নিয়ে। আচার্য নাম দিয়ে লিখে ফেললাম একটা ছোট গল্প। যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছেন একজন সৎ নিলোভ নির্মল শিক্ষাব্রতী দরিদ্র স্কুল মাষ্টার। অকৃতদার এই মাষ্টার মশাই তার ছাত্রদের পুত্রসম ভালোবাসেন। বিনা পারিশ্রমিকে তাদের টিউশন দেন। স্বপ্ন দেখেন–আমার ছাত্ররা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অধ্যাপক কবি সাহিত্যিক হবে। হবে জনগণমন অধিনায়ক। এগিয়ে নিয়ে যাবে দেশকে। আর ভারত একদিন জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *