০৫. ঘড়ি-কন্যা মদিনার ক্ষমতা পরীক্ষা

ঘড়ি-কন্যা মদিনার ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্যে হারুন তার বাল্যবন্ধু সুলতানকে খবর দিয়ে এনেছেন। তারা দুজন বসেছে গেস্টরুমে। রূপা। ঢুকল।

ঘড়ি পরীক্ষায় সেও থাকবে। সুলতান পকেটে করে দুটা ঘড়ি এনেছেন। একটার সময় তিন ঘণ্টা বাড়ানো। অন্যটায় ঘণ্টার কাটা নেই, বন্ধ ঘড়ি। রূপা বলল, সুলতান চাচা আপনাকে দেখলেই আমার অস্বস্তি লাগে।

সুলতান বললেন, আমি কি করেছি রে মা? আমি কি করেছি?

রূপা বলল, আপনি প্রতিটি কথা দুবার করে বলেন। ভয়ংকর অস্বস্তিকর ব্যাপার।

আর বলবনা রে মা। আর বলব না।

রূপা বলল, অসহ্য। পরীক্ষা-নিরীক্ষা আপনারা করুন। আমি ছাদে যাচ্ছি।

হারুন বললেন, তোকে থাকতে হবে। তুই না থাকলে মেয়েটা ফ্রি ফিল করবে না। কঠিন পরীক্ষা দিচ্ছে।

এক শর্তে থাকব। সুলতান চাচা কোনো কথা দুবার বলতে পারবেন না।

সুলতান বললেন, দুবার বলব না। বলব না। অবশ্যই বলব না।

রূপা হতাশ গলায় বলল, এখন তত তিনবার করে বলছেন।

হারুন বললেন, কথা বন্ধ। পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। মদিনা মদিনা।

মদিনা ঘরে ঢুকল। তার মুখ শুকনা। যে কোনো কারণেই হোক সে ভয় পেয়েছে। হারুন বললেন, মদিনা! আমার বন্ধু সুলতান সাহেবের পকেটে একটা ঘড়ি আছে। ঘড়ির টাইম ঠিক নেই। অর্থাৎ এখন ১১টা বাজে। তার ঘড়িতে ১১টা বাজে না। তুমি বল তার ঘড়িতে কয়টা বাজে।

মদিনা বলল, পারব না স্যার।

হারুন বললেন, আমার পকেটে দুটা ঘড়ি আছে। একটা কালো বেল্টের আরেকটা মেটালিক বেল্টের কোনটায় কত বাজে।

মদিনা ক্ষীণ গলায় বলল, পারব না স্যার।

পারবে না মানে? অবশ্যই পারবে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা কর তারপর বল।

মদিনা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ সময় থেকে চোখ মেলে বলল, পারব না স্যার।

সুলতান বললেন, তুমি কোত্থেকে কি শুনেছ। মেয়ে ফ্রড। মেয়ে ফ্রউ। এই মেয়ে ফ্রউ।

হারুন বললেন, মেয়েকে নিয়ে পত্রিকায় নিউজ হয়েছে। পেপার কাটিং আমার কাছে আছে। দেখবে?

না। ফালতু নিউজ। পাত্তা দেয়াই ঠিক না। পাত্তা দেয়াই ঠিক না। ঠিক না।

হারুনকে বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে। তিনি আশাই করেন নি ঘটনা এ রকম ঘটবে। তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, থাপড়ায়ে এই মেয়ের দাঁত ফেলে দেয়া দরকার।

রূপা বলল, শুধু শুধু চিৎকার করবে না বাবা। মেয়ে এমন কোনো অপরাধ করেনি যে থাপড়ায়ে তার দাঁত ফেলতে হবে। মদিনা! তুমি আমার ঘরে যাও কিছু হ্যান্ড মেড পেপার বাথটাবে ভেজাও। ছবি আঁকব।

মদিনা বের হয়ে গেল। তার চোখভর্তি পানি। রূপা বলল, বাবা তুমি তো তাকে পরীক্ষা করেছ। তোমার ঘড়ির সময় ঠিক ঠিক বলেছে। তাই না?

হুঁ।

রূপা বলল, আমার ধারণা তুমি কোনো পরীক্ষা নাও নি। পত্রিকায় খবর দেখে মদিনাকে নিয়ে চলে এসেছ। তোমার ঘড়ির টাইম বলে দিয়েছে এই গল্পটা তোমার বানানো।

খামাখা গল্প বানাবো কেন?

সেটা আমি কি করে বলব.

বেশি জ্ঞানী হবার চেষ্টা করিস না। কাগের ঠ্যাং বগের ট্যাং ছবি আঁকছিস ছবি আঁক। আমি মদিনা মেয়েটাকে কানে ধরে তার বাড়িতে পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। আমি সহজ চিজ না।

কবে পাঠাবে?

আজই পাঠাব। বদ মেয়েটাকে রেডি হতে বল। আমি মাইক্রোবাসে গ্যাস ভরে নিয়ে আসি। সুলতান যাবে নাকি আমার সাথে?

সুলতান হাই তুলতে তুলতে বললেন, যেতে পারি। একা মানুষের এই সুবিধা যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারি।

এখন তোর দুপা
যেখানে ইচ্ছা সেখানে যা
যখন হবে চার পা
ভাত কাপড় দিয়া যা,
যখন হবে ছয় পা
বাবা! তুমি যাবা না।

ছড়া স্টপ কর। সত্যি যাবে?

অবশ্যই। রাগে আমার শরীর চিড়বিড় করছে। এক কাজে দুই কাজ হবে। রথ দেখব, কলাও বেচব। পথে বগুড়ার কাছে একটা কুয়া আবিষ্কার হয়েছে তার কোন তল নেই।

শুল নেই মানে? তল নেই মানে?

হারুন উৎসাহের সঙ্গে বললেন, মনে কর তুমি পাথরের বড় একটা চ্যাং কুয়াতে ফেললে। পাথরটা কোথাও না কোথাও হিট করবে। শব্দ হবে। সেটাই লজিক, কিন্তু এই কুয়ায় কিছু ফেললে শব্দ হয় না।

বল কি? বল কি?

দড়ি ফেলেও মাপার চেষ্টা করা হয়েছে। দড়ি নেমেই যায় নেমেই যায়।

সুলতান বললেন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি পত্রিকায় ছাপা হবার মত নিউজ। ঠিকানা জান তো?

খুঁজে বের করব।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে দুজন মাইক্রোবাস নিয়ে বের হয়ে গেলেন। মদিনাকে সঙ্গে নেবার কথা তাদের মনে রইল না।

 

রূপা রাশেদের সুটকেস ঘাটছে। তার ঠিকানা যদি কোথাও পাওয়া যায়। বইপত্রের সঙ্গে একটা ডায়েরি পাওয়া গেছে। সেখানে অনেক কিছু লেখা কিন্তু কোথাও ঠিকানা নেই। অন্যের ডায়েরি পড়ার প্রশ্নই উঠে না।

তারপরেও দুই লাইনের একটা লেখা রূপা পড়ে ফেলল। লেখাটা ইংরেজিতে। শিরোনাম suspicion.

My own suspicion is that the Universe is not only queerer than we suppose, but qucerer then we can suppose.

বাংলায় কি হবে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আমরা যত অদ্ভুত মনে করি তার চেয়েও অদ্ভুত। অন্য কেউ এই ব্যাপারটা জানুক বা না জানুক, রূপা জানে। খুব ভাল করেই জানে।

আফা একটা কথা বলব?

রূপা তাকালো। তার সামনে মদিনা দাঁড়িয়ে, সে তাকিয়ে আছে ভীত চোখে। মনে হয় পরীক্ষায় ফেল করে ভালই কান্নাকাটি করেছে। তার চোখ লাল।

রূপা বলল, বল কি বলবে?

আমার উপরে রাগ হইয়েন না আফা।

তুমি ঘড়ির সময় বলতে পার নি। এটাই তো স্বাভাবিক। ঘড়ি না দেখে আমরা কেউ সময় বলতে পারি না। খানিকটা অনুমান হয়ত করতে পারি। এর বেশি না।

আফা অন্য একটা কথা বলব। আপনের পায়ে ধরি রাগ হইয়েন না।

বল কি বলবে। রাগ হব না।

মদিনা ক্ষীণ গলায় বলল, উনার অবস্থা ভাল না।

রূপা বলল, কার অবস্থা ভাল না?

মদিনা আঙ্গুল দিয়ে রূপার হাতের ডায়েরি দেখাল। রূপা গম্ভীর গলায় বলল, আমি যার লেখা পড়ছি তার অবস্থা ভাল না?

মদিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। রূপা বলল, বোস আমার সামনে।

মদিনা বসল। রূপা বলল, তোমার কথাবার্তা যথেষ্টই বিরক্তিকর। সুলতান চাচার চেয়েও বিরক্তিকর। তুমি এ বাড়িতে পা দিয়েই ভূত দেখে ফেললে। এখন আবার দেখছ একজনের অবস্থা ভাল না। বেশি বেশি দেখা ভাল না। এখন থেকে কম কম দেখবে।

মদিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

আমি একজন ভদ্রলোকের একটা খাতা হাতে নিয়েছি তাই দেখে তুমি তার শারীরিক অবস্থা বলে ফেললে? শারীরিক অবস্থা দেখার জন্যে মানুষের শরীর পরীক্ষা করতে হয়। তার জন্যে ডাক্তার আছেন। তুমি কি ডাক্তার?

না আফা।

তোমাকে কিছু জ্ঞানের কথা বলি, মানুষ তার ক্ষমতার সবটাই অর্জন করে। জন্ম থেকে বিশেষ কোনো ক্ষমতা নিয়ে কেউ আসে না। তুমি আর কখনো ভূত দেখা, অমুকের শরীর ভাল না, তমুক দুর্ঘটনায় মারা যাবে এইসব বলবে না।

জী আচ্ছা বলব না।

এখন সামনে থেকে যাও। তোমাকে দেখলেই রাগ লাগছে।

মদিনা উঠে গেল।

 

হারুন অনেক ঝামেলা করে তলহীন কুয়া খুঁজে পেয়েছেন। বগুড়া জেলার ভেতর কাহালু রেল স্টেশন। রেল স্টেশনে মাইক্রোবাস রেখে রিকশায় গেছেন উত্তরে এগারো কিলোমিটার। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে সাত কিলোমিটার। সুলতান বললেন, তোমার সঙ্গে বের হওয়া বিরাট বোকামি হয়েছে। তুমি বিপজ্জনক ব্যক্তি। অবশ্যই বিপজ্জনক ব্যক্তি।

হারুন বললেন, আমার মেয়ে ঠিকই বলে তুমি বিরক্তিকর মানুষ। প্রতিটা কথা দুবার তিনবার বল।

তোমার কথায় বিভ্রান্ত হয়ে বিরাট ভুল করেছি। বিরাট ভুল করেছি। দেখো আমার পায়ের অবস্থা হাঁটতে হাঁটতে পা ফুলে গেছে। পা ফুলে গেছে।

চুপ একটা কথা বলবে না। একটাও কথা বলবে না।

সুলতান অবাক হয়ে বললেন, এখন তো তুমিও দুবার করে বলছ।

হারুন চিৎকার করে উঠলেন, আমার সঙ্গে আসতে চাইলে আস। না আসতে চাইলে স্টেশনে ফিরে যাও।

একা একা কীভাবে ফিরব? আমি তো পথ চিনব না। পথ চিনব না।

দুজন যখন তলহীন কুয়ার পাশে উপস্থিত হলেন তখন রাত দশটা। গ্রামের সবাই খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক ডাকাডাকির পর তলহীন কুয়ার মালিক বের হয়ে এলেন। মধ্যম বয়সের মানুষ। গালভর্তি শাদা দাড়ি। দাড়িতে মেহেদি দিয়েছেন। এখন মুখভর্তি লাল-শাদার সমারোহ।

হারুন বললেন, জনাব আপনার নাম কি?

আমি মেরাজ ফকির।

তলহীন কুয়া আপনার?

জী, এই কুয়ার আরেক নাম জিন্দা কুয়া।

সুলতান বললেন, কুয়া আবার জিন্দা মুর্দা হবে কীভাবে?

মেরাজ ফকির বললেন, সবাই জিন্দা কুয়া বলে। কেন বলে জানি না।

কুয়াটা দেখতে এসেছি।

দেখতে এসেছেন দেখেন। একশ টাকা করে হাদিয়া। কুয়ার রক্ষণাবেক্ষণ আছে।

হারুন বললেন, আমরা আপনার কুয়ার ছবি তুলব। একটা পাথর ফেলব। পাথর ফেললে শব্দ হয় না এটা যদি নিশ্চিত হই তাহলে আপনাকে দুশ টাকা দিব।

মেরাজ ফকির বললেন, কুয়া হাত দিয়া ছোঁয়া নিষেধ, ছবি ভোলা নিষেধ। কিছু ফেলাও নিষেধ। জিন্দা কুয়া, তারে ইজ্জত করতে হয়।

সুলতান বললেন, আমরা দুজন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। কিছু খাওয়াতে পারবেন। টাকা দিব।

আমি হোটেল খুলি নাই। নিশি রাইতে অনেক ত্যাক্ত করেছেন, এখন ফিরত যান।

ফেরার পথে হারুনের সঙ্গে সুলতানের বন্ধু-বিচ্ছেদ হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *