গোটা জ্যৈষ্ঠ্যমাসে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয় নি।
বৃষ্টি-বাদলা না হলে জ্বরজারি হয় না। রুগীপত্র নেই, আমিন ডাক্তার মহা বিপদে পড়ে গেল। হাত একেবারে খালি। চৌধুরীবাড়িতে ত্রিশ টাকা কর্জ হয়েছে। গত বিশ দিনে রুগী এসেছে মাত্র একটি। সুখানপুকুরের অছিমুদ্দিনের মেজ ছেলে। ভিজিটের টাকা দূরে থাক, ওষুধের দামটা পর্যন্ত পাওয়া গেল না। অজিমুদ্দিন নিমতলির পীর সাহেবের নামে কিরা কেটেছে হাটবার দিন সকালবেলা এসে দিয়ে যাবে। নিমতলির পীর জ্যান্ত পীর। তার নাম নিয়ে টালবাহানা করা যায় না। কিন্তু অজিমুদ্দিন লোকটি মহা ধুরন্ধর। আজ নিয়ে তিন হাট গেল, তার দেখা নেই।
আমিন ডাক্তার শুকনো মুখে সারা হাট খুঁজে বেড়ায়। হাটের দিন চাষাভূষাের মত থাকা যায় না। দশ গ্রামের লোকজন আসে। নতুন মানুষদের সঙ্গে আলাপপরিচয় হয়। কাজেই হাটবারগুলিতে আমিন ডাক্তার একটু বিশেষ সাজসজ্জা করে। আজকে দেখা গেল আমিন ডাক্তারের গায়ে এই গরমেও একটি লাল কোট। হাতে ডাক্তারী ব্যাগটা কায়দা করে ধরা। ব্যাগটিতে ইংরেজি লেখা–
ডক্টর এ রহমান
প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার
আমিন ডাক্তারের চোখে নিকেলের চশমা। লোকজন ঠাহর হয় না। বারবার দেখতে হয়। অজিমুদ্দিনের মেছোহাটায় থাকার কথা। সেখানে পাওয়া গেল সিরাজুল ইসলামকে। সিরাজুল ইসলাম নিমতলির ডাক্তার। সমগ্র ভাটি অঞ্চলে তার নামী ডাক্তার হিসেবে খ্যাতি। লোকটি ছোটখাট, টেনে টেনে অত্যন্ত কায়দা করে কথা বলে। সিরাজুল ইসলাম আমিন ডাক্তারকে দেখামাত্র একগাল হেসে বলল, এই গরমের মধ্যে এমন কোট। সগিমি হয়ে মরবেন, বুঝলেন?
আমিন ডাক্তার হাটের দিনগুলিতে যথাসম্ভব শহুরে কথা বলতে চেষ্টা করে। চারদিকে লোকজন আছে। ডাক্তার শহুরে কথা বললে এরা খুব সমীহ করে।
শরীরটা খারাপ, জ্বরজ্বর ভাব। ইনফ্লুয়েঞ্জা হবে, এই জন্যেই গরম কাপড় পরলাম।
চশমা নতুন নিলেন নাকি?
হুঁ।
সিরাজুল ইসলাম খিলখিল করে হাসতে লাগল। এর মধ্যে হাসির কী আছে, আমিন ডাক্তার বুঝতে পারল না।
হাসেন কেন?
হাসি আসলে হাসব না? বলছেন ইনফ্লুয়েঞ্জা। এই সময় ইনফ্লুয়েঞ্জা হবে কীভাবে? আরে এখনো ইনফ্লুয়েঞ্জাই চিনলেন না, ডাক্তারী করেন কীভাবে? হা হ্যাঁ। হ্যাঁ। যেমন দেশ তেমন ডাক্তার।
সিরাজুল ইসলামের হাসির শব্দে লোক জমে গেল। আমিন ডাক্তার চট করে সরে পড়ল। মেছোহাটায় অজিমুদ্দিকে পাওয়া গেল না, অথচ তার এখানেই থাকার কথা। কারণ ছাড়া এক জায়গায় ঘোরাঘুরি করা যায় না। আমিন ডাক্তার এক প্রকাও রুই মাছ দাম করে ফেলল। গম্ভীর গলায় বলল, মাছ কত রে?
মাছ বিক্রি করছিল নিমতলির জলিল। সে দাম না বলে মাছ গেঁথে ফেলল।
আপনের সাথে দূর-দাম কি ডাক্তার সাব? যা হয় দিবেন।
আরে ইয়ে, এত বড় মাছ। দামটাম কি বল শুনি।
হুনাহুনির কিছু নাই। বড় গাঙ্গের মাছ-এর সুআদই আলাদা।
আমিন ডাক্তার পড়ে গেল মহা বিপদে। বহু কষ্ট্রে মুখের হাসি বজায় রেখে বলল, মুসিবত হয়ে গেল দেখি। টাকা তো আনতে মনে নেই। কি যেন বলে, ভুলে বোধহয় বাড়িতে ফালাইয়া অসছি।
মুছিবত কিছু না ডাক্তার সাব, টেকা আপনে পরের হাটে দিয়েন।
আমিন ডাক্তার মাছ হাতে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইল। এক বার মনে হল অজিমুদ্দিনের মতো দেখতে কে যেন হুট করে তরকারিহাটার দিকে চলে গেল। এত প্রকাও একটা মাছ হাতে নিয়ে অছিমুদ্দিনকে খুঁজে বের করার আর উৎসাহ রইল না। মাছ কেনাটা অবশ্য পুরোপুরি বৃথা গেল না। সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় দেখা হয়ে গেল।
মাছটা কিনলেন নাকি ডাক্তার সাব? তা কিনলাম।
হুঁ, রোজগারপাতি ভালেই মনে হয়?
আমিন ডাক্তার যথাসাধ্য গম্ভীর হয়ে বলল, পাই কিছু। না পাইলে কি আর ভাটি অঞ্চলে পইড়া থাকি?
সিরাজুল ইসলাম শুকনো মুখে চুপ করে যায়। আমিন ডাক্তার হৃষ্ট চিত্তে সারা হাটে দুটি চক্কর দেয়। হাতে যে একটা পয়সা নেই, চৌধুরীদের কাছে ত্ৰিশ টাকা কৰ্জ–সেই সব আর মনে থাকে না। মুখের উপর অতিরিক্ত একটা গাম্ভীর্য টেনে আনে। পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে গম্ভীর হয়ে বলে, কি, ভালো?
কেডা, ডাক্তার সাব না?
হুঁ। ছিলাম না অনেক দিন। নিখল সাব ডাক্তারের কাছে ছিলাম। নতুন চিকিৎসাপাতি শিখলাম। সাহেব খুব স্নেহ করতেন আমাকে। ডাক্তার ডাক্তারের মর্যাদা বুঝে তো। অশিক্ষিত মূর্খ তো নয়, কী বল?
গো-হাটার কাছে দেখা হল মতি মিয়ার সঙ্গে। মতি মিয়ার কেমন যেন দিশাহারা ভাব। এত বড়ো একটা মাছ আমিন ডাক্তারের হাতে, তা মতি মিয়ার চোখেই পড়ল না।
ডাক্তার, তোমার সাথে একটা জরুরী আলাপ আছে।
আমিন ডাক্তার ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলল, তোমার কাছে সাড়ে পাঁচ টাকা পাই মতি। টাকার আমার বিশেষ দরকার।
তোমারে কখন থাইক্যা খুঁজছি। আছিলা কই?
বুঝলা মতি, অযুদের জন্যে তিন টাকা আর তোমার……
কথা শেষ হবার আগেই মতি মিয়া আমিন ডাক্তারকে টেনে এক পাশে নিয়ে আসে। গলার স্বর দ ধাপ নিচে নেমে যায়। বিষয়টি সত্যি জরুরী। রূপকুমারী যাত্ৰা-পার্টির অধিকারী খবর পাঠিয়েছে, মতি মিয়া যদি বিবেকের পাঠ করতে চায় তাহলে যেন অতি অবশ্যি মোহনগঞ্জ চলে আসে। আগের বিবেক চাকরি ছেড়ে চলে গেছে বলেই এই সুযোগ।
বুঝলা ডাক্তার, বিবেকের পাঠে মোট দশ খান গান।
আমিন ডাক্তার অবাক হয়ে বলল, আমারে কী জন্যে দরকার, সেইটা তো মতি ভাই বুঝলাম না।
শরিফারে একটু বুঝাইয়া কইবা। তোমারে খুব মানে।
তুমি নিজেই কও।
আমি কই ক্যামনে? আমার সাথে তো কথাই কয় না।
আবার হইল কী?
মতি মিয়া ইতস্তত করে বলল, রহিমাবে বিয়া করবাম, হেইটা শুনার পরে ঝামেলা।
আমিন ডাক্তার আকাশ থেকে পড়ল, রহিমারে সাদি করবা? এই কথা তো আগে কও নাই।
মজাক কইরা কইছি। হাসি-তামশার কথা।
তুমি লোকটা অদ্ভুত মতি ভাই।
মতি মিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, অদ্ভুতের কী দেখলা? অন্যায়টা কী কইছি? আমার বাড়িত সারা জীবনের লাগি থাকব। বৌ হইয়া থাকনটা বালা না?
আমিন ডাক্তার চুপ করে রইল। মতি মিয়া ইতস্তত করে বলল, রহিমা রাজি আছে কিনা হেইডাও তুমি একটু জাইন্যা দিবা, বুঝছ?
কী-সব কথা যে তুমি কও, মতি ভাই!
মতি মিয়া ভ্রূ কুঁচকে বলল, আইজ রাইতেই আইবা, ঠিক তো?
দেখি।
দেখাদেখির কিছুই নাই, আইবা আইজ।
আইচ্ছা।
মাছটা কিনলা নাকি ডাক্তার বিষয় কী?
বিষয় কিছুনা, মাছটা লইয়া যাও। দোস্তাইনরে কইও রাইতে তোমরার সাথে ভাত খাইয়াম।
অত বড়ো মাছ কিনা, তোমার হনছি টোপয়সা কিছুই নাই।
আমিন ডাক্তার একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। আগামী হাটবারে টাকার কী হবে কে জানে?
বাড়ি ফিরতে দেরি হল। মতি মিয়া জোর করে একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। এক আনা করে কাপ। সেই সঙ্গে দুই পয়সা করে একটা টো বিস্কুট।
দোকানের চায়ের সুদই আলাদা, কী কও ডাক্তার?
হুঁ।
আরেক কাপ খাইবা?
নাহ্।
আরে খাও। এই, আরো দুইটা দে।
চায়ে চুমুক দিয়ে মতি মিয়া অস্বাভাবিক নিচু স্বরে বলল, বাজারে তিনটা মাইয়া আইছে, দেখছ? হাটবার দেইখ্যা আইছে, রঙ্গ-তামাশা করছে।
আমিন ডাক্তার অবাক হয়ে তাকাল।
মতি মিয়া বলল, বাজারে মেয়েমানুষ ছাড়া কি হাট জমে, কও দেহি? এর মইধ্যে একটার নাম ফুলন। কাঁচা হলদির লাহান গায়ের চামড়া। আর চুল কী!
তুমি অত কিছু জানলা ক্যামনে? আহু, দেখলাম। দূর থাইক্যা দেখলাম। তুমি কি ভাবছ, গেছিলাম? মালুদে এলাহী।
চা গলায় লেগে মতি মিয়া বিষম খেল।
মেয়ে তিনটি নৌকা নিয়ে এসেছে। সেজেগুজে নৌকার সামনে বসে আছে দু জন। আমিন ডাক্তার অবাক হয়ে দেখল, একটি মেয়ে সত্যি অপূর্ব। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে দেবীপ্রতিমার মতো লাগছে। মতি মিয়া আমিন ডাক্তারের হাতে একটি মৃদু চাপ দিয়ে বলল, উখ ট্যারা হইয়া যায়, কী কও ডাক্তার? ফুলনের আরেকটা নাম হইল গিয়া তোমার পরীবানু।
তুমি জানলা ক্যামনে?
হুনছি। হুনা কথা।
উত্তর বলে নেমে মতি মিয়া গুনগুন করে গান ধরল,
ও কইন্যা সোনার কন্যা রে
ও কইন্যা রূপের কন্যা রে
…. … … … …
মতি মিয়ার গলা ভালো, আমিন ডাক্তারের মনটা উদাস হয়ে গেল।