জাফর সাহেব আটটার আগেই অফিসে চলে যান। আজ সাড়ে নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। ছেলের বাবা আসবে তাঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার। কি কি বলবেন তাও গুছিয়ে রেখেছেন। তিনি বলবেন, ছেলে চলে যাবে মেয়ে একা থাকবে এটা তার পছন্দ না। দুজন এক সঙ্গেই যাক। টিকিটের টাকা তিনি দেবেন। এটা কোন ব্যাপার না।
তাঁর ক্ষিধে লেগেছে। এখনো নাশতা করেন নি। মেহমানদের সঙ্গে নিয়ে নাশতা করবেন এই ভেবে রেখেছেন।
তিথি বলল, তুমি খেয়ে নাও বাবা। তারা বোধহয় আসবেন না।
আসবে না কেন?
বাবা আর ছেলের মধ্যে রাগারাগি হয়েছে। মনে হয় বাবার রাগ ভাঙ্গানো যাচ্ছে। তুমি খেয়ে নাও।
ওরা যদি এসে দেখে আমরা নাশতা টাশতা খেয়ে বসে আছি সেটা কি একটা নিতান্তই অনুচিত কাজ হবে না?
আমি না হয় অপেক্ষা করি।
আচ্ছা দে দেখি। নাশতা করেই ফেলি।
জাফর সাহেব লক্ষ্য করলেন তার মেয়ে অনেক খাবারের আয়োজন করেছে। পরোটা, ভূনা গোশত, পাউরুটি, মাখন, ডিম, একটা বাটিতে চিড়া ভাজা, অন্য একটা বাটিতে মুড়ি। জাফর সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, পরোটা তুই ভেজেছিস না-কি? ভাল হয়েছে। খুব ভাল হয়েছে।
তিথি লজ্জিত গলায় বলল, পরোটা আমি ভাজি নি বাবা। পাশের ফ্ল্যাটের অরুনার মা, উনাকে বলেছিলাম। উনি বানিয়ে পাঠিয়েছেন।
গোশতও উনি রান্না করেছেন?
গোশত আমি রান্না করেছি। ভাল হয়নি বাবা?
ভাল হয়েছে। খুব ভাল হয়েছে অনেক পদ করেছিস। ঠিকমত নাশতা করলে দুপুরে আজ আর খেতে হবে না।
তিথির লজ্জা লাগছে। এতগুলি পদ টেবিলে সাজানো বাবা নিশ্চয়ই মনে মনে। হাসছেন। তাছাড়া সে খানিকটা সাজগোজও করেছে। বাবার চোখে পড়ার কথা। তেমন আহামরি কিছু না–চোখে কাজল দিয়েছে। নতুন ভাঁজ ভাঙ্গা একটা শাড়ি পরেছে।
তিথি।
জি বাবা।
তোর কি পাসপোর্ট আছে?
না।
পাসপোর্ট সাইজ ছবি আছে?
না।
তাহলে তুই এক কাজ কর। নিউমার্কেটে গিয়ে পাসপোর্টের জন্যে ছবি তোল। এরা ঘণ্টা খানিকের মধ্যে ছবি দিয়ে দেয়। ঐ ছবি নিয়ে তুই দুপুর বারটার মধ্যে আমার অফিসে চলে আসবি। তারপর তোকে নিয়ে আমি পাসপোর্ট অফিসে যাব। দু দিনের মধ্যে পাসপেটি বের করতে হবে।
তিথি অস্পষ্ট গলায় বলল, কেন?
আমি চাই তোরা দুজন যেন এক সঙ্গে যেতে পারিস। সেটাই ভাল হবে। তোর কোন আপত্তি আছে?
তিথি লজ্জিত গলায় বলল, না।
গুড। আপত্তি থাকাটা কোন কাজের কথা না। আজ সিলেটে যাচ্ছি মনে আছে তো?
মনে আছে।
জিনিস পত্র গুছিয়ে নে। তোর মাকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসতে হবে। কাল সকালে পৌঁছব বিকেলের ট্রেনে সবাইকে নিয়ে ঢাকা চলে আসব।
মা আসতে রাজি হবেতো?
অবশ্যই রাজি হবে। মেয়ের বিয়ে মা আসবে না। কি বলিস তুই। ঝগড়া আপাতত মুলতুবী থাক। বিয়ে টিয়ে হয়ে যাক তারপর আবার নতুন উদ্যমে শুরু করা যাবে।
জাফর সাহেব চলে গেছেন। তিথি অপেক্ষা করছে। মারুফের আসার নাম নেই। আসতে না পারলে একটা টেলিফোন তো করবে। তাও করছে না। তিথির খিদে লেগেছে কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। এতক্ষণ পর্যন্ত না খেয়ে বসে থাকার জন্যেই বোধহয় মাথা ধরেছে। হালকা ধরণের মাথা ব্যথা যা এক সময় সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
তিথি খালি পেটে চা খেল। সকাল থেকে এই পর্যন্ত চার কাপ চা খাওয়া হয়েছে। সে ঠিক করে ফেলল মারুফ না আসা পর্যন্ত সে কিছুই খাবে না। সে যদি আজ রাত এগারোটায় আসে তিথি রাত এগারোটা পর্যন্ত না খেয়ে অপেক্ষা করবে।
মারুফের সবচে বড় সমস্যা হল সে বেশীর ভাগ সময়ই কথা দিয়ে কথা রাখে। তার জন্যে সে মন খারাপ করে না বা দুঃখিতও হয় না। যেন কথা দিয়ে কথা না রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যাপার না। স্বাভাবিক ব্যাপার।
তিথি ঘড়ি দেখে ঠিক এগারোটা বাজার দশমিনিট আগে ঘর তালা দিয়ে বের হল। নিউমার্কেট যেতে লাগবে দশ মিনিট। ছবি তুলে এক ঘণ্টা ঘোরাফেরা করবে। বারোটায় ছবি ডেলিভারী নিয়ে বেবীটেক্সী করে বাবার কাছে চলে যাবে। সেখান থেকে পাসপোর্ট অফিস।
জাফর সাহেব অফিসে এসে দেখেন তার ঘর খোল। ঘরে তিথির বড় মামা বিরক্ত মুখে বসে আছেন। শুধু বসে আছেন বললে ভুল হবে পাইপ টানছেন। পাইপের ধোয়ায় ঘর অন্ধকার। এয়ার কুলার বসানো ঘরে দরজা জানালা বন্ধ থাকে। ধোয়া ঘর থেকে বেরুতে পারে না।
তিথির বড় মামা সাইদুর রহমান আর্মি শটকোর্সে মিলিটারীতে ছিলেন। দশ বছর চাকরির পর লেফটেন্যান্ট কর্ণেল হয়ে রিটায়ার করেছেন। বর্তমানে ব্যবসা করেন। সারাক্ষণই বলেন, ব্যবসার অবস্থা ভয়াবহ। কিন্তু তিনি ভয়াবহ অবস্থায় আছেন বলে মনে হয় না। ধানমন্ডিতে আশি লক্ষ টাকায় দশ কাঠা জমি কিনেছেন। সেখানে পাঁচতলা ফ্ল্যাট বাড়ি হবে। প্রতি তলায় দুটা করে ফ্ল্যাট। একেকটি বিক্রি হবে চল্লিশ লক্ষ টাকায়। এর মধ্যে ৬টি বিক্রি হয়ে গেছে। উত্তরার কাছে উত্তরখান নামের জায়গায় ছ বিঘার মত জমি কিনেছেন। সেখানে বাগানবাড়ি হচ্ছে। বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। সামনে ঝিল, ঝিলে নৌকা। বলতে গেলে হুলুস্থুল ব্যাপার। যে এমন হুলুস্থূল ব্যাপার শুরু করে তার মুখে সারাক্ষণ বিজনেসের অবস্থা ভয়াবহ–এই কথা শুনতে ভাল লাগে না। জাফর সাহেবের অসহ্য লাগে। তিনি রিটায়ার্ড লেফটান্যান্ট কর্ণেল সাইদুর রহমানকে দু চোখে দেখতে পারেন না। মাস খানিক আগে সাইদুর রহমানের ছোটমেয়ে পিঙ্গলার জন্মদিন উপলক্ষ্যে রিভার ক্রুজ হল। জাহাজে করে পাগলা থেকে চাদপুরে যাওয়া এবং ফিরে আসা। রিভার ক্রুজে সবাই গিয়েছে তিনি যাননি। শরীর খারাপের অজুহাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন।
সাইদুর রহমান জাফর সাহেবকে দেখে মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। জাফর সাহেব বললেন, খবর সব ভাল?
সাইদুর রহমানের ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি পাইপে নতুন করে তামাক ভরতে লাগলেন। জাফর সাহেব বললেন, কতক্ষণ হল এসেছেন?
অনেকক্ষণ। আমি এসেছি আটটা চল্লিশে এখন বাজে নটা পঞ্চাশ। তুমি কি সবসময়ই অফিসে এমন দেরী করে আস?
অপমান সূচক প্রশ্ন। এ জাতীয় প্রশ্নের জবাব দেয়াও এক ধরনের অপমান। জাফর সাহেব বললেন, চা দিতে বলব চা খাবেন?
চা খেতে পারি।
বেয়ারাকে চায়ের কথা বলে জাফর সাহেব নিজের চেয়ারে বসলেন। তিনি খানিকটা চিন্তিত। লেফটেন্যান্ট কর্ণেল সাহেব ঠিক কি উদ্দেশ্য এসেছেন বোঝা যাচ্ছে না।
সাইদুর রহমান পাইপে লম্বাটান দিয়ে বললেন, আমি তোমার বাসাতেই। যেতাম। শেষ পর্যন্ত অফিসে আসলাম। কিছু ট্যাকনিক্যাল কথাবার্তা আছে যা
অফিসে বলা যায় না।
কি ট্যাকনিক্যাল কথা?
আমি অনেকদিন থেকেই ভাবছি–তোমার সঙ্গে একটা ফুল ডিসকাশান হওয়া উচিত। তোমার কি বলার আছে আমি শুনতে চাই। এক তরফা কথা শুনলে তো হবে না।
এক তরফা কি কথা শুনেছেন? আমি বুঝতে পারছি না।
চা আসুক। তারপর বলি।
সাইদুর রহমান চোখ বন্ধ করে পাইপ টানছেন। জাফর সাহেবের ইচ্ছা করছে তার বেয়ারাকে ডেকে বলেন, এই হামবাগটাকে ঘাড় ধরে ঘর থেকে বের করে দাও। বের করে দেবার পর যে চেয়ারে হামবাগটা বসেছে সেটা ডেটল পানিতে ধুয়ে দাও। মনে যা ভাবা যায় অধিকাংশ সময়ই তার উল্টোটা করতে হয়। জাফর সাহেব বেয়ারাকে তাড়াতাড়ি চা আনতে বললেন। সাইদুর রহমান বললেন, তোমার ঘরের দরজায় কি লালবাতি জ্বালানোর সিস্টেম আছে? সিস্টেম থাকলে লালবাতী জ্বালিয়ে দাও–আমি চাইনা আমার কথাবার্তায় ইনটারাপসান হোক।
আপনার এমন কি কথা যে লালবাতি জ্বালিয়ে বলতে হবে?
সাইদুর রহমান আবার ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। চা এসে গেছে। তিনি এক চুমুক খেয়ে বললেন, চা তো ভাল বানিয়েছে। যাবার সময় আরেক কাপ খেতে হবে। মনে করিয়ে দিও তো।
মনে করিয়ে দেব। এখন বলুন কি ব্যাপার? লালবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছি ঘরে কেউ ঢুকবে না।
সাইদুর রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, শায়লা আমাকে কমপ্লেইন করেছে তুমি নাকি তাকে মারধর কর। ব্যাপারটা কি?
ও আপনাকে বলেছে?
না বললে তো জানতে পারতাম না। আমার কাছে ওহী নাজেল হয় নি। আমি শায়লার কথা শুনে স্তম্ভিত। যার মেয়ে এম. এ. পাশ করেছে তাকে মারধোর করতে সাহস লাগে। তোমার সাহস আছে বোঝা যাচ্ছে।You are a courageous man.
আপনি কি আমাকে শাস্তি দিতে এসেছেন?
না। শাস্তির প্রশ্ন আসে না। তবে শায়লা তোমাকে শাস্তি দিতে চায়। সে ঠিক করেছে তোমার সঙ্গে আর বাস করবে না। এই কথাটাই তোমাকে বলতে এসেছি।
বলুন শুনছি।
ও যা চাচ্ছে তা হল সে তার মেয়েদের নিয়ে থাকবে তুমি আলাদা কোথাও থাকবে। বাড়ি ভাড়া করে থাকতে পার। কিংবা কোন হোটেলে ঘর নিয়ে থাকতে পার। এবং আমার কাছে মনে হয় এটা দুজনের জন্যেই মঙ্গলজনক হবে। সমস্যার ভদ্র সমাধান হবে। কিছুদিন এই ভাবে থাকার পর লোকলজ্জার ভয়েই হোক কিংবা মেয়েদের কারণেই হোক আবার তোমরা একত্রে থাকা শুরু করতে পারবে।
শায়লা এটা চায়?
সে যা চায় তা ভয়াবহ। সে চায় ডিভোর্স। তারতো এম্নিতেই মাথা গরম। উকিল ডেকে এনে হুলুস্থুল কাণ্ড! বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে এটাতে রাজি করিয়েছি।
আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে?
শায়লা তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছে। চিঠি আমার সঙ্গেই আছে। চিঠিটা পড়। চিঠিতে সব লেখা আছে। আমি নিজেও পড়েছি। উচিত হয়নি, তবু পড়লাম।
সম্বোধন হীন চিঠি। ইংরেজিতে লেখা। জাফর সাহেবের মনে হল তিনি অপরিচিত কোন মেয়ের লেখা চিঠি পড়ছেন। তার পা কাঁপতে লাগল। শায়লা এসব কি শুরু করেছে। শুরুর লাইনটি হল–
I always longed for Love, never got it…
আমি সবসময় ভালবাসার জন্যে তৃষ্ণিত ছিলাম, কখনো তা পাইনি। তুমি আমার জীবনে রোবট স্বামী হিসেবে এসেছ। আমাদের দুজনের মধ্যে সামান্যতম মিলও ছিল না। আমি বেড়াতে পছন্দ করি, তুমি ঘরে বসে থাকতে পছন্দ কর। আমি গান ভালবাসি–গান শুনলে জীবনটাও রোবটের মত হয়ে গেছে। তুমি আমাকে বদলে দিয়েছ। আমি তোমাকে বদলাতে পারি নি। বরং আমি তোমার মধ্যে ক্রোধ ঘৃণা এইসব নিম্নস্তরের আবেগ তৈরী করেছি যা বেড়ে বেড়ে এখন এই পর্যায়ে এসেছে যে তুমি আমার গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করছ না। গায়ে হাত তোলার ব্যাপারটি যে এবারই প্রথম ঘটেছে তা না। আগেও ঘটেছে। তোমার মনে নেই। সেই সময় তুমি রাগে অন্ধ হয়ে থাক। এমন রাগের মুহূর্তে মানুষ স্মৃতি শূন্য হয়ে পড়ে। সে কি করে না করে তা সে বলতে পারে না। প্রচণ্ড রাগ তোমার আগে ছিল না। যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে। আমার জন্যেই যে বাড়ছে তাও আমি বুঝতে পারছি। আমিতো নির্বোধ নই। কোনকালে ছিলাম না। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত তুমি কখনো আমাকে ভালবেসেছ। বলে আমি মনে করি না। তুমি আমাকে সহ্য করে গিয়ে এই পর্যন্ত। এখন তাও পারছ না। পরে কি হবে ভাবতেও আমার ভয় হচ্ছে।
কাজেই আমি মনে করি আর কখনোই আমরা একত্রে বাস করব না এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে হবে। এই সিদ্ধান্ত দুজনের জন্যেই মঙ্গল জনক হবে। যে ফ্ল্যাট বাড়িতে আমরা বাস করছি তুমি নিশ্চয়ই জান সে ফ্ল্যাট বাড়ি আমার টাকার কেনা। আমার বাবা আমাকে যে টাকা দিয়েছেন সেই টাকায়। কাজেই এ বাড়িতে তোমার কোন অধিকার থাকার কথা না। তুমি অন্য কোথাও চলে যাবে। আমাদের টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করার তোমার প্রয়োজন নেই। আমার যা আছে তা দিয়ে আমি আমার মেয়েদের নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারব।
সাইদুর রহমান বললেন, চিঠি পড়েছ?
জ্বি।
শায়লার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে। সেই সব আর তোমাকে বলতে চাচ্ছি না। তোমার কিছু বলার আছে কি না বল।
না।
বেশ আমি তাহলে উঠব।
যাবার আগে এক কাপ চা খেয়ে যাবেন বলেছিলেন। দিতে বলি।
না থাক। চিঠিটা টেবিল থেকে পড়ে গেছে। তুলে রাখ। এই চিঠি অন্যের হাতে
যাওয়া ঠিক না।
তিথি দুপুরে বাবার কাছে এসে দেখে জাফর সাহেব গম্ভীর মুখে বসে আছেন। তিথি বলল, কি হয়েছে বাবা?
জাফর সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। মনে হল মেয়েকে চিনতে পারছেন না।
তিথি বলল, তোমার কি হয়েছে বাবা?
কিছু হয়নি।
আমি ছবি নিয়ে এসেছি।
কিসের ছবি?
পাসপোর্ট সাইজ ছবি।
ও আচ্ছা, আচ্ছা। চল যাই ..।
ট্রেনের টিকিট করেছ?
না, টিকিট করা হয়নি।
কখন করবে?
শরীরটা ভাল লাগছে না। যেতে ইচ্ছে করছে না।
তুমি যাবে না?
জাফর সাহেব ইতস্ততঃ করে বললেন, এক কাজ কর। তুই চলে যা।
আমি একা যাব?
হ্যাঁ। ফাস্ট ক্লাসে যাবি। দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকবি। অসুবিধা কি? গাধাটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যা।
তুমি সত্যি যাবে না?
না।
ঠিক করে বল তো–তোমার কি এর মধ্যে মার সঙ্গে কোন কথা হয়েছে?
না।
আমার দিকে তাকিয়ে বল। অন্যদিকে তাকিয়ে বলছ কেন? কথা হয়েছে মার সঙ্গে?
জাফর সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন, না, কোন কথা হয়নি। চল যাই। দুটার সময় অফিস বন্ধ করে দেয়।
তোমাকে অন্য রকম লাগছে। কি হয়েছে বল তো?
কিছু হয়নি। কিছু হয়নি।
পাসপোর্ট অফিসের কাজ সেরে জাফর সাহেব বললেন, চল, তোর সঙ্গে খানিকক্ষণ ঘুরি। আজ আর অফিসে ফেরত যাব না।
তিথি বিস্মিত হয়ে বলল, আমার সঙ্গে কোথায় যাবে?
তোরা কোথায় কোথায় বেড়াতে যাস তা তো জানি না। তুই আমাকে কোথাও নিয়ে যা। তার আগে চল কোথাও খেতে যাই।
তুমি তো দুপুরে কিছু খাও না।
আজ খাব। খিদে লেগেছে।
চাইনীজ খাবে?
হুঁ।
তুমি সত্যি তাহলে সিলেট যাবে না?
না। তুই যা। গাধাটাকে সাথে করে নিয়ে যা।
তুমি একা একা থাকবে?
হুঁ।
এক দিনেরই তো ব্যাপার। তোরা তো চলেই আসবি।
আমিও থেকে যাই। মাকে টেলিফোন করে আসতে বলি।
টেলিফোন করলে আসবে না। তোকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে। আমাকে যেভাবে সব গুছিয়ে বললি, তোর মাকেও সেইভাবে বলবি। তারপর সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। নুরুজ্জামান গাধাটাকে খবর দেয়া দরকার। গাধাটা এখন আছে কোথায়?
দিনে কোথায় থাকে তা তো বাবা জানি না। জিজ্ঞেসও করিনি। রাতে ফিরে আসে। হাতে করে দুটা আনারস ঝুলিয়ে আনে। ভাত খায় না। আনারস খায়।
বলিস কি?
সত্যি বাবা।
তিথি মিট মিট করে হাসছে। তিথির হাসি হাসি মুখের দিকে আনন্দ এবং বিস্ময় নিয়ে জাফর সাহেব তাকিয়ে আছেন। বিস্ময়ের কারণ হল, তার মেয়ে যে এত সুন্দর করে হাসে তা তিনি আগে কখনো লক্ষ্য করেন নি। অন্য মেয়ে দুটি কেমন করে হাসে কে জানে? এরাও কি তিথির মত সুন্দর করে হাসে?
দুপুরবেলা চাইনীজ রেস্টুরেন্টগুলি ফাঁকা থাকে। আজ আরো ফাঁকা। দোতলার হলঘরে একটা লোকও নেই। তিথি বলল, অন্য কোথাও চল তো বাবা। ফাঁকা ঘরে চাহনীজ খেতে ভাল লাগে না।
ফাঁকাই তো ভাল। নিরিবিলি।
হোটেলের নিরিবিলি অসহ্য লাগে। হোটেল থাকবে গমগমা, লোকজনে ভর্তি।
তাহলে চল লোকজনে ভর্তি গমগম হোটেল খুঁজে বের করি।
চল যাই গাড়ি ছেড়ে দাও বাবা। আমরা রিকশা করে ঘুরব।
জাফর সাহেব গাড়ি ছেড়ে দিলেন। রিকশায় উঠেই তিথি বলল, তুমি কি চাইনীজ খাওয়া নিয়ে এই গল্পটা শুনেছ?
কোন গল্প?
ঢাকা শহরে এক লোক হঠাৎ আলাউদ্দিনের চেরাগ হাতে পেয়ে গেল। চেরাগে ঘসা দিতেই দৈত্য এসে উপস্থিত। দৈত্য বলল, জাহাপনা, কি চাই বলুন। হুকুম করুন। হুকুম করলেই হুকুম তামিল হবে।
লোক বলল, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। কিছু খাবার আন।
দৈত্য বলল, কি খাবার খাবেন হুকুম করুন হুজুরে আলা।
চাইনীজ খাব।
দৈত্য অস্বস্তির সঙ্গে বলল, সত্যি চাইনীজ খাবেন?
অবশ্যই খাব। তোমার অসুবিধা আছে?
জি না। তবে একটু সময় লাগবে।
লাগুক। খাবার যেন ফ্রেশ হয়।
অবশ্যই ফ্রেশ হবে।
লোকটা খাবার জন্যে অপেক্ষা করছে। ঘণ্টা খানেক পর দৈত্য ঘাড়ে করে এক আধ-বুড়ো চাইনীজ নিয়ে উপস্থিত। দৈত্য বলল, হুজুরে আলা, চাইনীজ খেতে চেয়েছেন। চাইনীজ ধরে নিয়ে এসেছি। এক্কেবারে পিকিং থেকে এনেছি বলে বিলম্ব হয়েছে। এখন ব্যাটাকে খান। আমি দেখি।
জাফর সাহেব শব্দ করে হাসলেন। তিথি হাসছে। রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। জাফর সাহেব তাঁর হাসি থামাতে পারছেন না। যতবারই হাসি থামাতে যান ততবারই চোখের সামনে ভেসে উঠে আধবুড়ো চাইনীজটার হতভম্ব মুখ।
তিথি বলল, বাবা থাম তো। অনেক হোসেছ।
জাফর সাহেব হো হো, হা হা করে হাসতেই লাগলেন।
প্লীজ বাবা, থাম। তোমাকে নিয়ে তো ভাল যন্ত্রণায় পড়া গেল। আগে জানলে কে তোমাকে হাসির গল্প বলতো!
মা, আরেকটা গল্প বল তো। হো হো হে। হি হি হি।
তিথি অবাক হয়ে বাবাকে দেখছে। আশ্চর্য, এত হাসি! তিথি তার বাবাকে এমন করে কখনো হাসতে দেখেনি। তাঁর শরীর ভাল তো? অসুস্থ মানুষ মাঝে মাঝে এমন করে, সামান্য কারনে প্রচুর হাসে। প্রচুর কাদে। তিথি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, বাবা, নুরুজ্জামান সাহেবকে যে নিয়ে যাব–উনি থাকবেন কোথায়? ধর, এক রাত আমাদের সিলেট থাকতে হল। তখন কি করব? উনাকে কি কোন হোটেলে পাঠিয়ে দেব?
জাফর সাহেব হাসি থামাতে পারছেন না। অনেক কষ্টে হাসির ফাঁকে ফাঁকে বললেন, গাধাটাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দিবি–হি হি হি।
কি কথার কি উত্তর! কি হয়েছে বাবার?