০৫. ঘিঞ্জি কলকারখানা

ডাইনে বড় ঘিঞ্জি কলকারখানা। এর নাম টিটাগড়। গাছ-গাছালির আড়ালে দেখা যায় কলকারখানার বাতি, বড় বড় বাড়ি। চিমনির মাথায় লাল বাতি।

সামনে বারাকপুর। আবার বাঁক। নদীবঙ্ক। এপার ওপার বেশ বাড়ন্ত হে। ওই পশ্চিমের তেলাতে যেয়ো না। হাওয়া ওখানে ঢ়িল দিয়েছে। দেখছি না, মেঘঢাকা চাঁদিনি আধারে জলের চলকানি ছেড়ে, ওখানে যেন তেল গড়িয়ে গেছে। ওখানে বাতাস নেই। বুঝে নাও, বাতাস গতি নিয়েছে কোন দিক দিয়ে। ওখানে গেলে নৌকার পােল ঢলে পড়বে। গতি যাবে ঝিমিয়ে। পুবের আকাশ অনেকখানি কালো। এদিকে বড় গাছ, শত শত বছরের, দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আকাশে ভিতরে ভিতরে ঘোর অন্ধকার। যুগযুগান্তের জটা বেঁধে রেখেছে চারিদিক।

শুধু গাছ নয়, নজর করো, অনেক চোখ আছে। বাঁয়ে চেপে, পশ্চিমে, তেলাটার গা ঘেঁসে যেতে হবে। অনেক চোখের নজর আছে ওই জটাজটলার আড়ালে-ওখানে রাজা-উজিরের বাড়ি, এদিকে লাট সাহেব, ওদিকে ম্যাজিষ্ট্রেট। একশো চুয়াল্লিশ ধারার বাঁধ দেওয়া আছে জলে। বাঁধ তুমি দেখতে পাচ্ছ না, কিন্তু আছে। একশো হাত দূর দিয়ে চলো। তোমার আমার বাড়ি নয়, ধর্মপতির বাড়ি। শূলে দিলে দিতে পারে। শনির কোপ পড়লে আর রক্ষে নেই। মাছমারাদের অনেকের উপর পড়েছে। হাজত হয়েছে, জরিমানা হয়েছে। সে মরশুমে আর তাদের মাছ মারা হয়নি।

চোখের জলের প্রয়োজন কী। গঙ্গায় এত জল, তা-ই ঠেলে ফিরে গেছে। এক মরশুম হাতছাড়া, এক বছর কাটা গেল। তোমার পরমায়ু থেকে।

মাছমারাদের কথায়, বাবু যতটুকুন তোমার প্রত্যয় যায়, ততটুকু যাওয়াও। তল্লাটের মাছমারারা বলে, মর্জিমত মাছ দিলে আইন টিল হয়, নইলে বড় দড়ো। আইনের রক্ষাকতা না প্রহরী দড়ো, সেটা ঠাহর পাইনে বিপদে পড়ে।

তার চেয়ে মাছমারা, ওই শনির কুল ছেড়ে দূরে চলো। চাপে, চাপে, পশ্চিমে চাপে। তেলায় পড়লে তোমার জোরে চলার মুণ্ডুটাকে খসিয়ে দেবে, দিক।

তবু দূর দিয়ে যাও। সুজনের বেশে তারা কোনওদিন আসে না। আর দুর্জনের নেই ছিলের অভাব। ওই যে বলে, হেই ভেড়া, কী করছিস রে?

জিজ্ঞেস করছেন বাঘমশায়। বেচারি ভেড়ার প্রাণ দুরুদুরু। এঁজ্ঞে জল খাচ্ছি।

জল খাচ্ছিস? আমার খাওয়ার জল ঘোলা করলি যে। দোষ করলি, এবার তোকে খাব।

এ হল সেইরকম। সুতরাং অনেক দূর দিয়ে যাও। ওদের খপ্পরে পোড়ো না।

ধরলে পরে কীরকম সব কথা। এই, এই হারামজাদা জলের মধ্যে লৌকো ঢুকেয়েছিস যে!

—এঁজ্ঞে, জলের ব্যাপার, বুঝতে পারিনি।

—বুঝতে পারোনি? সব একেবারে যুধিষ্ঠির। অন্ধকার হলেই অমনি সিঁধকাটিটি নিয়ে উঠে আসবে। চেহারা দেখো, ব্যাটা ষণ্ডা।

বোঝ, এর পরে আর কী আছে।

ধক করে উঠল পাঁচখানি নৌকার বুক। এক জোড়া চোখের নজর বিদ্যুতের মতো এসে পড়ল নৌকার গায়ে। ব্যাটারির চোখ-ধাঁধাঁনো আলো। কোনও সাড়া-শব্দ নেই। মিনিট খানেক আলোকবলয় নৌকাকটির এপাশ ওপাশ করে বেড়াল। তারপরে আবার ঘোর অন্ধকার।

বিলাস প্রায় চিৎকার করে উঠল, হয়ে গেল গো দেখা।

ওই শোনো কথা। ধরলে মুণ্ডিটা গুড়োবে যে। —চুপো হারামজাদা।

না হলে অত দূর থেকে, দেখলেটা কী? যদি এটা ডাকাতের লৌকো হত?

পাঁচুরও মেজাজ বিগড়োয়, বলে, হবে কেন?

—আহা, বলে, যদি হত।

—তবে হাতকড়া দিত।

বিলাস হেসে বলল, ঠাওর করতেই পারলে না, কীসের লৌকো। দুবার বাত্তি ফেলে চুপ করে রইল। যেন একেবারে কী রাজকাজ্যিটা করে ফেলে দিলে। রাত জেগে খালি গপ্পো করা সার।

পাঁচু বলে উঠল, থামবি।

থামল বিলাস। বড় বাঁক ছেড়ে এবার ছোট বাঁক। এক একজন, এক-এক জায়গায় নোঙর করছে নৌকা। বরাবর যে যে-তল্লাটে মাছ ধরে, সেইখানে ভিড়ছে। সবাই এক জায়গায় থাকে না। দলে দলে থাকে ভিন্ন জায়গায়। সবার কথাও প্রায় সবাই জানে। সারাপুলের অর্জুন কোথায়, জিজ্ঞেস করলে আর একজন বলে দিতে পারবে। ইছাপুরের তল্লাটে আছে।

এই দেখা যায় ইছাপুর। খুব বড় বন্দুকের কারখানা নাকি। জেটি আর জেটির চারদিকে কেমন আলো ফুটফুট করছে।

আর দেখো হুই ওপরে দেখা যায় টুপি মাথায় একটি মানুহ। হাতে তার বন্দুক। পাহারা দিচ্ছে।

দুটি কারখানা, মাঝখান দিয়ে খাল চলে গেছে পুবে, এঁকেবেঁকে সেই বারুতীর বিলে। সেখান থেকে মালতীর বিল। আগেকার দিনে খালে খালে চলে যাওয়া যেত বারাসাত বসিরহাট। আজকাল মজো গেছে।

কলকারখানা কিছু কমে এসেছে এদিকে। গারুলিয়ার মাটি গঙ্গার বুকে একেবারে দৌড়ে ছুটে এসেছে। মনে হয়। বাঁক ঘুরে আর জল পাওয়া যাবে না। বড় বড় গাছ আর বন-বাদোড় ঠেলে এসেছে গঙ্গার মধ্যে।

টান রয়েছে, খুব টান জলে। বড় সহজ পাত্রী ভেবো না। এই ভগবতীকে। একটু পুব ঠেসেই যাও। জল পানের শব্দ টের পাবে, পশ্চিমে মাটি খাচ্ছেন। একটু একটু করে, ধীরে ধীরে। বছরে বছরে দেখছ, পশ্চিমের কোল বিস্তার করছে। এ দিকে কম। বেশি খাচ্ছে চন্দননগরের উত্তরে চুচড়োয়, হুগলিতে।

 

শেষ পর্যন্ত দু নৌকা দাঁড়াল। পাঁচু আর কেদমে। বাঁক ফিরতেই আবার বড় মুখ। বাঁয়ে চড়া আছে। এখন ড়ুবে রয়েছে। জোয়ারের বেলা তো।

ওই দেখো, সোজা রুপের পাতের সরু দাগ চলে গেছে উত্তরে। ওটা তোলা নয়। চারের দাগ পড়ে জলে। জল-খুটি-খাওয়া মানুষ হলে, তোমাকে আগে নিশানা দেবে, চর আছে সামনে।

ভরা জোয়ার। এখন বড় ঢলঢল করছে। কুলে কুলে ভরে উঠেছে গঙ্গার শরীর। প্রাণ মন তোমার বেশি ভরে উঠলে কী হয়। ভার হয়। অঙ্গ বিবশ হয়। ভেতরে ভেতরে ফুলছ, ফাঁপছ, ধরে রাখতে পারছি না নিজেকে। একি সুখ না। দুঃখ, কে জানে। কিন্তু বিবশ শরীর আর চলে না, থর হয়ে গেছে। ঘুরে ঘুরে পাক খেয়ে যাচ্ছে এক-এক জায়গায়। কান পাতলে শোনা যায়, কী এক বিচিত্র সুর এই ভরা জোয়ারের বুকে। কীসের সুধায় ভরে গেল প্রাণ। ব্যথার না। সুখের। কী চাও, কী চাও তুমি। তোমার সেই কচি মেয়ের ঝাঁপাইঝোড়া কোথায়। কী বলছি তুমি চুপি চুপি,, তটে-তটে, বিষকাটারি ঝাড়ে, জলে-ডোবা বন-হেনার ঝোপে।

জোয়ারের ভর-ভরতি হল। নিজের বশ নেই। আর স্রোতের টানে। বাতাস আছে। পাল খাঁটিয়ে যেতে হলে, এখন আবার কোনাকুনি রাখতে হবে। তার দরকার নেই। ওই দেখা যায় ব্ৰহ্মময়ী কালীবাড়ি। কাঁসর-ঘণ্টা বাজল বলে কালীবাড়িতে। রাত আর কতটুকুনি বা আছে। কাসর-ঘণ্টা বাজিয়ে, ঠাকুরমশাই মাকে জাগাবেন এখুনি। গড় করি গো মা! এক বছর বাদে আবার এসেছি তোমার পায়ে। জানিনে কী আছে কপালে। মুখ রেখো আমাদের। কালীবাড়ি পার হলেই, কারখানার জেটি। ওখানটিতে একটু আলোর ছড়াছড়ি।

তারপরে আবার অন্ধকার। পার ঘেঁসো-ঘেসে চলো। আর বেশি দূর নেই। বলবার আগে বিলাস উঠল। লাগি নিয়ে ঠেলা দিল নৌকা।

 

চাঁদ ঢলে গেছে। পশ্চিমে। মেঘে মেঘেই গেছে কৃষ্ণপক্ষের জোছনা রাত। অন্ধকার আসছে। ঘনিয়ে। রাত কাবারের আর দেরি নেই। ভোর হল বলে। তবে, মেঘে-ঢাকা আকাশ। মানুষের চোখে পোহাবে একটু দেরিতে। বিদ্যুতের চিকচিক নেই এখন আর। শেষ রাত্রে আকাশ-মাটি লেপালেপি হয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। মেঘ নামছে কুণ্ডলী পাকিয়ে।

দু-একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে পারে নোঙর করা। দু-একখানি বাছড়াও নজরে পড়ে। এসে গেছে কয়েক ঘরের লোক। বাকি রয়েছে বেশি। এপারে, ওপারে, জেলে-মালো-নিকিরিচুনুরি-পাড়ারও নৌকা আছে দু-একটি।

খানিকটা বিরতি দিয়ে, দূরে আবার একসারি কারখানা-বাড়ি। একটু পুবে ঠেলে আছে। গঙ্গার ধারটি ভরে আছে জঙ্গলে। ও সারিটা ছাড়িয়ে তারপর দাঁড়াবে নৌকা।

নাওয়া-খাওয়ার জন্যে নৌকা ভিড়বে ওপারে, অর্থাৎ পশ্চিমে। ওপারের জেলেপাড়াটা ছাড়িয়ে, উত্তর গায়ে, দুলেপাড়াটার কোলে। পাঁচু বলল, আর দু-দণ্ড আছে আলো ফুটতে। ততক্ষণে এ পারেই নোঙর কর বিলেস। এ পারটা দেখে তাপরে ও পারে যাব।

-কেন বলে তো?

—জলটা এট্টু দেখে যাব।

—রাত পোহালেই গড়ক মারবে নাকি?

—দেখি, কী হয়।

কেদমে পাঁচু প্ৰায় পাড়ি দিয়েছিল আর কি। বলল, কী হল পাঁচদা, এপারেই দাঁইড়ে গেলে যে?

পাঁচু বলল, এটু দেখে যাব হে।

সেও রয়ে গেল।

অন্ধকার ঘন ঘোর। মস্ত একটি গাছের তলায় নোঙর করেছে দুটি নৌকা। দক্ষিণে কারখানার পাঁচিলের আলোর একটু ক্ষীণ রেশ এসে পড়েছে কাছাকাছি। গাছটি কৃষ্ণচুড়া গাছ।

গঙ্গা নিঃশব্দ। ঝি-ঝি আর ব্যাঙের ডাক কোন মূল গায়েনের টানা দোহারকি ধরেছে ভাল।

বিলাস তামাক সেজে আগে দিল খুড়োকে।

পাঁচু একটু হাত-পা ছড়িয়ে হুঁকোয় টান দিল। যাক, এসে পৌঁছুনো গেল। তিন রাত আগে বেরিয়েছে। মঙ্গলে উষা, বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা। বুধবারে বেরিয়েছে। রাত পোহালে, শনিবারের দিন পড়বে।

দক্ষিণের বাতাস এসেছে পিছু পিছু একজনের নিশ্বাস নিয়ে। এখানে এসে সেও বলত, এ পারেই নোঙর করা রে পাঁচু, জলটা একবার দেখে যাই।

গুরুর কাছে শেখা পদ্ধতি। সেটা ঠাহর করে যাও এপার থেকে। দরকার হলে কাজ শুরু করে দাও। আগুন জ্বলিয়ে দুটি সিদ্ধ করে খেতে অনেক সময় পাবে। চোখ বুজে পড়ে থাকবার বিস্তর সময় তোমার আপনি আসবে। যদি না আসে বেঁচে গেলে। তবে জানবে তোমার সুদিন তোমার সঙ্গেই রয়েছে। তবু ঠিক জায়গায় এসে, একবার কাজে হাত দাও। কিছু পাও না পাও, জলটা দেখে, তারপর দু-দণ্ড বিশ্রাম করো।

পাঁচুর নড়া দাঁতে, বলিরেখায়। ভারী ফুর্তি। বলল, নে, টানাছদিটা বার কর, একবার দেখে যাই।

কেদমে পাঁচুও বার করল টানাছাঁদি জাল।

ভাটা পড়েছে। চলন্ত জল হে। মুকড়া জল। ভাটার টান খুব। জোয়ারের পর যে ভাটার টান লাগে, তাকে বলে চলন্ত। মুকড়া বলে কেউ কেউ। জলে টান দেখলে, টান লাগে প্ৰাণে। তখন আর স্থির থাকা যায় না। জল যত চলন্তা, তোমার প্রাণ তত চলন্ত। তবে কোটালের টান-ভাটা পড়েনি এখনও। সেই টানে শুধু নৌকা নয়, মনে হয়, গোটা ডাঙাটুকু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সমুদ্রে। সেও আসবে। সবুর করতে হবে একটু।

মেঘ ঘোঁট পাকাচ্ছে শুধু। আশেপাশে এ দিককার নৌকা দেখা যাচ্ছে কয়েকটি। এ নৌকা দেখলেই বোঝা যায়, বাছাড়ির সঙ্গে তার তফাত অনেকখানি। একে বলে বলাগড়ের নৌকা। অর্থাৎ বলাগড় কারখানায় তৈরি হয়েছে। গলুই একটু নীচে, কাঁড়ারের দিকে উঁচু। কাঁড়ারের দিকে একটু ভার না পড়লে, এ নৌক ভাল চলে না।

বাছাড়ির যেমন সরু খোল, দেখলেই মনে হয়, সরু লম্বা একখানি চোখ বল্লমের ফলের মতো, এ তা নয়। এর পেট মোটা, মাঝখানটি চওড়া। জায়গা বেশি, মাছ ধরবে বেশি খোলে। যদি তুমি মাছ পাও। দেখলে তোমার মনে হবে, এর চাল-চলন যেন একটু কেমন। আড়তদার কিংবা মহাজনের বউয়ের মতো, ভাল মন্দ খেয়ে, গায়ে গতরে ফেপে ফুলে, হেলে-দুলে চলা।

অত গা-ছড়ানো গতর নয় বাছাড়ির। মাছমারার হুকুমের নৌকা সে। হালে টান পড়লে ভেসে যাবে সাঁ সাঁ করে। আনাড়ি হলে অবিশ্যি, এ নৌকাও তোমার ভার লাগবে। মনে হবে, নৌক চলে না 6यনা।

সে যাক। মাছমারার বাহন হল নৌকা। যেমনই হোক, জলে ভাসবার মতো একটা হলেই হল। না থাকলেই হল কোনওরকম ফুটো, ফাটল। থাকলে চলে না। কেন না, জলেই তোমার অষ্টপ্রহর বাস। অগতির গতি বলে, এখানে গঙ্গার খাতির নেই। ফুটো পেলে, ওখান দিয়ে ঢুকে উনি তোমাকে তলায় টানবেন।

মনের ফাটলের মতো। অটুট মনের যে ফাটল দিয়ে পাপ ঢোকে, নিপাত দেয়, সেই রকম। মানুষ হলে তাকে সেই ফুটোটা চিনতে হয়।

এ অঞ্চলে বলাগড়ের নৌকাই বেশি দেখা যায়। এখনও দু-তিনটির বেশি ভাসেনি। তারা সব তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে পুবের মাছমারাদের। একটি নৌকার গলুই থেকে একজন ডেকে জিজ্ঞেস

কথায় একটু অশ্রদ্ধার ভাব আর গলার স্বর শুনে চিনতে পারল পাঁচু। বলল, হ্যাঁ। কে, রসিক ভাই? খবর কী ওপারের? সকলে ভাল তো?

রসিক এ তল্লাটের, পশ্চিম পারের জেলেপাড়ার মাঝি, মাছমারা। পুবের মানুষদের খুব ভাল চোখে দেখে না। যেন গঙ্গার এই হুগলির সীমানাখানি শুধু তাদের। এখানে আর কেউ এলে, জাল ফেললে তাদের বড় বুক টাটায়। মনে করে, তাদের বেঁধে-রাখা জলের সীমানায় বে-আইনি ঢুকেছে। পুবের মাছমারারা।

তবে রসিকদের তল্লাটের একটু বাড়াবাড়ি আছে। আশেপাশের সব তল্লাটের সঙ্গেই তাদের গণ্ডগোল লেগেই আছে।

শহর-ঘেঁষা মানুষ। তা ছাড়া ওপারের মাছমারাদের গোটা জীবনের মধ্যেই যেন কী একটা লুকিয়ে আছে। বাইরের মাঝিরা দেখে ভয় পায়। গালমন্দ, মারধোর, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাদ যায় না। কোনও বছরই। আর হাসি ঠাট্টা বিদ্রুপ, সে তো এখন জলভাত হয়ে গেছে। নিজেরা মাছ না পেলেই বলবে, শালার যত আপদ এসে জুটেছে।

রসিক বাছাড়ি জাল ফেলে এসেছিল ও পারে। বোধহয়, চক্কর দিয়ে দেখতেই এসেছিল এ পারের নৌকা আর মাছমারাদের। বলল, ও পারে কাদের খবর চাও, সেটা না বললে বুঝব কেমন করে?

পাঁচু হেসে বলল, তোমাদের দশজনের খবর চাই ভাই।

রসিকের কোলে বৈঠা। অথাৎ পায়ে বৈঠা। হাতে বিড়ি দেশলাই। একটা বড় খারাপ কথা বলল রসিক। কথার চল ওটা এখানে। বলল, পালে পালে তো সব আসছে। এদিকে গুছিয়ে নিতে। আমাদের দশজনের খবরে তোমার আবার কী দরকার হল?

বিলাস টানোছদি জালের ভাঁজ খুলছিল। মেঘের কোলে যেন কালো চকচকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে চওড়া শরীরে। ফিরে বলল, বলে, তোমরা কটা মলে বাঁচলে, সেই খবর নিচ্ছে। সবগুলান বেঁচে আছে তো?

ওই শোনো, পুবের গরম রক্তের কথা। তোকে কে কথা বলতে বলেছে। আকচা-আকচি বাড়িয়ে লাভ কী? ধমকে উঠল, তুই কাজ কর, গুয়োটা কমনেকার।

রসিকের দিকে ফিরল পাঁচু। মুখে তার গোটা জীবনের দাগগুলি কুটো কাঠির মতো দলা পাকিয়ে আছে। উঁচু চোয়ালের কোলে, চোখ দুটি কত দূর চলে, ঠাহর করা যায় না। বলল, রসিক, চিরকালের যাওয়া-আসা, জিজ্ঞেসাবাদ করতে হয়। জবাব কাড়া না কাড়া তোমার মনের ইচ্ছে। তুমি নিজে ভাল আছ তো?

চিরকালের যাওয়া-আসা, জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়।
জবাব কাড়া না কাড়া তোমার মনের সই।

 

দুজনেরই হাত শক্ত হয়ে রয়েছে। নৌকা ঠেলে রাখতে হচ্ছে। ঠেলে কি আর রাখা যাচ্ছে। ভাটার টানে সে দক্ষিণেই ভাসছে। একটু কম ভাসছে।

রসিক কালো লম্বা মানুষ। চোখ দুটি হলদে। বয়স বোধহয় চল্লিশের কাছাকাছি। তাকিয়ে ছিল বিলাসের দিকে, ঘাড় কাত করে। বলল, হ্যাঁ, ভাল আছি। তোমার ভাইপো বেশ তালেবর হয়েছে। দেখছি।

-দেখার কী দরকার। একবার আন্দাজ নিলে হত?

মুখ থেকে যেন ক্যাঁচা মারছে। শোনো কথা! তুই শুধু শুধু কেন লাগছিস। পায়ে পা দিচ্ছে একজন। তুই সরে যা, তা না, মুখে মুখে কথা। পাঁচু কাঁড়ারের দু-ফেলে চালায় পা দিয়ে লাথি মেরে বলল, থামবি রে গাড়লের লাতি।

বিলাসকে গালাগাল দেওয়ার ওইটি পাঁচুর ধরন। কোনও কিছুর পো বলে গাল দেয় না কখনও। শোরের পো কিংবা গাড়লের বাচ্ছা, ও সব বলবে না। তাতে যে নিবারণকে গালাগালি দেওয়া হয়। গুণিন, সাইদার, গুরু নিবারণ। তাকে গালাগাল দিতে পারবে না প্ৰাণ গেলেও। গাড়লের নাতি, না হয় শোরের ভাইপো বলবে।

রসিকের নৌকা বোঁ করে পাক খেয়ে, পশ্চিম মুখে চলে গেল। কেবল তার হলদে চোখদুটি দুই টুকরো আগুনের মতো জ্বলে উঠল ধকধক করে। বলে গেল পাঁচুকে, দামিনী বুড়ি হাঁপিয়ে মরছে। তোমার জন্যে।

পাঁচু হাসল। বলল, এই এলুম বলে।

টানাছাঁদ এক রকম তৈরি করেই বেরিয়েছিল পাঁচু। বিলাস চাপন বাঁধলে জালে। জাল ফেলল। জলে। পুবে পশ্চিমে দীঘল নৌকা। যা ভাটার টান, রাখা যায় না। জালের ভাসন্ত ছোল ড়ুবিয়ে, নৌকা আগ বেড়ে ভেসে যেতে চায়। জাল ছাড়িয়ে চলল বিলাস। চল্লিশ হাত টানাছাঁদি। পুবে পশ্চিমে লম্বা করে দিয়ে, জাল ছেড়ে দিল জলে। ওপরে নিশানা রইল। ভাসমান ছেলের। জাল চলল ভেসে, পিছে পিছে নৌকা। পেছনে জাল ফেলে আসছে। কেদমে পাঁচু, একটু পুব ঘেঁষে।

টানাছাঁদি সকলের নেই। কেউ কেউ সাংলো ফেলে গড়ান দিচ্ছে এর মধ্যেই। চেয়ে দেখছে। তারা, টানাছাঁদির টান।

পাঁচু আর একবার হুঁকো নিয়ে বসেছে।

ওই দূরে দক্ষিণে দেখা যায়, খেয়া পারাপার হচ্ছে। তারপরে জেটি। জেটি পার হয়ে জলে জাল তুলতে হবে। তারপর দহ, বড় ঘূর্ণি। বাঁয়ের ওই কোলটিতে মাছমারারা ঘেষবে না।

পুবে বাঁধা ঘাট নেই। পশ্চিমে আছে। তবে, পশ্চিমের যাবৎ বাঁধা ঘাটে ভাঙন ধরেছে। শানসুদ্ধ উপুড়ে নিয়ে, মুখ থুবড়ে ফেলেছে পারে। কয়েক বছর ধরে এই খাই দেখা যাচ্ছে। তলে তলে খাচ্ছে অনেক দিন থেকেই। পুবের এ দিকটায় নৌকা রাখবারও ঠাঁই নেই বিশেষ। যদি বা কারখানা আছে, সে অনেক ওপরে, সরে রয়েছে। বাদবাকি সবই জঙ্গল। নেলো, বিষকাটারি, কালকাসুন্দে। বাতাসে কেঁপে ঝেঁপে মরছে।

জল নামছে খলখল করে। একে দক্ষিণে বাতাস। তায়, ভাটার টান জলে। যেমন টান, তেমনি ঢেউ। এক-এক জায়গায় পাক খেয়ে যাচ্ছে জল। ওটি ঘূর্ণি-ঘূর্ণি খেলা। মানুষ খাবে না ওতে। লতাপাতা পেলে এক গরাসেই সাবাড় করবে। ছোটোখাট তক্তা গেলে, ধরে রাখবে খানিকক্ষণ।

তুমি গঙ্গায় এসেছি। সামনে তোমার জলেঙ্গা জল। তোমার প্রাণ-রসানো জল। জলেঙ্গা জল তোমার গঙ্গায় আসার প্রস্তাবনা।

তার আগে তোমাকে জানান দিয়েছে অম্বুবাচী। জানান দিয়েছে, টানের দিনের কচি মেয়েটি, মা হবেন এবার। নারীত্ব দর্শন করছেন সসাগরা ধরিত্রী। মানুষের পাপ সব। তাই মন বলে, তোমার আমার ঘরনি। আর কন্যার মতন। সেদিনের বিটকি-চুলো মেয়ে, দেখো ফেঁপে-ফুলে, ছড়িয়ে ভরিয়ে, দিগদিগন্তে ঢলঢল। কেন? না, মা হলেন এবার সেদিনের মেয়ে। কোল ভরে এবার জন্ম হবে সোনা-মানিকের। চেয়ে দেখো জলের দিকে। রক্তের ঢল নেমেছে সেই অম্বুবাচীর দিন। তোমার ঘরে যেমন নামে। তাই তোমার ঘরের কুলায় যিনি ঘরনি, তিনি ক্ষুদ্র বেশে পৃথিবীর লক্ষণ নিয়ে আছেন। ইছামতীর কালো জলেও তুমি লাল ঢল দেখে এসেছি। তারপর আসবে ঘোলা জল। সেটা আরও ভাল। জলের তলে যত অন্ধকার আসবে ঘনিয়ে, ঘুটিযুটি, রাতের মতো জমাট বাঁধবে, ততই সুদিন।

আস্তে, আস্তে হে, পা দুখানি একটু নরম করে ফেলো মাটিতে। তারপরে তো তুমি আর বাগ মানবে না, লাঙল কোদাল চালাবে। সংসারের নিয়ম। তুমি দাপাদাপি করবে, জন্মাবে, মরবো, খুটে খাবে এই ধরিত্রীর পরে। এখন রাখো, ধরিত্রীকে আঘাত কোরো না। মাতৃরূপ লাভ করেছেন তিনি। তিন দিন বিশ দণ্ড, মাটিতে আঘাত কোরো না। তোমার ঘরের কথা স্মরণ রাখো। আগুন জ্বেলো না। বামুন, বিধবার রান্না পোড়া কিছুই খাবে না। সেটা আবার ধর্মের কথা। বড় জাতে পালেন। যাদের খাওয়া জোটে না, তাদের আহার পেলে সরাতে নেই। ওটাও ধরিত্রীর বিধান।

মাটিতে আঘাত কোরো না। জলে জাল ডোবানো বন্ধ রাখো।

বাড়িতে গোরু নেই, বিলাসের মা কোথেকে দুধ এনেছিল পো খানেক, অম্বুবাচীর দিন। বাড়ির সকলের মুখে ফোঁটা-ফোঁটা দিয়েছে। দুধ খাও, শাস্ত্ৰে নাকি বলেছে সাপে কামড়াবে না। আর।

দেখছি না, চারদিকে বড় ভার হয়েছে ধরিত্রীর শরীর। যৌবন এল। পুজো হবে এবার, ঢ্যালাপ্যালা পুজো। মাঠের মাঝখানে গিয়ে, ঢালা মাঠে সাজিয়ে দিয়ে আসবে নৈবেদ্য। বাজিয়ে ফিরবে শাঁখ, কাঁসি।

যুবতী হয়েছে, এবার জীব দাও। ফল হবে। মাঠে ফসল হবে, মাছ আসবে এবার জলে।

পাঁচু দেখছে চেয়ে চেয়ে। লাল জল এসেছে গঙ্গায়। মা গঙ্গার এই আসল রূপ। প্রথম লাল ঢলটা গেছে। রং আবার একটু মাটো হয়েছে। এর নাম জলেঙ্গা জল।

জলের এমনি যাওয়া-আসা। জীবনের মতো। সুখ-দুঃখের মতো। মনে কোরো না, পাহাড়ি ঢল এসেছে। এর মধ্যে। এখন যে লাল দেখছ, এ উত্তরের গাঙের জল। এর মধ্যে এখনও প্ৰাণের উত্তাপ খানিক। এখানে দেখছি জলেঙ্গা জল, কোন না। কালনার কাছাকাছি। এতক্ষণে এসেছে পাহাড়ি ঠাণ্ডা জল। ঠেলে নিয়ে আসছে জলেঙ্গা জলকে।

আগে আগে এমনি করে মুখে মুখে, হাতে পায়ে কাজ শিখিয়েছে পাঁচু বিলাসকে, হ্যাঁরে, জলেঙ্গা জলে মাছ কেন? না, সমুদ্রের জোয়ারের সীমানা পার হয়ে, যে-মাছ আছে বারোমেসে ভাটার তল্লাটে, পাহাড়ি জল তাকেই নিয়ে আসছে তাড়িয়ে। তাই, জলেঙ্গা জল তোমাকে কিছু দেবেই।

এর পরে ঠাণ্ডা জল পিছু পিছু আসবে তোমার দুঃখের প্রস্তাবনা নিয়ে। তোমাকে দশ দিন ভোগাতে পারে, দু-দিন পারে, সারা মরশুমটাও পারে। যদি সে বেশি আসে, তবে তোমার কাল হয়েছে জানবে। কেন, না, তোমার যেমন শীত-গ্ৰীষ্ম আছে, তেমনি আছে মাছেরাও। জাড় লাগলে তুমি যেমন ওম খোঁজো, মাছও তেমনি তাপ খোঁজে। তাই বরফ-ভাঙা পাহাড়ি জল সে এড়িয়ে যেতে চায়।

এখন এই জলেঙ্গা জল দু-দিন থেকে তিন দিন থাকবে! তোমার সুদিনের প্রস্তাবনা নিয়ে এসেছে। এ জলে মাছ পড়বেই। যখন এসেছে, তখন ধরিত্রী তোমাকে ফাঁকি দেবে না। তুমি ধরতে জানলেই হল। পাবেই পাবে, কম আর বেশি। যে মাছমারা জানে, সে কখনও এ তিন দিন ছাড়বে না।

তারপরেই প্রথম বরফগলা জল আসবে। কিন্তু তার কারসাজি সমুদ্রে চলে না। আর মাছ সাগরের, বরফের সঙ্গে তার কারবার নেই। গায়ে ছোঁয়া লাগলেই সে পালাবে সাগরে। তারপর সইয়ে সইয়ে আসবে। সাগরের আর পাহাড়ের জলে মিশে যে তাপটুকুনি পাবে, তাই সয়ে যাবে। জল আরও ঘোলা হবে। গঙ্গা আরও বড় হবে। আরও ফুলবে, ফাঁপবে। তোমার নৌকা যত সাবধান করতে হবে, জানবে, গঙ্গার কাল ততই তোমার সহায় হবে। কেন? না, উজনি মাছ আসবে।

কেউ বারোমাস দেয় না। গঙ্গাও নয়। কিন্তু এই মরশুমে যা দেবে গঙ্গা। যদি দেয়, তবে তোমার মার নেই। নইলে মার কেউ ঠেকাতে পারবে না। তাই গঙ্গায় তোমাকে আসতে হবে। এইখানে তোমার জীবন-মরণ অপেক্ষা করছে।

বৃষ্টি আসবে নাকি! না। মেঘ জমজমাট চারদিকে। দলা পাকানো।

যেখানে দেখবে, মেঘ চিড় খেয়ে গেছে, ভেঙে গেছে, ক্ষয় ধরে রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, জানবে ওইখানে ঢালছে। দেখতে পাবে, যেন গলে গলে কালো মেঘ সাদাটে হয়ে পড়েছে, নামছে গড়িয়ে গড়িয়ে। মাথার উপর হলে জানবে, জল ঢালিবে মাথায়। যেন চিতনো মেঘখানি সহসা ঢল খেয়ে ঢলে পড়েছে। নীচের দিকে, উবজে পড়ছে। আর দেখবে, ধোঁয়ার আস্তরণ পড়েছে যেন। ওটা জলের কণা।

সামনে জেটি। জলের টান ঠেলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে যেন বড় আয়াসে, নির্বিকার, নির্লিপ্ত, মাপজোক-কষা লোহার জটা নিয়ে। আষাঢ়ের ভাটা চলেছে তার পায়ে মাথা খুঁড়ে। কখনও কলকল করে পাক দিয়ে, কখনও শাসিয়ে, উপরে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। আর যেন বৃথা আক্ৰোশে গৈরিক চুল এলিয়ে ছুটে চলেছে দক্ষিণে।

জেটি পার হল। সামনে দেখা যায় দহ। ভাবখানা, দেখো আমি টেনে চলিনি, থেমে আছি। তোমাকে আমি দূরে নিয়ে যাব না।

সে নিয়ে যাবে না। এই জায়গাতেই ফুলে ফুলে পাক খায়। রাখলে ওইখানেই রাখবে।

সাবধান, মাঝি সাবধান।

পাঁচু বলল, পারবি?

বিলাস তার আগেই জালে হাত দিয়েছে। এই প্ৰথম জাল ফেলা আর তোলা এই মরশুমে। মহাজনের মুখের কথা ভেবো না এখন। সে তোমার বারোমাস, এও তোমার বারোমাস। মন শান্ত করে।

বিলাস জবাব দিল, না পারার তো কোনও কারণ দেখিনে।

বলে জালে টান দিল। বিলাসের কথা কানে গেল না পাঁচুর। গন্ধ বলো, শ্রবণ বলো, দর্শন বলো, সব জালের উপরে। যতই বোঝাও মনকে। জলেঙ্গা জল কী দিল, শুধু সেই ভাবনা।

-হ্যাঁ রে, জালটা ঠিক চেলে পড়েছিল তো।

—চকের সামনেই তো ফেননু।

গায়ের মাংস কিলবিল করে ওঠা-নমা করতে লাগল বিলাসের। ঘাড়ের উপর খাড়া হয়ে উঠেছে। দুটি মাংসপিণ্ড। কাজে না নেই ছোঁড়ার। তবে জিভে যেন বিছুটির পাতা আছে, কথা বললেই জ্বালা দেয়। মালো যে!

জাল তুলতে তুলতে নৌকা ভেসে চলেছে। আর বেশি দূরে যাওয়া যাবে না। সামনে, বাঁয়ের বাঁকে আওড় পাক খাচ্ছে। কোলের ঘূর্ণি। দেখে কিছু ঠাহর করা যায় না। পড়লে ছাড়ানো দুষ্কর।

পাঁচুর সারা মুখখানি যেন একটি জাল। সুতোর জটা মুখখানা যেন জলের ঢেউয়ে চলকে চলকে উঠছে। প্রায় অর্ধেকখানি জাল উঠল। বিলাসের ঝাপটায়, শূন্য জাল থেকে, রেণু রেণু হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে জলেঙ্গা জলের কণা।

তারপর, একটি লালচে ভোলামাছ। গোটকয়েক রুপালি খয়রা। বড় খয়রা। থাকলে হয়। টানাছাঁদির ঘের। না থাকবারই কথা। তারপর, জলেঙ্গা জলের আশীর্বাদ।

দুটি ইলিশ। কী তার ঝকমকানি। যেন চোখ দুটি ধাঁধিয়ে যায়।

পাঁচু উঠে বিলাসের কাছে গেল। গলুয়ে। বিলাস ততক্ষণে জালের ভেতর থেকে মাছ বার করছে। পুষ্ট, নিটোল, সুন্দর গড়নের একটি। আর একটি ছোট, একটু লম্বা। হাত দিতে না দিতে রক্ত গড়িয়ে এল। কানকোর তলা দিয়ে।

মাছে হাত দিল পাঁচু। বুড়ো প্ৰাণখনি ভরে উঠল আনন্দে। চোখে জল আসতে চায়। নিবারণ যাওয়ার পর থেকে প্রতি বছরই প্রথম দিনের মাছ পেয়ে বড় টনটনিয়ে ওঠে বুকটা। সোজাসুজি চোখের দিকে তাকায় মাছের। তুই সব দেখিস, তোর চোখে ফাঁকি পড়ে না কিছু। আমার দাদাকে দেখে এসেছিস, আমাকে দ্যাখা। আমি তোর জন্যে এসেছি।

বিলাস বাকি জালে টান দিল। জাল প্ৰায় শেষ। আরও খানকয়েক খয়রা।

জালের গায়ে মেলাই মেকো। মেকো হল কাঁকড়ার বাচ্চা। সে কি একটা দুটো। নৌকা ভরে গেল জালে-ওঠা মেকোয়। আর তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছে রসনা চিংড়ি। এখনও অতি ছোট, প্রায় বিন্দু বিন্দু।

মেকো তোমার মাছের বাহন। থাকলে বুঝবে, অল্প হলেও মাছ আছে গঙ্গায়। তবে বড় আঁশটে গন্ধ হয় মেকোর জলে! আসে লাখে লাখে, মরে লাখে লাখ। মরলেই গন্ধ হয় জলে। বিস্তর জন্ম, বিস্তর মড়ক। এর মধ্যেই বাতাসে একটু একটু আঁশটে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

পাঁচু দেখছে মাছ। হ্যাঁ, সুন্দর। বড় মাছটির কোমরের ওপরে একটু টিপন দিয়ে দেখল। হুঁ, ডিম আছে একটু। তা হলেও বেশ।

সুন্দর গড়নটি। আটোসাটো যুবতী মেয়েমানুষটির মতো। লম্বাটি পুরুষ, বেটাছেলে মাছ।

ওদিকে কেদমেও পেয়েছে মন্দ নয়। খয়রা আছেই। একটি ছোট ইলিশ, একটি মাঝারি রিঠে।

—কেমন হে কদম পাঁচু?

–ভাল।

–হ্যাঁ ভাল।

দক্ষিণা বাতাস রয়েছে। একজন তো থাকে ওই বাতাসে। বুকের মধ্যে বড় টনটন করে। এই বুঝি আট বছর হল, পাঁচু একলা। আর একজনের নিশ্বাস ঘুরে মরে এইখানে। টের পায় পাঁচু।

মাছমারারা জানে, গুণিন মরলে দানো হয়। হতে পারে। তবু সে দাদা। অকল্যেন তো করবে না। তার আশীর্বাদ রয়েছে।

বাড়ির মানুষগুলোর বড় দুৰ্দশা যাবে এখন কি মাস। কোনওরকমে বেঁচে থাকবে। মাছমারার ঘর তো। তারা ফিরে না এলে, ঘরে কিছু থাকে না। তা দিয়েছে মন্দ না জলেঙ্গা জল। নিশানা দিয়েছে ভালই।

নে নে, নৌকা পুবে ঠাল। এই উজান ঠেলে যেতে হবে। আবার উত্তরে। তারপরে, পাড়ি ওপারে।

জাল রেখে লাগি ধরল। বিলাস। কাঁড়ার থেকে হাল চাপল পাঁচু। বিলাস গান ধরে দিল,

তোমারে না পেয়ে হিদে বড়ই অ-সুখ–হে
বড় উথালি পাথালি আমার বুক।

বড় উথালি পাথালি ছোঁড়ার বুক। ওর লগি ঠেলার চোটে আমার ঠেলা হয় না, এত জোর। দাঁড়ারে, দাঁড়া, তোর বুক শান্ত হবে। এই মরশুমটা যাক। অগ্রহায়ণে নয় মাঘে, এবারে কাজ সারতে হবে। নৌকাটাও যদি কোনওরকমে মহাজনের কবল থেকে একেবারে নিতে পারি, তবেই হয়ে যাবে। তারপর একটু বাঁধা সুখের ঠিকানা খুঁজতে হবে আমাদের খুড়ো-ভাইপোকে। এই না জন্ম জন্মান্তরের সাধ। জলেঙ্গা জলের এই নিশানাটুকু এই যেন অক্ষয় হয় এই মরশুমে।

ভাবে পাঁচু, হালে চাপ দিতে দিতে। তা আবার গোমলি পাঁচকে নাকি পছন্দ নয়, বড় যে ছেলেমানুষ। তবে কি তোমার জন্যে এখন একটা ধাড়ি বেশি ধরে নিয়ে আসতে হবে। এমনিতেই গাঁয়ে কথা হয়। গামালি পাঁচিকে নিয়ে। মেয়ে একটু বড় হয়ে পড়েছে। কথাটি মিছে নয়। মেয়েমানুষের বাড়, সে যে আগুন। যতই চাপে, চোখে পড়বে ঠিক। বলছে যখন দশজনে, তখন বড় হয়ে পড়েছে নিশ্চয়। আর সয়ারামের মুখে শুনেছে পাঁচু, ওদিকে একটু টানও ছিল ভাইপোের। কী একটা অঘটন ঘটে গেল অমর্তের বউয়ের সঙ্গে। এখন বলছে বড় ছেলেমানুষ।

তবে বলতে হয় তোমাকেই মুখ ফুটে, কাকে তোমার পছন্দ। দিবানিশি তোমার মন ফস ফস করে। উথালি পাথালি করে। বিষ রয়েছে তোমার প্রাণে। সে পাক দিয়ে উঠছে ভিতরে ভিতরে। তোমার জ্বালা বুঝি। মন-প্ৰাণটি একজনের কাছে দিয়ে তোমাকে বলতে হবে, একটু জুড়িয়ে দাও গো। আমার এত পাপ, এত পুণ্য, এত সুখ, এত দুঃখ, সব নিয়ে জ্বলে মরছি অনেক দিন থেকে। তুমি জুড়িয়ে দাও।

তবে হ্যাঁ, সে মানুষ মনের মানুষ হওয়া চাই। অবশ্য হওয়া চাই। পছন্দসই হতে হবে।

তুই আমার ভাইপো। তোকে বাবা বলি, সোনা-মানিক বলি মনে-মনে। তুই কাজের ছেলে। কিন্তু তুই বাদা-ঘাঁটা, সমুদ্র-ঘাটা ছেলে। গঙ্গায় আসিস এই শহরের পারে। কেমন তোর পছন্দ, সেই আমার ভাবনা।

হঠাৎ সংবিৎ হল পাঁচুর। বিলাসের সঙ্গে চোখাচে্যুখি হল। বিলাস বলল, কী দেখছি তখন থেকে তাককে, বল দি নি? যেন একেবারে চোখ-খাবলার মতো অপলক দেখছ।

শোনো, আমি নাকি চোখ-খাবলার মতো দেখছি। রেগে বলেনি, আসলে এতক্ষণ ধরে খুড়োকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেয়েছে বিলাস।

পাঁচু বলল, তোকে কি আর দেখছি আমি। আমি ভাবছি। দশটা কথা। ঠ্যাল ঠ্যাল, লগি ঠ্যাল।

খেয়া ঘাট পার হয়ে গেল। পার ঘেঁসে নৌকা উজানে চলেছে। কলকল করে ডাক ছেড়ে চলেছে ভাটার জল। সামনে ইট পোড়াবার কল। কল এখন বন্ধ। বিষাকালে পাততাড়ি গুটিয়েছে সব। পলি পড়বে সারা বিষৰ্গ, সেই মাটি দিয়ে পরে ইট তৈরি হবে। যেন পোড়ো কারখানা। পুরনো আর ভাঙা ইটের পাঁজায় ভূতুড়েবাড়ির মতো খাঁ খাঁ করছে। লোকজন নেই। ইটকলের পর মরুই-পোড়া ঘাট। তাকে ঠিক শ্মশান বলা চলে না। তারপর দুটি কারখানার পাঁচিল। কারখানা পার হয়ে পাড়ি দিতে হবে পশ্চিমে।

গঙ্গার ধারে পলি পড়েছে। দক্ষিণের মাটি নিয়ে এসেছিল জোয়ারের নেশায়। তখন খেয়াল ছিল না। এখন মাখনের মতো ছড়িয়ে রেখে যাচ্ছে নরম মাটি। পলিতে কিলবিল করছে মেকো। জল না পেলে শুকিয়ে মরে বাছাধনেরা! ওর মধ্যেই আছে। রসনা চিংড়ির মেলা। কাকের দল এসেছে উড়ে। বক ঘুরছে ইতস্তত। লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলছে, যেন পাড়ার বামুনঠাকুরুনটি। বড় ছুচিবই, যেন দেখেশুনে পা ফেলছে। আসলে নজর আছে ঠিক মেকো আর চিংড়ির ওপর। ভোজ লেগেছে কাক-বকের।

মেঘ পাতলা হচ্ছে। এত সময় করলে কী তা হলে আকাশ জুড়ে। রাতভোর এত গুমসোনি, এত বিজলি চমকের ঠাট। এখন আবার রোদ দেখা দিচ্ছে থেকে থেকে।

—একবার দাঁড়িয়ে যাবে নাকি হে?

ফড়ে ডাকছে, শ্মশানের উত্তর কোলে দাঁড়িয়ে। বিলাস তাকাল খুড়োর দিকে, পাঁচু দেখল ফড়েকে। চেনা-চেনা মুখ! এখানকার যাবৎ ফড়ে-পাইকেরই চেনা-মুখ। লক্ষ রেখেছে ঠিক, মাছ পেয়েছে এরা।

পাঁচু বলল, দাঁড়াবার উপায় নেই গো।

-কেন, পেয়েছ তো।

কী পেয়েছে, সেটি বলবে না। মাছ বলতে নেই। হয়তো মনের ধোঁকা। তবু নাম কোরো না। যাকে মেরেছি, তার আত্মা আছে। এখানেই, এই বাতাসে, জলে। সে সদয় হয়ে এসে মরেছে। তোমার হাতে। নাম করলে সে বিমুখ হতে পারে। জিজ্ঞেস করো, আছে নাকি। দেবে নাকি? পেলে নাকি?

পাঁচু জবাব দিল, তা পেয়েছি। কিন্তু দেওয়ার উপায় নেই। নেবার লোক আছে।

পাইকের বলল, কেন, আমরা কি লোক নাই?

এইরকম কথা ফাঁড়ে-পাহুঁকোরদের। এই তো সবে শুরু। আরও কত কথা হবে। মাছ কি আমি আমার নৌকার খোলে পচিয়ে রাখবার জন্যে ধরেছি। ধরেছি। আর-একজনের হাতে দেওয়ার জন্যেই। সেই তো আমার বড় পুন্য। থাকতেও যদি না দিতে পারি, তা হলে বুঝবে, আমার কোনও প্ৰতিবন্ধক আছে।

কিন্তু এরা তা বুঝবে না। খালি এড়ো এড়ো কথা বলবে। জবাব না দিলে দেবে গালাগাল। পাঁচু বলল, লোক বইকী। কিন্তুন আমার দেবার উপায় নেই।

বলতে বলতে নৌক এগিয়ে গেছে অনেকখানি। পিছন থেকে বলে উঠল কেদমে পাঁচু, আমি দিয়ে যাই পাঁচদা।

পাঁচু বলল, দিয়ে এসো।

বিলাস বলল, মাছ কি তুমি দামিনী বুড়ির জন্যে রাখলে?

-হ্যাঁ।

–পেত্থম মাছ বুড়িকে দেবে?

—হ্যাঁ। নগদে দেব। ধার-দেনা আছে বুড়ির কাছে। সেটার শোধ এখন দেব না। দিন তো পড়ে আছে। কিন্তু পেখম মাছ আমাকে বুড়িকেই দিতে হবে। রসিক বলে গেল যে বুড়ি বসে আছে আমাদের পথ চেয়ে। ও বাবা, না দিলে আমার পাপ হবে না?

যদি নগদ না দেয়?

—দেবে। তুই কি নতুন এলি নাকি? পেখম মাছ কেউ ধারে কাটিয়ে দেয় নাকি? না, কেউ ধার চায়? তার ঘটে বুদ্ধি নেই? নে নে, পাড়ি দৈ। পাল খাটা। খাট্টে কানদড়িটে দে আমার কাছে।

মাস্তুলে জড়ানো ছিল পাল। বাতাস রয়েছে ভালই। পাল খুলে দিয়ে, কানদাড়ি দিল বিলাস খুড়োকে। পাঁচু পায়ের আঙুলে বাঁধলে কানদাড়ি। নৌকা দিল ঘুরিয়ে পশ্চিম কোণে। বাছাড়ি ছুটিল গোঁ ধরে, বাঁয়ে চেপে।

জলেঙ্গা জল নামছে কলকল করে। প্ৰাণে বল দিয়েছে এই জল। জলের দিকে তাকিয়ে বলে পাঁচু মনে মনে, মা গো, এই জলটুকু রাখিস সারা মরশুমটা। আশ্বিন মাসের গঙ্গাপুজোয় পেট ভরে খাওয়াবে তোকে মা।

নৌকা এসেছে মন্দ না। ওই দেখা যায়, গলুয়ের চেয়ে কাঁড়ার অনেক উঁচু নৌকা কয়েকটা, ওগুলি দূরে পুবের নৌকা। এখন সেখানে পাকিস্তান হয়েছে। নৌকার কাঁড়ার বেশি উঁচু। পাথালিতে একটু বড়। খোল গভীর। প্ৰায় বলাগড়ের নৌকার মতোই। তবে ভাবখানি যেন আর-একটু চোখা চোখা।

পুব দেশের মাছমারাদের নৌকার গড়ন ওই রকম। সমুদ্রে দেখেছে পাঁচু অনেক। আজ দেশ ভাগাভাগি হয়েছে। পুবের লোকেরা আসত সমুদ্রে। বড় বড় সাই আসত পদ্মা-মেঘনা-পারের। খুব ভাল মাছমারা ওরা। সাহসও দুর্জয়।

তবে নৌকাগুলি দেখলে পাঁচু থতিয়ে যায় একটু। এত উঁচুতে বসে কাজ করে কেমন করে এরা। তবে হ্যাঁ, যার যেমন তার তেমন। পেট থেকে পড়ে ওই নৌকায় মাছ মেরেছে তারা। তারা আবার বাছাড়ি নৌক দেখে ভাবে, এ তো বাচ খেলার নৌকা, এতে কাজ হয় কেমন করে!

 

পশ্চিম সীমানায় আসা গেল। খরস্রোত এ পারে। খেলার বহরটাও বেশি। পায়ে পায়ে দহ। চোখে দেখতে পাচ্ছ না, কিন্তু পশ্চিম পার খাচ্ছেন একজন দিবানিশি। খানে খানে জল ফুলছে।

সামলে। পাল গুটো বিলেস। উলটা স্রোত দেখা যায়। এপারে উঁচু পাড়। ভাটার জল নেমেছে। কোলের জমি দেখে বোঝা যায় কে যেন এতক্ষণ বড় বড় থাবায় আঁচড়েছে।

পুব পারের যেখান থেকে পাড়ি দিয়েছিল, পশ্চিম পারে আসতে আসতে ভাটার টানে পেছিয়ে এসেছে প্ৰায় আধ মাইল। আবার লগি ঠেলতে হবে। কিন্তু লগি ঠাঁই পায় না। এ পারে।

দাঁড় ধর বিলেস। সামনে, চন্দননগরের মীয়াজীপিরের দহ। ডাঙার উপরে পিরের থান। এখন পির আছেন ওই দহে। তার মাথার উপর দিয়ে যেতে পারবে না। গেলে নৌকার তলা ফেঁসে যাবে। পির টেনে নিয়ে যাবেন তলায়। তারপরে ঘোড়া-পির। উনি এখনও জলে নামেননি। নামলে আওড় হবে। পাক খাবে জল। এখন অনেক মাছমারা ঘোড়াপিরের তলায়ও থাকে। অর্থাৎ ঘোড়াপিরের থানে।

কিন্তু পাঁচুকে যেতে হবে। আরও আধ মাইলটাক। তার মধ্যে আছে কয়েকটি কাঠ, চুন, সুরকির গোলা। কাজের ফাঁকে ওখানকার কুলি-কামিনরা পা ছড়িয়ে গালে হাত দিয়ে একটু বসে গঙ্গার পাড়ে এসে। তাকিয়ে দেখে ভিনদেশের মাঝিদের। তখন বোধহয় ঘরের কথা মনে পড়ে ওদের। গান গায় তখন। পাঁচুরা তার ভাষা বোঝে না। সেও দূরের মাছমারা। সুরের মধ্য দিয়ে আসল কথাটি মর্মে মর্মে বোঝে, কাকে ডাকছে তারা। কেন ডাকছে। বিদেশে এসে মাছমারারা যাদের কথা ভাবে, তারাও ভাবে সেই ঘরের মানুষের কথা।

পার হয়ে এল আধ মাইল। শ্মশানঘাট। ঘাটের পাষাণ গেছে উলটে। মুখ থুবড়ে উলটো হয়ে পড়ে আছে চিতিয়ে। ভাটা তার উপরে পলি ফেলে গেছে। মেকো গিজগিজ করছে। ভাঙা, বিকটমূর্তি পাষাণে।

একটি পুরনো অশখগাছ বাঁকানো পাকানো অগুনতি হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু পাড়ে। গোড়া থেকে মাটি ধসে গেছে। মনে হয়, শিকড়ের জটা নিয়ে প্রায় ঝুলে আছে বুড়ো অশখ। কপালে-সিঁদুর একটি সাধু ঝিমুচ্ছে বসে ভাঙা মুমূর্ষ ঘরের দরজায়। আর জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে বসে আছে দুটি পাঁশুটে কুকুর।

দাঁড় বাইতে বাইতে হেসে বলল বিলাস, আহা রে, বাছাদের আমার শোক দ্যাকো দিনি একবার।

অবাক হয়ে পাঁচু বলল, কার কথা বলছিস রে!

—ওই সাধুবাবাজি আর কুকুরের কথা বলছি। মড়া আসেনি, বেচারিদের ঝিমুনি কাটছে না।

—হেই হেইরে শোর, কাকে কী বলছিস তুই? তোর পাণে ডর নেই?

–কেন?

–কেন? আরো গাড়ল, ওঁয়ারা যে অন্তয্যামী।

বিলাস হেসে উঠে বলল, কারা? ওই মড়া-খেগোগুলান?

পাঁচুর হাতে হাল থেমে গেল। চিৎকার করে উঠল, চুপ করবি রে গাড়লের জাত, অ্যাঁ?

চুপ করল বিলাস। দাঁড় টানতে লাগল। দ্বিগুণ বেগে। মাছ পেয়েছে, তাই প্ৰাণে আর কোনও কথা বাগ মানছে না। কিন্তু মানাতে হবে। তুমি সব শেষ করে এখানে আসো। এরা তোমার শেষ পথের দ্বারী। এদের নিয়ে মশকরা চলে না।

শ্মশান গেল।

তারপরে ঘন জঙ্গল। নেলো, বিষকাটারি, কালকাসুন্দে আর আসিসেওড়ার ঝোঁপ। এদিকটা বড় নির্জন, কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে। বাড়ি-ঘর-দেরও বড় একটা দেখা যায় না।

আর ওই দেখ জল ওখানে দাঁড়িয়ে কেমন ফুলছে, যেন ভিতরে ড়ুব দিয়ে কে মোচড় দিচ্ছে স্রোতের বুকে। স্রোত পাক খেয়ে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে। উপরের ডাঙায় জানোয়ারের হাড়-পাঁজরা দেখা যায় ছড়িয়ে আছে। এদিকটা ভাগাড়।

তারপরে পাড়া। দেখেই বোঝা যায় ডোমপাড়া, ইতস্তত এলোমেলো ঘরের সারি। শুয়োর ঘুরছে কয়েকটা। আবার একটু বুনো জমি ছাড়িয়ে নতুন পাড়া দেখা যায়। পাড়াটা পুবে-পশ্চিমে লম্বা। গঙ্গার ধার থেকে ঢুকে গেছে। পশ্চিমে, গঞ্জের ঘিঞ্জিতে গেছে। হারিয়ে। একরাশ ঘর দেখা যায়। ছিটে বেড়া, গোলপাতার ছাউনি দেওয়া ঘর। মাঝে মাঝে কোঠাবাড়িও দেখা যায় দু-একখানি। গঞ্জের উপরে সবই অবশ্য কোঠাবাড়ি।

লোকে বলে, এটা মেয়েপাড়া। বলতে পারো, বাজার। মেয়েদের বাজার। খারাপ কথায় যদি বলো, তবে বেবুশ্যেপাড়া। খারাপ, কেন না। ওটা গালাগাল হয়ে গেল।

বাজার বলা ভাল। আমার জিনিস, এই নাও, সাজিয়ে গুছিয়ে বসেছি, এখন তোমার পছন্দ। মাছের বাজারে এসেও তুমি তাই করো। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখো। দরদস্তুর করো। আমার কলজের কথা তুমি বুঝবে না। তুমি কিনিয়ে, আমি বিকিয়ে। তুমি আমার লক্ষ্মী, তোমার ওপরে আমার কথা চলে না।

তবে সেটা মাছ, এটা মানুষ। তোমার প্রবৃত্তি নিয়ে কথা। মাছ বিক্রি করি, মানুষ বিক্রি করতে পারিনে আমি। কিন্তু মেয়েমানুষ নিজের অঙ্গ বিকোচ্ছে ওখানে। মানুষের অঙ্গ। তোমারও মানুষের অঙ্গ। একজন বিকোয় পেটের দায়ে। তুমি কেনো মাছের মতো।

আমি মাছ মারি, আমি জানি আমাকে সে মারছে দিবানিশি। তুমি ভাবো তোমাকে কে মারবে।

কাছের পুব থেকে যারা আসে, দক্ষিণ দেশের পুব থেকে, তাদের সঙ্গে এদের ও সব সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ, ধারে কাছের ঘরে যারা আছে তারা আসে মাছ নিতে। তাদের রং-ঢং একটু আলাদা। সকলেরই থাকে। তুমি যদি দিগগজ হও, সেটা বোঝা যাবে তোমাকে দেখে। আমাকে দেখে বলতে পারবে। আমি মাছমারা। তেমনি তাদেরও বোঝা যায়। মাছ চাইবার রীতিটা তার একটু আলাদা।

ক্যাঁচা দেখেছি মাছমারার? লোহার ধারালো ক্যাঁচা, শোল বানমাছ গিথে মারে তাতে। তারা, চোখে মুখে ওই রকম ক্যাঁচা মারে। মেরে মাছ চায়। ওটা তাদের অভ্যাস। ওতে মাছমারা মরে না। ঘায়েল হয় একটু। ঘরের মেয়েমানুষের কথা মনে পড়ে যায়। তার। তখন বুকে একটা ঝড় ওঠে। উঠে, বুকের মধ্যেই দাপিয়ে মরে। বড় কষ্ট হয় তাতে। মাছমারার আসল মরণ অন্যখানে। ও ক্যাঁচা তাকে বিধে না। দুটো চারটে পয়সা তোমাকে কমাতে হবে এখানে। বলবে দু-আনা পয়সা কম দেব, মাঝি ভাই, খাইয়ে যাও একটি মাছ।

তা সব মানুষের সমান নয়। সুখ-দুঃখ দেখতে হয়। পারলে তুমি না বলতে পারো না। মাছমারাদের আর কোনও সম্পর্ক নেই। নেই, তবে হাতের পাঁচটা আঙুল তোমার সমান নয়। যে মাছমারার প্রাণ পড়ে গেছে। এখানে, সে রকম দু-এক জনকে দিয়ে বিচার হয় না। এটা একটা মজলিশের মতো। রক্তে একবার ধরে গেলে ছাড়ানো যায় না। ঘরে যার বউ নেই, তার রক্তে ধরে বেশি। টাকার চেয়ে মাছের লেনদেনেই কাজ চলে। মাছমারাকে তার ঘরেও যেতে হয় না। গঙ্গার পাড়েই, একটু ফাঁকা নিরালায় নগদ বিদায় হয়।

তোমার দুটি মানুষের চোখ আছে। তোমার চোখ নেমে যাবে লজ্জায়। যে বিকোয় তার জায়গা অ-জায়গা, ঘাট অঘাট নেই। যে কেনে তারও। যে কেনে তার এটা স্বপ্নের তৃষ্ণা। স্বপ্নে যখন তোমার তৃষ্ণা পায়, তখন তুমি কত জল খাও। তবু তোমার তৃষ্ণা মেটে না। তোমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, বেরিয়ে যেতে চায় প্রাণটা। কত জল খাও, কত জল। তবু তৃষ্ণা মেটে না। তারপর স্বপ্ন ভাঙলে, কলসি থেকে জল গড়িয়ে ঘটি ভরে জল খেয়ে তৃষ্ণা মেটাও।

এটা তার স্বপ্নের কাল। তাই সে অন্ধ।

সমুদ্রে, গঙ্গায়, হাটে-বাজারে, সবখানে ছড়ানো আছে তোমার জন্যে এ সব। সমুদ্রের মাছ মেরে তোমাকে যখন হাসনাবাদ কিংবা ক্যানিং-এর আড়তে যেতে হয় তখন দেখা যাবে। হাড়োয়ার মাঘ মাসের মেলায় কত মেয়েমানুষ আসত। নিজেদের বিকিয়ে কুল পেত না তারা।

কিন্তু এখানে ওখানে তফাত আছে। মাছমারা তো শহরের কলকারখানার গঞ্জের নাগর নয়। ভিনগাঁয়ের কুকুরের মতো ল্যাজ গুটিনো থাকে তার। শহরের রঙ্গিনীরা সেই চোখে দেখে তাকে।

এ পাড়ার পরে একটি কাঁচা ঘাট। এইবার নতুন পাড়া পড়ল গঙ্গার ধারে। কয়েক ঘর জেলে আছে, তারপরে আবার জঙ্গল। ওপরের দিকে কয়েকটি ছোটখাট চাল-তামাক-কাঠের আড়ত, আবার পাড়া। এবার নৌকা নোঙর করতে হবে।

সারি সারি গাছ নেমে এসেছে কয়েকটা। আমগাছের পাশে তেঁতুল, তার পাশেই মস্ত বড় বটগাছ। বুড়ো গাছ, জটা ছড়িয়েছে আশেপাশে। শিকড় বিস্তৃত হয়েছে গুঁড়ি মেরে মেরে। গঙ্গায় ছয়েছে গিয়ে প্রায়।

নোঙর করবার আগে, বটের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দামিনী। ফোগলা দাঁতে হোসে, রোদ আটকে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ধলতিতের লোক এলে নাকি?

পাঁচু হাসল। পাড়ে গলুই তুলে দিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি পাঁচু এনু। চিনতে পারছ না?

দামিনীর দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হল পাঁচু। বলল, কী হল গো দিদি। চুল কেটে ফেলেছি, চেহারাখনিও কেমন রোগা রোগা লাগছে।

বলতে বলতে দেখতে লাগল পাঁচু। চুল পেকেছিল বটে বুড়ির। কিন্তু তেল দিয়ে তাকে পেটো পেড়ে আঁচড়ানো থাকত আগে। অবশ্য, দামিনীর চুলও ছিল অনেক। বুডো বয়সেও ছিল চোখে মুখে কথা। গত বছরে একটু ভাঙন দেখে গেছল দামিনীর। কিন্তু ভাঙনটা অনেকখানি এগিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে।

বড় ডাকসাইটে ফড়েনি ছিল এ পারের। ও পারেরও বটে। দুপারেই তার যাতায়াত ছিল। মাছের বাজারে যখন প্রকাণ্ড আঁশবঁটিখানি নিয়ে বসত দামিনী, তখন বাজার আলো করে বসত। রাত পোহালেই চান করে, একপিঠ চুল ছড়িয়ে দিয়ে বসত। নাকখানি বেশ উঁচু ছিল। চোখ দুটি তেমন বড় নয়। কিন্তু ধার ছিল খুব। মস্ত আশবঁটখানির সামনে মানাত তাকে। আশবঁটির ধার যত দেখতে ইচ্ছে করে তত ভয় হয়। দামিনী ছিল বাজারের তেমনি মেয়েমানুষ। সেও একখানি আশবঁটি। তাতে খান খান হয়ে কাটা পড়বার সাধ হত। কত ভদ্র অভদ্র মাছের, কত না জানি কেটেছে। অবশ্য সেটা বয়সকালে। তবে, বয়সে যার আলো থাকে, শেষদিকে সে অন্ধকার করে যায় না। দামিনীর বড় রকমের আসর ছিল বরাবর। গত বছরও দেখে গেছে পাঁচু।

দাদা নিবারণের সঙ্গে বড় হাসি-মশকরা ছিল দামিনীর। বিস্তর টাকা ফড়েনির, বড় মহাজনের মতো। টাকা ধারের কথা নিবারণকে বলতে হত না। দামিনী সেধে দিয়ে যেত। দিয়ে বলত লু তুলে, হিসেবটা তুমি রেখো বাপু, ও আমার মনে থাকে না।

সাইদার নিবারণ। দামিনীর চোখের দিকে না তাকিয়ে বলত, তোমার বড় দয়ার শরীর। আমি মাছ মেরে খাই দামিনীদিদি। আমার কাছে এত বেহিসেবি হয়ে না তুমি।

সে দামিনী কুড়ি-পঁচিশ বছর আগের দামিনী। নিজের প্রাণে ভয় ছিল না পাঁচুর, দাদার জন্যেই তার বুকের মধ্যে বড় ধকধক করত। আমরা মাছ মারি, সে বিক্রি করে খায়। শুধু খায় না, পুঁজিও অনেক। দাদার কখন কী মতিগতি হয়ে যায়, কে জানে।

তখন অবশ্য দামিনী আশ্বিনের গঙ্গা। দেহের স্রোতে নাবালেরই ঢল। শুকোবে শিগগিরই। কিন্তু সেই তো শেষ টান। ওই টানে পড়লে, পুরুষের উঠে আসা বড় দুষ্কর। কেন না। ওটা ছেউটি মেয়ের শুধু পিরিতের ঝাঁজ নয়। সংসারের সব ঘােট অঘাট দেখা হৃদয় বড় গহন। তাতে জল বেশি। ঘূর্ণিও আছে।

দামিনী বলত, মাছের একটি অংশও বঁটিতে বেসামাল হয়ে কাটিনে। পাল্লার ওজনে আমার নিক্তির ওজন। বেহিসেবে বলে আমাকে কেউ দুনাম দিতে পারবে না নিবারণদাদা।

নিবারণকেও সে দাদা বলত। কথায় পারা নিবারণের কর্ম ছিল না। বলত, তোমার হিসেবে ভুল না হয়, আমার যদি হয়।

দামিনী বলত, হয় তো হবে। তার জন্যে তো তোমায় কেউ মারতে আসছে না গো। তুমি সেয়ানা মানুষ। সোমসারে সেয়ানা মানুষের বেবভুল হওয়া দেখলে ভাল লাগে।

নিবারণ হাসত। প্ৰাণে কী হত, কে জানে। পাঁচুর বুকে লাগত সমুদ্রের হাঁকা। ঘরে রয়েছে। বউঠান, ছেলেমেয়ে। তার বুকের মধ্যে উঠত দখনে বাওড়ের ডাক।

কিন্তু সুখে দুঃখে কাটিয়ে গেছে নিবারণ। মাছমারারা নানান কথা বলেছে। তবে মনে প্ৰাণে জানত সবাই, মাছ মারতে এসে নিবারণ মালো ছিল খাঁটি মানুষ।

সেই দামিনী। গত বছরও একেবারে সোজা না হলেও অনেকখানি খাড়া দেখে গেছে। এখন, বুড়ি ঝুঁকে পড়েছে একেবারে। রোগা ডানায় আছে। অবশ্য সেই সোনার অনন্ত। হাতে বালা, গলায় হার। তবে সবই যেন কেমন বেমানান, নড়বড়ে, ঢলঢলে দেখাচ্ছে। নাকে এখনও আছে পাথর-বিসানো সেই নাকছবিখানি। কিন্তু নাকটি এবার ঝুলে পড়েছে। তেমন তোলো নেই। আর।

বিলাস নোঙর করল নৌকা। পাঁচু নেমে এল নৌকা থেকে।

দামিনী কাছে এসে বলল, চিনতে পারছি বইকী। চিনিব না! তোমরা কি আমার আজকের মানুষ। চুল আর রেখে কী হবে বলো। অনেক বয়স হল। কে আর চুলের সেবা করবে। তাই কেটে ফেলে দিয়েছি। তোমাদের সম্বাদ ভাল তো?

পাঁচু বলল, ওই এক রকম। ভালর কাল অনেক দিন চলে গেছে দামিনীদিদি।

বলে একটি নিশ্বাস ফেলল। পাঁচু। দামিনীও নিশ্বাস ফেলল। ফেলে, দুজনেই যেন একবার ভালর কালটিকে পিছন ফিরে দেখে নিল।

একজনের সঙ্গে সবই চলে গেছে যেন। সেই একজন নিবারণ। আসলে বোধ হয় তাদের যৌবন।

কিন্তু দামিনী বলল, তা কেন যাবে। যাওয়া-আসা আছেই সংসারে। আবার আসবে! ভাইপো তো মরদ হয়ে উঠেছে আর কী!

তা ঠিক। মানুষের কথার মধ্যে তুমি সত্য খুঁজে পাবে। যাওয়া-আসা আছেই সংসারে। আবার শুরুত্ব পামিনীর সঙ্গে পর্তুও অকাল বিলাসের দিকে। হ্যাঁ মরদ হয়ে উঠেছে। অনেক দিনই উঠেছে।

বিলাস বলে উঠল, আন কথা রাখো এখন। আমাকে আবার তিবড়ি জ্বালাতে হবে। যা করবার, তা করে নাও।

কী মাকড়া ছেলে। বছর ঘুরে দেখা। মানুষের সঙ্গে দুটো কথা বলতে দে। তা নয়, ওই যে দুজনে তাকিয়ে রয়েছি। ওর দিকে, তাইতে ওঁয়ার শরীম লেগে গেছে। তা ছাড়া মন-মেজাজও সেই রকমই হয়েছে আজকাল। নিজের ভাবই খুঁজে পায় না ছোঁড়া। তা আবার পরের ভাব।

দামিনী বলে উঠল, কেন গো, খিদে মানছে না বুঝি?

বিলাস পষ্টই জবাব দিল, না।

পাঁচু বলে উঠল, তুই থাম। তিবড়ি জ্বালাতে হয় জ্বালাগে।

দামিনী বলল, আমাকে রসিক বলে গেল, তোমরা এসেছি। শুনলুম, এসেই জাল ফেলেছ ও পারে। সেই থেকে বসে আছি। মন থেকে তোমাদের কোনও দিন অবিশ্বাস করিনি। তা এখন আবার কী হয়, তাই দেখো।

পাঁচু বলল, কেন গো, আবার হবে কী? দামিনী একটু এদিক ওদিক তাকাল সন্ত্রস্তভাবে। পাঁচুর মনটিও হাঁসফাঁস করে উঠল। দামিনী কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, আমার মেয়েটা মারা গেছে, বুইলে ভাই।

বলতে বলতে দামিনীর গলার স্বর ভেঙে গেল। কয়েক মুহূর্ত কান্না রোধ করে বলল আবার ফিসফিস করে, এখন সব কিছুর মালিক আমার নাতিন। ব্যাবসা সবই তার হাতে। বড় মেজাজি মেয়ে, বুইলে দাদা, বড় রাশভারী। বয়স কাঁচা। বাজারে বড় একটা যায়-টায় না। যদিন আমি ছিলুম, আমি গেছি। তা তোমাদের কাছে তো কিছু নুকোছাপা নেই। ওর মা, আমার মেয়ে, বুইলে, কাঁচা বয়সে বেধবা হয়ে রাঁড় হয়েছিল। সে অবিশ্যি বেঁচে থাকলে, এ বছর থেকে বাজারে যেত মাছ বেচিতে। নাতিনেরও আমার সুরাহা হত একটা। তা ভগবান দিলে না। পেছনে ঘুরছে এখন ষ্টুড়ির দশগণ্ডা পুরুষ। ঘুরুক, মেয়ে চট করে টোল খাবে না। পাড়ারই একজনকে দিয়ে বাজারের কাজ চালায়। আমিও যাই। বুইলে দাদা, নাতিন আমার হাতে নয়। তোমাদের কথা আমি তাকে বলেছি। বলেছে, চিনিনে শুনিনে, ধার-দেনা দিতে পারব কি না বলতে পারিনে। দেখি আগে, আসুক। আমাকে মাল দিক।

বলে আবার এদিক ওদিক তাকাল। মনটা বড় দমে গেল পাঁচুর। দামিনীর নাতনির কাছে তার জীবন বাঁধা নেই। জীবন তার এ জলে বাঁধা। তবু দামিনী সহায় ছিল। বুকে বল ছিল অনেকখানি। গঙ্গা নির্দয় হলে মুখ তুলে চাইবার ছিল একজন। বিশ্বাস করত মনে প্ৰাণে।

বিলাস বলে উঠল, অত কথায় আমাদের কী দরকার! তোমার লাতিনের কাছে তো আমরা খাত লিখে দিইনি।

পাঁচু ধমকে উঠল, তুই থাম দিকি গুয়োটা। দামিনী বলল, এখন দিচ্ছ না বটে, কিন্তু দিয়েছেলে তো। আমি যে পঞ্চাশ ট্যাক পাই, তাতে আর আমার হাত নেই। আমার মেয়ের ট্যাক ছেল সে সব। শোধ নেবে। আমার নাতিন।

বলে আবার ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল দামিনী, তবে একটা কথা বলে দিই আগে। আমার নাতিন জানে, তুমি পাঁচিশ টাকা ধারো। বাকি পাঁচশ ট্যাক তুমি আমাকে নুকিয়ে শোধ দিয়ো দাদা। খাবোদার, নাতিনকে বোলানি যেন, তা হলো নিয়ে নেবে।

ইতিমধ্যে এসে ভিড়ল কেদমে পাঁচুর নৌকা। দামিনী চোখ তুলে দেখে বলল, তোমাদের গাঁয়েরই তো।–হ্যাঁ। দামিনী হঠাৎ বিলাসের দিকে ফিরে বলল, তোমার ভাইপো দেখছি। ওর বাপের মতোই হয়েছে। চেহারায় তো বটেই— কথায়, চালচলনে, ব্যবহারেও। একটু দুঃখে হেসে বলল আবার, মনটা খারাপ। ছিল একদিন, কী একটু বলেছিলুম নিবারণদাদাকে। তা বললে আমাকে, দামিনীদিদি লৌকখানি রেখে গেলুম, ওতে তোমার দেনা শোধ হয়ে যাবে। এত কথার ধার ধারিনে। শোনো কথা। আমিও রেগে বললুম, হ্যাঁ আমার ঘরে দশটা মাঝি পোষা আছে কিনা। তুমি লৌকো রেখে গেলেই হল। লৌকো নিয়ে আমি করব কী।

তা কি শোনে! তোমার হাত ধরে উঠে এল ডাঙায়। বলল, চলরে পেচে। নিকুচি করেছে। তোর আন কথার। তুমি ভালমানুষ। দাদার সঙ্গে সুড়সুড়ি করে উঠে এলে। শেষ আমাকেই মুখ ছোটাতে হল। যত রগচটাই হোক, আমার মুখের সঙ্গে পারবে কেন। তা ছাড়া, দামিনীর মনখানি তো জানত। লৌকো ভাসিয়ে চলে গেল মাছ ধরতে।

বলে, দামিনী চুপ করে তাকিয়ে রইল জলের দিকে।

পাঁচু বলল, তোমার সব কথা মনে আছে দামিনীদিদি।

-থাকবে না! সে সব কি ভোলবার।

বলে একটি নিশ্বাস ফেলে হেসে বলল, তোমার ভাইপোটি দেখছি সেই রকম হয়েছে।

হ্যাঁ বাপের ব্যাটা হয়েছে। মালোর ছেলে তো। মেজাজে না মানলে মাথা ঝাঁকিয়ে আছে।

দামিনী আবার বলল, হ্যাঁ আর-এক কথা পাঁচুদাদা। আমাদের রসিক বড় খুসে গেল তোমার ভাইপোকে। বললে, তোমার পাঁচুকে একটু বলে দিয়ো মাসি, এখানে মাছ ধরতে এসে আমাদের চোখ রাঙিয়ে যাবে, তা হবে না।  বললুম, কেন রে, কী হয়েছে। বললে, পাঁচুর ভাইপোটিকে বড় তেরিয়ান দেখলুম। ছোঁড়ার যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা। বলে দিয়ো, জিভখানি টেনে বার করে লোব।

বিলাস ফোঁস করে উঠল কাঁড়ার থেকে, কোথায় গেলেন। সেই বাপের ছাওয়াল, জিভখান টেনে নে? যাক।

—চুপো!

ধমকে উঠল। পাঁচু। দামিনীকে বলল, হ্যাঁ, ভাইপোের আমার মুখ ভাল না ঠিক দামিনীদিদি। কিন্তুন, রসিককে তো তুমি জানো।

দামিনী বলল, ছাড়ান দাও ও সব। ও হারামজাদাকে জানিনে আবার? বড় তেল হয়েছে। ওর। আজকাল। আমার নাতিনের জন্যে বাবু ধরে নিয়ে আসে, বুইলে? বড় বাপের ব্যাটা কিনা! নাতিন একবার চোখ তুলে তাকালে তো কেঁচো।

এইবার গলা চড়াল দামিনী। বলল, না। আর দেরি করব না। জাল ফেলে কিছু পেলে?

পাঁচু বলল, পেয়েছি। জলেঙ্গা জলের কিরাপা হয়েছে দামিনীদিদি। নিশানা পেয়েছি ভালই। তবে, তোমার কথা শুনে মনটা এটুস ফেপে উঠল। অবিশ্যি, গঙ্গার কিরাপা থাকলে সব ভাল। জল দিলে, ডাঙাও দেবে। সে তোমার লাতিন না হোক, আর কেউ দেবে।

বিলাস বাঁশের দু-ফালি পাটাতন সরিয়ে মাছ বের করে দিল। রেখে দিল দুটি খয়রা।

মাছ দেখে দামিনীর খুশি আর ধরে না। ও মা! এ যে ডিমেল ইলিশ গো। সেরটাকের বেশি। হবে বোধ হয়। আহা, জামাই-ষষ্ঠীর সময় পেলে, চার টাকা সেরা বিকেত। তা এখনও তিন টাকা সাড়ে তিন টাকা সেরা তো যাবেই।

মাপা হল। দাঁড়িপাল্লা রয়েছে নৌকাতেই। মাছ শুধু মারলে হবে না, নুন দিয়ে ভাত খাওয়ার মতো পাল্লাটি তোমাকে রাখতে হবে সঙ্গে। কষ্ট করে পাওয়া কেষ্টকে ওজন করে ছাড়ো।

বড় ইলিশটি এক সের তিন ছটাক হল। ছোটটি আড়াইপো।

দামিনী বলল, দাঁড়াও। নাতিনকে ডেকে নিয়ে আসি। পেখম দিনকার মাছ তোমাদের। সে কিনে নিক, আমি বেচে আসব।

দামিনী ঠেলে ঠেলে উঠতে লাগল ওপরে। তেঁতুলগাছের গোড়ায় গিয়ে চিৎকার করে ডাক দিল, হিমি, অলো অ হিমি—।

বিলাস বলে উঠল, হাতের লোক ছেড়ে এসে এখন শোনো দিদিমা-লাতিনের বিত্তান্ত।

পাঁচুর মনটাও খারাপ হয়ে পড়েছিল। তবে, মহাজন নিয়ে কথা। এরাও তোমার মহাজন। দুর্দিনে তোমাকে দিয়েছে, দেবেও দরকার হলে।

মহাজনের জাল, মাছমারার প্রাণে জড়িয়ে আছে সব সময়।

একটি বছর ছয়েকের মেয়ে এসে দাঁড়াল উপরের আমগাছের কাছে। বলল, কাকে ডাকছ গো?

—আমাদের হিমিকে।

একটি চিল-গলা চেঁচিয়ে উঠল। পাড়ার মধ্যে, ও হিমি মাসি, তোমায় দি-মা ডাকছে।

একটু পরে এসে দাঁড়াল একটি মেয়েমানুষ। সেই উঁচুপাড়ের আমগাছের গোড়ায়। যেন চড়া-সুরে-বাঁধা তারে টঙ্কার পড়ল আলতো করে। শোনা গেল, কী বলছিস দি-মা।

দামিনী বলল, মাছ নিবি আয়।

—আ মরণ! রান্না চাপিয়েছি যে, ওদিকে।

বলতে বলতেও নেমে এল হিমি।

গায়ে জামা নেই। একখানি শাড়ি পরে এসেছে। গাঢ় নীল দক্ষিণের সমুদ্রের মতো। তার ওপরে ছড়ানো সাদা রঙের ফুল। যেন সোনার মতো সোনা খড়কে মাছ ছিটিয়ে দিয়েছে। গায়ের রংটি কটা কটা। খোলা চুল বাঁধা আছে আলগা করে। চোখ-মুখ একরকম। দেখে মনে হয় বটে, একটু যেন ভাব-গম্ভীর মেয়ে। গড়নটি একটু ছিপছিপে। হাতে গলায় নাকে কানে সোনাও আছে। সাতরকম মিলিয়ে দেখতে ভালই। বয়স কত আর। দেখে মনে হচ্ছে, ছেলে।পুলে হয়নি আজও। গড়ন-পিটনে একটু ছেউটি ছেউটি। অথাৎ শরীরখানি অকূল হয়নি, কুলের মুখে এসে থমকে আছে। বৰ্ষা এলে ভাসবে অকুল পাথারে। আন্দাজে বলা যায় বাইশ-চব্বিশ হবে। কিন্তু সিঁদুরের দাগ নেই কপালে সিথেয়। এ কি বেওয়া না। আইবুড়ো বোঝবার জো নেই।

কোমরে হাত দিয়ে এসে দাঁড়াল নাতনি দিদিমার সঙ্গে। পাঁচুর মনে হল বয়সকালের দামিনীকে দেখছে সে। অবশ্য, ওই বয়সের সময় সে দামিনীকে দেখেনি কোনওদিন, তবে ছায়াখানি রয়েছে।

হিমি ভ্রূ কুঁচকে তাকাল খুড়ো-ভাইপোর দিকে।

দামিনী বলল পাঁচুকে, আমার নাতিন, বুইলে দাদা। অ্যাদ্দিন আমাকে দিয়েছ, এবার আমার নাতনিকে দিয়ে। দুদিন কাজকারবার করলেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। একে অপরের সুখ-সুবিধে দেখবে। তোমরা ছাড়া আমরা নই, আমরা ছাড়া তোমরা নাও।

পাঁচু হাসল। সারা মুখে ঢেউভাঙা উপকূলের সর্পিল দাগ। পুরু ঠোঁট দুটি ফটা-ফাটা। জল বাদ সমুদ্র বোঝে। শহরঘেসা ডাঙার মানুষের সবটুকু ঠাহর করতে পারে না। একদিন দামিনীর সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। তবে, সে দামিনী ছিল ফড়েনি। দামিনীর নাতনিকে ঠিক তেমনটি লাগছে না। তা হবে হয়তো। দামিনীর নাতনি একটু অন্য রকম। মানুষ তো সবাই সমান হয় না।

হিমি ভ্রূ কুঁচকে বলল, দি-মা এ বুঝি তোর সেই বসিরহাটের লোক।

দামিনী বলল, হ্যাঁ।

পাঁচু বলে উঠল, হ্যাঁ, তা সে বসিরহাটেরও বলতে পারো। ওই তল্লাটেরই লোক আমরা। আমরা ধলতিতের লোক।

হিমি তাকাল বিলাসের দিকে। তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়ে আবার তাকাল। নাকের নাকছবিটি বোধহয় কেঁপেও উঠল বার দুয়েক।

বিলাস দাঁড়িয়ে ছিল গলুয়ের সামনে, পায়ের কাছে মাছ নিয়ে তাকিয়ে ছিল হিমির দিকে। কালো কুচকুচে পুরুষ, গায়ে তখন ঘাম দেখা দিয়েছে বিন্দু বিন্দু। তাকিয়ে ছিল খানিকটা হাবাগোবা ছেলের মতো। আগ্রহ কিছু থাকার কথা নয় বিলাসের। পুবের মাছমারার মতোই অবাক হয়ে দেখছিল দামিনীর নাতনিকে।

ঘটে যদি বুদ্ধি থাকে একটু ছোঁড়ার। অমন করে তাকিয়ে দেখছিস কী তুই। সামনে তোর অচেনা মেয়েমানুষ। গেয়ো গাড়লের মতো তাকালে চলে না। সহবন্ত জানা দরকার। হিমির ভু দুটি তার গম্ভীর মুখে বিদ্যুতের মতো চিকচিক করে উঠল একবার। অপাঙ্গে দেখল বিলাসকে। বলল, এটি কে।

পাঁচু বলল, আমার ভাইপো বিলেস।

বিলাস যে এতক্ষণে আবার মনে মনে খেপেছে, টের পায়নি। পাঁচু। বলে উঠল, মাছ বিকোতে এয়েছ, না কুটুম্বিতে করতে এয়েছ, বুঝলুম না। ওই করো এখন বসে বসে। আজ আর তিবড়ি জ্বলিয়ে দরকার নেই।

পাঁচুর সহ্য হল না। বলে উঠল, হারামজাদা, পেটে কি তোর দানো ঢুকেছে রে, অ্যাঁ? মানসের সঙ্গে কথা বলতে শিখিসনি গাড়ল কমনেকার। যা, কাঁড়ারে গে বসে থাক গে চুপ মেরে।

বিলাস আর-একবার হিমির দিকে তাকিয়ে, মাছ আর পাল্লা নামিয়ে দিয়ে গেল পাঁচুর কাছে। গলা একটু খাটো করে বলে গেল, এত ব্যাখন মাখামাখি, ত্যাখন আর শুদু বিলেস কেন, তেঁতলে বিলেস, সেটাও কানে ঢুককে দেও।

পাঁচুর বুড়ো পেশিতে ঢেউ খেলছিল। রাগে জ্বলছে বুকের ভেতরটা। যত অসহায় রাগ পাঁচুর, তত ব্যথা। এ সর্বনেশেকে দিয়ে জীবনের কোনও সাধ মিটবে না। হিমির দিকে ফিরে বলল, কিছু মনে কোরো না গো ভাল মানষের মেয়ে, ছোঁড়া যে শোরের লাতি!

শোরের লাতি। বিলাসের ব্যবহারে মনের মধ্যে দপ করে জ্বলে উঠেছিল হিমির। মন তো দেখা যায় না। মেয়ের চোখের কোণে ধিকি ধিক আগুন দেখা গেছে। কিন্তু পাঁচুর গালাগালি শুনে হিমির মনের আগুনে জল পড়ল। মুখে কাপড় চাপা দিয়ে নিঃশব্দ হাসির ঢেউয়ে কেঁপে উঠল। শরীরের কুল। চোখের কোণ দিয়ে আর-একবার দেখল বিলাসকে। বিলাস তখন সত্যি গিয়ে বসেছে কাঁড়ারে, একেবারে গঙ্গার পুবমুখো হয়ে। গাব-আঠা-মাখানো কালো কাঁড়ারের উপরে যেন রং-করা দারুমূর্তি। কী কালো! যেন কেউটে বসে আছে ফণা তুলে।

কী দেখে দামিনীর নাতনি অমন করে! দশ রকম কথা মনের মধ্যে আনচান করে উঠল পাঁচুর। বলল, মাছ ওজন করে দিয়েছি। আবার করতে হবে নাকি গো?

এতক্ষণে নজর পড়ল হিমির মাছের দিকে। দেখে আর খুশি ধরে না। বড় মাছখানি হাতে তুলে নিয়ে বলল, আহা, বেশ মাছটি, দাখ দি-মা। আষাঢ়ে এত বড় ইলিশ বড় একটা দেখা যায় না।

হ্যাঁ, ওই কথাটি শুনতে চায় পাঁচু। বলে উঠল, দেখা যায় গো মেয়ে, দেখা যায়। মাছের মন, সে এসে ধরা দিলে, এর চোঁ অনেক বড় পাওয়া যায়। তোমার দিদিমাকে জিজ্ঞেস করো, তাও দিয়েছি।

হিমি বলল, তা এই যথেষ্ট হয়েছে আমার।

দামিনী বলল, নে, আর দেরি করিস নে। রান্না বসিয়ে এসেছিস বললি। এদেরও দুটো ফুটোতে হবে এবার। সারারাত তো বাইতে হয়েছে লৌকো।

বলে দামিনী চুপড়িতে মাছ তুলে নিয়ে আবার বলল পাঁচুকে, আড়াই ট্যাকা হিসেবে দেব ভাই। পেখমকার দিন, তোমার একটু কম হল। আমি তিন ট্যাকায় বিকোব বাজারে। রাগ করলে না তো?

দামিনী পাইকের মেয়েমানুষ। কাকে কী বলতে হয় জানে। পাঁচু বলল, তোমার সঙ্গে তো কোনও দিনও দরাদরি করিনি দামিনীদিদি। যা তোমার মন চেয়েছে, দাও।

হিমি বলল, পেখমকার দিনে কম দিবি কেন দি-মা। এগারো সিকে করে দে। টাকা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

জলেঙ্গা জলের নিশানা ভাল। দামিনীর নাতনির মনটিও যেন ভাল ভাল লাগে। যে মাছ মারে, মেরেই তার মনের সবটুকু ভরে যায়। হিসেবে যদি একটু বেশি হয় তবে ষোলো আনার উপরে মন উপচে পড়ে। সেটা তোমার সুকৃতির ফল। ভাল, দামিনীর নাতনি ভাল। বয়সকালে মানুষের মন একটু দরাজ থাকে। দামিনীরও ছিল এককালে। নিজের লাভে দু-আনা কম রেখে, দিয়েছে। মাছমারাকে। আজ তার নাতনিও দিতে চায়।

ভাল। মেয়ে একটু বেপরোয়া। সেটা হতে পারে। যেমন গাছের যেমন ফল। সিথেয় কপালে সিঁদুর আছে কি নেই, সেটা দেখে লাভ নেই। মায়ের বৃত্তান্ত শুনেছ। হতে পারে, মেয়ে করে রাড়ি। নয়তো, মন চায়নি, তাই বিয়ে করেনি। হাতে পয়সা আছে, গায়ে গহনা আছে। বাজারে মাছের ব্যবসাও আছে। সে কথা বলতে পারে দশটা লোকের উপর। নিজের ভালমন্দ সে নিজে বোঝে। চালচলন একটু অন্য রকম হবেই। তা দিয়ে তোমার কোনও দরকার নেই। তুমি মাছ মারো। মহাজনের ভিতরে কী আছে, তা তুমি দেখতে যেয়ো না।

হিমি বলল, হ্যাঁ দি-মা, তুই কি এখুনি বাজারে যাবি মাছ নিয়ে?

দামিনী বলল, এখন কি আর বাজারে লোক আছে? বাজারে যাব না, মাস্টারবাবুর বাড়ি যাব। ওঁর ছেলের বউয়ের আজকে সাধ খাওয়া। গঙ্গার মাছ দেখে বুড়ো মাস্টার খুব খুশি হবে।

হিমি বলল, বাবাগো বাবা, সে কথাটি ভুলিসনি দেখছি। দামিনী বলল, নিজের সাধ-আহ্রদ না মিটুক, পরেরটা যতটুকুনি পারি, ততটুকু না মেটাব কেন?

হিমি চুপ করে গেল ঠোঁট টিপে। বোঝা গেল, দামিনী নাতনির কথা বলছে ঠারে ঠোরে। নাতনি বিয়ে-থা করে না, ঘর বাঁধে না, সাধ মেটে না বুড়ির।

দিদি-নাতনি উঠে গেল উপরে। নাতনি দু-বার পিছন ফিরে তাকিয়ে গেল। আবার বিলাসের দিকে। চোখে ঠোঁটে চমকে চমকে উঠল। হাসি। ভাল বলতে হবে। রাগ করতে পারেনি। বরং একটু মজা পেয়ে গেছে।

তবে হ্যাঁ, ছেলেটার উপর রাগ করে লাভ নেই। দেখো, কেমন ফড়িকে গিয়ে বসে আছে কাঁড়ারে। সেই কোন রাতে কাল খেয়েছে। তারপরে খাটুনিটা কিছু কম যায়নি।

বলল সে, এখন কাঁড়ার থেকে এদিকে আয়। এসে কী কমনে করবি, করে নে। ঘরের বাইরে এয়েছিস, দশটা বাইরের লোকের সঙ্গে তোকে ভাল করে কথাবাতী কইতে হবে। একটু খিদে-তেষ্টা সহ্য করতে হবে। নাকি বলো হে কদম পাঁচু।

পাশেই রয়েছে কদম পাঁচুর নৌকা। সে এসেছে তার দুই ছেলে পরান আর সুরীনকে নিয়ে। তাদের তিবড়িতে এতক্ষণ ভাত চেপে গেছে। কেদমে পাঁচু বলল, হ্যাঁ, তা বটে। বাইরে বিদেশ-বিভূঁয়ে আসা। বলা তো যায় না কে কেমন লোক।

বলে এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আবার বলে উঠল, আমার ভাবেও বেশি দরকার নেই, রাগেও বেশি দরকার নেই। ও দুটোই খারাপ।

কথাটা যেন কেমন বলল কেদমে পাঁচু। কেদমেকে ভালবাসে পাঁচু। পাশের গাঁয়ের মানুষ, পেট থেকে পড়ে চেনাশোনা। মনটা একটু আধটু বোঝা তো যায়। কথার মধ্যে যেন কেমন একটা সুর রয়েছে।

রয়েছে। কেন রয়েছে, তাও জানে পাঁচু। দামিনী আর তার নাতনির সঙ্গে একটু বেশি ভাবের লক্ষণ দেখেছে কেদমে। সেইটে সাবধান করে দিল। ভাল, তার দরকার আছে। কিন্তু শরীরে হিংসে রেখে কিছু বোলো না। তাতে তোমার নিজের ভাল না। পরের ভালও নয়। যখন গঞ্জের মহাজন বোজন ঠাউর (ব্ৰজেন ঠাকুর) আসবে, তখন কেদমে কত আত্মীসূয়তা দেখাবে। কেমন আছেন ঠাউরমশায়, বিত্তান্ত সব ভাল তো। এঁজ্ঞে আপনাদের দয়ায় বেঁচে আছি। কত কথা বলবে। পরিবর্তে কত মন্দ কথা শুনবে। কত বায়নাক্কা রাখতে হবে ঠাকুরের। কম করে পাঁচ সাত গণ্ডা পুবের মাছমারা ঠাকুরের কাছে ধারে। মেয়েমানুষ বলেই অবশ্য কেদমের ভয় লেগেছে। কেন? না, মানুষের মন। তুমি সামলাতে না পারলে বিপদ হবে।

তবে কি, না, পাইকের-মহাজনের জাত নেই। মেয়ে পুরুষ নেই তার। সে পারলে তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে না। দামিনী তো নতুন নয়। পাঁচু যে জীবনভর দেখে এল এদের।

বলল নিচ্চয় খারাপ, খুবই খারাপ। যা করতে এয়েছি। করে যাব। ভাবে রাগে প্রয়োজন কী। না, আমি বলছি, খিদে-তেষ্টা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করলে কি মাছমারার চলে?

মুখ না ফিরিয়েই কাঁড়ার থেকে ফোঁস করে উঠল বিলাস, কেন, খিদে-তেষ্টা নে তোমার পেছনে কি বিলেস কাটি মেরে বেড়াচ্ছে।

শোনো হারামজাদার কথা। জবাব দেবার আগেই বিলাস আবার বলে উঠল, আমার খিদের মুখে তো খুব ছাই ঢালছ, বলি তোমার বুড়ির লাতিনের ভাবখানা কেমন? য্যানো একেবারে বাবার বাড়ির কন্যে এলেন আর কি। কেন তোমার খাই না পরি। লবাবের বিটির মতো হাবভাব কথা–। আর তার কাছে তোমার অত পরিচয় পাড়াই বা কেন?

ও, মানে লেগেছে মালোর। মালোর ব্যাটা মালো, ও যে ঘাড় বেঁকিয়েই আছে। নিবারণ সাইদারের ছেলে তো। বলল, নে নে, শহরের ফড়েনি কি ওইটটুস ফষটি-নষটি করেছে, তাই নিয়ে আবার গোঁসা। মাছমারাদের পরে ফষটি-নষটি করবার মেলাই লোক আছে। শহরে, তার জন্যে কিছু মনে করতে গেলে চলে না। তুই দিবি তিবড়িতে আগুন, না আমি দেব?

নৌকা দুলিয়ে উঠল বিলাস কাঁড়ার থেকে। বলল, দিয়ে তো আবার দশটা কথা শোনাবে।

তিবাড়ি নিয়ে বসল বিলাস। মনটা তো ভাল ছোঁড়ার। তবে এত খোলাখুলি ভাল নয়। শাস্ত্রে বলে, মাছমারাদের বাপ-ঠাকুরদাও বলে, কথা কম বলো।

একটি লোক নেমে এল উপরের পাড় থেকে। এসে ডাকল, কই গো পাঁচু।

ছাইয়ের মধ্যে ঢুকেছিল পাঁচু চাল বের করবে বলে। গলা শুনেই চিনতে পারল দুলাল এসেছে। বলল, এসো দুলাল, এই চালটা মেপে নে যাচ্ছি।

দুলাল নৌকায় উঠে এল।

দেখলে মনে হয়, কেমন একটু ভাবের ঘোরে দিশেহারা মানুষ এই দুলাল। এই উপরের পাড়াতেই থাকে। দামিনীর পড়শি, পাশে আতরবালার বাড়ির মানুষ। ফড়েনি আতরবালা, মাছ বিক্রি করে বাজারে। বাজারে নিজে বসে মাঝেসাঝে, দুলাল বসে রোজ। আতরের বাড়ি, আতরের ঘর, তারই ব্যবসা, কাজ করে দুলাল। দুলাল স্বামী নয়, আতরবালার মানুষ।

বাজারে আতরের জায়গায়, তার আশবঁটিতে, তার মাছ কেটে বিক্রি করে দুলাল। পয়সা বাঁধে আতর নিজের আঁচলে। দুলাল আতরের খায়, আতরের পরে, আতরের ঘরে শোয়।

কিন্তু তারা কেউ কারুর নয়। এই বড় বিপরীত রীতি উপরের পাড়ার। মাছমারার জীবনের সঙ্গে ওই পাড়ার আর কোনও যোগ নেই। শুধু দেয়া আর নেয়া। তবু এই পাড়ের নীচে বাস। আর দেয়া-নেয়া, সেও যে জীবনের অনেকখানি। তাই এ চেনা-অচেনার তলায় বসে বড় ধুকুধুকু করে বুকের মধ্যে।

কথায় বলে, সংসারে বাস করছ, দুটিতে মিলে একটি গেরো বেঁধে রাখে। ফাঁসকলের গেরো নয়, প্রাণের গেরো। জগতে ওইটি দরকার। সংসার বড় বিস্তৃত, মানুষের দিশা থাকে না। চলতে ফিরতে টান পড়বে ওই গেরোতে। দিশা ফিরে পাবে তুমি।

আতর সধবা নয়, বিধবা নয়, শুধু ফড়েনি। দুলাল কাজ করে, খায়, মেয়েমানুষের সঙ্গেও থাকে। কারুর স্বামী নয়, বাপ নয়, পেটভাতায় কীসের গেরোতে বাঁধা আছে আতরের সঙ্গে, দেখা যায় না।

সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফেরার ঘর নেই তার। ডেকে নেওয়ার মানুষ নেই। আতরেরও নেই। কেউ সাঁঝবেলায় ঘরে ফেরার। কেউ কারুর অপেক্ষায় নেই। যেদিন খুশি দু-জনে দুজনকে ছেড়ে, দু-দিকে চলে যেতে পারে।

তবু আন্তর ফড়েনি। তার টাকা আছে, ঘর আছে। মেয়েমানুষের স্বাধীন জীবন আছে। আর আছে বয়সকাল। তার দাম আছে, সে বিকোয় ভাল, বিকোবেও।

পুরুষ হয়ে কী দামে বিকোচ্ছে দুলাল নিজেকে, ভেবে পায় না পাঁচু।

কিন্তু মানুষটি বড় ভাল। নেশা-ভাং করতে চোখে পড়ে না। তবু চোখ দুটি অষ্টপ্রহর জবাফুলের মতো লাল। বয়স এমন কিছু নয়, দেখায় একটু বেশি। পাঁচুর চেয়ে অনেক ছোট। কিন্তু বারবার ডেকে এসেছে নাম ধরেই। বেমানান লাগে না। রংটা বোধহয় ফরসা ছিল, এখন ঘোর তাঁবাটে। আর পাশুটে লোমে ছাওয়া গোটা শরীর। কেমন একটু হাসি মুখে লেগেই আছে সর্বক্ষণ। অমন হাসিটি কারুর মুখে কোনওদিন দেখেনি পাঁচু। যার কেউ নেই, কোথাও যাবার নেই, সে-ই বোধহয় অমনি করে হাসে। আর কথা বলে বড় আস্তে।

বিলাস তিবড়িতে আগুন দিচ্ছিল। দুলাল বলল, কী গো, খুড়ো, কী বলেছ। তুমি? আমার ছোট মাসি ঘরে গোঁ যে আর হেঁসে বাঁচে না।–

লোকটিকে ভাল লাগে বিলাসেরও। ওই খুড়ো ডাকের মধ্যে কোথায় একটি খাঁটি দরদের সুর আছে। সে ডাকে দুলাল খুড়ো বলে। বলল, তোমার ছোট মাসি আবার কে?

-কেন, দামিনী আমার বড় মাসি, তার লাতিন আমার ছোট মাসি।

ছাঁইয়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল পাঁচু। হাতের মালসায় চাল। মালসার চেয়ে গাঢ় তার রং। বলল, কী বলছি দুলাল?

দুলাল বলল, বলছি বলে, আমার খুড়োর কথা নে ছোটো মাসি ঘরে গে হাসছিল। তাই বলছি আমার খুড়োকে, কী বলেছ। তুমি। ছোট মাসির অন্ত হাসি কেন?

পাঁচুর কুটো-কাটি মুখখানিতে হাসি ফুটে উঠল। যাক, দামিনীর নাতনির প্রাণে তা হলে বিষ নেই। ছোঁড়ার ভাবটা বুঝেছে। বলল, মাকড়াটার যেরকম রকোম। বুদ্ধিসুদ্ধি তো নেই। ওর কথা শুনলে লোকে হাসবে না তো কাঁদবে নাকি?–কেমন আছ দুলাল।।

-ভাল। তোমাদের সব ভাল তো?

ভাল ছাড়া মন্দ নেই দুলালের। পাঁচু বলল, হরির কিরপায় বেঁচে-বর্তে আছি ভাই। এখন যা করেন, মা গঙ্গা।

—তা বটে। এনার হিন্দয়খনি বড় ছোট হয়ে পড়েছে কিনা। সরকার বাহাদুর না কাটালে আর ঠাঁই পাওয়া যাচ্ছে না।

ঠিক, খুব ঠিক কথা বলেছে দুলাল। হৃদয় গহিন না হলে আর চলছে না। বড় অগভীর হয়ে পড়েছেন। ভগবতী। তাই এখানে জল নেই, তো আর একখানে মানুষ-খাওয়া ঘূর্ণি। একদিকে মাটি এগিয়ে আসে তো আর একদিকে ঘরবাড়ি খায়।

মাছমারার প্রাণের কথা বলেছে দুলাল।

পাঁচু বলল, আতর দিদি কেমন আছে দুলাল।

তেমনি হেসেই বলল দুলাল, ভাল না। বিশ তিরিশটা পান খায় রোজ। একুনে একবার মিলিয়ে দেখো, কত পান। ভাত খাবে কোন পেটে। তার সঙ্গে দোক্তা-জারদা আছে, সাঁজবেলায় একটু ভাজা মদ না হলে থাকতে পারে না। এ মানুষের শরীর কখনও ভাল থাকে?

পাঁচু বলল, তা বটে।

এর বেশি কথা জোগায় না। কিন্তু দুলালের মুখটি দেখে বড় মায়া লাগে। ভয়ও করে। দুলালকে নয়, ওই জীবনকে। বেশি কিছু তো সে বলতে পারে না।

দুলাল হাত বাড়িয়ে টাকা দিল পাঁচুকে, নাও, ছোট মাসি পাঠিয়ে দিলে। পেখম বাউনি তোমাদের খারাপ যায়নি তা হলে?

টাকা নিল পাঁচু। বলল, হ্যাঁ জলেঙ্গা জল নিশেনা দিয়েছে ভালই।

দুলাল চলে গেল। বিলাসের কাছে চালের মালসাটা দিয়ে, টাকা কটি নিয়ে ছাঁইয়ের মধ্যে বাঁশের ফোকরে রাখল পাঁচু।

মনটি ভরে উঠেছে। দুচোখে স্বপ্ন নিয়ে তাকাল জলের দিকে।

জলেঙ্গা জল। ভাটা এবার থমকাবে লাগিছে। ভাটার সময় বেশি। নামে অনেকক্ষণ ধরে। এই জীবনের মতো। যদি দু-দণ্ড তোমার সুখ হয়, চার দণ্ড তোমাকে দুঃখ পোহাতে হয়। চার দণ্ডের সুখে, আট দণ্ড দুঃখ। সংসারের নিয়মে এমনি বাঁধা পড়ে আছ তুমি। জলে জলে শেওলা ধরে গোল তোমার শরীরে। কত পলি পড়ল। একবার উলটে পালটে দেখো এক মরশুম পেয়েছ, দুই মরশুম তোমাকে দেয়নি কিছু। তিন মাস যদি দুনোভাতে রইলে, ছমাস উনো।

সেই ভোরবেলা ভাটা পড়েছিল, এখনও তার রেশ রয়েছে। প্ৰায় আট দণ্ড গেল। জল দেখে বোঝা যাচ্ছে নাবালের মুখছাটে জোয়ারের ধাক্কা লেগে গেছে।

তবে বিষার জোয়ার, তার দাপট বেশি নয়। বর্ষার মরশুমে ভাটা হল আসল সময়। আর দু-দিন, তারপরে আসছে আরও লাল জল। আরও দুরন্ত স্রোত।

চোখ পড়ল বিলাসের দিকে। ভাতের ফ্যান গড়াচ্ছে। কিন্তু তাকিয়ে আছে সেই উঁচু পাড়ের আমগাছের দিকে। রাগ বুঝি যায়নি। ডাকল, ভাতের মাড় গড়াচ্ছে যে। উদিকে দেখছিস কী তুই!

বিলাস হাঁড়ি নামাল। পাঁচু গঙ্গায় নামল স্নান করতে। ওদিকে কেদমে পাঁচুও ঢুকেছে গিয়ে দক্ষিণের জঙ্গলে।

কেদমের বড় ছেলে পরান ভাত বসিয়েছে। সুরীন বাটনা বাটছে ছইয়ের মুখছাটের কাছে বসে। অনেকক্ষণ থেকেই কী যেন বলবে বলবে করছিল পরান। এতক্ষণে ফাঁকা পেয়ে পরান বলল, বিলেস, বড় জবর ফড়েনি দেখছি।

বিলাস বলল, কে?

পরান বলল, বুড়ির লাতিনের কথা বলছি!

বিলাসের কালো চোখ দুটি যেন এক বিস্ময়ে চকচক করছে। বলল, তা বটে। বলে, আবার তাকাল উঁচু পাড়ের দিকে।

এলোমেলো ঘর দেখা যায়। অধিকাংশই গোলপাতা আর টলিখোলার ঘর। মাঝে মাঝে নারকেল আম জাম গাছ। উঁচু থেকে মাটি এসেছে। গড়িয়ে। তাকে কেটে দিয়েছে থাকে থাকে।

বিলাস দেখছে। এই বিলাসকে দেখলে সয়ারাম বলত, বিলেস তোর ভাব বেরভোম হয়েছে। হল কী বল তো।

পরানের যদি বা মনে হয়েছে, তেঁতলে বিলাসকে কিছু বলবার সাহস নেই। মাল টেনে; অর্থাৎ তালের গুঁড়ি টেনে, পরানের ব্যাপকে হারিয়েছে বিলাস। ও এখন গাঁয়ের বাছাড়।

পাঁচু এল জলেঙ্গা জলে ড়ুব দিয়ে, প্ৰাণ জুড়িয়ে। ভাত খেয়ে, বসল। হুঁকো নিয়ে। বিলাসও নেয়ে খেয়ে, গুড়গুড় করে হুঁকো টানল। ধোঁয়ার আড়াল দিয়ে বারবার চোখ পড়ল উপরে। ইতিমধ্যে এল জোয়ার। দুনৌকার সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। অঘোরে। তিন রাত্রি ঘুম নেই। তার শোধ উঠবে এক জোয়ারেই। এখন আর দিনে জাগা রাতে ঘুম নয়। এখন জোয়ারে ঘুম, ভাটায় কাজ, এই নিয়মে চলবে। একটি ভাটাও হাতছাড়া করা চলবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *