০৫. গ্রিক মিথোলজির কথকতা

৫. গ্রিক মিথোলজির কথকতা : ইলেক্ট্রা বনাম ক্লাইমেনস্ট্রা 

ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল জানে না আবার। চোখ মেলতেই শিয়রে বড় বোন বুশরার ভীতসন্ত্রস্ত মুখ চোখে পড়ল। 

বাবু, এখন কেমন আছিস তুই? শরীরটা ঠিক আছে তো? 

ধাতস্থ হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিলো। কালকের পুরো ঘটনাটা কি কোনো দুঃস্বপ্ন ছিল! সেই মুখোশের আড়ালের লোকটার কণ্ঠের হিম নিঃসীম শীতলতা এখনো গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আবরারের। 

কিন্তু স্বপ্ন কখনো এতটা সুসংহত হতে পারে! গেমের ১৫টা নিয়ম এখনো আবরারের চোখের সামনে ভাসছে। মস্তিষ্কের সিলেট গাইরাস প্রীতিকর এবং অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার সমন্বয় করতে গিয়ে নিশ্চয়ই গতকাল রাতের অভিজ্ঞতা সবার আগে রাখবে। 

কালকের অভিজ্ঞতার পুরোটা স্বপ্ন না বাস্তব কিছুতেই আলাদা করতে পারছে না আবরার। এক-দুই…তিন-গেমের প্রত্যেকটা নিয়মের সারসংক্ষেপ মনে করতে গিয়ে হঠাই সাত নম্বর নিয়মের কথা মনে পড়ল আবরারের। 

কালকের পুরো ঘটনাটা সত্যি হলে তার বাম হাতের মধ্যমায় একটা আংটি থাকার কথা। বিবশস্মৃতি-জাতিস্মরের মতো সর্বশক্তি দিয়ে নিজের দুচোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে বাঁ হাতটা চোখ বরাবর আনল আবরার। মনে প্রাণে চাইল চোখ খুলে যাতে দেখতে পায় হাতে কিছুই নেই। 

কিন্তু ধীরে ধীরে চোখ দুটো খুলে স্তম্ভিত হয়ে গেল, পাকদণ্ড বেয়ে নেমে গেল মেরু অঞ্চলের অক্ষত এক খণ্ড হিমশৈল। ঠিক বাঁ হাতের মধ্যমায় খুব পাতলা সোনালি রঙের আংটি। ভাসমান মহাযাত্রীর শরীরের ভরহীন অলংকার সামগ্রীর মতো নিজের অস্তিত্ব লুকিয়ে রাখছে অদ্ভুত এই আংটি। 

কী ধাতু দিয়ে তৈরি কে জানে! বাইরে থেকে দেখলে বোঝার উপায়ই নেই যে এর উপর RIKEN দ্বারা বিশেষায়িত ন্যানো প্রযুক্তি-সংবলিত স্পাই রেকর্ডার আর ভেতরে নানো বিস্ফোরক। 

বাবু তোর কী হয়েছে বল তো? এভাবে কাঁপছিস কেন? 

ব্যস্ত হয়ে আবরারের গায়ে-কপালে হাত দিয়ে উত্তাপের খোঁজ করল বড় বোন বুশরা। 

গায়ে তো জ্বর নেই। ডক্টর আংকেলকে ফোন দিয়ে আসতে বলব একবার? 

আপু, একটা কথা বল তো। কাল রাতে আমি বাসায় ফিরলাম কী করে? 

তুই কালকে সিআইডি অফিসে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার পরে তোর কলিগরা তোকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। 

হতবুদ্ধ হয়ে বড় বোনের কথা শুনে চলেছে আবরার। 

এদিকে অফিস থেকে ফিরে আমি তোর দেরি দেখে টেনশন করছিলাম। তোকে ফোনেও পাচ্ছিলাম না। তোর কলিগদের নম্বরও জানি না যে ফোন করে খবর নেব।

রাতুলকে ঘুম পাড়িয়ে তোর দুলাভাইয়ের চেম্বারে পর্যন্ত ফোন করে জানালাম তুই বাড়ি ফিরছিস না। শেষমেশ রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ট্যাক্সি করে তোর এক কলিগ তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়। সেই জানায়, তুই নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলি। 

আমাকে যে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায় তাকে তুমি চেন? ইউনিফর্ম পরা ছিল? 

দেখ কাণ্ড! নিজের রিসার্চ পেপার নিয়ে কাজ করতে করতেই কূল পাই, আমি কিনা তোর কলিগদের মুখ চিনে রাখব! মা মাত্রই এত বড় একটা অপারেশন থেকে ফিরেছেন। আমরাই তো জোর করে রিফ্রেশমেন্টের জন্য মাকে মামার বাসায় পাঠিয়েছি। এখন একা বাসায় যদি তুই নিজের শরীরের যত্ন না নেস, এভাবে ওয়ার্ক লোড নিতে থাকিস, তাহলে মা বাসায় ফিরলে কী জবাব দেব বল তো?

আমি মোটেই মাথা ঘুরে পড়ে যাইনি। তুই জানিস না আমার সাথে ঠিক কী হয়েছে! 

বলতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে বলতে পারল না আবরার। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে বিষবাষ্প বয়ে এনেছে, তার আঁচ ভালোবাসার পরিবারের গায়ে কিছুতেই লাগতে দেবে না। 

স্যার, আফনের নামে একটা পার্সেল আইসে। 

রাহেলার কণ্ঠে সংবিৎ ফিরে পেল আবরার। আবরারদের বাড়ির রান্নার দায়িত্বে আছে সে। রাহেলার হাত থেকে মাঝারি সাইজের বাক্সটা নিলো। DHL-এর শিপিং পার্সেল। 

দেশের বাইরে থেকে কে গিফট পাঠাবে এই সময়ে! ধানমন্ডিস্থ DHL Express Service Point থেকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেছে ডেলিভারিম্যান। পার্সেলটা পাঠানো হয়েছে সুদূর সুইজারল্যান্ড থেকে। বড় বোন বুশরার মুখে কৌতুকাবহ, ভাবছে প্রবাসী কোনো প্রেমিকা কিংবা গুণমুগ্ধের উপহার। সুদর্শন আর বুদ্ধিমান ভাইয়ের তো পাণিপ্রার্থীর অভাব নেই।

পার্সেল খুলে কোল্ড বক্স দেখে আবরারের আক্কেল গুড়ুম। এক দেশ থেকে অন্য দেশে পচনশীল কোনো উপহার তাকে কে পাঠাবে। 

কোল্ডবক্স খুলে প্রায় বারো ইঞ্চি সাইজের এক পিঞ্জার প্যাকেট দেখতে পেল আবরার। প্যাকেটের গায়ে সুইজারল্যান্ডের জেনেভার কোনো 610165 777 311, Pizzeria Losteria Di Orestes, Genevai প্যাকেটের সাথেই ছোট একটা কাগজে বিল। 

কাগজটা হাতে নিয়ে প্রথমে কিছু চোখে না পড়লেও কাগজটা উল্টো করতেই পয়সার আকারে গোল সোনালি রঙের একটা লোগো দেখে পেটের মাঝে পাক খেয়ে উঠল। লোগোর ঠিক মাঝখানে জিউসের মুখ, তার উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা HellMyth Game। 

লেখার সমান্তরালে নিচে পরিধি বরাবর অ্যাসক্লেপিয়াসের চিহ্ন। তার মানে গেমের নিয়ম অনুসারে ১ নভেম্বর প্রথম লেভেলের প্রথম কো অর্ডিনেটটা আবরার পেয়ে গেছে। 

নিজের অনুভূতির শীতলতা বড় বোনকে বুঝতে না দেওয়ায় হাস্যোজ্জ্বল মুখে পিজা গরম করতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল বুশরা। 

বিক্ষিপ্ত মন আর ক্লিষ্ট শরীর নিয়ে তৈরি হয়ে নিলো আবরার। কর্মজীবনে ব্যক্তিগত অজুহাতের জায়গা নেই। টেলিভিশন শোর পরে আবার মেডিকেলে লেকচার ক্লাস নিতে যেতে হবে। 

গাড়ির কাছে গিয়ে দরজা খুলতেই ড্রাইভিং সিটে ছোট আরেক টুকরো কাগজ পড়ে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ আগের লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে সন্ত্রস্ত হয়ে গেল আবরার। নিশ্চয়ই গ্রিক মিথোলজির আরেকটা কো-অর্ডিনেট! 

কাগজটা হাতে নিয়ে তাকাতেই দেখল ইলেকট্রিক বিলের কাগজ। নাহ, ওদের বাসার ইলেক্ট্রিসিটি বিলের কাগজ তো নয়। ড্রাইভারের নয় তো? 

ড্রাইভারকে কিছুক্ষণ আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছে, ড্রাইভিং আবরারের প্রিয় কাজের একটি। বিধ্বস্ত মনকে কিছুটা প্রশান্তি দেবার জন্য পছন্দের কাজ করাকেই সমীচীন মনে করছে এখন।

প্রথম দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক কিছু না পেয়ে বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকল বিলের কাগজটা। সানগ্লাসটা খুলে সূর্যের দিকে তাক করতেই দৃশ্যমান হয়ে উঠল সেই রক্তশীতল করা লোগো। এবারের লোগো ফ্লোরোসেন্স জাতীয় পদার্থের কালি দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। 

.

টিভি শোর পুরোটা সময় যতটা বিক্ষিপ্ত ছিল, আবরারের ধারণা তার পুরো কর্মজীবনে এতটা বিক্ষিপ্ত সে কখনোই ছিল না। এমনকি টেলিফোনে দর্শকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েও বারবার জড়িয়ে যাচ্ছিল কথা। 

মেডিকেলে লেকচার দিতে গিয়েও মস্তিষ্কের সবগুলো কোষে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, Pizzeria Losteria Di Orestes আর ইলেক্ট্রিসিটি বিলের কাগজ। নাহ, ইলেক্ট্রিসিটি বিলের কাগজে কোনো কোডেড তথ্য ছিল বলে আবরারের মনে পড়ছে না। 

স্যার, আজকে আমাদের একটা সারপ্রাইজ টেস্ট নেবার কথা ছিল।

বিব্রত ভঙ্গিতে প্রথম বেঞ্চে বসা ছাত্রীর দিকে তাকাল আবরার। ধীর পায়ে ডায়াসের দিকে এগিয়ে গেল। ল্যাপটপটা অন করে ফোল্ডার খুলল। নিজের রুমে বসে কিছুক্ষণ আগে প্রশ্ন বানিয়েছে সে, যেই আবরারের সব সময় সব কাজ দুই রাত আগেই করে রাখা চাই!

এতটা কর্তব্যে অবহেলা জীবনে কখনো কোনোদিন করেনি অথচ আজ! চোখের সামনে এক অদৃশ্য কার্তুজের বারুদ তার রক্তস্রোতে ঘাপটি মেরে বসে বিস্ফোরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে এভাবে! প্রোজেক্টর অন করতেই একজন। ছাত্রের গলা শুনতে পেল, 

স্যার, আগের চ্যাপ্টার থেকে ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স আজকে টেস্ট শুরুর আগে বুঝিয়ে দেবেন বলছিলেন। 

কয়েক হাজার ভোল্ট বিদ্যৎ যেন বয়ে গেল আবরারের শরীর দিয়ে। ইশ! ক্লুটার মর্ম কেন আগে ভেদ করতে পারল না! ইলেক্ট্রিসিটি বিলের কাগজ থেকে প্রাপ্ত ব্লু ইলেক্ট্রা আর পিঞ্জার প্যাকেটের গায়ে দোকানের নাম থেকে প্রাপ্ত ক্লু ওরেস্টেস। 

এই দুজনকে নিয়ে গ্রিসের আঞ্চলিক উপকথায় আছে এক রক্ত শীতল করা উপাখ্যান। কোনো রকমে ক্লাসটা শেষ করে বাসায় ফিরেই নিজের খাতা আর কলম নিয়ে বসল আবরার। পোশাক না ছেড়েই স্বভাবসুলভ দ্রুতভঙ্গিতে লিখে চলল, 

গ্রিস দেশের প্রাচীন রাজা আগামেমনন এবং তার স্ত্রী ক্লাইমেনেস্ট্রার সন্তান ওরেস্টেস এবং ইলেক্টা। স্ত্রী ক্লাইমেনস্ট্রা এজিস্থাস নামক এক ব্যক্তির সাথে পরকীয়া শুরু করে। পরকীয়া প্রেমিকের সাথে ষড়যন্ত্র করে ক্লাইমেনস্ট্রা নিজের স্বামীকে হত্যা করে। পরবর্তীসময়ে বড় হবার পর দুই ভাইবোন নিজেদের পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে মাকে হত্যা করে। 

লেখা শেষ হতে না হতেই হোয়াটসঅ্যাপে নোটিফিকেশন পেয়ে থমকে দাঁড়াল আবরার। গেমের আট নম্বর নিয়মের কথা মনে পড়ে গেল। অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ভিডিও মেসেজ দেখে বেশ বুঝতে পারল, গ্রিক মিথের কোড ডিকোড করার বার্তা পৌঁছে গেছে ওদের কাছে। 

দুরু দুরু বুকে ভিডিও চালু করল। ভিডিওর পাত্র-পাত্রীকে দেখে থমকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। বেশ পরিচিত তুর্কি মডেল, ফেসবুক স্ক্রল করলেই এদের নিয়ে বানানো ফ্যানমেড ভিডিও নিউজফিডে আসতে থাকে। 

গেম ডেভেলপারদের ক্ষমতার পরিধি নিয়ে আবরারের ধারণা বিজ্ঞানী হাবলের সম্প্রসারণ তত্ত্বের মতো নিয়ত সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে। 

সামান্য কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও হলেও সিনেমাটোগ্রাফি, লাইটিং–সবকিছুই চমৎকার। অবাক বিস্ময়ে ৩০ সেকেন্ডের ভিডিও নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখে ফেলল নির্নিমিষে। ভিডিওতে তুর্কি ভাষায় দেখানো হয়েছে বৃদ্ধা এক অসহায় মা তার এক ছেলে আর মেয়ের কাছে জীবন ভিক্ষা চাইছে, কিন্তু নির্মম নিষ্ঠুরতায় ক্রুর হাসি হেসে সন্তানেরা মাকে বলছে, তোমাকে মরতেই হবে। 

ভিডিও শেষে স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে যাবার কয়েক সেকেন্ড পর ভেসে এলো এক মহিলার ছবি। নিচে নাম ভেসে উঠল-আসমা খাতুন। 

ভদ্রমহিলার বয়স সত্তরোর্ধ্ব হবে, ছবি দেখেই বুঝতে পারা যাচ্ছে। বৃদ্ধা হলেও মুখশ্রীতে বিগত যৌবনের লাবণ্যের রেশ রয়ে গেছে। 

এরপর বেশ কিছুদিন আবরার উদ্যমের সাথে ন্যাশনাল ডেটাবেজে ভদ্রমহিলার নামের উপর ভিত্তি করে তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করল। 

NIPORT-এ দিনরাত পড়ে থেকে তেমন সুবিধা করতে না পারলেও Information & Communication Technology Division 1 ফরেনসিক ল্যাবের ফেস রিকগনিশন অ্যান্ড প্রগনোসিস প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে ভিকটিমের বর্তমান অবস্থান জানতে পেরে গেল। 

ভদ্রমহিলা বর্তমানে অবস্থান করছে ঢাকাস্থ এক ওল্ড হোমে। গেমের ১৫তম দিনে আবার পেল গেমের ৯ নম্বর নিয়ম অনুসারে তৃতীয় কো অর্ডিনেট অর্থাৎ সংঘটিতব্য হত্যাকাণ্ডের উপায়-সংক্রান্ত ক্লু। 

অনলাইনে একটা ডেনিম জিন্স অর্ডার দেওয়ার পর ডেলিভারির কাগজের সাথে পাওয়া গেল একটা রঙিন খাম, যার ভেতর কোলাজ করা দুটো ছবি, সাথে গেমের লোগো। 

সাদা চোখে খুব অদ্ভুত বলে মনে হলেও আবরারের মনের ভেতর এক অনুকল্প প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের মতোই স্থিতিশীলতার জোগান দিতে লাগল। গেমের লোগোতে রড অফ অ্যাসক্লেপিয়াস চিহ্ন থাকায় হত্যার পদ্ধতির সাথে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনো না কোনো মিল আছে। 

কোলাজ করা ছবি দুটোর প্রথমটাতে এক বিয়ে বাড়ির ভোজসভার ছবি। খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত ক্যাটারিং সার্ভিসের লোকেরা। দ্বিতীয় ছবিতে একটা মঞ্চ নাটক চলছে এমনটাই দেখানো হচ্ছে। মঞ্চে নায়ক নায়িকরা নিজেদের সংলাপ বলার মুহূর্তে ক্যামেরাবন্দি হয়েছে। 

অদ্ভুত ছবি দুটো থেকে হত্যাকাণ্ডের পদ্ধতি সম্পর্কে আবার কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। ছবি দুটো থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনো ক্ল খোঁজার চেষ্টা করতে করতে হাল ছেড়ে দেবার উপক্রম হলো প্রায়। 

আবরার হত্যাপদ্ধতি অনুমান করতে পারল দিন কয়েক পর। ভাগ্নে রাতুলকে যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতায় ভূত সাজানোর জন্য কনট্যাক্ট লেন্স কিনতে গিয়েই ডিকোড করতে পারল ক্ল। 

বিয়েবাড়ির প্রথম ছবিতে খাদ্য পরিবেশনরত ক্যাটারার থেকে ক্যাটার এবং দ্বিতীয় ছবিতে অভিনয়র শিল্পীদের অভিনয় থেকে প্রাপ্ত কু এক্ট। দুয়ে মিলে ক্যাটারেক্ট অর্থাৎ চোখের ছানি। 

ইংরেজিতে অবশ্য cater এবং act থেকে পাওয়া যায় cateract, যা অর্থপূর্ণ নয়। ছবিতে পরিবেশিত খাদ্যের বাঙালিয়ানা মেন্যু দেখে আবরার নিশ্চিত হয়ে গেল, সে ঠিক পথেই এগোচ্ছে। বাংলা ভাষায়ই ক্যাটারেক্ট বোঝানো হয়েছে।

কোড ডিকোডের সঙ্গে সঙ্গে গেমের নিয়ম অনুসারে আংটি থেকে সবুজ সংকেত ভেসে এলো। এক মুহূর্ত পর এক যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর বলে উঠল, écheis dikio-গ্রিক ভাষার যেই বাক্যের অর্থ আপনি সঠিক। 

আসমা খাতুন সম্পর্কে পড়াশোনা করার সময় তার মেডিক্যাল রিপোর্টগুলো ওল্ড হোমের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বেশ কয়েকবার চেক করেছে আবরার। 

তার চোখে কোনো সমস্যা নেই। সম্ভবত চোখে কৃত্রিম লেন্সের মাধ্যমে কোনো বিষ প্রয়োগের পরিকল্পনা করেছে গেম ডেভেলপাররা। 

আসমা খাতুন যৌবন বয়সে পরকীয়া প্রেমিকের সাথে মিলে নিজের স্বামীকে হত্যা করেন। কিন্তু প্রেমিক দারুণ প্রভাবশালী এক ব্যক্তি হওয়ায় কোনো বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। পরবর্তীসময়ে প্রেমিককে বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু বেশ কিছু বছর পর দ্বিতীয় স্বামী নিষ্ঠুরভাবে পরিত্যাগ করে তাকে। বৃদ্ধ বয়সে এসে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মাথা গোঁজার জায়গা এই ওল্ড হোম। 

অনেক চেষ্টা করেও আসমা খাতুনের আগের পক্ষের ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে পারল না আবরার। বহুদিন ধরে মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখেনি তারা। 

২৭ নভেম্বর খবরের কাগজের সাথে আসা চতুর্থ কো-অর্ডিনেটে আবরারকে ভেন্যু সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া হলো। 

একটা সাদা কাগজে পেন্সিল দিয়ে কাঁচা হাতে আঁকা মানুষের বুকের নিচের অংশ থেকে কোমরের অংশের ছবি। পুরো অবয়ব পেন্সিল দিয়ে আঁকা হলেও নাভি আঁকা কালার পেন্সিল দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবরার বুঝতে পারল গেমের ভেন্যু কী হতে যাচ্ছে।

গ্রিক মিথোলজি অনুযায়ী গ্রিসের ডেলফি নামক স্থানে গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর মন্দির অবস্থিত ছিল। পাইথিয়া নামের এক পুরোহিত দেবতাদের সাথে মানুষের সংযোগ ঘটাতেন দেবতাদের মাধ্যমে পাওয়া দৈববাণীর দ্বারা। এই দৈববাণীকে বলা হতো ওরাকল। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশেও ওরাকল নিজেদের অফিস খুলেছে।

দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে আবরার বুঝতে পারল লেভেল ওয়ানের ভেন্যু গেম ডেভেলপারদের মাধ্যমেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। 

৩০ নভেম্বর ঠিক রাত আটটায় রাজধানীস্থ ওরাকলের অফিসের সামনে থেকে কালো রঙের প্রাডো যখন আবরারকে নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে, আবরার জানত না তার রক্তে ক্রিয়াশীল অ্যান্টিহিপনোটিক ড্রাগও আগন্তুকদের উন্নত চিকিৎসাবিজ্ঞানের কৌশলের সামনে মুখ থুবড়ে পড়বে। 

৬. HellMyth Game-Level 1 (হেলমিথ গেম–লেভেল ওয়ান)

জ্ঞান ফিরতেই লালচে চোখধাঁধানো আলোয় লাইট অ্যাডাপশন তত্ত্ব নিজের চিরায়ত নিয়ম মেনে চলার কথা ভুলে গেছে বলে ভ্রম হলো আবরারের। 

সুবিশাল শুভ্র হলরুম লালচে আলোর প্রভাবে লাল রঙের মনে হচ্ছে। আগেরবার হ্যালোথেন ব্যবহার করলেও এবার অন্য কোনো শক্তিশালী অচেতনকারক ব্যবহার করা হয়েছে। 

ল্যাবরেটরিতে এত এত গ্যাস, বিষাক্ত পদার্থ নিয়ে যার কাজ, ধ্রুপদী শব্দের বিমর্ষ স্তবক বুমেরাং হয়ে তারই জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তাকে এভাবে অভিঘাত করবে, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি সে। 

আগেরবারের মতো এবারও পৃথিবীর সাথে আবরারের যোগাযোগের ন্যূনতম মাধ্যম-মোবাইল ফোনসহ সামান্য সুতা পর্যন্ত সরিয়ে ফেলা হয়েছে। গায়ের পোশাকটা আছে কোনো রকমে। আর বাঁ হাতের মধ্যমায় বহাল তবিয়তে আছে সেই রাক্ষুসে আংটি। 

মুখ তুলে সামনে তাকাতেই আবরার দেখতে পেল নিশ্চল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মুখোশের আড়ালের হার্মিস। সেদিনের মতো আজও পরনে কালো আলখেল্লা, মাথায় সেই ডানাযুক্ত টুপি। মুখোশের আড়াল থেকে অদেখা মুখটা বলে উঠল, লেভেল ওয়ানে আপনাকে স্বাগত। 

কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল আবরার আলখেল্লা পরিহিত মুখোশমানবের পেছনে পেছনে গেমের মূল ভেন্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মুখোশমানব হাতের ছোট রিমোট কন্ট্রোলটায় চাপ দিতেই স্বয়ংক্রিয় সাদা দরজা খুলে গিয়ে উন্মুক্ত হলো গেমের ভেন্যু। 

চোখে যেন পলক পড়ে না আবরারের। 

নেদারল্যান্ডসের কর্পাস মিউজিয়াম-এর এক টুকরো অংশ যেন কোনো সুনিপুণ কারিগরের মাধ্যমে প্রাণ পেয়েছে। কৃত্রিমভাবে তৈরি মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো তার অভ্যন্তরীণ নকশা আর কর্মপ্রণালি মেলে ধরেছে। 

কী মুখগহ্বর, কী ক্ষুদ্রান্ত্র, কী রক্তনালি, কী হাইপোথ্যালামাস-বিশাল কলেবরে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুতকৃত প্রতিটি অঙ্গন্ত্রে যেন রোলার কোস্টার রাইডের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া যাবে। রক্তনালির ভেতর থেকে এমনভাবে কলকল শব্দ আসছিল, একবারের জন্য আবরারের মনে হচ্ছিল বোধ হয় ভুল করে গ্যালিভারের ধমনির ভেতর দিয়ে লিলিপুট হয়ে রক্তকণিকা রূপে সে এগিয়ে চলেছে।

বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে আবরার দেখতে পেল ক্রোমোসোম ডিএনএর মতো পরস্পরকে সর্পিলাকারে জড়িয়ে থাকা কাঁচ নির্মিত দুটো পেঁচানো সোপান। স্বচ্ছ কাঁচ হাইড্রোজেন বন্ডের মতো একে অন্যকে জড়িয়ে রেখেছে। প্রায় তিরিশটির মতো ধাপ পেরিয়ে চুড়ায় ছাদের মতো একটা অংশে একটি আসনে বেঁধে রাখা হয়েছে এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাকে। 

এইই তবে সেই ভিকটিম, আসমা খাতুন– 

বুকের থেকে গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাসটা বের হতে দিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করল আবরার। মুখোশমানব গেমের ভেন্যুতে পৌঁছে দেবার পর দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ প্রথম দিনের মতো যান্ত্রিক কণ্ঠে সেই মহিলা বলে উঠল,

প্রিয় খেলোয়াড়, সিঁড়ির চূড়া থেকে ভিকটিমকে বাঁচাতে আপনি সময় পাবেন চল্লিশ মিনিট। গেমের জন্য আপনার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ভিকটিমের ঠিক সামনে একটি কাঁচের পাত্রে রাখা আছে। আপনার সময় শুরু হচ্ছে ঠিক এখন।

যান্ত্রিক কণ্ঠ থেমে যেতেই কৃত্রিম হৃৎস্পন্দনের প্রচণ্ড আওয়াজে কানে তালা লেগে গেল আবরারের। আওয়াজের উৎস খুজতে গিয়ে আবিষ্কার করল ডিএনএর মতো পেঁচানো সিঁড়ি থেকে বেশ অনেকটা উচ্চতায় বিশালাকার অটোমেটেড হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে- ৪০:০০, ৩৯:৫৯, ৩৯:৫৮….গোটা গোটা নম্বরগুলো যেন ধারাপাতের অঙ্কের রূপে একেকটা জীবন্ত রাক্ষস!

রক্তস্রোতের ঘূর্ণিপাক আবরারের বুকের ভেতর নিয়ত সংকোচন প্রসারণশীল যন্ত্রটাকে যেন পারলে ঠেলে দেহের বাইরে বের করে দেবে। 

কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে সংযত করে দ্রুতপায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল আবরার। মাথা গরম করলে কিছুতেই চলবে না। 

সিঁড়ির প্রত্যেকটা ধাপ কাঁচ দিয়ে তৈরি। কিছুক্ষণ নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেও কাঁচের প্রকৃতি ঠিকঠাক অনুমান করতে পারল না আবরার। 

চোখ বন্ধ করে কোনোমতে প্রথম ধাপটাতে পা রেখে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। নাহ, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তিরিশটা ধাপ পার হয়ে শেষ পর্যন্ত আবরার যখন আসমা খাতুনের কাছে পৌঁছাল ততক্ষণে মিনিট পনেরো পেরিয়ে গেছে। 

কৃত্রিম হৃৎস্পন্দনের আওয়াজের ডেসিবল মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটানোর মতো যথেষ্ট তীব্র। তবু আবরার ঠান্ডা মাথায় প্রতিটি ধাপ ফেলতে লাগল। 

নিচ থেকে দেখতে খুব সংকীর্ণ মনে হলেও সিঁড়ির চূড়াটাকে তিরিশ চল্লিশ স্কয়ারফিটের মতো প্রশস্ত মনে হলো আবরারের। 

জায়গাটাকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে পূর্ণ মনঃসংযোগ স্থাপন করল বেঁধে রাখা বয়স্কা ভদ্রমহিলার উপর। 

নিজের দুই উরু সামনে পেতে রাখা এক মানুষের মতো অবয়বের সাথে সাদৃশ্য রেখে অদ্ভুত দর্শন একটা চেয়ার তৈরি করা হয়েছে। আর এই চেয়ারেই আষ্টেপৃষ্ঠে এক স্বয়ংক্রিয় ধাতব নির্মিত বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখা। হয়েছে ভদ্রমহিলাকে। 

মুখেও একই ধরনের বেল্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। যেনতেন বেল্ট নয়, এর গায়ে রয়েছে একটি বিচিত্র লক প্যাটার্ন। হয়তো বাইরে থেকে এই লক নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। 

ভদ্রমহিলার কাছে এসে প্রথমবারের মতো চোখের দিকে তাকাল আবরার। ক্রমোসোমস্থ জিন যেমন মানুষের চরিত্রের ফিরিস্তি দেয় খোলা বইয়ের মতো, মৃত্যুভয়ও ঠিক তেমনিভাবে মানুষের চোখে খোদাই করা অক্ষরের মাধ্যমে ভেসে ওঠে। 

দুটো চোখের ঘোলা লেন্স দেখে আপাতদৃষ্টিতে ছানি আক্রান্ত বৃদ্ধা মহিলা মনে হলেও আবরার জানে, আসমা খাতুনের চোখে কোনো ছানি নেই।

দারুণ কোনো অপটোমেট্রিস্ট (চক্ষুবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ) ছাড়া এত জীবন্ত লেন্স তৈরি করা সম্ভব নয়। সম্ভবত এর কারিগর হলিউডের কোনো প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতার নির্মিত চলচ্চিত্রে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেন। 

কিছুক্ষণ আগে জানিয়ে দেওয়া নির্দেশাবলি অনুযায়ী চেয়ারের সামনে একটা কাঁচের বাক্স থাকার কথা। একটু খুঁজতেই পেয়ে গেল। কাঁচের বাক্সের মাঝে একটা ট্র। আর এর মাঝে রাখা লেন্স এক্সট্রাক্টর এবং এর পাশে কয়েক ইঞ্চি লম্বা একটি সুচ। 

নিবিষ্ট মনে পর্যবেক্ষণ করে আবরার বুঝতে পারে, হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জে ব্যবহার করা সুচই এখানে রাখা হয়েছে। 

নিজের কাজ শুরু করার আগে উপরে তাকিয়ে সময়টা ভালোভাবে দেখে নিলো আরও একবার। মাত্র সতেরো মিনিট বাকি আছে। 

ভদ্রমহিলার চোখের ভাষা পুরোপুরি বোঝার উপায় না থাকলেও প্রচণ্ড ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছেন বলাই বাহুল্য। আবরার ভদ্রমহিলার কাঁধে হাত দিয়ে নিজের পুঞ্জীভূত আত্মপ্রত্যয় থেকে কিছুটা ভদ্রমহিলার ভেতর সঞ্চারিত করার চেষ্টা করল। 

এরপর লেন্স দুটোর দিকে ভালোভাবে তাকালো। নিখুঁতভাবে কনট্যাক্ট লেন্স দুটো তৈরি করা হয়েছে। নিজের যতটুকু চক্ষুবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান ছিল, তার ভিত্তিতে আবরার বারবার কয়েকটি কোণ থেকে পরীক্ষা করে দেখল, লেন্সের উপরে থকথকে একটি দ্বিস্তরী আবরণী রয়েছে। 

দ্বিস্তরী আবরণীর একটি স্তরে সম্ভবত চোখ দিয়ে শোষিত হয়, এমন কোনো বিষাক্ত পদার্থ রাখা আছে। 

বিষাক্ত পদার্থটা যে ঠিক কী, তা অনুমান করতে লেন্স এক্সট্রাক্টর দিয়ে সূক্ষ্মভাবে লেন্স দুটোকে খুলে নিয়ে আসতে হবে। তরল অথবা পাউডার জাতীয় উপাদান হবার সম্ভাবনাই বেশি। 

আবরার বেশ বুঝতে পারল, কাজটা মোটেও সহজ হবে না। সুচের সামান্যতম আঘাত লাগলে দ্বিস্তরী আবরণী ভেদ করে সম্ভবত বিষাক্ত পদার্থ ভদ্রমহিলার চোখে শোষিত হয়ে রক্ত সংবহনে ঢুকে নিজের কাজ শুরু করে দেবে। 

লেন্স এক্সট্র্যাক্টরের পাশে রাখা সুচটি আবরারকে বিভ্রান্ত করতে রাখা হয়েছে, বেশ বুঝতে পারল আবরার। সুচ দিয়ে কোনোক্রমে দ্বিস্তরী আবরণীতে সামান্য আঘাত লাগলেই গেম ওভার। 

কাঁপা কাঁপা হাতকে নিজের মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণাধীন করে যথাসম্ভব ধাত হয়ে লেন্স এক্সট্রাক্টর দিয়ে ধীরে ধীরে লেন্সের কিনারের অংশ তুলতে শুরু করল। ভদ্রমহিলার শরীর-হাত-পা বাঁধা থাকায় একদিক থেকে বেশ সুবিধাই হলো আবরারের। 

শেষ পর্যন্ত এক চোখ থেকে প্রথম লেন্সটা সাবধানে তুলে আনতে পারল, তবে মনে হচ্ছে গেম ভেন্যুতে বাজতে থাকা কৃত্রিম হৃৎস্পন্দনের শব্দের কারণে তার হৃৎস্পন্দনের শব্দ ঢাকা পড়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাল আবরার। মাত্র চার মিনিট সময় আছে। 

মেরুদণ্ড বেয়ে বয়ে চলা স্রোত যেন অ্যাড্রেনালিন প্রবাহের মুখোশ পরে শরীরে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। 

খুব সাবধানে দ্বিতীয় লেন্সটা তুলে আনার চেষ্টা করল। শত চেষ্টা করেও শরীরের কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। একবার তো কম্পমান হাতে যন্ত্রটা দিয়ে প্রায় আঘাত করেই ফেলেছিল চোখের মাঝ বরাবর। 

কোনোমতে দাঁতে দাঁত চেপে কয়েক পা পিছিয়ে এসে হোঁচট খেয়ে পড়ে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। টাইমারের দিকে মনোযোগ না দিয়ে শেষ পর্যন্ত যখন আবরার লেন্সটা তুলে আনতে পারল, তখন তার দুচোখ দিয়ে ঠিকরে পড়ছে বিশ্বজয়ের আনন্দ। 

বৃদ্ধা মহিলার শরীর আর মুখের বাঁধন মুহূর্তেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেল। অপরিচিতা বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার দুহাতে হাত রেখে উদ্‌যাপনের ভঙ্গি করতে না করতেই ঢং ঢং শব্দে স্ক্রিনের ০:০ চিহ্ন জানান দিয়ে গেল, মাত্র কয়েক সেকেন্ড দেরি হলেই চোখের সামনে ঝরে যেত জলজ্যান্ত একটি প্রাণ। 

ওই দিকে বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা প্রথমে ঘটনার আকস্মিকতায় অনুভূতিশূন্য হলেও কয়েক মুহূর্ত পর থেকে ডাক ছেড়ে কেঁদে চলেছেন। তাকে কিছুক্ষণ সান্ত্বনা দিয়ে সামনে রাখা কাঁচের বাক্সে লেন্স দুটোকে রাখল আবরার। 

সুচ দিয়ে দ্বিস্তরী আবরণী ভেদ করে সাবধানে বিষাক্ত পদার্থটা পরীক্ষা করল।

গন্ধহীন পাউডারসদৃশ উপাদান দেখে সম্ভাব্যতার সূত্র অনুযায়ী কয়েকটি বিষাক্ত পদার্থের কথা মাথায় এলেও চোখ দিয়ে শোষিত হয়, এমন পদার্থ খুব বেশি নয়। শেষ পর্যন্ত আবরার সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, অগাথা ক্রিস্টির রহস্যোপন্যাসে ব্যবহার করা স্ট্রাইকনিন ছাড়া এটা অন্য কিছু হতেই পারে না। 

তখনই যান্ত্রিক সেই চেনা শীতল কণ্ঠ বলে উঠল, লেভেল ওয়ানে উত্তীর্ণ হবার জন্য আপনাকে অভিনন্দন। 

৭. ওরা পাঁচজন (ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট)

স্থিরদৃষ্টিতে আবরারের দিকে তাকিয়ে আছেন সিআইডি প্রধান, মুখে রা সরছে না যেন!

আমার তো একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না, এ রকম কোনো ঘটনা আসলেই ঘটা সম্ভব! তুমি আমাদের আগে জানালে না কেন?

ডিআইজি তামিম সাহেব একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আবরারের হাতের আংটির দিকে। আবরার সিআইডি প্রধানের দিকে নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে তাকাল,

স্যার, প্রথমে ভেবেছিলাম পুরো ব্যাপারটাকে নিজের ভেতরেই রাখব। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, আমার ইন্টারনাল কনফ্লিক্ট বেড়েই চলেছে। গেমের নিয়মেও বলা আছে, গেমের কোড ডিকোডের ক্ষেত্রে আমি যে কারও সাহায্য নিতে পারি, ওদের কনফিডেন্সিয়ালিটি মেইনটেইন করলে ওরা আমার ক্ষতি করবে না। 

আর আমি খুব ভালো করেই জানি, আপনারা কখনোই গোটা ব্যাপারটা লিক করবেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, গেমের ব্যাপারে আপনাদেরকেই খুলে বলব। 

এই আংটি দিয়ে ওরা তোমার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট মনিটর করছে! অবিশ্বাস্য! পাতলা মেটালিক একটা আংটিতে এরকম প্রযুক্তি। 

অ্যাডিশনাল ডিআইজি ফজলে সাহেব আংটির দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থাকা তামিম সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই বললেন,

লেভেল টু-তে তোমার পাওয়া প্রথম কো-অর্ডিনেট সম্পর্কে আগে শুনি। গ্রিক মিথোলজিতে জিউসের স্ত্রী হেরার সাথে মিল রেখে রিয়েল লাইফের একটা ঘটনা নির্বাচন করা হচ্ছে, এটা তুমি কীভাবে বের করলে? প্লিজ, ডিটেইলস বলো। আমার আর তর সইছে না।

সিআইডি প্রধানের ঘরে পাঁচজনের আলোচনা সভা যে নব্বই দশকে ঠিক রাত আটটা বাজতেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা বুভুক্ষু দর্শকের আলিফ লায়লা থেকে পাওয়া রোমাঞ্চকেও হার মানাবে, কেউ কী ভেবেছিল কখনো! 

স্যার, লেভেল টুর প্রথম কো-অর্ডিনেট আমি পাই এ মাসের এক তারিখ। গেমের নিয়ম অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর অর্থাৎ আগামীকাল ঠিক রাত আটটায় আমাকে ওরা পিক করবে… 

আবরারের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিলো অবন্তি, কণ্ঠে রাজ্যের অনুসন্ধিৎসা, 

কালকেও কী ওরাকলের সামনে অপেক্ষা করতে হবে?

হ্যাঁ, লেভেল ওয়ানের মতো এবারও চতুর্থ কো-অর্ডিনেটে একই ভেন্যুর ক্ল দেওয়া হয়েছে। ওখান থেকেই ওরা আমাকে পিক করবে। 

আমার ভাবতেই কেমন কেমন লাগছে! আমরা যা আলোচনা করছি, সবকিছু ওরা মনিটর করতে পারছে! আপনার পার্সোনাল স্পেস বলে কিছুই নেই। 

আহা অবন্তি, সেকেন্ড লেভেলের প্রত্যেকটা কোড আবরার কীভাবে ডিকোড করেছে, সেই গল্পটা শুনতে দাও আমাদেরকে। 

ফজলে রাব্বির কণ্ঠে ঈষৎ ধমকের সুর। 

টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে সামান্য পানি নিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলো আবরার। দীর্ঘ বক্তৃতার প্রস্তুতির মতো গলা খাকারি দিয়ে শুরু করল। 

স্যার, লেভেল টুর প্রথম কো-অর্ডিনেট আমার গাড়ির ডিকিতে প্রথম দেখতে পাই। একটা বেশ পেটমোটা সাদা প্যাকেটের উপরে গেমের লোগো, ভেতরে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাস। প্যাকেটের ভেতরে আরও একটি খামে আমাদের পবিত্র মক্কার হেরা গুহার ছবি। 

বইটা খুলে প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি। পরে লক্ষ করে দেখি, সবগুলো অক্ষর কালো রঙের হলেও শ্রীকান্তের দ্বিতীয় পর্বের এক অংশে ঠাহর করিয়া দেখি, চালান যাইবে বটে কিন্তু বাছুর নয়, মানুষ-এই লাইনে কেবলমাত্র বাছুর শব্দটাই লোগোর রঙের মতো সোনালি রঙের অক্ষরে লেখা। হেরা আর বাছুর শব্দটা থেকে সহজেই গ্রিক মিথোলজির কোন উপাখ্যানের হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে যাই। 

আবরারের সামান্য বাকৃবিরতিতে সবার আটকে রাখা নিঃশ্বাস একযোগে অনুরণিত হয়ে উঠল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে চলেছে সবাই। 

গ্রিক মিথোলজিতে জিউসের স্ত্রী হেরা আর জিউসের প্রেমিকাকে নিয়ে এক অদ্ভুত কাহিনি আছে। দেবতাদের প্রধান হয়েও একবার কামুক, লম্পট জিউস বরাবরের মতো স্ত্রীকে রেখে আবার প্রেমে পড়লেন মর্ত্যের রাজকুমারী আইওর। আইওকে নানাভাবে প্ররোচিত করে গর্ভবতী করে ফেললেন জিউস। মহাপ্রভাবশালী দেবতাদের রাজা হলে কী হবে, নিজের স্ত্রীকে যমের মতো ভয় করতেন। স্ত্রীর রোষের কবল থেকে বাঁচাতে প্রেমিকা আইওকে পরিণত করলেন এক সাদা রঙের বকনা বাছুরে। 

বিশ্বপ্রেমিক স্বামীকে হাড়ে হাড়ে চিনতেন হেরা। অদ্ভুত ব্যাপার, লম্পট স্বামীকে কখনোই শাস্তি না দিয়ে স্বামীর প্রেমিকাদের আর অবৈধ সন্তানদের খুন করার জন্য উঠেপড়ে লাগতেন সব সময়। এবারও ব্যতিক্রম হলো না। 

যখন জানতে পারলেন, আইওর গর্ভে আসছে জিউসের সন্তান, তখন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠলেন। আইওর সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে সেই সন্তান ইপাফাসকে চুরি করতে লোক পাঠালেন। 

আর আমাকে পাঠানো ভিডিওটাতেও আপনারা দেখতে পেলেন, শিল্পপতি স্বামীর রক্ষিতার ঘরে সন্তান আছে জানতে পেরে শিল্পপতির স্ত্রী সেই রক্ষিতাকে নবজাতক শিশুসন্তান হত্যার হুমকি দিচ্ছে। দুটো কাহিনির মধ্যে মিল খুঁজে পাচ্ছেন কি? 

আমি একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারি না, প্রভাবশালী, প্রতিপত্তিশালী পুরুষেরা তাদের বৈধ স্ত্রী ছাড়াও কেন অজস্র মেয়েকে বিছানায় নিতে চায়? 

আগেরকার যুগের রাজা-বাদশাহ হোক কিংবা এখনকার যুগের মন্ত্রী এমপি, শিল্পপতি-সুন্দরী নায়িকা, মডেল, গায়িকা, মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের সুন্দরী ছাত্রী এমনকি কাজের বুয়াকে পর্যন্ত ছাড়ে না। সব নারীর শরীরের উপরই যেন প্রভাবশালীদের একান্ত অধিকার! বিবাহিত হোক কি তিন বাচ্চার বাপ-সব মেয়ে যেন ওরা চাইলেই শুতে বাধ্য থাকবে। 

ফজলে রাব্বি সাহেব ঈষৎ হেসে অবন্তির সুরে সুর মেলালেন,

আকবরের হেরেমখানায় নাকি ছিল ৫০০০-এর উপর নারী! ইভেন, চেঙ্গিস খান এত বড় নারীলিলু ছিলেন যে এশিয়ার মাইনরে প্রতি ১০০ জনে ৮ জন চেঙ্গিস খানের বংশধর। 

আমাদের বাংলাদেশেও এই জিনের পরিমাণ নেহাত নগণ্য নয়। যাক, সরকারি চাকরি করেও ছাপোষা জীবন্যাপন আমার, এক স্ত্রীতেই পুষিয়ে যায়। ভাগ্যিস অত প্রভাব-প্রতিপত্তির শখ নেই। আমি বাবা দারুণ ভীতু মানুষ! 

উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হয়েও সৎ জীবনযাপনের কৃতিত্বটুকু নিয়ে ফজলে সাহেব উপবিষ্ট সিনিয়র দুজনকে সূক্ষ্ম তীর নিক্ষেপ করলেন কিনা ঠিক বোঝা গেল না। ডিআইজি তামিম সাহেব নীরবতা ছেদ করে বললেন, 

জেমস ক্যামেরনের টার্মিনেটরের কথা তো মনে আছে সবার? সেই বিখ্যাত ফিল্মখ্যাত আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারও কিন্তু বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন নিজেরই বাড়ির কাজের মহিলার সাথে। সেই ঘরে তার সন্তানও ছিল। 

কী অদ্ভুত ব্যাপার! যারা সামাজিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থাকেন, তাদেরই তো সম্মান নিয়ে চলাফেরা করতে হয় সবচেয়ে বেশি। তাদেরই তো মানসম্মানের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকার কথা। তা না হয়ে উল্টোটা হয় কেন? 

কেন শিল্পপতি, বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা বিবাহবহির্ভূত সামান্য প্রেম করতে গিয়ে এত বড় বড় ঝুঁকি নেন যে অনেক ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তা তাদের পতন পর্যন্ত ডেকে আনে? 

এতক্ষণ পর মুখ খুলল আবরার, দৃষ্টি অবন্তির দিকে, 

মানছি পুরুষ পুঁজিপতিদের পরিমাণ বেশি, তাই বহুগামিত্বের হারও বেশি। তবে আপনারা মেয়েরাও যখন অগাধ ক্ষমতার মালিক হয়ে যান, তখন কিন্তু আপনারাও একই ধরনের আচরণ করেন। এলিজাবেথ টেলর জীবনে আট-নয়বার সঙ্গী বদল করেছে। কোনো কোনো সূত্রমতে বারো তেরোবার! 

সেলেনা গোমেজ, ক্রিস্টেন স্টুয়ার্টকে দেখুন। আমাদের মতো মধ্যম আয়ের দেশেও তামিমার মতো মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পারেন। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে তামিমা স্বামীর ভরণপোষণে পাড়াগা থেকে ঢাকা এসে শিক্ষিত হলো, বিমানে চাকরি পেল। পরে সেই স্বামীকেই ছেড়ে দিয়ে জাতীয় দলের ক্রিকেটারকে বিয়ে করলো। সাবেক স্বামীকে পাবলিকলি অশিক্ষিত, আনকালচার্ড বলে অপমান করল। 

কিন্তু তারপরেও পুরুষতন্ত্রের কামুক স্বভাবকে অস্বীকার করার উপায় নেই। মেয়েরা বছরের পর বছর ধরে অবদমিত ছিল, এ কথা আপনি ভুলে যাচ্ছেন। 

এতক্ষণ সবার মতবিনিময় বেশ ভালোই উপভোগ করছিলেন বিচক্ষণতা এবং ধীশক্তির অধিকারী সিআইডি প্রধান। আবরার আর অবন্তির ঈষৎ বাগ্‌বিতণ্ডার মাঝে হস্তক্ষেপ করলেন,

দেখো আবরার, আমার ধারণা, এবার অবন্তির সাথে তর্কে জেতার জন্য তমি এই যুক্তিগুলো দিচ্ছ। অসম্ভব ক্ষমতা মানুষকে ভোগবাদী করে তোলে। অনেকটা নার্সিসিস্টদের মতো-ডাক্তার হিসেবে তোমার ভালো জানার কথা। কিন্তু ভোগবাদের ক্ষেত্রেও নারী এবং পুরুষের মাঝে বেশ বড় ধরনের পার্থক্য আছে। 

বায়োলজিক্যালি, পুরুষ সাম্রাজ্যবাদী। গর্ভধারণের ক্ষমতা থেকে মুক্ত হবার কারণে কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই পুরুষ চায়, তার মতো ক্ষমতাশালীর জিন বহু নারীর মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ুক। তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তারই মতো ক্ষমতাশালী হবে, এটাই তার প্রচ্ছন্ন ইচ্ছে। আমার যুক্তি কী ঠিক আছে ডাক্তার সাহেব?

আসন্ন গেম-সংক্রান্ত ভয়াবহতা শরীর-মনকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে এই দুই মাসে শেষ কবে হেসেছে আবরার মনে করতে পারে না। তবে হেড স্যার আবরারের দুষ্টমি ধরে ফেলায় বহুদিন পর মুখমণ্ডলের ছয় জোড়া মাংসপেশি বিস্তৃত হাসির রূপ ধরে নিজের কর্মক্ষমতা দেখানোর সুযোগ পেল। 

হাহা, স্যার আপনি ঠিকই ধরেছেন। আসলে ম্যাডামের সাথে একটু তর্ক করার সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইনি। সত্যি বলতে নারীদের জিন পুরুষের থেকে তুলনামূলক স্থিতিশীল। অপত্য ধারণ এবং লালনের জন্য অধিকাংশ নারী পুরুষের থেকে স্বক্রিয়ভাবে জীবনচক্রে অনেকটা বেশি সময় অতিবাহিত করে। 

এ সময়ে পুরুষের চেয়ে নারীর শরীরে অক্সিটোসিন হরমোনের আধিক্য দেখা যায়। একই কারণে নারীদের শরীরে প্রবল অপত্যস্নেহ এবং দীর্ঘমেয়াদি একগামী সম্পর্কের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। তবে… 

তবে? 

তবে পুঁজিবাদী সমাজ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বতন্ত্রবাদকে এমনভাবে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে, আমার ধারণা বিবর্তনের হাত ধরে এই অপত্য স্নেহের জিনও মিউটেশনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। কে বলতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে নারীরাও পুরুষের মতো সাম্রাজ্যবাদী হয়ে পড়বে না! 

আচ্ছা, লেভেল ওয়ানে তো তুমি ভিকটিম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে পেরেছিলে। এবার কী ভিডিওতে কোনো কু-ই দেওয়া হয়নি? 

ভিডিও শেষে ঐ শিল্পপতির ইন্ডাস্ট্রির নাম দেখানো হয়েছে। ম্যারিগোল্ড গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি। আমাদের দেশের প্রথম শ্রেণির একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। 

তাহলে তো ভিকটিম সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারোনি। আগেরবার তো ভিকটিমের নাম জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল এমনটাই বললে। 

চিন্তিত ভঙ্গিতে সিআইডি প্রধানের দিকে তাকাল আবরার, 

আমার ধারণা, প্রত্যেক লেভেলে ওরা গেমকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে ফেলবে। 

দেখেছ, আমরা প্রসঙ্গ থেকে কত দূরে সরে গিয়েছি। পরের কোডটা নিয়ে বলো না আবরার। হত্যাপদ্ধতি কীভাবে অনুমান করতে পেরেছ? 

ফজলে সাহেবের গলায় অনুনয়ের সুর। মুহূর্তেই বাতাসে মিহি তরঙ্গ তুলে এক বিদেহী হিমশীতল হাওয়া ভয়ের রূপ ধারণ করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল আবরারকে। কী হতে যাচ্ছে কাল কে-ই বা জানে! 

স্যার, আমাকে তৃতীয় কো-অর্ডিনেটে একটা রথের ছবি পাঠানো হয়। ওখানে লুকনো কোডটা ডিকোড করতে পারায় শেষ পর্যন্ত ক্রাইম ভেন্যু জানতে পারি। এবারও ওদের নির্ধারিত জায়গায় খেলতে হবে। 

রথ থেকে মৃত্যুর পদ্ধতি! কীভাবে অনুমান করলে?

তামিম সাহেবের কন্ঠে একরাশ বিস্ময়। 

স্যার, গেমের লোগোতে অ্যাসক্লেপিয়াসের চিহ্ন থাকায় প্রথমবার আমার ধারণা ছিল, হত্যাপদ্ধতির সাথে মেডিক্যাল সায়েন্সের সাদৃশ্য আছে। লেভেল ওয়ানে আমার ধারণাটা মিলে যায়। এবার লেভেল টু-তে রথের ছবি থেকে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পরে রথের ইংরেজি প্রতিশব্দ Chariot থেকে ছয় অক্ষর নিয়ে caroti আর চার অক্ষর নিয়ে aort-দুটি অর্থহীন শব্দ বের করে বসে থাকি। 

প্রথম শব্দের শেষে একটা d আর দ্বিতীয় শব্দের শেষে a হলেই দুটো মেডিক্যাল রিলেটেড ক্রু পাওয়া যেত-carotid আর aorta। 

কিছুক্ষণ একমনে ভাবতেই বুঝতে পারলাম শব্দটা হচ্ছে aorta। ছবিতে যেহেতু একটাই রথ ছিল, তাই A Chariot ফ্রেজের আটটি অক্ষর থেকে পাঁচটি অক্ষর নিয়ে পাওয়া যায় aorta। 

তার মানে শরীরের কোনো ধমনির মাধ্যমে কোনো বিষাক্ত পদার্থ প্রবেশ করিয়ে ম্যারিগোল্ড গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকের রক্ষিতার সন্তানকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে। 

কিন্তু স্পেসিফিক কোন ধমনি? কী বিষাক্ত উপাদান? 

সিআইডি প্রধানের চোখে অভিভাবকের ছায়াসুলভ আন্তরিক জিজ্ঞাসা, ছেলের মতোই স্নেহ করেন তিনি আবরারকে। 

আপাতত জানি না। তাৎক্ষণিকভাবে ক্রাইম ভেন্যুতে রাখা যন্ত্র থেকে। আমাকে অনুমান করতে হবে। 

আবরার ভয়ের অনুভূতিকে স্থান দিতে না চাইলেও রূপকের পোশাকে মোড়া ভয়ের শীতল অনুভূতি শ্বাপদের মতো চোখ রাঙাচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে। 

৮. HellMyth Game-Level 2 (হেলমিথ গেম-লেভেল ২)

দুপাশে সবুজ পাহাড়, পাহাড়ের মাথা গিয়ে ঠেকেছে শ্বেতশুভ্র কুয়াশায়। পাহাড়ের মাঝখানে পায়ে হাঁটা আঁকাবাঁকা পথ। পথের দুপাশে বড় বড় বিচিত্র রঙের পাথর। 

দশ কদম সামনে এগোতেই ঝর্ণার অঝোর জলধারা। কৃত্রিমভাবে তৈরি পরিবেশে স্বয়ং প্রকৃতি যে এভাবে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারে, চোখের সামনে না দেখলে আবরার কখনোই বিশ্বাস করত না। 

সত্যি, অর্থের কী নিদারুণ ক্ষমতা! যাপিত জীবনের গাৰ্হস্থ্যবেলায় সংসারের ক্লান্তিকর বৃত্ত পরিভ্রমণ শেষে কেউ ঘাসের উপর এক বিন্দু শিশিরকণা দেখার অবকাশ পায় না, আবার ঐ একই পৃথিবীতে কেউ কেউ অর্থের দাপটে ঘরের মাঝেই প্রকৃতিকে তুলে আনতে পারে। 

কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে আবরারকে কে জানে! অবশ্য জ্ঞান ফিরতেই চিরাচরিত নিয়মে সেই বিশাল সাদা হলঘর থেকে মুখোশমানব হার্মিসই গেমের ভেন্যুতে নিয়ে এসেছে। 

কৃত্রিম ঝর্ণা তৈরি করতে বিশেষায়িত ইঞ্জিনিয়ারদের মাধ্যমে ৬-৭টা পাম্প প্রয়োজন হয়েছে-খুব সূক্ষ্মভাবে কৃত্রিম ঝর্ণা পর্যবেক্ষণ করে আবরারের ধারণা হলো। 

মাথার উপর নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। LED স্কাইলাইট দিয়ে ভার্চ্যুয়াল আকাশ তৈরির প্রযুক্তি সম্পর্কে আগেভাগে কেউ না জানলে কখনো বুঝতেই পারবে না, বিশাল এক ঘরের মাঝেই এক খণ্ড নীল আকাশকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। 

কৃত্রিম ঝর্ণা থেকে কিছু দূর আগাতেই কৃত্রিম ছোট একটা জলাশয়। জলাশয়ের ঠিক সামনেই একটা সিন্দুক রাখা। রাজা-বাদশাহদের আমলে প্রাপ্ত বহুল কারুকার্যখচিত সিন্দুকের মতোই অনেকটা। পার্থক্য হলো একে সিন্দুক না বলে মিনি সিন্দুক বলা যেতে পারে। মাঝারি কাঠের বাক্সের আকারের হবে। গেমের নোগোর সোনালি রঙের সাথে সিন্দুকের রং পুরোপুরিভাবে মিলে যায়। 

হাঁটু গেড়ে বসে সিন্দুকটা মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল আবরার। বিভিন্ন ধরনের উপকথায় অনেক সময় অত্যাচারী রাজার হাত থেকে নবজাতককে বাঁচানোর জন্য সিন্দুকে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেবার গল্প বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রচার করা হয়। আব্রাহামিক ধর্মগুলোতেও এ রকম অনেক ঘটনা রয়েছে। 

সিন্দুকের গায়ে খোদাইকাজের মাধ্যমে পদ্মফুল, সজীব গাছ, লতাপাতা নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সিন্দুকের কিনারা বেষ্টন করে রেখেছে ক্রিস্টাল নির্মিত স্বচ্ছ মুক্তোর আকারের ছোট ছোট অসংখ্য বল। 

সিন্দুকের ডালাটা খুলতেই ছোট একটা শিশুকে দেখতে পেল। ছোট ছোট আঙুল আর হাত-পা নাড়িয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে হাসছে। দেখে তিন মাসের বেশি বয়স হবে বলে মনে হচ্ছে না। 

শিশুদের বরাবরই ঈর্ষা করে আবরার। আসন্ন সব বিপদ আর আগুনের আঁচ সম্পর্কে অনবগত শিশুরা কী সুন্দর প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারে। বাচ্চাটার পরনে অদ্ভুত দর্শন একটি পোশাক। অনেকটা প্রাচীনকালের রাজপুত্রদের পোশাকের মতো ঝলমলে চামড়া নির্মিত। 

কৃত্রিম পাহাড়ের গায়ে হলোগ্রাফিক স্ক্রিন থেকে ভেসে উঠল সেই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর, 

প্রিয় খেলোয়াড়, সিন্দুকের ভেতর রাখা শিশুকে উদ্ধার করতে আপনি সময় পাবেন তিরিশ মিনিট। গেমের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সিন্দুকের ভেতরে ছোট এক বাক্সে রাখা আছে। আপনার সময় শুরু হচ্ছে এখন।

কৃত্রিম পাহাড় কী দিয়ে তৈরি কে জানে, পাহাড়ের গায়ে হলোগ্রাফিক প্রোজেক্টরে ভেসে ওঠা স্টপওয়াচ চাল হয়ে গেল। আজকে হিমশীতল হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না! 

সিন্দুকের ভেতরে বাচ্চাটির ঠিক পাশে আরেকটা ছোট বাক্স রাখা। কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্সটা খুলল আবরার। 

ক্ষুরের মতো দেখতে একটা যন্ত্র এবং তার সাথে হোমিওপ্যাথির শিশির মতো ছোট একটা লেবেলবিহীন স্বচ্ছ শিশিতে পানির মতো দেখতে তরল পদার্থ। 

আবরার বুঝতে পারল, নির্দেশনায় এই সরঞ্জামের কথাই বলা হয়েছে। কিন্তু এসবের মানে কী! দুহাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরে নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। 

বাচ্চাটার অদ্ভুতদর্শন পোশাকটা খুলে শরীরের দিকে ভালোভাবে লক্ষ করতেই হাত-পা অসাড় হয়ে গেল। পেটের মাঝবরাবর একটা অংশ স্ফীত 

হয়ে আছে। একনজর দেখলেই বোঝা যায়, রোগীর Abdominal Aortic Aneurysm আছে। 

মূলত হৃৎপিণ্ড থেকে নিচের দিকে, তলপেটের অংশে যেই রক্তনালির মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত হয়, সেই রক্তনালি কোনো কারণে ফুলে গেলে বাহির থেকে চাকার মতো একটা অংশ দেখা যায়। মেডিকেলের পরিভাষায় একেই Abdominal Aortic Aneurysm বলে। তবে কী বাচ্চাটার জন্মগতভাবেই এই সমস্যাটা ছিল! মনে হাজার প্রশ্ন উঁকি দিলেও কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার কোনো উপায় নেই। 

এই রোগের কারণে তো তাৎক্ষণিক মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই। তবে কী কোনো বিষাক্ত উপাদান এই স্ফীত অংশের ভেতর দিয়ে শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছে! 

অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে এই ধারণাকে বাতিল করে দিল আবার। বাচ্চার হার্টবিট, পালস রেট পরীক্ষা করে অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পায়নি, শরীরে বিষ প্রবেশ করলে কোনো না কোনো অস্বাভাবিকতা নিশ্চয় ওর চোখে ধরা পড়ত, বিষ নিয়েই তো ওর কারবার। পেটের স্ফীত অংশের পালসেশনেও স্পন্দনের মতো শব্দ শুনতে পেল আবরার। 

কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারল না, সাধারণত Abdominal Aortic Aneurysm ৬৫ বছরের উপরের পুরুষে বেশি দেখা যায়। জন্মগত কারণে বা ক্রুণগত অস্বাভাবিকতার কারণে এই রোগ হবার আশঙ্কা খুবই কম। এটা কোনো প্ল্যান নয় তো?

হয়তো এই স্ফীত অংশটা কৃত্রিম! কিন্তু তা কী করে হবে? স্পষ্ট পালসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। প্র্যাকটিসিং পেডিয়াট্রিক সার্জন না হলেও ডায়াগনোসিসে এত বড় ভুল আবরারের হবার কথা নয়।

কাঁচের বাক্স থেকে পাওয়া যন্ত্র দুটোর দিকে মন দিলো আবরার। ওদিকে স্টপওয়াচে সময় বয়ে চলেছে। 

ক্ষুরের মতো দেখতে যন্ত্রটা বেশ চেনা চেনা লাগছে। 

কিছুক্ষণ ভাবতেই বুঝতে পারল-এল বা ভায়াল কাটার। কাঁচ বা কাছাকাছি উপাদানে নির্মিত যেকোনো ল্যাবের সরঞ্জাম ভাঙতে হলে এর সাহায্য নেওয়া হয়। কিন্তু গেমের আগামাথা কিছুতেই বুঝতে পারল না আবরার। 

ছোট শিশিটা খুলে তরলের প্রকৃতি খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। স্টপওয়াচের দিকে এক ফাঁকে তাকিয়ে দেখল নিষ্ঠুর সময় নিজেকে ১৫:৫৯….১৫:৫৮… রূপে জানান দিয়ে যাচ্ছে। তার মানে পনেরো মিনিটের থেকে কম সময় আছে। 

শিশুদের হাসির মতো এত চমৎকার কোনো কিছু বোধ হয় নেই, চোখ বড় বড় করে আবরারের দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটা ফোকলা দাঁতে হাসছে। নিষ্পাপ দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে আবরার বুঝতে পারল সে কুল কুল করে ঘামছে। 

মনপ্রাণ এক করে শিশির ভেতরকার ফ্লুয়িডের গঠন-উপাদান বিশ্লেষণের চেষ্টা করল। এক ফোঁটা তরল কৃত্রিম সেটের মেঝেতে ফেলল। কোনো পরিবর্তন দেখতে পেল না। তরলটি প্রায় গন্ধহীন। তবে খুব সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করলে একটা চাপা গন্ধ পাওয়া যায়। একটা ফলের মতো গন্ধ।

নির্দিষ্ট কোনো ফলের নয়, কয়েকটা ফলের মিশ্রণ করা হলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায়, অনেকটা সে রকম গন্ধ। তবে গন্ধটা এতটাই ক্ষীণ যে অলফ্যাক্টরি নার্ভের সংবেদনশীলতা শিকারি কুকুরের মতো তীক্ষ্ণ না হলে পাওয়ার কথা নয়। 

কিছুতেই কোনো ক্ল পেলনা আবরার। এম্পুল কাটারের মতো একটা যন্ত্র আর নাম না-জানা তরল দিয়ে ওরা চাচ্ছেটা কী! ওরা কি চায়, বাচ্চাটার পেটের স্ফীত বর্ধিত অংশ আবরার সার্জারি করবে এ রকম অপ্রাসঙ্গিক যন্ত্র আর তরল দিয়ে! 

গ্রিক মিথোলজিতে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত সার্জারির প্রয়োগ দেখা যায়। অ্যাপোলো স্বয়ং অ্যাসক্লেপিয়াসকে অযৌক্তিক সার্জারির মাধ্যমে আগুনে দগ্ধ হতে থাকা মায়ের পেট থেকে বের করেছেন। এসব মিথথালজির পেছনে তো কোনো যুক্তি নেই। আছে কেবল প্রাচীন গ্রিসের অধিবাসীর জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, কিন্তু সাহিত্যিকদের সীমাহীন অথচ অযৌক্তিক কল্পনার ক্ষমতা। 

সময়ের নিয়মে স্টপওয়াচে সময় বয়ে যাচ্ছে, যা করার এখনই করতে হবে আবরারকে। কিন্তু করবে টা কী! এতটা অসহায় এর আগে নিজেকে কখনোই মনে হয়নি। মাথায় যেন খুন চেপে গেল আবরারের। হাতের এম্পুল কাটারটা দিয়ে সিন্দুকের ডালায় খুব জোরে আঘাত করল। 

ফসস…শব্দে সংবিৎ ফিরে পেল আবরার, যা দেখল তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না।

এতক্ষণ সিন্দুকের ডালা বেষ্টন করে রাখা মুক্তোর আকারের ক্রিস্টালের বল যেগুলোকে ভেবেছিল, সেগুলো আসলে ক্রিস্টালের বল নয়। 

হাতের এঙ্গুল কাটারের আঘাতে কাঁচসদৃশ ছোট বল ফেটে গিয়ে তরল বের হয়ে গভীর ফুটো সৃষ্টি করেছে সিন্দুকের ডালায়। তার মানে… তার মানে কারুকার্যের জন্য বলগুলোকে রাখা হয়নি, এর ভেতর হাই কনসেন্ট্রেশনের সালফিউরিক অ্যাসিড আছে। 

বিক্রিয়ার ধরন দেখেই সালফিউরিক অ্যাসিডের উপস্থিতি সম্পর্কে আবরারের আর সন্দেহ রইল না। 

খুব সাবধানে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো। হাত-পা নেড়ে খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। 

বাচ্চাটির আশপাশে গোল মুক্তোর সাইজের কাঁচের এম্পুল আছে কি না পরীক্ষা করে দেখল আবরার। সালফিউরিক অ্যাসিডের মাধ্যমেই বাচ্চাটির মৃত্যু নিশ্চিতের ব্যবস্থা করে রেখেছে গেম ডেভেলপাররা-এতটুকু সে নিশ্চিত। কিন্তু কীভাবে! বাচ্চার শরীরে কোনো কাঁচের বলের চিহ্নই পেল না আবরার। 

ওদিকে স্টপওয়াচ জানান দিয়ে যাচ্ছে, গেমের জন্য নির্ধারিত সময়ের মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি আছে। বাচ্চার পেটের স্ফীত অংশ আর ছোট শিশির মাঝে রাখা তরলের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল আবরার। 

বড় বড় হলিউডের মুভিতে জম্বি দেখাতে হলে বা জটিল মেডিক্যালীয় অস্ত্রোপচারের দৃশ্য, এলিয়েন দেখাতে হলে প্রস্থেটিক হিউম্যান লিম্ব, স্মার্ট প্রস্থেটিকস ব্যবহার করা হয়। এসব প্রস্থেটিক হিউম্যানয়েড মেকআপ অত্যন্ত জীবন্ত, ঠিক এই স্ফীত টিউমারসদৃশ অংশের মতো। হাতের সাহায্যে তোলা যায় না এই মেকআপ। 

প্রস্থেটিকের প্রান্তগুলো মানুষের চামড়ার সাথে সূক্ষ্মভাবে একীভূত করে মানুষের চামড়ারই একটি অংশ হিসেবে দর্শকদের ধোকা দেওয়া হয়। সেই প্রস্থেটিকের প্রান্তে থাকে বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত গু। অ্যাসিটোন জৈব দ্রাবক হওয়ায় প্রস্থেটিকের প্রান্তের সেই গুয়ের সাথে বিক্রিয়া করে ধীরে ধীরে সেটিকে চামড়া থেকে সরিয়ে আনতে সাহায্য করে। 

তার মানে যেই স্ফীত অংশকে Abdominal Aortic Aneurysm ভেবেছিল, সেটা আসলে কৃত্রিম। আবরার মনে মনে অনুকল্প দাঁড় করাল, গেম ডেভেলপাররা এতটাই প্রভাবশালী যে নেদারল্যান্ডসের কর্পাস মিউজিয়ামের এক খণ্ডকে বদ্ধ ঘরে পুনর্নির্মাণ করতে পারে। 

প্রস্থেটিক টিউমারের ভেতরে কম্পিউটারের সাহায্যে কৃত্রিম পালসেশন সৃষ্টি করা তাদের জন্য অসম্ভব কিছুই না।

সম্ভবত এই প্রস্থেটিক টিউমারের মতো দেখতে স্ফীত অংশ বের করতে না পারলে এর ভেতরে রাখা অসংখ্য এম্পুল ফেটে সালফিউরিক অ্যাসিড বাচ্চাটির সত্যিকারের চামড়ার সাথে বিক্রিয়া করবে। 

চোখ বন্ধ করে একবার শিউরে উঠল আবরার। আর মাত্র চার মিনিট বাকি আছে। যা করার এখনই করতে হবে। 

আবরার বাচ্চাটির পেটের মাঝবরাবর রাখা প্রস্থেটিকের প্রান্তে ধীরে ধীরে শিশিতে রাখা তরল ছড়িয়ে দিতে লাগল। 

আবরারকে বিভ্রান্ত করার জন্য শিশির অ্যাসিটোনের মাঝে নিশ্চিতভাবে ফেব্রিজ মিশ্রিত করে দিয়েছে ওরা, যাতে গন্ধ থেকে শিশির ভেতরে রাখা উপাদান সে অনুমান না করতে পারে। 

ফেব্রিজ এমন একটি উপাদান, যার ভেতরে থাকা সাইক্লিডেটিসিন যেকোনো পদার্থের নিজস্ব গন্ধকে দূর করতে পারে। তাই তো আবরার অ্যাসিটোন থেকে এত হালকা মিশ্র ফলের গন্ধ পেয়েছিল। অ্যাসিটোনের গন্ধ সাধারণত আরও অনেক তীব্র হবার কথা। 

পুরো প্রস্থেটিক টিউমারের প্রান্ত বরাবর অ্যাসিটোন লাগিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। ধীরে ধীরে যখন প্রস্থেটিক উঠে আসতে শুরু করেছে, তখন সময় শেষ হতে মাত্র তিরিশ সেকেন্ড বাকি। 

পুরোটা উঠে আসতেই আবরার শিউরে উঠল, উত্তল আকারের প্রস্থেটিক টিউমারটা সম্পূর্ণ ফাঁপা, ভেতরে সেই মুক্তোর মতো দেখতে অসংখ্য ছোট ছোট কাঁচের এল। 

ভয়ে দূরে ছুঁড়ে মারল প্রস্থেটিকটা, সঙ্গে সঙ্গে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে সময় শেষ হবার সংকেত দিতেই কাঁচ ভাঙার প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে গেল আবরারের। 

বিস্ফারিত দৃষ্টিতে আবরার দেখল মেঝের যে অংশে প্রস্থেটিকটা ছুঁড়ে ফেলেছিল, সেখানে আর সিন্দুকের ডালায় অজস্র স্পঞ্জের আকারে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।

আবরার বুঝতে পারল, প্রত্যেকটি সালফিউরিক অ্যাসিডসমৃদ্ধ কাঁচের এম্বুলের চাপ বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল। সময় শেষ হতেই একযোগে সবগুলো এম্বুলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। 

কৃত্রিম জলাশয়ের সামনে ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ধরে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে জলের উপর নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইল আবরার।

লেভেল টু-তে উত্তীর্ণ হবার জন্য আপনাকে অভিনন্দন্যান্ত্রিক সেই শীতল কণ্ঠ আবরারের ভাবলেশহীনতার চীনের প্রাচীরকে বিদীর্ণ করতে পারল না। 

৯. HellMyth Game-Level 3 (হেলমিথ গেম-লেভেল ৩)

কত বছর পর রমনা পার্কে এসেছেন, ঠিক অনুমান করতে পারলেন না সিআইডি প্রধান হাসান সাহেব। যৌবনকালে শুনতেন, রমনাকে নাকি ঢাকা শহরের ফুসফুস বলা হতো। 

কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞান মাদকসেবী, ছিন্নমূল মানুষ, ধান্দাবাজ, চোর-বাটপার আর দেহ ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্য হিসেবেই বরাবর রমনাকে দেখে এসেছে। 

আজকে এত ভোরে এখানে এসেছে অবশ্য আবরারের জোরাজুরিতেই। আজ করব, কাল করব করে করে ওয়ার্ক আউটটা কিছুতেই করা হয়ে উঠছিল না। 

কাজের চাপ বলে আত্মপ্রবঞ্চনায় নিজের ক্রমবর্ধমান উঁড়ির প্যারাবোলাকে আর নিজেকে সৌম্যদর্শন বলে সান্ত্বনা দিলেও আজ আর পারল না। 

আবার একেবারে বাসার নিচে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ফোনকল দিতে দিতে ঘুম ভাঙিয়েই ছাড়ল। 

পাখির চোখ দিয়ে দেখলে মনে হবে বটমূলে পাথুরে বসার জায়গার সামনে কোনো বাবা আর ছেলের জুটি শরীরচর্চা করছে। 

বুঝলে আবরার, প্রথমে তোমার উপর খুব রাগ হচ্ছিল। সকালের প্রিয় ঘুমটা ভাঙিয়ে এভাবে বাসার বাইরে বের করে নিয়ে আসলে কার না মেজাজ খারাপ হয়! 

কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এখন চমৎকার লাগছে। প্রেগন্যান্ট মহিলাদের মতোই দেখি আমার মুড সুইং হচ্ছে। 

বলতে বলতে ফিক করে হেসে দিলেন সিআইডি প্রধান। পোশাকি গাম্ভীর্যের আড়ালে যে তার এমন একটা প্রাঞ্চচঞ্চল রূপ আছে, ভুলেই গিয়েছিলেন। 

স্যার, আমারও আগে সারা সকাল ভরে ঘুমোনোর রোগ ছিল। এভাবে কত ক্লাস যে মিস করেছিলাম মেডিক্যাল লাইফে! একদিন রাতের বেলায় নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করলাম, নামাজ পড়ে, সূর্যোদয় দেখেই জগিং এ বের হব।

নিজেকে নিজে ধমক দিলে আমাদের দুষ্টু বডি ক্লকটাও বেশ লক্ষ্মী ছেলের মতো আচরণ করে। 

যাও, কাল থেকে প্রত্যেক দিন সকালবেলা তোমার সাথে বের হব। এত সুন্দর সকাল নিজের চোখে না দেখলে প্রকৃতিকেই অসম্মান করা হবে। 

কী জানো তো, ঢাকার যান্ত্রিকতার মাঝেও যে এত চমৎকার পাখির ডাক শুনতে পাওয়া যায়, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। 

দ্যাটস লাইক আ গুড বয়, স্যার!

পিতৃহীন আবরার প্রৌঢ়ত্বের শেষসীমা ছুঁই ছুঁই করা উধ্বতনকে এমনভাবে শাসনের স্বরে দিকনির্দেশিকা দিচ্ছে যে রাশভারী লোকটাকে কেন যেন খুব করে বাবা বলে ডাকতে ইচ্ছা করছে। 

আবরার, লেভেল থ্রিতে তো এখন পর্যন্ত দুটো কো-অর্ডিনেট পেয়েছ। এখন তুমি আর আমি একা আছি। কোডগুলো কীভাবে ডিকোড করলে, আমাকে বলো না প্লিজ। 

চোখ পাকিয়ে তাকাল আবরার, 

কিন্তু স্যার, বাকিদের রেখে একা আপনাকে বলেছি জানতে পারলে কিন্তু সবাই রাগ করবে। কথা ছিল, প্রত্যেকটা লেভেল শেষ করে যুদ্ধের পুরো কাহিনি আপনাদেরকে শোনাব। 

আহা, ওরা জানতেই পারবে না। শুধু তোমার আর আমার মাঝে থাকবে। পরে লেভেল শেষ হলে না হয় আবার শুনব। আমার আর তর সইছে না। বলোই না! 

সিআইডি প্রধানের গলায় অনুনয়ের সুর।

আচ্ছা ঠিক আছে, বলছি।

পার্কের বেঞ্চে হেলান দিয়ে আবরার বলে চলল, এবারের কু সমকামিতা নিয়ে।

কণ্ঠে শীতলতা প্রকাশ পেল হাসান সাহেবের, সমকামিতা! উমম…আমি যতখানি ফ্রয়েড পড়েছি, তাতে সমকামিতাকে তো স্বাভাবিকতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। সমকামিতার জন্য দায়ী জিনও নাকি আবিষ্কার করা হয়েছে। বিজ্ঞানী হাতুড়ি না কী যেন… 

গাম্ভীর্যপূর্ণ সমকামিতাবিষয়ক আলোচনার মধ্যেও ফিক করে হেসে ফেলল আবরার। 

স্যার, ওটা হাতুড়ি না, আমেরিকান বিজ্ঞানী ডিন হ্যামার।

ঐ আর কী! আমি খাঁটি দেশি মানুষ। ওসব হ্যামারট্যামার মনে থাকে না। আমার হাতুড়িই ভালো। তা যা বলছিলাম। 

তোমরা ডাক্তাররা অবশ্য ভালো বলতে পারবে। পত্রিকায় পড়েছিলাম, কিছু কিছু পুরুষের কত নম্বর জিনে যেন সমকামিতার জন্য দায়ী জিন খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা! 

আসলে ১৯৯৩ সালের দিকে এক গবেষণায় কয়েকজন সমকামী পুরুষের ১৩ এবং ১৪ নম্বর ক্রোমোসোমে নির্দিষ্ট মার্কার জিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। 

পরবর্তীতে ২০১৭ সালেও একটা জার্নালে এই ধারণাকে আবার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। 

তবে আরেক পক্ষের গবেষক গে জিন থাকার ব্যাপারটাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা যে প্রকৃতিবিরুদ্ধ-এতে সন্দেহ নেই। 

সমকামিতা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক যতই হোক না কেন, একটা ব্যাপার কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত। 

কী ব্যাপার? 

স্যার, দেখুন, সমকামিতা প্রাকৃতিক কি না, সেটা যেহেতু এখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাই গ্রহণযোগ্য কোনো কিছু আবিষ্কৃত হবার আগে একে প্রাকৃতিক অথবা অপ্রাকৃতিক বলার যোগ্যতা আমার নেই। 

কিন্তু এতটুকু আমি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত, এই ভিন্ন ধরনের ওরিয়েন্টেশনের জন্য সাংস্কৃতিক বিবর্তন এবং আর্থসামাজিক পরিবেশীয় প্রভাব অনেকাংশে দায়ী। 

মোর টু বি রিলেটেবল, এবার যেই ছেলেটা হেলমিথ গেমে ভিকটিম হতে চলেছে, তার জন্য আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট দায়ী। 

কী বলছ মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ঠিকঠাক বুঝিয়ে বলো।

উমম একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। চলুন আপনার যৌবনকালের সময় আর এখনকার তরুণ প্রজন্মের সময়কালের মধ্যে একটা তুলনা করা যাক। 

আপনাদের সময় প্রেমের মাঝে একটা শাশ্বত অনুভূতি কাজ করত। হয়তো ক্লাস শেষ হলে ফাঁকতালে একটু আড়চোখে দেখা, বাসায় ফিরে কাগজে সেই চাঁদমুখ নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কবিতা লেখা। প্রেয়সীকে চিঠি পাঠিয়ে তার উত্তরের জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করা। 

তাকে একনজর দেখতে কখনো কখনো তার মারকুটে দাদার চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রাণপণ ঝুঁকি নিয়ে তার এলাকায় একটু সাইকেল চালাতে যাওয়া। 

আশি-নব্বই দশকের হাজার যুবকের প্রেমের কাহিনি অনেকটা এমনই, তাই না? 

ভাবালুতায় ঢুলু ঢুলু চোখ দুটো নিয়ে যেন বছর তিরিশেক আগে হারিয়ে গিয়েছেন সিআইডি প্রধান। 

ঠিক তাই। কিন্তু এর সাথে সমকামিতার কী সম্পর্ক আছে বুঝলাম না। 

বলছি স্যার। আজকালকার যুগে প্রযুক্তির এত সহজলভ্য যে সামান্য চিঠির জন্য কাউকে আর দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় না। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপে মুহূর্তেরও কম সময়ে নিজের মনের কথা জানিয়ে দেওয়া, আবার সাথে সাথেই উত্তর পেয়ে যাওয়া কোথাও গিয়ে পুরোনো দিনের সেই উত্তাপ মিসিং। 

এখনই প্রিয় মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে? দিয়ে দাও ভিডিও কল। 

তা তো বটেই।

দুই যুগের ক্ষেত্রে কিন্তু সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রভাবের সাথে আমাদের মেডিক্যাল সায়েন্সও দায়ী। Agonist বলে মেডিক্যাল সায়েন্সে একটা টার্ম আছে। 

এটা একধরনের কেমিক্যাল, যেটা আমাদের শরীরের ভেতরে শাখা প্রশাখার মতো বিস্তার করা স্নায়ুতন্তুর রিসিপ্টরের সাথে যুক্ত হয়ে যেকোনো বায়োলজিক্যাল রেসপন্স ঘটায়। আমাদের হাসি-কান্না, আবেগ-অনুভূতি, প্রেম-কাম কিন্তু এই রেসপন্সেরই ইফেক্ট। 

এই যে না চাইতেই পেয়ে যাওয়া বা সার্বক্ষণিকভাবে আরাধ্য বস্তুর নাগাল পেয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের শরীরের ভেতরকার রিসিপ্টর নিজের সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলে। এটাকে ডিসেন্সিটাইজেশন অব রিসিপ্টর বলে। 

যারা অসম্ভব অর্থের মালিক, তাদের ক্ষেত্রে যেকোনো সূক্ষ্ম অনুভূতিরই ডিসেন্সিটাইজেশন ঘটার সম্ভাবনা প্রবল। 

অর্থের জোরে তারা যেকোনো কিছু পেয়ে যায়, যখন ইচ্ছে তখন। তখন স্বাভাবিক প্রেম-কামও তাদের চরম বিরক্তিকর মনে হয়। 

স্বাভাবিক হেঁটেরোসেক্সয়াল সঙ্গী বদল করতে করতেও তারা যখন বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন, তখন থ্রিসাম, অর্গি-এসব বিকৃতির পথে বায়োলজিক্যাল রেসপন্স খুঁজে চলেন। তাতেও সুখ না পেলে সমকামী সঙ্গীর খোঁজে পা বাড়ান। সব বুর্জোয়া-জমিদারদের ইতিহাস ঘাঁটলে যুগে যুগে আপনি এমন অনেক ঘটনাই পাবেন। 

একজ্যাক্টলি! যেমন হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুর আগে এ নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করে গিয়েছিলেন-ঘেটুপুত্র কমলা। যাহোক, জমিদারদের এই আচরণের পেছনে প্রাকৃতিক বা জিনগত ব্যাপার দায়ী নয় বলছ? 

অবশ্যই দায়ী নয়। পুরো ব্যাপারটাই আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক। তা না হলে কেনই-বা এ ধরনের কেস স্টাডিতে বিত্তের বিচারে অগ্রগণ্যদের এত প্রাধান্য থাকবে? 

কিন্তু সব বড়লোক, বুর্জোয়া, শিল্পপতিরা যে অমন তা-ও তো নয়। 

সব শিল্পপতি সমকামী নয় বটে, তবে সব সমকামীদের মাঝে সিংহভাগ দখল করে রাখে উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনোরঞ্জন করতে বাধ্য হয় একই সমাজে আর্থিক ব্যবধানে যোজন যোজন দূরে থাকা শ্রেণি। এবারের গেমটাও অনেকটা এমন। 

বুকের মাঝে আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে হাবিব সাহেব বললেন, 

তার মানে এবার তোমাকে এমনই একজন সমকামী সুপার রিচের হাত থেকে শিকারকে বাঁচাতে হবে? 

হ্যাঁ স্যার। 

আচ্ছা তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। যেই বাচ্চাটাকে লেভেল টু তে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলে, তার জন্য খুব ভালো এক নিঃসন্তান দম্পতিকে খুঁজে পেয়েছি। বাচ্চাটা খুব ভালো একটা জীবন পাবে, নিশ্চিত থাকতে পারো। 

আর সেই বৃদ্ধা মহিলাকেও খুব নিরাপদ একটা হোমে রাখা হয়েছে। আশা করা যায়, ওখানে উনি অনেক যত্নে থাকবেন। সত্যি আবরার, তুমি অনেক বড় মনের মানুষ। 

স্যার, আপনি বিশেষভাবে সাহায্য না করলে দুটো জীবনকে এত সুন্দরভাবে নিশ্চিত নির্ভাবনার আশ্রয় খুঁজে দিতে পারতাম না। স্পেশাল থ্যাংকস টু ইউ। 

তোমার কো-অর্ডিনেটের কাহিনিই তো শুনলাম না! আটটা বেজে যাচ্ছে, তোমার না আবার কলেজে লেকচার দিতে যেতে হবে? 

জি স্যার। মেন্টাল হেলথ ইনস্টিটিউশনে একটা ওয়ার্কশপ আছে। 

তাহলে আর দেরি কেন? বলে ফেলো।

তাড়া দেবার ভঙ্গিতে বললেন সিআইডি প্রধান।

স্যার, প্রথম কো-অর্ডিনেটটা পাই এ মাসের শুরুতেই। একটা নার্সারি। থেকে কে বা কারা ফুলের তোড়ার সাথে ছোট একটা প্যাকেট দিয়ে যায়। প্যাকেটের ভেতর এক গুচ্ছ কচুরিপানা, এক থোকা পাতা আর মঞ্জরিদণ্ডের সাথে অর্কিডের মতো দেখতে ১০-১২ দৃষ্টিনন্দন ফুল। 

কচুরিপানা! আর ইউ কিডিং মিঃ। 

ইয়েস স্যার! আই আম নট কিডিং অ্যাট অল। আর ফুলের তোড়ার সাথে গোজা ছোট কাগজে নার্সারির ঠিকানা-Block #E, Basndhara R/A, Dhaka-1229। 

কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এর থেকে গ্রিক মিথের সম্পর্ক কীভাবে খুঁজে বের করলে?

খালি চোখে দেখলে আর সাধারণভাবে ভাবলে সত্যি কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই প্রথম থেকেই চেষ্টা করেছি একটু অন্য রকমভাবে ভাবতে। কচুরিপানা থেকে প্রথমে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পারলেও কাগজে লেখা ঠিকানা কিন্তু স্পষ্ট একটা ইঙ্গিত দেয়। ঐ নার্সারি ছাড়াও বসুন্ধরা রেসিডেনসিয়াল এরিয়ার ব্লক ই-তে কিন্তু এক বিশাল হসপিটাল অবস্থিত। 

আই গেট ইট। এভারকেয়ার হসপিটাল। কিন্তু এর সাথে গ্রিক মিথোলজির কী সম্পর্ক? 

স্যার, আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন, ২০২০ সালের দিকে অ্যাপোলো হসপিটালের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় এভারকেয়ার। 

Evercare এবং CDC গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির অর্থায়নে দীর্ঘদিন অ্যাপোলো নামে পরিচিত হবার পর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় ব্র্যান্ড নেম এভেরকেয়ার-এ ফিরে আসার। 

হাসান সাহেবের অতর্কিত মস্তিষ্ক তখন কোষে সঞ্চিত জ্ঞানের সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছে আবরারের ভেদ করা কোডের। 

তার মানে গ্রিক চরিত্র অ্যাপোলো। কিন্তু কচুরিপানা দিয়ে ওরা কী ইন্ডিকেট করেছে? 

স্যার, কচুরিপানার ইংরেজি হলো হায়াসিন্থ (Hyacinth)। গ্রিক মিথোলজিতে অ্যাপোলো এবং হায়াসিন্থের সমকামিতা নিয়ে অদ্ভুত একটা গল্প আছে। 

আমি তো হায়াসিন্থ বলতে নীল রঙের লিলি ফুল জানতাম। 

স্যার, আপনি যেকোনো অথেনটিক সোর্স চেক করে দেখতে পারেন। ওয়াটার হায়াসিন্থ বলতে কচুরিপানাকে বোঝায়। 

গ্রিক মিথের সেই গল্পটা কী? আর ফাস্ট কো-অর্ডিনেট ব্রেক করার পর ওদের পাঠানো ভিডিওটাতে কী দেখানো হয়েছে? 

বলছি। গ্রিক মিথোলজি অনুযায়ী, হায়াসিন্থ ছিলেন অসম্ভব সুদর্শন এক তরুণ। সুর আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের দেবতা অ্যাপোলো দেখামাত্র প্রেমে পড়েন হায়াসিন্থের। 

নিজের মন্দির ছেড়ে, নাওয়া-খাওয়া ভুলে, সুর ভুলে তিনি সারাক্ষণ হায়াসিন্থকে নিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন। 

হায়াসিন্থের সাবেক সঙ্গী ঈর্ষার দহনে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যেতে লাগলেন। একদিন সুযোগ বুঝে খেলাচ্ছলে এক চাকতি দিয়ে হায়াসিন্থের প্রাণনাশ করলেন তিনি। ঠিক যেন এখনকার যুগের বাংলা সিনেমার মতো-তুই আমার না হলে তোকে কারও হতে দেব না। 

কী আশ্চর্য! এরপর ভিডিওতে কী দেখলে?

ওদের পাঠানো এবারের ভিডিওটা ছিল চল্লিশ সেকেন্ডের। স্যাডলি, প্রভাবশালী লোকটি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য বা কোনো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক-এসব সম্পর্কে কোনো কিছু রিভিল করা হয়নি। তবে ভিডিও শেষে সত্যিকারের ভিকটিম যে হতে যাচ্ছিল, তার ছবি দেখানো হয়েছে। অসম্ভব সুদর্শন, স্বীকার করতেই হবে।

ডামি ভিডিওতে হায়াসিন্থকে সম্ভবত এক কাশ্মীরি মডেল দিয়ে পোর্ট্রেট করা হয়েছে। এখানে দেখানো হয়, ভয়ংকর প্রভাবশালী এক লোক অসম্ভব সুদর্শন কলেজ পড়ুয়া এক যুবকের সাথে সমকামী সম্পর্কে লিপ্ত। 

যুবকটি অসম্ভব দরিদ্র ঘরের হওয়ায় বিষমকামী হয়েও টাকার লোভে এই সম্পর্কে জড়ায়। 

এক মডেলিং কোম্পানির অফার পাওয়ায় এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে সেই প্রভাবশালী লোকটি হাসিমুখে মেনে নেয়। কিন্তু যুবকটি বেরিয়ে যেতেই বিড়বিড় করে বলে ওঠে, তোকে এর জন্য জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হবে। 

কোনো এক বৃদ্ধের বুক চেরা দীর্ঘশ্বাসের মতো সকরুণ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সিআইডি প্রধানের মুখ থেকে। 

কী ভয়ংকর! তৃতীয় আর চতুর্থ কো-অর্ডিনেট তো এখনো পাওনি, তাই না?

না স্যার। তবে আশা করি, খুব শীঘ্রই পেয়ে যাব।

তোমার অনেকটা দেরি করিয়ে দিলাম। চলো, এবার যাওয়া যাক।

জগিং থেকে বাসায় ফিরে তৈরি হয়ে প্রথমে ওয়ার্কশপে, তারপর মেডিকেলে লেকচার দিতে গেল আবরার। মাসের মাঝামাঝি হওয়ায় ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি মন্দ নয়। ক্লাস শেষ করে সিআইডি অফিসের উদ্দেশে বের হলো, একটা নতুন ফ্রড কেসে ল্যাব স্পেসিম্যান নিয়ে বসতে হবে।

মেডিকেলের গেটের বাইরে বের হতেই বৃদ্ধা এক ভদ্রমহিলার ডাকে ফিরে তাকাল। 

বাপজান! মেডিক্যাল তুন রিপোর্ট দিসে। রিপোর্টটা একটু দেইখা দিবেন? আমার সোয়ামির বড়ই অসুখ। 

সহানুভূতির সাথে বৃদ্ধার হাত থেকে রিপোর্ট নিয়ে চোখ বোলাল। আবরার। প্যাথলজিক্যাল টেস্টে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, 

Result : Hepatotropic Virus Induced Liver Injury 

ভাইরাল ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়েছে লিভারজুড়ে। মুখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল-কোথায় বৃদ্ধা কোথায় তার স্বামী! হাতে রিপোর্ট ধরিয়ে দিয়ে পগার পার। ভয়ে ভয়ে টেস্ট রিপোর্টের দিকে তাকাল আবরার।

হ্যাঁ, এই মেডিক্যালেরই প্যাথলজিক্যাল টেস্টের রিপোর্ট। শ্বাপদের দৃষ্টিতে কাগজটাকে উল্টাতেই দেখতে পেল কাগজের ঠিক নিচে গেমের লোগো।

নিজেকে সামলে নিলো আবরার। তার মানে ঐ বৃদ্ধা মহিলার হাত দিয়ে কেবলমাত্র আবরারের জন্যই প্যাথলজিক্যাল টেস্টের রিপোর্টের আকারে কো-অর্ডিনেট পাঠানো হয়েছে। 

স্বামীর অসুস্থতার ব্যাপারটা পুরোপুরি বানানো। গাড়িতে সিআইডি অফিসে যাবার পথে সামান্য ক্লর আশায় রিপোর্টের একটা সামান্য অক্ষরও আবরারের নজর এড়াল না। নাহ, কিছুতেই কোনো ক্ল পাচ্ছে না। 

শেষ লাইনটা নিয়ে বসলো এবার। Hepatotropic Virus Induced Liver Injury-কেন যেন আবরারের মনে হলো, এই লাইনের মাঝেই লুকিয়ে আছে হত্যাপদ্ধতি। আচ্ছা, প্রত্যেকটা শব্দের প্রথম অক্ষর নিয়ে কোনো অর্থপূর্ণ কু তৈরি করা হয়নি তো! 

Hepatotropic=H

Virus=V

Induced=I

Liver=L

Injury=I 

H, V, 1, L, I-ছয়টি অক্ষর থেকে নানাভাবে বিন্যাস সমাবেশ করে অর্থপূর্ণ শব্দ বের করার চেষ্টা করতে লাগল। 

হঠাৎ করে মৎস্যগন্ধা সমুদ্রের তলায় পড়ে থাকা টাইটানিকের আবিষ্কৃত ভগ্নাবশেষের মতো হুট করেই মস্তিষ্কের কোনো তলানিতে পড়ে থাকা কোষ থেকে একটা সম্ভাব্যতার কথা উঁকি দিতে লাগল। 

সমকামিতা…..HIV…..বায়োলজিক্যাল উইপন! 

আর্কিমিডিসের মতো নগ্নাবস্থায় ইউরেকা বলার সুযোগ না থাকলেও আবরারের আত্মবিশ্বাস তাকে জানান দিয়ে গেল-এবার কৃত্রিম উপায়ে ভিকটিমের শরীরে HIV ভাইরাস প্রবেশ করিয়ে এইডসে আক্রান্ত করার মাধ্যমে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এখন অপেক্ষা শুধুমাত্র চতুর্থ কো-অর্ডিনেটের। 

***

৩১ জানুয়ারি, ২০২২,
রাত আটটা।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ 

দেখুন, আপনার একার জন্য আমাদের কোনো পেশেন্টের প্রাইভেসি আমরা নষ্ট করতে পারি না।

স্ক্রিনশট থেকে নেওয়া ছবিটা দেখিয়ে বারবার ছবির যুবকটি সন্ধানীতে নিয়মিত রক্তদাতা কি না, জিজ্ঞেস করতে নার্সের থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত সোজা আঙুল বাঁকা করতেই হলো আবরারকে। নিজের আইডি কার্ড বের করল, 

দেখুন, এই লোকটার লাইফ রিস্কে আছে। এই মুহূর্তে আপনি যদি আমাকে না বলেন যে উনি কোথায় আছেন, সিআইডির পক্ষ থেকে আমি অ্যাকশন নিতে বাধ্য হব। 

এবার কাজ হলো। একজন স্টাফ আবরারকে ভেতরে নিয়ে গেল। ভিডিও শেষে দেখানো সামান্য ছবির ভিত্তিতে ভীতসন্ত্রস্ত চোখে একটি মুখই খুঁজে বেড়াতে লাগল আবরারের চোখ। 

ঐ তো, হা ঐ তো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে একটা মুখ। একেই তো দেখতে পেয়েছিল ভিডিও শেষে। নার্সের দিকে বাঁ হাত বাড়িয়ে আধশোয়া ভঙ্গিতে রক্তদানের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে আছে ছেলেটি।

এখনো ছেলেটির নাম জানে না আবরার। সন্ধ্যা ছয়টার সময় চতুর্থ কোড ডিকোড করেই ছুটে এসেছে লেভেল থ্রির ভেন্যু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, সন্ধানীর সামনে।

নার্সের হাতে ভ্যাকুটেইনার, যেটা সংযুক্ত হয়ে আছে সিরিঞ্জ এবং হাইপোডার্মিক সুচের সাথে। যেনতেন সুচ নয়। HIV দ্বারা সংক্রমিত সুচ। সুচটা এখনই এগিয়ে যাবে অসম্ভব সুদর্শন ছেলেটার শিরার দিকে। 

পা টিপে টিপে নার্সের পাশে গিয়ে শক্ত করে ধরে ফেলল তার হাত। আব্রারের চোখের দৃষ্টির শীতলতায় জমে গেল রক্ত সংগ্রহ করতে আসা নার্স। মুঠো আলগা হয়ে যাওয়া হাত থেকে গড়িয়ে পড়ল সর্বনাশা সুচ। আংটির ভেতর থেকে যান্ত্রিক সেই চেনা কণ্ঠ বলে উঠল, 

লেভেল থ্রি-তে উত্তীর্ণ হবার জন্য আপনাকে অভিনন্দন। 

অবশ্য আপাতভাবে বিজয়ী হলেও আবরার যে আসলে জিততে পারেনি, তা জানতে পারল দুদিন পর। সুপ্ত নামের অসম্ভব সুদর্শন কলেজপড়ুয়া ছেলেটিকে তার জীবননাশের চেষ্টার কথা খুলে বলে সর্বতোভাবে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিল আবরার। 

নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পাশে থাকবে বলে কথা দিয়েছিল। তবু লাভ হয়নি। নিজে বিষমকামী হয়েও সেই পুঁজিপতির কাছেই ফিরে গেছে শেষ পর্যন্ত। হয়তো বিদ্রোহ করার সাহস হাইড্রার মতো ফুঁসে উঠতে উঠতে মিইয়ে গেছে।

বা কে বলতে পারে, হয়তো স্বপ্নই মরে গেছে। আর স্বপ্নের মৃত্যু মানে যে প্রগলভ একটি কচি প্রাণের কক্ষচ্যুত উপগ্রহের মতো যতিচিহ্নহীন পরিভ্রমণ, তা কে না জানে! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *