জহিরের দাড়ি শেভ করবার ব্যাপারটা দেখার মতো। মোটামুটি একটা রাজকীয় আয়োজন। বারান্দায় ছোট্ট টেবিল আনা হয়, আয়না লাগানো হয়। গরম পানি, ঠাণ্ডা পানি, স্যাভলন, ব্রাশ, সাবান, রেজার, আফটার শেভ। সব নিয়ে আসার পর গালে সাবান লাগানোর পালা। এই দৃশ্যটিও মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো। জহির ব্রাশ ঘষছে তো ঘষছেই। মুখ সাবানে ভরে উঠছে, তবুব্রাশ ঘষার বিরাম নেই। নিশাত এক বার অবাক হয়ে বলেছিল, এরকম তুচ্ছ একটা ব্যাপারে এত সময় নষ্ট কর?
দাড়ি কাটা তুচ্ছ মনে হল তোমার কাছে?
কেটে ফেলে দিচ্ছ, এটা তুচ্ছ না?
না। এর নাম বিসর্জন। আয়োজন ছাড়া বিসৰ্জন হয় না।
বিয়ের আগে জহিরের এই দিকটি নিশাতের চোখে পড়ে নি। শুধু দাড়ি কাটা নয়, সব ব্যাপারেই জহিরের আয়োজনের বেশ বাড়াবাড়ি আছে। অফিসে যাবার ব্যাপারটাই ধরা যাক। পালিশ করা জুতোও সে পাতলা ন্যাড়া দিয়ে অনেকক্ষণ ঝাড়পোছ করবে। রুমাল ইস্ত্ৰি করবে। সাজসজ্জা শেষ হবার পর অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে আয়নার সামনে। এইসব ব্যাপারগুলি বিয়ের আগে নিশাতের চোখে পড়ে নি। চোখে পড়েছে যে এই মানুষটি খুব ফিটফাট। রুচিবান একজন মানুষ, যার গায়ে কখনো ইস্ত্রি ছাড়া কাপড় দেখা যায় না। যার কাছে এসে দাঁড়িয়ে সবসময় আফটার শেভ লোশনের একটা গন্ধ পাওয়া যায়। গন্ধটা ভালো লাগে।
জহির টাই বাঁধতে-বাঁধতে নিশাতের ঘরে ঢুকল। নিশাতের ঘর মানে তার স্টুডিও। ছবি আঁকার সরঞ্জামে ঠাসা একটা ঘর। দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা ছবির স্তুপ। নিশাত একটি ছবির সামনে দাঁড়িয়ে। গত দু দিন এই ছবিটির জন্যে বেশ কিছুটা সময় দিয়েছে। লাইন-ওয়ার্ক শেষ হয়েছে, কিছু-কিছু জায়গায় রং পড়েছে।
জহির অবাক হয়ে বলল, কার পেইনটিং?
নিশাত বলল, চিনতে পারছ না?
পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার?
মহিলা বলাটা কি ঠিক হচ্ছে? বাচ্চা একটা মেয়ে।
ওর ছবি আঁকছ কেন?
কোনো বাধা আছে?
বাধা থাকবে কেন? জানতে চাচ্ছি।
নিশাত হাসল। ছবিটির দিকে তাকিয়ে হাসল। ভালো হচ্ছে। অনেকদিন পর নিজের কাজ তার পছন্দমতো এগুচ্ছে। মন লেগে গেলে কাজ খুব দ্রুত এগোয়। অনেকদিন ধরেই কোনো কিছুতেই মন বসছে না। নিশাত চাকু দিয়ে পোট্রেটের চুল থেকে কিছু রং ঘষে ঘষে তুলছে। চুল ঠিক আসছে না। মেয়েটির চুল ফ্লাফি ধরনের। এলোমেলো হয়ে থাকে, এখানে মনে হচ্ছে খুব গোছাননা চুল।
নিশাত।
বল।
আমার পোট্রেটে কবে হাত দেবে?
দেব খুব শিগগিরই।
একটা মজার ব্যাপার লক্ষ করেছ নিশাত? পুরুষশিল্পীরা তাঁদের স্ত্রীদের মডেল বানিয়ে অসংখ্য ছবি আঁকেন, অথচ মহিলারা কখনো তাঁদের স্বামীদের মডেল বানান না।
আমি তোমার ছবি আঁকি নি বলে অন্যরাও আকবে না এমন তো কথা নয়। কেউকেউ নিশ্চয়ই আঁকে।
কেউ আঁকে না। মেয়েদের এই সাইকোলজিটা বেশ অদ্ভুত। আমার কলমটা পাচ্ছি না। একটু দেখবে?
টেবিলের উপরই তো থাকে।
এখন নেই। তোমার বান্ধবীর পুত্র নিয়ে যায় নি তো?
ও কলম নিয়ে কী করবে?
কিছু করবে না। হাতের কাছে পেয়েছে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। কাইন্ডলি একটু খুজে দেখা বল পয়েন্টে আমি লিখতে পারি না।
অফিসে ফেলে আস নি তো?
অফিসে কি আমি কখনো কিছু ফেলে আসি?
তা আস না। দাঁড়াও, দেখি পাই কি না।
থাক, তোমাকে উঠতে হবে না। ছবি নিয়ে বসেছ, ডিসটার্ব করতে চাই না। শিল্পী-মানুষ–মুড কেটে গেলে মুশকিল।
ঠাট্টা করছ?
পাগল।
জহির ঘর থেকে বেরুল বিরক্ত মুখে। নিশাত তাকে এগিয়ে দিতে আসে নি। গত দিনও আসে নি। এটা কেন হচ্ছে জহির বুঝতে পারছে না। সম্পর্কে শীতলতা কি আসতে শুরু করেছে? নাকি জীবন-যাপনে মনোটনি? জহিরের প্রতি তার আগ্রহ কি কমে আসছে? কিছুটা নিশ্চয়ই কমেছে।
অফিসে পৌছেই জহির টেলিফোন করল। কিছু-কিছু কথা আছে মুখোমুখি বলা যায় না, অথচ টেলিফোনে খুব সহজেই বলা যায়।
নিশাত।
হ্যাঁ?
কি করছ?
তেমন কিছু না, গল্প করছি।
কার সঙ্গে গল্প করছ?
পুষ্প।
ও আচ্ছা তা হলে তুমি ব্যস্ত।
কিছু বলবে?
না।
তোমার কলমটা পাওয়া গেছে।
কোথায় ছিল?
যেখানে থাকার কথা সেখানেই ছিল। টেবিলের উপর। তুমি ভালো করে দেখ নি। তোমার জন্য যা খুব আনইউজুয়্যাল।
তা তো বটেই।
টেলিফোন রাখছি, কেমন?
জহির রিসিভার হাতে অনেকক্ষণ বসে রইল। নিশাত কখনন আগে টেলিফোন রাখে না। তার কাছে নাকি এটাকে অভদ্রতা মনে হয়। কিন্তু আজ সে সেই অভদ্রতাটাই করল, একবার জিজ্ঞেস করল না, টেলিফোন কেন করেছে।
পুষ্প খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। পল্টু ঘরময় চক্রাকারে হামাগুড়ি দিচ্ছে, মাঝে-মাঝে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে—পারছে না। ধপাস করে পড়ে যাচ্ছে। কিছুটা ব্যথা। নিশ্চয়ই পাচ্ছে, কিন্তু কাঁদছে না। আবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিশাত ব্যাপারটা খুব আগ্রহ নিয়ে লক্ষ করছে। শিশুদের মধ্যে এত অধ্যবসায় থাকে তা তার জানা ছিল না। জীবনের পরবর্তী সময়ে এই অধ্যবসায়টা থাকে না কেন কে জানে।
পুষ্প বলল, আপা, আমি যে প্রায়ই আপনার এখানে আসি, আপনি রাগ করেন না। তো?
না, করি না।
বিরক্ত হন নিশ্চয়ই।
মাঝে-মাঝে হই। সবসময় হই না।
পুষ্প মন-খারাপ করে ফেলল। নিশাত বলল, খুব প্রিয়জনদের উপরও আমরা মাঝে-মাঝে বিরক্ত হই। হই না? আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হচ্ছে আমার বাবা। মাঝে-মাঝে বাবার উপরও বিরক্ত হই। কাজেই তোমার এমন মুখ-কালো করার কিছু নেই।
আপনার বাবা বুঝি আপনাকে খুব ভালবাসেন?
তা বলতে পারব না। হয়তো বাসেন। ওঁর একটা গল্প তোমাকে বলব, শুনবে?
বলুন।
আমি তখন খুব ছোট। ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ি। বাবা কি জন্য জানি বকা দিয়েছেন, আমি খুব কাঁদছি। বাবা এসে বললেন, এখন থেকে নিয়ম করে দিলাম, যে আমার বকা খেয়ে কাঁদবে তাকেই একটা উপহার দেব। সত্যি-সত্যি চমৎকার একটা পুতুল কিনে আনলেন। এর পর থেকে ভাইবোনদের কেউ বকা খেয়ে কাঁদলেই দামি উপহার।
ও-মা, কী মজা!
আসল মজাটা এখনো বলিনি। কিছুদিন পর কী হল জান? বাবা বকা দিলে। আমরা কেউ কাঁদতে পারি না। কারণ বকা খেয়েছি, উপহার পাব এই আনন্দে এতই খুশি হয়ে যাই যে কান্না চলে যায়। আর না-কাঁদলে তো উপহার নেই।
কী সুন্দর গল্প।
এ-রকম সুন্দর-সুন্দর গল্প অনেক আছে। সব আমার বাবাকে নিয়ে। মাঝে মাঝে তোমাকে বলব।
এখন একটা বলুন না।
না, এখন না। তুমি বরং তোমার বাবা সম্পর্কে বল।
আমার বাবা সম্পর্কে বলার মতো কিছু নেই আপা। খুব সাধারণ মানুষ। নিজেকে। নিয়েই ব্যস্ত। আমাদের দিকে কখনো ফিরেও তাকান নি। মা মরে যাবার একুশ দিনের দিন আবার বিয়ে করেছেন। সংসার নাকি অচল হয়ে যাচ্ছে–বিয়ে না-করলেই না।
তুমি তখন কত বড়?
ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার বড় বোনের তখন বিয়ে হয়ে গেছে। একটা ছেলে আছে। আর আমাদের বোনদের বিয়ে কীভাবে হয়েছে জানেন আপা? ছেলে দেখতে এসেছে। বোনরা সবাই খুব সুন্দর তো, কাজেই দেখতে এসেই পছন্দ হয়ে গেছে। তখন বাবা বলেছেন, আলহামদুলিল্লাহ্, বিয়ে হয়ে যাক। শুভস্য শীঘ্রম। কাজি ডেকে বিয়ে।
তোমার বাবা মনে হয় খুব করিৎকৰ্মা মানুষ।
মোটই না আপা। টাকা বাঁচানোর ফন্দি। বিয়ের অনুষ্ঠান করতে হল না। আমাদের তিন বোনের বিয়ে হয়েছে কারো বিয়েতে অনুষ্ঠান হয় নি। বরপক্ষের ওরা অনুষ্ঠান করতে চেয়েছে। বাবা বলেছেন, বিয়ে তো হয়েই গেছে, আবার অনুষ্ঠান কিসের? মেয়ে উঠিয়ে নিয়ে যান।
তোমার মনে হয় বাবার উপর খুব রাগ?
আগে রাগ হত, এখন হয় না।
এখন হয় না কেন?
জানি না আপা। এখন কেমন যেন মায়া লাগে। সেও তো গরিব মানুষ আপা। কোথা থেকে টাকা খরচ করবে?
তা তো বটেই।
নিশাত অবাক হয়ে দেখল, পুষ্পের চোখে পানি এসে গেছে। মনে হচ্ছে সে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। খুবই সেনসিটিভ মেয়ে তো!
পুষ্প।
জ্বি?
চা খাবে?
না আপা।
তুমি কি খুব একা-একা থাক পুষ্প?
হ্যাঁ। ও কোথাও যাওয়া পছন্দ করে না, কাজেই কোথাও যাই না। কেউ আসেও না আমাদের এখানে শুধু ওর এক বন্ধু আসে মাঝে-মাঝে। তাকে আমার পছন্দ হয় না। শুধু আজেবাজে কথা বলে।
স্বামীর বন্ধুরা বন্ধুপত্নীদের সঙ্গে সবসময় এরকমই করে। জহিরের এক বন্ধু আছে, মাঝে-মাঝে এমন সব কথা বলে যে ইচ্ছে করে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিই।
পুষ্প হেসে ফেলল। বেশ শব্দ করে হাসি। হাসি থামিয়ে শান্ত গলায় বলল, অসময়ে উনি বাসায় আসেন, কেন জানি আমার ভালো লাগে না।
অসময়ে মানে কখন?
দুপুরের পর, আড়াইটা-তিনটার দিকে।
তুমি ওঁকে বলবে, যেন অসময়ে না আসেন।
ও আবার রাগ করবে। পল্টুর বাবার কথা বলছি। ওর চট করে রেগে যাবার অভ্যাস আছে।
তুমি তোমার অসুবিধার কথাটা বলছ, এতে ওঁর রাগ করবার তো কিছু নেই।
আমি তা বলতে পারব না আপা। তা ছাড়া মিজান সাহেব মানুষ হিসেবে খুব ভালো। সবার সঙ্গে রসিকতা করা ওঁর অভ্যাস। ওঁর মনে কোন পাপ নেই।
তাই বুঝি?
জ্বি আপা।
তবু তুমি ওঁকে বলবে যেন অসময়ে না আসেন। আমাদের দেশটা তো বিলেত আমেরিকা নয়। এ-দেশের নিজস্ব নিয়মকানুন আছে। ডিসেনসির ব্যাপার আছে। তাই না?
পুষ্প কিছু বলল না। নিশাত বলল, তোমার ওঁকে কেমন লাগে?
আমার পছন্দ হয় না।
অতিরিক্ত মেলামেশার একটা সমস্যা কি জান? কোনো-না-কোনভাবে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যে লোকটিকে শুরুতে অসহ্য বোধ হয় একসময় দেখা যায় তাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে।
কী যে বলেন আপা!
আমি ঠিকই বলি। পনের-যোল বছরের বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েকে আমি দেখেছি, বুড়ো গানের মাস্টারের প্রেমে হাবুড়ুবু খাচ্ছে। আমার নিজের কথা বলব?
বলুন।
না থাক। সব কথা এক দিনে বলতে নেই। কিছু কথা আরেক দিনের জন্যে ভোলা থাকুক।
টেলিফোন বাজতে শুরু করেছে। নিশাত টেলিফোন ধরল। ওপাশে জহিরের গলা।
নিশাত।
বল, শুনছি।
কি করছিলে?
তেমন কিছু না। তোমার কী হয়েছে বল তো! একটু পরপর…কি হয়েছে?
ভালো লাগছে না।
ভালো না-লাগলে চলে এস।
আমি ভাবছিলাম কি, বাইরে কোথাও গেলে কেমন হয়। ধর রাঙ্গামাটি বা কক্সবাজার।
হঠাৎ?
না, মানে–আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমাদের সম্পর্কটা একটু কোল্ড যাচ্ছে।
এ-রকম ধারণা হবার কারণ কি বল তো?
না, মানে……..
যেতে চাইলে চল যাই। ঘুরে আসি। আমার তো কোনো কাজ নেই, আমি তো ঘরেই বসে থাকি।
তা হলে চলে এস না।
আচ্ছা আসছি। টেলিফোন রাখলাম, কেমন?
নিশাত রিসিভার নামিয়ে আসতে শুরু করল। মনের কিছু দরজা-জানালা এখন খুলতে শুরু করেছে। নিশাত পল্টুকে কোলে নিয়ে গায়ের ঘ্রাণ নিল। কি অদ্ভুত গন্ধ শিশুদের গায়ে!