খোকনের ছোটচাচা আমিন সাহেব ঢাকা এয়ারপোর্ট এসে পৌঁছলেন বিকেল তিনটায়। চারদিক কেমন থমথম করছে। প্রচুর পুলিশ। এয়ারপোর্ট থেকে কেউ বেরুতে পারছে না।
আমিন সাহেবকে নেওয়ার জন্যে কেউ আসেনি। রাস্তাঘাট ফাঁকা। পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। কাস্টমসের একজন অফিসার বললেন, শহরে কার্ফু জারি হয়েছে। তবে আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আপনাদের পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন।
আমিন সাহেব দুঘন্টা অপেক্ষা করলেন। কোনো ব্যবস্থা হলো না। খোকনের ছোটচাচি রাহেলা খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। কারণ প্রিসিলার হঠাৎ শরীর খারাপ করেছে। দুবার বমি হয়েছে। জ্বর আসছে মনে হয়। ওকে ডাক্তার দেখানো উচিত। রাহেলা বললেন, এখন আমরা কী করব? সারা রাত এয়ারপোর্টে বসে থাকব নাকি?
অন্যরা যদি বসে থাকে আমরাও থাকব।
এ আবার কী ধরনের কথা? লোকজনদের সঙ্গে কথাটথা বলে দেখো কিছু করা যায় কি না।
আমিন সাহেব দুএক জায়গায় টেলিফোন করতে চেষ্টা করলেন। কোনো লাভ হলো না। লাইন নষ্ট বা কিছু একটা হয়েছে।
এয়ারপোর্টে বেশ কিছু লোক আটকা পড়েছে। একটি আমেরিকান ফ্যামিলিকে দেখা গেল খুব চিন্তিত। ভদ্রলোকের নাম পিটার কল। তিনি যেচে এসে আমিন সাহেবের সঙ্গে কথা বললেন, তোমাদের শহরের অবস্থা তো ভয়াবহ মনে হচ্ছে।
হুঁ।
আন্দোলন হচ্ছে শুনেছিলাম, এতটা বুঝতে পারিনি।
নরওয়ে থেকে এক ভদ্রমহিলা এসেছেন, তিনি শহরে ঢুকতে চান না। পর ফ্লাইটে নরওয়ে চলে যেতে চান। ইংল্যান্ডের দুটি পরিবার আছে। ওদের সঙ্গে তিনটি ছেলেমেয়ে। ছেলেমেয়েগুলি সমস্ত এয়ারপোর্ট জুড়ে ছোটাছুটি করছে। বাচ্চাগুলির মাকেও মনে হলো বেশ হাসিখুশি। খুট খুট করে ছবি তুলছে।
আমিন সাহেব ফিরে এসে দেখলেন প্রিসিলা আবার বমি করছে। তার গায়ে বেশ জ্বর।
কিরে প্রিসিলা, খারাপ লাগছে?
নো, আই অ্যাম জাস্ট ফাইন।
রাহেলা বললেন, কিছু ব্যবস্থা করতে পারলে না?
না। অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। জায়গায় জায়গায় মশাল মিছিল বের করছে। কেউ কার্টু মানছে না। গুলিটুলিও হচ্ছে বোধহয়, শব্দ শুনলাম।
এখন আমরা কী করব?
বসে থাকো।
তোমাকে কতবার বলেছি দেশে ফেরার দরকার নেই। শুনবে না।
গণ্ডগোল হচ্ছে বলে নিজের দেশে ফিরব না?
এইরকম দেশে ফিরে লাভটা কী?
আমিন সাহেব প্রিসিলাকে কোলে নিয়ে বসলেন। প্রিসিলা রিনরিনে গলায় ইংরেজিতে বলল, গণ্ডগোল হচ্ছে কেন?
গণ্ডগোল হচ্ছে কারণ আমরা বাঙালিরা বলছি, আমরা মানুষের মতো বাঁচতে চাই। পাকিস্তানিরা মানছে না। ওদের ধারণা, আমরা মানুষ না।
রাহেলা বিরক্ত মুখে বললেন, থাক, রাজনৈতিক বক্তৃতা মেয়েকে না শোনালেও হবে।
না শোনালে হবে না। এরা আন্দোলনের মধ্যে বড় হবে। এদের জানা দরকার এসব কী জন্যে হচ্ছে।
এখন না জানলেও হবে। এখন দয়া করে চুপ করে থাকো।
আমিন সাহেব চুপ করে গেলেন। প্রিসিলা বলল, এরকম ঝামেলা কতদিন চলবে?
বলা মুশকিল। অনেকদিন ধরে চলতে পারে। তবে শুরু যখন হয়েছে তখন একদিন একদিন শেষ হবে। শুরু হওয়াটাই শক্ত।
তোমার কথা বুঝতে পারছি না বাবা। ইংরেজিতে বলো।
আমিন সাহেব ইংরেজিতে বললেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, এখন থেকে তোমাকে বাংলায় কথা বলা শিখতে হবে মা। ভালো করে বাংলা শিখে নাও।
হোয়াই ডেডি?
কারণ তুমি বাঙালি মেয়ে, সেইজন্যে।
রাহেলা বিরক্ত হয়ে বললেন, বাংলায় কথা বলা শিখতে হবে না। তুমি কথাবার্তা ইংরেজিতে বলবে। নয়তো ইংরেজি ভুলে যাবে।
রাত আটটার দিকে একটা মাইক্রোবাস পাওয়া গেল যেটা বিদেশীদের হোটেলে পোছে দেবে। আটকেপড়া বাঙালিদের সম্পর্কে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আমিন সাহেব কথা বলতে গেলেন ওদের সঙ্গে। একজন পাকিস্তানি মিলিটারি অফিসারের দায়িত্বে বাসটি যাবে। আমিন সাহেবকে মিলিটারি অফিসারটি শান্তভাবে বলল, ব্যবস্থাটি ফরেনারদের জন্যে।
কিন্তু আমার মেয়েটি অসুস্থ।
অসুখ হোক আর যাই হোক, আমার কিছু করার নেই। এই অবস্থার জন্যে দায়ী আপনারা বাঙালিরা। এর ফল ভোগ করতে হবে আপনাদের।
আচ্ছ, আমাদের না হয় কোনো একটা হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিন।
একবার তো বলেছি এটা সম্ভব নয়।
কিন্তু আপনারা বিদেশীদের জন্যে তো করছেন।
হ্যাঁ, ওরা আমাদের অতিথি।
আমার মেয়েটিও বিদেশী। ওর জন্য আমেরিকায়। ও জন্মসূত্রে আমেরিকান। ওর আমেরিকান পাসপোর্ট আছে।
আপনি আমাকে যথেষ্ট বিরক্ত করেছেন। আর করবেন না।
আমিন সাহেব গম্ভীর মুখে ফিরে এসে দেখেন প্রিসিলাকে একটা টেবিলে শোয়ানো হয়েছে। একজন রোগামতো ভদ্রলোক তাকে পরীক্ষা করছেন। রাহেলা বলল, উনি একজন ডাক্তার।
ডাক্তার সাহেব বললেন, কী হয়েছে ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে বমিটা বন্ধ করা দরকার। মুশকিল হয়েছে আমার সঙ্গে কোনো ওষুধপত্র নেই। আমিও আপনাদের মতোই আটকা পড়েছি।
ডাক্তার সাহেব থাকতে থাকতেই প্রিসিলা আরও দুবার বমি করল। ডাক্তার সাহেব বললেন, ওকে হাসপাতালে ট্রান্সফার করা দরকার। আসুন, দেখা যাক একটা অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় কি না।
কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করা গেল না। রাহেলা কাঁদতে লাগলেন। বেশ কয়েকবার বললেন, এইজন্যেই দেশে আসতে চাইনি। তবু আসতে হবে। কী আছে এই দেশে?
আমিন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, প্রিসিলা মা, তুমি কেমন আছ?
ভালো। জাস্ট ফাইন।
ভোর হলেই আমরা তোমার দাদুমণির বাড়ি চলে যাব।
ভোর হতে কত দেরি?
বেশি দেরি নেই।
ডাক্তার সাহেব প্রিসিলার কাছেই বসে রইলেন। তারা সবাই অপেক্ষা ক লাগলেন ভোরের জন্যে।