জুলিয়াস নিশোর ঘুম ভাঙল ভোর পাঁচটায়। তিনি অবশ্যি তা বুঝতে পারলেন না। তাঁর ঘড়িটি নষ্ট হয়ে গেছে। ঘড়ি ছাড়া এখানে সময় বোঝার অন্য কোনো উপায় নেই। মাথার অনেক ওপরে ছোট্ট একটি ভেন্টিলেটার আছে। সেখান থেকে তেমন কোনো আলো আসে না। এলেও তা ধরা যায় না, কারণ ঘরে দিন-রাত্রি দু শ পাওয়ারের একটি বাতি জ্বলে। তিনি বাতিটি রাতের বেলা নিভিয়ে দেবার জন্যে মাওয়াকে বলেছিলেন। মাওয়াবিনীত ভঙ্গিতে বলেছে, কাল থেকে বাতি রাতের বেলা জ্বলবেনা। কিন্তু ঠিকই জ্বলেছে। একই অনুরোধ দ্বিতীয় বার করতে তাঁর ইচ্ছা হয় নি।
মাওয়াকে তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। তিনি যা বলেন, সে তাতেই সঙ্গে-সঙ্গেই রাজি হয় কিন্তু রাজি হওয়া পর্যন্তই। একটা ঘড়ির কথা বলেছিলেন, মাওয়া সঙ্গে-সঙ্গে বলেছে, কাল আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসব। তিনি বলেছিলেন, আজ দেওয়া যায় না?
ঠিক আছে স্যার, নিয়ে আসছি। এক ঘন্টার মধ্যে আসব।
তিনি অপেক্ষা করেছেন। সে আসে নি। মানুষ পশু না। তার চরিত্র এমন হবে কেন? ঘড়ি সে দেবে না, এটা স্পষ্ট করে প্রথম বারেই কি বলে দেওয়া যেত না?
জুলিয়াস নিশো ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। এখন ঠাণ্ডা লাগছে। সূর্য ওপরে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে তাপ বাড়তে থাকবে। বাতাস থাকবে না। অসহনীয় উত্তাপ। তারপর রাতের বেলা আবার শীত নামতে শুরু করবে। সেই শীতও অসহনীয়। আসলে বয়স হয়েছে, এই বয়সে শরীর অশক্ত হয়ে পড়ে। সামান্য শীতও শরীরের হাড়ে গিয়ে বেঁধে।
নিশো বিছানা থেকে নামলেন। মাওয়াকে ধন্যবাদ দিলেন মনে-মনে, কারণ সে একটি কাজ করেছে। লেখার জন্যে টেবিল-চেয়ার দিয়েছে। সময় কাটানোর জন্যে তিনি একটি লেখায় হাত দিয়েছেন। নাম দিয়েছেন কালো মানুষ: সাদা মানুষ। নামটি প্রথম দিন ভালো লেগেছিল, দ্বিতীয় দিনে লাগে নি। দ্বিতীয় দিনে নাম দিলেন—এক কালো মানুষ। সেই নামও এখন পছন্দ হচ্ছে না। তিনি আজ সেই নাম কেটে লিখলেন কালো মানুষ। ঘোট নামই ভালো। কিন্তু লেখা এগুচ্ছে না। তিনি ভেবে রেখেছেন খুব হালকা ধরনের একটি লেখা লিখবেন। নানান রকম রসিকতার মধ্য দিয়ে কালো মানুষের দুঃখ তুলে আনবেন। কিন্তু লেখা ভারিকি ধরনের হয়ে যাচ্ছে।
নিশো কলম হাতে দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। তাঁর ক্ষুধাবোধ হচ্ছে। মাওয়া কখন আসবে কে জানে। গরম এক কাপ কফি খেলে হত।
মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্ৰণাও হচ্ছে। চোখের সামনে দু শ পাওয়ারের বাল্ব নিয়ে ঘুমানো মুশকিল। আজ আরেক বার অনুরোধ করে দেখলে কেমন হয়?
ফোর্টনকের মাঠে সম্ভবত পিটি হচ্ছে। তালে-তালে হাত-পা ফেলার শব্দ হচ্ছে। এই শব্দগুলি শুনতে ভালো লাগে। তিনি দীর্ঘ সময় মন দিয়ে শব্দগুলি শুনলেন। মনেমনে সৈন্যদের তালে-তালে হাত-পা ফেলার দৃশ্যটি দেখতে চেষ্টা করলেন। সারি বেঁধে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পরনে খাকি হাফপ্যান্ট। গায়ে ধবধবে সাদা গেঞ্জি। সূর্যের আলো এসে পড়েছে তাদের ঘামে-ভেজা চকচকে কালো মুখে। কালো রঙের মতো সুন্দর কি কিছু আছে?
তাঁর মাথার যন্ত্রণা ক্রমেই বাড়ছে। তিনি আবার এসে বিছানায় শুলেন। হাত বাড়িয়ে একটি মোটা বই নিলেন। পড়বার জন্যে মাওয়া দিয়ে গিয়েছে। নিতান্তই বাজে বই। একটি কালো ছেলের প্রেমে পড়েছে সাদা মেয়ে। মেয়েটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে জঙ্গলে। মেয়ের বাবা তাকে ধরবার জন্যে বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে বন ঘিরে ফেলেছে। অসম্ভব সব ব্যাপার। পাতায়পাতায় রগরগে সমস্ত বর্ণনা। মেয়েটি ছেলেটিকে চুমু না-খেয়ে সেকেন্ডও থাকতে পারছে না। এবং চুমু খাবার সময় ছেলেটির হাত চলে যাচ্ছে বিশেষ-বিশেষ জায়গায়।
নিশো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। এ-জাতীয় বই পড়বার বয়স তাঁর নেই। শারীরিক বর্ণনায় তিনি এখন আর উত্তেজনা বোধ করেন না।
মাওয়া যখন ঘরে ঢুকল, তখন নিশো ঘুমুচ্ছেন। তাঁর গা ঈষৎ উষ্ণ। রাতে ঠাণ্ডা লেগেছে। জ্বরজারি হতে পারে। তালা খোলার শব্দে তিনি জেগে উঠে স্বভাবসুলভ সতেজ গলায় বললেন, মাওয়া, সুপ্ৰভাত।
সুপ্রভাত মিঃ নিশো। রাতে ভালো ঘুম হয়েছে?
এই অবস্থাতে ভালোই বলা চলে। অবিশ্যি শেষরাতের দিকে ঠাণ্ডায় কষ্ট পেয়েছি। আরেকটি গরম কম্বলের ব্যবস্থা করা যাবে?
নিশ্চয়ই যাবে। আমি আজ বিকেলেই নিয়ে আসব।
জুলিয়াস নিশো সামান্য হেসে বললেন, তুমি পলিটিশিয়ানদের মতো কথা বল। অনেক কিছুই নিয়ে আসার কথা বল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই আসে না।
মাওয়া গম্ভীর গলায় বলল, কম্বল বিকেলের মধ্যেই পাবেন।
মাথার ওপরে এই বাতি—এটা কি নিভিয়ে রাখা যায়?
এই বাতি রাত নটার পর থেকে জ্বলবে না।
মাওয়া খাবারের প্যাকেট টেবিলে সাজিয়ে রাখল। ফ্রাঙ্কে কফিও আছে। ভালো কফি। খাবারগুলি যত্ন করে তৈরি করা। সৈন্য বা কয়েদিদের সাধারণ খাবার নয়।
মাওয়া, এই খাবারগুলি কে রান্না করে?
আমার স্ত্রী ও বড় মেয়ে।
চমৎকার রান্না। তাদের আমার ধন্যবাদ দিও।
ধন্যবাদ দেওয়া যাবে না। কারণ, আপনি যে এখানে আছেন, এটা তাদের জানানো যাবে না।
যখন আমি এখানে থাকব না, কিংবা এই পৃথিবীতেই থাকব না, তখন দিও। তাদের বলবে, আমি সারা জীবন খাওয়াদাওয়া নিয়ে কষ্ট করেছি, কিন্তু জীবনের শেষ দিনগুলিতে খুব ভালো খানাপিনা করেছি।
আমি বলব।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মাওয়া ওঠার উপক্রম করল। নিশো বললেন, বাইরের কী খবর? আমার মৃত্যুসংবাদ দেশবাসী কীভাবে নিয়েছে?
আমি জানি না কীভাবে নিয়েছে, বাইরের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। ফোর্টনক শহর থেকে অনেক দূরে।
তা অবশ্যি দূরে। তোমার স্ত্রী, কন্যা? ওরা খবরটা কীভাবে নিয়েছে?
জানি না, মিঃ নিশো। আমি আমার স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করি না। রাজনীতি মেয়েদের বিষয় নয়।
রাজনীতি কোথায়, তুমি কথা বলবে একটি মানুষের মৃত্যু নিয়ে!
আমি কথা কম বলি।
আমরা এমন একটি দেশে বাস করি, যেখানে কথা কম বলাটাই বড় মানবিক গুণ বলে ধরা হয়। অথচ আমি সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছি একটি দেশের, যেখানে আমরা সবাই ইচ্ছেমতো বকবক করতে পারব।
মাওয়া আর দাঁড়াল না। নিশো গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। মাওয়া কম্বল নিয়ে এল না। দু শ পাওয়ারের বাতি জ্বলতেই থাকল।