০৫. খেলা ও কল্পনা

পঞ্চম অধ্যায় খেলা ও কল্পনা

কি মনুষ্য, কি কি মনুষ্যেতর প্রাণী সকলের সন্তানই খেলা ভালোবাসে। মানব শিশুরা খেলার ভিতর দিয়া নানারূপ ভান করিয়া অপরিসীম আনন্দ উপভোগ করে। খেলা এবং তাহার ভিতর দিয়া নানা কাজের ভান শিশুর সুখ ও স্বাস্থ্যের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়, এইরূপ খেলার অন্য কোনো উপকারিতার কথা চিন্তা না করিলেও শুধু শিশুর স্বাভাবিক এবং সুস্থভাবে বৃদ্ধির জন্যও ইহা প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে দুইটি বিষয় চিন্তা করিবার আছে : প্রথম, শিশুর খেলার সুযোগদানের জন্য পিতামাতা এবং স্কুল কি করিবেন? দ্বিতীয়, খেলার শিক্ষাসম্বন্ধীয় উপকারিতা বৃদ্ধি করিবার জন্য তাহাদিগকে কি আরও বেশি কিছু করিতে হইবে?

সূচনায় খেলার মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। কার্ল গ্রুস এ সম্বন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করিয়াছেন; পূর্ব অধ্যায়ে উইলিয়াম স্টার্নের যে পুস্তকের কথা উল্লিখিত হইয়াছে তাহাতে কিছু সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা আছে। এ বিষয়ে দুইটি পৃথক প্রশ্ন আছে প্রথমটি, খেলার মূল উৎস কি, সে সম্পর্কে; দ্বিতীয়টি খেলার দৈহিক বা জৈবিক উপযোগিতা সম্পর্কে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি সহজতর। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই যে পূর্ণ বয়সের প্রাণিদিগকে যে কাজ দৈহিক প্রয়োজনের খাতিরেই করিতে হইবে সকল প্রজাতির [species] শিশুরাই তাহা শৈশবে খেলাচ্ছলে করিয়া থাকে। কুকুর শাবকদের খেলা ঠিক বয়স্ক কুকুরের লড়াইয়ের মতোই, কেবল সত্য সত্যই দাঁত বসাইয়া কামড়ায় না এই যা পার্থক্য। বিড়ালছানাদের খেলা বিড়ালের ইঁদুর ধরিবার কস্রতের অনুরূপ। শিশুরা যাহা দেখে তাহা অনুকরণ করিতে ভালোবাসে, যেমন ইট, পাথর, কাঠের টুকরা প্রভৃতি দিয়া বাড়ি তৈয়ার করা কিংবা গর্ত খনন করা। যে কাজ তাহাদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় তাহারা সে কাজই করিতে বেশি পছন্দ করে। যে সব খেলায় শিশুদের মাংসপেশি নূতনভাবে সঞ্চালিত হইবার সুযোগ পায় তাহা তাহাদের নিকট বড়ই আনন্দদায়ক মনে হয়, যেমন–লাফানো মই বা খুঁটি বাহিয়া উপরে ওঠা, সরু তক্তার উপর দিয়া হাঁটা প্রভৃতি; তবে দেখিতে হইবে এ কাজ যেন খুব কঠিন না হয়। ইহা যদিও সাধারণভাবে শিশুর (খেলার আবেগের) ক্রীড়া আবেগের উপযোগিতা প্রমাণ করে, খেলার জন্য তাহার যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত কামনা থাকে, তাহার সম্পূর্ণ প্রকাশ শুধু ইহার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ইহার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।

কতক মনঃসমীক্ষক শিশুর খেলার ভিতর যৌন প্রতীকতা খুঁজিয়া বাহির করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ইহা যে সম্পূর্ণ অলীক সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নাই। শৈশবে শিশুর কার্যকলাপের মধ্যে প্রবৃত্তি-জাত যৌন আবেগ প্রধান নয়, বয়স্ক ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার বাসনা কিংবা আরও খাঁটিভাবে বলিলে বলা যায় যে, শক্তিলাভের বাসনাই তখন থাকে প্রবল। বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে তুলনায় শিশু তাহার দুর্বলতা বুঝিতে পারে; সে মনে মনে তাহাদের সমকক্ষ হওয়ার বাসনা পোষণ করে। আমার ছেলে যখন বুঝিয়াছিল যে সেও একদিন বয়স্কব্যক্তি হইবে এবং আমি নিজেও একদিন তাহার মতোই ছোট ছিলাম তখন সে অত্যন্ত সুখি হইয়াছিল। কৃতকার্য হওয়া যাইবে এই আশ্বাস মানুষের উদ্যম বৃদ্ধি করে। শিশুদের অনুকরণের অভ্যাস হইতেই দেখা যায় বয়স্ক ব্যক্তিরা যাহা করে শিশুরাও তাহা করিতে চায়; শিশুদের কাজে প্রেরণা জোগাইতে বড় ভাইবোনেরা খুব সাহায্য করে; তাহাদের উদ্দেশ্য কি তাহা শিশুরা সহজে বুঝিতে পারে এবং তাহাদের শক্তিও বয়স্ক লোকের দৈহিক শক্তির মতো বেশি নয় বলিয়া শিশুদের নাগালের সম্পূর্ণ বাহিরে নয়। বয়স্ক লোকের সঙ্গে তুলনায় শিশু নিজেকে যতখানি হীন মনে করে তাহার বড় ভাইবোনের সঙ্গে তুলনা করিয়া ততখানি ছোট মনে করে না। শিশুদের মধ্যে স্বভাবতই হীনতাবোধ খুব বেশি; তাহারা যদি স্বাস্থ্যবান হয় এবং উপযুক্তভাবে শিক্ষা পায় তবে এই হীনতাবোধ তাহাদিগকে চেষ্টায় প্রেরণা দেয়, তাহারা শক্তিমান হইয়া বয়স্কদের সমান হইতে চায় কিন্তু তাহাদিগকে যদি দমন করিয়া রাখা হয় তবে তাহাদের মানসিক অশান্তির কারণ হইয়া দাঁড়াইতে পারে।

খেলার ভিতর আমরা দুই প্রকারে শিশুর শক্তি অর্জনের বাসনার প্রকাশ (দুইটি স্বরূপ) দেখিতে পাই : প্রথম, কোনো কাজ শিখিবার চেষ্টায়; দ্বিতীয়, ভান বা কল্পনার আশ্রয় গ্রহণে। যৌনজীবনে ব্যর্থকাম হতাশ যুবক তাহার মনের কামনাগুলি পরিতৃপ্ত করিবার জন্য অনেক সময় জাগ্রত স্বপ্নের আশ্রয় নেয়; বাস্তব জীবনে যাহা পায় না, কল্পনায় তাহাই উপভোগ করিতে আনন্দ পায়। তেমনই স্বাভাবিক সুস্থ শিশু খেলার ভিতর দিয়া এমন ভান করিতে ভালোবাসে যাহাতে সে নিজের দৈহিক শক্তির পরিচয় দিতে পারে। সে দৈত্য, সিংহ কিংবা রেলগাড়ি হইতে চায়, সে এমন প্রাণী সাজিতে চায় বা এমন জিনিসের ভান করা পছন্দ করে যাহাতে অন্যের মনে ভয়ের সঞ্চার করিতে পারে। আমি পুত্রকে দানব নিধনকারী জ্যাকের গল্প বলিয়া তাহাকে জ্যাক সাজিতে বলিলাম কিন্তু সে দানব হওয়ার জন্যই ইচ্ছা প্রকাশ করিল।

সে যখন তাহার মায়ের নিকট ব্লু-বিয়ার্ডের গল্প শোনে তখন ব্লু-বিয়ার্ড হওয়ার জন্য সে পীড়াপীড়ি করিতে থাকে এবং বলে যে অবাধ্য হওয়ার জন্য তাহার স্ত্রীকে শাস্তি দেওয়া ঠিক কাজই হইয়াছে। বু-বিয়ার্ডের ভান করিয়া খেলার সময় সে মহিলাদের মাথা কাটিয়া ফেলে। ফ্রয়েডবাদী মনস্তাত্ত্বিকগণ হয়তো বলিবেন– স্ত্রীলোকদের উপর অত্যাচার করার বাসনা শিশুর মনে লুকাইয়া রহিয়াছে। কামজ প্রেমের বিকৃত অবস্থায় এই প্রকার ধর্ষকাম অর্থাৎ প্রীতির বিপরীত ভাব, নিষ্ঠুরতা দেখা দেয়। মহিলাদিগকে শাস্তি দেওয়ার বাসনা শিশুর ধর্ষকামের পরিচায়ক। কিন্তু সে শুধু মহিলাদিগের মাথা কাটিতেই আনন্দ পায় নাই, ছোট ছোট বালকদিগকে খাইয়া ফেলিয়াছিল যে দৈত্য সেই রূপ দৈত্য সাজিতে কিংবা ভারী ওজনের জিনিস টানিয়া লইয়া যাইতে পারে এমন ইঞ্জিন সাজিতেও অনুরূপ আনন্দ লাভ করিয়াছে। এইসব ভান-ক্রীড়ার মধ্যে শক্তিমান হওয়ার, দৈহিক ক্ষমতার পরিচয় দেওয়ার বাসনাই ছিল, যৌনবাসনার কোনো প্রকার প্রকাশ ছিল না। একদিন বেড়াইয়া ফিরিবার পথে গল্পচ্ছলে কৌতুক করিয়া ছেলেকে বলিয়াছিলাম, হয়তো বাড়ি গিয়া দেখিব যে ঢিডলিউইংক্স নামে এক অপরিচিত ভদ্রলোক আমাদের বাড়ি দখল করিয়া রহিয়াছেন; তিনি হয়তো আমাদগিকে বাড়িতে ঢুকিতেই দিবেন না। ইহার পর অনেক দিন পর্যন্ত আমার ছেলে বাড়িতে ঢুকিতেই দিবেন না। ইহার পর অনেক দিন পর্যন্ত আমার ছেলে বাড়িতে ঢুকিবার পথের দেওয়ালের উপর দাঁড়াইয়া মিঃ টিডইলিউইংক্স সাজিয়া আমাকে অন্য বাড়িতে যাইতে আদেশ করিত। এই খেলায় তাহার আনন্দের সীমা থাকিত না; এইভাবে যে সে শক্তির পরিচয় দেওয়ার ভান করিত তাহা স্পষ্টই বোঝা যায়।

যাহা হউক শক্তিমান হওয়ার বাসনাই যে শিশুর খেলার প্রেরণা জোগাইবার একমাত্র উৎস তাহা অনুমান করিলে বিষয়টি অযথাভাবে সহজ করিয়া দেখা হইবে। ইহার মূলে আরও অন্য কারণ আছে। শিশুরা ভয় পাওয়ার ভান করিতে আমোদ পায়; ইহার কারণ বোধহয় এই যে ইহা যে ভান সত্য নয় এই জ্ঞান তাহাদের নিরাপত্তার বোধ বৃদ্ধি করে। সময় সময় আমি কুমিরের ভান করিয়া ছেলেকে খাইতে আসি। সে এমন স্বাভাবিকভাবে চিৎকার করিয়া উঠে যে, সে সত্যই ভয় পাইয়াছে, মনে করিয়া আমি থামিয়া যাই, কিন্তু আমি থামা মাত্রই সে বলিয়া উঠে, বাবা আবার কুমির হও। নাটক অভিনয়েও এই ভান আনন্দ দেয়; ইহার জন্যই বয়স্ক ব্যক্তিরা উপন্যাস ও নাটক অভিনয় পছন্দ করেন। আমার মনে হয় এ সকলের মধ্যে কৌতূহলের বিশেষ স্থান আছে। ভালুক সাজিয়া শিশু ভালুক সম্বন্ধে কিছু কিছু শিখিল মনে করে, যেমন ভালুক কেমন করিয়া হাঁটে, কেমন শব্দ করে, কেমন পোষ মনে ও নাচে ইত্যাদি। আমি মনে করি যে শিশুর জীবনের প্রত্যেকটি প্রবল আবেগ তাহার খেলার ভিতর প্রতিফলিত হয়। ক্ষমতা বা শক্তি শিশুর বাসনার মধ্যে যেরূপ প্রাধান্য লাভ করে তাহার খেলার ভিতরেও সেই পরিমাণে তাহার প্রাধান্য প্রকাশ পায়। ক্ষমতার প্রতি যদি তাহার ঝোঁক বেশি থাকে তবে খেলায় সে এরূপ ভানই ভালোবাসিবে যাহাতে সে নিজেকে শক্তিশালী বলিয়া মনে করিতে পারে। এইভাবেই তাহার বাসনা কতকটা তৃপ্তি লাভ করে।

খেলার শিক্ষামূল্য কি, শিশুর শিক্ষাদান ব্যাপারে খেলা কতখানি সাহায্য করে সে বিষয় আলেচনা করিলে সকলেই স্বীকার করিবেন যে, যে-খেলার ভিতর দিয়া শিশু নূতন প্রবণতা ও কৌশল আয়ত্ত করে তাহা উপকারী ও প্রশংসনীয়। কিন্তু আধুনিককালের অনেকে ভান বা কল্পনা অবলম্বনে শিশু যে খেলা করে তাহার শিক্ষামূল্য সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেন। বয়স্ক যুবক যখন মনের রুদ্ধ কামনাগুলির তৃপ্তির জন্য জাগর স্বপ্নে অর্থাৎ রঙিন কল্পনাবিলাসে মগ্ন হয়, তখন ইহাকে একপ্রকার মানসিক রোগ বলিয়া অভিহিত করা যায়। মনের বাসনাকে কার্যে রূপান্তরিত করার পরিবর্তে জাগর স্বপ্নবিলাসী নিষ্ক্রিয় হইয়া বসিয়া থাকিয়া কল্পনায় বাসনার সার্থকতা আস্বাদ করিতে চায়। এই প্রকার অলস কল্পনাবিলাস কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। ইহার উপর সাধারণ মানুষের যে বিরূপ ভাব আছে তাহা কালক্রমে শিশুর কল্পনাবিলাসের উপরও গিয়া পড়িয়াছে। শিশুরা যেন তাহাদের খেলার সরঞ্জামগুলি রেলগাড়ি বা স্টিমার বা অন্য কোনো কিছু বলিয়া কল্পনা করিয়া লইবে, মন্তেসরি বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তাহা পছন্দ করেন না। তাঁহারা ইহাকে বলেন বিশৃঙ্খল কল্পনা। তাহাদের অভিমত সম্পূর্ণ সত্য, কেননা শিশুরা এভাবে প্রকৃতই কোনো খেলায় মগ্ন হইতেছে না। এমনকি শিশুদের নিজেদের নিকটও ইহা পূর্ণাঙ্গ খেলা বলিয়া মনে হয় না। মন্তেসরি সরঞ্জাম শিশুকে আনন্দ দেয়; এ সরঞ্জামের উদ্দেশ্য শিশুকে শিক্ষা দেওয়া; এখানে আনন্দ শিক্ষাদানের একটি উপায় মাত্র। কিন্তু প্রকৃত খেলায় আনন্দ লাভই প্রধান উদ্দেশ্য। কাজেই মন্তেসরি বিদ্যালয়ের শিক্ষা সরঞ্জাম লইয়া খেলা ও প্রকৃত খেলা সম্পূর্ণ একপ্রকার নয়। বিশৃঙখল কল্পনা সম্বন্ধে যে আপত্তির সঙ্গত কারণ আছে তাহাই যদি আসল খেলার বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হয় তবে ইহা একটু বাড়াবাড়ি হইবে। শিশুকে পরি, দৈৰ্ত, ডাইনি জাদুভরা কার্পেট প্রভৃতি অবাস্তব গল্প শুনাইতে যাহারা আপত্তি করেন তাহাদের সম্বন্ধে এ কথা বলা যায় যে শিশুকে সত্য ও বাস্তবের উপর গড়িয়া তুলিতে গিয়া তাঁহারা বাড়াবাড়ি করিতেছেন। এই ধরনের সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তির সহিত আমি একমত হইতে পারি না। এরূপ বলা হয় যে শিশুরা বাস্তব এবং বাস্তবের ভানের মধ্যে কোনো পার্থক্য করিতে পারে না কিন্তু ইহা বিশ্বাস করার কোনো কারণ আমি দেখি না। বাস্তব জগতে কখনও হ্যামলেট ছিল বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি না। কিন্তু যখন আমরা হ্যামলেট নাটকের অভিনয় দেখিতেছি তখন যদি কেহ সর্বদা বলিতে থাকে এ কাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক তখন আমরা বিরক্ত না হইয়া পারি না। সেইরূপ শিশু যখন কোনো কিছুর ভান করিয়া খেলার আনন্দ উপভোগ করিতে থাকে তখন ইহাকে কখনোই সত্য বলিয়া গ্রহণ করে না কিন্তু কেহ যদি তাহাকে সর্বদা স্মরণ করাইয়া দেয় যে ইহা নিছক মিথ্যা তবে সে অত্যন্ত বিরক্তি বোধ করে।

সত্য এবং কল্পনা উভয়ই প্রয়োজনীয় কিন্তু জাতির ইতিহাসে যেমন, ব্যক্তির জীবনেও তেমনই, কল্পনার স্ফুরণই হয় প্রথমে। যতদিন শিশুর স্বাস্থ্য সবল এবং স্বাভাবিক থাকে ততদিন সে বাস্তব সত্য অপেক্ষা খেলাতেই বেশি আনন্দ পায়। খেলার সময় সে যেন রাজা। বাস্তবিক সে নিজের কল্পনারাজ্যে জাগতিক রাজার অপেক্ষা বেশি ক্ষমতা প্রয়োগ করিয়া রাজত্ব করিয়া থাকে। বাস্তবে তাহাকে নির্দিষ্ট সময়ে শুইতে হয়, কত রকম আদেশ, হুকুম পালন করিতে হয়, উপদেশ অনুসারে কাজ করিতে হয়। কঠোর কল্পনাবিহীন বয়স্ক ব্যক্তিরা যখন শিশুর এই কল্পনাবিলাসে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে তখন সে অত্যন্ত রুষ্ট হয়। সে হয়তো একটি দেওয়াল তৈয়ারি করিয়াছে এবং কল্পনা করিয়াছে যে সেটি এত উঁচু যে সবচেয়ে বড় দৈত্যও তাহা ডিঙাইতে পারে না; আপনি যদি তাহা ডিঙাইয়া গিয়া হেলায় তাহার কল্পনা তুচ্ছ করিয়া দেন তবে সে আপনার উপর বিরক্ত হইবেই। বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে তুলনায় শিশুর হীনতা বোধ একান্তই স্বাভাবিক; ইহা মানসিক রোগের লক্ষণ নয়। তেমনি কল্পনায় এই হীনতা দূর করিয়া নিজের শক্তির পরিচয় দেওয়ার কামনা শিশুর পক্ষে একান্ত স্বাভাবিক। ইহা কোনোরূপ মনোবিকারের লক্ষণ নয়। খেলায় যে সময় ব্যয়িত হয় তাহা অন্য কোনো প্রকারে ইহার অপেক্ষা সার্থকতরভাবে নিয়োজিত হইতে পারে না, সব সময়ই যদি শিশুকে গুরুতর কাজকর্মে ব্যাপৃত রাখার ব্যবস্থা হয় তবে অচিরেই তাহার স্নায়ু বিকল হইয়া পড়িবে, সে হইবে অসুখি এবং অপদার্থ। যে বয়স্ক ব্যক্তি জাগর স্বপ্নে বিভোর হইয়া থাকে তাহাকে কাজে প্রবৃত্ত হইয়া মনের বদ্ধ ভাবগুলিকে বাস্তবে পরিণত করিতে উপদেশ দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু শিশুর পক্ষে এ উপদেশ নিরর্থক, কেননা ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দিবার দৈহিক ও বুদ্ধিগত সামর্থ্য ও কৌশল তাহার কাছে আশা করা যায় না। কল্পনা তাহার নিকট বাস্তবের স্থায়ী পরিবর্ত [Substitute] নয়; চিরদিন সে কল্পনা লইয়া সন্তুষ্ট থাকিতে প্রস্তুত নয়, উপযুক্ত সময় হইলে সে বরং তাহার কামনাকে বাস্তবে পরিণত করার আশাই মনে পোষণ করে।

সত্য ও কঠোর বাস্তবকে একত্রে মিশাইয়া তাল পাকাইয়া ফেলা একটা মারাত্মক ভুল। আমাদের জীবন কেবল বাস্তব ঘটনা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় না; জীবন গঠনে আশারও যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। সত্য বলিতে গিয়া যদি বাস্তব ঘটনা ছাড়া আর কিছু না বুঝায় তবে এরূপ সত্যনিষ্ঠা মানব মনের পক্ষে কারাগারস্বরূপ হইয়া দাঁড়ায়। কল্পনা যদি মনের বাসনাকে বাস্তবে রূপায়িত করার পরিবর্তে কেবল অলস স্বপ্নেই পর্যবসিত থাকে কেবল তখনই তাহা নিরুৎসাহ করা উচিত; কিন্তু কল্পনা যখন কাজের প্রেরণা জোগায় তখন ইহা মানুষের আদর্শগুলিতে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করিতেই সাহায্য করে। শৈশবে কল্পনাকে পিষিয়া মারিয়া ফেলিলে মানুষ বস্তুতান্ত্রিকতার দাসরূপে পরিণত হয়; মাটির পৃথিবীর বাস্তব দীনতা, হীনতা, তুচ্ছতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ থাকিয়া সে ভাবের স্বর্গলোক সৃষ্টি করিতে পারে না। আপনি হয়তো বলিবেন এ সবই উত্তম কিন্তু শিশু ভক্ষণকারী দৈত্যের সঙ্গে অথবা স্ত্রী হত্যাকারী ব্লু-বিয়ার্ডের সঙ্গে ইহার কি সম্বন্ধ? আপনার স্বর্গে কি এ সব থাকিবে? কল্পনা যাহাতে সত্যই কোনো ভালো কাজে লাগে সে জন্য কি ইহা বিশুদ্ধ ও উন্নত ধরনের করিতে হইবে না? আপনি তো একজন শান্তিবাদী কিন্তু আপনার নির্দোষ শিশু মানুষ হত্যার চিন্তায় আনন্দ পাইবে। ইহা কি আপনি সমর্থন করিবেন? মানুষ আদিম প্রবৃত্তিগত বর্বরতার স্তর পার হইয়া আসুক ইহাই কাম্য, কিন্তু নিষ্ঠুরতার চিন্তায় শিশু যে আনন্দলাভ করে তাহা আপনি কিভাবে সমর্থন করিবেন? পাঠক হয়তো এইরূপ চিন্তা করিতেছেন। এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ; কেন আমি এ বিষয়ে পৃথক অভিমত পোষণ করি তাহাই বিবৃত করিতে চেষ্টা করিব।

প্রবৃত্তিগুলি দমন করিয়া রাখিলেই শিক্ষাদান সম্পূর্ণ হইল না; এগুলির যথাযথ বৃদ্ধি এবং মঙ্গলজনক কাজে নিয়োগ করিতেই শিক্ষার সার্থকতা। মানব প্রবৃত্তিগুলি বড়ই অস্পষ্ট; ইহারা কোনো নির্দিষ্ট আকারে কোনো নির্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত হয় না, নানাভাবে ইহাদের তৃপ্তিসাধন করা যায়। বেশিরভাগ প্রবৃত্তিরই পরিতৃপ্তির জন্য কোনও প্রকার কৌশল আবশ্যক। ক্রিকেট এবং বেসবল একই প্রবৃত্তিকে তৃপ্ত করে কিন্তু বালক যে খেলাটি জানে সেইটিই খেলিবে। বালকের ক্রীড়াপ্রবৃত্তির তৃপ্তিসাধনের জন্য শুধু যে একই নির্দিষ্ট প্রকার খেলার কৌশল আয়ত্ত করিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। কাজেই চরিত্র গঠনের উদ্দেশ্যে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তাহার মূল সূত্র হইল মানুষকে এমন কৌশল আয়ত্ত করানো যাহাতে সে তাহার প্রবৃত্তিগুলিকে ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগাইতে পারে। শক্তিমান হওয়ার যে বাসনা তৃপ্ত করিবার জন্য শিল্প কল্পনায় অত্যাচারী, নিষ্ঠুর,–বিয়ার্ড সাজিয়া নিজের ক্ষমতার পরিচয় দেয়, পরবর্তীকালে সেই বাসনাই পরিতৃপ্তির জন্য অন্য পথ খোঁজে, শৈশবের সেই ক্ষমতাকামী কল্পনাপ্রবণ কামনা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, শিল্পসৃষ্টি, শিক্ষার ভিতর দিয়া উন্নত প্রকৃতির মানুষ সৃষ্টি প্রভৃতি অসংখ্য রকমের উৎকৃষ্ট কাজের মধ্যে সার্থকতা লাভ করে। কোনো লোক যদি কেমন করিয়া যুদ্ধ করিতে হয় কেবল তাহাই জানে তবে যুদ্ধই হইবে তাহার আনন্দের বিষয়। কিন্তু যদি অন্যান্য বিষয়েও তাহার নিপুণতা থাকে তবে আরও অনেক উপায়ে তাহার বাসনা চরিতার্থতা লাভ করিতে পারে। যদি তাহার শক্তিলাভের বাসনা শৈশবেই বিনাশ করিয়া ফেলা হয় তবে সে হইবে উদ্দেশ্যবিহীন এবং অলস। ভালো বা মন্দ কোনোপ্রকার কাজ করার ক্ষমতাই তাহার থাকিবে না। এই রকম নিরীহ, নিবীর্য নিষ্ক্রিয় ভালো মানুষ দ্বারা জগতের কোনো উপকারই হয় না; আমাদের শিশুদিগকে আমরা এইভাবে মেরুদণ্ডহীন প্রাণীতে পরিণত করিতে চাই না। বাল্যকালে শিশুরা বর্বরতার প্রতি আকৃষ্ট হয়, কল্পনায় তাহারা অত্যাচার ও নিষ্ঠুরতার অভিনয় করিতে ভালোবাসে, দৈহিক বিক্রমের প্রকাশ তাহাদের নিকট আনন্দদায়ক। শিশুর ক্রমবিকাশের পক্ষে এরূপ আচরণ তাহার জৈবিক প্রয়োজন বলিয়া গণ্য করা হয়। ক্রম বিবর্তনের ফলে আদিম হিংস্র বর্বর মানব বর্তমানে সভ্য মানবে রূপান্তরিত হইয়াছে। বয়স্ক সভ্য মানুষ তাহার আদিম পূর্বপুরুষের আচরণ অনুসরণ করে না, করিলে সভ্য সমাজ গড়িয়া উঠিতে পারিত না, পৃথিবী নবরূপী হিংস্র পশুর আবাসে পরিণত হইত। মানব-শিশু তাহার জীবনের প্রথম কয়েক বৎসর কল্পনা ও আচরণের ভিতর দিয়া আদিম মানুষের জীবনস্তর পার হইয়া আসে। এই সময় তাহারা থাকে ছোট, তাহাদের ক্ষতি করার সামর্থ্যও থাকে কম; কাজেই বর্বর আদি মানবের অভিনয় করিলেও তাহারা সমাজের কোনো অপকার করিতে পারে না। তাহাদের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য উন্নততর কোনো কৌশল আয়ত্ত করিতে পারিলে তাহারা বর্বরের স্তরে থাকিয়া যাইবে না। অতএব বাল্যে যেরূপ কল্পনায় তাহারা আনন্দ অনুভব করে পরবর্তীকালেও যে তাহারা সেই কল্পনাকেই বাস্তবে রূপ দিতে চাহিবে এমন আশঙ্কার কোনো কারণ নাই। বাল্যকালে ডিগবাজি খাইতে আমি খুব আনন্দবোধ করিতাম। এ কাজ যদিও খারাপ মনে হয় না তবু আমি আর এখন ডিগবাজি খাই না। সেইরূপ যে শিশু এখন ব্লু-বিয়ার্ড সাজিতে ভালোবাসে পরে রুচির পরিবর্তন ঘটিলে সে অন্য উপায়ে তাহার কামনা তৃপ্ত করিবে। বাল্যকালে শিশুর দেহ মনের উপযোগী উদ্দীপকের [Stimuli] সাহায্যে যদি তাহার কল্পনা সরস ও সজীব রাখা হয়, তবে সেই শিশু যখন বয়স্ক মানুষে পরিণত হইবে তখন তাহার কল্পনা বয়স্ক ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও নানা প্রবৃত্তিকে বাস্তবরূপ দিতে সাহায্য করিবে। শৈশবে শিশুর মনে নৈতিক ভাব বা আদর্শ প্রবেশ করাইবার চেষ্টা করা বৃথা; ইহাতে তাহাদের কোনো সাড়া পাওয়া যাইবে না; ওই বয়সে তাহাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এইরূপ নৈতিক উপদেশের কোনো প্রয়োজন নাই। এইরূপ করিলে শিশুর মনে আসিবে অবসাদ এবং ফল হইবে যে, যে-বয়সে শিশু এই ভাব গ্রহণে সক্ষম হইত তখনও সে উহা গ্রহণ করিতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাইবে না। অপ্রবেশ্য শিলায় জল জমিলে তাহা যেমন চুয়াইয়া নিচে নামে না শিশুর মনেও তেমনই নৈতিক ভাব গ্রহণের বিরুদ্ধে একটি শক্ত স্তর গঠিত হইবে। ভিন্ন ভিন্ন বয়সে শিশুর মনে গতি-প্রকৃতি কেমন থাকে তাহা প্রত্যেক পিতামাতা এবং শিক্ষকের জানা দরকার। এজন্যই শিশু মনস্তত্ত্ব শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বলিয়া গণ্য করা হয়।

শৈশবের খেলার সঙ্গে পরবর্তীকালের খেলার পার্থক্য এই যে, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খেলাও ক্রমে বেশি প্রতিযোগিতামূলক হইয়া উঠে। প্রথমে শিশু একা একা নির্জনে খেলিতে ভালোবাসে; বড় ভাইবোনের সঙ্গে মিলিয়া খেলিবার সামর্থ্য তখন তাহার থাকে না। কিন্তু সে যখন অন্যের সঙ্গে একত্রে খেলিলে আনন্দ পায় তখন একাকী খেলা আর তাহার নিকট পছন্দ হয় না। ইংরেজ অভিজাত সম্প্রদায় স্কুলের খেলাধুলার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করিয়াছে। যদিও খেলার কতকগুলি উপকারিতা আছে তবুও আমার মনে হয় ইংরেজরা ক্রীড়াকৌশলকে যেরূপ প্রাধান্য দিয়াছে তাহাতে যেন কিঞ্চিৎ আতিশয্য ঘটিয়াছে। খেলাধূলায় যদি চরম উৎকর্ষের দিকে ঝোঁক দেওয়া না হয় তবে ইহা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী সন্দেহ নাই। যদি খেলায় নিপুণতা প্রদর্শনীই উদ্দেশ্য হয় তবে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়গণ বাড়াবাড়ি করে এবং অপর সকলে দর্শকে পরিণত হয়। যাহারা ভালো খেলা জানে তাহারা আরও উৎকর্ষ লাভ করিবার জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করে, সাধারণ খেলোয়াড়গণ প্রতিযোগিতা হইতে দূরে সরিয়া শুধু অপরের ক্রীড়াকৌশল দেখে, তাহাদের নিজেদের স্বাস্থ্যচর্চা আশানুরূপ হয় না। খেলার একটি গুণ এই যে ইহা বালক-বালিকাদিগকে হইচই না করিয়া আঘাত সহ্য করিতে এবং প্রফুল্লচিত্তে কঠোর পরিশ্রম করিতে শিক্ষা দেয়। খেলার অন্যান্য উপকারিতা সম্বন্ধে যাহা বলা হয় তাহার বেশিরভাগই আমার কাছে কাল্পনিক বলিয়া মনে হয়। বলা হয় যে, খেলা সহযোগিতা শিক্ষা দেয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বালক-বালিকা উহা প্রতিযোগিতার আকারেই শিক্ষা করে। এই ধরনের প্রতিযোগিতা শিল্পে বা যথাযথ রূপ সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নয়, ইহার প্রয়োজন যুদ্ধে। বিজ্ঞানের কল্যাণে অর্থনীতিতে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রতিযোগিতার স্থান গ্রহণ করিতে সক্ষম হইয়াছে; বিজ্ঞানের কল্যাণেই প্রতিযোগিতা (যেমন যুদ্ধবিগ্রহ) পূর্বের অপেক্ষা অনেক বেশি মারাত্মক আকার ধারণ করিয়াছে। সে জন্য যে প্রতিযোগিতামূলক কার্যকলাপে মানুষে মানুষে সংঘাত বাঁধে, যাহাতে একদল মানুষ হয় জয়ী, অপর দল হয় পরাজিত তাহার পরিবর্তে এমন সহযোগিতামূলক কর্মপ্রচেষ্টায় উৎসাহ দেওয়া উচিত যাহাতে সেখানে বহিঃপ্রকৃতিকে শত্রু বলিয়া গণ্য করিয়া মানুষ তাহার উপর আধিপত্য লাভ করিতে পারে। মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা না করিয়া পরস্পরের সহযোগিতায় মানুষ প্রকতিকে জয় করিতে যত্নবান হউক ইহাই কাম্য। এই বিষয়ের উপর আর বেশি গুরুত্ব দিতে চাই না, কেননা প্রতিযোগিতার মনোভাব মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক এবং ইহা প্রকাশের কোনো পথও থাকা দরকার; আর খেলাধুলায় ও দেহচর্চায় দ্বন্দ্বের মতো নির্দোষ প্রতিযোগিতাও বিশেষ কিছু নাই। খেলা বন্ধ না করার পক্ষে ইহা যুক্তিপূর্ণ কারণ সন্দেহ নাই কিন্তু এই কারণে স্কুলের পাঠ্যতালিকায় ইহাকে প্রধান স্থান দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। বালকেরা খেলা পছন্দ করে, কাজেই তাহাদিগকে খেলিতে দেওয়া উচিত; জাপানিরা যাহাকে বলে বিপজ্জনক চিন্তা তাহা হইতে বালকদিগকে মুক্ত রাখিবার উদ্দেশ্যে বিপজ্জনক চিন্তার প্রতিষেধকরূপে কর্তৃপক্ষ দ্বারা খেলার প্রবর্তন ও প্রয়োগ সমর্থন করা চলে না।

পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে ভয়কে জয় করা এবং সাহস প্রদর্শনের উপযোগিতা আলোচনা করা হইয়াছে। মনে রাখিতে হইবে সাহস এবং নির্দয়তা [Brutality] এক জিনিস নয়। একজনের ইচ্ছা জোর করিয়া অন্যের উপর চাপাইয়া যে আনন্দ তাহাই নির্দয়তা; ব্যক্তিগত বিপদ উপেক্ষা করার মধ্যে দেখা যায় সাহস। সুযোগ পাওয়া গেলে আমি বালক-বালিকাদিগকে ঝড়ের মধ্যে সমুদ্রে ছোট জাহাজ চালানো, উচ্চস্থান হইতে জলে ঝাপানো, মোটর গাড়ি চালানো, এমনকি বিমান চালনা শিক্ষা দিতে চাই। আউন্ডলের [Sanderson of Oundle] স্যান্ডারসন যেমন করিয়াছিলেন আমিও তেমনি কিশোর-কিশোরীকে যন্ত্র তৈয়ার করিতে এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার বিপদের সম্মুখিন হইতে শিক্ষা দেওয়ার পক্ষপাতী। যতদূর সম্ভব খেলাধুলায় জড় প্রকৃতিকে আমি মানুষের প্রতিপক্ষরূপে বিচেনা করিতে চাই; জড় প্রকৃতির সহিত দ্বন্দ্বেও বালকের ক্ষমতালাভের বাসনা পরিতৃপ্ত হইবে, যেমন হয় অপর মানুষের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এই উপায়ে যে কৌশল অধিগত হয় তাহা ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার কৌশল অপেক্ষা বেশি প্রয়োজনীয় এবং যে চরিত্র গঠিত হয় তাহা সামাজিক নীতির সহিত বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। নৈতিক গুণগুলি ছাড়াও দেহচর্চার উপর অতিরিক্ত ঝোঁক দেওয়ার ফলে বুদ্ধিবৃত্তি ম্লান হইয়া পড়ে। মূর্খতা হেতু এবং কর্তৃপক্ষ বুদ্ধির বেশি মূল্য দেন না কিংবা ইহা বিকাশের উপর গুরুত্ব দেন না। এইজন্য গ্রেট ব্রিটেন শিল্পজগতে তাহার অধিকার হারাইতেছে, হয়তো সাম্রাজ্যও হারাইবে। এই সবই খেলাধুলার উপকারিতা এবং প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অতিরিক্ত গোঁড়া বিশ্বাসের ফল। ইহার আরও গভীরতর দিক আছে : বর্তমানের জটিল সমস্যাসঙ্কুল জগৎকে বুঝিতে হইলে জ্ঞান এবং চিন্তার বিশেষ প্রয়োজন। কিন্তু খেলাধুলার যোগ্যতাই কোনো যুবকের গুণপনার একমাত্র মাপকাঠি, এই বিশ্বাস যেখানে প্রবল সেখানে বুঝিতে হইবে যে বর্তমান জগতের মানুষের কোন কোন্ গুণ বেশি দরকারি তাহা আমরা উপলব্ধি করিতে পারি নাই। এই বিষয়টি পরে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হইবে।

স্কুলের খেলাধুলার আরও একটি দিকে আছে; সাধারণত এটি ভালো বলিয়াই বিবেচিত হয় কিন্তু আমার মতে ইহার ফল মোটের উপর ভালো নয়। খেলার ভিতর দিয়া সংঘ-প্রীতি বা দলের প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি করার কথাই এখানে বলিতেছি। কর্তৃপক্ষ এই সংঘ-প্রীতি পছন্দ করেন, কেননা ইহার সাহায্যে খারাপ উদ্দেশ্যকেও তথাকথিত ভালো কাজে লাগানো যায়। ছাত্রদের কাজে উৎসাহ দিতে হইলে অন্য এক দলকে প্রতিযোগিতায় পরাভূত করার বাসনা জাগাইয়া তুলিলেই কাজ সহজ হয়। ইহার অসুবিধা হইল এই যে, যাহাতে প্রতিযোগিতা নাই সেইরূপ কাজে উদ্যম আসে না। আমাদের সকল কাজেই প্রতিযোগিতার মনোভাব কতদূর প্রসারিত হইয়াছে তাহা চিন্তা করিলে বিস্মিত হইতে হয়। আপনি যদি আপনার নিজের জেলার শিক্ষা মঙ্গল সমিতির সেবাকার্য আরও ভালো করিতে চান আপনাকে উল্লেখ করিতে হইবে যে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে শিশু-মৃত্যুর হার অনেক কম। কোনো শিল্পোৎপাদনকারীকে যদি কোনো নূতন প্রকৃত পন্থা গ্রহণ করিতে বলেন তবে আপনাকে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ইহা দ্বারা কিরূপ সুবিধা হইবে তাহা দেখাইয়া দিতে হইবে। প্রতিযোগিতা ভিন্ন। কোনো নির্মাণ ক্ষমতার বা গঠন কৌশলের উন্নতির চেষ্টা হয় না; অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার চিন্তা বাদ দিয়া লোকে কেবল উন্নতির জন্যই চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয় না। আমাদের স্কুলের খেলাধুলার তুলনায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গেই ইহার বেশি সম্বন্ধ। কিন্তু বর্তমানে স্কুলের অনুষ্ঠিত খেলাধূলার মধ্যে প্রতিযাগিতার ভাব বিদ্যমান রহিয়াছে। যদি প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার মনোভাব প্রবর্তন করিতে হয় তবে স্কুলের খেলাধুলায় এর পরিবর্তন আবশ্যক হইবে। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করিতে হইলে আমাদের নির্ধারিত বিষয়বস্তু ছাড়া অন্য বিষয়ের অবতারণা করিতে হয়। আমরা এখানে ভালো রাষ্ট্র গঠনের বিষয় আলোচনা করিতেছি না, বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিতরেই ভালো নাগরিক সৃষ্টি করার উপায়ই এ পুস্তকের আলোচ্য বিষয়। নাগরিকের ব্যক্তিগত উন্নতি এবং সমাজের উন্নতি পাশাপাশি চলা উচিত কিন্তু শিক্ষা প্রসঙ্গে লেখকের নিকট ব্যক্তি ও তাহার যথোপযুক্ত বিকাশ সাধনই প্রধান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *