৫
মিসির আলি ছাত্রের ডায়েরি নিয়ে বসেছেন। অল্প কিছু পাতা বাকি। এই পাতাগুলোতে হঠাৎ হঠাৎ কিছু অসংলগ্ন বাক্য ঢুকে পড়েছে। যেমন তারকা চিহ্ন দিয়ে লেখা—‘পাচ্ছি না কেন?’ ‘রুলার রুলার।’ ‘লবণ নাই।’ পাঁচটা পুরো পাতা আছে উল্টো করে লেখা শুধুমাত্র আয়নার সামনে ধরলেই পড়া যায়। Dyslexia নামক ব্যাধির রোগীরা এইভাবে লেখে। তার কি Dyslexia আছে?
মিসির আলি উল্টো করে লেখা অংশটা আগে পড়লেন। তাঁর আয়না প্রয়োজন হল না। পড়তে কিছু বেশি সময় লাগল। তাঁর ছাত্র ফারুক লিখেছে।
.
এই অংশে আমি কিছু অদ্ভুত কথা লিখব। কথাগুলো সাধারণ ব্যাখ্যার বাইরে। সরকারি ছুটির দিন। আমি কলেজে যাই নি। কান্নার শব্দ শুনে উঠে গেলাম। আঙ্গুর কাঁদছে। আমার কাজের মেয়ে আঙ্গুর খুব ভয় পেয়েছে। সে বসার ঘরের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে কাঁদছিল। আমি তাকে পর্দার আড়াল থেকে বের করলাম। বললাম, কী হয়েছে?
সে বলল, ভয় পাইছি ।
কখন ভয় পেয়েছিস?
সকালে ।
দিন দুপুরে কীসের ভয়! কী দেখে ভয় পেয়েছিস?
মেয়েটা কিছু বলে না। শুধু কাঁদে আর এদিক-ওদিক তাকায়। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নেয়। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকির মতো উঠে গেল। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত অবস্থা। মেয়েটির একটিই কথা সে এই বাড়িতে থাকবে না। এখুনি চলে যাবে।
তার ভয় পাওয়া বিষয় নিয়ে যে আয়নার সঙ্গে আলাপ করব সে উপায় নেই। আয়নার নতুন অভ্যাস হয়েছে নদীর পাড়ে যাওয়া। সে নদীর পাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। আমাদের কলেজের পাশেই নদী, নাম বড় গাঙ্গ। আয়না খুঁজে খুঁজে নদীর পাড়ে একটা ছাতিম গাছ বের করেছে। সে গাছের গুঁড়িতে বসে থাকে। তাকে নিয়ে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কানাঘুষাও আছে। যেমন তার মাথার ঠিক নাই। সে নিজে নিজে হাত নেড়ে কথা বলে, হাসে।
আমি আঙ্গুরকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করলাম। লাভ হল না। আমি বললাম, আয়না ফিরুক তারপর তোকে আমি তোর বাড়িতে দিয়ে আসব। আঙ্গুর তাতেও রাজি না। তাকে এখনই দিয়ে আসতে হবে। সে আর এক মুহূর্তের জন্যও থাকবে না। থাকলে নাকি সে মরে যাবে।
বাধ্য হয়েই আমি তাকে নিয়ে রওনা হলাম। তার বাবা-মা শহরের এক বস্তিতে থাকে। রিকশায় যেতে পনের-বিশ মিনিট লাগে। রিকশায় উঠে আঙুর স্বাভাবিক হয়ে গেল। আমাকে ভয় পাওয়ার ঘটনা নিচু গলায় বলল।
সে ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল। তার আপামণি আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিল। হঠাৎ সে দেখে আপামণির হাত থেকে চিরুনি পড়ে গেছে আর আপামণি আয়নাটার ভেতর ঢুকে গেছে।
আমি তার কথার কোনো গুরুত্ব দিলাম না। কী দেখতে কী দেখেছে। মানুষ আয়নার ভেতর ঢুকে যাবে কীভাবে? সে যদি বলত আপামণি হঠাৎ শূন্যে মিলিয়ে গেছে তাও একটা কথা হতো। মানুষের চোখে Blind spot বলে একটা ব্যাপার আছে। হঠাৎ কোনো বস্তু Blind spot-এ পড়ে গেলে তা দেখা যায় না। ফেরাউনের কিছু জাদুকর Blind spot-এর বিষয়টা জানতেন। তার সাহায্যে তাঁরা জীবন্ত বস্তু অদৃশ্য করার খেলা দেখাতেন।
আমি আয়নাকেও কিছু বললাম না। আঙ্গুর তার বাবা-মাকে দেখার জন্য হঠাৎ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে কয়েকদিনের জন্য তাকে বাবা-মা’র কাছে রেখে এসেছি এইটুক বললাম। আয়না বলল, তাড়াতাড়ি নিয়ে এস। মেয়েটাকে ছাড়া বাসাটা খালি খালি লাগছে।
আমি বললাম, আচ্ছা!
আয়না বলল, মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ। তাকে পালক নিলে কেমন হয়? আমাকে মা ডাকবে। তোমাকে বাবা ডাকবে।
আমি বললাম, মেয়েটাকে পালক নিতে হবে কেন? আমাদের নিজেদের ছেলেমেয়ে হবে। তারা বাবা-মা ডাকবে।
আয়না বলল, আমাদের ছেলেমেয়ে হবে না।
আমি বললাম, কেন হবে না?
আয়না তার জবাব না দিয়ে আমার সামনে থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেল। তার পছন্দের জায়গায় গিয়ে বসল। তার বারান্দায় বসার অর্থ এক দুই ঘণ্টা সে ঝিম ধরে থাকবে। হাত নাড়বে, বিড়বিড় করবে।
ছোট মেয়েটার অনুপস্থিতি যে আমাদের জীবনযাত্রায় বড় কোনো পরিবর্তন আনল তা না। সবকিছু আগের মতো চলতে লাগল। আয়না গুছিয়ে সংসার করে। সে যে কাজ করছে—বাসন ধুচ্ছে কাপড় ধুচ্ছে কিংবা রান্না করছে তা বুঝাই যায় না। তার সব কাজকর্ম নিঃশব্দ।
আমি একটা ঠিকা বুয়া রাখতে চেয়েছিলাম সে রাজি হল না। সে বলল, ওদের গা থেকে আমি নোংরা গন্ধ পাই। আমার শরীর ঘিনঘিন করে। গন্ধ বিষয়ে আমার সমস্যা আছে। আয়নার এই কথা খুবই সত্যি। মাছের গন্ধ সে সহ্যই করতে পারে না। আমাদের বাসায় মাছ রান্না হয় না।
পাশের ফ্ল্যাটের মাছ রান্নাও সে মেনে নিতে পারে না। সারাক্ষণ নাকে রুমাল চাপা দিয়ে রাখে কিংবা নদীর পাড়ের ছাতিম গাছের নিচে বসে থাকে।
আয়নার সঙ্গে আমার কথাবার্তাও তেমন হয় না। আমি প্রশ্ন করলে জবাব দেয় তাও সব সময় না। মাঝে মাঝে অদ্ভুত কথা বলে আমাকে চমকে দেয়। যেমন একদিন বলল, ফ্ল্যাট থ্রি-বি-তে একটা কালো লম্বা ছেলে থাকে দেখেছ? গোঁফ আছে। সব সময় মাথা নিচু করে হাঁটে। খুব সিগারেট খায়।
আমি বললাম, দেখেছি।
তাকে চেন?
চিনি। ওর নাম মুকসেদ। বাংলা প্রফেসর জালাল সাহেবের শালা। চাকরির খুঁজে এসেছে।
আয়না বলল, ও একটা খুনি। পাঁচটা খুন করেছে।
আমি চমকে উঠে বললাম, কী বল তুমি!
আয়না বলল, মানুষ কারণে খুন করে। টাকাপয়সার জন্য করে, শত্রুতার জন্য করে, আর এই লোকটা কারণ ছাড়া খুন করে।
আমি বললাম, মনগড়া কথা কখনো বলবে না। মুকসেদের মতো শান্ত, নরম এবং ভদ্রছেলে আমি কখনোই দেখি নি।
আয়না বলল, সে পুলিশের হাতে ধরা পড়বে, পুলিশ তাকে খুঁজছে।
আমি বললাম, টেলিপ্যাথির মাধ্যমে সব জেনে ফেলেছ? নাকি স্বপ্নে জেনেছ? আয়না বলল, কীভাবে জেনেছি আমি জানি না। তবে জেনেছি। প্রফেসর সাহেব ঐ খুনিটার দুলাভাই না। তিনি সব জেনেশুনে খুনিটাকে আশ্রয় দিয়েছেন। খুনিটার নাম মুকসেদ না। তার নাম কামাল।
যাদের খুন করেছে তাদের নাম কী?
মেয়েটার নাম বলতে পারি। তার নাম শিউলি। মেয়েটাকে প্রথম সে পাটক্ষেতে টেনে নিয়ে গিয়ে ‘রেফ’ করেছে তারপর খুন করেছে।
আমি তাকিয়ে আছি। আয়নার উদ্ভট কথাবার্তার কোনো অর্থ করতে পারছি না। এটা কি প্যারানয়া?
আয়না বলল, তুমি কি থানার ওসি সাহেবকে বলবে যে কামাল এখানে লুকিয়ে আছে? আমি বললাম, উদ্ভট কথাবার্তা বলবে না। কোনো কারণ ছাড়া আমি ওসি সাহেবকে বলব যে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একজন খুনি ঘাপটি মেরে আছে?
আয়না ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, থাক বলতে হবে না। যা হবার আপনাতেই হবে। কয়েকদিন আগে আর পরে। খুনিটার ফাঁসি হবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে— ফাঁসির দড়িতে ঝুলেও সে কিন্তু মরবে না। দীর্ঘ সময় ঝুলন্ত অবস্থায় বেঁচে থাকবে এবং চোখের সামনে ভয়ংকর সব দৃশ্য দেখবে। তার কাছে মনে হবে সে অনন্তকাল এইসব দৃশ্য দেখছে।
আমি বললাম, তুমি তার ভবিষ্যৎ চোখের সামনে দেখে ফেলেছ?
আয়না হাসল আর কিছু বলল না।
আয়নার সঙ্গে খুনি মুকসেদ বিষয়ে কথাবার্তা বলার দ্বিতীয় দিনে পুলিশ এসে মুকসেদ এবং প্রফেসর জালাল সাহেবকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল। আমি প্রিন্সিপ্যাল সাহেব এবং চারজন শিক্ষককে নিয়ে থানায় ছুটে গেলাম। জালাল সাহেবকে অ্যারেস্ট করেছে। একজন সিনিয়র শিক্ষক। ওসি সাহেব বললেন, এই ভয়ংকর খুনি এখানে লুকিয়ে আছে আমরা জানতাম না। কীভাবে টের পেলাম সেই ইতিহাস আপনাদের বলতেই হবে। জগতে কত রহস্য যে আছে। ঘটনা হয়েছে কী—শরীরটা খারাপ লাগছিল আমি থানা থেকে দুপুর বেলা বাসায় গেলাম। খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছি হঠাৎ স্বপ্নে দেখি অতি অপরূপা এক মেয়ে আমাকে বলছে—ওসি সাহেব! ঘুম থেকে উঠুন। ভয়ংকর খুনি কামাল কোথায় আছে আমি জানি। এই হল ঠিকানা। সে ঠিকানা বলল। একবার না, কয়েকবার।
আমার ঘুম ভাঙল। ইউনিফর্ম পরলাম। আর্মড পুলিশ নিয়ে ফ্ল্যাট ঘেরাও করলাম। হারামজাদাটাকে পেয়ে গেলাম।
আমার স্ত্রী যে অস্বাভাবিক ক্ষমতা নিয়ে এসেছে এই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ কখনোই ছিল না। ক্ষমতার ব্যাপ্তিটা কতটুকু তা ধরতে পারছিলাম না। প্যারা নরমাল জগতে সাইকিক ক্ষমতাসম্পন্ন অনেক মানুষের উদাহরণ আছে। ডকুমেন্টেড সব ঘটনা। রাশিয়ার এস বেলায়েভ নামের একজন শৌখিন চিত্রকর পদার্থবিদদের সামনে তিন মিনিট লেভিটেশনে ছিলেন। মেঝে থেকে এক ফুট উঁচুতে ভেসে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে কাঁচকলা দেখিয়েছেন। সায়েন্টিস্টরা কিছুই ধরতে পারেন নি।
ইসরায়েলের য়ুরি গেলার চোখের দৃষ্টিতে চামচ বাঁকা করতে পারতেন। ম্যাজিশিয়ানরা দাবি করেন এখানে কিছু ম্যাজিকের কৌশল আছে। য়ুরি গেলার বিবিসি টেলিভিশনে চামচ বাঁকানো দেখালেন।
তাঁকে ঘিরে রইল সায়েন্টিস্ট এবং ম্যাজিশিয়ান। কেউ কিছু ধরতে পারল না।
.
আমেরিকার ABC টেলিভিশন মার্থা নামের আট বছর বয়েসী একটি মেয়েকে নিয়ে এক ঘণ্টার প্রোগ্রাম করেছিল। সে যে কোনো মানুষের দিকে তাকিয়ে মানুষটা কী ভাবছে বলতে পারত। এই মেয়েটি অদ্ভুত একটা কথা বলত। সে বলত মানুষের মনের কথা বুঝার ব্যাপারটায় তাকে আয়না সাহায্য করে। ঘরে আয়না না থাকলে সে কিছু বলতে পারে না। সে বলত পৃথিবীতে যেমন একটা জগৎ আছে। আয়নার ভেতরেও একটা জগৎ আছে। আয়নার মানুষরা পৃথিবীর মানুষের মতোই তবে তাদের অনেক ক্ষমতা। আয়নার ভেতরের জগতে কোনো পাপ নেই। পৃথিবীতে পাপ আছে।
মার্থাকে জিজ্ঞেস করা হল—পাপ কী?
উত্তরে মার্থা ভুরু কুঁচকে বলল, পাপ হচ্ছে ঈশ্বরের অন্ধকার (Dark side of God)।
আমার স্ত্রী আয়না কি মার্থার কথার আয়না জগতের কোনো মানবী? আমি তার উত্তর জানি না। তবে আঙ্গুরের মতো আমিও এক রাতে আমার স্ত্রীকে আয়নার ভেতর ঢুকে যেতে দেখলাম। ঘটনাটা এ রকম—
.
আয়না তার ঘরে বসেছিল। তার সামনে বড় একটা আয়না। সে একদৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দূর থেকে তাকে দেখছি। আমার দিকে সে পেছন ফিরে আছে বলে আমাকে দেখছে না। আমি দেখলাম সে আয়না কাছে টেনে নিল। আয়না চুমু খেল এবং চলে গেল আয়নার ভেতর। ব্যাপারটা এত সহজে ঘটল যে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। আমার মনে হল আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। আমি কোনো রকমে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।
কী আশ্চর্য! বারান্দায় আয়না হাঁটুর উপর মাথা রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসা। সে আমাকে দেখে বলল, কী হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কোনো কারণে কি ভয় পেয়েছ?
আমি উত্তর দিলাম না। একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আয়না বলল, বোস এখানে।
আমি বসলাম আর তখনই মনে হল আমার সামনের জগৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে। চোখে স্পষ্ট কিছুই দেখছি না। চলে গেছি অন্য কোনো ভুবনে। সেই ভুবনের আলো নরম। সবকিছু ছায়া ছায়া অস্পষ্ট। আমি বললাম, কোথায় আছি?
আয়নার গলা শুনতে পেলাম, সে বলল এই তো আমার পাশে। আমার হাত ধর। আমি আয়নার হাত খুঁজে পাচ্ছি না। তাকে স্পষ্টভাবে দেখছিও না। আবার বললাম, আমি কোথায়?
আয়না বলল, আমরা আয়নার ভেতর চলে এসেছি। এখন থেকে আয়নার ভেতর থাকব। ভালো হয়েছে না?
.
উল্টো করে লেখা অংশের এখানেই সমাপ্তি। মিসির আলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। উল্টো লেখা দীর্ঘ সময় পড়ার কারণে তাঁর মাথা খানিকটা জট পাকিয়ে গেছে। চারপাশের জগৎ দুলছে। বুক ধক ধক করছে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে মাথাকে সুস্থির হতে দিতে হবে। মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। এর মধ্যে ঢুকল মাজেদ। মাজেদ বলল, স্যার, ঘুম গেছেন?
মিসির আলি বললেন, না।
ঢাকায় কবে যামু স্যার?
আজই যাব।
আমার স্যান্ডেল?
কিনে দিব।
স্যার, মাথা মালিশ কইরা দিমু?
না। এখন বিরক্ত করিস না। আমি একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করছি।
চইলা যাব?
হ্যাঁ।
মাজেদ চলে গেল না। তার সামনে হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। মিসির আলি চোখ বন্ধ করেই বুঝতে পারছেন সে এখন কোথায়? যদিও মাজেদ হাঁটছে নিঃশব্দে। এইতো সে এখন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মিসির আলি চোখ মেললেন। মাজেদ ঘরে নেই। ঘর ফাঁকা। মস্তিষ্ক তাঁকে বিভ্রান্ত করেছে। মিসির আলি আবারো চোখ বন্ধ করলেন। এই অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে কয়েকটা ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন দেখলেন। একটি স্বপ্নে বিশাল আয়নার ভেতর থেকে বাচ্চা মেয়ে বের হয়ে এল। স্বপ্নে সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হয়। আয়নার ভেতর থেকে মেয়ে বের হয়ে আসার ঘটনাটা মিসির আলির কাছে স্বাভাবিক মনে হল। বাচ্চা মেয়েটি বলল, আমাকে চিনেছেন?
মিসির আলি বললেন, তুমি মার্থা।
আমি কোথায় থাকি জানেন?
জানি। আয়না জগতে।
আমাকে নিয়ে যে বইটি লিখেছে সেই বই আপনি পড়েছেন?
পড়েছি।
বইটার নাম বলুন।
বইটার নাম—Little girl from the mirror.
আমি যাই।
কোথায় যাবে?
যেখান থেকে এসেছি সেখানে যাব।
মেয়েটি আয়নার ভেতর ঢুকে গেল।
.
ঘুমন্ত মিসির আলিকে ডেকে তুললেন তরিকুল ইসলাম। তিনি বললেন, চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছেন এটা কেমন কথা? ভাই সাহেব শরীরটা খারাপ?
মিসির আলি বললেন, শরীর ঠিক আছে।
আপনার শরীর মোটেই ঠিক না। শরীর ঠিক থাকলে কেউ চেয়ারে বসে ঘুমায় না। আসুন বিছানায় শুয়ে থাকবেন। মাজেদকে বলছি পায়ে তেল মালিশ করে দেবে। যে কোনো অসুখে পায়ে তেল মালিশ মহৌষধ।
ভাই আমি ভালো আছি।
আপনি বললে তো হবে না। আমি বুঝতে পারছি সমস্যা আছে। হাত ধরি, উঠেন তো।
মিসির আলিকে হাত ধরে উঠতে হল। উঠে দাঁড়ানোর পরই তাঁর মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তিনি কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারালেন।
.
জ্ঞান ফিরে দেখেন বিছানায় শুয়ে আছেন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডাতেও তরিকুল ইসলাম পাখা দিয়ে প্রাণপণে হাওয়া করছেন। তরিকুল ইসলামের পাশেই তাঁর স্ত্রী চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে। ভদ্রমহিলার হাতে পানির গ্লাস। মাজেদ সর্বশক্তি দিয়ে পায়ের পাতায় তেল ঘষে যাচ্ছে। শুধু আয়নাকে কোথাও দেখা গেল না। মিসির আলি বললেন, খুবই বিব্রত বোধ করছি। আপনাদের সবাইকে হঠাৎ চিন্তার মধ্যে ফেলে দিলাম। এখন আমি ভালো আছি। খুবই ভালো।
তরিকুল ইসলাম বললেন, কোনো কথা বলবেন না। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করবে। ডাক্তার আনতে লোক গেছে। আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন। আপনি অজ্ঞান হয়ে আমার ঘাড়ে পড়লেন। কইলজাটা নড়ে গেল। ভেবেছি আপনি মারা গেছেন।
মিসির আলি লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসলেন।
তরিকুল ইসলাম বললেন, মন্দের মধ্যে একটা ভালো খবর শুনেন নবীনগর থেকে পাবদা মাছ নিয়ে এসেছে। আগেই খবর দিয়ে রেখেছিলাম আজ এনেছে। খাওয়ার দরকার নাই এই মাছ চোখে দেখাও শান্তির ব্যাপার। একেকটা মাছের সাইজ বোয়াল মাছের কাছাকাছি। ঠিকমতো রানতে পারব কি না চিন্তায় অস্থির হয়ে আছি।
তরিকুল ইসলাম সাহেবের স্ত্রী বললেন, মাছের কথা এখন বাদ থাকুক
তরিকুল ইসলাম বললেন, বাদ থাকবে কী জন্য? এত বড় পাবদা মাছ তুমি তোমার জন্মে দেখেছ? সেই মাছের গল্প করব না তো কী গল্প করব? তোমার বাপের বাড়ির গল্প করব? তোমার এক ভাই যে ঘুষ খেয়ে জেলে গেছে সেই গল্প?
এইসব কী কথা?
মিথ্যা বলেছি? মিথ্যা বললে মাটি খাই। আর যদি সত্যি বলে থাকি তুমি মাটি খাবে।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়াই উত্তম।
ঘরে মনে হয় আয়না ঢুকেছে। মিষ্টি ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। কদম ফুলের ঘ্রাণ। তরিকুল ইসলামের হইচই থেমেছে। তাঁর স্ত্রী মনে হয় কাঁদছেন। কান্নার আওয়াজ আসছে।
আয়না বলল, বাবা-মা! তোমরা দু’জনই ঘর থেকে যাও। উনার ভালো ঘুম দরকার। আরাম করে কিছুক্ষণ ঘুমালেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি উনার পাশে। মাজেদ তুমিও যাও। পায়ে তেল ঘষতে হবে না। তুমি যেভাবে তেল ঘষছ মনে হচ্ছে পায়ের চামড়া ঘষে তুলে ফেলবে।
মিসির আলি চোখ মেললেন। তরিকুল ইসলাম তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেছেন। মাজেদ চলে যাচ্ছে। আয়না দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এখন ইন্দ্রানীর মতো লাগছে। আয়না বলল, স্যার, আমি আপনার কপালে হাত রেখে বসে থাকব। আপনার ভালো লাগবে।
আয়না কপালে হাত রাখল। কী ঠাণ্ডা হাত। ঘুমে মিসির আলির চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে তিনি আলস্য ও আরামের আশ্চর্য এক জগতে ঢুকছেন।
স্যার।
বল আয়না।
আপনার ছাত্র এসেছে। খবর পেয়েছেন?
পেয়েছি।
আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন শুনে সে কী যে ভয় পেয়েছে। এরকম ভয় শুধু পশুরাই পায়। মানুষ পায় না।
পশুরা মানুষের চেয়ে বেশি ভয় পায়?
জি স্যার। ওরা ভয়ংকর এক ভয়ের জগতে বাস করে।
তুমি ওদের মনের কথা বুঝতে পার?
না। ওদের মনে ভয়ের বাইরে তেমন কোনো আবেগও অবিশ্যি নেই। অনেক মানুষের মনের কথাও আমি ধরতে পারি না।
কী ধরনের মানুষ?
নিম্ন শ্রেণীর মানুষ। ওরা পশুর মতোই। স্যার, আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
চোখ বন্ধ করে কথা বলতে আমার ভালো লাগছে।
তা হলে কথা বলুন।
তুমি কথা বল আমি শুনি।
আয়না বলল, আপনার ছাত্র প্রায়ই আমাকে বলত পৃথিবীটা মায়া ছাড়া কিছু না পৃথিবী কি মায়া? আমাদের চারপাশে যা ঘটছে সবই মায়া?
মিসির আলি বললেন, সাধু সন্ন্যাসীরা এরকম বলেন। এখন বিজ্ঞানীরাও বলছেন।
আয়না বলল, বুঝিয়ে বলবেন?
মিসির আলি বললেন, তুমি আমার মাথার কাছে বসে আছ। আমি পঞ্চ ইন্দ্ৰিয় দিয়ে তোমার উপস্থিতি বুঝতে পারছি। চোখ দিয়ে দেখছি, তোমার গলার স্বর শুনছি, ঘ্রাণ পাচ্ছি এবং স্পর্শ করেও জানছি। আমার ব্রেইন পঞ্চ ইন্দ্রিয় থেকে আসা signal কে ব্যাখ্যা করছে তোমার উপস্থিতি হিসেবে। সব signal ই কিন্তু electrical.
আয়না বলল, ব্রেইন তো সিগন্যাল পাচ্ছে যে আমি আছি তা হলে আমি মায়া হব কেন?
মিসির আলি বললেন, তুমি স্বপ্ন দেখ না?
জি দেখি।
স্বপ্নেও ব্রেইন সিগন্যাল পায় বলেই দৃশ্য দেখে। আমরা কিন্তু স্বপ্নকে বলি মায়া।
হ্যাঁ বলি।
স্বপ্ন যদি মায়া হয় তা হলে জাগ্রত অবস্থায় যা দেখছি তাও মায়া। ঠিক না?
ঠিক।
আমরা পৃথিবী দেখি সাত রঙে। একটা গরু দেখে সাদাকালো। তা হলে তুমি বল আমাদের জগৎ কি রঙিন না সাদাকালো?
আপনি কী বলতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছি।
এখন এই দাঁড়াচ্ছে না রঙের ব্যাপারটাও মায়া।
জি।
তুমি নিজেকে অতি রূপবতী হিসেবে মাঝে মাঝে দেখাও। ব্রেইনের ইলেকট্রিক সিগন্যাল প্রভাবিত করে এটা কর। সেটাও মায়া। তেমন রূপবতী তুমি না।
স্যার, ঘুমিয়ে পড়ুন।
মিসির আলি সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। ডাক্তার চলে এসেছে। আয়না বলল, ডাক্তার সাহেব আপনি অপেক্ষা করুন। বারান্দায় বসুন। চা খান। স্যার ঘুমাচ্ছেন। ঘুমের মধ্যে তাঁকে ডিসটার্ব না করাই ভালো।
মিসির আলি স্বপ্ন দেখছেন। স্বপ্নে আয়না মেয়েটি তাঁর সঙ্গে কথা বলছে।
স্যার, আপনি কি আমাকে চিনেছেন?
হ্যাঁ চিনেছি। তুমি আয়না!
আমি কোথায় থাকি জানেন?
এখানেই থাক।
না। আমি থাকি আয়নার ভেতর। মাঝে মাঝে আয়না থেকে বের হয়ে আসি।
ভালো তো।
হ্যাঁ খুব ভালো। আমি যখন আয়নার ভেতর থাকি তখন খুব ভালো থাকি। ভালো থাকাটা জরুরি। আর কিছুই জরুরি না। আমি একটা মায়া তাই না স্যার?
হ্যাঁ। শুধু তুমি একা না, আমরা সবাই মায়া। একজন কেউ সেই মায়া তৈরি করেছেন।
স্যার, কেন করেছেন?
আয়না আমি জানি না।
স্যার, আমি এখন আয়নার ভেতর ঢুকে যাব। আর কেউ আমাকে পাবে না। আপনি ঘুমান
মিসির আলি ঘুমুচ্ছেন। ঘুমের মধ্যে শুনছেন অনেক দূরে কোথাও অপূর্ব সংগীত হচ্ছে। এই সংগীত কি আয়নার ভেতর হচ্ছে?
.
মিসির আলির ঘুম পাতলা হয়ে এসেছে। তিনি এখন আছেন নিদ্রা এবং জাগরণের মাঝামাঝি। এই সময়টাও অদ্ভুত। তখন অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে।
কেকুল নামের এক বিজ্ঞানী এই সময় স্বপ্ন দেখলেন একটা সাপ বারবার তার লেজ কামড়ে ধরছে এবং ছেড়ে দিচ্ছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বুঝলেন কেউ একজন তাকে বেনজিনের রিং স্ট্রাকচার বুঝিয়ে দিচ্ছে। তাঁর ঘুম ভাঙল তিনি কাগজে বেনজিনের স্ট্রাকচার লিখলেন।
আরেক রাশিয়ার বিজ্ঞানী স্বপ্নে পেলেন পেরিওডিক টেবিল।
মিসির আলিও কি কিছু পাবেন? তিনি অস্পষ্ট গলায় ডাকলেন, আয়না।
আয়না। স্যার, আমি আপনার পাশেই আছি।
তুমি আমার ছাত্রকে খবর পাঠাও সে যেন চলে আসে।
আয়না বলল, আমি তাকে খবর পাঠিয়েছি।
মিসির আলি বললেন, আমি তোমার রহস্যের সমাধান করতে চাচ্ছি। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? আমি একা পারছি না।
আয়না বলল, স্যার, আমি সাহায্য করব।
.
ডাক্তার একজন না। দু’জন এসেছেন। একজন এমবিবিএস ডাক্তার আরেকজন হোমিওপ্যাথ। তরিকুল ইসলাম জানালেন, কবিরাজ রোহিনী বাবুকে খবর পাঠানো হয়েছে। উনিও চলে আসবেন। ত্রিমুখী চিকিৎসা হবে।
তাঁর প্রেশার মাপা হল, সুগার মাপা হল—সবই নরম্যাল।
মিসির আলি বললেন, আমি খুব ভালো আছি। হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে। এর বেশি কিছু না। আপনারা ব্যস্ত হবেন না।
তরিকুল ইসলাম বললেন, দুই ডাক্তারকেই রাত দশটা পর্যন্ত থাকতে হবে। একবার যার মাথা চক্কর দিয়েছে—আরো একবার দিতে পারে। আপনারা বিশ্রাম করেন। খাওয়াদাওয়া করেন। এমন পাবদা মাছ খাওয়াব মৃত্যুর সময় মনে হবে পৃথিবীতে কী জিনিস খেয়েছি। একেকটা পাবদা বোয়াল মাছের চেয়েও বড়। আপনারা বলেন মারহাবা।
দুই ডাক্তারই আনন্দিত গলায় বললেন, মারহাবা।