জলিল সাহেবের ভাই এখনো দেশে ফেরেন নি।
সমগ্র ঢাকা শহর চষে বেড়াচ্ছেন। কীভাবে-কীভাবে যেন এক জন কর্নেলের সঙ্গে দেখা করে দরখাস্ত দিয়ে এসছেন। দৈনিক পাকিস্তানে সন্ধান চাই–এই শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন এবং সন্ধানদাতাকে নগদ পাঁচ শ টাকা পুরস্কারের কথাও ঘোষণা করেছেন।
পুরস্কার ঘোষণা কাজে দিয়েছে বলা যেতে পারে। কালো মতো লম্বা এক লোক এসে হাজির। তার চোখে নিকেলের চশমা, নিচের পাটির একটি দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধান। জলিল সাহেবের ভাই লোকটিকে আমার কাছে এনে হাজির করলেন। লোকটির বক্তব্য, বিজ্ঞাপনের বর্ণনা মতো এক জন লোক মীরপুর বারো নম্বরে আটক আছে। তাকে ছাড়িয়ে আনা যাবে না, তবে এক হাজার টাকা দিলে সে দেখা করিয়ে দিতে পারে। আমে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। যথাসম্ভব শান্ত স্বরে বললাম, আপনি নিজে দেখেছেন?
জ্বি জনাব। নিজে না দেখলে বলি কেন? তবে আগের মতো নাই, অনেক রোগা হয়ে গেছেন।
আপনি দেখলেন কীভাবে? মীরপুর বারো নম্বরে আপনি কী করেন?
আমার চেনাজানা লোক আছে।
বাড়ি কোথায় আপনার?
বাড়ি দিয়ে আপনার দরকার কী? দেখা করিয়ে দিলেই তো হয়।
কখন দেখা করবেন?
এখন বলতে পারব না। খোঁজখবর নিয়ে বলতে হবে।
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, আপনার সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন এক কাজ করেন না কেন, জলিল সাহেবকে দিয়ে এক লাইনের একটা লেখা লিখিয়ে আনেন, আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে এক হাজার টাকা দেয়া হবে।
লোকটি সঙ্গে সঙ্গে রেগে উঠল।
আপনে আমার কথা বিশ্বাস ক-রেন নাই। আপনার সাথে ভাই আমি নাই। আমার এক কথা, আমি দেখা করিয়ে দিব। কিন্তু টাকাটা আমাকে এখন দিতে হবে।
এখন দিতে হবে?
জ্বি জনাব। অর্ধেক এখন দেন, আর বার্কি অর্ধেক দেখা হওয়ার দিন দেন। ব্যস, সাফ কথা।
আমি ঠাণ্ডা গলায় কাদেরকে বললাম, এই লোকটাকে ঘাড় ধরে বের করে দে কাদের।
জলিল সাহেবের ভাই দারুণ অবাক হয়ে বললেন, আরে না-না। এই সব কী বলছেন? আসেন তো ভাই আপনি আমার সাথে চা-পানি খান। আসেন দেখি। অবিশ্বাস করার কী আছে? মাকুদে এলাহী, অবিশ্বাস করব কেন? আপনি কি আর খামাখা মিথ্যা কথা বলবেন?
সন্ধ্যাবেলা খবর পেলাম লোকটিকে পাঁচ শ টাকা দেওয়া হয়েছে এবং একটি টিফিন কেরিয়ারে করে গোশত পারোটা দেওয়া হয়েছে পৌঁছে দেবার জন্যে। লোকটি বলে গেছে সে বৃহস্পতিবার বিকালে এসে জলিল সাহেবের ভাইকে মীরপুর বার নম্বরে নিয়ে যাবে। লোকটি যে আর আসবে না, সেই সম্পর্কে আমি ষোল আনা নিশ্চিত ছিলাম।
কিন্তু সে সত্যি সত্যি বৃহস্পতিবার বেলা দুটার সময় এসে হাজির। খালি টিফিন–কেরিয়ারটিও সঙ্গে নিয়ে এসেছে। সে অবশ্যি দেখা করানর জন্যে জলিল সাহেবের ভাইকে মীরপুরে নিয়ে গেল না। তার জন্যে নাকি অন্য এক বিহারী ব্যক্তির (সুলায়মান খা) সঙ্গে যোগাযোগ হওয়া প্রয়োজন। সেই লোক রোববার আসবে। রোববারে অবশ্যি দেখা হবে। এই বারও লোকটি একটি কম্বল, একটি বালিশ এবং দু, শ টাকা নিয়ে গেল!
জলিল সাহেবের ভাইয়ের ধৈর্য সীমাহীন। তিনি রোববার ভোরে গেলেন, মঙ্গলবার দুপুরে গেলেন এবং আবার বৃহস্পতিবার সকালে গিয়ে সন্ধ্যাবেলা গায়ে জ্বর নিয়ে ফিরে এলেন। আমি দেখতে গেলাম রাতে। বেশ জ্বর। ভদ্রলোক লেপ গায়ে দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে উঠে বসতে চেষ্টা করলেন, শুয়ে থাকেন, উঠতে হবে না। আজকেও দেখা হয় নি?
জ্বি-না। সামনের মাসের দুই তারিখ যাইতে বলে যাবেন?
জ্বি-না। ওরা কোনো খোঁজ জানে না। শুধু পেরেশানী করে।
এতদিনে বুঝলেন?
বুঝেছি আগেই ভাই, কিন্তু কী করব।–মিথ্যাটাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়।
আরো খোঁজখবর করবেন?
জ্বি-না, আগামী মঙ্গলবার ইনশাল্লাহ দেশের বাড়ি রওনা হব।
ঠিক আছে, আপনি বিশ্রাম করেন। পরে কথা বলব।
না ভাই, একটু বসেন। এক কাপ চা খান। আমিনা, ও আমিনা।
আমিনা সম্ভবত জলিল সাহেবের স্ত্রী। কঠিন পর্দা এদের। তিনি এলেন না। দরজার ওপাশে খটখট শব্দে জানান দিলেন। জলিল সাহেবের ভাই শান্ত স্বরে বললেন, আমিনা, রোজ কেয়ামতের দিন কোনো পর্দা থাকে না। মেয়ে-পুরুষ তখন সব সমান। এখন সময়টা কেয়ামতের মতো। এখন কোনো পর্দা-পুশিদা নাই। তুমি আস চা নিয়া।
জলিল সাহেবের স্ত্রীকে দেখে আমি বড়োই অবাক হলাম। নিতান্ত বাচ্চা একটি মেয়ে। শ্যামলা ছিপছিপে গড়ন। খুব লম্বা ঘন কালো চুল। এই বয়সের মেয়েরা বেণী দুলিয়ে স্কুলে যায়। হাত ভর্তি আচার নিয়ে বারান্দায় বসে চেটে চেটে খায়। মেয়েটি নিজে থেকেই বলল, আপনার কি মনে হয়, তাঁকে মেরে ফেলেছে?
আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারলাম না। মেয়েটি থেমে থেমে বলল, তাঁকে কেন মারবে বলেন? সে তো কিছুই করে নাই। সে তো মানুষকে একটা কড়া কথা পর্যন্ত বলতে পারে না! সাত বৎসর বয়স থেকে কোনো নামাজ কাজ করে নাই। কেন আল্লাহ্ এমন করবেন?
জলিল সাহেবের ভাই গম্ভীর হয়ে বললেন, আল্লাহর কাজের কোনো সমালোচনা নাই আমিনা। গাফুরুর রাহিম যা জানেন, আমরা সেইটা জানি না।
মঙ্গলবার দুপুরে জলিল সাহেবের ভাই সবাইকে নিয়ে চাঁদপুর চলে গেলেন। একটি ঠিকানা দিয়ে গেলেন কোনো খবর থাকলে জানাবার জন্যে। ভদ্রলোক রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে থাকলেন। আমার কিছু একটা বলা উচিত। কোনো একটা আশার কথা। অর্থহীন কোনো সান্ত্বনার বাণী। কিছুই বলতে পারলাম না।
রাত্রে অনেক দিন পর কোনো কানা শোনা গেল না। তাদের তালা–দেওয়া বাড়ির সামনে একটা কুকুর এসে শুয়ে থাকল। রাত দশটাব দিকে দেখি সেই বাড়ির বারান্দায় বসে নেজাম সাহেব সিগারেট টানছেন। জলিল সাহেবের ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বেশ খাতির হয়েছিল। প্রায়ই দেখতাম দু জন একসঙ্গে বেরুচ্ছেন।
মতিনউদ্দিন সাহেব আজকাল খুব ঘনঘন আসেন। আজিজ সাহেবের ঘরে না। গিয়ে সরাসরি উঠে আসেন দোতলায়। আমার খোঁজ করেন না, চিকন সুরে কাদেরকে ডাকেন, ও কাদের মিয়া। কাদের আছে নাকি?
কাদের সাড়া দিলেই তিনি অসংকোচে বলেন, কাদের মিয়া, রাতে এখানে খাব।
বড়োই আশ্চর্য লাগে আমার কাছে। এক দিন বিকালে এসে দেখি, ভদ্রলোক
বলল, ইনার শইলডা খারাপ। গায়ে জ্বর।
কাদের, রাত্রে আমি ভাত খাব না। রুটি করবে।
আমাকে বললেন, জ্বর গায়ে ভাত খাওয়াটা ঠিক হবে না। কী বলেন শফিক ভাই?
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, আপনি কি এইখানেই থাকবেন নাকি?
ভদ্রলোক আমার চেয়েও আশ্চর্য হ য বললেন, জ্বরাজুরি নিয়ে যাব কোথায়? কাজের জন্যে যে ছেলে রেখেছিলাম, সেটাও চলে গেছে। একা–একা থাকি কী করে?
তাকিয়ে দেখি ভদ্রলোক দুটি প্রকাণ্ড কালো রঙের সুটকেস সাথে করে নিয়ে এসেছেন।
বিলু ভদ্রলোকের কাণ্ড দেখে টেনে টেনে খুব হাসতে লাগল। আমার সামনেই নীলুকে বলল, আমি তোমাকে কত বার বলেছি, ভদ্রলোকের মাথা পুরোপুরি খারাপ। তুমি তো বিশ্বাস কর না।
নীলু খুবই রাগ করল। একেবারে কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। চোখ-মুখ লাল করে বলল, কী মনে করে ঘর-বাড়ি নিয়ে আপনি অন্যের বাড়িতে উঠে আসলেন?
একলা থাকতে পারি না নীলু। ভয় লাগে।
ভয় লাগে! আপনি কচি খোকা নাকি?
নীলু সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল। আমি অবস্থা সামলাবার জন্যে বললাম, এই সময় এক-একা থাকাটা ভয়েরই কথা।
নিচে থেকে নেজাম সাহেব হৈচৈ শুনে উঠে এসেছিলেন। তিনি মহা উৎসাহে বললেন, কোনো অসুবিধা নাই। আপনি ভাই আমার সঙ্গে থাকেন। ভূতের উপদ্রব এই বাড়িতে। এক-একা থাকতে আমারো ভয় লাগে।
মতিনউদ্দিন সাহেব পরদিন কাদেরকে নিয়ে বাড়ি থেকে সব জিনিসপত্র নিয়ে এলেন। মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে বিরাট এক একতলা বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। কাদেরের ভাষায় ঐ বাড়িতে একা–এক জ্বীনও থাকতে পারে না। আশেপাশে কোনো বাড়িতে কোনো লোক নেই। এই কদিন ভদ্রলোক কী করে এক-একা ছিলেন। তাই নাকি এক রহস্য।
কাদেরের কাছ থেকে আরো জানা গেল যে, মতিনউদ্দিন সাহেব এই দেশে থাকবেন না।–আবার চলে যাবেন। ভিসার জন্যে দরখাস্ত করেছেন। নতুন ব্যবস্থায় অজিজ সাহেব মহা খুশি। তাঁর মতে এটি একটি উত্তম ব্যবস্থা। সব দিক থেকেই ভালো। নীলুর মনোভাব ঠিক বোঝা যায় না। তাকে মতিনউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে গল্পটল্প করতে দেখি না, তবে এক দিন দেখলাম জামগাছের নিচে দু জনে কথা বলতে-বলতে হাঁটছে। আমাকে দেখতে পেয়ে নীলু চট করে আড়ালে সরে গেল। কী জন্যে কে জানে?
আজিজ সাহেব আজকাল আর আগের মতো আমাকে ডেকে পাঠান না। তাঁর ব্যস্ততা হঠাৎ করে খুব বেড়েছে। তিনি স্থির করেছেন ছৱিশে মার্চের পর থেকে কোথায় কী হচ্ছে সব লিখে রাখবেন। লেখার কাজটা করবে বিলু। তিনটি আলাদা খাতা করা হয়েছে। একটিতে লেখা হচ্ছে পাকিস্তান রেডিওর খবর, অন্যটিতে আকাশবাণী কলকাতার। তৃতীয়টি হচ্ছে স্বাধীন বাংলা, বি বি সি এবং ভয়েস অব আমেরিকার জন্যে।
জুন মাসে ঢাকার অবস্থা অনেক ভালো হয়ে গেল। কার্ফু সময়সীমা কমিয়ে রাত কারটা থেকে সকাল ছটা করা হল। রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় যে-সব মিলিটারি চেকপোস্ট ছিল, সেখান থেকে মিলিটারি সরিয়ে পুলিশ বসান হল। ঢাকার সমস্ত পুলিশ মিলিটারির সঙ্গে যুদ্ধে মারা গেছে বলে যে-খবর পেয়েছিলাম সেটি বোধ হয় পুরোপুরি সত্যি নয়। চারদিকে প্রচুর পুলিশ দেখা যেতে লাগল।
সেন্ট্রাল শান্তি কমিটি থেকে বলা হল, সমগ্র দেশের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। এক জন ফরাসী সাংবাদিক পত্রিকায় বিবৃতি দিলেন দেশের শান্তি-শৃঙ্খলার সাবিক উন্নতি হয়েছে। তেমন কোনো অস্বাভাবিকতা তার চোখে পড়ে নি। জনগণের মধ্যে আস্থার ভাব পুরোপুরি ফিরে এসেছে।
নীলক্ষেতের রাস্তা দিয়ে আসবার সময় দেখি মহসিন হলের অনেকগুলি জানালা খোলা। ছেলেরা দড়িতে শার্ট শুকতে দিয়েছে। সত্যি সত্যি হল খুলে দেয়া হয়েছে নাকি? হতেও পারে। পত্রিকায় দেখলাম আসন্ন রমজান উপলক্ষে রেশনে ঘি এবং সুজি দেওয়া হবে।
ঠিক এই সময় রফিকের ছোট ভাইটির বিয়ে হয়ে গেল। হঠাৎ করেই নাকি সব ঠিক হয়েছে। দুপুরবেলায় বিয়ে! আমাকে বরযাত্রী যেতে হল। রফিককে মনে হল বেশ সংকুচিত। তাকে বাদ দিয়ে ছোট ভাইয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এই কারণেই কিনা কে জানে।
বিয়েবাড়িতে গিয়ে দেখি হুলস্থূল কারবার। গেটের সামনে ব্যাও পাটি। ছোটছোট মেয়েরা পরীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড়ো ভালো লাগল দেখে। গেট-ধরনীরা হাজার টাকার কমে গোট ছাড়বে না। শুধু টাকা দিলেই হবে না। তিনটি ধাঁধা আছে, ভেতরে ঢুকতে হলে সেগুলিও ভাঙতে হবে। একটি ধাঁধা হচ্ছে, কাটলে কোন জিনিস বড়ো হয়। বরযাত্রী যারা ছিলাম, কারের বুদ্ধিসুদ্ধি বোধহয় সে-রকম নয়। আমরা কেউই একটি ধাঁধারও উত্তর দিতে পারলাম না। বাচ্চা মেয়েগুলি খুব হাসোহাসি করতে লাগল। হাসোহাসি করলে কী হবে, সবগুলি বিছু–গেট খুলবে না। শেষ পর্যন্ত মেয়ের বাবা এসে ধমক দিলেন, গেট খোল। সব সময় ফাজলামি।
বিয়ে পড়ান হয়ে গেল নিমেষের মধ্যেই। দেন মোহরান–যা নিয়ে দু পক্ষই ঘণ্টাদুয়েক দড়ি টানাটানি করেন, তাও দেখি আগেই ঠিক-করা। শুধু কবুল বলে নাম সই। বিয়ে বলতে এইটুকুই।
খেতে গিয়েও দেখি এলাহী ব্যবস্থা। জনপ্রতি ফুল রোষ্ট, কাবাব, রেজালা। আমার পাশে রোগামতো একটি লোক বসেছিলেন। সে আমার পেটে খোঁচা মেরে ফিসফিস করে বলল, ব্রিগেডিয়ার বখতিয়ার এসেছে, দেখেছেন?
কোথায় ব্রিগেডিয়ার বখতিয়ার?
ঐ যে দেখছেন না, সানগ্লাস পরা। খাস পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আর্মড কোরের লোক। বডি দেখেছেন?
আমি দেখলাম, লম্বা করে রোগামতো একটি লোক। বেশ কিছু লোক ঘুরঘুর করছে তার সঙ্গে।
কত বড়ো দালাল দেখেছেন? পাঞ্জাবীর সাথে পিতলা খাতির।
খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই রফিক আমাকে বউ দেখাতে নিয়ে গেল। মেয়েটি দেখে আমি স্তম্ভিত। যেন সত্যি সত্যি একটি জলপরী বসে আছে। এমন সুন্দর মেয়েও পৃথিবীতে আছে।